আল-ফিকহুল আকবর অধ্যায়-০৯ - হেদায়াত, কবর, অনুবাদ, আয়াতসমূহের মর্যাদা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আত্মীয়গণ, মিরাজ, কিয়ামতের আলামত ইত্যাদি
হেদায়াত, কবর, অনুবাদ, আয়াতসমূহের মর্যাদা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আত্মীয়গণ, মিরাজ, কিয়ামতের আলামত ইত্যাদি সম্পর্কে ইমাম আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিত (রাহিমাহুল্লাহু) বলেন
ইমাম আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিত (রাহিমাহুল্লাহু) বলেন:
وَاللهُ تَعَالَي يَهْدِيْ مَنْ يَشَاءُ فَضْلاً مِنْهُ، وَيُضِلُّ مَنْ يَشَاءُ
عَدْلاً مِنْهُ وَإِضْلاَلُهُ خُذْلاَنُهُ وَتَفْسِيْرُ الْخُذْلاَنِ أَنْ لاَ
يُوَفِّقَ الْعَبْدَ عَلَي مَا يَرْضَاهُ عَنْهُ وَهُوَ عَدْلٌ مِنْهُ. وَكَذَا
عُقُوْبَةُ الْمَخْذُوْلِ عَلَى الْمَعْصِيَةِ. وَلاَ يَجُوْزُ أَنْ نَقُوْلُ:
إِنَّ الشَّيْطَانَ يَسْلُبُ الإِيْمَانَ مِنَ الْعَبْدِ الْمُؤْمِنِ قَهْراً
وَجَبْراً. وَلَكِنْ نَقُوْلُ: الْعَبْدُ يَدَعُ الإِيْمَانَ فَإِذَا تَرَكَهُ
فَحِيْنَئِذٍ يَسْلُبُهُ مِنْهُ الشَّيْطَانُ.
وَسُؤَالُ مُنْكَرٍ وَنَكِيْرٍ حَقٌّ كَائِنٌ فِيْ الْقَبْرِ، وَإِعَادَةُ
الرُّوْحِ إِلَى جَسَدِ الْعَبْدِ فِيْ قَبْرِهِ حَقٌّ، وَضَغْطَةُ الْقَبْرِ
وَعَذَابُهُ حَقٌّ كَائِنٌ لِلْكُفَّارِ كُلِّهِمْ أَجْمَعِيْنَ وَلِبَعْضِ
عُصَاةِ الْمُؤْمِنِيْنَ.
وَكُلُّ شَيْءٍ ذَكَرَهُ الْعُلَمَاءُ بِالْفَارِسِيِّةِ مِنْ صِفَاتِ اللهِ
تَعَالَى عَزَّ اسْمُهُ فَجَائِزٌ الْقَوْلُ بِهِ سِوَى الْيَدِ بِالْفَارِسِيَّةِ
وَيَجُوْزُ أَنْ يُقَالَ "بُرُوئِ خُدَاي" عَزَّ وَجَّلَّ بِلاَ
تَشْبِيْهٍ وَلاَ كَيْفِيَّةٍ. وَلَيْسَ قُرْبُ اللهِ تَعَالَى وَلاَ بُعْدُهُ
مِنْ طَرِيْقِ طُوْلِ الْمَسَافَةِ وَقِصَرِهَا، وَلَكِنْ (وَلاَ) عَلَى مَعْنَى
الْكَرَامَةِ وَالْهَوَانِ، وَالْمُطِيْعُ قَرِيْبٌ مِنْهُ بِلاَ كَيْفٍ،
وَالْعَاصِىْ بَعِيْدٌ مِنْهُ بِلاَ كَيْفٍ. وَالْقُرْبُ وَالْبُعْدُ
وَالإِقْبَالُ يَقَعُ عَلَى الْمُنَاجِىْ وَكَذَالِكَ جَوَارُهُ فِىْ الْجَنَّةِ،
وَالْوُقُوْفُ بَيْنَ يَدَيْهِ بِلاَ كَيْفِيَّةٍ.
وَالْقُرْآنُ مُنَزَّلٌ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ وَهُوَ فِىْ الْمُصْحَفِ
مَكْتُوْبٌ، وَآَيَاتُ الْقُرْآَنِ فِىْ مَعْنَى الْكَلاَمِ كُلُّهَا مُسْتَوِيَةٌ
فِىْ الْفَضِيْلَةِ وَالْعَظَمَةِ، إِلاَّ أَنَّ لِبَعْضِهَا فَضِيْلَةَ الذِّكْرِ
وَفَضِيْلَةَ الْمَذْكُوْرِ، مِثْلُ آَيَةِ الْكُرْسِىِّ؛ لأَنَّ الْمَذْكُوْرَ فِيْهَا
جَلاَلُ اللهِ تَعَالَى وَعَظَمَتُهُ وَصِفَاتُهُ، فَاجْتَمَعَتْ فِيْهَا
فَضِيْلَتَانِ: فَضِيْلَةُ الذِّكْرِ وَفَضِيْلَةُ الْمَذْكُوْرِ، وَلِبَعْضِهَا
فَضِيْلَةُ الذِّكْرِ فَحَسْبٌ مِثْلُ قِصَّةِ الْكُفَّارِ، وَلَيْسَ
لِلْمَذْكُوْرِ فِيْهَا فَضْلٌ وَهُمُ الْكُفَّارُ. وَكَذَالِكَ الأَسْمَاءُ
وَالصِّفَاتُ كُلُّهَا مُسْتَوِيَةٌ فِىْ الْعَظَمَةِ وَالْفَضْلِ لاَ تَفَاوُتَ
بَيْنَهَا.
مَاتَ كَافِراً.tوَوَالِدَا رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى
اللهُ تَعَالَي عَلَيْهِ وَآَلِهِ وَسَلَّمَ مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ (وَفِيْ نُسْخَةٍ
زِيْدَ) وَرَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلَيْهِ وَآَلِهِ وَسَلَّمَ
مَاتَ عَلَى الاِيْمَانِ وَأَبُوْ طَالِبٍ عَمُّهُ ﷺ وَأَبُوْ عَلِيٍّ
وَقَاسِمٌ وَطَاهِرٌ وَإِبْرَاهِيْمُ كَانُوْا بَنِىْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ،
وَفَاطِمَةُ وَرُقَيَّةُ وَزَيْنَبُ وَأُمُّ كُلْثُوْمٍ كُنَّ جَمِيْعاً بَنَاتِ
رَسُوْلِ اللهِ ﷺ. وَرَضِيَ عَنْهُنَّ
وَإِذَا أَشْكَلَ عَلَى الإِنْسَانِ شَيْءٌ مِنْ دَقَائِقِ عِلْمِ التَّوْحِيْدِ،
فَإِنَّهُ يَنْبَغِىْ لَهُ أَنْ يَعْتَقِدَ فِىْ الْحَالِ مَا هُوَ الصَّوَابُ
عِنْدَ اللهِ تَعَالَى إِلَى أَنْ يَجِدَ عَالِماً فَيَسْأَلُهُ، وَلاَ يَسَعُهُ
تَأْخِيْرُ الطَّلَبِ، وَلاَ يُعْذَرُ بِالْوَقْفِ فِيْهِ، وَيَكْفُرُ إِنْ
وَقَفَ.
وَخَبَرُ الْمِعْرَاجِ حَقٌّ. مَنْ رَدَّهُ فَهُوَ ضَالٌّ مُبْتَدِعٌ . وَخُرُوْجُ
الدَّجَّالِ وَيَأْجُوْجَ وَمَأْجُوْجَ وَطُلُوْعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا
وَنُزُوْلُ عِيْسَى عَلَيْهِ السَّلاَمُ مِنَ السَّمَاءِ وَسَائِرُ عَلاَمَاتِ
يَوْمِ الْقِيَامَةِ عَلَى مَا وَرَدَتْ بِهِ الأَخْبَارُ الصَّحِيْحَةُ حَقٌّ
كَائِنٌ وَاللهُ تَعَالَى يَهْدِيْ مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ
বঙ্গানুবাদ:
আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে যাকে ইচ্ছা সুপথ প্রদর্শন করেন। আর তিনি ন্যায়পরায়ণতা পূর্বক যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন। বিভ্রান্ত করার অর্থ সাহায্য পরিত্যাগ করা। সাহায্য পরিত্যাগের ব্যাখ্যা এই যে, মহান আল্লাহ সে বান্দাকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করেন না। বিষয়টি তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। অনুরূপভাবে যে পাপীকে তিনি পাপ ও অবাধ্যতার কারণে পরিত্যাগ করেছেন তার পাপের কারণে শাস্তি প্রদানও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ।
আমাদের জন্য এ কথা বলা বৈধ নয় যে, শয়তান জবরদস্তি করে বা জোর করে মুমিন বান্দার ঈমান কেড়ে নেয়। বরং আমরা বলি: বান্দা তার ঈমান পরিত্যাগ করে, তখন শয়তান তা তার থেকে ছিনিয়ে নেয়।
মুনকার ও নাকীরের প্রশ্ন সত্য, যা কবরের মধ্যে হবে। কবরের মধ্যে বান্দার রূহকে দেহে ফিরিয়ে দেওয়া সত্য। কবরের চাপ এবং কবরের আযাব সত্য, কাফিররা সকলেই এ শাস্তি ভোগ করবে এবং কোনো কোনো পাপী মুমিনও তা ভোগ করবে।
মহান আল্লাহর- মহিমান্বিত হোক তাঁর নাম- বিশেষণসমূহের বিষয়ে আলিমগণ ফার্সী ভাষায় যা কিছু উল্লেখ করেছেন তা সবই বলা বৈধ, কেবলমাত্র ফার্সী ভাষায় ইয়াদ বা হাত বলা বাদে। ফার্সীতে ‘বরোয়ে খোদা’ -আয্যা ও জাল্লা- অর্থাৎ মহান আল্লাহর চেহারার ওসীলায়- এ কথা বলা যাবে, কোনোরূপ তুলনা ছাড়া এবং কোনোরূপ স্বরূপ সন্ধান ও প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়া। আল্লাহর নৈকট্য এবং তাঁর দূরত্ব কোনো স্থানের দূরত্ব বা স্থানের নৈকট্য নয়। কিন্তু এর অর্থ সম্মান বা অসম্মান। (মোল্লা আলী কারীর বর্ণনা: সম্মান বা অসম্মানের অর্থেও নয়।) অনুগত বান্দা কোনো স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়াই আল্লাহর নিকটবর্তী। অবাধ্য বান্দা কোনো স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়াই আল্লাহ থেকে দূরবর্তী। নৈকট্য, দূরত্ব, নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি প্রার্থনাকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনুরূপভাবে জান্নাতে মহান আল্লাহর প্রতিবেশিত্ব বা নৈকট্য এবং মহান আল্লাহর সম্মুখে অবস্থান সবই স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়া।
কুরআন কারীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ এবং তা মুসহাফের মধ্যে লিপিবদ্ধ। আল্লাহর কালাম হিসেবে সকল আয়াত মর্যাদা ও মহত্ত্বের দিক থেকে সমান। তবে কোনো কোনো আয়াতের দ্বিবিধ মর্যাদা রয়েছে: যিক্র-এর মর্যাদা এবং যিক্র-কৃতের মর্যাদা। যেমন আয়াতুল কুরসী। এর মধ্যে মহান আল্লাহর মহত্ত্ব, মর্যাদা ও বিশেষণ আলোচিত হয়েছে, এজন্য এর মধ্যে দ্বিবিধ মর্যাদা একত্রিত হয়েছে: যিক্র বা স্মরণের মর্যাদা এবং স্মরণকৃতের মর্যাদা। আর কোনো কোনো আয়াতের কেবল যিক্র-এর ফযীলত রয়েছে, যেমন কাফিরদের কাহিনী, এতে যাদেরকে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ কাফিরদের কোনো মর্যাদা নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহর নামসমূহ এবং বিশেষণসমূহ সবই সমমর্যাদার, এগুলোর মধ্যে মর্যাদাগত কোনো তারতম্য নেই।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কুফুরের উপর মৃত্যুবরণ করেন। (কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে অতিরিক্ত রয়েছে: এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেন।) তাঁর চাচা এবং আলী (রা)-এর পিতা আবু তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কাসিম, তাহির ও ইবরাহীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুত্র ছিলেন। ফাতিমা, রুকাইয়া, যাইনাব ও উম্মু কুলসূম তাঁরা সকলেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যা ছিলেন। আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।
যদি কোনো মানুষের কাছে ‘ইলমুত তাওহীদ’-এর বা আকীদার খুঁটিনাটি বিষয়ের সুক্ষ্ম তথ্য অস্পষ্ট হয়ে পড়ে তবে তার দায়িত্ব এই যে, তৎক্ষণাৎ এ বিষয়ে আল্লাহর নিকট যা সঠিক তাই আমার বিশ্বাস-এরূপ বিশ্বাস পোষণ করবে। এরপর যথাশীঘ্র সম্ভব কোনো আলিমকে জিজ্ঞাসা করে সঠিক তথ্য জেনে নিবে। সঠিক তথ্য জানার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দেরি করা তার জন্য বৈধ নয়। এরূপ বিষয়ে ‘দাঁড়িয়ে থাকা’ বা ‘বিরত থাকা’, অর্থাৎ ‘জানিও না এবং জানবও না বলে থেমে থাকা’, বা ‘কিছুই জানি না কাজেই কিছুই বিশ্বাস করব না’ এরূপ কথা বলা তার জন্য কোনো ওযর বলে গৃহীত হবে না। কেউ যদি এরূপ দাঁড়িয়ে থাকে বা বিরত থাকে তবে তা কুফরী বলে গণ্য হবে।
মি’রাজের সংবাদ সত্য। যে তা প্রত্যাখ্যান করে সে বিদ‘আতী ও বিভ্রান্ত।
দাজ্জালের বহির্গমন, ইয়াজূজ ও মাজূজের বহির্গমন, অস্তগমনের স্থান থেকে সূর্যের উদয় হওয়া, আকাশ থেকে ঈসা (আ)-এর অবতরণ এবং কিয়ামাতের অন্যান্য সকল পূর্বাভাস, যেভাবে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই সত্য এবং ঘটবেই। মহান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।
১. হেদায়াত ও গোমরাহি
উপরের বক্তব্যে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) প্রথমে হেদায়াত ও গোমরাহি বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন:
‘‘আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে যাকে ইচ্ছা সুপথ প্রদর্শন করেন। আর তিনি ন্যায়পরায়ণতা পূর্বক যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন। বিভ্রান্ত করার অর্থ সাহায্য পরিত্যাগ করা। সাহায্য পরিত্যাগের ব্যাখ্যা এই যে, মহান আল্লাহ সে বান্দাকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করেন না। বিষয়টি তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। অনুরূপভাবে যে পাপীকে তিনি পাপ ও অবাধ্যতার কারণে পরিত্যাগ করেছেন তার পাপের কারণে শাস্তি প্রদানও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। আমাদের জন্য এ কথা বলা বৈধ নয় যে, শয়তান জবরদস্তি করে বা জোর করে মুমিন বান্দার ঈমান কেড়ে নেয়। বরং আমরা বলি: বান্দা তার ঈমান পরিত্যাগ করে, তখন শয়তান তা তার থেকে ছিনিয়ে নেয়।’’
মহান আল্লাহ কুরআনে বারবার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন বা পথভ্রষ্ট করেন। এ বিষয়ক কয়েকটি আয়াত আমরা প্রথম পরিচ্ছেদে তাকদীর প্রসঙ্গে দেখেছি। এ অর্থে আরো কয়েকটি আয়াত:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ
فَيُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ
الْحَكِيمُ
‘‘আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়; অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আর তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’’[1]
فَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يَهدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلإِسْلامِ وَمَنْ
يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ
فِي السَّمَاءِ كَذَلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لا
يُؤْمِنُونَ
‘‘আল্লাহ যাকে হেদায়াত করতে চান তার বক্ষ ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করতে চান তার বক্ষকে সংকীর্ণ-সংকুচিত করে দেন; যেন সে আকাশে-ঊর্ধ্বে আরোহণ করছে। এভাবেই আল্লাহ অকল্যাণ দেন তাদের উপর যারা ঈমান আনে না।’’[2]
পাশাপাশি কুরআনে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঈমান আনয়ন বা সত্য গ্রহণ মানুষের নিজের ইচ্ছাধীন কর্ম। মহান আল্লাহ বলেন:
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ
فَلْيَكْفُرْ
‘‘আর বল, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সত্য; কাজেই যে ইচ্ছা করে সে ঈমান গ্রহণ করুক এবং যে ইচ্ছা করে সে কুফরী করুক।’’[3]
অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
إِنَّ هَذِهِ تَذْكِرَةٌ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ سَبِيلا
‘‘নিশ্চয় এ এক উপদেশ; অতএব যে চায় সে তার রবের দিকে পথ গ্রহণ করুক।’’[4]
উপরের সকল আয়াতের সমন্বিত অর্থ ইমাম আবু হানীফা এখানে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কথার সারমর্ম হলো, মানুষকে আল্লাহ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা ব্যবহার করে কি করবে তিনি তা জানেন। তিনি ইচ্ছা করলে তার ইচ্ছা ও কর্মে বাধা দিতে পারেন বা তার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করতে পারেন। তিনি তাঁর কোনো বান্দার ইচ্ছা বা কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অতিরিক্ত তাওফীক কল্যাণের সহায়তা প্রদান করেন। আর এ অর্থেই তিনি বলেছেন: ‘‘যাকে ইচ্ছা করেন তাকে তিনি হেদায়াত করেন।’’ তার হেদায়াত অর্থ তাঁর তাওফীক, যা তাঁর পক্ষ থেকে অতিরিক্ত করুণা। পক্ষান্তরে যার ইচ্ছা ও কর্মে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন তাকে এরূপ তাওফীক বা মঙ্গলের সহায়তা প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন; বরং তাকে তার স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেন। তখন সে স্বাধীন ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বিপথগামী হয়। এ অর্থেই তিনি বলেছেন: ‘‘যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে পথভ্রষ্ট করেন।’’ কাউকে তার ইচ্ছা ও কর্মের কারণে অতিরিক্ত করুণা ও তাওফীক প্রদান থেকে বিরত থাকা ইনসাফের ব্যতিক্রম নয়। এরূপ ব্যক্তির ইচ্ছা ও কর্মের জন্য তাকে শাস্তি দেওয়াও ইনসাফের ব্যতিক্রম নয়।
[1] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ৪। সূরা (১৬) নাহল: ৯৩; সূরা (৩৫) ফাতির: ৮; সূরা (৭৪) মুদ্দাস্সির: ৩১।
[2] সূরা ৬ আনআম: ১২৫ আয়াত।
[3] সূরা (১৮) কাহাফ: ২৯ আয়াত।
[4] সূরা (৭২) মুযাম্মিল: ১৯ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৭৪) মুদ্দাস্সির: ৫৫-৫৬ আয়াত; সূরা (৭৬) দাহর (ইনসান): ২৯ আয়াত; সূরা (৭৮) নাবা: ৩৯ আয়াত; সূরা (৮০) আবাসা: ১১-১২ আয়াত।
২. কবরের অবস্থা
এরপর ইমাম আযম কবর বিষয়ক আকীদার কয়েকটি দিক উল্লেখ করে বলেছেন: মুনকার ও নাকীরের প্রশ্ন সত্য, যা কবরের মধ্যে হবে। কবরের মধ্যে বান্দার রূহকে দেহে ফিরিয়ে দেওয়া সত্য। কবরের চাপ এবং কবরের আযাব সত্য, কাফিররা সকলেই এ শাস্তি ভোগ করবে এবং কোনো কোনো পাপী মুমিনও তা ভোগ করবে।’’
কুরআন ও হাদীসের আলোকে মৃত্যুর পরে কিয়ামাতের আগে মধ্যবর্তী সময়ের অবস্থা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। মহান আল্লাহ বলেন:
يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ
الدُّنْيَا وَفِي الآَخِرَةِ وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللَّهُ
مَا يَشَاءُ
‘‘যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহ শাশ্বত বাণীতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন ইহজীবনে এবং পরজীবনে এবং যারা জালিম আল্লাহ তাদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখবেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।’’[1]
এ থেকে জানা যায় যে, ইহজীবনের ন্যায় পরজীবনেও শাশ্বত বাণীর উপর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে পরকালীন জীবনের শুরুতে কবরে ‘মুনকার-নাকীর’ নামক মালাকদ্বয়ের প্রশ্নের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠা প্রমাণিত হবে।
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلائِكَةُ
بَاسِطُو أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُوا أَنْفُسَكُمُ الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ
الْهُونِ بِمَا كُنْتُمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ وَكُنْتُمْ
عَنْ آَيَاتِهِ تَسْتَكْبِرُونَ
‘‘যদি তুমি দেখতে, যখন জালিমগণ মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকবে এবং মালাকগণ হাত বাড়িয়ে বলবে: ‘তোমাদের প্রাণ বের কর, তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে অন্যায় বলতে ও তাঁর নিদর্শন সম্বন্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে, সে জন্য আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হবে।’’[2]
এ আয়াত থেকে মৃত্যুকালীন শাস্তি এবং মৃত্যুর পরেই- সেদিনেই- যে শাস্তি প্রদান করা হবে তার বিষয়ে জানা যায়। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَحَاقَ بِآَلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا
غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آَلَ فِرْعَوْنَ
أَشَدَّ الْعَذَابِ
‘‘কঠিন শাস্তি পরিবেষ্টন করল ফিরাউনের গোষ্ঠীকে। সকাল সন্ধ্যায় তাদের উপস্থিত করা হয় আগুনের সামনে এবং যেদিন কিয়ামাত ঘটবে সেদিন (বলা হবে:) ফিরাউনের গোষ্ঠীকে প্রবেশ করাও কঠিন শাস্তির মধ্যে।’’[3]
এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কিয়ামাতের পূর্বেও কাফিরগণকে শাস্তি প্রদান করা হবে এবং সকাল-সন্ধ্যায় আগুনের সামনে তাদের উপস্থিত করা হবে।
কিয়ামাত দিবসের বর্ণনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
يَوْمَ لا يُغْنِي عَنْهُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا وَلا هُمْ يُنْصَرُونَ وَإِنَّ
لِلَّذِينَ ظَلَمُوا عَذَابًا دُونَ ذَلِكَ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لا يَعْلَمُونَ
‘‘যে দিন তাদের ষড়যন্ত্র তাদের কোনো কাজে লাগবে না এবং তাদেরকে সাহায্যও করা হবে না। আর যালিমগণের জন্য রয়েছে এর পূর্বের বা নিম্নের শাস্তি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।’’[4]
এ আয়াতও কিয়ামাতের পূর্বের শাস্তির কথা প্রমাণ করে। পাশাপাশি অসংখ্য হাদীসে মৃত্যুর সময়ের, মৃত্যুর পরের এ সকল শাস্তি, পুরস্কার ইত্যাদির বিষয়ে জানানো হয়েছে। এ সকল হাদীস থেকে জানা যায় যে, মৃতব্যক্তিকে কবরে রাখার পরে তার ‘রূহ’ তাকে ফেরত দেওয়া হবে এবং তাকে ‘মুনকার ও নাকীর’ নামক ফিরিশতাগণ প্রশ্ন করবেন তার প্রতিপালক, তার দীন ও তার নবী সম্পর্কে। মুমিন ব্যক্তি এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবেন। মুনাফিক বা কাফির এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম হবে। পাপী ও অবিশ্বাসীদেরকে কবরে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি ভোগ করতে হবে, তন্মধ্যে রয়েছে ‘কবরের চাপ’। কবরের মাটি চারিদিক থেকে কবরস্থ ব্যক্তিকে চাপ দেওয়ার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করবে। পক্ষান্তরে নেককার মুমিনগণ কবরে অবস্থানকালে শান্তি ও নিয়ামত ভোগ করবেন।
সাধারণভাবে এ অবস্থাকে ‘কবরের’ অবস্থা বলা হয়। তবে ‘কবর’ বলতে মৃত্যু ও কিয়ামাতের মধ্যবর্তী অবস্থাকেই বুঝানো হয়। কোনো ব্যক্তি কোনো কারণে কবরস্থ না হলেও সে এ সকল শাস্তি বা পুরস্কার লাভ করে। কুরআনে বলা হয়েছে:
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ لَعَلِّي
أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ
وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ.
‘‘যখন তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন সে বলে, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে পুনরায় প্রেরণ কর; যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি যা আমি পূর্বে করি নি। না, এ হওয়ার নয়। এ তো তার একটি উক্তি মাত্র। তাদের সম্মুখে ‘বারযাখ’ (প্রতিবন্ধক বা পৃথকীকরণ সময়কাল) থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।’’[5]
ইমাম আবূ হানীফা এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস সংক্ষেপে এখানে ব্যাখ্যা করেছেন।
কবর আযাব প্রসঙ্গে তিনি ‘আল-ফিকহুল আবসাত’-এ বলেন:
من قال لا أعرف عذاب القبر فهو من الجهمية الهالكة لأنه أنكر قوله تعالى:
"سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ"، "ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَى عَذَابٍ
عَظِيمٍ"، يعني عذاب القبر وقوله تعالى: "وَإِنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا
عَذَابًا دُونَ ذَلِك"، يعني في القبر
‘‘যদি কেউ বলে: আমি কবরের আযাব জানি না তবে সে ধ্বংসগ্রস্ত জাহমীদের দলভুক্ত। কারণ, সে কুরআনের বক্তব্য অস্বীকার করেছে। আল্লাহ বলেন: ‘‘অচীরেই আমি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করব দু’বার’’ ‘‘এরপর তাদেরকে কঠিন আযাবের দিকে নেওয়া হবে’’- অর্থাৎ কবরের আযাব। আল্লাহ আরো বলেছেন: ‘‘আর যালিমগণের জন্য রয়েছে এর পূর্বের শাস্তি...’’[6], অর্থাৎ কবরের শাস্তি।’’[7]
[1] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ২৭ আয়াত।
[2] সূরা (৬) আন‘আম: ৯৩ আয়াত।
[3] সূরা (৪০) গাফির/মুমিন: ৪৫-৪৬ আয়াত।
[4] সুরা (৫২) তূর: ৪৬-৪৭ আয়াত।
[5] সূরা (২৩) মুমিনুন: ৯৯-১০০ আয়াত।
[6] সূরা (৯) তাওবা: ১০১ আয়াত এবং সূরা (৫২) তূর: ৪৭ আয়াত।
[7] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত (আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম-সহ), পৃষ্ঠা ৫২।
৩. আল্লাহর বিশেষণের অনুবাদ
এরপর ইমাম আযম বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহর- মহিমান্বিত হোক তাঁর নাম- বিশেষণসমূহের বিষয়ে আলিমগণ ফার্সী ভাষায় যা কিছু উল্লেখ করেছেন তা সবই বলা বৈধ, কেবলমাত্র ফার্সী ভাষায় ইয়াদ বা হাত বলা বাদে। ফার্সীতে ‘বরোয়ে খোদা’ -আয্যা ও জাল্লা- অর্থাৎ মহান আল্লাহর চেহারার ওসীলায়- এ কথা বলা যাবে, কোনোরূপ তুলনা ছাড়া এবং কোনোরূপ স্বরূপ সন্ধান ও প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়া।’’
আমরা জেনেছি যে, আল্লাহর বিশেষণসমূহ তুলনা ও স্বরূপ ব্যতিরেকে বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি। এখানে ইমাম আবূ হানীফা আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় এ সকল বিশেষণের অনুবাদ করার মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। অন্য ভাষায় আরবী বিশেষণটির যে আভিধানিক প্রতিশব্দ রয়েছে তা ব্যবহার করা হবে এবং তুলনা ও স্বরূপ সন্ধান ছাড়া তা বিশ্বাস করতে হবে। যেমন ওয়াজহুল্লাহ (وجه الله) অর্থ ‘রোয়ে খোদা’: ‘আল্লাহর চেহারা’ বা ‘মুখমন্ডল’ বলা হবে। মুমিন প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস করেন যে, ‘চেহারা’ বা ‘মুখমন্ডল’ মহান আল্লাহর একটি বিশেষণ, এর স্বরূপ আমরা জানি না এবং তা কোনো সৃষ্টির কোনো বিশেষণের সাথে তুলনীয় নয়। অন্যান্য সকল বিশেষণই এরূপ। যেমন আইন অর্থ চক্ষু, কাদাম অর্থ পদ, গাযাব অর্থ ক্রোধ, রিদা অর্থ সন্তুষ্টি, ইসতিওয়া অর্থ অধিষ্ঠান, নুযূল অর্থ অবতরণ ইত্যাদি। তবে ইয়াদ বা হাত শব্দটির ফার্সী প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে ইমাম আযম আপত্তি করেছেন। মোল্লা আলী কারী বলেন: এ নিষেধের কারণ স্পষ্ট নয়। তবে সালফ সালিহীন সকলেই একমত যে, ইয়াদ (হস্ত) বিশেষণটি ব্যাখ্যাবিহীনভাবে গ্রহণ করতে হবে।[1]
[1] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ১৭৬।
৪. আল্লাহর নৈকট্য ও দূরত্ব
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এরপর বলেছেন: ‘‘আল্লাহর নৈকট্য এবং তাঁর দূরত্ব কোনো স্থানের দূরত্ব বা স্থানের নৈকট্য নয়। সম্মান বা অসম্মানের অর্থেও নয়। অনুগত বান্দা কোনো স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়াই আল্লাহর নিকটবর্তী। অবাধ্য বান্দা কোনো স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়াই আল্লাহ থেকে দূরবর্তী। নৈকট্য, দূরত্ব, নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি প্রার্থনাকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনুরূপভাবে জান্নাতে মহান আল্লাহর প্রতিবেশিত্ব বা নৈকট্য এবং মহান আল্লাহর সম্মুখে অবস্থান সবই স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়া।’’
মহান আল্লাহ বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বান্দার নিকটবর্তী, তিনি তার গলার ধমনী হতেও বেশি নিকটবর্তী, তিনি তার সাথে, তিনি নেককার বান্দাগণের নিকটবর্তী বা সাথে... ইত্যাদি। এগুলি সবই আল্লাহর সিফাত বা বিশেষণ। জাহমী ও মুতাযিলীগণ কখনো এ সকল বিশেষণের নানারূপ ব্যাখ্যা করেছে। কখনো এগুলির ভিত্তিতে মহান আল্লাহর আরশের উপর অধিষ্টিত হওয়ার বিশেষণ অস্বীকার করেছে। তাদের ধারণায় আল্লাহর নৈকট্য ও আরশের উপর অধিষ্ঠিত থাকার মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে। আসল বৈপরীত্য তাদের ধারণা ও চেতনায়; তারা মহান আল্লাহকে সৃষ্টির মত চিন্তা করে কল্পনা করেছে যে, তিনি একই সময়ে আরশে সমাসীন ও বান্দার নিকট হতে পারেন না। তারা ভাবতে পারে নি বা চায় নি যে, তিনি এরূপ মানবীয় সীমবদ্ধতার অনেক ঊর্ধ্বে। ইমাম আযম উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল বিশেষণকেও একইভাবে কোনোরূপ তুলনা এবং স্বরূপসন্ধান ছাড়াই সরল অর্থে বিশ্বাস করতে হবে।
৫. কুরআনের আয়াতসমূহের মর্যাদার পার্থক্য
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এরপর কুরআনের আয়াতসমূহের মর্যাদার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘‘কুরআন কারীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ এবং তা মুসহাফের মধ্যে লিপিবদ্ধ। আল্লাহর কালাম হিসেবে সকল আয়াত মর্যাদা ও মহত্ত্বের দিক থেকে সমান। তবে কোনো কোনো আয়াতের দ্বিবিধ মর্যাদা রয়েছে: যিক্র-এর মর্যাদা এবং যিক্র-কৃতের মর্যাদা। যেমন আয়াতুল কুরসী। এর মধ্যে মহান আল্লাহর মহত্ত্ব, মর্যাদা ও বিশেষণ আলোচিত হয়েছে, এজন্য এর মধ্যে দ্বিবিধ মর্যাদা একত্রিত হয়েছে: যিক্র বা স্মরণের মর্যাদা এবং স্মরণকৃতের মর্যাদা। আর কোনো কোনো আয়াতের কেবল যিক্র-এর ফযীলত রয়েছে, যেমন কাফিরদের কাহিনী, এতে যাদেরকে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ কাফিরদের কোনো মর্যাদা নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহর নামসমূহ এবং বিশেষণসমূহ সবই সমমর্যাদার, এগুলির মধ্যে মর্যাদাগত কোনো তারতম্য নেই।’’
কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতের কিছু ফযীলত বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে অনেক তথাকথিত ‘‘ধার্মিক’’ মানুষ অনেক জাল ও মিথ্যা কথাও ফযীলতের নামে প্রচার করেছেন।[1] এ সকল বর্ণনা ফযীলত বিষয়ে এক প্রকারের বাড়াবাড়ির জন্ম দেয়। ফযীলতের আয়াত ও সূরাগুলোর বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপের কারণে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত, অধ্যয়ন ও অনুধাবনের সুন্নাহ নির্দেশিত ইবাদতে অবহেলা ও ত্রম্নটি হয়।
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এ বিষয়ক মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহর কালাম হিসেবে সকল আয়াতের মর্যাদা সমান। কুরআনের মর্যাদা ও ফযীলতের মূল বিষয় এটিই। কাজেই মুমিনকে এ দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি কিছু আয়াতের অর্থগত বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। সহীহ হাদীসে প্রমাণিত বিশেষ ফযীলতগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এরূপ অর্থগত মর্যাদার কথা তাতে বলা হয়েছে। আর এরূপ অর্থগত ফযীলত লাভ করতে অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা এবং পঠিত আয়াতে মহান আল্লাহর যে মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা অনুভব করা প্রয়োজন। কাজেই এ বিষয়ে সহীহ সুন্নাতের নির্দেশনার মধ্যে অবস্থান জরুরী।
[1] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি ১৫৮, ২৬৪; ফুরফুরার পীর আবূ জাফর সিদ্দিকীর ‘আল-মাউযূআত’: একটি বিশেস্নষণাত্মক পর্যালোচনা, পৃ. ২৮৫।
৬. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরিজনবর্গ
এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আত্মীয়-স্বজন বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন:
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কুফুরের উপর মৃত্যুবরণ করেন। (কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে অতিরিক্ত রয়েছে: এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেন।) তাঁর চাচা এবং আলী (রা)-এর পিতা আবু তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কাসিম, তাহির ও ইবরাহীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুত্র ছিলেন। ফাতিমা, রুকাইয়া, যাইনাব ও উম্মু কুলসূম তাঁরা সকলেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যা ছিলেন। আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।’’
আমরা ইমাম আযমের এ কথাগুলো পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
৬. ১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা / ৬. ১. ১. কী বলেছিলেন ইমাম আবূ হানীফা?
৬. ১. ১. কী বলেছিলেন ইমাম আবূ হানীফা?
এ পরিচ্ছেদে ইমাম আযম আবূ হানীফা (রাহ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা, চাচা ও সন্তানদের বিষয় উল্লেখ করেছেন। প্রথম অনুচ্ছেদে তিনটি বাক্য বিদ্যমান। তিনটি বাক্যই মৃত্যু প্রসঙ্গে। প্রথম বাক্যে তাঁর পিতামাতার মৃত্যু, দ্বিতীয় বাক্যে তাঁর মৃত্যু ও তৃতীয় বাক্যে তাঁর চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর অবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে। তৃতীয় বাক্যটি সকল পান্ডুলিপিতে বিদ্যমান। প্রথম ও দ্বিতীয় বাক্যটি ‘‘আল-ফিকহুল আকবারের’’ কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে বিদ্যমান ও অন্যান্য পান্ডুলিপিতে অবিদ্যমান।
‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থের প্রসিদ্ধতম ব্যাখ্যা দশম-একাদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি/১৬০৬ খৃ) প্রণীত ‘‘শারহুল ফিকহিল আকবার’’। এ গ্রন্থের কোনো পান্ডুলিপিতে বাক্যদুটি বিদ্যমান এবং কোনো কোনোটিতে শুধু তৃতীয় বাক্যটি বিদ্যমান। থানবী প্রকাশনী, দেওবন্দ, ভারত থেকে প্রকাশিত ‘শারহুল ফিকহিল আকবার’ এ বাক্যগুলো এভাবেই বিদ্যমান। শাইখ মারওয়ান মুহাম্মাদ আশ-শা‘আর (الشيخ مروان محمد الشعار)-এর সম্পাদনায় লেবাননের দারুন নাফাইস কর্তৃক প্রকাশিত ‘‘শারহুল ফিকহিল আকবার’’ গ্রন্থেও বাক্যগুলো বিদ্যমান। কিন্তু দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ বৈরুত, লেবানন প্রকাশিত ‘শারহু ফিকহিল আকবার’ পুস্তকে (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন) বাক্যটি নেই। অনুরূপভাবে কাদীমী কুতুবখানা, আরামবাগ, করাচি, পাকিস্তান হতে প্রকাশিত মোল্লা আলী ক্বারীর শারহুল ফিকহিল আকবারেও বাক্যটি নেই।
আল-ফিকহুল আকবারের পান্ডুলিপিগুলো প্রসিদ্ধ হানাফী আলিমগণ সংরক্ষণ ও অনুলিপি করেছেন। এখানে দুটি সম্ভাবনা বিদ্যমান: (ক) ইমাম আযম বাক্যগুলো লিখেছিলেন, কিন্তু পরবর্তী যুগের কোনো কোনো লিপিকার হানাফী আলিম বাক্যগুলো অশোভনীয় হওয়ায় তা ফেলে দিয়েছেন। (খ) বাক্যগুলো তিনি লিখেন নি, পরবর্তী যুগের কোনো লিপিকার হানাফী আলিম অতিরিক্ত বাক্যগুলো সংযোজন করেছেন।
প্রথম সম্ভাবনাই স্বাভাবিক। পরবর্তী যুগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে এ বাক্য সংযোজন করার কোনো প্রয়োজনীয়তা হানাফী আলিমদের ছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। কিন্তু এ বাক্যদুটোকে পরবর্তী যুগের অনেক হানাফী আলিমই অশোভনীয় বলে গণ্য করেছেন। কাজেই অপ্রাসঙ্গিক বা অশোভনীয় হিসেবে তা ফেলে দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমরা দেখব যে, মোল্লা আলী কারীর ব্যাখ্যার মধ্যে এ বিষয়ক আলোচনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাঁর ব্যাখ্যা গ্রন্থের সাথে মুদ্রিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এর কোনো কোনো মুদ্রণে এ বাক্যটি নেই। অর্থাৎ মুদ্রণ বা অনুলিপির সময় ইমাম আযমের বক্তব্য থেকে কথাটি ফেলে দেওয়া হয়েছে, যদিও ব্যাখ্যার মধ্যে তা বিদ্যমান। আমরা পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখব যে, ইসলামের প্রথম তিন-চার শতাব্দীতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমগণ যা বলেছেন পরবর্তী আলিমগণ সেগুলো সেভাবে বলা অশোভনীয় বলেই মনে করেছেন।
কোনো কোনো আলিম মত প্রকাশ করেছেন যে, হয়ত বক্তব্যটি নিম্নরূপ ছিল (والدا رسول الله صلى
الله عليه وسلم ما ماتا على الكفر) ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেন নি’’। পান্ডুলিপিকারের ভুলে (ما) শব্দটি পড়ে যাওয়ায় অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে গিয়েছে। এটি একটি দূরবর্তী সম্ভাবনা। কারণ এক্ষেত্রে ‘কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেন নি’ না বলে ‘ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন’ বলাই ছিল স্বাভাবিক।
উল্লেখ্য যে, মোল্লা আলী কারী এ বিষয়ে পৃথক একটি পুস্তক রচনা করেন। পুস্তকটির নাম (أدلة معتقد أبي حنيفة الأعظم في أبوي الرسول عليه السلام) অর্থাৎ ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে ইমাম আযম আবূ হানীফার আকীদার পক্ষে দলীলসমূহ’’। এ গ্রন্থের শুরুতে তিনি বলেন:
"قَدْ قَالَ الإِمَامُ الأَعْظَمُ وَالْهُمَامُ الأَقْدَمُ فِيْ كِتَابِهِ
الْمُعْتَبَرِ الْمُعَبَّرِ بِـ(الْفِقْهِ الأَكْبَرِ) مَا نَصُّهُ:
"وَوَالِدَا رَسُوْلِ اللهِ مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ". فَقَالَ
شَارِحُهُ: هَذَا رَدٌّ عَلَى مَنْ قَالَ بِأَنَّ وَالِدَيْ رَسُوْلِ اللهِ مَاتَا
عَلَى الإِيْمَانِ، وَعَلَى مَنْ قَال مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ ثُمَّ (دَعَا)
رَسُوْلُ اللهِ اللهَ لَهُمَا فَأَحْيَاهُمَا اللهُ وَأَسْلَمَا ثُمَّ مَاتَا
عَلَى الإِيْمَانِ. فَأَقُوْلُ وَبِحَوْلِهِ أَصُوْلُ: إِنَّ هَذَا الْكَلاَمَ
مِنْ حَضْرَةِ الإِمَامِ لاَ يُتَصَوَّرُ فِيْ هَذَا الْمَقَامِ لِتَحْصِيْلِ
الْمَرَامِ إِلاَّ أَنْ يَكُوْنَ قَطْعِيَّ الدِّرَايَةِ لاَ ظَنِّيَّ
الرِّوَايَةِ لأَنَّهُ فِيْ بَابِ الاِعْتِقَادِ لاَ يُعْمَلُ بِالظَّنِّيَّاتِ
وَلاَ يُكْتَفَى بِالآحَادِ مِنَ الأَحَادِيْثِ الْوَاهِيَاتِ وَالرِّوَايَاتِ
الْوَهْمِيَّاتِ إِذْ مِنَ الْمُقَرَّرِ وَالْمُحَرَّرِ فِيْ الأَصْلِ
الْمُعْتَبَرِ أَنَّهُ لَيْسَ لأَحَدٍ مِنْ أَفْرَادِ الْبَشَرِ أَنْ يَحْكُمَ
عَلَى أَحَدٍ بِأَنَّهُ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَلاَ بِأَنَّهُ مِنْ أَهْلِ
الْعُقُوْبَةِ إِلاَّ بِنَقْلٍ ثَبْتٍ بِنَصٍّ مِنَ الْكِتَابِ أَوْ تَوَاتُرٍ
مِنَ السُّنَّةِ أَوْ إِجْمَاعِ عُلَمَاءِ الأُّمَّةِ بِالإِيْمَانِ الْمَقْرُوْنِ
بِالْوَفَاةِ أَوْ بِالْكُفْرِ الْمُنْضَمِّ إِلَى آخِرِ الْحَيَاةِ. فَإِذَا
عَرَفْتَ ذَلِكَ فَنَسْتَدِلُّ عَلَى مَرَامِ الإِمَامِ بِحَسْبِ مَا اطَّلَعْنَا
عَلَيْهِ فِيْ هَذَا الْمَقَامِ بِالْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَاتِّفَاقِ أَئِمَّةِ
الأَنَامِ".
‘‘ইমাম আযম তাঁর ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ নামক নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বলেছেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কুফুরের উপর মৃত্যুবরণ করেন।’’ ব্যাখ্যাকার বলেন: এ কথার দ্বারা তিনি দুটি মত খন্ডন করেছেন: যারা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মত এবং যারা বলেন যে, তাঁরা কুফরের উপর মৃত্যু বরণ করেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেন, তখন আল্লাহ তাদের দুজনকে পুনর্জীবিত করেন এবং তাঁরা দুজন ইসলাম গ্রহণ করে ইসলাম-সহ মৃত্যুবরণ করেন- তাদের মত তিনি খন্ডন করেছেন। এ বিষয়ে আমি আল্লাহর সাহায্য ও তাওফীকে বলি যে, এ বিষয়ে হযরত ইমাম আযমের বক্তব্য বুঝতে হলে কোনো যন্নী বা ‘‘ধারণা’’ প্রদানকারী প্রমাণের উপর নির্ভর করা যাবে না; বরং কাতয়ী বা সুনিশ্চিত বিশ্বাস প্রদানকারী প্রমাণের উপর নির্ভর করতে হবে। কারণ বিষয়টি আকীদা বা বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট, যে বিষয়ে ‘‘যন্নী’’ বা ধারণাজ্ঞাপক প্রমাণের উপর নির্ভর করা যায় না। আর এ বিষয়ে দুর্বল-অনির্ভরযোগ্য দু-চারটি হাদীস বা কাল্পনিক বর্ণনা যথেষ্ট নয়। কারণ নির্ভরযোগ্য মূলনীতিতে একথা নির্ধারণ ও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, কোনো মানুষের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে জান্নাতী বা শাস্তিপ্রাপ্ত (জাহান্নামী) বলে নিশ্চিত করা বৈধ নয়। কেবলমাত্র যদি কুরআন কারীমের সুস্পষ্ট বক্তব্য, মুতাওয়াতির হাদীস বা উম্মাতের আলিমগণের ইজমা দ্বারা যদি সুনিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে, উক্ত ব্যক্তি ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন, অথবা জীবনের শেষ মুহূর্তে কাফির থেকে কুফরসহ মৃত্যুবরণ করেছেন, তাহলেই কেবল তাকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলে নিশ্চিত করা যায়। উপরের বিষয়টি বুঝার পরে আমি আমার জ্ঞান অনুসারে কুরআন হাদীস ও উম্মাতের ইমামগণের ইজমার আলোকে ইমাম আযমের বক্তব্য প্রমাণ করব।’’[1]
শারহুল ফিকহিল আকবার গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মোল্লা আলী কারী বলেন:
هَذَا رَدٌّ عَلَى مَنْ قَالَ أَنَّهُمَا مَاتَا عَلَى الإِيْمَانِ أَوْ مَاتَا
عَلَى الْكُفْرِ ثُمَّ أَحْيَاهُمُ اللهُ تَعَالَى فَمَاتَا فِيْ مَقَامِ
الإِيْمَانِ. وَقَدْ أَفْرَدْتُ لِهَذِهِ الْمَسْأَلَةِ رِسَالَةً مُسْتَقِلَّةً
وَدَفَعْتُ مَا ذَكَرَهُ السُّيُوْطِيُّ فِيْ رَسَائِلِهِ الثَّلاَثَةِ، فِيْ
تَقْوِيَةِ هَذِهِ الْمَقَالَةِ بِالأَدِلَّةِ الْجَامِعَةِ الْمُجْتَمِعَةِ مِنَ
الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَالْقِيَاسِ وَإِجْمَاعِ الأُمَّةِ. وَمِنْ غَرِيْبِ مَا
وَقَعَ فِيْ هَذِهِ الْقَضِيَّةِ إِنْكَارُ بَعْضِ الْجَهَلَةِ مِنَ
الْحَنَفِيَّةِ عَلَى مَا فِيْ بَسْطِ هَذَا الْكَلاَمِ بَلْ أَشَارَ إِلَى
أَنَّهُ غَيْرُ لاَئِقٍ بِمَقَامِ الإِمَامِ الأَعْظَمِ. وَهَذَا بِعَيْنِهِ كَمَا
قَالَ الضَّالُّ جَهْمُ بْنُ صَفْوَانَ: وَدِدْتُ أَنْ أَحُكَّ مِنَ الْمُصْحَفِ
قَوْلَهُ تَعَالَى: ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ ... وَقَوْلِ الرَّافِضِيِّ
الأَكْبَرِ إِنَّهُ بَرِيْءٌ مِنَ الْمُصْحَفِ الَّذِيْ فِيْهِ نَعْتُ
الصِّدِّيْقِ الأَكْبَرِ.
‘‘এ কথা দ্বারা তাদের মত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যারা বলেন যে, তাঁরা উভয়ে ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছিলেন, অথবা কুফর অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন, পরে আল্লাহ তাঁদেরকে জীবিত করেন এবং তাঁরা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেন। এ বিষয়ে আমি পৃথক একটি পুস্তিকা রচনা করেছি। তাতে আমি সুয়ূতীর তিনটি পুস্তিকার বক্তব্য খন্ডন করেছি। এ পুস্তিকায় আমি কুরআন, হাদীস, কিয়াস ও ইজমার বক্তব্য দিয়ে ইমাম আযমের এ মত জোরদার করেছি। এ সম্পর্কিত একটি মজার বিষয় হলো, কিছু অজ্ঞ হানাফী এ বিষয়ক আলোচনা আপত্তিকর বলে মনে করেন। বরং তারা বলে, এ ধরনের কথা বলা ইমাম আযমের মর্যাদার পরিপন্থী। তাদের এ কথা অবিকল (জাহমী মতের প্রতিষ্ঠাতা) বিভ্রান্ত জাহম ইবনু সাফওয়ানের কথার মত। সে বলত: ‘‘আমার মনে চায় আল্লাহর বাণী ‘অতপর তিনি আরশে সমাসীন হলেন’ কথাটি আমি কুরআনের পৃষ্ঠা থেকে মুছে ফেলে দিই।’’ অনুরূপভাবে তাদের কথা অবিকল সেই শ্রেষ্ঠ শীয়া-রাফিযীর কথার মত, যে বলে: যে কুরআনের মধ্যে সিদ্দীকে আকবারের প্রশংসা বিদ্যমান সে কুরআনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’’ (অর্থাৎ জাহম যেমন মুর্খতা বশত বলত যে, ‘আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন’ কথাটি আল্লাহর মর্যাদার পরিপন্থী এবং শীয়া-প্রবর যেমন মনে করেছে যে সিদ্দীকে আকবারের প্রশংসা কুরআনের মর্যাদার পরিপন্থী, তেমনি এ অজ্ঞ হানাফী ভেবেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা বিষয়ক আবূ হানীফার বক্তব্যটি তাঁর মর্যাদার পরিপন্থী।)[2]
মোল্লা আলী কারীর এ বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্যের মধ্যে এ বাক্যটির বিদ্যমান থাকার বিষয়ে তিনি সুনিশ্চিত ছিলেন এবং তার ব্যাখ্যা গ্রন্থের মধ্যেও বাক্যটি বিদ্যমান ছিল। সম্ভবত পরবর্তী কোনো কোনো প্রকাশক বাক্যটির বিষয়ে বিতর্কের কারণে বা বাক্যটি ইমাম আযমের মর্যাদার পরিপন্থী বলে মনে করে তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন। মহান আল্লাহই ভাল জানেন।
[1] মোল্লা আলী কারী, আদিল্লাতু মু’তাকাদি আবী হানীফা, পৃ. ৬১-৬৪।
[2] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার ১৩১ পৃ. (মাকতাবায়ে থানবী)
৬. ১. ২. পিতামাতা প্রসঙ্গ ও ইসলামী আকীদা
উপরের বাক্যটি ইমাম আবূ হানীফার লেখা হোক বা না হোক প্রসঙ্গটি ইসলামী আকীদার সাথে জড়িত। পরবর্তী অনুচ্ছেদে আবূ তালিবের ওফাত প্রসঙ্গে আমরা দেখব যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকেই শীয়াগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও তাঁর চাচা আবূ তালিবকে মুমিন হিসেবে বিশ্বাস করাকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন। মূলধারার তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনেক প্রসিদ্ধ ইমাম উল্লেখ করেছেন যে, তাঁরা কাফির-মুশরিক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিভিন্ন হাদীস এরূপই প্রমাণ করে। আনাস (রা) বলেন:
إنَّ رَجُلا قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيْنَ أَبِي قَالَ فِي النَّارِ فَلَمَّا
قَفَّى دَعَاهُ فَقَالَ إِنَّ أَبِي وَأَبَاكَ فِي النَّارِ
‘‘এক ব্যক্তি বলে: হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা কোথায়? তিনি বলেন: জাহান্নামে। লোকটি যখন চলে যাচ্ছিল তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন: নিশ্চয়ই আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে।’’[1]
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন:
زَارَ النَّبِيُّ ﷺ قَبْرَ أُمِّهِ (يَوْمَ الْفَتْحِ) فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ
حَوْلَهُ (فَمَا رُئِيَ بَاكِيًا أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ الْيَوْمِ) فَقَالَ
اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي فِي أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي
وَاسْتَأْذَنْتُهُ فِي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأُذِنَ لِي فَزُورُوا الْقُبُورَ
فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ
(মক্কা বিজয়ের সময়) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর মাতার কবর যিয়ারত করেন। তখন তিনি এমনভাবে ক্রন্দন করেন যে তাঁর সাথীগণও ক্রন্দন করতে থাকেন (তাঁকে এত বেশি ক্রন্দন করতে আর কখনো দেখা যায় নি)। তিনি বলেন: আমি আমার রবের নিকট আমার মায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার অনুমতি চাইলাম, কিন্তু আমাকে অনুমতি দেয়া হলো না। তারপর আমি তার কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলাম। তখন আমাকে অনুমতি দেয়া হলো। তোমরা কবর যিয়ারত করবে; কারণ তা মৃত্যুর কথা স্মরণ করায়।[2]
ইমাম ইবন মাজাহ মুহাম্মাদ ইবন ইয়াযীদ কাযবীনী (২৭৩ হি), ইমাম নাসায়ী আহমদ ইবন শুআইব (৩০৩ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এ হাদীসকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাতার মুশরিক হওয়ার প্রমাণ ও মুশরিকের কবর যিয়ারতের বৈধতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন। এ হাদীস প্রসঙ্গে ইবন মাজাহ বলেন: ‘‘(باب ما جاء في
زيارة قبور المشركين) মুশরিকদের কবর যিয়ারত বিষয়ে বর্ণিত হাদীসের অনুচ্ছেদ’’[3] এবং নাসায়ী বলেন: (باب زيارة قبر المشرك) ‘‘মুশরিকের কবর যিয়ারতের অনুচ্ছেদ’’।[4] তৃতীয়-চতুর্থ শতক পর্যন্ত অনেকেই বিষয়টিকে স্বতঃসিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন:
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلاَ تُسْأَلُ عَنْ
أَصْحَابِ الْجَحِيمِ
‘‘নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আপনি জাহান্নামীদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন না।’’[5]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম তাবারী (৩১০ হি) তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবন কা’ব কুরাযী থেকে উদ্ধৃত করেন, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
ليت شعري ما فعل أبواي؟ فنزلت
‘‘আমার পিতামাতার কি অবস্থা তা যদি আমি জানতে পারতাম!’- তখন এ আয়াতটি নাযিল করা হয়।’’
এরপর ইমাম তাবারী বলেন:
فإن ظن ظان أن الخبر الذي روي عن محمد بن كعب صحيح ، فإن في استحالة الشك من
الرسول عليه السلام - في أن أهل الشرك من أهل الجحيم ، وأن أبويه كانا منهم، ما
يدفع صحة ما قاله محمد بن كعب، إن كان الخبر عنه صحيحا.
‘‘যদি কোনো ধারণাকারী ধারণা করেন যে, মুহাম্মাদ ইবন কা’ব থেকে বর্ণিত এ হাদীসটি সহীহ তবে তার এ ধারণা সঠিক হবে না। কারণ মুশরিকগণ যে জাহান্নামী এবং তাঁর পিতামাতা যে তাদের অন্তর্ভুক্ত এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো সন্দেহ থাকা-ই অসম্ভব বিষয়। আর এটিই প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ ইবন কাব যে কথা বলেছেন তা সঠিক নয়; যদিও তিনি এ কথা বলেছেন বলে প্রমাণিত হয়।[6]
ইমাম ফাখরুদ্দীন রাযী (৬০৬ হি) এ মত সমর্থন করে বলেন:
هذه الرواية بعيدة لأنه ﷺ كان عالماً بكفرهم، وكان عالماً بأن الكافر معذب، فمع
هذا العلم كيف يمكن أن يقول : ليت شعري ما فعل أبواي.
‘‘এ বর্ণনাটি অগ্রহণযোগ্য। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের কাফির হওয়ার বিষয় জানতেন এবং কাফিররা যে শাস্তি পাবে তাও জানতেন। কাজেই এরূপ জ্ঞান থাকার পরেও কিভাবে তিনি বলবেন: আমার পিতামাতা কিরূপ আছেন তা যদি জানতাম!?’’[7]
এ মতের বিপরীতে বিগত কয়েক শতাব্দী যাবৎ অনেক আলিম মত প্রকাশ করছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন। ইবনু শাহীন উমার ইবনু আহমদ (৩৮৫ হি), খতীব বাগদাদী (৪৬৩ হি), ইবনু আসাকির (৫৭১হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা সকলেই একই সনদে হাদীসটি সংকলন করেছেন। আয়েশা (রা)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, বিদায় হজ্জের সময়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেদনার্ত ছিলেন। একসময় তিনি আনন্দিত চিত্তে আয়েশার (রা) নিকট আগমন করেন। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন:
ذَهَبْتُ لِقَبْرِ أُمِّي آمِنَةَ فَسَأَلْت اللهَ رَبِّي أَنْ يُحْيِيَهَا
فَأَحْيَاهَا فَآمَنَتْ بِي أَوْ قَالَ فَآمَنَتْ وَرَدَّهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ
‘‘আমি আমার আম্মা আমেনার কবরের নিকট গমন করি এবং আল্লাহর কাছে দুআ করি তাঁকে জীবিত করতে। তখন আল্লাহ তাঁকে জীবিত করেন, তিনি আমার উপর ঈমান আনয়ন করেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁকে ফিরিয়ে নেন।’’ কোনো কোনো বর্ণনায় পিতামাতার কথা বলা হয়েছে।
নবম-দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও শাফিয়ী ফকীহ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি) ও অন্যান্য আলিম এ হাদীসের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেন বলে মত প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য যে, ইবনুল জাওযী, মোল্লা আলী কারী, শাওকানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে নিশ্চিত করেছেন। ইবনু কাসীর বলেন: হাদীসটি মুনকার ও অত্যন্ত দুর্বল এবং হাদীসের রাবীগণ দুর্বল ও অজ্ঞাতপরিচয়। ইবনু আসাকিরও একই কথা বলেছেন। ইমাম সুয়ূতী উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি নিশ্চিতরূপেই দুর্বল। তিনি বলেন, মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি দুর্বল, কেউ কেউ একে জাল বলেছেন। তবে একে জাল না বলে দুর্বল বলা উচিত। ইমাম সুয়ূতীর মতে ফযীলত বা মর্যাদার বিষয় যেহেতু ঈমান-আকীদা ও হালাল-হারাম-এর সাথে সংশিস্নষ্ট নয়, এজন্য ফযীলত বিষয়ে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়। আর এ মূলনীতির ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার ফযীলতে এ দুর্বল হাদীসটি গ্রহণ করা যায়।[8]
এর বিপরীতে কোনো কোনো আলিম বলেছেন যে, আমল বা কর্মের ফযীলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করার পক্ষে অনেক আলিম মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তির ফযীলত বা মর্যাদার বিষয় যেহেতু বিশ্বাস বা আকীদার বিষয় সেহেতু এ বিষয়ে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায় না। অনেক আলিম বলেন, হাদীসটি জাল না হলেও এরূপ দুর্বল হাদীস বুখারী-মুসলিম সংকলিত সহীহ হাদীসের বিপরীতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বোপরি কুরআন ও হাদীসে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, আযাব বা মৃত্যুর আগমনের পর ঈমান বা তাওবা অর্থহীন।[9] আল্লাহ তাঁর হাবীবের পিতামাতাকে ক্ষমা করতে চাইলে তাঁর দুআর মাধ্যমেই করতে পারেন; মৃত্যুর মাধ্যমে আখিরাত প্রত্যক্ষ করার পরে ঈমান গ্রহণ এক্ষেত্রে অর্থহীন।[10]
অন্য হাদীসে আলী (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
خَرَجْتُ مِنْ نِكَاحٍ، وَلَمْ أَخْرُجْ مِنْ سِفَاحٍ مِنْ لَدُنْ آدَمَ إِلَى
أَنْ وَلَدَتْنِي أَبِي وَأُمِّي ، لَمْ يُصِبْنِي مِنْ سِفَاحِ الْجَاهِلِيَّةِ
شَيْءٌ.
‘‘আদম (আ) থেকে শুরু করে আমার পিতামাতা আমাকে জন্ম দেওয়া পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমার জন্ম, কোনো অবৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে আমার জন্ম হয় নি। জাহিলী যুগের কোনো অবৈধতা- অশ্লীলতা আমাকে স্পর্শ করে নি।’’[11]
কেউ কেউ এ অর্থের হাদীস দ্বারা দাবি করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও পূর্বপুরুষগণ কেউ কাফির ছিলেন না। ইমাম বাইহাকী ও অন্যান্য আলিম বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বাইহাকী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও পিতামহের জাহান্নামী হওয়ার অর্থে অনেকগুলো হাদীস উদ্ধৃত করেন। এরপর তিনি বলেন:
وكيف لا يكون أبواه وجده بهذه الصفة في الآخرة؟ وكانوا يعبدون الوثن حتى ماتوا،
ولم يدينوا دين عيسى ابن مريم عليه السلام. وأمرهم لا يقدح في نسب رسول الله ﷺ؛
لأن أنكحة الكفار صحيحة، ألا تراهم يسلمون مع زوجاتهم فلا يلزمهم تجديد العقد، ولا
مفارقتهن إذا كان مثله يجوز في الإسلام.
‘‘তাঁর পিতা, মাতা ও পিতামহ মৃত্যু পর্যন্ত মূর্তিপূজা করেছেন এবং তাঁরা ঈসা (আ)-এর দীনও গ্রহণ করেন নি, কাজেই তাঁরা আখিরাতে জাহান্নামী হবেন না কেন? এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশের পবিত্রতার পরিপন্থী নয়; কারণ কাফিরদের বিবাহ বিশুদ্ধ। এজন্য তো কাফিরগণ যখন তাদের স্ত্রীদের সাথে একত্রে ইসলাম গ্রহণ করেন তখন নতুন করে বিবাহ পড়ানোর দরকার হয় না এবং স্ত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ারও কোনো বিধান নেই, যদি এরূপ বিবাহ ইসলামে বৈধ থাকে।’’[12]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে তৃতীয় একটি মত বিদ্যমান। এ মতানুসারে তাঁর পিতামাতা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও নবী-বিহীন যুগে মৃত্যুর কারণে তাঁরা শাস্তিযোগ্য নন। নিম্নের আয়াতগুলো তা প্রমাণ করে:
وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولا
‘‘রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি শাস্তি প্রদান করি না।’’[13]
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ
حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ
‘‘রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও ভয়প্রদর্শনকারী হিসেবে; যেন রাসূলগণের পরে মানুষের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ অবশিষ্ট না থাকে।’’[14]
وَلَوْ أَنَّا أَهْلَكْنَاهُمْ بِعَذَابٍ مِنْ قَبْلِهِ لَقَالُوا رَبَّنَا
لَوْلَا أَرْسَلْتَ إِلَيْنَا رَسُولًا فَنَتَّبِعَ آَيَاتِكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ
نَذِلَّ وَنَخْزَى
‘‘যদি আমি তাদেরকে ইতোপূর্বে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম তবে তারা বলত, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের কাছে একজন রাসূল পাঠালেন না কেন? পাঠালে আমরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার আগে আপনার নিদর্শন মেনে চলতাম।’’’[15]
এ সকল আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘‘ফাতরাত’’ বা রাসূল-বিহীন যুগে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এরূপ মানুষদেরকে কিয়ামাতে পরীক্ষা করে মুক্তি দেওয়া হবে। এজন্য অনেক আলিম মত প্রকাশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হবেন না।
এ মতটি অত্যন্ত জোরালো। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার কুফরের উপর মৃত্যু হওয়ার বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সুনিশ্চিত। মৃত্যুর পরে পুনর্জীবিত হয়ে ঈমান গ্রহণের হাদীসটি সনদগতভাবে অত্যন্ত দুর্বল। উপরন্তু অর্থের দিক থেকে মৃত্যুর পরে ঈমান আনার বিষয়টি কুরআন-হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। পক্ষান্তরে ‘ফাতরাতে’ বা ‘রাসূল-বিহীন’ যুগে মৃত্যুর কারণে আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে উপরে উল্লেখিত ‘‘আমার ও তোমার পিতা জাহান্নামে’’ হাদীসটি এ মতের সাথে সাংঘর্ষিক।
সপ্তম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম নববী (৬৭৬ হি) ‘আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে’- হাদীসটিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণের নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে বলেন:
فِيهِ أَنَّ مَنْ مَاتَ عَلَى الْكُفْر فَهُوَ فِي النَّار، وَلا تَنْفَعهُ
قَرَابَة الْمُقَرَّبِينَ، وَفِيهِ أَنَّ مَنْ مَاتَ فِي الْفَتْرَة عَلَى مَا
كَانَتْ عَلَيْهِ الْعَرَب مِنْ عِبَادَة الأَوْثَان فَهُوَ مِنْ أَهْل النَّار،
وَلَيْسَ هَذَا مُؤَاخَذَة قَبْل بُلُوغ الدَّعْوَة، فَإِنَّ هَؤُلاءِ كَانَتْ
قَدْ بَلَغَتْهُمْ دَعْوَة إِبْرَاهِيم وَغَيْره مِنْ الأَنْبِيَاء
‘‘এ হাদীসে নির্দেশনা রয়েছে, যে ব্যক্তি কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামী। আল্লাহর প্রিয়ভাজনদের আত্মীয়তা তার কোনো উপকার করবে না। এ হাদীসে আরো নির্দেশনা রয়েছে, আরবের মানুষগণ যেরূপ মুর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল সেরূপ কর্মের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তি রাসূল-বিহীন ‘ফাতরাতের’ সময়ে মৃত্যুবরণ করেছে সে ব্যক্তিও জাহান্নামী। এরূপ ব্যক্তিদের জাহান্নামে যাওয়ার অর্থ এ নয় যে, তাদেরকে দীনের দাওয়াত পৌঁছানোর পূর্বেই শাস্তি দেওয়া হলো। কারণ, এদের কাছে ইবরাহীম (আ) ও অন্যান্য নবীর দাওয়াত পৌঁছেছিল।’’[16]
আল্লামা খলীল আহমদ সাহারানপূরী (১৩৪৬ হি) বলেন:
قَدْ بَالَغَ السُّيُوْطِيُّ فِيْ إِثْبَاتِ إِيْمَانِ أَبَوَيْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ.
قَالَ الْقَارِي: الجمهور عَلَى أَنَّ وَالِدَيْهِ ﷺ مَاتَا كَافِرَيْنِ. وَهَذَا
الْحَدِيْثُ أَصَحُّ مَا رُوِيَ فِيْ حَقِّهِمَا... فَعَلَى تَقْدِيْرِ صِحَّتِهِ
لاَ يَصْلُحُ أَنْ يَكُوْنَ مُعَارِضاً لِحَدِيْثِ مُسْلِمٍ مَعَ أَنَّ
الْحُفَّاظَ طَعَنُوْا فِيْهِ وَمَنَعُوْا جَوَازَهُ بِأَنَّ إِيْمَانَ الْيَأْسِ
غَيْرُ مَقْبُوْلٍ إِجْمَاعاً كَمَا يَدُلُّ عَلَيْهِ الْكِتَابُ وَالسُّنَّةُ
وَبِأَنَّ الإِيْمَانَ الْمَطْلُوْبَ مِنَ الْمُكَلَّفِ إِنَّمَا هُوَ الإِيْمَانُ
الْغَيْبِيُّ... وَهَذَا الْحَدِيْثُ الصَّحِيْحُ صَرِيْحٌ أَيْضاً فِيْ رَدِّ مَا
تَشَبَّثَ بِهِ بَعْضُهُمْ بِأَنَّهُمَا كَانَا مِنْ أَهْلِ الْفَتْرَةِ وَلاَ
عَذَابَ عَلَيْهِمْ
‘‘সুয়ূতী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতা-মাতার ঈমানের বিষয়টি প্রমাণে অতি-চেষ্টা করেছেন। মোল্লা আলী ক্বারী বলেছেন: অধিকাংশ আলিম একমত যে, তাঁরা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এ ব্যাপারে এ হাদিসটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ দলিল। ... (পুনর্জীবিত করার) হাদিসটি সহীহ বলে মেনে নিলেও মুসলিম শরীফের (আমার ও তোমার পিতা জাহান্নামে) হাদীসটির বিপরীতে দাঁড় করানো যায় না। সর্বোপরি প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ (পুনরুজ্জীবিত করার) এ হাদিসটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে আপত্তি করেছেন। তাঁরা এ ঘটনার সম্ভাবনাও অস্বীকার করেছেন। কারণ মুসলিম উম্মাহর ইজমা যে, নৈরাশ্যের পরে ঈমান- অর্থাৎ মৃত্যুর আগমনের পরে ঈমান- গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন ও হাদীসে তা সুস্পষ্ট বলা হয়েছে। এছাড়া ঈমান তো গাইবী বিষয়ের উপরই হয়ে থাকে। মৃত্যুর পরে তো সব গাইবী বিষয় প্রত্যক্ষ হয়ে যায়; এরপর তো আর ঈমান বিল-গাইব থাকে না। ... (আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে) হাদিসটি সুষ্পষ্টভাবে তাদের বক্তব্যও প্রত্যাখ্যান করে যারা দাবী করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ‘‘ফাতরাত’’ বা রাসূল-বিহীন যুগে থাকার কারণে তাদের শাস্তি হবে না।’’[17]
এভাবে ইমাম নববী ও অন্যান্য আলিম এ হাদীসের উপর নির্ভর করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার ফাতরাত’-বাসী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাঁরা দাবি করেছেন যে, আরবের মুশরিকগণ ‘‘রাসূল-বিহীন’’ ছিলেন না; বরং ইবরাহীম (আ)-এর দাওয়াত তাদের নিকট পৌঁছেছিল। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা এই যে, ইবরাহীম (আ)-এর বিশুদ্ধ দাওয়াত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগের অনেক আগেই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। কাজেই তাঁর নুবুওয়াতের অব্যবহিত পূর্বের যুগের মানুষদেরকে রাসূল-বিহীন বলে গণ্য করাই কুরআন, সুন্নাহ, ইতিহাস ও যুক্তির দিক থেকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
তবে আলোচ্য হাদীসটি বাহ্যত এ মতটির সাথে সাংঘর্ষিক। এ হাদীসটির অর্থ হতে পারে যে ‘‘আমার ও তোমার পিতা রাসূল-বিহীন যুগের অধিবাসীদের পরীক্ষা পর্যন্ত জাহান্নামী হওয়ার বিধানের মধ্যে’’- এ অর্থের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতাকে রাসূল-বিহীন যুগের অধিবাসী হিসেবে আখিরাতের আযাব-মুক্ত বলে গণ্য করার মতটিই অগ্রগণ্য বলে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহই ভাল জানেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে চতুর্থ মত হলো এ বিষয়ে মত প্রকাশ থেকে বিরত থাকা। সঠিক জ্ঞান তো মহান আল্লাহরই নিকটে।
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৯১ (ঈমান, বাবু বায়ানি আন্না মান মাতা আলাল কুফর..)।
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৭১ (জানাইয, বাবু ইসতিজানিন নাবিয়্যি.. ফি যিয়ারাতি)।
[3] ইবন মাজাহ, কিতাবুল জানায়িয, বাব মা জাআ ফী যিয়ারাতি কুবূরির মুশরিকীন ১/৫০১।
[4] নাসায়ী, কিতাবুল জানায়িয, বাব যিয়ারত কাবরিল মুশরিক ৪/৯০-৯১।
[5] সূরা (২) বাকারা: ১১৯ আয়াত।
[6] তাবারী, তাফসীর ২/৫৫৮-৫৬০।
[7] ফখরুদ্দীন রাযী, মাফাতীহুল গাইব ৪/২৮।
[8] সুয়ূতী, আল-হাবী লিল-ফাতাওয়া ২/২১৮।
[9] সূরা নিসা: ১৭-১৮ আয়াত; সূরা গাফির (মুমিন): ৮৫ আয়াত।
[10] বিস্তারিত দেখুন: সুহাইলী, আর-রাওযুল উনুফ /২৯৬; ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত ১/২৮৪; ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৪/৩০৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী আল-মাসনূআ ১/২৪৫; আল-হাবী লিল-ফাতওয়া ২/২১৮; ৩/৩৪৩; কুরতুবী, আত-তাযকিরা ফী আহওয়ালিল আখিরাহ ১/১২; মোল্লা আলী কারী, আদিল্লাতু মু’তাকাদি আবী হানীফা, ৮৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ আল-মাজমুআ ১/৩২২।
[11] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৭/১৯০; আলবানী, সহীহুল জামি ১/৬১৩, নং ৩২২৫।
[12] বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াত ১/১১২, ১১৯-১২২।
[13] সূরা (১৭) ইসরা (বনী ইসরাঈল): ১৫ আয়াত।
[14] সূরা (৪) নিসা: ১৬৫ আয়াত।
[15] সূরা (২০) তাহা: ১৩৪ আয়াত। পুনশ্চ: সূরা (২৮) কাসাস: ৪৭ আয়াত।
[16] নববী, শারহু সাহীহ মুসলিম ৩/৭৯।
[17] সাহারানপুরী, বজলুল মাজহূদ ৫/২১৪ ।
৬. ২. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাত
আমরা দেখেছি, কোনো কোনো পান্ডুলিপির ভাষ্য অনুসারে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেন।’’
এ বিষয়টি সন্দেহাতীত মহাসত্য এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ বা মতভেদ নেই। কাজেই বিষয়টি আকীদা বিষয়ক গ্রন্থে উল্লেখের আবশ্যকতা কী? এ বিষয়ে মোল্লা আলী কারী বলেন: ‘‘এ বাক্যটি ব্যাখ্যাকারের মূল পান্ডুলিপিতে নেই। এ বিষয়টি এত সুস্পষ্ট যে এর কোনো ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুমহান মর্যাদার প্রেক্ষাপটে এ কথা উল্লেখের কোনো প্রয়োজনও নেই। যদি ধরে নেওয়া হয় যে কথাটি মূলতই ইমাম আযম লিখেছেন, তবে এ কথার অর্থ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং অন্যান্য নবী-রাসূল নুবুওয়াতের মর্যাদার কারণে ‘মাসূম’ এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কুফর থেকে সংরক্ষিত। কাজেই তাঁদের বিষয়ে আমাদের আকীদা পোষণ করতে হবে যে, তাঁরা ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যান্য আউলিয়া, উলামা বা আল্লাহর প্রিয়পাত্রদের কারো বিষয়ে এরূপ নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না যে, তারা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের থেকে যদি অলৌকিক কারামতাদি প্রকাশিত হয়, তাদের পরিপূর্ণ কামালাত ও বেলায়াত প্রমাণিত হয় বা সকল প্রকারের নেক আমলে তাদের লিপ্ত থাকা নিশ্চিত জানা যায়, তবুও তাদের কারো বিষয়ে এরূপ নিশ্চিত হওয়া যায় না।...।’’[1]
[1] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৮২-১৮৩।
৬. ৩. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচার ওফাত
আমরা আগেই বলেছি, শীয়াগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা, চাচা, দাদা ও পূর্বপুরুষদের মুমিন বলে দাবি করেন। বিশেষত তাঁর চাচা ও আলী (রা)-এর পিতা আবূ তালিবকে মুমিন বলে প্রমাণ করতে তারা অগণিত বইপুস্তক রচনা করেছেন। আবূ তালিবকে কাফির প্রমাণ করার চেষ্টাকে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর বংশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং তাঁর সাথে চরমতম বেয়াদবী বলে দাবি করেছেন। এ বিষয়ক আলোচনার আগে নিম্নের বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পাঠককে অনুরোধ করছি।
(ক) আকীদার উৎস বিষয়ে আমরা দেখেছি যে, সাহাবী-তাবিয়ীগণ এবং আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত কুরআন ও সহীহ হাদীসকে আকীদার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং নিজেদের আবেগ ও পছন্দ-অপছন্দকে এর ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। পক্ষান্তরে শীয়াগণ তাদের পণ্ডিতগণের মত, ব্যাখ্যা ও আবেগকেই আকীদার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং এর আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যা করেছেন।
(খ) শীয়া ধর্মমতের মূল বিষয় রাজনৈতিক অপপ্রচারের ধর্মীয়করণ। রাজনৈতিক মতভেদ, সংঘর্ষ, ইত্যাদি মানব ইতিহাসের চিরপরিচিত চিত্র এবং মানবীয় প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানবীয় প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য হলো যে, এরূপ সংঘর্ষে লিপ্তগণ নিজের স্বার্থে ধর্মের ব্যবহারের চেষ্টা করেন, ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্য করেন। কিন্তু নিজ ধর্মকে সচেতনভাবে বিকৃত করতে চেষ্টা করেন না। বরং প্রত্যেকেই নিজ অবস্থানকে ধর্মীয়ভাবে সঠিক বলে দাবি করেন। ইহূদী, খৃস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ও সকল ধর্মের অনুসারীদের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ অগণিত যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ, শতবর্ষের যুদ্ধ ইত্যাদি সবই এ কথাই প্রমাণ করে।
শীয়াগণ রাজনৈতিক সংঘর্ষকে ধর্মীয়করণ করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলি যেমন নিজেদের নেতৃবৃন্দকে দেবতা ও অন্যদেরকে জাতির শত্রু, স্বাধীনাতার শত্রু, ধর্মের শত্রু ইত্যাদি আখ্যায়িত করেন, যে কোনোভাবে অপরপক্ষের চরিত্রহননে সচেষ্ট থাকেন এবং এজন্য সকল প্রকার গালগল্প বানান ঠিক তেমনিভাবে শীয়াগণ রাজনৈতিক ক্ষমতাগ্রহণের জন্য যাদের নাম ব্যবহার করতেন তাদেরকে দেবতা এবং বিরোধীদেরকে দানব হিসেবে চিত্রিত করতে সকল প্রকার অপপ্রচারের আশ্রয় গ্রহণ করেন।
(গ) মানুষের মর্যাদার দুটি দিক রয়েছে: (১) মানুষের নিজের সচেতন ইচ্ছাধীন কর্মের মাধ্যমে অর্জিত মর্যাদা এবং (২) মানুষের রক্ত, বংশ, জন্ম, পরিবার ইত্যাদি ইচ্ছাবহির্ভুত-কর্মবহির্ভুত বিষয় নির্ভর মর্যাদা। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে সাহাবী-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত প্রথম বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিষয়টি একেবারে অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। শীয়াগণ একেবারেই বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বংশ, রক্ত, বর্ণ, পরিবার ইত্যাদি বিষয়কে মানুষের মর্যাদার মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কর্ম, তাকওয়া ইত্যাদিকে একেবারেই অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। নবী-বংশের বা আলী-বংশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের মূল আলোচ্য বিষয় তাদের অলৌকিক জন্ম, নূর দ্বারা সৃষ্টি, পবিত্র বংশধারা ইত্যাদি। আর বংশধারার পবিত্রতা প্রমাণের জন্য তারা তাঁদের সকলকে ঈমানদার প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এজন্য আমরা দেখি যে, তাঁরা আবূ তালিব, আব্দুল মুত্তালিব ও অন্যান্যদেরকে মুমিন, মুসলিম ও আল্লাহর প্রিয়তম ও পবিত্রতম হিসেবে প্রচার করেছেন। পাশাপাশি আবূ বকর, উমর, উসমান, তালহা, যুবাইর, সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস, আবূ হুরাইরা, আনাস ও অন্যান্য সকল মুহাজির-আনসার সাহাবী (রাঃ)-কে কাফির, মুরতাদ ও ইসলামের অন্যতম শত্রু হিসেবে বিশ্বাস করাকে ইসলামী আকীদার মূল ভিত্তি বলে গণ্য করেছেন।
উপরের মূলনীতির ভিত্তিতে আহলূস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমামগণ আবূ তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলে বিশ্বাস করেছেন। কারণ সাহাবীগণ থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত অনেকগুলো হাদীস বিষয়টি প্রমাণ করে। ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আব্দুর রায্যাক সানআনীর সূত্রে মা‘মার থেকে যুহরী থেকে সায়ীদ ইবনুল মুসাইবি থেকে সাহাবী মুসাইয়িব (রা) থেকে, তিনি বলেন:
إنَّ أَبَا طَالِبٍ لَمَّا حَضَرَتْهُ الْوَفَاةُ دَخَلَ عَلَيْهِ النَّبِيُّ ﷺ
وَعِنْدَهُ أَبُو جَهْلٍ فَقَالَ أَيْ عَمِّ قُلْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ كَلِمَةً
أُحَاجُّ لَكَ بِهَا عِنْدَ اللَّهِ فَقَالَ أَبُو جَهْلٍ وَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ
أَبِي أُمَيَّةَ يَا أَبَا طَالِبٍ تَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ
فَلَمْ يَزَالا يُكَلِّمَانِهِ حَتَّى قَالَ آخِرَ شَيْءٍ كَلَّمَهُمْ بِهِ عَلَى
مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ لأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ
أُنْهَ عَنْهُ فَنَزَلَتْ: مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ
يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا
تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ. وَنَزَلَتْ: إِنَّكَ لا تَهْدِي
مَنْ أَحْبَبْتَ.
‘‘যখন আবূ তালিবের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলো, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার নিকট প্রবেশ করেন। তখন তার নিকট আবূ জাহল উপস্থিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: চাচা, আপনি বলুন: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’; এ বাক্যটি দিয়ে আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য দাবি-দাওয়া পেশ করব। তখন আবূ জাহল এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া বলল: হে আবূ তালিব, আপনি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম অপছন্দ করবেন? উক্ত দু ব্যক্তি এভাবে অনবরত তাকে বুঝাতে থাকলেন। ফলশ্রুতিতে আবূ তালিব সর্বশেষ কথটি তাদেরকে বললেন: ‘আব্দুল মুত্তালিবের ধর্মের উপরেই’। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: আমাকে নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকব। তখন নাযিল হয়[1]: ‘‘নবী ও মুমিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে, যদিও তারা আত্মীয় হয়, তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে, নিশ্চয় তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী।’’ আরো নাযিল হয়[2]: ‘‘তুমি যাকে ভালবাস তাকে তুমি হেদায়াত করতে পারবে না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দেন..।’’[3]
আরেকটি হাদীস ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস নবী-বংশের প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল হারিস ইবনু নাওফাল ইবন আব্দুল মুত্তালিব হাশিমী (৮৪ হি) থেকে উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচা আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিব (রা) তাঁকে বলেন: আপনি আপনার চাচার কী উপকার করেছেন? তিনি তো আপনাকে ঘিরে রাখতেন, হেফাযত করতেন এবং আপনার জন্যই অন্যদের উপর ক্রুদ্ধ হতেন? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
هُوَ فِى ضَحْضَاحٍ مِنْ نَارٍ ، وَلَوْلاَ أَنَا لَكَانَ فِى الدَّرَكِ
الأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ
‘‘তিনি সামান্য গোড়ালি পরিমাণ আগুনের মধ্যে রয়েছেন। আমি না হলে তিনি আগুনের (জাহান্নামের) তলদেশে থাকতেন।’’[4]
অন্য হাদীসে ইমাম বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবন খাব্বাব আনসারী (১০০ হি)-এর সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন, আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তাঁর চাচা আবূ তালিবের বিষয় উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন:
لَعَلَّهُ تَنْفَعُهُ شَفَاعَتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَيُجْعَلُ فِى ضَحْضَاحٍ
مِنَ النَّارِ، يَبْلُغُ كَعْبَيْهِ، يَغْلِى مِنْهُ دِمَاغُهُ
‘‘সম্ভবত আমার শাফাআত কিয়ামতে তার উপকার করবে; ফলে তিনি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সামান্য আগুনের মধ্যে থাকবেন, তাতেই তাঁর মস্তিষ্ক ফুটতে থাকবে।’’[5]
আবূ দাউদ, নাসায়ী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস কর্তৃক সহীহ সনদে সংকলিত হাদীসে তাবিয়ী নাজিয়া ইবন কা’ব বলেন, আলী (রা) বলেন:
قُلْتُ لِلنَّبِيِّ ﷺ إِنَّ عَمَّكَ الشَّيْخَ الضَّالَّ قَدْ مَاتَ قَالَ اذْهَبْ
فَوَارِ أَبَاكَ
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে বললাম, আপনার চাচা পথভ্রষ্ট শাইখ মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন তিনি বললেন, তুমি যাও এবং তোমার পিতাকে কবরস্থ কর।’’[6]
এ সকল হাদীসের আলোকে সাহাবী, তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত-এর ইমামগণ আবূ তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলে মেনে নিয়েছেন। এ বিষয়টিকে তাঁরা নবী-বংশের, আলী-বংশের বা আলী (রা)-এর প্রতি বেয়াদবী বা অবমাননা বলে কোনোভাবে মনে করেন নি। এ আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম আযম লিখেছেন: ‘‘তাঁর চাচা এবং আলী (রা)-এর পিতা আবু তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।’’
পক্ষান্তরে শীয়াগণ আবূ তালিবকে মুমিন হিসেবে বিশ্বাস করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। এ অর্থে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ), আলী (রা) ও তাঁর বংশের ইমামগণের নামে অনেক বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। আলী (রা)-এর খুতবা হিসেবে সংকলিত ‘নাহজুল বালাগা’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় ৭ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শীয়া-মুতাযিলী পন্ডিত ইবন আবিল হাদীদ আব্দুল হামীদ ইবন হিবাতুল্লাহ (৬৫৬ হি) বলেন:
وروى أن رجلا من رجال الشيعة وهو إبان بن محمود كتب إلى على بن موسى الرضا عليه
السلام جعلت فداك إنى قد شككت في إسلام أبى طالب فكتب إليه (ومن يشاقق الرسول من
بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين) الاية، وبعدها إنك إن لم تقر
بإيمان أبى طالب كان مصيرك إلى النار
‘‘বর্ণিত আছে যে, আবান ইবন মাহমূদ নামক একজন শীয়া নেতা (শীয়া মতবাদের অষ্টম ইমাম, ইমাম) আলী রিদা ইবন মূসা কাযিম (২০৩ হি)-কে পত্র লিখেন যে, আমি আপনার জন্য কুরবানি হই! আবূ তালিবের ঈমান গ্রহণের বিষয়ে আমার মনে আমি সন্দেহ অনুভব করি। তখন আলী রিদা কুরআনের নিম্নের আয়াত লিখেন: ‘‘কারো নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসুলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং মু’মিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর ওটা কত মন্দ আবাস!’’ (সূরা নিসা: ১১৫ আয়াত)। এরপর তিনি লিখেন: তুমি যদি আবূ তালিবের ঈমানের স্বীকৃতি না দাও তবে তোমাকে জাহান্নামেই যেতে হবে।’’[7]
শীয়া পন্ডিতগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা, চাচা আবূ তালিব, দাদা আব্দুল মুত্তালিব ও সকল পূর্বপুরুষকে ঈমানদার দাবি করার জন্য অনেক পুস্তক রচনা করেছেন। আবূ তালিবের বিষয়ে তাদের লেখালেখি সবচেয়ে বেশি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতার বিষয়ে তাদের লেখালেখির তুলনায় আলী (রা)-এর পিতার বিষয়ে তাঁদের লেখালেখি অনেক অনেক বেশি। এ বিষয়ক বইয়ের মধ্যে রয়েছে: আল্লামা শাইখ আব্দুল হুসাইন আমীনী নাজাফীর লেখা: ‘‘ঈমান আবী তালিব (আ) ও সীরাতুহূ’’, আয়াতুল্লাহ শাইখ নাসির মাকারিম শীরাযী রচিত ‘ঈমান আবী তালিব’’, শাইখ আব্দুল্লাহ খানবাযী রচিত ‘আবূ তালিব মুমিন কুরাইশ’ ইত্যাদি। এ সকল পুস্তকে উদ্ধৃত ‘হাদীস’ বা ‘দলীল-প্রমাণগুলো’ আলোচনা অর্থহীন; কারণ এগুলোর কোনো সনদ তারা উল্লেখ করেন না এবং সনদ যাচাইয়ের কোনো উপায়ও আমাদের নেই। তাঁদের কয়েকটি যুক্তি নিম্নরূপ:
(ক) তাঁরা দাবি করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ), তাঁর বংশ, আলী (রা) ও তাঁর বংশের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষের কারণে সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ ও মূলধারার ইমামগণ বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে উদ্ধৃত এ সকল হাদীস জালিয়াতি করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবন আবিল হাদীস বলেন:
أما حديث الضحضاح من النار، فإنما يرويه الناس كلهم عن رجل واحد ، وهو المغيرة بن
شعبة ، وبغضه لبنى هاشم وعلى الخصوص لعلى عليه السلام مشهور معلوم ، وقصته وفسقه
أمر غير خاف .
‘‘আবূ তালিব পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সামান্য আগুনের মধ্যে অবস্থান করবেন বলে যে হাদীসটি প্রচলিত সে হাদীসটি দুনিয়ার সকল মানুষ একজন মাত্র মানুষ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি হলেন: মুগীরা ইবন শুবা। আর হাশিমী বংশ (নবী-বংশ), বিশেষত আলী (আ)-এর প্রতি তাঁর শত্রুতা-বিদ্বেষ অতি প্রসিদ্ধ এবং তাঁর কাহিনী ও পাপাচারের বিষয়ও কারো অজানা নয়।’’[8]
আমরা দেখেছি যে, ‘গোড়ালি পর্যন্ত আগুনে থাকার’ হাদীসগুলো মুহাদ্দিসগণ মুগীরা ইবন শু’বা (রা) থেকে বর্ণনা করেন নি, বরং বিভিন্ন সহীহ সনদে আব্বাস (রা) ও আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আমরা বলেছি যে, দুজন সৎ মানুষের মধ্যে বিরোধিতা স্বাভাবিক। তবে একারণে কাউকে মিথ্যাচারে অভিযুক্ত করা যায় না। আলী (রা)-এর সাথে শত্রুতার কারণে অন্য কোনো সাহাবী মিথ্যা বলবেন এরূপ ধারণা করার অর্থ রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে একজন ব্যর্থ নবী বলে দাবি করা (নাউযু বিল্লাহ!)। কিন্তু শীয়াগণ এভাবে সাধারণ মানুষদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন।
সর্বোপরি, শীয়াগণের এ মতের বিষয়ে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারীরা যদি এরূপ বিদ্বেষ পোষণ করেই থাকতেন তবে হামযা, আব্বাস, আলী (রা) ও নবী বংশের অন্যান্যদের মর্যাদায় এত হাদীস তাঁরা কেন বর্ণনা করলেন? পিতামাতা, চাচা ও দাদা যদি সত্যই ইসলাম গ্রহণ করতেন তবে তাঁদের গল্প ও মর্যাদার কথা কি আরো বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করতো না?
(খ) শীয়াগণ প্রশ্ন করেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা, চাচা, দাদা ও তাঁর বংশের অন্যান্যদেরকে জাহান্নামী বানিয়ে আপনাদের কী লাভ? আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত বিষয়টিকে কুরআন ও হাদীসের কাছে আত্মসমর্পণ হিসেবে গণ্য করেন। তাঁরা বলেন: কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যগুলো মেনে নিলে আপনাদের কী ক্ষতি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রিয়জনদের প্রতি আবেগ ও ভালবাসা কোনো মুমিনেরই কম নেই। কিন্তু বিভিন্ন সহীহ হাদীস প্রমাণ করছে যে, তাঁরা ঈমান গ্রহণ না করে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর বিপরীতে একটিও সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য মুমিনকে আবেগ বিসর্জন দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশনার কাছে আত্মসমর্পন করতে হবে।
(গ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও চাচার কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার মতটিকে শীয়াগণ তাঁর সাথে চরম বেয়াদবি বলে গণ্য করেছেন। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পরবর্তী যুগের যে সকল আলিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার ঈমান গ্রহণের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন তাঁরাও এরূপ যুক্তি দিয়েছেন। এ যুক্তি গ্রহণ করলে প্রসিদ্ধ ইমাম ও আলিমগণের অনেককেই বেয়াদব বলে গণ্য করতে হয়। তবে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত আদব ও বেয়াদবির ক্ষেত্রেও কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণকেই সর্বোচ্চ স্থান প্রদান করেছেন। তাঁদের মতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সকল মত ও বক্তব্য নির্বিচারে গ্রহণ করাই মূলত আদব এবং তাঁর কোনো বক্তব্য, মত বা শিক্ষা অমান্য করাই তাঁর সাথে বেয়াদবি। মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ
وَرَسُولِهِ
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সম্মুখে অগ্রবর্তী হয়ো না।’’[9]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ
أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘‘যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’’[10]
এজন্য মনের আবেগ যেদিকেই ধাবিত হোক না কেন দীনের সকল বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা বিনা বাক্যে মেনে নিতে হবে। আর এটিই দীনের আদব।
[1] সূরা (৯) তাওবা: ১১৩ আয়াত।
[2] সূরা (২৮) কাসাস: ৫৬ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৪০৮ (কিতাবু ফাদাইলিস সাহাবা, বাবু কিস্সাতি আবী তালিব)
[4] বুখারী, ৩/১৪০৮, নং ৩৬৭০ (কিতাবু ফাদাইলিস সাহাবা, বাবু কিস্সাতি আবী তালিব); মুসলিম ১/১৯৫ (কিতাবুল ঈমান, বাব (৯০) শাফাআতিন নাবিয়্যি লি আবি তালিব...)
[5] বুখারী, ৩/১৪০৯, ৫/২৪০০, মুসলিম ১/১৯৫-১৯৬ (কিতাবুল ঈমান, বাব আহওয়নি আহলিন্নার)
[6] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৩/২১১, নং ৩২১৪; নাসায়ী, আস-সুনান ৪/৭৯, নং ২০০৬।
[7] ইবন আবিল হাদীদ, শারহ নাহজিল বালাগা (কাইরো, দার এহইয়ায়িল কুতুবিল আরাবিয়্যা: ঈসা বাবী হালাবী) ১৪/৬৭।
[8] ইবন আবিল হাদীদ, শারহ নাহজিল বালাগা ১৪/৭০।
[9] সূরা (৪৯) হুজুরাত: ১ আয়াত।
[10] সূরা (২৪) নূর: ৬৩ আয়াত।
৬. ৪. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুত্রগণ
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুত্রগণের নাম ও সংখ্যার বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কিছু মতভেদ আছে। কাসিম এবং ইবরাহীম-এ দু পুত্রের কথা অনেক সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এদের বিষয়ে সকল ঐতিহাসিক একমত। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও সীরাত লেখক তাইয়িব, তাহির, আব্দুল্লাহ, মুতাইয়াব ও মুতাহ্হার নামে আরো ৫ পুত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে তাইয়িব ও তাহিরের নাম প্রসিদ্ধ। এ সকল বর্ণনামতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সন্তানদের সংখ্যা ৭ পুত্র ও ৪ কন্যা মোট ১১ জন।
ইবরাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সকল সন্তানের মাতা খাদীজাতুল কুবরা (রা)। কাসিম, তাহির ও অন্যান্য পুত্র মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং শিশু বয়সেই মৃত্যু বরণ করেন। প্রথম পুত্র কাসিম নুবওয়াতের পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। দু বছর বা তার কম বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। কাসিমের নাম অনুসারে আরবীয় নিয়মে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘আবুল কাসিম’ অর্থাৎ ‘কাসিমের আববা’ কুনিয়াত বা উপনামে ডাকা হতো। অন্যান্য পুত্রের জন্ম ও ওফাত সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দাসী-স্ত্রী মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভে মদীনায় তাঁর কনিষ্ট পুত্র ইবরাহীম জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৮ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭ বা ১৮ মাস বয়সে ১০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ওয়াকিদী উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ১০ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ১০ তারিখ মঙ্গলবার ইন্তেকাল করেন।
৬. ৫. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যাগণ
হাদীস ও সাহাবীগণের বক্তব্যের আলোকে ঐতিহাসিকগণ একমত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ৪ কন্যা ছিলেন: যাইনাব (রা), রুকাইয়া (রা), উম্মু কুলসূম (রা) ও ফাতিমা (রা)। তাঁরা নুবুওয়াতের পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন, নুবুওয়াতের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মদীনায় হিজরত করেন এবং মদীনায় ইন্তেকাল করেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জ্যেষ্ঠা কন্যা যাইনাব (রা)। তিনি নবুওয়াতের বছর দশেক আগে জন্মগ্রহণ করেন। খালাত ভাই ‘‘আবুল আস ইবনুর রাবীয়’’-এর সাথে মক্কায় তাঁর বিবাহ হয়। যাইনাব ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদীনায় হিজরত করেন। তাঁর স্বামী আবুল আস কাফির অবস্থায় মক্কায় থেকে যান। মক্কা বিজয়ের পূর্বে তিনি মদীনায় যেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং উভয়ে মদীনায় দাম্পত্য জীবন অব্যাহত রাখেন। যায়নাব (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় ৮ হিজরী সালে- প্রায় ৩৩ বৎসর বয়সে- মদীনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর স্বামী আবুল আস রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পরের বৎসর ১২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
যায়নাব (রা) আলী নামে এক পুত্র এবং উমামা নামে এক কন্যা জন্মদান করেন। পুত্র আলী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় মক্কা বিজয়ের পরে ইন্তেকাল করেন। মক্কা বিজয়ের সময় আলী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উটের পিঠে তাঁর পিছনে বসে ছিলেন। কন্যা উমামাকেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অত্যন্ত আদর করতেন। বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি উমামাকে কাঁধে নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করেন। সাজদার সময় তাকে নামিয়ে রাখতেন এবং সাজদা থেকে উঠলে আবার ঘাড়ে নিতেন। ফাতিমার (রা) ওফাতের পরে আলী (রা) উমামাকে বিবাহ করেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দ্বিতীয়া কন্যা রুকাইয়া (রা)। নুবুওয়াতের ৭ বৎসর পূর্বে তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। মক্কায় আবূ লাহাবের পুত্র উতবার সাথে তাঁর বিবাহ হয়। যখন সূরা আবূ লাহাব নাযিল হয় তখন ক্রুদ্ধ আবূ লাহাবের নির্দেশে উতবা তাঁকে তালাক দেন। এরপর উসমান (রা)-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। উসমানের সাথে তিনি ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন। এরপর তিনি মদীনায় হিজরত করেন। দ্বিতীয় হিজরী সালে বদর যুদ্ধের সময়ে তিনি মদীনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বদরে ছিলেন। তাঁর অসুস্থতার কারণেই উসমান বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি। ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স ছিল প্রায় ২২/২৩ বৎসর। রুকাইয়ার গর্ভে উসমান (রা)-এর আব্দুল্লাহ নামে একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। বছর ছয়েক বা তার কম বয়সে এ পুত্র মৃত্যুবরণ করে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তৃতীয়া কন্যা উম্মু কুলসূম (রা)। নবুওয়াতের কয়েক বৎসর পূর্বে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মক্কায় আবূ লাহাবের অন্য পুত্র উতাইবার সাথে তার বিবাহ হয় এবং দাম্পত্য জীবন শুরুর আগেই উতাইবা তাঁকে পরিত্যাগ করে। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে হিজরত করেন। রুকাইয়া (রা)-এর ইন্তেকালের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মু কুলসূমকে উসমান (রা)-এর সাথে বিবাহ দেন। ৩ হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসে উসমানের সাথে তাঁর বিবাহ হয় বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। ৯ হিজরী সালে প্রায় ২৭/২৮ বৎসর বয়সে মদীনায় তাঁর ওফাত হয়। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কনিষ্ঠা কন্যা ফাতিমা (রা)। তিনি নুবুওয়াতের কয়েক বৎসর আগে বা নুবুওয়াত লাভের পরের বৎসর জন্মগ্রহণ করেন। হিজরতের পরে দ্বিতীয় (অথবা তৃতীয়) হিজরী সালে আলী (রা)-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। হাসান, হুসাইন ও মুহসিন নামে তিন পুত্র ও যাইনাব, উম্মু কুলসূম ও রুকাইয়া নামে তিন কন্যা সন্তান তাঁরা লাভ করেন। মুহসিন জন্মসময়ে মৃত্যুবরণ করেন। হাসান, হুসাইন, উম্মু কুলসূম ও যাইনাব পরিণত বয়সে বিবাহশাদি করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশধর বলতে তাঁদের সন্তানদেরকেই বুঝানো হয়। ১১শ হিজরী সালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের ৬ মাস পরে ২৪/২৫ বৎসর বয়সে ফাতিমা (রা) ইন্তেকাল করেন।[1]
[1] মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ শামী, সুবুলুল হুদা (সীরাহ শামিয়্যাহ) ১১/১৬-৭১; মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৮৪-১৮৮।
৭. তাওহীদের অজানা বিষয়ে করণীয়
এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘যদি কোনো মানুষের কাছে ‘ইলমুত তাওহীদ’ বা আকীদার খুঁটিনাটি বিষয়ের সুক্ষ্ম তথ্য অস্পষ্ট হয়ে পড়ে তবে তার দায়িত্ব এই যে, তৎক্ষণাৎ এ বিষয়ে আল্লাহর নিকট যা সঠিক তাই আমার বিশ্বাস-এরূপ বিশ্বাস পোষণ করবে। এরপর যথাশীঘ্র সম্ভব কোনো আলিমকে জিজ্ঞাসা করে সঠিক তথ্য জেনে নিবে। সঠিক তথ্য জানার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দেরি করা তার জন্য বৈধ নয়। এরূপ বিষয়ে ‘দাঁড়িয়ে থাকা’ বা ‘বিরত থাকা’, অর্থাৎ ‘জানিও না এবং জানবও না বলে থেমে থাকা’, বা ‘কিছুই জানি না কাজেই কিছুই বিশ্বাস করব না’ এরূপ কথা বলা তার জন্য কোনো ওযর বলে গৃহীত হবে না। কেউ যদি এরূপ দাঁড়িয়ে থাকে বা বিরত থাকে তবে তা কুফরী বলে গণ্য হবে।’’
আমরা দেখেছি যে, প্রথম যুগে ইলমুল আকীদাকে ‘‘ইলমুত তাওহীদ’’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। শিরক-কুফর থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য তাওহীদের ইলম বিশদভাবে অর্জন করা মুমিনের জীবনের প্রধান ফরয দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন:
فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ
‘‘কাজেই জান (জ্ঞানার্জন করা) যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ্ নেই।’’[1]
তাহলে ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই’’- তাওহীদুল ইবাদাতের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা মুমিনের জীবনের প্রথম ও প্রধান ফরয দায়িত্ব। স্বভাবতই এ জ্ঞান অর্জন করতে হবে ‘ওহী’ অর্থাৎ কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য পাঠ ও অনুধাবনের মাধ্যমে। তাওহীদের মৌলিক কোনো বিষয় কোনো মুমিনের অজানা থাকতে পারে না। তবে খুঁটিনাটি সুক্ষ্ম কোনো বিষয় হয়ত কারো অজানা থাকতে পারে। উপরের বক্তব্য এরূপ বিষয়ে মুমিনের করণীয় উল্লেখ করেছেন ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)।
আকীদার খুঁটিনাটি সুক্ষ্ম কোনো বিষয় মুমিনের অজানা থাকলে ‘‘আল্লাহর কাছে যেটি সঠিক আমি তাই বিশ্বাস করি’’ বলে দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করতে হবে। অনুমান বা অজ্ঞতার উপর নির্ভর করে তর্ক-বিতর্কে না জড়িয়ে কুরআন-হাদীস নির্দেশিত সত্য সর্বান্তকরণে গ্রহণ করার প্রেরণা-সহ মুমিন ঘোষণা দিবেন যে, এ বিষয়ে আল্লাহর কাছে যা সঠিক তাই আমার বিশ্বাস।
পাশাপাশি কুরআন-হাদীস এ বিষয়ে কী বলে তা জানার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। প্রাজ্ঞ আলিমগণের কাছে প্রশ্ন করে বা তাঁদের লেখা পাঠ করে সে বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। জানার বিষয়ে অবহেলা অমার্জনীয় অপরাধ। কারণ তা দুটো বিষয় নির্দেশ করে: (১) বিশুদ্ধ ঈমানী জ্ঞান অর্জনে অবজ্ঞা এবং (২) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঈমানের অনুপস্থিতি। এ বিষয়দুটো কুফর-এর নামান্তর।
তাওহীদের বিষয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জনে অবহেলার আরেকটি দিক কুরআন-সুন্নাহের নির্দেশনা অনুসন্ধান ও গ্রহণ না করে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), তাঁর সাথীগণ ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম তাহাবী বলেন:
وَلا نَخُوضُ فِي اللَّهِ، وَلا نُمَارِي فِي دِينِ اللَّهِ، وَلا نُجَادِلُ فِي
الْقُرْآنِ.
‘‘আমরা আল্লাহর বিষয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হই না। আমরা আল্লাহর দীন নিয়ে বিতর্ক করি না, এবং আমরা কুরআন নিয়ে তর্ক-ঝগড়া করি না।’’[2]
বস্ত্তত তাওহীদ ও আকীদার ভিত্তি ওহীর জ্ঞানের নিকট আত্মসমর্পণ। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যা বলেছেন তাই বলা, তাঁরা যা বলেন নি তা না বলা এবং ওহীর অতিরিক্ত কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা বা সমালোচনায় লিপ্ত না হওয়া আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূল বৈশিষ্ট্য।
কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে মুমিনের দায়িত্ব জ্ঞান সন্ধান করা। জ্ঞান সন্ধানে মুমিনের নিজের কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকে না। তিনি ওহী ও সত্য অনুসন্ধান করেন এবং সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি আলোচনা করেন কিন্তু বিতর্ক করেন না। আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যে পার্থক্য খুবই সুস্পষ্ট। আলোচনাকারী নিজের জ্ঞানের অপূর্ণতার বিষয়ে সচেতন। তিনি সত্য জানতে চান। তিনি প্রশ্ন করেন। উত্তরে তার তৃপ্তি না হলে পুনরায় প্রশ্ন করেন, আলোচনা করেন বা অন্যান্য আলিমের সাথে আলোচনা করেন। সকল ক্ষেত্রে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ওহীর নির্দেশনা সঠিকভাবে জানা।
পক্ষান্তরে বিতর্ককারী নিজের জ্ঞান বা মতকে চূড়ান্ত সত্য বলে গণ্য করে তাকে বিজয়ী করতে ও বিপক্ষের মতকে বাতিল প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। বিতর্কের মধ্যে ‘‘নফসানিয়্যাত’’ বা প্রবৃতির অনুসরণ ও আত্মগরিমা থাকে, আল্লাহর জন্য সত্য অনুসন্ধানের প্রেরণা থাকে না। বিতর্কে পরাজিত হলেও মানুষ সত্য গ্রহণ করে না, বরং পরাজয়কে অস্বীকারের জন্য বা পরাজয়ের গ্লানি মুছার জন্য চেষ্টা করে। দীন নিয়ে বিতর্ক বিভ্রান্ত ও বিদআতী গোষ্ঠীগুলোর বৈশিষ্ট্য। পক্ষান্তরে ‘আহলুস সুন্নাত’ আন্তরিক ভালবাসা ও সত্যসন্ধানের আগ্রহ-সহ আলোচনা করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَا ضَلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدًى كَانُوا عَلَيْهِ إِلا أُوتُوا الْجَدَلَ
‘‘কোনো জাতি হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়ার পরে বিভ্রান্ত হওয়ার একটিই কারণ তা হলো তারা ঝগড়া-বিতর্কে লিপ্ত হয়।’’[3]
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
مَنْ تَرَكَ الْمِِرَاءَ وَهُوَ مُبْطِلٌ، بُنِيَ لَهُ بَيْتٌ فِيْ رَبَضِ
الْجَنَّةِ، وَمَنْ تَرَكَهُ وَهُوَ مُحِقٌّ بُنِيَ لَهُ فِيْ وَسَطِهَا، وَمَنْ
حَسُنَ خُلُقُهُ بُنِيَ لَهُ فِيْ أَعْلاَهَا
‘‘নিজের মত ভুল বুঝতে পেরে যে বিতর্ক পরিত্যাগ করবে তার জন্য জান্নাতের পাদদেশে বাড়ি নির্মাণ করা হবে। আর যে ব্যক্তি নিজের মত সঠিক হওয়া সত্ত্বেও বিতর্ক পরিত্যাগ করবে তার জন্য জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে বাড়ি নির্মাণ করা হবে। আর যার আচরণ সুন্দর তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে বাড়ি নির্মাণ করা হবে।’’[4]
[1] সূরা (৪৭) মুহাম্মাদ: ১৯ আয়াত।
[2] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৩।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৩৭৮ (কিতাবু তাফসীরিল কুরআন, বাব ৪৪ ওয়া মিন সূরাতিয যুখরুফ)। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।
[4] হাদীসটি সহীহ। মুনযিরী, আত-তারগীব ১/৭৭; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১৩২।
৮. মিরাজ
এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) মিরাজ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন: ‘‘মি’রাজের সংবাদ সত্য। যে তা প্রত্যাখ্যান করে সে বিদ‘আতী ও বিভ্রান্ত।’’
মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূল ﷺ-কে যত মুজিযা দিয়েছেন সেগুলোর অন্যতম ইসরা ও মি’রাজ। ‘‘ইসরা’’ অর্থ ‘নৈশ-ভ্রমণ’ বা ‘রাত্রিকালে ভ্রমণ করানো’। আর ‘মি’রাজ’ অর্থ ‘ঊর্ধ্বারোহণ’ বা ‘উর্ধারোহণের যন্ত্র’। মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এক রাত্রিতে মক্কার ‘আল-মাসজিদুল হারাম’ থেকে ফিলিস্তিনের ‘আল-মাসজিদুল আকসা’ পর্যন্ত নিয়ে যান। এরপর সেখান থেকে ঊর্ধ্বে ৭ আসমান ভেদ করে তাঁর নৈকট্যে নিয়ে যান। ‘আল-মাসজিদুল হারাম’ থেকে আল-মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে ‘‘ইসরা’’ এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বে গমনকে মি’রাজ বলা হয়। সাধারণভাবে ‘ইসরা’ ও ‘মি’রাজ’ উভয় বিষয়কে একত্রে ‘‘মি’রাজ’’ বলা হয়।
৮. ১. কুরআন মাজীদে ইসরা ও মিরাজ
মিরাজ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের অত্যতম ঘটনা। কুরআনে একাধিক স্থানে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। ‘ইসরা’ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى
الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آَيَاتِنَا
‘‘পবিত্র তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য।’’[1]
এ আয়াত ও বহুসংখ্যক সহীহ হাদীস প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ‘ইসরা’ ও ‘মিরাজ’-এ গমন করেন। কারণ ‘বান্দা’ বলতে আত্মা ও দেহের সমন্বিত মানুষকেই বুঝানো হয়। কুরআনে বান্দা বলতে ‘দেহ ও আত্মা’ সমন্বিত মানুষকেই বুঝানো হয়েছে, শুধু আত্মাকে ‘বান্দা’ বলা হয় নি।[2]
‘‘মি’রাজ’’ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى وَلَقَدْ رَآَهُ نَزْلَةً أُخْرَى عِنْدَ
سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا
يَغْشَى مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى لَقَدْ رَأَى مِنْ آَيَاتِ رَبِّهِ
الْكُبْرَى
‘‘সে (মুহাম্মাদ (ﷺ)) যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে তার সাথে বিতর্ক করবে? নিশ্বয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহা-র (প্রান্তবর্তী বদরী বৃক্ষের) নিকট। যার নিকট অবস্থিত জান্নাতুল মা‘ওয়া। যখন বৃক্ষটি যদ্বারা আচ্ছাদিত হবার তদ্বারা ছিল আচ্ছাদিত। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয় নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয় নি। সে তো তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলি দেখেছিল।’’[3]
এ আয়াতও প্রমাণ করে যে, তিনি সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় সিদরাতুল মুনতাহার নিকট আল্লাহর মহান এ সকল নিদর্শন দেখেছিলেন। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মূলধারার আলিমগণ একমত। তবে সিদরাতুল মুনতাহার নিকট তিনি কাকে দেখেছিলেন? মহান আল্লাহকে? না জিবরাঈল (আ)-কে? এ বিষয়ে সাহাবীগণের যুগ থেকে মতভেদ রয়েছে। সূরা নাজমের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর অন্তর দিয়ে দুবার তাঁর রববকে দেখেছিলেন। এ মতের অনুসারী সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, মহান আল্লাহ মূসা (আ)-কে তাঁর সাথে কথা বলার মুজিযা দিয়েছিলেন এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-তে তাঁর দর্শনের মুজিযা দিয়েছিলেন।
পক্ষান্তরে আয়েশা (রা) ও অন্যান্য সাহাবী বলেছেন যে, তিনি আল্লাহকে দেখেন নি, জিবরাঈলকে (আ) দেখেছিলেন। ইমাম বুখারী সংকলিত হাদীসে প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাসরূক বলেন: ‘‘আমি আয়েশা (রা)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। তিনি বলেন, হে আবূ আয়েশা (মাসরূক), তিনটি কথার যে কোনো একটি কথা যদি কেউ বলে তবে সে আল্লাহ নামে জঘন্য মিথা বলার অপরাধে অপরাধী হবে। আমি বললাম: সে কথাগুলো কী কী? তিনি বলেন, যদি কেউ মনে করে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর প্রতিপালককে (আল্লাহকে) দেখেছিলেন তবে সে আল্লাহর নামে জঘন্য মিথ্যচারী বলে গণ্য হবে। মাসরূক বলেন, আমি তখন হেলান দিয়ে ছিলাম। তাঁর কথায় আমি উঠে বসলাম এবং বললাম: হে মুমিনগণের মাতা, আপনি আমাকে একটু কথা বলতে দিন, আমার আগেই আপনার বক্তব্য শেষ করবেন না। আল্লাহ কি বলেন নি[4]: ‘‘সে তো তাকে স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছিল’’, ‘‘নিশ্চয় তাকে সে আরেকবার দেখেছিল’’?
আয়েশা (রা) বলেন: এ উম্মাতের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যে এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করেছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তরে বলেন: ‘‘এ হলো জিবরীলের কথা। আল্লাহ তাঁকে যে আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন আমি দুবার ছাড়া আর কখনো তাঁকে তাঁর সে প্রকৃত আকৃতিতে দেখি নি। আমি দেখলাম তিনি আকাশ থেকে নেমে আসছেন। তাঁর আকৃতির বিশালত্ব আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী সবকিছু অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে।’’ আয়েশা বলেন: তুমি কি আল্লাহকে বলতে শোন নি[5]: ‘‘তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত; এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক পরিজ্ঞাত’’? তুমি কি আল্লাহকে বলতে শোন নি[6]: ‘‘কোনো মানুষের জন্যই সম্ভব নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে, অথবা এমন দূত প্রেরণ করবেন যে দূত তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করবে, তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়’’?’’[7]
[1] সূরা (১৭) ইসরা (বনী ইসরাঈল): ১ আয়াত।
[2] সূরা (৯৬) আলাক: ৯-১০ আয়াত; সূরা (৭২) জিন্ন: ১৯ আয়াত।
[3] সূরা (৫৩) নাজ্ম: ১২-১৮ আয়াত।
[4] সূরা (৮১) তাকবীর: ২৩ আয়াত ও সূরা (৫৩) নাজম: ১৩ আয়াত।
[5] সূরা (৬) আন‘আম: ১০৩ আয়াত।
[6] সূরা (৪২) শূরা: ৫১ আয়াত।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৮৪০ (কিতাবুত তাফসীর, বাবু তাফসীর সূরাতিন নাজম); মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫৯-১৬১ (কিতাবুল ঈমান, বাবু মা’না কাওলিহি তাআলা: ওয়ালাকাদ রাআহু...); তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৬২ (কিতাবুত তাফসীর, বাবু ৭ ওয়া মিন সূরাতিল আনআম); ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৩১৩, ৮/৬০৬।
৮. ২. মিরাজের তারিখ
ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা বিস্তারিতভাবে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। হাদীস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থে প্রায় ৪০ জন সাহাবী সহীহ বা যয়ীফ সনদে মিরাজের ঘটনার বিভিন্ন দিক ছোট বা বড় আকারে বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীসে মিরাজের বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হয়েছে। কোনো হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে মি’রাজের তারিখ সম্পর্কে একটি কথাও বর্ণিত হয় নি। ফলে তারিখের বিষয়ে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। মি’রাজ একবার না একাধিকবার সংঘঠিত হয়েছে, কোন্ বৎসর হয়েছে, কোন্ মাসে হয়েছে, কোন্ তারিখে হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে প্রায় ২০টি মত রয়েছে। কারো মতে যুলকাদ মাসে, কারো মতে রবিউস সানী মাসে, কারো মতে রজব মাসের এক তারিখে, কারো মতে রজব মাসের প্রথম শুক্রবারে বা রজব মাসের ২৭ তারিখে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। ইমাম নববী, ইবনুল আসীর, ইবন হাজার আসকালানী ও অন্যান্য অনেকেই বলেছেন যে, রবিউল আউয়াল মাসে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে আবার তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন এ মাসের ১২ তারিখে এবং কেউ বলেছেন এ মাসের ২৭ তারিখে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল।[1]
[1] মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামী, সুবুলুল হুদা (সীরাহ শামিয়্যাহ) ৩/৬৪-৬৬। আরো দেখুন ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/৪৭০-৪৮০; কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ ২/৩৩৯-৩৯৮; খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি,. পৃ.৩৫০-৩৫৫, ৫৩০-৫৩১।
৮. ৩. মিরাজের বিবরণ
এ সকল হাদীসে বর্ণিত ইসরা ও মিরাজের সার-সংক্ষেপ এই যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাবা ঘরের নিকট শুয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় জিবরাঈল (আ) কয়েকজন ফিরিশতা সহ তথায় আগমন করেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্ষের উপরিভাগ থেকে পেট পর্যন্ত কেটে তাঁর হৃৎপিন্ড বের করেন, তা ধৌত করেন এবং বক্ষকে ঈমান, হিকমাত ও প্রজ্ঞা দ্বারা পরিপূর্ণ করেন এবং তাঁর হৃৎপিন্ডকে পুনরায় বক্ষের মধ্যে স্থাপন করেন। এরপর ‘‘বুরাক’’ নামে আলোর গতি সম্পন্ন একটি বাহন তাঁর নিকট আনয়ন করা হয়। তিনি এ বাহনে বাইতুল মাকদিস বা জেরুজালেমে গমন করেন। মহান আল্লাহ তথায় পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলকে সমবেত করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইমামতিতে তাঁরা তথায় দু রাক‘আত সালাত আদায় করেন। এরপর ‘‘মি’রাজ’’ বা ‘‘ঊর্ধ্বারোহণ যন্ত্র’’ আনয়ন করা হয়। তিনি মি’রাজে উঠে ঊর্ধ্বে গমন করেন এবং একে একে সাত আসমান অতিক্রম করেন। বিভিন্ন আসমানে বিভিন্ন নবী-রাসূলের সাথে তাঁর সাক্ষাত, সালাম ও দুআ বিনিময় হয়। এরপর তিনি সৃষ্টিজগতের শেষ প্রান্ত ‘‘সিদরাতুল মুনতাহা’’ গমন করেন। তথা থেকে তিনি জান্নাত, জাহান্নাম ও মহান আল্লাহর অন্যান্য মহান সৃষ্টি পরিদর্শন করেন ও তাঁর মহান সান্নিধ্য লাভ করেন। মহান আল্লাহ তাঁর উম্মাতের জন্য দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত সালাতের বিধান প্রদান করেন। পরে তা সংক্ষিপ্ত করে ৫ ওয়াক্তের বিধান দেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিরাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। মিরাজে গমন ও প্রত্যাবর্তনের সময় এবং জান্নাত-জাহান্নামে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বিভিন্ন পাপ ও পুণ্যের বিভিন্ন প্রকার শাস্তি ও পুরস্কার দেখানো হয়।[1]
মুতাযিলা ও অন্যান্য কতিপয় ফিরকা বিজ্ঞান বা যুক্তির নামে ‘মিরাজ’ অস্বীকার করেছে বা ব্যাখ্যা করেছে। এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি এ বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত সকল বিষয় সরল ও স্বাভাবিক অর্থে বিশ্বাস করা। এগুলিকে অবিশ্বাস করা বা ব্যাখ্যার নামে সরল অর্থ অস্বীকার করা বিভ্রান্তি। যেহেতু ইসরা বা নৈশভ্রমণের কথা কুরআন কারীমে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সেহেতু তা অস্বীকার করা কুফর বলে গণ্য। আর মিরাজ বা ঊর্ধ্বভ্রমণের বিষয়টি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয়গুলি অস্বীকার করলে তাকে বিভ্রান্ত ও বিদআতী বলে গণ্য করা হবে, কাফির বলে গণ্য করা হবে না। হানাফী ফকীহগণ বলেছেন:
وَمَنْ أَنْكَرَ الْمِعْرَاجَ يُنْظَرُ إنْ أَنْكَرَ الإِسْرَاءَ من مَكَّةَ إلَى
بَيْتِ الْمَقْدِسِ فَهُوَ كَافِرٌ وَإِنْ أَنْكَرَ الْمِعْرَاجَ من بَيْتِ
الْمَقْدِسِ لا يَكْفُرُ
‘‘যদি কেউ মি’রাজ অস্বীকার করে তবে দেখতে হবে সে কী অস্বীকার করছে। সে যদি মক্কা থেকে বাইতুল মাকদিস পর্যন্ত নৈশযাত্রা বা ইসরা অস্বীকার করে তবে সে কাফির। আর যদি বাইতুল মাকদিস থেকে মিরাজ বা ঊর্ধ্বগমন অস্বীকার করে তবে কাফির হবে না।’’[2]
এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্য আমরা দেখেছি। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:
وَالْمِعْرَاجُ حَقٌّ، وَقَدْ أُسْرِيَ بِالنَّبِيِّ ﷺ، وَعُرِجَ بِشَخْصِهِ فِي
الْيَقَظَةِ إِلَى السَّمَاءِ، ثُمَّ إِلَى حَيْثُ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الْعُلا،
وَأَكْرَمَهُ اللَّهُ بِمَا شَاءَ، وَأَوْحَى إِلَيْهِ مَا أَوْحَى "مَا
كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى"
‘‘মি’রাজের ঘটনা সত্য। নবী (ﷺ)-কে রাত্রে ভ্রমণ করানো হয়েছে। তাঁকে জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে প্রথমে আকাশে উঠানো হয়, পরে ঊর্ধ্ব জগতের যেখানে আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছা ছিল সেখানে নেওয়া হয়। তথায়, আল্লাহ্ পাক যা ইচ্ছা ছিল তা দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেন এবং তাঁর প্রতি যে বার্তা দেওয়ার ছিল তা প্রদান করেন। ‘‘যা সে দেখেছে সে বিষয়ে অন্তর মিথ্যা বলে নি[3]।’’[4]
[1] মিরাজ বিষয়ক ‘সিহাহ-সিত্তার’’ হাদীসগুলি একত্রে দেখুন: ইবনুল আসীর, জামিউল উসূল ১১/২৯২-৩১০। মি’রাজ বিষয়ক হাদীসগুলির একত্র সংকলন ও সনদ বিষয়ক আলোচনার জন্য দেখুন: মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী, আল-ইসরা ওয়াল মিরাজ; মুহাম্মাদ ইবনু রিযক ইবনু তুরহূনী, আল-ইসরা ওয়াল মি’রাজ। আরো দেখুন: ইমাম সুয়ূতী, আল-ইসরা ওয়াল মি’রাজ)।
[2] আল-ফাতাওয়া হিনদিয়্যাহ ১/৮৪। আরো দেখুন: ইবন নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক ৩/৩৯৯; যাইলায়ী, তাবয়ীনুল হাকাইক ২/১৬০; ইবনুল হুমাম, শারহু ফাতহিল কাদীর ১/৩৫০।
[3] সূরা (৫৩) নাজম: ১১ আয়াত।
[4] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১০-১১।
৮. ৪. মিরাজ বিষয়ক জাল ও ভিত্তিহীন ধারণা
ইসলামের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মি’রাজ বিষয়েও দ্বিবিধ বিভ্রান্তি বিদ্যমান। একদিকে খারিজী, মু’তাযিলী ও সমমনা গোষ্ঠীগুলো যুক্তি, বিজ্ঞান বা দর্শনের নামে কুরআন মাজীদ ও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত ও বর্ণিত ঘটনাবলি অস্বীকার করেছে এবং ব্যাখ্যার নামে প্রকাশ্য অর্থ বাতিল করেছে। অপরদিকে শীয়াগণ এবং সুন্নী সমাজের শীয়া প্রভাবিত অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এ বিষয়ে অনেক জাল ও বানোয়াট কাহিনী প্রচার করেছে। তারা এ বিষয়ক কুরআন মাজীদ ও সহীহ হাদীসে বিধৃত বিষয়গুলোর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেন না। বরং তাদের প্রচারিত জাল ও বানোয়াট কাহিনীগুলোকেই ‘‘মিরাজ’’-এর মূল বিষয় বলে বিশ্বাস ও প্রচার করে।
জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থগুলোতে আমরা মিরাজ বিষয়ক অনেক জাল হাদীস দেখতে পাই। মিরাজের রাত্রিতে জান্নাতের সকল স্থানে ফাতিমা (রা), আলী (রা) ও তাঁর পরিবারের ‘পাক পাঞ্জাতনের’ নাম দেখা, তাদের ইমামতের সাক্ষ্য দেখা ইত্যাদি বিষয় এ সকল হাদীসের প্রতিপাদ্য। এ জাতীয় কিছু জাল হাদীস রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আরশে আরোহণ কেন্দ্রিক।
কুরআনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সিদরাতুল মুনতাহার নিকট আল্লাহর মহান নিদর্শনাবলির দর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে আরশে গমনের কথা উল্লেখ করা হয় নি। সিহাহ সিত্তা ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থের হাদীসগুলোতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিরাজের রাত্রিতে আরশে গমন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয় নি। রাফরাফে চড়া, আরশে গমন করা ইত্যাদি কোনো কথা সিহাহ সিত্তা, মুসনাদে আহমদ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ কোনো হাদীস-গ্রন্থে সংকলিত কোনো হাদীসে নেই। ৫/৬ শতাব্দী পর্যন্ত সংকলিত ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থগুলোতেও এ বিয়য়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। দশম হিজরী শতাব্দী ও পরবর্তী যুগে সংকলিত সীরাতুন্নবী বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থে রাফরাফ-এ আরোহণ, আরশে গমন ইত্যাদি ঘটনা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী (১১২২ হি) ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্যিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে আল্লামা রাযী কাযবীনীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:
لَمْ يَرِدْ فِيْ حَدِيْثٍ صَحِيْحٍ وَلاَ حَسَنٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ جَاوَزَ
سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى، بَلْ ذُكِرَ فِيْهَا أَنَّهُ انْتَهَى إِلَى مُسْتَوًى
سَمِعَ فِيْهِ صَرِيْفَ الأَقْلاَمِ فَقَطْ. وَمَنْ ذَكَرَ أَنَّهُ جَاوَزَ ذَلِكَ
فَعَلَيْهِ الْبَيَانُ، وَأَنَّى لَهُ بِهِ! وَلَمْ يَرِدْ فِيْ خَبَرٍ ثَابِتٍ
وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ رَقِىَ الْعَرْشَ. وَافْتِرَاءُ بَعْضِهِمْ لاَ يُلْتَفَتُ
إِلَيْهِ.
‘‘কোনো একটি সহীহ, হাসান অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন। বরং বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তথায় এমন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন যে, কলমের খসখস শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। যিনি দাবি করবেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন তাকে তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। আর কিভাবে তিনি তা করবেন! একটি সহীহ অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি আরশে আরোহণ করেছিলেন। কেউ কেউ জালিয়াতি-মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। তাদের এরূপ মিথ্যাচারের প্রতি দৃকপাত করা যায় না।’’[1]
মিরাজ বিষয়ক এ জাতীয় জাল ও বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জুতা পায়ে আরশে আরোহণের গল্প, মিরাজের রাত্রিতে ‘‘আত-তাহিয়্যাতু’’ লাভ, মুহূর্তের মধ্যে মি’রাজের সকল ঘটনা সংঘটিত হওয়া ইত্যাদি।[2]
[1] যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩।
[2] বিস্তারিত দেখুন: খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি পৃ. ৩৫০-৩৫৫।
৯. কিয়ামাতের আলামাত / ৯. ১. কিয়ামাতের সময় ও আলামত
সর্বশেষ ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) কিয়ামতের কয়েকটি ‘আলামাত কুবরা’ বা ‘বড় চিহ্ন’ উল্লেখ করে বলেন: ‘‘দাজ্জালের বহির্গমন, ইয়াজূজ ও মাজূজের বহির্গমন, অস্তগমনের স্থান থেকে সূর্যের উদয় হওয়া, আকাশ থেকে ঈসা (আ)-এর অবতরণ এবং কিয়ামাতের অন্যান্য সকল পূর্বাভাস, যেভাবে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই সত্য এবং ঘটবেই। মহান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।’’
৯. ১. কিয়ামাতের সময় ও আলামত
কিয়ামাত (القيامة) শব্দটি (قام) ক্রিয়া থেকে গৃহীত। এর অর্থ দাঁড়ানো বা উত্থিত হওয়া। ইসলামী পরিভাষায় মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানকে কিয়ামাত বলা হয়। সাধারণত মহাপ্রলয় ও পুনরুত্থানকে একত্রে ‘কিয়ামত’ বলা হয়। অনেক সময় সামগ্রিকভাবে পরকালীন জীবনকে ‘কিয়ামাত’ বা ‘কিয়ামত দিবস’ বলা হয়। আমরা আগেই দেখেছি যে, আখিরাত ও কিয়ামাতের বিশ্বাস ঈমানের অন্যতম বিষয়। কিয়ামাতে বিশ্বাসের অন্যতম দিক যে এর সময় বা ক্ষণ আল্লাহ তাঁর কোনো সৃষ্টিকে জানান নি। কুরআনে বিষয়টি বারংবার বলা হয়েছে। একস্থানে আল্লাহ বলেন:
قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ وَمَا
يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ
‘‘বল, ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই গাইবের জ্ঞান রাখে না এবং তারা জানে না তারা কখন পুনরুত্থিত হবে।’’[1]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কিয়ামাত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:
مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنْ السَّائِلِ وَسَأُخْبِرُكَ عَنْ
أَشْرَاطِهَا إِذَا وَلَدَتْ الأَمَةُ رَبَّهَا وَإِذَا تَطَاوَلَ رُعَاةُ
الإِبِلِ الْبُهْمُ فِي الْبُنْيَانِ فِي خَمْسٍ لا يَعْلَمُهُنَّ إِلا اللَّهُ
ثُمَّ تَلا النَّبِيُّﷺ : إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ...الآيَةَ
‘‘প্রশ্নকারীর চেয়ে প্রশ্নকৃত ব্যক্তি এ বিষয়ে বেশি জানে না। আমি তোমাকে কিয়ামাতের আলামত বলব। যখন দাসী তার প্রভুকে জন্ম দেবে এবং যখন অবলা উটের রাখালগণ সুউচ্চ ইমারত-অট্টালিকা নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে। কিয়ামাতের জ্ঞান পাঁচটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করেন[2]: ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর কাছেই রয়েছে কিয়ামাতের জ্ঞান....’’[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে, কিয়ামাতের সময় আল্লাহ মানুষকে জানান নি, তবে কিয়ামাতের বিষয়ে কিছু পূর্বাভাস তিনি জানিয়েছেন। কুরআনে বলা হয়েছে:
فَهَلْ يَنْظُرُونَ إِلا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً فَقَدْ جَاءَ
أَشْرَاطُهَا فَأَنَّى لَهُمْ إِذَا جَاءَتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ
‘‘তারা কি কেবল এজন্য অপেক্ষা করছে যে, কিয়ামাত তাদের নিকট এসে পড়ুক আকস্মিকভাবে? কিয়ামাতের লক্ষণসমূহ তো এসেই পড়েছে! কিয়ামাত এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?’’[4]
কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলিমগণ কিছু বিষয়কে ‘আলামাত সুগরা’ (العلامات الصغرى) অর্থাৎ ‘ক্ষুদ্রতর ‘আলামত’ এবং কিছু বিষয়কে ‘আলামাত কুবরা’ (العلامات الكبرى) অর্থাৎ ‘বৃহত্তর ‘আলামত’ বা ‘বিশেষ আলামত’ বলে উল্লেখ করেছেন।
[1] সূরা (২৭) নামল: ৬৫ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৭) আ‘রাফ: ১৮৭; সূরা (৩১) লুকমান: ৩৪; সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৪৭; সূরা (৪৩) যুখরুফ: ৮৫; সূরা (৭৯) নাযি‘আত: ৪২-৪৫ আয়াত।
[2] সূরা (৩১) লুকমান: ৩৪ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭ (কিতাবুল ঈমান, বাবু সুআলি জিবরাঈলান নাবিয়্যা আনিল ঈমান); মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৯ (কিতাবুল ঈমান, বাবু বায়ানিল ঈমানি ওয়াল ইসলাম...)
[4] সূরা (৪৭) মুহাম্মাদ: ১৮ আয়াত।
৯. ২. আলামাত সুগরা
আমরা দেখলাম যে, কিয়ামাতের পূর্বাভাসসমূহ প্রকাশিত হয়েছে বলে কুরআনে বলা হয়েছে। এ সকল পূর্বাভাসের অন্যতম সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আগমন। সাহল ইবনু সাদ আস সায়িদী (রা) বলেন:
بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةَ كَهَذِهِ مِنْ هَذِهِ أَوْ كَهَاتَيْنِ وَقَرَنَ
بَيْنَ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর হাতের তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি একত্রিত করে বলেন: ‘‘আমি প্রেরিত হয়েছি কিয়ামাতের সাথে এভাবে পাশাপাশি।’’[1]
উপরের আলামতগুলো ছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে কিয়ামাতের আরো অনেক পূর্বাভাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিয়ামাতের পূর্বে আরব উপদ্বীপে নদনদী প্রবাহিত হবে এবং ক্ষেত-খামার ছড়িয়ে পড়বে। মক্কার বাড়িঘরগুলো মক্কার পাহাড়গুলো ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বে উঠে যাবে, মক্কার মাটির নিচে সুড়ঙ্গগুলো একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত হবে, পাহাড়গুলো স্থানচ্যুত হবে। ইরাকের ফুরাত নদীর তলদেশ থেকে স্বর্ণের পাহাড় প্রকাশিত হবে, যে জন্য ভয়ঙ্কর যুদ্ধবিগ্রহ ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হবে, অল্প সময়ে মানুষ অনেক সময়ের কাজ করবে, অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী হয়ে যাবে। তবে মানুষের বিশ্বাস ও ধার্মিকতা কমে যাবে, নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটবে, পাপ, অনাচার ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করবে, মিথ্যা ও ভন্ড নবীগণের আবির্ভাব ঘটবে, হত্যা, সন্ত্রাস, ও বৃহৎ পরিসরের যুদ্ধ হতে থাকবে। এ সকল ‘আলামাত’ বা পূর্বভাস প্রকাশের এক পর্যায়ে ‘বৃহৎ আলামতগুলো’ প্রকাশিত হবে।[2]
[1] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৮৮১ (কিতাবুত তাফসীর, বাবু তাফসীরি সূরাতিন নাযিআত); মুসলিম, আস-সহীহ ২/৫৯২ (কিতাবুল জুমুআহ, বাবু তাখফীফিস সালাতি ওয়াল খুতবা)
[2] বিস্তারিত দেখন: ড. উরাইফী, মুহাম্মাদ ইবন আব্দুর রাহমান, নিহায়াতুল আলাম।
৯. ৩. আলামাতে কুবরা
হুযাইফা ইবনু আসীদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরাফাতের মাঠে (বিদায় হজ্জের সময়ে) অবস্থান করছিলেন। আমরা তাঁর থেকে নিচু স্থানে অবস্থান করছিলাম। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমরা কি আলোচনা করছ? আমরা বললাম: কিয়ামাতের আলোচনা করছি। তিনি বলেন:
إِنَّ السَّاعَةَ لا تَكُونُ حَتَّى تَكُونَ عَشْرُ آيَاتٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ
وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَالدُّخَانُ
وَالدَّجَّالُ وَدَابَّةُ الأَرْضِ وَيَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَطُلُوعُ الشَّمْسِ
مِنْ مَغْرِبِهَا وَنَارٌ تَخْرُجُ مِنْ قُعْرَةِ عَدَنٍ تَرْحَلُ النَّاسَ،
ونُزُولُ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ...
‘‘দশটি আয়াত বা নিদর্শন না ঘটা পর্যন্ত কিয়ামাত হবে না: (১) পূর্ব দিকে ভূমিধ্বস (ভূপৃষ্ঠ যমীনের মধ্যে ডুবে যাওয়া), (২) পশ্চিমদিকে ভূমিধ্বস, (৩) আরব উপদ্বীপে ভূমিধ্বস, (৪) ধুম্র, (৫) দাজ্জাল, (৬) ভূমির প্রাণী, (৭) ইয়াজূজ-মাজূজ, (৮) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, (৯) এডেনের ভূগর্ভ থেকে অগ্নি নির্গত হয়ে মানুষদেরকে তাড়িয়ে নেওয়া এবং (১০) মরিয়ম-পুত্র ঈসা (আ)-এর অবতরণ।’’[1]
এ সকল আলামতের বিস্তারিত বর্ণনায় অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত। কুরআন কারীমে কোনো আলামতের বিষয়ে ইঙ্গিত বা উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِنَ الأَرْضِ
تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآَيَاتِنَا لا يُوقِنُونَ
‘‘যখন ঘোষিত শাস্তি তাদের নিকট আসবে তখন আমি যমিন হতে বের করব এক জীব যা তাদের সাথে কথা বলবে, এ জন্য যে মানুষ আমার নিদর্শনে অবিশ্বাসী।’’[2]
কুরআনের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈসা (আ)-এর পুনরাগমনের পর সকল কিতাবী তাঁর বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ও ঈমান লাভ করবেন। আল্লাহ বলেন:
وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ
وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ
اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلا اتِّبَاعَ
الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ
اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ
قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا
‘‘আর ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মরিয়ম-তনয় ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি’ তাদের (ইহূদীদের) এ উক্তির জন্য। অথচ তারা তাকে হত্যা করে নি, ক্রুশবিদ্ধও করে নি; কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল তারা নিশ্চয় এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। নিশ্চিত যে তারা তাকে হত্যা করে নি। বরং আল্লাহ্ তাকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ্ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামাতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।’’[3]
ইয়াজুজ মাজুজের বিষয়ে আল্লাহ বলেন:
حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُونَ
وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ أَبْصَارُ الَّذِينَ
كَفَرُوا يَا وَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا بَلْ كُنَّا
ظَالِمِينَ
‘‘এমন কি যখন য়া’জুজ ও মা’জুজকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং তারা প্রতি উচ্চভূমি হতে ছুটে আসবে। অমোঘ প্রতিশ্রুতকাল আসন্ন হলে সহসা কাফিরদিগের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে, তারা বলবে ‘হায়, দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন; না, আমরা সীমালঙ্ঘনকারীই ছিলাম’।’’[4]
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২২৫-২২২৬ (কিতাবুল ফিতান, বাবু ফিল আয়াতিল্লাতি তাকূনু কাবলা)
[2] সূরা (২৭) নামল: ৮২ আয়াত।
[3] সূরা (৪) নিসা: ১৫৭-১৫৯ আয়াত।
[4] সূরা (২১) আম্বিয়া: ৯৬-৯৭।
৯. ৪. কিয়ামতের আলামাত: মুমিনের করণীয়
আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় কিয়ামতের আলামত বিষয়ে মুমিনের দায়িত্ব কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যগুলো সরল অর্থে বিশ্বাস করা। এগুলোর ব্যাখ্যা ও প্রকৃতি জানা আমাদের দায়িত্ব নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ বিষয়ক ব্যাখ্যা ভিত্তিহীন ও অন্তহীন বিতর্ক সৃষ্টি করে। যেমন: হাদীসে যে ভূমিধ্বসের কথা বলা হয়েছে তা কি তুরস্কের ভূমিকম্প? ইরানের ভূমিকম্প? জাপানের সুনামি? না তা ভবিষ্যতে ঘটবে? কবে ঘটবে? অথবা: ইয়াজূজ-মাজূজ কারা, তারা কি তাতার? চেঙ্গিশ খানের বাহিনী? চীন জাতি? অন্য কোনো জাতি? কোথায় তারা থাকে? তারা বের হয়েছে না বের হবে? অথবা: দাজ্জাল কে? ইস্রায়েল রাষ্ট্র? আমেরিকা? দাজ্জাল কি বের হয়েছে? না ভবিষ্যতে হবে? কখন তার আবির্ভাব ঘটবে? কিয়ামতের আলামত বিষয়ক এ জাতীয় প্রশ্ন বা গবেষণার নামে সময় ধ্বংস করে দুনিয়া ও আখিরাতে মুমিনের কোনোই লাভ হয় না, তবে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়। ইবাদত, দাওয়াত, উপার্জন, আল্লাহর হক্ক, বান্দার হক্ক ইত্যাদি জরুরী কর্ম ফাঁকি দিতে মুমিনকে এরূপ অকারণ বিতর্কে লিপ্ত করে শয়তান।
মুমিনের দায়িত্ব সাধারণভাবে বিশ্বাস করা যে, কিয়ামতের আগে এ সকল আলামত দেখা যাবে। এ সকল বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসে যা বলা হয়েছে সবই সত্য। যখন তা ঘটবে তখন মুমিনগণ জানবেন যে কিয়ামত ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে। এগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আল্লাহই জানেন। এর ব্যাখ্যা জানার দায়িত্ব মুমিনকে দেওয়া হয় নি। মুমিনের দায়িত্ব দুনিয়া ও আখিরাতে কাজে লাগার মত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা করা। কুরআন-হাদীস অনুসন্ধান করে মানুষের প্রায়োগিক জীবনের সমাধান দেওয়ার জন্য গবেষণা করতে নির্দেশ দেয় ইসলাম। চিকিৎসা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি সকল মানব-কল্যাণ বিষয়ক গবেষণার নির্দেশ দেয় ইসলাম। এ সকল বিষয়ে গবেষণা-অনুসন্ধান মানুষকে একটি নিশ্চিত ফলাফল লাভের পথে নিয়ে যায়। কিন্তু গাইবী বিষয় নিয়ে গবেষণার নামে অকারণ বিতর্ক কোনো ফলাফল দেয় না। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) ইয়াজূজ-মাজূজ বা দাজ্জাল বলতে কী বুঝিয়েছেন সে বিষয়ে হাজার বছর এভাবে গবেষণা নামের প্রলাপ-বিলাপ ও বিতর্ক করেও নিশ্চিত সিদ্ধামেত্ম পৌঁছানো যাবে না।[1]
ইমাম আবূ হানীফা উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল বিষয়ে কেবলমাত্র সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। এটিই আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি। শুধু সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা, দুর্বল ও জাল বর্ণনা বর্জন করা এবং সহীহ হাদীসে বর্ণিত বিষয়গুলি অপব্যাখ্যা না করে সরল অর্থে বিশ্বাস করা।
[1] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ১৯২।
৯. ৫. ইমাম মাহদী
উপরের হাদীসে কিয়ামতের দশটি পূর্বভাসের মধ্যে ‘ইমাম মাহদী’-র বিষয় উল্লেখ করা হয় নি। ইমাম আবূ হানীফাও কিয়ামতের আলামতের মধ্যে বিষয়টি উল্লেখ করেন নি। তবে বিভিন্ন হাদীসে কিয়ামতের পূর্বে ‘ইমাম মাহদী’র আবির্ভাবের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো হাদীসে বিষয়টিকে ঈসা মাসীহের অবতরণ ও দাজ্জালের সাথে সংশিস্নষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমরা দেখেছি যে, হাদীস, ফিকহ ও আকীদার পরিভাষায় ‘ইমাম’ শব্দটি ‘খলীফা’ বা ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ শব্দের সমার্থক। মাহদী অর্থ ‘হেদায়াত-প্রাপ্ত’। এজন্য পারিভাষিকভাবে ‘ইমাম মাহদী’ অর্থ ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত-প্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান’।
ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর পরের খলীফাগণকে ‘খুলাফা রাশিদীন মাহদিয়্যীন’ বা ‘মাহদী রাশিদ খলীফা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ থেকে আমরা জানি যে, খুলাফায়ে রাশিদীন সকলেই ‘মাহদী’ বা ‘হেদায়াতপ্রাপ্ত’ ছিলেন। তবে শেষ যুগে আরো একজন ‘মাহদী রাষ্ট্রপ্রধান’ ক্ষমতাগ্রহণ করবেন বলে বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। মাহদীর কথা উল্লেখ করে কোনো হাদীস সহীহ বুখারী বা সহীহ মুসলিমে নেই। অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীসগুলো সংকলিত। এ বিষয়ে কিছু সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ হাদীস বিদ্যমান এবং অগণিত জাল হাদীস এ বিষয়ে প্রচারিত হয়েছে। এখানে এ বিষয়ক কয়েকটি গ্রহণযোগ্য হাদীস উল্লেখ করছি।
প্রথম হাদীস: আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لَوْ لَمْ يَبْقَ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ يَوْمٌ لَطَوَّلَ اللَّهُ ذَلِكَ
الْيَوْمَ حَتَّى يَبْعَثَ فِيهِ رَجُلاً مِنِّى أو مِنْ أَهْلِ بَيْتِى (يَمْلِكَ
الْعَرَبَ/ يلي رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ بَيْتِى) يُوَاطِئُ اسْمُهُ اسْمِى وَاسْمُ
أَبِيهِ اسْمَ أَبِى يَمْلأُ الأَرْضَ قِسْطًا وَعَدْلاً كَمَا مُلِئَتْ ظُلْمًا
وَجَوْرًا.
‘‘দুনিয়ার যদি একটি দিনও বাকি থাকে তবে আল্লাহ সে দিনটিকে দীর্ঘায়িত করে আমার বংশধর থেকে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যার নাম ও পিতার নাম আমার নাম ও আমার পিতার নামের মতই হবে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করবেন, আরবদের উপর রাজত্ব গ্রহণ করবেন জুলুম পূর্ণ পৃথিবীকে ইনসাফে পূর্ণ করবেন।’’ হাদীসটি সহীহ।[1]
দ্বিতীয় হাদীস: আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
الْمَهْدِىُّ مِنِّى أَجْلَى الْجَبْهَةِ أَقْنَى الأَنْفِ يَمْلأُ الأَرْضَ
قِسْطًا وَعَدْلاً كَمَا مُلِئَتْ جَوْرًا وَظُلْمًا يَمْلِكُ سَبْعَ سِنِينَ
‘‘মাহদী আমার (বংশধর) থেকে, তার কপাল চুলমুক্ত (মাথার সম্মুখভাগে চুল থাকবে না) এবং নাক চিকন। সে অত্যাচারে পরিপূর্ণ দুনিয়াকে ন্যায়পরায়ণতায় পূর্ণ করবে। সে সাত (অন্য বর্ণনায়: নয়) বছর রাজত্ব করবে।’’ হাদীসটি সহীহ।[2]
তৃতীয় হাদীস: উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
يَكُونُ اخْتِلاَفٌ عِنْدَ مَوْتِ خَلِيفَةٍ فَيَخْرُجُ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ
الْمَدِينَةِ هَارِبًا إِلَى مَكَّةَ فَيَأْتِيهِ نَاسٌ مِنْ أَهْلِ مَكَّةَ
فَيُخْرِجُونَهُ وَهُوَ كَارِهٌ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ
وَيُبْعَثُ إِلَيْهِ بَعْثٌ مِنَ الشَّامِ فَيُخْسَفُ بِهِمْ بِالْبَيْدَاءِ
بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ فَإِذَا رَأَى النَّاسُ ذَلِكَ أَتَاهُ أَبْدَالُ
الشَّامِ وَعَصَائِبُ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ
وَالْمَقَامِ ثُمَّ يَنْشَأُ رَجُلٌ مِنْ قُرَيْشٍ أَخْوَالُهُ كَلْبٌ فَيَبْعَثُ
إِلَيْهِمْ بَعْثًا فَيَظْهَرُونَ عَلَيْهِمْ وَذَلِكَ بَعْثُ كَلْبٍ
وَالْخَيْبَةُ لِمَنْ لَمْ يَشْهَدْ غَنِيمَةَ كَلْبٍ فَيَقْسِمُ الْمَالَ وَيَعْمَلُ
فِى النَّاسِ بِسُنَّةِ نَبِيِّهِمْ -صلى الله عليه وسلم- وَيُلْقِى الإِسْلاَمُ
بِجِرَانِهِ إِلَى الأَرْضِ فَيَلْبَثُ سَبْعَ سِنِينَ/ تِسْعَ سِنِينَ، ثُمَّ
يُتَوَفَّى وَيُصَلِّى عَلَيْهِ الْمُسْلِمُونَ
‘‘একজন খলীফার মৃত্যুর সময় মতভেদ হবে। তখন মদীনার একজন মানুষ পালিয়ে মক্কায় চলে আসবে। তখন মক্কার কিছু মানুষ তার কাছে এসে তাকে বের করে আনবে। তার অনিচ্ছা ও অপছন্দ সত্ত্বেও তারা হাজার আসওয়াদ ও মাকাম ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে তার বাইয়াত করবে। সিরিয়া থেকে একটি বাহিনী তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হবে। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে এ বাহিনী ভূমিধ্বসে ধ্বংস হবে। যখন মানুষেরা তা দেখবে তখন সিরিয়া থেকে আবদালগণ এবং ইরাক থেকে দলেদলে মানুষ এসে হাজার আসওয়াদ ও মাকাম ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে। এরপর কুরাইশ বংশ থেকে একব্যক্তি তার (মাহদীর) বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, যার মাতুল হবে কালব বংশের। এ ব্যক্তি একটি বাহিনী তার (মাহদীর) বিরুদ্ধে প্রেরণ করবে। কিন্তু মাহদীর বাহিনী কালব গোত্রের বাহিনীকে পরাজিত করবে। কালব গোত্রের গনীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) বণ্টনে যে উপস্থিত থাকবে না সে দুর্ভাগা। তখন সে (মাহদী) সম্পদ বণ্টন করবে এবং মানুষদের মধ্যে তাদের নবীর (ﷺ) সুন্নাত অনুসারে কর্ম করবে। আর পৃথিবীর বুকে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। সে সাত (অন্য বর্ণনায়: নয়) বৎসর এভাবে থাকবে। এরপর সে মৃত্যুবরণ করবে এবং মুসলিমগণ তার সালাতুল জানাযা আদায় করবে।’’
হাদীসটির বিশুদ্ধতার বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে হাসান এবং সহীহ পর্যায়ের বলে উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে শাইখ আলবানী হাদীসটিকে যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন।[3]
চতুর্থ হাদীস: আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
يَكُونُ فِي أُمَّتِي الْمَهْدِيُّ إِنْ قُصِرَ فَسَبْعٌ وَإِلَّا فَتِسْعٌ
فَتَنْعَمُ فِيهِ أُمَّتِي نِعْمَةً لَمْ يَنْعَمُوا مِثْلَهَا قَطُّ تُؤْتَى
أُكُلَهَا وَلَا تَدَّخِرُ مِنْهُمْ شَيْئًا وَالْمَالُ يَوْمَئِذٍ كُدُوسٌ
فَيَقُومُ الرَّجُلُ فَيَقُولُ يَا مَهْدِيُّ أَعْطِنِي فَيَقُولُ خُذْ
‘‘আমার উম্মাতের মধ্যে মাহদী আসবে। কম হলে সাত (বছর), না হলে নয় (বছর)। তখন আমার উম্মাতের মধ্যে নিয়ামত সর্বজনীন হবে। তারা এমনভবে প্রাচুর্য ও নিয়ামত ভোগ করবে যা তারা ইতোপূর্বে কখনোই ভোগ করে নি। উম্মাতকে সকল প্রাচুর্য দেওয়া হবে এবং মাহদী তাদেরকে না দিয়ে কিছুই সঞ্চিত করে রাখবে না। তখন সম্পদ হবে অফুরন্ত। কোনো ব্যক্তি যদি বলে, হে মাহদী, আমাকে প্রদান করুন তবে মাহদী বলবে: তুমি নিয়ে যাও।’’ হাদীসটি হাসান।[4]
পঞ্চম হাদীস: উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
الْمَهْدِيُّ مِنْ عِتْرَتِي مِنْ وَلَدِ فَاطِمَةَ
‘‘মাহদী আমার বংশের, ফাতিমার বংশধর থেকে।’’ হাদীসটি সহীহ।[5]
ষষ্ঠ হাদীস: সাওবান (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
يَقْتَتِلُ عِنْدَ كَنْزِكُمْ ثَلَاثَةٌ كُلُّهُمْ ابْنُ خَلِيفَةٍ ثُمَّ لَا
يَصِيرُ إِلَى وَاحِدٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَطْلُعُ الرَّايَاتُ السُّودُ مِنْ قِبَلِ
الْمَشْرِقِ فَيَقْتُلُونَكُمْ قَتْلًا لَمْ يُقْتَلْهُ قَوْمٌ ثُمَّ ذَكَرَ
شَيْئًا لَا أَحْفَظُهُ فَقَالَ فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَبَايِعُوهُ وَلَوْ
حَبْوًا عَلَى الثَّلْجِ فَإِنَّهُ خَلِيفَةُ اللَّهِ الْمَهْدِيُّ
‘‘তোমাদের সংরÿÿত সম্পদ নিয়ে তিন ব্যক্তি লড়াই করবে, তিনজনই খলীফার সমত্মান। তাদের তিনজনের একজনও তা অধিকার করতে পারবে না। এরপর পূর্ব দিক থেকে কাল পতাকাসমূহের উদয় হবে, তখন তারা তোমাদেরকে এমনভাবে হত্যা করবে যেভাবে ইতোপূর্বে কেউ করে নি। এরপর তিনি কিছু বললেন, যা আমি মনে রাখতে পারি নি। এরপর বলেন: যখন তোমরা তা দেখবে তখন তার বাইয়াত করবে। বরফের উপরে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও বাইয়াত করবে; কারণ সেই আল্লাহর খলীফা মাহদী।’’ ইমাম বাযযার, হাকিম নাইসাপূরী, যাহাবী, বূসীরী, সুয়ূতী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। আলবানী হাদীসটি শেষ বাক্যটিকে যয়ীফ বলেছেন।[6]
বুখারী ও মুসলিম সংকলিত কয়েকটি হাদীস ইমাম মাহদী প্রাসঙ্গিক বলে গণ্য করেছেন আলিমগণ। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا نَزَلَ ابْنُ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ
‘‘তোমরা কি জান তোমাদের কী অবস্থা হবে যখন মরিয়মের পুত্র ঈসা যখন তোমাদের মধ্যে অবতরণ করবেন আর তখন তোমাদের ‘ইমাম’ হবেন তোমাদেরই মধ্যকার একজন।’’[7]
অন্য হাদীসে জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ
إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ - قَالَ - فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ -صلى الله
عليه وسلم- فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ لَنَا. فَيَقُولُ لاَ. إِنَّ
بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ. تَكْرِمَةَ اللَّهِ هَذِهِ الأُمَّةَ.
‘‘আমার উম্মাতের কিছু মানুষ হক্কের উপরে বিজয়ী থেকে লড়াই করে চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। তিনি বলেন: অতঃপর মরিয়মের পুত্র ঈসা (আ) অবতরণ করবেন তখন তাদের আমীর বলবে: আসুন আমাদের জন্য ইমাম হয়ে সালাত আদায় করুন। তিনি বলবেন: না, আপনারা একে অপরের উপর আমীর, এটি এ উম্মাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মাননা।’’[8]
এ সকল হাদীসের আলোকে আলিমগণ বলেন যে, ইমাম মাহদীর সময়েই ঈসা (আ) অবতরণ করবেন এবং তাঁরই ইমামতিতে তিনি সালাত আদায় করবেন।
উপরের হাদীসগুলো থেকে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারি:
(ক) ‘ইমাম মাহদী’ বলতে একজন হেদায়াতপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান বুঝানো হয়েছে। যিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে বিশ্বে প্রাচুর্য, শান্তি, ইনসাফ ও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে।
(খ) তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশধর এবং ৭ বা ৯ বৎসর রাজত্ব করবেন।
(গ) তার রাজত্বকালেই ঈসা (আ) অবতরণ করবেন।
(ঘ) তার ইমামত, খিলাফত বা শাসন আরবদেশ কেন্দ্রিক হবে।
(ঙ) তার ক্ষমতাগ্রহণের পূর্বে ক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ হবে। বাইতুল্লাহর পাশে তার বাইয়াত হবে। সিরিয়া, ইরাক ও পূর্বদিক থেকে তার পক্ষে যোদ্ধারা আসবে।
(চ) এ রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতাগ্রহণ, বাইয়াত ইত্যাদি বিষয়ে মুমিনের কোনো দায়িত্ব নেই। এগুলো ঘটবে বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানিয়েছেন। তবে যখন তার বিরোধী সৈন্যবাহিনী ভূমিধ্বসে ধ্বংস হবে, সিরিয়া, ইরাক ও পূর্ব দিকের সেনাবাহিনী তাঁর বাহিনীতে যোগ দিবে এবং সামগ্রিকভাবে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে বা মুসলিম উম্মাহ তাঁকে স্বীকার করে নিবে, তখন মুমিনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর বাইয়াত করা। এজন্য ইমাম মাহদী প্রসঙ্গে ইমাম সুফিয়ান সাওরী বলেন:
لو مر ببابك فلا تبايعه حتى يجتمع الناس عليه
যদি তিনি তোমার দরজা দিয়ে গমন করেন তবুও তুমি তাঁর বাইয়াত করবে না; যতক্ষণ না সকল মানুষ তাঁর বিষয়ে একমত হয়।[9]
[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৫০৫, নং ২২৩০, ২২৩১। হাদীসটি সহীহ।
[2] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/১৭৪ (নং ৪২৮৭)। ইবনুল কাইয়িম, সুয়ূতী ও আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বা হাসান বলেছেন।
[3] ইবনুল কাইয়িম, আল-মানারুল মুনীফ, পৃষ্ঠা ১৪১-১৪৮; আলবানী, যায়ীফাহ ৪/৪৩৫-৪৩৭, নং ১৯৬৫এ
[4] হাদীসটি হাসান। ইবন মাজাহ, আস-সুনান ২/১৩৬৬। আলবানী, সহীহ ইবন মাজাহ ২/৩৮৯, নং ৩২৯৯।
[5] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/১৭৪, নং ৪২৮৬। সুয়ূতী, আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[6] বায্যার, আল-বাহরুয যাখখার ১০/৩২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৫১০; বূসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ৪/২০৪; আব্দুল মুহাসিন আববাদ, শারহ সুনান আবী দাঊদ ২৫/৩৫; আলবানী, যায়ীফ ইবন মাজাহ, পৃষ্ঠা ৩৩৪, নং ৮৮৭; যায়ীফাহ ১/১৯৫, নং ৮৫।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৭২; মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩৬ (কিতাবুল ঈমান,বাব নুযূলি ঈﷺ.নং ১৫৫)
[8] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩৭ (কিতাবুল ঈমান, বাব (৭১) নুযূলি ঈসা, নং ১৫৬)
[9] ইরশীফ মুলতাকা আহলিল হাদীস (শামিলা ৩.৫) ১/৮০৫৬।
৯. ৬. ইমাম মাহদী দাবিদারগণ
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখি যে, যুগে যুগে অনেক মানুষ নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেছেন এবং দ্রুত জুলুম-অনাচার দূর করে ইনসাফপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেগে অথবা স্বপ্ন ও কাশফের গল্পে অনেকেই তার ভক্ত হয়ে গিয়েছেন। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছে। অকারণে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছেন বা রক্ত দিয়েছেন। ইতিহাসের বইগুলো ঘাটলে এরূপ কয়েক হাজার প্রসিদ্ধ ‘ইমাম মাহদী’-র পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে অল্প কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি।
(১) মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান হাসানী: আন- নাফসুস যাকিয়্যাহ (৯৩-১৪৫ হি)। তিনি আলী-বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম, আবিদ ও বীর ছিলেন। আববাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আগে নবী-বংশের খিলাফতের নামে আববাসী নেতৃবৃন্দ তাঁর হাতেই বাইয়াত করেন। কিন্তু ১৩২ হিজরীতে উমাইয়াগণের পতনের পর আববাসীগণ ক্ষমতা দখল করেন। দ্বিতীয় আববাসী খলীফা মানসূর (১৩৬-১৫৮ হি) তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেন। তিনি লুকিয়ে থাকার কারণে খলীফার বাহিনী তাঁর পিতা ও আত্মীয়-স্বজনকে গ্রেফতার করে এবং নির্যাতন করে হত্যা করেন। এ পর্যায়ে তিনি বিদ্রোহ করেন। মদীনা, বসরা ও অন্যান্য স্থানে তাঁকে খলীফা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আববাসী সেনাবাহিনী ১৪৫ হিজরীতে তাকে পরাজিত ও হত্যা করতে সক্ষম হয়। তৎকালীন অনেক নেককার বুজুর্গ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম তাকে ইমাম মাহদী বলে বিশ্বাস করেছিলেন এবং তাঁর বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন।[1]
(২) তৃতীয় আববাসী খলীফা মাহদী (জন্ম: ১২৭, খিলাফাত: ১৫৮-১৬৯ হি)। তিনি দ্বিতীয় আববাসী খলীফা আবূ জাফর মানসূরের পুত্র। মনসূরের মূল নাম আব্দুল্লাহ। তিনি পুত্রের নাম রাখেন মুহাম্মাদ। মানসূরের মৃত্যুর পর মাহদী খলীফা হন। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করতেন। তার এ দাবীর পক্ষে কিছু দুর্বল হাদীসও বিদ্যমান, যেগুলোতে বলা হয়েছে যে, ইমাম মাহদী আববাসের বংশধর হবেন।[2]
(৩) হুসাইন ইবন যাকরাওয়াইহি ইবন মাহরাওয়াইহি (২৯১ হি)। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। তিনি সিরিয়ার বিভিন্ন দেশ দখল করে লুটপাট ও গণহত্যা চালান। সর্বশেষ আববাসী খলীফা মুকতাফী বিল্লাহ নিজের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে এই ইমাম মাহদীর বাহিনীকে পরাজিত করেন ও তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।[3]
(৪) উবাইদুল্লাহ ইবন মাইমূন কাদ্দাহ (২৫৯-৩২২ হি)। তৃতীয় হিজরী শতকের শেষ প্রান্তে ২৯৬ হিজরী সালে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে প্রচার করেন। কাইরোয়ানে ২৯৭ হিজরীতে তাঁর অনুসারীরা ইমাম মাহদী ও ইমামে যামান হিসেবে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। দ্রুত তারা মরক্কোয় তাদের ‘ফাতিমী’ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ৩৫৮ হিজরীতে তার বংশধর মিসর দখল করেন। প্রায় দুই শতাব্দী পর ৫৬৭ হিজরী সালে সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে মিসরের ফাতিমী শীয়া মাহদী রাজত্বের পতন ঘটে।[4]
(৫) হুসাইন ইবন মানসূর হাল্লাজ (৩০৯ হি)। তিনি সূফী ও দার্শনিক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি নিজেকে আল্লাহর মধ্যে ফানাপ্রাপ্ত ও বাকা প্রাপ্ত ওলী, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, নতুন শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, ইমাম মাহদী ইত্যাদি দাবি করেন। তাঁর অনুসারীরা তাঁর বহু অলৌকিক ক্ষমতার কথা প্রচার করে। ৩০৯ হি. সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। তবে তাঁর অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি নিহত হন নি, বরং তাঁর একজন শত্রুকে তার আকৃতি প্রদান করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন।[5]
(৬) আল-মুয়িয্য ইবনুল মানসূর: মাআদ ইবন ইসমাঈল ইবন উবাইদুল্লাহ ফাতিমী (৩৬৫ হি)। পূর্বোক্ত উবাইদুল্লাহ ইবন মাইমূন-এর পৌত্র। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী হিসেবে দাবি করেন। তিনি কয়েক দিন নির্জনে থাকেন এবং দাবি করেন যে, তিনি এ সময়ে আরশে আল্লাহর সাথে ছিলেন। তার অনুসারীরা তার অগণিত কারামত প্রচার করতেন। এভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গভীর প্রভাব পড়ে। তিনি ক্রমান্বয়ে মিসর দখল করে কাইরো শহর প্রতিষ্ঠা করেন।[6]
(৭) বালিয়া (৪৮৪ হি)। এ ব্যক্তি শয়তান-সাধক ও জ্যোতিষী (astrologer) ছিল। মানুষদেরকে অনেক ভেল্কি দেখিয়ে ৪৮৩ হি. সালে দাবি করে যে, সেই ইমাম মাহদী। তাকে যে অবিশ্বাস করবে সে কাফির। সাধারণ মানুষেরা অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে তার দলে যোগ দেয়। সে বসরা অঞ্চলে অনেক শহর ও গ্রাম দখল করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ বছরেরই শেষ প্রান্তে সে ধৃত ও নিহত হয়।[7]
(৮) মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন তাওমারত (৪৮৫-৫২৪ হি)। ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের শুরুতে মরোক্কোয় তিনি আলিম, আবিদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি নিজেকে আলীর বংশধর ও ইমাম মাহদী বলে দাবি ও প্রচার করেন। দ্রুত তাঁর অনুসারী বাড়তে থাকে। মরোক্কোর শাসক ইবন তাশফীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ‘বিশুদ্ধ’ ইসলামী রাষ্ট প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অনুসারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। রাষ্ট্র দখলের আগেই তার মৃত্যু হয়। তার সাথী ও খলীফা আব্দুল মুমিন মরক্কোর শাসনক্ষমতা দখল করে নতুন রাজবংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।[8]
(৯) আহমদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন হাশিম মুলাস্সাম (৬৫৮-৭৪০ হি)। মিসরে ফকীহ, আবিদ, সূফী ও ওলী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। একপর্যায়ে ৬৮৯ সালে তিনি নিজেকে মাহদী হিসেবে দাবি করেন। তিনি তার কারামত ও হাল সম্পর্কে আল্লাহর নামে শপথ করে অনেক দাবি-দাওয়া করেন। তিনি দাবি করেন যে, তিনি মহান আল্লাহকে স্বপ্নে দেখেন ও তাঁর সাথে কথা বলেন, তাকে মহান আল্লাহর কাছে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিনি তাকে মাহদী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া অনেক দাবি-দাওয়া তিনি ও তার অনুসারীরা করেন। তাকে কয়েকবার কারারুদ্ধ করা হয়।
(১০) শাইখ আবুল আব্বাস আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ সালজামাসী, ইবন মহালস্নী (৯৬৭-১০২২ হি)। মরক্কোর সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ও সূফী ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি ফিকহে পারদর্শিতা অর্জন করেন। এরপর তিনি তাসাউফের বিভিন্ন তরীকায় অনুশীলন করে কাশফ-কারামত সম্পন্ন সূফী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার কারামত ও ইবাদতের প্রসিদ্ধির কারণে দলেদলে মানুষ তার ভক্ত হয়ে যায়। তিনি সমাজে প্রচলিত অন্যায়, জুলুম ও পাপাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। তিনি পাপী ও জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেন। মরোক্কোর তৎকালীন শাসকের বাহিনীকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করে তিনি সালজামাসা শহর অধিকার করেন এবং তথায় তিন বৎসর রাজত্ব করেন। তিনি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ১০২২ হিজরীতে এক যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। মরক্কো শহরের প্রাচীরে তার ও তার কয়েকজন ঘনিষ্ট ভক্তের কর্তিত মাথা প্রায় ১২ বৎসর ঝুলানো ছিল। তার অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি নিহত হন নি, বরং তিনি লুকিয়ে রয়েছেন এবং যথাসময়ে প্রকাশিত হবেন। পরবর্তী কয়েকশত বৎসর পর্যন্ত অনেক মানুষ এরূপ বিশ্বাস পোষণ করতেন।[9]
(১১) মুহাম্মাদ আহমদ ইবন আব্দুল্লাহ (১২৫৯-১৩০২হি/১৮৮৫খৃ)। সুদানের সুপ্রসিদ্ধ সূফী ও ইমাম মাহদী। সুদানের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর প্রভাব সুদূর প্রসারী। ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জনের পর তিনি তাসাউফের অনুশীলন, ইবাদত-বন্দেগি এবং শিক্ষা প্রচারে মনোনিবেশে করেন। ক্রমান্বয়ে তার ভক্ত-মুরীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তিনি শাসকদের অনাচার থেকে দেশকে পবিত্র করার দাওয়াত দিতে থাকেন। ১২৯৮ হি/১৮৮১ খৃস্টাব্দে তিনি নিজেকে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। সুদানের আলিমদের পত্র লিখে তাকে সহযোগিতা করতে আহবান জানান। তিনি ‘দরবেশ’ উপাধিতে আখ্যায়িত তাঁর অনুসারীদেরকে সুদানের সকল অঞ্চলে জিহাদের দাওয়াত দিতে প্রেরণ করেন। মিসর-সুদানের সরকারী বাহিনী ও বৃটিশ বাহিনী অনেকবার মাহদীর বাহিনীকে নির্মূল করতে চেষ্টা করে। কিন্তু মূলত এ সকল বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়। সমগ্র সুদান মাহদীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্থলাভিষিক্ত ও অনুসারীরা তাদের রাজত্ব সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। তবে অল্প সময়েই তারা পরাজিত হন এবং সুদান ও মিসর বৃটিশের অধীনে চলে যায়।[10]
(১২) আলী মুহাম্মাদ ইবন মিরযা রিদা শীরাযী (১২৬৬ হি/ ১৮৫০খৃ)। বাবিয়্যা বাহায়ী মতবাদের মূল প্রতিষ্ঠাতা। ইরানের শীরায প্রদেশে তার জন্ম। সংসার ত্যাগ, সাধনা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রৌদ্রে অবস্থান ইত্যাদি দ্বারা তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি নিজেকে প্রথমে ‘আল-বাব’ অর্থাৎ দরজা উপাধিতে আখ্যায়িত করেন। এরপর তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। স্বভাবতই অনেক মানুষ তার অনুসারী ও ভক্ত হয়ে যায়। সর্বশেষ তিনি সকল ধর্মের সমন্বয়ে নতুন এক ধর্মের উদ্ভাবন করেন। তার এ নতুন ধর্ম সমাজে অনেক হানাহানি সৃষ্টি করে। ১৮৫০ খৃস্টাব্দে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।[11]
(১৩) মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৪০-১৯০৮খৃ)। কাদিয়ানী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। সে প্রথম দিকে সূফী দরবেশ ও কাশফ-কারামতের অধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। ইসলামের পক্ষে হিন্দু ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও বইপত্র লিখে বৃটিশ শাসিত মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হিন্দু ও খৃস্টানদের প্রতিবাদের নামে ১৮৮০ সালে বারাহীন আহমাদিয়া নামক গ্রন্থটির প্রথম খ- প্রকাশ করে। গ্রন্থটি মূলত তার নিজের কাশফ ও কারামতের দাবি-দাওয়ায় পরির্পূণ। ক্রমান্বয়ে তার দাবি-দাওয়া বাড়তে থাকে। ১৩০২ হিজর সালে (১৮৮৫খৃ) সে নিজেকে চতুর্দশ হিজরী শতকের মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে। ১৮৯১ সালে সে নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করে। এরপর নিজেকে ঈসা মাসীহ বলে দাবী করে। এরপর নিজেকে ওহী-প্রাপ্ত ছায়া নবী বলে দাবি করে। সর্বশেষ ১৯০১ সালে সে নিজেকে তিন লক্ষ মুজিযা প্রাপ্ত পূর্ণ নবী বলে দাবি করে। ১৯০৮ খৃস্টাব্দে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।[12]
(১৪) মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কাহতানী (১৪০০ হি/১৯৭৯ খৃ)। ১৪০০ হিজরী সালের প্রথম দিনে (১৯/১১/৭৯) এ মাহদীর আবির্ভাব। জুহাইমান উতাইবী নামক একজন সৌদি ধার্মিক যুবক সমাজের অন্যায় অবÿয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ আলিমগণ তাকে ভালবাসতেন। ক্রমান্বয়ে জুহাইমানের আন্দোলনে অনেক শিক্ষÿত ও ধার্মিক যুবক অংশ গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে জুহাইমানের একজন আত্মীয় মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কাহতানীকে তিনি প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী হিসেবে ঘোষণা করেন। কাহতানী নিজে এবং তার অনেক অনুসারী স্বপ্নে দেখতে থাকেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং কাহতানীকে ‘ইমাম মাহদী’ বলে জানাচ্ছেন। এভাবে স্বপ্নের মাধ্যমে তারা সুনিশ্চিত হন যে কাহতানীই ইমাম মাহদী। যেহেতু কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কাবা শরীফের পাশে হাজারে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে মাহদীর বাইয়াত হবে, এজন্য তারা ১৪০০ হিজরীর প্রথম দিনে এ বাইয়াত সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। অনেকগুলো লাশের কফিনের মধ্যে অস্ত্র ভরে ১/১/১৪০০ (১৯/১১/৭৯) ফজরের সময় তারা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। সালাতের পর তারা মসজিদ অবরোধ করেন এবং ইমাম ও মুসলস্নীদেরকে ইমাম মাহদীর বাইয়াত গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। সৌদি সরকারী বাহিনী দীর্ঘ ১৫ দিন প্রাণান্ত প্রচেষ্টার পর অবরুদ্ধ মাসাজিদুল হারাম মুক্ত করেন। ইমাম মাহদী ও তার অনেক অনুচর নিহত হয়। এছাড়া অনেক হাজী ও মুসলস্নীও উভয় পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিহত হন।
(১৫) হুসাইন ইবন মূসা হুসাইন আল-লুহাইদী। বর্তমান যুগের ‘ইমাম মাহদীগণের’ একজন। তিনি কুয়েতের অধিবাসী। যুবক বয়সে পাপাচারের পথে ছিলেন। এরপর তিনি ইবাদত-বন্দেগি ও নির্জনতার মধ্যে বাস করতে থাকেন। সমাজের অবÿয়ের অজুহাতে মসজিদে সালাত আদায় বর্জন করেন। একপর্যায়ে তিনি দাবি করেন যে তিনি ইমাম মাহদী, তার কাছে আল্লাহর ওহী ও ইলহাম আসে। নষ্ট সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে অনেক কথা তিনি বলেন। ফলে অনেকেই তার ভক্ত হয়ে পড়েছে। আমরা দেখেছি যে, সহীহ হাদীসগুলোতে বলা হয়েছে, প্রতিশ্রুত মাহদীর নাম ও পিতার নাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মতই হবে। এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, লুহাইদী মাহদী নয়। এজন্য এর ব্যাখ্যায় লুহাইদী প্রচার করে যে, এ সকল হাদীসে মূলত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর পুনরাগমনের কথা বলা হয়েছে। তিনি পুনরুজ্জীবিত হয়ে কবর থেকে বেরিয়ে আসবেন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে তার অনেক ভক্ত অনুসারী বিদ্যমান। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের আলিমগণ তার বিভ্রান্তিগুলো প্রকাশ করে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
[1] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩১৯; যিরকলী, আল-আ’লাম ৬/২২০।
[2] ইবন তাইমিয়া, মিনহাজুস সুন্নাত ৪/৪৫; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানারুল মুনীফ, পৃ. ১৪১-১৪৮।
[3] ইবনুল আদীম, বুগইয়াতুত তালাব ফী তারীখি হালাব (শামিলা) ১/৩০০।
[4] ইবন তাইমিয়া, মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/৪৫-৪৬; ইবনুল কাইয়িম: আল-মানারুল মুনীফ, পৃ ১৪১-১৪৮; যিরকলী, আল-আ’লাম ৪/১৯৭।
[5] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৪/৩১৩-৩৫৪; যিরকলী, আল-আ’লাম ২/২৬০।
[6] সুয়ূতী, আল-আরাফুল ওয়ারদী, সম্পাদকের ভূমিকা, পৃ ২৩।
[7] ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১২/১৬৮।
[8] ইবন তাইমিয়া, মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/৪৫; যিরকলী, আল-আ’লাম ৬/২২৮।
[9] যিরকলী, আল-আ’লাম ১/১৬১।
[10] যিরকলী, আল-আ’লাম ৬/২০।
[11] যিরকলী, আল-আ’লাম ৫/১৭।
[12] বিস্তারিত দেখুন: Ehsan Elahi Zaheer, Qadiyaniat an Analytical Survey.
৯. ৭. বিভ্রান্তির কারণ ও প্রতিকার
ইতিহাসে এ জাতীয় শত শত ‘ইমাম মাহদী’-র সন্ধান পাওয়া যায় যাদের মাধ্যমে হাজার হাজার মুসলিম বিভ্রান্ত হয়েছেন, হত্যাকারী বা নিহত হয়েছেন এবং অনেকে ঈমানহারা হয়েছেন। মাহদী দাবিদার ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে অনেক ভণ্ড ও প্রতারক থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক আলিম, আবিদ ও নেককার মানুষও ছিলেন। তাদের বিভ্রান্তির পিছনে তিনটি মৌলিক কারণ কার্যকর বলে আমরা দেখি:
(১) সমাজ পরিবর্তনের অন্ধ আবেগ। সকল সমাজেই পাপ ও জুলুম বিদ্যমান। পাপাচারী, জালিম ও ধর্মহীনদের সংখ্যা সবসময়ই ধার্মিকদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। আবেগী ধার্মিক মানুষ, বিশেষত যুবক, এ সকল অন্যায় দূর করে ‘আদর্শ’ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। স্বাভাবিকভাবে ইলম প্রসার ও দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন ‘কষ্টকর’, ‘দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ’ ও ‘অসম্ভব’ বলে মনে হয়। এজন্য ‘জিহাদ’ বা ‘ইমাম মাহদী’ বিষয়টি খুবই আকর্ষণীয় বলে গণ্য করেন অধিকাংশ আবেগী ধার্মিক মানুষ। ফলে এ জাতীয় কোনো কথা শুনলে বাছবিচার না করেই শরীক হয়ে যান তারা।
অষ্টম-নবম শতকের সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবন খালদূন আব্দুর রাহমান ইবন মুহাম্মাদ (৭৩২-৮০৮ হি) মাহদীর প্রত্যাশায় শীয়া ও সূফীগণের বিভিন্ন মত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, মাহদীর ধারণার সাথে মুজাদ্দিদের ধারণা মিশ্রিত হয়ে গিয়েছে। সকলেই অপেক্ষা করেন, এই তো মুজাদ্দিদ বা মাহদী এসে ধর্ম, দেশ, জাতি ও সমাজকে ভাল করে ফেলবেন।[1] এগুলো সবই পলায়নী মনোবৃত্তির প্রকাশ। ফলাফলের চিন্তা না করে দীন পালন ও প্রচারের দায়িত্ব সাধ্যমত আঞ্জাম দেওয়াই মুমিনের কাজ। দুনিয়ায় ফলাফল যা-ই হোক না কেন এরূপ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মুমিন আখিরাতের অফুরন্ত নিয়ামত ও মর্যাদা লাভ করেন। মাহদী বা মুজাদ্দিদ অনুসন্ধান বা অনুসরণের নামে মুমিন মূলত নিজের এ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ান।
(২) স্বপ্ন-কাশফের উপর নির্ভর করা। মাহদী দাবিদার অধিকাংশ ব্যক্তি ও তার অনুসারীগণ আল্লাহর কসম করে দাবি করেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) উক্ত ব্যক্তিকে মাহদী বলে স্বপ্নে বা কাশফ-ইলহামের মাধ্যমে তাদেরকে জানিয়েছেন। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে স্বপ্নে দেখার কথা শুনলেই মুমিন দুর্বল হয়ে পড়েন। অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, শয়তান তাঁর আকৃতি গ্রহণ করতে পারে না; তাঁর নাম ধরে জালিয়াতি করতে পারে না- তা তিনি বলেন নি। স্বপ্নে যদি তাঁকে হুবহু দুনিয়ার আকৃতিতে দেখা যায় তবেই তাঁকে দেখা বলে গণ্য হবে। তারপরও স্বপ্নের বক্তব্য অনুধাবন ও ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। এছাড়া স্বপ্নে বা জাগ্রত অবস্থায় শয়তান নিজেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দাবি করে মিথ্যা বলতে পারে। বস্ত্তত, মুসলিমদের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ স্বপ্ন, ইলহাম ইত্যাদিকে দীনের দলীল হিসেবে গণ্য করা।
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, শেষ যুগে একজন ন্যায়পরায়ণ সুপথপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম বিশ্ব শাসন করবেন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করার প্রমাণ কী? যদি কারো নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইতুল্লাহর পাশে বাইয়াত গ্রহণ ইত্যাদি সব মিলে যায় তারপরও তাকে ‘মাহদী’ বলে বিশ্বাস করার কোনোরূপ দলীল নেই। কারণ মাহদীর মধ্যে এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকবে, কিন্তু এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেই তিনি মাহদী নন।
কোনো হাদীসে কোনোভাবে বলা হয় নি যে, মহান আল্লাহ কাউকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ হিসেবে গ্রহণ করলে তাকে বিষয়টি জানিয়ে দিবেন। কাজেই যিনি নিজেকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ বলে দাবি করেন তিনি নিঃসন্দেহে মিথ্যাচারী প্রতারক বা প্রতারিত। তিনি কিভাবে জানলেন যে, তিনি মাহদী বা মুজাদ্দিদ? একমাত্র ওহীর মাধ্যমেই কারো বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানা যায়। নবীগণ ওহীর মাধ্যমে তাঁদের নুবুওয়াতের কথা জেনেছেন। এ সকল দাবিদার কিভাবে তাদের বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানলেন?
সাধারণত তারা ওহীর দাবি করেন না; কারণ তাতে মুসলিম সমাজে তারা ভণ্ড নবী বলে গণ্য হবেন। এজন্য তারা স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে তা জানার দাবি করেন। সরলপ্রাণ মুসলিমগণ এতে প্রতারিত হন। অথচ স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবি করা আর ওহীর লাভের দাবি একই। কারণ যে ব্যক্তি তার স্বপ্ন বা কাশফের বিষয়কে নিজের বা অন্যের বিশ্বাসের বিষয় বানিয়ে নিয়েছেন তিনি নিঃসন্দেহে তার স্বপ্ন বা কাশফকে নবীদের স্বপ্নের মত ওহীর সম-পর্যায়ের বলে দাবি করেছেন। অনুরূপভাবে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার স্বপ্ন-কাশফ নির্ভর দাবি বিশ্বাস করার অর্থ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরে কাউকে ওহীপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা।
মাহদী ও অন্য সকল বিষয়ে মুমিন শুধু কুরআন ও হাদীসের কথায় বিশ্বাস করেন। মাহদী ও কিয়ামতের আলামত বিষয়ক হাদীসগুলো বর্ণনামূলক। ভূমিধ্বস হবে, পাহাড় স্থানচ্যুত হবে... অন্যান্য বিষয়ের মত মাহদীর রাজত্বও আসবে। কিয়ামতের কোনো আলামত ঘটিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব মুমিনের নয়। অন্যান্য আলামতের মত এ ক্ষেত্রেও ঘটে যাওয়ার পরে মুমিন বলবেন যে, আলামতটি প্রকাশ পেয়েছে। যখন কোনো শাসকের বিষয়ে হাদীসে নির্দেশিত সকল আলামত প্রকাশিত হবে এবং মুসলিমগণ তাকে মাহদী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নিবেন তখনই মুমিন তাকে মেনে নিবেন।
মুমিনের হয়ত মনে হতে পারে যে, মাহদীকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব। চিন্তাটি ভিত্তিহীন। যদি কেউ নিজেকে মাহদী বলে দাবি করেন তবে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে যে তিনি মিথ্যাবাদী। আর যদি দাবি-দাওয়া ছাড়াই কারো মধ্যে মাহদীর অনেকগুলো আলামত প্রকাশ পায় তবে তার থেকে সতর্কতার সাথে দূরে থাকতে হবে, অবশিষ্ট আলামতগুলো প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত। কারণ তিনি যদি সত্যিকার মাহদী হন তবে আল্লাহই ভূমিধ্বস ও অন্যান্য অলৌকিক সাহায্যের মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছে দেবেন। সকল আলামত প্রকাশ পাওয়ার পরে অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয় ও সকল দেশের মুসলিমগণ তাকে মেনে নেওয়ার পরেই শুধু মুমিনের দায়িত্ব তার বাইয়াত করা।
(৩) ব্যাখ্যার নামে ওহীর সরল অর্থ পরিত্যাগ। আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মাহদী বিষয়েও ওহীর অপব্যাখ্যা বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। উপরে আলোচিত মাহদীগণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইয়াতের স্থান, রাজত্বলাভ, জুলুম দূর করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি আলামতগুলোর অধিকাংশ বা কোনোটিই পাওয়া যায় না। তারপরও হাজার হাজার মুসলিম তাদের দাবি নির্বিচারে বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয়েছেন ও হচ্ছেন। হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্যগুলো তারা নানান ব্যাখ্যা করে বাতিল করছেন। কারো বিষয়ে একবার সুধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে তার সকল দাবিই ভক্তরা নানা অজুহাতে মেনে নেয়। এজন্য প্রতারকগণ প্রথমে ইবাদত-বন্দেগি, দরবেশি, নির্লোভতা, কাশফ-কারামত ইত্যাদি দেখিয়ে মানুষদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। এরপর নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করে। ফলে তাদের ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তিও ভক্তগণ নির্বিচারে বিশ্বাস করেন। ঈমানী দুর্বলতার কারণেই প্রতারকগণ সফল হয়। আমরা দেখেছি, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য দাবি যে, আমরা তাঁর কথা ছাড়া আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করব না। প্রত্যেকের প্রতিটি কথা সুন্নাত দিয়ে যাচাই করব। আর এটিই মুমিনের রক্ষাকবজ।
[1] ইবন খালদূন, তারীখ ১/৩২৭।
৯. ৮. দাজ্জাল
দাজ্জাল অর্থ প্রতারক। ইসলামী পরিভাষায় কিয়ামতের পূর্বে যে মহা প্রতারকের আবির্ভাব হবে তাকে ‘মাসীহ দাজ্জাল’ বলা হয়। যে নিজেকে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী ব্যক্তিত্ব’ বলে দাবি করবে এবং তার ঈশ্বরত্ব প্রমাণের জন্য বহু অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখাবে। অনেক মানুষ তাকে বিশ্বাস করে ঈমানহারা হবে। দাজ্জাল বিষয়ক হাদীসগুলো মুতাওয়াতির পর্যায়ের। এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি।
(১) আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন:
ثُمَّ ذَكَرَ الدَّجَّالَ، فَقَالَ: إِنِّى لأُنْذِرُكُمُوهُ، وَمَا مِنْ نَبِىٍّ
إِلاَّ أَنْذَرَهُ قَوْمَهُ... وَلَكِنِّى أَقُولُ لَكُمْ فِيهِ قَوْلاً لَمْ
يَقُلْهُ نَبِىٌّ لِقَوْمِهِ ، تَعْلَمُونَ أَنَّهُ أَعْوَرُ ، وَأَنَّ اللَّهَ
لَيْسَ بِأَعْوَرَ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)... দাজ্জালের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন: আমি তোমাদেরকে তার বিষয়ে সতর্ক করছি। প্রত্যেক নবীই তাঁর জাতিকে দাজ্জালের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। .... তবে পূর্ববর্তী কোনো নবী তাঁর জাতিকে যে কথা বলেন নি আমি তোমাদেরকে সে কথা বলছি। তোমরা জেনে রাখ যে, দাজ্জাল কানা (একটি চক্ষু নষ্ট) আর আল্লাহ কানা নন।[1]
(২) আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ عَنِ الدَّجَّالِ حَدِيثًا مَا حَدَّثَهُ نَبِىٌّ قَوْمَهُ
إِنَّهُ أَعْوَرُ وَإِنَّهُ يَجِىءُ مَعَهُ مِثْلُ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ
فَالَّتِى يَقُولُ إِنَّهَا الْجَنَّةُ هِىَ النَّارُ.
‘‘আমি তোমাদেরকে দাজ্জালের বিষয়ে একটি কথা বলব যা কোনো নবী তাঁর জাতিকে বলেন নি; তা হলো যে, দাজ্জাল কানা। আর সে তার সাথে জান্নাত ও জাহান্নামের নমুনা নিয়ে আসবে। যাকে সে জান্নাত বলবে সেটিই জাহান্নাম।’’[2]
(৩) আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন,
حَدَّثَنَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ حَدِيثًا طَوِيلاً عَنِ الدَّجَّالِ، فَكَانَ فِيمَا
حَدَّثَنَا بِهِ أَنْ قَالَ: يَأْتِى الدَّجَّالُ- وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيْهِ أَنْ
يَدْخُلَ نِقَابَ الْمَدِينَةِ- بَعْضَ السِّبَاخِ الَّتِى بِالْمَدِينَةِ ،
فَيَخْرُجُ إِلَيْهِ يَوْمَئِذٍ رَجُلٌ، هُوَ خَيْرُ النَّاسِ- أَوْ مِنْ خَيْرِ
النَّاسِ- فَيَقُولُ أَشْهَدُ أَنَّكَ الدَّجَّالُ ، الَّذِى حَدَّثَنَا عَنْكَ رَسُولُ
اللَّهِ ﷺ حَدِيثَهُ ، فَيَقُولُ الدَّجَّالُ أَرَأَيْتَ إِنْ قَتَلْتُ هَذَا
ثُمَّ أَحْيَيْتُهُ ، هَلْ تَشُكُّونَ فِى الأَمْرِ فَيَقُولُونَ لاَ.
فَيَقْتُلُهُ ثُمَّ يُحْيِيهِ فَيَقُولُ حِينَ يُحْيِيهِ وَاللَّهِ مَا كُنْتُ
قَطُّ أَشَدَّ بَصِيرَةً مِنِّى الْيَوْمَ، فَيَقُولُ الدَّجَّالُ أَقْتُلُهُ
فَلاَ أُسَلَّطُ عَلَيْهِ.
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন আমাদেরকে দাজ্জালের বিষয়ে দীর্ঘ কথা বললেন। তাঁর কথার মধ্যে তিনি বলেন: দাজ্জালের জন্য মদীনার মধ্যে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। এজন্য সে মদীনার পার্শবর্তী মরুপ্রান্তরে আগমন করবে। তখন এক ব্যক্তি (মদীনা থেকে) বেরিয়ে তার কাছে গমন করবে, যে সে সময়ের শ্রেষ্ট মানুষ বা শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন। সে বলবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমিই সেই দাজ্জাল যার কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে তাঁর হাদীসের মধ্যে জানিয়েছেন। তখন দাজ্জাল (উপস্থিত অনুসারীদেরকে) বলবে: আমি যদি এ ব্যক্তিকে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করি তবে কি তোমরা আমার (ঈশ্বরত্বের) বিষয়ে সন্দেহ করবে? তারা বলবে: না। তখন দাজ্জাল সে ব্যক্তিকে হত্যা করবে তারপর জীবিত করবে। তখন সে ব্যক্তি বলবে: আল্লাহর কসম, তোমার (দাজ্জাল হওয়ার) বিষয়ে আমি পূর্বের চেয়ে এখন আরো বেশি সুনিশ্চিত হলাম। তখন দাজ্জাল তাকে হত্যা করার চেষ্টা করবে কিন্তু সে তার উপর আর কর্তৃত্ব পাবে না (সে তার কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না)।’’[3]
(৪) আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَا بَعَثَ اللَّهُ مِنْ نَبِىٍّ إِلاَّ أَنْذَرَ قَوْمَهُ الأَعْوَرَ الْكَذَّابَ
، إِنَّهُ أَعْوَرُ ، وَإِنَّ رَبَّكُمْ لَيْسَ بِأَعْوَرَ ، مَكْتُوبٌ بَيْنَ
عَيْنَيْهِ كَافِرٌ
‘‘যত নবী প্রেরিত হয়েছেন সকলেই কানা মিথ্যাবাদীর বিষয়ে তার উম্মাতকে সতর্ক করেছেন। তোমরা সতর্ক থাকবে। সে কানা আর তোমাদের প্রতিপালক কানা নন। আর তার দু চোখের মধ্যবর্তী স্থানে ‘কাফির’ লেখা থাকবে।’’[4]
(৫) নাওয়াস ইবন সামআন (রা) বলেন:
ذَكَرَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ الدَّجَّالَ ذَاتَ غَدَاةٍ فَخَفَّضَ فِيهِ وَرَفَّعَ
حَتَّى ظَنَنَّاهُ فِى طَائِفَةِ النَّخْلِ ... إِنْ يَخْرُجْ وَأَنَا فِيكُمْ
فَأَنَا حَجِيجُهُ دُونَكُمْ وَإِنْ يَخْرُجْ وَلَسْتُ فِيكُمْ فَامْرُؤٌ حَجِيجُ
نَفْسِهِ وَاللَّهُ خَلِيفَتِى عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ إِنَّهُ شَابٌّ قَطَطٌ
عَيْنُهُ طَافِئَةٌ كَأَنِّى أُشَبِّهُهُ بِعَبْدِ الْعُزَّى بْنِ قَطَنٍ فَمَنْ
أَدْرَكَهُ مِنْكُمْ فَلْيَقْرَأْ عَلَيْهِ فَوَاتِحَ سُورَةِ الْكَهْفِ إِنَّهُ
خَارِجٌ خَلَّةً بَيْنَ الشَّأْمِ وَالْعِرَاقِ فَعَاثَ يَمِينًا وَعَاثَ شِمَالاً
يَا عِبَادَ اللَّهِ فَاثْبُتُوا. قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا لَبْثُهُ فِى
الأَرْضِ قَالَ: أَرْبَعُونَ يَوْمًا يَوْمٌ كَسَنَةٍ وَيَوْمٌ كَشَهْرٍ وَيَوْمٌ
كَجُمُعَةٍ وَسَائِرُ أَيَّامِهِ كَأَيَّامِكُمْ. قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ
فَذَلِكَ الْيَوْمُ الَّذِى كَسَنَةٍ أَتَكْفِينَا فِيهِ صَلاَةُ يَوْمٍ قَالَ:
لاَ، اقْدُرُوا لَهُ قَدْرَهُ. قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا إِسْرَاعُهُ فِى
الأَرْضِ قَالَ: كَالْغَيْثِ اسْتَدْبَرَتْهُ الرِّيحُ فَيَأْتِى عَلَى الْقَوْمِ
فَيَدْعُوهُمْ فَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَجِيبُونَ لَهُ فَيَأْمُرُ السَّمَاءَ
فَتُمْطِرُ وَالأَرْضَ فَتُنْبِتُ فَتَرُوحُ عَلَيْهِمْ سَارِحَتُهُمْ أَطْوَلَ
مَا كَانَتْ ذُرًا وَأَسْبَغَهُ ضُرُوعًا وَأَمَدَّهُ خَوَاصِرَ ثُمَّ يَأْتِى
الْقَوْمَ فَيَدْعُوهُمْ فَيَرُدُّونَ عَلَيْهِ قَوْلَهُ فَيَنْصَرِفُ عَنْهُمْ
فَيُصْبِحُونَ مُمْحِلِينَ لَيْسَ بِأَيْدِيهِمْ شَىْءٌ مِنْ أَمْوَالِهِمْ
وَيَمُرُّ بِالْخَرِبَةِ فَيَقُولُ لَهَا أَخْرِجِى كُنُوزَكِ. فَتَتْبَعُهُ
كُنُوزُهَا كَيَعَاسِيبِ النَّحْلِ ثُمَّ يَدْعُو رَجُلاً مُمْتَلِئًا شَبَابًا
فَيَضْرِبُهُ بِالسَّيْفِ فَيَقْطَعُهُ جَزْلَتَيْنِ رَمْيَةَ الْغَرَضِ ثُمَّ
يَدْعُوهُ فَيُقْبِلُ وَيَتَهَلَّلُ وَجْهُهُ يَضْحَكُ فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِذْ
بَعَثَ اللَّهُ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ فَيَنْزِلُ عِنْدَ الْمَنَارَةِ
الْبَيْضَاءِ شَرْقِىَّ دِمَشْقَ بَيْنَ مَهْرُودَتَيْنِ وَاضِعًا كَفَّيْهِ عَلَى
أَجْنِحَةِ مَلَكَيْنِ إِذَا طَأْطَأَ رَأَسَهُ قَطَرَ وَإِذَا رَفَعَهُ تَحَدَّرَ
مِنْهُ جُمَانٌ كَاللُّؤْلُؤِ فَلاَ يَحِلُّ لِكَافِرٍ يَجِدُ رِيحَ نَفَسِهِ
إِلاَّ مَاتَ وَنَفَسُهُ يَنْتَهِى حَيْثُ يَنْتَهِى طَرْفُهُ فَيَطْلُبُهُ حَتَّى
يُدْرِكَهُ بِبَابِ لُدٍّ فَيَقْتُلُهُ ثُمَّ يَأْتِى عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ
قَوْمٌ قَدْ عَصَمَهُمُ اللَّهُ مِنْهُ فَيَمْسَحُ عَنْ وُجُوهِهِمْ
وَيُحَدِّثُهُمْ بِدَرَجَاتِهِمْ فِى الْجَنَّةِ فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِذْ
أَوْحَى اللَّهُ إِلَى عِيسَى إِنِّى قَدْ أَخْرَجْتُ عِبَادًا لِى لاَ يَدَانِ
لأَحَدٍ بِقِتَالِهِمْ فَحَرِّزْ عِبَادِى إِلَى الطُّورِ. وَيَبْعَثُ اللَّهُ
يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُونَ فَيَمُرُّ
أَوَائِلُهُمْ عَلَى بُحَيْرَةِ طَبَرِيَّةَ فَيَشْرَبُونَ مَا فِيهَا وَيَمُرُّ
آخِرُهُمْ فَيَقُولُونَ لَقَدْ كَانَ بِهَذِهِ مَرَّةً مَاءٌ. وَيُحْصَرُ نَبِىُّ
اللَّهُ عِيسَى وَأَصْحَابُهُ حَتَّى يَكُونَ رَأْسُ الثَّوْرِ لأَحَدِهِمْ
خَيْرًا مِنْ مِائَةِ دِينَارٍ لأَحَدِكُمُ الْيَوْمَ فَيَرْغَبُ نَبِىُّ اللَّهِ
عِيسَى وَأَصْحَابُهُ فَيُرْسِلُ اللَّهُ عَلَيْهُمُ النَّغَفَ فِى رِقَابِهِمْ
فَيُصْبِحُونَ فَرْسَى كَمَوْتِ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ ثُمَّ يَهْبِطُ نَبِىُّ اللَّهِ
عِيسَى وَأَصْحَابُهُ إِلَى الأَرْضِ فَلاَ يَجِدُونَ فِى الأَرْضِ مَوْضِعَ
شِبْرٍ إِلاَّ مَلأَهُ زَهَمُهُمْ وَنَتْنُهُمْ فَيَرْغَبُ نَبِىُّ اللَّهِ عِيسَى
وَأَصْحَابُهُ إِلَى اللَّهِ فَيُرْسِلُ اللَّهُ طَيْرًا كَأَعْنَاقِ الْبُخْتِ
فَتَحْمِلُهُمْ فَتَطْرَحُهُمْ حَيْثُ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ يُرْسِلُ اللَّهُ
مَطَرًا لاَ يَكُنُّ مِنْهُ بَيْتُ مَدَرٍ وَلاَ وَبَرٍ فَيَغْسِلُ الأَرْضَ
حَتَّى يَتْرُكَهَا كَالزَّلَفَةِ ثُمَّ يُقَالُ لِلأَرْضِ أَنْبِتِى ثَمَرَتَكِ
وَرُدِّى بَرَكَتَكِ.
فَيَوْمَئِذٍ تَأْكُلُ الْعِصَابَةُ مِنَ الرُّمَّانَةِ وَيَسْتَظِلُّونَ
بِقِحْفِهَا وَيُبَارَكُ فِى الرِّسْلِ حَتَّى أَنَّ اللِّقْحَةَ مِنَ الإِبِلِ
لَتَكْفِى الْفِئَامَ مِنَ النَّاسِ وَاللِّقْحَةَ مِنَ الْبَقَرِ لَتَكْفِى
الْقَبِيلَةَ مِنَ النَّاسِ وَاللِّقْحَةَ مِنَ الْغَنَمِ لَتَكْفِى الْفَخِذَ
مِنَ النَّاسِ فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ بَعَثَ اللَّهُ رِيحًا طَيِّبَةً
فَتَأْخُذُهُمْ تَحْتَ آبَاطِهِمْ فَتَقْبِضُ رُوحَ كُلِّ مُؤْمِنٍ وَكُلِّ
مُسْلِمٍ وَيَبْقَى شِرَارُ النَّاسِ يَتَهَارَجُونَ فِيهَا تَهَارُجَ الْحُمُرِ
فَعَلَيْهِمْ تَقُومُ السَّاعَةُ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন সকালে দাজ্জালের কথা বললেন। তিনি উচ্চস্বরে ও নিম্নস্বরে এমন গুরুত্ব দিয়ে বললেন যে আমাদের মনে হলো দাজ্জাল খেজুরের বাগানের মধ্যে উপস্থিত.... তিনি আমাদের বলেন: আমি তোমাদের মাঝে থাকা অবস্থায় যদি দাজ্জালের আবির্ভাব হয় তবে তোমাদের পক্ষ থেকে আমিই তার সাথে বিতর্ক করব। আর যদি এমন অবস্থায় সে আসে যখন আমি তোমাদের মাঝে নেই তবে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের পক্ষ হয়ে বিতর্ক করবে। আর প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আল্লাহ আমার খলীফা (স্থলাভিষিক্ত) থাকবেন। দাজ্জাল কোঁকড়ানো চুল ফোলা চোখ একজন যুবক। আমি যেন তাকে ‘আব্দুল উয্যা ইবন কাতান’ নামক লোকটির সাথে তুলনা করছি। তোমাদের কেউ যদি তাকে পায় তবে সে যেন তার কাছে সূরা কাহাফের প্রথম আয়াতগুলো পাঠ করে। সে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থানে বহির্ভূত হবে এবং ডানে-বামে অশান্তি-বিশৃঙ্খলা ছড়াবে। হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা সুদৃঢ় থাকবে।
আমরা বললাম: সে কতদিন পৃথিবীতে থাকবে? তিনি বলেন: ৪০ দিন। প্রথম দিন এক বছরের মত। দ্বিতীয় দিন এক মাসের মত। তৃতীয় দিন এক সপ্তাহের মত। আর অবশিষ্ট দিনগুলো তোমাদের সাধারণ দিনের মত। আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, এক বছরের মত যে দিন সে দিনে কি এক দিনের সালাত আদায় করলেই চলবে? তিনি বলেন: না, তোমরা সালাতের জন্য সময় হিসাব করে নিবে। আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল: পৃথিবীতে তার দ্রুততা কিরূপ? তিনি বলেন: ঝড়-তাড়িত মেঘের মত। সে এক জাতির নিকট এসে তাদেরকে দাওয়াত দিবে। তখন তারা তার উপর ঈমান আনবে এবং তার ডাকে সাড়া দিবে। তখন তার নির্দেশে আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত হবে, যমিনে ফল-ফসল জন্ম নেবে, তাদের পালিত পশুগুলোর আকৃতি ও দুধ সবই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর সে অন্য একটি জনগোষ্ঠীর নিকট গমন করবে এবং তাদেরকে দাওয়াত দিবে। তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। তখন সে তাদের নিকট থেকে ফিরে যাবে, কিন্তু তাদের যমিনগুলো অনুর্বর ফসলহীন হয়ে যাবে এবং তাদের হাতে তাদের সম্পদের কিছুই থাকবে না। সে পতিত ভূমি দিয়ে গমন করার সময় তাকে বলবে: তোমার সম্পদ-ভাণ্ডার বের কর। তখন মৌমাছিরা যেমন রাণী মাছির পিছে পিছে চলে তেমনি খনিজ সম্পদগুলো তার পিছে পিছে চলবে। এরপর সে একজন যৌবনে পূর্ণ যুবককে ডেকে তাকে তরবারি দ্বরা দুখন্ড করবে এবং তীর নিক্ষেপের দূরত্বে ছুড়ে ফেলবে। এরপর তাকে ডাকবে। তখন সে হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার দিকে এগিয়ে আসবে।
সে যখন এসব করবে তখন আল্লাহ মরিয়মের পুত্র ঈসা (আ)-কে প্রেরণ করবেন। তিনি দামেশকের পূর্ব দিকে সাদা মিনারার উপর অবতরণ করবেন। তাঁর পরিধানে থাকবে দুটি রঙিন কাপড়। তিনি তাঁর হাত দুটি দুজন ফিরিশতার পাঁখার উপর রেখে অবতরণ করবেন। তিনি মাথা নিচু করলে ফোঁটা ফোঁটা (ঘাম) পড়বে। আবার যখন মাথা উচু করবেন তখন মুক্তোর মত (ঘাম) পড়বে। যে কোনো কাফির তাঁর নিশ্বাস পেলেই মৃত্যুবরণ করবে। আর তাঁর দৃষ্টি যতদূর যাবে তাঁর নিশ্বাসও ততদূর যাবে। তিনি দাজ্জালকে খুঁজতে থাকবেন এবং ‘বাব লুদ্দ’ নামক স্থানে তাকে পেয়ে তাকে বধ করবেন। এরপর আল্লাহ যাদেরকে দাজ্জাল থেকে রক্ষা করেছেন এমন মানুষদের নিকট তিনি আগমন করবেন। তিনি তাদের মুখমণ্ডল মুছে দিবেন এবং জান্নাতে তাদের মর্যাদার বিষয়ে কথা বলবেন।
এ অবস্থায় আল্লাহ মরিয়মের পুত্র ঈসা (আ)-কে ওহী করবেন যে, আমি আমার এমন একদল বান্দাকে বের করে দিয়েছি যাদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। কাজেই আমার বান্দাদেরকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যাও। তখন আল্লাহ ইয়াজূজ -মাজূজকে প্রেরণ করবেন। সকল জনপদ দিয়ে তারা চলতে থাকবে। তাদের মধ্য থেকে যারা প্রথমে বের হবে তারা তাবারিয়া হ্রদে পৌঁছে হ্রদের সব পানি পান করবে। সব শেষে যারা সে পথ দিয়ে যাবে তারা বলবে: এখানে এক সময় পানি ছিল। আল্লাহর নবী ঈসা (আ) ও তাঁর সাথীরা অবরুদ্ধ থাকবেন। এমনকি একটি ষাড়ের মাথা তাদের কাছে ১০০ স্বর্ণমুদ্রার চেয়েও উত্তম বলে গণ্য হবে। তখন আল্লাহর নবী ঈসা (আ) ও তাঁর সাথীরা আল্লাহর কাছে দুআ করবেন। আল্লাহ ইয়াজূজ-মাজুজদের ঘাড়ে এক জাতীয় কীট প্রেরণ করবেন ফলে তারা সকলেই একযোগে মহামারিতে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহর নবী ঈসা (আ) ও তাঁর সাথীরা পৃথিবীতে নেবে আসবেন। কিন্ত পৃথিবীর এক বিঘত জমিও তাদের পঁচাগলা লাশ থেকে মুক্ত পাবেন না। তখন আল্লাহর নবী ঈসা (আ) ও তাঁর সাথীর আল্লাহর কাছে দুআ করবেন। এরপর আল্লাহ সর্বব্যাপী বৃষ্টি দান করবেন যা বাড়িঘর ও তাঁবুসহ পুরো পৃথিবী ধুয়ে আয়নার মত চকচকে করবে। এরপর যমিনকে বলা হবে: তোমার ফল-ফসল উৎপন্ন কর এবং তোমার বরকত বের কর। তখন একটি বেদানা একদল মানুষেরা ভক্ষণ করবে এবং তার খোসার ছায়া পেতে পারবে। আল্লাহ সম্পদে বরকত প্রদান করবেন। এমনকি একটি উটের দুধ একদল মানুষের চাহিদা মেটাবে, একটি গরুর দুধ একটি গোত্রের চাহিদা মেটাবে, একটি মেষ একদল মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে। এ অবস্থা চলতে থাকবে। এমন সময়ে আল্লাহ একটি পবিত্র বায়ুপ্রবাহ প্রেরণ করবেন যা মানুষদের বগলের নিচে ধরবে এবং সকল মুমিন-মুসলিম ব্যক্তির প্রাণ গ্রহণ করবে। এরপর শুধু খারাপ মানুষগুলোই জীবিত থাকবে। তারা দুনিয়াতে গর্দভের মত অশস্নীলতায় মেতে উঠবে। এদের সময়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে।[5]
দাজ্জাল বিষয়ে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত। এ বিষয়ক হাদীসগুলো থেকে জানা যায় যে, দুটি বিভ্রান্তির উপর এ ফিতনার ভিত্তি: (১) অলৌকিকত্ব বা কারামত দেখে কাউকে ‘অলৌকিক ব্যক্তিত্ব’ বা ‘ওলী’ বলে বিশ্বাস করা এবং (২) ওলী বা কোনো মানুষের মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক শক্তি থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করা। আমরা দেখেছি যে, মুশরিক জাতিগুলোর শিরকের মূল কারণ এ দুটো বিষয়। অবতারত্ব, ফানা, বাকা ইত্যাদি অজুহাতে তারা মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহ, তাঁর কোনো ক্ষমতা বা বিশেষণ মিশ্রিত বা প্রকাশিত হতে পারে বলে বিশ্বাস করেন। তাওহীদ বিষয়ক অজ্ঞতার কারণে বর্তমানে মুসলিম জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও এ দুটি বিশ্বাস ব্যাপক। বর্তমানে বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রায়ই নতুন নতুন ‘ওলী বাবা’ প্রকাশিত হন। কারামতের গল্প শুনে লক্ষলক্ষ মুসলিম এদেরকে ‘অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ওলী’ বলে বিশ্বাস করেন। সাজদা, তাওয়াক্কুল, ভয়, আশা ইত্যাদি ইবাদতে তাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করেন। এ সকল ‘ক্ষুদ্র দাজ্জালের’ ভক্তগণ বিশ্বাস করেন যে, ঝড়-বৃষ্টি, ধন-সম্পদ, জীবন-মৃত্যু সবই তাদের বাবা বা গুরুর ইচ্ছাধীন। এ সকল ‘ক্ষুদ্র দাজ্জাল’ মহা দাজ্জালকে গ্রহণ করার প্রেক্ষাপট তৈরি করছে। যারা ছোট দাজ্জালদেরকে ‘কারামতের গল্প’ শুনেই মেনে নিচ্ছেন, স্বভাবতই ‘কানা দাজ্জাল’-এর মহা ‘কারামত’ দেখে তাকে বিনা দ্বিধায় মেনে নিবেন। এমনকি যারা ছোট দাজ্জালদের বিশ্বাস করে নি তারাও কানা দাজ্জালের মহা ‘কারামত’ দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। শুধু তাওহীদ ও রিসালাতের গভীর ঈমান এবং মহান আল্লাহর তাওফীক ও রহমতই মুমিনকে এ ফিতনা থেকে রক্ষা করবে।
মহান আল্লাহ বান্দাদের পরীক্ষার জন্য দাজ্জালকে কিছু ক্ষমতা প্রদানের সাথে সাথে তার অক্ষমতা প্রকাশিত রাখবেন। সে নিজের নষ্ট চক্ষুটি ভাল করতে সক্ষম হবে না। যেন সচেতন মুমিন বুঝতে পারেন যে, সে সীমাবদ্ধ ক্ষমতার সৃষ্টি মাত্র। কিন্তু ঈমানের গভীরতা না থাকলে এ সীমাবদ্ধতা মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় অথবা ভক্তিভরে তা ব্যাখ্যা করে। যেমন বর্তমানের ক্ষুদ্র দাজ্জালদের ভক্তগণ তাদের গুরুদের অক্ষমতা ব্যাখ্যা করে।
অতীত ও বর্তমানে বিভিন্ন বিভ্রান্ত দল দাজ্জাল বিষয়ক হাদীসগুলোকে রূপক অর্থে গ্রহণ করে নানা প্রকার উদ্ভট ব্যাখ্যা করেছে। তারা দাজ্জাল বলতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। এ প্রসঙ্গে ইমাম নববী (৭৬৭ হি) বলেন: ‘‘কাযী ইয়ায (৫৪৪ হি) বলেন: ‘‘মুসলিম এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস দাজ্জালের বিষয়ে যে সকল হাদীস উদ্ধৃত করেছেন সেগুলো হক্কপন্থীদের দলীল। তারা দাজ্জালের অসিত্মত্বে বিশ্বাস করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, দাজ্জাল বলতে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যার দ্বারা আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করবেন এবং যাকে তাঁর ক্ষমতাধীন কিছু বিষয়ের ক্ষমতা প্রদান করবেন।... ঈসা (আ) তাকে হত্যা করবেন। এটিই আহলুস সুন্নাত এবং সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ ও গবেষকের মত। খারিজীগণ, জাহমীগণ এবং মুতাযিলীদের কেউ কেউ দাজ্জালের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন....।’’[6]
মুমিনের দায়িত্ব সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসগুলো সরল ও বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষা অনুসারে দাজ্জালের ফিতনা থেকে সংরক্ষণের জন্য দুআ করা। বিভিন্ন হাদীসে তিনি দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার দুআ শিখিয়েছেন এবং সূরা কাহ্ফ-এর প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ ও পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ক কয়েকটি দুআ ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি।
[1] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২১৪, ৬/২৬০৭; মুসলিম আস- সহীহ ৪/২২৪৫ (কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাতুস সাআ, বাবু যিকরি ইবনিস সাইয়াদ, নং ১৬৯)
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৫০ (কিতাবুল ফিতান..., যিকরিদ্দাজ্জাল)
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬০৮; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৫৬।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৯৫; মুসলিম ৪/২২৪৮।
[5] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৫১-২২৫৫।
[6] নববী, শারহ সহীহ মুসলিম ১৮/৫৮।
৯. ৯. ঈসা (আ)-এর অবতরণ
কিয়ামতের বড় আলামতগুলোর অন্যতম ঈসা (আ)-এর অবতরণ। এ বিষয়ে কুরআনের নির্দেশনা আমরা দেখেছি। কুরআনের পাশাপাশি বহুসংখ্যক সাহাবীর সূত্রে মুতাওয়াতির হাদীসে তাঁর অবতরণের বিষয়টি প্রমাণিত। উপরে আমরা এ অর্থে চারটি হাদীস দেখেছি। অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَيُوشِكَنَّ أَنْ يَنْزِلَ فِيكُمُ ابْنُ مَرْيَمَ
حَكَمًا مُقْسِطًا فَيَكْسِرَ الصَّلِيبَ ، وَيَقْتُلَ الْخِنْزِيرَ ، وَيَضَعَ
الْجِزْيَةَ ، وَيَفِيضَ الْمَالُ حَتَّى لاَ يَقْبَلَهُ أَحَدٌ، حَتَّى تَكُونَ
السَّجْدَةُ الْوَاحِدَةُ خَيْرًا مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا
‘‘যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, অচিরেই তোমাদের মাঝে মরিয়মের পুত্র ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে অবতরণ করবেন। তিনি ক্রুশ ভাঙবেন, শূকর বধ করবেন, জিযিয়া তুলে দিবেন এবং সম্পদের প্রাচুর্য দেখা দেবে। এমনকি কেউ সম্পদ গ্রহণ করবে না, এমনকি একটি সাজদার মূল্য দুনিয়া ও তার সব সম্পদের চেয়ে বেশি বলে গণ্য হবে।’’[1]
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
الأَنْبِيَاءُ إِخْوَةٌ لِعَلاَّتٍ أُمَّهَاتُهُمْ شَتَّى وَدِينُهُمْ وَاحِدٌ
وَأَنَا أَوْلَى النَّاسِ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ لأَنَّهُ لَمْ يَكُنْ بَيْنِى
وَبَيْنَهُ نَبِىٌّ وَإِنَّهُ نَازِلٌ فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَاعْرِفُوهُ رَجُلاً
مَرْبُوعاً إِلَى الْحُمْرَةِ وَالْبَيَاضِ عَلَيْهِ ثَوْبَانِ مُمَصَّرَانِ
كَأَنَّ رَأْسَهُ يَقْطِرُ وَإِنْ لَمْ يُصِبْهُ بَلَلٌ فَيَدُقُّ الصَّلِيبَ
وَيَقْتُلُ الْخِنْزِيرَ وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ وَيَدْعُو النَّاسَ إِلَى
الإِسْلاَمِ فَيُهْلِكُ اللَّهُ فِى زَمَانِهِ الْمِلَلَ كُلَّهَا إِلاَّ
الإِسْلاَمَ وَيُهْلِكُ اللَّهُ فِى زَمَانِهِ الْمَسِيحَ الدَّجَّالَ وَتَقَعُ
الأَمَنَةُ عَلَى الأَرْضِ حَتَّى تَرْتَعَ الأُسُودُ مَعَ الإِبِلِ وَالنِّمَارُ
مَعَ الْبَقَرِ وَالذِّئَابُ مَعَ الْغَنَمِ وَيَلْعَبَ الصِّبْيَانُ
بِالْحَيَّاتِ لاَ تَضُرُّهُمْ فَيَمْكُثُ أَرْبَعِينَ سَنَةً ثُمَّ يُتَوَفَّى
وَيُصَلِّى عَلَيْهِ الْمُسْلِمُونَ
‘‘নবীগণ বৈমাত্রেয় ভাইদের মত; তাঁদের মাতৃগণ পৃথক হলেও তাঁদের দীন একই। মরিয়মের পুত্র ঈসার বিষয়ে আমারই অধিকার বেশি; কারণ তাঁর ও আমার মাঝে কোনো নবী নেই। তিনি অবতরণ করবেন। যখন তোমরা তাঁকে দেখবে তাঁকে চিনবে: তিনি মধ্যমাকৃতির লালচে-শুভ্র মানুষ। তাঁর পরিধানে হালকা হলুদ রঙের দুটি কাপড় থাকবে। (পরিচ্ছন্নতার কারণে) তাঁর মাথায় পানি স্পর্শ না করলেও মনে হয় যে তা থেকে পানি পড়ছে। তিনি ক্রুশ ভাঙবেন, শূকর বধ করবেন, জিযিয়া অপসারণ করবেন, সকল মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকবেন। তাঁর সময়ে ইসলাম ছাড়া অন্য সকল ধর্ম বিলুপ্ত হবে। তাঁর সময়েই মাসীহ দাজ্জালকে আল্লাহ ধ্বংস করবেন। এরপর পৃথিবীতে শান্তি-নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে। এমনকি উটের সাথে সিংহ, গরুর সাথে বাঘ ও মেষের সাথে চিতা চরবে। শিশুরা সাপ নিয়ে খেলবে কিন্তু সাপ তাদের ক্ষতি করবে না। তিনি চল্লিশ বৎসর অবস্থান করবেন। এরপর তিনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং মুসলিমগণ তাঁর জানাযা আদায় করবে।[2]
আরো অনেক হাদীস এ বিষয় বর্ণিত। মুমিনের দায়িত্ব এ বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা সরল অর্থে বিশ্বাস করা। কিয়ামতের আলামতগুলো বর্ণনামূলক। এগুলো ঘটবে বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানিয়েছেন। ঘটার পরে বিশ্বাস করা ছাড়া মুমিনের অন্য কোনো দায়িত্ব নেই। ঈসা (আ) বিষয়ক সকল ভবিষ্যদ্বাণী যখন প্রকাশিত হবে, তখন সে যুগের মুমিনগণ বলবেন, আল-হামদু লিল্লাহ, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, কোনো আলামত পরিপূর্ণ প্রকাশিত হওয়ার আগে তা নিয়ে গবেষণা-বিতর্ক বা বিশ্বাস বিভ্রান্তির দরজা উন্মুক্ত করে।
[1] বুখারী, আস-সহীহ ২/৭৭৪, ৩/১২৭২; মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩৫ (ঈমান, নুযূল ঈﷺ..)
[2] আহমদ, আল-মুসনাদ ২/৪০৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৪৮; আলবানী, সাহীহাহ ৫/১৮১। হাদীসটির সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ।
৯. ১০. ঈসা (আ) হওয়ার দাবিদার
উম্মাতের মধ্যে মেহেদী হওয়ার দাবিদার শত শত হলেও নিজেকে ঈসা ইবন মরিয়ম বলে দাবি করার মত পাগল পূর্বে পাওয়া যায় নি। কারণ সকল হাদীসেই বলা হয়েছে যে, তিনি মরিয়মের বেটা ঈসা। কাজেই অন্য কোনো ব্যক্তি একেবারে বদ্ধ পাগল না হলে নিজেকে মরিয়মের বেটা বলে দাবি করতে পারে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে মরিয়মের বেটা ঈসা বলে দাবি করে।
ইবন মাজাহ অত্যন্ত দুর্বল সনদের একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
لاَ الْمَهْدِىُّ إِلاَّ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ
‘‘ঈসা ইবন মরিয়ম ভিন্ন মাহদী নেই।’’[1]
হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী মুহাম্মাদ ইবনু খালিদ জানাদী অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি এবং হাদীসটির সনদে বিভিন্ন অসঙ্গতি বিদ্যমান। মুহাদ্দিসগণ একমত যে হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল। অনেকে হাদীসটিকে জাল বলে নিশ্চিত করেছেন।[2] এ হাদীসটি সহীহ হলে এর দ্বারা মাহদীর অস্তিত্ব অস্বীকার করা যেত, কিন্তু কোনোভাবেই মরিয়মের পুত্র ঈসা (আ)-এর অবতরণ অস্বীকার করা যেত না। কিন্তু কাদিয়ানী সম্প্রদায় ঠিক বিপরীত করেছে। গোলাম আহমদ প্রথমে নিজেকে ওলী, এরপর মুজাদ্দিদ, এরপর মাহদী, এরপর ঈসা এবং সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ নবী বলে দাবি করে। এ জাল হাদীসে বলা হয়েছে ‘ঈসা (আ) ভিন্ন পৃথক কোনো মাহদী নেই।’ আর সে এ জাল হাদীসটির জাল অর্থ করে সে বলে ‘‘মাহদী ছাড়া পৃথক কোনো ঈসা নেই।’ এরপর সে ও তার অনুসারীরা এ জাল অর্থটিকেই ‘ঈমান’ এর মূল বানিয়েছে।
সর্বোপরি, কাদিয়ানীর সকল দাবি-দাওয়াই সন্দেহাতীতভাবে মিথ্যা বলে প্রমাণিত। সে রাজত্ব লাভ করে নি, ৪০ বৎসর রাজত্ব করে নি, ইনসাফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করে নি... মাহদী বা ঈসা (আ) কারো কোনো আলামতই তার মধ্যে পাওয়া যায় নি। তবুও লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে মাহদী ও ঈসা নামে বিশ্বাস করছে!
খাতমুন নুবুওয়াত বা নুবুওয়াতের পরিসমাপ্তির ঘোষণা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অন্যতম মুজিযা। ইহূদী জাতির ইতিহাসে আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পূর্বে নুবুওয়াতের ধারা তাদের মধ্যে অব্যাহত ছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরে বিগত দেড় হাজার বৎসরে তাদের মধ্যে একজনও নবী আসেন নি। তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে না মানলেও বাস্তবে মেনে নিয়েছে যে, নুবুওয়াতের ধারা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অথচ মুসলিম নামধারীদের মধ্যে গোলাম আহমদকে নবী বলে বিশ্বাস করা মানুষ পাওয়া যায়!!
[1] ইবন মাজাহ, আস-সুনান ২/১৩৪০।
[2] আলবানী, যায়ীফাহ ১/১৭৫ (নং ৭৭)।
৯. ১১. ঈসায়ী প্রচারকদের প্রতারণা
এর বিপরীতে খৃস্টান মিশনারিগণ ঈসা (আ)-এর অবতরণ বিষয়ে মুসলিমদের বিশ্বাস বিকৃত করে প্রতারণামূলকভাবে মুসলিমদেরকে খৃস্টান বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। সরলপ্রাণ মুসিলমদেরকে তারা বলেন: যেহেতু ঈসা মাসীহ আবার আসবেন, কাজেই এখনই আমাদের সকলের দায়িত্ব তার ধর্ম গ্রহণ করে প্রস্ততি গ্রহণ করা!
বস্ত্তত বিগত দেড় হাজার বছরে খৃস্টান মিশনারিগণ মুসলিমদেরকে ধর্মান্তর করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্য গত শতকের শেষ দিকে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মুসলিমদেরকে মুসলিম সেজে ধর্মান্তর করার। তারা তাদের গ্রন্থগুলো ইসলামী পরিভাষায় রূপান্তর করেছেন এবং মুসলিমদের মধ্যে বলে বেড়াচ্ছেন যে, তারা খৃস্টান নন; তারা ঈসায়ী মুসলমান, তারা কুরআন, ইঞ্জিল, তাওরাত, যাবুর সবই মানেন, তাঁরা মুহাম্মাদ (ﷺ) ও ঈসা (আ) উভয়কেই মানেন...। এ জাতীয় অগণিত মিথ্যাচারের পাশাপাশি তারা কুরআনের বিভিন্ন আয়াত উদ্ধৃত করে দাবি করেন যে, এ সকল আয়াত তাদের ধর্ম সঠিক বলে প্রমাণ করে। তাদের এ সকল প্রতারণার স্বরূপ জানতে আমার লেখা ‘‘কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম’’ পুস্তিকাটি পাঠ করতে অনুরোধ করছি। এখানে ঈসা মাসীহের অবতরণ বিষয়ক বিভ্রান্তি সংক্ষেপে পর্যালোচনা করব।
প্রচলিত ইঞ্জিলে বারবার বলা হয়েছে যে, ঈসা (আ) তাঁর ভক্তদের জীবদ্দশাতেই কিয়ামত ঘটার ও তাঁর পুনরাগমনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে প্রতিশ্রুত শতভাগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফ নামক পুস্তকের নিম্নের কয়েকটি উদ্ধৃতি দেখুন:
(১) ‘‘কেননা মনুষ্যপুত্র আপন দূতগণের (angels) সহিত আপন পিতার প্রতাপে আসিবেন, আর তখন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাহার ক্রিয়ানুসারে প্রতিফল দিবেন। আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, যাহারা এখানে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, তাহাদের মধ্যে এমন কয়েক জন আছে, যাহারা কোন মতে মৃত্যুর আস্বাদ পাইবে না, যে পর্যন্ত মনুষ্যপুত্রকে আপনার রাজ্যে আসিতে না দেখিবে।’’ মথি ১৬/২৭-২৮।
(২) ‘‘আমরা প্রভুর বাক্য দ্বারা তোমাদিগকে ইহা বলিতেছি যে, আমরা যাহারা জীবিত আছি, যাহারা প্রভুর আগমন পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকিব, আমরা কোন ক্রমেই সেই নিদ্রাগত লোকদের অগ্রগামী হইব না। কারণ প্রভু স্বয়ং আনন্দধ্বনি সহ, প্রধান দূতের রব সহ, এবং ঈশ্বরের তূরীবাদ্য সহ স্বর্গ হইতে নামিয়া আসিবেন, আর যাহারা খ্রীষ্টে মরিয়াছে তাহারা প্রথমে উঠিবে। পরে আমরা যাহারা জীবিত আছি, যাহারা অবশিষ্ট থাকিব, আমরা আকাশে প্রভুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত একসঙ্গে তাহাদের সহিত মেঘযোগে নীত হইব; আর এইরূপে সতত প্রভুর সঙ্গে থাকিব।’’ ১ থিষলনীকীয় ৪/১৫-১৭।
(৩) ‘‘দেখ, আমি তোমাদিগকে এক নিগূঢ়তত্ত্ব বলি; আমরা সকলে নিদ্রাগত হইব না (মরিব না), কিন্তু সকলে রূপান্তরীকৃত হইব; এক মুহূর্তের মধ্যে, চক্ষুর পলকে, শেষ তূরীধ্বনিতে হইবে; কেননা তূরী (সিঙ্গা) বাজিবে, তাহাতে মৃতেরা অক্ষয় হইয়া উত্থাপিত হইবে, এবং আমরা রূপান্তরীকৃত হইব।’’ ১ করিন্থীয় ১৫/৫১-৫২।
(৪) ‘‘আর তিনি আমাকে কহিলেন, তুমি এ গ্রন্থের ভাববাণীর বচন সকল মুদ্রাঙ্কিত করিও না (লিখিও না); কেননা সময় (কিয়ামত) সন্নিকট। যে অধর্মচারী, সে ইহার পরেও অধর্মাচরণ করুক এবং যে কলুষিত, সে ইহার পরেও কলুষিত হউক; এবং যে ধার্মিক, সে ইহার পরেও ধর্মাচরণ করুক; এবং যে পবিত্র, সে ইহার পরেও পবিত্রকৃত হউক।’’ (প্রকাশিত বাক্য/ প্রকাশিত কালাম ২২/১০-১১)
খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফ ঈসা (আ)-কে অত্যন্ত অবমানাকরভাবে চিত্রিত করেছে। যেমন, তিনি মানুষদেরকে গালি দিতেন (মথি ১৬/২৩, ২৩/১৩-৩৩), অন্য বংশ বা ধর্মের মানুষদের শূকর ও কুকুর বলতেন (মথি ৭/৬; ১৫/২২-২৮, মার্ক ৭/২৫-২৯), পূর্ববর্তী নবীদেরকে চোর-ডাকাত বলতেন (যোহন ১০/৭-৮), নিরপরাধ মানুষদেরকে অভিশাপ দিতেন (মথি ২৩/৩৫-৩৬), অকারণে হত্যা করতেন (মথি ২১/১৮-২১, মার্ক ৫/১০-১৪; ১১/১২-২২), অবিশ্বাসীদেরকে নির্বিচারে ধরে ধরে জবাই করার নির্দেশ দিতেন (লূক ১৯/২৭), মিথ্যা বলতেন (মথি ১৬/২৭-২৮: ১৯/২৮: মার্ক ২/২৫-২৬, ১১/২৩, ১৬/১৭-১৮: লূক ১৮/২৯-৩০, যোহন ৩/১৩), মদ পান করে মাতাল হতেন (লূক ৭/৩৪-৫০, যোহন ১৩/৪-৫), বেশ্যা মেয়েদেরকে তাঁকে স্পর্শ করতে ও চুম্বন করতে দিতেন (লূক ৭/৩৪-৫০, ৮/১-৩, যোহন ১১/১-৫), নিজের মায়ের সাথে ভয়ঙ্কর বেয়াদবি করেছেন, (মথি ১২/৪৬-৫০; মার্ক ৩/৩১-৩৫; লূক ৮/১৯-২১, যোহন ২/৪, ১৯/২৬), তিনি অত্যন্ত ভীত ও কাপরুষ ছিলেন (মথি ২৬/৩৬-৪৬, ২৭/৩৮-৫১; লূক ২২/৪১-৪৬, মার্ক ১৫/২৭-৩৮)। সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা ঈসা (আ)-কে ‘মালউন’ বা অভিশপ্ত বলে দাবি করেছেন। (গালাতীয় ১০-১৩)। (নাঊযু বিল্লাহ!)
খৃস্টান প্রচারককে বলুন, আপনারা ঈসা (আ)-এর অনুসারী নন, আপনারা সাধু পলের অনুসারী। আপনার ঈসা (আ)-কে অপমানিত করেছেন এবং তাঁর নাম ভাঙ্গিয়ে শিরক-কুফর প্রচার করেছেন। তিনি অবতরণ করে প্রথমে আপনাদের মত মিথ্যচারীদেরকেই ধ্বংস করবেন। কাজেই তাঁর বিষয়ে সাধুপলের মিথ্যা ধর্ম পরিত্যাগ করে কুরআনের বিশুদ্ধ বিশ্বাস গ্রহণ করে তাঁর পুনরাগমনের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন।
শেষ কথা
ইমাম আবূ হানীফা (রা) তাঁর ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের শেষ বাক্যে বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।’’
বাহ্যত তিনি বুঝাচ্ছেন যে, কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিশুদ্ধ আকীদা বর্ণনা করাই আমাদের দায়িত্ব। কাউকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ক্ষমতা তো আমাদের নেই। রাব্বুল আলামীনের কাছে হেদায়াত ও তাওফীক প্রার্থনাই মুমিনের দায়িত্ব। সূরা ফাতিহাতে মহান আল্লাহ আমাদেরকে এরূপ দুআ করতে শিক্ষা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মহান আল্লাহর কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করে দুআ শিখিয়েছেন। আয়েশা (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাহাজ্জুদের সালাতের শুরুতে নিম্নের দুআটি পাঠ করতেন:
اَللّهُمَّ رَبَّ جِبْرَائِيْلَ وَمِيْكَائِيْلَ وَإِسْرَافِيْلَ فَاطِرَ
السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ
بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ اهْدِنِيْ لِمَا اخْتُلِفَ
فِيْهِ مِنْ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ تَهْدِيْ مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ
مُسْتَقِيْمٍ
‘‘হে আল্লাহ, জিবরাঈল, মিকাঈল ও ইসরাফীলের প্রভু, আসমানসমূহ ও পৃথিবীর স্রষ্টা, দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, আপনার বান্দারা যে সকল বিষয় নিয়ে মতভেদ করত তাদের মধ্যে সে বিষয়ে আপনিই ফয়সালা প্রদান করবেন। যে সকল বিষয়ে সত্য বা হক্ক নির্ধারণে মতভেদ হয়েছে সে সকল বিষয়ে আপনি আপনার অনুমতিতে আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আপনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকে সিরাতুল মুস্তাকিমে পরিচালিত করেন।’’[1]
আমরা এ দুআর মাধ্যমেই ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা শেষ করছি। সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ), তাঁর পরিজন ও সাহবীগণের উপর। প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর নিমিত্ত।
[1] মুসলিম (৬-কিতাব সালাতিল মুসাফিরীন, ২৬-বাবুদ দুআ ফী সালাতিল লাইল) ১/৫৩৪ (ভা ১/২৬৩)।
No comments