হাদীসের নামে জালিয়াতি - দ্বিতীয় অধ্যায় - মিথ্যা ও ওহীর নামে মিথ্যা

. মিথ্যা ওহীর নামে মিথ্যা

. . মিথ্যার সংজ্ঞা

প্রসিদ্ধ পরিজ্ঞাত বিষয় সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। মিথ্যার সংজ্ঞা কি? সত্যের বিপরীতই মিথ্যা। যা সত্য নয় তাই মিথ্যা। এমন কিছু বলা, যা প্রকৃত পক্ষে ঠিক নয় বা সত্য নয় তাই মিথ্যা

 . . . ইচ্ছাকৃত বনাম অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা

বিষয়টি সুস্পষ্ট। তবে ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার বিষয়ে মুসলিম আলিমদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে। মুতাযিলা সম্প্রদায়ের আলিমগণ মনে করতেন যে, ভুলবশত যদি কেউ কোনো কিছু বলেন যা প্রকৃত অবস্থার বিপরীত তবে তা শরীয়তের পরিভাষায় মিথ্যা বলে গণ্য হবে না। শুধুমাত্র জেনেশুনে মিথ্যা বললেই তা মিথ্যা বলে গণ্য হবে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আলিমগণ ধারণার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁদের মতে, না-জেনে বা ভুলে মিথ্যা বললেও তা শরীয়তের পরিভাষায় মিথ্যা বলে গণ্য হবে

ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-নাবাবী (৬৭৬ হি) বলেন: ‘‘হক্ক-পন্থী আলিমদের মত হলো, ইচ্ছাকৃতভাবে, অনিচ্ছায়, ভুলে বা অজ্ঞতার কারণে প্রকৃত অবস্থার বিপরীত কোনো কথা বলাই মিথ্যা।[1]

তিনি আরো বলেন: ‘‘আমাদের আহলুস সুন্নাহ-পন্থী আলিমগণের মতে মিথ্যা হলো প্রকৃত অবস্থার বিপরীত কোনো কথা বলা, তা ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা ভুলে হোক। মুতাযিলাগণের মতে শুধু ইচ্ছাকৃত মিথ্যাই মিথ্যা বলে গণ্য হবে।[2]

[1] নাবাবী, ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ (৬৭৬ হি) শারহু সাহীহি মুসলিম /৯৪
[2]
নাবাবী, শারহু সাহীহি মুসলিম /৬৯

 . . . হাদীসের আলোকে অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা

হাদীসের ব্যবহার থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, ইচ্ছাকৃতভাবে, অনিচ্ছাকৃতভাবে, অজ্ঞতার কারণে বা যে কোনো কারণে বাস্তবের বিপরীত যে কোনো কথা বলাই মিথ্যা বলে গণ্য। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেখুন :

. জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বলেন,

إِنَّ عَبْدًا لِحَاطِبٍ جَاءَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَشْكُو حَاطِبًا فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ لَيَدْخُلَنَّ حَاطِبٌ النَّارَ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم:্রكَذَبْتَ، لاَ يَدْخُلُهَا، فَإِنَّهُ شَهِدَ بَدْرًا وَالْحُدَيْبِيَةَগ্ধ.

হাতিবের (রা) একজন দাস তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে রাসূলুল্লাহ ()-এর কাছে এসে বলে: হে আল্লাহর রাসূল, নিশ্চয় হাতিব জাহান্নামে প্রবেশ করবেন। তখন রাসূলুল্লাহ () বলেন: তুমি মিথ্যা বলেছ। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না; কারণ সে বদর হুদাইবিয়ায় উপস্থিত ছিল[1]

এখানে রাসূলুল্লাহ () হাতিবের দাসের কথাকেমিথ্যাবলে গণ্য করেছেন। সে অতীতের কোনো বিষয়ে ইচ্ছাকৃত কোনো মিথ্যা বলেনি। মূলত সে ভবিষ্যতের বিষয়ে তার একটি ধারণা বলেছে। সে যা বিশ্বাস করেছে তাই বলেছে। তবে যেহেতু তার ভবিষ্যদ্বাণীটি বাস্তবের বিপরীত সেজন্য রাসূলুল্লাহ () তাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন। এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, অতীত বা ভবিষ্যতের যে কোনো সংবাদ যদি সত্য বা বাস্তবের বিপরীত হয় তাহলে তা মিথ্যা বলে গণ্য হবে, সংবাদদাতার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, অজ্ঞতা বা অন্য কোনো বিষয় এখানে ধর্তব্য নয়। তবে মিথ্যার পাপ বা অপরাধ ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত

. তাবিয়ী সালিম ইবনু আব্দুল্লাহ বলেন, আমার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনু উমারকে (রা) বলতে শুনেছি:

بَيْدَاؤُكُمْ هَذِهِ الَّتِى تَكْذِبُونَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فِيهَا مَا أَهَلَّ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلاَّ مِنْ عِنْدِ الْمَسْجِدِ يَعْنِى ذَا الْحُلَيْفَةِ

হলো তোমাদের বাইদা প্রান্তর, যে প্রান্তরের বিষয়ে তোমরা রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বল (তিনি স্থান থেকে হজ্জের ইহরাম শুরু করেছিলেন বলে তোমরা বল।) অথচ রাসূলুল্লাহ  যুল হুলাইফার মসজিদের কাছ থেকে হজ্জের ইহরাম করেছিলেন[2]

স্বভাবতই ইবনু উমার (রা) এসকল ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলার অভিযোগ করছেন না। রাসূলুল্লাহ  বিদায় হজ্জের সময় লক্ষাধিক সাহাবীকে সাথে নিয়ে হজ্জ আদায় করেন। তিনি মদীনা থেকে বের হয়েযুল হুলাইফাপ্রান্তরে রাত্রি যাপন করেন এবং পরদিন সকালে সেখান থেকে হজ্জের ইহরাম করেন। যুল হুলাইফা প্রান্তরের সংলগ্নবাইদাপ্রান্তর। যে সকল সাহাবী কিছু দূরে ছিলেন তাঁরা তাঁকে যুল হুলাইফা থেকে ইহরাম বলতে শুনেন নি, বরং বাইদা প্রান্তরে তাঁকে তালবিয়া পাঠ করতে শুনেন। তাঁরা মনে করেন যে, তিনি বাইদা থেকেই ইহরাম শুরু করেন। একারণে অনেকের মধ্যে প্রচারিত ছিল যে, রাসূলুল্লাহ  বাইদা প্রান্তর থেকে ইহরাম শুরু করেন। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার যেহেতু কাছেই ছিলেন, সেহেতু তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতেন

এভাবে আমরা দেখছি যে, বাইদা থেকে ইহরাম করার তথ্যটি ছিল সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভুল। যারা তথ্যটি প্রদান করেছেন তারা তাদের জ্ঞাতসারে সত্যই বলেছেন। কিন্তু তথ্যটি যেহেতু বাস্তবের বিপরীত এজন্য ইবনু উমার (রা) তাকেমিথ্যাবলে অভিহিত করেছেন

[1] মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২৬১ হি), আস-সহীহ /১৯৪২

[2]
মুসলিম, আস-সহীহ /৮৪৩

 . . . মিথ্যা বনামমাউদূ’ (মাউযূ)[1] বাতিল

হাদীসের পরিভাষায় ১ম শতকে সাহাবী-তাবিয়ীগণের পরিভাষায় রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে কথিত মিথ্যাকে حديث كذب বামিথ্যা হাদীসবলে অভিহিত করা হতো। আবু উমামাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেন:

مَنْ حَدَّثَ عَنِّيْ حَدِيْثاً كَذِباً مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدُهُ مِنَ النَّارِ

যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামেমিথ্যা হাদীসবলবে তাকে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে[2]

যে কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন নি তা তাঁর নামে বলা হলে সাহাবী তাবিয়িগণ বলতেন: هذا الحديث كذب হাদীসটি মিথ্যা, حديث كذبমিথ্যা হাদীস বা অনুরূপ শব্দ ব্যবহার করতেন। ধরনের মানুষদের সম্পর্কেমিথ্যাবাদী(كذّاب), ‘সে মিথ্যা বলে(يكذب) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন[3]

দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে হাদীসের নামে মিথ্যার প্রসারের সাথে সাথে সকল মিথ্যাবাদীদের চিহ্নিত করতে মুহাদ্দিসগণমিথ্যা’- সমার্থক আরেকটি শব্দ ব্যবহার করতে থাকেন। শব্দটি الوضع শব্দটির মূল অর্থ নামানো, ফেলে দেয়া, জন্ম দেয়া। বানোয়াটি অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়[4] ইংরেজিতে: To lay, lay off, lay on, lay down, put down, set up... give birth, produce ...humiliate, to be low, humble...[5]

পরবর্তী যুগে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় শব্দের ব্যবহারই ব্যাপকতা লাভ করে। তাঁদের পরিভাষায় হাদীসের নামে মিথ্যা বলাকেওয়াদউ(وضع) এবং এধরনের মিথ্যা হাদীসকেমাউদূ(موضوع) বলা হয়। ফার্সী-উর্দু প্রভাবিত বাংলা উচ্চারণে আমরা সাধারণত বলিমাউযূ

অনেক মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বা ভুল উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করেন নি। উভয় প্রকার মিথ্যা হাদীসকেই তাঁরা মাউদূ (موضوع) হাদীস বলে অভিহিত করেছেন[6] বাংলায় আমরা মাউদূ (মাউযূ) অর্থ বানোয়াট বা জাল বলতে পারি

মুহাদ্দিসগণ মাউযূ (মাউদূ) হাদীসের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন দুভাবে: অনেক মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেন: المختلق المصنوع’ ‘‘বানোয়াট জাল হাদীসকে মাউযূ হাদীস বলা হয়।’’ এখানে তাঁরা হাদীসের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন[7]

অন্যান্য মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেন: (ما تفرد بروايته كذاب) ‘‘যে হাদীস কোনো মিথ্যাবাদী রাবী একাই বর্ণনা করেছে তা মাউযূ হাদীস।[8] এখানে তাঁরা মাউযূ বা জাল হাদীসের সাধারণ পরিচয়ের দিকে লক্ষ্য করেছেন। মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার (Cross Examine) মাধ্যমে রাবীর সত্য-মিথ্যা যাচাই করতেন। নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি প্রমাণিত হয় যে, কোনো একটি হাদীস একজন মিথ্যাবাদী ব্যক্তি ছাড়া কেউ বর্ণনা করছেন না তবে তাঁরা হাদীসটিকে মিথ্যা বা মাউযূ বলে গণ্য করতেন

কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁরা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাকেবাতিল(باطل) ইচ্ছাকৃত মিথ্যাকেমাউযূবামাউদূ(موضوع) বলে অভিহিত করেছেন। নিরীক্ষা মাধ্যমে যদি প্রমাণিত হয় যে, বাক্যটি রাসূলুল্লাহবলেন নি, কিন্তু ভুল করে তাঁর নামে বলা হয়েছে, তাহলে তাঁরা সে হাদীসটিকেবাতিলবলে অভিহিত করেন। আর যদি প্রমাণিত হয় যে, বর্ণনাকারী ইচ্ছাপূর্বক বা জ্ঞাতসারে কথাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলেছে, তাহলে তাঁরা একেমাউযূনামে আখ্যায়িত করেন[9]

মিথ্যা হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ প্রথম পদ্ধতিরই অনুসরণ করেছেন। তাঁরা ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার মিথ্যাকেইমাউযূ(موضوع) বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য হলো, যে কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন নি বা যে কর্ম তিনি করেন নি, অথচ তাঁর নামে কথিত বা প্রচারিত হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে ওহীর নামে জালিয়াতি রোধ করা। বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাটি বলেছেন, না ভুলক্রমে তা বলেছেন সে বিষয় তাঁদের বিবেচ্য নয়। বিষয় বিবেচনার জন্য রিজাল জারহ ওয়াত্ তাদীল শাস্ত্রে পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে[10]

[1] মূল আরবী উচ্চারণে আমরা (মাউদূ) বলতেই অভ্যস্থ পক্ষান্তরে ফার্সী উর্দু প্রভাবিত বাংলা ব্যবহারে আমরা (মাউযূ) বলে থাকি বইয়ে উভয় উচ্চারণই ব্যবহার করা হয়েছে
[2]
তাবারানী, সুলাইমান ইবনু আহমাদ (৩৬০ হি), আল-মুজামুল কাবীর /১২২
[3]
ইবনু আবী হাতিম, আব্দুর রাহমান ইবনু মুহাম্মাদ (৩২৭ হি), আল-জারহু ওয়াত তাদীল /৩৪৯, ৩৫০, ৩৫১, /৪০৭, /২১২, /১৬, ৫২, ৩২৫; যাহাবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ (৭৪৮ হি) মীযানুল তিদাল /২৭১, ২৮৫, /৮০, ১০৯, ১২২, ২৪১, /, ৫০, ৩৭৫, ৪৬৭, ৪৭৫, /৩১, ৯১, ১৭৮, ১৯১, ৪২০, ৪২৮, ৪৩৭, /, ২৯, ৫২, ৫৪, ৮৮, ১২৮, ১৬৯, ২০৭, ২২০, /২৪, ৫৫, ১৩৮, ২৪৬, ২৪৯, ৫৩৪, ৫৪৫, ৫৬৬, /২১৯, ৩৪১, ৩৯৩, /১৬২, ১৮২, ১৯৬; ইবনু হাজার আসকালানী, আহমাদ ইবনু আলী (৮৫২ হি), ফাতহুল বারী, ১৩/১১৩; আল-মুনাবী, মুহাম্মাদ আব্দুর রাঊফ (১০৩১ হি), ফাইদুল কাদীর /৫৪০, /২১৯, /৩০০, /১৫, ২১৬, ২২১, ৩৫৩
[4]
ইবনু দুরাইদ, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (৩২১ হি), জামহারাতুল লুাগাহ /৯৫; জাওহারী, ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ (৩৯৩ হি), আস-সিহাহ /১২৯৯; ইবনু ফারিস, আহমাদ (৩৯৫ হি), মুজাম মাকাঈসুল লুগাহ /১১৭-১১৮; ইবনুল আসীর, মুহাম্মাদ ইবনুল মুবারাক (৬০৬ হি), আন-নিহাইয়াহ /১৯৭, ১৯৮; ইবনু মানযূর, মুহাম্মাদ ইবনু মাকরাম (৭১১ হি) লিসানুল আরাব /৩৯৬-৩৯৭; ফাল্লাতা, উমার ইবনু হাসান, আল-ওয়াদউ ফিল হাদীস /১০৮
[5] Hans Wehr, A Dictionary of Modern Written Arabic, p 1076.
[6]
হাকিম নাইসাপূরী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ (৪০৫ হি), মারিফাতু উলুমিল হাদীস, পৃ: ১১৯-১২১; ইবনুল জাওযী, আব্দুর রাহমান ইবনু আলী (৫৯৭ হি), আল-ইলালুল মুতানাহিয়্যাহ /১৭২-১৭৩; মুযযী, ইউসূফ ইবনুয যাকী (৭৪২ হি), তাহযীবুল কামাল ১৯/৪৮৩
[7]
ইরাকী, আত-তাকঈদ, পৃ: ১২৮; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী /২৭৪; ইবনু জামা, মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম (৭৩৩ হি), আল-মানহালুর রাবী, পৃ: ৫৩; মুহাম্মাদ সালিহ উসাইমীন, শারহুল বাইকূনিয়্যাহ, পৃ: ১৩৫
[8]
ইবনু হাজার আসকালানী, নুখবাতুল ফিকার, পৃ: ২৩০, আব্দুল হক্ক দেহলবী (১০৫২ হি), মুকাদ্দিমা ফী উসূলিল হাদীস, পৃ: ৬৩-৬৪
[9]
মুআল্লিমী, আব্দুর রাহমান ইবনু ইয়াহইয়া আল-ইয়ামানী (১৩৮৬ হি), মুকাদ্দিমাতুল ফাওয়াইদিল মাজমূ লিশ-শাওকানী, পৃ: ৫৭; ফাল্লাতা, আল-ওয়াদউ /১০৮
[10]
মুআল্লিমী, মুকাদ্দিমাতুল ফাওয়াইদ, পৃ: ৫৭

 

 . . মিথ্যার বিধান

ওহী বা হাদীসের নামে মিথ্যা বলার বিধান আলোচনার আগে আমরা সাধারণভাবে মিথ্যার বিধান আলোচনা করতে চাই। মিথ্যাকে ঘৃণা করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। এজন্য সকল মানব সমাজে মিথ্যাকে পাপ, অন্যায় ঘৃণিত মনে করা হয়। কুরআন কারীমে হাদীস শরীফে মিথ্যাকে অত্যন্ত কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতে মুমিনদিগক সর্বাবস্থায় সত্যপরায়ণ হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে মিথ্যাকে ঘৃণিত পাপ কঠিন শাস্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে

সার্বক্ষণিক সত্যবাদিতার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ- সুবহানাহু- বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ

হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও[1]

মিথ্যার ভয়ানক শাস্তির বিষয়ে আল্লাহ-সুবহানাহু- বলেছেন:

فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যা বলত[2]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:

فَأَعْقَبَهُمْ نِفَاقًا فِي قُلُوبِهِمْ إِلَى يَوْمِ يَلْقَوْنَهُ بِمَا أَخْلَفُوا اللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

পরিণামে তিনি (আল্লাহ) তাদের অন্তরে কপটতা স্থিত করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্যন্ত, কারণ তারা আল্লাহর কাছে যে অঙ্গীকার করেছিল তা ভঙ্গ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী[3]

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে:

إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ

আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারী মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না[4]

অগণিত হাদীসে মিথ্যাকে ভয়ঙ্কর পাপ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ (الصِّدْقُ بِرٌّ) وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ (لَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ) حَتَّى يُكْتَبَ (عِنْدَ اللهِ) صِدِّيقًا وَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ (الْكَذِبُ فُجُوْرٌ) وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ (لَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ) حَتَّى يُكْتَبَ (عِنْدَ اللَّهِ) كَذَّابًا

সত্য পুণ্য। সত্য পুণ্যের দিকে পরিচালিত করে এবং পুণ্য জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে। যে মানুষটি সদা সর্বদা সত্য বলতে সচেষ্ট থাকেন তিনি একপর্যায়ে আল্লাহর কাছেসিদ্দীকবা মহা-সত্যবাদী বলে লিপিবদ্ধ হন। আর মিথ্যা পাপ। মিথ্যা পাপের দিকে পরিচালিত করে। আর পাপ জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে। যে মানুষটি মিথ্যা বলে বা মিথ্যা বলতে সচেষ্ট থাকে সে এক পর্যায়ে মহা-মিথ্যাবাদী বলে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়[5]

হাদীসে মিথ্যা বলাকে মুনাফিকীর অন্যতম চিহ্ন বলে গণ্য করা হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে যে, মুমিন অনেক অন্যায় করতে পারে, কিন্তু মিথ্যা বলতে পারে না। সা ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহবলেন

يُطْبَعُ الْمُؤْمِنُ عَلَى كُلِّ خَلَّةٍ غَيْرَ الْخِيَانَةِ وَالْكَذِبِ

মুমিনের প্রকৃতিতে সব অভ্যাস থাকতে পারে, কিন্তু খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা মিথ্যা থাকতে পারে না[6]

[1] সূরা () তাওবা: ১১৯ আয়াত
[2]
সূরা () বাকারা: ১০ আয়াত
[3]
সূরা () তাওবা: ৭৭ আয়াত
[4]
সূরা (৪০) মুমিন: ২৮ আয়াত
[5]
বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (২৫৬ হি), আস-সহীহ /২২৬১, মুসলিম, আস-সহীহ /২০১২, ২০১৩
[6]
বাযযার, আবু বাকর আহমাদ ইবনু আমর (২৯২ হি), আল-মুসনাদ /৩৪১, হাইসামী, আলী ইবনু আবী বাকর (৮০৭ হি), মাজমাউয যাওয়াইদ /৯২

 

 . . ওহীর নামে মিথ্যা

মিথ্যা সর্বদা ঘৃণিত। তবে তা যদি ওহীর নামে হয় তাহলে তা আরো বেশি ঘৃণিত ক্ষতিকর। সাধারণভাবে মিথ্যা ব্যক্তিমানুষের বা মানব সমাজের জন্য জাগতিক ক্ষতি বয়ে আনে। আর ওহীর নামে মিথ্যা মানব সমাজের ইহলৌকিক পারলৌকিক স্থায়ী ধ্বংস ক্ষতি করে। মানুষ তখন ধর্মের নামে মানবীয় বুদ্ধি প্রসূত বিভিন্ন কর্মে লিপ্ত হয়ে জাগতিক পারলৌকিক ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত হয়

পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর দিকে তাকালে আমরা বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই। আমরা আগেই বলেছি যে, মানবীয় জ্ঞান প্রসূত কথাকে ওহীর নামে চালানোই ধর্মের বিকৃতি বিলুপ্তির কারণ। সাধারণভাবে সকল ধর্মের প্রাজ্ঞ পন্ডিতগণ ধর্মের কল্যাণেই সকল কথা ওহীর নামে চালিয়েছেন। তারা মনে করেছেন যে, তাদের সকল কথা, ব্যাখ্যা, মতামত ওহীর নামে চালালে মানুষের মধ্যেধার্মিকতা’, ‘ভক্তিইত্যাদি বাড়বে এবং আল্লাহ খুশি হবেন। আর এভাবে তারা তাদের ধর্মকে বিকৃত ধর্মাবলম্বীদেরকে বিভ্রান্ত করেছেন। কিন্তু তারা বুঝেন নি যে, মানুষ যদি মানবীয় প্রজ্ঞায় সকল বিষয় বুঝতে পারতো তাহলে ওহীর প্রয়োজন হতো না

এর অত্যন্ত পরিচিত উদাহরণ খৃস্টধর্ম। প্রচলিত বিকৃত বাইবেলের বিবরণ অনুযায়ীযীশুখৃস্টতাঁর অনুসারীদের একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে, ইহুদী ধর্মের ১০ মূলনির্দেশ পালন করতে, খাতনা করতে, তাওরাতের সকল বিধান পালন করতে, শূকরের গোশত ভক্ষণ থেকে বিরত থাকতে অনরূপ অন্যান্য কর্মের নির্দেশ প্রদান করেন। সাধু পল (পল) ‘খৃস্টধর্মের প্রচার মানুষের মধ্যে ভক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেপ্রচার করতে থাকেন যে, শুধুমাত্রযীশুখৃস্টকেবিশ্বাস ভক্তি করলেই চলবে, সকল কর্ম না করলেও চলবে। প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফের বিভিন্ন স্থানে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করেছেন যে, আমি প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের পছন্দ মত মিথ্যা বলি, যেন ঈশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এক স্থানে তিনি লিখেছেন: "For if the truth of God hath more abounded through my lie unto his glory; why yet am I also judged as a sinner? কিনতু আমার মিথ্যায় যদি ঈশ্বরের সত্য তাঁহার গৌরবার্থে উপচিয়া পড়ে, তবে আমিও বা এখন পাপী বলিয়া আর বিচারিত হইতেছি কেন?’’[1]

এভাবে তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করেন। ক্রমান্বয়ে পৌলীয় কর্মহীন ভক্তিধর্মই খৃস্টানদের মধ্যে প্রসার লাভ করে। ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানব সন্তান শিরক-কুফর পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু বিশ্বাসেই স্বর্গ, সেহেতু কোনোভাবেই ধর্মোপদেশ দিয়ে খৃস্টান সমাজগুলি থেকে মানবতা বিধ্বংসী পাপ, অনাচার অপরাধ কমানো যায় না

ওহীর নামে মিথ্যা সবচেয়ে কঠিন মিথ্যা হওয়ার কারণে কুরআন কারীমে হাদীস শরীফে ওহীর নামে বা আল্লাহ তাঁর রাসূলের () নামে মিথ্যা বলতে, সন্দেহ জনক কিছু বলতে বা আন্দাজে কিছু বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরে অবতীর্ণ উভয় প্রকারের ওহী যেন কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত থাকে সেজন্য সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে

[1] পবিত্র বাইবেল (কিতাবুল মোকাদ্দস): নতুন নিয়ম (ইঞ্জিল শরীফ) রোমান (রোমীয়) /

 . . মিথ্যা থেকে ওহী রক্ষার কুরআনী নির্দেশনা

ওহী নামে মিথ্যা প্রচারের দুটি পর্যায়: প্রথমত: নিজে ওহীর নামে মিথ্যা বলা দ্বিতীয়ত: অন্যের বলা মিথ্যা গ্রহণ প্রচার করা। উভয় পথ রুদ্ধ করার জন্য কুরআন কারীমে একদিকে আল্লাহর নামে মিথ্যা বা অনুমান নির্ভর কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। অপরদিকে কারো প্রচারিত কোনো তথ্য বিচার যাচাই ছাড়া গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে

 . . . আল্লাহর নামে মিথ্যা আন্দায কথার নিষেধাজ্ঞা

কুরআন বারবার আল্লাহর নামে মিথ্যা বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে। অনুরূপভাবে না-জেনে, আন্দাজে, ধারণা বা অনুমানের উপর নির্ভর করে আল্লাহর নামে কিছু বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ -এর নামে মিথ্যা বলার অর্থ আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা। কারণ রাসূলুল্লাহ  আল্লাহর পক্ষ থেকেই কথা বলেন। কুরআনের মত হাদীসও আল্লাহর ওহী কুরআন হাদীস, উভয় প্রকারের ওহীই একমাত্র রাসূলুল্লাহ -এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী পেয়েছে। কাজেই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে কোনো প্রকারের মিথ্যা, বানোয়াট, আন্দাজ বা অনুমান নির্ভর কথা বলার অর্থই আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা বা না-জেনে আল্লাহর নামে কিছু বলা। কুরআন কারীমে বিষয়ে বারংবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে[1] এখানে কয়েকটি বাণী উল্লেখ করছি

. কুরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে:

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا

‘‘আল্লাহর নামে বা আল্লাহর সম্পর্কে যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে?’[2]

. অন্যত্র বলা হয়েছে:

وَيْلَكُمْ لا تَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا فَيُسْحِتَكُمْ بِعَذَابٍ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَى

‘‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না। করলে, তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করবেন। যে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে সে ব্যর্থ হয়েছে।[3]

. কুরআন কারীমে বারংবার না-জেনে, আন্দাজে বা অনুমান নির্ভর করে আল্লাহ, আল্লাহর দীন, বিধান ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন একস্থানে বলা করা হয়েছে:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الأَرْضِ حَلالا طَيِّبًا وَلا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ إِنَّمَا يَأْمُرُكُمْ بِالسُّوءِ وَالْفَحْشَاءِ وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ

হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো কেবল তোমাদেরকে মন্দ অশ্লীল কার্যের এবং আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা যা জান না এমন সব বিষয় বলার নির্দেশ দেয়[4]

. অন্যত্র আল্লাহ-সুবহানাহু ওয়া তাআলা- বলেন:

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ

বল, ‘আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য গোপন অশ্লীলতা আর পাপ এবং অসংগত বিরোধিতা এবং কোনো কিছুকে আল্লাহর শরীক করা, যার কোনো সনদ তিনি প্রেরণ করেন নি, এবং আল্লাহর সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে সম্বন্ধে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই।[5]

এভাবে কুরআনে ওহীর জ্ঞানকে ভেজাল মিথ্যা থেকে রক্ষার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ, তাঁর প্রিয় রাসূল (ﷺ), তাঁর দীন, তাঁর বিধান ইত্যাদি কোনো বিষয়ে মিথ্যা, বানোয়াট, আন্দাজ বা অনুমান নির্ভর কথা বলা কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে

[1] সূরা () বাকারা: ৮০, ১৬৯; সূরা () আল-ইমরান: ৯৪; সূরা () নিসা: ১৫৭; সূরা () আনআম: ২১, ৯৩, ১১৬, ১৪৪, ১৪৮; সূরা () রাফ: ২৮, ৩৩, ৩৭, ৬২; সূরা (১০) ইউনূস: ১৭, ৩৬, ৬৮, ৬৯; সূরা (১১) হূদ: ১৮; সূরা (১৮) কাহফ: ১৫; সূরা (২৩) মুমিনূন: ৩৮; সূরা (২৯) আনকাবূত: ৬৮; সূরা (৪২) শূরা: ২৪; সূরা (৫৩) নাজম: ২৮, ৩২; সূরা (৬১) সাফ্ফ: আয়াত
[2]
সূরা () আনআম: ২১, ৯৩, ১৪৪; সূরা () রাফ: ৩৭; সূরা (১০) ইউনূস: ১৭; সূরা (১১) হূদ: ১৮; সূরা (১৮): কাহফ: ১৫; সূরা (২৯) আনকাবূত: ৬৮; সূরা (৬১) সাফ্ফ:
[3]
সূরা (২০) তাহা: ৬১ আয়াত
[4]
সূরা () বাকারাহ: ১৬৮-১৬৯ আয়াত
[5]
সূরা () রাফ: ৩৩ আয়াত

 

 . . . তথ্য গ্রহণের পূর্বে যাচাইয়ের নির্দেশ

নিজে আল্লাহ বা তাঁর রাসূল ()-এর নামে মিথ্যা বলা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি অন্যের কোনো অনির্ভরযোগ্য, মিথ্যা বা অনুমান নির্ভর বর্ণনা বা বক্তব্য গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ। যে কোনো সংবাদ বা বক্তব্য গ্রহণে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ

‘‘হে মুমিনগণ, যদি কোনো পাপী তোমাদের কাছে কোনো খবর আনে, তবে তোমরা তা পরীক্ষা করবে যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্থ না কর, এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।[1]

নির্দেশের আলোকে, কেউ কোনো সাক্ষ্য বা তথ্য প্রদান করলে তা গ্রহণের পূর্বে সে ব্যক্তির ব্যক্তিগত সততা তথ্য প্রদানে তার নির্ভুলতা যাচাই করা মুসলিমের জন্য ফরয। জাগতিক সকল বিষয়ের চেয়েও বেশি সতর্কতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন রাসূলুল্লাহ () বিষয়ক বার্তা বা বাণী গ্রহণের ক্ষেত্রে। কারণ জাগতিক বিষয়ে ভুল তথ্য বা সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করলে মানুষের সম্পদ, সম্ভ্রম বা জীবনের ক্ষতি হতে পারে। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস বা ওহীর জ্ঞানের বিষয়ে অসতর্কতার পরিণতি ঈমানের ক্ষতি আখিরাতের অনন্ত জীবনের ধ্বংস। এজন্য মুসলিম উম্মাহ সর্বদা সকল তথ্য, হাদীস বর্ণনা পরীক্ষা করে গ্রহণ করেছেন

[1] সূরা (৪৯) হুজুরাত: আয়াত

 

 . . মিথ্যা থেকে ওহী রক্ষায় হাদীসের নির্দেশনা

ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার বিকৃতি, ভুল বা মিথ্যা থেকে তাঁর বাণী বা হাদীসকে রক্ষা করার জন্য রাসূলুল্লাহ () তাঁর উম্মাতকে বিভিন্ন প্রকারের নির্দেশ দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:

. . . বিশুদ্ধরূপে হাদীস মুখস্থ প্রচারের নির্দেশনা

বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাদীস বা বাণী হুবহু বিশুদ্ধরূপে মুখস্থ করে তা প্রচার করতে নির্দেশ দিযেছেন। জুবাইর ইবনু মুতয়িম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

نَضَّرَ اللهُ عَبْداً (وَجْهَ عَبْدٍ) سَمِعَ مَقَالَتِيْ (مِنَّا حَدِيْثاً) فَوَعَاهَا (وَحَفِظَهَا) ثُمَّ أَدَّاهَا إِلَى مَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا

‘‘মহান আল্লাহ সমুজ্জ্বল করুন সে ব্যক্তির চেহারা, যে আমার কোনো কথা শুনল, অতঃপর তা পূর্ণরূপে আয়ত্ত্ব করল মুখস্থ করল এবং যে তা শুনে নি তার কাছে তা পৌঁছে দিল।’’ অর্থে আরো অনেক হাদীস অন্যান্য অনেক সাহাবী থেকে বর্ণিত সংকলিত হয়েছে[1]

[1] তিরমিযী, আস-সুনান /৩৩-৩৪; আবু দাউদ, আস-সুনান /৩২২; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান /৮৪-৮৬; ইবনু হিববান, আস-সহীহ /২৬৮, ২৭১, ৪৫৫; হাকিম নাইসাপূরী, আল-মুসতাদরাক /১৬২, ১৬৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /১৩৮-১৩৯

 

. . . রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যার নিষেধাজ্ঞা

অপরদিকে কোনো মানবীয় কথা যেন তাঁর নামে প্রচারিত হতে না পারে সে জন্য তিনি তাঁদেরকে তাঁর নামে মিথ্যা বা অতিরিক্ত কথা বলতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আলী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ  বলেছেন :

لا تَكْذِبُوا عَلَيَّ فَإِنَّهُ مَنْ كَذَبَ [يَكْذِبْ] عَلَيَّ فَلْيَلِجِ النَّارَ.

‘‘তোমরা আমার নামে মিথ্যা বলবে না; কারণ যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে।[1]

যুবাইর ইবনুল আউয়াম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন :

مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

‘‘যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা বলবে তার আবাসস্থল জাহান্নাম।[2]

সালামাহ ইবনুল আকওয়া (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ () বলেছেন :

مَنْ يَقُلْ عَلَىَّ مَا لَمْ أَقُلْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

‘‘আমি যা বলি নি তা যে আমার নামে বলবে তার আবাসস্থল জাহান্নাম।[3]

এভাবেই রাসূলুল্লাহউম্মাতকে তাঁর নামে মিথ্যা বলার বিষয়ে সতর্ক করেছেন এবং প্রায় ১০০ জন সাহাবী অর্থে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর কোনো হাদীস এত বেশি সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়নি[4]

[1] বুখারী, আস-সহীহ /৫২; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৯৯, মুসলিম, আস-সহীহ /
[2]
বুখারী, আস-সহীহ /৫২
[3]
বুখারী, আস-সহীহ /৫২
[4]
নাবাবী, শারহু সাহীহ মুসলিম /৬৮, ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত ২৮-৫৬

 

 . . . বেশি হাদীস -মুখস্থ হাদীস বলার নিষেধাজ্ঞা

বেশি হাদীস বলতে গেলে ভুলের সম্ভাবনা থাকে। এজন্য বিষয়ে সতর্ক করেছেন রাসূলুল্লাহ () বিশুদ্ধ মুখস্থ নির্ভুলতা সম্পর্কে পরিপূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কোনো হাদীস বর্ণনা করতে তিনি নিষেধ করেছেন। আবু কাতাদাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ  মিম্বারের উপরে দাঁড়িয়ে বলেন,

إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةَ الْحَدِيْثِ عَنِّيْ! فَمَنْ قَالَ عني فَلْيَقُلْ حَقًّا وَصِدْقًا (فلا يقل إلا حقا) وَمَنْ تَقَوَّلَ (قال) عَلَيَّ مَا لَمْ أقُلْ فَلْيَتَبَوَّأ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.

‘‘খবরদার! তোমরা আমার নামে বেশি হাদীস বলা থেকে বিরত থাকবে। যে আমার নামে কিছু বলবে, সে যেন সঠিক কথা বলে। যে আমার নামে এমন কথা বলবে যা আমি বলি নি তাকে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।[1]

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

اتَّقُوا الْحَدِيثَ عَنِّي إِلا مَا عَلِمْتُمْ.

‘‘তোমরা আমার থেকে হাদীস বর্ণনা পরিহার করবে, শুধুমাত্র যা তোমরা জান তা ছাড়া।[2]

আবু মূসা মালিক ইবনু উবাদাহ আল-গাফিকী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () আমাদেরকে সর্বশেষ ওসীয়ত নির্দেশ প্রদান করে বলেন:

عَلَيْكُمْ بِكِتَابِ اللهِ، وَسَتَرْجِعُوْنَ إِلَى قَوْمٍ يُحِبُّونَ الْحَدِيْثَ عَنِّيْ- أَوْ كَلِمَةً تُشْبِهُهَا- فَمَنْ حَفِظَ شَيْئاً فَلْيُحَدِّثْ بِهِ، وَمَنْ قَالَ عَلَيَّ مَا لَمْ أَقُلْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.

‘‘তোমরা আল্লাহর কিতাব সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে অনুসরণ করবে। আর অচিরেই তোমরা এমন সম্প্রদায়ের কাছে গমন করবে যারা আমার নামে হাদীস বলতে ভালবাসবে। যদি কারো কোনো কিছু মুখস্থ থাকে তাহলে সে তা বলতে পারে। আর যে ব্যক্তি আমার নামে এমন কিছু বলবে যা আমি বলি নি তাকে জাহান্নামে তার আবাসস্থল গ্রহণ করতে হবে।[3]

এভাবে বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে তাঁর হাদীস হুবহু নির্ভুলভাবে মুখস্থ রাখতে এরূপ মুখস্থ হাদীস প্রচার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে পরিপূর্ণ মুখস্থ না থাকলে বা সামান্য দ্বিধা থাকলে সে হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন। কারণ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, তিনি যা বলেন নি সে কথা তাঁর নামে বলা নিষিদ্ধ কঠিনতম পাপ। ভুলক্রমেও যাতে তাঁর হাদীসের মধ্যে হেরফের না হয় এজন্য তিনি পরিপূর্ণ মুখস্থ ছাড়া হাদীস বলতে নিষেধ করেছেন। আমরা দেখতে পাব যে, সাহাবীগণ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন

[1] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান /১৪; আলবানী, সহীহ সুনানি ইবনি মাজাহ /২৯; দারিমী, , আস-সুনান /৮২, হাকিম, আল মুসতাদরাক /১৯৪
[2]
তিরমিযী, আস-সুনান /১৮৩
[3]
আহমাদ ইবনু হাম্বাল (২৪১ হি), আল-মুসনাদ /৩৩৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /১৯৬; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /১৪৪

 

 . . . মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীদের থেকে সতর্কতা

নিজের পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বলা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি অন্যের বানোনো মিথ্যা গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ। মুসলিম উম্মাহর ভিতরে মিথ্যাবাদী হাদীস বর্ণনাকারীর উদ্ভব হবে বলে তিনি উম্মাতকে সতর্ক করেছেন। আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহবলেন:

سَيَكُونُ فِيْ آخِرِ الزَّمَانِ أُنَاسٌ مِنْ أُمَّتِيْ يُحَدِّثُونَكُمْ بِمَا لَمْ تَسْمَعُوا أَنْتُمْ وَلاَ آبَاؤُكُمْ فَإِيَّاكُمْ وَإِيَّاهُمْ.

‘‘শেষ যুগে আমার উম্মাতের কিছু মানুষ তোমাদেরকে এমন সব হাদীস বলবে যা তোমরা বা তোমাদের পিতা-পিতামহগণ কখনো শুনে নি। খবরদার! তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে, তাদের থেকে দুরে থাকবে।[1]

ওয়াসিলাহ ইবনুল আসকা’ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

لاَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتَّى يَطُوْفَ إِبْلِيْسُ فِيْ الأَسْوَاقِ، يَقُوْلُ: حَدَّثَنِيْ فُلاَنُ بْنُ فُلاَنٍ بِكَذَا وَكَذَا.

‘‘কেয়ামতের পূর্বেই শয়তান বাজারে-সমাবেশে ঘুরে ঘুরে হাদীস বলবে: আমাকে অমুকের ছেলে অমুক এই এই বিষয়ে হাদীস বলেছে।[2]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন,

إِنَّ الشَّيْطَانَ لِيَتَمَثَّلُ فِي صُورَةِ الرَّجُلِ فَيَأْتِي الْقَوْمَ فَيُحَدِّثُهُمْ بِالْحَدِيثِ مِنَ الْكَذِبِ فَيَتَفَرَّقُونَ فَيَقُولُ الرَّجُلُ مِنْهُمْ سَمِعْتُ رَجُلا أَعْرِفُ وَجْهَهُ وَلا أَدْرِي مَا اسْمُهُ يُحَدِّثُ.

‘‘শয়তান মানুষের রূপ ধারণ করে মানুষদের মধ্যে আগমন করে এবং তাদেরকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করে। এরপর মিথ্যা হাদীসগুলো শুনে সমবেত মানুষ সমাবেশ ভেঙ্গে চলে যায়। অতঃপর তারা সে সকল মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করে বলে: আমি এক ব্যক্তিকে হাদীসটি বলতে শুনেছি যার চেহারা আমি চিনি তবে তার নাম জানি না।[3]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /১২
[2]
ইবনু আদী, আহমাদ, আল-কামিল ফী দুআফাইর রিজাল /১১৫
[3]
মুসলিম, আস-সহীহ /১২

 . . . সন্দেহযুক্ত বর্ণনা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাচাই না করে কোনো হাদীস গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। যদি কেউ যাচাই না করে যা শুনে তাই হাদীস বলে গ্রহণ করে বর্ণনা করে তাহলে হাদীস যাচাইয়ে তার অবহেলার জন্য সে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হবে। ইচ্ছাকৃত মিথ্যা হাদীস বানানোর জন্য নয়, শুধুমাত্র সত্যমিথ্যা যাচাই না করে হাদীস গ্রহণ করাই তার মিথ্যাবাদী বানানোর জন্য যথেষ্ট বলে হাদীসে বলা হয়েছে। উপরন্তু, যদি কোনো হাদীসের বিশুদ্ধতা নিভুলতা সম্পর্কে দ্বিধা বা সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি সে হাদীস বর্ণনা করে তাহলে সেও মিথ্যাবাদী বলে গণ্য হবে মিথ্যা হাদীস বলার পাপে পাপী হবে

আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ.

‘‘একজন মানুষের পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।[1]

সামুরাহ ইবনু জুনদুব (রা) মুগীরাহ ইবনু শুবা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

مَنْ حَدَّثَ عَنِّيْ حَدِيْثًا وَهُوَ يُرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الْكَاذِبَيْنِ.

‘‘যে ব্যক্তি আমার নামে কোনো হাদীস বলবে এবং তার মনে সন্দেহ হবে যে, হাদীসটি মিথ্যা, সেও একজন মিথ্যাবাদী।[2]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /১০
[2]
মুসলিম, আস-সহীহ /

 

 . . হাদীসের নামে মিথ্যা বলার বিধান

. . . হাদীসের নামে মিথ্যা কঠিনতম কবীরা গোনাহ

উপরে উল্লেখিত আয়াত হাদীসের আলোকে আমরা অতি সহজেই বুঝতে পারি যে, হাদীসের নামে মিথ্যা বলা বা মানুষের কথাকে হাদীস বলে চালানো জঘন্যতম পাপ। বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোনোরূপ সংশয় বা দ্বিধা নেই। আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাহাবীগণ অনিচ্ছাকৃত বা অসাবধানতামূলক ভুলের ভয়ে হাদীস বলা থেকে বিরত থাকতেন। অনিচ্ছাকৃত ভুলকেও তারা ভয়ানক পাপ মনে করে সতর্কতার সাথে পরিহার করতেন। এছাড়া অন্যের বানোনো মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করাকেও তাঁরা মিথ্যা হাদীস বানানোর মত অপরাধ বলে মনে করতেন

প্রসঙ্গে ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-নাবাবী (৬৭৬ হি) বলেন: সকল হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্য বলা কঠিনতম হারাম, ভয়ঙ্করতম কবীরা গোনাহ এবং তা জঘন্যতম ধ্বংসাত্মক অপরাধ। বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ একমত। তবে অধিকাংশ আলিমের মতে অপরাধের কারণে কাউকে কাফির বলা যাবে না। যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে কোনো মিথ্যা বলবে সে যদি তার মিথ্যা বলাকে হালাল মনে না করে তাহলে তাকে কাফির বলা যাবে না। সে পাপী মুসলিম। আর যদি সে কঠিনতম পাপকে হালাল মনে করে তাহলে সে কাফির বলে গণ্য হবে। আবু মুহাম্মাদ আল-জুআইনী অন্যান্য কতিপয় ইমাম অপরাধকে কুফুরী বলে গণ্য করেছেন। জুআইনী বলতেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা বলবে সে কাফির বলে গণ্য হবে এবং তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে হবে

সকল হাদীস থেকে আরো জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে যে কোনো মিথ্যাই সমভাবে হারাম, তা যে বিষয়েই হোক। শরীয়তের বিধিবিধান, ফযীলত, ওয়ায, নেককাজে উৎসাহ প্রদান, পাপের ভীতি বা অন্য যে কোনো বিষয়ে তাঁর নামে কোনো মিথ্যা বলা কঠিনতম হারাম ভয়ঙ্করতম কবীরা গোনাহ। বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্য রয়েছে। যাঁরা মতামত প্রকাশ করতে পারেন এবং যাঁদের মতামত গ্রহণ করা যায় তাঁদের সকলেই বিষয়ে একমত[1]

[1] নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম /৬৯

 . . . মাউযূ হাদীস উল্লেখ বা প্রচারও কঠিনতম হারাম

ইমাম নাবাবী আরো বলেন: জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বানোয়াট হাদীস বর্ণনা করাও হারাম, তা যে অর্থেই হোক না কেন। তবে মিথ্যা হাদীসকে মিথ্যা হিসাবে জানানোর জন্য তার বর্ণনা জায়েয[1]

অন্যত্র তিনি বলেন: যদি কেউ জানতে পারেন যে, হাদীসটি মাউযূ অর্থাৎ মিথ্যা বা জাল, অথবা তার মনে জোরালো ধারণা হয় যে, হাদীসটি জাল তাহলে তা বর্ণনা করা তার জন্য হারাম। যদি কেউ জানতে পারেন অথবা ধারণা করেন যে, হাদীসটি মিথ্যা এবং তারপরও তিনি সে হাদীসটি বর্ণনা করেন, কিন্তু হাদীসটির বানোয়াট হওয়ার বিষয় উল্লেখ না করেন, তবে তিনিও হাদীস বানোয়াটকারী বলে গণ্য হবেন এবং সকল হাদীসে উল্লিখিত ভয়ানক শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হবেন[2]

ইমাম যাইনুদ্দীন আব্দুর রাহীম ইবনুল হুসাইন আল-ইরাকী (৮০৬ হি) বলেন: মাউযূ বা জাল হাদীস যে বিষয়ে বা যে অর্থেই হোক্, তা বলা হারাম। আহকাম, গল্প-কাহিনী, ফযীলত, নেককর্মে উৎসাহ, পাপ থেকে ভীতি প্রদর্শন বা অন্য যে কোনো বিষয়েই হোক না কেন, যে ব্যক্তি তাকে মাউযূ বলে জানতে পারবে তার জন্য তা বর্ণনা করা, প্রচার করা, তার দ্বারা দলীল দেয়া বা তার দ্বারা ওয়ায করা জায়েয নয়। তবে হাদীসটি যে জাল বানোয়াট সেকথা উল্লেখ করে তা বলা যায়[3]

[1] নাবাবী, তাকরীব, তাদরীবুর রাবী সহ /২৭৪
[2]
নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম /৭১
[3]
ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ: ১২০-১২১

 . . . হাদীস বানোয়াটকারীর তাওবার বিধান

হাদীসের নামে মিথ্যা বলা অন্যান্য বিষয়ে মিথ্যা বলার মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য হলো, হাদীসের নামে মিথ্যাবাদীর তাওবা মুহাদ্দিসগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যদি কোনো ব্যক্তির বিষয়ে প্রমাণিত হয় যে, তিনি কোনো কথাকে মিথ্যাভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা বলে উল্লেখ করেছেন বা প্রচার করেছেন এবং এরপর তিনি তাওবা করেছেন, তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতেও পারেন, তবে মুহাদ্দিসগণের কাছে তিনি তাওবার কারণে গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবেন না। মুহাদ্দিসগণ আর কখনোই সে ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস সত্য নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করবেন না

পঞ্চম শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ফকীহ আহমাদ ইবনু সাবিত খতীব বাগদাদী (৪৬৩ হি) বলেন: যে ব্যক্তি মানুষের সাথে মিথ্যা বলে তার হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। তবে সে যদি তাওবা করে এবং তাঁর সততা প্রমাণিত হয় তাহলে তার হাদীস গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হতে পারে বলে ইমাম মালিক উল্লেখ করেছেন। আর যদি কেউ হাদীস জাল করে, হাদীসের মধ্যে কোনো মিথ্যা বলে বা যা শোনে নি তা শুনেছে বলে দাবী করে তাহলে তার বর্ণিত হাদীস কখনোই সত্য বা সঠিক বলে গণ্য করা যাবে না। আলিমগণ উল্লেখ করেছেন যে, সে যদি পরে তাওবা করে তাহলেও তার বর্ণিত কোনো হাদীস সত্য বলে গণ্য করা যাবে না। ইমাম আহমাদ (২৪১ হি)-কে প্রশ্ন করা হয়: একব্যক্তি একটিমাত্র হাদীসের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলেছিল, এরপর সে তাওবা করেছে এবং মিথ্যা বলা পরিত্যাগ করেছে, তার বিষয়ে কী করণীয়? তিনি বলেন: তার তাওবা তার আল্লাহর মাঝে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে কবুল করতে পারেন। তবে তার বর্ণিত কোনো হাদীস আর কখনোই সঠিক বলে গ্রহণ করা যাবে না বা কখনোই তার বর্ণনার উপর নির্ভর করা যাবে না। ইমাম সুফিয়ান সাওরী (১৬১ হি), আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক (১৮১ হি) অন্যান্য ইমামও অনুরূপ কথা বলেছেন

ইমাম বুখারীর অন্যতম উস্তাদ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর আল-হুমাইদী (২১৯ হি) বলেন, যদি কেউ হাদীস বর্ণনা করতে যেয়ে বলে: আমি অমুকের কাছে হাদীসটি শুনেছি, এরপর প্রমাণিত হয় যে, সে উক্ত ব্যক্তি থেকে হাদীসটি শোনেনি, বা অন্য কোনোভাবে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তার মিথ্যা ধরা পড়ে তবে তার বর্ণিত কোনো হাদীসই আর সঠিক বা নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা যাবে না খতীব বাগদাদী বলেন, ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ধরা পড়লে সেক্ষেত্রে বিধান[1]

শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলবী (১০৫২ হি) বলেন: যদি কোনো ব্যক্তির বিষয়ে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে জীবনে একবারও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলার কথা প্রমাণিত হয় তবে তার বর্ণিত কোনো হাদীস সঠিক বা নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য হবে না, যদিও সে তাওবা করে[2]

[1] খতীব বাগদাদী, আহমাদ ইবনু আলী ইবনু সাবিত (৪৬৩ হি), আল-কিফাইয়াতু ফী ইলমির রিওয়াইয়া, পৃ: ১১৭-১১৮
[2]
আব্দুল হক দেহলবী, মুকাদ্দিমাহ ফী উসূলিল হাদীস, পৃ: ৬৩-৬৪

 . . হাদীসের নামে মিথ্যা বলার উন্মেষ

আমরা জানি যে, সকল সমাজ, জাতি ধর্মে মিথ্যা মিথ্যাবাদী ঘৃণিত। সত্যবাদীতা সর্বদা সর্বত্র প্রশংসিত নন্দিত। এজন্যই আরবের জাহিলী সমাজেও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অতুলনীয় সত্যবাদিতা প্রশংসিত হয়েছে। তিনিআল-আমীনআস-সাদিক’: বিশ্বস্ত সত্যবাদী বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহতাঁর সহচর সাহাবীগণকে অনুপম অতুলনীয় সত্যবাদিতার উপর গড়ে তুলেছেন। তাঁদের সত্যবাদিতা ছিল আপোষহীন। কোনো কষ্ট বা বিপদের কারণেই তাঁরা সত্যকে বাদ দিয়ে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেন নি। উপরন্তু তিনি ওহীর নামে হাদীসের নামে মিথ্যা বলতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছেন এবং এর কঠিন শাস্তির কথা বারংবার বলেছেন

আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে ইচ্ছাকৃত কোনো মিথ্যা তো দূরের কথা, সামান্যতম অনিচ্ছাকৃত ভুল বা বিকৃতিকেও তাঁরা কঠিনতম পাপ বলে গণ্য করে তা পরিহার করতেন

এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্দশায় বা তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর সাহাবীগণের মধ্যে কখনোই কোনো অবস্থায় তাঁর নামে মিথ্যা বলার কোনো ঘটনা ঘটে নি। বরং আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ সাহাবী অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে কোনো হাদীসই বলতেন না

রাসূলুল্লাহ ()-এর জীবদ্দশায় মদীনার সমাজে কতিপয় মুনাফিক বাস করত। এদের মধ্যে মিথ্যা বলার প্রচলন ছিল। তবে এরা সংখ্যায় ছিল অতি সামান্য সমাজে এদের মিথ্যাবাদিতা জ্ঞাত ছিল। এজন্য তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করতেন না এবং তারাও কখনো রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বলার সাহস বা সুযোগ পাননি

একটি ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে যে, এক যুবক এক যুবতীর পাণিপ্রার্থী হয়। যুবতীর আত্মীয়গণ তার কাছে তাদের মেয়ে বিবাহ দিতে অসম্মত হয়। পরবর্তী সময়ে সে যুবক তাদের কাছে গমন করে বলে যে, রাসূলুল্লাহ () আমাকে তোমাদের বংশের যে কোনো মেয়ে বেছে নিয়ে বিবাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যুবকটি সেখানে অবস্থান করে। ইত্যবসরে তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ()-এর দরবারে এসে বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তিনি বলেন, যুবকটি মিথ্যা বলেছে। তোমরা তাকে জীবিত পেলে মৃত্যুদন্ড প্রদান করবে। ... তবে তাকে জীবিত পাবে বলে মনে হয় না। ... তারা ফিরে যেয়ে দেখেন যে, সাপের কামড়ে যুবকটির মৃত্যু হয়েছে।..[1]

বর্ণনাটি নির্ভরযোগ্য হলে থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্দশায় তাঁর নামে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলার একটি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু বর্ণনাটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল। কয়েকজন মিথ্যায় অভিযুক্ত অত্যন্ত দুর্বল রাবীর মাধ্যমে ঘটনাটি বর্ণিত[2]

সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পরে যতদিন মুসলিম সমাজে সাহাবীগণের আধিক্য ছিল ততদিন তাঁর নামে মিথ্যা বলার কোনো ঘটনা ঘটে নি

সময়ের আবর্তনে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সময়ে অনেক সাহাবী মৃত্যুবরণ করেন। অগণিত নও-মুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বলার প্রবণতার উন্মেষ ঘটে। ক্রমান্বয়ে তা প্রসার লাভ করতে থাকে

২৩ হিজরী সালে যুন্নুরাইন উসমান ইবনু আফফান (রা) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৩৫ হিজরী পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর তিনি খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। সময়ে ইসলামী বিজয়ের সাথে সাথে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইসলামের প্রসার ঘটে। অগণিত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মদীনা থেকে বহুদূরে মিশর, কাইরোয়ান, কুফা, বাসরা, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, খোরাসান ইত্যাদি এলাকায় বসবাস করতেন। সাহাবীগণের সাহচর্য থেকেও তারা বঞ্চিত ছিলেন

তাঁদের অনেকের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী বিশ্বাস, চরিত্র কর্মের পূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারে নি। এদের অজ্ঞতা, পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, ইসলাম ধর্ম বা আরবদের প্রতি আক্রোশ ইত্যাদির ফলে এদের মধ্যে বিভিন্ন মিথ্যা অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইসলামের অনেক শত্রু সামরিক ময়দানে ইসলামের পরাজয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে মিথ্যা অপপ্রচারের মাধ্যমে ইসলামের ধ্বংসের চেষ্টা করতে থাকে। আর সবচেয়ে কঠিন স্থায়ী মিথ্যা যে মিথ্যা ওহী বা হাদীসের নামে প্রচারিত হয়। ইসলামের শত্রুরা সে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে

এসময়ে সকল মানুষ রাসূলুল্লাহ ()-এর বংশধরদের মর্যাদা, ক্ষমতা, বিশেষত আলী (রা)-এর মর্যাদা, বিশেষ জ্ঞান, বিশেষ ক্ষমতা, অলৌকিকত্ব, তাকে ক্ষমতায় বসানোর প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে উসমান ইবনু আফফান (রা)-এর নিন্দায় অগণিত কথা বলতে থাকে। সব বিষয়ে অধিকাংশ কথা তারা বলতো যুক্তিতর্কের মাধ্যমে। আবার কিছু কথা তারা আকারে-ইঙ্গিতে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামেও বানিয়ে বলতে থাকে। যদিও রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে সরাসরি মিথ্যা বলার দুঃসাহস তখনো সকল পাপাত্মাদের মধ্যে গড়ে ওঠে নি। তখনো অগণিত সাহাবী জীবিত রয়েছেন। মিথ্যা ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। তবে মিথ্যার প্রবণতা গড়ে উঠতে থাকে

৩য়-৪র্থ হিজরী শতকের অন্যতম ফকীহ, মুহাদ্দিস ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী (৩১০ হি) ৩৫ হিজরীর ঘটনা আলোচনা কালে বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা ইয়ামানের ইহুদী ছিল। উসমান (রা) এর সময়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর বিভিন্ন শহরে জনপদে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক কথা প্রচার করতে থাকে। হিজাজ, বসরা, কূফা সিরিয়ায় তেমন সুবিধা করতে পারে না। তখন সে মিশরে গমন করে। সে প্রচার করতে থাকে: অবাক লাগে তার কথা ভাবতে যে ঈসা () পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন বলে বিশ্বাস করে, অথচ মুহাম্মাদ () পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন বলে বিশ্বাস করে না। ঈসার পুনরাগমনের কথা সে সত্য বলে মানে, আর মুহাম্মাদ ()-এর পুনরাগমনের কথা বললে তা মিথ্যা বলে মনে করে।.... হাজারো নবী চলে গিয়েছেন। প্রত্যেক নবী তাঁর উম্মতের একজনকে ওসীয়তের মাধ্যমে দায়িত্ব প্রদান করে গিয়েছেন। মুহাম্মাদ ﷺ-এর প্রদত্ত ওসীয়ত দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি আলী ইবনু আবী তালিব। ... মুহাম্মাদশেষ নবী এবং আলী শেষ ওসীয়ত প্রাপ্ত দায়িত্বশীল।... যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওসীয়ত দায়িত্ব প্রদানকে মেনে নিল না, বরং নিজেই ক্ষমতা নিয়ে নিল, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে। ...[3]

এখানে আমরা দেখছি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা নিজের বিভ্রান্তিগুলোকে যুক্তির আবরণে পেশ করার পাশাপাশি কিছু কথা পরোক্ষভাবে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বলছে। আলী রাসূলুল্লাহ () থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাকে দায়িত্ব প্রদান না করা যুলুম ইত্যাদি কথা সে বলছে

আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, সময়ে মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে সত্যপরায়ণতার ক্ষেত্রে ধরনের দুর্বলতা দেখা দেয়ায় সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের নামে মিথ্যা বলা প্রতিরোধের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেন

প্রথম হিজরী শতকের শেষ দিকে নিজ নিজ বিভ্রান্ত মত প্রমাণের জন্য রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বানোয়াট হাদীস তৈরি করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। সাহাবীগণের নামেও মিথ্যা বলার প্রবণতা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও বৃদ্ধি পেতে থাকে

মুখতার ইবনু আবু উবাইদ সাকাফী (-৬৭ হি) সাহাবীগণের সমসাময়িক একজন তাবিয়ী। ৬০ হিজরীতে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা) -এর শাহাদতের পরে তিনি ৬৪-৬৫ হিজরীতে মক্কার শাসক আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের (-৭৩ হি) পক্ষ থেকে কুফায় গমন করেন। কুফায় তিনি ইমাম হুসাইনের হত্যায় জড়িতদের ধরে হত্যা করতে থাকেন। এরপর তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের আনুগত্য অস্বীকার করে নিজেকে আলীর পুত্র মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যার প্রতিনিধি বলে দাবী করেন। এরপর তিনি নিজেকে ওহী-ইলহাম প্রাপ্ত, রাসূলুল্লাহ ()-এর বিশেষ প্রতিনিধি, খলীফা ইত্যাদি দাবী করতে থাকেন। অবশেষে ৬৭ হিজরীতে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের বাহিনীর কাছে তিনি পরাজিত নিহত হন

তার সকল দাবীদাওয়ার সত্যতা প্রমাণিত করার জন্য তিনি একাধিক ব্যক্তিকে তার পক্ষে মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলার জন্য আদেশ, অনুরোধ উৎসাহ প্রদান করেন। আবু আনাস হাররানী বলেন, মুখতার ইবনু আবু উবাইদ সাকাফী একজন হাদীস বর্ণনাকারীকে বলেন, আপনি আমার পক্ষে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে একটি হাদীস তৈরি করুন, যাতে থাকবে যে, আমি তাঁর পরে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে আগমন করব এবং তাঁর সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করব। এজন্য আমি আপনাকে দশহাজার দিরহাম, যানবাহন, ক্রীতদাস পোশাক-পরিচ্ছদ উপঢৌকন প্রদান করব। সে হাদীস বর্ণনাকারী বলেন: রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে কোনো হাদীস বানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোনো একজন সাহাবীর নামে কোনো কথা বানানো যেতে পারে। এজন্য আপনি আপনার উপঢৌকন ইচ্ছামত কম করে দিতে পারেন। মুখতার বলে: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে কিছু হলে তার গুরুত্ব বেশি হবে। সে ব্যক্তি বলেন: তার শাস্তিও বেশি কঠিন হবে[4]

মুখতার অনেককেই এভাবে অনুরোধ করে। প্রয়োজনে ভীতি প্রদর্শন বা হত্যাও করেছেন। সালামাহ ইবনু কাসীর বলেন, ইবনু রাবয়া খুযায়ী রাসূলুল্লাহ ()-এর যুগ পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি একবার কুফায় গমন করি। আমাকে মুখতার সাকাফীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমার সাথে একাকী বসে বলেন, জনাব, আপনি তো রাসূলুল্লাহ ()-এর যুগ পেয়েছেন। আপনি যদি রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে কোনো কথা বলেন তা মানুষেরা বিশ্বাস করবে। রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে একটি হাদীস বলে আমার শক্তি বৃদ্ধি করুন। ৭০০ স্বর্ণমুদ্রা আপনার জন্য। আমি বললাম: রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বলার নিশ্চিত পরিণতি জাহান্নাম। আমি তা বলতে পারব না[5]

সাহাবী আম্মার ইবনু ইয়াসারের (রা) পুত্র মুহাম্মাদ ইবনু আম্মারকেও মুখতার তার পক্ষে তাঁর পিতা আম্মারের সূত্রে মিথ্যা হাদীস বানিয়ে প্রচার করতে নির্দেশ দেয়। তিনি অস্বীকার করলে মুখতার তাকে হত্যা করে[6]

প্রথম হিজরী শতকের শেষ দিক থেকে প্রখ্যাত সাহাবীগণের নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা দেয়। বিশেষত আলী ইবনু আবী তালিব (রা)-এর নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা তাঁর কিছু অনুসারীর মধ্যে দেখা দেয়। তিনি আবু বাকর (রা) উমার (রা)-কে মনে মনে অপছন্দ করতেন বা নিন্দা করতেন, তিনি অলৌকিক সব কাজ করতেন, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের বানোয়াট কথা তারা বলতে শুরু করে

প্রখ্যাত তাবিয়ী ইবনু আবী মুলাইকা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (১১৭ হি) বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসের (৬৮ হি) নিকট পত্র লিখে অনুরোধ করি যে, তিনি যেন আমাকে কিছু নির্বাচিত প্রয়োজনীয় বিষয় লিখে দেন। তখন তিনি বলেন:

وَلَدٌ نَاصِحٌ أَنَا أَخْتَارُ لَهُ الأُمُورَ اخْتِيَارًا وَأُخْفِي عَنْهُ قَالَ فَدَعَا بِقَضَاءِ عَلِيٍّ فَجَعَلَ يَكْتُبُ مِنْهُ أَشْيَاءَ وَيَمُرُّ بِهِ الشَّيْءُ فَيَقُولُ وَاللَّهِ مَا قَضَى بِهَذَا عَلِيٌّ إِلا أَنْ يَكُونَ ضَلَّ

‘‘বিশ্বস্ত কল্যাণকামী যুবক। আমি তার জন্য কিছু বিষয় পছন্দ করে লিখব এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিব। তখন তিনি আলী (রা) এর বিচারের লিখিত পান্ডুলিপি চেয়ে নেন। তিনি তা থেকে কিছু বিষয় লিখেন। আর কিছু কিছু বিষয় পড়ে তিনি বলেন: আল্লাহর কসম, আলী বিচার কখনোই করতে পারেন না। বিভ্রান্ত না হলে কেউ বিচার করতে পারে না।[7]

অর্থাৎ আলীর কিছু অতি-উৎসাহী অতি-ভক্ত সহচর তাঁর নামে এমন কিছু মিথ্যা কথা এসব পান্ডুলিপির মধ্যে লিখেছে যা তাঁর মর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত করেছে, যদিও তারা তার মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই এগুলো বাড়িয়েছে

বিষয়ে অন্য তাবিয়ী তাঊস ইবনু কাইসান (১০৬ হি) বলেন:

أُتِيَ ابْنُ عَبَّاسٍ بِكِتَابٍ فِيهِ قَضَاءُ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فَمَحَاهُ إِلا قَدْرَ وَأَشَارَ سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ بِذِرَاعِهِ

‘‘ইবনু আববাস (রা) এর কাছে আলী (রা) এর বিচারের পান্ডুলিপি আনয়ন করা হয়। তিনি এক হাত পরিমাণ বাদে সে পান্ডুলিপির সব কিছু মুছে ফেলেন।[8]

প্রখ্যাত তাবিয়ী আবু ইসহাক আস-সাবীয়ী (১২৯ হি) বলেন, যখন আলী (রা)-এর সকল অতিভক্ত অনুসারী তাঁর ইন্তেকালের পরে সকল নতুন বানোয়াট কথার উদ্ভাবন ঘটালো তখন আলীর (রা) অনুসারীদের মধ্যে এক ব্যক্তি বলেন: আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন! কত বড় ইলম এরা নষ্ট করল![9]

তাবিয়ী মুগীরাহ ইবনু মিকসাম আদ-দাববী (১৩৬ হি) বলেন,

لَمْ يَكُنْ يَصْدُقُ عَلَى عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فِي الْحَدِيثِ عَنْهُ إِلا مِنْ أَصْحَابِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رضي الله عنه.

(আলীর (রা) নামে মিথ্যাচারের কারণে) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদের সাহচর্য লাভ করেছে এমন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ আলী (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করলে তা সঠিক নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা হতো না[10]

এভাবে আমরা দেখছি যে, প্রথম হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে ক্রমান্বয়ে মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থে উদ্দেশ্যে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা দেয়। যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে সব প্রবণতা বাড়তে থাকে। হিজরী দ্বিতীয় শতক থেকে ক্রমেই মিথ্যাবাদীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং মিথ্যার প্রকার পদ্ধতিও বাড়তে থাকে। আমরা পরবর্তী পরিচ্ছেদে জালিয়াতদের পরিচয় জালিয়াতির কারণ আলোচনা করব। তবে তার আগেই আমরা মিথ্যা প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহর কর্মপন্থা আলোচনা করতে চাই

[1] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /১৪৫; তাবারানী, সুলাইমান ইবনু আহমাদ (৩৬০ হি), আল-মুজামুল আউসাত /৩১৮; যাহাবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ (৭৪৮ হি.), মীযানুল তিদাল /৪০১-৪০২; ইবনু আদী, আবু আহমাদ আব্দুল্লাহ (৩৬৫ হি), আল-কামিল ফী দুআফাইর রিজাল /৫৩-৫৪; ফাল্লাতা, উমার ইবনু হাসান, আল-ওয়াদউ ফিল হাদীস /১৮৫-১৮৮
[2]
যাহাবী, মীযানুল তিদাল /৪০১-৪০২; ইবনু আদী, আল-কামিল /৫৪, ফাল্লাতা, আল-ওয়াদউ /১৮৫-১৮৮
[3]
তাবারী, মুহাম্মাদ ইবনু জারীর (৩১০ হি), তারীখুল উমামি ওয়াল মুলুক /৬৪৭
[4]
ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত /১৬-১৭
[5]
বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর /৪৩৮; আত-তারীখুস সাগীর /১৪৭
[6]
বুখারী, আত-তারীখুস সাগীর /১৪৭; ইবনু আবী হাতিম, আব্দুর রাহমান ইবনু মুহাম্মাদ (৩২৭ হি), আল-জারহু ওয়াত তাদীল /৪৩
[7]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৩
[8]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৩
[9]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৩
[10]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৩

No comments

Powered by Blogger.