রাহে বেলায়াত তৃতীয় অধ্যায় - অনুচ্ছেদ-৬, প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৬. আযানের যিকর
অনুচ্ছেদ-৬,
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৬. আযানের যিকর
আযান দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ ফযীলতের ইবাদত। সকল মুসলিমের উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাওয়াব অর্জনের উদ্দেশ্যে সুযোগ পেলে সালাতের জন্য আযান দেওয়া। সর্বাবস্থায় আমরা অধিকাংশ মানুষই আযান দিতে পারি না, বরং শ্রবণ করি। আমরাও যেন আযানকে কেন্দ্র করে অগণিত পুরস্কার, রহমত ও বরকত অর্জন করতে পারি সে সুযোগ প্রদান করছেন মহান রাব্বুল আলামীন।
আযানের পূর্বে কোনো মাসনূন যিকর নেই
আমাদের দেশে অনেক স্থানে আযানের পূর্বে মুয়াযযিন নিজে বা শ্রোতাগণ দরুদ সালাম পাঠ করেন। কোথাও আযানের পূর্বে মুয়াযযিন আ‘ঊযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ বলেন। এগুলি সবই সুন্নাত বিরোধী কর্ম। এ সকল কর্মকে যারা পছনদ করেন তাঁদের যুক্তি: দরুদ সালাম পাঠ তো কখনো না-জায়েয নয়। আ‘ঊযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ বললে তো কোনো দোষ নেই। কাজেই, ভালো কাজে কেন বাধা দেওয়া হবে?
কথাটি শুনতে খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। কিন্তু এখানে সমস্যা জায়েয বা না-জায়েয নিয়ে নয়, সুন্নাত নিয়ে। অবিকল সুন্নাত অনুসারে বিলালের মতো আযান দিলে কি আমাদের কোনো অসুবিধা আছে? তাতে কি আমাদের সাওয়াব কম হবে?
এ সময়ে এসকল যিকর সুন্নাত-সম্মত নয়, বরং সুন্নাত বিরোধী। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে প্রায় ১০ বৎসর তাঁর মুয়াযযিনগণ এবং অন্যান্য অগণিত মুয়াযযিন মুসলিম জনপদগুলিতে আযান দিয়েছেন। তাঁর পরে সাহাবীগণের যুগে শতবৎসর ধরে অগণিত মুয়াযযিন আযান দিয়েছেন। তাঁরা কেউ কখনো একটিবারও আযানের আগে আ‘ঊযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ বা দরুদ পাঠ করে নেননি। এগুলির ফযীলত রাসূলুল্লাহ (সা.) জানতেন, তা সত্ত্বেও তিনি আযানের আগে এগুলি বলতে শিক্ষা দেননি। এজন্য এগুলি আযানের আগে না বলাই সুন্নাত। বললে সুন্নাত বর্জন করা হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতকে ছোট করা হবে। মনে করা হবে যে, তাঁর শেখানো ও আচরিত আযানের মধ্যে একটু কমতি রয়ে গেছে, তাই শুরুতে এই বিষয়গুলি যুক্ত করে তাকে পূর্ণতা দেওয়া হলো।
এসকল মাসনূন যিকর বা ইবাদতের সাথে কোনো রকম সংযুক্তির ভয়াবহ পরিণতি সুন্নাত উঠে যাওয়া। যদি কোনো এলাকায় কয়েক বছর যাবৎ আ‘ঊযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ বলে আযান দেওয়া হয়, অথবা দরুদ পাঠ করে আযান দেওয়া হয় তাহলে একসময় এগুলি আযানের অংশে পরিণত হবে। তখন যদি কেউ এগুলি বাদে অবিকল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগের মতো করে আযান প্রদান করেন, তাহলে তাকে (আযান দেওয়াকে) খারাপ মনে করা হবে এবং তার (মুয়াযযিনের) আযানকে অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হবে ও তার (মুয়াযযিনের) সমালোচনা করা হবে। যদি কেউ বলে - এগুলিতো আযানের অংশ নয়; তাহলে বলা হবে - আমরাও বলছি না যে, এগুলি আযানের অংশ, তবে এগুলি বলা ভালো, এগুলির ফযীলত আছে, কেন সে এগুলি বলবে না? ... ইত্যাদি। এভাবে একসময় আমাদের আযান ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আযান ভিন্ন রকমের হয়ে যাবে। সুন্নাত উঠে যাবে।
যিকর নং ৪২ : মুয়াযযিনের সাথে সাথে তার কথাগুলি বলা :
আমরা সাধারণত একে আযানের জবাব দেওয়া বলি। মুয়াযযিন আযানের মধ্যে যা যা বলবেন মুমিন শ্রোতাও তাই বলবেন। এ বিষয়ে হাদীসে কয়েকটি সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
إِذَا سَمِعْتُمْ الْمُؤَذِّنَ
فَقُولُوا مِثْلَ مَا يَقُولُ الْمُؤَذِّن
“যখন তোমরা মুয়াযযিনকে আযান দিতে শুনবে, তখন মুয়াযযিন যেরূপ বলে তদ্রূপ বলবে।”[1]
উপরের হাদীস ও পরবর্তী হাদীসটি থেকে বুঝা যায় যে, মুয়াযযিন যা বলবেন, আযান শ্রবণকারী অবিকল তাই বলবেন। কোনো ব্যতিক্রম বলতে বলা হয়নি। তবে উমার (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম শিক্ষা দিয়েছেন- মুয়াযযিন ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ ও ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ বললে, শ্রোতা ‘লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলবেন। এ হাদীসে তিনি আরো বলেনঃ
من قال ... من قلبه دخل الجنة
“এভাবে যে ব্যক্তি মুয়াযযিনের সাথে সাথে আযানের বাক্যগুলি অন্তর থেকে বলবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[2]
অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ছিলাম। তখন বিলাল (রাঃ) দাঁড়িয়ে আযান দিলেন। বিলাল আযান শেষ করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেনঃ
من قال مثل ما قال هذا يقينا دخل الجنة
“এই ব্যক্তি (মুয়াযযিন) যা বলল, তা যদি কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[3]
ফজরের আযানের জবাবে খেলাফে সুন্নাত ব্যতিক্রম
আমাদের দেশের একটি বহুল প্রচলিত রীতি, ফজরের আযানের সময় যখন মুয়াযযিন “আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাঊম” - বলেন, তখন শ্রোতা “সাদাকতা ও বারিরতা (বারারতা)” অর্থাৎ, “তুমি সত্য বলেছ এবং পুণ্য করেছ” বলেন। আযানের জবাবে উক্ত কথাটি খেলাফে সুন্নাত। ইবনু হাজার আসকালানী, মুল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেছেন যে, আযানের জবাবে এই বাক্যটি বানোয়াট, মাওযূ ও ভিত্তিহীন। কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে রাসূলুল্লাহ (সা.) বা কোনো সাহাবী থেকে এই দু‘আটি বর্ণিত হয়নি। মূলত শাফেয়ী মযহাবের কোনো কোনো ফকীহ নিজের মন থেকে এই বাক্যটিকে এই সময়ে বলার জন্য মনোনীত করেন। পরবর্তী যুগে তা অন্যান্য মাযহাবের অনেক আলিম গ্রহণ করেছেন।[4]
এ সকল আলিম এই বাক্যটিকে এই সময়ে বলা পছন্দনীয় বলে মনে করেছেন। কারণ, “আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাঊম” -বাক্যের অর্থের সাথে এই কথাটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রে কয়েকটি সমস্যা রয়েছে :
প্রথমত, এতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশের বিরোধিতা করা হচ্ছে। কারণ উপরের হাদীসগুলিতে আমরা দেখেছি যে, তিনি আমাদেরকে অবিকল মুয়াযযিনের অনুরূপ বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। একমাত্র “হাইয়া আলা ... “-এর সময় ছাড়া অন্য কোনো ব্যতিক্রম তিনি শিক্ষা দেননি। এ সকল হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ যে, এই একমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া হুবহু মুয়াযযিনের মতোই বলতে হবে। মুয়াযযিন যখন “আস- সালাতু খাইরুম মিনান নাঊম” বলবেন, তখন শ্রোতাও অবিকল তা-ই বলবেন। এর ব্যতিক্রম করলে উপরের হাদীসগুলি পূর্ণরূপে মান্য করা হবে না।
দ্বিতীয়ত, এতে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সুন্নাতে নববীর প্রতি অবজ্ঞা করা হচ্ছে। কারণ আযান দেওয়া ও আযানের জবাব দেওয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক আচরিত ও শেখানো একটি অত্যন্ত জরুরি ও প্রতিদিনে বহুবার পালন করার মতন ইবাদত। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে আযান ও আযানের উত্তর প্রদানের পদ্ধতি সাহাবীগণকে শিখিয়েছেন এবং তাঁরা তা পালন করেছেন। তিনি আযানের উত্তরে এই বাক্যটি বলেন নি বা শেখান নি। সাহাবীগণও বলেন নি। এখানে অর্থের সামঞ্জস্যতার কথাও তাঁরা অনুভব করেন নি। তাঁদের পরে আমরা কী-ভাবে একটি মাসনূন ইবাদতের মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করতে পারি? কী জন্যই-বা করব? অবিকল তাঁদের মতো আযানের জবাব দিলে কি আমাদের সাওয়াব কম হবে? না সেভাবে জবাব দিতে আমাদের কোনো কঠিন বাধা বা অসুবিধা আছে?
প্রিয় পাঠক, সুন্নাতের মধ্যে থাকা আমাদের নিরাপত্তা ও মুক্তির রক্ষাকবজ। সুন্নাতের বাইরে কোনো ইবাদত তৈরি করে আমরা কিভাবে বুঝব যে তা আল্লাহ কবুল করবেন? আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নাতের মধ্যে থাকার তৌফিক প্রদান করুন ; আমীন।[5]
যিকর নং ৪৩ : মুয়াযযিনের শাহাদতের সময় অতিরিক্ত যিকর
:
(وأنا اشهد) ان لا اله الا الله وحده لا شريك له وأن محمدا عبده
ورسوله رضيت بالله رباً وبالإسلام ديناً وبمحمد نبياً
উচ্চারণঃ [ওয়া আনা আশহাদু] আল লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়া‘হদাহু, লা- শারীকা লাহু, ওয়া আন্না মু‘হাম্মাদান ‘আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। রাদ্বীতু বিল্লা-হি রাব্বান, ওয়া বিল ইসলা-মি দীনান, ওয়া বিমু‘হাম্মাদিন নাবিয়্যান।
অর্থঃ “এবং আমিও সাক্ষ্য দিচিছ যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি তুষ্ট ও সন্তুষ্ট আছি আল্লাহকে প্রভু হিসাবে, ইসলামকে দ্বীন হিসাবে এবং মুহাম্মাদকে (সা.) নবী হিসাবে।”
সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি মুআযযিনকে শুনে উপরের বাক্যগুলি বলবে তার সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।”[6]
যিকর নং ৪৪ : আযানের পরে দরুদ পাঠ
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
إِذَا سَمِعْتُمْ الْمُؤَذِّنَ
فَقُولُوا مِثْلَ مَا يَقُولُ ، ثُمَّ صَلُّوا عَلَيَّ ، فَإِنَّهُ مَنْ صَلَّى
عَلَيَّ صَلاةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ بِهَا عَشْرًا ، ثُمَّ سَلُوا اللَّهَ لِي
الْوَسِيلَةَ ، فَإِنَّهَا مَنْزِلَةٌ فِي الْجَنَّةِ لا تَنْبَغِي إِلا لِعَبْدٍ
مِنْ عِبَادِ اللَّهِ ، وَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَنَا هُوَ ، فَمَنْ سَأَلَ لِي
الْوَسِيلَةَ حَلَّتْ لَهُ الشَّفَاعَةُ
“যখন তোমরা মুয়াযযিনকে আযান দিতে শুনবে, তখন সে যেরূপ বলে তদ্রূপ বলবে। এরপর আমার উপর সালাত পাঠ করবে ; কারণ যে ব্যক্তি আমার উপর একবার সালাত পাঠ করবে, আল্লাহ তাঁকে দশবার সালাত (রহমত) প্রদান করবেন। এরপর আমার জন্য ‘ওসীলা’ চাইবে ; কারণ ‘ওসীলা’ জান্নাতের সর্বোচচ স্থান, আল্লাহর একজন মাত্র বান্দাই এই মর্যাদা লাভ করবেন এবং আমি আশা করি আমিই হব সেই বান্দা। যে ব্যক্তি আমার জন্য ‘ওসীলা’ প্রার্থনা করবে, তাঁর জন্য শাফায়াত প্রাপ্য হয়ে যাবে।”[7]
যিকর নং ৪৫ : আযানের পরে ওসীলার দু‘আ চাওয়া
‘ওসীলা’ শব্দের অর্থ নৈকট্য। জান্নাতের সর্বোচচ স্তর যা আল্লাহর আরশের সবচেয়ে নিকটবর্তী তাকে ‘ওসীলা’ বলা হয়। এই স্থানটি আল্লাহর একজন বান্দার জন্যই নির্ধারিত, তিনি নবীয়ে মুসতাফা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। উপরের হাদীসে আমরা দেখেছি যে, তিনি আযানের পরে সালাত (দরুদ) পাঠের পরে তাঁর জন্য ওসীলা চেয়ে দু‘আ করতে উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সেজন্য মহান পুরস্কার - ‘শাফায়াত’ লাভের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। অন্যান্য হাদীসে ‘ওসীলা’ প্রার্থনার পদ্ধতি ও বাক্য তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন। দু‘আটি নিম্নরূপঃ
للَّهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ
التَّامَّةِ وَالصَّلاةِ الْقَائِمَةِ ، آتِ مُحَمَّدًا الْوَسِيلَةَ
وَالْفَضِيلَةَ ، وَابْعَثْهُ الْمَقَامَ الْمَحْمُودَ الَّذِي وَعَدْتَهُ
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, রাব্বা হা-যিহিদ দা‘অ্ওয়াতিত তা-ম্মাতি ওয়াস স্বালা-তিল কবা-য়িমাতি, আ-তি মু‘হাম্মাদান আল-ওয়াসীলাতা ওয়াল ফাদীলাতা, ওয়াব‘আসহু মাকা-মাম মা‘হমদুানিল্লাযী্ ও‘য়াদতাহু।
অর্থঃ “হে আল্লাহ, এই পরিপূর্ণ আহবান এবং আগত সালাতের মালিক, আপনি প্রদান করুন মুহাম্মাদকে (সা.) ওসীলা (নৈকট্য) এবং মহা মর্যাদা এবং তাঁকে উন্নীত করুন সম্মানিত অবস্থানে, যা আপনি তাঁকে ওয়াদা করেছেন।”
জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মুয়াযযিনের আযান শুনে যে ব্যক্তি উপরের বাক্যগুলি বলবে, তাঁর জন্য কিয়ামতের দিন আমার শাফা’আত পাওনা হয়ে যাবে।”[8]
ওসীলার দু‘আর দুটি অতিরিক্ত বাক্য
আযানের পরে ওসীলার দু‘আর উপরের বাক্যগুলি সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আমাদের দেশে প্রচলিত আযানের দু‘আর মধ্যে দুটি বাক্য অতিরিক্ত রয়েছে, যা উপরের দু‘আটিতে নেই। প্রথম বাক্যটিতে (والفضيلة) (ওয়াল ফাদীলাতা)-র পরে (والدرجة الرفيعة) (এবং সুঊচচ মর্যাদা) বলা হয়। দ্বিতীয় বাক্যটি দু‘আর শেষে: (إنك لا تخلف الميعاد) (নিশ্চয় আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না) বলা। এই দ্বিতীয় বাক্যটি একটি দুর্বল সনদে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।[9] আর প্রথম বাক্যটি (ওয়াদ-দারাজাতার রাফী’আহ) একেবারেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট ও মিথ্যা হাদীস নির্ভর।
ইবনু হাজার আসকালানী, সাখাবী, যারকানী, মুল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এই বাক্যটি (ওয়াদ-দারাজাতার রাফী’য়াহ) বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। মাসনূন দু‘আর মধ্যে এই ভিত্তিহীন বাক্যটি বৃদ্ধি করা সুন্নাত বিরোধী ও অন্যায়।[10]
মাইকে আযানের দু‘আ পাঠ
আযানের পরবর্তী মাসনূন ইবাদত, দরুদ পাঠ, ওসীলার দু‘আ পাঠ, নিজের জন্য দু‘আ চাওয়া। এগুলি সবই ব্যক্তিগতভাবে মনে মনে আদায় করা সুন্নাত। এগুলি জোরে জোরে বা সমবেতভাবে আদায় করা খেলাফে সুন্নাত। বর্তমানে আমাদের দেশে রেডিও ও টেলিভিশনের প্রভাবে বিভিন্ন মাসজিদে আযানের পরে মাইকে ওসীলার দু‘আ পাঠ করা হয়। এভাবে পাঠ করা সুন্নাত-বিরোধী। এভাবে দু‘আ পাঠের অর্থ মিনারে দাঁড়িয়ে আযান দিয়ে আযানের পরে ঠিক আযানের মতো চিৎকার করে দু‘আ পাঠ।
এভাবে দু‘আ পাঠের রীতি প্রচলনের ফলে আযানের পরে দরুদ পাঠের সুন্নাত ও আযানের পরে ওসীলার দু‘আ মনে মনে পাঠের সুন্নাতের মৃত্যু ঘটছে। সর্বোপরি একটি নতুন বিদ‘আত জন্মগ্রহণ করবে। কিছুদিন পরে দেখা যাবে, যদি কেউ অবিকল বিলালের মতো ও অন্যান্য সাহাবীগণের মতো শুধুমাত্র আযান জোরে দেন এবং পরের দু‘আ মনে মনে পাঠ করেন তখন মানুষে বলতে থাকবে, ‘আহা, দু‘আটা পড়ল না। একটু ঘাটতি থেকে গেল!’ - এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময়কার আযান তাদের নিকট ‘অসম্পূর্ণ আযান’ বলে প্রতিপন্ন হবে।
আযান শেষে নিজের জন্য প্রার্থনা করা
দু‘আ কবুলের সময় আলোচনাকালে আমরা এ বিষয়ে বিভিন্ন হাদীস উল্লেখ করছি। এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে আযান সংশিলষ্ট যিকর শেষ করে নিজেদের পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে শিক্ষা দিয়েছেন। এই সময়ের প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
[1] সহীহ বুখারী ১/২২১, নং ৫৮৬, সহীহ মুসলিম ১/২৮৮, নং ৩৮৩।
[2] সহীহ মুসলিম ১/২৮৯, নং ৩৮৫।
[3] হাদিসটি হাসান। সহীহ ইবনু হিব্বান ৪/৫৫৩, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩২১, মুসনাদ আহমাদ ২/৩৫২, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১/৫১০, ৬/১৪৬, সহীহুত তারগীব ১/১৭৭।
[4] নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম ৪/৮৮, আল-আযকার পৃ. ৬৬, ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ১/২১১।
[5] পাঠককে আবারো অনুরোধ করছি “এহইয়াউস সুনান” বইটি পাঠ করতে, সেখানে সুন্নাতের বাইরে ইবাদত বন্দেগী উদ্ভাবনের পরিণতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
[6] সহীহ মুসলিম ১/২৯০, নং ৩৮৬, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ১/২২০, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪/৫৯১।
[7] সহীহ মুসলিম ১/২৮৮, নং ৩৮৪।
[8] সহীহ বুখারী ১/২২২, নং ৫৮৯, ৪/১৭৪৯, নং ৪৪৪২।
[9] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ১/৪১০, (৬০৩-৬০৪)।
[10] ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ১/২১১, সাখাবী, আল-মাকসিদ, পৃ. ২২২-২২৩, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ. ১০৭, মুল্লা আলী কারী, আল-মাসনূ, পৃ. ৭০-৭১, আল-আসরারুল মারফু’আ, পৃ. ১২২, মুবারাকপুরী,
তুহফাতুল আহওয়াযী, পৃ. ১/৫৩২।
No comments