আল-ফিকহুল আকবর অধ্যায়-০৪ - আল-ফিকহুল আকবার ও ইসলামী আকীদা
ঈমান, আকীদা ও অন্যান্য পরিভাষা
আল-ফিকহুল আকবার গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় ইসলামী ধর্ম-বিশ্বাস। বিশ্বাস বুঝাতে কুরআন-হাদীসে ‘ঈমান’ শব্দটিই ব্যবহৃত। তাবিয়ীগণের যুগ থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলোর অন্যতম:
(১) আল-ফিকহুল আকবার: শ্রেষ্ঠতম ফিকহ। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) আকীদা বিষয়ে রচিত তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থটির নাম রেখেছেন ‘আল-ফিকহুল আকবার’। সম্ভবত ‘আকীদা’ বুঝাতে এটিই প্রাচীনতম পরিভাষা।
(২) ইলমুত তাওহীদ: একত্ববাদের জ্ঞান বা তাওহীদ শাস্ত্র। ‘তাওহীদ’ অর্থ একত্ব বা মহান আল্লাহর একত্বের বিশ্বাস। ইসলামী ঈমান বা বিশ্বাসকে ‘তাওহীদ’ বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং এ বিষয়ক জ্ঞানকে ‘ইলমুত তাওহীদ’ বা তাওহীদের জ্ঞান বলা হয়। ইমাম আবূ হানীফা আল-ফিকহুল আকবার গ্রন্থে ‘ইলমুল আকীদা’-কে ‘ইলমুত তাওহীদ’ নামে অভিহিত করেছেন। এ পরিভাষাটিও দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে বিশেষ পরিচিত লাভ করে।
(৩) আস-সুন্নাহ। ‘সুন্নাত’ বা ‘সুন্নাহ’ শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, ‘সুন্নাহ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ: মুখ, ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি, জীবন পদ্ধতি, কর্মধারা ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তে ‘সুন্নাত’ অর্থ রাসূরলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা, কর্ম, অনুমোদন বা এক কথায় তাঁর সামগ্রিক জীবনাদর্শ।[1] আমরা দেখব যে, ইসলামী ধর্ম বিশ্বাসে বিভ্রান্তির উন্মেষ ঘটে বিশ্বাসের বিষয়ে সুন্নাত বর্জন করে যুক্তির উপর নির্ভর করার কারণে। এজন্য বিশ্বাসের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের মূলনীতি আলোচনা করতে তৃতীয় শতাব্দী থেকে অনেক আলিম ‘আস-সুন্নাহ’ নামে ‘আকীদা’ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। এদের অন্যতম ছিলেন ইমাম আহমদ ইবন হাম্বাল (২৪১ হি)। তাঁর পর অনেক প্রসিদ্ধ আলিম ‘আস-সুন্নাহ’ নামে আকীদা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন।
(৪) আশ-শারী‘আহ। ‘শারীয়াত’ বা ‘শারী‘আহ’ অর্থ নদীর ঘাট, জলাশয়ে পানি পানের স্থান, পথ ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় ‘শারী‘আহ’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। সেগুলির মধ্যে একটি অর্থ ‘‘ধর্ম বিশ্বাস’’ বা বিশ্বাস বিষয়ক মূলনীতিসমূহ।[2] তৃতীয় শতকের কোনো কোনো ইমাম ‘‘আশ-শারী‘আহ’’ নামে আকীদা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন।
(৫) উসূলুদ্দীন বা উসূলুদ্দিয়ানাহ: দীনের ভিত্তিসমূহ। চতুর্থ শতক থেকে কোনো কোনো আলিম আকীদা বুঝাতে এ পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন।
(৬) আকীদা। ধর্ম-বিশ্বাস বিষয়ক প্রসিদ্ধতম পরিভাষা ‘আকীদা’। আকীদা ও ই’তিকাদ শব্দদ্বয় আরবী ‘আক্দ (عقد) শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ বন্ধন করা, গিরা দেওয়া, চুক্তি করা, শক্ত হওয়া ইত্যাদি। ভাষাবিদ ইবন ফারিস এ শব্দের অর্থ বর্ণনা করে বলেন: ‘‘শব্দটির মূল অর্থ একটিই: দৃঢ় করণ, দৃঢ়ভাবে বন্ধন, ধারণ বা নির্ভর করা। শব্দটি যত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা সবই এই অর্থ থেকে গৃহীত।[3]
‘বিশ্বাস’ বা ধর্মবিশ্বাস অর্থে ‘আকীদা’ ও ‘ই’তিকাদ’ শব্দের ব্যবহার কুরআন ও হাদীসে দেখা যায় না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে বা তাঁর পূর্বের যুগে আরবী ভাষায় ‘বিশ্বাস’ অর্থে বা অন্য কোনো অর্থে ‘আকীদা’ শব্দের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায় না। তবে ‘দৃঢ় হওয়া’ বা ‘জমাট হওয়া’ অর্থে ‘ই’তিকাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শক্ত বিশ্বাস বা ধর্ম-বিশ্বাস বুঝাতে আকীদা শব্দের ব্যবহার পরবর্তী যুগগুলিতে ব্যাপক হলেও প্রাচীন আরবী ভাষায় এ ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। ‘আকীদা’ শব্দটিই কুরআন, হাদীস ও প্রাচীন আরবী অভিধানে পাওয়া যায় না। হিজরী চতুর্থ শতকের আগে এ শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায় না। চতুর্থ হিজরী শতক থেকে এ পরিভাষাটি প্রচলন লাভ করে। পরবর্তী যুগে এটিই একমাত্র পরিভাষায় পরিণত হয়।
(৭) ইলমুল কালাম: কথাশাস্ত্র। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস বিষয়ক আলোচনা বা গবেষণাকে অনেক সময় ‘ইলমুল কালাম’ বলা হয়। ইলমুল আকীদা ও ইলমুল কালাম- এর পার্থক্য বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।[4]
[1] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃষ্ঠা ২৯-৫০।
[2] আল-ফাইঊমী, আল-মিসবাহুল মুনীর ১/৩১০; মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আল-হামদ, আকীদাতু আহলিস সুন্নাহ, পৃ. ১৬-১৭
[3] ইবন ফারিস, মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ ৪/৮৬।
[4] উপরের পরিভাষাগুলো বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা দেখুন: ইসলামী আকীদা, পৃষ্ঠা ২১-৩২।
২. ইলমুল আকীদার গুরুত্ব
জাগতিক সাফল্য ও আখিরাতের মুক্তির মূল ভিত্তি বিশুদ্ধ বিশ্বাস। মানুষের মন ও বিশ্বাস-ই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্য একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে এবং মানবতার পূর্ণতায় উপনীত হতে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অপরিহার্যতা আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা থেকে সুস্পষ্ট যে, বিশ্বাসের বিশুদ্ধতার উপরেই মানুষের মুক্তির মূল ভিত্তি। আর এজন্যই ইমাম আবূ হানীফা ইলমুল আকীদার নামকরণ করেছেন: ‘আল-ফিকহুল আকবার’ বা শ্রেষ্ঠতম ফিকহ। বিশ্বাস-জ্ঞানকে ‘‘শ্রেষ্ঠতম ফিকহ’’ নামকরণের মাধ্যমে ইমাম আযম বুঝিয়েছেন যে, ফিকহ বা ধর্মীয় জ্ঞানের যত শাখা রয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ শাখা ও দীনী ইলমের শ্রেষ্ঠতম বিষয় ঈমান বিষয়ক জ্ঞান। তিনি নিজেই এ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ পুস্তিকাটির শুরুতে আবূ মুতী বালখী (১৯৯ হি) বলেন:
سَأَلْتُ أَبَا حَنِيْفَةَ النُّعْمَانَ بْنَ ثَابِتٍ عَنِ الْفِقْهِ الأَكْبَرِ،
فَقَالَ: أَنْ لاَ تُكَفِّرَ أَحَداً مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ بِذَنْبٍ، وَلاَ
تَنْفِيْ أَحَداً مِنَ الإِيْمَانِ، وَأَنْ تَأْمُرَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَى
عَنِ الْمُنْكَرِ، وَتَعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ،
وَأَنَّ مَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيْبَكَ، وَلاَ تَتَبَرَّأَ مِنْ أَحَدٍ
مِنْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، وَلاَ تُوَالِيْ أَحَداً دُوْنَ أَحَدٍ، وَأَنْ
تَرُدَّ أَمْرَ عُثْمَانَ وَعَلِيٍّ إِلَى اللهِ تَعَالَى.
‘‘আমি আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিতকে ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ (শ্রেষ্ঠতম ফিকহ) সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন: তা এই যে, তুমি কোনো আহল কিবলাকে পাপের কারণে কাফির বলবে না, কোনো ঈমানের দাবিদারের ঈমানের দাবি অস্বীকার করবে না, তুমি ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায়ের নিষেধ করবে, তুমি জানবে যে, তোমার উপর যা নিপতিত হয়েছে তার ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো পথ ছিল না এবং তুমি যা পাও নি তা পাওয়ার ছিল না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো সাহাবীর প্রতি অবজ্ঞা-অভক্তি প্রকাশ করবে না, তাঁদের কাউকে বাদ দিয়ে কাউকে ভালবাসবে না, এবং উসমান (রা) ও আলী (রা)-এর বিষয় আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করবে।’’[1]
‘ফিক্হ’ শব্দটি কুরআন ও হাদীসে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। কুরআন হাদীসের আলোকে ইসলামী বিধিবিধানের গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে ‘ফিকহ’ বলা হয়। ইমাম আবূ হানীফা উল্লেখ করেছেন যে, শরীয়তের আহকাম বা বিধিবিধান বিষয়ক ফিকহ শিক্ষা করার চেয়ে দীনের বিশ্বাস বিষয়ক ফিকহ অর্জন করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন:
الْفِقْهُ فِيْ الدِّيْنِ أَفْضَلُ مِنَ الْفِقْهِ فِيْ الأَحْكَامِ ... قُلْتُ:
فَأَخْبِرْنِيْ عَنْ أَفْضَلِ الْفِقْهِ. قَالَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ: أَنْ
يَتَعَلَّمَ الرَّجُلُ الإِيْمَانَ بِاللهِ تَعَالَى وَالشَّرَائِعَ وَالسُّنَنَ
وَالْحُدُوْدَ وَاخْتِلاَفَ الأُمَّةِ وَاتِّفَاقَهَا...
‘‘দীন বিষয়ে জ্ঞানার্জন আহকাম বিষয়ে জ্ঞানার্জনের চেয়ে উত্তম। .... আমি বললাম: তাহলে আপনি আমাকে ফিকহের উত্তম বিষয় সম্পর্কে বলুন। আবূ হানীফা বলেন: শ্রেষ্ঠ ফিকহ এই যে, মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান শিক্ষা করবে, শরীয়তের বিধিবিধান, সুন্নাত, সীমারেখা এবং উম্মাতের মতভেদ ও ঐকমত্য শিক্ষা করবে।’’[2]
এখানে ইমাম আযম দীন ও আহকামের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। দীন হলো বিশ্বাস ও তাওহীদের নাম, পক্ষান্তরে আহকাম ও শরীয়াহ কর্ম বিষয়ক বিধানাবলির নাম। বিভিন্ন নবী ও রাসূলকে আল্লাহ বিভিন্ন শরীয়াহ দিয়েছেন, তবে সকলের দীন এক ও অভিন্ন। এ প্রসঙ্গে ‘আল-আলিম ওয়াল-মুতাআল্লিম’ গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফা বলেন:
أَلَسْتَ تَعْلَمُ أَنَّ رُسُلَ اللهِ صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلاَمُهُ عَلَيْهِمْ
أَجْمَعِيْنَ لَمْ يَكُوْنُوْا عَلَى أَدْيَانٍ مُخْتَلِفَةٍ، لَمْ يَكُنْ كُلُّ
رَسُوْلٍ مِنْهُمْ يَأْمُرُ قَوْمَهُ بِتَرْكِ دِيْنِ الرَّسُوْلِ الَّذِيْ كَانَ
قَبْلَهُ؛ لأَنَّ دِيْنَهُمْ كَانَ وَاحِداً، وَكَانَ كُلُّ رَسُوْلٍ يَدْعُوْ
إِلَى شَرِيْعَةِ نَفْسِهِ، وَيَنْهَى عَنْ شَرِيْعَةِ الرَّسُوْلِ الَّذِيْ
قَبْلَهُ؛ لأَنَّ شَرَائِعَهُمْ كَثِيْرَةٌ مُخْتَلِفَةٌ، وَلِذَلِكَ قَالَ اللهُ
تَعَالَى: (لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ
اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً)، وَأَوْصَاهُمْ جَمِيْعاً بِإِقَامَةِ
الدِّيْنِ وَهُوَ التَّوْحِيْدُ، وَأَنْ لاَ يَتَفَرَّقُوا؛ لأَنَّهُ جَعَلَ
دِيْنَهُمْ وَاحِداً فَقَالَ: (شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ
نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ
وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ) وَقَالَ
سُبْحَانَهُ: (وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلا نُوحِي إِلَيْهِ
أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا أَنَا فَاعْبُدُونِ). وَقَالَ جَلَّ وَعَلاَ: (لاَ
تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ)، أَيْ: لاَ تَبْدِيْلَ
لِدِيْنِهِ، فَالدِّيْنُ لَمْ يُبَدَّلْ وَلَمْ يُحَوَّلْ وَلَمْ يُغَيَّرْ،
وَالشَّرَائِعُ قَدْ غُيِّرَتْ وَبُدِّلَتْ..
‘‘তুমি কি জান না যে, আল্লাহর রাসূলগণ (আ) ভিন্ন ভিন্ন দীনের অনুসারী ছিলেন না, প্রত্যেক রাসূল তাঁর জাতিকে পূর্ববর্তী রাসূলের দীন বর্জন করতে নির্দেশ দিতেন না; কারণ তাঁদের দীন ছিল এক। প্রত্যেক রাসূল তাঁর নিজ শরীয়ত পালনের দাওয়াত দিতেন এবং পূর্ববর্তী রাসূলের শরীয়ত পালন করতে নিষেধ করতেন; কারণ তাঁদের শরীয়ত ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এজন্য আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমাদের প্রত্যেককে শরীয়ত ও স্পষ্ট পথ প্রদান করেছি, ইচ্ছা করলে আল্লাহ তোমাদেরকে এক জাতি করতে পারতেন’’[3]। আর তিনি তাঁদের সবাইকে দীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন, আর দীন হচ্ছে ‘‘তাওহীদ’’। আর তিনি নির্দেশ দিয়েছেন দীন, অর্থাৎ তাওহীদের বিষয়ে পরস্পর দলাদলি না করতে; কারণ তিনি তো তাদের একই দীন প্রদান করেছেন। এজন্য তিনি বলেছেন: ‘‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে- আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকে- এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না।’’[4] আল্লাহ আরো বলেছেন: ‘‘আমি তোমার পূর্বে কোনো রাসূলই প্রেরণ করি নি এ ওহী ব্যতীত যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’’[5] মহান আল্লাহ আরো বলেন: ‘‘আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই; এটিই প্রতিষ্ঠিত দীন’’[6]; অর্থাৎ তাঁর দীনের কোনো পরিবর্তন নেই। অতএব দীন কোনোভাবে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত বা স্থানান্তরিত হয় নি; তবে শরীয়ত বা বিধি-বিধানসমূহ পরিবর্তিত হয়েছে।’’[7]
[1] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪১।
[2] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪১।
[3] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৮ আয়াত।
[4] সূরা (৪২) শুরা: ১৩ আয়াত।
[5] সূরা (২১) আম্বিয়া: ২৫ আয়াত।
[6] সূরা (৩০) রূম: ৩০ আয়াত।
[7] ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ১৪-১৫।
৩. ইলমুল আকীদার আলোচ্য ও উদ্দেশ্য
স্বভাবতই ইলমুল আকীদার আলোচনা বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আলোচনার বিষয়বস্ত্তর দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা মৌলিক চারটি বিষয় দেখি:
প্রথমত: ‘আল-উলূহিয়্যাহ’ (الالوهية: godhead, godhood, divinity) অর্থাৎ মহান আল্লাহর সত্তা, বিশেষণ, মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়।
দ্বিতীয়ত: ‘আন-নুবুওয়াত’ (النبوة: prophecy, prophethood)। অর্থাৎ নবীগণের পরিচয়, মর্যাদা, দায়িত্ব, তাঁদের প্রতি বিশ্বাসের স্বরূপ ইত্যাদি।
তৃতীয়ত: ‘আল-ইমামাহ’ (الإمامة: leadership of Muslim society and state)। অর্থাৎ মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের যোগ্যতা, মর্যাদা, দায়িত্ব ইত্যাদি।
চতুর্থত: ‘আল-আখিরাহ’ (الآخرة: the hereafter, the life after
death)। অর্থাৎ মৃত্যু পরবর্তী জীবন, কবর, পুনরুত্থান, বিচার, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি।
আকীদা বিষয়ক সকল আলোচনাই মূলত এগুলোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আর সকল আলোচনার উদ্দেশ্য সুন্নাতে নববীর অনুসরণ।
মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পদ্ধতিতে ও অনুকরণে আল্লাহর ইবাদতই ইসলাম। ইসলামী ইলমের সকল শাখার উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন: মুমিনের জীবনকে হুবহু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণে পরিচালিত করা। ইলমুল ফিকহ-এর উদ্দেশ্য মুমিনের ইবাদত, মুআমালাত ও সকল কর্মকান্ড যেন অবিকল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের আদলেই পালিত হয়। ইলমুত তাযকিয়া বা তাসাউফের উদ্দেশ্য মুমিনের হৃদয়ের অবস্থা যেন অবিকল তাঁদের পবিত্র হৃদয়গুলোর মত হয়ে যায়। অনুরূপভাবে ইলমুল আকীদা বা আল-ফিকহুল আকবারের উদ্দেশ্য মুমিনের বিশ্বাস যেন হুবহু তাঁদের বিশ্বাসের সাথে মিলে যায়।
৪. ইলমুল আকীদা বনাম ইলমুল কালাম
আকীদা-শাস্ত্রের আরেকটি প্রসিদ্ধ নাম ‘ইলমুল কালাম’। ইলমুল কালাম বলতে মূলত ধর্মবিশ্বাসের বিষয়ে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা ভিত্তিক আলোচনা বুঝানো হয়। ‘আল-কালাম’ (الكلام) শব্দের অর্থ কথা, বাক্য, বক্তব্য, বিতর্ক (word, speech, conversation, debate) ইত্যাদি। কেউ কেউ মনে করেন যে কালামুল্লাহ বা আল্লাহর কালাম (كلام الله) থেকে ইলমুল কালাম পরিভাষাটির উদ্ভব। কারণ ইলমুল কালামে আল্লাহর কালাম বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে জোরালো মত হল, গ্রীক ‘লগস’ (logos) শব্দ থেকে ‘কালাম’ শব্দটি গৃহীত হয়েছে। লগস (logos) শব্দটির অর্থ বাক্য, যুক্তিবৃত্তি, বিচারবুদ্ধি, পরিকল্পনা (word, reason, plan) ইত্যাদি। লগস শব্দ থেকে লজিক (logic) শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ তর্কশাস্ত্র বা যুক্তিবিদ্যা।
সম্ভবত মূল অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে হিজরী দ্বিতীয় শতকের আরব পন্ডিতগণ ‘লজিক’ শব্দের আরবী প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ইলমুল কালাম’ (কথা-শাস্ত্র) পরিভাষা ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে এ অর্থে ‘ইলমুল মানতিক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার আভিধানিক অর্থও ‘কথা-শাস্ত্র’। সর্বাবস্থায় ইলমুল কালাম বলতে দর্শন বা যুক্তিবিদ্যা ভিত্তিক ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা বা গবেষণা (speculative theology, scholastic theology) বুঝানো হয়।
প্রাচীন যুগ থেকে দার্শনিকগণ মানবীয় যুক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান বা দর্শনের মাধ্যমে মানবীয় ইন্দ্রিয়ের অজ্ঞাত বিষয় সমূহ নিয়ে গবেষণা করেছেন। স্রষ্টা, সৃষ্টি, সৃষ্টির প্রকৃতি, স্রষ্টার প্রকৃতি, কর্ম, বিশেষণ ইত্যাদি বিষয়ে যুক্তি তর্ক দিয়ে তাঁরা অনেক কথা বলেছেন। এ সকল বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিতর্ক মানুষকে অত্যন্ত আকর্ষিত করলেও তা কোনো সত্যে পৌঁছাতে পারে না। কারণ মানুষ যুক্তি বা জ্ঞান দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে বা নিশ্চিত হতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার প্রকৃতি, কর্ম, বিশেষণ, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছাতে পারে না। এজন্য কখনোই দার্শনিকগণ এ সকল বিষয়ে একমত হতে পারেন নি। তাদের গবেষণা ও বিতর্ক অন্ধের হাতি দেখার মতই হয়েছে।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে গ্রীক, ভারতীয় ও পারসিক দর্শন প্রচার লাভ করে। মূলধারার তাবিয়ীগণ ও তাঁদের অনুসারীগণ বিশ্বাস বা গাইবী বিষয়ে দার্শনিক বিতর্ক কঠিনভাবে অপছন্দ করতেন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, গাইবী বিষয়ে ওহীর উপর নির্ভর করা এবং ওহীর নির্দেশনাকে মেনে নেওয়াই মুমিনের মুক্তির পথ।
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সহচরগণ ‘ইলমুল কালামৎ শিক্ষা করতে ঘোর আপত্তি করেছেন। ইলমুল কালামের প্রসার ঘটে মূলত দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমাংশে, বিশেষত ১৩২ হিজরী (৭৫০ খৃ) সালে আববাসী খিলাফতের প্রতিষ্ঠার পর। ইমাম আবূ হানীফা শিক্ষা জীবনে বা তাঁর জীবনের প্রথম ৩০ বৎসরে (৮০-১১০ হি) দর্শনভিত্তিক ইলমুল কালাম সমাজে তেমন পরিচয় লাভ করে নি। তবে দর্শনভিত্তিক বিভ্রান্ত মতবাদগুলো তখন কুফা, বসরা ইত্যাদি এলাকায় প্রচার হতে শুরু করেছে। গ্রীক-পারসিক দর্শন নির্ভর কাদারিয়া, জাবারিয়া, জাহমিয়া ইত্যাদি মতবাদ দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরু থেকেই জন্ম লাভ করে। এ সকল মতবাদ খন্ডন করতে মূলধারার কোনো কোনো আলিম দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা নির্ভর যুক্তি-তর্কের আশ্রয় নিতে থাকেন।
কোনো কোনো জীবনীকার উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) প্রথম জীবনে এরূপ দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা নির্ভর বিতর্ক বা ইলমুল কালামের চর্চা করেন। পরবর্তীতে তিনি তা বর্জন করেন এবং তা বর্জন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। ইলমুল কালামের প্রাথমিক অবস্থাতেই তিনি এর ক্ষতি ও ভয়াবহতা অনুধাবন করতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
كنت أعطيت جدلا فى الكلام ... فلما مضى مدة عمري تفكرت وقلت السلف كانوا أعلم
بالحقائق ولم ينتصبوا مجادلين بل أمسكوا عنه وخاضوا فى علم الشرائع ورغبوا فيه
وتعلموا وعلموا وتناظروا عليه فتركت الكلام واشتغلت بالفقه ورأيت المشتغلين
بالكلام ليس سيماهم سيماء الصالحين قاسية قلوبهم غليظة أفئدتهم لا يبالون بمخالفة
الكتاب والسنة ولو كان خيرا لاشتغل به السلف الصالحون
‘‘কালাম বা দর্শনভিত্তিক বিতর্কে আমার পারদর্শিতা ছিল ... আমার জীবনের কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমি চিন্তা করলাম যে, পূর্ববর্তীগণ (সাহাবীগণ ও প্রথম যুগের তাবিয়ীগণ) দীন-ঈমানের প্রকৃত সত্য বিষয়ে অধিক অবগত ছিলেন। তাঁরা এ সকল বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন নি। বরং ঈমান-আকীদা বিষয়ক বিতর্ক তাঁরা পরিহার করতেন। তাঁরা শরীয়ত বা আহকাম বিষয়ে আলোচনা ও অধ্যয়নে লিপ্ত হতেন, এগুলোতে উৎসাহ দিতেন, শিক্ষা করতেন, শিক্ষা দিতেন এবং এ বিষয়ে বিতর্ক- আলোচনা করতেন। এজন্য আমি কালাম পরিত্যাগ করে ফিকহ চর্চায় মনোনিবেশ করি। আমি দেখলাম যে, কালাম বা দর্শনভিত্তিক আকীদা চর্চায় লিপ্ত মানুষগুলোর প্রকৃতি ও প্রকাশ নেককার মানুষদের মত নয়। তাদের হৃদয়গুলো কঠিন, মন ও প্রকৃতি কর্কশ এবং তারা কুরআন ও সুন্নাতের বিরোধিতা করার বিষয়ে বেপরোয়া। কালাম চর্চা যদি কল্যাণকর হতো তাহলে অবশ্যই পূর্ববর্তীগণ (সাহাবী-তাবিয়ীগণ) এর চর্চার করতেন।’’[1]
ইমাম যাহাবী উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফার শিক্ষা জীবনে ‘ইলমুল কালাম’-এর অস্তিত্বই ছিল না।[2] অর্থাৎ এ সময়ে দর্শন ভিত্তিক আকীদা চর্চা কোনো পৃথক ‘ইলম’ বা জ্ঞানে পরিণত হয় নি। কারণ ইমাম আবূ হানীফা ১০০ হিজরীর আগেই ফিকহ শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ইমাম যাহাবী বলেন:
فأفقه أهل الكوفة علي وابن مسعود، وأفقه أصحابهما علقمة، وأفقه أصحابه إبراهيم،
وأفقه أصحاب إبراهيم حماد، وأفقه أصحاب حماد أبو حنيفة،
‘‘কূফার সর্বশ্রেষ্ঠ ফকীহ আলী (রা) এবং ইবন মাসঊদ (রা)। তাঁদের ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ আলকামা। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ ইবরাহীম নাখয়ী (৯৬ হি)। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান (১২০ হি)। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ আবূ হানীফা।’’[3]
উল্লেখ্য যে, ১২০ হিজরীতে ইমাম হাম্মাদের ওফাতের পর ইমাম আবূ হানীফা তাঁর স্থলাভিষিক্ত বলে গণ্য হন। এতে প্রমাণ হয় যে, এ সময়ের অনেক পূর্বেই ইমাম আবূ হানীফা কুফার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ বলে গণ্য হয়েছেন। এতে সুস্পষ্ট যে, ১০০ হিজরীর পূর্ব থেকেই তিনি ফিকহ শিক্ষা ও চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আর ১০০ হিজরীর পূর্বে মুসলিম বিশ্বে দর্শনভিত্তিক আকীদা চর্চা কোনো ‘ইলম’ বা শাস্ত্র হিসেবে প্রকাশ ও প্রসার লাভ করে নি। তাঁর পরিণত বয়সে (১১০-১৫০ হি) সমাজে ইলমুল কালাম চর্চা প্রসার লাভ করে এবং তিনি ইলমুল কালামের চর্চা থেকে তাঁর অনুসারীদেরকে নিষেধ করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর পুত্র হাম্মাদ বলেন:
أخذ أبو حنيفة رضي الله عنه بيدي يوم الجمعة، فأدخلني المسجد، .... مَرَّ بقوم
يتنازعون في الدين، فقال: يا بنيَّ! إذا مهر في هذا الأمر، قيل: زنديق ، وأُخرِج
من حَدِّ الإسلام، فيصير بحال لا ينتفع به. .... قال حماد بن أبي حنيفة: وكنتُ
معجَبا بالمنازعة، فتركتُ المنازعةَ بعد قول الشيخ
এক শুক্রবারে আবূ হানীফা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আমার হাত ধরে মসজিদে প্রবেশ করেন। .... তিনি দীন (আকীদা) বিষয়ে বিতর্কে (কালাম চর্চায়) লিপ্ত একদল মানুষদের নিকট দিয়ে গমন করেন এবং আমাকে বলেন: বেটা, যে ব্যক্তি এ শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করবে সে যিনদ্দীক (ধর্মত্যাগী ও ধর্ম অবমাননাকারী) বলে আখ্যায়িত হবে এবং ইসলামের পরিমন্ডল থেকে বহির্ভূত বলে গণ্য হবে। এভাবে সে এমন অবস্থায় পৌঁছাবে যে, তার দ্বারা কোনো কল্যাণ সাধিত হবে না। .... হাম্মাদ ইবন আবী হানীফা বলেন: আমি এরূপ বিতর্কের বিষয়ে খুবই আগ্রহী ছিলাম। শাইখ (রা)-এর এ কথার পরে আমি এ জাতীয় বিতর্ক পরিত্যাগ করি।’’[4]
ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র নূহ ইবন আবী মরিয়ম বলেন:
قلت لأبي حنيفة رحمه الله ما تقول فيما أحدث الناس من كلام في الأعراض والأجسام
فقال مقالات الفلاسفة عليك بالأثر وطريقة السلف وإياك وكل محدثة فإنها بدعة.
‘‘আমি আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহকে বললাম: মানুষেরা ইলমুল কালামে (স্রষ্টার অস্তিত্ব, অনাদিত্ব ও বিশেষণ প্রমাণে) ‘আরায’ (অমৌল-পরনির্ভর: nonessential), ‘জিসম’ (দেহ: body) ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনা উদ্ভাবন করেছে। এগুলোর বিষয়ে আপনার মত কী? তিনি বলেন: এগুলো দার্শনিকদের কথাবার্তা। তোমার দায়িত্ব হাদীসের উপর নির্ভর করা এবং পূর্ববতীদের (সাহাবী-তাবিয়ীদের) তরীকা অনুসরণ করা। সাবধান! সকল নব-উদ্ভাবিত বিষয় বর্জন করবে; কারণ তা বিদআত।’’[5]
ইমাম আযমের ছাত্রগণও এভাবে ইলমুল কালাম চর্চা নিষেধ করতে থাকেন। ইমাম আবূ ইউসূফ রাহ. (১৮৯ হি) তাঁর ছাত্র ইলমুল কালামের বিশেষজ্ঞ ও মু’তাযিলী পণ্ডিত বিশ্র আল-মারীসী (২১৮ হি)- কে বলেন:
اَلْعِلْمُ بِالْكَلاَمِ هُوَ الْجَهْلُ وَالْجَهْلُ بِالْكَلاَمِ هُوَ الْعِلْمُ،
وَإِذَا صَارَ الرَّجُلُ رَأْساً فِيْ الْكَلاَمِ قِيْلَ: زِنْدِيْقٌ.
‘‘কালামের জ্ঞানই হলো প্রকৃত অজ্ঞতা আর কালাম সম্পর্কে অজ্ঞতাই হলো প্রকৃত জ্ঞান। ইলমুল কালামে সুখ্যাতির অর্থ তাকে যীনদীক বা অবিশ্বাসী-ধর্মত্যাগী বলা হবে।’’[6]
ইমাম আবূ ইউসুফ (রাহ) আরো বলেন:
مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ بِالْكَلاَمِ تَزَنْدَقَ
‘‘যে ব্যক্তি ইলমু কালাম শিক্ষা করবে সে যিনদীকে পরিণত হবে।’’[7]
ইমাম শাফিয়ী রাহ. (২০৪ হি) বলেন,
حُكْمِيْ فِيْ أَهْلِ الْكَلاَمِ أَنْ يُضْرَبُوا بِالْجَرِيْدِ وَالنِّعَالِ
وَيُطَافُ بِهِمْ فِيْ الْعَشَائِرِ وَالْقَبَائِلِ وَيُقَالُ: هَذَا جَزَاءُ مَنْ
تَرَكَ الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ وَأَقْبَلَ عَلَى الْكَلاَمِ.
‘‘যারা ইলমুল কালাম চর্চা করে তার বিষয়ে আমার বিধান এই যে, তাদেরকে খেজুরের ডাল ও জুতা দিয়ে পেটাতে হবে, এভাবে মহল্লায় মহল্লায় ও কবীলাসমূহের মধ্যে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে এবং বলতে হবে: যারা কিতাব ও সুন্নাত ছেডে ইলমুল কালামে মনোনিবেশ করে তাদের এ শাস্তি।’’[8]
এভাবে প্রসিদ্ধ চার মুজতাহিদ ইমাম এবং দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকের সকল প্রসিদ্ধ আলিম, ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ইলমুল কালামের নিন্দা করেছেন।[9]
পরবর্তী যুগে ইমাম আবূ হানীফা ও অন্যান্য ইমামের অনুসারী অনেক আলিম আহলুস সুন্নাতের আকীদা ব্যাখ্যার জন্য ইলমুল কালাম চর্চা করেছেন। বিভ্রান্ত ফিরকাসমূহের বিভ্রান্তির উত্তর প্রদানের প্রয়োজনেই তাঁরা ইলমুল কালামের পরিভাষা ও পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন। তবে তাঁরা ইলমুল কালামের দার্শনিক ছায়া থেকে বের হতে পারেন নি। তাদের আলোচনায় সর্বদা কুরআন, হাদীস বা ওহীর বক্তব্যর চেয়ে যুক্তি, তর্ক ও দর্শন প্রাধান্য পেয়েছে।[10]
ইলমুল কালামের বিরুদ্ধে ইমাম আযম ও অন্যান্য ইমামের বক্তব্যকে তাঁরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা দাবি করেছেন যে, ইমামগণ মূলত ইলমুল কালাম ভিত্তিক মুতাযিলী ও অন্যান্য মতবাদের নিন্দা করেছেন, ইলমুল কালম ভিত্তিক আকীদা চর্চার নিন্দা তাঁরা করেন নি। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি যে, চার ইমাম ও দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের অন্যান্য ইমাম মূলত ইলমুল কালাম ভিত্তিক আকীদা চর্চার নিন্দা করেছেন। তাঁরা সকলেই আকীদা বিষয় আলোচনা করেছেন এবং অনেকে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে তাঁরা কুরআন, হাদীস ও সাহাবীগণের বক্তব্যের উপর নির্ভর করে আকীদা ব্যাখ্যা করেছেন। এর বিপরীতে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা নির্ভর আকীদা চর্চা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। সঠিক আকীদা প্রমাণের জন্যও দর্শন নির্ভর বিতর্ক তাঁরা নিষেধ করেছেন। কারণ সালফ সালিহীনের আকীদা চর্চা ও ইলমুল কালামের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ওহী ও আকল-এর অবস্থান।
ইমামগণ বা সালফ সালিহীনের আকীদা চর্চা ওহী নির্ভর, বিশেষত হাদীস ও ‘আসার’ বা সাহাবীগণের বক্তব্য নির্ভর। পক্ষান্তরে ইলমুল কালাম ‘আকল’ অর্থাৎ জ্ঞানেন্দ্রিয়, বোধশক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও দর্শন নির্ভর। ইমামগণের বক্তব্য সর্বদা নিম্নরূপ: তোমার বিশ্বাস এরূপ হতে হবে; কারণ কুরআনে, হাদীসে বা সাহাবীগণের বক্তব্যে এরূপ বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে ইলমুল কালামের বক্তব্য নিম্নরূপ: তোমাকে এরূপ বিশ্বাস করতে হবে; কারণ জ্ঞান, বিবেক ও যুক্তি এটিই প্রমাণ করে। আমরা ওহী ও আকলের অবস্থান সম্পর্কে ইমামগণের মত আকীদার উৎস বিষয়ক অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:
(ক) আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র নূহ ইবন আবী মরিয়ম যখন তাকে ইলমুল কালামের আরায (অমৌল), জিসম (দেহ) ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করেন তখন তিনি বলেন: ‘‘এগুলো দার্শনিকদের কথাবার্তা। তোমার দায়িত্ব হাদীসের উপর নির্ভর করা এবং পূর্ববতীদের (সাহাবী-তাবিয়ীদের) তরীকা অনুসরণ করা। সাবধান! সকল নব-উদ্ভাবিত বিষয় বর্জন করবে; কারণ তা বিদআত।’’
ইলমুল কালাম চর্চা করতে গেলে এ সকল পরিভাষার উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপাই নেই। মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ব, বিশেষণ ইত্যাদি প্রমাণের জন্য আরায, জিসম, জাওহার ইত্যাদি পরিভাষাগুলোই কালামবিদগণের একমাত্র ভিত্তি। এ থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, ইমামগণ মূলত সাহাবী তাবিয়ীদের পদ্ধতিতে ওহী-নির্ভর আকীদা চর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন এবং দার্শনিকদের পরিভাষা এবং দার্শনিক যুক্তিতর্ক নির্ভর ইলমুল কালাম ভিত্তিক আকীদা চর্চা নিষেধ করেছেন।
(খ) ইমামগণ ফিকহ ও কালাম উভয় ক্ষেত্রেই কুরআন, হাদীস ও আসার বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্যের উপর সমানভাবে নির্ভর করেছেন। ফিকহের ন্যায় আকীদার ক্ষেত্রেও তাঁরা ‘খাবারুল ওয়াহিদ’ বা একক বর্ণনার সহীহ হাদীসগুলোর উপর নির্ভর করেছেন। আর এজন্যই ইমাম আযম আকীদাকেও ‘ফিকহ’ বলেছেন এবং আল-ফিকহুল আকবার বা আল-ফিকহু ফিদ্দীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। পক্ষান্তরে কালামবিদগণ ফিকহ ও আকীদার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তারা দাবি করেছেন যে, ফিকহ বা কর্মের ক্ষেত্রে হাদীস, খাবারুল ওয়াহিদ বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্যের উপর নির্ভর করা যায়, কিন্তু বিশ্বাস বা আকীদার ক্ষেত্রে আকলের বিরুদ্ধে কারো বক্তব্য গ্রহণ করা যায় না বা কারো ‘তাকলীদ’ করা যায় না।
(গ) ইমামগণের দৃষ্টিতে ওহী বা কুরআন-হাদীসের বক্তব্য মানুষকে সত্যের নির্দেশনা প্রদানের জন্য। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাধারণ-অসাধারণ সকল মানুষ যেন বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা-বহির্ভূত ও ইন্দ্রিয়-বহির্ভূত বিষয়গুলোতে সহজ দিক নির্দেশনা লাভ ও সত্য অনুসরণ করতে পারে সেজন্যই মহান আল্লাহ নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে ওহী ও কিতাব প্রদান করেন। এজন্য দীন ও শরীয়তে বা বিশ্বাস ও কর্মে সকল ক্ষেত্রে ওহীর বক্তব্যকে সর্বদা সরল ও প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করতে হবে এবং এর রূপকার্থ ও দূরবর্তী ব্যাখ্যা বর্জন করতে হবে। ওহীকে রূপকার্থে ব্যবহার করা বা ওহীর দূরবর্তী ব্যাখ্যা করার অর্থ ওহীকে অকার্যকর করা। এজন্য তাঁরা যেভাবে সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি কর্ম বিষয়ক নির্দেশনার রূপক অর্থ গ্রহণ ও ব্যাখ্যা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, তেমনি মহান আল্লাহর বিশেষণ, আখিরাত, কিয়ামতের আলামত, কবর, হাশর ও অন্যান্য বিশ্বাসীয় বিষয়েও ওহীর বক্তব্যের রূপক অর্থ গ্রহণ ও ব্যাখ্যা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এর বিপরীতে ইলমুল কালামের দৃষ্টিতে ওহীর নির্দেশনা অস্পষ্ট ও এতে রূপকের সম্ভাবনা ব্যাপক। এজন্য বিশ্বাসের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আকলের উপর নির্ভর করতে হবে। ওহীর কোনো বক্তব্য আকলের ব্যতিক্রম হলে তা রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করতে হবে।
(ঘ) ইমামগণের দৃষ্টিতে বিশ্বাস ও কর্মে সকল ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণই পূর্ণতম আদর্শ। তাঁদের মত হওয়া বা হুবহু তাঁদের অনুসরণ করাই মুমিনের লক্ষ্য। অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় আকীদা চর্চারও উদ্দেশ্য আকীদা বিষয়ে সুন্নাতের প্রতিষ্ঠা ও পুনরুজ্জীবন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের আকীদার সাথে মুমিনের আকীদার হুবহু মিল প্রতিষ্ঠাই এখানে উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে ইলমুল কালামের উদ্দেশ্য আকল, বুদ্ধি ও বিবেক খাটিয়ে বিশ্বাস বিষয়ক সত্যে উপনীত হওয়া। কুরআন, সুন্নাহ বা সাহাবীগণের সাথে মিল ও অমিল এখানে গৌণ। মিল হলে ভাল কথা, নইলে কোনোরূপ ব্যাখ্যা করলেই হলো।
(ঙ) ইমামগণের আকীদা চর্চার ক্ষেত্রে মতভেদের সুযোগ খুবই সীমিত। কারণ সকলেই ওহীর উপর নির্ভর করেছেন এবং ওহীর ব্যাখ্যা বর্জন করেছেন। আর ওহীর মধ্যে ভিন্নতার অবকাশ খুবই কম। পক্ষান্তরে ইলমুল কালাম চর্চায় সকলেই জ্ঞান, যুক্তি ও বুদ্ধি-বিবেকের উপর নির্ভর করেছেন এবং ওহীকে নিজ নিজ বুদ্ধি-বিবেক অনুসারে ব্যাখ্যা করেছেন। জ্ঞানবুদ্ধি ও যুক্তির কোনো নির্ধারিত মানদন্ড নেই। কেউ দেবতার জন্য নরবলিকেও আকল-নির্দেশিত বা জ্ঞান ও যুক্তিসঙ্গত বলে প্রমাণের চেষ্টা করছেন। আবার কেউ জীবন ধারণের জন্য মাংস ভক্ষণকে অযৌক্তিক বা বিবেক বিরুদ্ধ বলে দাবি করছেন। এজন্য কালাম ভিত্তিক আকীদা চর্চায় মতভেদ খুবই বেশি।
[1] কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা, ৪৬৮।
[2] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯৮।
[3] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৩১-২৩৬।
[4] সায়িদ নাইসাপূরী হানাফী, আল-ই’তিকাদ, পৃষ্ঠা ১৭৭।
[5] হারাবী, আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ আনসারী, যাম্মুল কালাম ওয়া আহলিহী ৫/২০৬-২০৭।
[6] ইবন আবিল ইয্য হানাফী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৫
[7] ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৫
[8] ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৫
[9] গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/৩৩, ৫২-৫৩; ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭২-৭৭, ২০৪-২১০।
[10] গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/৩৩, ৫২-৫৩; ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭২-৭৭, ২০৪-২১০।
No comments