আল-ফিকহুল আকবর অধ্যায়-০৮ - মুরজিয়া মতবাদ, নেক আমল, মুজিযা-কারামত, আখিরাত, ঈমান-ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
মুরজিয়া মতবাদ, নেক আমল, মুজিযা-কারামত, আখিরাত, ঈমান-ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গে ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত (রাহ) যা বলেন
ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত (রাহ) বলেন:
وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّ الْمُؤْمِنَ لاَ يَضُرُّهُ الذُّنُوْبُ، وَلاَ نَقُوْلُ:
إِنَّهُ لاَ يَدْخُلُ النَّارَ، وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّهُ يَخْلُدُ فِيْهَا، وَإِنْ
كَانَ فَاسِقاً بَعْدَ أَنْ يَخْرُجَ مِنَ الدُّنْيَا مُؤْمِناً. وَلاَ نَقُوْلُ:
إِنَّ حَسَنَاتِنَا مَقْبُوْلَةٌ وَسَيِّئَاتِنَا مَغْفُوْرَةٌ كَقَوْلِ
الْمُرْجِئَةِ. وَلَكِنْ نَقُوْلُ: الْمَسْأَلَةُ مُبَيَّنَةٌ مُفَصَّلَةٌ: مَنْ
عَمِلَ حَسَنَةً بِجَمِيْعِ شَرَائِطِهَا خَالِيَةً عَنِ الْعُيُوْبِ الْمُفْسِدَةِ
وَالْمَعَانِيْ الْمُبْطِلَةِ وَلَمْ يُبْطِلْهَا بِالْكُفْرِ وَالرِّدَّةِ
وَالأَخْلاَقِ السَّيِّئَةِ حَتَّى خَرَجَ مِنَ الدُّنْيَا مُؤْمِناً فَإِنَّ
اللهَ تَعَالَى لاَ يُضَيِّعُهَا بَلْ يَقْبَلُهَا مِنْهُ وَيُثِيْبُهُ عَلَيْهَا
. وَمَا كَانَ مِنَ السَّيِّئَةِ دُوْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ وَلَمْ يَتُبْ
عَنْهَا صَاحِبُهَا حَتَّى مَاتَ مُؤْمِناً فَإِنَّهُ فِيْ مَشِيْئَةِ اللهِ
تَعَالَى بِقَوْلِهِ إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ بِالنَّارِ، وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ
وَلَمْ يُعَذِّبْهُ بِالنَّارِ أَصْلاً. وَالرِّيَاءُ إِذَا وَقَعَ فِيْ عَمَلٍ
مِنَ الأَعْمَالِ فَإِنَّهُ يُبْطِلُ أَجْرَهُ، وَكَذَلِكَ الْعُجْبُ.
وَالآيَاتُ ثَابِتَةٌ لِلأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ،
وَالْكَرَامَاتُ لِلأَوْلِيَاءِ حَقٌّ. وَأَمَّا الَّتِيْ تَكُوْنُ ِلأَعْدَائِهِ
مِثْلِ إِبْلِيْسَ وَفِرْعَوْنَ وَالدَّجَّالِ مِِمَّا رُوِيَ فِيْ الأَخْبَارِ
أَنَّهُ كَانَ وَيَكُوْنُ لَهُمْ لاَ نُسَمِّيْهَا آَيَاتٍ وَلاَ كَرَامَاتٍ،
وَلكِنْ نُسَمِّيْهَا قَضَاءَ حَاجَاتٍ لَهُمْ، وَذَلِكَ ِلأَنَّ اللهَ تَعَالَى
يَقْضِيْ حَاجَاتِ أَعْدَائِهِ اسْتِدْرَاجاً لَهُمْ وَعُقُوْبَةً لَهُمْ
فَيَغْتَرُّوْنَ بِهِ وَيَزْدَادُوْنَ طُغْيَاناً وَكُفْراً، وَذَلِكَ كُلُّهُ
جَائِزٌ وَمُمْكِنٌ. وَكَانَ اللهُ تَعَالَي خَالِقاً قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ،
وَرَازِقاً قَبْلَ أَنْ يَرْزُقَ.
وَاللهُ تَعَالَي يُرَي فِيْ الآخِرَةِ، وَيَرَاهُ الْمُؤْمِنُوْنَ وَهُمْ فِيْ
الْجَنَّةِ بِأَعْيُنِ رُؤُوْسِهِمْ بِلاَ تَشْبِيْهٍ وَلاَ كَيْفِيَّةٍ وَلاَ
يَكُوْنَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ خَلْقِهِ مَسَافَةٌ.
وَالإِيْمَانُ هُوَ الإِقْرَارُ وَالتَّصْدِيْقُ، وَإِيْمَانُ أَهْلِ السَّمَاءِ
وَالأَرْضِ لاَ يَزِيْدُ وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ جِهَةِ الْمُؤْمَنِ بِهِ، وَيَزِيْدُ
وَيَنْقُصُ مِنْ جِهَةِ الْيَقِيْنِ وَالتَّصْدِيْقِ. وَالْمُؤْمِنُوْنَ
مُسْتَوُوْنَ فِيْ الإِيْمَانِ وَالتَّوْحِيْدِ مُتَفَاضِلُوْنَ بِالأَعْمَالِ.
وَالإِسْلاَمُ هُوَ التَّسْلِيْمُ وَالاِنْقِيَادُ ِلأَوَامِرِ اللهِ تَعَالَي.
فَمِنْ طَرِيْقِ اللُّغَةِ فَرْقٌ بَيْنَ الإِيْمَانِ وَالإِسْلاَمِ. وَلَكِنْ لاَ
يَكُوْنُ إِيْمَانٌ بِلاَ إِسْلاَمٍ، وَلاَ يُوْجَدُ إِسْلاَمٌ بِلاَ إِيْمَانٍ،
وَهُمَا كَالظَّهْرِ مَعَ الْبَطْنِ، وَالدِّيْنُ اسْمٌ وَاقِعٌ عَلَي الإِيْمَانِ
وَالإِسْلاَمِ وَالشَّرَائِعِ كُلِّهَا. نَعْرِفُ اللهَ تَعَالَي حَقَّ
مَعْرِفَتِهِ كَمَا وَصَفَ اللهُ نَفْسَهُ فِيْ كِتَابِهِ بِجَمِيْعِ صِفَاتِهِ،
وَلَيْسَ يَقْدِرُ أَحَدٌ أَنْ يَعْبُدَ اللهَ حَقَّ عِبَادَتِهِ كَمَا هُوَ
أَهْلٌ لَهُ، وَلَكِنَّهُ يَعْبُدُهُ بِأَمْرِهِ كَمَا أَمَرَهُ بِكِتَابِهِ
وَسُنَّةِ رَسُوْلِهِ ﷺ. وَيَسْتَوِيْ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ فِيْ
الْمَعْرِفَةِ وَالْيَقِيْنِ وَالتَّوَكُّلِ وَالْمَحَبَّةِ وَالرِّضَا
وَالْخَوْفِ وَالرَّجَاءِ وَالإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ، وَيَتَفَاوَتُوْنَ فِيْمَا
دُوْنَ الإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ كُلِّهِ. وَاللهُ تَعَالَي مُتَفَضِّلٌ عَلَي
عِبَادِهِ عَادِلٌ، قَدْ يُعْطِيْ مِنَ الثَّوَابِ أَضْعَافَ مَا يَسْتَوْجِبُهُ
الْعَبْدُ تَفَضُّلاً مِنْهُ، وَقَدْ يُعَاقِبُ عَلَي الذَّنْبِ عَدْلاً مِنْهُ.
وَقَدْ يَعْفُوْ فَضْلاً مِنْهُ.
وَشَفَاعَةُ الأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ حَقٌّ، وَشَفَاعَةُ نَبِيِّنَا ﷺ
لِلْمُؤْمِنِيْنَ الْمُذْنِبِيْنَ وَلأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْهُم
الْمُسْتَوْجِبِيْنَ الْعِقَابَ حَقٌّ ثَابِتٌ، وَوَزْنُ الأَعْمَالِ
بِالْمِيْزَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَقٌّ، وَالْوَزْنُ وَالْقِصَاصُ فِيْمَا
بَيْنَ الْخُصُوْمِ بِالْحَسَنَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَقٌّ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ
لَهُمُ الْحَسَنَاتُ فَطَرْحُ السَّيِّئَاتِ عَلَيْهِمْ حَقٌّ جَائِزٌ. وَحَوْضُ
النِّبِيِّ ﷺ حَقٌّ. وَالْجَنَّةُ وَالنَّارُ مَخْلُوْقَتَانِ الْيَوْمَ لاَ
تَفْنَيَانِ أَبَداً. وَلاَ تَمُوْتُ الْحُوْرُ الْعِيْنُ أَبَداً، وَلاَ يَفْنَى
عِقَابُ اللهِ تَعَالَي وَثَوَابُهُ سَرْمَداً.
বঙ্গানুবাদ:
আমরা বলি না যে, পাপ মুমিনের কোনো ক্ষতি করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। মুমিন যদি ফাসিক বা পাপী হয় কিন্তু ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করে তবে তার বিষয়ে আমরা এরূপ বলি না। আমরা বলি না যে, আমাদের নেক কর্মগুলো কবুলকৃত এবং পাপরাশি ক্ষমাকৃত। মুরজিয়াগণ এরূপ বলে। বরং আমরা বলি যে, এ বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। যে ব্যক্তি সকল শর্ত পূরণ করে এবং সকল বিনষ্টকারী ত্রুটি হতে মুক্ত থেকে কোনো নেক কর্ম করবে এবং কুফর বা ধর্মত্যাগ দ্বারা (বা অশোভন আচরণ দ্বারা)[1] তার নেককর্মটি বিনষ্ট করবে না এবং ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করবে আল্লাহ তার কর্মটি নষ্ট করবেন না, বরং তিনি তা কবুল করবেন এবং তাকে তার জন্য সাওয়াব প্রদান করবেন। কোনো মানুষ যদি শির্ক ও কুফর ছাড়া অন্য কোনো পাপ কর্ম করে তাওবা না করে ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করে তবে তার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন থাকবে। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে জাহান্নামের মধ্যে শাস্তি দিবেন, আর ইচ্ছা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে জাহান্নামে কোনোরূপ শাস্তিই দিবেন না। রিয়া যদি কোনো কর্মের মধ্যে প্রবেশ করে তবে তা সে কর্মের পুরস্কার বাতিল করে দেয়। ‘উজব’ও তদ্রূপ।
নবীগণের জন্য ‘আয়াত’ প্রমাণিত। এবং ওলীগণের কারামত সত্য। আর ইবলীস, ফিরাউন, দাজ্জাল ও তাদের মত আল্লাহর দুশমনদের দ্বারা যে সকল অলৌকিক কর্ম সাধিত হয়, যে সকল অলৌকিক কর্মের বিষয়ে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের দ্বারা তা সংঘটিত হয়েছিল বা হবে, সেগুলোকে আমরা আয়াত বা কারামত বলি না, বরং এগুলোকে আমরা তাদের ‘কাযায়ে হাজাত’ বা প্রয়োজন মেটানো বলি। কারণ আল্লাহ তাঁর দুশমনদের প্রয়োজন মিটিয়ে দেন ‘ইসতিদরাজ’ হিসেবে -তাদেরকে তাদের পথে সুযোগ দেওয়ার জন্য- এবং তাদের শাস্তি হিসেবে। এতে তারা ধোঁকাগ্রস্ত হয় এবং আরো বেশি অবাধ্যতা ও অবিশ্বাসে নিপতিত হয়। এগুলি সবই সম্ভব।
মহান আল্লাহ স্রষ্টা ছিলেন সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই। তিনি রিয্কদাতা ছিলেন সৃষ্টিকে রিয্ক প্রদানের পূর্ব থেকেই। আর আখিরাতে মহান আল্লাহ পরিদৃষ্ট হবেন। জান্নাতের মধ্যে অবস্থানকালে মুমিনগণ তাঁকে দর্শন করবেন তাদের নিজেদের চর্মচক্ষু দ্বারা। এ দর্শন সকল তুলনা ও স্বরূপ-প্রকৃতি নির্ধারণ ব্যতিরেকে। মহান আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো দূরত্ব হবে না।
ঈমান হচ্ছে (মুখের) স্বীকৃতি ও (অন্তরের) সত্যায়ন। বিশ্বাসকৃত বিষয়াদির দিক থেকে (আরকানুল ঈমানের দিক থেকে)) আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের ঈমান বাড়ে না এবং কমে না, কিন্তু ইয়াকীন বা বিশ্বাসের দৃঢ়তা-গভীরতা ও সত্যায়নের দিক থেকে ঈমান বাড়ে এবং কমে। এভাবে ঈমান ও তাওহীদের ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। কর্মের ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে।
ইসলাম অর্থ আল্লাহর নির্দেশের জন্য আত্মসমর্পন করা এবং অনুগত হওয়া। আভিধানিকভাবে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তবে বাস্তবে ও ব্যবহারে ইসলাম ছাড়া কোনো ঈমান হয় না এবং ঈমান ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কাজেই ঈমান ও ইসলাম হলো পিঠের সাথে পেটের ন্যায়। ঈমান, ইসলাম ও সমস্ত শরীয়তকে একত্রে দীন বলা হয়।
মহান আল্লাহর সত্যিকার মা’রিফাত (পরিচয়) আমরা লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। তবে কেউই মহান আল্লাহর সঠিক পরিপূর্ণ ইবাদত করতে সক্ষম নয়, যেরূপ ইবাদত তাঁর পাওনা। বান্দা তাঁর ইবাদত করে তাঁর নির্দেশ মত, যেভাবে তিনি তাঁর কিতাবে এবং তাঁর রাসূলের (ﷺ) সুন্নাতে নির্দেশ দিয়েছেন। মারিফাত (পরিচয় লাভ), ইয়াকীন (বিশ্বাস), তাওয়াক্কুল (নির্ভরতা), মহববত (ভালবাসা), রিযা (সন্তুষ্টি), খাওফ (ভয়), রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের উপর করুণাকারী ও ন্যায়বিচারক। তিনি মেহেরবানি করে অনেক সময় বান্দার প্রাপ্য সাওয়াবের চেয়ে অনেকগুণ বেশি পুরস্কার প্রদান করেন। কখনো তিনি ন্যায়বিচার হিসেবে পাপের শাস্তি প্রদান করেন। কখনো মেহেরবানি করে পাপ ক্ষমা করেন।
নবীগণের শাফা‘আত সত্য। পাপী মুমিনগণ এবং কবীরা গোনাহকারীগণের জন্য, পাপের কারণে যাদের জাহান্নাম পাওনা হয়েছিল তাদের জন্য কিয়ামাতের দিন আমাদের নবী (ﷺ)-র শাফা‘আতও সত্য। কিয়ামাতের দিন তুলাদন্ডে আমল ওযন করাও সত্য। কিয়ামাতের দিন বিবাদকারীদের মধ্যে পুণ্যকর্মের মাধ্যমে বদলার ব্যবস্থা করা সত্য। যদি তাদের সাওয়াব বা নেককর্ম না থাকে তবে পাওনাদারের পাপ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও সত্য ও সম্ভব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাউয সত্য। জান্নাত ও জাহান্নাম বর্তমানে সৃষ্ট অবস্থায় রয়েছে (পূর্বেই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।) জান্নাত ও জাহান্নাম কখনোই বিলুপ্ত হবে না। আয়তলোচনা হূরগণ কখনোই মৃত্যুবরণ করবে না। মহান আল্লাহর অনন্ত-চিরস্থায়ী শাস্তি ও পুরস্কার কখনোই বিলুপ্ত হবে না।
[1] আল-ফিকহুল আকবারের কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে এ অতিরিক্ত বাক্যাংশটি বিদ্যমান।
১. মুরজিয়া বিভ্রান্তি ও আহলুস সুন্নাতের আকীদা
মুরজিয়াহ (المرجئة) ‘আরজাআ’ (أرجأ) ক্রিয়া থেকে গৃহীত। আরজাআ (أرجأ) অর্থ বিলম্বিত করা, পিছিয়ে দেওয়া, স্থগিত রাখা (To postpone, adjourn)
ইত্যাদি। মুরজিউন (مرجئ) অর্থ বিলম্বিতকারী বা স্থগিতকারী। বহুবচন বা ফিরকা অর্থে ‘মুরজিয়াহ’ বলা হয়, অর্থাৎ বিলম্বিতকারীগণ বা স্থগিতকারীগণ।
পূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, খারিজীদের মতে মুমিন পাপের কারণে কাফির হয়ে যান। যে মুমিন পাপ করে তাওবা ছাড়া মৃত্যু বরণ করবে সে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। তার ঈমান তার কোনো কাজে লাগবে না। মুতাযিলাগণও এরূপ বিশ্বাস পোষণ করে। তাদের মতে মুমিন তার ঈমান সত্ত্বেও যখন কোনো কবীরা গোনাহ করে তখন তার ঈমান ও সকল নেক কর্ম বিনষ্ট হয়ে যায়। এরূপ ব্যক্তি কাফির না হলেও মুমিন থাকে না। অর্থাৎ সে মুমিনও নয়, কাফিরও নয়। তবে পরিণতি কাফিরেরই। সেও কাফিরের মত অনন্তকাল জাহান্নামে শাস্তিভোগ করবে।
এদের মতে ইসলামের বিধান পালন ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কর্মের ঘাটতি মানেই ঈমানের ঘাটতি। আর ঈমানের ঘাটতি অর্থই কুফর। এর বিপরীতে আরেক দলের উদ্ভব হয়। তারা বলে, ঈমানের সাথে আমলের কোনো সম্পর্ক নেই। ঈমান থেকে আমল বা কর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঈমানের জন্য শুধু অন্তরের ভক্তি বা বিশ্বাসই যথেষ্ট। ইসলামের কোনো বিধিবিধান পালন না করেও একব্যক্তি ঈমানের পূর্ণতার শিখরে আরোহণ করতে পারে। আর এরূপ ঈমানদার ব্যক্তির কবীরা গোনাহ তার কোনো ক্ষতি করে না। যত গোনাহই করুক না কেন সে জান্নাতী হবে। এদের মূলনীতি:
لاَ يَضُرُّ مَعَ الإِيْمَانِ مَعْصِيَةٌ كَمَا لاَ يَنْفَعُ مَعَ الْكُفْرِ
طَاعَةٌ
‘‘ঈমান থাকলে কোনো পাপই কোনো ক্ষতি করে না, যেমন কুফর থাকলে কোনো পুণ্যই কাজে লাগে না।’’
দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম থেকেই এ মতটি বিশেষভাবে প্রসার লাভ করে। এদেরকে মুরজিয়া কেন বলা হলো সে বিষয়ে একাধিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ইবনুল আসীর বলেন, এরা যেহেতু বিশ্বাস করে যে, কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ শাস্তি দিবেন না বা তার শাস্তি স্থগিত রাখবেন সেহেতু তাদেরকে মুরজিয়া বলা হয়। আর আব্দুল কাহির বাগদাদী বলেন, এরা যেহেতু আমল বা কর্মকে ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে বা স্থগিত করেছে এজন্য এদেরকে মুরজিয়া বলা হয়।[1]
খারিজীগণ যেরূপ কুরআন- হাদীসের কিছু বক্তব্য নিজেদের মতের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে তার বিপরীতে অন্য বক্তব্যগুলো ব্যাখ্যা বা বাতিল করেছে, মুরজিয়াগণও একইভাবে কুরআন ও হাদীসের ক্ষমা বিষয়ক ও তাওহীদের ফযীলত বিষয়ক বক্তব্যগুলোকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে বাকি আয়াত ও হাদীসগুলো ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করেছে। সমন্বয় বা উভয় প্রকার শিক্ষা গ্রহণ করতে তারা সচেষ্ট হয় নি।
এখানে লক্ষণীয় যে, খারিজী, মুতাযিলী এবং তাদের সংগে একমত বিভিন্ন ফিরকা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতকেও মুরজিয়াহ বলে আখ্যায়িত করে। কারণ এ সকল ফিরকা কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুসলিমের বিধান তাৎক্ষণিক বলে দেয় যে, সে অনন্তকাল জাহান্নামে বাস করবে। আর আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে অনন্ত জাহান্নামবাসী না বলে তার বিষয়টি আল্লাহর হাতে বলে বিশ্বাস করেন এবং আল্লাহ তাকে ইচ্ছা করলে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন। এভাবে তাঁরা পাপী মুসলিমের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি পিছিয়ে দেন।
বস্ত্তত ‘আহলুস সুন্নাত’ কুরআন ও হাদীসের সকল নির্দেশ সমানভাবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা কিছু আয়াত ও হাদীসকে অগ্রগণ্য করে অন্য আয়াত ও হাদীসকে ব্যাখ্যার নামে বাতিল করেন নি। বরং তাঁরা উভয় অর্থের ওহী সমানভাবে বিশ্বাস ও গ্রহণ করেছেন। আর এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন:
আমরা বলি না যে, পাপ মুমিনের কোনো ক্ষতি করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। মুমিন যদি ফাসিক বা পাপী হয়, কিন্তু ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করে তবে তার বিষয়ে আমরা এরূপ বলি না। আমরা বলি না যে, আমাদের নেক কর্মগুলি কবুলকৃত এবং পাপরাশি ক্ষমাকৃত, মুরজিয়াগণ এরূপ বলে থাকে।
বরং আমরা বলি যে, এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যাকৃত। যে ব্যক্তি সকল শর্ত পূরণ করে এবং সকল বিনষ্টকারী ত্রুটি হতে মুক্ত থেকে কোনো নেক কর্ম করবে এবং কুফর বা ধর্মত্যাগ দ্বারা বা অশোভন আচরণ দ্বারা তার নেককর্মটি বিনষ্ট করবে না এবং ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করবে আল্লাহ তার কর্মটি নষ্ট করবেন না, বরং তিনি তা কবুল করবেন এবং তাকে তার জন্য সাওয়াব প্রদান করবেন।
কোনো মানুষ যদি শির্ক ও কুফর ছাড়া অন্য কোনো পাপ কর্ম করে তাওবা না করে ঈমান সহ মৃত্যুবরণ করে তবে তার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন থাকবে। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে জাহান্নামের মধ্যে শাস্তি দিবেন, আর ইচ্ছা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে জাহান্নামে কোনোরূপ শাস্তিই দিবেন না। রিয়া যদি কোনো কর্মের মধ্যে প্রবেশ করে তবে তা সে কর্মের পুরস্কার বাতিল করে দেয়। ‘উজব’ও তদ্রূপ।
এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সাথীদ্বয়ের আকীদা আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম তাহাবী। তিনি বলেন:
وَلا نَقُولُ: لا يَضُرُّ مَعَ الإِيمَانِ ذَنْبٌ لِمَنْ عَمِلَهُ. نَرْجُو
لِلْمُحْسِنِينَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ، وَيُدْخِلَهُمُ
الْجَنَّةَ بِرَحْمَتِهِ، وَلا نَأْمَنُ عَلَيْهِمْ، وَلا نَشْهَدُ لَهُمْ
بِالْجَنَّةِ، وَنَسْتَغْفِرُ لِمُسِيئِهِمْ، وَنَخَافُ عَلَيْهِمْ، وَلا
نُقَنِّطُهُمْ. ... وَالأَمْنُ وَالإِيَاسُ يَنْقُلانِ عَنْ مِلَّةِ الإِسْلامِ،
وَسَبِيلُ الْحَقِّ بَيْنَهُمَا لأَهْلِ الْقِبْلَةِ. .... وَأَهْلُ الْكَبَائِرِ
مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ ﷺ فِي النَّارِ لاَ يَخْلُدُونَ، إِذَا مَاتُوا وَهُمْ
مُوَحِّدُونَ، وَإِنْ لَمْ يَكُونُوا تَائِبِينَ، بَعْدَ أَنْ لَقُوا اللَّهَ
عَارِفِينَ مُؤْمِنِينَ، وَهُمْ فِي مَشِيئَتِهِ وَحُكْمِهِ إِنْ شَاءَ غَفَرَ
لَهُمْ، وَعَفَا عَنْهُمْ بِفَضْلِهِ، كَمَا ذَكَرَ عَزَّ وَجَلَّ فِي كِتَابِهِ: "وَيَغْفِرُ
مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ"، وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُمْ فِي النَّارِ
بِعَدْلِهِ، ثُمَّ يُخْرِجُهُمْ مِنْهَا بِرَحْمَتِهِ وَشَفَاعَةِ الشَّافِعِينَ
مِنْ أَهْلِ طَاعَتِهِ، ثُمَّ يَبْعَثُهُمْ إِلَى جَنَّتِهِ، وَذَلِكَ بِأَنَّ
اللَّهَ تَعَالَى تَوَلَّى أَهْلَ مَعْرِفَتِهِ، وَلَمْ يَجْعَلْهُمْ فِي
الدَّارَيْنِ كَأَهْلِ نُكْرَتِهِ الَّذِينَ خَابُوا مِنْ هِدَايَتِهِ، وَلَمْ
يَنَالُوا مِنْ وَلايَتِهِ.
‘‘আমরা এ কথাও বলি না যে, ঈমান থাকলে কোনো পাপ পাপীর ক্ষতি সাধন করে না। মু‘মিনগণের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল ইহসান অর্জনকারী নেককার তাদের সম্পর্কে আমরা আশা করি যে, আল্লাহ্ পাক তাদের দোষক্রটি ক্ষমা করবেন এবং নিজ রহমতে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তবে, আমরা তাদের সম্পর্কে সম্পুর্ণ নির্ভয় নই এবং তাদের জান্নাতী হওয়ার কোনো সাক্ষ্যও আমরা প্রদান করি না। আর মুমিনগণের মধ্যে যারা গুনাহগার তাদের ভূলক্রটির জন্য আমরা আল্লাহর নিকট মাগফেরাত কামনা করি এবং তাদের ব্যাপারে আশঙ্কাও পোষণ করি। তবে, আমরা তাদেরকে নিরাশাগ্রস্থ করি না।
নির্ভয় ও হতাশা উভয়ই বান্দাকে মিল্লাতে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। আহলু কিবলার জন্য এতদুভয়ের মাঝামাঝি সত্যের পথ নিহিত রয়েছে। .... মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উম্মতের মধ্যে যারা কবীরা গুণাহ করবে তারা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে না, যদি তারা তাওহীদের সাথে মৃত্যু বরণ করে, যদিও তারা তাওবা না করে মারিফাত ও ঈমানসহ আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে থাকে। তাদের পরিণতি আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের উপর নির্ভর করবে। তিনি চাইলে নিজ দয়ায় তাদের ক্ষমা করে দিবেন। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘এবং তিনি শিরক ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।’’[2] আর তিনি চাইলে আপন ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে তাদের জাহান্নামে শাস্তি দিতে পারেন। অতঃপর তিনি নিজ অনুগ্রহে এবং তাঁর অনুগত বান্দাহগণের শাফা‘আতের ফলে তাদের বের করে জান্নাতে পাঠাবেন। এর কারণ, আল্লাহ তা’আলা তাঁর ঈমানদার বান্দাহগণের অভিভাবকত্ব বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন। তাদের ইহকাল ও পরকালে ঐসব কাফেরদের সমতুল্য করেন নি যারা তাঁর হেদায়াত থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছে এবং তাঁর বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্ব লাভে সক্ষম হয় নি।’’[3]
[1] ইবনুল আসীর, আন-নিহাইয়া ১/৯৮; বাগদাদী, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ২০২।
[2] সূরা (৪) নিসা: ৪৮ ও ১১৬ আয়াত।
[3] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৩-১৫।
২. নেক কর্ম কবুলের শর্তাবলি
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বললেন: ‘‘যে ব্যক্তি সকল শর্ত পূরণ করে এবং সকল বিনষ্টকারী ত্রুটি থেকে মুক্ত থেকে কোনো নেক কর্ম করবে এবং কুফর বা ধর্মত্যাগ দ্বারা বা অশোভন আচরণ দ্বারা তার নেককর্মটি বিনষ্ট করবে না এবং ঈমান-সহ পৃথিবী ত্যাগ করবে আল্লাহ তার কর্মটি নষ্ট করবেন না, বরং তিনি তা কবুল করবেন এবং তাকে তার জন্য সাওয়াব প্রদান করবেন।’’ এখানে তিনি ইবাদতের পুরস্কার লাভের জন্য চারটি শর্ত উল্লেখ করেছেন: (১) নেক আমল কবুলের শর্ত পূরণ হওয়া, (২) নেক আমল বিনষ্টকারী ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়া, (৩) কুফর-শিরক থেকে মুক্ত থাকা ও (৪) ঈমনসহ মৃত্যু বরণ করা।
প্রথমে আমরা নেক আমল কবুলের শর্তগুলো পর্যালোচনা করব।
২. ১. ইবাদাত ও অনুসরণের বিশুদ্ধতা
নেক আমল কবুলের প্রথম শর্ত ‘ঈমান’। আমরা দেখেছি যে, ঈমানের মূল আল্লাহর তাওহীদ ও মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের সাক্ষ্য। এজন্য কোনো কথা, কর্ম বা বিশ্বাস কবুল হওয়ার বা সাওয়াব পাওয়ার পূর্বশর্ত দুটি: (১) ইখলাসুল ইবাদাত (إخلاص العبادة): ইবাদতের বিশুদ্ধতা এবং (২) ইখলাসুল মুতাবাআহ (إخلاص المتابعة): অনুসরণের বিশুদ্ধতা। অর্থাৎ ইবাদতটি একমাত্র আল্লাহর জন্যই হতে হবে এবং একমাত্র মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর অনুসরণে তা পালিত হতে হবে।
২. ১. ১. ইখলাসুল ইবাদাত: ইবাদাতের বিশুদ্ধতা
ইবাদত কবুল হওয়ার প্রথম শর্ত ইবাদতকারীকে শিরকমুক্ত ঈমানের অধিকারী হতে হবে এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই ইবাদতটি পালন করা হবে। কুরাআন-হাদীসে এ বিষয়ে অগণিত নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ বলেন:
فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلا صَالِحًا وَلا يُشْرِكْ
بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
‘‘অতএব যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ আশা করে সে নেক কর্ম করুক এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করুক।’’[1]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلا يَخَافُ ظُلْمًا وَلا
هَضْمًا
‘‘আর যে ব্যক্তি মুমিন হওয়া অবস্থায় নেক কর্ম করবে সে কোনো জুলুম, ক্ষতি বা কমতির আশঙ্কা করবে না।’’[2]
এভাবে কুরআনে বারবার বলা হয়েছে যে, আমল কবুলের পূর্বশর্ত ঈমান। আর ঈমানের প্রথম অংশ তাওহীদের অর্থ ইবাদত শুধুই আল্লাহর জন্য করা।[3]
[1] সূরা (১৮) কাহ্ফ: ১১০ আয়াত।
[2] সূরা (২০) তাহা: ১১২ আয়াত।
[3] দেখুন: সূরা: (৪) নিসা: ১২৪ আয়াত; সূরা (১৬) নাহল: ৯৭ আয়াত; সূরা (১৭) ইসরা (বনী ইসরাঈল): ১৯ আয়াত; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৯৪ আয়াত; সূরা (৪০) গাফির (মুমিন): ৪০ আয়াত ...।
২. ১. ২. অনুসরণের বিশুদ্ধতা
‘নেক আমল’ অর্থাৎ আল্লাহর সাওয়াব লাভের জন্য যে বিশ্বাস বা কর্ম পালন করা হয় তা কবুল হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত, তা অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত ও তাঁর শিক্ষা অনুসারে পালিত হতে হবে। যদি কোনো ইবাদত তাঁর শেখানো ও আচরিত পদ্ধতিতে পালিত না হয়, তাহলে যত ইখলাস বা আন্তরিকতাই থাক না কেন, তা আল্লাহর দরবারে কোনো অবস্থাতেই গৃহীত বা কবুল হবে না।
আমরা দেখেছি যে, শাহাদাতাইন বা তাওহীদ এবং রিসালাতে বিশ্বাসের মূল অর্থই এটি। বস্ত্তত কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করলে তিনি তা কবুল করবেন তা শিক্ষা দেওয়াই রিসালাতের দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে কথা বলেন নি বা যে কাজ করেন নি সে কথা বলা বা সে কাজ করা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অল্প বা বেশি প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করা অথবা এরূপ কাজ না করলে আল্লাহর সন্তুষ্টির কমতি হবে বলে মনে করার অর্থ তাঁর রিসালাতের দায়িত্বের পূর্ণতায় সন্দেহ করা। তিনি ছাড়া অন্য কারো কথা, কর্ম বা রীতি আল্লাহর নিকট কবুলিয়্যাতের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করার অর্থ উক্ত ব্যক্তিকে রিসালাতের মর্যাদায় আসীন করা, যা ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক।
তাঁর সুন্নাতের ব্যতিক্রম কথা বা কর্ম জায়েয হতে পারে, তবে সাওয়াব বা কবুলের বিষয় হতে পারে না। যে কোনো কর্ম বা কথার মধ্যে যতটুকু ‘‘ইত্তিবায়ে রাসূল’’ বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুকরণ রয়েছে ততটুকুই কবুল হবে। ইত্তিবার অতিরিক্ত বা ব্যতিক্রম কোনো কিছুই কবুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّهُ
وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ.
‘‘বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদেরকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ ক্ষমাকারী দয়ালু।’’[1]
এ আয়াত নির্দেশ করে যে, আল্লাহর মহববত ও মাগফিরাত লাভের একমাত্র পথ ‘ইত্তিবায়ে রাসূল’ বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুকরণ-অনুসরণ। তাঁর অনুকরণের বাইরে আল্লাহর মহববত, কুবলিয়্যাত ও মাগফিরাত লাভের কোনো পথ নেই। বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ عَمِلَ عَمَلا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘‘আমাদের কর্ম যা নয় এমন কোনো কর্ম যদি কোনো মানুষ করে তবে তার কর্ম প্রত্যাখ্যাত (আল্লাহর নিকট কবুল হবে না)।’’[2]
সাহাবীগণ ইত্তিবায়ে রাসূলকেই ইবাদতের একমাত্র ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতেন। উমার (রা) কাবা শরীফে হাজারে আসওয়াদকে সম্বোধন করে বলেন:
أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لا تَضُرُّ وَلا تَنْفَعُ
وَلَوْلا أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ ﷺ اسْتَلَمَكَ مَا اسْتَلَمْتُكَ
فَاسْتَلَمَهُ ثُمَّ قَالَ فَمَا لَنَا وَلِلرَّمَلِ؟ إِنَّمَا كُنَّا رَاءَيْنَا
بِهِ الْمُشْرِكِينَ وَقَدْ أَهْلَكَهُمُ اللَّهُ ثُمَّ قَالَ: شَيْءٌ صَنَعَهُ
النَّبِيُّ ﷺ فَلا نُحِبُّ أَنْ نَتْرُكَهُ.
‘‘আমি নিশ্চিতরূপেই জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র, কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো ক্ষমতা তোমার নেই। যদি নবী ﷺ তোমাকে চুম্বন না করতেন তাহলে কখনই আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। এরপর তিনি হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন করেন। এরপর তিনি বলেন: তাওয়াফের সময় দৌড়ানোর আর কী প্রয়োজন? আমরা তো মুশরিকদের দেখানোর জন্য এভাবে তাওয়াফ করেছিলাম। আল্লাহ তো মুশরিকদেরকে ধ্বংস করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন: একটি কাজ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) করেছেন (কোনো যুক্তি বা প্রয়োজন না থাকলেও) আমরা তা পরিত্যাগ করতে চাই না। (আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর পদ্ধতিতে দৌড়ে দৌড়ে তাওয়াফ করব)।’’[3]
এখানে খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)-এর বক্তব্য থেকে আমরা দেখি যে ‘ইত্তিবায়ে রাসূল’ (ﷺ) বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণ ছাড়া কোনো ইবাদাত নেই।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাবাগৃহের রুকন ইয়ামানী বা দক্ষিণ পশ্চিম কোণ এবং হাজার আসওয়াদ (দক্ষিণ পূর্ব কোণ) স্পর্শ করেন বা চুম্বন করেন। কাবা গৃহের অন্য কোনো স্থান তিনি স্পর্শ করেন নি। কোনো মুমিন যদি হাজার আসওয়াদ (কাল পাথর) চুম্বন করেন, চুম্বন করতে না পারলে স্পর্শ করেন, কোনো লাঠি দিয়ে স্পর্শ করেন বা দূর থেকে ইঙ্গিত করেন তবে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে এবং তিনি সাওয়াব ও কবুলিয়্যাত লাভ করবেন, তার মনের আবেগ যাই হোক না কেন। পক্ষান্তরে তিনি যদি রুকন ইয়ামানী বা হাজার আসওয়াদ ছাড়া অন্য কোনো স্থান স্পর্শ বা চুম্বন করেন এবং তাতে তার মনের মহা আবেগ, ভাব, ক্রন্দন ইত্যাদি থাকে তবে তার যতই ভাল লাগুক না কেন তাতে কোনো সাওয়াব হবে না; কারণ তা ইত্তিবা না হওয়ার কারণে ইবাদত বলে গণ্য হবে না।
এ বিষয়ে মুজাদ্দিদ-ই-আলফ-ই-সানী, শাইখ আহমদ সারহিন্দী (১০৩৪ হি.) বলেন: ‘‘যদি কেহ সহস্র্ বৎসর ধরিয়া ইবাদত বন্দেগি, কঠোর ব্রত ও অসাধ্য সাধন করে এবং পয়গম্বর (আ.)-গণের অনুসরণের নূরের আলোতে আলোকিত না হয়, তবে উক্ত সাধনার এ কদর্পকও মূল্য হইবে না। দ্বিপ্রহরের নিদ্রা, যাহা পয়গাম্বর (আ.)- গণের সুন্নাত এবং যাহা সরাসরি অচৈতন্য (অর্থাৎ, যাহা কোনো কর্মই নয়, শুধু আরামে অচেতন হওয়া) উল্লেখিত কঠোর সাধনাবলী ইহারও সমতুল্য নহে...।’’[4]
[1] সূরা (৩) আল-ইমরান: ৩১,৩২ আয়াত।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৭৫ (কিতাবুল ই’তিসাম, বাবু ইযাজতাহাদাল আমিলু..); মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৩৪৩ (কিতাবুল আকদিয়া, বাবু নাকদিল আহকামিল বাতিলা..)
[3] বুখারী, আস-সহীহ ২/৫৭৯ (কিতাবুল হজ্জ, বাবু মা যুকিরা ফিল হাজারিল আসওয়াদি)
[4] মুজাদ্দিদ আলফ সানী, মাকতুবাত শরীফ, ১ম খন্ড, ২য় ভাগ, মাকতুব ১৯১, পৃ: ৭০।
২. ২. হালাল খাদ্য ভক্ষণ
ইবাদত বা নেক আমল, বিশেষত অর্থসম্পদ-নির্ভর নেক আমল কবুল হওয়ার শর্ত হালাল ভক্ষণ ও হালাল সম্পদ দ্বারা ইবাদত পালন। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي
بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ
‘‘হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র বস্ত্ত হতে আহার কর এবং সৎকর্ম কর। তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমি অবহিত।’’[1]
এখানে মহান আল্লাহ সৎকর্ম করার পূর্বেই পবিত্র খাদ্য আহার করার কথা উল্লেখ করেছেন। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ
وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদেরকে আমি যে সব পবিত্র বস্ত্ত দিয়েছি তা থেকে আহার কর এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত কর।’’[2]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لا يَقْبَلُ إِلا طَيِّبًا وَإِنَّ
اللَّهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ .... ثُمَّ
ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى
السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ
حَرَامٌ وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ
‘‘হে মানুষেরা, নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কোনো কিছুই কবুল করেন না। আল্লাহ মুমিনগণকে সে নির্দেশ দিয়েছেন যে নির্দেশ তিনি রাসূলগণকে দিয়েছেন ...(পবিত্র খাদ্য ভÿণের)... এরপর তিনি একজন মানুষের কথা উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি (আল্লাহর পথে) দীর্ঘ সফরে রত থাকে, ধূলি ধূসরিত দেহ ও এলোমেলো চুল, তার হাত দু’টি আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে দোয়া করতে থাকে, হে প্রভু! হে প্রভু!! কিন্তু তার খাদ্য হারাম, তার পোশাক হারাম, তার পানীয় হারাম এবং হারাম উপার্জনের জীবিকাতেই তার রক্তমাংস গড়ে উঠেছে। তার দু‘আ কিভাবে কবুল হবে?!’’[3]
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لاَ يَقْبَلُ الله صَلاَةً بِغَيْرِ طُهُورٍ، وَلاَ صَدَقَةً مِنْ غُلُولٍ
‘‘ওযু-গোসল ছাড়া কোনো সালাত আল্লাহ কবুল করেন না, তেমনি গুলূল বা ফাঁকি, ধোঁকা ও অবৈধ সম্পদের কোনো দান আল্লাহ কবুল করেন না।’’[4]
বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কেউ অবৈধ সম্পদ উপার্জন করে তা থেকে দান করলে তার দানের কোনো সাওয়াব সে পাবে না এবং তার পাপের বোঝাও হালকা হবে না। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ جَمَعَ مَالاً حَرَاماً ثُمَّ تَصَدَّقَ بِهِ لَمْ يَكُنْ لَهُ فِيْهِ أَجْرٌ
وَكَانَ إِصْرُهُ عَلَيْهِ
‘‘যে ব্যক্তি অবৈধভাবে সম্পদ সঞ্চয় করে এরপর তা দান করবে, সে দানের জন্য কোনো সাওয়াব পাবে না এবং তার পাপ তাকে ভোগ করতে হবে।’’[5]
[1] সূরা (২৩) মুমিনূন: ৫১ আয়াত।
[2] সূরা (২) বাকারা: ১৭২ আয়াত।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭০৩ (কিতাবুয যাকাত, বাবু কাবুলিস সাদাকাতি মিনাল কাসবিত...)।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/২০৪ (কিতাবুত তাহারাহ, বাবু উজূবিত তাহারাতি লিস সালাত)।
[5] ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ: মাওয়ারিদুয যামআন ৩/১৯, ১৩৩। হাদীসটির সনদ শক্তিশালী।
৩. নেক কর্ম বাতিল হওয়ার কারণাদি
ইমাম আযম নেক আমল বাতিল হওয়ার কারণাদি উল্লেখ করে বলেছেন: ‘‘সকল বিনষ্টকারী ত্রুটি থেকে মুক্ত থেকে কোনো নেক কর্ম করবে এবং কুফর বা ধর্মত্যাগ দ্বারা বা অশোভন আচরণ দ্বারা তার নেককর্মটি বিনষ্ট করবে না ...।’’ এখানে তিনি কুফর ও ধর্মত্যাগের কথা উল্লেখ করেছেন। কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে ‘‘অশোভন আচরণ’’ কথাটিও বিদ্যমান। পরবর্তীতে তিনি রিয়া ও উজবের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’’ গ্রন্থে তিনি বলেন:
وَأَمَّا الْحَسَنَاتُ فَإِنَّهُ لاَ يَهْدِمُهَا شَيْءٌ غَيْرُ ثَلاَثِ خِصَالٍ.
أَمَّا الْوَاحِدُ فَالشِّرْكُ بِاللهِ؛ لأَنَّ اللهَ تَعَالَى قَالَ:
"وَمَنْ يَكْفُرْ بِالإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ". وَالأُخْرَى
أَنْ يَعْمَلَ الإِنْسَانُ فَيُعْتِقَ نَسَماً أَوْ يَصِلَ رَحِماً أَوْ
يَتَصَدَّقَ بِمَالٍ يُرِيْدُ بِهَذَا كُلِّهِ وَجْهَ اللهِ. ثُمَّ إِذَا غَضِبَ
أَوْ قَالَ فِيْ غَيْرِ الْغَضَب امْتِنَاناً عَلَى صَاحِبِهِ الَّذِيْ كَانَ
الْمَعْرُوْفُ مِنْهُ إِلَيْهِ: أَلَمْ أُعْتِقْ رَقَبَتَكَ؟ أَوْ يَقُوْلُ لِمَنْ
وَصَلَهُ: أَلَمْ أَصِلْكَ؟ وَفِيْ أَشْبَاهِ هَذَا يَضْرِبُ بِهِ عَلَى رَأْسِهِ.
وَلِذَلِكَ قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: "لاَ تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ
بِالْمَنِّ وَالأَذَى". وَالثَّالِثَةُ مَا كَانَ مِنْ عَمَلٍ يُرَائِيْ بِهِ
النَّاسَ، فَإِنَّ ذَلِكَ الْعَمَلَ الصَّالِحَ الَّذِيْ رَاءَى بِهِ لاَ
يَتَقَبَّلُهُ اللهُ مِنْهُ. فَمَا كَانَ سِوَى هَذَا مِنَ السَّيِّئَاتِ
فَإِنَّهُ لاَ يَهْدِمُ الْحَسَنَاتِ.
‘‘নেক কর্ম বিনষ্ট করে মাত্র তিনটি বিষয়। প্রথম বিষয়: আল্লাহর সাথে শিরক করা; কারণ মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে কুফরী করবে তার কর্ম বিনষ্ট হবে।’’[1] নেক আমল বিনষ্টকারী দ্বিতীয় বিষয় (খোঁটা বা কষ্ট দেওয়া, তা) এই যে, মানুষ কোনো নেক আমল করল, যেমন একজন ক্রীতদাসকে মুক্ত করল, কোনো আত্মীয়কে সহযোগিতা করল অথবা কিছু সম্পদ দান করল। এ সকল কর্ম সে একান্তই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করল। এরপর যখন সে ক্রোধান্বিত হলো- অথবা ক্রোধ ছাড়াই- সে খোঁটা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বলল: আমি কি তোমাকে মুক্ত করি নি? আমি কি তোমাকে সাহায্য করি নি? অথবা এরূপ কোনো কথা দিয়ে তার মাথায় আঘাত করল। এজন্য এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমরা খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-কল্যাণকর্মগুলো বাতিল করো না।’’[2] নেক আমল বিনষ্ট করার তৃতীয় বিষয় রিয়া বা মানুষের দেখানোর জন্য কর্ম করা। যে নেক কর্ম মানুষের দেখানোর জন্য করা হয় তা আল্লাহ কবুল করেন না। এ ছাড়া যত পাপ তা নেক কর্ম বিনষ্ট করে না।’’[3]
আমরা এখানে এ বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করব। মহান আল্লাহর কাছে তাওফীক ও কবুলিয়্যাত প্রার্থনা করছি।
[1] সূরা (৫) মায়িদা: ৫ আয়াত।
[2] সূরা (২) বাকারা: ২৬৪ আয়াত।
[3] ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ৩২।
৩. ১. শিরক, কুফর ও ধর্মত্যাগ
আমরা ইতোপূর্বে প্রথম পরিচ্ছেদে শিরক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এছাড়া তাকফীর পরিচ্ছেদে আমরা কুফর-এর অর্থ আলোচনা করেছি। ইসলাম গ্রহণের পর কোনো শিরক বা কুফরে লিপ্ত হওয়াকে ‘‘রিদ্দাহ’’ (الردة) বা ধর্মত্যাগ বলে। শিরক মানব জীবনের ভয়ঙ্করতম পাপ। তাওবা বা অনুতপ্ত হয়ে পাপ বর্জন করা সকল পাপের ক্ষমার পথ। তবে মহান আল্লাহ তাওবা ছাড়াও নেক কর্মের কারণে, শাস্তির মাধ্যমে, শাফাআতের মাধ্যমে বা তাঁর অপার করুণায় অন্য সকল পাপ ক্ষমা করতে পারেন। তবে শিরকের পাপ তিনি তাওবার মাধ্যমে শিরক বর্জন ছাড়া ক্ষমা করেন না। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ
يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا
‘‘আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। তা ছাড়া অন্য কিছু যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং যে কেউ আল্লার সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।’’[1]
এছাড়া সকল পাপ বা মহাপাপে লিপ্ত ব্যক্তির জন্যও জাহান্নামের শাস্তির পর জান্নাত লাভের আশা থাকে। কিন্তু শিরক-কুফরে লিপ্ত থাকা অবস্থায় মৃত্যু হলে তার আর কোনো আশা থাকে না। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ
وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ
‘‘কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ করেন ও তার আবাস জাহান্নাম; জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।’’[2]
সর্বোপরি শিরক-কুফর মানুষের অন্যান্য নেক আমলও বিনষ্ট করে। ইমাম আযম এ বিষয়ক একটি আয়াত উল্লেখ করেছেন। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ
لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘‘তোমার এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, ‘তুমি আল্লাহর শরীক স্থির করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্ত’।’’[3]
আমরা দেখেছি যে, আরবের কাফিরগণ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অনেক ইবাদত করত। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্জ-উমরা, কুরবানী ইত্যাদি ইবাদত পালন করত। কিন্তু আল্লাহর নিকট তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে বারবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শিরকযুক্ত নেক আমল সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا
‘‘এবং আমি তাদের (কাফির-মুশরিকদের) আমলের প্রতি অগ্রসর হব এবং তা বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব।’’[4]
[1] সূরা (৪) নিসা: ৪৮ আয়াত।
[2] সূরা (৫) মায়িদা: ৭২ আয়াত।
[3] সূরা (৩৯) যুমার: ৬৫ আয়াত।
[4] সূরা (২৫) ফুরকান: ২৩ আয়াত।
৩. ২. সমাজে প্রচলিত কিছু শিরক-কুফর
আমরা শিরক বিষয়ক মূলনীতিগুলো পূর্বে উল্লেখ করেছি। তবে যেহেতু শিরক-কুফর নেক আমল নষ্ট হওয়ার মূল কারণ এবং কুরআনের ভাষায় অধিকাংশ মানুষ ঈমান থাকা সত্ত্বেও শিরকে লিপ্ত হয়, সেহেতু আমরা এখানে সমাজে প্রচলিত কিছু শিরক-কুফর উল্লেখ করছি, যেন সচেতন পাঠক এগুলো থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেন।
1. তাওহীদ বা রিসালাতের কোনো বিষয় অবিশ্বাস করা। যেমন আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস না করা। মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে তাঁর বান্দা, দাস ও মানুষ রূপে বিশ্বাস না করা। অথবা তাঁকে আল্লাহর অবতার, আল্লাহ তাঁর সাথে মিশে গিয়েছেন, ‘যে আল্লাহ সে-ই রাসূল’ ইত্যাদি মনে করা। অথবা তাঁকে আল্লাহর নবী ও রাসূল রূপে না মানা। তাঁকে কোনো বিশেষ যুগ, জাতি বা দেশের নবী মনে করা। তাঁর কোনো কথা বা শিক্ষাকে ভুল বা অচল মনে করা। আল্লাহর নৈকট্য, সন্তুষ্টি ও মুক্তি পাওয়ার জন্য তাঁর শিক্ষার অতিরিক্ত কোনো শিক্ষা, মত বা পথ আছে, থাকতে পারে বা প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করা।
2. আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ এ বিশ্বের প্রতিপালন বা পরিচালনায় শরীক আছেন বলে বিশ্বাস করা। অন্য কোনো সৃষ্টি, প্রাণী, ফিরিশতা, জীবিত বা মৃত মানুষ, নবী বা ওলী সৃষ্টি, পরিচালনা, অদৃশ্য জ্ঞান, অদৃশ্য সাহায্য, রিযিক দান, জীবন দান, সুস্থতা বা রোগব্যাধি দান, বৃষ্টি দান, বরকত দান, অনাবৃষ্টি প্রদান, অমঙ্গল প্রদান ইত্যাদি কোনো প্রকার কল্যাণ বা অকল্যাণের কোনো ক্ষমতা রাখেন বা আল্লাহ কাউকে অনুরূপ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন বলে বিশ্বাস করা।
3. আল্লাহ ছাড়া কোনো নবী, ওলী, জিন বা ফিরিশতা সকল প্রকার অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী, গায়েব বা দূরের ডাক শুনতে পারেন, সাড়া দিতে পারেন, সদাসর্বদা সর্বত্র বিরাজমান বা হাজির নাযির বলে বিশ্বাস করা।
4. রাসূলুল্লাহ (ﷺ), ঈসা (আ) বা অন্য কাউকে আল্লাহর যাত (সত্তা) বা সিফাত (বিশেষণ)-এর অংশ, আল্লাহর সত্তা, বিশেষণ বা নূর থেকে (Same Substance/ Light from Light) সৃষ্ট বা জন্ম-দেওয়া বলে বিশ্বাস করা।
5. কোনো বস্ত্ত, প্রাণী, কর্ম, বার, তিথি, মাস ইত্যাদিকে অশুভ বা অযাত্রা বলে মনে করা। সকল প্রকার অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাসই শিরক।
6. আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করা। আল্লাহ ছাড়া কোনো দৃশ্য বা অদৃশ্য, জীবিত বা মৃত প্রাণী বা বস্ত্তকে; যেমন মানুষ, জিন, ফিরিশতা, মাযার, কবর, পাথর, গাছ, মূর্তি, ছবি ইত্যাদিকে সাজদা করা, তাদের কাছে অলৌকিক সাহায্য, ত্রাণ, দীর্ঘায়ূ, রোগমুক্তি, বিপদমুক্তি, সন্তান ইত্যাদি প্রার্থনা করা, তাদের নামে মানত, কুরবানি বা উৎসর্গ করা শিরক। মূর্তিতে ভক্তিভরে ফুলদান, মূর্তির সামনে নীরবে বা ভক্তিভরে দাঁড়ানো এজাতীয় শিরকী বা শিরকতুল্য কর্ম।
7. আল্লাহর জন্য কোনো ইবাদত করে সে ইবাদত দ্বারা আল্লাহর সাথে অন্য কারো সম্মান প্রদর্শন বা সন্তুষ্টি কামনাও শিরক। যেমন আল্লাহর জন্য সাজদা করা তবে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা বস্ত্তকে সামনে রেখে সাজদা করা, যেন আল্লাহর সাজদার সাথে সাথে তাকেও সম্মান করা হয়ে যায়। অথবা আল্লাহর জন্য মানত করে কোনো জীবিত বা মৃত ওলী, ফিরিশতা, জিন, কবর, মাযার, পাথর, গাছ ইত্যাদিকে মানতের সাথে সংযুক্ত করা।
8. আল্লাহ, তাঁর রাসূল বা তাঁর দ্বীনের মৌলিক কোনো বিষয় অস্বীকার করা, অবিশ্বাস করা, অবজ্ঞা করা বা অপছন্দ করা কুফর। এ জাতীয় প্রচলিত কুফরীর মধ্যে অন্যতম আল্লাহর বিভিন্ন বিধান, যেমন - নামায, পর্দা, বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি, ইসলামী আইন ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ বা এগুলিকে বর্তমানে অচল বা মধ্যযুগীয় মনে করা।
9. ইসলামকে শুধু ব্যক্তি জীবনে পালন করতে হবে এবং সমাজ, বিচার, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলাম চলবে না বলে মনে করা, ইসলামের কোনো বিধান বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো সুন্নাতের প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণা প্রকাশ করা, ওয়াজ মাহফিল, যিক্র, তিলাওয়াত, নামায, মাদ্রাসা, মসজিদ, বোরকা, পর্দা ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণা অনুভব করা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা পূর্ববর্তী অন্য কোনো নবী-রাসূলের প্রতি সামান্যতম অবজ্ঞা প্রকাশ করা।
10.
মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সর্বশেষ নবী হওয়ার বিষয়ে সামান্যতম সন্দেহ পোষণ করা, তাঁর পরে কারো কাছে কোনো প্রকার ওহী এসেছে বা আসা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা।
11.
সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারকি, রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শেখানো নিয়ম, পদ্ধতি, রীতি, নীতি, আদর্শ, আইন ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোনো নিয়ম, নীতি, মতবাদ বা আদর্শ বেশী কার্যকর, উপকারী বা উপযোগী বলে মনে করা। যুগের প্রয়োজনে তাঁর শেখানো পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করা। এগুলো সবই কুফর।
12.
যে কোনো প্রকার কুফরীর প্রতি সন্তুষ্ট থাকাও কুফরী। উপরে বর্ণিত কোনো কুফুর বা শিরকে লিপ্ত মানুষকে মুসলিম মনে করা বা তাঁদের আকীদার প্রতি সন্তুষ্ট থাকাও কুফরী। যেমন যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে সর্বশেষ নবী বলে মানেন না বা তাঁর পরে কোনো নবী থাকতে পারে বা ওহী আসতে পারে বলে বিশ্বাস করেন তাদেরকে কাফির মনে না করা কুফরী। অনুরূপভাবে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মকে সঠিক বা পারলৌকিক মুক্তির মাধ্যম বলে মনে করা, সব ধর্মই ঠিক মনে করা কুফর। অন্যান্য ধর্মের শিরক বা কুফরমূলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা, সেগুলোর প্রতি মনের মধ্যে ঘৃণাবোধ না থাকা, অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে আন্তরিক বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা, তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অনুকরণ করা, ক্রিসমাস (বড়দিন), পূজা ইত্যাদিতে আনন্দ- উদ্যাপন করা ইত্যাদি বর্তমান যুগে অতি প্রচলিত কুফরী কর্ম ও বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামই সর্বপ্রথম সকল ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রত্যেকেই তাদের ধর্ম পালন করবেন। তাদের ধর্ম পালনে বাধা দেওয়া বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা নিষিদ্ধ। তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মুক্তি একমাত্র ইসলামের মধ্যে বলে বিশ্বাস ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘সব ধর্মই ঠিক’ বলার অর্থ সকল ধর্মকে মিথ্যা বলা এবং সকল ধর্মকে অবিশ্বাস করা; কারণ প্রত্যেক ধর্মেই অন্য ধর্মকে ‘বেঠিক’ বলা হয়েছে।
13.
আরেকটি প্রচলিত কুফরী গণক, জ্যোতিষী, হস্তরেখাবিদ, রাশিবিদ, জটা ফকির বা অন্য কোনোভাবে ভাগ্যগণনা, ভবিষ্যৎ গণনা বা গোপন জ্ঞান দাবি করা অথবা এসকল মানুষের কথায় বিশ্বাস করা। এ ধরনের কোনো কোনো কর্ম ইসলামের নামেও করা হয়। যে নামে বা যে পদ্ধতিতেই করা হোক গোপন তথ্য, গায়েব, অদৃশ্য, ভবিষ্যৎ বা ভাগ্য গণনা বা বলা জাতীয় সকল কর্মই কুফরী কর্ম। অনুরূপভাবে কোনো দ্রব্য, পাথর, ধাতু, অষ্টধাতু, গ্রহ বা এ জাতীয় কোনো কিছু মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে অথবা দৈহিক বা মানসিক ভালমন্দ করতে পারে বলে বিশ্বাস করা শিরক।
14.
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শেখানো কোনো কর্ম, পোষাক, আইন, বিধান, রীতি, সুন্নাত, কর্মপদ্ধতি বা ইবাদত পদ্ধতিকে অবজ্ঞা বা উপহাস করা।
15.
কোনো মানুষকে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর শরীয়তের উর্ধ্বে মনে করা বা কোনো কোনো মানুষের জন্য শরীয়তের বিধান পালন করা জরুরী নয় বলে বিশ্বাস করা কুফরী। যেমন, মারিফাত বা মহববত অর্জন হলে, বিশেষ মাকামে পৌঁছালে আর শরীয়ত পালন করা লাগবে না বলে মনে করা। অনুরূপভাবে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, হালাল উপার্জন, পর্দা ইত্যাদি শরীয়তের যে সকল বিধান প্রকাশ্যে পালন করা ফরয তা কারো জন্য গোপনে পালন করা চলে বলে বিশ্বাস করাও কুফরী।
16.
যাদু, টোনা, বান ইত্যাদি ব্যবহার করা বা শিক্ষা করা।
17.
ইসলাম ধর্ম জানতে-বুঝতে আগ্রহ না থাকা। ইসলামকে জানা ও শিক্ষা করাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে না করা বা এ বিষয়ে মনোযোগ না দেয়া।
আল্লাহ ও বান্দার মাঝখানে কোনো মধ্যস্থ আছে বা মধ্যস্থতা ছাড়া আল্লাহর নিকট ক্ষমালাভ, করুণালাভ বা মুক্তিলাভ সম্ভব নয় বলে বিশ্বাস করা শিরক।
৩. ৩. অশোভন আচরণ: খোঁটা দেওয়া
সকলের সাথে উত্তম ও শোভনীয় আচরণ করা আল্লাহর প্রিয় ইবাদত। আবু দারদা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
مَا مِنْ شَيْءٍ يُوضَعُ فِي الْمِيزَانِ أَثْقَلُ مِنْ حُسْنِ الْخُلُقِ وَإِنَّ
صَاحِبَ حُسْنِ الْخُلُقِ لَيَبْلُغُ بِهِ دَرَجَةَ صَاحِبِ الصَّوْمِ
وَالصَّلاةِ.
‘‘কিয়ামতের দিন কর্মবিচারের পাল্লায় বান্দার সবচেয়ে ভারী ও মূল্যবান কর্ম হবে সুন্দর আচরণ এবং সুন্দর আচরণের অধিকারী মানুষ শুধু তার সুন্দর ব্যবহারের বিনিময়েই নফল সিয়াম ও নফল সালাত পালনকারীর মর্যাদা লাভ করবে।[1]
জাবির (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ
الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلاقًا وَإِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَيَّ
وَأَبْعَدَكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الثَّرْثَارُونَ
وَالْمُتَشَدِّقُونَ وَالْمُتَفَيْهِقُونَ
‘‘তোমাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ও কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী অবস্থান লাভ করবে যাদের আচরণ সবচেয়ে সুন্দর। আর তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি অপ্রিয় এবং কেয়ামতের দিন আমার থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করবে তারা যারা বেশি কথা বলে, যাদের কথায় বা আচরণে অহংকার প্রকাশিত হয় এবং যারা কথাবার্তায় অন্যের প্রতি অবজ্ঞা বা অভদ্রতা প্রকাশ করে।’’[2]
এভাবে আমরা দেখছি যে, সুন্দর আচরণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল, তেমনি অশোভন আচরণ একটি কঠিন পাপ। তবে সকল অশোভন আচরণ নেক আমল বিনষ্ট করে না। ইমাম আবূ হানীফা অশোভন আচরণ বলতে মূলত খোঁটা দেওয়া ও কষ্ট দেওয়া (المن والأذى) বুঝিয়েছেন এবং তিনি বিষয়টি কুরআনের আলোকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
এছাড়া হিংসা-বিদ্বেষ নেক আমল নষ্ট করে বলে বর্ণিত হয়েছে। যুবাইর ইবুনল আউআম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন :
دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمْ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِيَ
الْحَالِقَةُ لا أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعَرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ وَالَّذِي
نَفْسِي بِيَدِهِ لا تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلا تُؤْمِنُوا
حَتَّى تَحَابُّوا أَفَلا أُنَبِّئُكُمْ بِمَا يُثَبِّتُ ذَاكُمْ لَكُمْ أَفْشُوا
السَّلامَ بَيْنَكُمْ
‘‘পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ব্যাধি তোমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে : হিংসা ও বিদ্বেষ। হিংসা-বিদ্বেষ মুন্ডন করে। আমি বলি না যে তা চুল মুন্ডন করে, বরং তা দীনকে মুন্ডন ও ধ্বংস করে। আমার প্রাণ যাঁর হাতে তাঁর শপথ করে বলছি, মুমিন (বিশ্বাসী) না হলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর পরস্পরে একে অপরকে ভালো না বাসলে তোমরা মুমিন (বিশ্বাসী) হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে এ ভালবাসা প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি শিখিয়ে দিব না? পরস্পরে সালাম প্রদানের রেওয়াজ প্রচলিত রাখবে।’’[3]
এ অর্থে আবু হুরাইরা (রা) থেকে যয়ীফ সনদে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে:
إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ
النَّارُ الْحَطَبَ أَوْ قَالَ الْعُشْبَ
‘‘খবরদার! হিংসা থেকে সাবধান; কারণ হিংসা এমনভাবে নেককর্ম ধ্বংস করে ফেলে, যেভাবে আগুন খড়ি বা খড়কুটো পুড়িয়ে ফেলে।’’[4]
[1] হাদীসটি সহীহ। তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৩৬৩ (কিতাবুল বির্রি ওয়া সিলাহ, বাবু মা জাআ ফী হুসনিল খুলুকি); হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/২২; আলবানী, সহীহুল জামি ২/৯৯৮।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৩৭০। (কিতাবুল বির্রি ওয়াস সিলাহ, বাবু মা জাআ ফী মাআলিল আখলাক)। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৬৬৪, নং ২৫১০, (কিতাবু সিফাতিল কিয়ামাতি..., বাব ৫৬); আহমদ, আল-মুসনাদ ১/১৬৪, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/১৮৫, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৩০, আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৩/২৩৭-২৪২, নং ৭৭৭। হাদীসটি হাসান।
[4] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/২৭৬ (কিতাবুল আদাব, বাবুন ফিল হাসাদি); আলবানী, যায়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ. ৩২৩, নং ২১৯৭।
৩. ৪. রিয়া
রিয়া (الرياء) অর্থ প্রদর্শন করা বা প্রদর্শনেচ্ছা। আল্লাহর জন্য করণীয় ইবাদত পালনের মধ্যে মানুষের দর্শন, প্রশংসা বা বাহবার ইচ্ছা পোষণ করাকে রিয়া বলে।
মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করে তাকে জাহান্নামী বানানোর জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ ‘রিয়া’। কুরআন-হাদীসে রিয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তাদের একজন বড় আলিম, একজন প্রসিদ্ধ শহীদ ও একজন বড় দাতা। তারা আজীবন আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে কাটালেও রিয়ার কারণে তারা ধ্বংসগ্রস্ত হয়।[1]
বিভিন্ন হাদীসে রিয়াকে ‘শিরক আসগার’ বা ছোট শিরক এবং ‘শিরক খাফী’ বা লূক্কায়িত শিরক বলা হয়েছে। কারণ বান্দা আল্লাহর জন্য ইবাদত করলেও অন্য সৃষ্টি থেকেও সেজন্য ‘কিছু’ আশা করে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করে। এ শিরকের কারণে মুসলিম কাফির বলে গণ্য না হলেও তার ইবাদত ধ্বংস ও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। মাহমূদ ইবন লাবীদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالُوا وَمَا
الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ
وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ
اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ
تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً
‘‘আমি সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে ভয় পাই তা হলো শিরক আসগার বা ক্ষুদ্রতর শিরক। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: হে আল্লাহর রাসূল, শিরক আসগার কী? তিনি বলেন: রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা। কিয়ামতের দিন যখন মানুষদেরকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে তখন মহান আল্লাহ এদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে তাদের নিকট যাও, দেখ তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’’[2]
এক হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
أَلا أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِي مِنْ الْمَسِيحِ
الدَّجَّالِ قَالَ قُلْنَا بَلَى فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِيُّ أَنْ يَقُومَ
الرَّجُلُ يُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلاتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ
‘‘দাজ্জালের চেয়েও যে বিষয় আমি তোমাদের জন্য বেশি ভয় পাই সে বিষয়টি কি তোমাদেরকে বলব না? আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন। তিনি বলেন, বিষয়টি গোপন শির্ক। গোপন শির্ক এই যে, একজন সালাতে দাঁড়াবে এরপর যখন দেখবে যে মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে তখন সে সালাত সুন্দর করবে।’’[3]
রিয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্য মুমিনের চেষ্টা করতে হবে যথাসম্ভব সকল নফল ইবাদত গোপনে করা। তবে যে ইবাদত প্রকাশ্যে করাই সুন্নাত-সম্মত তা প্রকাশ্যেই করতে হবে। রিয়ার ভয়ে কোনো নিয়মিত ইবাদত বা প্রকাশ্যে করণীয় ইবাদত বাদ দেওয়া যাবে না। রিয়ার অনুভূতি মন থেকে দূর করতে চেষ্টা করতে হবে। কখনো এসে গেলে বারবার তাওবা করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে তাওফীক প্রার্থনা করতে হবে।
রিয়ার কারণ সমাজের মানুষদের কাছে সম্মান, মর্যাদা বা প্রশংসার আশা। আমাদের বুঝতে হবে যে, দুনিয়ায় কোনো মানুষই কিছু দিতে পারে না। যে মানুষকে দেখানোর বা শোনানোর জন্য, যার প্রশংসা বা পুরস্কার লাভের জন্য আমি লালায়িত হচ্ছি সে আমার মতই অসহায় মানুষ। আমার কর্ম দেখে সে প্রশংসা নাও করতে পারে। হয়ত তার প্রশংসা শোনার আগেই আমার মৃত্যু হবে। অথবা প্রশংসা করার আগেই তার মৃত্যু হবে। আর সে প্রশংসা বা সম্মান করলেও আমার কিছুই লাভ হবে না। আমার পালনকর্তার পুরস্কারই আমার জন্য যথেষ্ট। তিনি অল্পতেই খুশি হন ও বেশি পুরস্কার দেন। তিনি দিলে কেউ ঠেকাতে পারে না। আর তিনি না দিলে কেউ দিতে পারে না।
কা’ব ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلا فِي غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ
الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ
‘‘দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে একটি মেষপালের মধ্যে ছেড়ে দিলে নেকড়েদুটি মেশপালের যে ক্ষতি করে, সম্পদ ও সম্মানের লোভ মানুষের দীনের তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করে।’’[4]
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫১৩-১৫১৪ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবু মান কাতালা লির্রিয়া)।
[2] আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/৪২৮-৪২৯; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১০২। হাদীসটি সহীহ।
[3] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১৪০৬ (কিতাবুয যুহদ, বাবুর রিয়া ওয়াস সুমআখ); আলবানী, সহীহুুত তারগীব ১/৮৯। হাদীসটি হাসান।
[4] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৫৮৮ (কিতাবুয যুহদ, বাব ৪৩)। হাদীসটি হাসান-সহীহ।
৩. ৫. উজব
উজব (العُجْب) শব্দের আত্মতৃপ্তি বা আত্মগরিমা। আজব (العَجَب) অর্থ অবাক হওয়া, আশ্চার্যান্বিত হওয়া বা তাজ্জব হওয়া। নিজের কর্মে বা মতে নিজেই অবাক হওয়া, পরিতৃপ্ত থাকা বা আত্মগরিমায় ভোগাকে উজ্ব বলা হয়।
উজব, আত্মতৃপ্তি বা আত্মগরিমা অহঙ্কারের একটি দিক। অহঙ্কার, এর প্রকাশ ও প্রতিরোধ বিষয়ে ‘‘রাহে বেলায়াত’’ গ্রন্থে আলোচনার চেষ্টা করেছি। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, নিজেকে অন্য কোনো মানুষ থেকে কোনো দিক থেকে উন্নত, ভালো, উত্তম বা বড় মনে করা, অথবা কাউকে কোনোভাবে নিজের চেয়ে হেয় মনে করাই কিবর, তাকাববুর বা অহঙ্কার। এটি মূলত একটি মানসিক অনুভূতি, তবে কর্মের মধ্যে অনেক সময় তার কিছু প্রভাব থাকে। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّ اللَّهَ لا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالا فَخُورًا
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’’[1]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
وَلا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلا تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ
لا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
‘‘তুমি মানুষের জন্য তোমার ঘাড় বক্র কর না এবং তুমি পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না; আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।’’[2]
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ
قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ
حَسَنَةً قَالَ إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ الْكِبْرُ بَطَرُ
الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ
‘‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার বিদ্যমান সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’’ তখন এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘মানুষ তো ভালবাসে যে তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক ....।’’ তিনি বলেন: ‘‘আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য ভালবাসেন। অহঙ্কার হচ্ছে সত্য অপছন্দ করা ও মানুষদেরকে অবজ্ঞা বা হেয় করা।’’[3]
অহঙ্কার মহান আল্লাহর অধিকার। কোনো মানুষের জন্য অহঙ্কার করা মূলত আল্লাহর অধিকারে হস্তক্ষেপ। কারণ, অহঙ্কারের বিষয় সর্বদা আল্লাহর নিয়ামতেই হয়। পৃথিবীর সকল নিয়ামত আল্লাহ সবাইকে সমানভাবে প্রদান করেন না। কাউকে দেন, কাউকে দেন না অথবা কমবেশি প্রদান করেন। যিনি নিয়ামত পেয়েছেন তার দায়িত্ব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কিন্তু যদি তিনি এ নিয়ামতকে আল্লাহর দয়ার দান বা ভিক্ষা হিসাবে গ্রহণ না করে নিজস্ব উপার্জন ও সম্পদ মনে করেন তখনই অহঙ্কারের শুরু হয়। এতে প্রথমেই আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। বেশি নিয়ামত-প্রাপ্ত বান্দার দায়িত্ব কম নিয়ামত প্রাপ্ত কোনো বান্দাকে দেখলে প্রথমত আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং দ্বিতীয়ত কম নিয়ামত প্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে যথাযোগ্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধাভরে আচরণ করা।
অহঙ্কার ধ্বংসের পথ। সবচেয়ে নোংরা অহঙ্কার ‘‘ধার্মিকতার অহঙ্কার’’ বা ‘উজব’। ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগির কারণে বা কোনো বিশেষ ধর্মীয় দলের অনুসারী হওয়ার কারণে নিজেকে অন্য কারো চেয়ে বেশি ধার্মিক বলে মনে করা বা নিজের ধার্মিকতায় সন্তুষ্টি বোধ করাই ‘‘উজব’’। বস্ত্তত এর চেয়ে বড় নির্বুদ্ধিতা আর কিছুই নেই। এর বড় কারণ নিজের পাপ ও দুর্বলতার দিকে না লক্ষ্য করে অন্য মানুষের পাপ-অন্যায়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। আল্লাহর অগণিত নিয়ামতের মুকাবিলায় আসলেই কিছু গ্রহণযোগ্য নেক আমল করতে পেরেছি কিনা তার ঠিক নেই, যা কিছু করেছি তা আল্লাহর নিকট কবুল হয়েছে কিনা তারও ঠিক নেই, মৃত্যু পর্যন্ত এ আমল ধরে রাখতে পারব কিনা তারও ঠিক নেই, এরপরও মুমিন কিভাবে নিজেকে অন্যের চেয়ে অধিক ধার্মিক বলে চিন্তা করতে পারেন?! ধ্বংসের জন্য এর চেয়ে বড় পথ আর কিছুই হতে পারে না।
এজন্য হাদীস শরীফে ‘‘উজব’’-কে পাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لَوْ لَمْ تَكُوْنُوْا تُذْنِبُوْنَ لَخِفْتُ عَلَيْكُمْ مَا هُوَ أَكْبَرُ مِنْ
ذَلِكَ الْعُجْبُ الْعُجْبُ.
‘‘তোমরা যদি পাপ না করতে তাহলে আমি তোমাদের জন্য পাপের চেয়ে ভয়ঙ্করতর বিষয়ের ভয় পেতাম, তা হলো উজ্ব, তা হলো উজ্ব।’’[4]
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
وَأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ فَشُحٌّ مُطَاعٌ وَهَوًى مُتَّبَعٌ وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ
بِنَفْسِهِ
‘‘ধ্বংসকারী স্বভাবগুলি হলো (১) আনুগত্যকৃত লোভণ্ডকৃপণতা, (২) অনুসরণকৃত প্রবৃত্তি এবং (৩) নিজের বিষয়ে মানুষের পরিতৃপ্তি।’’[5]
ঈমানের অহঙ্কার, ইলমের অহঙ্কার ইত্যাদি বিষয়ে উমার (রা) বলেন:
مَنْ قَالَ أَنَا مُؤْمِنٌ فَهُوَ كَافِرٌ وَمَنْ قَالَ هُوَ عَالِمٌ فَهُوَ
جَاهِلٌ وَمَنْ قَالَ هُوَ فِيْ الْجَنَّةِ فَهُوَ فِيْ النَّارِ.
‘‘যে ব্যক্তি বলে: আমি মুমিন সে কাফির, যে ব্যক্তি বলে: আমি আলিম সে জাহিল এবং যে ব্যক্তি বলে: আমি জান্নাতী সে জাহান্নামী।’’[6]
উজব বা আত্মতৃপ্তি ও আত্মগরিমার একটি প্রকাশ সকল মানুষের মধ্যে ত্রুটি দেখা এবং নিজে বা নিজের মতাবলম্বী ছাড়া সকলেই খারাপ পথে চলছে বলে দাবি করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
إِذَا قَالَ الرَّجُلُ (إِذَا سَمِعْتَ الرَّجُلَ يَقُوْلُ) هَلَكَ النَّاسُ
فَهُوَ أَهْلَكُهُمْ
‘‘যদি কেউ বলে- যদি শুন যে কেউ বলছে-: মানুষেরা ধ্বংস হয়ে গেল, তবে সেই সবচেয়ে বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত।’’[7]
অহঙ্কার, আত্মতৃপ্তি বা আত্মগরিমার একটি প্রকাশ ব্যক্তিগত, দলগত বা গোষ্ঠীগতভাবে অন্যান্য মানুষদের উপহাস করা, অবজ্ঞা করা। যদি সত্যিই কেউ বাহ্যিকভাবে উপহাস বা অবজ্ঞার যোগ্য হয় তাকেও উপহাস করা যায় না; কারণ হতে পারে আল্লাহর কাছে সে উত্তম। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ
يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا
مِنْهُنَّ وَلا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ
الاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ
الظَّالِمُونَ
‘‘হে মুমিনগণ, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর সম্প্রদায়কে উপহাস-বিদ্রূপ না করে; হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। কোনো নারী যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ-উপহাস না করে; হতে পারে সে বিদ্রূপকারিণী অপেক্ষা উত্তম। আর তোমরা একে অপরকে নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপাধি দিয়ে ডেকো না। ঈমানের পর পাপী নাম পাওয়া খুবই খারাপ বিষয়। আর যারা তাওবা করে না তারাই যালিম।’’[8]
‘‘উজব’’ ইহূদী-খৃস্টানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা নিজেদের আল্লাহর ওলী, আওলাদে রুসুল বা নবীগণের আওলাদ, আল্লাহর সমত্মান ও আল্লাহর খাঁটি আবিদ বলে দাবি ও প্রচার করত। এসকল বিষয়ে তারা তাদের বংশ, কাশফ, কারামত, ইলহাম, ইলকা ইত্যাদির দোহাই দিত। খৃস্টানগণ এ বিষয়ে অধিক অগ্রসর ছিলেন। যে কোনো পাঠক খৃস্টান সাধু ও পাদরিদের লেখা কাহিনী পড়লে এ জাতীয় অগণিত দাবি দেখবেন। মহান আল্লাহ তাদের এ সকল দাবি-দাওয়াকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করে বলেন:
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يُزَكُّونَ أَنْفُسَهُمْ بَلِ اللَّهُ يُزَكِّي مَنْ
يَشَاءُ وَلا يُظْلَمُونَ فَتِيلا انْظُرْ كَيْفَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ
الْكَذِبَ وَكَفَى بِهِ إِثْمًا مُبِينًا
‘‘তুমি কি দেখ নি যারা নিজেদের পরিশুদ্ধতা দাবি করে। বরং আল্লাহ যাকে চান পরিশুদ্ধ করেন আর তাদেরকে সূতা পরিমাণ জুলুমও করা হবে না। দেখ, কিভাবে তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা রটনা করে। আর প্রকাশ্য পাপ হিসেবে এটিই যথেষ্ট।’’[9]
এ জাতীয় ‘উজব’ বা দীনদারির আত্মগরিমা প্রকাশক সকল বিষয় কুরআন ও হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি ‘নেককার’ বা ব্যক্তিগত পবিত্রতা ও দীনদারি বোধক নাম বা উপাধি ব্যবহার নিষেধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
فَلا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى
‘‘অতএব তোমরা নিজেদের আত্মপ্রশংসা বা পরিশুদ্ধতা-পবিত্রতা বর্ণনা করো না, কে মুত্তাকী তা তিনি অধিক জানেন।’’[10]
যে নামের অর্থ দ্বারা ব্যক্তিকে নেককার বুঝা যায় সে নাম রাখতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আপত্তি করতেন। উম্মুল মুমিনীন উম্মু সালামা (রা)-এর কন্যা যাইনাব বলেন:
إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ نَهَى عَنْ هَذَا الاسْمِ وَسُمِّيتُ بَرَّةَ فَقَالَ
رَسُولُ اللَّهِ ﷺ لا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ اللَّهُ أَعْلَمُ بِأَهْلِ الْبِرِّ
مِنْكُمْ فَقَالُوا بِمَ نُسَمِّيهَا قَالَ سَمُّوهَا زَيْنَبَ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ নাম রাখতে নিষেধ করেছেন। আমার নাম রাখা হয় ‘‘বার্রা’’ (পুণ্যবতী)। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: তোমরা নিজেদের আত্মপ্রশংসা করো না বা নিজেদের ‘নেককার’ হওয়ার মত কোনো কথা বলো না। তোমাদের মধ্যে পুণ্যবান-পুণ্যবতী কে তা আল্লাহ অধিক অবগত আছেন। তখন তারা বলেন, আমরা তার নাম কী রাখব? তিনি বলেন: তার নাম রাখ যাইনাব।’’[11]
উল্লেখ্য যে, সুন্দর দেখতে একটি আরবীয় গাছের নাম ‘‘যাইনাব’’। এ গাছের নামে আরবে মেয়েদের ‘‘যাইনাব’’ নাম রাখার প্রচলন ছিল। এ সকল নাম ব্যক্তির সৌন্দর্য প্রকাশ করে, কিন্তু তার নেক আমল প্রকাশ করে না। এজন্য তিনি এরূপ নাম রাখার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি নেক আমল প্রকাশক নাম রাখতে নিষেধ করেন।
ইসলামের বরতকময় তিন যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ‘‘তাযকিয়া’’-বোধক, অর্থাৎ ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ পবিত্রতা ও আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক বোধক নাম ও উপাধি ব্যবহার প্রচলিত হতে থাকে। প্রথম তিন যুগে উপাধির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। একটু পরের যুগে সামান্য উপাধি যা ব্যবহার করা হতো তা বাহ্যিক পেশা বা বাহ্যিক আমল অনুসারে। যেমন কখনো কখনো কারো সম্পর্কে বলা হতো: আলেম, কারী, মুহাদ্দিস, ফকীহ, যাহেদ বা সংসারত্যাগী, সালেহ বা নেককর্মশীল, ইমাম বা নেতা ইত্যাদি। এগুলিও তাবে-তাবেয়ীগণের পরের যুগে ব্যবহার করা হতো, উপাধি হিসবে নয়, বরং মৃত্যুর পরে জীবনী বর্ণনার প্রয়োজনে বলা হতো এবং অতি অল্প পরিমাণে ব্যবহার করা হতো। বান্দার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক কতটুকু তা নিয়ে উপাধি তৈরি করা হতো না।
গাওস, কুতুব, মুহিউস সুন্নাহ, কামেউল বিদ‘আত, ইমামুল আইম্মাহ, গওস, গাওসে আ’জম, গাওসে সাকালাইন, মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আযম, মুজাদ্দিদে যামান, ওলীয়ে কামেল, হাদীয়ে জামান, কুতুব, কুতুবে রাববানী, কুতুবে দাওরান, কুতুবে এরশাদ, খাজা, আশেকে রাসূল, ওলীকুল শিরোমণি, সূফী সম্রাট, মাহবুবে ইলাহী, মাহবুবে সোবহানী, কেবলা, কাবা ইত্যাদি ইত্যাদি অগণিত উপাধির কোনোকিছুই তাঁরা কখনোই ব্যবহার করেন নি। কারো জীবদ্দশায় তো নয়ই, এমনকি কারো মৃত্যুর পরেও তাঁর নামের সাথে এরূপ কোনো উপাধি তাঁরা ব্যবহার করতেন না।[12]
এ সকল উপাধি ব্যবহার সুন্নাহ বিরোধী নিষিদ্ধ কর্ম। যেখানে সাধারণ ‘‘বার্রা’’ বা পুণ্যবতী নাম পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাখতে দেন নি, সেখানে এ জাতীয় গালভরা উপাধিগুলো তাঁর কাছে কত বেশি অপছন্দনীয় তা চিন্তা করুন। বস্ত্তত এ সকল উপাধী উপাধিপ্রাপ্ত ও তার অনুসারীদের মধ্যে ‘‘উজব’’ সৃষ্টি করে। সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা ও আমাদের রুচিকে সুন্নাত অনুসারে সংশোধন করা দরকার।
হানাফী মাযহাবের অন্যতম দু ইমাম, ইমাম মুহাম্মাদ ও আবু ইউসূফ তাঁদের উস্তাদ ইমাম আবু হানীফার ওফাতের পরে তাঁর মতামত সংকলন করে অনেক বই লিখেন। এ বইয়েও তাঁদের কিছু বক্তব্য আমরা দেখছি। তাঁরা ‘রাহিমাহুল্লাহ’ বা ‘রাদিয়াল্লাহু আনহু’ বলা ছাড়া কোনো উপাধি ব্যবহার করেন নি। অগণিত স্থানে শুধু লিখেছেন: আবু হানীফা বলেছেন, আবু হানীফা রাহিমহুল্লাহ বলেছেন, আবু হানীফার মত, আবু হানীফা রাদিআল্লাহু আনহুর মত ইত্যাদি। ইমাম, ইমামুল মুহাদ্দিসীন, ইমাম আ’যম, ইমামুল আইম্মাহ, ফকীহকুল শিরোমণি, ওলীকুল শিরোমণি, গওসে সামদানী ইত্যাদি একটি উপাধিও তাঁরা তাঁর জন্য ব্যবহার করেন নি। তাঁদের সকল ভক্তি প্রকাশ করেছেন একটি বাক্যে: ‘রহিমাহুল্লাহ’ বা ‘রাদিআল্লাহু আনহু’।
আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফার দু ছাত্র আবূ মুতী ও আবূ মুকাতিল আল-ফিকহুল আবসাত ও আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম গ্রন্থদ্বয়ে ইমামের নাম উল্লেখের সময় কোনো উপাধি ব্যবহার করেন নি। শুধু লিখেছেন: ‘‘আবূ হানীফা বলেন’’ বা ‘‘আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বলেন’’।
[1] সূরা (৪) নিসা: ৩৬ আয়াত।
[2] সূরা (৩১) লুকমান: ১৮ আয়াত।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯৩ (কিতাবুল ঈমান, বাবু তাহরীমিল কিবরি ওয়া বায়ানিহী)
[4] আলবানী, সহীহুল জামি ২/৯৩৮ (নং ৫৩০৩)। হাদীসটি হাসান।
[5] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৯১; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১২। হাদীসটি হাসান লিগাইরহী।
[6] ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৩২ (সূরা নিসার ৪৯ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে)
[7] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০২৪ (কিতাবুল বির্রি..., বাবুন নাহই আন কাওলি: হালাকান্নাস)।
[8] সূরা (৪৯) হুজুরাত: ১১ আয়াত।
[9] সূরা (৪) নিসা: ৪৯-৫০ আয়াত।
[10] সূরা (৫৩) নাজম: ৩২ আয়াত।
[11] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬৮৬ (কিতাবুল আদাব, বাবু ইসতিহবাবি তাগয়ীরিল ইসমিল কাবীহ)।
[12] বিস্তারিত দেখুন, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৫০৮-৫১৬।
৪. জান্নাত-জাহান্নামের সাক্ষ্য
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এখানে অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন, তা হলো কাউকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলে নিশ্চয়তা দান বা সাক্ষ্য প্রদান। তিনি বলেছেন যে, মুমিনের বিষয়টি মূলত আল্লাহর মর্জির উপর নির্ভরশীল। সকল শর্ত পূরণ করার পরে আমলটি কবুল হওয়ার আশা করা যায়, তেমনি কুফর-শিরকমুক্ত পাপের ক্ষেত্রে শাস্তির নিশ্চিত ভয়ের পাশাপাশি ক্ষমার আশা করা যায়। এ থেকে জানা যায় যে, দুনিয়াতে কোনো মানুষের কর্মের ভিত্তিতে তাকে নিশ্চিতভাবে ‘আল্লাহর ওলী’ বা জান্নাতী অথবা জাহান্নামী বলা যায় না। আমরা দেখেছি যে, ইমাম তাহাবী বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফার এ বিষয়ক আকীদা ব্যাখ্যা করে বলেছেন:
‘‘মু‘মিনগণের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল ইহসান অর্জনকারী নেককার তাদের সম্পর্কে আমরা আশা করি যে, আল্লাহ্ পাক তাদের দোষক্রটি ক্ষমা করবেন এবং নিজ রাহমাতে তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তবে, আমরা তাদের সম্পর্কে সম্পুর্ণ নির্ভয় নই এবং তাদের জান্নাতী হওয়ার কোনো সাক্ষ্যও আমরা প্রদান করি না।’’
এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এক্ষেত্রে ওহীর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হবে। কুরআন বা হাদীসে যাদেরকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাদেরকে নিশ্চিতরূপে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলতে হবে। অন্য কারো বিষয়ে নিশ্চিতরূপে বলা যাবে না যে, লোকটি জান্নাতী বা জাহান্নামী, ধারণা বা আশা পোষণ করা যাবে। তিনি বলেন:
فَإِنَّ النَّاسَ عِنْدَنَا عَلَى ثَلاَثَةِ مَنَازِلَ: الأَنْبِيَاءُ مِنْ أَهْلِ
الْجَنَّةِ، وَمَنْ قَالَتِ الأَنْبِيَاءُ إِنَّهُ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَهُوَ
مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ. وَالْمَنْزِلَةُ الأُخْرَى لِلْمُشْرِكِيْنَ نَشْهَدُ
عَلَيْهِمْ أَنَّهُمْ مِنْ أَهْلِ النَّارِ، وَالْمَنْزِلَةُ الثَّالِثَةُ
لِلْمُوَحِّدِيْنَ نَقِفُ عَلَيْهِمْ، فَلاَ نَشْهَدُ أَنَّهُمْ مِنْ أَهْلِ
النَّارِ وَلاَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ، وَلَكِنَّا نَرْجُوْ لَهُمْ وَنَخَافُ
عَلَيْهِمْ... قَالَ الْمُتَعَلِّمُ .. أَخْبِرْنِيْ هَلْ أَحَدٌ مِنَ النَّاسِ
تُوْجِبُ لَهُ الْجَنَّةَ إِنْ رَأَيْتَهُ صَوَّاماً قَوَّاماً غَيْرَ
الأَنْبِيَاءِ صَلَوَاتُ اللهِ عَلَى نَبِيِّنَا وَعَلَيْهِمْ وَمَنْ قَالَتْ لَهُ
الأَنْبِيَاءُ؟ قَالَ الْعَالِمُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: لاَ أُوْجِبُ الْجَنَّةَ
إِلاَّ لِمَنْ أَوْجَبَهُ النَّصُّ، وَكَذَلِكَ النَّارُ.
‘‘মানুষ আমাদের নিকট তিন পর্যায়ের: (১) নবীগণ জান্নাতী এবং নবীগণ যার বিষয়ে বলেছেন যে সে জান্নাতী সেও জান্নাতী। (২) দ্বিতীয় পর্যায় মুশরিকদের। আমরা তাদের বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করি যে, তারা জাহান্নামী। (৩) তৃতীয় পর্যায় মুমিনগণ। তাদের বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত প্রদান থেকে বিরত থাকি, তাদেরকে আমরা জাহান্নামী বলেও সাক্ষ্য দিই না এবং জান্নাতী বলেও সাক্ষ্য দিই না। কিন্তু আমরা তাদের বিষয়ে আশা পোষণ করি ও আশঙ্কাও করি। .... আবূ মুকাতিল বলেন: ... নবীগণ এবং যাদের কথা নবীগণ বলেছেন তাঁরা ছাড়া অন্য কাউকে যদি আপনি দেখেন যে, সে সদাসর্বদা অত্যধিক তাহাজ্জুদ, সিয়াম ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগিতে রত তবে তার বিষয়ে কি আপনি জান্নাতের নিশ্চয়তা প্রদান করবেন? ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন, না, যার বিষয়ে নস্স বা কুরআন বা হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে সে ব্যক্তি ভিন্ন আর কারো বিষয়ে আমি জান্নাতের নিশ্চয়তা প্রদান করব না। জাহান্নামের বিষয়ও অনুরূপ।’’[1]
[1] ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ২৭-২৯।
৫. মুজিযা, কারামাত, ইসতিদরাজ
আমরা দেখেছি, এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ইসলামী আকীদার সর্ম্পূণ ভিন্ন একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি বলেছেন:
‘‘নবীগণের জন্য ‘আয়াত’ প্রমাণিত। এবং ওলীগণের কারামত সত্য। আর ইবলীস, ফিরাউন, দাজ্জাল ও তাদের মত আল্লাহর দুশমনদের দ্বারা যে সকল অলৌকিক কর্ম সাধিত হয়, যে সকল অলৌকিক কর্মের বিষয়ে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের দ্বারা তা সংঘটিত হয়েছিল বা হবে, সেগুলোকে আমরা আয়াত বা কারামত বলি না, বরং এগুলোকে আমরা তাদের ‘কাযায়ে হাজাত’ বা প্রয়োজন মেটানো বলি। কারণ আল্লাহ তাঁর দুশমনদের প্রয়োজন মিটিয়ে দেন ‘ইসতিদরাজ’ হিসেবে -তাদেরকে তাদের পথে সুযোগ দেওয়ার জন্য- এবং তাদের শাস্তি হিসেবে। এতে তারা ধোঁকাগ্রস্ত হয় এবং আরো বেশি অবাধ্যতা ও অবিশ্বাসে নিপতিত হয়। এগুলি সবই সম্ভব।’’
আমরা এখানে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
৫. ১. আয়াত ও মুজিযা
মুজিযা (المعجزة) শব্দটি আরবী ‘ইজায’ (إعجاز) শব্দ থেকে গৃহীত, যার অর্থ ‘অক্ষম করা’। মুজিযা অর্থ ‘অক্ষমকারী অলৌকিক নিদর্শন’’। নবীগণ তাঁদের নুবুওয়াতের দাবি প্রমাণ করতে যে সকল অলৌকিক নিদর্শন প্রদর্শন করেন সেগুলোকে ‘মুজিযা’ বলা হয়।[1]
কুরআন-হাদীসে মুজিযা শব্দটি ব্যবহৃত হয় নি, মুজিযা বুঝাতে ‘আয়াত’ (الآية) অর্থাৎ চিহ্ন বা নিদর্শন বলা হয়েছে। পরবর্তী যুগে ‘মুজিযা’ পরিভাষাটির উৎপত্তি। নতুন পরিভাষা ব্যবহারে কোনো আপত্তি নেই; তবে কুরআন-হাদীসের ‘‘মাসনূন’’ পরিভাষা ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে উত্তম। সম্ভবত এজন্যই ‘মুজিযা’ বুঝাতে ইমাম আযম ‘আয়াত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছায় মুজিযা প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ বলেন:
قَالُوا إِنْ أَنْتُمْ إِلا بَشَرٌ مِثْلُنَا تُرِيدُونَ أَنْ تَصُدُّونَا عَمَّا
كَانَ يَعْبُدُ آَبَاؤُنَا فَأْتُونَا بِسُلْطَانٍ مُبِينٍ. قَالَتْ لَهُمْ
رُسُلُهُمْ إِنْ نَحْنُ إِلا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ عَلَى
مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَمَا كَانَ لَنَا أَنْ نَأْتِيَكُمْ بِسُلْطَانٍ
إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ
‘‘তারা (কাফিরগণ) বলত: ‘তোমরা (নবীগণ) তো আমাদেরই মত মানুষ। আমাদের পিতৃপুরুষগণ যাদের ইবাদত করত তোমরা তাদের ইবাদত থেকে আমাদেরকে বিরত রাখতে চাও। অতএব তোমরা আমাদের নিকট কোনো অকাট্য ক্ষমতা (মুজিযা) উপস্থিত কর। তাদের রাসূলগণ তাদেরকে বলতেন: সত্য বটে আমরা তোমাদের মত মানুষ বৈ কিছুই নই, কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তোমাদের নিকট ক্ষমতা (মুজিযা) উপস্থিত করা আমাদের কাজ নয়। মুমিনগণের আল্লাহরই উপর নির্ভর করা উচিত।’’[2]
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে:
وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآَيَةٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ
‘‘আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোনো নিদর্শন (মুজিযা) উপস্থিত করা কোনো রাসূলের কাজ নয়।’’[3]
এ সকল আয়াত ও অন্যান্য আয়াত বারবার উল্লেখ করেছে যে, নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছায় ও নির্দেশে মুজিযা প্রদর্শন করেছেন। কুরআন কারীমে নবীগণের অনেক মুজিযার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নূহ (আ)-এর নৌকার মুজিযা, ইবরাহীম (আ)-এর অগ্নিকুন্ডে নিরাপদ থাকার মুজিযা, মূসা (আ)-এর লাঠি ও অন্যান্য মুজিযা, ঈসা (আ)-এর মৃতকে জীবিত করা ও অন্যান্য মুজিযা, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা, ইসরা, মিরাজ ও অন্যান্য মুজিযা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে। এগুলি বিশ্বাস করা মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব।
[1] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৩০; জুরজানী, আত-তা’রীফাত, পৃ. ২৮২।
[2] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১০-১১ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৬) আন‘আম: ৯১ আয়াত; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৩; সূরা (২৩) মুমিনূন: ২৪, ৩৩; সূরা (২৬) শু‘আরা: ১৫৪, ১৫৬; সূরা (৩৬) ইয়াসীন: ১৫ আয়াত।
[3] সূরা (১৩) রা’দ: ৩৮ আয়াত, সূরা (৪০) গাফির/মুমিন: ৭৮ আয়াত।
৫. ২. কারামাতুল আওলিয়া
নবীগণের ‘আয়াত’ প্রসঙ্গে ইমামগণ আরো দু প্রকারের ‘অলৌকিক’ কর্মের আলোচনা করেছেন: ওলীগণের কারামত ও পাপীদের ইসতিদরাজ। এগুলির বাহ্যিক প্রকাশ অনেকটা এক রকম হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলির মধ্যে পার্থক্য অনেক। যেন কোনো মুমিন অজ্ঞতার কারণে যে কোনো অলৌকিক কর্মকেই মুজিযা বা কারামত মনে না করে এজন্য তারা মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজ একত্রে ব্যাখ্যা করেছেন।
৫. ২. ১. বিলায়াত ও ওলী
‘ওলী’ শব্দটি আরবী (الـوِلايَـة) বিলায়াত/ওয়ালায়াত শব্দ থেকে গৃহীত। আমরা দেখেছি যে, শব্দটির অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব বা অভিভাবকত্ব। বিলায়াত অর্জনকারীকে ‘ওলী’/‘ওয়ালী’ (الولي) বলা হয়, অর্থাৎ নিকটবর্তী, বন্ধু, সাহায্যকারী বা অভিভাবক। ইসলামী পরিভাষায় ‘বিলায়াত’ ‘ওলী’ ও ‘মাওলা’ শব্দের বিভিন্ন প্রকারের ব্যবহার রয়েছে। উত্তরাধিকার আইনের পরিভাষায় ও রাজনৈতিক পরিভাষায় এ সকল শব্দ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। তবে বেলায়াত বা ওলী শব্দদ্বয় সর্বাধিক ব্যবহৃত (ولاية الله) ‘আল্লাহর বন্ধুত্ব’ ও (ولي الله) ‘আল্লাহর বন্ধু’ অর্থে। আল্লাহর বন্ধুদের পরিচয় দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
أَلا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ
الَّذِينَ آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ
‘‘জেনে রাখ! নিশ্চয় আল্লাহর ওলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিমত্মাগ্রস্থও হবে না- যারা ঈমান এনেছে এবং যারা আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করে চলে বা তাকওয়া অবলম্বন করে।’’[1]
ঈমান অর্থ শিরক-কুফর-মুক্ত তাওহীদ ও রিসালাতের বিশ্বাস। তাকওয়া অর্থ আত্মরক্ষা করা। সকল পাপ বর্জনকে তাকওয়া বলা হয়। ঈমান ও তাকওয়া যার মধ্যে যত বেশি ও যত পরিপূর্ণ হবে তিনি আল্লাহর তত বেশি ওলী বলে বিবেচিত হবেন। এজন্য প্রত্যেক মুসলিমই আল্লাহর ওলী। ইমান ও তাকওয়ার গুণ যার মধ্যে যত বেশি থাকবে তিনি তত বেশি ওলী। আমরা দেখব যে, আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহুর মতে ঈমান ও মা’রিফাতের দিক থেকে সকল মুমিনই সমান। বিলায়াতের কমবেশি হয় মূলত তাকওয়া, নেক আমল ও কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণের পূর্ণতার ভিত্তিতে। এজন্য ইমাম আবূ হানীফার আকীদা বর্ণনা করে ইমাম তাহাবী বলেন:
وَالْمُؤْمِنُونَ كُلُّهُمْ أَوْلِيَاءُ الرَّحْمَنِ، وَأَكْرَمُهُمْ عِنْدَ
اللَّهِ أَطْوَعُهُمْ وَأَتْبَعُهُمْ لِلْقُرْآنِ.
‘‘সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর নিকট সম্মানিত (ততবেশি বিলায়াতের অধিকারী)।[2]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, ফরয ইবাদতগুলো পালনের সাথে সাথে অনবরত নফল পালনের মাধ্যমে বান্দা বেলায়াত অর্জন করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ বলেছেন:
مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ
عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ
عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا
أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ
بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ
سَأَلَنِي لأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لأُعِيذَنَّهُ.
‘‘যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলীর সাথে শত্রুতা করে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার নৈকট্য অর্জন বা ওলী হওয়ার জন্য বান্দা যত কাজ করে তন্মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি যে কাজ আমি ফরয করেছি। (ফরয পালনই আমার নৈকট্য অর্জনের জন্য সবচেয়ে প্রিয় কাজ)। এবং বান্দা যখন সর্বদা নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আমার বেলায়তের পথে অগ্রসর হতে থাকে তখন আমি তাকে ভালবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণযন্ত্রে পরিণত হই, যা দিয়ে সে শুনতে পায়, আমি তার দর্শনেন্দ্রিয় হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখতে পায়, আমি তার হাত হয়ে যাই, যদ্দবার সে আঘাত করে এবং আমি তার পা হয়ে যাই, যদ্দবারা সে হাঁটে। সে যদি আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তাহলে আমি অবশ্যই তাকে তা প্রদান করি। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় প্রদান করি।’’[3]
ঈমান, তাকওয়া ও ফরয-নফল আমলের বাহ্যিক অবস্থার আলোকে আমরা মুসলিমদেরকে আল্লাহর ওলী হিসেবে ধারণা করব। তবে কার ঈমান, তাকওয়া ও আমল আল্লাহ কবুল করছেন তা আমরা জানি না। আমরা দেখেছি যে, এজন্য ওহীর নির্দেশনার বাইরে কাউকে ‘ওলী’ বলে সুনিশ্চিত বিশ্বাস করা বা সাক্ষ্য দেওয়া যায় না।
[1] সূরা (১০) ইউনূস: ৬২-৬৩ আয়াত।
[2] তাহাবী, আল-আকীদাহ (ইবন আবিল ইয্য-এর শারহসহ), পৃ: ৩৫৭-৩৬২।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৩৮৪ (কিতাবুর রাকাইক, বাবুত তাওয়াদু)।
৫. ২. ২. আয়াত ও কারামাত
কারামত (الكرامة) শব্দটির অর্থ ‘ভদ্রতা’, ‘সম্মাননা’ বা ‘সম্মান-চিহ্ন’। ঈমান ও তাকওয়ার অধিকারী ফরয ও নফল ইবাদত পালনকারী কোনো ব্যক্তি থেকে যদি কোনো অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয় তবে তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘কারামাত’ বলা হয়।
কুরআন মাজীদে এরূপ অলৌকিক কর্মকেও ‘আয়াত’ বলা হয়েছে। পূর্ববর্তী যুগের একজন ‘ওলী’-র পদস্খলন সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آَتَيْنَاهُ آَيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا
فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ
‘‘তাদেরকে সে ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও যাকে আমি ‘আয়াত’ বা অলৌকিক নিদর্শন দিয়েছিলাম, অতঃপর সে তা থেকে বিচ্যুত হয়, ফলে শয়তান তাকে তার অনুসারী বানিয়ে নেয় এবং সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’’[1]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্সিরগণ পূর্ববর্তী যুগের বিভিন্ন ওলীর কথা উল্লেখ করেছেন যাদেরকে আল্লাহ ‘কারামাত’ দান করেন, কিন্তু আল্লাহর হুকুম অমান্য করায় তারা বিপথগামী হয়ে যান। এ থেকে আমরা দেখি যে, ওলীদের কারামতকেও কুরআনে ‘আয়াত’ বলা হয়েছে। আমরা আরো দেখি যে, একজন নেককার মানুষ বিলায়াত ও কারামাত লাভের পরেও বিভ্রান্ত হতে পারেন। ‘কারামত’ প্রকাশিত হওয়া ওলী হওয়ার প্রমাণ নয়। বরং ঈমান ও তাকওয়া, অর্থাৎ পাপবর্জন ও অনবরত ফরয ও নফল ইবাদত পালন করতে থাকই বেলায়াতের একমাত্র চিহ্ন।
দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ নবীগণের অলৌকিক কর্মকে ‘মুজিযা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, কারণ নুবুওয়াতের চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাফিরদের অক্ষমতা প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ তাদের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেন। অনুরূপভাবে তাঁরা ওলীদের অলৌকিক কর্মকে ‘কারামত’ নামে আখ্যায়িত করেছেন, যেন মানুষ বুঝতে পারে যে, এরূপ অলৌকিক কর্ম ওলীর কোনো ক্ষমতা বা শক্তি নয়, বরং একান্তই আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘ইকরাম’ বা সম্মাননা মাত্র।[2]
‘‘ওলীগণের কারামত সত্য’’ অর্থ ওলীগণ থেকে অলৌকিক কর্ম প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। যদি কোনো মুমিন মুত্তাকী মানুষ থেকে কোনো অলৌকিক কার্য প্রকাশ পায় তাহলে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সম্মাননা বা কারামত বলে বুঝতে হবে। তা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেওয়া মু‘তাযিলী ও অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের আকীদা। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে নবী ছাড়াও অন্যান্য মুমিন মুত্তাকী মানুষের অলৌকিক কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এরূপ কারামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
[1] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৭৫ আয়াত।
[2] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৩০-১৩৩।
৫. ২. ৩. কারামাত বিষয়ক অস্পষ্টতা / ৫. ২. ৩. ১. অলৌকিক ক্ষমতার ধারণা
‘‘ওলীগণের কারামত সত্য’’ কথাটির বিষয়ে অনেকের মনে অস্পষ্টতা বা বিভ্রান্তিকর ধারণা বিদ্যমান। সেগুলির মধ্যে রয়েছে:
৫. ২. ৩. ১. অলৌকিক ক্ষমতার ধারণা
অনেকে কারামত অর্থ ‘‘অলৌকিক ক্ষমতা’’ বলে ধারণা করেন। তারা মনে করেন ওলীগণকে আল্লাহ অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন, যে ক্ষমতা তারা ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারেন। আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন জাতির কাফিরগণও এরূপ ধারণা করত। তারা নবী-রাসূলদের কাছে ‘সুলতান’ বা ক্ষমতা এবং আয়াত প্রদর্শনের দাবি করত। তাদের ধারণা ছিল, নবী-রাসূল হলে তাঁর মুজিযা প্রদর্শনের ক্ষমতা থাকতে হবে। কুরআনে এরূপ ধারণা খন্ডন করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, ‘আয়াত’ প্রদর্শনের ক্ষমতা কোনো নবী-রাসূলের থাকে না, অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তিনি যখন ইচ্ছা করেন তখন নবী-রাসূলদের মাধ্যমে তা প্রদর্শন করেন। নবী-রাসূলগণ ইচ্ছামত তা প্রদর্শনের ক্ষমতা রাখেন না।
ওলীগণের ‘‘আয়াত’’ বা ‘‘কারামত’’-ও একইরূপ। কোনো ওলী বা নেককার ব্যক্তি কর্তৃক কোনো অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হওয়ার অর্থ এ নয় যে, কর্মটি সম্পাদন করা সে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বা তার নিজের ক্ষমতা। এর অর্থ হলো একটি বিশেষ ঘটনায় আল্লাহ তাকে সম্মান করে একটি অলৌকিক চিহ্ন প্রদান করেছেন। অন্য কোনো সময়ে তা নাও দিতে পারেন।
একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, ২৩ হিজরীর প্রথম দিকে এক শুক্রবারে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) মসজিদে নববীতে খুতবা প্রদান কালে উচ্চস্বরে বলে উঠেন: (يا سارية، الجبلَ) ‘‘হে সারিয়া, পাহাড়ে যাও।’’ সে সময়ে একজন মুসলিম সেনাপতি সারিয়া ইবন যুনাইম পারস্যের এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার উপক্রম করছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি উমারের এই বাক্যটি শুনতে পান এবং পাহাড়ের আশ্রয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন।[1]
এ ঘটনায় আমরা উমার (রা)-এর একটি কারামত দেখতে পাই। তিনি হাজার মাইল দূরের যুদ্ধ ক্ষেত্রের অবস্থা ‘অবলোকন’ করেছেন, মুখে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে নির্দেশনা সারিয়া শুনতে পেয়েছেন। এ কারামতের অর্থ হলো, মহান আল্লাহ তাঁর এ মহান ওলীকে এ দিনের এ মুহূর্তে এ বিশেষ ‘সম্মাননা’ প্রদান করেন, তিনি দূরের দৃশ্যটি জনতে পারেন, নির্দেশনা দেন এবং তাঁর নির্দেশনা আল্লাহ সারিয়ার নিকট পৌঁছে দেন। এর অর্থ এ নয় যে, উমার (রা)-এর হাজার মাইল দূরের কিছু অবলোকন করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, অথবা তিনি ইচছা করলেই দূরের কিছু দেখতে পেতেন বা নিজের কথা দূরে প্রেরণ করতে পারতেন।
এ বছরেরই শেষে ২৩ হিজরীর যুলহাজ্জ মাসের ২৭ তারিখে উমার (রা) যখন ফজরের সালাত শুরু করেন, তখন তাঁরই পিছেন চাদর গায়ে মুসল্লীরূপে দাঁড়ানো আল্লাহর শত্রু আবূ লু’লু লুকানো ছুরি দিয়ে তাঁকে বারবার আঘাত করে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে যান। চেতনা ফিরে পেলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে কে আঘাত করল? তাঁকে বলা হয়, আবূ লু’লু। তিনি বলেন, আল-হামদু লিল্লাহ, আমাকে কোনো মুসলিমের হাতে শহীদ হতে হলো না। এর কয়েকদিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন।[2]
আল্লাহ প্রথম ঘটনায় হাজার মাইল দূরের অবস্থা উমারকে দেখিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় পাশে দাঁড়ানো শত্রুর বিষয়ে তাঁকে জানান নি। কারণ ‘কারামত’ কখনোই ক্ষমতা নয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া সম্মাননা মাত্র।
‘আয়াত’ বা অলৌকিক কর্মকে ‘অলৌকক ক্ষমতা’ মনে করে শিরকে নিপতিত হয়েছে পূর্ববর্তী অনেক জাতি। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ খৃস্টানগণ। ঈসা মাসীহ (আ) মৃতকে জীবিত করতেন আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিতে। কিন্তু খৃস্টানগণ একে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে ধারণা করে শিরকে নিপতিত হন। তারা দাবি করেন যে, ‘মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা ঈশ্বর ছাড়া কারো নেই, যীশু মৃতকে জীবিত করেছেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, যীশু ঈশ্বর বা তাঁর মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল। বস্ত্তত মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোনোরূপ ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ আছে বলে বিশ্বাস করা শির্ক।
[1] তাবারী, তারীখ ২/৫৫৩-৫৫৪; বাইহাকী, আল-ই’তিকাদ,পৃ. ৩১৪; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ৩/৫-৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪৬৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫১৪-৫১৫।
[2] ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ৭/১৩০-১৩৮।
৫. ২. ৩. ২. বিলায়াতের মানদন্ডের ধারণা
অজ্ঞতার কারণে অনেক মুসলিম ‘কারামত’-কে ওলী হওয়ার মানদন্ড বলে মনে করেন। তারা ভাবেন যার কারামত নেই তিনি ওলী নন এবং যার কারামত যত বেশি তিনি তত বড় ওলী। ধারণাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, এ উম্মাতের সবচেয়ে বড় ওলী সাহাবীগণ। অথচ সাহাবীগণ থেকে তেমন কোনো কারামত বর্ণিত হয় নি। তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী ও চার ইমাম থেকেও তেমন কোনো কারামত বর্ণিত হয় নি। পক্ষান্তরে পরবর্তী যুগের অনেক বুজুর্গ থেকে অনেক বেশি কারামত বর্ণিত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে ঈমান, তাকওয়া, ফরয ও নফল ইবাদত সদা-সর্বদা পালন, কুরআন ও সুন্নাহের সর্বাত্মক অনুসরণই ওলী হওয়ার প্রমাণ ও চিহ্ন। কোনো মুসলিম যদি কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে সঠিক ঈমান সংরক্ষণ করেন, হারাম ও নিষেধ বর্জন করেন, ফরয দায়িত্বগুলো আদায় করেন এবং যথাসম্ভব বেশি বেশি নফল ইবাদত আদায় করেন তবে তিনি আল্লাহর ওলী। এ সকল বিষয়ে যিনি যতুটুকু অগ্রসর হবেন তিনি ততটুকু আল্লাহর নৈকট্য বা বেলায়াত অর্জন করবেন। কারামত বা অলৌকিক কর্ম বিলায়াতের প্রমাণ বা মানদন্ড নয়। তবে কোনো ওলীকে আল্লাহ কারামত দিতে পারেন।
৫. ২. ৩. ৩. বিলায়াতের নিশ্চয়তার ধারণা
এ বিষয়ক আরেকটি বিভ্রান্তি অলৌকিক কর্মের কারণে বা অন্য কোনো কারণে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ‘‘ওলী’’ বলে বিশ্বাস করা। আমরা দেখেছি যে, ঈমান ও তাকওয়া বিলায়াতের মূল এবং ফরয ও নফল ইবাদত পালন এর পথ। ঈমান ও তাকওয়া দুটিই মূলত আভ্যন্তরীণ বিষয়, যা দেখা যায় না বা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। এজন্য কে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ওলী তা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। কার ইবাদত আল্লাহ কতটুকু কবুল করেছেন বা কে আল্লাহর কতটুকু ওলী তা একমাত্র তিনিই জানেন।
আমরা ইতোপূর্বে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বক্তব্য থেকে জেনেছি যে, কুরআন বা হাদীসে যাঁদের কবুলিয়াত বা জান্নাতের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে তাঁদের বাইরে কাউতে ব্যক্তিগতভাবে নির্দিষ্ট করে আল্লাহর ওলী বলা তো দূরের কথা ‘‘জান্নাতী’’ বলেও সাক্ষ্য দেওয়া যাবে না। কোনো কারামত বা অলৌকিকত্বও এবিষয়ে কোনো রকম প্রমাণ পেশ করে না। কারণ আমরা যাকে কারামত মনে করছি তা শয়তানী অলৌকিকত্ব বা ইসতিদরাজ কি-না তা কেউ বলতে পারবে না। কুরআনের বিবরণ থেকে আমরা আরো জেনেছি যে, অনেক সময় কারামতের অধিকারী ওলীও গোমরাহ ও বিভ্রান্ত হয়েছেন। কাজেই বাহ্যিক আমল ও কুরআন-সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসরণ দেখে আমরা কোনো মুমিনের বিষয়ে ধারণা ও আশা করি যে, তিনি আল্লাহর ওলী বা প্রিয়। তবে নিশ্চিত বিশ্বাসের সুযোগ নেই।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ‘কারামত’-এর দাবিদার সবচেয়ে বেশি শীয়াদের মধ্যে। ইরানে ও অন্যান্য দেশে শীয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে আপনি অগণিত ওলীর কথা জানবেন যাদের অগণিত কারামত জনগণের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ। অথচ সুন্নীগণ তাদেরকে ওলী তো দূরের কথা মুসলিম বলে মানতেই রাজি নন। মূলধারার মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই তাদের বুজুর্গদের কারামত প্রচার করেন, কিন্তু বিরুদ্ধ মতের মানুষেরা তাদেরকে বিদ‘আতী, ওহাবী বা বিভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করেন। মুজাদ্দিদ-ই-আলফ-ই-সানী ‘‘মাকতুবাত’’-এ ও সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী ‘সেরাতে মুসতাকীম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কোনো ফাসিক বা কাফিরও তাসাউফের আমল পালন করে বিভিন্ন হালত, তাজাল্লী ও কাশ্ফ অর্জন করতে পারে। এগুলি কখনো বিলায়াত বা কামালাতের প্রমাণ নয়।[1]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভালো-মন্দ বলতে নিষেধ করেছেন। বাহ্যিক যা দেখা যায় তাই বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। একবার একজন সাহাবী তাঁর সামনে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন যে: তাঁকে তিনি মু’মিন বলে মনে করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বলেন: মুমিন না বলে বল: মুসলিম। অর্থাৎ, ইসলামের বিধান পালনকারী হিসাবে বাহ্যিক যা দেখা যায় তাই বলতে হবে। ঈমানের গভীরতা ও বিশুদ্ধতা আল্লাহই জানেন।[2]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দুধ-ভাই, প্রথম অগ্রবর্তী মুহাজিরদের অন্যতম, প্রসিদ্ধ বুজুর্গ সাহাবী উসমান ইবন মাযঊন (রা)-এর ওফাতের পরের ঘটনা বর্ণনা করে মহিলা সাহাবী উম্মুল আলা (রা) বলেন:
فَدَخَلَ عَلَيْنَا النَّبِيُّ ﷺ فَقُلْتُ رَحْمَةُ اللَّهِ عَلَيْكَ أَبَا
السَّائِبِ شَهَادَتِي عَلَيْكَ لَقَدْ أَكْرَمَكَ اللَّهُ فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ
وَمَا يُدْرِيكِ أَنَّ اللَّهَ أَكْرَمَهُ قَالَتْ قُلْتُ لاَ أَدْرِي، بِأَبِي
أَنْتَ وَأُمِّي يَا رَسُولَ اللَّهِ فَمَنْ يُكْرِمُهُ الله؟ قَالَ أَمَّا هُوَ
فَقَدْ جَاءَهُ وَاللَّهِ الْيَقِينُ وَاللَّهِ إِنِّي لأَرْجُو لَهُ الْخَيْرَ
وَمَا أَدْرِي وَاللَّهِ وَأَنَا رَسُولُ اللَّه مَا يُفْعَلُ بِي قَالَتْ
فَوَاللَّهِ لا أُزَكِّي أَحَدًا بَعْدَهُ
‘‘তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট আসলেন। আমি বললাম, হে আবুস সাইব (উসমান ইবন মাযঊন) আমি আপনার বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: তুমি কিভাবে জানলে যে, আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করেছেন? আমি বললাম, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবানী হোন, আমি তো জানি না, তবে তাঁকে যদি আল্লাহ সম্মানিত না করেন তবে আর কাকে করবেন? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তাঁর কাছে একীন এসেছে, আল্লাহর কসম, আমি তাঁর বিষযে ভাল আশা করি। আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহর রাসূল, আমিও জানি না যে, আমার বিষয়ে কি করা হবে।’ উম্মুল আলা (রা) বলেন, আল্লাহর কসম! এরপর আমি আর কাউকে ভাল বলি না।’’[3]
[1] মুজাদ্দিদ আলফসানী, মাকতুবাত শরীফ ১/১/ মাকতুব ৭, পৃ: ১৪; সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী, সেরাতে মুস্তাকীম (উর্দু) পৃ: ৫১।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/১৮ (কিতাবুল ঈমান, বাবু ইযা লাম ইয়াকুনিল ইসলাম...); মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩২ (কিতাবুল ইমান, বাবু তাআল্লুফি কালবি মান ইউখাফু...)
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৪২৯ (কিতাবু ফাদায়িলিস সাহাবা, বাবু মাকদামিন্নাবিয়্যি...)
৫. ২. ৩. ৪. কারামত বর্ণনায় সনদ যাচাই না করা
কেউ কেউ মনে করেন, ‘ওলীদের কারামত সত্য’-এ কথার অর্থ ওলীদের নামে যা কিছু অলৌকিক কথা বলা হবে সবই সত্য মনে করতে হবে। কথাটি জঘন্য ভুল। বিশুদ্ধ সনদ ছাড়া কোনো বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। জাল হাদীসের মত অগণিত ‘জাল’ কারামত ওলীদের নামে সমাজে ছড়ানো হয়েছে। ইমাম তাহাবী এ বিষয়ে বলেন:
وَلا نُفَضِّلُ أَحَدًا مِنَ الأَوْلِيَاءِ عَلَى أَحَدٍ مِنَ الأَنْبِيَاءِ
عَلَيْهِمُ السَّلام، وَنَقُولُ: نَبِيٌّ وَاحِدٌ أَفْضَلُ مِنْ جَمِيعِ
الأَوْلِيَاءِ. وَنُؤْمِنُ بِمَا جَاءَ مِنْ كَرَامَاتِهِمْ، وَصَحَّ عَنِ
الثِّقَاتِ مِنْ رِوَايَاتِهِمْ.
‘‘আমরা কোনো ওলীকে কোনো নবীর উপর প্রাধান্য দেই না। বরং আমরা বলি: একজন নবী সকল ওলী থেকে শ্রেষ্ঠ। তাদের যে সকল কারামত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত রাবীদের মাধ্যমে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তা আমরা বিশ্বাস করি।’’[1]
[1] তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৯।
৫. ৩. ইসতিদরাজ
‘ইসতিদরাজ’ শব্দটি আরবী ‘দারাজা’ (درَج) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ চলা, হাঁটা, অগ্রসর হওয়া, ক্রমান্বয়ে এগোনো ইত্যাদি। ‘দারাজাহ’ (الدرجة) অর্থ ধাপ বা পর্যায়। ইসতিদরাজ (الاستدراج) অর্থ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নেওয়া, ক্রমান্বয়ে উপরে তোলা বা নিচে নামান, ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। কোনো পাপী বা অবিশ্বাসী ব্যক্তি থেকে কোনো অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হলে তাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইসতিদরাজ’ বলা হয়।
এথেকে আমরা বুঝি যে, সকল অলৌকিক কর্মই কারামত নয় এবং কোনো অলৌকিক কর্মই কারো ‘ওলীত্বে’-র প্রমাণ নয়। কারণ একই প্রকার অলৌকিক কর্ম মুমিন থেকে প্রকাশিত হতে পারে এবং ফাসিক বা কাফির থেকেও প্রকাশিত হতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো অলৌকিক কর্ম কোনো মানুষের বিলায়াত তো দূরের কথা, ঈমানেরও প্রমাণ নয়। বরং মানুষের ঈমান, তাকওয়া, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ আনুগত্য ও সদা সর্বদা ফরয ও নফল ইবাদত পালন করাই বিলায়াতের প্রমাণ। যদি এরূপ ব্যক্তি থেকে কোনো অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয় তবে তাকে কারামত বলা হবে। আর যদি কোনো ব্যক্তির ঈমান, তাকওয়া বা ইত্তিবায়ে সুন্নাত না থাকে কিন্তু তিনি বিভিন্ন অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করেন তবে তাকে ‘ইসতিদরাজ’ বলা হবে।
কাফিরও সাধনার মাধ্যমে এক প্রকার ‘কাশফ‘ অর্জন করে বা জিনের সহযোগিতা লাভ করে। একে সাধারণ মানুষ ‘‘অলৌকিক ক্ষমতা’’ মনে করে বিভ্রান্ত হন। মোল্লা আলী কারী বলেন: ‘‘ফিরাসাত বা অন্তর্দৃষ্টি তিন প্রকার। (১) ঈমানী ফিরাসাত। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত নূর যা আল্লাহ তাঁর বান্দার অন্তরে নিক্ষেপ করেন। হঠাৎ অনুভূতি হিসেবে তা মানুষের অন্তরে হামলা করে, যেমন সিংহ তার শিকারের উপরে হামলা করে। .... (২) সাধনার মাধ্যমে অর্জিত ফিরাসাত। এ প্রকারের ফিরাসাত অর্জিত হয় ক্ষুধা, রাত্রি-জাগরণ, নির্জনবাস ইত্যাদির মাধ্যমে। কারণ মানুষের নফস যখন জাগতিক সম্পর্ক ও সৃষ্টির সাথে যোগাযোগ থেকে বিমুক্ত হয় তখন তার বিমুক্তির মাত্রা অনুসারে তার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি ও কাশফ সৃষ্টি হয়। এ প্রকার ফিরাসাত কাফির ও মুমিন উভয়েরই হতে পারে। এ প্রকার কাশফ বা ফিরাসাত ঈমান বা বেলায়াত প্রমাণ করে না। এর দ্বারা কোনো কল্যাণ বা সঠিক পথও জানা যায় না।... (৩) সৃষ্টিগত ফিরাসাত। এ হলো চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশার মানুষের ফিরাসাত যারা সৃষ্টিগত আকৃতি থেকে প্রকৃতি ও আভ্যন্তরীণ অবস্থা অনুমান করতে পারেন।’’[1]
দাজ্জাল ‘কারামত’ নামের অলৌকিকতা দেখিয়ে মানুষদেরকে ঈমান-হারা করবে। যুগে যুগে অগণিত সাধারণ মুমিন-মুসলিম ‘অলৌকিকতার’ খপ্পরে পড়ে ঈমান হারা হয়েছেন। বিশেষত, রোগ-ব্যাধি ও অশান্তির বিষয়ে ‘তদবির’ দিয়ে ‘ভাল করা’, ‘দুআ’ দিয়ে ধনী বানিয়ে দেওয়া, মনের কথা বা গোপন প্রয়োজন বলে দেওয়া, আগামী আগন্তুকের বিষয়ে সংবাদ দেওয়া ইত্যাদি বিষয়কে ‘কারামত’ মনে করে ঈমান-হারা হয়েছেন ও হচ্ছেন অগণিত সাধারণ মুসলিম। খৃস্টান পাদরি-প্রচারক, হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসী ও মুসলিম নামধারী ‘দয়াল বাবা’, ‘দয়াল মা’, ‘পাগলা বাবা’, ‘জটাধারি’ ইত্যাদির পিছনে ঘুরে, তাদেরকে ‘ওলী’ মনে করে প্রতারিত ও বিভ্রান্ত হচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে মুমিনকে সচেতন করতে ইমাম আযম ও অন্যান্যরা কারামত প্রসঙ্গে ইসতিদরাজ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
[1] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৩২-১৩৩।
৬. আখিরাতে আল্লাহর দর্শন
এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন:
‘‘মহান আল্লাহ স্রষ্টা ছিলেন সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই। তিনি রিয্কদাতা ছিলেন সৃষ্টিকে রিয্ক প্রদানের পূর্ব থেকেই। আর আখিরাতে মহান আল্লাহ পরিদৃষ্ট হবেন। জান্নাতের মধ্যে অবস্থানকালে মুমিনগণ তাঁকে দর্শন করবেন তাদের নিজেদের চর্মচক্ষু দ্বারা। এ দর্শন সকল তুলনা ও স্বরূপ-প্রকৃতি নির্ধারণ ব্যতিরেকে। মহান আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো দূরত্ব হবে না।’’
এখানে তিনি মহান আল্লাহর বিশেষণের অনাদিত্ব বিষয়টি আবারো উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি আখিরাতে আল্লাহর দর্শন বিষয়ক আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা উল্লেখ করেছেন।
জান্নাতে মহান আল্লাহর দর্শনই হবে মুমিনগণের শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত। কুরআন-হাদীসে বারবার এ নিয়ামতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ
‘‘সেদিন কোনো কোনো মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’’[1]
আখিরাতে মহান আল্লাহর দর্শনের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলি বহু-সংখ্যক বা ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের। এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন:
إنَّ أُنَاسًا فِي زَمَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى
رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ النَّبِيُّ ﷺ نَعَمْ هَلْ تُضَارُّونَ فِي
رُؤْيَةِ الشَّمْسِ بِالظَّهِيرَةِ ضَوْءٌ لَيْسَ فِيهَا سَحَابٌ قَالُوا لا قَالَ
وَهَلْ تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ ضَوْءٌ لَيْسَ
فِيهَا سَحَابٌ قَالُوا لا
‘‘নবী (ﷺ)-এর যুগে কিছু মানুষ বলে, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি কিয়ামাতের দিন আমাদের প্রতিপালককে দেখব? তখন নবী (ﷺ) বলেন: হ্যাঁ। দ্বিপ্রহরের সময় আলোকোজ্জ্বল আকাশে যদি কোনো মেঘ না থাকে তবে সূর্য দেখতে কি তোমাদের কোনো অসুবিধা হয়? তারা বলেন: না। তিনি বলেন: পুর্ণিমার রাতে আলোকোজ্জ্বল আকাশে যদি কোনো মেঘ না থাকে তাহলে কি চাঁদ দেখতে তোমরা বাধাগ্রস্ত হও? তারা বলেন: না।’’[2]
অন্য হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন,
قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ هَلْ
تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ الشَّمْسِ وَالْقَمَرِ إِذَا كَانَتْ صَحْوًا قُلْنَا لا
قَالَ فَإِنَّكُمْ لا تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ رَبِّكُمْ يَوْمَئِذٍ إِلا كَمَا
تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَتِهِمَا
‘‘আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি কিয়ামাতের দিন আমাদের প্রতিপালককে দেখব? তিনি বলেন, আকাশ পরিষ্কার থাকলে সূর্য বা চন্দ্র দেখতে কি তোমাদের কোনো কষ্ট হয়? আমরা বললাম: না। তিনি বলেন: সেদিন তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে তোমাদের কোনো কষ্ট বা অসুবিধা হবে না, ঠিক যেমন চন্দ্র ও সূর্য দেখতে অসুবিধা হয় না।’’[3]
অন্য হাদীসে জারীর ইবন আব্দুল্লাহ (রা) বলেন:
كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ ﷺ فَنَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةً يَعْنِي الْبَدْرَ
فَقَالَ إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ لا
تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ
‘‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ছিলাম। রাতটি ছিল পূর্ণিমার রাত। তিনি চাঁদের দিকে তাকালেন এবং বললেন: তোমরা যেভাবে এ চাঁদকে দেখছ, কোনোরূপ অসুবিধা হচ্ছে না, সেভাবেই তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে দেখবে।’’[4]
এ সকল আয়াত ও হাদীসের আলোকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস করেন যে, জান্নাতে মুমিনগণ মহান আল্লাহকে দর্শন করবেন।
খারিজী, মু’তাযিলী ও সমমনা কোনো কোনো ফিরকা আখিরাতে মহান আল্লাহর দর্শনের কথা অস্বীকার করে। কুরআনের কিছু আয়াত ও কিছু যুক্তি তাদের দলিল। মহান আল্লাহ বলেন:
لا تُدْرِكُهُ الأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الأَبْصَارَ وَهُوَ اللَّطِيفُ
الْخَبِيرُ
‘‘তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত; এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক পরিজ্ঞাত।’’[5]
অন্যত্র তিনি বলেন:
وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللَّهُ إِلا وَحْيًا أَوْ مِنْ وَرَاءِ
حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولا فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ إِنَّهُ عَلِيٌّ
حَكِيمٌ
‘‘কোনো মানুষের জন্যই সম্ভব নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে, অথবা এমন দূত প্রেরণ করবেন, যে দূত তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করেন, তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়।’’[6]
মূসা (আ) যখন আল্লাহকে দেখতে চান তখন আল্লাহ বলেন:
لَنْ تَرَاني
‘‘তুমি আমাকে দেখবে না।’’[7]
এ সকল আয়াতের ভিত্তিতে তারা দবি করেন যে, মহান আল্লাহকে আখিরাতে দর্শন করা সম্ভব নয়; কারণ তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন। তারা আরো যুক্তি পেশ করেন যে, মহান আল্লাহ স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে। তাঁকে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করার অর্থ তাঁকে স্থান বা দিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে বিশ্বাস করা। এছাড়া মহান আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি কোনো কিছুর সাথে তুলনীয় নন। তাঁকে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করার অর্থই তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা। এ সকল যুক্তির ভিত্তিতে তারা এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীস বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও আপত্তির মাধ্যমে বাতিল করে দেন।
‘আহলুস সুন্নাত’ এ বিষয়ে তাঁদের মূলনীতির অনুসরণে সকল আয়াত ও হাদীস সমানভাবে বিশ্বাস করেন। কুরআনের দ্ব্যর্থহীন আয়াতগুলোর ভিত্তিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবীতে কেউ মহান আল্লাহকে দেখতে পারে না। একইভাবে কুরআন ও হাদীসের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যের ভিত্তিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, আখিরাতে মুমিনগণ মহান আল্লাহর দর্শন লাভে ধন্য হবেন। উভয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। মানবীয় জ্ঞানে আখিরাতে আল্লাহর দর্শন অসম্ভব নয়। কাজেই আখিরাতের দর্শনের খুঁটিনাটি বিষয় মানবীয় কল্পনা দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করা বা তা অস্বীকার করা বিভ্রান্তি বৈ কিছুই নয়।
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) উপরের বক্তব্যে এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস ব্যাখ্যা করেছেন। ইমাম সায়িদ নাইসাপূরী লিখেছেন:
في رسالة أبي حنيفة - رضي الله عنه - إلى بعض الناس: وأما قولك: إني أزعم أن الرب
تعالى لا ينظر إليه أهلُ الجنة، سبحان الله العظيم! كيف تأتى بِما لستُ له من القائلين،
الله تعالى يقول "وجوه يومئذ ناضرة إلى ربّها ناظرة" فلو قلتَ: لا
ينظرون، كنتَ تقول: الله من الكاذبين. ولكنك حرّفتَ عليّ قولي: إن نظرهم إلى الله
تعالى لا يشبهه نظرُ الخلق إلى الخلق
‘‘আবূ হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে পত্র লিখেন। এ পত্রে তিনি বলেন: আপনি আমার নামে বলেছেন যে, আমি নাকি বলেছি, জান্নাতবাসীগণ মহান প্রতিপালক আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। সুবহা-নাল্লাহিল আযীম!! আমি যা বলি নি সে কথা আপনি আমার নামে কিভাবে বললেন! মহান আল্লাহ বলেন: ‘সেদিন কোনো কোনো মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’ এখন যদি আপনি বলেন যে, ‘মুমিনগণ তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে না’ তবে আপনি মূলত বললেন যে, আল্লাহ মিথ্যা বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে আপনি আমার কথাকে বিকৃত করেছেন। আমি বলেছি যে, মহান আল্লাহর প্রতি মুমিনদের তাকিয়ে থাকা সৃষ্টির দিকে সৃষ্টির তাকিয়ে থাকার সাথে তুলনীয় নয়।’’[8]
এ বিষয়ে ইমাম তাহাবী বলেন:
وَالرُّؤْيَةُ حَقٌّ لأَهْلِ الْجَنَّةِ، بِغَيْرِ إِحَاطَةٍ وَلا كَيْفِيَّةٍ،
كَمَا نَطَقَ بِهِ كِتَابُ رَبِّنَا: "وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى
رَبِّهَا نَاظِرَةٌ" وَتَفْسِيرُهُ عَلَى مَا أَرَادَ اللَّهُ تَعَالَى
وَعَلِمَهُ، وَكُلُّ مَا جَاءَ فِي ذَلِكَ مِنَ الْحَدِيثِ الصَّحِيحِ عَنْ
رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فَهُوَ كَمَا قَالَ، وَمَعْنَاهُ عَلَى مَا أَرَادَ، لا
نَدْخُلُ فِي ذَلِكَ مُتَأَوِّلِينَ بِآرَائِنَا وَلا مُتَوَهِّمِينَ
بِأَهْوَائِنَا، فَإِنَّهُ مَا سَلِمَ فِي دِينِهِ إِلاَّ مَنْ سَلَّمَ لِلَّهِ
عَزَّ وَجَلَّ وَلِرَسُولِهِ ﷺ . وَرَدَّ عِلْمَ مَا اشْتَبَهَ عَلَيْهِ إِلَى
عَالِمِهِ. وَلا تَثْبُتُ قَدَمُ الإِسْلامِ إِلاَّ عَلَى ظَهْرِ التَّسْلِيمِ
وَالاسْتِسْلاَمِ. فَمَنْ رَامَ عِلْمَ مَا حُظِرَ عَنْهُ عِلْمُهُ، وَلَمْ
يَقْنَعْ بِالتَّسْلِيمِ فَهْمُهُ، حَجَبَهُ مَرَامُهُ عَنْ خَالِصِ التَّوْحِيدِ
وَصَافِي الْمَعْرِفَةِ وَصَحِيحِ الإِيمَانِ، فَيَتَذَبْذَبُ بَيْنَ الْكُفْرِ
وَالإِيمَانِ، وَالتَّصْدِيقِ وَالتَّكْذِيبِ، وَالإِقْرَارِ وَالإِنْكَارِ،
مُوَسْوَسًا تَائِهًا، زَائِغًا شَاكًّا، لا مُؤْمِنًا مُصَدِّقًا، وَلا جَاحِدًا
مُكَذِّبًا. وَلا يَصِحُّ الإِيمَانُ بِالرُّؤْيَةِ لأَهْلِ دَارِ السَّلامِ
لِمَنِ اعْتَبَرَهَا مِنْهُمْ بِوَهْمٍ، أَوْ تَأَوَّلَهَا بِفَهْمٍ، إِذْ كَانَ
تَأْوِيلُ الرُّؤْيَةِ وَتَأْوِيلُ كُلِّ مَعْنًى يُضَافُ إِلَى الرُّبُوبِيَّةِ
بِتَرْكِ التَّأْوِيلِ وَلُزُومِ التَّسْلِيمِ، وَعَلَيْهِ دِينُ الْمُسْلِمِينَ.
وَمَنْ لَمْ يَتَوَقَّ النَّفْيَ وَالتَّشْبِيهَ زَلَّ وَلَمْ يُصِبِ
التَّنْزِيهَ؛ فَإِنَّ رَبَّنَا جَلَّ وَعَلاَ مَوْصُوفٌ بِصِفَاتِ
الْوَحْدَانِيَّةِ، مَنْعُوتٌ بِنُعُوتِ الْفَرْدَانِيَّةِ، لَيْسَ فِي مَعْنَاهُ
أَحَدٌ مِنَ الْبَرِيَّةِ.
‘‘জান্নাতবাসীদের জন্য আল্লাহ পাকের দর্শন লাভ সত্য। তা হবে বিনা পরিবেষ্টনে এবং আমাদের বোধগম্য কোনো ধরন বা প্রকৃতি ব্যতীত। আমাদের প্রতিপালকের গ্রন্থে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে: ‘‘সে দিন অনেকের মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের পানে দৃষ্টিমান থাকবে।’’[9] এ কথা দ্বারা আল্লাহ তা’আলা যা ইচ্ছা করেছেন এবং যা তিনি জেনেছেন তা-ই এর ব্যাখ্যা। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সহীহ হাদীসে যা বর্ণিত আছে তা যেভাবে তিনি বলেছেন সে ভাবেই গ্রহণ করতে হবে এবং এর দ্বারা তিনি যে উদ্দেশ্য করেছেন তা স্বীকার করে নিতে হবে। এতে আমরা নিজেদের মতামত অনুসারে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বা নিজেদের প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোনো অর্থের অনুপ্রবেশ ঘটাব না। কারণ, দ্বীনের ব্যা্পারে কেবল সে ব্যক্তিই ভ্রান্তি ও পদস্খলন থেকে নিরাপদ থাকতে পারে যে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নিকট নিজেকে সমর্পন করে এবং তাঁর নিকট সংশয়যুক্ত বিষয়ের সঠিক জ্ঞান এর জ্ঞাতার উপর ছেড়ে দেয়। পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও বশ্যতা স্বীকার ব্যতিরেকে কারো ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন কোনো জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হবে যা জানা তার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং যার বুদ্ধি আত্মসমর্পনের মাধ্যমে তুষ্ট হয় না সে খালেস তাওহীদ, পরিচ্ছন্ন জ্ঞান ও বিশুদ্ধ ঈমান থেকে দূরে থাকবে। এমতাবস্থায়, সে কুফরী ও ঈমান, সমর্পণ ও অস্বীকৃতি এবং গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের মাঝামাঝি প্রবঞ্চিত, ওয়াসওয়াসাগ্রস্ত দিশাহারা ও সংশয়ী হয়ে দোটানায় দোদুল্যমান থেকে যায়। সে না হয় পূর্ণ সমর্পক মুমিন এবং না হয় দৃঢ় অবিশ্বাসী কাফির।
জান্নাতবাসীদের মহান আল্লাহর দর্শন লাভ সম্পর্কে এমন লোকের ঈমান বিশুদ্ধ হবে না, যে এটাকে তার পক্ষে বিশেষ কল্পনা দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করবে বা স্বীয় জ্ঞানানুসারে এর অপব্যাখ্যা করবে। কারণ, আল্লাহর দর্শন এবং তাঁর রুবুবিয়্যাত সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ের সঠিক ব্যাখ্যা হলো এর ব্যাখ্যা থেকে বিরত থাকা এবং তা অবিকৃতভাবে গ্রহণ করা। এ নীতির উপরই মুসলিমদের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। আর যে ব্যক্তি (আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে) অস্বীকৃতি ও তুলনা করা হতে আত্মরক্ষা না করবে তার অবশ্যই পদস্খলন ঘটবে এবং সঠিকভাবে আল্লাহর পবিত্রতায় বিশ্বাস স্থাপনে ব্যর্থ হবে। কেননা, আমাদের মহামহিম প্রভু অনন্য অতুলনীয় গুণাবলির দ্বারা বিশেষিত এবং একত্বের বিশেষণে বিভূষিত। বিশ্বলোকের কেউ তাঁর গুণে গুণান্বিত নয়।’’[10]
[1] সূরা (৭৫) কিয়ামা: ২২-২৩ আয়াত।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭৭; ৬/২৭০৪ (কিতাবু সিফাতিস সালাত, বাবু ফাদলিস সুজূদ, কিতাবুত তাওহীদ, বাবু উজূহুন ইয়াওমা..); মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৬৩-১৬৭, ৪/২২৭৯ (কিতাবুল ঈমান, বাবু মারিফাতি তারিকির রুইয়াতি, কিতাবুয যুহদি ওয়ার রাকাইক, বাবু-১)।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৭০৬ কিতাবুত তাওহীদ, বাবু উজূহুন ইয়াওমা..); মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৬৭ (কিতাবুল ঈমান, বাবু মারিফাতি তারিকির রুইয়াতি)।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ১/২০৩ (কিতাবু মাওয়াকীতুস সালাত, বাবু ফাদলি সালাতিল আসর); মুসলিম,আস-সহীহ ১/৪৩৯ (কিতাবুল মাসাজিদি, বাবু ফাদলি সালাতাইস সুবহি ওয়াল আসর)।
[5] সূরা (৬) আন‘আম: ১০৩ আয়াত।
[6] সূরা (৪২) শূরা: ৫১ আয়াত।
[7] সূরা (৭) আরাফ: ১৪৩ আয়াত।
[8] সায়িদ নাইসাপূরী, আল-ই’তিকাদ, পৃষ্ঠা ১৪৩।
[9] সুরা (৭৫) কিয়ামাহ: ২২-২৩ আয়াত।
[10] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১০।
৭. ঈমান, ইসলাম, দীন ও মারিফাত
এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ঈমানের সংজ্ঞা, ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি উল্লেখ করে বলেছেন: ‘‘ঈমান হচ্ছে (মুখের) স্বীকৃতি ও (অন্তরের) সত্যায়ন। বিশ্বাসকৃত বিষয়াদির দিক থেকে (আরকানুল ঈমানের দিক থেকে) আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের ঈমান বাড়ে না এবং কমে না, কিন্তু ইয়াকীন বা বিশ্বাসের দৃঢ়তা-গভীরতা ও সত্যায়নের দিক থেকে ঈমান বাড়ে এবং কমে। এভাবে ঈমান ও তাওহীদের ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। কর্মের ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। ইসলাম অর্থ আল্লাহর নির্দেশের জন্য আত্মসমর্পন করা এবং অনুগত হওয়া। আভিধানিকভাবে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তবে বাস্তবে ও ব্যবহারে ইসলাম ছাড়া কোনো ঈমান হয় না এবং ঈমান ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কাজেই ঈমান ও ইসলাম হলো পিঠের সাথে পেটের ন্যায়। ঈমান, ইসলাম ও সমস্ত শরীয়তকে একত্রে দীন বলা হয়। মহান আল্লাহর সত্যিকার মা’রিফাত (পরিচয়) আমরা লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। তবে কেউই মহান আল্লাহর সঠিক পরিপূর্ণ ইবাদত করতে সক্ষম নয়, যেরূপ ইবাদত তাঁর পাওনা। বান্দা তাঁর ইবাদত করে তাঁর নির্দেশ মত, যেভাবে তিনি তাঁর কিতাবে এবং তাঁর রাসূলের (ﷺ) সুন্নাতে নির্দেশ দিয়েছেন। মারিফাত (পরিচয় লাভ), ইয়াকীন (বিশ্বাস), তাওয়াক্কুল (নির্ভরতা), মহববত (ভালবাসা), রিযা (সন্তুষ্টি), খাওফ (ভয়), রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।’’
আমরা এ অনুচ্ছেদে তাঁর উপরের বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করব।
৭. ১. ঈমানের প্রকৃতি ও হ্রাস-বৃদ্ধি
আমরা দেখেছি যে, খারিজী ও সমমনা ফিরকাগুলো পাপী মুমিনকে কাফির বলে গণ্য করত। তাদের ‘তাকফীর’-এর তাত্ত্বিক ভিত্তি ঈমানের প্রকৃতি নির্ধারণের উপর। তারা ‘আমল’ বা ইসলামের বিধান পালনকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য করেছে। ফলে বিধান পালনের বিচ্যুতি তাদের মতে ঈমানের বিচ্যুতি বা কুফর বলে গণ্য। এর বিপরীতে মুরজিয়াগণ ঈমানকে আমল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেছে। তাদের মতে কোনোরূপ ইসলাম পালন ছাড়াই ঈমানের চূড়ান্ত পূর্ণতায় পৌঁছানো সম্ভব। তারা পাপী মুসলিমকে পরিপূর্ণ ঈমানদার ও নিশ্চিত জান্নাতী বলে গণ্য করেছে।
উভয় প্রান্তিকতার মাঝে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত বিশ্বাস করেন যে, পাপী মুমিন কাফির নন, আবার ঈমানের পূর্ণতাও তিনি লাভ করেন নি। তবে ঈমানের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যায় আহলুস সুন্নাতের ইমামগণের মধ্যে সামান্য কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের দুটি মত রয়েছে:
(১) ইমাম আবূ হানীফা ও কোনো কোনো ইমামের মতে অন্তরের বিশ্বাস ও মুখে সে বিশ্বাসের স্বীকৃতির নামই ঈমান। আমল বা কর্ম ঈমানের অংশ নয়, বরং ঈমানের অবিচ্ছেদ্য দাবি ও সম্পূরক। আমলের ঘাটতি বা অনুপস্থিতি ঈমানের ঘাটতি বা অনুপস্থিতি প্রমাণ করে না, তবে দুর্বলতা প্রমাণ করে। বিষয়বস্ত্ত (আরকানুল ঈমান)-এর দিক থেকে ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না, তবে গভীরতার দিক দিয়ে হ্রাসবৃদ্ধি হয়।
(২) অন্য তিন ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ বলেন: ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস, মুখের স্বীকৃতি ও দেহের কর্ম। আমল বা কর্ম ঈমানের অংশ, তবে মনের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকৃতির মত ‘অবিচ্ছেদ্য’ অংশ নয়, বরং দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘সম্পূরক’ অংশ। এজন্য তাঁদের মতে কর্মের অনুপস্থিতি দ্বারা ঈমানের অনুপস্থিতি প্রমাণিত হয় না, তবে দুর্বলতা ও কমতি প্রমাণিত হয়। আমল বা কর্মের হ্রাসবৃদ্ধির কারণে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।
এ দু মতের মধ্যে শব্দ প্রয়োগে যতই পার্থক্য থাক না কেন, মূল বিশ্বাসে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কারণ উভয় মতের অনুসারীগণই একমত যে:
(১) ঈমান ও আমল দুটিই আল্লাহর নির্দেশ এবং বান্দাকে দুটিই অর্জন করতে হবে। ঈমান-হীন ইসলাম বা ইসলাম-হীন ঈমান অকল্পনীয়।
(২) আমল বা কর্মের ত্রুটির কারণে বা কবীরা গোনাহের কারণে বান্দা কাফির হয় না, তবে আল্লাহর শাস্তির যোগ্য হবে।
উপরে ইমাম আবূ হানীফা এ বিষয়ে তাঁর মত ব্যাখ্যা করে বলেছেন: ‘‘বিশ্বাসকৃত বিষয়াদির দিক থেকে আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের ঈমান বাড়ে না এবং কমে না, কিন্তু ইয়াকীন বা বিশ্বাসের দৃঢ়তা-গভীরতা ও সত্যায়নের দিক থেকে ঈমান বাড়ে এবং কমে।’’ অর্থাৎ ঈমানের বিষয়বস্ত্তর বা আরকানুল ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না। এরূপ কল্পনা করা যায় না যে, একজন মুমিন প্রথমে ৫টি বিষয় বিশ্বাস করত এবং পরে ৬টি বিষয় বিশ্বাস করেছে। তবে ঈমানের গভীরতা ও দৃঢ়তার হ্রাসবৃদ্ধি হয়। কুরআন-হাদীসে যেখানে ঈমানের বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে সেখানে মূলত দৃঢ়তা গভীরতার বৃদ্ধির কথাই বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:
وَالإِيمَانُ وَاحِدٌ وَأَهْلُهُ فِي أَصْلِهِ سَوَاءٌ، وَالتَّفَاضُلُ بَيْنَهُمْ
بِالْخَشْيَةِ وَالتُّقَى، وَمُخَالَفَةِ الْهَوَى، وَمُلازَمَةِ الأَوْلَى ....
وَالإِيمَانُ: هُوَ الإِيمَانُ بِاللَّهِ، وَمَلائِكَتِهِ، وَكُتُبِهِ،
وَرُسُلِهِ، وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، وَالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ، وَحُلْوِهِ
وَمُرِّهِ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى.
‘‘ঈমান একই, এবং ঈমানদারগণ এর মূলে সবাই সমান। তবে, আল্লাহর ভয়, তাক্বওয়া, কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ এবং সর্বদা উত্তম কর্ম সম্পাদনের অনুপাতে তাদের মধ্যে স্তর ও মর্যাদাগত প্রভেদ হয়ে থাকে। ... ঈমান হলো: আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমুহ, তাঁর রাসূলবর্গ, আখিরাতের দিন, এবং ভাল-মন্দ ও মিষ্ট-তিক্তসহ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।’’[1]
[1] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৪-১৫।
৭. ২. ঈমান, ইসলাম ও দীন
ঈমান-ইসলাম পরস্পর সম্পৃক্ত শব্দ। অন্য একটি প্রাসঙ্গিক শব্দ ‘‘দীন’’। ইমাম আবূ হানীফা এখানে এ পরিভাষাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন। ‘আমন’ শব্দ থেকে ঈমান শব্দটির উৎপত্তি। আম্ন (أمن) অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, আস্থা বা বিশ্বস্ততা। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ: নিরাপত্তা প্রদান, আস্থা স্থাপন, বিশ্বাস করা, সত্যতা স্বীকার করা, বিশ্বস্ততায় আস্থা স্থাপন করা, ইত্যাদি।[1] সাধারণভাবে আরবীতে অদৃশ্য কোনো বিষয়ে কারো বক্তব্য বা তথ্য সত্য বলে বিশ্বাস করাকে ‘‘ঈমান’’ বলা হয়।
‘ইসলাম’ শব্দটি ‘সালাম’ (سلم) শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সমর্পণ ইত্যাদি। ইসলাম অর্থ আনুগত্য, আত্মসমর্পণ বা শান্তিস্থাপন। ইবন ফারিস বলেন: ‘‘শব্দটির মূল অর্থ সুস্থতা ও নিরাপত্তা।... ইসলামও এ অর্থ থেকেই। ইসলাম অর্থ আনুগত্য বা আত্মসমর্পণ; এর ফলে অবাধ্যতা থেকে নিরাপত্তা পাওয়া যায়।[2] এভাবে আমরা দেখছি যে, আভিধানিক ভাবে ‘‘ঈমান’’ বিশ্বাসের দিক এবং ‘‘ইসলাম’’ কর্মের দিক। তবে ব্যবহারিক ভাবে ঈমান ও ইসলাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
আভিধানিকভাবে ‘দীন’ অর্থ ‘আনুগত্য’ অথবা ‘যে সকল বিধান-ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ আনুগত্য প্রকাশ করে’। আর এ অর্থেই পারিভাষিকভাবে ‘‘দীন’’ বলতে বুঝানো হয় ‘ধর্ম’ বা ‘ধর্মীয় বিধিবিধান ও ব্যবস্থার সমষ্টি’ যেগুলোর মাধ্যমে স্রষ্টার আনুগত্য ও উপাসনা করা হয়।[3] শব্দটির মূল অর্থ বিষয়ে প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইবন ফারিস বলেন: ‘‘এর মূল অর্থ ... আনুগত্য, বিনয় ও হীনতা। দীন অর্থ আনুগত্য। ... হুকুম, হিসাব বা বিচার অর্থে দীন ব্যবহৃত হয়। তার মধ্যেও আনুগত্যের অর্থ রয়েছে’’।[4]
ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ‘তাওহীদ’ বা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসকেই ‘‘দীন’’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর পূর্বে ও পরে আরো অনেক তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী ও পরবর্তী মুফাস্সির ‘‘দীন’’ অর্থ ‘‘তাওহীদ’’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ ‘‘তাওহীদ’’-ই দীনের মূল। তবে সাধারণভাবে দীন বলতে তাওহীদ-সহ ইসলামের সকল বিধিবিধানের সমষ্টি বুঝানো হয়। ইসলামের বিশ্বাস বিষয়ক দিকটিকে ‘‘ঈমান’’, কর্ম বিষয়ক দিকটিকে ‘‘ইসলাম’’ এবং বিশ্বাস, কর্ম ও সকল বিধিবিধানের সমষ্টিকে ‘‘দীন’’ বলা হয়। এ বিষয়েই ইমাম আযম বলেছেন: ‘‘ইসলাম অর্থ আল্লাহর নির্দেশের জন্য আত্মসমর্পণ করা এবং অনুগত হওয়া। আভিধানিকভাবে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তবে বাস্তবে ও ব্যবহারে ইসলাম ছাড়া কোনো ঈমান হয় না এবং ঈমান ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ... ঈমান, ইসলাম ও সমস্ত শরীয়তকে একত্রে দীন বলা হয়।’’
[1] ইবন ফারিস, আহমদ (৩৯৫হি), মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ ১/১৩২-১৩৩।
[2] ইবন ফারিস, মু’জামু মাকায়ীসিল লুগাহ ৩/৯০।
[3] ড. ইবরাহীম আনীস ও অন্যান্য, আল-মুজামুল ওয়াসীত ১/৩০৭।
[4] ইবন ফারিস, মুজামু মাকায়ীসিল লুগাহ ২/৩১৯-২০।
৭. ৩. আল্লাহর মারিফাত
আরবী মা’রিফাত (المعرفة) শব্দটি আরাফা (عرف) ক্রিয়াপদ থেকে গৃহীত। এর অর্থ (إدراك الشيء بحاسة من حواسه) কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে কোনো কিছু অবগত হওয়া বা পরিচয় লাভ করা। এভাবে মূলত ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বা পরিচয়কে ‘‘মারিফাত’’ বলা হয়। তবে সাধারণত ‘মারিফাত’ বলতে ‘‘জ্ঞান’’, ‘‘পরিচয়’’ বা শিক্ষা (knowledge, education)
সবই বুঝানো হয়।
‘জ্ঞান’ বা ‘মারিফাত’ ঈমান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আল্লাহর মারিফাত বা আল্লাহর পরিচয় লাভ মানুষকে তাঁর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসের দিকে ধাবিত করে। তবে কুরআন-হাদীসে মূলত ‘ইলম’ এবং ‘ফিকহ’-এর প্রশংসা করা হয়েছে, ‘মারিফাত’-এর কোনো বিশেষ প্রশংসা করা হয় নি। ‘মারিফাত’ ঈমানের পথে পরিচালিত করলে তা প্রশংসনীয়। কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘মারিফাত’ অর্জনের পরেও মানুষ কুফর বা অবিশ্বাসে লিপ্ত হয়। কুরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদী-খৃস্টানদের অনেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর দীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ‘মারিফাত’ অর্জনের পরেও কুফরী করত।[1] অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ
‘‘অতঃপর যখন তাদের নিকট তা আগমন করল, তারা তার পরিচয় জানার বা মা’রিফাত অর্জনের পরেও কুফরী করল।’’[2]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
يَعْرِفُونَ نِعْمَةَ اللَّهِ ثُمَّ يُنْكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘আল্লাহর নিয়ামতের মারিফাত (প্রকৃত পরিচয়) তারা লাভ করে- অতঃপর তারা তা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই কাফির।’’[3]
আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরু থেকে জাহম ইবন সাফওয়ান প্রচার করেন যে, মারিফতই ঈমান এবং মারিফাতই সব। মারিফতের পরে আর আমলের প্রয়োজন নেই। মুরজিয়া মতবাদের মূল ভিত্তিও এটি। শীয়াগণও ‘মারিফাত’ বিষয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি প্রচার করেন।
কুরআন-হাদীসে ‘মারিফাত’-কে ‘ইলম’-এর চেয়ে নিম্নপর্যায়ে স্থান দেওয়া হয়েছে। মুমিনগণকে ‘মারিফাত’ অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয় নি, বরং ইলম অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কারণ ‘মারিফাত’ ঈমান অর্জনের পূর্বের অবস্থা। কিন্তু জাহমীগণ মারিফাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। তারা মারিফাতই ঈমান এবং ঈমানই সব, অর্থাৎ মারিফাতই সব বলে দাবি করতেন। শীয়াগণ ‘মারিফাত’-কে ইলম-এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং ঈমান ও শরীয়ত থেকে উচ্চপর্যায়ের বিষয় বলে প্রচার করেন এবং মারিফাতকে ‘তত্ত্বজ্ঞান’ বা গোপন ও পৃথক জ্ঞান বলে প্রচার করেন। এ বিষয়ে তারা অনেক জাল হাদীস প্রচার করেন।
ইমাম আযম (রাহ) তাদের এ সকল বিভ্রান্তি দূর করতে দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন: (১) মারিফাত ঈমানেরই সহযাত্রী। সকল মুমিনই আল্লাহর সত্যিকার ও পরিপূর্ণ মারিফাত লাভ করেছেন। (২) আল্লাহর মারিফাত গোপন কোনো তত্ত্বজ্ঞান নয় বা তা অর্জনের জন্য গোপন কোনো পথ নেই। মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে যা জানিয়েছেন তা অবগত হওয়াই তাঁর প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মারিফাত। তিনি বলেন: ‘‘মহান আল্লাহর সত্যিকার মা’রিফাত আমরা পূর্ণভাবে লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। ... মারিফাত, ইয়াকীন, তাওয়াক্কুল, মাহাববাত, রিযা, খাওফ, রাজা এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।’’
এ প্রসঙ্গে ‘ওসিয়্যাত’ পুস্তিকায় ইমাম আযম (রাহ) বলেন:
الإِيمان وهو إِقرارٌ باللسان وتصديقٌ بالجَنان. والإِقرار وحده لا يكون إِيمانًا
، لأنه لو كان إِيمانًا لكان المنافقون كلهم مؤمنين. وكذلك المعرفة وحدها لا تكون
إِيمانًا ، لأنها لو كانت إِيمانًا لكان أهل الكتاب مؤمنين
‘‘ঈমান হচ্ছে মুখের স্বীকৃতি এবং অন্তরের বিশ্বাস। শুধু মুখের স্বীকৃতি ঈমান হতে পারে না; এরূপ হলে তো সকল মুনাফিক-ই মুমিন বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে শুধু ‘মারিফাত’ (অন্তরের জ্ঞান ও পরিচয় লাভ) ঈমান হতে পারে না; তাহলে তো ইহূদী-খৃস্টানগণ সকলেই মুমিন বলে গণ্য হবে। (কারণ আল্লাহ কুরআনে বারবার বলেছেন যে, তারা মারিফাত অর্জন করেছিল)।[4]
[1] সূরা (২) বাকারা: ১৪৬; সূরা (৬) আনআম: ২০ আয়াত।
[2] সূরা (২) বাকারা: ৮৯ আয়াত।
[3] সূরা (১৬) নাহল: ৮৩ আয়াত।
[4] ইমাম আবূ হানীফা, কিতাবুল ওসিয়্যাত (আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম-সহ), পৃষ্ঠা ৭৬।
৭. ৪. আল্লাহর ইবাদাত
আমরা দেখেছি যে, ইবাদত অর্থ ‘চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি’। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন: (১) মারিফাত অর্জন করেই ঈমান অর্জন করতে হয়, এজন্য মারিফাতের ক্ষেত্রে সকল মুমিনই সমান। মুমিনের প্রকৃত প্রতিযোগিতা মারিফাতে নয়, বরং আল্লাহর ইবাদতে; কারণ প্রকৃত হক্ক আদায় করে ইবাদত কেউই করতে পারে না। (২) কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে তা জানার একমাত্র মাধ্যম আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত। এ বিষয়ে তিনি বলেন: ‘‘কেউই মহান আল্লাহর সঠিক পরিপূর্ণ ইবাদত করতে সক্ষম নয়, যেরূপ ইবাদত তাঁর পাওনা। তবে বান্দা তাঁর ইবাদত করে তাঁর নির্দেশ মত, যেভাবে তিনি তাঁর কিতাবে এবং তাঁর রাসূলের (ﷺ) সুন্নাতে নির্দেশ দিয়েছেন।’’
এখানে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) মুমিন জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর ইবাদতের আগ্রহ ও আবেগ অনেক সময় মুমিনকে অতি-উৎসাহী করে তোলে এবং অধিক ইবাদত, নৈকট্য ও বিলায়াতের আগ্রহে মুমিন দুটি ভুল করেন: (১) নিজের উপর কাঠিন্য আরোপ করেন এবং (২) সুন্নাতের অতিরিক্ত ইবাদত করেন।
দুটি বিষয় মূলত একই সূত্রে গাঁথা। কুরআন ও সুন্নাতের অতিরিক্ত আমলই কাঠিন্যের মধ্যে নিপতিত করে। এক্ষেত্রে মুমিনকে বুঝতে হবে যে, আল্লাহর ‘যথাযোগ্য’ (كما حقه) ইবাদত করা তার দায়িত্ব নয়, বরং ‘নির্দেশিত’ ইবাদত পালন তার দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
سَدِّدُوا وَقَارِبُوا وَأَبْشِرُوا فَإِنَّهُ لا يُدْخِلُ أَحَدًا الْجَنَّةَ
عَمَلُهُ قَالُوا وَلا أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ وَلا أَنَا إِلا أَنْ
يَتَغَمَّدَنِي اللَّهُ بِمَغْفِرَةٍ وَرَحْمَةٍ، وَاعْلَمُوا أَنَّ أَحَبَّ
الْعَمَلِ إِلَى اللَّهِ أَدْوَمُهُ وَإِنْ قَلَّ.... إنَّ هذا الدِّين يُسْرٌ
ولنْ يُشادَّ الدِّينَ أحدٌ إلا غَلَبَه.
‘‘তোমরা সঠিক আমল কর, কাছাকাছি থাক এবং আনন্দচিত্ত হও; কারণ কাউকেই তার নিজ কর্ম জান্নাতে প্রবেশ করাবে না। সাহাবীগণ বললেন: আপনিও নন, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বলেন, না, আল্লাহ যদি আমাকে ক্ষমা ও করুণা দিয়ে অভিষিক্ত না করেন তবে আমিও শুধু নিজের আমলের কারণে জান্নাতের দাবিদার হতে পারব না। আর জেনে রাখ, আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় কর্ম হলো নিয়মিত কর্ম, তা যদি অল্পও হয়।’’[1] অন্য হাদীসে তিনি বলেন: ‘‘নিশ্চয় এ দীন সহজ, যে কোনো ব্যক্তি যদি এ দীনকে কঠিন করে নেয় তবে তা অবশ্যই তার অসাধ্যে পরিণত হবে।’’[2]
এ অর্থে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীসে ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে পূর্ণতা বা আধিক্যের চেয়ে বিশুদ্ধতা ও সঠিকত্বের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সঠিকত্বের একমাত্র মাপকাঠি সুন্নাতে রাসূল (ﷺ)। তাঁর সুন্নাতের মধ্যে থেকে অল্প হলেও নিয়মিত আমল করাই মুমিনের দায়িত্ব। অধিক ইবাদতের আবেগে সুন্নাতের ব্যতিক্রমের পরিণতি ভয়াবহ। এ বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেন, আমার আববা আমাকে বিবাহ দেন, কিন্তু ইবাদতের আগ্রহের কারণে আমি রাতদিন নামায রোযায় ব্যস্ত থাকতাম এবং আমার স্ত্রীর কাছে যেতাম না। তখন আমার আববা আমাকে অনেক রাগ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেন। আব্দুল্লাহ (রা) বলেন:
فَأَرْسَلَ إِلَيَّ النَّبِيُّ ﷺ فَأَتَيْتُهُ فَقَالَ لِي أَتَصُومُ النَّهَارَ
قُلْتُ نَعَمْ قَالَ وَتَقُومُ اللَّيْلَ قُلْتُ نَعَمْ قَالَ لَكِنِّي أَصُومُ
وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّي وَأَنَامُ وَأَمَسُّ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ
سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي ... ثُمَّ قَالَ ﷺ فَإِنَّ لِكُلِّ عَابِدٍ شِرَّةً
وَلِكُلِّ شِرَّةٍ فَتْرَةً فَإِمَّا إِلَى سُنَّةٍ وَإِمَّا إِلَى بِدْعَةٍ
فَمَنْ كَانَتْ فَتْرَتُهُ إِلَى سُنَّةٍ فَقَدِ اهْتَدَى وَمَنْ كَانَتْ
فَتْرَتُهُ إِلَى غَيْرِ ذَلِكَ فَقَدْ هَلَكَ.
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন: তুমি কি প্রতিদিন রোযা রাখ? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বলেন: তুমি কি সারা রাত জেগে নামায পড়? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: কিন্তু আমি তো রোযাও রাখি আবার মাঝে মাঝে বাদ দিই, রাতে নামায পড়ি আবার ঘুমাই, স্ত্রীদেরকে সঙ্গ প্রদান করি। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে অপছন্দ করল আমার সাথে তার সম্পর্ক থাকবে না।... এরপর তিনি বলেন : প্রত্যেক আবিদের (ইবাদতকারীর) কর্মের উদ্দীপনার জোয়ার ভাটা আছে। ইবাদতের উদ্দীপনা কখনো তীব্র হয় আবার এ তীব্রতা এক সময় স্থিতি পায়, কখনো সুন্নাতের দিকে, কখনো বিদ‘আতের দিকে। যার স্থিতি সুন্নাতের প্রতি হবে সে হেদায়াত প্রাপ্ত হবে। আর যার স্থিতি সুন্নাতের ব্যতিক্রমের (বিদআতের) দিকে হবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’’[3]
এ অর্থের আরো অনেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, তাঁর কর্ম ও বর্জনের সামগ্রিক রূপই সুন্নাত। ইবাদতের আবেগে সুন্নাতের ব্যতিক্রম ইবাদত ধ্বংসের পথ।[4]
[1] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৩৭৩ (কিতাবুর রিকাক, বাবুল কাসদি); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২১৬৯; (কিতাবু সিফাতিল কিয়ামাতি ওয়াল জান্নাতি ..., বাবু লান ইয়াদখুলা আহাদুন..)।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৩ (কিতাবুল ঈমান, বাবুদ দীন ইউসরুন)
[3] হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ২/৩৯৪, নং ৬৫৩, ইবনু আবী আসিম, আস-সুন্নাহ, পৃ: ২৭- ২৮, নং ৫১, আলবানী, সাহীহুত তারগীব ১/৯৮।
[4] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৫০-৮৫।
৮. আল্লাহর পুরস্কার ও শাস্তি
আল্লাহর পুরস্কার ও শাস্তির বিষয়টি ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এ বিষয়ে বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের উপর করুণাকারী ও ন্যায়বিচারক। তিনি মেহেরবানি করে অনেক সময় বান্দার প্রাপ্য সাওয়াবের চেয়ে অনেকগুণ বেশি পুরস্কার প্রদান করেন। কখনো তিনি ন্যায়বিচার হিসেবে পাপের শাস্তি প্রদান করেন। কখনো মেহেরবানি করে পাপ ক্ষমা করেন।’’
কুরআন-হাদীসে এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে:
(১) মহান আল্লাহ পাপের শাস্তি দিবেন এবং পুণ্যের পুরস্কার দিবেন। তিনি পাপ পরিমাণে শাস্তি দিবেন। তবে পুরস্কারের ক্ষেত্রে তিনি ইচ্ছা করলে বান্দাকে তার কর্মের চেয়ে বহুগুণ বেশি পুরস্কার প্রদান করবেন।
(২) শিরক ছাড়া যে কোনো পাপ আল্লাহ ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন।
(৩) আল্লাহ কাউকে জুলুম করবেন না; তবে তিনি ইচ্ছা করলে অতিরিক্ত করুণা করবেন। শাস্তি তাঁর ইনসাফ এবং পুরস্কার তাঁর করুণা।
এ বিষয়ে কুরআন-হাদীসে অগণিত নির্দেশনা রয়েছে। কয়েকটি আয়াত দেখুন:
وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ
وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
‘‘আল্লাহর জন্যই যা আছে আসমানসমূহে এবং যা আছে যমীনে। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা আযাব দেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’’[1]
إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ
يَشَاءُ
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।’’[2]
مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ
فَلا يُجْزَى إِلا مِثْلَهَا وَهُمْ لا يُظْلَمُونَ
‘‘যে সৎকাজ এনেছে, তার জন্য তার দশ গুণ। আর যে অসৎকাজ এনেছে, তাকে কর্ম-পরিমাণই প্রতিদান দেওয়া হবে এবং তাদেরকে যুলুম করা হবে না।’’[3]
وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
‘‘আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বহুগুণ বৃদ্ধি করেন।’’[4]
হাদীস শরীফে এ বিষয়ে অগণিত নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এ বিষয়গুলো সবই মহান আল্লাহর মর্যাদার সাথে এবং মানবীয় বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু মুতাযিলীগণ ও সমমনা কিছু ফিরকা যুক্তি ও বুদ্ধির নামে দাবি করেন যে, মহান আল্লাহ পাপীকে ক্ষমা করতে পারেন না; কারণ তা ইনসাফের পরিপন্থী। মু’তাযিলাগণ নিজদেরকে ‘আহলুল আদলি ওয়াত তাওহীদ’ (أهل العدل والتوحيد) অর্থাৎ ন্যায়বিচার ও একত্বের অনুসারী বলতেন। তাদের আকীদার অন্যতম (১) আদল (العدل) বা ন্যায়বিচার ও (২) ইনফাযুল ওঈদ (إنفاذ الوعيد) বা শাস্তির অঙ্গীকার বাস্তবায়ন।[5] এজন্য তারা দাবি করেন যে, কোনো মুমিন কবীরা গোনাহ করে তাওবা ছাড়া মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। এ ব্যক্তি কাফিরের মতই অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। এ বিশ্বাসকে তারা ‘শাস্তির অঙ্গীকার বাস্তবায়ন’ বলে আখ্যায়িত করতেন। কারণ আল্লাহ পাপীদের শাস্তির অঙ্গীকার করেছেন। এরপর যদি তিনি ক্ষমা করেন তবে তা ন্যায়বিচার ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পরিপন্থী হয়। আল্লাহর ন্যায়বিচারের যুক্তিতে তারা ‘ক্ষমা’ ও ‘শাফা‘আত’ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের সকল নির্দেশনা বিভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে অস্বীকার করেন।
আমরা আগেই দেখেছি যে, তাদের সকল বিভ্রান্তির মূল নিজেদের তথাকথিত ‘বুদ্ধি-বিবেক’ বা দর্শন দিয়ে ওহীর দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য বিচার ও ছাঁটাই করা। এ মত প্রমাণ করতে তারা কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বাতিল করেন। মহান আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ‘‘শিরক ছাড়া অন্য যে কোনো পাপ তিনি ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন।’’ আল্লাহ কুরআনে বিভিন্ন স্থানে বারবার বলেছেন যে, তাওবা করলে শিরক ক্ষমা করবেন তিনি।[6] কাজেই এ আয়াতের দ্ব্যর্থহীন অর্থ যে, তিনি অন্যান্য পাপ তাওবা ছাড়াও ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন। মুতাযিলাগণ বিভিন্নভাবে এ আয়াতের অপব্যাখ্যা করেন।
নব্য মুতাযিলীদের কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন। তবে তিনি কাউকে ক্ষমা করলে জাহান্নামে প্রবেশের আগেই ক্ষমা করবেন। পাপের কারণে কোনো মানুষ একবার জাহান্নামে প্রবেশ করলে আর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতে পারবেন না। কারণ, কুরআনে কোথাও বলা হয় নি যে, জাহান্নামে প্রবেশের পরে কেউ আবার বেরিয়ে আসবে।’ আর যেহেতু বিষয়টি কুরআনে নেই সেহেতু এ বিষয়ক হাদীসগুলো তারা অস্বীকার করেন।
বস্ত্তত তারা মহান আল্লাহর ক্ষমা করার ক্ষমতাও সংকুচিত করতে চান। আল্লাহ সুস্পষ্ট বলেছেন যে, তিনি শিরক ছাড়া অন্যান্য পাপ তাওবা ছাড়াই ক্ষমা করতে পারেন। অর্থাৎ বান্দাকে কোনোরূপ শাস্তি না দিয়েই তিনি ক্ষমা করতে পারেন। তাহলে জাহান্নামে কিছুদিন শাস্তি ভোগের পর ক্ষমা করা তো আরো স্বাভাবিক, বিবেকসঙ্গত ও যৌক্তিক বিষয়। পাশাপাশি অগণিত মুতাওয়াতির হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, জাহান্নামে প্রবেশের পরে শাস্তি শেষ হওয়ায়, শাফাআতের কারণে বা আল্লাহ নিজ করুণায় অনেক জাহান্নামীকে জান্নাত প্রদান করবেন।
বস্ত্তত মুতাযিলীগণ যুক্তির নামে অযৌক্তিকভাবে মহান আল্লাহকে অতি সাধারণ একজন জাগতিক শাসকের চেয়েও অক্ষম বলে কল্পনা করে। পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রে আইনের শাসনের অংশ অপরাধের শাস্তির বিধানের পাশাপাশি শাসককে ক্ষমার অধিকার দেওয়া। শাস্তিভোগ শুরুর আগে এবং কিছু শাস্তি ভোগের পরে উভয় অবস্থাতেই শাসক ক্ষমা করতে পারেন। শাসকের ক্ষমা করার অধিকারকে কেউই আইনের শাসনের পরিপন্থী বলে গণ্য করেন না। বরং এরূপ ক্ষমার অধিকার আইন ও ইনসাফেরই অংশ।
সর্বোপরি তারা আল্লাহর ইনসাফের নামে আল্লাহর বে-ইনসাফির দাবি করেন। কারণ ‘ঈমান’ বান্দার সর্বোচ্চ ইবাদত। বান্দার অন্য পাপের কারণে যদি এ ইবাদত সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয় তাহলে তা বে-ইনসাফী বলে গণ্য হবে। কারণ এতে সবচেয়ে বড় পুণ্য ও পাপ: ঈমান ও কুফরের কোনো বিচার করা হয় না, শুধু অন্যান্য পাপ ও পুন্যের বিচার করা হয়। জাগতিক বিচারেও একই অপরাধে দু প্রকার শাস্তি হতে পারে। অপরাধীর মানসিকতা, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আচরণ, অপরাধে অংশগ্রহণের প্রকৃতি ইত্যাদি বিচার করে বিচারক শাস্তি প্রদান করেন। কাজেই আল্লাহ কাফির পাপী এবং মুমিন পাপীকে সমান বিচার করবেন এবং পাপী মুমিনের ঈমানের কোনোই মূল্যয়ন করবেন না বলে দাবি করলে তাতে আল্লাহর ইনসাফের দাবি করা হয় না, বরং বে-ইনসাফির দাবি করা হয়।
এজন্য আহলুস সুন্নাত এ বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের সকল নির্দেশনা আক্ষরিক ও সরল অর্থে বিশ্বাস করেন। আল্লাহর শাস্তির ওয়াদা এবং ক্ষমার ওয়াদা দুটিই তাঁরা বিশ্বাস করেন। মহান আল্লাহর শাস্তি তাঁর ইনসাফ, তাঁর পুরস্কার তাঁর অনুদান এবং তাঁর ক্ষমা তাঁর করুণা। ইমাম আবূ হানীফা এ আকীদাই ব্যাখ্যা করেছেন।
[1] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১২৯ আয়াত। সূরা (৫) মায়িদা ১৮ আয়াত ও সূরা (৪৮) ফাতহ: ১৪ আয়াত।
[2] সূরা (৪) নিসা: ৪৮ আয়াত। আরো দেখুন: ১১৬ আয়াত।
[3] সূরা (৬) আনআম: ১৬০ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৪) নিসা: ৪০ আয়াত; সূরা (২৭) নামল: ৮৯ আয়াত; (২৮) কাসাস: ৮৪ আয়াত; সূরা (৪০) গাফির (মুমিন): ৪০ আয়াত...।
[4] সুরা (২) বাকারা: ২৬১ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (২৫) ফুরকান: ৬৯ আয়াত।
[5] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫২০-৫২৮।
[6] সূরা (৯) তাওবা: ৫, ১১ আয়াত।
৯. শাফাআত ও আখিরাতের কিছু বিষয় / ৯. ১. শাফাআতের অর্থ ও এ বিষয়ক বিভ্রান্তি
আমরা বলেছি যে, মুতাযিলীগণ আল্লাহর ইনসাফের অজুহাতে শাফাআত অস্বীকার করত। এজন্য এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা শাফাআত ও আখিরাতের অন্যান্য কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘‘নবীগণের শাফা‘আত সত্য। পাপী মুমিনগণ এবং কবীরা গোনাহকারীগণের জন্য- পাপের কারণে যাদের জাহান্নাম পাওনা হয়েছিল তাদের জন্য- কিয়ামাতের দিন আমাদের নবী (ﷺ)-র শাফা‘আতও সত্য।
৯. ১. শাফাআতের অর্থ ও এ বিষয়ক বিভ্রান্তি
শাফা‘আত (الشفاعة) অর্থ সুপারিশ করা বা কারো দাবি বা আব্দারকে সমর্থন করা। শব্দটি ‘আশ-শাফউ (الشفع) থেকে গৃহীত, যার অর্থ জোড়া বা জোড়া বানানো। আল্লামা ইবনুল আসীর (৬০৬ হি) বলেন:
قَدْ تَكَرَّرَ ذِِكْرُ الشَّفَاعَةِ فِيْ الْحَدِيْثِ فِيْمَا يَتَعَلَّقُ
بِأُمُوْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَهِيَ السُّؤالُ فِيْ التَّجَاوُزِ عَنِ
الذُّنُوْبِ وَالْجَرائِمِ.
‘‘হাদীসে বিভিন্ন স্থানে শাফা‘আত শব্দটি এসেছে জাগতিক বা আখিরাতের বিষয়ে। এর অর্থ পাপ বা অপরাধের শাস্তি না দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করা।’’[1]
শাফাআত বিষয়ে দ্বিমুখি বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছিল। প্রথমত কাফিরগণ শাফাআতকে আল্লাহর ফিরিশতা বা নবী-ওলীগণের ক্ষমতা বলে বিশ্বাস করত। তারা দাবি করত যে, আল্লাহ তাদেরকে শাফাআতের ক্ষমতা প্রদান করেছেন, তাঁরা নিজেদের ইচ্ছামত যাকে খুশি শাফাআত করবেন। কাজেই তাদেরকে ভক্তির মাধ্যমে খুশি করতে পারলেই হলো। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শীয়াগণ এরূপ বিশ্বাস পোষণ করেন। এরূপ বিশ্বাস পোষণকারীরা ফিরিশতা, নবীগণ ও নেককার বান্দাগণের শাফাআতের বিষয়ে পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থের ও কুরআন-হাদীসের বক্তব্যকে দলীল হিসেবে পেশ করত।
পক্ষান্তরে খারিজী, মু’তাযিলা ও অন্যান্য কতিপয় ফিরকা পাপীদের জন্য নবীগণের বা অন্যদের শাফা‘আত অস্বীকার করে। এক্ষেত্রে তাদের দলিলগুলো মূলত দু প্রকারের: (১) শাফা‘আত অস্বীকার বিষয়ক কুরআনের আয়াতগুলো এবং (২) তাদের মতবাদ ভিত্তিক যুক্তি। তাদের মতে পাপী মুসলিমের শাস্তি না দেওয়া আল্লাহর ন্যায়বিচারের পরিপন্থী, কাজেই আল্লাহ নিজের রহমতে বা অন্য কারো শাফা‘আতে কোনো পাপীকে ক্ষমা করতে পারেন না। আমরা কুরআন-হাদীসের আলোকে শাফা‘আত বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা ব্যাখ্যা করব।
[1] ইবনুল আসীর, আন-নিহায়া ২/৪৮৫।
৯. ২. শাফাআত বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা
কুরআনে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিয়ামাতের দিন কোনো শাফা‘আত কবুল করা হবে না, আল্লাহ ছাড়া কেউ শাফা‘আতের অধিকার রাখবে না এবং আল্লাহ ছাড়া কোনো শাফা‘আতকারী থাকবে না। কয়েকটি আয়াত দেখুন:
وَاتَّقُوا يَوْمًا لا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلا يُقْبَلُ مِنْهَا
شَفَاعَةٌ وَلا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلا هُمْ يُنْصَرُونَ
‘‘তোমরা সে দিনকে ভয় কর, যে দিন কেউ কারো কাজে আসবে না এবং কারো শাফাআত (সুপারিশ) স্বীকৃত হবে না এবং কারো নিকট হতে ক্ষতিপূরণ গৃহীত হবে না এবং তারা কোন প্রকার সাহায্য পাবে না।’’[1]
وَاتَّقُوا يَوْمًا لا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلا يُقْبَلُ مِنْهَا
عَدْلٌ وَلا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَلا هُمْ يُنْصَرُونَ
‘‘তোমরা সে দিনকে ভয় কর যে দিন কেউ কারো উপকার করবে না এবং কারো নিকট হতে কোন ক্ষতিপূরণ গৃহীত হবে না এবং কোন শাফাআত কারো উপকারে লাগবে না এবং তারা কোন সাহায্যও পাবে না।’’[2]
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ
أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لا بَيْعٌ فِيهِ وَلا خُلَّةٌ وَلا شَفَاعَةٌ
‘‘হে মু’মিনগণ, আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা হতে তোমরা ব্যয় কর সে দিন আসার পূর্বে- যে দিন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব এবং শাফাআত থাকবে না।’’[3]
أَأَتَّخِذُ مِنْ دُونِهِ آَلِهَةً إِنْ يُرِدْنِ الرَّحْمَنُ بِضُرٍّ لا تُغْنِ
عَنِّي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا وَلا يُنْقِذُونِ
‘‘আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য ইলাহ গ্রহণ করব? দয়াময় আল্লাহ আমার অমঙ্গল চাইলে তাদের শাফাআত-সুপারিশ আমার কোন কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না।’’[4]
وَأَنْذِرْ بِهِ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْ يُحْشَرُوا إِلَى رَبِّهِمْ لَيْسَ
لَهُمْ مِنْ دُونِهِ وَلِيٌّ وَلا شَفِيعٌ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
‘‘তুমি এ দ্বারা তাদেরকে সতর্ক কর যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের প্রভুর নিকট সমবেত করা হবে এমন অবস্থায় যে, তিনি ব্যতীত তাদের কোনো অভিভাবক থাকবে না এবং কোনো শাফাআতকারীও থাকবে না; হয়ত তারা সাবধান হবে।’’[5]
وَذَكِّرْ بِهِ أَنْ تُبْسَلَ نَفْسٌ بِمَا كَسَبَتْ لَيْسَ لَهَا مِنْ دُونِ
اللَّهِ وَلِيٌّ وَلا شَفِيعٌ
‘‘এ দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দাও, যাতে কেউ নিজ কৃত কর্মের জন্য ধ্বংস না হয়, যখন আল্লাহ ব্যতীত তার কোনো অভিভাবক থাকবে না এবং কোনো সুপারিশকারীও থাকবে না।’’[6]
مَا لَكُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلا شَفِيعٍ أَفَلا تَتَذَكَّرُونَ
‘‘তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক নেই এবং সুপারিশকারীও নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না।’’[7]
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ
وَيَقُولُونَ هَؤُلاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ
بِمَا لا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلا فِي الأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى
عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করে তারা তাদের ক্ষতিও করে না উপকারও করে না। তারা বলে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের শাফাআতকারী। বল, তোমরা কি আল্লাহকে আকাশম-লী ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দিচ্ছ, যা তিনি জানেন না? তিনি মহান পবিত্র এবং তাদের শির্ক থেকে তিনি অতি ঊর্ধ্বে।’’[8]
قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ ثُمَّ
إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
‘‘বল, সকল সুপারিশ আল্লাহরই, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই; অতঃপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তন করবে।’’[9]
এ সকল আয়াতে বাহ্যত শাফা‘আত অস্বীকার করা হয়েছে। এ সকল আয়াত থেকে মু’তাযিলা ও অন্যান্য ফিরকা দাবি করে যে, কিয়ামাতের দিন কারো শাফা‘আতে কোনো পাপীর ক্ষমালাভের ধারণা বাতিল ও ভিত্তিহীন।
বস্ত্তত এ সকল আয়াতে মূলত শাফা‘আত বিষয়ে মুশরিকদের বিশ্বাস খন্ডন করা হয়েছে। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ওহীর জ্ঞানের সাথে কিছু কল্পনা যোগ করে কাফিরগণ বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর ফিরিশতাগণ, নবীগণ বা প্রিয়পাত্রগণ শাফা‘আতের ক্ষমতা ও অধিকার সংরক্ষণ করেন। মহান আল্লাহ তাদেরকে এ ধরনের ক্ষমতা ও অধিকার দিয়ে দিয়েছেন। তারা তাদের ইচ্ছামত যাকে ইচ্ছা সুপারিশ করে মুক্তি দিতে পারবেন। মহান আল্লাহ তাদের এ ভ্রান্ত বিশ্বাস খন্ডন করে জানিয়েছেন যে, শাফা‘আতের মালিকানা, অধিকার ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।
অন্যান্য আয়াতে শাফা‘আতের স্বীকৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। যিনি শাফা‘আত করবেন তিনি যদি শাফা‘আত করার জন্য মহান আল্লার অনুমতি গ্রহণ করেন এবং যার জন্য শাফা‘আত করবেন তার প্রতি যদি মহান আল্লহ সন্তুষ্ট থাকেন তবে সেক্ষেত্রে শাফা‘আত করার সুযোগ আল্লাহ প্রদান করবেন। যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট নন তার জন্য কেউই শাফা‘আত করবে না। সর্বাবস্থায় শাফা‘আত গ্রহণ করা বা না করা মহান আল্লাহর ইচ্ছা। এ অর্থের কয়েকটি আয়াত দেখুন:
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلا بِإِذْنِهِ
‘‘কে সে যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করবে?’’[10]
يُدَبِّرُ الأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ
‘‘তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই।’’[11]
لا يَمْلِكُونَ الشَّفَاعَةَ إِلا مَنِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا
‘‘শাফাআতের মালিকানা তাদের কারো নেই। তবে ব্যতিক্রম সে ব্যক্তি যে দয়াময়ের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে।’’[12]
يَوْمَئِذٍ لا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ
لَهُ قَوْلا
‘‘দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারো সুপারিশ সে দিন কোন কাজে আসবে না।’’[13]
وَلا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ
‘‘যাকে অনুমতি দেয়া হয় সে ব্যতীত আল্লাহর নিকট কারো সুপারিশ কার্যকর হবে না।’’[14]
আমরা দেখেছি যে, কাফিরগণ ফিরিশতাগণের শাফাআত বিষয়ক বক্তব্য অপব্যাখ্যা করে ফিরিশতাগণের শাফাআত লাভের আশায় তাঁদের ইবাদত করত। কুরআনে তাদের এ বিভ্রান্তি অপনোদন করা হয়েছে। একস্থানে আল্লাহ বলেন:
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُكْرَمُونَ لا
يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ
أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلا يَشْفَعُونَ إِلا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ
خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ.
‘‘তারা বলে, ‘দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তিনি পবিত্র, মহান! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তিনি যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের ছাড়া আর কারো জন্য তারা সুপারিশ করে না এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত।’’[15]
আল্লাহ ফিরিশতাদের বা অন্যান্য সম্মানিত সৃষ্টির ‘শাফা‘আতের’ সুযোগ অস্বীকার করেন নি, কাফিরদের ‘বিকৃতি’ খন্ডন করেছেন। কাফিরগণ আল্লাহর সাথে ফিরিশতা বা প্রিয় বান্দাগণের সম্পর্ককে পৃথিবীর রাজাবাদশার সাথে আমলা-চামচাদের সম্পর্কের মত মনে করেছে। অন্যায়কারী ব্যক্তি রাজার অজ্ঞাতে তার কোনো প্রিয়পাত্রকে তোয়াজ করে সুপারিশ আদায় করে নিতে পারে। আর এরূপ সুপারিশে শাসক বা রাজা প্রভাবিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন। আর এক্ষেত্রে সুপারিশ প্রার্থী উক্ত ‘আমলা’-কে যে কোনো প্রকারে ভক্তি বা তোয়াজ করে সুপারিশ আদায়ের চেষ্টা করেন। উক্ত রাজাকে যেমন ভক্তি তোয়াজ করেন, আমলাকেও তদ্রূপ বা তার চেয়ে বেশি করলেও অসুবিধা নেই।
মহান আল্লাহ তাদের বিভ্রান্তির স্বরূপ তুলে ধরেছেন। ফিরিশতাগণ বা অন্যান্য ‘সম্মানিত বান্দাগণ’ ‘আল্লাহর বান্দা’। তাঁরা ‘আল্লাহর সন্তান’ নন। তাঁদের কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা নেই বা ‘ইবাদত (চূড়ান্ত ভক্তি) লাভের অধিকার নেই। ফিরিশতাগণ বা আল্লাহর অন্যান্য প্রিয় বান্দগণের সুপারিশ কখনোই জাগতিক রাজা-বাদশাহগণের কাছে আমলাদের সুপারিশের মত নয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। ফিরিশতাগণ বা নেক বান্দাগণ সদা সর্বদা তাঁরই ভয়ে ভীত। তাঁরা শুধু আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্যই আল্লাহর কাছে শাফাআত করেন। যাদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের জন্য তাঁরা আল্লাহর কাছে শাফাআত করেন না। সর্বোপরি কার জন্য কার সুপারিশ গ্রহণ করতে হবে সে বিষয়ে মহান আল্লাহই সবচেয়ে বেশি ও ভাল জানেন।
এ বিষয়ে অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلا مِنْ
بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى
‘‘আকাশে কত মালাক (ফিরিশতা) রয়েছে তাদের কোনো সুপারিশ ফলপ্রসু হবে না, যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি অনুসারে কাউকে অনুমতি দেন।’’[16]
এভাবে কুরআন ‘মালাক’গণের শাফা‘আত অস্বীকার করছে না। তবে তাঁদের শাফা‘আতের মালিকানা বা ক্ষমতার ধারণা অস্বীকার করছে। শাফা‘আতের মালিকানা ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা যখন অনুমতি প্রদান করবেন সে তখন কেবলমাত্র যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন তাদেরই জন্য সুপারিশ করবেন।
উপরের আয়াতগুলি থেকে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো বুঝতে পারি:
(১) শাফা‘আতের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো শাফা‘আতের কোনো মালিকানা, ক্ষমতা বা অধিকার নেই।
(২) আল্লাহ অনুমতি দিলে কেউ শাফ‘আত করতে পারবেন।
(৩) যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট শুধু তাকেই অনুমতি প্রদান করবেন।
(৪) আল্লাহর অনুমতিক্রমে ফিরিশতাগণ সুপারিশ করবেন বলে কুরআনে স্পষ্টত বলা হয়েছে। এছাড়া অন্য কারা তাঁর অনুমতিক্রমে সুপারিশ করতে পারবেন তা স্পষ্টত উল্লেখ করা হয় নি। হাদীস শরীফে এ বিষয়ক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
(৫) যে ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করা হবে তার জন্য আল্লাহর অনুমোদন পূর্বশর্ত।
(৬) যে ব্যক্তির প্রতি স্বয়ং আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন সে ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো জন্য কেউ সুপারিশ করবেন না।
বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে যে, কিয়ামাতের দিন নবীগণ ও অন্যান্য মানুষ এবং মানুষের বিভিন্ন আমল শাফা‘আত করবে এবং তাদের শাফা‘আত কবুল করা হবে। এ সকল হাদীসের বিস্তারিত আলোচনার জন্য বৃহৎ পরিসরের প্রয়োজন। হাদীসে বর্ণিত শাফা‘আতের পর্যায়গুলো নিম্নরূপে ভাগ করা যায়:
(১) শাফা‘আতে উযমা (الشفاعة العظمى) বা মহোত্তম শাফা‘আত। এদ্বারা বিচার শুরুর জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করা বুঝানো হয়। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিয়ামাতের দিন মানুষ বিভিন্ন নবী-রাসূলের নিকট গমন করে ব্যর্থ হয়ে সর্বশেষ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট গমন করবেন। তিনি সমগ্র মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে শাফা‘আত করবেন, মানুষদের বিচার শেষ করে দেওয়ার জন্য।
(২) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আতে মহান আল্লাহ তাঁর উম্মাতের অনেক গোনাহগারকে ক্ষমা করবেন।
(৩) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আতে অনেক পাপী মুসলিম জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
(৪) উম্মাতে মুহাম্মাদীর অনেক নেককার মানুষ শাফা‘আত করবেন।
(৫) সন্তানগণ তাদের পিতামাতাদের জন্য শাফা‘আত করবে।
(৬) কুরআন তার পাঠক ও অনুসারীদের জন্য শাফা‘আত করবে।
(৭) সিয়াম ও অন্যান্য ইবাদত শাফা‘আত করবে।
কেউ যদি আল্লাহ থেকে বিমুখ থাকে, ঈমান বিশুদ্ধ না করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা না করে কিন্তু কোনো ফিরিশতা, নবী বা ওলীকে বিশেষভাবে ভালবাসে, তাঁকে ভক্তি-সম্মান করে বা সর্বদা তাঁর জন্য দু‘আ করে এবং আশা করে যে, উক্ত ফিরিশতা, নবী বা ওলী তাকে সুপারিশ করে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা করবেন তবে তা ভিত্তিহীন দুরাশা ও শিরকের রাজপথ ছাড়া কিছুই নয়।
পক্ষান্তরে কেউ যদি ঈমান ও তাওহীদ বিশুদ্ধ করেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন, কিন্তু মানবীয় দুর্বলতায় বা শয়তানের প্ররোচনায় কবীরা গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়েন তবে মহান আল্লাহ তাঁর আন্তরিকতা ও চেষ্টার প্রতি সন্তুষ্ট হলে তাঁর কোনো সম্মানিত বান্দাকে তার জন্য শাফা‘আত করার অনুমতি প্রদান করবেন। মূল বিষয় আল্লাহর সন্তুষ্টি। মহান আল্লাহ কোনো পাপী বান্দার তাওহীদ ও ঈমানে সন্তুষ্ট হলে তিনি নিজেই তাঁকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। অথবা তাঁর কোনো সম্মানিত বান্দাকে সম্মান করে তার জন্য শাফা‘আতের অনুমতি দিতে পারেন।
মু’তাযিলাগণ শাফা‘আতে উযমা স্বীকার করে; কারণ তা তাদের মূলনীতির পরিপন্থী নয়। পাপী মুমিনের জন্য শাফা‘আত বিষয়ক অন্যান্য আয়াত ও হাদীসকে তারা শাফা‘আতে উযমা বলে ব্যাখ্যা করে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণ সহীহ হাদীসে প্রমাণিত সকল প্রকারের শাফা‘আতেই বিশ্বাস করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, শাফ‘আতের মালিকানা একমাত্র মহান আল্লাহরই। তিনি যার উপর সন্তুষ্ট হবেন তার জন্য তিনি দয়া করে শাফা‘আতের ব্যবস্থা করে দিবেন। তিনি যার উপর সন্তুষ্ট থাকবেন তার জন্য তাঁর অনুমতিপ্রাপ্ত কেউ শাফা‘আত করলে তিনি ইচ্ছা করলে তা কবুল করে গোনাহগার মুমিনকে ক্ষমা করতে পারেন।
[1] সূরা (২) বাকারা: ৪৮ আয়াত।
[2] সূরা (২) বাকারা: ১২৩ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ২৫৪ আয়াত।
[4] সূরা (৩৬) ইয়াসীন: ২৩ আয়াত।
[5] সূরা (৬) আন‘আম: ৫১ আয়াত।
[6] সূরা (৬) আন‘আম: ৭০ আয়াত।
[7] সূরা (৩২) সাজদা: ৪০ আয়াত।
[8] সূরা (১০) ইউনুস: ১৮ আয়াত।
[9] সূরা (৩৯) যুমার: ৪৪ আয়াত।
[10] সূরা (২) বাকারা: ২৫৫ আয়াত।
[11] সূরা (১০) ইউনুস: ৩ আয়াত।
[12] সূরা (১৯) মারইয়াম: ৮৭ আয়াত।
[13] সূরা (২০) তাহা: ১০৯ আয়াত।
[14] সূরা (৩৪) সাবা: ২৩ আয়াত।
[15] সূরা (২১) আম্বিয়া: ২৬-২৯ আয়াত।
[16] সূরা (৫৩) নাজম: ২৬ আয়াত।
১০. মীযান
এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন: ‘‘কিয়ামাতের দিন মীযানে (তুলাদন্ডে) আমল ওযন করাও সত্য।’’
মীযান অর্থ দাড়িপাল্লা বা পরিমাপ যন্ত্র। আখিরাতের হিসাব, শাস্তি ও পুরস্কারের অন্যতম বিষয় কর্মের ওযন। কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ কিয়ামাতের দিন মানুষের কর্ম ওজন করবেন এবং ওজনের জন্য মীযান বা তুলাদন্ড স্থাপন করবেন। মুতাযিলা ও সমমনা অনেকে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে অতীতে বলতেন যে, মানুষের বিশ্বাস, কথা বা কর্ম তো কোনো পদার্থ নয়, কাজেই তা কিভাবে ওযন করা হবে? তারা ওযন বিষয়ক আয়াত ও হাদীসকে বিভিন্ন রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করতেন। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য বাহ্যিক ও সরল অর্থে গ্রহণ করে বলেছেন যে, কিয়ামাতের দিন মানুষের বিশ্বাস, কথা ও কর্ম সবই ওযন করা হবে। ওযনের প্রকৃতি মহান আল্লাহ জানেন। এ বিষয়ক কয়েকটি আয়াত দেখুন:
وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلا تُظْلَمُ نَفْسٌ
شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى
بِنَا حَاسِبِينَ
‘‘এবং কিয়ামাত-দিবসে আমি স্থাপন করব ন্যায় বিচারের তুলাদ-। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না এবং কর্ম যদি তিল পরিমাণ ওজনেরও হয় তবুও আমি তা উপস্থিত করব; হিসাব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।’’[1]
وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ
الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا
أَنْفُسَهُمْ بِمَا كَانُوا بِآَيَاتِنَا يَظْلِمُونَ
‘‘সে দিনের ওজনের বিষয়টি সত্য। যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে; আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজদের ক্ষতি করেছে, যেহেতু তারা আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করত।’’[2]
فَأَمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ وَأَمَّا مَنْ
خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ
ّ‘‘তখন যার পাল্লা ভারী হবে সে তো লাভ করবে সন্তোষজনক জীবন, কিন্তু যার পাল্লা হালকা হবে তার স্থান হবে ‘হাবিয়া’ (গভীর গর্ত)।’’[3]
হাদীস শরীফে এ বিষয়ে অগণিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
[1] সূরা (২১) আম্বিয়া: ৪৭ আয়াত।
[2] সূরা (৭) আ’রাফ: ৮-৯ আয়াত।
[3] সূরা (১০১) কারিয়া: ৬-১১ আয়াত।
১১. পারস্পরিক যুলুমের বিচার ও বদলা
এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) কিয়ামত বিষয়ক আরেকটি বিশ্বাস উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন: ‘‘কিয়ামাতের দিন বিবাদকারীদের মধ্যে পুণ্যকর্মের মাধ্যমে বদলার ব্যবস্থা করা সত্য। যদি তাদের সাওয়াব বা নেককর্ম না থাকে তবে পাওনাদারের পাপ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও সত্য ও সম্ভব।’’
কিয়ামাতের একটি দিক সৃষ্টির পারস্পরিক অধিকার ও পাওনা বিষয়ক বিচার, প্রতিশোধ ও বদলা। কিয়ামাত দিবসে মানুষের প্রত্যেক কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে এবং কোনো যুলম থাকবে না। এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
الْيَوْمَ تُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ لا ظُلْمَ الْيَوْمَ...وَاللَّهُ
يَقْضِي بِالْحَقِّ
‘‘আজ প্রত্যেক প্রাণ যা কিছু অর্জন করেছে তার প্রতিফল পাবে; কোনো যুলম নেই আজ।.... আল্লাহ হক্ক বিচার করেন।’’[1]
এ অর্থের বিভিন্ন আয়াত থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কিয়ামাতের দিবসে মানুষদের পারস্পরিক পাওনা ও জুলুম ইনসাফের সাথে বিচার করা হবে এবং মাজলুমের অধিকার আদায় করে জুলুমের চির-নিষ্পত্তি করা হবে। হাদীস শরীফে এ বিষয়ক বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিয়ামাতের দিন মানুষদের মধ্যকার সকল জুলুম, পাওনা, ঋণ ও লেনদেনের বিচার নিষ্পত্তি করা হবে। হত্যা, রক্তপাত, মারধর, গীবত, কর্মদাতার কর্মের আমানত নষ্ট, কর্মচারীর অধিকার নষ্ট ইত্যাদি সকল প্রকারের অপরাধের ক্ষেত্রে মাজলুমকে তার ন্যায্য পাওনা বুঝে দেওয়া হবে।
আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
اتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘‘তোমরা কাউকে জুলুম করা থেকে আত্মরক্ষা করবে; কারণ জুলুম কিয়ামাতের দিন ভয়াবহ অন্ধকারে পরিণত হবে।’’[2]
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي الدِّمَاءِ
‘‘কিয়ামাতের দিন প্রথম যে বিষয়টি মানুষের মধ্যে বিচার করা হবে তা হলো রক্ত বা খুন-হত্যার বিষয়।’’[3]
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لأَحَدٍ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَىْءٍ
فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ، قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ دِينَارٌ وَلاَ
دِرْهَمٌ، إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ،
وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ
عَلَيْهِ
‘‘যদি কারো যিম্মায় অন্য কারো সম্মান-মর্যাদা বা অন্য কোনো বিষয়ক অন্যায়-জুলুম থাকে তাহলে সে যেন আজই তার থেকে তা মুক্ত করে নেয়; সে দিবস আগমনের আগেই, যে দিবসে কোনো টাকা-পয়সা থাকবে না। যদি তার কোনো নেক আমল থাকে তাহলে তার অন্যায়ের পরিমাণে নেক আমল গ্রহণ করা হবে। আর যদি নেক আমল না থাকে তবে মাজলুমের পাপ থেকে নিয়ে তার ঘাড়ে চাপানো হবে।’’[4]
আবূ হুরাইরা (রা) বর্ণিত অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَتَدْرُونَ مَا (مَنِ) الْمُفْلِسُ قَالُوا الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لا دِرْهَمَ
لَهُ وَلا مَتَاعَ فَقَالَ إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ
الْقِيَامَةِ بِصَلاةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ
هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا
مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ
أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ
طُرِحَ فِي النَّارِ
‘‘তোমরা কি জান কপর্দকহীন দরিদ্র কে? সাহাবীগণ বলেন: আমাদের মধ্যে দরিদ্র তো সেই যার কোনো অর্থ-সম্পদ নেই। তিনি বলেন: আমার উম্মাতের অসহায় দরিদ্র সে ব্যক্তি যে কিয়ামাতের দিন সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি নিয়ে আগমন করবে। কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কাউকে অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ ভক্ষণ করেছিল, কারো রক্তপাত করেছিল, কাউকে প্রহার করেছিল। তখন একে একে এ সকল মাযলূমকে তার পুণ্য থেকে প্রদান করা হবে। তার যিম্মায় বিদ্যমান অপরাধ শেষ হওয়ার আগেই যদি তার পুণ্য শেষ হয়ে যায় তবে মাযলূমদের পাপ নিয়ে তার উপর নিক্ষেপ করা হবে, অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’’[5]
আব্দুল্লাহ ইবন উমার বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ دِينَارٌ أَوْ دِرْهَمٌ قُضِيَ مِنْ حَسَنَاتِهِ لَيْسَ
ثَمَّ دِينَارٌ وَلا دِرْهَمٌ
‘‘ঋণগ্রস্ত অবস্থায় যে মৃত্যুবরণ করবে যে দিন কোনো টাকা-পয়সা থাকবে না সেদিন তার পুণ্য থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা হবে।’’[6]
[1] সূরা (৪০) গাফির (মুমিন): ১৭ ও ২০ আয়াত।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ২/৮৬৩-৮৬৪ (কিতাবুল মাযালিম, বাবুয যুলম যুলুমাত), মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৯৬ (কিতাবুল বির্রি ওয়াস সিলাহ, বাবু তাহরীমিয যুলম)।
[3] বুখারী, আস-সহীহ (কিতাবুদ দিয়্যাত, বাবু মান কাতালা...); মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৩০৪ (কিতাবুল কাসামা, বাবুল মুজাযাত বিদ-দিমা)।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ২/৮৬৫ (কিতাবুল মাযালিম, বাব মান কানাত লাহু মাযলামাতুন্...)
[5] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৯৭ (কিতাবুল বির্রি ওয়াস সিলাহ, বাবু তাহরীমিয যুলম)
[6] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, ২/৮০৭ (কিতাবুস সাদাকাত, বাবুত তাশদীদি ফিদ দাইনি); আলবানী, সহীহুত তারগীব ২/১৬৭। হাদীসটির সনদ সহীহ।
১২. হাউয
আখিরাত বিষয়ক ইসলামী আকীদার অন্যতম একটি বিষয় ‘‘হাউয’’ বিষয়ক বিশ্বাস। এ প্রসঙ্গে ইমাম আযম বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাউয সত্য।’’
হাউয (الحوض) অর্থ চৌবাচ্চা, পুকুর বা জলাশয়। আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে একটি পবিত্র ‘হাউয’ দান করেছেন যেখান থেকে তাঁর উম্মাত কিয়ামাতের দিন পানি পান করবে। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ
‘‘নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রদান করেছি ‘‘কাওসার’’।[1]
কাওসার শব্দের অর্থ অধিক বা আধিক্য। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, কাওসার জান্নাতের একটি নদীর নাম, যা মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন। হাউযের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলো মুতাওয়াতির পর্যায়ের। প্রায় ৩৫ জন সাহাবী থেকে এ বিষয়ক হাদীসগুলো বর্ণিত।[2] এক হাদীসে আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন:
بَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ ذَاتَ يَوْمٍ بَيْنَ أَظْهُرِنَا إِذْ أَغْفَى
إِغْفَاءَةً ثُمَّ رَفَعَ رَأْسَهُ مُتَبَسِّمًا فَقُلْنَا مَا أَضْحَكَكَ يَا
رَسُولَ اللَّهِ قَالَ أُنْزِلَتْ عَلَيَّ آنِفًا سُورَةٌ فَقَرَأَ بِسْمِ اللَّهِ
الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ ...)، ثُمَّ قَالَ
أَتَدْرُونَ مَا الْكَوْثَرُ؟ فَقُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ:
فَإِنَّهُ نَهْرٌ وَعَدَنِيهِ (أعطانيه) رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْهِ خَيْرٌ
كَثِيرٌ هُوَ حَوْضٌ تَرِدُ عَلَيْهِ أُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ آنِيَتُهُ
عَدَدُ النُّجُومِ فَيُخْتَلَجُ الْعَبْدُ مِنْهُمْ فَأَقُولُ رَبِّ إِنَّهُ مِنْ
أُمَّتِي فَيَقُولُ مَا تَدْرِي مَا أَحْدَثَتْ (أحدث) بَعْدَكَ
‘‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের মাঝে ছিলেন। তিনি একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হন। এরপর তিনি হাসিমুখে মাথা উঠান। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি হাসছেন কেন? তিনি বলেন, এখন আমার উপরে একটি সূরা নাযিল করা হলো। অতঃপর তিনি সূরা কাউসার পাঠ করেন। তিনি বলেন, তোমরা কি জান কাউসার কী? আমরা বললাম: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। তিনি বলেন: কাউসার হলো একটি নদী যা মহান আল্লাহ আমাকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন (অন্য বর্ণনায়: যা তিনি আমাকে প্রদান করেছেন)। তাতে রয়েছে অনেক কল্যাণ। এ হলো হাউয, যেখানে আমার উম্মাত কিয়ামাতের দিন আমার নিকট আগমন করবে। তার পানপাত্রগুলো তারকারাজির ন্যায়। কোনো কোনো বান্দাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক, এ তো আমার উম্মাতের একজন। তখন তিনি বলবেন, আপনি জানেন না, আপনার পরে এরা কি নব-উদ্ভাবন করেছিল।’’[3]
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
إِنَّ حَوْضِي أَبْعَدُ مِنْ أَيْلَةَ مِنْ عَدَنٍ لَهُوَ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنْ
الثَّلْجِ وَأَحْلَى مِنْ الْعَسَلِ بِاللَّبَنِ وَلآنِيَتُهُ أَكْثَرُ مِنْ
عَدَدِ النُّجُومِ وَإِنِّي لأَصُدُّ النَّاسَ عَنْهُ كَمَا يَصُدُّ الرَّجُلُ
إِبِلَ النَّاسِ عَنْ حَوْضِهِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَتَعْرِفُنَا
يَوْمَئِذٍ قَالَ نَعَمْ لَكُمْ سِيمَا لَيْسَتْ لأَحَدٍ مِنْ الأُمَمِ تَرِدُونَ
عَلَيَّ غُرًّا مُحَجَّلِينَ مِنْ أَثَرِ الْوُضُوءِ
‘‘আদান (ইয়ামান) থেকে আইলা (ফিলিস্তিন)-এর যে দূরত্ব তার চেয়ে বেশি প্রশস্ততা আমার হাউযের। তার পানি বরফের চেয়েও বেশি শুভ্র এবং মধু মিশ্রিত দুগ্ধের চেয়েও বেশি মিষ্ট। তার পানপাত্রগুলি সংখ্যা আকাশের তারকারাজির চেয়েও বেশি। একজন মানুষ যেমন তার হাউয থেকে অন্য মানুষদের উট ঠেকিয়ে রাখে আমি তেমন ভাবে আমার উম্মাত ছাড়া অন্য মানুষদের সেভাবে ঠেকিয়ে রাখব। সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আমাদেরকে চিনবেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তোমাদের এমন একটি চিহ্ন রয়েছে যা অন্য কোনো উম্মাতের নেই, তোমরা আমার নিকট যখন আগমন করবে তখন ওযুর কারণে তোমাদের ওযুর অঙ্গগুলি শুভ্রতায় উদ্ভাসিত থাকবে।’’[4]
সাহল ইবন সা’দ (রা) ও অন্যান্য সাহাবী বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
إِنِّي فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ مَنْ مَرَّ عَلَيَّ شَرِبَ وَمَنْ شَرِبَ لَمْ
يَظْمَأْ أَبَدًا لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُونِي
ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ، فَأَقُولُ: إِنَّهُمْ مِنِّي فَيُقَالُ
إِنَّكَ لا تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ (في رواية: إِنَّكَ لا تَدْرِي مَا
عَمِلُوا بَعْدَكَ)، فَأَقُولُ سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِي.
‘‘আমি তোমাদের আগে হাউযে গিয়ে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। যে আমার কাছে যাবে সে (হাউয) থেকে পান করবে, আর যে পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। অনেক মানুষ আমার কাছে (হাউযে পানি পানের জন্য) আসবে, যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেওয়া হবে না, বাধা দেওয়া হবে। আমি বলব: এরা তো আমারই উম্মত। তখন উত্তরে বলা হবে : আপনি জানেন না, এরা আপনার পরে কী-সব নব উদ্ভাবন করেছিল। (দ্বিতীয় বর্ণনায় : আপনার পরে তারা কী আমল করেছে তা আপনি জানেন না।) তখন আমি বলব: যারা আমার পরে (আমার দ্বীনকে) পরিবর্তিত করেছে তারা দূর হয়ে যাক, তারা দূর হয়ে যাক!’’[5]
আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
إِنَّ قَدْرَ حَوْضِي كَمَا بَيْنَ أَيْلَةَ وَصَنْعَاءَ مِنْ الْيَمَنِ وَإِنَّ
فِيهِ مِنْ الأَبَارِيقِ كَعَدَدِ نُجُومِ السَّمَاءِ
‘‘ফিলিস্তিন থেকে ইয়ামানের সান‘আ পর্যন্ত যে দূরত্ব আমার হাউযের পরিমাণ তদ্রূপ। তথায় পানপাত্রের সংখ্যা আকাশের তারকারাজির ন্যায়।’’[6]
আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
حَوْضِي مَسِيرَةُ شَهْرٍ وَزَوَايَاهُ سَوَاءٌ وَمَاؤُهُ أَبْيَضُ مِنْ الْوَرِقِ
(مِنْ اللَّبَنِ) وَرِيحُهُ أَطْيَبُ مِنْ الْمِسْكِ وَكِيزَانُهُ كَنُجُومِ
السَّمَاءِ فَمَنْ شَرِبَ مِنْهُ فَلا يَظْمَأُ بَعْدَهُ أَبَدًا
‘‘আমার হাউযের প্রশস্ততা একমাসের পথ। এর সকল কোণ সমান। এর পানি দুধের (অন্য বর্ণনায় রৌপ্যের) চেয়েও শুভ্র এবং মেশকের চেয়েও অধিক সুগন্ধ। তার পানপাত্রের সংখ্যা আকাশের তারকারাজির ন্যায়। যে ব্যক্তি এ থেকে পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না।’’[7]
কুরআন ও হাদীসের এ সকল নির্দেশনার ভিত্তিতে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাউয সত্য’’। এ প্রসঙ্গে ইমাম তাহাবী বলেন:
وَالْحَوْضُ الَّذِيْ أَكْرَمَهُ اللهُ تَعَالَى بِهِ غِيَاثاً لأُمَّتِهِ حَقٌّ.
... وَالشَّفَاعَةُ الَّتِيْ ادَّخَرَهَا لَهُمْ حَقٌّ، كَمَا رُوِيَ فِيْ
الأَخْبَارِ.
হাউয (হাউয কাউসার) সত্য। মহান আল্লাহ যদ্বারা তাঁর নবীকে সম্মানিত করেছেন, উম্মতের পিপাসা নিবারণার্থে তিনি তাঁকে তা দান করেছেন। ... নবী ﷺ এর শাফাআত সত্য। তিনি তা আপন উম্মতের জন্য সংরক্ষিত করে রেখেছেন। হাদীসে এর বিশদ বর্ণনা এসেছে।’’[8]
[1] সূরা (১০৮) কাউসার: ১ আয়াত।
[2] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ২২৭।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩০০ (কিতাবুস সালাত, বাবু হুজ্জাতি মান কালাল বাসমালাতু আয়াত)।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১৭ (কিতাবুত তাহারাহ, বাবু ইসতিহবাবি ইতালাতিল গুর্রাহ)
[5] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৪০৬ (কিতাবুর রিকাক, বাবুন ফিল হাউয)।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৪০৫ (কিতাবুর রিকাক, বাবুন ফিল হাউয); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৮০০ (কিতাবুল ফাদাইল, বাবু ইসবাতি হাউযি নাবিয়্যিনা ﷺ)।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৪০৫ (কিতাবুর রিকাক, বাবুন ফিল হাউয); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩ (কিতাবুল ফাদাইল, বাবু ইসবাতি হাউযি নাবিয়্যিনা ﷺ)।
[8] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১১।
১৩. জান্নাত ও জাহান্নাম
এরপর আখিরাত বিষয়ক আকীদা প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘জান্নাত ও জাহান্নাম বর্তমানে সৃষ্ট অবস্থায় রয়েছে (পূর্বেই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।) জান্নাত ও জাহান্নাম কখনোই বিলুপ্ত হবে না। আয়তলোচনা হূরগণ কখনোই মৃত্যুবরণ করবে না। মহান আল্লাহর অনন্ত-চিরস্থায়ী শাস্তি ও পুরস্কার কখনোই বিলুপ্ত হবে না।’’
জান্নাত শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘‘বাগান’’। আখিরাতে নেককার মুমিনগণের জন্য যে মহা-নিয়ামতপূর্ণ আবাসস্থল আল্লাহ তৈরি করে রেখেছেন তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘‘জান্নাত’’ বলা হয়। জান্নাতের বিভিন্ন স্তর, পর্যায় ও নাম রয়েছে। ফার্সী ভাষায় জান্নাতকে ‘‘বেহেশত’’ বলা হয়, যা বাংলা ভাষায় বহুল-ব্যবহৃত।
জাহান্নাম শব্দের মূল অর্থ ‘‘গভীরগর্ত কূপ’’। মহান আল্লাহ আখিরাতে অবিশ্বাসী ও পাপীদের শাস্তির জন্য যে অগ্নিময় আবাস তৈরি করেছেন তাকে কুরআন-হাদীসে ‘‘জাহান্নাম’’ বলা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ইমাম আযম (রাহ) আরবীতে ‘‘জাহান্নাম’’ শব্দটি ব্যবহার করেন নি। তিনি (النار) বা অগ্নি শব্দ ব্যবহার করেছেন। জাহান্নামকে কুরআন ও হাদীসে অনেক সময় ‘‘নার’’ ব ‘‘অগ্নি’’ (নরক) বলা হয়েছে। বাংলায় ‘‘অগ্নি’’ বা ‘‘নার’’ বললে অনেকেরই বুঝতে অসুবিধা বলে আমরা সুপরিচিত ‘জাহান্নাম’ শব্দ বা ফারসী ‘দোযখ’ শব্দ ব্যবহার করেছি।
আখিরাতে বিশ্বাসের মূল বিষয় জান্নাত ও জাহান্নামের বিশ্বাস। শেষ বিচারের পরে বান্দারা জান্নাত বা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। জান্নাতীগণ অনন্তকাল জান্নাতে অবস্থান করবেন এবং আল্লাহর নিয়ামত ভোগ করবেন। জাহান্নামীগণের মধ্যে যারা মুমিন তারা এক পর্যায়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। জাহান্নামের অবশিষ্ট বাসিন্দারা অনন্তকাল জাহান্নামে অবস্থান ও শাস্তিভোগ করবেন।
কুরআন ও হাদীসে উভয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো সকল মুমিনের জানা। তবে কিছু বিভ্রান্ত সম্প্রদায় এ বিষয়েও নানাবিধ বিভ্রান্তি প্রচার করেছে। উদ্ভট যুক্তি বা বিজ্ঞানের নামে তারা জান্নাত ও জাহান্নাম বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যগুলো ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থের নামে বাতিল করেছে। তাদের বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর দাবির অন্যতম: (১) জান্নাত ও জাহান্নাম কিয়ামাতে সৃষ্টি করা হবে, বর্তমানে তা বিদ্যমান নয় এবং (২) জান্নাত ও জাহান্নাম অনন্তকালস্থায়ী নয়, বরং সেগুলো এক সময় বিলীন হয়ে যাবে।
যেহেতু তাদের এ সকল বক্তব্য কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী এজন্য ইমাম আবূ হানীফা সেগুলো খন্ডন করে উপরের কথাগুলো বলেছেন। তিনি দুটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন: (১) জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্ট অবস্থায় বিদ্যমান এবং (২) উভয়টিই অনন্তকাল স্থায়ী। কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য বিষয়দুটি প্রমাণ করে। মহান আল্লাহ আদমকে সৃষ্টির পর তাঁকে বলেন:
يَا آَدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ
‘‘হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর।’’[1]
কুরআনের ব্যবহার ও আরবী ব্যাকরণ নিশ্চিত করে যে, এখানে জান্নাত বলতে সুপরিচিত জান্নাতকেই বুঝানো হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, আদম সৃষ্টির পূর্বেই জান্নাত সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ
‘‘এবং তোমরা ভয় কর আগুনকে যা কাফিরদের জন্য প্রস্ত্ততকৃত।’’[2]
وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ
وَالأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
‘‘এবং দ্রুত ধাবিত হও তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষের মাগফিরাতের দিকে এবং জান্নাতের দিকে যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীগণের জন্য প্রস্ত্ততকৃত হয়েছে।’’[3]
এ অর্থে আরো আয়াত বিদ্যমান। এগুলো প্রমাণ করে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম পূর্ব থেকেই প্রস্ত্ততকৃত ও সৃষ্ট। মিরাজ বিষয়ক হাদীসগুলো ও অন্যান্য অনেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন, তাঁর সামনে সেগুলোকে পেশ করা হয়েছে, তিনি সেগুলোর মধ্যকার অনেক নিয়ামত ও শাস্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। এ অর্থের হাদীসগুলি মুতাওয়াতির বা বহু সাহাবী থেকে বহু সনদে বর্ণিত।
অনুরূপভাবে কুরআনে বারবার বলা হয়েছে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম অনন্তকাল স্থায়ী থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي
مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا
‘‘আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, অচিরেই আমি তাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতসমূহে, যেগুলির তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ, সেখানে তারা চিরস্থায়ী থাকবে অনন্তকাল।’’[4]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ
فِيهَا أَبَدًا
‘‘আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন, তথায় তারা চিরস্থায়ী থাকবে অনন্তকাল।’’[5]
এ ছাড়া আরো অনেক আয়াতে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসীগণ কখনোই সেখান থেকে বহিস্কৃত হবেন না, কখনোই মৃত্যু তাদেরকে স্পর্শ করবে না, জান্নাতের নিয়ামত কখনোই কর্তিত বা শেষ হবে না, জাহান্নামের শাস্তিও শেষ হবে না। অগণিত হাদীসেও এ কথা বলা হয়েছে।
[1] সূরা (২) বাকারা: ৩৫ আয়াত ও সূরা (৭) আরাফ: ১৯ আয়াত।
[2] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৩১ আয়াত।
[3] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৩৩ আয়াত।
[4] সূরা (৪) নিসা: ৫৭ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৪) নিসা: ১২২ আয়াত; সূরা (৫) মায়িদা ১১৯ আয়াত; সূরা (৯) তাওবা: ২২ ও ১০০ আয়াত; সূরা (৬৪) তাগাবুন: ৯ আয়াত; সূরা (৬৫) তালাক: ১১ আয়াত; সূরা (৯৮) বাইয়িনা: ৮ আয়াত।
[5] সূরা (৭২) জিন্ন: ২৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৩) নিসা: ১৬৮-১৬৯ আয়াত; সূরা (৩৩) আহযাব: ৬৪-৬৬ আয়াত।
No comments