আল-ফিকহুল আকবর অধ্যায়-০৫ - আল-ফিকহুল আকবর বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা
তাওহীদ, আরকানুল ঈমান ও শিরক
ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবনু সাবিত (রাহিমাহুল্লাহ) ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ পুস্তিকাটির শুরুতে বলেন:
أَصْلُ التَّوْحِيْدِ وَمَا يَصِحُّ الاعْتِقَادُ عَلَيْهِ يَجِبُ أَنْ يَقُوْلَ:
آَمَنْتُ بِاللهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْبَعْثِ بَعْدَ
الْمَوْتِ وَالْقَدْرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ مِنَ اللهِ تَعَالَي. وَالْحِسَابُ
وَالْمِيْزَانُ وَالْجَنَّةُ وَالنَّارُ حَقٌّ كُلُّهُ. وَاللهُ تَعَالَي وَاحِدٌ،
لاَ مِنْ طَرِيْقِ الْعَدَدِ، وَلَكِنْ مِنْ طَرِيْقِ أَنَّهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ،
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ
يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
বঙ্গানুবাদ
তাওহীদের মূল এবং যার উপর বিশ্বাস বিশুদ্ধ হয় তা এই যে, অবশ্যই বলতে হবে: আমি ঈমান এনেছি আল্লাহে, এবং তাঁর মালাকগণে (ফিরিশতাগণে), এবং তাঁর গ্রন্থসমূহে, এবং তাঁর রাসূলগণে, এবং মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানে এবং তাকদীরে, যার ভাল এবং মন্দ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এবং হিসাব, মীযান, জান্নাত, জাহান্নাম এ সবই সত্য। মহান আল্লাহ এক। তাঁর একত্ব সংখ্যায় নয়। বরং তাঁর একত্বের অর্থ তাঁর কোনো শরীক নেই। বল, ‘তিনিই আল্লাহ, একক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নহেন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয় নি। এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।[1]
[1] সূরা (১১২) ইখলাস: ১-৪ আয়াত।
১. তাওহীদ [১. ১. তাওহীদ: অর্থ ও পরিচিতি]
১. ১. তাওহীদ: অর্থ ও পরিচিতি
ইমাম আযম (রাহ) প্রথমেই তাওহীদের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘তাওহীদ’ শব্দটি ‘ওয়াহাদা (وَحَدَ) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ ‘এক হওয়া’, ‘একক হওয়া’ বা ‘অতুলনীয় হওয়া’ (to be alone, unique,
unmatched, incomparable)। তাওহীদ অর্থ ‘এক করা’, ‘এক বানানো’, ‘একত্রিত করা’, ‘একত্বের ঘোষণা দেওয়া’ বা ‘একত্বে বিশ্বাস করা’। এখানে তাওহীদ বলতে ‘‘আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস’’ বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস বলতে ‘‘আল্লাহ এক’’ শুধু এতটুকু বিশ্বাস বুঝানো হয় না। কারণ কুরআন ও হাদীসের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি যে, আরবের কাফিরগণ এবং অন্যান্য যুগের কাফিরগণ প্রায় সকলেই এরূপ একত্বে বিশ্বাস করত। তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহ এক এবং তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও সর্বশক্তিমান প্রভু-প্রতিপালক।[1] এছাড়া তারা আল্লাহর ইবাদত করত, তাঁকে ডাকত, প্রার্থনা করত এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানত, কুরবানী ইত্যাদি করত।[2] কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ‘‘তাওহীদের’’ বিশ্বাস পূর্ণ হয় নি। কারণ তারা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করার পাশাপাশি আল্লাহর ফিরিশতাগণ, নবীগণ, ওলীগণ বা কল্পিত ‘পুত্রকন্যাগণের’ ইবাদত পাওয়ার অধিকার আছে বলে বিশ্বাস করত।[3]
[1] দেখুন: সূরা (১০) ইউনূস: ৩১ আয়াত; সূরা (২৩) মুমিনুন: ৮৪-৮৯ আয়াত।
[2] দেখুন: সূরা (৬) আনআম: ১৩৩ আয়াত; সূরা (৮) আনফাল: ৩২ আয়াত।
[3] দেখুন: সূরা (৯) তাওবা: ৩১ আয়াত; সূরা (৩৪) সাবা: ৪০ আয়াত; সূরা (৭১) নূহ: ২৩ আয়াত।
১. ২. তাওহীদের প্রকারভেদ
মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
‘‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর সাথে শরীক করে।’’[1]
এ থেকে স্পষ্টতই জানা যায় যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের একাধিক পর্যায় রয়েছে, এক পর্যায়ে ঈমানের সাথে সাথে শিরক্ একত্রিত হতে পারে। এর ব্যাখ্যায় সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, কাফিরগণ আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, রিয্কদাতা ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করতো, কিন্তু তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো।[2]
এ ভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের অন্তত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং কাফিরগণ একটি বিশ্বাস করতো এবং একটি অস্বীকার করত। কুরআন কারীমের এজাতীয় অগণিত নির্দেশনা ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের এ সকল তাফসীরের আলোকে পরবর্তী যুগের আলিমগণ ‘তাওহীদ’-কে বিভিন্ন ভাবে ভাগ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফাই প্রথম তাওহীদকে (১) রুবূবিয়্যাত (প্রতিপালন) ও (২) উলূহিয়্যাত (উপাসনা) দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করেন। পরবর্তী অধিকাংশ আকীদাবিদ এ বিষয়ে তাঁর অনুসরণ করেন। আল-ফিকহুল আবসাত গ্রন্থে তিনি বলেন:
وَاللهُ تَعَالَى يُدْعَى مِنْ أَعْلَى لاَ مِنْ أَسْفَلَ لَيْسَ مِنْ وَصْفِ
الرُّبُوْبِيَّةِ وَالأُلُوْهِيَّةِ فِيْ شَيْءٍ
‘‘মহান আল্লাহকে ডাকতে হয় ঊর্ধ্বে, নিম্নে নয়। নিম্নে থাকা রুবূবিয়্যাত (রবব হওয়ার) এবং উলূহিয়্যাতের (উপাস্য হওয়ার) কোনো বিশেষত্ব নয়।’’[3]
কেউ কেউ দুটি পর্যায়কে আরো বিস্তারিতভাবে তিনটি বা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা সাদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আলাউদ্দীন আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবিল ইয্য দিমাশকী (৭৩১-৭৯২ হি) তাঁর রচিত ‘শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ’ পুস্তকে তাওহীদকে প্রথমত দু পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল ইসবাত ওয়াল মা’রিফাহ (توحيد الإثبات
والمعرفة) বা জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ এবং (২) তাওহীদুত তালাবি ওয়াল কাসদি (توحيد الطلب والقصد) বা কর্ম পর্যায়ের তাওহীদ।[4] অন্যত্র তিনি উক্ত প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করে তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত, (২) তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত ও (৩) তাওহীদুল ইলাহিয়্যাহ।[5]
প্রসিদ্ধ ভারতীয় আলিম ও সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (১১৭৬ হি) প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেন এবং এভাবে তিনি তাওহীদকে চার পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন:
(১) আল্লাহকে একমাত্র অনাদি অনন্ত সত্তা বলে বিশ্বাস করা।
(২) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করা।
(৩) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র পরিচালক হিসেবে বিশ্বাস করা।
(৪) আল্লাহকে একমাত্র মা‘বুদ বা উপাস্য হিসেবে বিশ্বাস করা।[6]
এভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের মূলত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং প্রথম পর্যায়টির একাধিক পর্যায় রয়েছে। এগুলি অনুধাবন করা ঈমানের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য, অন্যথায় ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত হয়ে যেতে পারে। আমরা এখন এ পর্যায়গুলো বুঝতে চেষ্টা করব, ইনশা আল্লাহ।
[1] সূরা (১২) ইউসূফ: ১০৬ আয়াত।
[2] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১৩/৭৭-৭৯।
[3] ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৫০-৫১।
[4] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৯।
[5] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৮।
[6] শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৭৬।
১. ৩. জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ
জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদের দুটি মূল বিষয় রয়েছে: ১) সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্ব, ও ২) নাম ও গুণাবলির একত্ব।
১. ৩. ১. সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্ব
আরবীতে একে ‘তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ্’ (توحيد الربوبية) ‘‘প্রতিপালনের একত্ব’’ বলা হয়।[1] অর্থাৎ এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহই এ মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সংহারক, রিযিকদাতা, নিয়ন্ত্রক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
১. ৩. ২. কাফিরগণ এ তাওহীদ বিশ্বাস করত
কুরআন-হাদীসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, কাফির-মুশরিকগণ এ পর্যায়ের তাওহীদ বিশ্বাস ও স্বীকার করত। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এক স্থানে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ
قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ
بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ
مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ
الْمُتَوَكِّلُونَ
‘‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ডাক তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে? বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ নির্ভরকারীগণ আল্লাহর উপরেই নির্ভর করে।’’[2]
এ আয়াত এবং এ অর্থের অন্যান্য আয়াত থেকে আমরা জানছি যে, কাফিররা স্বীকার ও বিশ্বাস করত যে, আল্লাহই বিশ্বের সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সকল ক্ষমতার মালিক, সর্বশক্তিমান, তাঁর উপরে কেউ আশ্রয়দাতা নেই, তিনি অনিষ্ট চাইলে কেউ তা দূর করতে পারে না এবং তিনি কল্যাণ চাইলে কেউ তা রোধ করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরোধিতা করা সত্ত্বেও এ কথা তারা অকপটে স্বীকার করতো। তবে তাদের ধারণা ছিল যে, তাদের উপাস্যগণ আল্লাহর প্রিয়পাত্র। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে সক্ষম না হলেও এবং আল্লাহ চূড়ান্ত ফয়সালা দিলে তা পরিবর্তনের ক্ষমতা না রাখলেও সাধারণভাবে কিছু অলৌকিক নিষ্ট-অনিষ্টের ক্ষমতা তাদের আছে, যা আল্লাহই তাদের দিয়েছেন।
[1] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ ১৫।
[2] সূরা (৩৯) যুমার: ৩৮ আয়াত।
১. ৩. ৩. নাম ও গুণাবলির একত্ব
‘তাওহীদুল আসমায়ি ওয়াস সিফাত’ (توحيد الأسماء والصفات) বা ‘নাম ও গুনাবলির তাওহীদ’ অর্থ: দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ সকল পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন হাদীসে আল্লাহর বিভিন্ন নাম ও বিশেষণের উল্লেখ করেছেন। এ সকল নাম ও বিশেষণের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে, সকল প্রকার বিকৃতি, অপব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহর কোনো কর্ম, গুণ বা বিশেষণ কোনো সৃষ্টজীবের কর্ম, গুণ বা বিশেষণের মত নয়, তুলনীয় নয় বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আল্লাহ বলেন:
وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ
يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘এবং আল্লাহরই নিমিত্ত উত্তম নামসমূহ, তোমরা তাঁকে সে সকল নামেই ডাকবে। যারা তাঁর নামসমূহের বিষয়ে বক্রতা অবলম্বন করে তাদেরকে তোমরা বর্জন করবে। শীঘ্রই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল প্রদান করা হবে।’’[1]
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[2]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:
فَلا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لا
تَعْلَمُونَ
‘‘তোমরা আল্লাহর জন্য উপমা স্থাপন করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।’’[3]
[1] সূরা (৭) আরাফ: ১৮০ আয়াত।
[2] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[3] সূরা (১৬) নাহল: ৭৪ আয়াত।
১. ৩. ৪. নাম ও গুণাবলির তাওহীদে বিভ্রান্তি
মহান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি গাইবী বিষয়। মানুষ যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্বের বাস্তবতা অনুভব করতে পারে, কিন্তু যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে তাঁর সত্তা ও গুণাবলির খুঁটিনাটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ এ বিষয়ে দর্শন, যুক্তি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়েছে। যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে কেউ বলেছেন, আল্লাহর কোনো বিশেষণ থাকতে পারে না, তিনি ‘‘নির্গুণ’’। কেউ বলেছেন, তাঁর অমুক গুণ থাকতে পারে, কিন্তু তমুক গুণ থাকতে পারে না। মক্কার কাফিরগণ আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করলেও তাঁকে ‘রাহমান’ বা ‘মহা-করুণাময়’ নামে ডাকতে অস্বীকার করত। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اسْجُدُوا لِلرَّحْمَنِ قَالُوا وَمَا الرَّحْمَنُ
أَنَسْجُدُ لِمَا تَأْمُرُنَا وَزَادَهُمْ نُفُورًا
‘‘যখন তাদেরকে বলা হয় ‘সাজদাবনত হও রাহমান-এর প্রতি’, তখন তারা বলে, ‘রাহমান আবার কি? তুমি কাউকে সাজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সাজদা করব?’ এতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।’’[1]
তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত বা মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলির একত্বের বিষয়ে দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভিন্ন বিভ্রান্তির উদ্ভব ঘটে। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তাঁর এ গ্রন্থে এ জাতীয় অনেক বিভ্রান্তি আলোচনা করেছেন, যা আমরা দেখব ইনশা আল্লাহ।
[1] সূরা (২৫) ফুরকান: ৬০ আয়াত।
১. ৪. কর্ম পর্যায়ের একত্ব বা ইবাদাতের তাওহীদ
আরবীতে একে ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’ বা ‘তাওহীদুল ইবাদত’ বলা হয়। উলুহিয়্যাহ শব্দটি ‘ইলাহ’ থেকে গৃহীত। ‘‘ইলাহ’’ (إله) শব্দের অর্থ ‘‘মাবুদ’’, অর্থাৎ উপাস্য বা পূজ্য। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ আহমদ ইবনু ফারিস (৩৯৫ হি) বলেন:
اَلْهَمْزَةُ وَاللاَمُ وَالْهَاءُ أَصْلٌ وَاحِدٌ، وَهُوَ التَّعَبُّدُ.
فَالإِلهُ اللهُ تَعَالَى، وَسُمِّيَ بِذَلِكَ لأَنَّهُ مَعْبُوْدٌ
‘‘হামযা, লাম ও হা=ইলাহ: ধাতুটির একটিই মূল অর্থ, তা হলো ইবাদত করা। আল্লাহ ‘ইলাহ’ কারণ তিনি মা’বুদ বা ইবাদতকৃত।’’[1]
আরবী ভাষায় সকল পূজিত ব্যক্তি, বস্ত্ত বা দ্রব্যকেই ‘ইলাহ’ বলা হয়। এজন্য সূর্যের আরেক নাম ‘আল-ইলাহাহ’ (الإلاهة); কারণ কোনো কোনো সম্প্রদায় সূর্যের উপাসনা বা পূজা করত।[2]
[1] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাইসিল্লুগাহ ১/১২৭।
[2] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাইসিল্লুগাহ ১/১২৭; রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃ. ২১।
১. ৪. ১. ইবাদাতের পরিচয়
আমরা দেখলাম যে, উলূহিয়্যাত অর্থ ইবাদাত। ইবাদাত শব্দটি ‘আবদ’ বা ‘দাস’ শব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতে ‘উবূদিয়্যাত’ ও ‘ইবাদত’ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবূদিয়্যাত অর্থ লৌকিক বা জাগতিক দাসত্ব এবং ‘ইবাদত’ অর্থ অলৌকিক বা অপার্থিব দাসত্ব। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ রাগিব ইস্পাহানী (৫০২ হি) বলেন:
اَلْعُبُوْدِيَّةُ إِظْهَارُ التَّذَلُّلِ وَالْعِبَادَةُ أَبْلَغُ مِنْهَا
لأَنَّهَا غَايَةُ التَّذَلُّلِ وَلاَ يَسْتَحِقُّهَا إِلاَّ مَنْ لَهُ غَايَةُ
الأَفْعَالِ (الإِفْضَالِ)
‘‘‘উবূদিয়াত’ (slavery, serfdom, bondage) হলো বিনয়-ভক্তি-অসহায়ত্ব প্রকাশ করা। আর ‘ইবাদত’ (worship, veneration) এর চেয়েও অধিক গভীর অর্থজ্ঞাপক। কারণ ইবাদত হলো চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি-অসহায়ত্ব প্রকাশ, যিনি চূড়ান্ত কর্ম-ক্ষমতা বা দয়ার মালিক তিনি ছাড়া কেউ এরূপ চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।’’[1]
অন্যান্য আলিমও অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের ভাষায়:
اَلْعِبَادَةُ عَلَى الْمَعْنَى اللُّغَوِيِّ غَايَةُ التَّذَلُّلِ
وَالاِفْتِقَارِ وَالاِسْتِكَانَةِ
‘‘ইবাদাতের আভিধানিক অর্থ চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি, অসহায়ত্ব ও মুখাপেক্ষিতা।’’[2]
[1] রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃ. ৩১৯।
[2] আযীম আবাদী, আউনুল মা’বূদ ৪/২৪৭; মুবারকপূরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/২২০; মুনাবী, আব্দুর রাউফ, ফাইদুল কাদীর ৩/৫৪০।
১. ৪. ২. ইবাদাতের প্রকারভেদ
চূড়ান্ত ভক্তি প্রকাশ করে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারীর জন্য যে কর্ম করা হয় তা বিভিন্ন পর্যায়ের। কিছু কর্ম মানুষ ‘ইবাদত’ হিসেবেই করে। কোনো নাস্তিক তা করে না। শুধু ‘‘বিশ্বাসীরা-ই’’ এরূপ কর্ম করে। যে বিশ্বাসী যার মধ্যে এরূপ অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করে তাকে উদ্দেশ্য করেই এরূপ কর্ম করে। সকল সমাজের সকল ভাষার মানুষই এগুলো জানেন। পূজা, অর্চনা, বলি, কুরবানী, মানত, সাজদা, প্রার্থনা, জপ ইত্যাদি এ জাতীয় কর্ম। পাশাপাশি কিছু কর্ম আছে যা মানুষ ইবাদত হিসেবেও করে এবং জাগতিকভাবেও করে। যেমন প্রশংসা করা, ভয় করা, আনুগত্য করা ইত্যাদি। এগুলো মানুষ হিসেবে জাগতিকভাবে এক মানুষ অন্য মানুষের জন্য করে। আবার ‘মা’বূদ’ বা পূজিত সত্তার জন্যও করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রথম প্রকারের কর্ম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করাই শিরক। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য মানত, বলি, উৎসর্গ, জবাই, অলৌকিক সাহায্য প্রার্থনা ইত্যাদি করা। এগুলো কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করলে তা শিরক বলে গণ্য হবে। কারণ, কারো ভিতরে ঈশ্বরত্ব (divinity), ঐশ্বরিক ক্ষমতা, অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা, চূড়ান্ত আধিপত্য, অলৌকিক শক্তি ইত্যাদি কল্পনা না করলে কেউ তার জন্য এরূপ কর্ম করে না। আর দ্বিতীয় প্রকারের কর্ম ইবাদাত কিনা তা নির্ভর করবে কর্মকারীর উদ্দেশ্য বা চেতনার উপর। কাউকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করে চূড়ান্ত ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশের অনুভূতি নিয়ে এরূপ কর্ম করলে তা শিরক বলে গণ্য হবে। এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রাহ) বলেন:
اِعْلَمْ
أَنَّ الْعِبَادَةَ هِيَ التَّذَلُّلُ الأَقْصَى. وَكَوْنُ التَّذَلُّلِ أَقْصَى
مِنْ غَيْرِهِ لاَ يَخْلُو إِمَّا أَنْ يَكُوْنَ بِالصُّوْرَةِ- مِثُلُ كَوْنِ
هَذَا قِيَاماً وَذَلِكَ سُجُوْداً- أَوْ بِالنِّيَّةِ بِأَنْ نَوَى بِهَذَا
الْفِعْلِ تَعْظِيْمَ الْعِبَادِ لِمَوْلاَهُمْ، وَبِذَلِكَ تَعْظِيْمَ
الرَّعِيَّةِ لِلْمُلُوْكِ، أَوِ التَّلاَمِذَةِ لِلأُسْتَاذِ، لاَ ثَالِثَ
لَهُمَا.
‘‘জেনে রাখ, ইবাদত হলো চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয়। কোন্ ভক্তি-বিনয় চূড়ান্ত এবং কোন্টি চূড়ান্ত নয় তা দুভাবে জানা যায়: (১) ভক্তি-বিনয়ের প্রকার থেকে, যেমন দাঁড়িয়ে ভক্তি করা চূড়ান্ত ভক্তি নয় তবে সাজদা করা চূড়ান্ত ভক্তি এবং (২) নিয়্যাত বা উদ্দেশ্য থেকে, যেমন বান্দা হিসেবে তার মাবূদকে ভক্তি করার উদ্দেশ্যে যে ভক্তি বা বিনয় প্রকাশ করা হয় তা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। আর প্রজা হিসেবে রাজার বা ছাত্র হিসেবে শিক্ষকের ভক্তির নিয়েতে যা করা হয় তা চূড়ান্ত ভক্তি নয় বলে গণ্য। ভক্তি-বিনয় চূড়ান্ত পর্যায়ের কি না তা জানার তৃতীয় কোনো পথ নেই।’’[1]
[1] শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৭৯।
১. ৪. ৩. সকল নবীর দাওয়াত তাওহীদুল ইবাদাত
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, তাওহীদুল ইবাদাতের অর্থ সকল প্রকার ইবাদাত- যেমন প্রার্থনা, সাজদা, জবাই, উৎসর্গ, মানত, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি- একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য বলে বিশ্বাস করা। আর কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা দেখি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) ও পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল তাঁদের উম্মাতকে মূলত ‘‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’’ বা ইবাদতের একত্বের দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহর অস্তিত্বে বা আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের একত্বে বিশ্বাসের দাওয়াত তাঁদের মূল বিষয় ছিল না। কারণ রুবুবিয়্যাত বিষয়ে মূলত কোনো আপত্তি ছিল না। যুগে যুগে কাফিরদের আপত্তি, সংশয়, বিরোধ ও শিরক ছিল মূলত তাওহীদুল ইবাদত কেন্দ্রিক।[1]
এ বিশ্বের একাধিক স্রষ্টা আছেন অথবা কোনো স্রষ্টা নেই- এ ধরনের বিশ্বাস খুবই কম মানুষই করেছে বা করে। সকল যুগে সকল দেশের প্রায় সব মানুষই মূলত বিশ্বাস করেছেন এবং করেন যে, এ বিশ্বের একজনই স্রষ্টা ও প্রতিপালক রয়েছেন। কিন্তু তারা উপাসনা বা ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর সাথে ফিরিশতা, নবী, নেককার মানুষ, জিন্ন, অন্যান্য দেবদেবী, পাথর, গাছপালা, মানুষের মুর্তি, স্মৃতিবিজড়িত স্থান, দ্রব্য বা স্মৃতিচিহ্নের পূজা, উপাসনা বা ‘ভক্তি’ করেছেন। তারা ভেবেছেন যে, আল্লাহ এদেরকে কিছু দায়িত্ব বা ক্ষমতা প্রদান করেছেন অথবা এদের সাথে আল্লাহর বিশেষ সম্পর্কের কারণে এদের দাবি আল্লাহ না মেনে পারেন না, অথবা এদের মাধ্যম ছাড়া আল্লাহর বন্ধুত্ব, ক্ষমা বা করুণা লাভ সম্ভব না...।
এ বিষয়ে মোল্লা আলী কারী হানাফী (১০১৪ হি) ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় বলেন: ‘‘সকল নবী-রাসূল তো কেবল তাওহীদের বর্ণনা দিতে এবং একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের দাওয়াত দিতে আগমন করেন। এজন্যই তাঁদের সকলের কথা ও দলীল ছিল একটিই: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই)। তাঁরা তাঁদের উম্মাতদের বলেন নি যে, তোমরা বল, আল্লাহ বিদ্যমান। বরং আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই- এ কথাটি পরিস্কার ও প্রতিষ্ঠা করাই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। কারণ এ সকল জাতির মানুষেরা ধারণা করত যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরও ইবাদত করা যায়। এজন্য তারা বলত[2]: ‘‘এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপাশিকারী’’, এবং ‘‘আমরা তো কেবলমাত্র এজন্যই তাদের ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর অধিকতর নৈকট্যে দ্রুত পৌঁছে দেবেন।’’[3]
[1] দেখুন: সূরা (১৬) নাহল: ৩৬ আয়াত; সূরা (২১) আম্বিয়া: ২৫ আয়াত; সূরা (৭) আ’রাফ: ৫৯-১০৩ আয়াত; সূরা (১১) হূদ: ২৫-৯৯ আয়াত ...।
[2] সূরা (১০) ইউনুস: ১৮ আয়াত ও সূরা (৩৯) যুমার: ৩ আয়াত।
[3] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার (ইলমিয়্যাহ), পৃ. ২৪।
১. ৫. তাওহীদই কুরআনের মূল বিষয়
মোল্লা আলী কারী উল্লেখ করেছেন যে, কুরআনে প্রতিপালনের তাওহীদের উল্লেখ করা হয়েছে মূলত ইবাদাতের তাওহীদ প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য। যেহেতু আল্লাহই একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রতিপালক, কাজেই ইবাদত একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য।
সূরা ফাতিহাতে আমরা এর প্রকৃষ্ট নমুনা দেখতে পাই। আল্লাহ ‘সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর’ বলে প্রতিপালনের একত্বের কথা উল্লেখ করেছেন এবং এরপর ‘তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ বলে ইবাদতের একত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। মোল্লা কারী এ প্রসঙ্গে বলেন: ‘‘মহান আল্লাহ সূরা ফাতিহার শুরুতে বলেছেন: ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্ত যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক’। একথা দিয়ে তিনি তাওহীদুর রুবূবিয়্যাতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আল্লাহকে রবব হিসেবে এক বলে বিশ্বাস করার দাবি একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা। সার কথা এই যে, ইবাদতের তাওহীদ স্বীকার করলে স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রতিপালনের তাওহীদ স্বীকার করা হয়ে যায়। (তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ স্বীকার করার অর্থই তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ স্বীকার করা।) কিন্তু তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ স্বীকার করলে তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ স্বীকার করা হয় না। কাফিরগণ রুবুবিয়্যাতের একত্বে বিশ্বাস করত কিন্তু ইবাদতের ক্ষেত্রে শিরক করত। তাদের রুবূবিয়্যাতের একত্বে স্বীকৃতির বিষয়ে আল্লাহ বলেন: ‘‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’[1]’’ আবার তাদের ইবাদতের শিরক ও শিরকের পক্ষে তাদের দলীল বা যুক্তি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلا
لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى
‘‘আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য আউলিয়া (অভিভাবক) গ্রহণ করেছে (তারা বলে): আমরা তো এদের শুধু এজন্যই ইবাদাত করি যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে দ্রুত পেঁŠছে দেবে।[2]
কুরআনের অধিকাংশ সূরা ও আয়াতই এ দু প্রকারের তাওহীদের বর্ণনা সম্বলিত। বরং সত্যিকার বিষয় যে, কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কথাই এ দু প্রকারের তাওহীদের বিবরণ। কারণ কুরআনে কোথাও আল্লাহর সত্তা, নামসমূহ, গুণাবলি ও কার্যাদির বর্ণনা করা হয়েছে, আর এগুলি জ্ঞান ও সংবাদের তাওহীদ। আর কোথাও শির্ক-মুক্ত ভাবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে এবং আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর ইবাদত করা হয় সব কিছু বর্জন করতে আহবান করা হয়েছে। এ হলো ‘আত-তাওহীদুল ইরাদী আত-তালাবী’ বা ‘ইচ্ছাধীন নির্দেশিত একত্ব’ (ইবাদতের তাওহীদ)।’’[3]
[1] সূরা (২৯) আনকাবূত: ৬১, ৬৩ আয়াত; সূরা (৩১) লুকমান: ২৫ আয়াত; সূরা (৩৯) যুমার: ৩৮ আয়াত; সূরা (৪৩) যুখরুফ: ৯, ৮৭ আয়াত।
[2] সূরা (৩৯) যুমার: ২-৩ আয়াত।
[3] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২২-২৩।
২. আরকানুল ঈমান
এরপর ইমাম আযম বলেন: ‘‘অবশ্যই বলতে হবে: আমি ঈমান এনেছি আল্লাহে, এবং তাঁর মালাকগণে, এবং তাঁর গ্রন্থসমূহে, এবং তাঁর রাসূলগণে, এবং মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানে এবং তাকদীরে, যার ভাল এবং মন্দ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এবং হিসাব, মীযান, জান্নাত, জাহান্নাম এ সবই সত্য।’’
এখানে তিনি ঈমানের ছয়টি রুকন বা স্তম্ভের উল্লেখ করেছেন। কুরআন ও হাদীসে বিভিন্ন স্থানে ঈমানের এ ছয়টি বিষয়ের উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমরা সংক্ষেপে বিষয়গুলো আলোচনা করব:
২. ১. ঈমান বিল্লাহ বা আল্লাহে বিশ্বাস
আল-ঈমান বিল্লাহ (الإيمان بالله) বা আল্লাহে বিশ্বাস অর্থ আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাস। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَتَدْرُونَ مَا الإِيمَانُ بِاللَّهِ؟ ... شَهَادَةُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ
وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ (لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ
شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ)
‘‘তোমরা কি জান ঈমান বিল্লাহ বা আল্লাহে বিশ্বাস কী... এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর রাসূল। অন্য বর্ণনায়: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল।’’[1]
এখানে আমরা দেখছি যে, ঈমান বিল্লাহ বলতে আল্লাহর ইবাদতের একত্বে বিশ্বাস করা বুঝায়। আর এর অবিচ্ছেদ্য অংশ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের বিশ্বাস।
[1] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৯ (কিতাবুল ঈমান, বাবু আদায়িল খুমুসি মিনাল ঈমান), মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৮ (কিতাবুল ঈমান, বাবুল আমরি বিল ঈমান বিল্লাহ), তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়্যীন ১/৩৪৬; বূসীরী, ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহরাহ ১/১৩৫।
২. ২. ঈমান বিল মালাইকা: মালাকগণে বিশ্বাস
২. ২. ১. মালাকগণে বিশ্বাসের প্রকৃতি
আরবী ভাষায় ‘‘মালাক’’ শব্দকে ফার্সী ভাষায় ফিরিশতা বলা হয়। ‘মালাক’ (مَلَك) শব্দটির অর্থ পত্র, বাণী বা দূত বা আল্লাহর দূত (angel)।[1]
‘ঈমান বিল মালাইকা’ বা মালাকগণে বিশ্বাসের অর্থ তাঁদের বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসে যা বর্ণিত হয়েছে তা সরলভাবে বিশ্বাস করা। কুরআনের বর্ণনা অনুসারে আমরা বিশ্বাস করি যে, মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ অগণিত মালাইকা সৃষ্টি করেছেন, যাঁরা আল্লাহর সম্মানিত সৃষ্টি। তাঁরা মানবীয় দুর্বলতা ও কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত। তাঁরা সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার কোনো অনুভূতি তাঁদের মধ্যে নেই। সর্বদা আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর প্রশংসা ও মহত্ব বর্ণনা করা, তাঁর নির্দেশে সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করা তাঁদের কর্ম।[2] সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মালাকগণ নূর বা আলো থেকে সৃষ্ট।[3]
২. ২. ২. মালাকগণ বিষয়ক বিভ্রান্তি
ফিরিশতাগণ অদৃশ্য জগতের অংশ। তাঁদের বিষয়ে ওহীর বক্তব্য, অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের বক্তব্য আক্ষরিক ও সরল অর্থে বিশ্বাস করাই মুমিনের নাজাতের একমাত্র পথ। গাইবী বিষয়ে ওহীর সাথে কল্পনা, ধারণা, যুক্তি ইত্যাদি মিশ্রিত করে ওহীর অতিরিক্ত কিছু বলা বিভ্রান্তির পথ উন্মুক্ত করে। মালাকগণের বিষয়ে এ ধরনের কিছু বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে পূর্ববর্তী কোনো কোনো জাতি। এ জাতীয় বিভ্রান্তির একটি ছিল তাঁদেরকে আল্লাহর সন্তান বলে কল্পনা করা। আরবের মুশরিকগণ মালাকগণকে আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করত।[4]
এ জাতীয় আরেকটি বিভ্রান্তি দায়িত্বকে ক্ষমতা মনে করা। আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছেন, যেমন মৃত্যুর দায়িত্ব, বৃষ্টির দায়িত্ব, রিযকের দায়িত্ব ইত্যাদি। কিন্তু তিনি তাঁদেরকে কোনো ক্ষমতা দেন নি। এ দায়িত্বকে অতীত কালের অনেক বিভ্রান্ত সম্প্রদায় ‘ক্ষমতা’ বলে বিশ্বাস করেছে। এরপর তারা এ সকল ফিরিশতাকে ভক্তির নামে ইবাদত করেছে এবং এদের কাছে প্রার্থনা করেছে। মৃত্যুর ফিরিশতা, বৃষ্টির ফিরিশতা, রিযকের ফিরিশতা ও অন্যান্যের পূজা, ভক্তি বা আরাধনা করে তাঁদের কাছে দীর্ঘায়ূ, বৃষ্টি বা রিযক প্রার্থনা করেছেন।
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, মহান আল্লাহ মালাকদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কোনো জীবিত বা মৃত মানুষকে কোনোরূপ দায়িত্ব দিয়েছেন বলে জানান নি। কিন্তু অনেক বিভ্রান্ত জাতি তাদের মধ্যকার অনেক নবী, ওলী, ‘বীর’ ‘সাধু’ বা ‘সৎ’ মানুষকে মৃত্যুর পরে ‘মালাকগণের’ মত ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ বলে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে দাবি করেছে। এরপর তারা দায়িত্বকে ক্ষমতা বলে কল্পনা করেছে। এরপর তারা এভাবে তাদের ইবাদত, ভক্তি, অর্চনা বা পূজা করেছে ও তাদের কাছে অলৌকিক সাহায্য চেয়েছে।
ফিরিশতাগণের এরূপ ভক্তি বা পূজার অন্যতম কারণ ছিল তাঁদের শাফাআত বিষয়ক ওহীর নির্দেশনার অপব্যাখ্যা। আল্লাহ ফিরিশতাগণের দুআ, সুপারিশ বা শাফাআত কবুল করেন। কাফিরগণ ধারণা করত যে, এদের সুপারিশ ছাড়া সরাসরি আল্লাহকে ডাকলে কাজ হবে না। ভক্তি-অর্চনা করে এদেরকে খুশি করতে পারলেই এরা আমাদের জন্য দুআ করবেন। এজন্য তারা তাঁদের ইবাদত করত, অর্থাৎ তাঁদের স্মৃতি বা মৃর্তির সামনে নিজেদের চূড়ান্ত অসহায়ত্ব ও ভক্তি প্রকাশ করে সাহায্য প্রার্থনা করত, তাঁদের স্মৃতিকে চুম্বন, সাজদা, মানত ও উৎসর্গ করত। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে এ জাতীয় বিভ্রান্তি অপনোদন করা হয়েছে। আমরা ‘‘শাফাআত’’ বিষয়ক আলোচনায় তা দেখব, ইনশা আল্লাহ।
[1] খালীল ইবনু আহমাদ, কিতাবুল আইন ১/৪৪৫; জাওহারী, আস-সিহাহ ২/১৮১; ইবনুল আসীর, আন-নিহাইয়া ৪/৭৮৯; যাবীদী, তাজুল আরূস ১/৬৬৪১-৬৬৪২।
[2] দেখুন: সূরা (৭) আ’রাফ: ২০৬ আয়াত; সূরা (২১) আম্বিয়া: ২০ ও ২৬-২৮ আয়াত; সূরা (৬৬) তাহরীম: ৬ আয়াত...। বিস্তারিত দেখুন: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ২৪৩-২৫৬।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৯৪ (কিতাবুয যুহদ, বাবুন ফী আহাদীস মুতাফার্রিকা)
[4] দেখুন: সূরা (৩৭) সাফফাত: ১৪৯-১৫২ আয়াত; সূরা (৪৩) যুখরুফ: ১৯ আয়াত।
২. ৩. ঈমান বিল কুতুব: গ্রন্থসমূহে বিশ্বাস
ঈমানের অন্যতম রুকন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত গ্রন্থসমূহে বিশ্বাস করা। মুমিন সুদৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূলদের নিকট ওহীর মাধ্যমে ‘কিতাব’ প্রেরণ করেছেন, যেগুলো আল্লাহর বাণী, আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য হেদায়াত এবং মানবজাতির পথনির্দেশক নূর। তবে সেগুলো বিকৃত বা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তাই আল্লাহ সর্বশেষ কিতাব ‘আল-কুরআন’ নাযিল করেছেন পূর্ববর্তী সকল গ্রন্থের সত্যতা ঘোষণা করতে, সেগুলোর স্থান পূরণ করতে এবং পূর্ববতী সকল কিতাবের নিয়ন্ত্রক হিসেবে। এ সর্বশেষ কিতাব কুরআনের মধ্যেই সকল কিতাবের নির্যাস ও মানব জাতির মুক্তির পথ রয়েছে।
বিশেষত ইহূদী ও খৃস্টানদেরকে প্রদত্ত তিনটি গ্রন্থের বিকৃতির কথা কুরআন মাজীদে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ মূসা (আ)-কে তাওরাত, দাঊদ (আ)-কে যাবূর ও ঈসা (আ)-কে ইঞ্জিল গ্রন্থ প্রদান করেন। তাঁদের পরে তাঁদের অনুসারীরা এ গ্রন্থগুলো বিভিন্নভাবে বিকৃত করেন। কুরআনে তিন প্রকারের বিকৃতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে: (১) ওহীর মাধ্যমে পাওয়া কিছু গ্রন্থ বা বাণী একেবারে ভুলে যাওয়া বা হারিয়ে ফেলা, (২) পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজন জাতীয় বিকৃতি এবং (৩) জাল পুস্তক, আয়াত বা সূরা লিখে তা ওহীর নামে চালানো।[1]
দেড় হাজার বৎসর পূর্বে কুরআন এ সকল বিকৃতির কথা ঘোষণা করলেও বিগত প্রায় এক হাজার বৎসর যাবৎ ইহূদী-খৃস্টানগণ দাবি করতেন যে, তাদের নিকট বিদ্যমান তাওরাত, যাবূর, ইনজীল ইত্যাদি গ্রন্থ সবই আক্ষরিকভাবে বিশুদ্ধ। কিন্তু গত কয়েকশত বৎসরের গবেষণার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের ইহূদী-খৃস্টান গবেষকগণই প্রমাণ করেছেন যে, বাইবেলের অনেক পুস্তিকা হারিয়ে গিয়েছে, হাজার হাজার স্থানে পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজনের মাধ্যমে বিকৃতি করা হয়েছে এবং অনেক জাল পুস্তক এর মধ্যে সংযোজিত হয়েছে। তাদের এ আবিষ্কার কুরআনের অলৌকিক সত্যতার আরেকটি প্রমাণ।[2]
[1] সূরা (২) বাকারা: ৭৯ আয়াত; সূরা (৩) আল-ইমরান: ৭৮ আয়াত; সূরা (৫) মায়িদা: ১৩-১৪ আয়াত..
[2] বিস্তারিত দেখুন: ইসলামী আকীদা, পৃ. ২৬৩-২৭০। আরো দেখুন আল্লামা রাহমাতুল্লাহ কিরানবী, ইযহারুল হক্ক, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম; তাওরাত, যাবূর, ইঞ্জিল ও কুরআনের আলোকে কুরবানি ও জাবীহুল্লাহ।
২. ৪. ঈমান বির রুসুল: রাসূলগণে বিশ্বাস - ২. ৪. ১. নবী ও রাসূল
ঈমানের অন্যতম বিষয় আল্লাহর রাসূলগণে বিশ্বাস করা। মানুষের প্রতি মহান স্রষ্টার করুণা অসীম। তিনি তাকে তার দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও গুণাবলী দান করা ছাড়াও তাকে মঙ্গলের পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন সমাজের মধ্যে থেকে বিভিন্ন মানুষকে বেছে নিয়ে তাঁদের কাছে ওহীর মাধ্যমে সঠিক পথের সন্ধান দান করেছেন। আল্লাহর মনোনীত এসকল মানুষকে ইসলামের পরিভাষায় নবী বা রাসূল বলা হয়। ‘নবী’ (النبيّ) অর্থ সংবাদদাতা এবং রাসূল (الرسول) অর্থ প্রেরিত বা দূত। আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী লাভ করে যারা মানুষদেরকে আল্লাহর পথের নির্দেশনা দেন তাঁদেরকে নবী ও রাসূল বলা হয়।
অর্থের দিক থেকে দুটি শব্দ প্রায় সমার্থক। শব্দদ্বয়ের মধ্যে শরীয়তের পরিভাষায় কোনো পার্থক্য আছে কি না সে বিষয়ে কুরআন বা হাদীসে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। আলিমগণ কুরআন ও হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশনার আলোকে ইজতিহাদ ও মতভেদ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মোল্লা আলী কারী (রাহ) বলেন:
اَلرَّسُوْلُ مَنْ أُمِرَ بِالتَّبْلِيْغِ، وَالنَّبِيُّ مَنْ أُوْحِي إِلَيْهِ،
أَعَمُّ مِنْ أَنْ يُؤمَرَ بِالتَّبْلِيْغِ أَمْ لاَ. قَالَ الْقَاضِيْ عِيَاضٌ:
وَالصَّحِيْحُ الَّذِيْ عَلَيْهِ الْجُمْهُوْرُ أَنَّ كُلَّ رَسُوْلٍ نَبِيٌّ مِنْ
غَيْرِ عَكْسٍ. وَهُوَ أَقْرَبُ مِنْ نَقْلِ غَيْرِهِ الإِجْمَاعَ عَلَيْهِ،
لِنَقْلِ غَيْرِ وَاحِدٍ الْخِلاَفَ فِيْهِ، فَقِيْلَ: النَّبِيُّ مُخْتَصٌّ
بِمَنْ لاَ يُؤْمَرُ، وَقِيْلَ هُمَا مُتَرَادِفَانِ، وَاخْتَارَهُ ابْنُ
الْهُمَامِ، وَالأظْهَرُ أَنَّهُمَا مُتَغَايِرَانِ...
‘‘যাকে প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তিনি রাসূল। আর যাকে ওহী দেওয়া হয়েছে তিনিই নবী, তাঁকে প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হোক বা না হোক। কাযি ইয়ায বলেন: অধিকাংশ আলিম একমত যে, সকল রাসূলই নবী, তবে সকল নবীই রাসূল নন। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন যে, আলিমগণ এ বিষয়ে ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কাযি ইয়াযের বর্ণনাটিই সঠিক, অর্থাৎ এ বিষয়ে সকল আলিম একমত পোষণ করেন নি, বরং অধিকাংশ আলিম একমত পোষণ করেছেন। কারণ একাধিক আলিম এ বিষয়ে মতভেদ উল্লেখ করেছেন। কেউ বলেছেন, যাকে প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয় নি তাঁকেই শুধু নবী বলা হয়। কেউ বলেছেন: নবী ও রাসূল দুটি একার্থবোধক শব্দ; উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ইবনুল হুমাম এ মতটি গ্রহণ করেছেন। সঠিকতর মত যে, উভয় পরিভাষার মধ্যে পার্থক্য আছে...।’’[1]
এভাবে আমরা দেখছি যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী প্রাপ্ত প্রত্যেক মানুষকেই নবী বলা হয়। যদি কোনো ওহী-প্রাপ্ত মানুষকে আল্লাহ নতুন বিধান দান করেন ও তা প্রচারের নির্দেশ দান করেন তবে তাঁকে রাসূল বলা হয়। আর যদি তাঁকে শুধু ওহীর মাধ্যমে, আল্লাহর বাণী দান করা হয়, নতুন কোনো বিধান প্রচারের দায়িত্ব্ দেওয়া না হয় তবে তিনি রাসূল নন, কেবল নবী বলে আখ্যায়িত হন।
[1] মোল্লা আলী ক্বারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১০৬।
২. ৪. ২. নবী-রাসূলগণের সংখ্যা
কুরআনের বর্ণনা অনুসারে আমরা জানতে পারি যে, মহান আল্লাহ সকল যুগে সকল সমাজেই নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন:
وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلا خَلا فِيهَا نَذِيرٌ
‘‘প্রত্যেক জাতিতেই সর্তককারী প্রেরণ করা হয়েছে।’’[1]
এ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তবে তাঁদের সংখ্যা কত ছিল তা কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। এ বিষয়ে কোনো প্রসিদ্ধ গ্রন্থে কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। মুসনাদ আহমদ, মুসনাদ আবী ইয়ালা মাওসিলী, সহীহ ইবন হিব্বান ইত্যাদি গ্রন্থে বিভিন্ন সনদে সংকলিত কয়েকটি হাদীসে এ বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীগণের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার। অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে নবীগণের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার। অন্য হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবীগণের সংখ্যা এক হাজার বা তার বেশি ছিল। একাধিক হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলগণের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন বা ৩১৫ জন। এ সকল হাদীসের অধিকাংশই দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থে এ সকল হাদীসের সনদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সামগ্রিক বিচারে একাধিক সনদের কারণে কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসগুলিকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।[2]
যেহেতু এ হাদীসগুলো ‘খবর ওয়াহিদ’ পর্যায়ের, বিশেষত এগুলোর সনদে দুর্বলতা রয়েছে, সেহেতু এ বিষয়ে সুনিশ্চিত কিছু না বলাই উত্তম বলে মত প্রকাশ করেছেন কোনোকোনো আলিম। ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী বলেন: ‘‘বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নবীগণের সংখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন: ১ লক্ষ ২৪ হাজার। কোনো কোনো বর্ণনায়: ২ লক্ষ ২৪ হাজার। তবে তাঁদের বিষয়ে কোনো সংখ্যা নির্ধারণ না করাই উত্তম।’’[3]
তিনি আরো বলেন: ‘‘উত্তম হলো নবীগণের সংখ্যা নির্ধারিত সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা; কারন ‘খাবারুল ওয়াহিদ’ পর্যায়ের হাদীসের উপরে আকীদার বিষয়ে নির্ভর করা যায় না। বরং জরুরী হলো আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবে সাধারণভাবে নবী-রাসূলগণের উপর ঈমান আনা ... ফিরিশতাগণের সংখ্যা, কিতাবসমূহের সংখ্যা, নবীগণের সংখ্যা, রাসূলগণের সংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে মনোনিবেশ না করা।’’[4]
[1] সূরা (৩৫) ফাতির: ২৪ আয়াত।
[2] আলবানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন, সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ ৬/৩৫৮-৩৬৯।
[3] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ৯৯-১০০।
[4] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১০১।
২. ৪. ৩. নবী-রাসূলগণের নাম
কুরআনে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে: আদম, ইদরীস, নূহ, হুদ, সালিহ, ইবরাহীম, লূত, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, ইউসূফ, আইয়ূব, শুয়াইব, মূসা, হারূন, ইউনূস, দাউদ, সুলাইমান, ইল্ইয়াস, ইল্ইয়াসা’, যুলকিফল, যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ঈসা, মুহাম্মাদ (عليهم الصلاة والسلام)।[1]
উযাইরকে ইহূদীগণ আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করত।[2] কিন্তু কুরআনে তাঁর নবুয়ত সম্পর্কে কিছুই বলা হয় নি। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَا أَدْرِيْ أعُزَيْرٌ نَبِيُّ هُوَ أَمْ لاَ
‘‘আমি জানি না যে, উযাইর নবী ছিলেন কি না।’’[3]
মূসা (আ)-এর খাদিম হিসাবে ইউশা ইবনু নূন-এর নাম হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত কোনো সহীহ হাদীসে অন্য কোনো নবীর নাম উল্লেখ করা হয় নি। কোনো কোনো যয়ীফ হাদীসে আদম (&আ) এর পুত্র ‘‘শীস’’-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন-হাদীস থেকে অন্য কোনো নবীর নাম জানা যায় না।
কুরআন কারীমে উল্লিখিত নবী-রাসূলগণকে আমরা নির্দিষ্টভাবে আল্লাহর মনোনীত নবী হিসেবে বিশ্বাস করি। তাঁদের সবাইকে আমরা ভালবাসি ও শ্রদ্ধা করি। আমরা বিশ্বাস করি যে, তারা সবাই নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পবিত্র মানুষ ছিলেন। তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করেছেন। তাঁরা সবাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী ছিলেন। এঁদের নবুয়ত বা রিসালত আমরা অস্বীকার করি না। কেউ যদি এঁদের কারো নবুয়ত বা রিসালাত অস্বীকার করে অথবা এঁদের অবমাননা করে তবে সে অবিশ্বাসী বা কাফির বলে গণ্য হবে।
কুরআন-হাদীসে যাদেরকে নবী হিসেবে উল্লেখ করা হয় নি তাদের কাউকে আমরা নির্দিষ্টরূপে আল্লাহর মনোনীত নবী বলতে পারি না। অন্য কোনো মানুষের সম্পর্কেই আমরা বলতে পারি না যে, তিনি আল্লাহর নবী ছিলেন। তবে আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ যুগে যুগে আরো অনেক নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন, যারা আল্লাহর মনোনীত প্রিয় পুত-পবিত্র, নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী বান্দা ছিলেন। তাঁরা তাঁদের প্রতি প্রদত্ত দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন। তাঁদের নাম বা বিবরণ আমরা জানি না।
[1] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৬; কুরতুবী, তাফসীর, ৩/৩১।
[2] সূরা ৯: তাওবা, আয়াত ৩০।
[3] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/২১৮ (কিতাবুস সুন্নাহ, বাবুত তাখয়ীর বাইনাল আম্বিয়া, ভারতীয় ছাপা, পৃ. ৬৪২); আযীম আবাদী, আউনুল মা’বুদ ১২/২৮০। হাদীসটির সনদ সহীহ।
২. ৪. ৪. আল্লাহর বান্দা, মানুষ ও পুরুষ
পূর্ববর্তী নবীগণের নুবুওয়াত অস্বীকার করার ক্ষেত্রে কাফিরগণের বড় ‘দলিল’ ছিল যে, নবীগণ তাদের মতই মানুষ, কাজেই তাঁরা নবী হতে পারেন না।[1] অপরদিকে কোনো কোনো বিভ্রান্ত সম্প্রদায় তাদের নবীদের মুজিযাকে ‘‘অলৌকিক ক্ষমতা’’ বলে মনে করে তাঁদের ইবাদত করেছে এবং আল্লাহর বিশেষ বান্দা হিসেবে তাঁদেরকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলে আখ্যায়িত করেছে।[2] কুরআনে এ সকল বিভ্রান্তি অপনোদন করে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবীগণ অন্য সকল মানুষের মতই আল্লাহর বান্দা ও মানুষ ছিলেন।[3] তাঁরা সকলেই পুরুষ ছিলেন।[4] তাঁরা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ও ওহীপ্রাপ্ত মানুষ ছিলেন। তাঁরা কোনো ‘অলৌকিক ক্ষমতা’র অধিকারী ছিলেন না। আল্লাহর নির্দেশ ও ইচ্ছার বাইরে কোনো অলৌকিক নিদর্শন বা মুজিযা দেখানোর কোনো ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। তাঁদের মর্যাদা আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা ও রাসূল হওয়ায়; আল্লাহর ক্ষমতা, গুণাবলি বা ইবাদত পাওয়ার বিষয়ে আল্লাহর শরীক হওয়ায় নয়।[5]
[1] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১০, ১১ আয়াত; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৩, ৭ আয়াত; সূরা (২৩) মুমিনূন: ২৪ আয়াত।
[2] সূরা (৯) তাওবা: ৩০ আয়াত।
[3] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১০, ১১ আয়াত; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৩, ৭; সূরা (২৩) মুমিনূন: ২৪ আয়াত।
[4] সূরা (১২) ইউসুফ: ১০৯ আয়াত; সূরা (১৬) নাহল: ৪৩ আয়াত; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৭ আয়াত।
[5] সূরা: (৩) আল-ইমরান: ১৪৪; (৫) মায়িদা: ৭৫; (৬) আনআম: ৫৭-৫৮, ৯১; (১৩) রা’দ: ৩৮; (১৪) ইবরাহীম: ১০-১১; (১৭) বানী ইসরাঈল: ৯৩; (২১) আম্বিয়া: ৩; (২৩) মুমিনূন: ২৪, ৩৩; সূরা (২৫) ফুরকান: ২০; (২৬) শুআরা: ১৫৪, ১৫৬; (৩৬) ইয়াসীন: ১৫; (৬০) মুমতাহিনা: ৪ আয়াত।
২. ৪. ৫. সকল নবী-রাসূলের দা‘ওয়াত এক
নবী-রাসূলগণের দা’ওয়াত বা প্রচারের বিষয় মূলত এক ছিল। তাঁরা সবাই মানুষদেরকে তাওহীদ বা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে আহবান করেছেন এবং আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করতে নিষেধ করেছেন। মানুষদেরকে দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর শেখানো পথে চলতে এবং সকল মানুষের জন্য কল্যাণময় সামাজিক জীবনে বাস করতে পথ নির্দেশ দিয়েছেন। যে বিশ্বাস, কর্ম বা আচরণ মানুষের অকল্যাণ করে বা আল্লাহর প্রেম থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে তা থেকে তাঁরা মানুষদেরকে নিষেধ করেছেন। তাঁদের মূল দাওয়াত ও ধর্ম ছিল এক ও অভিন্ন ইসলাম, তবে তাঁদের শরীয়াত বা বিধানাবলী ছিল যুগ ও সমাজ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন। মানুষদেরকে কল্যাণের পথে আহবান করা বা পথের নির্দেশ দেওয়াই ছিল তাঁদের দায়িত্ব। তাঁদের আহবানে সাড়া দেওয়া বা না দেওয়া ছিল মানুষের এখতিয়ার।[1]
[1] সূরা (৬) আনআম: ৪৮-৪৯ আয়াত ; সূরা (২১) আম্বিয়া: ২৫ আয়াত; সূরা (৪২) শুরা: ১৩ আয়াত; সূরা (১৬) নাহল: ৩৬ আয়াত।
২. ৪. ৬. বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার সমতা বনাম মর্যাদার পার্থক্য
সকল নবী-রাসূল আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তাঁরা সকলেই পাপ থেকে সংরক্ষিত ছিলেন। আল্লাহ তাঁদেরকে অলৌকিক চিহ্ন বা মুজিযা দিয়ে সাহায্য করেন। সকলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা মুমিনের ঈমানের অংশ। বিশ্বাস, ভালবাসা ও ভক্তির দিক থেকে সকল নবীর অধিকার সমান। মুমিনগণ নবীগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন না। আল্লাহ বলেন:
آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ
آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ
أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ
‘‘রাসূল তার প্রতি তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে এবং মুমিনগণও। তাদের সকলে আল্লাহে, তাঁর মালাকগণে, তাঁর কিতাবসমূহে এবং তাঁর রাসূলগণে ঈমান এনেছে। (তারা বলে): ‘আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না।’[1]
বিশ্বাস, ভক্তি ও ভালবাসার ক্ষেত্রে সাম্যের পাশাপাশি নবী-রাসূলগণের মধ্যে কারো মর্যাদা কারো চেয়ে বেশি। মহান আল্লাহ বলেন:
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ
اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ
‘‘এ রাসূলগণ, তাদের মধ্যে কতককে আমি কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাদের মধ্যে এমন কেউ রয়েছে যার সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন, আবার কাউকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন।’’[2]
এভাবে আমরা সকল নবীকে সমান সম্মানের সাথে বিশ্বাস করি। আরো বিশ্বাস করি যে, তাঁদের মধ্যে কারো মর্যাদা আল্লাহর কাছে অন্যদের চেয়ে বেশি। আর সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)।
[1] সূরা (২) বাকারা: ২৮৫ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (২) বাকারা ১৩৬ আয়াত ও সূরা (৩) আল-ইমরান ৮৪ আয়াত।
[2] সূরা (২) বাকারা: ২৫৩ আয়াত।
২. ৪. ৭. মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতে বিশ্বাস
রাসূলগণে বিশ্বাসের অন্যতম বিষয় মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নুবুওয়াত ও রিসালাতে বিশ্বাস করা। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, ‘‘ঈমান বিল্লাহ’’-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। এখানে দুটি বিষয়ের বিশ্বাস ও সাক্ষ্য রয়েছে:
২. ৪. ৭. ১. মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা
যুগে যুগে মানুষের শিরকে নিপতিত হওয়ার মূল কারণ ছিল ফিরিশতা, রাসূল বা নেককার মানুষদের বিষয়ে অতিভক্তি বশত তাঁদের মধ্যে ‘‘ঈশ্বরত্ব’’ বা ‘‘অলৌকিকত্ব’’ কল্পনা করে তাঁদের বা তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান বা বস্ত্তর ইবাদত করা।
সৃষ্টির মধ্যে ‘‘ইশ্বরত্ব’’ কল্পনার প্রধান দুটি দিক: প্রথমত, সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার বিশেষ সম্পর্ক দাবী করা। তাকে ইশ্বরের সন্তান বা বংশধর বলে দাবী করা। দ্বিতীয়ত, অবতারত্ব (Incarnation) দাবী, অর্থাৎ অমুকের মধ্যে স্র্ষ্টা বা তাঁর কোন শক্তি মিশে গিয়েছে বা স্রষ্টার সাথে তার ফানা বা মিলন হয়েছে। এ ধরনের শিরকের মূলোৎপাটন করতে ইসলামী ঈমানের মধ্যে ‘‘মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূুলূহু’’ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ‘‘আব্দ’’ শব্দের ফার্সী অর্থ ‘‘বান্দা’’, যা বাংলায় বহুল প্রচলিত। এর বাংলা অর্থ: ‘‘দাস’’ বা ‘‘চাকর’’ (slave, bondsman, serf)। কুরআন ও হাদীসে ‘‘আল্লাহর বান্দা’’ বলতে আল্লাহর সৃষ্ট মানুষ (servant of God, man, human being) বুঝানো হয়।
মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর আবদ, বান্দা বা দাস হিসেবে বিশ্বাস করার অর্থ তিনি আল্লাহর মাখলূক, বান্দা ও মানুষ। তিনি তাঁর মহোত্তম ও তাঁর প্রিয়তম সৃষ্টি। সর্বাবস্থায় তিনি তাঁর বান্দা, দাস ও মানুষ। তিনি স্রষ্টার অবতার নন, পুত্র নন, তাঁর যাত (সত্তা) বা সিফাত (বিশেষণ)-এর অংশ নন, আল্লাহর রুবুবিয়্যাত (প্রতিপালন) ও উলূহিয়্যাত (ইবাদত) এর কোনো ক্ষমতা, দায়িত্ব বা অধিকার-এর অংশীদার নন। তিনি আল্লাহর সৃষ্ট মাখলূক বান্দা। তাঁর মর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব শ্রেষ্ঠতম ও প্রিয়তম বান্দা ও উপাসক হিসাবে, পুত্র, সন্তান বা অংশীদার হিসেবে নয়। তাঁকে পরিপূর্ণ ভক্তি, ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা প্রদানের সাথে সাথে সকল প্রকার শিরক মূলক বাড়াবাড়ি ও অতিভক্তি থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করার জন্য এ বিশ্বাস রক্ষাকবজ।[1]
২. ৪. ৭. ২. মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল
কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন নির্দেশনার আলোকে আমরা জানি যে, নিম্নের বিষয়গুলো এ সাক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত:
১. মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর মনোনীত নবী ও রাসূল।
২. তিনি আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাঁর পরে আর কোনো ওহী নাযিল হবে না, কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না।
৩. তিনি বিশ্বের সকল দেশের সকল জাতির সব মানুষের জন্য আল্লাহর মনোনীত রাসূল। তাঁর আগমনের দ্বারা পূর্ববর্তী সকল ধর্ম রহিত হয়েছে। তাঁর রিসালাতে বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো মানুষই মুক্তি পাবে না।
৪. তিনি পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বজনীন নবী ও রাসূল হিসাবে তাঁর নবুয়তের ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহর সকল বাণী, শিক্ষা ও নির্দেশ তিনি পরিপূর্ণভাবে তাঁর উম্মতকে শিখিয়ে গিয়েছেন, কোন কিছুই তিনি গোপন করেন নি।
৫. তাঁর সকল শিক্ষা ও সকল কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য।
৬. আল্লাহর ইবাদত করতে ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে অবশ্যই মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শিক্ষা ও রীতি অনুসরণ করতে হবে। তাঁর শিক্ষা বা সুন্নাতের বাইরে ইবাদত করলে তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।
৭. জীবনের সকল ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে তাঁর আনুগত্য করতে হবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষা, বিধান ও নির্দেশ সর্বান্তঃকরণে ও দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিতে হবে। নিজের ও সকল মানুষের মতের উর্দ্ধে তাঁর কথাকে স্থান দিতে হবে। আভ্যন্তরীণ সকল মতভেদ তাঁর নির্দেশ ও সুন্নাত অনুসারে নিষ্পত্তি করতে হবে।
৯. জীবনের সকল পর্যায়ে তাঁর অনুকরণ করতে হবে। তাঁর সুন্নাত বা রীতিই মুসলিমের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ বলে বিশ্বাস করতে হবে।
১০. তাঁকে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করতে হবে। তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, মানবজাতির নেতা, নবী-রাসূলদের প্রধান। তিনি আল্লাহর সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রিয়মত বান্দা। তিনি নিষ্পাপ। নবুয়ত প্রাপ্তির আগে ও পরে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাঁকে সকল পাপ, অন্যায় ও অপরাধ থেকে রক্ষা করেছেন। প্রথম মানব আদম (আ)-এর সৃষ্টির সময়েই আল্লাহ তাঁকে সর্বশেষ নবী হিসাবে মনোনীত করেছেন। তিনি আল্লাহর বান্দা, দাস ও মানুষ ছিলেন। তবে মহান আল্লাহ তাঁকে অগণিত অলৌকিক বৈশিষ্ট দান করেছেন, যা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
১১. তাঁর মর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা। তাঁর ব্যাপারে কুরআন মাজীদ বা সহীহ হাদীসে যা বলা হয়েছে তা সবকিছু পরিপূর্ণভাবে সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করা। নিজের থেকে কোন কিছু বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলা বা ব্যাখ্যা করে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন থেকে বিরত থাকা।
১২. মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে ভালবাসা। তাঁর সাহাবীগণ ও বংশধরকে ভালবাসা এবং তাঁর পরিপূর্ণ অনুসারী উম্মাতের নেককার মানুষদের ভালবাসাও তাঁর ভালবাসার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ভালবাসা মুখের দাবীর ব্যাপার নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাত অনুসরণ ও তাঁর আদেশ-নিষেধ হুবহু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করাই তাঁর মহববতের প্রকাশ ও মহববত অর্জন ও বৃদ্ধির একমাত্র পথ।[2]
এ বিষয়ক কিছু কথা ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যা আমরা পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে দেখব, ইনশা আল্লাহ।
[1] দেখুন: সূরা (৩) আল-ইমরান: ১২৮ আয়াত; সূরা (৭) আ’রাফ: ১৮৮ আয়াত; সূরা (৯) তাওবা: ৮০ আয়াত; সূরা (১০) ইউনূস: ৪৯ আয়াত; সূরা (১৬) নাহাল: ৩৭ আয়াত; সূরা (১৭) বনী ইসরাঈল: ৯০-৯৫ আয়াত; সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০ আয়াত; সূরা (২৮) কাসাস: ৫৬ আয়াত; সূরা (৪১) হা- মীম (ফুসসিলাত): ৬ আয়াত; সূরা (৪৬) আহকাফ: ৯ আয়াত; সূরা (৭২) জিন: ২১ আয়াত।
[2] বিস্তারিত দেখুন: খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ১৩৫-২৪০।
২. ৫. ঈমান বিল আখিরাহ: আখিরাতে বিশ্বাস
মহান আল্লাহ বলেন:
مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآَخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ
أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ
‘‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে এবং সৎকাজ করে তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকট। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’’[1]
কুরআন ও হাদীসে পরকালে বিশ্বাসকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, স্রষ্টায় বিশ্বাস সকল মানুষের মধ্যে সর্বজনীন বিশ্বাস, যা মানুষের জন্মগত অনুভূতির অংশ। পরকালে বিশ্বাস ছাড়া স্রষ্টার প্রতি এ বিশ্বাস অর্থহীন হয়ে যায়। এ অর্থহীন বিশ্বাস ছিল মক্কার কাফিরদের মধ্যে। মক্কার কাফিরেরা ঈমানের অন্যান্য কিছু বিষয় বিকৃতভাবে বিশ্বাস করলেও তাদের মধ্যে অনেকেই পরকালে বা পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করত না এবং অনেকে অস্পষ্টভাবে কিছু ধারণা পোষণ করত। কুরআনে কাফিরদের এ বিভ্রান্তি খন্ডন করা হয়েছে এবং আখিরাতে বিশ্বাসের আবশ্যকতা, যৌক্তিকতা ও গুরুত্ব বারবার আলোচনা করা হয়েছে। অনুরূপভাবে আখিরাতের বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনা করা হয়েছে।
কুরআনের আলোকে আমরা দেখি যে, আল্লাহে বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ পরকালীন জীবনে বিশ্বাস। কুরআনে ঈমানের নির্দেশনা জ্ঞাপক আয়াতগুলোতে সর্বদা ‘আখিরাত’ বা ‘শেষ দিবসে’ ঈমান আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআনের যে কোনো পাঠক বুঝতে পারেন যে, দুটি বিষয়কে এতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে: (১) আল্লাহর ইবাদতের একত্ব এবং (২) আখিরাতে বিশ্বাস। কুরআনের এমন একটি পৃষ্ঠাও পাওয়া কষ্ট যে পৃষ্ঠাতে আখিরাতের কোনো না কোনো বর্ণনা নেই।
বিশ্বাসী মানুষের কঠিনতম পদস্খলন ও বিভ্রান্তির দুটি পথ: (১) শির্কে নিপতিত হওয়া এবং (২) আখিরাত সম্পর্কে অসচেতনতা। অনেক সময় বিশ্বাসী মানুষও পার্থিব বিষয়াদি নিয়ে অতি-ব্যস্ততা, অসচেতনতা বা শয়তানী প্ররোচনার কারণে আখিরাত সম্পর্কে অসচেতন হন বা অবজ্ঞা করতে থাকেন। এ ভয়ঙ্করতম পদস্খলন থেকে মুমিনকে রক্ষা করার জন্য সদা-সর্বদা আখিরাতের স্মরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাওহীদুল ইবাদাত ও আখিরাতের বিষয়ে কুরআনের বিশেষ গুরুত্বপ্রদানের এ হলো একটি কারণ।
পরকাল বা আখিরাতে ঈমানের অর্থ হলো, মৃত্যুর পরে কি ঘটবে সে বিষয়ে পবিত্র কুরআনে এবং সহীহ হাদীসে যা কিছু বর্ণনা আছে তা সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করা। যেমন কবরের প্রশ্ন, পুরস্কার ও শাস্তি, কিয়ামতের আলামত বা পূর্বাভাসসমূহ, কিয়ামত বা পুনরুত্থান, শেষ বিচার, আমলনামা প্রদান, আল্লাহর মীযান ও মানুষের কর্ম ওযন করা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাউয, জাহান্নামের উপর সেতু, শাফায়াত, জান্নাত, জাহান্নাম, জান্নাতের নিয়ামত, জাহান্নামের শাস্তি, আল্লাহর দর্শন ইত্যাদি। এ সকল বিষয় বিশ্বাস করা ঈমানের অন্যতম রুকন।[2] এ জাতীয় কিছু বিষয় ইমাম আবূ হানীফা পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে উল্লেখ করবেন।
[1] সূরা (২) বাকারা: ৬২ আয়াত।
[2] বিস্তারিত দেখুন: খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা ৩১০-৩৩৯।
২. ৬. ঈমান বিল কাদর: তাকদীরে বিশ্বাস
২. ৬. ১. তাকদীরে বিশ্বাসের প্রকৃতি
‘কাদ্র’ ও ‘কাদার’ (القَدْرُ والقَدَرُ) শব্দ পরিমাপ, পরিমাণ, মর্যাদা, শক্তি ইত্যাদি বুঝায়। তাকদীর অর্থ পরিমাপ করা, নির্ধারণ করা, সীমা নির্ণয় করা ইত্যাদি।[1] ‘ঈমান বিল কাদার’ (الإيمان بالقَدَر) অর্থ আল্লাহর অনাদি, অনন্ত ও সর্বব্যাপী জ্ঞান, তাঁর ইচ্ছা এবং তাঁর নির্ধারণ বা তাক্দীরে বিশ্বাস করা। এ বিশ্বের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টির জন্য যে সুশৃঙ্খল নিয়ম, কার্যপ্রণালী বা ব্যবস্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাকেই তাক্বদীর বলা হয়। আমরা বিশ্বাস করি যে, এ বিশ্বের ভাল মন্দ, আনন্দ বা কষ্টের যা কিছু ঘটে তা সবই আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারে। তাঁর জ্ঞান ও ইচ্ছার বাইরে কিছুই সংঘটিত হয় না। সবকিছুই আল্লাহ নির্ধারিত ‘পরিমাপ’ বা ‘ক্বাদার’-এর মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ
‘‘আমি প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।’’[2]
ইসলামী ‘‘ঈমান বিল কাদার’’ বা ‘‘তাকদীরে বিশ্বাস’’ বলতে নিম্নের ৫টি বিষয় বিশ্বাস করা বুঝায়:
(১) আল্লাহর অনাদি, অনন্ত ও সর্বব্যাপী জ্ঞানে বিশ্বাস
মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ সর্বজ্ঞ। কোনো সৃষ্টির জ্ঞানের সাথে আল্লাহর জ্ঞানের তুলনা হয় না। সৃষ্টির আগেই তিনি বিশ্বের সকল বিষয় কোথায় কিভাবে সংঘটিত হবে সবই জানেন। তাঁর জ্ঞানের কোনো পরিবর্তন নেই।
(২) আল্লাহর লিখনে বিশ্বাস
কুরআন-হাদীসের নির্দেশে মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তাঁর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও সর্বব্যাপী জ্ঞান ‘কিতাবে মুবীন’ (সুস্পষ্ট কিতাব) বা ‘লাওহে মাহফুজে’ (সংরক্ষিত পত্রে) লিখে রেখেছেন। লিখনের প্রকৃতি আমরা জানি না।
(৩) আল্লাহর ইচ্ছায় বিশ্বাস
কুরআন ও হাদীসের নির্দেশে আমরা বিশ্বাস করি যে, এ মহাবিশ্বে যা কিছু সংঘটিত হয় তা সবই আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাঁর জ্ঞানে। তাঁর ইচ্ছা ও জ্ঞানের বাইরে এ মহাবিশ্বের কোথাও সামান্যতম কোনো ঘটনাও ঘটে না।
(৪) আল্লাহর সৃষ্টিতে বিশ্বাস
মুমিন বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বের সবকিছুর স্রষ্টা আল্লাহ। তিনি ছাড়া সবই সৃষ্ট। মানুষের কর্মও আল্লাহ সৃষ্টি করেন।
(৫) মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মফলে বিশ্বাস
মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, ইচ্ছাধীন কর্ম ও কর্মফলের বিশ্বাসের উপরেই ইসলামের সকল বিধি-বিধানের ভিত্তি। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছায় যে কর্ম করে সে শুধু তারই প্রতিফল লাভ করে। কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুমিন বিশ্বাস করেন যে, মানুষকে আল্লাহ বিবেক, বিচার শক্তি ও জ্ঞান দান করেছেন। মানুষ তার নিজ ইচ্ছায় কর্ম করে। তবে তার কর্ম আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারে সংঘটিত হয়। কুরআনে মহান আল্লাহ জানিয়েছেন যে, তিনি মানুষকে তার স্বাধীন ইচ্ছা, বিবেক ও বিচারবুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই সে তার বিচারবুদ্ধি দিয়ে যে কর্ম করবে তার ফল ভোগ করবে।
উপরের ৫টি বিষয়ই কুরআন ও হাদীসে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তাকদীরে বিশ্বাসের বিভিন্ন দিক এ গ্রন্থে কয়েক স্থানে আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গত আমরা তা ব্যাখ্যা করব ইনশা আল্লাহ।[3]
[1] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ ৫/৬২।
[2] সূরা (৫৪) কামার: ৪৯ আয়াত।
[3] তাকদীর বিষয়ক আলোচনা দেখুন: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ.৩৪০-৩৪৫।
২. ৬. ২. তাকদীরে বিশ্বাসের অর্থ
তাকদীরে বিশ্বাস অর্থ আল্লাহর জ্ঞান ও আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা উভয় বিশেষণে সমানভাবে বিশ্বাস করা। আল্লাহর নির্ধারণে অবিশ্বাস করলে আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতায় অবিশ্বাস করা হয়। আর মানুষের স্বাধীন ইচ্ছায় অবিশ্বাস করলে আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা ও করুণায় অবিশ্বাস করা হয়। এ অবিশ্বাসের শুরু মহান আল্লাহর বিশেষণ ও কর্মকে মানুষের বিশেষণ বা কর্মের মত বলে বিশ্বাস করা থেকে। আল্লাহর সকল বিশেষণ সমানভাবে প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস করলে এ বিষয়ে কোনো অস্পষ্টতা থাকে না।
সম্ভবত একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বুঝানো যাবে। আল্লাহর নির্ধারণ যে, বিষ মৃত্যু আনে। মানুষকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন যে, বিষ মৃত্যু আনে। এরপরও কেউ বিষ পান করলে সে মৃত্যু বরণ করবে। তবে তা আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞান অনুসারে ঘটবে। আল্লাহ তাঁর অনন্ত জ্ঞানে জানেন যে, নির্দিষ্ট ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ে স্বেচ্ছায়, বাধ্য হয়ে, জেনে বা না-জেনে বিষ পান করবে। তিনি তাঁর এ জ্ঞান লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি ইচ্ছা করলে ঐ ব্যক্তির ইচ্ছা শক্তি হরণ করে তাকে বিষপান থেকে বিরত রাখতে পারেন বা বিষের ক্রিয়া নষ্ট করে বিষপানকারীকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করতে পারেন। আল্লাহর জ্ঞান, লিখনি বা তাকদীর অনুসারে বিষপানকারীর মৃত্যু আসবে অথবা আসবে না। বিষপানকারী বিষপানে তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা ও কর্ম অনুসারে পাপ বা পুণ্য লাভ করবে।
২. ৬. ৩. তাকদীরের বিশ্বাসের বিকৃতি
গাইবী বিষয়ে ওহীর শিক্ষাকে সরল অর্থে বিশ্বাস না করে যুক্তি, তর্ক, ব্যক্তিগত অভিমত ইত্যাদির আলোকে বিচার, গ্রহণ, সংযোজন ইত্যাদি করা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির মূল কারণ। মক্কার কাফিরগণ তাকদীর বিষয়ে এরূপ কিছু বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত ছিল। আল্লাহ বলেন:
سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلا
آَبَاؤُنَا وَلا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ
قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ
فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلا
تَخْرُصُونَ قُلْ فَلِلَّهِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُ فَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ
أَجْمَعِينَ
‘‘যারা শিরক করেছে তারা বলবে, ‘আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন তবে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষগণ শির্ক করতাম না।’ এ-ভাবে তাদের পূর্ববতীগণও কুফরী করেছিল, অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিল। বল, ‘তোমাদের নিকট কি কোনো ‘ইলম’ আছে? থাকলে আমার নিকট তা পেশ কর; তোমরা শুধু ধারণারই অনুসরণ কর এবং শুধু মিথ্যাই বল। বল, ‘চুড়ান্ত প্রমাণ তো আল্লাহরই; তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে সৎ পথে পরিচালিত করতেন।’’[1]
এখানে কাফিরগণ বলেছে: ‘‘আল্লাহ চাইলে আমরা এরূপ করতাম না’’। এ কথা দ্বারা তারা বুঝাচ্ছে যে, আমরা যে শিরক করছি তা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হচ্ছে এবং আল্লাহ এতে সন্তুষ্ট রয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘তোমাদের নিকট ‘ইলম’ থাকলে তা দেখাও।’’ অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর বিষয়ে যা বলছ তা ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত কোনো ইলম বা কিতাবে থাকলে তা দেখাও। তোমরা যা বলছ তা ওহীর জ্ঞান নয়, বরং তা যুক্তি-তর্ক ভিত্তিক ‘ধারণা’ মাত্র। আর প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহর নামে মিথ্যা। এরপর আল্লাহ ওহীর জ্ঞানটি জানিয়ে দিলেন, তা হলো: ‘‘তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে সৎ পথে পরিচালিত করতেন।’’
এখানে ওহীর জ্ঞান: ‘‘আল্লাহ চাইলে তোমাদের সকলকে হিদায়াত করতেন।’’ ওহীর অন্যান্য নির্দেশনার আলোকে আল্লাহর এ বাণীর অর্থ: আল্লাহ শিরক অপছন্দ করেন এবং ঈমান পছন্দ করেন। তিনি তা তোমাদেরকে ওহীর জ্ঞান ও বিবেকের নির্দেশনার মাধ্যমে জানিয়েছেন। তবে তোমরা তোমাদের স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মশক্তিকে অপব্যবহার করে কুফরী করেছ। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নিতে পারতেন। তবে তোমাদের অবাধ্যতার কারণে তোমরা সে দয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছ।
আর কাফিরদের দাবি: ‘‘আল্লাহ চাইলে আমরা পাপ করতাম না।’’ কাফিরদের দাবি ওহীর বিকৃতি ও নিজেদের মর্জি মত ব্যাখ্যার ফল। তারা ওহীর অন্য সকল নির্দেশনা বাদ দিয়ে দু একটি নির্দেশনাকে নিজেদের মর্জি মত ব্যাখ্যা করেছে। তাদের যুক্তি আমরা নিম্নভাবে সাজাতে পারি: আল্লাহ বলেছেন: ‘তিনি চাইলে আমাদেরকে হেদায়াত করতেন।’ এতে বুঝা যায় যে তিনি চাইলে আমরা শিরক করতাম না। এতে বুঝা যায় যে, তিনি চান বলেই আমরা শিরক করি। এতে বুঝা যায় যে, তিনি আমাদের কর্মে সন্তুষ্ট।’’ কাফিররা যে দাবি করছে হুবহু সে কথা কোনোভাবে কোনো ওহীর শিক্ষায় নেই। তা ওহীর মনগড়া ব্যাখ্যা, যুক্তি-তর্ক নির্ভর ‘ধারণা’ এবং আল্লাহর নামে মিথ্যা।
আল্লাহ বলেছেন, মনগড়া তর্ক বিতর্কের মধ্যে প্রবেশ করা রাসূলের দায়িত্ব নয়। ওহীর হুবহু শিক্ষা তাদেরকে জানিয়ে দেওয়াই তাঁর দায়িত্ব।
[1] সূরা (৬) আন‘আম: ১৪৮-১৪৯ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (১৬) নাহল: ৩৫ আয়াত।
২. ৬. ৪. তাকদীরে বিশ্বাসের গুরুত্ব ও উপকারিতা
ইসলামী তাকদীরে বিশ্বাস ও অনৈসলামিক ভাগ্যে বিশ্বাসকে অনেক সময় এক করে ফেলা হয়। অনেকে মনে করেন ভাগ্য অনুসারেই যখন সবকিছু হবে তখন কর্মের কি দরকার। আমরা দেখলাম যে, এ সকল চিন্তা ওহীর বিকৃতি ও যুক্তি-তর্ক ভিত্তিক ‘ধারণা’ মাত্র।
যে অবিশ্বাসী তাকদীর নিয়ে বিবাদ করে, তাকদীরের দোহাই দিয়ে কর্ম ছেড়ে দেয়, সে মূলত নিজেকে আল্লাহর কর্মের পরিদর্শক ও বিচারক নিয়োগ করেছে। সে বলতে চায়, কর্ম করা আমার দায়িত্ব নয়, আমার কাজ আল্লাহর কাজের বিচার করা।
আর মুমিনের বিশ্বাস, আল্লাহর কর্মের বিচার করা মানুষের কর্ম নয়। তিনি কি জানেন, কি লিখেছেন, কি মুছেন আর কি রেখে দেন কিছুই মানুষকে জানান নি। কারণ, এসব জানা মানুষের কোনো কল্যাণে আসবে না। সবকিছুই তাঁর মহান রুবূবিয়্যাতের অংশ। মানুষের দায়িত্ব আল্লাহর রহমত ও ন্যায়পরায়ণতার উপরে আস্থা রেখে আল্লাহর নির্দেশ মত কর্ম করা, ফলাফলের জন্য উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা মনে স্থান না দেওয়া। ইসলামের তাকদীরে বিশ্বাস মুসলিমকে কর্মমূখী করে তোলে, কখনই কর্মবিমূখ করে না। তাকদীরে বিশ্বাসের ফলে মানুষ সকল হতাশা, অবসাদ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পায়। মুসলিম জানে যে, তার দায়িত্ব কর্ম করা, ফলাফলের জন্য দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠা তার জীবনে অর্থহীন, কারণ ফলাফলের দায়িত্ব এমন এক সত্তার হাতে যিনি তাকে তার নিজের চেয়েও ভাল জানেন, ভালবাসেন, যিনি দয়াময়, যিনি কাউকে জুলুম করেন না। যিনি তাঁর বান্দাকে কর্মের চেয়ে বেশি পুরস্কার দিতে চান। তাই মুমিন উৎকণ্ঠা মুক্ত হয়ে কর্ম করেন।
তাক্দীরের বিশ্বাস মুসলিমকে অহংকার, অতিউল্লাস ও হতাশা থেকে রক্ষা করে। তার জীবনে সফলতা বা নিয়ামত আসলে সে অহংকারী হয়ে উঠে না। সে জানে আল্লাহর ইচ্ছায় ও রহমতেই সে সফলতা লাভ করেছে। তার হৃদয় কানায় কানায় ভরে ওঠে কৃতজ্ঞতায়। কৃতজ্ঞ হৃদয় আর অহংকারী হৃদয়ের মধ্যে রয়েছে মানবিক ও পাশবিক হৃদয়ের পার্থক্য।
অপরদিকে মুমিন ব্যর্থতা বা পরাজয়ে হতাশ হয় না। সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞান অনুযায়ী সে ফল পেয়েছে, নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। সে জানে যে, তার প্রচেষ্টা ও কর্মের জন্য সে অবশ্যই আল্লাহর কাছে পুরস্কার লাভ করবে। কাজেই সে হতাশ না হয়ে নিজের কর্মের ভুল দূর করে আল্লাহর নির্দেশ মত চেষ্টা করতে থাকে, ফলাফলের দায়িত্ব আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়।
তাকদীরে বিশ্বাসের ফল আমরা দেখতে পাই এ বিশ্বাস সর্বপ্রথম যাদের জীবনে এসেছিল: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণের জীবনে। আমরা দেখেছি তাকদীরের উপর সবচেয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর, আর তাই তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি দৃঢ়প্রত্যয়ী কর্মবীর। তিনি তাঁর সাধ্যমত কর্ম করেছেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন এবং ফলাফলের ভার ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর প্রতিপালকের কাছে। ঠিক তেমনি অকুতোভয় দৃঢ়প্রত্যয়ী কর্মবীর ছিলেন তাঁর সাহাবীগণ, তাক্দীরে বিশ্বাস তাঁদের সকল সংশয়, ভয়, দুশ্চিন্তা দূর করে বিশ্বজয়ে প্রেরণা জুগিয়েছে।
এ বিশ্বাসের জন্যই অতি নগণ্য সংখ্যক বিশ্বাসী মুসলিম বিপুল সংখ্যক অবিশ্বাসীর বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে দাঁড়াতে পেরেছেন। এরূপ অকুতোভয় শক্তিশালী তাকদীরে বিশ্বাসী কর্মবীর মুমিনকে আল্লাহ ভালবাসেন, যার তাকদীরে বিশ্বাস তাকে পরাজয়ের হতাশা, হা-হুতাশ ও গ্লানি থেকে রক্ষা করে। অতীতের ব্যর্থতা নিয়ে যিনি হা-হুতাশ করেন না, আবার ভবিষ্যত পরাজয়ের দুশ্চিন্তাও তাকে দ্বিধান্বিত করতে পারে না। বরং সকল পরাজয় পায়ে দলে তাকদীরের বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে তিনি সামনে এগিয়ে যান। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ الْمُؤْمِنِ
الضَّعِيفِ وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ
بِاللَّهِ وَلا تَعْجَزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ فَلا تَقُلْ لَوْ أَنِّي
فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ
فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ
‘‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দূর্বল মুমিন থেকে বেশি প্রিয় ও বেশি ভাল, তবে তাদের উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। তোমার যাতে মঙ্গল রয়েছে সে বিষয়ে সচেষ্ট হও এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। অক্ষম বা হতাশ হয়ো না। যদি তোমার কিছু হয় (যদি তুমি আশানুরূপ ফল না পাও বা ব্যর্থ হও) তবে কখনো বলবে না: হায়, যদি আমি অমুক বা তমুক কাজ করতাম তাহলে হয়ত এরূপ হতো.. (অতীতের ব্যার্থতা নিয়ে হা-হুতাশ করবে না) বরং (তাকদীরের বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে) বলবে: আল্লাহর তাকদীরে যা ছিল হয়েছে, আল্লাহর যা মর্জি হয়েছে তাই করেছেন। কারণ, ‘‘যদি ঐ কাজ করতাম তবে হয়ত এরূপ হতো’’-এ ধরনের কথা শয়তানের দরজা খুলে দেয়।’’[1]
তাক্দীরে বিশ্বাস হৃদয়ের দরজা শয়তানের জন্য বন্ধ করে দেয়। সেখানে শয়তান হতাশা বা অবসাদের বীজ বপন করতে পারে না।
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৫২ (কিতাবুল কাদর, বাবুল আমরি বিল কুওয়াতি)।
৩. হিসাব, মীযান, জান্নাত ও জাহান্নাম
আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ঈমানের আরকানগুলি উল্লেখ করার পর বলেছেন: ‘‘এবং হিসাব, মীযান, জান্নাত, জাহান্নাম এ সবই সত্য’’।
এ কথার মাধ্যমে তিনি ‘‘আখিরাতের ঈমানের’’ বিশেষ কয়েকটি দিক উল্লেখ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, আখিরাতে বিশ্বাস করার অর্থ কুরআন ও সহীহ হাদীসে আখিরাতের বিষয়ে যা কিছু বলা হয়েছে তা সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করা। এগুলোর মধ্যে হিসাব, মীযান, জান্নাত ও জাহান্নামের বিশ্বাস অন্যতম। এ জাতীয় কিছু বিষয় ইমাম আবু হানীফা, রাহিমাহুল্লাহ, পরবর্তীতে পুনরায় উল্লেখ করবেন এবং আমরা তা পর্যালোচনা করব ইনশা আল্লাহ।
৪. শিরক
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহ এক। তাঁর একত্ব সংখ্যায় নয়। বরং তাঁর একত্বের অর্থ তাঁর কোনো শরীক নেই।’’
ইমাম আযম এখানে উল্লেখ করেছেন যে, ‘আল্লাহ একজন আছেন’ এরূপ বিশ্বাসের নাম তাওহীদ নয়। বরং শিরকমুক্ত বিশ্বাসের নামই তাওহীদ। বস্ত্তত শিরকমুক্ত ইবাদত ইসলামের মূল ভিত্তি। মহান আল্লাহ বলেন:
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا
‘‘এবং তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক বানিও না।’’[1]
আমরা এ অনুচ্ছেদে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে শিরক প্রসঙ্গ আলোচনা করব।
[1] সূরা (৪) নিসা: ৩৬ আয়াত।
৪. ১. শিরকের অর্থ ও পরিচয়
শির্ক (شِرْك) অর্থ অংশীদার হওয়া (to share, participate, be partner, associate)। ইশরাক (إشراك) ও তাশ্রীক (تَشْرِيك) অর্থ অংশীদার করা বা বানানো। ‘শির্ক’ শব্দটিও ‘অংশীদার করা’ বা ‘সহযোগী বানানো’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা বা আল্লাহর প্রাপ্য কোনো ইবাদাত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য পালন করাকে শিরক বলা হয়। কুরআনের ভাষায় কাউকে ‘আল্লাহর সমতুল্য’ করাই শিরক। আল্লাহ বলেন:
فَلا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
অতএব তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমতুল্য বানাবে না।’’[1]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন,
سَأَلْتُ أَوْ سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ أَيُّ الذَّنْبِ عِنْدَ اللَّهِ أَكْبَرُ
قَالَ أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করলাম, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে কঠিন পাপ কী? তিনি বলেন: সবচেয়ে কঠিন পাপ এই যে, তুমি আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’’[2]
তাহলে কাউকে আল্লাহর ‘নিদ্দ’ মনে করাই শিরক। আরবীতে ‘নিদ্দ’’ (الندّ) অর্থ সমতুল্য, মত বা তুলনীয়। কাউকে নাম, বিশেষণ, প্রতিপালন বা ইবাদাতের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সমতুল্য মনে করা, আল্লাহকে যে ভক্তি প্রদর্শন করা হয় বা আল্লাহর জন্য যে ইবাদাত করা হয় তা অন্য কারো জন্য করাই শিরক।[3]
দুভাবে মানুষ শিরকে নিপতিত হয়: (১) আল্লাহর কোনো সৃষ্টির প্রতি অতি-সুধারণা অথবা (২) মহান আল্লাহর প্রতি কু-ধারণা বা অবধারণা। মুশরিকগণ কখনো ফিরিশতা, নবী, ওলী, পাহাড়, সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি কোনো সৃষ্টির বিষয়ে ভক্তিতে অতিরঞ্জন করে তাদের মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা কল্পনা করেছে। অথবা আল্লাহর পূর্ণতার গুণের প্রতি কু-ধারণা পোষণ করে তাঁকে সৃষ্টির মতই পরিষদ প্রভাবিত বলে কল্পনা করেছে।
বৈধ ভক্তি-শ্রদ্ধা থেকেই শিরকী অতিভক্তির জন্ম। পিতামাতা, উস্তাদ, পীর ও গুরুজনদের সর্বোচ্চ মানবীয় ভক্তিশ্রদ্ধা করতে হবে। কিন্তু যখনই উক্ত ব্যক্তির মধ্যে অলৌকিক শক্তি বা মঙ্গল-অমঙ্গলের ক্ষমতা কল্পনা করা হয় তখনই শিরক শুরু হয়। মহান আল্লাহ পিতামাতা বা নেককার মানুষের দুআ কবুল করেন। তবে তাঁদের দুআ নির্বিচারে গ্রহণ করেন, তাঁদেরকে অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছেন অথবা তাঁদের দুআর মাধ্যম ছাড়া আল্লাহর কাছে কিছু পাওয়া যাবে না মনে করা থেকে শিরকের যাত্রা।
তাওহীদের মত শিরকও দু প্রকারের হতে পারে: (১) রুবূবিয়্যাতে শিরক এবং (২) ইবাদাতে শিরক। আল্লাহ সব কিছু জানেন, দেখেন, শুনেন, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সৃষ্টির কল্যাণ-অকল্যাণ তাঁরই হাতে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে এ সকল গুণ আছে বা আল্লাহ কাউকে এরূপ ক্ষমতা প্রদান করেছেন বলে বিশ্বাস করা রুবুবিয়্যাতের শিরক। ‘ইবাদত’-এর ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বলে বিশ্বাস করা বা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করা ‘ইবাদাতের শির্ক’। উভয় প্রকারের শিরক পরস্পরে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কোনো সৃষ্টি বা মাখলূকের মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা বা ঐশ্বরিক শক্তি বিদ্যমান থাকার ধারণা থেকেই তাঁর প্রতি অলৌকিক ভক্তি, প্রার্থনা, সাজদা, মানত, উৎসর্গ, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি শিরকের জন্ম হয়।
[1] সূরা (২) বাকারা: ২২ আয়াত।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬২৬, ৫/২২৩৬, ৬/২৪৯৭ (কিতাবুত তাফসীর, সূরাতুল বাকারা, বাব ফালা তাজআলু...) মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯০-৯১ (কিতাবুল ঈমান, বাবু কওনিশ শিরকি আকবাহুয যুনূব, ভারতীয় ছাপা ১/৬৩)
[3] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১/১৬৩-১৬৪।
৪. ২. শিরকের হাকীকত
শিরকের হাকীকত বা মূল প্রকৃতি বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহ) বলেন: ‘‘শিরকের হাকীকত এই যে, কোনো মানুষ কোনো সম্মানিত মানুষের ক্ষেত্রে ধারণা করবে যে, উক্ত ব্যক্তি দ্বারা যে সকল অলৌকিক কার্য সংঘটিত বা প্রকাশিত হয় তা উক্ত ব্যক্তির পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত হওয়ার কারণে। এ সকল অলৌকিক কার্য প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় না এরূপ কিছু বিশেষ গুণ উক্ত ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান। এরূপ গুণ মূলত একমাত্র আল্লাহরই আছে। আল্লাহ যাকে ‘উলূহিয়্যত’ বা এরূপ বিশেষত্ব প্রদান করেন, অথবা ‘আল্লাহ’ যে ব্যক্তির সত্তার সাথে সংমিশ্রিত হন, অথবা যে ব্যক্তি আল্লাহর সত্তার মধ্যে ফানা বা বিলুপ্তি লাভ করেন এবং আল্লাহর সত্তার সাথে ‘বাকা’ বা অস্তিত্ব লাভ করেন বা অনুরূপ কোনো ভাবে যে ব্যক্তিকে আল্লাহ এরূপ ক্ষমতা বা পূর্ণতা প্রদান করেন তিনিই কেবল তা প্রাপ্ত হন। এভাবে মানুষের উলূহিয়্যাত বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা বা গুণ লাভের পদ্ধতি ও প্রকার সম্পর্কে মুশরিকদের মধ্যে অনেক ভিত্তিহীন কুসংস্কার বিদ্যমান। এ বিষয়ে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে, আরবের কাফিরগণ হজ্জের ‘তালবিয়া’র মধ্যে ও কাবাঘর তাওয়াফের সময় বলত:
لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ إِلا شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ
লাববাইকা...আপনার কোনো শরীক নেই, আপনি নিজে যাকে শরীক বানিয়েছেন সে ছাড়া। এরূপ শরীকও আপনারই মালিকানাধীন, আপনারই বান্দা, উক্ত শরীক ও তার সকল কর্তৃত্ব ও রাজত্ব আপনারই অধীন[1] ..।’’[2]
আরবের মুশরিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন: ‘‘এ সকল মুশরিক বিশ্বসৃষ্টির ব্যাপারে এবং বিশ্বের বৃহৎ বিষয়গুলো পরিচালনার ব্যাপারে আল্লাহর কোনো শরীক আছে বলে বিশ্বাস করত না। তারা একথাও স্বীকার করত যে, আল্লাহ যদি কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নেন বা কোনো বিষয় নির্ধারণ করেন তবে তা পরিবর্তন বা রোধ করার ক্ষমতাও কারোরই নেই। তারা কেবল বিশেষ কিছু বিষয়ে কিছু বান্দাকে শরীক করত। কারণ তারা মনে করত যে, একজন মহারাজ তার দাসদেরকে এবং তার নিকটবর্তী প্রিয় মানুষদেরকে তার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় কিছু ছোটখাট দায়িত্ব পালনের জন্য প্রেরণ করেন এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসকল ছোটখাট বিষয় নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালনা করার ক্ষমতা তাদেরকে প্রদান করেন। তারা আরো ধারণা করত যে, একজন মহারাজ তার প্রজাগণের খুঁটিনাটি বিষয় নিজে সম্পন্ন বা পরিচালনা করেন না, বরং অধীনস্থ প্রশাসক ও কর্মকর্তাদেরকে এ সকল বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এ সকল কর্মকর্তার অধীনে যারা কর্ম করেন বা তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখেন তাদের বিষয়ে এ সকল কর্মকর্তার সুপারিশ তিনি গ্রহণ করেন। সকল রাজার মহারাজা রাজাধিরাজ মহান আল্লাহও অনুরূপভাবে তাঁর কিছু নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাকে উলূহ্যিয়াতের উপঢৌকন প্রদান করেছেন এবং এদের বিরক্তি ও সন্তুষ্টিকে তাঁর অন্যান্য বান্দাদের ক্ষেত্রে প্রভাবময় করে দিয়েছেন।
এ জন্য তারা মনে করত যে, এ সকল নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দার নৈকট্যলাভের চেষ্টা করা জরুরী, যেন তা প্রকৃত মহারাজের নিকট তাদের কবুলিয়্যাতের ওসীলা হতে পারে। আর হিসাব ও প্রতিফলের সময় এদের শাফা‘আত মহান আল্লাহর দরবারে কবুলিয়্যাত ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এ ধারণা তাদের মনের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে যায়। এজন্য তাদের মন বলে যে, এ সকল নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের সামনে সাজদা কর, তাদের জন্য জবাই-উৎসর্গ কর, তাদের নামে কসম কর, তাদের অলৌকিক ক্ষমতার কারণে তাদের কাছে ত্রাণ ও সাহায্য প্রার্থনা কর, পাথরে, তামায়, পিতলে বা অন্য কিছুতে তাদের ছবি ও প্রতিকৃতি একে রাখ, এদের এ সকল প্রতিকৃতি সামনে রেখে এদের রূহের (আত্মার) প্রতি মুতাওয়াজ্জাহ হও। ক্রমান্বয়ে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মানুষেরা মুর্খতার কারণে এদের এ সকল মুর্তি ও প্রতিকৃতিকেই প্রকৃত ইলাহ বা মা‘বূদ বলে বিশ্বাস করতে থাকে।’’[3]
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৪৩ (কিতাবুল হাজ্জ, বাবুত তালবিয়াতি ওয়া সিফাতিহা); তাবারী, তাফসীর ১৩/৭৮-৭৯।
[2] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ২৪-২৫।
[3] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ২৪-২৫।
৪. ৩. মুশরিকগণের প্রকারভেদ
কুরআন-হাদীসে বর্ণিত মুশরিকগণকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহ) ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ গ্রন্থে তিন শ্রেণীতে এবং ‘আল-বালাগুল মুবীন’ গ্রন্থে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। তাঁর শ্রেণীভাগ নিম্নরূপ:
৪. ৩. ১. জ্যোতিষি, প্রকৃতিপূজারী বা নক্ষত্র পূজারীগণ
এরা দাবি করে যে, গ্রহ-নক্ষত্র ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। এদের ইবাদত করলে পৃথিবীতে উপকার পাওয়া যায়। মানুষের প্রয়োজন বা হাজত এদের কাছে পেশ করা সঠিক। তারা বলে, আমরা গবেষণা করে উদ্ঘাটন করেছি যে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, ব্যক্তির সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য, সফলতা-ব্যর্থতা, সুস্থতা-অসুস্থতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে এদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এ সকল গ্রহ-নক্ষত্রের বুদ্ধিমান সত্তা আছে যার ভিত্তিতে তারা যাত্রা ও চলাচল করে। এরা এদের পূজারীদের বিষয়ে অচেতন নয়। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা বিভিন্ন গ্রহনক্ষত্রের নামে মন্দির তৈরি করেছে এবং তাদের ইবাদত করে।
৪. ৩. ২. পৌত্তলিকগণ
এরা মুসলিমদের সাথে তাওহীদুর রুবূবিয়্যাতের অধিকাংশ বিষয়ে একমত। তারা বিশ্বাস করে যে, বিশ্বের বৃহৎ বিষয়গুলো পরিচালনার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই। এছাড়া যে বিষয়গুলো তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন এবং অন্য কাউকে কোনো এখতিয়ার বা ক্ষমতা প্রদান করেন নি সে সকল বিষয়ও তিনি পরিচালনা করেন। অন্যান্য বিষয়ে তারা মুসলিমদের সাথে একমত নয়। তারা দাবি করে যে, তাদের পূর্ববর্তী নেককার বুজুর্গগণ আল্লাহর ইবাদাত করে তাঁর নৈকট্য অর্জন করেছিলেন, ফলে আল্লাহ তাদেরকে ‘উলূহিয়্যাত’ বা ‘উপাস্যত্ব’ প্রদান করেন। এভাবে তারা অন্যান্য বান্দাদের ‘ইবাদত’ লাভের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। যেমনভাবে রাজাধিরাজ মহারাজের খাদিম বা সেবক তার সেবা ও ভক্তি করে যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় তখন মহারাজ সে খাদিমকেও রাজত্ব উপঢৌকন প্রদান করেন বা তাকে একটি বিশেষ এলাকার ‘সামন্ত’ রাজা বানিয়ে দেন। তখন সে রাজ্যের পরিচালনার দায়ভার এ সামন্ত রাজার উপরেই বর্তায়। আর উক্ত রাজ্যের প্রজাদের দায়িত্ব হয়ে যায় এ রাজার আনুগত্য করা।
তারা বলে, এ সকল বুজুর্গের ইবাদত না করে শুধু আল্লাহর ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। এ ছাড়া আল্লাহ অতি মহান ও অতি ঊর্ধ্বে। তাঁর নৈকট্যের জন্য সরাসরি তাঁর ইবাদত কোনো কাজে আসবে না। বরং এ সকল বুজুর্গের ইবাদত করলে তারা আল্লাহর নৈকট্য পাইয়ে দিতে পারেন। তারা বলে, এরা শুনেন, দেখেন, তাদের উপাসকদের জন্য সুপারিশ করেন, তাদের বিষয়াদি পরিচালনা করেন এবং তাদের সাহায্য করেন। ....
.... হে পাঠক, মুশরিকদের আকীদা ও কর্ম সম্পর্কে এ সকল বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে যদি আপনি নিশ্চিত হতে চান তবে এ যুগের কুসংস্কারগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত মানুষদের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। বিশেষ করে যারা মুসলিম দেশের প্রান্তে বা সীমান্তে বসবাস করে। লক্ষ্য করে দেখুন যে, ওলী বা বেলায়াত সম্পর্কে তাদের ধারণা কী? তারা প্রাচীন ওলীগণের বেলায়াতের স্বীকৃতি দেয় কিন্তু বর্তমানে আর এভাবে ওলী হওয়া তারা সম্ভব বলে মনে করে না। তারা কবর ও ওলীদের দরজায় যেয়ে পড়ে থাকে এবং বিভিন্ন প্রকারের শিরক, বিদ‘আত ও ভিত্তিহীন কুসংস্কারের মধ্যে তারা নিমগ্ন। আরবের মুশরিকগণ যেভাবে ইবরাহীম (আ)-এর দীনকে বিকৃত করেছিল এবং মহান আল্লাহকে মানুষের সাথে তুলনা করেছিল অনুরূপ বিকৃতি ও তুলনার মধ্যে এরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতি অনুসরণ করবে।’’[1] এ হাদীসটি এদের বিষয়ে পুরোপুরিই খাটে। পূর্ববর্তী মুশরিকগণ যত প্রকারের বিভ্রান্তি বা ফিতনায় নিপতিত হয়েছিল সেগুলোর সবই মুসলিম নামধারী কোনো না কোনা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান। তারা এসকল শিরকের গভীরে নিমজ্জিত রয়েছে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।’’[2]
[1] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৭৪, ৬/২৬৬৯ (কিতাবুল আম্বিয়া, বাবু যিকরিন আন বানী ইসরাঈল, কিতাবুল ইতিসাম, বাব... লাতাত্তাবিউন্না...); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৫৪ (কিতাবুল ইলম, বাবু ইত্তিবায়ি সুনানিল ইয়াহূদ ওয়ান নাসারা)
[2] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ২৪-২৬।
৪. ৩. ৩. খৃস্টানগণ
খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, ঈসা মাসীহ (আ)-এর সাথে আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য আছে এবং তিনি অন্য সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে। কাজেই তাঁকে ‘আব্দ’ অর্থাৎ দাস বা ‘বান্দা’ বলা উচিত নয়। কারণ তাঁকে ‘আব্দ’ বা ‘বান্দা’ বললে তাঁকে অন্য সকল সৃষ্টির সমান বানিয়ে দেওয়া হয়। এরূপ করা তাঁর মহান মর্যাদার সাথে বেয়াদবী। সর্বোপরি এতে আল্লাহর সাথে তাঁর যে বিশেষ নৈকট্যের সম্পর্ক রয়েছে তা প্রকাশে অবহেলা করা হয়।
এরপর তাদের কেউ কেউ আল্লাহর সাথে তাঁর বিশেষ নৈকট্য বুঝানোর জন্য তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলতে পছন্দ করেন। তাদের যুক্তি এই যে, পিতা তার পুত্রকে বিশেষভাবে দয়া করেন এবং নিজের চোখের সামনে তাকে প্রতিপালন করেন। আর সাধারণ দাস বা চাকরদের চেয়ে পুত্র অধিক মর্যাদার অধিকারী হয়। এজন্য ‘পুত্র’ পদটিই তাঁর মর্যাদার সাথে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ।
এছাড়া তাদের কেউ কেউ তাঁকে ‘আল্লাহ’ বলতে শুরু করেন। তাদের যুক্তি এই যে, আল্লাহ ঈসা মাসীহের মধ্যে অবতরণ এবং অবস্থান করছেন। আর এজন্যই তো তিনি মৃতকে জীবিত করা, মাটি থেকে পাখি বানানো ইত্যাদি মানুষের অসাধ্য কাজ করতে সক্ষম হন। কাজেই তাঁর কথা-ই আল্লাহর কথা এবং তাঁকে ইবাদত করা অর্থ আল্লাহকে ইবাদত করা।
পরবর্তী প্রজন্মের খৃস্টানগণের মধ্যে ঈসা (আ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলার এ সকল দার্শনিক যুক্তি ও চিন্তা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা বিরাজ করে। ফলে তারা ‘আল্লাহর পুত্রত্ব’ বলতে প্রকৃত পুত্রত্বই বুঝতে থাকে। কেউ মনে করতে থাকে যে, তিনি প্রকৃতই ‘আল্লাহ’। এজন্য আল্লাহ তাদের বিভ্রান্তি অপনোদনে কখনো বলেছেন যে, তাঁর কোনো স্ত্রী নেই, কখনো বলেছেন যে, তিনিই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা।
এ তিন দলেরই মত প্রমাণের জন্য অনেক লম্বা চওড়া যুক্তি তর্কের বহর রয়েছে। কুরআনে শেষের দু দলের শিরকের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং তাদের বিভ্রান্তি, বিভ্রান্তিকর দলিল-প্রমাণাদি বিস্তারিতভাবে খন্ডন করা হয়েছে।’’[1]
তিনি আরো বলেন: ‘‘শির্ক রোগে আক্রান্ত মানুষেরা বিভিন্ন প্রকারের। তাদের মধ্যে কেউ আল্লাহর মহত্ব ও মর্যাদা ভুলে গিয়েছে। সে কেবল শরীকগণেরই ইবাদত করে এবং কেবল তাদের কাছেই নিজের হাজত-প্রয়োজন পেশ করে। আল্লাহর কাছে সে নিজের প্রয়োজন জানায় না বা আল্লাহর দিকে সে দৃষ্টিপাতও করে না। যদিও সে নিশ্চিতভাবে জানে ও মানে যে, এ মহাবিশ্বের অনাদি-অনন্ত স্রষ্টা আল্লাহই। মুশরিকদের মধ্যে কেউ বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই নেতা, প্রভু এবং বিশ্বের পরিচালক। কিন্তু তিনি তাঁর ‘উলূহিয়্যাত’-এর কিছু মর্যাদা তাঁর কোনো কোনো বান্দাকে দিয়ে থাকেন এবং তাদের সুপারিশ কবুল করেন। তাদেরকে তিনি কিছু বিশেষ বিষয়ে পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। যেমন মহারাজ বা রাজাধিরাজ তার রাজ্যের প্রত্যেক প্রদেশে ‘সামন্ত’ রাজা নিয়োগ করেন এবং তাকে উক্ত এলাকার পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। বৃহৎ বিষয়গুলো ছাড়া সাধারণ সকল বিষয় পরিচালনা করার দায়িত্ব এ সকল ছোট রাজাদের উপর অর্পিত হয়। এরূপ বিশ্বাস পোষণকারী মুশরিক আল্লাহর এ সকল বিশেষ বান্দাদেরকে ‘আল্লাহর বান্দা’, ‘আল্লাহর দাস’ বা আল্লাহর আবদ’ বলতে দ্বিধাবোধ করে; কারণ এতে ‘এ সকল খাস বান্দাকে অন্য সব ‘আম’ বান্দার সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্য সে এরূপ খাস বান্দাদেরকে আল্লাহর বান্দা না বলে ‘আল্লাহর পুত্র’ বা ‘আল্লাহর মাহবূব’ (আল্লাহর প্রিয়) বলে। আর নিজেকে সে এরূপ ‘খাস বান্দাদের’ বান্দা বলে নামকরণ করে। যেমন ‘আব্দুল মাসীহ’, আব্দুল উয্যা, ইত্যাদি। ইহূদী, খৃস্টান, সাধারণ মুশরিক এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দীনের অনুসারী সীমালঙ্ঘনকারী মুনাফিকদের অধিকাংশই এ রোগে আক্রান্ত।’’[2]
তিনি কুরআনের আলোকে ইহূদীদের বিভ্রান্তি আলোচনার পর বলেন: ‘‘পাঠক যদি ইহূদীদের এ সকল বিভ্রান্তির নমুনা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে দেখতে চান তবে অসৎ আলিমগণ এবং পার্থিব স্বার্থের অনুসন্ধানকারীদের দিকে তাকান। পিতা-পিতামহদের অন্ধ অনুকরণ এদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়কর্ম। মহান আল্লাহর কিতাব ও তাঁর মহান রাসূলের (ﷺ) সুন্নাত এরা ততটা গুরুত্ব দেয় না। আলিমগণ নিজস্ব পছন্দ, যুক্তিতর্ক, অকারণ বাড়াবাড়ি ও গভীরতার নামে যে সকল মত প্রকাশ করেছেন সেগুলোই তাদের দলিল, অথচ কুরআন ও সুন্নাতে এ সকল মতের কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় না। এরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রমাণিত ও সহীহ বাণী বাদ দিয়ে জাল বা মাউযূ হাদীসের উপর নির্ভর করে এবং ভিত্তিহীন বাজে ব্যাখ্যা ও তাফসীরের পিছনে দৌঁড়ায়।’’[3]
তিনি কুরআনের আলোকে খৃস্টানদের বিভ্রান্তি আলোচনা করে বলেন: ‘‘আপনি যদি এ সকল বিভ্রান্ত পথভ্রষ্টদের নমুনা নিজ জাতির মধ্যে দেখতে চান তবে আপনার সমাজের ‘ওলী-আল্লাহ’দের সন্তানদের অনেকের দিকে তাকান। তাদের বিষয়ে এদের ধারণা ও আকীদা পর্যালোচনা করুন। তাহলে বুঝতে পারবেন যে, কোন্ পর্যায়ে এরা পৌঁছেছে। ‘আর অচিরেই জালিমগণ জানবে যে, তাদের কি পরিণতি হবে[4]।’’[5]
[1] শাহ ওয়ালিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৭৭-১৭৯।
[2] শাহ ওয়ালিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৮২-১৮৩।
[3] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ৩৪।
[4] সূরা (২৬) শু‘আরা: ২২৭ আয়াত।
[5] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ৩৬।
৪. ৩. ৪. কবর পূজারীগণ
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী তাঁর আল-বালাগুল মুবীন গ্রন্থে বলেন: ‘‘মুশরিকগণের চতুর্থ দলটি হইল কবর পূজারীদের দল। তাহাদের দাবী হইল যখন আল্লাহ তাআলার কোন বান্দা ইবাদত বন্দেগী সাধন-ভজন দ্বারা আল্লাহর দরবারে দোআ কবুল হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হইয়াছেন, এইরূপ ব্যক্তির ইনতিকালের পর তাহার আত্মা বিরাট শক্তিশালী এবং ক্ষমতাশালী হইয়া থাকে। সুতরাং যে লোক এমন বুযুর্গের আকৃতি ও চেহারার ধ্যান করে অথবা তাহাদের থাকার স্থান এবং কবরকে খুব বিনয়, নম্রতা এবং ভক্তি সহকারে সিজদাহ করে, তাহার যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে এই বুযুর্গের আত্মা অবহিত হইয়া যায়; দুনিয়া ও পরকালে তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া দিয়া তাহার জন্য সুপারিশকারী হয়। উল্লেখিত শিরক ও বিদআতীদের বাতিল মতবাদ প্রচার করার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিয়াছেন...। ... ইহা আমাদের ভালভাবে বুঝা উচিত যে, উল্লেখিত কুরআনের আয়াতসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অদৃশ্য আত্মা ও দেহসমূহের যে ইবাদত বন্দেগী এই পৃথিবীতে করা হয় এবং তাহাদের নিকট যে বস্ত্তর প্রার্থনা করা হয় ঐ সব আত্মা ও দেহসমূহ প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। হাশরের ময়দানে যখন আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা করা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিবেন তখন তাহারা বলিবে আমরা এই সম্বন্ধে অবগত নহি। পূজারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা ও আল্লাহর দরবারে তাহাদের জন্য শাফায়াত করা তো দূরের কথা, তাহাদের কাজকে আদৌ স্বীকৃতি দিবে না।’’[1]
[1] শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী, আল-বালাগুল মুবীন (বঙ্গানুবাদ), পৃ. ৫৯-৬১।
৪. ৪. কুরআন-হাদীসে আলোচিত শিরকসমূহ / ৪. ৪. ১. প্রতিপালনের শিরক / ৪. ৪. ১. ১. আত্মীয়তার শিরক
কুরআন-হাদীসে বিভিন্ন প্রকারের শিরকের কথা উল্লেখ করে সেগুলো থেকে সাবধান করা হয়েছে। এখানে অতি সংক্ষেপে কিছু বিষয় উল্লেখ করছি।
৪. ৪. ১. প্রতিপালনের শিরক
আমরা দেখেছি যে, কাফিরগণ মূলত আল্লাহর প্রতিপালনের একত্বে বিশ্বাস করত, তবে তারা এ বিষয়ক বিভিন্ন শিরকে নিপতিত হতো। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
৪. ৪. ১. ১. আত্মীয়তার শিরক
আল্লাহর কোনো আত্মীয় বা সন্তান আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। ইহূদী, খৃস্টান, আরবের মুশরিকগণ ও অন্যান্য অনেক জাতি এরূপ শিরকে লিপ্ত ছিল। আমরা সূরা ইখলাস আলোচনা প্রসঙ্গে দেখব যে, মূলত তারা সন্তান বলতে ‘‘স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান’’ বুঝাতো না; বরং ‘‘বিশেষ প্রিয়পাত্র’’ বুঝাতো, যারা ‘‘মাখলূক’’ বা ‘‘বান্দা’’-র স্তর অতিক্রম করে ‘‘পুত্রত্ব’’, ‘‘আত্মীয়তা’’ বা ‘‘মাহবূবিয়্যাতের’’ স্তরে পৌঁছে গিয়েছেন। কখনো তারা বুঝাতো যে, মহান আল্লাহ তাঁর নূর বা ‘‘যাত’’ (সত্তার) উপাদান (light from light/
same substance) দিয়ে তাঁকে সৃষ্টি করেছেন; কাজেই তিনি তাঁর পুত্র। কোনো কোনো ইহূদী সম্প্রদায় উযাইর (আ)-কে, খৃস্টানগণ ঈসা (আ)-কে, আরবের কাফিরগণ ফিরিশতাগণকে, জিনগণকে ও কোনো কোনো ‘‘মাহবূব’’ মানুষকে আল্লাহর পুত্র, কন্যা বা সন্তান বলে বিশ্বাস করত।
৪. ৪. ১. ২. ক্ষমতার শিরক
বিশ্ব পরিচালনায় বা সৃষ্টির কল্যাণ-অকল্যাণে আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে, কেউ জাগতিক উপকরণ ছাড়া ইচ্ছা করলে কারো মঙ্গল-অমঙ্গল করতে পারেন বা আল্লাহ কাউকে এরূপ ক্ষমতা প্রদান করেছেন বলে বিশ্বাস রুবুবিয়্যাতের শিরক। আরবের কাফিররা এরূপ শিরকে নিপতিত হতো। আল্লাহ তাঁর ফিরিশতাগণকে বিভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করেন, নবী-রাসূলগণ এবং নেককার বান্দগণকে ভালবাসেন, ইচ্ছা করলে তাঁদের দুআ কবুল করেন, তাঁদের মাধ্যমে কোনো অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করেন, কিন্তু কখনোই তিনি কাউকে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন না। কিন্তু কাফিরগণ বিশ্বাস করত যে, ফিরিশতাগণ, নবীগণ ও অন্যান্য মাহবূব বান্দগণকে আল্লাহ এরূপ ক্ষমতা প্রদান করেন।
তারা বিশ্বাস করত যে আল্লাহই একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রতিপালক এবং সকল ক্ষমতা তাঁরই। তবে তিনি করুণাবশত তাঁর কোনো কোনো বান্দাকে বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন। তাঁরা আল্লাহর ‘‘ভান্ডার’’ বা ‘‘ধন’’ গ্রহণ করে তা বণ্টন করার ক্ষমতা পান। এ জন্যই তারা হজ্জের তালবিয়ায় বলত: ‘‘আপনার কোনো শরীক নেই, তবে আপনি নিজে যাকে আপনার শরীক বানিয়েছেন সে ছাড়া। এরূপ শরীকও আপনারই মালিকানাধীন, ... সে ও তার সকল কর্তৃত্ব ও রাজত্ব আপনারই অধীন...।’’
এ প্রসঙ্গে ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ গ্রন্থে ইমাম আবূ মুতী বালখী বলেন:
قُلْتُ لأَبِيْ حَنِيْفَةَ أَخْبِرْنِيْ عَنِ الإِيْمَانِ قَالَ أَنْ تَشْهَدَ
أَنْ لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَتَشْهَدَ
بِمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبُهِ وَرُسُلِهِ وَجَنَّتِهِ وَنَارِهِ وَقِيَامَتِهِ
وَخَيْرِهِ وَشَرِّهِ وَتَشْهَدَ أَنَّهُ لَمْ يُفَوِّضِ الأَعْمَالَ إِلَى
أَحَدٍ.
‘‘আমি আবূ হানীফাকে বললাম: আমাকে ঈমানের পরিচয় জানান। তিনি বলেন: তুমি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। এবং তুমি সাক্ষ্য দেবে তাঁর ফিরিশতাগণের, এবং তাঁর গ্রন্থসমূহের, এবং তাঁর রাসূলগণের এবং তাঁর জান্নাতের, তাঁর জাহান্নামের, কিয়ামতের এবং তাঁর মঙ্গল-অমঙ্গলের। তুমি আরো সাক্ষ্য দেবে যে, তিন তাঁর কর্মকান্ডের দায়িত্ব কাউকে প্রদান করেন নি।’’[1]
[1] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত (আল-আলিম ওয়াল মুতাআলিস্নমসহ), পৃ. ৪৩
৪. ৪. ১. ৩. শাফা‘আতের ক্ষমতার শিরক / ৪. ৪. ১. ৪. ইলমুল গাইব বিষয়ক শিরক
কাফিরগণ বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর এরূপ ‘‘মাহবূব’’ বান্দাগণকে আল্লাহ শাফা‘আত বা শুপারিশ করার ‘‘ক্ষমতা’’ প্রদান করেছেন। তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামত যার জন্য খুশি সুপারিশ করে আল্লাহ নিকট থেকে তার প্রয়োজন মিটিয়ে দিতে পারেন। কুরআনে তাদের এ বিশ্বাস খন্ডন করা হয়েছে। শাফাআত বিষয়ক আলোচনায় তা আমরা দেখব, ইনশা আল্লাহ।
৪. ৪. ১. ৪. ইলমুল গাইব বিষয়ক শিরক
মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের অন্যতম দিক তাঁর অনন্ত-অসীম অতুলনীয় ও সামগ্রিক ইলম বা জ্ঞান। তাঁর অন্যতম সিফাত হলো ‘আলিমুল গাইব’ বা ‘অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী’ এবং ‘আলিমুল গাইব ওয়াশ শাহাদাহ’ বা ‘দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী’। কুরআনে একথা বলা হয় নি যে, ‘আল্লাহর মত গাইবী ইলম’ কারো নেই, বরং বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘গাইবের জ্ঞান’-ই আল্লাহ ছাড়া কারো নেই। আল্লাহ ছাড়া কারো এরূপ গাইবের জ্ঞান বা অনাদি-অনন্ত জ্ঞান আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। ইহূদী-খৃস্টান ও আরবের কাফিরগণ এরূপ শিরকে লিপ্ত ছিল। প্রচলিত বাইবেলেও বারংবার ঘোষণা করা হয়েছে যে, ঈসা মাসীহ গাইবের বিষয় জানতেন না[1]; তবুও খৃস্টানগণ বিশ্বাস করতেন এবং করেন যে, ঈসা (আ) গাইবের জ্ঞানের অধিকারী। কাফিরগণ বিশ্বাস করতেন ও করেন যে, জিনগণ এবং তাদের পুরোহিতগণ (কাহিন) গাইবের জ্ঞানের অধিকারী। কুরআন ও হাদীসে এ সকল শিরকী বিশ্বাস খন্ডন করা হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো মুসলিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিষয়ে এরূপ ধারণা প্রকাশ করলে তিনি তার কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। আল্লাহ বলেন:
قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ
‘‘বল, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ ব্যতীত কেউ গাইবের জ্ঞান রাখে না।’’[2]
নবী-রাসূলগণ কেউই পৃথিবীতে জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরে কখনো ইলম গাইবের অধিকারী হন না।
এ বিষয়ক কয়েকটি আয়াত দেখুন:
يَوْمَ يَجْمَعُ اللَّهُ الرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَا أُجِبْتُمْ قَالُوا لا عِلْمَ
لَنَا إِنَّكَ أَنْتَ عَلامُ الْغُيُوبِ
‘‘যে দিন (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ রাসূলদেরকে একত্র করবেন এবং বলবেন, তোমরা কী উত্তর পেয়েছিলে? তারা বলবে, আমাদের তো কোনো জ্ঞান নেই, আপনিই তো অদৃশ্য সম্মন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’’[3]
قُلْ لا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلا
أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلا مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ
يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلا تَتَفَكَّرُونَ
‘‘বল, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডারসমূহ রয়েছে, অদৃশ্য (গায়েব) সম্বন্ধেও আমি অবগত নই, আর আমি তোমাদেরকে একথাও বলি না যে, আমি ফিরিশতা। আমি তো শুধু আমার প্রতি যে ওহী প্রেরণ করা হয় তারই অনুসরণ করি।’’[4]
قُلْ لا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلا ضَرًّا إِلا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ
كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ
السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
‘‘বল, আমার নিজের কোনো মঙ্গল বা অমঙ্গল করার ক্ষমতাও আমার নেই, শুধু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত। আমি যদি গাইব (গোপন জ্ঞান) জানতাম তাহলে প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম, আর কোনো অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমি তো কেবল ভয়প্রদর্শনকারী এবং সুসংবাদদাতা বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য।’’[5]
মহিলা সাহাবী রুবাই’ বিনতু মু‘আওয়িয বলেন:
دَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ صَبِيحَةَ عُرْسِي وَعِنْدِي جَارِيَتَانِ
تُغَنِّيَانِ ... وَتَقُولانِ فِيمَا تَقُولانِ: وَفِينَا نَبِيٌّ يَعْلَمُ مَا
فِي غَدٍ، فَقَالَ أَمَّا هَذَا فَلا تَقُولُوهُ، مَا يَعْلَمُ مَا فِي غَدٍ إِلا
اللَّهُ
‘‘আমার বিবাহের দিন সকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার ঘরে প্রবেশ করেন, তখন আমার কাছে দু’জন বালিকা বসে গীত গাচ্ছিল।... তারা তাদের কথার মাঝে মাঝে বলছিল: ‘আমাদের মধ্যে একজন নবী রয়েছেন যিনি আগামীকাল (অর্থাৎ ভবিষ্যতে) কি আছে তা জানেন।’ তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে বলেন: ‘এ কথা বলো না, আগামীতে (ভবিষ্যতে) কি আছে তা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না।’’[6]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, কিয়ামতের দিন অনেক মানুষ আমার কাছে (হাউযে পানি পানের জন্য) আসবে, যাদেরকে আমি চিনব এবং তারাও আমাকে চিনবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে বাধা দেওয়া হবে। আমি বলব: এরা তো আমারই উম্মত-সহচর। তখন উত্তরে বলা হবে:
إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا عَمِلُوا بَعْدَكَ فَأَقُولُ كَمَا قَالَ الْعَبْدُ
الصَّالِحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ: وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ
فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ وَأَنْتَ
عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ ...
‘‘‘আপনার পরে তারা কী আমল করেছে তা আপনি জানেন না’। তখন আমি তা-ই বলব নেকবান্দা ঈসা ইবনু মারিয়াম যা বলেন[7]: ‘যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাদের শাহীদ-সাক্ষী। কিন্তু যখন আপনি আমাকে তুলে নিলেন তখন আপনিই তো ছিলেন তাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাবধায়ক এবং আপনিই সর্ববিষয়ে সাক্ষী (শাহীদ)।’’[8]
এ অর্থের হাদীস আয়েশা, উম্মু সালামা, আসমা বিনত আবী বাকর, ইবনু মাসঊদ, আনাস ইবনু মালিক, আবূ সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনু সা’দ, আমর ইবনুল আস, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস প্রমুখ প্রায় দশ জন সাহাবী (রাঃ) থেকে অনেকগুলি সহীহ সনদে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ে বর্ণিত।[9]
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ أَتَى كَاهِنًا أَوْ عَرَّافًا فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ فَقَدْ كَفَرَ
بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ
‘‘যে ব্যক্তি কোনো গণক, ভাগ্যবক্তা বা ভবিষ্যদ্বক্তার নিকট গমন করে এবং তার কথা বিশ্বাস করে সে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ দীনের প্রতি কুফরী করে।’’[10]
মোল্লা আলী কারী ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় বলেন:
اِعْلَمْ أَنَّ الأَنْبِيَاءَ عَلَيْهِمُ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ لَمْ
يَعْلَمُوْا الْمَغِيْبَاتِ مِنَ الأَشْيَاءِ إِلاَّ مَا عَلَّمَهُمُ اللهُ
أَحْيَاناً. وَذَكَرَ الْحَنَفِيَّةُ تَصْرِيْحاً بِالتَّكْفِيْرِ بِاعْتِقَادِ
أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ يَعْلَمُ الْغَيْبَ؛ لِمُعَارَضَةِ قَوْلِهِ تَعَالَى: (قُلْ
لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ)...".
‘‘জেনে রাখ, নবীগণ (আ) অদৃশ্য বা গাইবী বিষয়াদির বিষয়ে আল্লাহ কখনো কখনো যা জানিয়েছেন তা ছাড়া কিছুই জানতেন না। হানাফী মাযহাবের আলিমগণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গাইব জানতেন বলে আকীদা পোষণ করা কুফরী, কারণ তা আল্লাহর এ কথার সাথে সাংঘর্ষিক[11]: ‘‘বল: আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য (গাইব) বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।’’[12]
[1] বাইবেল: মথি ২৪/৩৪-৩৬; মার্ক: ১৩/৩০-৩২।
[2] সূরা (২৭) নাম্ল: ৬৫ আয়াত।
[3] সূরা (৫) মায়িদা: ১০৯ আয়াত।
[4] সূরা (৬) আনআম: ৫০ আয়াত। আরো দেখুন (সূরা ১১ হূদ: ৩১ আয়াত)
[5] সূরা (৭) আ‘রাফ: ১৮৮ আয়াত।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৪৬৯ (কিতাবুল মাগাযী, বাবু শুহূদিল মালাইকাতি বাদরান); ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ৭/৩১৫।
[7] সূরা (৫) মায়িদা: ১১৭ আয়াত।
[8] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৯১ (কিতাবুল আম্বিয়া, বাবু কাওলিল্লাহি: ওয়াত্তাখাযাল্লাহু ইবরাহীমা খালীলান); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩-১৭৯৪ (কিতাবুল জান্নাতি, বাবু ফানাইদ্দুনইয়া)
[9] বিস্তারিত দেখুন, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ১৬৭-১৬৯; কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ২০১-২০২।
[10] আহমদ, আল-মুসনাদ ২/৪২৯; আলবানী, সাহীহুত তারগীব ৩/৯৭-৯৮।
[11] সূরা (২৭) নাম্ল: ৬৫ আয়াত।
[12] মোল্লা আলী কারী: শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৩।
৪. ৪. ১. ৫. অশুভ বা অযাত্রায় বিশ্বাস
কোনো বস্ত্ত, সময়, বার, তিথি, দিক, পশুপাখি ইত্যাদির মধ্যে কোনো অশুভ বা অযাত্রা আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ
‘‘অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস বা নির্ণয়ের চেষ্টা শির্ক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস বা নির্ণয়ের চেষ্টা শির্ক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস বা নির্ণয়ের চেষ্টা শির্ক।[1]
[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/১৬০ (কিতাবুস সিয়ার, বাবু মা জাআ ফিত তিয়ারাতি); আবূ দাঊদ, আস-সুনান ৪/১৭ (কিতাবুত তিবব, বাবুন ফিত তিয়ারাতি); ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১১৭০ (কিতাবুত তিবব, বাবু মান কানা ইউজিবুহুল ফাল...); ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১৩/৪৯১; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৪। তিরমিযী, ইবনু হিব্বান, হাকিম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
৪. ৪. ২. ইবাদাতের শিরক / ৪. ৪. ২. ১. সাজদা
আমরা দেখেছি যে, মুশরিকগণ মূলত ইবাদতের ক্ষেত্রে শিরক করত বা বিভিন্নভাবে গাইরুল্লাহকে ইবাদত করত। এখানে কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত এ সকল শিরক অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
৪. ৪. ২. ১. সাজদা
সাজদা ইবাদতের একটি সর্বজনীন প্রকাশ। চাঁদ, সূর্য, প্রতিমা, ইত্যাদি সকল উপাস্যকে সাজদার মাধ্যমে ইবাদত করে মুশরিকগণ। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সাজদা করতে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন:
لا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي
خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
‘‘তোমরা সূর্যকে সাজদা করো না, চন্দ্রকেও নয়, সাজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর।’’[1]
আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, সাজদা, উৎসর্গ ইত্যাদি ইবাদতের উদ্দেশ্যও ‘দু‘আ’ বা ‘ডাকা’। যাকে ডাকা হচ্ছে তিনি যেন খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি সাড়া দেন সেজন্যই সাজদা। এজন্য মহান আল্লাহ বলেন:
وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا
‘‘এবং সাজদার কর্মগুলো বা সাজদার স্থানসমূহ আল্লাহরই জন্য; সুতরাং তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না।’’[2]
আল্লামা ইবনু আবেদীন শামী ‘হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার গ্রন্থে বলেন:
وَالسُّجُوْدُ أَصْلٌ لأَنَّهُ شُرِعَ عِبَادَةً بِلاَ قِيَامٍ كَسَجْدَةِ
التِّلاَوَةِ، وَالْقِيَامُ لَمْ يُشْرَعْ عِبَادَةً وَحْدَهُ، حَتَّى لَوْ سَجَدَ
لِغَيْرِ اللهِ تَعَالَى يَكْفُرُ بِخِلاَفِ الْقِيَامِ.
‘‘সাজদাই মূল; কারণ দাঁড়ানো ছাড়াই শুধু সাজদা শরীয়তে ইবাদত বলে গণ্য, যেমন তিলাওয়াতের সাজদা। দাঁড়ানো এককভাবে ইবাদত হিসেবে শরীয়তে নির্ধারিত নয়। এজন্য যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য সাজদা করে তবে সে কাফির বলে গণ্য হবে, দাঁড়ানোর বিষয়টি তদ্রূপ নয়।’’[3]
তিনি আরো বলেন:
تَقْبِيلِ الأَرْضِ بَيْنَ يَدَيْ الْعُلَمَاءِ وَالْعُظَمَاءِ فَحَرَامٌ
وَالْفَاعِلُ وَالرَّاضِي بِهِ آثِمَانِ لأَنَّهُ يُشْبِهُ عِبَادَةَ الْوَثَنِ
وَهَلْ يَكْفُرَانِ: عَلَى وَجْهِ الْعِبَادَةِ وَالتَّعْظِيمِ كُفْرٌ وَإِنْ
عَلَى وَجْهِ التَّحِيَّةِ لا وَصَارَ آثِمًا مُرْتَكِبًا لِلْكَبِيرَةِ
‘‘আলিম ও সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে ভূমি-চুম্বন বা জমিন-বুসী করা হারাম। যে ব্যক্তি তা করে এবং যে তাতে রাজি থাকে উভয়েই পাপী; কারণ তা মূর্তিপূজার অনুকরণ। এখন প্রশ্ন হলো: এরূপ ভূমি-চুম্বন-কারী এবং তাতে সন্তুষ্ট ব্যক্তি কাফির বলে গণ্য হবে কিনা? যদি ইবাদত ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য তা করে তবে তা কুফর। আর যদি সালাম বা সম্ভাষণ প্রদানের জন্য করে তবে কুফর হবে না, এরূপ ব্যক্তি কবীরা গোনাহে লিপ্ত পাপী বলে গণ্য হবে।’’[4]
[1] সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৩৭ আয়াত।
[2] সূরা (৭২) জিন্ন: ১৮ আয়াত।
[3] ইবনু আবিদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ১/৪৮০, ৬/৪২৬।
[4] ইবনু আবিদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ৬/৩৮৩।
৪. ৪. ২. ২. উৎসর্গ-মানত
উৎসর্গ করা (sacrifice) ইবাদতের একটি সর্বজনীন প্রকাশ। পূজিত ব্যক্তিকে খুশি করতে এবং তার আশীর্বাদ, করুণা বা নেক নযর লাভ করতে মানত, সদকা, বলি, কুরবানি, নযর-নিয়ায ইত্যাদি নামে ফল, ফুল, ফসল, অর্থ, পশু ইত্যাদি উৎসর্গ করা হয়। আল্লাহ ছাড়া কারো উদ্দেশ্যে এরূপ উৎসর্গ শিরক। মুশরিকগণের এ জাতীয় শিরকের বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন:
وَجَعَلُوا لِلَّهِ مِمَّا ذَرَأَ مِنَ الْحَرْثِ وَالأَنْعَامِ نَصِيبًا
فَقَالُوا هَذَا لِلَّهِ بِزَعْمِهِمْ وَهَذَا لِشُرَكَائِنَا فَمَا كَانَ
لِشُرَكَائِهِمْ فَلا يَصِلُ إِلَى اللَّهِ وَمَا كَانَ لِلَّهِ فَهُوَ يَصِلُ
إِلَى شُرَكَائِهِمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
‘‘আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন তন্মধ্য হতে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নির্দিষ্ট করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, ‘এটি আল্লাহর জন্য এবং এটি আমাদের শরীকদের জন্য’। যা তাদের শরীকদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু যা আল্লাহর অংশ তা তাদের শরীকদের কাছে পেঁŠছে; তাদের ব্যবস্থা খুবই নিকৃষ্ট।’’[1]
উৎসর্গ একমাত্র আল্লাহর জন্যই করার নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ
الْعَالَمِينَ، لا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ
الْمُسْلِمِينَ
‘‘বল, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার উৎসর্গ-কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু আল্লাহরই জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক,তাঁর কোন শরীক নেই। এজন্যই আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং আমি সর্বাগ্রে আত্মসমর্পণ করছি।’’[2]
প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আলী আলাউদ্দীন আল-হাসকাফী (১০৮৮ হি) আদ-দুর্রুল মুখতার গ্রন্থে বলেন:
وَاعْلَمْ أَنَّ النَّذْرَ الَّذِي يَقَعُ لِلأَمْوَاتِ مِنْ أَكْثَرِ الْعَوَّامِ
وَمَا يُؤْخَذُ مِنْ الدَّرَاهِمِ وَالشَّمْعِ وَالزَّيْتِ وَنَحْوِهَا إلَى
ضَرَائِحِ الأَوْلِيَاءِ الْكِرَامِ تَقَرُّبًا إلَيْهِمْ فَهُوَ بِالإِجْمَاعِ
بَاطِلٌ وَحَرَامٌ مَا لَمْ يَقْصِدُوا صَرْفَهَا لِفُقَرَاء الأَنَامِ وَقَدْ
اُبْتُلِيَ النَّاسُ بِذَلِكَ ، وَلا سِيَّمَا فِي هَذِهِ الأَعْصَارِ
‘‘জেনে রাখ, মৃতদের জন্য নযর-মানত যা অধিকাংশ সাধারণ মানুষ করে থাকে এবং আওলিয়ায়ে কেরামের মাযার-কবরের জন্য যে সব টাকাপয়সা, মোমবাতি, তেল ও অনুরূপ দ্রব্য গ্রহণ করা হয় তাদের নৈকট্য বা নেক-নজর লাভের জন্য তা সবই বাতিল ও হারাম বলে ইজমা হয়েছে। যদি না তারা দরিদ্র অসহায় মানুষদের জন্য তা ব্যয় করার মানত করে। মানুষেরা এরূপ নিষিদ্ধ নযর-মানতের মধ্যে নিপতিত হয়েছে, বিশেষত বর্তমান যুগে।’’[3]
এর ব্যাখ্যায় আল্লামা শামী ‘‘হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার’’ গ্রন্থে বলেন:
قَوْلُهُ (تَقَرُّبًا إلَيْهِمْ ) كَأَنْ يَقُولَ يَا سَيِّدِي فُلانٌ إنْ رُدَّ
غَائِبِي أَوْ عُوفِيَ مَرِيضِي أَوْ قُضِيَتْ حَاجَتِي فَلَكَ مِنْ الذَّهَبِ
أَوْ الْفِضَّةِ أَوْ مِنْ الطَّعَامِ أَوْ الشَّمْعِ أَوْ الزَّيْتِ ... (
قَوْلُهُ بَاطِلٌ وَحَرَامٌ ) لِوُجُوهٍ: مِنْهَا أَنَّهُ نَذَرَ لِمَخْلُوقٍ
وَالنَّذْرُ لِلْمَخْلُوقِ لا يَجُوزُ لأَنَّهُ عِبَادَةٌ وَالْعِبَادَةُ لا
تَكُونُ لِمَخْلُوقٍ. وَمِنْهَا أَنَّ الْمَنْذُورَ لَهُ مَيِّتٌ وَالْمَيِّتُ لا
يَمْلِكُ. وَمِنْهُ أَنَّهُ إنْ ظَنَّ أَنَّ الْمَيِّتَ يَتَصَرَّفُ فِي الأُمُورِ
دُونَ اللَّهِ تَعَالَى وَاعْتِقَادَهُ ذَلِكَ كُفْرٌ
‘‘মাযারে তাদের নৈকট্য বা নেক-নজর লাভের জন্য মানত করার ধরন এই যে, মানতকারী বলবে, হে অমুক হুজুর বা অমুক বাবা, যদি আমার হারানো ব্যক্তি ফিরে আসে বা আমার অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হয় বা আমার হাজত পূর্ণ হয় তবে তোমার জন্য অমুক পরিমাণ স্বর্ণ, রৌপ্য, খাদ্য, মোমবাতি বা তেল দেব। এ প্রকারের মানত বাতিল ও হারাম হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে: প্রথমত, তা মাখলূক বা সৃষ্টির জন্য নযর-মানত করা, আর কোনো সৃষ্টির জন্য মানত-নযর জায়েয নয়। কারণ মানত-নযর ইবাদত এবং কোনো মাখলুকের ইবাদত করা যায় না। দ্বিতীয়ত, যার জন্য মানত করা হয়েছে তিনি মৃত। আর মৃত ব্যক্তি কোনো মালিকানা লাভ করতে পারে না। তৃতীয়ত, এরূপ মানতকারী ধারণা করেছে যে, আল্লাহ ছাড়া মৃত মানুষও দুনিয়ার পরিচালনায় কিছু করতে পারেন, আর তার এ আকীদা কুফর।’’[4]
এ প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী বলেন: ‘‘মহান আল্লাহ বলেছেন[5]: ‘‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না...।’’ যারা আল্লাহর ওলীগণের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে এখানে তাদের নিন্দার প্রতি ইশারা করা হয়েছে; কারণ তারা বিপদে আপদে তাদের নিকট ত্রাণপ্রার্থনা করে এবং মহান আল্লাহর নিকট ত্রাণ প্রার্থনা করা থেকে গাফিল থাকে এবং এ সকল ওলীর জন্য তারা নযর-মানত করে। তাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান তারা বলে, এ সকল ওলী হচ্ছেন আল্লাহর নিকট আমাদের ওসীলা। এবং বলে যে, আমরা আল্লাহর জন্যই নযর-মানত করি এবং এর সাওয়াব ওলীর জন্য প্রদান করি। এ কথা সুস্পষ্ট যে, তাদের প্রথম দাবির বিষয়ে তারা মূর্তিপূজকদের সবচেয়ে নিকটবর্তী ও মূর্তিপূজকদের মতই, যারা বলত[6]: ‘আমরা এদের ইবাদত করি তো এজন্যই যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিয়ে দেবে।’
তাদের দ্বিতীয় দাবিটি আপত্তিকর হবে না, যদি তারা এরূপ মানতের মাধ্যমে ওলীগণের নিকট থেকে তাদের অসুস্থব্যক্তিদের সুস্থতা, তাদের হারানো মানুষের প্রত্যাবর্তন বা অনুরূপ কোনো হাজত প্রার্থনা না করে। কিন্তু তাদের বাহ্যিক অবস্থা প্রমাণ করে যে, তারা এদের নিকট মানতের দ্বারা এরূপ কিছুই প্রার্থনা করে। এর প্রমাণ এই যে, তাদেরকে যদি বলা হয় যে, তোমরা আল্লাহর জন্য মানত কর এবং এর সাওয়াব তোমাদের পিতামাতার জন্য দান কর, কারণ এ সকল ওলী-আওলিয়ার চেয়ে তোমাদের পিতামাতগণেরই সাওয়াবের প্রয়োজন বেশি, তবে তারা তা করবে না। আমি এদের অনেককে দেখেছি যে, তারা ওলীগণের কবরের পাথরের বেদিমূলে সাজদা করছে।
এদের অনেকে দাবি করে যে, সকল ওলীই তাদের কবরে বসে দুনিয়া পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন, তবে তাদের বেলায়াতের মর্তবা অনুসারে তাদের ক্ষমতার কমবেশি রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা আলিম তারা বিশ্ব পরিচালনার এরূপ ক্ষমতা ৪ বা ৫ জন কবরবাসীর জন্য সীমাবদ্ধ করেন। তাদের নিকট যদি প্রমাণ চাওয়া হয় তবে তারা বলেন, কাশফ দ্বারা তা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন! এরা কত বড় জাহিল!! আর এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াতি কত ব্যাপক!!!
তাদের অনেকে দাবি করে যে, এ সকল ওলী-আউলিয়া তাদের কবর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করেন। তাদের মধ্যে যারা আলিম তারা বলে, এ সকল ওলীর রূহ প্রকাশিত হয়ে যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায় এবং কখনো কখনো তারা বাঘ, সিংহ, হরিণ বা অনুরূপ প্রাণীর আকৃতি ধারণ করে। এ সবই ভিত্তিহীন বাতিল কথা। কুরআন, সুন্নাহ এবং উম্মাতের প্রথম যুগে ইমামগণের কথার মধ্যে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। এ সকল মিথ্যাচারী মানুষদের দীন-ধর্ম নষ্ট করে দিয়েছে। ইহূদী, খৃস্টান ও অন্যান্য বাতিল ও বিকৃত ধর্মের মানুষদের নিকটেও এরা হাসি-মস্করার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমনকি বাতিল মতবাদ ও নাস্তিকতার অনুসারীরাও এদের নিয়ে হাস্যকৌতুক করে। আমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করি।’’[7]
শাহ ওয়ালি উল্লাহ বলেন: ‘‘কবর পূজারীদেরকে পীর পুরস্ত বা পীর পূজারীও বলা হয়। কবর পূজারী সম্প্রদায় কবর পূজাকে ফরয ইবাদত তথা নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি হইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। সুন্নত ইবাদত ও অযীফা করার চেয়ে কবর পূজাকে অধিক ফযীলতপূর্ণ ও সাওয়াবের কাজ মনে করে। তাই তাহারা কবর পূজাকে যে কোন প্রকার ইবাদতের পরিবর্তে করিয়া থাকে এবং ইহাকেই যথেষ্ট মনে করে। বস্ত্তত তারা কিন্তু কবর পূজার পরিবর্তে আল্লাহর কোন ইবাদতকে গুরুত্ব দেয় না এবং উহাকে যথেষ্ট মনে করে না। যখন কোন বুযুর্গের উরশ বা মেলা ইত্যাদি হয় তখন সেখানে বহু দূর দূরান্ত হইতে বহু লোকের সমাগম হয়। এই ক্ষেত্রে কবর পূজারীরা সেই মেলায় উপস্থিত হওয়া ফরয ইবাদত মনে করে এবং অন্যান্য ফরয অর্জন করার চেয়ে এটাকেই অধিক প্রয়োজন মনে করিয়া থাকে।
কবর পূজারীদের সবচেয়ে জঘন্য কাজ হইল যাবতীয় পার্থিব বিপদাপদ ও সঙ্কটময় কাজের সমাধান হওয়ার জন্য কবরের নিকট গিয়া এমন বিনয়তা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সাথে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে যে, মসজিদে বা অন্য কোথাও আল্লাহকে হাযির নাযির মনে করিয়া উহার শত ভাগের এক ভাগও করে না। কবরে শায়িত বুযুর্গের নাম ধরিয়া তাহাকে ডাকে এবং দোআ করে এবং তাহার নিকট জীবিকা ও সন্তানাদি কামনা করে। অত্যন্ত বিনয় ও মনযোগের সহিত মাথানত (করিয়া) কাপড়ের গেলাফ এবং চাদর লাগায়; কবরের উপর সুগন্ধি ছড়ায়। পূণ্যের কাজ মনে করিয়া লোবান, আগর বাতি জ্বালায় এবং কবরকে সুন্দরভাবে সজ্জিত করে। এই অযথা কাজে পীরের আত্মাকে খুশী করার নিয়তে তাহার সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করে। আপাতঃদৃষ্টে দেখা যায় যে হিন্দু ও মুশরিক সম্প্রদায় তাহাদের প্রতিমার জন্য যেভাবে অর্চনা করিয়া থাকে ঠিক সেই ভাবেই এই কবর পূজারীগণও সেই সমস্ত কাজকে পুণ্যময় মনে করিয়া সম্পাদন করিয়া থাকে।’’[8]
[1] সূরা (৬) আনআম : ১৩৬ আয়াত।
[2] সূরা (৬) আনআম : ১৬২-১৬৩ আয়াত।
[3] ইবনু আবিদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ২/৪৩৯-৪৪০।
[4] ইবনু আবিদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ২/৪৩৯।
[5] সূরা (২২) হাজ্জ: ৭৩ আয়াত।
[6] সূরা (৩৯) যুমারের ৩ আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
[7] আলূসী, রূহুল মা‘আনী ১৩/১৫৫।
[8] শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী, আল-বালাগুল মুবীন (বঙ্গানুবাদ), পৃ. ১৮।
৪. ৪. ২. ৩. দু‘আ, ডাকা বা প্রার্থনা
দু‘আ (دعاء) অর্থ আহবান, ডাকা, প্রার্থনা (call, pray, invoke)। ডাকা এবং প্রার্থনা করা পরস্পর জড়িত। কারো কাছে প্রার্থনা করতে হলে তাকে ডাকা হয় এবং সাধারণত কারো ডাকার উদ্দেশ্য তার সাহায্য প্রার্থনা করা। বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে দু‘আকে অনেক সময় ‘ইসতি‘আনাহ (الاستعانة) অর্থাৎ ‘আওন’ বা সাহায্য প্রার্থনা, ‘ইসতিম্দাদ’ (الاستمداد), অর্থাৎ ‘মদদ’ বা সাহায্য প্রার্থনা, ‘ইসতিগাসাহ’ (الاستغاثة) অর্থাৎ ‘গাউস’ বা ত্রাণ প্রার্থনা বলা হয়। সবকিছুরই মূল ‘দু‘আ’ বা প্রার্থনা। প্রার্থনা বা ডাকার বিষয়বস্ত্ত দু প্রকারের হতে পারে: লৌকিক ও অলৌকিক।
লৌকিক বা জাগতিক প্রার্থনা মানুষ স্বাভাবিকভাবে একে অপরের কাছে করতে পারে। এ সকল বিষয় প্রকৃতিগতভাবে একজন মানুষ আরেকজনের নিকট চেয়ে থাকে এবং মানুষ জাগতিকভাবে তা প্রদান করতে পারে। যেমন, কারো কাছে টাকাপয়সা চাওয়া, সাহায্য চাওয়া, পানিতে পড়ে গেলে উঠানোর জন্য ডাকা, সাহায্য চাওয়া, মাথার বোঝা পড়ে গেলে উঠাতে সাহায্য চাওয়া, ইত্যাদি। জাতি, ধর্ম, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সকলেই এ ধরনের সাহায্য প্রার্থনা করে।
দ্বিতীয় প্রকার প্রার্থনা বা ডাকা অলৌকিক। জাগতিক উপকরণ ছাড়া অলৌকিক সাহায্য, ত্রাণ ইত্যাদি প্রার্থনা করা। এ জাতীয় প্রার্থনা শুধু কোনো ‘‘ধর্মের অনুসারী’’ বা ‘‘বিশ্বাসী’’ করেন। ‘‘বিশ্বাসী’’ কেবল ‘আল্লাহ’, ‘ঈশ্বর’ বা সর্বশক্তিমান বলে যাকে বিশ্বাস করেন, অথবা যার সাথে ‘ইশ্বরের’ বিশেষ সম্পর্ক ও যার মধ্যে ‘ঐশ্বরিক’ ক্ষমতা আছে, তার কাছেই এরূপ প্রার্থনা করেন বা তাকেই এভাবে ডাকেন।
দ্বিতীয় প্রকারের এ প্রার্থনাই ইবাদত-এর সর্বজনীন প্রকাশ। সকল যুগে সকল ধর্মের মানুষই মূলত তার আরাধ্য বা উপাস্যকে ডাকে ও তার কাছে প্রার্থনা করে অলৌকিক সাহায্য লাভের জন্য। উৎসর্গ, কুরবানি (sacrifice), মানত, ফুল, সাজদা, গড়াগড়ি ইত্যাদি সবই দু‘আর জন্যই। যেন পূজিত ব্যক্তি বা বস্ত্ত এ সকল উৎসর্গে খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি প্রার্থনা পূরণ করেন সে জন্যই বাকি সকল প্রকারের ইবাদত ও কর্ম। এভাবে আমরা দেখছি যে দু‘আই ইবাদত-এর সর্বজনীন ও সর্বপ্রধান প্রকাশ। নু’মান ইবনু বাশীর (রা) বলেন, নবীজী (ﷺ) বলেন :
الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ .... وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ
إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ
دَاخِرِينَ
‘‘দু‘আ অর্থাৎ ডাকা বা প্রার্থনা করাই ইবাদত।’’ একথা বলে তিনি পাঠ করলেন[1]: ‘‘তোমাদের প্রভু বলেন: তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। যারা আমার ইবাদত থেকে অহঙ্কার করে (আমার কাছে প্রার্থনা না করে) তারা শীঘ্রই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’’[2]
বিশ্বের সকল মুশরিকের ন্যায় আরবের মুশরিকগণের মূল শিরক ছিল অলৌকিক বা গাইবী সাহায্যের জন্য গাইরুল্লাহকে ডাকা। তারা বিপদে আপদে ফিরিশতা, জিন, ঈসা (আ), উযাইর (আ), ইবরাহীম (আ) ইয়াগূস, ওয়াদ্দ প্রমুখ নবী, ওলী এবং তাদের কল্পিত উপাস্যদেরকে ডাকত। এরূপ প্রার্থনার অসারতা প্রকাশ করে আল্লাহ বলেন:
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِهِ فَلا يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ
عَنْكُمْ وَلا تَحْوِيلا أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى
رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ
عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا
‘‘বল, ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ধারণা কর তাদেরকে আহবান কর, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।’ তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য সন্ধান করে, কে কত বেশি নিকটতর হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।’’[3]
মুশরিকগণ বিশ্বাস করত যে, ফিরিশতাগণ, জিন্নগণ, ঈসা (আ), উযাইর (আ), ইয়াগূস, ইয়াউক ও তাদের অন্যান্য জীবিত বা মৃত উপাস্যগণকে দুনিয়ার যেখান থেকেই ডাকা হোক তারা সকল গাইবী ডাক শুনেন ও সাড়া দেন। ফিরিশতাগণ, জিন্নগণ তো জীবিত, তাঁরা তো শুনেনই, উপরন্তু মৃত নবী-ওলীগণের আত্মা তাদের ডাক শুনেন ও সাড়া দেন। কুরআনের বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, জিন্ন শয়তানগণ এ সকল মাবুদের রূপ ধরে তাদেরকে প্রতারণা করত; ফলে কাফিরদের এরূপ ধারণা জোরদার হতো।[4] মহান আল্লাহ এ বিশ্বাস খন্ডন করে জানান যে, এদের কেউই গাইবী ডাক বা দূরের ডাক শুনেন না এবং সাড়াও দেন না। উপরন্তু কিয়ামতের দিন এরা এ সকল পূজারীর বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে নালিশ করবেন। আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لا يَسْتَجِيبُ لَهُ
إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ وَإِذَا حُشِرَ
النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاءً وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِينَ
‘‘সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কাউকে ডাকে যে কিয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দিবে না? এবং তারা তার প্রার্থনা সম্বন্ধে অবহিতও নয়। যখন কিয়ামতের দিন মানুষকে একত্র করা হবে তখন তারা হবে তাদের শত্রু এবং তারা তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে।’’[5]
যেহেতু দু‘আই ইবাদতের মূল প্রকাশ এবং এতেই বেশি শিরকে লিপ্ত হয় মানুষ, সেহেতু কুরআনে এ ইবাদতের কথা সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে বা একমাত্র তাঁরই কাছে দু‘আ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোথাও আল্লাহ ছাড়া আর অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করার অসারতা বর্ণনা করা হয়েছে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট প্রার্থনা করতে নিষেধ করা হয়েছে, কোথাও মুশরিকরা যে তাদের উপাস্যদের ডাকত বা তাদের কাছে দুআ করার মাধ্যমে শিরক করত তা বলা হয়েছে। কুরআনে দু-শতাধিক স্থানে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে।
দু‘আর শিরকের বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ বলেন: ‘‘মুশরিকগণ আল্লাহ ছাড়া অন্যদের নিকট হাজত বা প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাহায্য প্রার্থনা করত। অসুস্থ ব্যক্তির সুস্থতা, দরিদ্র ব্যক্তির সচ্ছলতা ইত্যাদি প্রয়োজনে তারা তাদের নিকট প্রার্থনা করত। এ সকল উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার জন্য তারা তাদের নামে মানত করত। তারা আশা করত যে, এ সকল মানতের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে এবং বিপদাপদ কেটে যাবে। তারা বরকত লাভের উদ্দেশ্যে এ সকল উপাস্যের নাম পাঠ করত। একারণে আল্লাহ তাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, তারা সালাতের মধ্যে বলবে[6]:
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
‘‘আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’’[7]
একটি উদাহরণ থেকে আমরা লৌকিক এবং শিরকী ত্রাণ প্রার্থনা বা ডাকার মধ্যে পার্থক্য বুঝার চেষ্টা করি। মনে করুন আমার গরুটি পালিয়ে যাচ্ছে, আমি পানিতে ডুবে যাচ্ছি বা পথ হারিয়েছি। আমি সামনে কোনো মানুষ দেখে বা কোনো মানুষ- জিন বা ফিরিশতা- থাকতে পারে মনে করে চিৎকার করে বললাম, ভাই, কে আছেন ভাই, আমার গরুটি ধরে দিন! আমাকে টেনে তুলুন! আমাকে পথটি বলে দিন!
এখানে আমি লৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করছি। আমি দৃশ্য বা অদৃশ্য ঐ ব্যক্তির মধ্যে কোনো অলৌকিকত্ব বা ঐশ্বরিক গুণ কল্পনা করছি না। ঐ ব্যক্তির পরিচয়ও আমার কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। আমি জানি যে, স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ একটি গরু ধরতে পারে, ডুবন্ত মানুষকে টেনে তুলতে পারে বা উক্ত স্থানের একজন বাসিন্দা পথটি চিনবে বলে আশা করা যায়। এজন্য আমি তার থেকে এরূপ লৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করছি।
কিন্তু এ প্রকার লৌকিক বা জাগতিক সাহায্য প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে যদি কেউ অনুপস্থিত কাউকে ডাকেন বা অনুপস্থিত কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন তাহলে তা শিরক। কারণ সে মনে করছে, অনুপস্থিত অমুক ব্যক্তি সর্বত্র বিরাজমান বা সর্বদা সকল স্থানের সবকিছু তার গোচরিভূত। কাজেই, তিনি দূরবর্তী স্থান থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছেন বা আমার ডাক শুনতে পাচ্ছেন এবং দূর থেকে আমার বিপদ কাটিয়ে দেওয়ার মতো ‘‘অলৌকিক’’ ক্ষমতা তার আছে। এভাবে সে একটি নির্দিষ্ট সৃষ্টির মধ্যে অলৌকিকত্ব বা আল্লাহর বিশেষণ আরোপ করে শিরকে নিপতিত হয়েছে।
এছাড়া সে আল্লাহর ক্ষমতাকে ছোট বলে মনে করেছে। সে ঐ বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে যে ক্ষমতা কল্পনা করেছে তা একান্তভাবেই আল্লাহর। কিন্তু সে তা শুধু আল্লাহর বলে মনে করে না। সে বিশ্বাস করে যে, এ ক্ষমতা যেমন আল্লাহর আছে, তেমনি অমুক ব্যক্তিরও আছে। বাহ্যত সে তার কল্পনার মানুষটির ক্ষমতা এ ক্ষেত্রে আল্লাহর ক্ষমতার চেয়ে অধিক বলে বিশ্বাস করে। এজন্যই সে আল্লাহকে না ডেকে তাকে ডেকেছে।
মুসলিম সমাজে প্রচলিত এ জাতীয় কিছু শিরকী কর্মের বিষয়ে প্রসিদ্ধ তাফসীর-গ্রন্থ ‘রূহুল মা‘আনী’র প্রণেতা আল্লামা শিহাব উদ্দীন মাহমূদ আল আলূসী হানাফী (১২৭০ হি) তাঁর তাফসীরের বিভিন্ন স্থানে আলোচনা করেছেন। মহান আল্লাহ কুরআনে বিভিন্ন স্থানে বলেছেন যে, মুশরিকগণ সাধারণ বিপদ-আপদে তাদের মাবুদদের ডাকত এবং কঠিন বিপদে আল্লাহকে ডাকত। এ প্রসঙ্গে সূরা ইউনুসের ২২ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা আলূসী বলেন: ‘‘এ আয়াত প্রমাণ করে যে, এরূপ অবস্থায় মুশরিকগণ মহান আল্লাহ ছাড়া কাউকে ডাকত না। আর আপনি ভালই অবগত আছেন যে, আজকাল মানুষেরা কি করে! জলে বা স্থলে যখন কোনো কঠিন বিপদ বা বড় কোনো সমস্যার মধ্যে তারা নিপতিত হয় তখন তারা এমন ব্যক্তিদেরকে ডাকে যারা কোনো ক্ষতি করেন না এবং উপকারও করেন না, যারা দেখেনও না এবং শুনেনও না। তাদের কেউ খিযির এবং ইলিয়াসকে ডাকে। আর কেউ আবুল খামীস এবং আব্বাস (আ)-কে ডাকে। কেউ বা কোনো একজন ইমামকে ডাকে। কেউ বা উম্মাতের বুজুর্গ-মাশাইখের মধ্য থেকে কারো কাছে আকুতি আবেদন পেশ করে। তাদের মধ্যে একজনকেও দেখবেন না যে শুধু তার মালিক-মাওলাকে ডাকছে এবং শুধু তাঁর কাছেই আকুতি-আবেদন পেশ করছে। সম্ভবত তার মনের কোণে একবারও এ চিন্তা উকি দেয় না যে, যদি সে একমাত্র আল্লাহকে ডাকত তবে এ সকল বিপদ থেকে রক্ষা পেত। হে পাঠক, আল্লাহর কসম দিয়ে আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, বলুন তো, এ দিক থেকে মক্কার মুশরিকগণ এবং বর্তমানের মানুষদের মধ্যে কোন দল অধিকতর হেদায়াত প্রাপ্ত? উভয় প্রার্থনাকারী ও আহবানকারীর মধ্যে কার প্রার্থনা অধিকতর সত্য?’’[8]
এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী বলেন: ‘‘কবর পূজারীগণ যে সমস্ত কারণে কবর পূজা করিয়া থাকে উহাদের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হইল নিজেদের কুকর্মের সমর্থনে মিথ্যা হাদীস সৃষ্টি করা। নিজেদের মনগড়া এই জাতীয় হাদীস প্রচার করিয়া সরল প্রাণ মুসলমানদিগকে ধোঁকা দিয়া আল্লাহর পথ হইতে দূরে সরাইয়া লইয়া যায়। ..... কবর পূজারী সম্প্রদায় তাহাদের কুকর্মের সমর্থনে যে সমস্ত অলীক ও মনগড়া কাহিনীর অবতারণা করিয়া জনসাধারণকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করিয়া থাকে উহা সত্যিই প্রণিধানযোগ্য। যেমন তাহারা বলিয়া থাকে যে, অমুক ব্যক্তি কঠিন বিপদে পড়িয়া একেবারে দিশাহারা হইয়া পড়ে। মুক্তির কোন পথ দেখিতে না পাইয়া অমুক দরবেশের মাজারে গিয়া বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা জানায়। কি আশ্চর্য! সেই দরবেশ তাহাকে দুই-একদিনের মধ্যে সমস্ত বিপদাপদ দূর করিয়া দেয়। ... এমনকি কেহ কেহ নিজের কথাও বলিয়া থাকে যে, আমি অমুক বিপদে পতিত হইয়া শেষ চেষ্টা স্বরূপ অমুক পীরের মাজারে নযর-নেওয়াজ লইয়া গিয়া তাহার সকল বিপদ দূর করিয়া দেয় .....
নাউযুবিল্লাহ! আল্লাহ আমাদের সকলকে এই শিরক ও বিদআত হইতে নিরাপদ রাখুন।... ঘর হইতে পা বাড়াইলেই যে আল্লাহর খালেছ ইবাদতখানা মসজিদ সেখানে যাওয়ার কষ্টটুকু ইহারা স্বীকার করিতে চায় না। অথচ মাইলের পর মাইল, দিনের পর দিন হাঁটিয়া গিয়া কবরের নিকট ধর্ণা দিয়া পড়িয়া থাকাকেই শ্রেয় মনে করে।... ইহারা যদি কবরে না গিয়া রাস্তাঘাট, হাট-বাজার অথবা গোসলখানায় বসিয়াও এমন কাকুতি-মিনতি ও একাগ্রতার সাথে কান্নাকাটি করিয়া মুক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করিত তবুও আল্লাহ তাদের দোআ কবুল করিতেন, তাহাদের দোআ ব্যর্থ হইত না। সুতরাং এই অবস্থায় কবরের বুযুর্গী ও প্রভাব মনে করা অজ্ঞতা ও কুসংস্কার ব্যতীত কিছুই নহে। আল্লাহ বিপদাপন্নের দোআ যে সকল সময়ই কবুল করিয়া থাকেন ইহা এই অজ্ঞেরা বুঝিতে চায় না। এমন কি কাফেরও যদি আল্লাহর নিকট একাগ্রতার সাথে দোআ করে আল্লাহ তাহাও কবুল করিয়া থাকেন।... ।’’[9]
বাংলার প্রসিদ্ধ পীর ও সংস্কারক ফুরফুরার পীর শাইখ আবূ বকর সিদ্দীকী (১৩৫৮হি/১৯৩৯খৃ)-এর নির্দেশে আল্লামা রুহুল আমিন (১৩৬৪হি/১৯৪৫খৃ) দুআ, ডাকা বা প্রার্থনা বিষয়ক শিরকগুলো ব্যাখ্যা করেন। তিনি হাফিযুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন শিহাবুদ্দীন ইবনুল বায্যায রচিত ফাতাওয়া বায্যাযিয়্যাহ, শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবীর আল-কাওলুল জামীল, শাহ আব্দুল আযীয দেহলবীর তাফসীরে আযীযী, শাহ রফীউদ্দীন দেহলবীর রেসালায়ে নুযূর, শাহ ইসহাক দেহলবীর মিআত মাসাইল, কাযী সানাউল্লাহ পানিপথীর এরশাদুত্তালিবীন, মাওলানা আব্দুল হাই লাখনবীর মাজমুআ ফাতাওয়া ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে তৎকালীন সমাজে প্রচলিত নিম্নরূপ শিরকগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন:
আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে গাইবী ইলম বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, মনোবাঞ্ছা পূরণকারী বা কল্যাণ-অকল্যাণে সক্ষম বলে ধারণা করা শিরক। বিপদে আপদে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিপদ মোচনের জন্য ডাকা বা কারো দিকে মনোনিবেশ করা শিরক। (ইয়া শাইখ আব্দুল কাদির, শাইয়ান লিল্লাহ): হে শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী, আল্লাহর জন্য আমাকে কিছু দিন, অথবা হে খাজা শামসুদ্দীন পানিপতি, আল্লাহর জন্য আমাকে কিছু দিন.. ইত্যাদি বলা শিরক।
মহান আল্লাহ তাঁর ওলীদেরকে বিশ্বের সকল স্থানের মানুষদের ডাক শোনা, অবস্থা জানা বা সাহায্য করার অলৌকিক জ্ঞান বা ক্ষমতা প্রদান করেছেন বলে বিশ্বাস করা শিরক।
যদি সালাত-সালাম বলার জন্য কেউ দূর থেকে ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ’ বলে তবে তা বৈধ। আর যদি কেউ ধারণা করে যে, রাসূলুল্লাহ বা কোনো ওলী দূর থেকে ডাকলে শুনতে পান, মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার ক্ষমতা রাখেন, দুনিয়ার কার্য নির্বাহ করেন অথবা বিশ্ব পরিচালনায় কোনোভাবে আল্লাহর কাজের অংশীদার আছেন বা এরূপ বিশ্বাসের ভিত্তিতে দূর থেকে ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া ওলিয়াল্লাহ ইত্যাদি বলে ডাকে তবে তা সুস্পষ্ট শিরক। এরূপ শিরক বাতিল করতেই নবীগণ প্রেরিত হয়েছিলেন।
নবীগণ বা ওলীগণ সব সময় হাযির-নাযির, বা দূরের ডাক শুনেন ও দুআ করেন বলে ধারণা করা হারাম ও সুস্পষ্ট শিরক।
পীরগণের রূহ হাযির বা লোকদের অবস্থা জানেন বলে বিশ্বাস করা শিরক।
কেউ যে কোনো স্থান থেকে ডাকলে ‘গাওস আযম’ তা শুনতে পারেন বা তার অবস্থার দিকে লক্ষ্য করেন বলে আকীদা পোষণ করা শিরক।[10]
[1] সূরা গাফির (মুমিন) : ৬০ আয়াত।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২১১ (কিতাবু তাফসীরিল কুরআন, বাব ওয়ামিন সূরাতিল বাকারাহ) ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৩/১৭২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৬৭। হাদীসটি সহীহ।
[3] সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ৫৬-৫৭ আয়াত। তাবারী, ইবনু কাসীর ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থে এ আয়াতের তাফসীর দেখুন।
[4] দেখুন: সূরা (৩৪) সাবা: ৪০-৪১; (১৬) নাহল: ৮৬-৮৭ আয়াত।
[5] সূরা (৪৬) আহকাফ: ৫-৬ আয়াত।
[6] সূরা (১) ফাতিহা: ৪ আয়াত।
[7] শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১/১২৯।
[8] আলূসী, রুহূল মাআনী ৭/৪৭৪।
[9] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন, পৃ. ৪৪-৪৭।
[10] মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বাগমারির ফকিরের ধোকাভঞ্জন, পৃ. ১-১৪।
৪. ৪. ২. ৪. তাবার্রুক
তাবার্রুক অর্থ বরকত অনুসন্ধান করা। আরবের মুশরিকদের শিরকের একটি দিক ছিল তাবার্রুক বা বরকত লাভের জন্য কোনো স্থান বা দ্রব্যের প্রতি ভক্তি প্রকাশ। তারা কাবা ঘরের পাথর বরকতের জন্য কাছে রাখত, তাওয়াফ করত বা সম্মান করত। এ সম্পর্কে ইবনু ইসহাক তার ‘‘সীরাতুন্নবী’’ গ্রন্থে বিভিন্ন সাহাবী ও তাবেয়ীর সূত্রে লিখেছেন: ইসমাঈলের বংশে আরবদের মধ্যে শিরক প্রচলনের কারণ ছিল, এরা কাবাঘরের খুবই ভক্তি করতেন। তারা কাবাঘর ছেড়ে যেতে চাইতেন না। যখন তাদের বাধ্য হয়ে কাবাঘর ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় যেতে হতো, তখন তারা সাথে করে কাবাঘরের তাযীমের জন্য কাবাঘরের কিছু পাথর নিয়ে যেতেন। তারা যেখানেই যেতেন সেখানে এ পাথরগুলো রেখে তার তাওয়াফ করতেন ও সম্মান করতেন। পরবর্তী যুগে ক্রমান্বয়ে এ সকল পাথর ইবাদত করার প্রচলন হয়ে যায়। পরে মানুষেরা খেয়াল খুশি মতো বিভিন্ন পাথর পূজা করতে শুরু করে।[1]
কাবাগৃহের পাথর-গেলাফ ছাড়া আরো অনেক কিছু তারা ‘তাবার্রুকের নামে’ ভক্তি করত এবং শিরকে নিপতিত হতো। এগুলোর মধ্যে ছিল ‘যাত আনওয়াত’ নামক একটি বৃক্ষ। আবু ওয়াকিদ লাইসি (রা) বলেন:
إنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ لَمَّا خَرَجَ إِلَى حُنَيْنٍ (خَرَجَنَا مَع رسول الله ﷺ
إِلَى حُنَيْنٍ وَنَحْنُ حَدِيْثُوْ عَهْدٍ بِكُفْرٍ، وكَانُوا أَسْلَمُوا يَوْمَ
الْفَتْحِ) مَرَّ بِشَجَرَةٍ لِلْمُشْرِكِينَ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ
يُعَلِّقُونَ عَلَيْهَا أَسْلِحَتَهُمْ (سِدْرَةٌ يَعْكُفُوْنَ حَوْلَهَا
ويُعَلِّقُوْنَ بِهَا أَسْلِحَتَهُمْ) فَقَالُوا (قُلْنَا) يَا رَسُولَ اللَّهِ
اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ
سُبْحَانَ اللَّهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا
لَهُمْ آلِهَةٌ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ
قَبْلَكُمْ
‘‘মক্কা বিজয়ের পরে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সাথে হুনাইনের যুদ্ধের জন্য যাত্রা করি। তখন আমরা নও মুসলিম। মক্কা বিজয়ের সময়েই কেবল আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। চলার পথে তিনি মুশরিকদের একটি (বরই) বৃক্ষের নিকট দিয়ে যান, যে গাছটির নাম ছিল ‘যাতু আনওয়াত’। মুশরিকগণ এ গাছের কাছে বরকতের জন্য ভক্তিভরে অবস্থান করত এবং তাদের অস্ত্রাদি বরকতের জন্য ঝুলিয়ে রাখত। আমাদের কিছু মানুষ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, মুশরিকদের যেমন ‘যাতু আনওয়াত’ আছে আমাদেরও অনুরূপ একটি ‘যাতু আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দেন। তখন তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর কসম, মূসার কওম যেরূপ বলেছিল: মুশরিকদের মূর্তির মতো আমাদেরও মূর্তির দেবতা দাও[2], তোমরাও সেরূপ বললে। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর কসম, তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতি অনুসরণ করবে।’’[3]
ইহূদী-খৃস্টানদের তাবার্রুক বিষয়ক যে শিরকের কথা হাদীস শরীফে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো নবী ও অলীগণের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও কবর-মাজার থেকে বরকত লাভের চেষ্টা। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে আবূ উবাইদা, জুনদুব, কাব ইবনু মালিক, ইবনু মাসঊদ, ইবনু আব্বাস প্রমুখ সাহাবী (রাঃ) থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে সংকলিত মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَلا وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ
وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلا فَلا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّي
أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ. ... لَعَنَ اللَّهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا
قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسْجِدًا.
‘‘তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোন! তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মানুষেরা তাদের নবীগণ ও ওলীগণের কবরকে মসজিদ (ইবাদত-বন্দেগির স্থান) বানিয়ে নিত। তোমরা সাবধান! তোমরা কবরকে মসজিদ বানাবে না, আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি এ কাজ থেকে।’’ ... ‘‘আল্লাহ লানত করুন ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে, তারা তাদের নবীগণের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছিল।’’[4]
কবরের নিকট মসজিদ বানানোর উদ্দেশ্য কবরবাসীর ইবাদত করা নয়, বরং আল্লাহর ইবাদতে নেককার মানুষের সাহচর্য ও বরকত লাভ মাত্র। কিন্তু এরূপ তাবার্রুকের চিন্তাই শিরকের অন্যতম পথ। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কঠোরভাবে এরূপ করতে নিষেধ করেছেন।
সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যবহৃত দ্রব্য, তাঁর চুল, নখ ইত্যাদিকে বরকতের জন্য গ্রহণ ও সংরক্ষণ করতেন। আর তাঁর স্মৃতি বিজড়িত স্থানে তাঁর অনুকরণ করতেন। অর্থাৎ যেখানে তিনি যে ওয়াক্তের সালাত আদায় করেছেন সেখানে সে ওয়াক্তের সালাত আদায় করতেন, যেখানে ইসতিনজা করেছেন সেখানে ইসতিনজা করতেন, যেখানে যে সময়ে ঘুমিয়েছেন সেখানে সে সময়ে ঘুমাতেন... ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে তাঁরা এরূপ করেন নি। অনুরূপভাবে তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণ কখনো কোনো সাহাবী বা তাবিয়ীর কোনো স্মৃতি বিজড়িত দ্রব্য, বস্ত্ত বা স্থানের বরকত গ্রহণের চেষ্টা করেন নি। তাঁরা তাবার্রুকের নামে অতিভক্তির প্রতিবাদ করতেন।
নাফে’ (রাহ) বলেন: কিছু মানুষ হুদাইবিয়ায় ‘বাইয়াতে রেদওয়ানের গাছ’ নামে কথিত গাছটির নিকট আসত এবং সেখানে সালাত আদায় করত। উমার (রা) এ কথা জানতে পারেন। তখন তিনি তাদেরকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখান। পরে তিনি ঐ গাছটিকে কেটে ফেলতে নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশে গাছটি কেটে ফেলা হয়।[5]
উমার (রা) তাঁর খিলাফতকালে এক সফরে কিছু মানুষকে দেখেন যে, তারা সবাই একটি স্থানের দিকে যাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেন: এরা কোথায় যাচ্ছে? তাঁকে বলা হয়: হে আমীরুল মু’মিনীন, এখানে একটি মসজিদ আছে যেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাত আদায় করেছিলেন, এরা সেখানে যেয়ে সালাত আদায় করছে। তখন তিনি বলেন:
إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِمِثْلِ هَذَا، يَتَّبِعُوْنَ آثَارَ
أَنْبِيَائِهِمْ فَيَتَّخِذُونَهَا كَنَائِسَ وَبِيَعاً. مَنْ أَدْرَكَتْهُ
الصَّلاَةُ فِيْ هَذِهِ الْمَسَاجِدِ فَلْيُصَلِّ، وَمَنْ لاَ، فَلْيَمْضِ، وَلاَ
يَتَعَمَّدُهَا.
‘‘তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতেরা তো এ ধরনের কাজ করেই ধ্বংস হয়েছে। তারা তাদের নবীগণের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো খুঁজে বেড়াত এবং সেখানে গীর্জা ও ইবাদতখানা তৈরি করে নিত। যদি কেউ যাত্রা পথে (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্মৃতি বিজড়িত) এসব মসজিদে সালাতের সময়ে উপস্থিত হয় তবে সে সেখানে সালাত আদায় করবে। আর যদি কেউ যাত্রাপথে অন্য সময়ে সেখানে উপস্থিত হয়, তাহলে সে না থেমে চলে যাবে। বিশেষ করে এসকল মসজিদে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্য করবে না।’’[6]
[1] ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ ১/৯৪-৯৫।
[2] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৩৮ আয়াত।
[3] ইবনু আবী আসিম, আস-সুন্নাহ, পৃ. ৩৭; তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৪৭৫। হাদীসটি সহীহ।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ১/১৬৮ (আবওয়াবুল মাসাজিদ, বাবুস সালাতি ফিল বীয়াহ); মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৭৫-৩৭৮ (কিতাবুল মাসাজিদ, বাবুন নাহই আন বিনায়িল মাসাজিদ আলাল কুবূর)। বিস্তারিত বর্ণনাগুলির জন্য দেখুন: বুখারী, আস-সহীহ ১/১৬৫, ১৬৮, ৪৪৬, ৪৬৮, ৩/১২৭৩, ৪/১৬১৪, ৪/১৬১৫, ৫/২১৯০; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৭৫-৩৭৮; মালিক, আল-মুআত্তা ১/১৭২; আহমদ, আল-মুসনাদ ১/১৯৫, ২/২৪৬, ৩৭৬; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১/৫২৩-৫২৪, ৫৩১, ৩/২০০, ২০৮, ২৫৫।
[5] ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ২/৭৬, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৭/৪৪৮।
[6] ইবনু ওয়াদ্দাহ, আল-বিদাউ, ৪১-৪২, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/৫৬৯, শাতেবী, ইতিসাম ১/৪৪৮-৪৪৯।
৪. ৪. ২. ৫. আনুগত্য
কুরআন-হাদীসে আনুগত্যের শিরকের কথা বলা হয়েছে। আনুগত্য দু প্রকারের হতে পারে: লৌকিক বা জাগতিক এবং অলৌকিক বা অপার্থিব। বিশ্বাসী, নাস্তিক, ধার্মিক, অধার্মিক সকলেই স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় জাগতিকভাবে পিতামাতা, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের অনেকের আনুগত্য করেন। এরূপ জাগতিক আনুগত্য ইবাদত নয়। এমনকি জাগতিক লোভ বা ভয়ে আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে অন্যের আনুগত্যও ইবাদত বা শিরক নয়। ‘‘বিশ্বাসজাত’’ অলৌকিক বা অপার্থিব আনুগত্য ইবাদত।
ইহূদী-খৃস্টানগণ দাবি করত যে, তাওরাত-ইঞ্জিলের বিধিবিধান বুঝা সাধারণ মানুষদের কর্ম নয়। পাদরি-পোপগণ যা বলেন সেটিই চূড়ান্ত। তাঁরা ‘‘অভ্রান্ত’’ (infallible)। পবিত্র আত্মার সহায়তায় এরা সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে ইলম লাদুন্নী লাভ করেন; কাজেই এদের ভুল হতে পারে না। তাঁরা যা হালাল বলবেন তা প্রকৃতই হালাল, এবং তারা যা হারাম বলবেন তা প্রকৃতই হারাম, যদিও তাওরাত-ইঞ্জিলের বক্তব্য ভিন্ন হয়। এরূপ আনুগত্যকে শিরক বলে উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন:
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ
‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পন্ডিতগণকে এবং সংসার-বিরাগী দরবেশ-বুজুর্গগণকে রবব-প্রতিপালক রূপে গ্রহণ করেছে, এবং মরিয়ম তনয় মাসীহকেও।’’[1]
[1] সূরা (৯) তাওবা: ৩১ আয়াত। দেখুন: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ৪০৯-৪১৫।
৪. ৪. ২. ৬. ভালবাসা
ভালবাসার ক্ষেত্রেও জাগতিক ও ঈমানী দুটি পর্যায় আছে। জাগতিক ভালবাসা ইবাদত নয়, তবে জাগতিক ভালবাসা যদি আল্লাহর বিধান পালনের বিপরীতে দাঁড়ায় তবে তা পাপ। পিতামাতা, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্য মানুষকে মানুষ জাগতিকভাবে ভালবাসে।
ঈমানী ভালবাসার তিনটি দিক: (১) আল্লাহকে ভালবাসা (حب الله), (২) আল্লাহর জন্য ভালবাসা (الحب لله) এবং (৩) আল্লাহর সাথে ভালবাসা (الحب مع الله)। আল্লাহকে ভালবাসা হয় কেবল তাঁরই জন্য এবং এ ভালবাসার সাথে থাকে অলৌকিক ভয়, আশা, অসহায়ত্ব ও ভক্তির প্রকাশ। এরূপ ভালবাসাই ইবাদত। আল্লাহর জন্য ভালবাসতে হয় যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসতে নির্দেশ দিয়েছেন তাদেরকে এবং তাদেরকে ভালবাসার মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্টি নয় বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি আশা করা হয়। আর আল্লাহর সাথে ভালবাসা শিরক। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে অলৌকিক ভক্তি, ভয় ও অসহায়ত্বের সাথে ভালবাসা বা তার অলৌকিক নেক-নযর লাভের জন্য ভালবাসা শিরক। আল্লাহ বলেন:
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ
كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ
‘‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে, কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তর।’’[1]
মুশরিকগণ দাবি করত যে, তারা তাদের উপাস্যদেরকে ভালবাসত আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের হৃদয়ে এ সকল উপাস্যের প্রেমই ছিল মূল। এদের প্রশংসায় কিছু বললে তারা খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠত। কিন্তু একমাত্র আল্লাহর মর্যাদা, প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলে তারা বিরক্ত হতো। আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ
بِالآَخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِنْ دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
‘‘একমাত্র আল্লাহর কথা বলা হলে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্যদের উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়।’’[2]
এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী হানাফী বলেন: ‘‘মহান আল্লাহ এখানে মুশরিকদের যে বিশেষণ উল্লেখ করেছেন আমরা অনেক মানুষকে সে অবস্থায় দেখতে পাই। এ সকল মানুষ যে সকল মৃতব্যক্তির নিকট ত্রাণ প্রার্থনা করে ও সাহায্য চায় তাদের কথা উল্লেখ করা হলে তারা উৎফুল্ল উল্লসিত হয়। তাদের নামে মিথ্যা কাহিনীগুলি শুনলে তারা উল্লাসে উদ্বেলিত হয়। এসকল কাহিনী তাদের মর্যি ও পছন্দ মত হয় এবং তাদের আকীদার পক্ষে হয় বলেই তারা এরূপ উল্লসিত হয়। যারা এরূপ কাহিনী বর্ণনা করে তাদেরকে তারা খুবই মর্যাদা দেয় এবং ভক্তি করে। আর যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর কথা বলে, একমাত্র তিনিই সকল কার্য পরিচালনা করেন এবং সকল ক্ষমতার মালিক বলে উল্লেখ করে এবং তাঁর মহত্ব ও মর্যাদার পরিচায়ক প্রমাণগুলো উল্লেখ করে তার প্রতি তারা বিতৃষ্ণা বোধ করে। এরূপ কার্য যে করে তার প্রতি তারা অত্যন্ত বিরক্ত হয় এবং তার থেকে দূরে অবস্থান করে। তাকে তারা ঘৃণিত দল-মতের অনুসারী (খারিজী, ওহাবী, বিদাতী ইত্যাদি) বলে অভিযোগ করে। একব্যক্তি একদিন কঠিন বিপদে পড়ে জনৈক মৃত মানুষের নিকট ত্রাণ ও সাহায্য প্রার্থনা করছিল এবং বলছিল, হে বাবা অমুক, আমাকে রক্ষা কর। আমি তাকে বললাম, তুমি আল্লাহকে ডাক, বল: হে আল্লাহ; কারণ মহাপবিত্র আল্লাহ বলেছেন: ‘আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। আহবানকারী যখন আমাকে আহবান করে তখন আমি তার আহবানে সাড়া দেই।’’[3] আমার এ কথায় ঐ ব্যক্তি ক্রোধান্বিত হয়। পরে আমি শুনেছি যে, সে আমার বিষয়ে বলেছে: অমুক ব্যক্তি ওলীগণের মর্যাদা অস্বীকার করে। আমি শুনেছি যে, তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহর চেয়েও ওলীরা দ্রুত ডাকে সাড়া দেন। এ কথা যে কত বড় কুফরী তা সহজেই বুঝা যায়। আমরা দু‘আ করি যে, মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিভ্রান্তি ও অবাধ্যতা থেকে রক্ষা করেন।’’[4]
[1] সূরা (২) বাকারা: ১৬৫ আয়াত।
[2] সূরা (৩৯) যুমার: ৪৫ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ১৮৬ আয়াত।
[4] আলূসী, রুহূল মা‘আনী ১৭/৪৮৬-৪৮৭।
৪. ৪. ২. ৭. তাওয়াক্কুল: উকিল গ্রহণ বা নির্ভরতা
তাওয়াক্কুল শব্দটির সাধারণ অর্থ নির্ভর করা বা আস্থা স্থাপন করা। শব্দটি মূলত আরবী ‘উকীল’ শব্দ থেকে গৃহীত, যার অর্থ কার্যপরিচালনাকারী, দায়িত্বপ্রাপ্ত, প্রতিনিধি। বাংলা ভাষায়ও ‘উকিল’ শব্দটি হুবহু একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘তাওয়াক্কুল’ শব্দটির মূল অর্থ উকীল ধরা, কাউকে উকীল বানানো বা কারো উকীল হওয়া।
তাওয়াক্কুল, নির্ভরতা বা উকীল গ্রহণ লৌকিক ও অলৌকিক দু প্রকার হতে পারে। লৌকিক নির্ভরতা জাগতিক উপকরণ নির্ভর। যেমন পিতা, মাতা, পুলিশ, শাসক, ডাক্তার, উকীল, বিচারক, লাঠি, অস্ত্র ইত্যাদি জাগতিক উপকরণ বা ক্ষমতার অধিকারীর উপর নির্ভরতা। ধার্মিক-অধার্মিক বা আস্তিক-নাস্তিক সকলেই এরূপ নির্ভর করেন। এরূপ নির্ভরতা শিরক নয়, তবে মুমিনের জন্য এরূপ নির্ভরতা থেকেও হৃদয়কে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভরতায় হৃদয়কে পূর্ণ করা প্রয়োজন।
অলৌকিক নির্ভরতা কেবলমাত্র বিশ্বাসীরাই করেন। যে যার মধ্যে ‘অলৌকিক’ ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করেন তার অলৌকিক করুণা লাভের আকুতি তার হৃদয়ে থাকে এবং তিনি তার উপর নির্ভর করেন বা তাকে অলৌকিক ‘উকীল’ বা কার্যনির্বাহী বলে গ্রহণ করেন। মহান আল্লাহ ছাড়া কারো উপর এরূপ নির্ভরতা শিরক। ঈমান ও ইসলামের অবিচ্ছেদ্য দাবি একমাত্র আল্লাহর উপরেই নির্ভর করা। আল্লাহ বলেন:
إِنْ كُنْتُمْ آَمَنْتُمْ بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ
مُسْلِمِينَ
‘‘তোমরা যদি আল্লাহকে বিশ্বাস করে থাক, যদি তোমরা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী হও তবে শুধু তারই উপরে নির্ভর কর।’’[1]
মহান আল্লাহ বারবার বলেছেন:
وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ
‘‘আর কেবল আল্লাহর উপরেই নির্ভর করুক মুমিনগণ।’’[2]
মুশরিকগণ দাবি করত যে, ফিরিশতা, জিন, নবীগণ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে তারা আল্লাহর দরবারে ‘‘উকীল’’ হিসেবে গ্রহণ করে। তাঁরা তাদের পক্ষ হয়ে আল্লাহর দরবারে ওকালতি করবেন। আর এ উদ্দেশ্যেই তারা তাঁদের বন্দনা বা অর্চনা করেন। এরা তাদের ত্রাণকর্তা (saviour) বা মধ্যস্থতাকারী (mediator)। মুশরিকগণ মহান আল্লাহকে অজ্ঞ, অবিবেচক ও চাটুকার-প্রভাবিত ‘রাজা-বাদশা’ বলে কল্পনা করার কারণেই এরূপ শিরকের মধ্যে নিপতিত হত। অথচ মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার বিষয়ে সর্বজ্ঞ ও তার সবচেয়ে নিকটতম করুণাময় প্রতিপালক। তাঁর কাছে কোনো উকীলের প্রয়োজন নেই। বরং তিনিই বান্দার একমাত্র উকীল।
শাফাআত ও ওকালত এক নয়। মহান আল্লাহর অনুমতিতে যে বান্দার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট তার জন্য নবী-রাসূল, ফিরিশতা ও নেককারগণ শাফাআত করবেন। তবে বান্দার দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য মহান আল্লাহই তাঁর উকীল। কারো শাফাআতে, দুআয় বা বিনা শাফাআতে বান্দার কল্যাণ ও মুক্তির সকল ‘তদবীর’ ও বন্দোবস্ত তিনিই করেন। আল্লাহ বারবার বলেছেন যে, উকীল হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট;
وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلا
‘‘আর আল্লাহর উপর নির্ভর কর; উকীল হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’’[3]
মহান আল্লাহকে উকিল ধরতে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন:
لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِيلا
‘‘তিনি ছাড়া কোনো মাবূদ নেই; তুমি তাঁকেই উকীল হিসেবে গ্রহণ কর।’’[4]
আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে উকীল গ্রহণ করা নিষেধ। আল্লাহ বলেন:
أَلاَّ تَتَّخِذُوا مِنْ دُونِي وَكِيلا
‘‘তোমরা আমাকে ছাড়া কাউকে উকীল গ্রহণ করবে না।’’[5]
[1] সূরা ইউনূস: ৮৪ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা মায়েদা: ২৩ আয়াত।
[2] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১২২; ১৬০ আয়াত; সূরা (৫) মায়িদা: ১১ আয়াত; সূরা (৯) তাওবা: ৫১ আয়াত; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১১ আয়াত; সূরা (৫৮) মুজাদালা: ১০ আয়াত; সূরা (৬৪) তাগাবুন: ১৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৭) আ’রাফ: ৮৯ আয়াত; সূরা (১০) ইউনুস: ৮৪, ৮৫ আয়াত; সূরা (১২) ইউসুফ: ৬৭ আয়াত; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১২ আয়াত; সূরা (৬০) মুমতাহিনা: ৪ আয়াত; সূরা (৬৭) মুলক: ২৯ আয়াত।
[3] সূরা (৪) নিসা: ৮১ আয়াত; সূরা (৩৩) আহযাব: ৩; ৪৮ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৪) নিসা: ১৩২; ১৭১ আয়াত; সূরা (১৭) ইসরা/ বনী ইসরাঈল: ৬৫ আয়াত।
[4] সূরা (৭৩) মুয্যাম্মিল: ৯ আয়াত।
[5] সূরা (১৭) ইসরা/ বনী ইসরাঈল: ২ আয়াত।
৪. ৪. ২. ৮. ভয় ও আশা
ভয় ও আশাও পার্থিব ও অপার্থিব বা লৌকিক ও অলৌকিক হতে পারে। জাগতিক ভাবে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সকলেই কোনো ব্যক্তি বস্ত্ত বা দ্রব্যের ভয় বা আশা করতে পারেন। অলৌকিক নির্ভরতা, ভয়, আশা ইত্যাদি কোনো নাস্তিক বা অবিশ্বাসী করেন না। ধর্ম-বিশ্বাসী যার মধ্যে অলৌকিক মঙ্গল-অমঙ্গলের ক্ষমতা, নেক-নযর রাখার ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করেন তার অলৌকিক নেক-নযর বা সাহায্যের আশা রাখেন বা ভয় করেন। কুরআন-হাদীসে এরূপ ভয়, আশা, ভালবাসা একমাত্র আল্লাহর নিমিত্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ
‘‘এবং তোমরা কেবলমাত্র আমাকেই ভয় কর।’’[1]
মহান আল্লাহর দয়ার আশায় হৃদয়কে উজ্জীবিত রাখা ইবাদত এবং নিরাশ হওয়া কুফর। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّهُ لا يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ
‘‘কাফিরগণ ছাড়া কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না।’’[2]
অলৌকিক ‘ভয় ও আশা’ মিশ্রিত আনুগত্যই যে ইবাদত সে বিষয়ে ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’’ পুস্তিকায় ইমাম আবূ হানীফা বলেন:
اِسْمُ الْعِبَادَةِ اسْمٌ جَامِعٌ يَجْتَمِعُ فِيْهِ الطَّاعَةُ وَالرَّغْبَةُ
وَالإِقْرَارُ بِالرُّبُوْبِيَّةِ. وَذَلِكَ أَنَّهُ إِذَا أَطَاعَ اللهَ
الْعَبْدُ فِيْ الإِيْمَانِ بِهِ وَدَخَلَ عَلَيْهِ الرَّجَاءُ وَالْخَوْفُ مِنَ
اللهِ فَإِذَا دَخَلَ عَلَيْهِ هَذِهِ الْخِصَالُ الثَّلاَثُ فَقَدْ عَبَدَهُ ...
اَلْخَوْفُ وَالرَّجَاءُ عَلَى مَنْزِلَتَيْنِ. وَإِحْدَى الْمَنْزِلَتَيْنِ مَنْ
كَانَ يَرْجُوْ أَحَداً أَوْ يَخَافُهُ يَرَى أَنَّهُ يَمْلِكُ لَهُ مِنْ دُوْنِ
اللهِ ضَرًّا أَوْ نَفْعاً، فَهُوَ كَافِرٌ. وَالْمَنْزِلَةُ الأُخْرَى مَنْ كَانَ
يَرْجُوْ أَحَداً أَوْ يَخَافُهُ لِرَجَائِهِ الْخَيْرَ أَوْ مَخَافَةَ الْبَلاَءِ
مِنَ اللهِ تَعَالَى عَسَى اللهُ أَنْ يُنْزِلَ بِهِ عَلَى يَدَيْ آَخَرَ أَوْ
مِنْ سَبَبِ شَيْءٍ فَإِنَّ هَذَا لاَ يَكُوْنُ كُفْراً؛ لأَنَّ الْوَالِدَ
يَرْجُوْ وَلَدَهُ أَنْ يَنْفَعَهُ، وَيَرْجُوْ الرَّجُلُ دَابَّتَهُ أَنْ
تَحْمِلَ لَهُ، وَيَرْجُوْ جَارَهُ أَنْ يُحْسِنَ إِلَيْهِ وَيَرْجُوْ
السُّلْطَانَ أَنْ يَدْفَعَ عَنْهُ، فَلاَ يَدْخُلُ عَلَيْهِ الْكُفْرُ؛ لأَنَّهُ
إِنَّمَا رَجَاؤُهُ مِنَ اللهِ عَسَى أَنْ يَرْزُقَهُ مِنْ وَلَدِهِ أَوْ مِنْ
جَارِهِ، وَيَشْرَبُ الدَّوَاءَ عَسَى اللهُ أَنْ يَنْفَعَهُ بِهِ، فَلاَ يَكُوْنُ
كَافِراً. وَقَدْ يَخَافُ الشَّرَّ وَيَفِرُّ مِنْهُ مَخَافَةَ أَنْ يَبْتَلِيَهُ
اللهُ بِهِ. وَالْقِيَاسُ فِيْ ذَلِكَ مُوْسَى عَلَيْهِ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ
الَّذِيْ اصْطَفَاهُ اللهُ تَعَالَى بِرِسَالَتِهِ وَخَصَّهُ بِكَلاَمِهِ إِيَّاهُ
حَيْثُ لَمْ يَجْعَلْ بَيْنَهُ وَبَيْنَ مُوْسَى رَسُوْلاً، قال: (فَأَخَافُ أَنْ
يَقْتُلُونِ) وَسَيِّدُنَا مُحَمَّدٌ ﷺ حَيْثُ فَرَّ إِلَى الْغَارِ، فَلَمْ
يَدْخُلْ عَلَيْهِمُ الْكُفْرُ. وَكَذَلِكَ أَيْضاً يَخَافُ الرَّجُلُ مِنَ
السَّبُعِ أَوِ الْحَيَّةِ أَوِ الْعَقْرَبِ أَوْ هَدْمِ بَيْتٍ أَوْ سَيْلٍ أَوْ
أَذَى طَعَامٍ يَأْكُلُهُ أَوْ شَرَابٍ يَشْرَبُهُ، فَلاَ يَدْخُلُ عَلَيْهِ
الْكُفْرُ وَلاَ الشَّكُّ، وَلَكِنْ إِنَّمَا يَدْخُلُ الْجُبْنُ.
‘‘ইবাদত কয়েকটি বিষয়ের সমন্বিত নাম, যার মধ্যে আশা, আনুগত্য ও রুবূবিয়্যাতের স্বীকৃতি একত্রিত। যখন কোনো বান্দা আল্লাহর প্রতি ঈমান-সহ তাঁর আনুগত্য করে এবং তার মধ্যে আল্লাহর প্রতি আশা ও ভয় প্রবেশ করে, যখন এ তিনটি বিষয় তার মধ্যে প্রবেশ করে তখন তা ইবাদতে পরিণত হয়। .... ভয় ও আশার (অপার্থিব ও পার্থিব) দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম (অপার্থিব বা অলৌকক) পর্যায় এরূপ যে, সে কারো থেকে আশা করবে বা কাউকে ভয় করবে এভাবে যে, আল্লাহ ছাড়াও সে তার মঙ্গল-অমঙ্গল বা কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা রাখে। এ ব্যক্তি কাফির। দ্বিতীয় (লৌকিক) পর্যায় এই যে, কেউ কারো থেকে আশা করে বা তাকে ভয় পায় এজন্য যে সে হয়ত কোনো উপকার তার করবে, অথবা আল্লাহর নির্ধারিত কোনো বিপদের বিষয়ে সে মনে করে হয়ত বিপদটি এর হাত দিয়েই তার উপর নিপতিত হবে, বা কোনো বিষয় বিপদের কারণে পরিণত হবে। এরূপ আশা ও ভয় কুফর নয়। কারণ একজন পিতা তার সন্তান থেকে আশা করে যে, সন্তান তার উপকার করবে, সে তার বাহন থেকে আশা করে যে, সে তাকে বহন করবে, সে তার প্রতিবেশী থেকে আশা করে যে, সে তার কিছু উপকার করবে, সে শাসক-প্রশাসক থেকে আশা করে যে, সে তাকে নিরাপত্তা দিবে। এ সকল বিষয় কুফরের মধ্যে ঢুকবে না। কারণ সে মূলত আশা করে যে, আল্লাহ হয়ত তার এ সন্তান দ্বারা বা তার প্রতিবেশী দ্বারা তার উপকার করবেন। সে ঔষধ পান করে এবং আশা করে যে, আল্লাহ হয়ত এদ্বারা তার উপকার করবেন। এতে সে কাফির হয় না। কখনো বা ক্ষতির ভয়ে সে পলায়ন করে এ আশঙ্কায় যে আল্লাহ তাকে বিপদগ্রস্ত করবেন এর দ্বারা। এর কিয়াস বা যুক্তি মূসা (আ)। আল্লাহ তাঁকে নিজের রাসূল হিসেবে পবিত্র ও বাছাই করেছিলেন এবং তাঁর ও মূসার মাঝে কোনো দূত ছাড়াই সরাসরি তাঁর সাথে কথা বলেছেন। সেই মূসা (আ) বলেন: (আমি ভয় করি যে, তারা আমাকে হত্যা করবে)[3]। আমাদের নেতা মুহাম্মাদ (ﷺ) গুহায় আত্মগোপন করেন। এতে তাঁদের উপর কুফর প্রবেশ করে নি। অনুরূপভাবে মানুষ বন্যপ্রাণী, সাপ, বিচ্ছু থেকে ভয় পায়, বাড়ি ভেঙ্গে যাওয়ার ভয় পায়, বন্যার ভয় পায়, যে খাদ্য খাচ্ছে বা যে পানীয় পান করছে তার ক্ষতির ভয় পায়, এগুলির কারণে সে কুফরীতে পতিত হয় না; বরং তার ভীতি, দুর্বলতা বা কাপুরুষতা প্রকাশ পায়।’’[4]
এখানে ইমাম আযম পার্থিব আশা ও ভয় এবং অলৌকিক আশা ও ভয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়েছেন। মানুষ জাগতিক যে সকল বিষয় আশা করে বা ভয় পায় তা মূলত এগুলির মধ্যে বিদ্যমান জাগতিক ক্ষমতা যা স্বাভাবিকভাবে আল্লাহ প্রদান করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লাহ ছাড়া কারো মধ্যে কোনো অলৌকিক, অতিপ্রাকৃতিক বা অপার্থিব মঙ্গল-অমঙ্গল ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা কুফর ও শিরক।
[1] সূরা বাকারা: ৪০ আয়াত ও নাহল: ৫১ আয়াত।
[2] সূরা (১২) ইউসুফ: ৮৭ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (১৫) হিজর: ৫৬ আয়াত।
[3] সূরা (২৬): শুআরা: ১৪ আয়াত।
[4] ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ৩৩-৩৪।
৪. ৪. ২. ৯. ওসীলা ও তাওয়াস্সুল
আরবী ভাষায় ‘ওসীলা’ শব্দের নৈকট্য। মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ
الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর ওসীলা (নৈকট্য) সন্ধান কর এবং তাঁর পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’’[1]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু জারীর তাবারী (৩১০ হি) বলেন:
وابتغوا إليه الوسيلة يقول واطلبوا القربة إليه ومعناه بما يرضيه والوسيلة هي
الفعلية من قول القائل توسلت إلى فلان بكذا بمعنى تقربت إليه
‘‘তাঁর দিকে ওসীলা সন্ধান কর। এর অর্থ: তাঁর দিকে নৈকট্য সন্ধান কর, অর্থাৎ যে কর্ম করলে তিনি সন্তুষ্ট হন তা কর। ওসীলা শব্দটি ‘তাওয়াস্সালতু’ কথা থেকে ‘ফায়ীলাহ’ ওযনে গৃহীত ইসম। বলা হয় ‘তাওয়াস্সালতু ইলা ফুলান বি-কাযা, অর্থাৎ আমি অমুক কাজ করে অমুকের নিকটবর্তী হয়েছি।’’[2]
কুরআন-হাদীস নির্দেশিত সকল নেক আমলই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের ওসীলা বা উপকরণ। নেককার মানুষের সাহচর্যে গমনও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের কর্ম। তবে ‘ওসীলা’ বলতে মধ্যস্থ মনে করা শিরকের রাজপথ। এ বিষয়ক শিরক সম্পর্কে ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[3] এখানে দুআর মধ্যে কারো ওসীলা প্রদান প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফার মত আলোচনা করব।
মহান আল্লাহর পবিত্র নামের ওসীলা দিয়ে, নিজের নেক আমলের ওসীলা দিয়ে বা কোনো ব্যক্তির দুআর ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করার নির্দেশনা হাদীস শরীফে বিদ্যমান। যেমন: হে আল্লাহ, আপনার রহমান-রহীম নামের ওসীলায় বা আমার দরুদ পাঠের ওসীলায় আপনি আমার দুআ কবুল করুন। হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তি আমার জন্য দুআ করেছেন, আপনি তার দুআর ওসীলায় আমার দুআ কবুল করুন।
তবে কোনো ব্যক্তির ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ চাওয়া, অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ, অমুক ওলী বা বুজুর্গ ব্যক্তির ওসীলায় আমার দুআ কবুল করুন’- এভাবে দুআ করা যাবে কিনা সে বিষয়ে আলিমগণ মতভেদ করেছেন। কারণ এরূপ দুআর নির্দেশনা কুরআন বা হাদীসে নেই। ইমাম আবূ হানীফা এরূপ ওসীলা প্রদান নিষেধ করেছেন। ইমাম আবূ ইউসূফ বলেন, আবূ হানীফা বলেছেন:
لا ينبغي لأحد أن يدعو الله إلا به والدعاء المأذون فيه المأمور به ما استفيد من
قوله تعالى (ولله الأسماء الحسنى فادعوه بها) ... وكره قوله بحق رسلك وأنبيائك
وأوليائك
‘‘আল্লাহকে তাঁর নিজের (ওসীলা) দ্বারা ছাড়া অন্য কারো (ওসীলা) দ্বারা ডাকা বা দুআ করা কারো জন্য বৈধ নয়। দুআর অনুমোদিত ও নির্দেশিত পদ্ধতি মহান আল্লাহর নিম্নের বাণী থেকে জানা যায়: ‘‘এবং আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ বিদ্যমান; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামের (ওসীলা) দ্বারা ডাক। ... আপনার রাসূলগণের, আপনার নবীগণের, আপনার ওলীগণের হক্কে (ওসীলায়) বলা তিনি মাকরূহ বলেছেন।’’[4]
আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবন মাহমূদ মাউসিলী হানাফী (৬৮৩ হি) বলেন:
قال: (ويكره أن يدعو الله إلا به) فلا يقول أسألك بفلان أو بملائكتك أو بأنبيائك
ونحو ذلك لأنه لا حق للمخلوق على الخالق
‘‘তিনি বলেন: ‘মহান আল্লাহকে তাঁর নিজের (ওসীলা) দ্বারা ছাড়া অন্য কারো (ওসীলা) দ্বারা ডাকা বা দুআ করা মাকরূহ।’ কাজেই একথা বলা যাবে না যে, ‘অমুকের ওসীলা দিয়ে আপনার নিকট প্রার্থনা করছি’, অথবা ‘আপনার ফিরিশতাগণ ও নবীগণের ওসীলা দিয়ে আপনার নিকট প্রার্থনা করছি’। এ জাতীয় কোনো দুআ করবে না; কারণ স্রষ্টার উপর কোনো সৃষ্টির কোনো অধিকার বা দাবি নেই।’’[5]
বস্ত্তত তাওহীদের মর্যাদা সমুন্নত করতেই ইমাম আযম এ ধরনের ওসীলা প্রদান নিষেধ করেছেন। কারো স্মৃতিবিজড়িত স্থান বা কবরের পাশে দুআ-ইবাদত করা এবং বরকতের জন্য কোনো গাছের নিকট দুআ করা, গাছে সুতা, কাপড় বা অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখার মতই এরূপ ওসীলা মনের অজান্তে মুমিনকে শিরকের পথে ধাবিত করে। কবর বা গাছের পাশে ইবাদত বা প্রার্থনাকারী মূলত মহান আল্লাহকেই ডাকছেন; কিন্তু উক্ত নবী বা ওলীর কবর বা স্মৃতির ওসীলায় বা বরকতময় গাছটির ওসীলায় আল্লাহর কবুলিয়াত আশা করছেন। দরগা বা গাছে সুতা, পোশাক বা অস্ত্র রাখার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি মূলত মহান আল্লাহর নিকট থেকেই বরকত আশা করছেন। তিনি উক্ত গাছ বা দরগাকে মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের মাধ্যম বা ওসীলা বলে গণ্য করছেন। অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তির ওসীলা দিয়ে প্রার্থনাকারীও মূলত আল্লাহকেই ডাকছেন। তবে তিনি মনে করছেন যে, উক্ত ব্যক্তির নাম মহান আল্লাহর রহমত ও কবুলিয়াত পাওয়ার মাধ্যম বা উপকরণ। তার মনে ক্রমান্বয়ে ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে, এ সকল মাধ্যম, উপকরণ বা ওসীলা ছাড়া সরাসরি মহান আল্লাহর রহমত-বরকত লাভ অসম্ভব বা দুষ্কর। এভাবে বান্দার মন মহান আল্লাহর পরিবর্তে উক্ত ওসীলা বা মাধ্যমকে কেন্দ্র করে অধিক আবর্তিত হতে থাকে। কখনো তিনি তাদেরকে আল্লাহর ভান্ডারের মালিক, অংশীদার বা বণ্টনকারী মনে করেন। কখনো তাদের সন্তুষ্টি ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব নয় বলে মনে করেন। এভাবে মূলত তিনি জেনে বা মনের অজান্তে উক্ত ব্যক্তি বা বস্ত্তকে মহান আল্লাহর রহমত, বরকত ও কবুলিয়্যাতের অংশীদার বানিয়ে নেন।
দু ব্যক্তির কথা চিন্তা করুন! এক ব্যক্তি মনের গভীরতম আস্থায় বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহ বান্দার নিকটতম, তিনি তার সকল কথা জানছেন ও শুনছেন, তার ভালমন্দ তিনিই সবচেয়ে বেশি জানেন এবং তার রহমত, বরকত বা কবুলিয়্যাতের সিদ্ধান্ত তিনিই গ্রহণ করেন। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কেউ কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে না। শয়নে, জাগরণে, স্বপ্নে, বিচরণে আনন্দে ও বেদনায় সর্বদা একমাত্র মহান আল্লাহকেই স্মরণ করেন এবং তাঁরই সাথে কথা বলেন। আনন্দে তাঁরই প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর হৃদয় পূর্ণ হয় এবং তাঁকেই শুকরিয়া জানান। বেদনা ও কষ্টে তাঁকেই ডাকেন এবং তাঁরই কাছে মনের আবেগ-আহাজারি পেশ করেন। দীন, আমল ও ইলম শিখতে তিনি আলিম, পীর ও বুজুর্গদের কাছে যান। তবে প্রার্থনা, দুআ, চাওয়া-পাওয়া ও তাওয়াক্কুল নির্ভরতার জন্য তিনি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কথাই চিন্তা করেন না।
অন্য ব্যক্তিও বিশ্বাসে কর্মে উপরের মানুষটির কাছাকাছি। তবে তিনি কোনো ব্যক্তি বা বস্ত্তকে মহান আল্লাহর রহমত, বরকত বা কবুলিয়ত লাভের জন্য ওসীলা, মাধ্যম বা উপকরণ হিসেবে বিশ্বাস করেন। আনন্দে ও প্রাপ্তিতে তার হৃদয় মূলত উক্ত ‘মাধ্যম’-এর প্রতি কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হয়- অমুকের ওসীলাতেই আমি এটা পেয়েছি। বিপদে-কষ্টে উক্ত ওসীলার প্রতিই তার হৃদয় ধাবিত হয়। তাকে খুশি করে আল্লাহর রহমত অর্জনের জন্য তিনি সচেষ্ট হন। নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় ব্যক্তির তাওয়াক্কুল, নির্ভরতা, আশা, ভয় ইত্যাদি ইবাদত ক্রমান্বয়ে উক্ত ওসীলা বা মাধ্যমকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকবে। আর শিরকের এ দরজা বন্ধ করতেই ইমাম আযম কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে বা ওসীলায় মহান আল্লাহর কাছে দুআ করতে নিষেধ করেছেন।
[1] সূরা (৫) মায়িদা: ৩৫ আয়াত।
[2] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ৬/২২৬।
[3] খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ ৪৬৭-৪৮৪।
[4] হাসকাফী, আদ-দুর্রুল মুখতার (বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৩৮৬ হি) ৬/৩৯৬-৩৯৮।
[5] আব্দুল্লাহ ইবন মাহমূদ মাউসিলী, আল-ইখতিয়ার লিতা’লীলিল মুখতার ৪/১৭৫।
৫. সূরা ইখলাস
ইমাম আযম তাওহীদ প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘‘বল, ‘তিনিই আল্লাহ, একক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নহেন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয় নি। এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’’
এভাবে তিনি সূরা ইখলাস উদ্ধৃত করেছেন। আল্লাহর তাওহীদের সংক্ষিপ্ত ও পরিপূর্ণ বিবরণ এ সূরাটি। এখানে আল্লাহর বিষয়ে মূলত ৪টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে:
প্রথমত: তিনি একক ও অদ্বিতীয়। আরবীতে এখানে ‘আহাদ’ (أحدٌ) বলা হয়েছে। এর অর্থ: এক, অতুলনীয় বা অদ্বিতীয়। আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবু হানীফা বলেছেন যে, আল্লাহর এক ও অদ্বিতীয় হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তাঁর মত অন্য কোনো সত্তা নেই বলে বিশ্বাস করা। বরং এর পাশাপাশি এ কথাও বিশ্বাস করতে হবে যে, তাঁর যাত, সিফাত, রুবুবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের কোনো বিষয়ে তাঁর কোনো শরীক নেই।
দ্বিতীয়ত: তিনি অমুখাপেক্ষী এবং সকলেই তাঁরই মুখাপেক্ষী। এখানে আরবীতে ‘‘সামাদ’’ (صمد) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘সামাদ’ শব্দটি আরবীতে ব্যাপক অর্থ বোধক। এজন্য এক শব্দে এর অনুবাদ করা যায় না। আভিধানিকভাবে ‘‘সামাদা’’ ক্রিয়াটির অর্থ কারো দিকে মুতাওয়াজ্জাহ হওয়া, তাকে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য করে যাওয়া, সুদৃঢ় বা অটল থাকা ইত্যাদি। আর ‘‘সামাদ’’ বিশেষ্যটির আভিধানিক অর্থ চূড়ান্ত নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সম্পন্ন নেতা বা কর্তা সকলেই যার দিকে মুতাওয়াজ্জাহ হয়, যাকে উদ্দেশ্য করে, সকল বিপদে ও প্রয়োজনে যার সাহায্য চাওয়া হয়, সকল দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত, যিনি ছাড়া কারো কাছে যেতে হয় না, যিনি ছাড়া কেউ প্রয়োজন মেটাতে পারে না, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন।[1]
তৃতীয়ত: তিনি কারো জন্ম দেন নি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয় নি। তিনি অনাদি-অনন্ত ও চিরন্তন। বিভিন্ন সমাজের মুশরিকগণ অনেক মানুষ, ফিরিশতা বা জিনকে আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক বুঝাতে তাঁর পুত্র, কন্যা বা সন্তান বলে দাবি করত। শাহ ওয়ালিউল্লাহর বক্তব্য থেকে আমরা দেখেছি যে, তারা ‘‘সন্তান’’ বলতে জাগতিক বা জৈবিক ‘‘সন্তান’’ বুঝাতো না; বরং তাঁর সাথে বিশেষ সম্পর্ক যুক্ত বা তাঁর ‘‘প্রিয়পাত্র’’ বুঝাতো। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ
ইহূদী ও খৃস্টানগণ বলে: আমরা আল্লাহর পুত্র ও তাঁর প্রিয়পাত্র।’’[2]
ইহূদীগণ উযাইর (আ)-কে আল্লাহর পুত্র, খৃস্টানগণ ঈসা (আ)-কে আল্লাহর পুত্র, আরবের কাফিরগণ ফিরিশতাগণকে আল্লাহর কন্যা বলে দাবি করত। এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন জাতি ও সমাজের কাফিরদের মধ্যে এরূপ দাবি ও বিশ্বাসের প্রচলন ছিল। এ আয়াতে মহান আল্লাহ এ ধরনের সকল শিরকী ধারণা খন্ডন করেছেন।
চতুর্থত: তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। আমরা দেখেছি যে, কাউকে সামগ্রিকভাবে বা আংশিক ভাবে আল্লাহর কোনো ক্ষমতা, অধিকার, বিশেষণ, রুবূবিয়্যাত বা ইবাদতে আল্লাহর সমতুল্য বলে বিশ্বাস করাই শিরক। আর এ আয়াতে শিরকের মূলোৎপাটন করা হয়েছে।
[1] তাবারী, আত-তাফসীর ২৪/৬৮৯-৬৯৩; জাওহারী, আস-সিহাহ ১/৩৯৬; ফাইরোয-আবাদী, আল-কামূসুল মুহীত ১/৩৭৫; সামীন হালাবী, আদ-দুর্রুল মাসূন ১/৫৯৪৪।
[2] সূরা (৫) মায়িদা: ১৮ আয়াত।
No comments