রাহে বেলায়াত দ্বিতীয় অধ্যায় অনুচ্ছেদ-১: ক. ইবাদত কবুলের শর্ত পূরণ
রাহে বেলায়াত দ্বিতীয় অধ্যায় অনুচ্ছেদ-১: ক. ইবাদত কবুলের শর্ত পূরণ
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা বেলায়াতের পরিচয়, যিকরের অর্থ, গুরুত্ব মর্যাদা, ফযীলত ও প্রকারভেদ আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, আল্লাহর বেলায়াত অর্জন মুমিনের অন্যতম কাম্য ও মুমিন জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্য অর্জনে যিকর অন্যতম অবলম্বন। তবে নফল পর্যায়ের যিকরের মাধ্যমে বেলায়াত অর্জনের পূর্বে মুমিনকে আরো অনেক কর্ম করতে হয়। যেগুলির অবর্তমানে সকল যিকর অর্থহীন ও ভন্ডামিতে পরিণত হতে পারে। এ অধ্যায়ে আমরা এ জাতীয় কিছু বিষয় আলোচনা করব। এছাড়া যিকরের ন্যূনতম বা পরিপূর্ণ ফযীলত অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ও আলোচনা করতে চাই। মহান আল্লাহর নিকট তাওফীক ও কবুলিয়্যত প্রার্থনা করি।
ক.
ইবাদত
কবুলের
শর্ত
পূরণ
কুরআন কারীম ও সুন্নাতের আলোকে যিকরসহ সকল ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল বা গৃহীত হওয়ার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত রয়েছেঃ
(১) বিশুদ্ধ ঈমান ও ইখলাস: শির্ক, কুফর ও নিফাক-মুক্ত
বিশুদ্ধ
ঈমান
সকল ইবাদত
কবুল
হওয়ার
পূর্ব
শর্ত।
শুধু
তাই নয়। উপরন্তু
ইবাদতটি
পরিপূর্ণ
ইখলাসের
সাথে
শুধুমাত্র
আল্লাহর
সন্তুষ্টির
জন্য
হতে হবে।
আল্লাহর
সন্তুষ্টি
ছাড়া
অন্য
কোনো
রকম উদ্দেশ্যর
সামান্যতম
সংমিশ্রণ
থাকলে
সে ইবাদত
আল্লাহ
কবুল
করবেন
না।
(২) সুন্নাতের অনুসরণ : কর্মটি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত, রীতি ও তাঁর শিক্ষা অনুসারে পালিত হতে হবে। যদি কোনো ইবাদত তাঁর শেখানো ও আচরিত পদ্ধতিতে পালিত না হয়, তাহলে যত ইখলাস, আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতাই থাক না কেন, তা আল্লাহর দরবারে কোনো অবস্থাতেই গৃহীত বা কবুল হবে না।
(৩) হালাল ভক্ষণ : ইবাদত পালনকারীকে অবশ্যই হালাল-জীবিকা-নির্ভর হতে হবে। হারাম ভক্ষণকারীর কোনো ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।
দ্বিতীয়
ও তৃতীয়
শর্তটির
বিষয়ে
পূর্ববর্তী
অধ্যায়ে
কিছু
আলোচনা
করা হয়েছে।
প্রথম
শর্তটির
বিষয়ে
‘কুরআন-সুন্নাহের
আলোকে
ইসলামী
আকীদা’
গ্রন্থে
ও ‘মুসলমানী
নেসাব’
গ্রন্থে
বিস্তারিত
আলোচনা
করেছি।
এ বিষয়ে
বিস্তারিত
আলোচনা
বইয়ের
কলেবর
বৃদ্ধি
করবে।
আবার
এ বিষয়ের
প্রতি
সার্বক্ষণিক
সচেতনতা
ছাড়া
সকল ইবাদতই
অর্থহীন।
এজন্য
এখানে
অত্যন্ত
সংক্ষেপে
এ বিষয়ে
কয়েকটি
কথা বলতে
চাই।
আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর রিসালাতের সাক্ষ্য দেওয়া বা এই দুটি বিষয়ে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করাই ইসলামের মূল ভিত্তি। ঈমানের প্রথম অংশ (আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য বা মা’বুদ নেই) এই সাক্ষ্য প্রদান করা। দ্বিতীয় অংশ (মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল) এই সাক্ষ্য প্রদান করা। প্রথম অংশকে সংক্ষেপে “তাওহীদ” ও দ্বিতীয় অংশকে সংক্ষেপে “রিসালাত” বলা হয়।
কুরআন-হাদীসের
আলোকে
আমরা
দেখতে
পাই যে, তাওহীদের
বিভিন্ন
পর্যায়
রয়েছে।
প্রথমত,
জ্ঞান
পর্যায়ের
তাওহীদ।
এই পর্যায়ে
মহান
আল্লাহকে
তাঁর
গুণাবলী
ও কর্মে
এক ও অদ্বিতীয়
বলে বিশ্বাস
করা হয়। বিশ্বাস
করা হয় যে, আল্লাহই
এই মাহবিশ্বের
একমাত্র
স্রষ্টা,
প্রতিপালক,
পরিচালক,
সংহারক,
রিযিকদাতা
ও পালনকর্তা।
এ সকল কর্মে
তাঁর
কোনো
শরীক
বা সমকক্ষ
নেই।
দ্বিতীয়ত,
কর্ম
পর্যায়ের
একত্ব
বা ইবাদতের
একত্ব।
এ পর্যায়ে
বান্দার
কর্মে
আল্লাহকে
এক বলে বিশ্বাস
করা হয়। অর্থাৎ
বান্দার
সকল প্রকার
ইবাদাত
বা উপাসনা
আরাধনা
মূলক
কর্ম
যেমন
প্রার্থনা,
সাজদা,
জবাই
উৎসর্গ,
মানত,
তাওয়াক্কুল,
ইত্যাদি
একমাত্র
আল্লাহর
জন্য
করা ও আল্লাহরই
প্রাপ্য
বলে বিশ্বাস
করা এই পর্যায়ের
তাওহীদ।
তাওহীদের
এই দুইটি
পর্যায়
একে অপরের
সম্পূরক
ও পরস্পরে
অবিচ্ছিন্নভাবে
জড়িত।
এক পর্যায়
থেকে
অন্য
পর্যায়কে
পৃথক
করা যায় না বা একটিকে
বাদ দিয়ে
অন্যটির
উপর ঈমান
এনে মুসলিম
হওয়া
যায় না। তবে এখানে
প্রণিধানযোগ্য
যে, ঈমানের
প্রথম
অংশ (লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহ
)-তে মূলত
দ্বিতীয়
পর্যায়
বা “তাওহীদুল
উলুহিয়্যাহ্”-র বিষয়ে
গুরুত্ব
দেওয়া
হয়েছে।
এখানে
বলা হয়নি
যে (লা খালিকা
ইল্লাল্লাহ
) অর্থাৎ
(আল্লাহ
ছাড়া
কোন স্রষ্টা
নেই,), বা (লা রাযিকা
ইল্লাল্লাহু)
অর্থাৎ
(আল্লাহ
ছাড়া
কোন রিজিকদাতা
নেই)। অনুরূপভাবে
আল্লাহ
ছাড়া
কোন জীবনদাতা
নেই, মৃত্যুদাতা
নেই, পালনকর্তা
নেই ইত্যাদি
বিষয়ে
সাক্ষ্য
দানের
নির্দেশ
দেওয়া
হয়নি।
বরং আমাদের
এই ঘোষণা
দিতে
হবে, এই বিশ্বাস
করতে
হবে যে, আল্লাহ
ছাড়া
কোন উপাস্য
বা মাবুদ
নেই।
এর কারণ
কুরআন
ও হাদীসের
বর্ণনা
অনুসারে
মক্কার
কাফিরগণ
এবং সকল যুগের
কাফির-মুশরিকগণ
অধিকাংশ
ক্ষেত্রে
প্রথম
পর্যায়ের
তাওহীদ
বিশ্বাস
করত। তারা একবাক্যে স্বীকার করত যে, আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা, তিনিই সর্বশক্তিমান এবং সকল কিছুর একমাত্র মালিক তিনিই।[1]
মহান আল্লাহর একত্ব বা তাওহীদের এই বিশ্বাস নিয়ে তারা মহান আল্লাহর ইবাদাত বা উপাসনা করতো। তাঁকে সাজদা করত, তাঁর নামে মানত করত, তাঁর কাছে প্রার্থনা করত, সাহায্য চাইত। তবে তারা এর পাশাপাশি অন্যান্য দেবদেবী, নবী, ফিরিশতা, ওলী, পাথর, গাছগাছালি ইত্যাদির পূজা উপাসনা করত। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত, উপাসনা বা পূজা করা যাবে না এই কথাটি তারা মানতো না। তাদের দাবি ছিল যে, কিছু মানুষ ও ফিরিশতা আছেন যারা মহান আল্লাহর খুবই প্রিয়। এদের ডাকলে, এদের পূজা-উপাসনা করলে আল্লাহ খুশি হন ও তাঁর নৈকট্য, প্রেম ও সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। এছাড়া তারা বিশ্বাস করত যে, এ সকল প্রিয় সৃষ্টির সুপারিশ আল্লাহ শুনেন। কাজেই এদের কাছে প্রার্থনা করলে এরা আল্লাহর নিকট থেকে সুপারিশ করে ভক্তের মনোবাঞ্চনা পূর্ণ করে দেন। এজন্য তারা এ সকল ফিরিশতা, জিন, মানুষ, নবী, ওলী বা কল্পিত ব্যক্তিত্বের মুর্তি, সমাধি, স্মৃতিবিজড়িত স্থান বা স্মৃতিবিজড়িত দ্রব্যকে সম্মান করত এবং সেখানে তাদের উদ্দেশ্যে সাজদা, মানত, কুরবানী ইত্যাদি করত।[2]
এজন্য ইসলামে ইবাদতের তাওহীদের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মূলত এর মাধ্যমেই ঈমান ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়।
আল্লাহর একত্বে বা তাওহীদের বিশ্বাসের ৬টি দিক রয়েছে, যেগুলিকে আরকানুল ঈমান বা ঈমানের স্তম্ভ বলা হয়। (১) আল্লাহর উপর বিশ্বাস, (২) আল্লাহর মালাইকা বা ফিরিশতাগণের উপর বিশ্বাস, (৩) আল্লাহর গ্রন্থসমূহের উপর বিশ্বাস, (৪) আল্লাহর প্রেরিত নবী- রাসূলগণের উপর বিশ্বাস, (৫) আখেরাতের উপর বিশ্বাস, (৬) আল্লাহর জ্ঞান ও নির্ধারণ বা তাকদীরে বিশ্বাস।
ঈমানের
দ্বিতীয়
অংশ মুহাম্মাদ
(সা.)-কে আল্লাহর
বান্দা
ও রাসূল
হিসেবে
বিশ্বাস
করা।
এ কথা বিশ্বাস
করা যে, মুহাম্মাদ
(সা.) আল্লাহর
মনোনীত
নবী ও রাসূল।
মানবজাতির
মুক্তির
পথের
নির্দেশনা
দানের
জন্য
তাদের
কল্যাণ
ও অকল্যাণের
পথ শিক্ষা
দেওয়ার
জন্য
আল্লাহ
তাকে
মনোনীত
করেছেন।
মানবজাতির
মুক্তির
পথ, কল্যাণ
ও অকল্যাণের
সকল বিষয় আল্লাহ তাকে জানিয়েছেন এবং তা মানুষদেরকে শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁকে দান করেছেন। তিনি আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তার পরে আর কোনো ওহী নাযিল হবে না, কোন নবী বা রাসূল আসবেন না। তিনি বিশ্বের সকল দেশের সকল জাতির সব মানুষের জন্য আল্লাহর মনোনীত রাসূল। তার আগমনের দ্বারা পূর্ববর্তী সকল ধর্ম রহিত হয়ে গিয়েছে। তার রিসালাতে বিশ্বাস করা ছাড়া কোন মানুষই মুক্তির দিশা পাবে না। তিনি পরিপূর্ণ বিশবস্ততার সাথে আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বজনীন নবী ও রাসূল হিসাবে তার নবুয়তের ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহর সকল বাণী, শিক্ষা ও নির্দেশ তিনি পরিপূর্ণভাবে তার উম্মতকে শিখিয়ে গিয়েছেন, কোন কিছুই তিনি গোপন করেননি। তিনি যা কিছু উম্মতকে শিখিয়েছেন, জানিয়েছেন সবকিছুই তিনি সত্য বলেছেন। তার সকল শিক্ষা, সকল কথা সনেদহাতীতভাবে সত্য। আল্লাহকে ডাকতে হলে, তাঁকে পেতে হলে, তার ইবাদত করতে বা তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে অবশ্যই তাঁর শিক্ষা অনুসারে আল্লাহকে ডাকতে হবে বা ইবাদত করতে হবে। তার শিক্ষার বাইরে ইবাদত করলে তা কখনো আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের মুক্তির একমাত্র পথ। তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তাঁকে সর্বোচ্চসম্মান করতে হবে এবং সকলের চেয়ে বেশি ভালবাসতে হবে। তাঁর ভালবাসার অংশ হিসেবে তাঁর সাহাবীগণ ও বংশধরকে ভালবাসতে হবে। ভালবাসা, ভক্তি ও মর্যাদা ক্ষেত্রে অবশ্যই মুমিনকে কুরআন কারীম ও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত তাঁর বাণীর উপর নির্ভর করতে হবে। মনগড়াভাবে কিছুই বলা যাবে না। নিজের পছন্দ-অপছন্দ অবশ্যই তাঁর শিক্ষার অধীন করতে হবে।
[1] সূরা
ইউনুসঃ
৩১, সূরা
মু’মিনুন
৮৪-৮৯, সূরা
আনকাবুতঃ
৬১-৬৩, সূরা
লুকমানঃ
২৫, সূরা
যুখরুফঃ
৯।
[2] সূরা
যুমার
২-৩, সূরা ইউনুস ১৮।
No comments