রাহে বেলায়াত প্রথম অধ্যায় অনুচ্ছেদ-২১

. মাসনূন যিকরের শ্রেণীবিভাগ - . আল্লাহর উপর নির্ভরতা জ্ঞাপক বাক্য

যিকর নং ১৩ : (لا حول ولا قوة إلا بالله)

উচ্চারণঃ লা- ‘হাওলা ওয়া লা- ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লা-

অর্থঃ “কোনো অবলম্বন নেই, কোনো ক্ষমতা নেই আল্লাহ ছাড়া বা আল্লাহর সাহায্য ছাড়া।

আল্লার উপর নির্ভরতা জ্ঞাপক শ্রেষ্ঠ যিকর এই বাক্যটি। এই বাক্যের বেশি বেশি যিকর বা জপ করার নির্দেশে অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ

اسْتَكْثِرُوا مِنَ الْبَاقِيَاتِ الصَّالِحَاتِ ... التَّكْبِيرُ وَالتَّهْلِيلُ وَالتَّسْبِيحُ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلا حَوْلَ وَلا قُوَّةَ إِلا بِاللَّهِ

তোমরা বেশি বেশি বেশি করেচিরস্থায়ী নেককর্মগুলিকর। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেনঃ এগুলি কি? তিনি বললেনঃ তাকবীরআল্লাহু আকবার’, তাহলীললা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু’, তাসবীহসুবহা-নাল্লাহ’, ‘আল-‘হামদু লিল্লাহএবংলা-হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহহাদীসটির সনদ হাসান।[1]

আবু মুসা (রাঃ), আবু হুরাইরা (রাঃ), আবু যার (রাঃ), মুআয ইবনু জাবাল (রাঃ), সা ইবনু উবাদাহ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী থেকে বর্ণিত অনেকগুলি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরালা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহবলবে, কারণ বাক্যটি জান্নাতের ভান্ডারগুলির মধ্যে একটি ভান্ডার জান্নাতের একটি দরজা।[2]

আবু আইউব আনসারী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মেরাজের রাত্রিতে ইবরাহীম () আমাকে বলেন, আপনার উম্মতকে নির্দেশ দিবেন, তারা যেন বেশি করে জান্নাতে বৃক্ষ রোপণ করে ... জান্নাতের বৃক্ষ রোপণলা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহবলা।হাদীসটির সনদ হাসান।[3]

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَا عَلَى الْأَرْضِ أَحَدٌ يَقُولُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ إِلَّا كُفِّرَتْ عَنْهُ خَطَايَاهُ وَلَوْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ

পৃথিবীতে যে কোনো ব্যক্তি যদি বলেঃলা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আল্লাহু আকবার, ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, আল্লাহ মহান, কোনো অবলম্বন নেই এবং কোনো ক্ষমতা নেই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া), তবে তার সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার সমান হয়।হাদীসটি হাসান।[4]


. আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা জ্ঞাপক বাক্যাদি

উপরের প্রকারের যিকরে বান্দা তার মহান প্রভুর মহত্ব, একত্ব, পবিত্রতা, ক্ষমতা ইত্যাদি জপ করে মহান স্রষ্টার প্রতি তার মনের আবেগ, আকুলতা নির্ভরতা প্রকাশ করে তাঁকে স্মরণ করে নিজের হৃদয় মনকে পবিত্র উদ্ভাসিত করে। এগুলিতে সে প্রভুর কাছে সরাসরি বা স্পষ্টভাবে কিছু চায় না

আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, আল্লাহর কাছে চাওয়াও আল্লাহর যিকর। মহান প্রতিপালকের নিকট তাঁর করুণা, বরকত, ক্ষমা, জাগতিক, আধ্যাত্মিক পারলৌকিক কল্যাণ চাওয়া আল্লাহর যিকরের অন্যতম প্রকরণ

আল্লাহর নিকট বান্দা সবই চাইবে। নিজের জন্য চাইবে এবং অন্যদের জন্যও চাইবে। সব চাওয়াই যিকর। তবে প্রথমে তাঁর নিকট

ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আল্লাহর ক্ষমা লাভের উপরেই নির্ভর করছে বান্দার ইহকালীন পরকালীন সকল উন্নতি কল্যাণ। দ্বিতীয় প্রকার চাওয়া জাগতিক বা বা পারলৌকিক কোনো কিছু তাঁর কাছে চাওয়া। তৃতীয় প্রকার চাওয়া অন্যের জন্য চাওয়া

মানব প্রকৃতির অন্যতম দিক যে, সে কোনো না কোনোভাবে নিয়মভঙ্গ করবে। তার মহান স্রষ্টা তার জাগতিক পারলৌকিক কল্যাণের জন্য যে নির্ধারিত নিয়ম ব্যবস্থা প্রদান করেছেন তার বাইরে সে প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে চলে যায়। এভাবে প্রতিনিয়ত মানুষ পাপ করতে থাকে। একদিকে তার মানবীয় দুর্বলতা প্রবৃত্তির টান পারিপার্শিক পরিবেশ অপরদিকে শয়তানের প্রতিনিয়ত প্ররোচনা

তাওবা অর্থ ফিরে আসা এবং ইসতিগফার অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। যে কোনো পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে অনুশোচনা করা সেই পাপ আর করব না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করার নাম তাওবা। আর আল্লাহর নিকট পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার নাম ইসতিগফার। সাধারণনভাবে তাওবা ইসতিগফার এক সাথে ক্ষমা চাওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাওবা-ইসতিগফাররের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় মুমিনের আন্তরিক অনুশোচনা, অনুতাপ পুনরায় পাপ আর না করার আন্তরিক ইচ্ছা সিদ্ধান্ত

পাপ মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে। তাকে তার মহান স্রষ্টার করুণার পথ থেকে দূরে নিয়ে যায়। মহান রাব্বুল আলামীন অত্যন্ত ভালবেসে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে ভালবেসেছেন এবং সম্মানিত করেছেন। পাপ যেন মানুষকে কলুষিত করতে না পারে সে জন্য তিনি ক্ষমার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাওবা ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনার ফলে বান্দা শুধু পাপমুক্ত - হয় না, উপরন্তু সে অশেষ সাওয়াব মহান মর্যাদার অধিকারী হয়। যে কোনো মানুষ যখন পাপের জন্য আল্লাহর কাছে সর্বান্তকরণে ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন সে আল্লাহর ক্ষমা লাভে সক্ষম হয়। উপরন্তু এই ক্ষমা প্রার্থনা, অনুতাপ ক্রন্দনের কারণে তার হৃদয় আরো পবিত্র মুক্ত হয়। সে আল্লাহ্ আরো বেশি নৈকট্য, সন্তুষ্টি সাওয়াব অর্জন করে

মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে বান্দাকে যে কোনো পাপের পরেই ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীগণের জন্য নিশ্চিত ক্ষমা, অফুরন্ত সাওয়াব জান্নাতের অনন্ত নিয়ামতের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিদিন শতাধিকবার ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। তিনি উম্মতকে সদা সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা বা ইস্তেগফারের নির্দেশ দিয়েছেন


() ইস্তেগফারের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

() সৃষ্টির প্রতি অন্যায় ক্ষমা হয় না

ইস্তেগফারের মাধ্যমে সকল গোনাহ ক্ষমা হয়, কিন্তু সৃষ্টির প্রতি অন্যায় ক্ষমা হয় না। আল্লাহ যা কিছু বিধানাবলী প্রদান করেছেন তা তাঁর নিজের জন্য নয়, সবই মানুষের কল্যাণের জন্য। সকল বিধান দুই প্রকার। প্রথম প্রকার বিধান মানুষের ব্যক্তিগত কল্যাণ উন্নতির জন্য। এগুলিকে সাধারণত হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর অধিকার বলা হয়। দ্বিতীয় প্রকার বিধান মানুষের সামাজিক জীবনের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য। এগুলিকে হক্কুল ইবাদ বা সৃষ্টিজগতের অধিকার বলা হয়

প্রথম প্রকার বিধান লঙ্ঘন করলে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁর জাগতিক, মানসিক, আত্মিক পারলৌকিক উন্নতি ব্যাহত বা ধ্বংস হয়। যেমন,- সালাত, সিয়াম, হজ্ব, যিকর ইত্যাদি নির্দেশিত কর্মে অবহেলা করা অথবা শিরক, মদপান ইত্যাদি নিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত হওয়া

দ্বিতীয় প্রকার বিধান লঙ্ঘন করলে মানুষ নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও তার আশপাশের কোনো মানুষ, জীব জানোয়ার বা কোনো প্রকার সৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন, কাউকে গালি, গীবত ইত্যাদির মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া, কারো সম্পদ, অর্থ, সম্মান বা জীবনের কোনো প্রকার ক্ষতি সাধন করা। ফাঁকি, ধোঁকা, সূদ, ঘুষ, জুলুম, খুন, ধর্ষণ সবই এই জাতীয় পাপ। কেউ যদি অন্য কাউকে কোনো ব্যক্তিগত পাপে প্ররোচিত করে, যেমন সালাত ত্যাগ, মদপান ইত্যাদি কর্মে অন্য কাউকে প্ররোচিত করে তাহলে তাও এই প্রকারের পাপে পরিণত হবে। এছাড়া আল্লাহ তাঁর মহান রাসূল (সা.) সমাজের প্রতিটি মানুষের প্রতি অন্য মানুষের কিছু দায়িত্ব নির্ধারিত করেছেন। স্বামীর প্রতি দায়িত্ব, স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব, পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব, কর্মদাতার দায়িত্ব, কর্মচারীর দায়িত্ব, সহকর্মীর দায়িত্ব, দরিদ্রের প্রতি দায়িত্ব, অসহায়ের প্রতি দায়িত্ব, বিধবা এতিমদের প্রতি দায়িত্ব, পালিত পশুর প্রতি দায়িত্ব অন্যান সকল দায়িত্ব। এগুলি পূর্ণভাবে পালন না করলে তা হক্কুল ইবাদ বা সৃষ্টির অধিকার নষ্টের পাপ হবে


প্রথম প্রকারের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন বলে কুরআন হাদীসে বারংবার সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। অপরদিকে দ্বিতীয় প্রকারের পাপের মধ্যে দুটি দিক রয়েছে : প্রথমত, আল্লাহর বিধানের অবমাননা এবং দ্বিতীয়ত, আল্লাহর

কোনো সৃষ্টির অধিকার নষ্ট করা। সকল পাপে নিজেকে কলুষিত করার পরে বান্দা যখন আন্তরিকতার সাথে অনুতপ্ত হয়ে ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন আল্লাহ তাঁর বিধান অবমাননার দিকটি ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিচার দিনের মহান ন্যায়বিচারক তাঁর কোনো সৃষ্টির প্রাপ্য ক্ষমা করেন না। তার পাওনা তিনি বুঝে নেবেন তাকে বুঝে দেবেন। এজন্য এই জাতীয় পাপের ক্ষেত্রে সংশিলষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ, যাদের অধিকার নষ্ট বা সংকুচিত হয়েছে তাদের নিকট থেকে ক্ষমা না নিলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না

থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, সালাত-সিয়াম পরিত্যাগকারী, মদ্যপ, শূকরের মাংস ভক্ষণকারী বা এধরনের যে কোনো পাপীর জন্য ক্ষমালাভ সহজ। কিন্তু ভেজালদাতা, ফাঁকি দাতা, ধোঁকাপ্রদানকারী, যৌতুক গ্রহণকারী, এতিম, দুর্বল বিধবাদের সম্পদ

দখলকারী, ঘুষ, সুদ জুলুম, চাঁদাবাজি ইত্যাদি দুর্নীতির মাধ্যমে কারো সম্পদ গ্রহণ বা অধিকার হরণকারীগণের ক্ষমালাভ খুবই কষ্টকর। এজন্য প্রতিটি যাকিরকে সদা সর্বদা চেষ্ট করতে হবে, দ্বিতীয় প্রকার পাপ থেকে সর্বদা দূরে থাকার। যদি কোনো মুসলিমের পূর্ব জীবনে এধরনের পাপ সংঘঠিত হয়ে থাকে, তাহলে যথাশীঘ্র সংশিলষ্ট ব্যক্তির থেকে ক্ষমা গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে। সাথে সাথে বেশি করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি, ক্ষমা সাহায্য ভিক্ষা করতে হবে, যেন তিনি এগুলি থেকে ক্ষমা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন


() সকল পাপই বড়

ইস্তেগফারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় মুমিন-মনের উপলব্ধি। মানব মনের একটি অতি আকর্ষণীয় কাজ অন্যের ভুলত্রুটি অন্যায়গুলি বড় করে দেখা নিজের অন্যায়কে খুব ছোট যুক্তি বা কারণসঙ্গত বলে মনকে প্রবোধ দেওয়া। আমরা একাকী বা একত্রে যখনই চিন্তাভাবনা বা গল্প করি, তখনই সাধারণত অন্যের দোষত্রুটি অন্যায়গুলি আলোচনা করি। মুমিনের আত্মিক জীবন ধ্বংসে এটি অন্যতম কারণ। মুমিনকে সদা সর্বদা নিজের পাপের কথা চিন্তা করতে হবে। এমনকি আল্লাহর অগণিত নিয়ামতের বিপরীতে তাঁর ইবাদতের দুর্বলতাকেও পাপ হিসাবে গণ্য করে সকাতরে সর্বদা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। সকল প্রকার পাপকে খুবই কঠিন, ভয়াবহ নিজের জীবনের জন্য ধ্বংসাত্মক বলে দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে বারবার ক্ষমা চাইতে হবে। এই পাপবোধ নিজেকে সংকুচিত করার জন্য নয়। এই পাপবোধ আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজেকে ভারমুক্ত, পবিত্র, উদ্ভাসিত আল্লাহর নৈকট্যের পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বলেছেনঃ

إِنَّ الْمُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَأَنَّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ وَإِنَّ الْفَاجِرَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلَى أَنْفِهِ فَقَال بِهِ هَكَذَا (فطار)


মুমিন ব্যক্তি তাঁর পাপকে খুব বড় করে দেখেন, যেন তিনি পাহাড়ের নিচে বসে আছেন, ভয় পাচ্ছেন, যে কোনো সময় পাহাড়টি

ভেঙ্গে তাঁর উপর পড়ে যাবে। আর পাপী মানুষ তার পাপকে খুবই হালকাভাবে দেখেন, যেন একটি উড়ন্ত মাছি তার নাকের ডগায় বসেছে, হাত নাড়ালেই উড়ে যাবে।”[5]


() ইস্তিগফার বিষয়ক কতিপয় মাসনূন যিকর

মুমিন যে কোনো ভাষায় যে কোনো বাক্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন। ভাষা বা বাক্যের চেয়ে মনের অনুতাপ, অনুশোচনা আবেগ বেশি প্রয়োজনীয়। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আচরিত বা শেখানো বাক্য ব্যবহার করা উত্তম। বিশেষত যে সকল বাক্যের বিশেষ মর্যাদা তিনি বর্ণনা করেছেন। সাধারণভাবে বিভিন্ন হাদীসেআসতাগফিরুল্লাহ’ ( আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি ) - এই বাক্যটি ইস্তেগফারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক সময় এর সাথেওয়া আতূবু ইলাইহি’ (এবং আমি তাঁর কাছে তাওবা করছি) বাক্যটি সংযক্তু করা হয়েছে। ইসিগফারের ফযীলত নিদেশর্না আলোচনা কালে আমরা এগুলি বিস্তারিত দেখতে পাব। এখানে জাতীয় কয়েকটি মাসনূন বাক্য উল্লেখ করছিঃ

যিকর নং ১৪(সাইয়্যেদুল ইস্তিগফার) সকাল সন্ধ্যার যিকর দ্রষ্টব্য

যিকর নং ১৫ : (أسْتَغْفِرُ اللهَ)

উচ্চারণঃ আস্তাগফিরুল্লা-হ। অর্থঃ আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি

যিকর নং ১৬ : (أسْتَغْفِرُ اللهَ وَأتُوبُ إلَيهِ)

উচ্চারণঃ আস্তাগফিরুল্লা-হা ওয়া আতূবু ইলাইহি

অর্থঃ আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি তাঁর দিকে তাওবা করছি

যিকর নং ১৭ : (رَبِّ اغْفِرْ لِي وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ (أَنْتَ) التَّوَّابُ الْغَفُر)

উচ্চারণরাব্বিগ্ ফিরলী, ওয়া তুবআলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত তাওয়া-বুল গাফূর

অর্থঃ “হে আমার প্রভু, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি মহান তাওবা কবুলকারী ক্ষমাকারী।

যিকর নং ১৮ : ( বার)

(أسْتَغْفِرُ اللهَ العَظِيمَ الَّذِي لاَ إلَهَ إلاَّ هُوَ الحَيُّ القَيُّومُ وَأتُوبُ إلَيهِ)

উচ্চারণঃ আসতাগফিরুল্লা-হাল্ (‘আযীমাল্) লাযী লা- ইলা-হা ইল্লা- হুআলহাইউল কাইঊমু ওয়া আতূবু ইলাইহি

অর্থঃ “আমি মহান আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব সর্ব সংরক্ষক, এবং তাঁর কাছে তাওবা করছি।


() ইস্তেগফারের ফযীলত নির্দেশনা

কুরআন কারীমে মুমিনগণকে বারংবার তাওবা ইসতিগফার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাওবা ইসতিগফারের জন্য ক্ষমা, পুরস্কার মর্যাদা ছাড়াও জাগতিক উন্নতি বরকতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। অনুরূপভাবে বিভিন্ন হাদীসে ইসতিগফারের নির্দেশ

দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, ইসতিগফার আল্লাহর অন্যতম যিকর। যিকরের সাধারণ ফযীলত ইস্তিগফারকারী লাভ করবেন। ছাড়াও ইস্তেগফারের অতিরিক্ত মর্যাদা সাওয়াব রয়েছে। বিষয়ক কিছু হাদীস এখানে উল্লেখ করছি :

() আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

وَاللَّهِ إِنِّي لَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ فِي اليَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِينَ مَرَّةً


আল্লাহর কসম! আমি দিনের মধ্যে ৭০ বারেরও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাওবা করি।”[6]

() আগার আল-মুযানী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

يا أيها الناس توبوا إلى الله (استغفر الله) في اليوم مائة مرة


হে মানুষেরা তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর। নিশ্চয় আমি একদিনের মধ্যে ১০০ বার আল্লাহর নিকট তাওবা করি বা ইস্তিগফার করি।”[7]


(
) আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, আমরা গুণে দেখতাম রাসূলুল্লাহ (সা.) এক মাজলিসেই (একবারের যে কোনো বৈঠকের মধ্যে) মাজলিস ত্যাগ করে উঠে যাওয়ার আগে ১০০ বার উপরের ১৭ নং যিকরে বর্ণিত বাক্যটি (রাব্বিগ্ ফিরলী ... গাফূর) বলতেন।[8]

() আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বান্দা আল্লাহর নিকট তাওবা করলে (পাপ থেকে ফিরে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করলে) সীমাহীন খুশি হন। তার খুশির তুলনা, এক ব্যক্তি বিশাল জনবানবশূন্য ভয়ঙ্কর মরুভূমিতে থেমেছে। তার সাথে তার বাহন, যার পিঠে তার খাদ্য পানীয় রয়েছে। সে একটু বিশ্রাম করতে যেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে দেখে যে, তার বাহন হারিয়ে গিয়েছে মরুভূমির প্রচন্ড রোদ্র পিপাসায় সে ক্লান্ত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুকে মেনে নিয়ে একসময় অবসাদে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে সে দেখতে পায় যে তার উট তার পাশে দাড়িয়ে রয়েছে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে সে এত খুশি হয় যে, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে: ‘হে আল্লাহ, আপনি আমার দাস, আমি আপনার প্রভু।আনন্দের আতিশয্যে সে ভুল করে ফেলে। উট ফিরে আসাতে এই ব্যক্তি যত আননিদত হয়েছে কোনো পাপী বান্দা পাপ থেকে ফিরে আসলে বা তাওবা করলে আল্লাহ তার চেয়েও বেশি আননিদত হন।[9]

সুবহা-নাল্লাহ! কত ভালবাসেন আল্লাহ তাঁর পাপী বান্দাকে!! সুযোগ শুধু পাপীদের জন্যই। আমাদের কি আগ্রহ হয় না যে মহান প্রভুকে এভাবে আনন্দিত করব!

() আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বলতে শুনেছি, আল্লাহ বলেনঃ হে আদম সন্তান, তুমি যতক্ষণ আমাকে ডাকবে আমার করুণার আশা করবে আমি তোমাকে ক্ষমা করব, তুমি যাই কর না কেন, কোনো কিছুই পরোয়া করব না। হে আদম সন্তান, যদি তোমার পাপ আসমান স্পর্শ করে এরপরও তুমি ইস্তিগফার কর বা ক্ষমা চাও আমি তোমাকে ক্ষমা করব, কোনো পরোয়া করব না। হে আদম সন্তান, তুমি যদি পৃথিবী পূর্ণ পাপ নিয়ে আমার কাছে হাজির হও, কিন্তু শির্ক থেকে মুক্ত থাক, তাহলে আমি পৃথিবী পূর্ণ ক্ষমা তোমাকে প্রদান করব।[10]

() আবদ ইবনু বুসর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছিঃ

طوبى لمن وجد في صحيفته استغفاراً كثيرًا


সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি যার আমলনামায় অনেক ইসতিগফার পাওয়া গিয়েছে।হাদীসটির সনদ সহীহ।[11]
(
) অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ যদি কেউ উপরে লিখিত ১৮ নং যিকরের বাক্যগুলি: (أسْتَغْفِرُ اللهَ العَظِيمَ الَّذِي لاَ إلَهَ إلاَّ هُوَ الحَيُّ القَيُّومُ وَأتُوبُ إلَيهِ) তিন বার বলে, তাহলে তার গোনাহসমূহকে ক্ষমা করা হবে, যদি সে জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে আসার মতো কঠিন পাপও করে থাকে।হাদীসটিকে হাকিম যাহাবী সহীহ বলেছেন।[12]
() পিতামাতা সকল মুসলিমের জন্য ইস্তিগফার
মুমিন যেমন নিজের জন্য আল্লাহর ক্ষমা ভিক্ষা করবেন, তেমনি মুসলিম উম্মাহর সকল সদস্যের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। বিশেষত নিজের পিতামাতা, আত্মীয় বন্ধুগণের জন্য পূর্ববর্তী মুসলিমগণের জন্য যাদের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর দ্বীনকে পেয়েছি। অন্যান্য সকল মুসলিমের জন্য ইস্তিগফার করা আল্লাহর নির্দেশ। কুরআন কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে যে, পরবর্তী যুগের মুসলিম প্রজন্মরা বলেঃ

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ


হে আমাদের প্রভু, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং ঈমানের ক্ষেত্রে অগ্রণী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করুন। আর আপনি আমাদের অন্তরে মুমিনগণের বিরুদ্ধে কোনো হিংসা, বিদ্বেষ বা অমঙ্গল ইচ্ছা রাখবেন না। হে আমাদের প্রভু, নিশ্চয় আপনি মহা করুণাময় পরম দয়ার্দ্র।”[13]

এভাবে সকল মুসলিমের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করা ফিরিশতা নবীগণের সুন্নাত। কুরআন কারীমে ধরনের অনেক দু উল্লেখ করা হয়েছে

পিতামাতার জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তেগফারের ফযীলতে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إن الرجل لترفع درجته في الجنة فيقول أنى هذا فيقال باستغفار ولدك لك


জান্নাতে কোনো কোনো ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে। তখন সে বলবেঃ কিভাবে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি পেল? তখন তাকে বলা হবে,তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, এজন্য তোমার মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”[14]

[1] মুসনাদু আহমাদ /৭৫, /২৬৭, সহীহ ইবনু হিব্বান /১২১, মুসতাদরাক হাকিম /৬৯৪, ৭২৫, মাজমাউয যাওয়াইদ /২৪৭, /১৬৬, ১০/৮৬, ৮৭, ৮৯, মাওয়ারিদুয যামআন /৩৩৭-৩৩৯।
[2]
সহীহ বুখারী /১৫৪১, /২৩৪৬, /২৩৫৪, /২৪৩৭, ২৬৯০, সহীহ মুসলিম /২০৭৮, মুনযিরী, আত-তারগীব /৪৩২-৪৩৬, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৯৭-৯৯।
[3]
মুসনাদু আহমাদ /৪১৮, আত-তারগীব /৪৩৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৯৭।
[4]
সুনানুত তিরমিযী /৫০৯, নং ৩৪৬০, মুসতাদরাক হাকিম /৬৮২, তারগীব /৪১৮, নং ২৩১৪।
[5]
সহীহ বুখারী /২৩২৪, নং ৫৯৪৯, সুনানুত তিরমিযী /৬৮৫, নং ২৪৯৭।
[6]
সহীহ বুখারী /২৩২৪, নং ৫৯৪৮।
[7]
সহীহ মুসলিম /২০৭৫, নং ২৭০২।
[8]
সুনানুত তিরমিযী /৪৯৪, নং ৩৪৩৪, সহীহ ইবনু হিব্বান /২০৬, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা /১১৯। তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।
[9]
সহীহ বুখারী /২৩২৪, নং ৫৯৪৯, সহীহ মুসলিম /২১০৪, নং ২৭৪৭।
[10]
হাদিসটি হাসান। সুনানুত তিরমিযী /৫৪৮, নং ৩৫৪০, আত-তারগীব /৪৬৪, নং ২৪০৪।
[11]
সুনানু ইবনি মাজাহ /১২৫৪, নং ৩৮১৩, আত-তারগীব /৪৬৫।
[12]
মুসতাদরাক হাকিম /৬৯২, /১২৮, সুনানু আবী দাউদ /৮৫, নং ১৫১৭।
[13]
সূরা হাশরঃ ১০।
[14]
সুনানু ইবনি মাজাহ /১২০৭, নং ৩৬৬০, মুসনাদ আহমাদ /৫০৯, মিসবাহুস যুজাজাহ /৯৮, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/২১০, তাফসীরে ইবনু কাসীর /২৪৩। হাদিসটির সনদ সহীহ

No comments

Powered by Blogger.