কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম অধ্যায়-০৭ -খৃস্টান প্রচারকদের কয়েকটি অসত্যকথন

. . ঈসায়ী মুসলিম, ঈসায়ী তরীকা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মান্য করা

খৃস্টান প্রচারকগণ বলেন: আমরা মুসলিম, ঈসায়ী মুসলিম। আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ঈসা () সকলকে মান্য করি। আমরা কুরআনও মানি ইঞ্জিল বা কিতাবুল মোকাদ্দসও মানি। আমরা সকল নবীকেই ভক্তি করি। তবে আমরা তরীকাটা শুধু ঈসা মাসীহ থেকে গ্রহণ করি।

যারা বিকৃত কিতাবুল মোকাদ্দাসের বর্ণনামত সকল নবীকে পাপী, ব্যভিচারী, ধর্ষক, মদ্যপ বা খুনি বলে বিশ্বাস করেন, যারা কুরআন টয়লেটে ফেলেন, আগুনে পুড়ান, গণতান্ত্রিক দেশে কুরআন নিষিদ্ধ করার জন্য রাজনীতি করেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য মিথ্যা কার্টুন সিনেমা তৈরি করে প্রচার করেন, তাঁরাই বলেন যে, আমরা সকল নবীকে ভক্তি করি অথবা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মানি! তাঁরা মুসলিমদের বলেন, যারা কুরআন পোড়ায়, নবীকে নিয়ে সিনেমা বানায় আমরা সে খৃস্টান নই; আমরা ঈসায়ী মুসলিম! একজন মানুষ এত ভয়ঙ্কর মিথ্যাবাদী-প্রতারক হতে পারে! আপনি বলুন: ‘ সব খৃস্টান এবং আপনাদের মধ্যে পার্থক্য কী? আকীদার পাথক্য? কর্মের পার্থক্য? ধর্মগ্রন্থের পার্থক্য? ইংরেজিতে আপনাদের পরিচয় কি লিখেন: (Jesuit Muslim) না (Christian)?

দীর্ঘ গবেষণা করে তাঁরা দেখেছেন যে, বাংলাদেশের মুসলিম ধর্ম পরিবর্তন করেন না; তবে সহজেইতরীকাপরিবর্তন করেন। এজন্য প্রতারণামূলকভাবে তাঁরা খৃস্টধর্মকে ধর্ম না বলে তরীকা বলতে এবং ধর্মগ্রহণকেতরীকাবন্দীবলতে শুরু করেছেন। তাঁরা বলেন, মুসলিম এত প্রকারের তরীকা গ্রহণ করতে পারে, তাতে মুসলিমরা আপত্তি করে না, তাহলে ঈসায়ী তরীকা নিলে সমস্যা কী?

তাদের কথাগুলি যে মহামিথ্যা তা যে কোনো সচেতন মুসলিম জানেন। কিন্তু গ্রামগঞ্জের সরল মুসলিমগণ প্রতারিত হন। এজন্য নিম্নের বিষয়গুলি বুঝতে হবে:

() আমরা দেখলাম, ‘ঈসায়ীগণঈসা মাসীহের আকীদা বা আমল কিছুই মানেন না। আমরা দেখব যে, তাঁরা কিতাবুল মোকাদ্দসের একটি বিধানও মানেন না

() যিনি একাধিক নবী মানার দাবি করেন তিনি মিথ্যাবাদী অথবা পাগল এবং তার ধর্ম জারজ ধর্ম। সকল নবীকে সম্মান করতে হয়; কিন্তু দুজনকে একত্রে মান্য করা যায় না। একসাথে দুজন নবীর উম্মাত হওয়া সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। একাধিক নবী মানার দাবি করার অর্থ কাউকে না মানা। কারণ প্রত্যেক নবীরই কিছু না কিছু নিয়ম রয়েছে যা অন্য নবীর নিকট নেই বা অন্য নবীর কাছে তার বিপরীত কিছু শরীয়ত রয়েছে। কারণ প্রতি যুগের জন্য সে যুগের উপযোগী কিছু বিশেষত্ব সহকারে শরীয়ত দেওয়া হয়

() আমরা দেখেছি, ঈসা মাসীহ বলেছেন, আল্লাহ ছাড়া কাউকে পিতা এবং ঈসা ছাড়া কাউকে আচার্য মানা যাবে না। কাজেই যে ব্যক্তি বলেন, তিনি ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়কেই আচার্য মানেন তিনি মাসীহের কথা অবিশ্বাস করলেন

() লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ অর্থও একই: আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই এবং তাঁর ইবাদতের তরীকা একমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করতে হবে। মুসলিমরা আলেমদের কাছে গিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরীকা শিখেন

() আল্লাহ বলেন: “বল, ’তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ্ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ্ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (আল-ইমরান: ৩১) অর্থাৎ আল্লাহর ভালবাসা নাজাত পেতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরীকায় চলতে হবে। তাঁর তরীকার বাইরে অন্য কোনো নবীর তরীকায় নাজাত থাকতে পারে বলে মনে করাও কুফরী

() আল্লাহ বলেন: “কিন্তু না, আপনার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না, যতক্ষন পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের মধ্যকার সকল বিতর্ক-সমস্যার বিচার-সিদ্ধান্তের ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; তারপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং আন্তরিকভাবে তা মেনে নেয়।” (সূরা আন-নিসা ৬৫) কাজেই তাঁর নির্দেশ মানার পরেও যদি অন্য কোনো আচার্যের শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন, উচিত বা সম্ভব বলে বিশ্বাস থাকে তাহলেও সে মুসলিম বলে গণ্য হবে না

() একই সাথে দুজনকে মানার একমাত্র পথ পরবর্তীকে মানা। পূর্ববর্তী সকল প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা এমপিকে সম্মান করতে হয়, কিন্তু দুজনকে একত্রে মানা যায় না। কেবল সর্বশেষকেই মান্য করতে হয়। এজন্য দুজনকে মানতে চাইলে অবশ্যই ঈসা মাসীহের প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা সহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই মানতে হবে

() আপনি যদি যীশু-সহ সকল নবী-রাসূলকে ভালবাসতে চান তাহলে কিতাবুল মুকাদ্দাসকে পরিত্যাগ করতে হবে। কারণকিতাবুল মুকাদ্দাসনবীগণকে মহাপাপী বলে চিত্রিত করেছে এবং চোর-ডাকাত বলে ঘৃণা করতে শিক্ষা দেয়। কিতাবুল মুকাদ্দাসের ভাষায় ঈসা মাসীহ পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণকে চোর-ডাকাত এবং নিজেকে দরজা বলে আখ্যায়িত করে বলেন: “আমিই মেষদের দ্বার। যাহারা আমার পূর্বে আসিয়াছিল তাহার সকলে চোর দস্যু; কিন্তু মেষেরা তাহাদের রব শুনে নাই।” (যোহন ১০/-) একমাত্র কুরআনেই সকল নবীকে সম্মান করা হয়েছে এবং তাঁদের সঠিক পবিত্র জীবন তুলে ধরা হয়েছে। আর এজন্যই খৃস্টানগণ নবীদের নামে অশালীন সিনেমা কার্টুন প্রকাশ করেন; কখনোই মুসলিমগণ তা করেন না

 . . কুরআন মানি, হাদীস মানি না

ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন, আমরা কুরআন মানি, হাদীস মানি না। আমরা দেখলাম যে, আল্লাহর প্রেম মুক্তিলাভের জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরঅনুসরণ করতে হবে (আলে-ইমরান: ৩১), অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগি সকল বিষয়ে তাঁর পদ্ধতি মানতে হবে। কুরআনে মূল নির্দেশ থাকলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে এগুলো পালন করতেন তা হাদীসে বিদ্যমান। কাজেই হাদীস বাদ দিয়ে কেউ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুবহু অনুসরণ করার কুরআনী নির্দেশ মানতে পারে না। মানবতাকে নাজাতের পথ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্যই খৃস্টান প্রচারকগণ হাদীস না মানার কথা বলেন। আপনি তাঁকে বলুন:

() কুরআন মানলে আপনাকে নিম্নের বিষয়গুলি বিশ্বাস করতে হবে:

() প্রচলিত তাওরাত-ইঞ্জিলের মধ্যে অগণিত জালিয়াতি বিদ্যমান (বাকারা ৭৯, আল-ইমরান ৭৮, মায়িদা: ১৩, ১৪ ৪১)

() প্রচলিত খৃস্টধর্মের বিশ্বাসগুলি প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে নেই; বরং তা কতিপয় ধর্মগুরুর উদ্ভাবিত বিদআত শির্ক (মায়িদা: ৭৭)

() যারা ঈসাকে () মানুষরূপী আল্লাহ বা আল্লাহর সত্যিকার পুত্র বলে বিশ্বাস করেন এবং ত্রিত্বে বিশ্বাস করে তারা কাফির (মায়িদা ১৭, ৭২, ৭৩)

() ঈসা মাসীহ ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেন নি। (নিসা: ১৫৭)

() কেউ অন্যের পাপের জন্য দায়ী হয় না এবং কেউ অন্যের পাপ বহন করতে পারে না; বরং প্রত্যেকেই নিজের পাপের জন্য দায়ী (আনআম: ১৬৪, বনী ইসরাঈল: ১৫, ফাতির: ১৮, যুমার: , নাজম: ৩৮)

() ঈসা মাসীহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন (সাফ্ফ: )

() যে ব্যক্তি কুরআন মানার দাবি করে আবার বলে যে, হাদীস মানি না তিনি মূলতই কুরআন মানেন না। মহান আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শুধু কুরআন প্রদান করেন নি; বরং কিতাব এবং প্রজ্ঞা দুটি বিষয় তাঁর উপর নাযিল করেন (বাকারা ১২৯, ১৫১, ২৩১; আল-ইমরান ১৬৪, নিসা, ১১৩; আহযাব ৩৪; জুমুআহ আয়াত) কিতাব আক্ষরিকভাবে কুরআন হিসেবে সংকলিত। আর হিকমাহ বা প্রজ্ঞা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ভাষায় উম্মাতকে জানান, যা হাদীস হিসেবে সংকলিত। কাজেই যিনি কুরআন নির্দেশিত হিকমাহ বা হাদীস মানেন না তার কুরআন মানার দাবি অসত্য

() প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে আল্লাহর কালাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এতে ঈসা মাসীহের কিছু কথা, তাঁর কয়েকজন শিষ্য, শিষ্যের শিষ্য অন্যান্য মানুষদের কথাবার্তা সংকলিত। অর্থাৎইঞ্জিলনামক গ্রন্থটি যীশু, তাঁর কয়েকজন সাহাবী তাবিয়ীর হাদীসের সংকলন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস ঈসার () হাদীসের মধ্যে পার্থক্য হলো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি হাদীসের সনদ বিদ্যমান এবং হাদীসগুলি প্রথম থেকেই লেখা শুরু হয়ে পরবর্তী ২০০ বৎসরের মধ্যে গ্রন্থাকারে সংকলিত। পক্ষান্তরে ইঞ্জিল নামক মাসীহী হাদীস-এর কোনোরূপ কোনো সনদ নেই এবং ৩০০ বৎসরের পরে সংকলিত। অতএব, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈসা () উভয়কে মানার দাবি করেন, অথচ ঈসার () হাদীস মানেন কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস মানেন না- তার দাবিটি অবশ্যই মিথ্যা

() তাঁরা বলেন: “হাদীস যদি ওহী হয় তা হলে হাদীসের এত প্রকার কেন? তাতে জাল মওজু কেন?” আপনি বলুন: কিতাবুল মোকাদ্দাস যদি ওহী হয় তাহলে এত প্রকার কিতাবুল মুকাদ্দাস কেন? ক্যাথলিক কিতাবে বইয়ের সংখ্যা ৭৩; কিন্তু প্রটেস্ট্যান্ট কিতাবুল মোকাদ্দসে বইয়ের সংখ্যা ৬৬। উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান বইগুলির মধ্যেও আয়াত অধ্যায়ে অনেক বৈপরীত্য। জাল-মাওযু যাচাই করা যদি খারাপ হয় তাহলে খৃস্টানদের কিতাবুল মুকাদ্দাসের এত শতশত জাল (non-canonical/ Apocryphal) ইঞ্জিল কেন? ইন্টারনেটে গসপেল (ইঞ্জিল) এবং (Apocrypha) লিখে সার্চ দিলেই দেখবেন কিতাবুল মোকাদ্দসের জাল-মাউযূ কাকে বলে! ইংরেজি না জানলে বাংলা জুবিলী বাইবেল, কেরি বাইবেল, কিতাবুল মোকাদ্দাস ইঞ্জিল শরীফ মিলিয়ে দেখলেই বুঝবেন বৈপরীত্য কাকে বলে![() তাছাড়া ঈসা আলাইহিস সালামের হাদীসের শুদ্ধ অশুদ্ধতা যাচাইয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি খৃস্টানদের কাছে নেই। সেখানে সেগুলোর বর্ণনাকারীদের নেই কোনো গ্রহণযোগ্য জীবন-চরিত; যা দেখে গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী অগ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী নির্ধারণ করা যাবে, পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসসমূহের শুদ্ধাশুদ্ধ যাচাইয়ের রয়েছে সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি। সেগুলোর বর্ণনাকারীদের পূর্ণাঙ্গ জীবন-বৃত্তান্ত সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেগুলোর উপর ভিত্তি করে সত্যনিষ্ঠ বিজ্ঞ আলেমগণ খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকে অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা থেকে পৃথক করতে পারেন। বিষয়টিকে অনেক ইনসাফের অধিকারী প্রাচ্যবিদও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। সুতরাং হাদীস না মানার কোনো যৌক্তিক কারণ কেউ দেখাতে পারবে না। কারণ কোনো বিষয়ে জাল দুর্বল বর্ণনা থাকলেই সেখানকার বিশুদ্ধ বর্ণনাও নেওয়া যাবে না এমন কথা দুনিয়ার কোনো বিবেকবানও বলবে না। যদি এটা বলা হয় তবে দুনিয়ার কোনো কর্মকাণ্ডই সঠিকভাবে পরিচালিত হবে না। কারণ সকল কিছুরই পক্ষে-বিপক্ষে কথা আছে, তারপরও মানুষ বিশুদ্ধতাকে যাচাই করে দুনিয়ার বিধি-বিধান পরিচালনা করছে।[1]]

[1] দু ব্রাকেটের মাঝখানের অংশ সম্পাদক কর্তৃক সংযোজিত

No comments

Powered by Blogger.