রাহে বেলায়াত তৃতীয় অধ্যায় - অনুচ্ছেদ-৩, প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৩. ওযুর যিকর
অনুচ্ছেদ-৩, প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৩. ওযুর যিকর
যিকর নং
৩৮
: ওযুর
পূর্বের
যিকর
: (بسم الله)
উচ্চারণঃ বিসমিল্লা-হ।
অর্থঃ আল্লাহর নামে। অথবা, (بسم الله الرحمن الرحيم)
উচ্চারণঃ বিসমিল্লা-হির রা‘হমা-নির রা‘হীম।
অর্থঃ পরম করুণাময় দয়াবান আল্লাহর নামে।
ওযুর পূর্বে “বিসমিল্লা-হ” অথবা “বিসমিল্লা-হির রাহমা-নির রাহীম” বলা সুন্নাত। একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ
لا وضوء لمن لم يذكر اسم الله عليه
“ওযুর শুরুতে যে আল্লাহর নাম যিকর করল না তার ওযু হবে না।” হাদীসটি কয়েকটি দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। তবে ভিন্ন ভিন্ন যয়ীফ সনদে বর্ণিত হওয়ার ফলে তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।[1]
ওযুর আগে মুখে নিয়্যাত পাঠ খেলাফে সুন্নাত
এখানে উল্লেখ্য যে, ওযুর পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা ছাড়া অন্য কোনো মাসনূন যিকর নেই। আমাদের দেশে অনেকে ওযুর পূর্বে ‘নাওয়াইতু আন...’ ইত্যাদি শব্দে ওযুর নিয়্যাত বলেন বা পাঠ করেন। নিয়্যাত অর্থ উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা। যে কোনো ইবাদতের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন। এই নিয়্যাত মানুষের অন্তরের অভ্যন্তরীণ সংকল্প বা ইচ্ছা, যা মানুষকে উক্ত কর্মে উদ্বুদ্ধ বা অনুপ্রাণিত করেছে। নিয়্যাত, উদ্দেশ্য বা সংকল্প করতে হয়, বলতে বা পড়তে হয় না। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো জীবনে একটিবারের জন্যও ওযু, গোসল, সালাত, সিয়াম ইত্যাদি কোনো ইবাদতের জন্য কোনো প্রকার নিয়্যাত মুখে বলেননি। তাঁর সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ, ইমাম আবু হানীফা (রহ)-সহ চার ইমাম বা অন্য কোনো ইমাম ও ফকীহ কখনো কোনো ইবাদতের নিয়্যাত মুখে বলেননি বা বলতে কাউকে নির্দেশ দেননি।
পরবর্তী যুগের কোনো কোনো আলিম এগুলি বানিয়েছেন। তাঁরাও বলেছেন যে, মুখের উচ্চারণের কোনো মূল্য নেই, মনের মধ্যে উপস্থিত নিয়্যাত বা উদ্দেশ্যই মূল, তবে এগুলি মুখে উচ্চারণ করলে মনের নিয়্যাত একটু পোক্ত বা দৃঢ় হয়। এজন্য এগুলি বলা ভালো। তাঁদের এই ভালোকে অনেকেই স্বীকার করেননি। মুজাদ্দিদে আলফে সানী ওযু, সালাত, সিয়াম ইত্যাদি যে কোনো ইবাদতের জন্য মুখে নিয়্যাত করাকে খারাপ বিদ‘আত হিসাবে নিন্দা করেছেন এবং কঠোরভাবে এর বিরোধিতা করেছেন। কারণ এভাবে মুখে নিয়্যাত বলার মাধ্যমে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের আজীবনের সুন্নাত - ‘শুধুমাত্র মনে মনে নিয়্যাত করা’-কে পরিত্যাগ করছি। আমি “এহ্ইয়াউস সুনান” গ্রন্থে এ বিষয়ে বিসাত রিত আলোচনা করেছি।[2]
ওযুর মধ্যে কোনো সহীহ মাসনূন যিকর নেই
ওযুর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার পরে ওযু শেষ করার আগে কোনো প্রকারের মাসনূন যিকর নেই। আমাদের দেশে ধার্মিক মানুষদের মধ্যে ওযুর মধ্যে প্রত্যেক অঙ্গ ধোয়ার সময় কিছু কিছু দু‘আ পাঠের রেওয়ায আছে। এগুলি সবই বানোয়াট দু‘আ। ইমাম নাবাবী, মুল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে, ওযুর সময় বিভিন্ন অঙ্গ ধোয়া বা মাসেহ করার সময় যে সকল দু‘আ পাঠ করা হয় তা সবই ‘মাউযূ’ বা বানোয়াট মিথ্যা হাদীস। রাসূলুল্লাহ (সা.) বা সাহাবীগণ থেকে এ বিষয়ে সহীহ বা গ্রহণযোগ্য সনদে একটি দু‘আও বর্ণিত হয়নি।[3]
কোন কোন আলিম ও বুজুর্গ এ সকল দু‘আ গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি, মুমিন যে কোনো সময় দু‘আ ও যিকর করতে পারে। কোনো সময়ে বা স্থানে মাসনূন যিকর বা দু‘আ না থাকলে সেখানে আমরা আমাদের বানানো দু‘আ করতে পারি। এ সকল দু‘আ না- জায়েয হবে না।
কথাটি বাহ্যত ঠিক হলেও এর ভিন্ন একটি দিক রয়েছে। মুমিন সর্বাবস্থায় যিকর বা দু‘আ করতে পারেন। তিনি মাসনূন শব্দ ছাড়াও নিজের বানানো শব্দে দু‘আ ও যিকর করতে পারেন, যদি তার অর্থ শরীয়ত-সঙ্গত হয়। কিন্তু মুমিন কোনো মাসনূন ইবাদত বা যিকর পরিবর্তন করতে পারেন না। এ ছাড়া মাসনূন ব্যতীত অন্য কোনো যিকরকে রীতি হিসাবে গ্রহণ করাও অনুচিত। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিতঃ
প্রথমত, যে সকল ইবাদত রাসূলুল্লাহ (সা.) পালন করেছেন সে সকল ইবাদতের মধ্যে বানোয়াট যিকর প্রবেশ করানো রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর সুন্নাতকে অবজ্ঞা করার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। যেমন, সালাত, আযান, ওযু, গোসল, তায়াম্মুম, হাঁচি, ইত্যাদির মাসনূন পদ্ধতি ও যিকর নির্ধারিত রয়েছে। এগুলির মধ্যে কিছু বৃদ্ধি করার অর্থ রাসূলুল্লাহ (সা.) যতটুকু শিখিয়েছেন তাতে আমরা তৃপ্ত হতে পারলাম না। অথবা একথা মনে করা যে, তিনি যতটুকু শিখিয়েছে ততটুকু ভালো, তবে আরেকটু বেশি করলে তা আরো ভালো হবে। আমরা সকলেই বুঝতে পারি যে, এই চিন্তা খুবই অন্যায়।
তাহলে প্রশ্ন, হাদীসে যতটুকু বর্ণিত আছে তার বেশি কি আমরা দু‘আ করতে পারব না? এ প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ। মাসনূন ইবাদত, যিকর ও দু‘আর মধ্যে আমরা কোনো কম-বেশি করব না। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে অতিরিক্ত দু‘আ, যিকর ও ইবাদতের সময় ও সুযোগ শিক্ষা দিয়েছেন, সে সময়ে ও সুযোগে আমরা যত খুশি বেশি বেশি দু‘আ ও যিকর করতে পারব।
উদাহরণ হিসাবে সালাতের উল্লেখ করা যায়। সালাত মুমিনের জীবনের অন্যতম যিকর ও ইবাদত। মুমিন যত ইচ্ছা বেশি সালাত পড়তে পারেন এবং পড়া উচিত। তবে তিনি মাসনূন সালাতের মধ্যে বৃদ্ধি করতে পারেন না। তিনি যোহরের আগে বা পরে আসর পর্যন্ত যত ইচ্ছা নফল সালাত পড়তে পারেন। কিন্তু তিনি যোহরের আগের সুন্নাত সালাত বা পরের সুন্নাত সালাত ৬ রাকাত পড়তে পারেন না। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ আজীবন ওযু করেছেন, কিন্তু তাঁরা ওযুর সময় কোনো যিকর বা দু‘আ পাঠ করেছেন বলে কোনো নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়নি। এ সময়ে দু‘আ বা যিকরের কোনো ফযীলতও তাঁরা বলেননি। কাজেই, এই সময়ে বিশেষভাবে কোনো দু‘আ করা সুন্নাতের স্পষ্ট খেলাফ।
দ্বিতীয়ত, ওযুর সময়ে যিকর বা দু‘আ না-জায়েয বা মাকরূহ নয়। মুমিন এ সময়ে মনের আবেগ হলে তাসবীহ তাহলীল করতে পারেন বা কোনো বিষয় মনে পড়লে সে জন্য দু‘আ করতে পারেন। হাঁচি দিলে ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ বা কেউ হাঁচি দিলে উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলতে পারেন, কাউকে সালাম দিতে পারেন বা কেউ সালাম দিলে উত্তর দিতে পারেন। এরূপভাবে যিকর বা দু‘আ তিনি করলে তা না-জায়েয হবে না। কিন্তু এই সময়ের জন্য কোনো দু‘আ বা যিকর তিনি রীতি হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন না। কারণ তাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর রীতি পরিবর্তন করা হবে এবং তাঁর সুন্নাত আংশিকভাবে নষ্ট হবে।
তৃতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সুন্নাতেই নিরাপত্তা এবং সুন্নাতের বাইরে গেলেই ভয়। কাজেই, একান্ত বাধ্য না হয়ে সুন্নাতের বাইরে আমরা কেন যাব? বিভিন্ন যুক্তিতর্ক দিয়ে খেলাফে সুন্নাত কর্মকে জায়েয করার চেয়ে বিভিন্ন যুক্তিতর্ক দিয়ে নিজের মন ও প্রবৃত্তিকে সুন্নাতের মধ্যে আবদ্ধ রাখা উত্তম নয় কি? অগণিত সুন্নাত যিকর, দু‘আ ও ইবাদত আমরা করছি না, করতে চেষ্টা বা আগ্রহও করছি না। অথচ খেলাফে সুন্নাত কিছু কর্মের জন্য আমাদের আগ্রহ বেশি। এটা কি সুন্নাতের মহব্বতের পরিচায়ক? মহান আল্লাহ দয়া করে আমাদের প্রবৃত্তিকে সুন্নাতের অধীন করে দিন, আমীন।
ওযুর পরে পালনের জন্য একাধিক যিকর হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। এখানে তিনটি মাসনূন যিকর উল্লেখ করছি :
যিকর নং ৩৯ : ওযুর পরের যিকর-১
أَشْهَدُ أَنَّ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ الله
(وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ) وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
উচ্চারণঃ আশহাদু আল্ লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু [ওয়া‘হদাহু লা- শারীকা লাহু] ওয়া আশহাদু আন্না মু‘হাম্মাদান ‘আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।
অর্থঃ “আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই [তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই] এবং সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বান্দা (দাস) ও রাসূল (প্ররিত বার্তাবাহক)।”
উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যদি কেউ সুন্দরভাবে এবং পরিপূর্ণভাবে ওযু করে এরপর উক্ত যিকর পাঠ করে তাহলে জান্নাতের আটটি দরজাই তাঁর জন্য খুলে দেওয়া হবে, সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা করবে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।”[4]
যিকর নং ৪০ : ওযুর পরের যিকর-২
اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ
التَوَّابِينَ ، واجْعَلْني مِنَ المُتَطَهِّرِينَ
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মাজ্ ‘আলনী মিনাত তাওয়া-বীন ওয়াজ্ ‘আলনী মিনাল মুতাতাহ্ হিরীন।
অর্থঃ “হে আল্লাহ আপনি আমাকে তাওবাকারীগণের অন্তভর্ক্তু করুন এবং যারা গুরুত্ব ও পূর্ণতা সহকারে পবিত্রতা অর্জন করেন আমাকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করুন।”
দু’আটি ইমাম তিরমিযী বর্ণিত একটি হাদীসে উপরের (৩৯) নং যিকরের (শাহাদাতের) পরে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীসটির সনদ
সহীহ।[5]
যিকর নং ৪১ : ওযুর পরের যিকর-৩
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ،
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
উচ্চারণঃ সুব’হা-নাকা আল্লা-হুম্মা, ওয়া বি’হামদিকা, আশহাদু আল্ লা-ইলা-হা ইল্লা-আনতা, আস্তাগফিরুকা, ওয়া আতূবু ইলাইকা।
অর্থঃ “আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, হে আল্লাহ, এবং আপনার প্রশংসা জ্ঞাপন করছি। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার নিকট (তাওবা) করছি।”
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি কেউ ওযু করার পরে উপরিউক্ত দ’আটি বলে, তাহলে তা একটি পত্রে লিখে তার উপর সীলমোহর অঙ্কিত করে রেখে দেওয়া হবে। কিয়ামতের আগে সেই মোহর ভাঙ্গা হবে না। হাদীসটির সনদ সহীহ।[6]
[1] তিরমিযী ১/৩৭-৩৮, নং ২৫, আহমাদ ৩/৪১, যাইলায়ী, নাসবুর রাইয়াহ ১/৩-৬, ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ১/৭২, নাবাবী, আল-আযকার পৃ. ৫৫, আলবানী, সহীহুল জামি’ ২/১২৫৬, নং ৭৫৭০।
[2] এহ্ইয়াউস সুনান, পৃ. ১০৬।
[3] নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ৫৭, ইবনুল কাইয়েম, আল-মানারুল মুনীফ (আবদুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ), পৃ. ১২০, আলী কারী, আল- আসবারুল মারফূআ, পৃ. ৩৪৫।
[4] সহীহ মুসলিম ১/২০৯, নং ২৩৪।
[5] সুনানুত তিরমিযী ১/৭৮, নং ৫৫, সহীহু সুনানিত তিরমিযী ১/১৮, সহীহুত তারগীব ১/১৬৬।
[6] নাসাঈ, সুনানুল কুবরা ৬/২৫, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ২/১০০, সহীহুত তারগীব ১/১৬৬-১৬৭।
No comments