হাদীসের নামে জালিয়াতি - অধ্যায়-২৪ - আহল বাইত, সাহাবী-তাবিয়ী ও উম্মাত
আহল বাইত, সাহাবী-তাবিয়ী ও উম্মাত
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সুমহান মর্যাদার স্বাভাবিক দাবী যে, তাঁর পরিবার পরিজন এবং সাথী-সহচরগণের মর্যাদা ও সম্মান হবে নবীগণের পরে বিশ্বের সকল যুগের সকল মানুষের ঊর্ধ্বে। কুরআন ও হাদীসে যদি তাঁদের বিষয়ে কোন প্রকার উল্লেখ নাও থাকত, তবুও তাঁদের মহোত্তম মর্যাদার বিষয় যে কোন বিবেকবান ও জ্ঞানী মানুষ খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারতেন।
এ স্বাভাবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে এবং তাঁদের মহিমা, মর্যাদা ও সম্মান বর্ণনা করেছে কুরআন কারীমের অনেক আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অগণিত বাণী। এ সকল আয়াত ও হাদীসের বিস্তারিত আলোচনার জন্য পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন। এসবের সার কথা হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পরিজনগণকে এবং সাহাবীগণকে ভালবাসা ও সম্মান করা তাঁকে ভালবাসা ও সম্মান করার এবং ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কুরআন ও হাদীসের এসকল মহান বাণী, সহজ ও হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা অনেক মুর্খ ভক্তের হৃদয়কে তৃপ্ত করতে পারে নি। তৃপ্ত করতে পারে নি অতিভক্তির ভন্ডামীতে লিপ্ত অগণিত মানুষকে। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আজগুবি ও অবাস্তব কথা বানিয়েছে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে। এভাবে তারা তাঁর নামে মিথ্যা বলার জঘন্যতম পাপ করার সাথে সাথে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক আবেদনকে কলুষিত করেছে। মুমিনের ঈমান ও জ্ঞানীর অনুভবকে অপবিত্র করেছে। নিচে এ জাতীয় বানোয়াট ও অনির্ভযোগ্য কিছু কথা উল্লেখ করছি।
১. পাক-পাঞ্জাতন
আহল বাইতের মধ্য থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রা)-কে একত্রিত করে পাঁচজনের একত্রিত বিশেষ মর্যাদা জ্ঞাপক অনেক বানোয়াট ও মিথ্যা কথা ‘‘পাক-পাঞ্জাতন’’ নামে প্রচলিত আছে। ‘‘পাক-পাঞ্জাতন’’ বিষয়ক সকল কথা বানোয়াট ও জঘন্য মিথ্যা কথা।
আলী ও ফাতিমা- রদিয়াল্লাহু আনহুমা-কে কেন্দ্র করে মুর্খরা অনেক বানোয়াট, আজগুবি ও মিথ্যা কথা রটনা করেছে। যেমন: ফাতিমা (রা) একদিন একটি পাখির গোশত খেতে চান। আলী (রা) অনেক চেষ্টা করেও পাখিটি ধরতে পারেন না।.... জঘন্য মিথ্যা কথা।
২. বিষাদ সিন্ধু ও অন্যান্য প্রচলিত পুঁথি ও বই
বিষাদ সিন্ধু বইয়ের ৯৫% কথা মিথ্যা। বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস। কোনো ইতিহাস বা ধর্মীয় পুস্তক নয়। উপন্যাস হিসাবে এর মূল্যায়ন হবে। কিন্তু দুঃখজনক কথা যে, সমাজের সাধারণ মানুষেরা এ ধরনের বইয়ের কথাগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। বিশেষত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জড়িয়ে যে সকল মিথ্যা কথা বলা হয়েছে সে বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা দরকার। মু‘আবিয়াকে ইয়াযীদ বিষয়ক (রা) ভবিষ্যদ্বাণী, মুহাম্মদ হানুফার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী, হুসাইন (রা)-এর গলায় বারংবার ছুরির আঘাতে ক্ষত না হওয়া... তাঁর হত্যাকারীর বেহেশতে নেওয়া ইত্যাদি সকল কথা বানোয়াট। মুহাম্মাদ হানুফা (মুহাম্মাদ ইবনু আলী, ইবনুল হানাফিয়্যাহ) বিষয়ক, ইয়াযিদের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ, তাঁর পাহাড়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকা ইত্যাদি কথা সবই মিথ্যা।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, ‘বিষাদ সিন্ধু’ জাতীয় পুস্তকাদি, পুঁথি সাহিত্য ও ‘খাইরুল হাশর’ জাতীয় পুস্তকগুলোই আমাদের সমাজে মিথ্যা ও জাল হাদীস প্রচারের অন্যতম কারণ। এর পাশাপাশি রয়েছে ‘বার চাঁদের ফযীলত’, ‘নেক আমল’, ‘মকছুদুল মুমিনীন’, ‘নেয়ামুল কোরান’, ‘নাফেউল খালায়েক’ জাতীয় পুস্তক। সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রয়োজনীয় ইসলামী শিক্ষা প্রসারে এ সকল পুঁথি-পুস্তকের অবদান অনস্বীকার্য। এ সকল পুস্তকের সম্মানিত লেখকগণ তাঁদের যুগের ও সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে সাধ্যমত দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এরূপ কল্যাণময় খিদমতের পাশাপাশি জাল হাদীস, ভিত্তিহীন কথাবার্তা, বিভিন্ন প্রকারের কুসংস্কার ও ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণার প্রসারেও এগুলো অবদান রেখেছে। মহান আল্লাহ তাদের খিদমাত কবুল করুন এবং ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করুন।
এক সময় বাংলার ‘যোগ্য’ আলিমগণ বাংলাভাষায় পুস্তকাদি রচনা ‘দূষণীয়’ বলে গণ্য করতেন। এ ধ্বংসাত্মক বিভ্রান্তিই সমাজে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য আলিমদের রচিত ভুলভ্রান্তিপূর্ণ পুস্তক প্রচলনের সুযোগ করে দেয়।
৩. ফাতিমা (রা)-এর শরীর টেপার জন্য বাঁদী চাওয়া!
এখানে অনুবাদের বিকৃতি ও মিথ্যার একটি নমুনা উল্লেখ করছি। প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেঃ- একদিন বিবি ফাতেমা (রা) হযরত মোহাম্মদ ﷺ-এর কাছে আসিয়া আরজ করিলেন হে পিতঃ! আমাকে সমস্ত দিনই আটা পিষায় ও গৃহ কার্যে নিযুক্ত থাকিতে হয় তাই আমার শরীরটা বেদনা ও দরদযুক্ত হইয়া যায়। অতএব আমাকে একটি বাঁদী ক্রয় করিয়া দিন যাতে সে আমার শরীরটা টিপিয়ে দিতে ও গৃহ কার্যে আমাকে সাহায্য করিতে পারে। তদুত্তরে হুজুর (ﷺ) বলিলেন, হে মাতঃ! স্ত্রী লোকের পক্ষে আপন স্বামীর ও পরিজন পোষনের জন্য আটা পিষা গৃহ কার্যে আঞ্জাম করার ন্যায় পুণ্য কাজ আর কিছুই নাই। কিন্তু বাদী বা চাকরানীর সাহায্য লইলে ততদূর ছোওয়াবের ভাগী হইতে পারিবে না। অতএব আমার উপদেশ মানিয়া সর্বদা নিম্নলিখিত দোয়া পাঠ করিতে থাক, নিশ্চয়ই তোমার শরীরের বেদনা দুর হইয়া যাইবে এবং শরীর সর্বদা সুস্থ ও সবল থাকিবে। আর অতিরিক্ত ছওয়াবও পাইবে। তখন হইতে বিবি ফাতেমা তাহাই করিতেন। দোওয়া:
سُبْحَانَ اللهِ
وَالْحَمْدُ للهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ‘‘.[1]
একটি সহীহ হাদীসের মনগড়া অনুবাদ করে এখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে অনেকে মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু ফাতিমা (রা) এর জন্য অবমাননাকর কথাবার্তা বলা হয়েছে। মূল হাদীসটি বুখারী, মুসলিম ও অন্য সকল মুহাদ্দিস কাছাকাছি শব্দে সংকলন করেছেন: হাদীসটি নিম্নরূপ:
আলী (রা) বলেন, যাঁতা চালানোর কারণে তাঁর হাতে কী কষ্ট হয় তা জানাতে ফাতিমা (রা) নবীজী ﷺ-এর কাছে গমন করেন। ফাতিমা শুনেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে কিছু যুদ্ধবন্দী দাস-দাসী এসেছে। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাড়িতে যেয়ে তাঁকে পান নি। তখন তিনি আয়েশা (রা)-কে বিষয়টি জানান। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘরে আসেন তখন আয়েশা বিষয়টি তাঁকে জানান। আলী বলেন, আমরা রাতে বিছানায় শুয়ে পড়ার পরে তিনি আমাদের কাছে আগমন করলেন। তখন আমরা উঠতে গেলাম। তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের জায়গাতেই থাক। তিনি এসে আমার ও ফাতিমার মধ্যখানে বসলেন। এমনকি আমি আমার পেটের উপর তাঁর পদযুগলের শীতলতা অনুভব করলাম। তিনি আমাদেরকে বললেন, তোমার যা চাচ্ছ তার চেয়েও উত্তম বিষয় কি তোমাদের শিখিয়ে দেব না? তোমরা যখন তোমাদের বিছানায় শুয়ে পড়বে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদু লিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। এ আমলটি তোমাদের জন্য দাসীর চেয়েও উত্তম। আলী বলেন, এরপর আমি কখনোই এ আমলটি ত্যাগ করি নি।
এ হলো মূল ঘটনা, যা বুখারী ও মুসলিম সহ সকল মুহাদ্দিস বিভিন্ন সহীহ সনদে সংকলিত করেছেন। অথচ উপরের অনুবাদে সব কিছু বিকৃত করা হয়েছে এবং অনেক মিথ্যা কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলা হয়েছে।[2]
[1] মো. গোলাম রহমান, কাজী মাওলানা, মকছুদোল মো'মেনীন, পৃ. ৫৫-৫৬।
[2] সহীহ বুখারী ৩/১১৩৩, ৩/১৩৫৮, ৫/২০৫১, ৫/২৩২৯, নং ২৯৪৫, ৩৫০২, ৫০৪৬, ৫৯৫৯, সহীহ মুসলিম ৪/২০৯১, নং ২৭২৭, ফাতহুল বারী ১১/১২০।
৪. আবূ বাক্র (রা)-এর খেজুর পাতা পরিধান
প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে একটি ভিত্তিহীন কাহিনী উদ্ধৃত করছি: ‘‘ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিবার পূর্বে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) একজন বড় ধনাঢ্য লোক ছিলেন। যেদিন হযরত (ﷺ)-এর খেদমতে আসিয়া ইসলামে দিক্ষীত হইলেন সেইদিন হইতেই তাঁহার যাবতীয় ধন সম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করিতে লাগিলেন। ... একদিন পরনের কাপড়ের অভাবে মসজিদে নামায পড়িতে যাইতে কিঞ্চিত দেরী হইয়াছিল। দেখিয়া হযরত (ﷺ) বলিলেন, হে আবু বকর (রা), আমি জীবিত থাকিতেই ইসলামের প্রতি আপনাদের এত অবহেলা হইতেছে, আমি অভাবে আরও কত কি হয় বলা যায় না। ...তিনি বলিলেন হুজুর আমার অবহেলার কিছুই নহে। বাস্তবিক আমার পরনে কাপড় ছিলনা, সেই হেতু আমি ছোট এক খানা কাপড়ের সহিত বালিশের কাপড় ছিঁড়িয়া খেজুর পাতা ও কাঁটা দ্বারা সেলাই করতঃ ধুইয়া ও শুকাইয়া পরিয়া আসিতে এত গৌণ হইয়াছে...। ইহার কিছুক্ষণ পরে জীব্রাইল সম্পুর্ণ খেজুর পাতার পোষাক পরিয়া হযরতের সম্মুখে হাজির হইলেন...। হযরত (ﷺ) তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ... আজকে খেজুর পাতার পোশাক দেখিতেছি কেন? তদুত্তরে জিব্রাইল (ﷺ) বলিলেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) খেজুর পত্রের সেলাই করা কাপড়ে নামায পড়িতে আসিয়াছিলেন। তখন আল্লাহ তায়ালা সমস্ত ফেরেশতাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘দেখ হে ফেরেশ্তাগণ, আবুবকর আমার সন্তোষ লাভের জন্য কতইনা কষ্ট স্বীকার করিতেছেন। অতএব তোমরা যদি আজ আমার সন্তোষ চাও তবে এখনই আবুবকরের সম্মানার্থে সকলেই খেজুর পত্রের পোশাক পরিধান কর। নচেৎ আজই আমার দপ্তর থেকে সমস্ত ফেরেশ্তার নাম কাটিয়া দিব।’ এই কঠোর বাক্য শুনিয়া আমরা সকলেই তাঁহার সম্মানার্থে খেজুর পত্রের পোশাক পরিধান করিতে বাধ্য হইয়াছি।’’[1]
[1] মো. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, ১৪৯-১৫১।
৫. আবূ বাকরের সাথে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) কথা উমার বুঝতেন না
জালিয়াতদের বানানো একটি কথা: উমার (রা) বলেছেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ
إِذَا تَكَلَّمَ مَعَ أَبِيْ بَكْرٍ كُنْتُ بَيْنَهُمَا كَالزَّنْجِيِّ الَّذِيْ
لاَ يَفْهَمُ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন আবূ বাকরের (রা) সাথে কথা বলতেন, তখন আমি তাঁদের মাঝে অনারব হাবশীর মত হয়ে যেতাম, যে কিছুই বুঝে না।’’
জালিয়াত দাজ্জালরা বলতে চায়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ বাক্র (রা)-এর সাথে এমন মারেফতী ভাষায় (!) কথা বলতেন যে, উমারও (রা) তাঁদের কথা বুঝতে পারতেন না। মুহাদ্দিসগণ একমত যে এ কথাটি সনদ বিহীন ভিত্তিহীন একটি মিথ্যা কথা।[1]
[1] ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ১১৫; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ২০৩; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৪০৭; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩৪২; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৯৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৪২৩।
৬. উমার (রা) কতৃক নিজ পুত্র আবূ শাহমাকে দোররা মারা
প্রচলিত আছে যে, উমার (রা) তাঁর নিজ পুত্র আবূ শাহমাকে ব্যভিচারের অপরাধে ১০০ বেত্রাঘাত করেন। এতে পুত্রের মৃত্যু হয়। এ ব্যভিচার উদঘাটন, স্বীকারোক্তি, শাস্তি, পিতা-পুত্রের কথাবার্তা ইত্যাদি নিয়ে লম্বা চওড়া কাহিনী বলা হয়, যা শুনলে সাধারণ শ্রোতাগণের চোখে পানি আসে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলো ভিত্তিহীন মিথ্যা গল্প। ইবনুল জাওযী বলেন, ‘‘সাধারণ শ্রোতাদেরকে কাঁদানোর জন্য জাহিল ওয়ায়িযগণ এগুলো বানিয়েছে।’’[1]
ইতিহাসে পাওয়া যায়, উমারের পুত্র আব্দুর রাহমান আবূ শাহমা মিশরের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধরত ছিলেন। একদিন তিনি নাবীয বা খেজুর ভিজিয়ে তৈরি করা ‘শরবত’ পান করেন। কিন্তু এ খেজুরের শরবতে মাদকতা এসে গিয়েছিল, ফলে আবূ শাহমার মধ্যে মাতলামি আসে। তিনি মিশরের প্রশাসক আমর ইবনুল আস (রা)-এর কাছে আগমন করে বলেন, আমি মাদক দ্রব্য পান করেছি, কাজেই আমাকে আপনি মাদক পানের শারীয়হ নির্ধারিত শাস্তি (বেত্রাঘাত) প্রদান করুন। আমর (রা) তাকে গৃহাভ্যন্তরে বেত্রাঘাত করেন। উমার (রা) তা জানতে পেরে আমরকে (রা) তিরস্কার করেন এবং বলেন সাধারণ মুসলিম নাগরিককে যেভাবে জনসমক্ষে শাস্তি প্রদান করা হয়, আমার পুত্রকেও সেভাবে শাস্তি প্রদান করা উচিত ছিল। আবূ শাহমা মদীনা ফিরে গেলে তিনি নিজে পুনরায় তাকে শাস্তি প্রদান করেন। এর কিছুদিন পরে আবূ শাহমা ইন্তেকাল করেন।[2]
[1] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৪৪২।
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৪৩৮-৪৪৩; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ৪/৩৩৯, ৫/৪৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১৯৪-১৯৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/২২০।
৭. উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের দিনে কাবাঘরে আযান শুরু
প্রচলিত আছে যে, উমার (রা) যেদিন ইসলাম গ্রহণ করেন, সে দিন থেকে কাবাঘরে প্রথম আযান শুরু হয়। কথাটি ভুল। উমার (রা) হিজরতের ৫ বৎসর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। আর আযানের প্রচলন হয় হিজরতের পরে মদীনায়। উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের সময় এবং পরবর্তী প্রায় ৬ বছর যাবৎ আযানের কোনো প্রচলন ছিল না। তবে উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মক্কায় মুসলিমগণ কাবা ঘরের পাশে নামায আদায় করতে পারতেন না। মক্কার কাফিরগণ তাতে বাধা দিত। উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি কাফিরদের বাধা প্রতিহত করে নিজে কাবার পাশে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করেন এবং তাঁর সাথে অন্যান্য মুসলিমও সেখানে নামায আদায় করেন।[1]
এ তথ্যটি কিভাবে ক্রমান্বয়ে বিকৃত হয়েছে তার একটি নমুনা দেখুন। খাজা নিজামউদ্দীন আউলিয়ার (রাহ) নামে প্রচলিত ‘রাহাতিল কুলূব’ গ্রন্থে রয়েছে তাঁর মুর্শিদ ফরীদ উদ্দীন গঞ্জে শক্কর (রহ) বলেন: ‘‘যতদিন পর্যন্ত হযরত আমিরুল মো'মেনীন ওমর এবনে খাত্তাব (রা) ইসলামে ঈমান আনেন নি ততদিন পর্যন্ত নামাজের আযান গুহায় গহবরে দেয়া হতো। কিন্তু যে দিন আমিরুল মো'মেনীন হযরত ওমর ফারুক (রা) ঈমান আনলেন সে দিন তিনি তলোয়ার মুক্ত করে দাঁড়িয়ে হযরত বেলাল (রা)-কে বললেন, কা’বা ঘরের মেম্বারে উঠে আজান দাও। হযরত বেলাল তার নির্দেশ মতো কাজ করলেন।’’[2]
আমরা জানি যে, এ কথাগুলো সঠিক নয়। উমার (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের আগে বা পরে কখনোই মক্কায় গুহায়, গহবরে বা কাবাঘরে কোথাও আযান দেয়া হয় নি। এ ছাড়া কাবা ঘরের কোনো মিম্বার ছিল না। আমরা দেখেছি যে, এ পুস্তকটি সম্ভবত খাজা নিযামউদ্দীনের নামে জাল করে লেখা। অথবা সরলতার কারণে তাঁরা যা শুনেছেন সহজেই বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন।
[1] ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ ১/৩৬৯।
[2] হযরত খাজা নিজামউদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলূব, পৃ. ৭১ (১২ মজলিস)।
৮. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইলমের শহর ও আলী (রা) তার দরজা
আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত হাদীস:
أَنَا مَدِيْنَةُ الْعِلْمِ
وَعَلِيٌّ بَابُهَـا
‘‘আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা।’’
এ হাদীসটিকে অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে মিথ্যা না বলে যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী এ অর্থে একটি হাদীস বর্ণনা করে নিজেই হাদীসটি দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।[1] ইমাম বুখারী, আবু হাতিম, ইয়াহইয়া বিন সায়ীদ, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে ভিত্তিহীন মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন।[2]
[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৯৬।
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/২৬১-২৬৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৩২৮-৩৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, ৭১-৭২ পৃ, নং ২৫১, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ১১৪-১১৬, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ পৃ: ৬৯।
৯. আলী (রা) কে দরবেশী খিরকা প্রদান
প্রচলিত একটি গল্পে বলা হয়েছে: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মি’রাজ থেকে ফিরে আসার পরে নিজের সাহাবা (রা)-দেরকে ডেকে এরশাদ করলেন যে, আমার দরবেশী খিরকা ঐ ব্যক্তিকে প্রদান করবো যে আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে... আবূ বাকর (রা)-কে বললেন, যদি আমি তোমাকেই এ দরবেশী খিরকা দান করি তাহলে তুমি এর হক কিভাবে আদায় করবে? ... এভাবে উমার (রা) কে জিজ্ঞাসা করলেন ... উসমান (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলেন...। এরপর আলী (রা)-কে প্রশ্ন করলেন। আলী (রা) উত্তরে বলেন, আমি আল্লাহর বান্দাদের গোপনীয়তা রক্ষা করব। তখন তিনি আলীকেই খিরকা প্রদান করেন...’’ ইত্যাদি। পুরো কাহিনীটিই ভিত্তিহীন বানোয়াট।[1]
[1] হযরত খাজা নিজামউদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলূব, পৃ. ৮-৯।
১০. আলীকে ডাক, বিপদে তোমাকে সাহায্য করবে!
মোল্লা কারী বলেন, শিয়াদের বানানো একটি ঘৃণ্য জাল ও মিথ্যা কথা:
نَادِ عَلِيًّا مُظْهِرَ
الْعَجَائِبِ، تَجِدْهُ عَوْناً لَكَ فِيْ النَّوَائِبِ، بِنُبُوَّتِكَ يَا
مُحَمَّدُ، بِوَلاَيَتِكَ يَا عَلِيُّ
‘‘আলীকে ডাক, সে আশ্চর্য কর্মাদি প্রকাশ করে, তাকে তুমি বিপদে আপদে তোমার সহায়ক পাবে। হে মুহাম্মাদ, আপনার নবুয়তের ওসীলায়। হে আলী, আপনার বেলায়াতের ওসীলায়।’’[1]
বস্ত্তত, আমাদের সমাজে প্রচলিত সকল কুসংস্কার, শির্ক ও বিদ‘আতের উৎস হচ্ছে শিয়া মতবাদ ও শিয়া সম্প্রদায়। কুরআন কারীম ও সুস্পষ্ট সুন্নাতকে পরিত্যাগ করে তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বংশের ১২ বা ৭ ইমামের নামে ভক্তিতে বাড়াবাড়ি করেন। ফলে এসকল নেককার মানুষের নামে বিভিন্ন প্রকার মিথ্যা ও ঈমান বিধ্বংসী কথা তাদের মধ্যে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করা ইসলামের শত্রুদের পক্ষে সহজ হয়ে যায়। তাদের হৃদয়গুলো কুরআন কারীম ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সুন্নাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছে। হৃদয়ের মণিকোঠায় বসেছেন আলী ও তাঁর বংশের ইমামগণ। তাঁদের নামে জালিয়াতগণ যা বলেছে সবই তারা ভক্তিভরে মেনে নিয়েছেন এবং এ মিথ্যাগুলোর ভিত্তিতে কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনার বিকৃত ব্যাখ্যা করেছেন।
এ সম্প্রদায়ের কঠিনতম অপরাধগুলির অন্যতম হলো, এরা আলী (রা) ও তাঁর বংশের ইমামদেরকে ‘ঈশ্বর’ বানিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ‘ঈশ্বরত্ব’ বা ‘ঐশ্বরিক শক্তি’ কল্পনা করেছে। এ কথাটি তাদের মধ্যে প্রচলিত একটি শির্ক। যেখানে কুরআন ও সুন্নাহ বারংবার শেখাচ্ছে সকল বিপদে আপদে শুধুমাত্র মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার, সেখানে এরা বানিয়েছে আলীর কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা। বিপদে আপদে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে অলৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করাই হলো সকল শিরকের মূল। এ বিষয়ে আমি ‘রাহে বেলায়াত’ নামক পুস্তকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
এ জঘন্য মিথ্যা কথাটির ভিত্তিতে শিয়াগণ একটি দোয়া বানিয়েছে, যা দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সমাজে অনেক ‘সুন্নী’ মুসলিমের মধ্যেও প্রচলিত। এ শিরক-পূর্ণ দোয়াটি প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘‘দোয়ায়ে নাদে আলী। তাহাজ্জুদ নামাজের পর আগে পরে দরূদ শরীফ পড়ে এ দোয়া যত বেশী পারা যায় পড়ে দোয়া করিলে মনের বাসনা পূর্ণ হয় ও কঠিন বিপদ দূর হয়ে থাকে। বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। নাদে আলিয়ান মাজহারাল আজায়েবে তাজেদহু আউনাল্লাকা ফিন্নাওয়ায়েবে ওয়াকুল্লি হাম্মিন ওয়া গাম্মিন সাইয়ানজালি বি-আজমা-তিকা ইয়া আল্লাহ বিনুবুওয়াতিকা ইয়া মুহাম্মাদ বি-বিলায়াতিকা ইয়া আলী, ইয়া আলী, ইয়া আলী, লা ফাতা ইল্লা আলী, লা সাই- ফা ইল্লা জুল ফাক্কারে, নাছরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারীব, ওয়া বাশ্শিরিল মুমেনীন, ফাল্লাহু খাইরুন হাফিজাও ওয়া হুয়া আরহামার রাহিমিন।’’[2]
শিয়াদের রচিত এ দোয়াটি নিরেট শির্ক। অথচ তা আমাদের ধার্মিক মানুষদের মধ্যে প্রচলিত। কোনো সরল প্রাণ বুযুর্গ হয়ত দোয়াটি শুনে অর্থ না জেনে বা অসাবধানতা বশত তা আমল করেছিলেন। এখন আপনি যতই বলুন একথা শিরক, একথা শিয়াদের বানানো, সকল মুহাদ্দিস এ বিষয়ে একমত... ইত্যাদি, আপনার কোনো কথাই বাজারে ঠাঁই পাবে না। একটি কথাতেই সব নষ্ট হয়ে যাবে: অমুক বুযুর্গ তা পালন করেছেন, তিনি কি কিছুই বুঝেন নি?
[1] মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৬৫-২৬৬; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৪৮৯।
[2] মো. বসির উদ্দীন আহমাদ, নেক আমল, পৃ. ১৮৬।
১১. আলী (রা)-কে দাফন না করে উটের পিঠে ছেড়ে দেয়া
৪০ হিজরীর রামাদান মাসের ২৩ তারিখে আলী (রা) তাঁর খেলাফতের রাজধানী কূফায় এক গুপ্তঘাতক খারিজীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ্য পুত্র হাসান ইবনু আলী (রা) তাঁর জানাযার সালাতে ইমামতি করেন। জানাযা শেষে কূফাতেই তাঁর বাড়ীর অভ্যন্তরে তাঁকে দাফন করা হয়। কারণ ইমাম হাসান ও অন্যান্যরা ভয় পাচ্ছিলেন যে, সাধারণ গোরস্থানে তাঁকে দাফন করলে খারিজীগণ তাঁর মৃতদেহকে চুরি করবে ও অপমানিত করবে। এ বিষয়টি প্রথম যুগের মুসলিমদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল।
পরবর্তী কালে শিয়াগণ এ বিষয়ে একটি বানোয়াট ও মিথ্যা গল্প প্রচার করেছে। গল্পটির সার সংক্ষেপ হলো, আলী (রা)-কে দাফন না করে উটের পিঠের উপর ছেড়ে দেয়া হয়। উটটি হারিয়ে যায়। ... পরবর্তী কালে ‘নাজাফ’-এর তাঁর কবরের খোঁজ পাওয়া যায়।... ইত্যাদি।
এ সকল কাহিনী শুধু মিথ্যাই নয়, উপরন্তু তা আলী (রা), হাসান (রা), হুসাইন (রা) ও আলীর পরিবারের সকলের জন্যই কঠিন অবমাননাকর। ইন্তিকালের পরে মৃত দেহ দাফন করা জীবিতদের উপর ফরয। এ ফরয দায়িত্বে অবহেলা করে তাঁরা আমীরুল মুমিনীনের মৃত দেহ উটের পিঠে ছেড়ে দিবেন একথা একান্ত কান্ডজ্ঞানহীন মুর্খ ছাড়া কেউই বিশ্বাস করবে না। হাসান-হুসাইন (রা) তো দূরের কথা, একজন অতি সাধারণ মানুষও তার পিতার মৃতদেহ এভাবে ছেড়ে দিতে রাজি হবে না। সেও চাইবে যে, তার পিতার কবরটি পরিচিত থাক, যেন সে ও তার বংশধরেরা তা যিয়ারত করতে পারে...। কিন্তু সমস্যা হলো, কুরআন-সুন্নাহকে পরিত্যাগ করে অতিভক্তির অন্ধকারে হৃদয়কে নিমজ্জিত করার পরে ইমামগণের নামে যা কিছু বাতিল, শরীয়ত বিরুদ্ধ, বুদ্ধি ও বিবেক বিরুদ্ধ কথা বলা হয়েছে, সবই শিয়ারা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বিশ্বাস করে নিয়েছে।
এ মিথ্যাচারের ভিত্তিতে নাজাফ শহরে একটি কবরকে শিয়াগণ আলীর কবর বলে বিশ্বাস ও প্রচার করেন। আলী (রা)-এর শাহাদাতের পরে তিন শত বছর পর্যন্ত কেউ বলেন নি যে, আলীর কবর নাজাফে। প্রায় তিন শত বছর পরে বিভিন্ন জনশ্রুতি ও কুসংস্কারের ভিত্তিতে এ কবরটি আলীর (রা) কবর বলে পরিচিতি পেতে শুরু করে। করবটির অবস্থা অবিকল বাবরী মসজিদের স্থলে রাম জন্ম-মন্দিরের কাহিনীর মত। সকল হিন্দু গবেষক ও ঐতিহাসিক একমত যে, অযোধ্যার বাবরী মসজিদের স্থানে কোনো দিনই রাম-মন্দির ছিল না। কিন্তু এ মিথ্যা কথাটি উগ্রপন্থি হিন্দুদের প্রচারে এখন প্রায় স্বতঃসিদ্ধ সত্যে পরিণত হয়েছে। হয়ত এক সময় এখানে ‘রাম-মন্দির’ নির্মিত হবে। ভারতের কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করবে যে, এখানেই রামের জন্ম হয়েছিল! যেমন ভাবে কোটি কোটি শিয়া বিশ্বাস করে যে নাজাফের এ কবরটিই আলীর কবর। এজন্য তারা নাজাফ শহরকে বলে ‘নাজাফ আল-আশরাফ’। মক্কা শরীফ, মদীনা শরীফ ও নাজাফ আশ্রাফ। অর্থাৎ পবিত্র মক্কা, পবিত্র মদীনা ও মহা পবিত্র নাজাফ!!![1]
[1] ইবনু তাইমিয়া, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ২৭/৪৪৬; ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ৭/৩৩০; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৮০।
১২. আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য
মুসলিম সমাজে অত্যন্ত প্রচলিত একটি ‘হাদীস’:
أَصْحَابِيْ كَالنُّجُوْمِ
بِأَيِّهِمْ اقْتَدَيْتُمْ اهْتَدَيْتُمْ
‘‘আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য, তাঁদের যে কাউকে অনুসরণ করলেই তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হবে।’’
হাদীসটি আমাদের মধ্যে এত প্রসিদ্ধ যে, সাধারণ একজন মুসলিম স্বভাবতই চিন্তা করেন যে, হাদীসটি বুখারী, মুসলিমসহ সিহাহ সিত্তা ও সকল হাদীগ্রন্থেই সংকলিত। অথচ প্রকৃত বিষয় হলো, সিহাহ সিত্তা তো দূরের কথা অন্য কোনো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি নেই। যয়ীফ ও জালিয়াত রাবীগণের জীবনী গ্রন্থে, কয়েকটি ফিকহী গ্রন্থে ও অপ্রসিদ্ধ দুই একটি হাদীসের গ্রন্থে এ বাক্যটি এবং এ অর্থের একাধিক বাক্য একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সনদেরই একাধিক রাবী জালিয়াত হিসেবে প্রসিদ্ধ অথবা অত্যন্ত দুর্বল এবং মিথ্যা বলায় অভিযুক্ত। এজন্য আবূ বাকর বায্যার আহমাদ ইবনু আমর (২৯২হি), ইবনু হায্ম যাহিরী আলী ইবনু আহমাদ (৪৫৬), যাহাবী মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ (৭৪৮হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে জাল ও ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন।[1]
আশ্চর্যের বিষয় হলো, সাহাবীগণের মর্যাদা প্রমাণের জন্য আমরা এ ধরনের অনির্ভরযোগ্য হাদীসের উপর নির্ভর করি, অথচ কুরআনে অনেক স্থানে সুস্পষ্টভাবে তাঁদের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের মর্যাদার বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস প্রসিদ্ধ হাদীসের গ্রন্থসমূহে সংকলিত রয়েছে।
[1] আবদ ইবনু হুমাইদ, আল-মুসনাদ, পৃ. ২৫০; ইবনু হায্ম, আল-ইহকাম ৬/২৪৪; ইবনুল মুলাক্কিন (৮০৪হি), খুলাসাতুল বাদরিল মুনীর ১/২৫০; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/১৪১-১৪২, ৩৭৯, ৮/৭৩; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ২/১৩৭; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪৯-৫০; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/১৪৭; ইবন আবিল ইজ্জ হানাফী, শারহুল আকীদাতিত তাহাবিয়্যাহ পৃ: ৪৬৭-৪৭১, আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীসিস যাঈফাহ ১/১৪৪-১৫২, নং ৫৮-৬১।
১৩. আমার আহলু বাইত নক্ষত্রতুল্য
উপরের হাদীসের ভাষাতেই আরেকটি হাদীস:
أَهْلُ بَيْتِيْ
كَالنًُّجُوْمِ بِأَيِّهِمْ اقْتَدَيْتُمْ اهْتَدَيْتُمْ
‘‘আমার আহলু বাইত অর্থাৎ বাড়ির মানুষেরা বা বংশধরেরা নক্ষত্রতুল্য, তাঁদের যে কাউকে অনুসরণ করলেই তোমরা সুপথপ্রাপ্ত হবে।’’
নুবাইত ইবনু শারীত (রা) একজন সাহাবী ছিলেন। একাধিক তাবিয়ী তাঁর থেকে হাদীস শিক্ষা ও বর্ণনা করেছেন। তাঁরই এক অধস্তন পুরুষ আহমাদ ইবনু ইসহাক ইবনু ইবরাহীম ইবনু নুবাইত তৃতীয়-চতুর্থ হিজরী শতকে দাবী করেন যে, নুবাইতের লিখিত একটি পান্ডুলিপি তার নিকট আছে। তিনি দাবী করেন, তিনি তার পিতা-পিতামহের মাধ্যমে এ পান্ডুলিপিটি পেয়েছেন। এতে লিখিত হাদীসগুলোর একটি এ হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ লোকটি একজন জঘন্য মিথ্যাবাদী ছিলেন। তিনি নিজে জালিয়াতি করে এ পান্ডুলিপিটি লিখে তার ঊর্ধ্বতন দাদার নামে চালান। এ হাদীসটি এবং পান্ডুলিপিটির সকল হাদীস জাল।[1]
[1] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/২১৪; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/১৩৬; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী,পৃ. ২০১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৪১৯; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৯৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৪৮৯।
১৪. সাহাবীগণের বা উম্মতের মতভেদ রহমত
একটি অতি প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ ‘হাদীস’:
اِخْتِلاَفُ أُمَّتِيْ
(اختلاف العلماء) رَحْمَةٌ
‘‘আমার উম্মতের ইখতিলাফ (মতবিরোধ) রহমত (করুণা)’’।
কখনো বলা হয়: ‘‘আলিমদের ইখতিলাফ রহমত’’ এবং কেউ বলেন: ‘আমার সাহাবীগণের ইখতিলাফ রহমত।’ মুহাদ্দিসগণ ঘোষণা করেছেন যে, এ বাক্যটি হাদীস হিসাবে সমাজে বহুমুখে প্রচারিত হলেও কোনো হাদীসের গ্রন্থে এ হাদীসটি সনদসহ পাওয়া যায় না। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদেও এ কথাটি বর্ণিত হয় নি। সনদবিহীনভাবে অনেকেই বিভিন্ন গ্রন্থে এ বাক্যটিকে হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা সুবকী বলেছেন: ‘‘মুহাদ্দিসগণের কাছে এটি হাদীস বলে পরিচিত নয়। আমি এ হাদীসের কোন সনদ-ই পাই নি, সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট কোন রকম সনদই এ হাদীসের নেই।’’[1]
ইখতিলাফ বা মতভেদ মূলত নিন্দনীয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অনুমোদিত বা প্রশংসিত হতেও পারে। আমরা ইখতিলাফের প্রশংসায় বা নিন্দায় অনেক কিছু বলতে পারি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে এ কথাটি বলতে পারি না; কারণ তা সনদহীন ভিত্তিহীন কথা।
[1] মোল্লা কারী, আল-আসরার, ৫১ পৃ, সুযূতী, আল-জামি আস সগীর ১/১৩, আলবানী, যায়ীফাহ ১/১৪১, নং ৫৭, যায়ীফুল জামিয় ৩৪ পৃ।
১৫. মুআবিয়ার (রা) কাঁধে ইয়াযীদ: বেহেশতীর কাঁধে দোযখী
খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নামে প্রচলিত ‘রাহাতিল কুলুব’ পুস্তকে রয়েছে, ফরীদউদ্দীন গঞ্জে শক্কর বলেন: ‘‘হযরত রাসূলে মাকবুল (ﷺ) একদিন সাহাবাদেরকে সঙ্গে নিয়ে বসেছিলেন, এমন সময় মো‘য়াবিয়া তার পুত্র এজিদকে কাঁধে নিয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো, তাঁকে দেখে হুজুর পাক ﷺ মুচকি হেসে বললেন, ‘দেখ-দেখ, বেহেস্থির কাঁধে দুজখী যাচ্ছে।’...’’[1]
এ কথাটি যে ভিত্তিহীন বানোয়াট তা বুঝতে বেশি জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে যার সাধারণ জ্ঞান আছে তিনিও জানেন যে, ইয়াযীদের জন্ম হয়েছে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তেকালের প্রায় ১৪ বছর পরে।
[1] রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১৩০।
১৬. সাহাবীগণের যুগে ‘যমিন-বুসি’
নিজামুদ্দীন আউলিয়ার (রাহ) নামে প্রচলিত ‘রাহাতিল কুলুব’ পুস্তকে রয়েছে: ‘‘একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবাগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন... এমন সময় একজন আরবী এসে জমিনে আদব-চুমু খেয়ে আরজ করলেন।’’[1]
কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। আমরা আগেই বলেছি যে, এ বইটি পুরোটাই জালিয়াতদের রচিত বলেই প্রতীয়মান হয়। যমিন-বুসী তো দূরের কথা কদমবুসীর রীতিও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে প্রচলিত ছিল না। রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর দরবারে তাঁর ২৩ বছরের নবুয়তী যিন্দেগিতে তাঁর লক্ষাধিক সাহাবীর কেউ কেউ দু-একবার এসেছেন। কেউ কেউ সহস্রা্ধিকবার এসেছেন। এসকল ক্ষেত্রে তাঁদের সুন্নাত ছিল সালাম প্রদান। কখনো কখনো দেখা হলে তাঁরা সালামের পরে হাত মিলিয়েছেন, বা মুসাফাহা করেছেন। দু’একটি ক্ষেত্রে তাঁরা একজন আরেক জনের হাতে বা কপালে চুমু খেয়েছেন বা কোলাকুলি করেছেন। কয়েকটি যয়ীফ বর্ণনায় দেখা যায় কেউ রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর পায়ে চুমু খেয়েছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ ২৩ বছরের নবুয়তী যিন্দেগিতে লক্ষ মানুষের অগণিতবার আগমনের ঘটনার মধ্যে মাত্র ৪/৫টি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এ সকল ঘটনায় কোনো সুপরিচিত সাহাবী তাঁর পদচুম্বন করেন নি, করেছেন নতুন ইসলাম গ্রহণ করতে আসা বেদুঈন বা ইহুদী, যারা দরবারে থাকে নি বা দরবারের আদব জানত না।[2] ) ও তাঁদের মতো প্রথম কাতারের শত শত সাহাবী প্রত্যেকে ২৩ বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার বার তাঁর দরবারে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু কেউ কখনো একবারও তাঁর কদম মুবারকে চুমু খান নি বা সেখানে হাত রেখে সে হাতে চুমু খান নি, তাঁর সামনে মাটিতে চুমু খাওয়া তো অনেক দূরের কথা।yআবু বাকর, উমার, উসমান, আলী, ফাতিমা, বিলাল (
হিন্দুগণ মানুষকে সাজদা, গড় বা প্রণাম করতে অভ্যস্ত ছিলেন। ইসলামের আগমনের পরে ভারতের মুসলমানদের মধ্যেও পীর, মুরববী বা রাজা-বাদশাহকে সাজদা করা, তাদের পায়ে মুখ দিয়ে চুমু খাওয়া বা তাদের সামনে মাটিতে চুমু খাওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। এ রীতিটি নিঃসন্দেহে ইসলাম বিরোধী। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, একে হাদীস বলে মনে করা।
[1] রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১৩০।
[2] বিস্তারিত দেখুন: ইবনুল মুকরি’, আবু বাকর মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম, আর রুখসাতু ফী তাকবীলিল ইয়াদ, ৫৫-৮০ পৃ।
১৭. উয়াইস কার্নী (রাহ)
তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের বুযুর্গগণের বিষয়ে অগণিত বানোয়াট কথা প্রচলিত। তন্মধ্যে উয়াইস কারনী (রাহ) বিষয়ক গল্পগুলো প্রসিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর জীবদ্দশায় ইয়ামানের ‘‘কার্ন’’ গোত্রের উয়াইস ইবনু আমির নামক এক ব্যক্তির কথা সাহাবীগণকে বলেন এবং তাঁর ওফাতের পরে উমারের (রা) সাথে তাঁর সাক্ষাতের কথা সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী যুগে উয়াইস (রাহ)- কে কেন্দ্র করে অনেক আজগুবি মিথ্যা কথা বানানো হয়েছে। অনেক বক্তা শ্রোতাগণকে বিমুগ্ধ করার জন্য আজগুবি কথা বানিয়েছেন। অনেক সরলপ্রাণ দরবেশ যা শুনেছেন তাই বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে কিছু আছে উয়াইস কেন্দ্রিক। আর কিছু কথা বানানো হয়েছে রাসূলুল্লাহর ﷺ নামে। এগুলো নিঃসন্দেহে বেশি ভয়ঙ্কর ও কঠিনতম গোনাহ।
উয়াইস ইবনু আমির আল-কার্নী (রাহ) সম্পর্কে সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত সহীহ হাদীসে যতটুকু বর্ণিত হয়েছে তার সার সংক্ষেপ হলো: উমার (রা) যখন খলীফা ছিলেন (১৩- ২৩ হি) তখন তাঁর কাছে ইয়ামানের সৈন্যদল আগমন করলে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন? আপনাদের মধ্যে কি উয়াইস ইবনু আমির নামে কেউ আছেন? এভাবে একবার তিনি উয়াইসকে পেয়ে যান। তিনি বলেন: আপনি উয়াইস? উয়াইস বলেন: হাঁ, উমার বলেন: আপনি কারন গোত্রের শাখা মুরাদ গোত্রের মানুষ? তিনি বলেন: হাঁ। উমার বলেন: আপনার শরীরে কুষ্ঠ রোগ ছিল এবং শুধুমাত্র নাভীর কাছে একটি দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া বাকী সব আল্লাহ ভাল করে দিয়েছেন? তিনি বলেন: হাঁ। তিনি বলেন: আপনার আম্মা আছেন? তিনি বলেন: হাঁ। তখন উমার বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,
يَأْتِي عَلَيْكُمْ أُوَيْسُ
بْنُ عَامِرٍ مَعَ أَمْدَادِ أَهْلِ الْيَمَنِ مِنْ مُرَادٍ ثُمَّ مِنْ قَرَنٍ
كَانَ بِهِ بَرَصٌ فَبَرَأَ مِنْهُ إِلاِّ مَوْضِعَ دِرْهَمٍ، لَهُ وَالِدَةٌ هُوَ
بِهَا بَرٌّ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لأَبَرَّهُ فَإِنْ اسْتَطَعْتَ أَنْ
يَسْتَغْفِرَ لَكَ فَافْعَلْ. وفي رواية: إِنَّ خَيْرَ التَّابِعِينَ رَجُلٌ
يُقَالُ لَهُ أُوَيْسٌ ..... فَمُرُوهُ فَلْيَسْتَغْفِرْ لَكُمْ
‘‘ইয়ামানের সৈন্যদলের সাথে উয়াইস ইবনু আমির তোমাদের কাছে আগমন করবে। সে কার্ন গেত্রের শাখা মুরাদ গোত্রের মানুষ। তার শরীরে কুষ্ঠ রোগ ছিল। আল্লাহ এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া বাকী সব ভাল করে দিয়েছেন। তার আম্মা আছেন। সে তার আম্মার সেবা করে। সে যদি আল্লাহর কাছে কসম করে কিছু বলে তবে আল্লাহ তার কথা রাখবেন। যদি তুমি তার কাছে তোমার গোনাহ মাফের জন্য দুআ চাইতে পার তবে চাইবে।’’ অন্য বর্ণনায়: ‘‘তাবিয়ীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘‘উয়াইস’’ নামক এক ব্যক্তি।... তোমরা তাকে বলবে তোমাদের জন্য ক্ষমা চাইতে।’’
একথা বলে উমার (রা) বলেন: আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তখন উয়াইস আল্লাহর কাছে উমারের গোনাহের ক্ষমার জন্য দোয়া করেন। উমার তাঁকে বলেন: আপনি কোথায় যাবেন? তিনি বলেন: আমি কুফায় যাব। উমার বলেন: তাহলে আমি আপনার জন্য কুফার গভর্নরের কাছে চিঠি লিখে দিই? উয়াইস বলেন: অতি সাধারণ মানুষদের মধ্যে মিশে থাকাই আমার বেশি পছন্দ। পরের বছর কুফার একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হজ্জে গমন করেন। তিনি খলীফা উমারের (রা) সাথে দেখা করলে তিনি তাকে উয়াইস সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বলেন: তাকে তো একটি অতি ভগ্ন বাড়ীতে অতি দরিদ্র অবস্থায় দেখে এসেছি। তখন উমর (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপরের হাদীসটি তাকে বলেন। তখন ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কুফায় ফিরে উয়াইসের কাছে গমন করে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার অনুরোধ করেন। উয়াইস বলেন: আপনি তো হজ্জের নেক সফর থেকে ফিরে আসলেন, আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আপনি কি উমারের (রা) সাথে দেখা করেছিলেন? তিনি বলেন: হাঁ। তখন উয়াইস তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে গোনাহের ক্ষমা চান। এ ঘটনার পরে মানুষেরা উয়াইস সম্পর্কে জেনে যায়। ফলে তাঁর কাছে মানুষ আসা যাওয়া করতে থাকে। তখন উয়াইস লোকচক্ষুর আড়ালে কোথাও চলে যান।
পরবর্তী প্রায় দুই দশক উয়াইস কারনী লোকচক্ষুর আড়ালে সমাজের অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করেন। যে এলাকায় যখন বসবাস করতেন সেখানের মসজিদে সাধারণ মুসল্লী হিসাবে নিয়মিত নামাযে ও ওয়ায আলোচনায় বসতেন। কখনো নিজেও কিছু বলতেন। মসজিদে বসে কয়েকজনে কুরআন তিলাওয়াত করতেন বলেও জানা যায়। এভাবেই তিনি বিভিন্ন জিহাদে শরীক হতেন বলে বুঝা যায়। ৩৭ হিজরীতে আলী (রা) ও মু‘আবিয়ার (রা) মধ্যে সিফফীনের যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এ যুদ্ধে উয়াইস কারনী (রাহ) আলীর সেনাদলে ছিলেন। তিনি আলী (রা)-এর পক্ষে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় শহীদ হয়ে যান।[1]
এ হলো তাঁর সম্পর্কে সহীহ বর্ণনা। তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত। যেমন তিনি নাকি তাঁর আম্মাকে বহন করতেন, তিনি নাকি উহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র দাঁত আহত হওয়ার সংবাদে নিজের সকল দাঁত ভেঙে ফেলেছিলেন, ইত্যাদি। এ সকল কথার কোন ভিত্তি পাওয়া যায় না। বলা হয়, উমার (রা) ও আলী (রা) নাকি তাঁর কাছে যেয়ে দেখা করেন বা দোয়া চান। এগুলো সবই মিথ্যা কথা। উপরের সহীহ হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে উয়াইসই উমারের (রা) দরবারে এসেছিলেন।
তবে আরো মারাত্মক তাঁকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বানোয়াট কথা। যেমন বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর ওফাতের পূর্বে তাঁর মুবারক পিরহান উয়াইস কারনীর (রাহ) জন্য রেখে যান এবং উমার (রা) ও আলী (রা) তাঁকে সে পোশাক পৌঁছে দেন। কথাগুলো সবই বানোয়াট। ইবনু দাহিয়া, ইবনুস সালাহ, ইবনু হাজার, সাখাবী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একমত যে, এগুলি সবই বাতিল ও বানোয়াট কথা।[2]
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৬৮-১৯৬৯; আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/৪৮০, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৪৫৫-৪৬১, আবু নুআইম, হিলয়াতুল আউলিয়া ২/৭৯, যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/২০, যিরিকলী, আল-আ’লাম ২/৩২।
[2] ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন ২/২৯৭-২৯৮; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/৩৫০, সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৪৯, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৩৫, নং ৮৫২, ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩২-৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৮১, নং ৭০১, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ১১১, নং ২৩৫, আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/১৮০-১৮১, নং ২০৩৫, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৫৬, নং ৭৮৮।
১৮. হাসান বসরী (রাহ)
হাসান বসরী (২২-১০৯হি) একজন প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট কথা সমাজে প্রচলিত। যেমন, ‘হাসান বসরী’ ও ‘রাবেয়া বসরী’ দুজনের কথাবার্তা, আলোচনা ইত্যাদি আমাদের সমাজে অতি পরিচিত। অথচ দুজন সমবয়সী বা সমসাময়িক ছিলেন না। রাবেয়া বসরী ১০০ হিজরী বা তার কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮০/১৮১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। হাসান বসরী যখন ইন্তেকাল করেন তখন রাবেয়া বসরীর বয়স মাত্র ১০/১১ বছর। এ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এ দুজনকে নিয়ে প্রচলিত গল্পকাহিনীগুলো সবই বানোয়াট।
তবে সবচেয়ে মারাত্মক তাঁকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বানোয়াট কথা। যেমন, প্রচলিত আছে যে, হাসান বসরী আলীর (রা) মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে ‘‘তরীকত’’ গ্রহণ করেন বা চিশতিয়া তরীকতের খিরকা, লাঠি ইত্যাদি গ্রহণ করেন। এ কথাটি ভিত্তিহীন।
হাসান বসরী (রাহ) তাবিয়ীগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজাহিদ, ওয়ায়িয ও সংসারত্যগী বুযুর্গ ছিলেন। তিনি হাদীস ও ফিক্হ শিক্ষা দানের পাশাপাশি জাগতিক লোভ-লালসার বিরুদ্ধে এবং জীবনকে আল্লাহর ভালবাসা ও আখিরাত কেন্দ্রিক করার জন্য ওয়ায করতেন। সঙ্গীগণের সাথে বসে আখিরাতের কথা স্মরণ করে আল্লহর প্রেমে ও আল্লাহর ভয়ে কাঁদাকাটি করতেন। তাঁর এসকল মাজলিসের বিশেষ প্রভাব ছিল সে যুগের মানুষদের মধ্যে। পরবর্তী যুগের অধিকাংশ সূফী দরবেশ তাঁর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর থেকে শিক্ষা নিয়েছেন।
হাসান বসরীর (রাহ) যুগে তাসাউফ, সূফী ইত্যাদি শব্দ অপরিচিত ছিল। এছাড়া প্রচলিত অর্থে তরীকতও অপরিচিত ছিল। তাঁরা মূলত কুরআন ও হাদীসের আলোকে আল্লাহর মহববত ও আখিরাতের আলোচনা করতেন এবং বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত থাকতেন। তরীকতের জন্য নির্দিষ্ট কোন মানুষের কাছে গমনের রীতিও তখন ছিল না। বিভিন্ন সাহাবী ও তাবিয়ীর সামগ্রিক সাহচর্যে মানুষ হৃদয়ের পূর্ণতা লাভ করত। প্রায় ৫০০ বছর পরে, যখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বিচ্ছিন্নতা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ও তাতারদের ভয়াবহ হামলায় ছিন্নভিন্ন, তখন হিজরী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে প্রচলিত তরীকাগুলো প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করে।
কাদিরীয়া তরীকার সম্পর্ক আব্দুল কাদির জীলানীর (মৃ ৫৬১হি/ ১১৬৬ খৃ) সাথে। তবে তিনি প্রচলিত কাদিরীয়া তরীকা প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলিত করেন নি। তাঁর অনেক পরে তা প্রচলিত হয়েছে। রিফায়ী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ ইবনু আলী রিফায়ী (মৃ ৫৭৮ হি)। সোহরাওয়ার্দী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (মৃ. ৬৩২হি)। মুঈনউদ্দীন চিশতী চিশতিয়া তরীকার মূল প্রচারক। তিনি ৬৩৩হি/১২৩৬খৃ ইন্তেকাল করেন। আলী ইবনু আব্দুল্লাহ শাযলী (৬৫৬হি/১২৫৮খৃ) শাযলিয়া তরীকা প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ বুখারী বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (মৃ ৭৯১হি/ ১৩৮৯খৃ) নকশাবন্দিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠা করেন। রাহিমাহুমুল্লাহ- আল্লাহ তাঁদেরকে রহমত করুন। তাঁরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে মাসনূন ইবাদতগুলো বেছে তার আলোকে মুসলিমগণের আধ্যাত্মিক উন্নতির চেষ্টা করেন। প্রকৃতপক্ষে সে অন্ধকার ও কষ্টকর দিনগুলোতে এঁরাই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তী যুগের একটি প্রচলিত কথা হলো, চিশতিয়া তরীকা ও অন্য কিছু তরীকা হাসান বসরী (রাহ) আলীর (রা) মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে লাভ করেছেন। তিনি আলী (রা) থেকে খিরকা বা খিলাফত লাভ করেছেন ও ‘তরীকতের ‘সাজ্জাদ-নশীন’ হয়েছেন। কথাটি ভিত্তিহীন।
হাসান বসরী (রাহ) ২২ হিজরীতে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন ১৩ বছর তখন ৩৫ হিজরীতে আলী (রা) খলীফা নিযুক্ত হন এবং খিলাফতের রাজধানী মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তর করেন। এরপর আর হাসান বসরী (রাহ) আলীকে (রা) দেখেন নি। তিনি আলী (রা)-এর দরবারে বসে শিক্ষা গ্রহণেরই কোনো সুযোগ পান নি। ৪০ হিজরীতে আলী (রা) শহীদ হন। আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, আলী (রা) তাঁর যোগ্যতম সন্তানগণ, অগণিত নেতৃস্থানীয় ভক্ত, ছাত্র ও সহচরদের বাদ দিয়ে ১৩ বছরের কিশোরকে খিরকা ও খিলাফত দিয়ে যান নি বা সাজ্জাদ-নশীন করেন নি। ইবনু দাহিয়া, ইবনুস সালাহ, যাহাবী, ইবনু হাজার, সাখাবী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এগুলো সব ভিত্তিহীন ও বাতিল কথা।[1]
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৩৫; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৮১; আল-মাসনূ, পৃ: ১১১; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/১৮০-১৮১; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৫৬।
১৯. আখেরী যামানার উম্মাতের জন্য চিন্তা
আব্দুল কাদির জীলানীর (রাহ) নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ গ্রন্থের মধ্যে ঢুকানো অগণিত ভিত্তিহীন জাল হাদীসের একটি নিম্নরূপ:
غَمِّيْ لأَجْلِ أُمَّتِيْ
فِيْ آخِرِ الزَّمَانِ
‘‘আমার শেষ যামানার উম্মতের জন্য আমার খুবই চিন্তা!’’[1]
সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ কোনো সনদেই কোনো গ্রন্থে এ কথা পাওয়া যায় না। আমরা আগেই বলেছি এ বইটি পুরোটিই জাল বলে প্রতীয়মান হয়।
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ১৫।
No comments