রাহে বেলায়াত প্রথম অধ্যায় অনুচ্ছেদ-১৪

. কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকরের পরিচয় - () জায়েয বনাম সুন্নাত

এভাবে আমরা ভাষাগত বা উন্মুক্ত যিকর্ মাসননূ যিকরের্ পাথর্ক্য বুঝাতে পারছি এখানে আরেকটি বিষয় আমাদের স্মরণ রাখা দরকার আমরা দেখেছি যে, শুধুমাত্র আল্লাহর মহান নামআল্লাহবা অন্য কোনো গুণবাচক নাম বা অন্য কোনো ভাষায় বা শব্দে তাঁর নাম জপ বা স্মরণ করলে হয়ত যিকরের নূন্যতম পর্যায় পলিত হতে পারে কিন্তু এই প্রকারের গাইর মাসনূন বা সুন্নাত বিরোধী যিকর, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) শেখাননি বা তিনি বা তাঁর সাহাবীগণ পালন করেননি সেসকল যিকরকে আমরা কখনো রীতি হিসাবে গ্রহণ করতে পারব না সুন্নাতের বাইরে কোনো কিছুকে নিয়মিত পালনের রীতি হিসাবে বা নিয়মিত ইবাদত হিসাবে গ্রহণ করলে তাবিদআতেপারিণত হবে এবং এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতকে অপছন্দ অবজ্ঞা করা হবে

উপরের উদাহরণগুলি চিন্তা করুন। কেউ যদি পশু জবাই করার সময় যিকর হিসাবে শুধুমাত্রআল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ ... “, “রহমান”, “দয়ালুইত্যাদি নাম বা গুণবাচক নাম বলে যিকর করে তাহলে হয়ত তার যিকরের দায়িত্ব সর্বনিম্ন পর্যায়ে পলিত হতে পারে, তবে তা খেলাফে সুন্নাত হবে। আর যদি তিনি মাসনূন যিকরবিসমিল্লাহবাদ দিয়ে সর্বদা সকলজায়েযযিকর করতে থাকেন তাহলে বুঝা যাবে যে তিনি এই ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) যে যিকর শিখিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট নন বা তাঁকে পছন্দ করছেন না

অনুরূপভাবে বাড়িতে প্রবেশের সময়, খাদ্য গ্রহণের সময়, সকাল, বিকাল, সন্ধ্যায়, রাত্রে, সারাদিন, বাজারে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে এরূপ সকল স্থানে কেউ যদি মাসনূন যিকর বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর নাম, নামের অর্থ, গুণবাচক নাম ইত্যাদি জপ করে বা এক

স্থানের যিকর অন্য স্থানে করেন তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে জায়েয হলেও সুন্নাতের খেলাফ হবে। আর সকল খেলাফে সুন্নাত যিকর নিয়মিত করলে বা রীতি হিসাবে গ্রহণ করলে সুন্নাতকে অবজ্ঞা, অবহেলা অপছন্দ করা হবে


(
) সুন্নাত বনাম উদ্ভাবন

অনেক সময় আমরা ইচ্ছাপূর্বক বা না বুঝে সুন্নাত বিদআত এবং অনুসরণ উদ্ভাবনের মধ্যে পার্থক্য নষ্ট করে ফেলি। এগুলির মধ্যে পার্থক্য বুঝা সুন্নাত অনুসরণ আকড়ে ধরে চলার জন্য অতি প্রয়োজনীয় :


(
) সুন্নাত, ইত্তিবায়ে সুন্নাত খেলাফে সুন্নাত

সুন্নাত শব্দের অর্থ, ব্যবহার, সুন্নাতের গুরুত্ব, মর্যাদা, সুন্নাতের খেলাফ চলার ভয়াবহ পরিণতি ইত্যাদি বিষয়েএহ্ইয়াউস সুনানগ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। এখানে সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সামগ্রিক জীবন পদ্ধতিই সুন্নাত। যে কাজ রাসূলুল্লাহ (সা.) ফরয হিসাবে করেছেন তা ফরয হিসাবে করাই তাঁর সুন্নাত। যা তিনি নফল হিসাবে করেছেন তা নফল হিসাবে করাই তাঁর সুন্নাত। যা তিনি সর্বদা নিয়মিতভাবে করেছেন তা সর্বদা নিয়মিতভাবে করাই তাঁর সুন্নাত। যা তিনি মাঝে মাঝে করেছেন তা মাঝে মাঝে করাই তাঁর সুন্নাত। যা তিনি কখনো করেননি, অর্থাৎ সর্বদা বর্জন করেছেন তা সর্বদা বর্জন করাই তাঁর সুন্নাত। যা তিনি মাঝে মাঝে বর্জন করেছেন তা মাঝে মাঝে বর্জন করাই তাঁর সুন্নাত

যে কাজ রাসূলুল্লাহ (সা.) করতে নির্দেশ দিয়েছেন বা উৎসাহ প্রদান করেছেন তা পালনের ক্ষেত্রে তাঁর পালন পদ্ধতিই সুন্নাত। যে কাজ তিনি করতে নিরুৎসাহিত করেছেন বা বর্জন করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন তা তাঁর কর্মপদ্ধতির আলোকে বর্জন করাই সুন্নাত

যে কাজ রাসূলুল্লাহ (সা.) শর্তসাপেক্ষে বা নির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতিতে, সময়ে, স্থানে বা পদ্ধতিতে করেছেন বা করতে বলেছেন তাকে ঐসব শর্তসাপেক্ষে বা নির্দেশনা সাপেক্ষে পালন করাই সুন্নাত। যা তিনি উন্মুক্তভাবে বা সাধারণভাবে করেছেন বা করতে বলেছেন,

কোনো বিশেষ সময়, স্থান, পরিস্থিতি বা পদ্ধতি নির্ধারণ করেননি তাকে কোনোরূপ বিশেষ পদ্ধতি, সময় বা পরিস্থিতি বা স্থান নির্ধারণ ব্যতিরেকে উন্মুক্তভাবে পালন করাই সুন্নাত

কোনো কর্ম পালন বা বর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব, পদ্ধতি, ক্ষেত্র, সময়, স্থান ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে সুন্নাতের বেশি বা কম হলে বা সুন্নাতের বাইরে গেলে তাখেলাফে সুন্নাতহবে। অর্থাৎ, যা তিনি ফরয হিসাবে করেছেন তা নফল মনে করে পালন করা, যা তিনি নফল হিসাবে করেছেন তা ফরযের গুরুত্ব দিয়ে পালন করা, যা তিনি সর্বদা নিয়মিতভাবে করেছেন তা মাঝেমধ্যে করা, যা তিনি মাঝে মাঝে করেছেন তা সর্বদা করা, যা তিনি কখনই করেননি তা সর্বদা বা মাঝেমাঝে করা, যা তিনি কোনো শর্তসাপেক্ষে বা নির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতিতে, সময়ে, স্থানে বা পদ্ধতিতে করেছেন বা করতে বলেছেন তাকে শর্তহীন উন্মুক্তভাবে পালন করা, যা তিনি উন্মুক্তভাবে বা সাধারণভাবে করেছেন বা করতে বলেছেন, কোনো বিশেষ সময়, স্থান, পরিস্থিতি বা পদ্ধতি নির্ধারণ করেননি তা পালনের জন্য কোনরূপ বিশেষ পদ্ধতি, সময় বা পরিস্থিতি বা স্থান নির্ধারণ করা বা যা তিনি বর্জন করেছেন তা পালন করা সবইখেলাফে সুন্নাতখেলাফে সুন্নাতসুন্নাতের নির্দেশনার আলোকে মুবাহ, জায়েয, হারাম, মাকরূহ বা বিদআত হতে পারে


(
) উদ্ভাবন বিদআত বনাম কিয়াস ইজতিহাদ

বিদআতের পরিচয়, পরিণতি, প্রকরণ কারণ সম্পর্কে পূর্বোক্ত বইয়ে আলোচনা করেছি। কোনো বিদআতই কুরআন- হাদীসের দলিল ছাড়া বানানো হয় না। সুন্নাত থেকেই বিদআতের উদ্ভাবন হয়। উদ্ভাবনের এই প্রক্রিয়া উদ্ভাবন অনুসরণের মধ্যে পার্থক্য বুঝার জন্য কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা যায়

মনে করুন আমি একজন পীর সাহেবের মুরীদ। আমি দেখতে পেলাম যে আমার পীর মাঝে মাঝে কালো পাগড়ি মাঝে মাঝে সাদা পাগড়ি ব্যবহার করেন। আমি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখতে পেলাম যে, তিনি শুক্রবারে জুমআর সালাতের জন্য সাদা পাগড়ী ব্যবহার করেন। অন্যান্য দিনে তিনি কালো পাগড়ি ব্যবহার করেন। এখন একজন ভক্ত অনুসারী হিসাবে যদি আমিও হুবহু তাঁর মতো শুক্রবারে সাদা পাগড়ি অন্যান্য দিনে কালো পাগড়ি ব্যবহার করি তাহলে আমাকে প্রকৃত পরিপূর্ণ অনুসারী বলা হবে। কিন্তু আমি যদি এখানে নিজের বিবেক বিবেচনাকে কাজে লাগিয়ে সর্বদা সাদা পাগড়ি ব্যবহার করি তাহলে আমার অন্যান্য পীরভাই স্বভাবতই আমাকে পূর্ণ অনুসারী বলবেন না এবং আমাকে পীরের কর্মের বিরোধিতার জন্য প্রশ্ন করবেন। তাদের প্রশ্নের জবাবে আমি বলতে পারব, শুক্রবার হচ্ছে সর্বোত্তম দিন এবং এই দিনে আমার পীর সাদা পাগড়ি ব্যবহার করেন। এদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কালো পাগড়ি ব্যবহারের চেয়ে সাদা পাগড়ি ব্যবহারই উত্তম। যদিও পীর নিজে অন্যান্য দিনে কালো পাগড়ি ব্যবহার করেন, তবে তিনি নিজের কর্ম দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, সর্বদা সাদা পাগড়ি ব্যবহারই উত্তম। তাই আমি সকল দিনেই সাদা পাগড়ি ব্যবহার করি। আমার যুক্তি দলিল যতই অকাট্য হোক আমার পীর ভাইয়েরা আমাকে পূর্ণ অনুসারী বলে মানবেন না, বরং যিনি পীরের হুবহু অনুকরণ করে শুক্রবারে সাদা পাগড়ি অন্য দিনে কালো পাগড়ি পরেন তাকেই হুবহু অনুসরণকারী বলবেন। আমাকে উদ্ভাবনকারী বলবেন। হয়ত কেউ বলেও বসবেন, তুমি এভাবে সাদা পাগড়ির ফযীলত আবিষ্কার করলে, অথচ তোমার পীর তা বুঝতে পারলেন না, তুমি কি তাঁর চেয়েও বেশি বুঝ?


সুন্নাতের আলোকে একটি উদাহরণ বিবেচনা করুন। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) অনেক সময় বিশেষ নিয়ামত লাভ করলে বা সুসংবাদ পেলে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য শুকরানা সাজদা করতেন। এখন যদি কেউ এসকল হাদীসের আলোকে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে নিয়মিত একটি করে শুকরানা সাজদা দেওয়ার প্রচলন করেন তাহলে তাকে কখনোই অনুসারী বলা যাবে না। তাকে উদ্ভাবক বলতে হবে। তিনি হয়ত অনেক অকাট্য দলিল পেশ করবেন। তিনি বলবেন, যে কোনো নিয়ামত লাভের পরেই শুকরিয়া সাজদা করা সুন্নাত। মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় নিয়ামত সালাত আদায় করতে পারা। কাজেই, এই নিয়ামত লাভের পরে যে শুকরানা সাজদা করে না সে অকৃতজ্ঞ বান্দা। যে বান্দা সন্তান লাভের সংবাদে শুকরিয়া সাজদা করে অথবা চাকরি পাওয়ার সংবাদে শুকরিয়া করে অথচ জীবনের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত সালাত আদায়ে তৌফিক পেয়ে সাজদা করে না সে কেমন বান্দা!


তিনি হয়ত বলবেন, এই সাজদা যে নিষেধ করে সে বেয়াকুফ, তাকে আবু জাহল বলা উচিত। কারণ সে, আল্লাহর দরবরে শুকরিয়া জানাতে বান্দাকে নিষেধ করছে। কোথাও কি আছে যে, বিশেষ কোনো নিয়ামতের জন্য সাজদায়ে শুকর আদায় করা যাবে না? রাসূলুল্লাহ (সা.) কি কখনো সালাতের পরে শুকরানা সাজদা করতে নিষেধ করেছেন? নিয়ামতের জন্য সাজদা হাদীসে প্রমাণিত। সালাত মুমিনের জীবনের অন্যতম নিয়ামত। এছাড়া সাজাদার সময়ে দু কবুল হয় তাও প্রমাণিত। সালাতের পরে দু কবুল হয় তাও প্রমাণিত। কাজেই, প্রত্যেক সালাতের পরে সাজদা করা সাজদার মধ্যে দু করা সুন্নাত

এরূপ অনেক কথাই তিনি বলতে পারবেন। অগণিতঅকাট্যপ্রমাণ তিনি প্রদান করবেন। কিন্তু কখনই আমরা তাঁকে সুন্নাতে নববীর অনুসারী বলতে পারব না। কারণ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নিয়মিত রাসূলুল্লাহ (সা.) আজীবন আদায় করেছেন, তাঁর সাহাবীগণও করেছেন, কিন্তু কেউ কখনোই সালাত আদায়ের নিয়ামত লাভের পর শুকরিয়ার সাজদা করেননি। কাজেই, সালাতের পরে শুকরানা সাজদা না করাই তাঁদের সুন্নাত। আর সাজদার প্রথা এই সুন্নাতকে মেরে ফেলবে। অনুকরণপ্রিয় সুন্নাত প্রেমিকের প্রশ্ন: আমরা কি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়েও বেশি কৃতজ্ঞ বান্দা হতে চাই? সকল অকাট্য দলিলের মাধ্যমে আমরা কি রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবীগণকেই অকৃতজ্ঞ হেয় বলে প্রমাণিত করছি না?

এখানে পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন যে, সুন্নাতই কি সব? তাহলে ইজমা, কিয়াস, ইজতিহাদ ইত্যাদির অবস্থান কোথায়? বস্তুত সুন্নাতের ক্ষেত্র ইজমা, কিয়াস ইজতিহাদের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেখানে সুন্নাত নেই সেখানেই ইজমা, কিয়াস ইজতিহাদ প্রয়োজন

যে সকল বিষয়ে কুরআন হাদীসে স্পষ্ট বিধান দেওয়া হয় নি কিয়াস ইজতিহাদের মাধ্যমে সেগুলির বিধান নির্ধারণ করতে হয়। যেমন, রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মাতকে সালাত শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কোন কাজটি ফরয, কোনটি মুস্তাহাব ইত্যাদি বিস্তারিত বলেন নি। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে মুজতাহিদ তা নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। কোনো কোনো বিষয়ে সুন্নাতে একাধিক পদ্ধতি উল্লেখ রয়েছে, সেগুলির সমন্বয়ের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সুন্নাতের মধ্যে নেই। যেমন সালাতের রুকুর সময় হাত উঠানো অথবা না উঠানো, ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করা অথবা না করা ইত্যাদি। এক্ষেত্রেও মুজতাহিদ প্রাসঙ্গিক প্রমাণাদি কিয়াসের ভিত্তিতে এগুলির সমন্বয় দেওয়ার চেষ্টা করেন। অনুরূপভাবে মাইক, টেলিফোন, প্লেন ইত্যাদি বিষয়ে কুরআন হাদীসে কিছু বলা হয় নি। কুরআন হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশাবলির আলোকে কিয়াস ইজতিহাদের মাধ্যমে এগুলির বিধান অবগত হওয়ার চেষ্টা করেন মুজতাহিদ। কোনো ইজতিহাদী বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর সকলেই একমত হলে তাকেইজমাবা ঐকমত্য বলা হয়


এভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, কুরআন বা সুন্নাতে যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত রয়েছে সে বিষয়ে কোনো কিয়াস বা ইজতিহাদের সুযোগ নেই। আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (সা.) যে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন সে বিষয়ে আবার ইজতিহাদ, কিয়াস বা ইজমার কোনো প্রয়োজনের কথা কোনো মুমিন চিন্তাও করতে পারেন না

আর এজন্যই কিয়াস, ইজমা বা ইজতিহাদ দ্বারা কোনো ইবাদত-বন্দেগির পদ্ধতি তৈরি, উদ্ভাবন, পরিবর্তন বা সংযোজন করা যায় না। যেমন ইজতিহাদ বা কিয়াসের মাধ্যমে জোরে বা আস্তেআমীনবলার বিষয়ে বিধান, গমের উপর কিয়াস করে চাউলের বিধান, প্লেন, মাইক ইত্যাদির বিধান প্রদান করা যায়। কিন্তু সালাতের মধ্যে আস্তে আমীন বলার উপর কিয়াস করে ঈদুল আযহার দিনগুলিতে সালাতের পরের তাকবীরআস্তেবলার বিধান দেওয়া যায় না, সালাতের মধ্যে জোরে আমীন বলার উপর কিয়াস করে সালাতের পরে তাসবীহ, তাহলীল, তাকবীর, আয়াতুল কুরসী ইত্যাদি জোরে পড়ার বিধান দেওয়া যায় না, সফরে সালাত কসর করার উপর কিয়াস করে সিয়াম কসর বা অর্ধেক করার বিধান দেওয়া যায় না, হজ্জের সময় ইহরাম পরিধানের উপর কিয়াস করে সালাতের মধ্যে ইহরাম পরিধানের বিধান দেওয়া যায় না... প্রত্যেক ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত হুবহু অনুকরণ করতে হবে। এমনকি রামাদান মাসে জামাতে সালাতুল বিতর আদায়ের উপর কিয়াস করে কেউ অন্য সময়ে জামাতে সালাতুল বিতর আদায়ের বিধান দিতে পারেন না। বিতরের মধ্যে দাঁড়িয়ে দু করার উপর কিয়াস করে সালাতের পরের দু করার সময় দাঁড়ানোর বিধান দিতে পারেন না। দাঁড়িয়ে সালাত আদায়ের উপর কিয়াস করে দাঁড়িয়ে যিকর করা বা কুরআন তিলাওয়াত করাকে উত্তম বলতে পারেন না

অনুরূপভাবে ইজমা, কিয়াস বা ইজতিহাদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীগণের যুগে ছিল না এমন কোনো কিছুকে দীনের অংশ বানানো যায় না। যেমন ইজহিতাদের মাধ্যমে প্লেনে চড়ে হজ্জে গমন, মাইকে আযান দেওয়া ইত্যাদির বিষয়ে জায়েয বা না-জায়েয বিধান দেওয়া যায়, কিন্তু প্লেনে চড়ে হজ্জে গমন বা মাইকে আযান দেওয়াকে দীনের অংশ বানানো যায় না। কেউ বলতে পারেন না যে, প্লেন ছাড়া অন্য বাহনে হজ্জে গমন করলে সাওয়াব বা বরকত কম হবে বা বাইতুল্লাহর সাথে আদবের ক্ষেত্রে অপূর্ণতা থাকবে। অনুরূপভাবে কেউ বলতে পারেন না যে, মাইকে আযান না দিলে আযানের ইবাদত অপূর্ণ থাকবে। সকল ইজতিহাদী বিষয়ই এরূপ

সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ ইজমা-কিয়াস এবং উদ্ভাবন-বিদআতের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রক্ষা করেছেন। সালাতুল বিতরের রাকআত, সালাতের মধ্যে হাত উঠানো, আমীন বলা, সূরা ফাতিহা পাঠ, ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন নতুন পদ্ধতির বিধান ইত্যাদি অগণিত বিষয়ে সাহাবী, তাবিয়ী তাবি-তাবিয়ী আলিমগণ কিয়াস ইজতিহাদ করেছেন এবং মতভেদ করেছেন। বিষয়ক মতভেদের কারণে তাঁরা কাউকে নিন্দা করেন নি বা বিদআতী বলেন নি। পক্ষান্তরে ইবাদত-বনেদগির পদ্ধতির মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবীগণের পদ্ধতির সামান্যতম ব্যতিক্রম করলে তাতে আপত্তি করেছেন এবং বিদআত বলেছেন। জাতীয় অনেক ঘটনা বিস্তারিত তথ্যসূত্র সহএহইয়াউস সুনানগ্রন্থে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, দলবদ্ধভাবে গণনা করে যিকর করতে দেখে কঠিনভাবে আপত্তি করেছেন ইবনু মাসঊদ (রাঃ) আযানের পরে মিনারায় উঠে ডাকাডাকি করতে দেখে কঠিন আপত্তি করেছেন ইবনু উমার (রাঃ) হাঁচির পরে দুআর মধ্যেআল-হামদু লিল্লাহ’-এর সাথেদরুদ শরীফপাঠ করতে আপত্তি করেছেন ইবনু উমার (রাঃ) সালাতের পরে সশব্দেলা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবারবলতে দেখে আপত্তি করেছেন প্রসিদ্ধ তাবিয়ী- হাসান বসরী, ইবনু সিরীন প্রমুখ তাবিয়ীর উস্তাদ- আবীদাহ ইবনু আমর কঠিনভাবে আপত্তি করেছেন। এরূপ অগণিত ঘটনা আমরা হাদীসের গ্রন্থগুলিতে দেখতে পাই

এভাবে আমরা বুঝতে পারছি যে, ইবাদত পালনের পদ্ধতির সাথে ইজমা, কিয়াস বা ইজতিহাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এক্ষেত্রে সুন্নাতের পরিপূর্ণ হুবহু অনুসরণই ইবাদত কবুল হওয়ার সাওয়াব বেশি হওয়ার মূল পথ। বিষয়ক আয়াত হাদীসসমূহএহইয়াউস সুনানগ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সুন্নাতের হুবহু অনুসরণের আগ্রহেই আমরা এই পুস্তক রচনা করছি। বেলায়াতের পথে তাযকিয়ায়ে নাফস বা আত্মশুদ্ধির কর্মে এবং বিশেষ করে যিকর-আযকারের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হুবহু অনুসরণই আমাদের এই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য। তিনি কখন কোন যিকর কী-ভাবে করেছেন বা করতে বলেছেন তা জানতে আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করব এবং হুবহু তার অনুসরণের চেষ্টা করব। তাঁর সুন্নাতকে কেন্দ্র করে উদ্ভাবনা থেকে বিরত থাকব


আমরা দেখেছি যে, জ্ঞান যেরূপ সুন্নাতের অনুসরণের দিকে ধাবিত করে, অনুরূপভাবে সুন্নাতের জ্ঞান অনেক সময় সুন্নাত পরিত্যাগ করে নতুন উদ্ভাবনার দিকেও ধাবিত করে। মুসলিম বিশ্বে সকল সুন্নাত-বিরোধী বা সুন্নাত-অতিরিক্ত-উদ্ভাবনার পিছনে সমর্থন যুগিয়েছেন কিছু প্রাজ্ঞ আলিম পন্ডিত। উদ্ভাবনমুখী জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁর জ্ঞানের উপর আস্থাশীল। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, তিনি সুন্নাতকে এত বেশি গভীরভাবে বুঝেছেন যে, এখন এর উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করার ক্ষমতা তাঁর অর্জিত হয়েছে। অপর দিকে অনুসরণকারী সরল প্রেমিক। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সমগ্র হৃদয় দিয়ে ভালবাসেন। ভালবাসেন তাঁর সুন্নাতকে। তাঁর সুন্নাতকেই একমাত্র নাজাত, বেলায়াত, কামালাত সকল নিয়ামতের উৎস মনে করেন। তাই হুবহু তাঁর অনুসরণ করতে চান। তিনি তাঁর জ্ঞানের উপর অতবেশি আস্থাশীল নন। তাই তিনি উদ্ভাবনের চেয়ে অনুসরণকে নিরাপদ মনে করেন

মুহতারাম পাঠক, আমিও আমার জ্ঞানের উপর বা অন্য কারো জ্ঞানের উপর অতবেশি আস্থাশীল নই, যেরূপ আস্থাশীল আমি রাসূলে আকরাম (সা.) তাঁর সাহাবীগণের উপর। আমিও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সকল সুন্নাতের কর্ম বর্জনের অবিকল হুবহু অনুসরণকেই নিরাপদ পথ বলে মনে করি। একেই আমি নাজাত, কামালাত সকল নিয়ামতের একমাত্র পথ বলে বিশ্বাস করি। এই পুস্তকটিও এই ধরনের সরল অনুসারীদের জন্য লেখা, যারা উদ্ভাবনের চেয়ে হুবহু অনুসরণ করাকেই নিরাপদ মনে করেন

সুন্নাতের বাইরে ইবাদত বন্দেগি কবুল হবে না বলে অনেক হাদীসে বলা হয়েছে। যদিও পরবর্তী অনেক প্রাজ্ঞ আলিম আশ্বাস দিয়েছেন যে, খেলাফে সুন্নাত অনেক কর্মই আল্লাহ কবুল করে বিশেষ সাওয়াব দিবেন, কিন্তু অনেক মুমিনের মন এতে স্বস্তি পায় না। তাঁরা সুন্নাতের বাইরে যেতে চান না। ক্ষণস্থায়ী এই জীবন। ইবাদত বন্দেগি কতটুকুই বা করতে পারি। এই সামান্য কাজও যদি আবার বাতিল হয়ে যায় তাহলে তো তা সীমাহীন দুর্ভাগ্য। এজন্য তাঁরা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সুন্নাত সম্মত আমল সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। তাঁদের উদ্দেশ্যেই এই পুস্তক লেখা

No comments

Powered by Blogger.