হাদীসের নামে জালিয়াতি -বিংশ অধ্যায় - হিজরত, মি’রাজ, ওফাত ইত্যাদি বিষয়ক জাল হাদীস
২২. সাওর গুহায় আবূ বাকর (রা)-কে সাপে কামড়ানো
১৩শ শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত বলেন,
مَا
يُذْكَرُ فِيْ السِّيَرِ مِنْ نَبَاتِ شَجَرَةٍ عِنْدَ فَمِ الْغَارِ وَقْتَ
هِجْرَتِهِ ﷺ وَأَنَّهُ فُتِحَ بَابٌ فِيْ ظَهْرِ الْغَارِ وَظَهَرَ عِنْدَهُ
نَهْرٌ وَأَنَّ الْحَيَّةَ لَدَغَتْ أَبَا بَكْرٍ فِيْ الْغَارِ- بَاطِلٌ لاَ
أَصْلَ لَهُ
‘‘সীরাতুন্নবী লেখকগণ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হিজরতের সময়ে গুহার মুখে গাছ জন্মেছিল, গুহার পিছনে দরজা প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেখানে একটি নদী দেখা গিয়েছিল, এবং গুহার মধ্যে আবূ বাকরকে (রা) সাপে কামড় দিয়েছিল- এগুলো সবই বাতিল কথা, যার কোনো ভিত্তি নেই।’’[1]
বস্ত্তত গুহার পিছনে দরজা প্রকাশ হওয়া, নদী দেখতে পাওয়া ইত্যাদি বিষয় একেবারেই ভিত্তিহীন ও সনদবিহীন গল্প বলে প্রতীয়মান। আর গুহার মুখে গাছ জন্মানো, মাকড়াসার জাল বোনা, কবুতরের বাসা বানানো এবং আবূ বাকর (রা)-কে সাপে কামড়ানো বিষয়ে কিছু হাদীস সনদ-সহ বর্ণিত।
(ক) আবূ বাকরকে সাপে কামড়ানোর কাহিনীটি ইমাম বাইহাকী দালাইলুন নুবুওয়াত গ্রন্থে সংকলন করেছেন। এ হাদীসের সারমর্ম যে, আবূ বাকর (রা) সাওর গুহায় প্রবেশের পর আবূ বাকর (রা) দেখেন যে সেখানে ফাটল বা গর্ত রয়েছে। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিরাপত্তার জন্য ফাটলটির মুখে নিজের পা রাখেন। তখন ফাটলের মধ্যে অবস্থানরত সাপ তাঁকে দংশন করে এবং বেদনায় তাঁর চক্ষু দিয়ে অশ্রু পড়তে থাকে। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বলেন: তুমি ব্যথিত হয়ো না; আল্লাহ তো আমাদের সাথে। এ কথার পর আল্লাহ আবূ বাকর (রা)-এর উপর প্রশান্তি নাযিল করেন।
বাইহাকী বর্ণিত হাদীসে এতটুকুই বলা হয়েছে, যদিও আমাদের সমাজে এ গল্পের সাথে অনেক কিছু সংযুক্ত হয়েছে। ইমাম যাহাবী ও ইমাম ইবন হাজার আসকালানী হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন। হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী আব্দুর রাহমান ইবনু ইবরাহীম রাসিবী জালিয়াত বলে গণ্য। তাঁর উস্তাদ ফুরাত ইবনুস সায়িবও অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী।[2]
(খ) গুহার মুখের গাছ, মাকড়াসার জাল ও কবুতরের বাসা বিষয়ে মুসনাদ আহমাদ, তাবাকাত ইবন সা’দ, বাইহাকীর দালাইলুন নুবুওয়াত ও অন্যান্য গ্রন্থে অত্যন্ত দুর্বল সনদে কয়েকটি হাদীস সংকলিত। অনেক মুহাদ্দিস পুরো বিষয়টিকেই ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। মাকড়াসার জাল বিষয়ক একটি হাদীসকে ইবন কাসীর ও ইবন হাজার হাসান বলে গণ্য করেছেন।[3]
[1] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৮৬।
[2] বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াত ২/৪৭৬-৪৭৭; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ২/৪৫৪, ৪/৫০৩-৫০৪; ইবন হাজার, লিসানুল মীযান ৪/৩৯৭, ৬/৯-১০।
[3] ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/১৮১, ২২২-২২৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/২৭; ইবন হাজার, ফাতহুল বারী ৭/২৭৮; আলবানী, যায়ীফাহ ৩/২৫৯-২৬৪; ৩৩৭-৩৩৯।
২৩. মি’রাজের রাত্রিতে পাদুকা পায়ে আরশে আরোহণ
সমাজে অতি প্রসিদ্ধ কথা যে, মি’রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জুতা পায়ে আরশে আরোহণ করেছিলেন। কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট একটি কথা। মি’রাজের ঘটনা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ ৬টি হাদীস গ্রন্থ সহ সকল হাদীস গ্রন্থে প্রায় অর্ধ শত সাহাবী থেকে বিভিন্নভাবে মি’রাজের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সিহাহ সিত্তার এ বিষয়ক হাদীসগুলো আমি ভালভাবে পড়ার চেষ্টা করেছি। এছাড়া মুসনাদ আহমাদসহ প্রচলিত আরো ১৫/১৬টি হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীসগুলো পাঠ করার চেষ্টা করেছি। কুরআনে এবং এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমনের কথা বারংবার বলা হয়েছে। তিনি সিদরাতুল মুনতাহার ঊর্ধ্বে বা আরশে গমন করেছেন বলে কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। রাসূলুল্লাহ ﷺ জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে মি’রাজে গমন করেন এবং সিদরাতুল মুনতাহার সর্বোচ্চ মাকামে আল্লাহর সান্নিধ্য বা ‘দীদার’ লাভ করেন বলে এ সকল হাদীস প্রমাণ করে।
রাফরাফে চড়া, আরশে গমন করা ইত্যাদি কথা সিহাহ সিত্তা, মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস-গ্রন্থে সংকলিত কোনো হাদীসে নেই। ৫/৬ শতাব্দী পর্যন্ত সংকলিত ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থগুলোতেও এ বিয়য়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। দশম হিজরী শতাব্দী ও পরবর্তী যুগে সংকলিত সীরাতুন্নবী বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থে মি’রাজের বিষয়ে রাফরাফ-এ আরোহণ, আরশে গমন ইত্যাদি ঘটনা বলা হয়েছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবীর আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি, যে সকল হাদীস কোনো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায় না, বরং ৫ম হিজরী শতকে বা তার পরে কোনো কোনো মুহাদ্দিস বা বিষয়ভিত্তিক লেখক তা সংকলন করেছেন, সেগুলো সাধারণত বাতিল বা অত্যন্ত দুর্বল সনদের হাদীস। বিশেষত ১১শ-১২শ শতাব্দীর গ্রন্থাদিতে সহীহ, যয়ীফ ও মাউযূ সবকিছু একত্রে মিশ্রিত করে সংকলন করা হয়েছে।
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী (১১২২ হি) ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে আল্লামা রাযী কাযবীনীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:
لَمْ
يَرِدْ فِيْ حَدِيْثٍ صَحِيْحٍ وَلاَ حَسَنٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ جَاوَزَ
سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى، بَلْ ذُكِرَ فِيْهَا أَنَّهُ انْتَهَى إِلَى مُسْتَوًى
سَمِعَ فِيْهِ صَرِيْفَ الأَقْلاَمِ فَقَطْ. وَمَنْ ذَكَرَ أَنَّهُ جَاوَزَ ذَلِكَ
فَعَلَيْهِ الْبَيَانُ، وَأَنَّى لَهُ بِهِ! وَلَمْ يَرِدْ فِيْ خَبَرٍ ثَابِتٍ
وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ رَقِىَ الْعَرْشَ. وَافْتِرَاءُ بَعْضِهِمْ لاَ يُلْتَفَتُ
إِلَيْهِ.
‘‘কোনো একটি সহীহ, হাসান অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন। বরং বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তথায় এমন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন যে, কলমের খসখস শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। যিনি দাবি করবেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন তাকে তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। আর কিভাবে তিনি তা করবেন! একটি সহীহ অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি আরশে আরোহণ করেছিলেন। কারো কারো মিথ্যাচারের প্রতি দৃকপাত নিষ্প্রয়োজন।’’[1]
সর্বাবস্থায় আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি জাল হাদীস:
لَمَّا
أُسْرِيَ بِهِ ﷺ لَيْلَةَ الْمِعْرَاجِ إِلَى السَّمَوَاتِ الْعُلَى وَوَصَلَ
إِلَى الْعَرْشِ الْمُعَلَّى أَرَادَ خَلْعَ نَعْلَيْهِ أَخْذاً مِنْ قَوْلِهِ
تَعَالَى لِسَيِّدِنَا مُوْسَى حِيْنَ كَلَّمَهُ: فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ إِنَّكَ
بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى. فَنُوْدِيَ مِنَ الْعَلِيِّ الأَعْلَى: يَا
مُحَمَّدُ! لاَ تَخْلَعْ نَعْلَيْكَ فَإِنَّ الْعَرْشَ يَتَشَرَّفُ بِقُدُوْمِكَ
مُتْنَعِلاً وَيَفْتَخِرُ عَلَى غَيْرِهِ مُتَبَرِّكاً، فَصَعِدَ النَّبِيُّ ﷺ إِلَى
الْعَرْشِ وَفِيْ قَدَمَيْهِ النَّعْلاَنِ...
‘‘মি’রাজের রাত্রিতে যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে উচ্চতম আকাশমন্ডলিতে নিয়ে যাওয়া হলো এবং আরশে মু‘আল্লায় পৌঁছালেন, তখন তিনি তাঁর পাদুকাদ্বয় খুলার ইচ্ছা করেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা মূসাকে (আ) বলেছিলেন: ‘‘তুমি তোমার পাদুকা খোল; তুমি পবিত্র ‘তুয়া’ প্রান্তরে রয়েছ।’’[2] তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান করে বলা হয়, হে মুহাম্মাদ, আপনি আপনার পাদুকাদ্বয় খুলবেন না। কারণ আপনার পাদুকাসহ আগমনে আরশ সৌভাগ্যমন্ডিত হবে এবং অন্যদের উপরে বরকতের অহংকার করবে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাদুকাদ্বয় পায়ে রেখেই আরশে আরোহণ করেন।’’
এ কাহিনীর আগাগোড়া সবটুকুই বানোয়াট। এ কাহিনীর উৎপত্তি ও প্রচারের পর থেকে মুহাদ্দিসগণ বলছেন যে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসও এ সকল মিথ্যা কথা নির্বিচারে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলেন। এ সকল কথা তাঁরা কোন্ হাদীস গ্রন্থে পেয়েছেন তাও বলেন না, খুঁজেও দেখেন না, আবার যারা খুঁজে দেখে এগুলোর জালিয়াতির কথা বলেছেন তাঁদের কথাও পড়েন না বা শুনতে চান না। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন।[3]
আল্লামা রাযিউদ্দীন কাযবীনী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মাক্কারী, যারকানী, আব্দুল হাই লাখনবী, দরবেশ হূত প্রমুখ মুহাদ্দিস এ কাহিনীর জালিয়াতি ও মিথ্যাচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী এ প্রসঙ্গে বলেন: ‘‘এ ঘটনা যে জালিয়াত বানিয়েছে আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মি’রাজের ঘটনায় বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি। এত হাদীসের একটি হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মি’রাজের সময় পাদুকা পরে ছিলেন। এমনকি একথাও প্রমাণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরশে আরোহণ করেছিলেন।’’[4]
[1] যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩।
[2] সূরা (২০) তাহা: আয়াত ১২।
[3] যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৭; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ৫৩০।
[4] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৭।
২৪. মি’রাজের রাত্রিতে ‘আত-তাহিয়্যাতু’ লাভ
আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি কথা হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মি’রাজের রাত্রিতে ‘আত-তাহিয়্যাতু’ লাভ করেন। এ বিষয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটির সার-সংক্ষেপ হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মি’রাজের রাত্রিতে যখন সর্বোচ্চ নৈকট্যে পৌছান তখন মহান আল্লাহকে সম্ভাষণ করে বলেন: (আত-তাহিয়্যাতু লিল্লাহি...)। তখন মহান আল্লাহ বলেন, (আস-সালামু আলাইকা...)। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চান যে তাঁর উম্মতের জন্যও সালামের অংশ থাক। এজন্য তিনি বলেন (আস-সালামু আলাইনা ওয়া...)। তখন জিবারাঈল ও সকল আকাশবাসী বলেন: (আশহাদু...)। কোনো কোনো গল্পকার বলেন: (আস-সালামু আলাইনা...) বাক্যটি ফিরিশতাগণ বলেন...।
এ গল্পটির কোনো ভিত্তি আছে বলে জানা যায় না। কোথাও কোনো গ্রন্থে সনদসহ এ কাহিনীটি বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় নি। মি’রাজের ঘটনা বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে ও সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কোনো সনদ-সহ বর্ণনায় মি’রাজের ঘটনায় এ কাহিনীটি বলা হয়েছে বলে আমি দেখতে পাই নি। সনদ বিহীনভাবে কেউ কেউ তা উল্লেখ করেছেন।[1]
বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে, সাহাবীগণ সালাতের শেষে বৈঠকে সালাম পাঠ করতেন। আল্লাহকে সালাম, নবীকে সালাম, জিবরাঈলকে সালাম...। তখন তিনি তাঁদেরকে বলেন, এভাবে না বলে তোমরা ‘আত-তাহিয়্যাতু...’’ বলবে।[2] সকল হাদীসেই এইরূপ বলা হয়েছে। কোনো হাদীসেই বলা হয় নি যে, ‘আত-তাহিয়্যাতু’ মি’রাজ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে
[1] কুরতুবী, তাফসীর ৩/৪২৫।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৮৭; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩০১।
২৫. মুহূর্তের মধ্যে মি’রাজের সকল ঘটনা সংঘটিত হওয়া
প্রচলিত একটি কথা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মি’রাজের সকল ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে সংঘটিত হয়ে যায়। তিনি সকল ঘটনার পর ফিরে এসে দেখেন পানি গড়ছে, শিকল নড়ছে, বিছানা তখনো গরম রয়েছে... মি’রাজে ২৭ বৎসর অতিবাহিত হয় ... ইত্যাদি। এ সকল কথা ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান।
আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, সিহাহ সিত্তাহ-সহ প্রায় ২০ খানা হাদীস গ্রন্থের মি’রাজ বিষয়ক হাদীসগুলো আমি অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছি। অধিকাংশ হাদীসে মি’রাজে ভ্রমণ, দর্শন ইত্যাদি সবকিছু সমাপ্ত হতে কত সময় লেগেছিল সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ করা হয় নি। তাবারানী সংকলিত একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
ثُمَّ
أَتَيْتُ أَصْحَابِيْ قَبْلَ الصُّبْحِ بِمَكَّةَ فَأَتَانِيْ أَبُوْ بَكْرٍ
فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَيْنَ كُنْتَ اللَّيْلَةَ فَقَدِ الْتَمَسْتُكَ فِيْ
مَكَانِكَ فَلَمْ أَجِدْكَ
‘‘অতঃপর প্রভাতের পূর্বে আমি মক্কায় আমার সাহাবীদের কাছে ফিরে আসলাম। তখন আবূ বাক্র আমার কাছে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি গত রাতে কোথায় ছিলেন? আমি আপনার স্থানে আপনাকে খুঁজেছিলাম, কিন্তু আপনাকে পাই নি।... তখন তিনি মি’রাজের ঘটনা বলেন।’’[1]
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রথম রাতে মি’রাজে গমন করনে এবং শেষ রাতে ফিরে আসেন। সারা রাত তিনি মক্কায় অনুপস্থিত ছিলেন। এরূপ আরো দু একটি হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, মি’রাজের ঘটনায় রাসুলুল্লাহ (ﷺ) রাতের কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েছিলেন। [2]
মি’রাজের ঘটনায় কত সময় লেগেছিল তা কোনো গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় নয়। এ মহান অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ সময় ছাড়া বা অল্প সময়ে যে কোনো ভাবে তাঁর মহান নবীর (ﷺ) জন্য সম্পাদন করতে পারেন। কিন্তু আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, হাদীসে যা বর্ণিত হয় নি তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে না বলা। তিনি ফিরে এসে দেখেন পানি গড়াচ্ছে, শিকল নড়ছে, বিছানা তখনো গরম রয়েছে ইত্যাদি কথা কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় না। মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত (১২৭৬ হি) বলেন:
ذَهَابُهُ
وَرُجُوْعُهُ لَيْلَةَ الإِسْرَاءِ وَلَمْ يَبْرُدْ فِرَاشُهُ، لَمْ يَثْبُتْ
ذَلِكَ.
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিরাজের রাত্রিতে গমন করেন এবং ফিরে আসেন কিন্তু তখনো তার বিছান ঠান্ডা হয় নি, এ কথাটি প্রমাণিত নয়।’’[3]
[1] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৭৩-৭৪। হাদীসটির সনদের একজন রাবীকে কেউ কেউ নির্ভরযোগ্য বলেছেন এবং কেউ কেউ দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।
[2] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৭৫-৭৬; ইবনু হাজার, আল-মাতালিব ৪/৩৮৯-৩৮১।
[3] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ১১২।
২৬. মি’রাজ অস্বীকারকারীর মহিলায় রূপান্তরিত হওয়া
আমাদের দেশে প্রচলিত একটি বানোয়াট কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, মি’রাজের রাত্রিতে মুহূর্তের মধ্যে এত ঘটনা ঘটেছিল বলে মানতে পারে নি এক ব্যক্তি। ঐ ব্যক্তি একটি মাছ ক্রয় করে তার স্ত্রীকে প্রদান করে নদীতে গোসল করতে যায়। পানিতে ডুব দেয়ার পরে সে মহিলায় রূপান্তরিত হয়। একজন সওদাগর তাকে নৌকায় তুলে নিয়ে বিবাহ করেন.... অনেক বছর পরে আবার ঐ মহিলা পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে দেখেন যে, তার স্ত্রী তখন মাছটি কাটছেন...। এগুলো সবই মিথ্যা কাহিনী।
২৭. হরিণীর কথা বলা বা সালাম দেওয়া
প্রচলিত গল্পে বলা হয়: একটি হরিণী রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সালাম দেয়, তাঁর সাথে কথা বলে, অথবা শিকারীর কাছ থেকে তার নাম বলে ছুটি নেয় .... ইত্যাদি। এসকল কথার কোনো নির্ভরযোগ্য ভিত্তি পাওয়া যায় না।[1]
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ১৭০; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৯৫; আল-মাসনূ, পৃ. ৫১-৫২; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ৮৬, ২৮৮।
২৮. হাসান-হুসাইনের ক্ষুধা ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রহৃত হওয়া
হাসান-হুসাইনের অভুক্ত থেকে ক্রন্দন, ফাতেমা (রা) ও আলীর কষ্ট, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক ইহূদীর বাড়িতে কাজ করা, ইহূদী কতৃক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আঘাত করা ....ইত্যাদি আমাদের দেশের অতি প্রচলিত ওয়ায ও গল্প। এ সকল কাহিনী সবই বানোয়াট। এগুলোর কোনো ভিত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। মদীনার রাষ্ট্রপতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কারো বাড়িতে শ্রম বিক্রয় করতে গিয়েছেন বলে বর্ণিত হয় নি। এছাড়া হাসান ও হুসাইন (রা) ৩ ও ৪ হি. সালে জন্মগ্রহণ করেন। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ৪ হি. সালে বনূ নযীর ও ৫ হি. সালে বনূ কুরাইযার ইহূদীদেরকে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কারণে মদীনা থেকে বিতাড়িত করেন। কাজেই ইমামদ্বয়ের কথা বলার বয়স হওয়ার অনেক আগেই মদীনা ইহূদী মুক্ত হয়েছিল।
২৯. জাবিরের (রা) সন্তানদের জীবিত করা
প্রচলিত একটি গল্পে বলা হয়, জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দাওয়াত দেন। ইত্যবসরে জাবিরের এক পুত্র আরেক পুত্রকে জবাই করে। এরপর সে ভয়ে পালাতে যেয়ে চুলার মধ্যে পড়ে পুড়ে মারা যায়। জাবির (রা)-এর স্ত্রী এ সকল বিষয় গোপন রেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর মেহমানদারী করেন। ... এরপর মৃত পুত্রদ্বয়কে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করেন। ... রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দোয়ায় তারা জীবিত হয়ে ওঠে।... পুরো কাহিনীটি আগাগোড়াই বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।[1]
[1] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৮২; মুহাম্মাদ ইবনুল বাশীর, তাহযীর, পৃ. ৭৫।
৩০. বিলালের জারি
প্রচলিত বিলালের জারির সকল কথাই বানোয়াট।
৩১. উসমান ও কুলসূমের (রা) দাওয়াত সংক্রান্ত জারি
এ বিষয়ক প্রচলিত জারিতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা।
৩২. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছায়া না থাকা প্রসঙ্গ
সমকালীন মুসলিম সমাজের দীনদার মুসলিমদের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ বিশ্বাস যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো ছায়া ছিল না। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ৫০০ বৎসরে লিখিত হাদীস, তাফসীর, সীরাতুন্নবী, দালাইলুন নুবুওয়াত ইত্যাদি কোনো গ্রন্থে এ বিষয়টির কোনোরূপ উল্লেখ পাওয়া যায় না। ষষ্ঠ হিজরী শতক থেকে কোনো কোনো আলিম বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। মরক্কো ও স্পেনের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা কাযী ইয়ায ইবন মূসা ইয়াহসূবী সাবতী (৫৪৪ হি) ‘আশ শিফা বিতা’রীফি হুকুকিল মুসতাফা ﷺ’ নামক গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মু’জিযা, বৈশিষ্ট্য ও অলৌকিকত্ব বিষয়ক আলোচনায় বলেন:
وما
ذكر من أنه كان لا ظل شخصه في شمس ولا قمر لأنه كان نورا
‘‘কথিত আছে যে, সূর্যের আলোয় বা চাঁদের আলোয় তাঁর দেহের কোনো ছায়া ছিল না; কারণ তিনি নূর ছিলেন।’’[1]
এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লামা কাযী ইয়ায এ কথিত বক্তব্যটির কোনো সনদ বা অন্তত গ্রন্থসূত্র প্রদান করেন নি। এ গ্রন্থটির বিষয়ে মরোক্কোর অধিবাসী বিগত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও সূফী আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন জা’ফর কাত্তানী হাসানী (১৩৪৫ হি) বলেন:
وكتاب
(الشفا ... لأبي الفضل عياض... وفيه أحاديث ضعيفة, وأخرى قيل فيها: إِنها موضوعة،
تبع فيها ((شفاء الصدور)) (للخطيب أبي الربيع سليمان بن سبع السبتي)
‘‘কাযী ইয়াযের ‘আশ-শিফা’ গ্রন্থটি.. এতে যয়ীফ হাদীসাদি বিদ্যমান। এছাড়া আরো হাদীস বিদ্যমান যেগুলোকে জাল বলা হয়েছে। এগুলোতে (যয়ীফ-জাল হাদীস নির্ভরতায়) তাঁর অনুসরণ করেছেন খতীব আবুর রাবী সুলাইমান ইবন সাবু’ সাবতী তাঁর রচিত ‘‘শিফাউস সুদূর’’ নামক গ্রন্থে।’’[2]
সুলাইমান ইবন সাবু’ কাযী ইয়াযের ছাত্র প্রজন্মের আলিম ছিলেন। তাঁর দৌহিত্র মুহাম্মাদ ইবন হাসান ইবন আতিয়্যাহ ৫৯১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।[3] এতে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ষষ্ঠ হিজরী শতকের মাঝামাঝি মৃত্যুবরণ করেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
إن
ظله ﷺ كان لا يقع على الأرض وإنه كان نورا وكان إذا مشى في الشمس
أو القمر لا يظهر له ظل.
‘‘তাঁর ছায়া মাটিতে পড়ত না, তিনি নূর ছিলেন, সূর্যের বা চাঁদের আলোয় তিনি যখন হাঁটতেন তখন তাঁর কোনো ছায়া প্রকাশিত হতো না।’’[4]
আমরা দেখছি যে, তিনিও এ বক্তব্যের কোনো সনদ বা তথ্যসূত্র উল্লেখ করেন নি। তাঁর এ গ্রন্থের বিষয়ে ইমাম সাখাবী (৯০২ হি) বলেন:
في
مجلدات واختصره بعض الأئمة, وفيه مناكير كثيرة
‘‘গ্রন্থটি অনেকগুলি খন্ডে রচিত। পরবর্তী কোনো কোনো ইমাম তা সংক্ষেপ করেছেন। এতে অনেক আপত্তিকর-ভিত্তিহীন হাদীস বিদ্যমান।’’[5]
ষষ্ঠ হিজরী শতকের অন্য প্রসিদ্ধ আলিম ইমাম আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী (৫০৮-৫৯৭ হি)। তিনি ‘আল-ওয়াফা বিআহওয়ালিল মুসতাফা ﷺ’ নামক গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে একটি হাদীস উল্লেখ করে বলেন:
عن
ابن عباس y قال: لم يكن لرسول الله ﷺ ظل، ولم يقم مع شمس قط إلا غلب ضوؤه ضوء الشمس، ولم يقم مع
سراج قط إلا غلب ضوؤه السراج
‘‘ইবন আববাস (রা) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো ছায়া ছিল না। তিনি যখনই সূর্যের আলোয় দাঁড়াতেন তাঁর আলো সূর্যের আলোর উপর প্রাধান্য লাভ করত। আর যখনই তিনি প্রদীপের আলোয় দাঁড়াতেন তাঁর আলো প্রদীপের আলোর উপর প্রাধান্য লাভ করত।’’[6]
পরবর্তী যুগগুলিতে আলিমগণ এগুলোর সনদ ও সূত্র সন্ধান করেছেন। বিশেষত ইমাম সুয়ূতী (৯১১ হি) ও তাঁর ছাত্রগণ এ বিষয়ে প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। ইমাম সুয়ূতী রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এ সকল অলৌকিকত্ব সংকলনের জন্য দীর্ঘ ২০ বৎসর অক্লান্ত পরিশ্রম করে (খাসাইস কুবরা) গ্রন্থটি সংকলন করেন। এছাড়া তিনি ‘‘শিফা’’ গ্রন্থের হাদীসগুলির সূত্র বর্ণনায় গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বলেন:
أخرج
الحكيم الترمذي من طريق عبد الرحمن بن قيس الزعفراني عن عبد الملك بن عبد الله بن
الوليد عن ذكوان أن رسول اللهﷺ لم يكن يرى له ظل في شمس
ولا قمر...
‘‘(চতুর্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম মুহাম্মাদ ইবন আলী ইবনুল হাসান) হাকীম তিরমিযী (মৃত্যু ৩২০ হিজরীর দিকে) উদ্ধৃত করেছেন (দ্বিতীয় হিজরী শতকের রাবী) আব্দুর রাহমান ইবন কাইস যা‘আফরানী থেকে, তিনি আব্দুল মালিক ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল ওয়ালীদ থেকে, তিনি তাবিয়ী যাকওয়ান (মৃত্যু ১০১ হি) থেকে, তিনি বলেন: সূর্যের আলোতে বা চাঁদের আলোতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো ছায়া দেখা যেত না...।’’[7]
ইমাম সুয়ূতীর ছাত্র আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ইউসুফ শামী (৯৪২ হি)। তাঁর রচিত প্রসিদ্ধ সীরাতগ্রন্থ ‘সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ’। তিনি লিখেছেন যে, তিনি তিনশতাধিক গ্রন্থ অধ্যয়ন করে এ গ্রন্থটি রচনা করেছেন এবং এটি তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফসল। এ গ্রন্থে তিনি বলেন:
قال
ذكوان (رح) لم ير لرسول الله ﷺ ظل في شمس ولا قمر. رواه
الحكيم الترمذي. وقال: معناه لئلا يطأ عليه كافر فيكون مذلة له.
‘‘যাকওয়ান (রাহ) বলেন: সূর্যের বা চাঁদের আলোয় রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া দেখা যেত না। হাকীম তিরমিযী কথাটি সংকলন করেছেন। তিনি বলেছেন: এর অর্থ হলো; যেন কোনো কাফির তাঁর ছায়া পদদলিত করতে না পারে; কারণ এতে তাঁর অবমাননা হয়।’’[8]
দশম-একাদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী (১০১৪হি) কাযী ইয়াযের বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলেন:
ذكره
الحكيم الترمذي في نوادر الأصول عند عبد الرحمن بن قيس، وهو مطعون، عن عبد الملك
بن عبد الله بن الوليد، وهو مجهول، عن ذكوان
‘‘ছায়া না থাকার হাদীসটি হাকীম তিরমিযী ‘নাওয়াদিরুল উসূল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি আব্দুর রাহমান ইবন কাইস থেকে উদ্ধৃত করেছেন। আব্দুর রাহমান ইবন কাইস অভিযুক্ত রাবী। তিনি আব্দুল মালিক ইবনু আব্দুল্লাহ্ ইবনুল ওয়ালীদ থেকে, তিনি অজ্ঞাত পরিচয়। তিনি যাকওয়ান থেকে।’’[9]
মোল্লা আলী কারী অন্যত্র বলেন:
وَفِي
حَدِيثِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: لَمْ يَكُنْ لِرَسُولِ اللَّهِ ﷺ ظِلٌّ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ شَمْسٍ قَطُّ ...وَلَمْ يَقُمْ
مَعَ سِرَاجٍ قَطُّ إِلاَّ غَلَبَ ضَوْءُهُ ذَكَرَهُ ابْنُ الْجَوْزِيِّ...
‘‘ইবন আববাসের হাদীস: ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো ছায়া ছিল না। তিনি যখনই সূর্যের আলোয় ... প্রদীপের আলোয় দাঁড়াতেন তাঁর আলো ... প্রাধান্য লাভ করত।’ হাদীসটি ইবনুল জাওযী উল্লেখ করেছেন। ’’[10]
উল্লেখ্য যে, আল্লামা আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ কাসতালানী (৯২৩ হি), মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল বাকী যারকানী (১১২২ হি) ও অন্যান্য আলিমও ইবনুল জাওযী ও হাকীম তিরমিযীর সূত্র প্রদান করেছেন।[11] ইবনুল জাওযী উদ্ধৃত হাদীসটির সনদ তিনি নিজে বা অন্য কেউ উল্লেখ করেন নি। নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইমাম তাকিউদ্দীন আহমাদ ইবন আলী মাকরীযী (৮৪৫হি) এ হাদীসটির শুরুতে একটি সনদ উল্লেখ করে বলেন:
قال
أحمد بن عبد الله الغدافي أخبرنا عمرو بن أبي عمرو عن محمد بن السائب عن أبي صالح
عن ابن عباس y: لم يكن....
‘আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ গাদ্দাফী বলেন, আমাদেরকে (তাবিয়ী) আমর ইবন আবী আমর বলেন (১৫০ হি), তিনি (তাবি-তাবিয়ী) মুহাম্মাদ ইবনুস সায়িব (১৪৬ হি) থেকে, তিনি (তাবিয়ী) আবূ সালিহ বাযাম থেকে, তিনি ইবন আববাস থেকে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো ছায়া ছিল না...।’’[12]
আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ গাদ্দাফী নামের কোনো রাবীর পরিচয় জানতে পারি নি। আর ইমাম মাকরীযী এ সনদ কোথায় পেলেন তাও জানান নি।
এভাবে সুয়ূতী, হালাবী, শামী, আলী কারী প্রমুখের আজীবনের গবেষণা ও অনুসন্ধান থেকে আমরা নিম্নের তথ্যগুলি আমরা জানতে পারি:
(ক) চতুর্থ শতকে হাকীম তিরমিযীর পূর্বে কোনো মুহাদ্দিস কোনো হাদীসের গ্রন্থে এ হাদীস বা এ অর্থে অন্য কোনো হাদীস সংকলন করেন নি।
(খ) ইমাম সুয়ূতী তাঁর জামি কাবীরের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, যে সকল হাকীম তিরমিযী সংকলন করেছেন কিন্তু অন্য কোনো মুহাদ্দিসের গ্রন্থে পাওয়া যায় না সেগুলি সন্দেহাতীতভাবে অনির্ভরযোগ্য।[13] আমরা দেখেছি যে, মোল্লা আলী কারী, আবূ জাফর সিদ্দিকী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাকীম তিরমিযীর গ্রন্থগুলি জাল হাদীসে পরিপূর্ণ হওয়ার কারণে সেগুলি পড়তে নিষেধ করেছেন।
(গ) আব্দুর রাহমান যা‘আফরানী থেকে শতাধিক বৎসর সময়ে হাদীসটি কে বা কারা বর্ণনা করে হাকীম তিরমিযীকে শুনালেন তা তিনি বলেন নি।
(ঘ) হাদীসটি মুরসাল। আমরা দেখেছি ইবনুল জাওযী এ বিষয়ক হাদীসের বর্ণনাকারী হিসেবে ইবনু আববাস (রা)-এর নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সুয়ূতী ও তাঁর ছাত্রগণের অনুসন্ধানে এ একটিমাত্র মুরসাল সনদ ছাড়া অন্য কোনো সনদ পাওয়া যায় নি। তাবিয়ী যাকওয়ান কার মাধ্যমে এ তথ্যটি জেনেছেন তা বলেন নি। তাঁর ছাত্র আব্দুল মালিক ইবন আব্দুল্লাহও অজ্ঞাত।
(ঙ) সর্বোপরি এ হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী আব্দুর রাহমান ইবন কাইস যা‘আফরানী সুপরিচিত জালিয়াত। ইমাম আব্দুর রাহমান ইবন মাহদী, ইমাম আবূ যুরআত, ইমাম আহমাদ, ইমাম সালিহ যাজরাহ, ইমাম বুখারী ও অন্যান্য সকল মুহদ্দিস তাকে জালিয়াত ও পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[14]
আমরা ইতোপূর্বে ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামক পুস্তকটির বিষয় আলোচনা করেছি। এ পুস্তকে এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, পুস্তকটি সন্দেহাতীতভাবেই জাল। এটিকে ‘আব্দুর রায্যাক সানআনী’ রচিত বলে মনে করলে মুসলিম উম্মাহর সকল ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বুজুর্গকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা গোপনকারী বলে গণ্য করতেই হবে। আব্দুর রায্যাক হাদীসটি বর্ণনা ও সংকলন করবেন, অথচ ইমাম আহমাদ, বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাজার বছর ধরে তাদের গ্রন্থগুলিতে হাদীসটি বয়কট করবেন বলে কল্পনাও করা যায় না। বিশেষত সুয়ূতী, শামী ও আলী কারী তাঁদের গ্রন্থে মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক থেকে হাজার হাজার উদ্ধৃতি প্রদান করবেন, অথচ এ হাদীসটি প্রমাণ করতে মুসান্নাফ গ্রন্থের ‘সহীহ হাদীস’ বাদ দিয়ে শতবৎসর পরে রচিত অনির্ভরযোগ্য বলে প্রসিদ্ধ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিবেন তা কল্পনা করা যায় না।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া ছিল বলে কোনে কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসনাদ আহমাদ ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত এক হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ একবার তাঁর স্ত্রী যাইনাব বিনত জাহশ (রা)-এর আচরণে কষ্ট পেয়ে কয়েক মাস তাঁর গৃহে গমন থেকে বিরত থাকেন। কয়েকমাস পর একদিন দুপুরে তিনি তাঁর গৃহে গমন করেন। এ প্রসঙ্গে যাইনাব (রা) বলেন:
قالت:
فبينما أنا يوماً بنصف النهار؛ إذا أنا بظل رسول الله ﷺ مُقْبِل (فلما كان شهر ربيع الأول دخل عليها فرأت ظله فقالت
إن هذا لظل رجل وما يدخل على النبي ﷺ فمن هذا فدخل النبي ﷺ)
‘‘এমতাবস্থায় একদিন দুপুরে আমি হঠাৎ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া দেখতে পেলাম..। দ্বিতীয় বর্ণনায়: (প্রায় তিন মাস পরে) রবিউল আউআল মাসে একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর গৃহে গমন করেন। যাইনাব (রা) তাঁর ছায়া দেখতে পান। তিনি বলেন: এ তো পুরুষ মানুষের ছায়া! রাসূলুল্লাহ ﷺ তো আমার নিকট আসেন না! তাহলে এ কার ছায়া? তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর গৃহে প্রবেশ করেন।’’
হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম হাইসামী বলেন: ‘‘হাদীসের একজন বর্ণনাকারী সুমাইয়া (শুমাইসা)। আবূ দাউদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। কেউ তাকে দুর্বল বলেন নি। অন্যান্য রাবী নির্ভরযোগ্য।’’ শুমাইসা নামক এ মহিলা তাবিয়ী আয়েশা (রা)-এর ছাত্রী ছিলেন। ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন, ইবন আবী হাযিম, দারাওয়ারদী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁকে সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য বলেছেন। শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। সনদের অন্যান্য বর্ণনাকারী সহীহ মুসলিমের রাবী। এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসটি সহীহ।[15]
উপরের হাদীসতাত্ত্বিক আলোচনার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি:
(ক) সনদতাত্ত্বিকভাবে আমরা দেখলাম যে, তাঁর ছায়া প্রকাশিত না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ক দুটি হাদীসেরই পুরো সনদ বা সনদের দীর্ঘ অংশ অপরিজ্ঞাত। এছাড়া সনদে অজ্ঞাত পরিচয় ও জালিয়াত রাবী বিদ্যমান। এর বিপরীতে তাঁর ছায়া প্রকাশিত হতো অর্থের হাদীসটি সহীহ বা অধিকতর শক্তিশালী। যদি উভয় হাদীস সহীহ প্রমাণিত হতো তাহলে বলা যেত যে, কখনো তাঁর ছায়া প্রকাশিত হতো এবং কখনো হতো না।
(খ) অলৌকিক বিষয় সর্বদা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং মানুষ সহজে তা ভুলে না। এজন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অলৌকিক বিষয়গুলো অনেকগুলি সনদে বর্ণিত। মি’রাজ, চাঁদ দ্বিখন্ডিত করা, সূর্যগ্রহণ, খাদ্য ও পানীয় বিষয়ক মুজিযা ইত্যাদি সবই এরূপ। অথচ মুসলিম উম্মাহর প্রথম প্রায় ৫০০ বৎসরে প্রসিদ্ধ চার ইমাম বা অন্য কোনো ইমাম, ফকীহ, মুহাদ্দিস, আকীদাবিদ বা বুজুর্গ তাঁর ছায়া না থাকার বিষয়টি কোনোভাবে উল্লেখ করেন নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ বিষয়ক হাদীসগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন।
(গ) মহান আল্লাহ তাঁর মহান রাসূল (ﷺ)-কে অনেক অলৌকিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছিলেন। সহীহ সনদে বর্ণিত এ সকল অলৌকিক বৈশিষ্ট্য বিশ্বাস করা মুমিনের দায়িত্ব। পাশাপাশি কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত অলৌকিকত্ব ও বৈশিষ্ট্যই তাঁর মর্যাদা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট; জাল বা দুর্বল হাদীসের উপর বিশ্বাস ও ভক্তির ভিত্তি স্থাপনের কোনো প্রয়োজন নেই।
(ঘ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া প্রকাশিত না হওয়ার মত অলৌকিকত্ব মহান আল্লাহ তাঁকে প্রদান করতে পারেন। তিনি তাঁকে এর চেয়ে অনেক বড় বড় বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেন। তবে বিষয়টি অবশ্যই সহীহ সনদে প্রমাণিত হতে হবে। তা না হলে আমরা তাঁর নামে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হব।
(ঙ) সর্বাবস্থায় কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয়গুলি বাদ দিয়ে এরূপ বিষয়কে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদার মূল বিষয় বলে গণ্য করা খুবই দুঃখজনক। মহান আল্লাহই ভাল জানেন। আমরা তাঁর তাওফীক প্রার্থনা করছি।
[1] কাযী ইয়ায, আশ-শিফা (শামিলা) ১/৩৬৮; মোল্লা আলী কারী, শারহুশ শিফা ১/৭৫৩।
[2] কাত্তানী, আর-রিসালাতুল মুসতাতরাফা, পৃষ্ঠা ১০৬।
[3] মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কুযায়ী, আত-তাকমিলা লিকিতাবিস সিলাহ (শামিলা) ২/১৬০।
[4] শামী, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ (৯৪২হি.), সুবুলুল হুদা/ সীরাহ শামিয়্যাহ ২/৯০।
[5] সাখাবী, ই’লানুত তাওবীখ, পৃ ১১০; কাত্তানী, আর-রিসালাতুল মুসতাতরাফা (শামিলা) ১১/২৪।
[6] ইবনুল জাওযী, আল-ওয়াফা, পৃষ্ঠা ৪১২; শামী, সীরাহ শামিয়্যাহ ২/৪০।
[7] সুয়ূতী, আল-খাসাইসুল কুবরা ১/১২২; মানাহিলুস সাফা..আহাদীসিস শিফা, পৃষ্ঠা ১৭৩।
[8] শামী, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ (৯৪২ হি), সীরাহ শামিয়াহ (সুবুলুল হুদা) ২/৯০।
[9] আলী কারী, শারহুশ শিফা ১/৭৫৩।
[10] মোল্লা আলী কারী, জামউল ওয়াসাইল ফী শারহিশ শামাইল (দারুল আকসা: শামিলা) ১/২১৭।
[11] কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল্লাদুন্নিয়্যাহ ২/২৭৫; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়া ৭/১৯৯-২০০।
[12] মাকরীযী, ইমতাউল আসমা‘আ বিমা লিন্নাবিয়্যি মিনাল আহওয়াল.. (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৯: শামিলা) ২/১৭০।
[13] সুয়ূতী, জামিউল আহাদীস (শামিলা ) ১/৬
[14] ইবন আদী, আল-কামিল ৪/২৯১; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৪/৩০৯।
[15] আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল-মুসনাদ ৬/১৩১; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩২৩; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৭/৮৫; সাহীহাহ ১৩/৮।
৩৩. উকাশার প্রতিশোধ গ্রহণ
একটি অতি পরিচিত গল্প উকাশার প্রতিশোধ নেয়ার গল্প। মূল মিথ্যা কাহিনীর উপরে আরো শত রঙ চড়িয়ে এ সকল গল্প বলা হয়। মূল বানোয়াট কাহিনী হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইন্তেকালের পূর্বে সাহাবীগণকে সমবেত করে বলেন, আমি যদি কাউকে কোনো যুলুম করে থাকি তবে আজ সে প্রতিশোধ বা বদলা গ্রহণ করুক। এক পর্যায়ে উকাশা নামক এক বৃদ্ধ উঠে বলেন, এক সফরে আপনার লাঠির খোঁচা আমার কোমরে লাগে। উকাশা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোমরে লাঠির খোঁচা মেরে প্রতিশোধ নিতে চান। হাসান, হুসাইন, আবু বাকর, উমার প্রমুখ সাহাবী (রাদিয়াল্লহু আনহুম) উকাশার সামনে নিজেদের দেহ পেতে দেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, কিন্তু তিনি তাতে রাজি হন নি। উকাশার দাবী অনুসারে রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের গায়ের জামা খুলে দেন। উকাশা তাঁর পেটে চুমু দেন এবং তাঁকে ক্ষমা করে দেন।..... ইত্যাদি।
পুরো ঘটনাটিই বানোয়াট। তবে সনদ বিহীন বানোয়াট নয়, সনদ-সহ বানোয়াট। পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ নু‘আইম ইসপাহানী তার ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া নামক গ্রন্থে এ হাদীসটি সংকলন করেছেন। তিনি বলেন, আমাদেরকে সুলাইমান ইবনু আহমাদ বলেছেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আল-বারা বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুল মুনয়িম ইবনু ইদরীস বলেছেন, তিনি তাঁর পিতা থেকে, ওয়াহ্ব ইবনু মুনাবিবহ থেকে, তিনি জাবির ও ইবনু আববাস (রা) থেকে .... এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
এ হাদীসের বর্ণনাকারী আব্দুল মুনয়িম ইবনু ইদরীস (২২৮হি) তৃতীয় হিজরী শতকে বাগদাদের প্রসিদ্ধ গল্পকার ওয়ায়িয ছিলেন। ইমাম আহমাদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এ ব্যক্তি জালিয়াত ছিলেন। তার ওয়াযের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য এরূপ বিভিন্ন গল্প তিনি সনদ-সহ বানিয়ে বলতেন। এ হাদীসটিও তার বানানো একটি হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল, বানোয়াট ও জঘন্য মিথ্যা।[1]
[1] আবূ নু‘আইম, হিলইয়া ৪/৭৩-৭৫; ইবনুল জাওযী, মাউযূআত ১/২১৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৭৭-২৮২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩২৬-৩৩১; লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৮-৪২।
৩৪. ওফাতের সময় মালাকুল মাউতের আগমন ও কথাবার্তা
প্রসিদ্ধ একটি গল্প: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ওফাতের সময় মালাকুল মাউতের আগমন বিষয়ক। গল্পটির সার-সংক্ষেপ হলো, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ওফাতের দিন মালাকুল মাউত একজন বেদুঈনের বেশে আগমন করেন এবং গৃহের মধ্যে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেন। এক পর্যায়ে ফাতেমা (রা) অনুমতি প্রদান করেন। তিনি গৃহে প্রবেশ করে অনেক কথাবার্তা আলাপ আলোচনার পরে তাঁর পবিত্র রূহকে গ্রহণ করেন..। গল্পটি বানোয়াট। গল্পটি মূলত উপরের জাল হাদীসের অংশ। আরো অনেক গল্পকার এতে অনেক রং চড়িয়েছেন।[1]
[1] আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৪/৭৩-৭৫; ইবনুল জাওযী, মাউযূআত ১/২১৯; ইবনু তাইমিয়া, মাজমূঊল ফাতাওয়া ১৮/৩৬৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৭৭-২৮২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩২৬-৩৩১, ৩৪০।
৩৫. স্বয়ং আল্লাহ তাঁর জানাযার নামায পড়েছেন!
আরেকটি প্রচলিত ওয়ায ও গল্প হলো, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তেকালের পরে তাঁর গোসল ও কাফনের পর তাঁর মুবারাক দেহকে মসজিদে রাখা হয়। প্রথমে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর জানাযার সালাত আদায় করেন! গল্পটি বানোয়াট। এ গল্পটিও উপর্যুক্ত আব্দুল মুনয়িম ইবনু ইদরীসের বানানো গল্পের অংশ।[1]
[1] আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৪/৭৩-৭৫; ইবনুল জাওযী, মাউযূআত ১/২১৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৭৭-২৮২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩২৬-৩৩১।
৩৬. ইন্তেকালের পরে ১০ দিন দেহ মুবারক রেখে দেওয়া!
খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার নামে প্রচলিত ‘রাহাতিল কুলুব’ নামক বইয়ের বিষয়ে ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। এ বইয়ের ২৪শ মাজলিসে শাইখ নিজামউদ্দীন লিখেছেন, ২রা রবিউল আউয়াল ৬৫৬ হিজরীতে (৮/৩/১২৫৮ খৃ) তিনি তার পীর শাইখ ফরীদ উদ্দীনের দরবারে আগমন করলে তিনি বলেন, ‘‘আজকের দিনটা এখানেই থেকে যাও, কেননা আজ হযরত রেসালতে পানাহ (ﷺ)-এর উরস মোবারক। কালকে চলে যেও। এরপর বললেন, ইমাম সাবী (রহ) হতে রাওয়ায়েত আছে যে, হযরত রেছালতে পানাহ ﷺ- এর বেছাল মোবারক রবিউল আউয়াল মাসের ২ তারিখে। তাঁর দেহ মোবারক মোজেজার জন্য দশ দিন রাখা হয়েছিলো। দুনিয়ার জীবিত কালে তাঁর পছিনা (ঘাম) মোবারকের সুগন্ধ ছিলো সমস্ত উৎকৃষ্ট সুগন্ধির চেয়েও উৎকৃষ্ট। সে একই খুশবু একই ভাবে বেরিয়েছে ঐ দশ দিন, একটুও কমেনি (সুবহানাল্লা)। হুজুর পাক (ﷺ)-এর এ মোজেজা দেখে কয়েক হাজার ইহুদী তখন মোসলমান হয়েছিল। এ দশদিনের প্রতিদিন গরীব-মিসকিনদেরকে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে বিভিন্ন বিবিদের ঘর হতে। ঐ সময় হুজুর (ﷺ)-এর নয়টি হুজরা ছিল এবং নয়দিন তাঁদের সেখান থেকে দান করা হয়েছে। এবং দশম দিন, অর্থাৎ ১২ই রবিউল আউয়াল দান করা হয়েছে হযরত সিদ্দিকে আকবর আবুবকর (রাদি)-এর ঘর থেকে। এদিন মদিনার সমস্ত লোককে পেট ভরে পানাহার করানো হয়েছে এবং এ দিনই তাঁর পবিত্র দেহ মোবারক দাফন করা হয়েছে। এ জন্যই মোসলমানগণ ১২ রবিউল আউয়াল উরস করে এবং ১২ রবিউল আউয়াল দিনটিই উরসের দিন হিসাবে প্রসিদ্ধ।’’[1]
আমরা জানি না, খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রাহ)-এর গ্রন্থের মধ্যে পরবর্তী কালে কেউ এই কথাগুলো লিখেছে, নাকি কারো মুখ থেকে গল্পটি শুনে ফরীদ উদ্দীন (রাহ) এ কথাগুলো সরল মনে বিশ্বাস করেছেন এবং বলেছেন। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, এ সকল পুস্তকের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের কোনো উপায় নেই। পূরো বইটিও জাল হতে পারে।
সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ মোবারক দেহ ১০ দিন দাফন বিহীন রাখা, হাজার হাজার ইহূদীর ইসলাম গ্রহণ, ১০ দিন খানা খাওয়ানো ইত্যাদি সকল কথাই ভিত্তিহীন। রবিউল আউয়াল মাসের আমল প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ওফাত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, ইনশা আল্লাহ। তবে মুসলিম উম্মাহ একমত যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ সোমবার পূর্বাহ্নে ইন্তেকাল করেন। পরদিন মঙ্গলবার দিবসে তাঁর গোসল ও জানাযার সালাত আদায়ের শেষে দিবাগত সন্ধ্যায় বা রাতে তাঁকে দাফন করা হয়।
[1] খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১৫০।
No comments