হাদীসের নামে জালিয়াতি - অধ্যায়-২৫ - বেলায়াত, আওলিয়া ও ইলম বিষয়ক
১. ওলীদের কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতা সত্য
আল্লাহর ওলীগণের পরিচয়, কর্ম ও মর্যাদার বিষয়ে কুরআন-হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। এহইয়াউস সুনান ও রাহে বেলায়াত পু্স্তকদ্বয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে অনেক মিথ্যা কথা মুসলিম সমাজে প্রচার করেছে জালিয়াতগণ। অনেক সরলপ্রাণ নেককার বুযুর্গ সরল মনে এগুলো বিশ্বাস করেছেন। এখানে এ বিষয়ক কিছু কথা উল্লেখ করছি।
১. ওলীদের কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতা সত্য
প্রচলিত একটি গ্রন্থে লেখা হয়েছে: ‘‘আল্লাহ তায়ালার বন্ধুদের শানে কোরান শরীফ ও হাদীস শরীফের কয়েকটি বাণী:.... কারামাতুল আউলিয়া হাক্কুন- আল-হাদীস। অর্থ আউলিয়া-এর অলৌকিক ক্ষমতা সত্য।’’[1]
এখানে এ বাক্যটি ‘আল-হাদীস’ বলে বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী বলে উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে জালিয়াতি করা হয়েছে। এছাড়াও বাক্যটির বিকৃত ও ভুল অনুবাদ করা হয়েছে। এখানে আমরা দুটি বিষয় আলোচনা করব: (১) এ বাক্যটির উৎস ও (২) এ বাক্যটির অর্থ।
প্রথমত: বাক্যটির উৎস
كَرَامَاتُ
الأَوْلِيَاءِ حَقٌّ
‘‘ওলীগণের কারামত সত্য’’ এ বাক্যটি আলিমগণের কথা। এটি কোনো হাদীস নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনোই এ কথা বলেন নি বা তাঁর থেকে কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে তা বর্ণিত হয় নি। উপরন্তু ‘কারামত’ শব্দটিই কুরআন বা হাদীসের শব্দ নয়। নবী ও ওলীগণের অলৌকিক কর্মকে কুরআন ও হাদীসে ‘আয়াত’ বা চিহ্ন বলা হয়েছে। দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দী থেকে নবী-রাসূলগণের ‘আয়াত’কে ‘মুজিযা’ এবং ওলীগণের ‘আয়াত’কে ‘কারামাত’ বলা শুরু হয়।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মু’তাযিলা ও অন্যান্য কিছু সম্প্রদায়ের মানুষেরা ওলীগণের দ্বারা অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করেন। তাদের এ মতটি কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীস প্রমাণ করে যে, নবীগণ ছাড়াও আল্লাহ নেককার মানুষদেরকে কখনো কখনো অলৌকিক চিহ্ন বা ‘আয়াত’ প্রদান করেন। এজন্য সুন্নাত-পন্থী আলিমগণ বলেন: ‘‘কারামাতুল আউলিয়া হাক্ক।’’
দ্বিতীয়ত: বাক্যটির অর্থ
এভাবে আমরা দেখছি যে, এ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী নয়; বরং আলিমগণের বক্তব্য। কাজেই বাক্যটিকে ‘হাদীস’ বলে জালিয়াতি করা হয়েছে। এছাড়া উপরের উদ্ধৃতিতে বাক্যটির ভুল অনুবাদ করা হয়েছে। ফলে অনুবাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জালিয়াতি ঘটেছে।
ক. ‘কারামত’ বনাম ‘অলৌকিক ক্ষমতা’
এ বাক্যে তিনটি শব্দ রয়েছে: কারামত, আউলিয়া, হক্ক। উপরের উদ্ধৃতিতে প্রথম শব্দ ‘কারামত’-এর অনুবাদ করা হয়েছে ‘অলৌকিক ক্ষমতা’। এ অনুবাদটি শুধু ভুলই নয়, বরং ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। কারামত অর্থ অলৌকিক কর্ম বা চিহ্ন, অলৌকিক ক্ষমতা নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোনোরূপ ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ আছে বলে বিশ্বাস করা শির্ক।
‘কারামত’ শব্দটির মূল অর্থ ‘সম্মাননা’। ইসলামী পরিভাষায় ‘কারামত’ অর্থ ‘নবী-রাসূলগণ ব্যতীত অন্যান্য নেককার মানুষের দ্বারা সংঘটিত অলৌকিক কর্ম।’ ‘অলৌকিক চিহ্ন’কে ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ মনে করা শির্কের অন্যতম কারণ। খৃস্টানগণ দাবি করেন, ‘মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা ঈশ্বর ছাড়া কারো নেই, যীশু মৃতকে জীবিত করেছেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, যীশু ঈশ্বর বা তাঁর মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল।
কুরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে যে, কোনো অলৌকিক কর্ম বা চিহ্ন কোনো নবী-রাসূল বা কেউ নিজের ইচ্ছায় ঘটাতে বা দেখাতে পারেন না; শুধুমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটতে পারে। কোনো ওলী বা নেককার ব্যক্তি কর্তৃক কোনো অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হওয়ার অর্থ এ নয় যে, এ কর্মটি সম্পাদন করা সে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বা তার নিজের ক্ষমতা। এর অর্থ হলো একটি বিশেষ ঘটনায় আল্লাহ তাকে সম্মান করে একটি অলৌকিক চিহ্ন প্রদান করেছেন। অন্য কোনো সময়ে তা নাও দিতে পারেন।
একটি উদাহরণ দেখুন। নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত, ২৩ হিজরীর প্রথম দিকে উমার (রা) মসজিদে নাবাবীতে জুমুআর খুতবা প্রদান কালে উচ্চস্বরে বলে উঠেন: (يا سارية، الجبلَ) ‘‘হে সারিয়া, পাহাড়।’’ সে সময়ে মুসলিম সেনাপতি সারিয়া ইবনু যুনাইম পারস্যের এক যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার উপক্রম করছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি উমারের এ বাক্যটি শুনতে পান এবং পাহাড়ের আশ্রয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন।[2]
এ ঘটনায় আমরা উমার (রা)-এর একটি মহান কারামত দেখতে পাই। তিনি হাজার মাইল দূরের যুদ্ধ ক্ষেত্রের অবস্থা ‘অবলোকন’ করেছেন, মুখে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে নির্দেশনা সারিয়া শুনতে পেয়েছেন।
এ কারামতের অর্থ হলো, মহান আল্লাহ তাঁর এ মহান ওলীকে এ দিনের এ মুহূর্তে এ বিশেষ ‘সম্মাননা’ প্রদান করেন, তিনি দূরের দৃশ্যটি হৃদয়ে অনুভব করেন, নির্দেশনা দেন এবং তাঁর নির্দেশনা আল্লাহ সারিয়ার কাছে পৌঁছে দেন। এর অর্থ এ নয় যে, উমার (রা)-এর হাজার মাইল দূরের সব কিছু অবলোকন করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, অথবা তিনি ইচছা করলেই এভাবে দূরের কিছু দেখতে পেতেন বা নিজের কথা দূরে প্রেরণ করতে পারতেন।
এ বছরেরই শেষে ২৩ হিজরীর যুলহাজ্জ মাসের ২৭ তারিখে ফজরের সালাত আদায়ের জন্য যখন উমার (রা) তাকবীরে তাহরীমা বলেন, তখন তাঁরই পিছেন চাদর গায়ে মুসল্লীরূপে দাঁড়ানো আল্লাহর শত্রু আবূ লু’লু লুকানো ছুরি দিয়ে তাঁকে বারংবার আঘাত করে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে যান। চেতনা ফিরে পেলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে কে আঘাত করল? তাঁকে বলা হয়, আবূ ল’লু। তিনি বলেন, আল-হামদু লিল্লাহ, আমাকে কোনো মুসলিমের হাতে শহীদ হতে হলো না। এর কয়েকদিন পর তিনি ইন্তিকাল করেন।[3]
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মহান আল্লাহ প্রথম ঘটনায় হাজার মাইল দূরের অবস্থা উমারকে দেখিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় পাশে দাঁড়ানো শত্রুর বিষয়ে তাঁকে জানতে দেন নি। কারণ ‘কারামত’ কখনোই ক্ষমতা নয়, কারমাত আললাহর পক্ষ থেকে দেয়া সম্মাননা মাত্র।
খ. ওলী ও আউলিয়া
ওলী ও বেলায়াতের অর্থ, পরিচয় ও বেলায়াত অর্জনের সুন্নাত পদ্ধতি জানতে পাঠককে আমরা লেখা ‘রাহে বেলায়াত’ বইটি পাঠ করতে অনুরোধ করছি। মূলত ‘বেলায়াত’ (الولاية) শব্দের অর্থ বন্ধুত্ব, নৈকট্য, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। ‘‘বেলায়েত’’ অর্জনকারীকে ‘‘ওলী’’ (الولي), অর্থাৎ বন্ধু, নিকটবর্তী বা অভিভাবক বলা হয়। ওলীদের পরিচয় প্রদান করে মহান আল্লাহ বলেন:
أَلا
إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ
آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ
‘‘জেনে রাখ! নিশ্চয় আল্লাহর ওলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা চিন্তাগ্রস্তও হবেন না- যারা ঈমান এনেছেন এবং তাকওয়া অবলম্বন করেন।’’[4]
‘‘ঈমান’’ অর্থ তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি বিশুদ্ধ বিশ্বাস- যে বিশ্বাস শিরক, কুফর ও বিদআত থেকে মুক্ত। ‘‘তাকওয়া’’ শব্দের অর্থ আত্মরক্ষা করা। ফরয-ওয়াজিব পালন ও হারাম-পাপ বর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষার নাম-ই তাকওয়া। এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানছি যে, দুটি গুণের মধ্যে ওলীর পরিচয় সীমাবদ্ধ। ঈমান ও তাকওয়া। এ দু’টি গুণ যার মধ্যে যত বেশি ও যত পরিপূর্ণ হবে তিনি বেলায়াতের পথে তত বেশি অগ্রসর ও আল্লাহর তত বেশি ওলী বা প্রিয় বলে বিবেচিত হবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওলীর বা বেলায়াতের পথের কর্মকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন: ফরয ও নফল। সকল ফরয পালনের পরে অনবরত বেশি বেশি নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্যের পথে বেশি বেশি অগ্রসর হতে থাকে।
এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক মুসলিমই আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়া যার মধ্যে যত বেশি থাকবে তিনি তত বেশি ওলী। ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (৩২১হি) ইমাম আবু হানীফা, মুহাম্মাদ, আবু ইউসূফ (রাহ) ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা বর্ণনা করে বলেন:
اَلْمُؤْمِنُوْنَ
كُلُّهُمْ أَوْلِيَاءُ الرَّحْمَنِ، وَأَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللهِ أَطْوَعُهُمْ
وَأَتْبَعُهُمْ لِلْقُرْآنِ
‘‘সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর কাছে কারামত-প্রাপ্ত (ততবেশি ওলী বা ততবেশি সম্মানিত)।[5]
তাহলে ওলী ও বেলায়েতের মানদন্ড হচ্ছে: ঈমান ও তাকওয়া: সকল ফরয কাজ আদায় এবং বেশি বেশি নফল ইবাদত করা। যদি কোনো মুসলিম পরিপূর্ণ সুন্নাত অনুসারে সঠিক ঈমান সংরক্ষণ করেন, সকল প্রকারের হারাম ও নিষেধ বর্জনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করেন, তাঁর উপর ফরয যাবতীয় দায়িত্ব তিনি আদায় করেন এবং সর্বশেষে যথাসম্ভব বেশি বেশি নফল ইবাদত আদায় করেন তিনিই আল্লাহর ওলী বা প্রিয় মানুষ। এ সকল বিষয়ে যিনি যতুটুকু অগ্রসর হবেন তিনি ততটুকু আল্লাহর নৈকট্য বা বেলায়াত অর্জন করবেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ‘বেলায়াত’ কোনো পদ-পদবী নয় এবং ইসলামের ‘ওলী’ বলে কোনো বিশেষ পদ বা পর্যায় নেই। প্রত্যেক মুমিনই ওলী। যে যত বেশি ঈমান ও তাকওয়া অর্জন করবেন তিনি তত বেশি ওলী।
গ. হক্ক
‘কারমাতুল আউলিয়া হক্ক’ বা ‘ওলীগণের অলৌকিক কর্ম সত্য’ অর্থ ওলীগণ থেকে অলৌকিক কর্ম প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। যদি কোনো বাহ্যত মুমিন মুত্তাকী মানুষ থেকে কোনো অলৌকিক কার্য প্রকাশ পায় বা এরূপ ঈমানদার-মুত্তাকী মানুষ থেকে অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয়েছে বলে সহীহ সনদে জানা যায় তবে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সম্মাননা বলে বুঝতে হবে। তা অস্বীকার করা বা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়া মু‘তাযিলীদের আকীদা।
‘ওলীদের কারামত সত্য’ বলতে দু প্রকারে ভুল অর্থ করা হয়:
(১) কেউ মনে করেন, ওলীদের নামে যা কিছু কারামত বা অলৌকিক কথা বলা হবে সবই সত্য মনে করতে হবে। কথাটি জঘন্য ভুল। আমরা দেখেছি, যাচাই ছাড়া কোনো সংবাদ গ্রহণ করতে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ নিষেধ করেছেন। কথিত, লিখিত বা বর্ণিত কথাগুলি যাচাই ছাড়া গ্রহণ ও বর্ণনা করা হাদীসে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং এরূপ ব্যক্তিকে মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করা হয়েছে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে যা কিছু কথিত বা বর্ণিত হয় তা যাচাই ছাড়া বিশ্বাস বা গ্রহণ করা যেমন হারাম, তেমনি ওলীগণের নামে কথিত, লিখিত বা বর্ণিত কোনো তথ্য সনদ যাচাই ছাড়া গ্রহণ, বর্ণনা বা বিশ্বাস করাও হারাম। প্রকৃত সত্য যে, জাল হাদীসের মত অগণিত ‘জাল’ কারামত ওলীদের নামে সমাজে ছড়ানো হয়েছে।
(২) কেউ মনে করেন যে, ‘ওলীগণের কারামত সত্য’ অর্থ ওলীগণের কারামত থাকতেই হবে বা কারামতই ওলীগণের আলামত বা চিহ্ন। এ ধারণাটি কঠিন ভুল। ঈমান ও তাকওয়া ছাড়া ওলীর আর কোনো পরিচয় নেই। ঈমান ও আমালের বাহ্যিক প্রকাশ ছাড়া ‘ওলী’-র পরিচয়ের জন্য কেনো চিহ্ন, মার্কা বা সার্টিফিকেট নেই। কোনো ‘কারামত’ কখনোই বেলায়াতের মাপকাঠি নয়। আল্লাহর প্রিয়তম ওলীর কোনো প্রকার কারামত নাও থাকতে পারে। আমরা জানি আল্লাহর প্রিয়তম ওলী সাহাবায়ে কেরামের অধিকাংশেরই কোনো কারামত বর্ণিত হয় নি। আবার পাপী বা কাফির মুশরিক থেকেও অলৌকিক কার্য প্রকাশিত হতে পারে। সর্বোপরি কারামতের অধিকারী ওলীও কোনো বিশেষ পদমর্যাদার ব্যক্তি নন বা পদস্খলন থেকে সংরক্ষিত নন। কর্মে ত্রুটি হলে তিনি শাস্তিভোগ করবেন। কুরআন উল্লেখ করেছে যে, কারামতের অধিকারী ওলীও গোমরাহ ও বিভ্রান্ত হয়েছেন।[6]
[1] খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ), রাহাতুল মুহিববীন, শেষ প্রচ্ছদ।
[2] তাবারী, তারীখ ২/৫৫৩-৫৫৪; বাইহাকী, আল-ই’তিকাদ,পৃ. ৩১৪; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ৩/৫-৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪৬৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫১৪-৫১৫।
[3] ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ৭/১৩০-১৩৮।
[4] সূরা (১০) ইউনূস: ৬২-৬৩ আয়াত।
[5] ইমাম তাহাবী, আল-আকীদাহ (শারহ সহ), পৃ: ৩৫৭-৩৬২।
[6] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৭৫-১৭৭ আয়াত। দেখুন: তাবারী, তাফসীর ৯/১১৯-১৩০, ইবনু কাসির, তাফসীর ২/২৬৫-২৬৮।
২. ওলীগণ মরেন না
আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি বাক্য:
إِنَّ
أَوْلِيَاءَ اللهِ لاَ يَمُوْتُوْنَ، بَلْ يَنْتَقِلُوْنَ مِنْ دَارِ الْفَنَاءِ
إِلَى دَارِ الْبَقَاءِ
প্রচলিত একটি পুস্তকে এ বাক্যটির অনুবাদ লেখা হয়েছে: ‘‘নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোন মৃত্যু নেই বরং তাঁরা স্থানান্তরিত হয় ধ্বংসশীল ইহ জগৎ হতে স্থায়ী পরজগতে’’-আল হাদীস।[1]
এখানে উল্লেখ্য যে, আব্দুল কাদির জীলানীর (রাহ) নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ পুস্তকে এ হাদীসটি অন্যভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
اَلْمُؤْمِنُوْنَ
لاَ يَمُوْتُوْنَ، بَلْ يَنْتَقِلُوْنَ مِنْ دَارِ الْفَنَاءِ إِلَى دَارِ
الْبَقَاءِ
‘‘মুমিনগণের কোন মৃত্যু নেই বরং তাঁরা স্থানান্তরিত হয় ধ্বংসশীল ইহজগৎ হতে স্থায়ী পরজগতে।’’
দুটি কথাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে জঘন্য মিথ্যা, বানোয়াট ও জাল কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট সনদেও তা বর্ণিত হয় নি।
আমরা জানি যে, মুমিন-কাফির প্রতিটি মানুষই মৃত্যুর মাধ্যমে ‘‘ধ্বংসশীল ইহ জগৎ থেকে স্থায়ী পরজগতে স্থানান্তরিত হয়।’’ এখানে কারো কোনো বিশেষত্ব নেই। কুরআন ও হাদীস দ্বারা শহীদগণের পারলৌকিক বিশেষ জীবন প্রমাণিত। সহীহ হাদীসের আলোকে নবীগণের পারলৌকিক বিশেষ জীবন প্রমাণিত। এছাড়া অন্য কোনো নেককার মানুষের পারলৌকিক বিশেষ কোনো জীবন প্রমাণিত নয়। আলিমগণ, ওলীগণ, মুআযযিনগণ... ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার নেককার মানুষের মৃত্যু পরবর্তী ‘হায়াত’ বা জীবন সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় সবই সনদ বিহীন, ভিত্তিহীন কথা।[2]
[1] খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ), রাহাতুল মুহিববীন, শেষ প্রচ্ছদ।
[2] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৯৫-২৯৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৩৫।
৩. ওলীগণ কবরে সালাত আদায়ে রত
ওলীগণের পারলৌকিক জীবন বিষয়ক আরেকটি জাল কথা
اَلأَنْبِيَاءُ
وَالأَوْلِيَاءُ يُصَلُّوْنَ فِيْ قُبُوْرِهِمْ كَمَا يُصَلُّوْنَ فِيْ
بُيُوْتِهِمْ
‘‘নবীগণ ও ওলীগণ তাঁদের কবরের মধ্যে সালাত আদায় করেন, যেমন তাঁরা তাঁদের বাড়িতে সালাত আদায় করেন।’’ [1]
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, নবীগণের ক্ষেত্রে হাদীসটি সহীহ। তবে এখানে ‘ওলীগণ’ শব্দটির সংযোগ বানোয়াট।
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ৫৫।
৪. ওলীগণ আল্লাহর সুবাস
প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছে: ‘‘আল-আউলিয়াও রায়হানুল্লাহ- আল হাদীস। অর্থ আউলিয়া আল্লাহর সুবাস।’’[1]
কথাটি কোনো কোনো বুজুর্গ বলেছেন, হাদীস হিসেবে এটি জাল। ওলীগণকে আল্লাহর সুবাস বলায় কোনো অসুবিধা নেই। আল্লাহর রিযককে আল্লাহর সুবাস বলা হয়েছে, সন্তানকেও আল্লাহর সুবাস বলা হয়েছে।[2] কিন্তু এ কথাটিকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলতে হলে সহীহ সনদে তা বর্ণিত হতে হবে। কিন্তু এ কথাটির কোনো জাল সনদও নেই।
[1] খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ), রাহাতুল মুহিববীন, শেষ প্রচ্ছদ।
[2] তাবারী, তাফসীর ২৭/১২৩; হাকীম তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল ২/৫৯; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/৬২১।
৫. ওলীগণ আল্লাহর জুববার অন্তরালে
প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছে: ‘‘ইন্না আউলিয়াই তাহ্তা কাবাই লা ইয়ারিফুহুম গাইরী ইল্লা আউলিয়াই।- হাদীসে কুদসী। অর্থ: নিশ্চয়ই আমার বন্ধুগণ আমার জুববার অন্তরালে অবস্থান করেন, আমি ভিন্ন তাঁদের পরিচিতি সম্বন্ধে কেহই অবগত নহে, আমার আউলিয়াগণ ব্যতীত।’’[1]
এটিও একটি ভিত্তিহীন ও জাল কথা। সহীহ, যয়ীফ বা জাল কোনো সনদে এ কথাটি বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় নি। সনদবিহীন অন্যান্য জাল হাদীসের মত এ কথাটিও সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। আর নবম-দশম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম ভিত্তিহীন জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে সনদ বিহীন ভাবে এ কথাটি তাদের পুস্তকে উল্লেখ করেছেন।[2]
[1] খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ), রাহাতুল মুহিববীন, শেষ প্রচ্ছদ।
[2] জুরজানী, আলী ইবনু মুহাম্মাদ (৮১৬হি), তা’রীফাত, পৃ. ২৯৫; মুনাবী, মুহাম্মাদ আব্দুর রাঊফ (১০৩১হি); তা’আরীফ, পৃ. ৬৭৬; মোল্লা আলী কারী, মিরকাত (শামিলা) ১৫/২৫৬।
৬. ওলীদের খাস জান্নাত: শুধুই দীদার
আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে যে, আল্লাহর খাস ওলীগণ জান্নাতের নেয়ামতের জন্য ইবাদত করেন না, বরং শুধুই ‘মহববত’ বা ‘দীদারের’ জন্য। এ অবস্থাকে ‘সর্বোচ্চ’ অবস্থা বলে মনে করা হয়। এ মর্মে একটি জাল হাদীস:
إِنَّ
للهِ جَنَّةً لاَ فِيْهَا حُوْرٌ وَلاَ قَصْرٌ وَلاَ عَسَلٌ وَلاَ لَبَنٌ
‘‘আল্লাহর এমন একটি জান্নাত আছে যেখানে হুর, অট্টালিকা, মধু এবং দুগ্ধ নেই। (বরং শুধু দীদারে ইলাহী-মাওলার দর্শন)।’’ কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, সনদবিহীন একটি জাল কথা।[1]
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ১৯-২০।
৭. ওলী-আল্লাহদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারাম!
উপরের অর্থেই আরেকটি বানোয়াট কথা:
اَلدُّنْيَا
حَرَامٌ عَلَى أَهْلِ الآخِرَةِ، وَالآخِرَةُ حَرَامٌ عَلَى أَهْلِ الدُّنْيَا،
وَالدُّنْيَا وَالآخِرَةُ حَرَامٌ عَلَى أَهْلِ اللهِ
‘‘আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া হারাম আর দুনিয়া-ওয়ালাদের জন্য আখিরাত হারাম। আর আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই হারাম।’’ (অর্থাৎ উভয়কে হারাম না করে আল্লাহওয়ালা হওয়া যায় না)
দাইলামী (৫০৯ হি) ‘ফিরদাউস’-এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তাঁর পুত্র আবূ মানসূর দাইলামী (৫৫৮হি) তার ‘মুসনাদুল ফিরদাউস’ গ্রন্থে এর একটি সনদ উল্লেখ করেছেন। সনদের অধিকাংশ রাবীই একেবারে অজ্ঞাত পরিচয়। অন্যরা দুর্বল। এজন্য হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করা হয়েছে।[1]
এ হাদীসে বলা হয়েছে যে, (১) আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া হারাম এবং (২) আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া আখিরাত উভয়ই হারাম। এ কথা দুটি কুরআন কারীম ও অগণিত সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। মহান আল্লাহ ঠিক এর বিপরীত কথা বলেছেন। তিনি তাঁর প্রিয়তম রাসূল ﷺ ও শ্রেষ্ঠতম আল্লাহ-ওয়ালা সাহাবীগণসহ সকল আল্লাহওয়ালা ও আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সৌন্দর্য ও আনন্দ হারাম করেন নি বলে ঘোষণা করেছেন: ‘‘আপনি বলুন: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সৌন্দর্য ও পবিত্র আনন্দ ও মজার বস্তগুলো বের (উদ্ভাবন) করেছেন তা হারাম বা নিষিদ্ধ করলো কে? আপনি বলুন: সেগুলো মুমিনদের জন্য পার্থিব জীবনে এবং কিয়ামতে শুধুমাত্র তাদের জন্যই।’’[2]
এরূপ একটি জাল কথা: ‘‘ঐ ব্যক্তি আমার প্রিয়তম যে আমাকেই চায় শাস্তির ভয়ে কিংবা পুরস্কারের আশায় নহে।... তাহা অপেক্ষা অপরাধী কে, যে দোজখের ভয়ে কিংবা বেহেশতের আশায় আমাকে অর্চ্চনা করে..।’’[3]
কুরআনে ‘আল্লাহওয়ালা’ ও ‘আখেরাতওয়ালা’দিগকে দুনিয়া ও আখিরাতের নেয়ামত প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ সর্বদা এভাবে দোয়া করতেন। আর আখিরাতের নেয়ামত তো আল্লাহওয়ালা ও আখেরাতওয়ালাদের মূল কাম্য। আল্লাহওয়ালা হতে হলে, জান্নাতের নিয়ামতের আশা আকাঙ্খা বর্জন করতে হবে, এ ধারণাটি কুরআন ও হাদীসের সুষ্পষ্ট বিরোধী। কোনো কোনো নেককার মানুষের মনে এরূপ ধারণা আসতে পারে। তবে রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণ সর্বদা জান্নাতের নিয়ামত চেয়েছেন, সাহাবীগণকে বিভিন্ন নিয়ামতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সর্বোপরি মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে সর্বোচ্চ মর্যাদার নবী-ওলীগণ এবং সাধারণ ওলীগণ সকলের জন্য জান্নাতের নিয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন।
[1] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ২/২৩০; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৪৯৩; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১০৫-১০৬।
[2] সূরা (৭) আ’রাফ: ৩১-৩২ আয়াত।
[3] আলহাজ্জ খান বাহাদুর আহছানউল্লা (ই. ফা. বা. ২য় সংস্করণ ২০১১) পৃষ্ঠা ৬৯।
৮. শরীয়ত, তরীকত, মারিফত ও হাকীকত
এগুলো সমাজে প্রচলিত অতি পরিচিত চারটি পরিভাষা। কুরআন-হাদীসে ‘‘শরীয়ত’’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামের চারটি পর্যায় বা স্তর অর্থে তরীকত, মারেফত ও হাকীকত পরিভাষাগুলো কুরআন বা হাদীসে কোথাও ব্যবহৃত হয় নি। কখনোই কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, প্রসিদ্ধ চার ইমাম বা অন্য কেউ ইসলামের চারটি স্তর বা পর্যায় হিসেবে এ পরিভাষাগুলি ব্যবহার করেন নি। প্রথমে শীয়াগণ এগুলি উদ্ভাবন ও ব্যবহার করেন। পরে সুন্নী সরল সূফীগণের মধ্যে পরিভাষাগুলি প্রসার লাভ করে। বিশেষত, ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর পর মিসর, ইয়ামান, ইরান, ইরাক, বাগদাদ ও মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শীয়াগণের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে শীয়া আকীদার অনেক কিছুই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ সুযোগে জালিয়াতগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে হাদীস বানিয়ে বলেছে:
اَلشَّرِيْعَةُ
شَجَرَةٌ وَالطَّرِيْقَةُ أَغْصَانُهَا وَالْمَعْرِفَةُ أَوْرَاقُهَا
وَالْحَقِيْقَةُ ثَمَرُهَا
‘‘শরীয়ত একটি বৃক্ষ, তরীকত তার শাখা-প্রশাখা, মারিফত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল।’’[1]
মিথ্যাচারিদের আল্লাহ লাঞ্চিত করুন। তাদের বানানো আরেকটি কথা:
اَلشَّرِيْعَةُ
أَقْوَالِيْ وَالطَّرِيْقَةُ أَفْعَالِيْ وَالْحَقِيْقَةُ حَالِيْ وَالْمَعْرِفَةُ
رَأْسُ مَالِيْ
‘‘শরীয়ত আমার কথাবার্তা, তরীকত আমার কাজকর্ম, হাকীকত আমার অবস্থা এবং মারিফাত আমার মূলধন।’’[2]
আরবী মা’রিফাত (المعرفة) শব্দটি আরাফা (عرف) ক্রিয়াপদ থেকে গৃহীত। এর অর্থ (إدارك الشيء بحاسة من حواسه) কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে কোনো কিছু অবগত হওয়া বা পরিচয় লাভ করা। এভাবে মূলত ইন্দ্রিয়-লব্ধ জ্ঞান বা পরিচয়কে ‘‘মারিফাত’’ বলা হয়। তবে সাধারণত ‘মারিফাত’ বলতে ‘‘জ্ঞান’’, ‘‘পরিচয়’’ বা শিক্ষা (knowledge, education)
বুঝানো হয়।
‘‘শরীয়ত, তরীকত, হাকীকাত ও মারিফাত’’ এ পর্যায়ক্রমিক ধারায় ‘‘মারিফাত’’-কে শরীয়তের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে কুরআন-সুন্নাহ সুস্পষ্টভাবেই মারিফাতকে শরীয়তের নিম্নের স্থান দিয়েছে। ‘জ্ঞান’ অর্থে ‘মারিফাত’ ঈমান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আল্লাহর মারিফাত বা আল্লাহর পরিচয় লাভ মানুষকে তাঁর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসের দিকে ধাবিত করে। তবে কুরআন-হাদীসে মূলত ‘‘ইলম’’ এবং ‘‘ফিকহ’’-এর প্রশংসা করা হয়েছে, ‘‘মারিফাত’’-এর কোনো বিশেষ প্রশংসা করা হয় নি। ‘‘মারিফাত’’ ঈমানের পথে পরিচালিত করলে তা প্রশংসনীয়। উপরন্তু কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের পরেও মানুষ কুফর বা অবিশ্বাসে লিপ্ত হয়। কুরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদী-খৃস্টানদের অনেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর দীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের পরেও কুফরী করত।[3] অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
فَلَمَّا
جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ
‘‘অতঃপর যখন তাদের নিকট তা (কুরআন) আগমন করল, তারা তার মারিফাত অর্জনের (প্রকৃত পরিচয় জানার) পরেও কুফরী করল।’’[4]
يَعْرِفُونَ
نِعْمَةَ اللَّهِ ثُمَّ يُنْكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘আল্লাহর নিয়ামতের মারিফাত (প্রকৃত পরিচয়) তারা লাভ করে- অতঃপর তারা তা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই কাফির।’’[5]
কুরআন-সুন্নাহ মুমিনদেরকে ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের নির্দেশ দেয় নি, বরং ইলম অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে; কারণ ‘‘মারিফাত’’ তো ঈমান অর্জনের পূর্বের অবস্থা। কিন্তু শীয়াগণ মারিফাতকে ঈমান, ইসলাম ও শরীয়ত থেকে পৃথক উচ্চপর্যায়ের বিষয় বলে প্রচার করেন এবং মারিফাতকে ‘‘তত্ত্বজ্ঞান’’ বা গোপন বা পৃথক কোনো জ্ঞান বলে প্রচার করেন। এ সকল বিভ্রান্তির অপনোদনে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর নিম্নের বক্তব্য প্রণিধানযোগ:
نَعْرِفُ
اللهَ تَعَالَي حَقَّ مَعْرِفَتِهِ كَمَا وَصَفَ اللهُ نَفْسَهُ فِيْ كِتَابِهِ
بِجَمِيْعِ صِفَاتِهِ .. وَيَسْتَوِيْ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ فِيْ
الْمَعْرِفَةِ وَالْيَقِيْنِ وَالتَّوَكُّلِ وَالْمَحَبَّةِ وَالرِّضَا
وَالْخَوْفِ وَالرَّجَاءِ وَالإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ، وَيَتَفَاوَتُوْنَ فِيْمَا
دُوْنَ الإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ كُلِّهِ.
‘‘মহান আল্লাহর প্রকৃত মা’রিফাত আমরা লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। ... মুমিনগণ সকলেই সমান মারিফাতের বিষয়ে, এবং ইয়াকীন, তাওয়াক্কুল, মাহাববাত, রিযা (সন্তুষ্টি), খাওফ (ভয়), রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।’’[6]
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বক্তব্য থেকে দুটি বিষয় সুস্পষ্ট: (১) মারিফাত ঈমানেরই সহযাত্রী। আল্লাহর সত্যিকার মারিফাত লাভই ঈমানের পথে পরিচালিত করে; এজন্য সকল মুমিনই আল্লাহর হক্ক বা প্রকৃত মারিফাত লাভ করেছেন এবং এ বিষয়ে তাঁরা সকলেই সমমর্যাদার। (২) আল্লাহর মারিফাত গোপন কোনো তত্ত্বজ্ঞান নয় বা তা অর্জনের জন্য গোপন কোনো পথ নেই। মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে যা জানিয়েছেন তা অবগত হওয়াই তাঁর প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মারিফাত।
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ৩৩।
[2] আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৬।
[3] সূরা (২) বাকারা: ১৪৬; সূরা (৬) আনআম: ২০ আয়াত।
[4] সূরা (২) বাকারা: ৮৯ আয়াত।
[5] সূরা (১৬) নাহল: ৮৩ আয়াত।
[6] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আকবার (মোল্লা আলী কারীর ব্যাখ্যা-সহ), পৃ. ১৫১-১৫৭।
৯. ছোট জিহাদ ও বড় জিহাদ
কথিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে বলেন:
رَجَعْنَا
مِنَ الْجِهَادِ الأَصْغَرِ إِلَى الْجِهَادِ الأَكْبَرِ... جِهَادُ الْقَلْبِ/
مُجَاهَدَةُ الْعَبْدِ هَوَاهُ
‘‘আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম। ... বড় জিহাদ হলো মনের সাথে জিহাদ বা নিজের প্রবৃত্তির সাথে সংগ্রাম।’’
ইবনু তাইমিয়া হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বাতিল বলে গণ্য করেছেন। ইরাকী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি দুর্বল সনদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে সহীহ সনদে কথাটি ইবরাহীম ইবনু আবী আবলা (১৫২ হি) নামক প্রসিদ্ধ তাবিয়ী থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এজন্য ইবনু হাজার আসকালানী বলেছেন যে, হাদীসটি মূলত এ তাবিয়ীর বক্তব্য। অনেক সময় দুর্বল রাবীগণ সাহাবী বা তাবিয়ীর কথাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসেবে বর্ণনা করেন।[1]
[1] তাহির পাটনী, তাযকিরাহ, পৃ. ১৯১; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ১২৭; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৫১১; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ১৫৩; আলবানী, যায়ীফাহ ৫/৪৭৮-৪৮১।
১০. প্রবৃত্তির জিহাদই কঠিনতম জিহাদ
আমাদের সমাজে এ অর্থে আরেকটি ‘হাদীস’ প্রচলিত:
أَشَدُّ
الْجِهَادِ جِهَادُ الْهَوَى
‘‘সবচেয়ে কঠিন জিহাদ প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ।’’
কথাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা নয়। তাঁর কথা হিসেবে কোনো সনদেই তা বর্ণিত হয় নি। প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ইবরাহীম ইবনু আদহাম (১৬১হি) থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত।[1]
উল্লেখ্য যে, এ অর্থের কাছাকাছি সহীহ হাদীস রয়েছে। ফুদালাহ ইবনু উবাইদ (রা) বলেন, বিদায় হজ্জের ওয়াযের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
الْمُجَاهِدُ
مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ للَّهِ (وفي رواية: فِي طَاعَةِ اللَّهِ)
‘‘আর মুজাহিদ তো সে ব্যক্তি যে আল্লাহর জন্য/ আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজের প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ করে।’’[2]
দুঃখজনক যে, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে সংকলিত সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে ভিত্তিহীন বানোয়াট কথাগুলো আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলি।
[1] আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৮/১৮; বাইহাকী, কিতাবুয যুহদ ২/১৫২।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/১৬৫; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১১/২০৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৫৪; হাইসামী, মাওয়ারিদ ১/১২৭-১২৮; মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/২৬৮।
১১. আলিম বনাম আরিফ
আমরা একটু আগেই শরীয়ত-মারিফাত বিষয জেনেছি। মারিফাত অর্জনকারীকে ‘আরিফ’ এবং ইলম অর্জনকারীকে ‘আলিম’ বলা হয়। আমরা দেখেছি যে, কুরআন ও হাদীসে মারিফতের কোনো প্রশংসা করা হয় নি; বরং ইলমের প্রশংসা করা হয়েছে। ‘মারিফাত’ অর্থে ‘তত্ত্বজ্ঞান’, ‘গুপ্তজ্ঞান’ বা ‘বিশেষজ্ঞান’ বুঝাতে, ‘আরিফ’ বলতে তত্ত্বজ্ঞানী বুঝাতে, আলিম (ইলম অর্জনকারী) এবং আরিফ (মারিফাত অর্জনকারী)-এর মধ্যে পার্থক্য বুঝাতে বা আরিফের মর্যাদা বুঝাতে কুরআন ও হাদীসে কোনো কিছুই বলা হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা। এরূপ একটি জাল হাদীস:
اَلْعَالِمُ
يَتَنَقَّشُ وَالْعَارِفُ يَصْقِلُ
‘‘আলিম নকশা অঙ্কিত করে এবং আরিফ (খোদাতত্ব জ্ঞানে জ্ঞানী) তা পরিষ্কার করে।’’[1]
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ৪৯।
১২. আল্লাহর স্বভাব গ্রহণ কর
সূফীগণের মধ্যে প্রচলিত একটি ভিত্তিহীন সনদবিহীন জাল ‘হাদীস’:
تَخَلَّقُوْا
بِأَخْلاَقِ اللهِ
‘‘তোমরা আল্লাহর আখলাক বা স্বভাব-আচরণ গ্রহণ কর।’’[1]
[1] মুনাবী, আত-তা‘আরীফ, পৃ. ৫৬৪; সিররুল আসরার, পৃ. ৫০।
১৩. একা হও আমার নিকটে পেঁছাবে
تَجَرَّدْ
تَصِلْ إِلَيَّ
‘‘একা হও আমার কাছে পৌঁছাবে।’’[1]
উপরের কথাগুলি সবই সনদহীন, ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ সনদেও এ কথাগুলো বর্ণিত হয়নি।
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ৭৮।
১৪. সামা বা প্রেম-সঙ্গীত শ্রবণ কারো জন্য ফরয...
‘সামা’ (সেমা) অর্থ ‘শ্রবণ’’। সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগে ‘সামা’ বলতে কুরআন শ্রবণ ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবনী ও বাণী শ্রবণকেই বোঝান হতো। এগুলোই তাঁদের মনে আল্লাহ-প্রেম ও নবী-প্রেমের জোয়ার সৃষ্টি করত। কোনো মুসলিম কখনই আল্লাহর প্রেমের জন্য গান শুনতেন না। সমাজের অধার্মিক মানুষদের মধ্যে বিনোদন হিসাবে গানবাজনার প্রচলন ছিল, কিন্তু আলিমগণ তা হারাম জানতেন। ২/১ জন বিনোদন হিসাবে একে জায়েয বলেছেন; কিন্তু কখনই এসকল কর্ম আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম বলে গণ্য হয় নি।
ক্রমান্বয়ে ‘সামা’ বলতে ‘গান-বাজনা’ বুঝানো হতে থাকে। আর গানের আবেশে উদ্বেলিত হওয়া ও নাচানাচি করাকে ‘ওয়াজদ’ অর্থাৎ ‘আবেগ, উত্তেজনা, উন্মত্ততা (passion, ardor) বলা হতো। এ ‘সামা’ বা সঙ্গীত ও ‘ওয়াজদ’ অর্থাৎ গানের আবেশে তন্ময় হয়ে নাচানাচি বা উন্মত্ততা ৫ম হিজরী শতাব্দী থেকে সূফী সাধকদের কর্মকান্ডের অন্যতম অংশ হয়ে যায়। সামা ব্যতিরেকে কোনো সূফী খানকা বা সূফী দরবার কল্পনা করা যেত না। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী (৫০৫হি) ও অন্য কোনো কোনো আলিম সূফীগণের প্রতি ভক্তির কারণে এরূপ গান বাজনা ও নর্তন কুর্দনকে জায়েয, শরীয়ত-সঙ্গত ও বিদ‘আতে হাসানা বলে দাবি করেছেন।[1]
এদিকে যখন সামা-সঙ্গীতের ব্যাপক প্রচলন হয়ে গেল নেককার মানুষদের মাঝে তখন জালিয়াতগণ তাদের মেধা খরচের একটি বড় ক্ষেত্র পেয়ে গেল। তারা সামা, ওয়াজদ ইত্যাদির পক্ষে বিভিন্ন হাদীস বানিয়ে প্রচার করে। যেমন বলা হয়েছে: ‘‘হুযুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন:
اَلسَّمَاعُ
لِقَوْمٍ فَرْضٌ وَلِقَوْمٍ سُنَّةٌ وَلِقَوْمٍ بِدْعَةٌ، وَالْفَرْضُ
لِلْخَوَاصِّ، وَالسُّنَّةُ لِلْمُحِبِّيْنَ وَالْبِدْعَةُ لِلْغَافِلِيْنَ
‘‘সামা কারো জন্য ফরয, কারো জন্য সুন্নাত এবং কারো জন্য বিদ‘আত। খাস লোকদের জন্য ফরয, প্রেমিকদের জন্য সুন্নাত এবং গাফিলদের জন্য বিদআত।’’[2]
এটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বানানো একটি ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা, যা কোনো যয়ীফ বা জাল সনদেও বর্ণিত হয় নি। এছাড়া ইসলামী পরিভাষা বিষয়ে যার ন্যূনতম জ্ঞান আছে তিনি জানেন যে, ফরয, সুন্নাত, বিদআত ইত্যাদি পরিভাষার এরূপ ব্যবহার কখনোই রাসূলুল্লাহ ﷺ করেন নি।
[1] আবু হামিদ আল-গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/২৯২-৩৩২।
[2] সিররুল আসরার, পৃ. ৮৮-৮৯।
১৫. যার ওয়াজদ বা উন্মত্ততা নেই তার ধর্মও নেই, জীবনও নেই
গানের মাজলিসে আবেগে উদ্বেলিত হয়ে অচেতন হওয়া বা নাচানাচি করাকে ইশকের বড় নিদর্শন বলে গণ্য করা হতো। জালিয়াতরা এ বিষয়ে কিছু হাদীস বানিয়েছে। এরূপ একটি ‘হাদীস’ উল্লেখ করা হয়েছে:
مَنْ
لاَ وَجْدَ لَهُ لاَ حَيَاةَ لَهُ/ لاَ دِيْنَ لَهُ
‘‘যার ‘ওয়াজদ’ বা উত্তেজনা-উন্মত্ততা নেই তার জীবন নেই/ধর্ম নেই।’’[1]
এ কথাটিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন সনদহীন বানোয়াট কথা।
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ৮৬, ৮৯।
১৬. যে গান শুনে আন্দোলিত না হয় সে মর্যাদাশালী নয়
এ বিষয়ে অন্য একটি জাল হাদীস প্রসিদ্ধ। এ হাদীসটির একটি সনদও আছে। সনদের মূল রাবী মিথ্যাবাদী জালিয়াত। এ হাদীসে বলা হয়েছে: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে একটি প্রেমের কবিতা পাঠ করা হয়। গানে বলা হয়: ‘প্রেমের সর্প আমার কলিজায় দংশন করেছে। এর কোনো চিকিৎসক নেই, ঔষধও নেই। শুধু আমার প্রিয়তম ছাড়া। সে আমার অসুস্থতা এবং সেই আমার ঔষধ।’ এ কবিতা শুনে তিনি উত্তেজিত উদ্বেলিত হয়ে নাচতে বা দুলতে থাকেন। এমনকি তাঁর চাদরটি গা থেকে পড়ে যায়। তাঁর সাথে সাহাবীগণও এভাবে নাচতে বা দুলতে থাকেন...। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لَيْسَ
بِكَرِيْمٍ مَنْ لَمْ يَهْتَزَّ عِنْدَ السَّمَاعِ
‘‘সামার (শ্রবণের) সময় যে আন্দোলিত হয় না সে মর্যাদাশালী নয়।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ হাদীসটি জঘন্য মিথ্যা ও জাল কথা।[1]
[1] ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুস্সাস, পৃ. ৬০-৬১; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/১৯৮; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৪/২৭০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/২৩৩; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৮৩; আল-মাসনূ, পৃ. ১১১; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/১৮৪।
১৭. গওস, কুতুব, আওতাদ, আকতাব, আবদাল, নুজাবা
আমাদের সমাজে ধার্মিক মানুষদের মধ্যে বহুল প্রচলিত পরিভাষার মধ্যে রয়েছে, গওস, কুতুব, আবদাল, আওতাদ, আকতাব ইত্যাদি শব্দ। আমরা সাধারণভাবে আওলিয়ায়ে কেরামকে বুঝাতে এ সকল শব্দ ব্যবহার করি। এছাড়া এ সকল পরিভাষার বিশেষ অর্থ ও বিশেষ বিশেষ পদবীর কথাও প্রচলিত। আরো প্রচলিত আছে যে, দুনিয়াতে এতজন আওতাদ, এতজন আবদাল, এতজন কুতুব, এতজন গাওস ইত্যাদি সর্বদা বিরাজমান...। এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) নামে বানোয়াট কথা। একমাত্র ‘আবদাল’ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
‘গওস’ কুতুব, আওতাদ... ইত্যাদি সকল পরিভাষা, পদ-পদবী ও সংখ্যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ সকল বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কেনো কিছুই সহীহ বা গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। শুধুমাত্র ‘আবদাল’ শব্দটি একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
‘আবদাল’ শব্দটি ‘বদল’ শব্দের বহুবচন। আবদাল অর্থ বদলগণ। একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কিছু সংখ্যক নেককার মানুষ আছেন যাদের কেউ মৃত্যু বরণ করলে তার ‘বদলে’ অন্যকে আল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত করেন। এজন্য তাদেরকে ‘আবদাল’ বা ‘বদলগণ’ বলা হয়। এ বিষয়ে বর্ণিত প্রতিটি হাদীসেরই সনদ দুর্বল। কোনো সনদে মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। কোনো সনদ বিচ্ছিন্ন। কোনো সনদে দুর্বল রাবী রয়েছেন। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস ‘আবদাল’ বিষয়ক সকল হাদীসকে এককথায় ও ঢালাওভাবে মুনকার, বাতিল বা মাউযূ বলে উল্লেখ করেছেন।
অন্য অনেক মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে এগুলোকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন মুহাদ্দিসের বিস্তারিত আলোচনা ও বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হাদীসগুলোর পর্যালোচনা করে আমার কাছে দ্বিতীয় মতটিই সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। দুটি বিষয় ‘আবদাল’ শব্দটির ভিত্তি প্রমাণ করে: (ক) এ বিষয়ক বিভিন্ন হাদীস এবং (খ) দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর অনেক তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী, মুহাদ্দিস, ইমাম ও ফকীহ এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, এ শব্দটির ভিত্তি ও উৎস রয়েছে।
অন্যান্য সকল বিষয়ের মত ‘আবদাল’ বিষয়েও অনেক মিথ্যা কথা ‘হাদীস’ বলে প্রচারিত হয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি এ বিষয়ক নিম্নের তিনটি হাদীসকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।
প্রথম হাদীস: শুরাইহ ইবনু উবাইদ (১০১হি) নামক একজন তাবিয়ী বলেন, আলী (রা)-এর সাথে যখন মুয়াবিয়া (রা)-এর যুদ্ধ চলছিল, তখন আলীর (রা) অনুসারী ইরাকবাসীগণ বলেন, হে আমীরুল মুমিনীন, আপনি মুয়াবিয়ার অনুসারী সিরিয়াবাসীগণের জন্য লানত বা অভিশাপ করুন। তখন তিনি বলেন, না। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি:
الأَبْدَالُ
(البْدَلاءُ) (يَكُونُونَ) بِالشَّامِ، وَهُمْ أَرْبَعُونَ رَجُلاً، كُلَّمَا
مَاتَ رَجُلٌ أَبْدَلَ اللَّهُ مَكَانَهُ رَجُلاً يُسْقَى بِهِمُ الْغَيْثُ،
وَيُنْتَصَرُ بِهِمْ عَلَى الأَعْدَاءِ، وَيُصْرَفُ عَنْ أَهْلِ الشَّامِ بِهِمُ
الْعَذَابُ.
‘‘আবদাল (বদল-গণ) সিরিয়ায় থাকবেন। তাঁরা ৪০ ব্যক্তি। যখনই তাঁদের কেউ মৃত্যু বরণ করেন তখনই আল্লাহ তাঁর বদলে অন্য ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করেন। তাদের কারণে আল্লাহ বৃষ্টি প্রদান করেন। তাঁদের কারণে শত্রুর উপর বিজয় দান করেন। তাদের কারণে সিরিয়ার অধিবাসীদের থেকে তিনি আযাব দূরীভুত করবেন।’’
এ হাদীসের সনদের সকল রাবীই নির্ভরযোগ্য এবং বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক গৃহীত। শুধুমাত্র শুরাইহ ইবনু উবাইদ ব্যতিক্রম। তাঁর হাদীস বুখারী ও মুসলিমে নেই। তবে তিনিও বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী হিসাবে স্বীকৃত। কাজেই হাদীসটির সনদ সহীহ। কোনো কোনা মুহাদ্দিস সনদটি বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেছেন। তাঁরা বলেন, শুরাইহ বলেন নি যে, আলীর মুখ থেকে তিনি কথাটি শুনেছেন। বরং তিনি শুধু ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এতে মনে হয়, শুরাইহ সম্ভবত অন্য কারো মাধ্যমে ঘটনাটি শুনেছেন, যার নাম তিনি উল্লেখ করেন নি। তবে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। সিফ্ফীনের যুদ্ধের সময় শুরাইহ কমবেশি ৩০ বছর বয়সী ছিলেন। কাজেই তাঁর পক্ষে আলী (রা) থেকে হাদীস শ্রবণ করা বা এ ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা অসম্ভব ছিল না। এজন্য বাহ্যত হাদীসটির সনদ অবিচ্ছিন্ন বলেই মনে হয়।
যিয়া মাকদিসী উল্লেখ করেছেন যে, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সনদে এ হাদীসটি আলীর (রা) নিজের বক্তব্য হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। কাজেই এ হাদীসটি আলীর (রা) বক্তব্য বা মাউকূফ হাদীস হিসেবে সহীহ।[1]
দ্বিতীয় হাদীস: তাবিয়ী আব্দুল ওয়াহিদ ইবনু কাইস বলেন, উবাদা ইবনুস সামিত (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
الأَبْدَالُ
فِى هَذِهِ الأُمَّةِ ثَلاثُونَ مِثْلُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلِ الرَّحْمَنِ، عَزَّ
وَجَلَّ، كُلَّمَا مَاتَ رَجُلٌ أَبْدَلَ اللَّهُ، تَعَالَى، مَكَانَهُ رَجُلاً.
‘‘এ উম্মাতের মধ্যে ‘বদল’গণ (আবদাল) ত্রিশ ব্যক্তি। এরা দয়ালু আল্লাহর খলীল ইবরাহীম (আ)-এর মত। যখন এদের কেউ মৃত্যু বরণ করেন, তখন আল্লাহ তা’লা তার বদলে অন্য ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করেন।’’
এ হাদীসটির বর্ণনাকারী আব্দুল ওয়াহিদ ইবনু কাইসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের মতভেদ আছে। ইজলী ও আবূ যুর‘আ তাঁকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। ইমাম আহমাদ হাদীসটিকে মুনকার, অর্থাৎ আপত্তিকর বা অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে হাসান পর্যায়ের বলে গণ্য করেছেন।[2]
তৃতীয় হাদীস: আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
لَنْ
تَخْلُوَ الأَرْضُ مِنْ أَرْبَعِينَ رَجُلاً مِثْلَ خَلِيلِ الرَّحْمنِ فَبِهِمْ
تُسْقَوْنَ وَبِهِمْ تُنْصَرُونَ مَا مَاتَ مِنْهُمْ أَحَدٌ إِلاَّ أَبْدَلَ الله
مَكانَهُ آخَرَ
‘‘যমীন কখনো ৪০ ব্যক্তি থেকে শূন্য হবে না, যাঁরা দয়ালু আল্লাহর খলীল ইবরাহীমের মত হবেন। তাঁদের কারণেই তোমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হও, এবং তাঁদের কারণেই তোমরা বিজয় লাভ কর। তাঁদের মধ্য থেকে কেউ মৃত্যু বরণ করলে আল্লাহ তাঁর বদলে অন্য ব্যক্তিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন।’’
হাদীসটি তাবারানী সংকলন করেছেন। সনদের একাধিক বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আপত্তি আছে। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। তবে আল্লামা হাইসামী হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলে গণ্য করেছেন।[3]
উপরের তিনটি হাদীস ছাড়াও ‘আবদাল’ বিষয়ে আরো কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রতিটি হাদীস পৃথকভাবে যয়ীফ বা অত্যন্ত যয়ীফ হলেও সামগ্রিকভাবে আবদালের অস্তিত্ব প্রমাণিত। স্বভাবতই এ প্রমাণিত বিষয়কে কেন্দ্র করে অনেক জাল ও বানোয়াট কথাও বলা হয়েছে। আবদাল বা বদলগণের দায়িত্ব, পদমর্যাদা ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক বানোয়াট কথা রয়েছে।
‘আবদাল’ বা বদলগণের নিচের পদে ও উপরে অনেক বানোয়াট পদ-পদবীর নাম বলা হয়েছে। যেমন ৩০০ জন নকীব/ নুকাবা, ৭০ জন নাজীব/ নুজাবা, ৪০ জন বদল/আবদাল, ৪ জন আমীদ/উমুদ, ১ জন কুতুব বা গাউস... ইত্যাদি। ‘আবদাল’ ছাড়া বাকী সকল নাম বা পদ-পদবী ও সংখ্যা সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- থেকে বর্ণিত কেনো একটি সহীহ বা যয়ীফ সনদেও কুতুব, গাওস, নজীব, নকীব ইত্যাদির কথা কোনোভাবে বর্ণিত হয় নি। এছাড়া এদের দেশ, পদ মর্যাদা, দায়িত্ব, কর্ম ইত্যাদি যা কিছু বলা হয়েছে সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ বা যয়ীফ সনদে কিছুই বর্ণিত হয় নি, যদিও গত কয়েক শতাব্দীতে কোনো কোনো আলিম এ বিষয়ে অনেক কিছু লিখেছেন।[4]
এখানে এ সম্পর্কিত দুটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি: (১) আবদালের পরিচয় ও (২) আবদালের দায়িত্ব।
ক. আবদালের পরিচয়
আবদালের পরিচয় সম্পর্কে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। আবদাল বা বদলগণ নিজেদেরকে বদল বলে চিনতে বা বুঝতে পারেন বলেও কোনো হাদীসে কোনোভাবে উল্লেখ করা হয় নি। তবে বাহ্যিক নেক আমল দেখে দ্বিতীয় শতক থেকে নেককার মানুষকে আবদালের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হতো। কোনো কোনো যয়ীফ হাদীসে এ বিষক কিছু বাহ্যিক আমলের কথা বলা হয়েছে। একটি দুর্বল হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
إِنَّهُمْ
لَمْ يُدْرِكُوْهَا بِصَلاَةٍ وَلاَ بِصَوْمٍ وَلاَ صَدَقَةٍ (بِكَثْرَةِ صَوْمٍ
وَلاَ صَلاَةٍ)... وَلَكِنْ ... بِالسَّخَاءِ وَالنَّصِيْحَةِ لِلْمُسْلِمِيْنَ
(سَلاَمَةِ الصُّدُوْرِ وَسَخَاوَةِ الأَنْفُسِ وَالرّحْمَةِ لِجَمِيْعِ
الْمُسْلِمِيْنَ
‘‘তাঁরা এ মর্যাদা বেশি বেশি (নফল) সালাত, সিয়াম বা দান-সাদকা করে লাভ করেন নি.. বরং বদান্যতা, হৃদয়ের প্রশস্ততা ও সকল মুসলিমের প্রতি দয়া, ভালবাসা ও নসীহতের দ্বারা তা লাভ করেছেন।’’ হাদীসটির সনদ দুর্বল।[5]
বিভিন্ন যয়ীফ হাদীস এবং তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের বক্তব্যের আলোকে আল্লামা সাখাবী, সুয়ূতী, আজলূনী প্রমুখ আলিম বদলগণের কিছু আলামত উল্লেখ করেছেন: অন্তরের প্রশস্ততা, বদান্যতা, ভাগ্যের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, হারাম থেকে বিরত থাকা, আল্লাহর দীনের জন্য ক্রোধান্বিত হওয়া, কাউকে আঘাত না করা, কেউ ক্ষতি করলে তার উপকার করা, কেউ কষ্ট দিলে তাকে ক্ষমা করা, উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য প্রতিদিন দোয়া করা, নিঃসন্তান হওয়া, কাউকে অভিশাপ না দেয়া... ইত্যাদি।[6]
খ. আবদালের দায়িত্ব
আমাদের মধ্যে আরো প্রচলিত যে, গাওসের অমুক দায়িত্ব, কুতুবের অমুক দায়িত্ব, আবদালের অমুক দায়িত্ব... ইত্যাদি। এগুলোও ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। অগণিত বুযুর্গ ও নেককার মানুষ সরল বিশ্বাসে এ সকল ভিত্তিহীন শোনা কথা সঠিক মনে করেন এবং বলেন। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, আবদাল ব্যতীত বাকি সকল পদ-পদবী ও পরিভাষাই ভিত্তিহীন। আর আবদালের ক্ষেত্রে কোনো কোনো হাদীসে বলা হয়েছে ‘তাঁদের কারণে বা তাঁদের জন্য আল্লাহ বৃষ্টি দেন ইত্যাদি।’’ এ কথাটির দুটি অর্থ রয়েছে:
প্রথম অর্থ: তাদের নেক আমলের বরকত লাভ
নেককার মানুষের নেক আমলের কারণে আল্লাহ জাগতিক বরকত প্রদান করেন। সহীহ হাদীসে আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে দু ভাই ছিলেন। এক ভাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে আগমন করতেন এবং অন্য ভাই অর্থোপার্জনের কর্মে নিয়োজিত থাকতেন। উপার্জনকারী ভাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে আগমন করে তার অন্য ভাই সম্পর্কে অভিযোগ করেন যে, সে তাকে কর্মে সাহায্য করে না। তখন তিনি বলেন:
لَعَلَّكَ
تُرْزَقُ بِهِ
‘‘হতে পারে যে, তুমি তার কারণে রিয্ক প্রাপ্ত হচ্ছ।’’[7]
দ্বিতীয় অর্থ: তাঁদের দোয়া লাভ
দ্বিতীয় অর্থ হলো, তাদের দোয়ার কারণে আল্লাহ রহমত ও বরকত প্রদান করবেন। আল্লাহর তাঁর প্রিয় নেককার বান্দাদের দোয়া কবুল করেন বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। আবদাল বিষয়ক একাধিক যয়ীফ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এদের দোয়ার বরকত মানুষ লাভ করবে। নেককার মানুষদের প্রকৃতিই হলো যে, তাঁরা সদা-সর্বদা সকল মুসলিমের ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। এ দোয়ার বরকত মুসলিম উম্মাহ লাভ করে।
এখানে তিনটি ভুল ও বিকৃত অর্থ সমাজে প্রচলিত:
প্রথম ভুল: দোয়া কবুলের বাধ্যবাধকতা
অনেকে ধারণা করেন ‘আবদাল’ বা এ প্রকারের কোনো নেককার মানুষ দোয়া করলে আল্লাহ শুনবেনই। কাজেই আল্লাহ খুশি থাকুন আর বেজার থাকুন, আমি কোনো প্রকারে অমুক ব্যক্তির কাছে থেকে দোয়া আদায় করে নিতে পারলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে। এই ধারণা শুধু ভুলই নয়, উপরন্তু ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক ও শির্কমূলক।
প্রথম, কে বদল বা আবদাল তা আমরা কেউই জানি না। এ বিষয়ে সবই ধারণা ও কল্পনা। দ্বিতীয়ত, কারো দোয়া কবুল করা বা না করা একান্তই আল্লাহর ইচ্ছা। কুরআন কারীম থেকে আমরা জানতে পারি আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম হাবীব ও খালীল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ﷺ) মনের অব্যক্ত আশাটিও পূরণ করেছেন। আবার তিনি তাঁর মুখের দোয়াও কবুল করেন নি। তিনি একজন মুনাফিকের জন্য ক্ষমার দোয়া করেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ কবুল করেন নি। উপরন্তু বলেছেন, ৭০ বার এভাবে দোয়া করলেও তা কবুল হবে না। একজন কারামতপ্রাপ্ত-ওলী, আল্লাহর মর্যির বাইরে দোয়া করেছিলেন বলে তাকে কঠিনভাবে শাস্তি দেওয়া হয়।[8]
দ্বিতীয় ভুল: দোয়া কবুলের মাধ্যম বা ওসীলা
‘তাঁর কারণে বা মাধ্যমে তুমি রিযিক পাও’, ‘তাদের কারণে বা মাধ্যমে তোমরা বৃষ্টি পাও...’ ইত্যাদি কথার একটি বিকৃত ব্যাখ্যা হলো, এ ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের দোয়া বা সুপারিশ ছাড়া বোধহয় আল্লাহ এগুলো দিবেন না। এরা বোধহয় রাজা-বাদশাহের মন্ত্রীদের মত, তাঁদের সুপারিশ ছাড়া চলবে না। পৃথীবিতে রাজা, শাসক ও মন্ত্রীদের কাছে কোনো আবেদন পেশ করতে হলে তাদের একান্ত আপনজনদের মাধ্যমে তা পেশ করলে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে আল্লাহর কাছে সরাসরি চাওয়ার চেয়ে এদের মাধ্যমে চাওয়া হলে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এ ধারণাগুলো সুস্পষ্ট শির্ক। পৃথিবীর বাদশা আমাকে চেনেন না, আমার সততা ও আন্তরিকতার কথা তাঁর জানা নেই। কিন্তু তাঁর কোনো প্রিয়পাত্র হয়ত আমাকে চেনেন। তার সুপারিশ পেলে বাদশাহর মনে নিশ্চয়তা আসবে যে, আমি তাঁর দয়া পাওয়ার উপযুক্ত মানুষ। আল্লাহ তা’আলার বিষয় কি তদ্রূপ? তিনি কি আমাকে চেনেন-না? আল্লাহর কোনো ওলী, কোনো প্রিয় বান্দা কি আমাকে আল্লাহর চেয়ে বেশি চেনেন? না বেশি ভালবাসেন? অথবা বেশি করুণা করতে চান? এছাড়া পৃথিবীর বাদশাহ বা বিচারকের মানবীয় দুর্বলতার কারণে পক্ষপাতিত্বের বা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভয় আছে, সুপারিশের মাধ্যমে যা দূরীভুত হয়। আল্লাহর ক্ষেত্রে কি এমন কোনো ভয় আছে?
কে আল্লাহর কাছে মাকবূল ও প্রিয় তা কেউই বলতে পারে না। আমরা আগেই দেখেছি, নেককার মানুষদের প্রকৃতিই হলো যে, তাঁরা সদা সর্বদা সকল মুসলিমের ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। এ দোয়ার বরকত মুসলিমগণ লাভ করেন। এছাড়া কোনো মুসলিমকে ব্যক্তিগতভাবে, অথবা মুসলিম সমাজকে সমষ্টিগতভাবে কোনো নির্ধারিত নেককার ব্যক্তির কাছে যেয়ে দোয়া চাইতে হবে, এ কথা কখনোই এ সকল হাদীসের নির্দেশনা নয়। ইসলামের বরকতময় যুগগুলোতে সাহাবী, তাবিয়ী,তাবি-তাবিয়ী বা তৎকালীণ মানুষেরা কখনোই এরূপ করেন নি।
তৃতীয় ভুল: দায়িত্ব বা ক্ষমতা
অনেকে মনে করেন, আবদাল বা আউলিয়ায়ে কেরামকে আল্লাহ বৃষ্টি, বিজয় ইত্যাদির দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিয়েছেন। এরা নিজেদের সুবিধামত তা প্রদান করেন। এ ধারণাটি হিন্দু ও মুশরিকদের দেব-দেবতায় বিশ্বাসেরই মত শিরক। এ বিশ্ব পরিচালনায় আল্লাহ কোনো জীবিত বা মৃত কোনো নবী, ওলী বা কোনো মানুষকেই কোনো দায়িত্ব বা অধিকার প্রদান করেন নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় বা মনে করা হয় সবই জঘন্য মিথ্যা কথা ও কুরআন ও হাদীসের অগণিত সুস্পষ্ট কথার বিপরীত কথা। আল্লাহ ফিরিশতাগণকে বিশ্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছেন, কিন্তু কোনো ক্ষমতা দেন নি। কোনো জীবিত বা মৃত মানুষকে কোনোরূপ কোনো দায়িত্ব প্রদান করেন নি।
মুসলিম সমাজের অনেকেই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে মনের আন্দাযে ধারণা করেন যে, অমুক ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বান্দা। এরপর মনের আন্দাযে ধারণা করেন যে, আল্লাহ তাকে হয়ত কোনো ক্ষমতা দিয়েছেন। এরপর মনগড়াভাবে এদের কাছে চাইতে থাকেন। আর এ সকল জঘন্য শির্ককে সমর্থন করার জন্য কোনো কোনো জ্ঞানপাপী উপরের ‘আবাদল’ বিষয়ক হাদীসগুলো বিকৃত করে ব্যবহার করেন।
[1] আহমাদ, আল-মুসনাদ ১/১১২; যিয়া মাকদিসী, আল-আহাদীস আল-মুখতারাহ ২/১১০-১১২; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ১৩৬; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৬১-৬৩; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩২-৩৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৩৩০-৩৩২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩০৬-৩০৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৯৩-১৯৫।
[2] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৫/৩২২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৬২-৬৪; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩২-৩৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৩৩০-৩৩২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩০৬-৩০৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৯৩-১৯৫।
[3] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ৪/২৪৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৬৩; আলবানী, যায়ীফাহ ৯/৩২৫-৩২৭; যায়ীফুল জামি, পৃ. ৬৮৯।
[4] হাকিম তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল ১/২৬১-২৬৩; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদু‘আত ২/৩৩৫-৩৩৭; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ১৩৬; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/৬৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৬১-৬৩; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৪/১৫০; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩২-৩৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৩৩০-৩৩২; আল-হাবী ২/২৯১-৩০৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩০৬-৩০৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৯৩-১৯৫; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৪৮, ৩৫৪; মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইয়ামানী, আন-নাওয়াফিহ, পৃ. ১৫; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ৬৩; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ২০৩, ৩৩৪, ৩৬৭; যায়ীফাহ ২/৩৩৯-৩৪১, ৩/৬৬৬-৬৭১, ৫/৫১৯-৫২১।
[5] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৬৩; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/২৪-২৫।
[6] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদু‘আত ২/৩৩৫-৩৩৭; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩২-৩৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৩৩০-৩৩২; আল-হাবী ২/২৯১-৩০৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩০৬-৩০৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৯৩-১৯৫।
[7] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৫৭৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/১৭২; মাকদিসী, আল-মুখতারাহ ৫/৪৯-৫০।
[8] সূরা : ৯ তাওবা, ৮০ আয়াত; সূরা : ৭ আ’রাফ, ১৭৫-১৭৭। দেখুন, ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/২৬৫-২৬৯।
১৮. আব্দুল কাদির জীলানী (রাহ) বিষয়ক
মুসলিম উম্মার ইতিহাসের অবক্ষয়, বিচ্ছিন্নতা, অজ্ঞানতা ও বহির্শত্রুর আক্রমনের যুগের, হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম, ফকীহ ও সূফী ছিলেন আব্দুল কাদির জীলানী। তিনি ৪৭১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯০ বৎসর বয়সে (৫৬১ হি/১১৬৬খৃ) ইন্তেকাল করেন। তিনি হাম্বলী মাযহাবের একজন বড় ফকীহ ছিলেন। এছাড়া তাসাউফের বড় সাধক ও ওয়ায়িয ছিলেন। তাঁর ওয়াযের প্রভাবে অগণিত মানুষ সে অন্ধকার যুগে আল্লাহর দীনের পথে ফিরে আসেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর অনেক কারামত প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাঁর ছাত্রগণ বা নিকটবর্তীগণ, যেমন যাহাবী, সাম‘আনী ও অন্যান্যরা তাঁর বিশুদ্ধ জীবনী রচনা করেছেন। এছাড়া তিনি নিজে অনেক গ্রন্থ লিখে হাম্বলী মাযহাব অনুসারে মুসলিমগণের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের শিক্ষা প্রদান করেন। যদিও তিনি তৎকালীন মাযহাবী কোন্দোলের প্রভাবে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁকে অনুসারীদেরকে জাহান্নামী ফিরকা হিসেবে উল্লেখ করেছেন[1], তবুও হানাফীগণ-সহ সকল মাযহাবের মানুষই তাঁকে ভক্তি করেন।
পরবর্তী যুগে তাঁর নামে অগণিত আজগুবি ও মিথ্যা কথা কারামতের নামে বানানো হয়। এসকল কথা যেমন ভিত্তিহীন ও মিথ্যা, তেমনি তা ইসলামী ধ্যানধারণার পরিপন্থী। তবে এখানে আমাদের আলোচ্য হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ কেন্দ্রিক মিথ্যা কথা। আব্দুল কাদির জীলানীকে (রাহ) কেন্দ্র করে মিথ্যাবাদীদের বানোয়াট কথার একটি হলো, মি’রাজের রাত্রিতে নাকি রাসূলুল্লাহ ﷺ আব্দুল কাদির জিলানীর কাঁধে পা রেখে আরশে উঠেছিলেন। কথাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বানোয়াট জঘন্য মিথ্যা কথা। কোনো হাদীসের গ্রন্থেই এর অস্তিত্ব নেই। আর যে কথা রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন নি, কোনো হাদীসের গ্রন্থে নেই বা সনদ নেই, সে সকল আজগুবি বানোয়াট কথা একজন মুমিন কিভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলতে পারেন সে কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। যেখানে সাহাবীগণ তাঁদের মুখস্থ ও জানা কথা সামান্য কমবেশি হওয়ার ভয়ে বলতে সাহস পেতেন না, সেখানে নির্বিচারে যা শুনছি তাই তাঁর নামে বলে কিভাবে কিয়ামতের দিন তাঁর সামনে মুখ দেখাব!
[1] আব্দুল কাদের জীলানী, গুনিয়াতুত তালিবীন, পৃ: ৬, ৭, ১৪৯, ১৫১, ১৫২, ১৫৫, ২১১, ২২৭।
১৯. পীর-মুরীদি: যার পীর নেই তার পীর শয়তান
পীর-মুরীদি বিষয়ক সুন্নাত, খেলাফে সুন্নাত, বিদআত ও শিরক-কুফর বিষয়াদি আমি অন্যান্য গ্রন্থে আলোচনা করেছি। ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে[1], ‘ফুরফুরার পীর আবূ জাফর সিদ্দিকী রচিত আল-মাউযূআত’ গ্রন্থের পর্যালোচনায়[2], ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা গ্রন্থে[3] এবং রাহে বেলায়াত গ্রন্থে[4] আলোচনা করেছি। মূলত আল্লাহর নৈকট্য বা বেলায়াতের পথে অগ্রসর হতে নেককার মানুষদের সাহচর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেককার মানুষদের ভালবাসা, তাদের সাহচর্য গ্রহণ, তাদের সাথে মাঝে মাঝে বসে আল্লাহর নৈকট্য বিষয়ক আলোচনা ইত্যাদি কর্ম শুধু ইবাদতই নয়; উপরন্তু অন্যান্য ইবাদত পালনের সহায়ক। এ ইবাদত পালনের জন্যই পীর-মুরিদী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে মুসলিম সমাজে। ক্রুসেড যুদ্ধোত্তর এবং বিশেষত তাতার আক্রমনোত্তর মুসলিম বিশ্বে সূফী মাশাইখগণ-ই মূলত দীনী দাওয়াতের ধারা অব্যাহত রাখেন। পাশাপাশি তাসাউফের নামে ব্যাপক শিরক-বিদআত ও কুসংস্কার সর্বত্র প্রসারিত হয়ে যায়। অগণিত জাল হাদীস এ সকল শিরক ও বিদআতের সমর্থনে তৈরি করা হয়। এ সকল জাল হাদীসের একটি:
مَنْ
لاَ شَيْخَ لَهُ فَشَيْخُهُ الشَّيْطَانُ
‘‘যার শাইখ (পীর) নেই তার শাইখ (পীর) শয়তান।’’
এ বইয়ের প্রথম পর্বে ‘‘জাল হাদীস চিহ্নিতকরণে বাঙালী আলিমগণ’’ শীর্ষক নবম পরিচ্ছেদে দেখেছি যে, এ কথাটি হাদীস হিসেবে ভিত্তিহীন ও জাল কথা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা কোনো সাহাবী-তাবিয়ী থেকে কোনোরূপ সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদেও কথাটি বর্ণিত হয় নি। অনেক পরের যুগের কোনো কোনো বুজুর্গ এ কথাটি বলেছেন। এ কথাটির ভাল ও খারাপ অর্থ হতে পারে।
(ক) কুরআন-হাদীসের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জনের জন্য আলিমগণের সহযোগিতা গ্রহণ মুমিনের জন্য জরুরী । আল্লাহ বলেন: ‘‘তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর’’[5]। আল্লাহ আরো বলেন: ‘‘প্রত্যেক জনগোষ্ঠী থেকে কিছু মানুষ বেরিয়ে যেয়ে দীনের বিষয়ে ফিকহ অর্জন করবে; যেন তারা ফিরে এসে তাদের জনপদকে ভয় প্রদর্শন করে; ফলে তারা সতর্ক হবে।’’[6] এজন্য আলিমগণের কোনোরূপ সাহচর্য ও সহযোগিতা ছাড়া একাকী কুরআন-হাদীস পড়ে নিজে যা বুঝলাম সেটিকেই চূড়ান্ত বলে হঠকারিতা করা মুমিনকে শয়তানের খপ্পরে ফেলতে পারে। এ অর্থে হয়ত অতীত যুগের কোনো আলিম এ কথাটি বলে থাকতে পারেন।
(খ) এ কথাটি থেকে অনেকেই দাবি করেন যে, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কোনো ‘একজন’ মানুষকে ‘শাইখ’ বা ‘পীর’ হিসেবে গ্রহণ করা জরুরী। যদি কেউ কোনো মানুষকে পীর না ‘ধরে’ তবে সে শয়তানের মুরীদ হিসেবে গণ্য হবে এবং সে নাজাত বা জান্নাত লাভ করবে না। এরূপ ধারণা ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি।
(গ) ইলম বা তাযকিয়া অর্জনের জন্য সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ীগণের যুগে নির্দিষ্ট এক ব্যক্তিকে ‘পীর’ বা ‘শাইখ’ হিসেবে গ্রহণ করার কোনো প্রচলন ছিল না। তাঁরা সকল নেককার মানুষকে আল্লাহর জন্য ভালবাসতেন, কিছু মানুষকে বিশেষভাবে ভালবাসতেন এবং তাঁদের সাহচর্য গ্রহণ করতে সর্বদা চেষ্টা করতেন। কিন্তু কখনোই একজনকে নির্দিষ্ট করতেন না। সাহচর্য গ্রহণের নামে ‘বাইয়াত’ গ্রহণ করার কোনোরূপ প্রচলন তাঁদের মধ্যে ছিল না। তাঁরা উন্মুক্ত সাহচর্য গ্রহণ করতেন। আবূ নুআইম ইসপাহানীর হিলইয়াতুল আওলিয়া ও ৪র্থ শতকের তাসাউফ বিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থে উমার ইবন আব্দুল আযীয, হাসান বসরী, ইবন সিরীন, সুফইয়ান সাওরী, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক, ইবরাহীম ইবনুল আদহাম, বিশর আল-হাফী, যুন্নুন মিসরী, হারিস মুহাসিবী, জুনাইদ বাগদাদী ও ‘সূফী’ হিসেবে প্রসিদ্ধ অন্যান্যদের জীবনী অধ্যয়ন করলেই পাঠক তা বুঝতে পারবেন। ৪র্থ-৫ম হিজরী শতক থেকে একজন নির্দিষ্ট নেককার মানুষের সাহচর্য গ্রহণের প্রবণতা বাড়তে থাকে। তবে তখনও ‘বাইয়াত’ পদ্ধতি ছিল না। আরো কয়েক শত বৎসর পরে বাইয়াতের মাধ্যমে পীর-মুরীদি পদ্ধতির প্রচলন হয়।
(গ) উপরের বইগুলো পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, মুজাদ্দিদ আলফ সানী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলবী-সহ ভারতের ও বিশ্বের প্রসিদ্ধ সূফীগণ একমত যে, ‘পীরের মুরীদ হওয়া’ ইবাদত নয়; উপকরণ মাত্র। ঈমান ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে বেলায়াত লাভের জন্য এটি সহায়ক উপকরণ। মুমিনের বেলায়াত নির্ভর করবে তার ঈমান ও তাকওয়ার গভীরতার উপরে, মুরীদ হওয়ার উপরে নয়। মুরীদ হয়ে বা না হয়ে, নির্দিষ্ট একজনের সাহচর্য নিয়ে বা বিভিন্ন মানুষের সাহচর্য নিয়ে মুমিন বেলায়াত অর্জন করতে পারেন। বিষয়টি অনেকটা মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার মতই। মাদরাসায় ভর্তি হওয়া কোনো ইবাদত নয়; ইলম শিক্ষা করা ইবাদত। মাদরাসায় ভর্তি না হয়ে বিভিন্ন আলিমের মজলিসে যেয়ে, বাড়িতে বইপত্র পড়ে বা অন্য যে কোনো পদ্ধতিতে ইলম শিক্ষা করলেও মুমিন একইরূপ সাওয়াব লাভ করবেন। মাদরাসায় ভর্তি হওয়াকে ইবাদত বা ইবাদতের অংশ মনে করলে তা বিদআতে পরিণত হয়। অর্থাৎ কেউ যদি মনে করেন যে, ইলম শিক্ষা করি বা না করি মাদরাসায় ভর্তি হলেই ইবাদত পালন হয়ে গেল, অথবা মাদরাসায় ভর্তি না হয়ে বিভিন্ন আলিমের বাড়িতে বা দরসে যেয়ে বা অন্যভাবে যতই ইলম অর্জন করুক ইলম শিক্ষার ইবাদত এতে পালিত হবে না তবে তিনি বিদআতে লিপ্ত।
(ঘ) ‘‘যার শাইখ নেই তার শাইখ শয়তান’’ কথা দ্বারা অনেকে দাবি করেন আল্লাহ এবং বান্দার মাঝখানে কোনো মানুষের মধ্যস্থতা প্রয়োজন। কোনো একজন মানুষের মধ্যস্থতা ছাড়া আল্লাহর রহমত, বরকত বা বেলায়াত লাভ সম্ভব নয়। এরূপ বিশ্বাস সন্দেহাতীতভাবেই শিরক।
[1] এহইয়াউস সুনান, পৃষ্ঠা ৪৭৮-৫১৬।
[2] ফুরফুরার পীর আবূ জাফর সিদ্দিকী রচিত আল-মাউযূআত, পৃষ্ঠা ১১১-১৩১।
[3] কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃষ্ঠা ৪৬৭-৪৮৪।
[4] রাহে বেলায়াত, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩১৭-৩১৯।
[5] সূরা (১৬) নাহল: ৪৩ আয়াত ও সূরা (২১) আম্বিয়া ৭ আয়াত।
[6] সূরা (৯) তাওবা: ১২২ আয়াত।
২০. শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কালি উত্তম
ইলেমের ফযীলতে বানানো একটি জাল হাদীস:
مِدَادُ
الْعُلَمَاءِ أَفْضَلُ مِنْ دِماَءِ الشُّهَدَاءِ
‘‘শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কালি উত্তম।’’ সাখাবী, যারকানী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস জানিয়েছেন যে, কথাটি খুব সুন্দর শোনালেও তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা নয়। যারকাশী বলেছেন: বাক্যটি আসলে তাবিয়ী হাসান বসরীর (রাহ) উক্তি। [1]
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, ৩৭৭ পৃ:, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ ১৭২ পৃ:, মোল্লা কারী, আল আসরার, ২০৭ পৃ, আল-মাসনূয়, ২৫৫ পৃ, শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৩৬৯।
২১. আমার উম্মতের আলিমগণ বনী ইসরাঈলের নবীগণের মত
আলিম ও ধার্মিকদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি বাক্য:
عُلَمَاءُ
أُمَّتِي كَأَنْبِيَاء بَنِيْ إسْرائِيْلَ
‘‘আমার উম্মতের আলিমগণ বনী ইসরাঈলের নবীগণের মত।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা নয়, বরং তাঁর নামে প্রচালিত একটি ভিত্তিহীন, সনদহীন মিথ্যা, বানোয়াট ও জাল কথা।[1] অনেক ওয়ায়িয এ মিথ্যা হাদীসকে কেন্দ্র করে বানোয়াট গল্প বলেন যে, মূসা (আ)-এর সাথে নাকি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল! নাউযূ বিল্লাহ! কি জঘন্য বানোয়াট কথা!!
এখানে উল্লেখ্য যে, আলিমদের ফযীলতে বর্ণিত একটি হাসান হাদীস:
اَلْعُلَمَاءُ
وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ
‘‘আলিমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী।’’
তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনু মাজাহ প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি সকংলন করেছেন। আমাদের উচিত বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলে গোনাহগার না হয়ে এ সকল গ্রহণযোগ্য হাদীস আলোচনা করা।
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, ২৯৩পৃ; মোল্লা কারী, আল আসরার, ১৫৯পৃ, আল-মাসনূ ১৯৬পৃ; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ ৬৫২ পৃ, শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৩৬৮।
২২. আলিমের চেহারার দিকে তাকানো
আলিমদের ফযীলতে বানানো অন্য একটি জাল হাদীস:
نَظْرَةٌ
إِلَى وَجْهِ الْعَالِمِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنْ عِبَادَةِ سِتِّيْنَ سَنَةً
صِيَاماً وَقِيَاماً
‘‘আলিমের চেহারার দিকে তাকানো আল্লাহর কাছে ৬০ বছরের সিয়াম (রোযা) ও কিয়াম (তাহাজ্জুদের) ইবাদতের চেয়ে অধিক প্রিয়।’’
অন্য জাল হাদীসে বলা হয়েছে:
النَظَرُ
إِلَى وَجْهِ الْعَالِمِ عِبَادَةٌ ً
‘‘আলিমের চেহারার দিকে তাকানো একটি এবাদত।’’
এ দুটি বাক্যের কোনটিই হাদীস নয়। মুহাদ্দিসগণ বাক্য দুটিকে মিথ্যা বা বানোয়াট হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন।[1]
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, ৪৪২পৃ, মোল্লা কারী, আল আসরার, ২৫৩ পৃ, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ ১৯৬ পৃ।
২৩. আলিমের ঘুম ইবাদত
এ ধরনের আরেকটি জাল ‘হাদীস’:
نَوْمُ
الْعَالِمِ عِبَادة
‘‘আলিমের ঘুম ইবাদত।’’ মোল্লা আলী কারী বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা (মারফূ হাদীস) হিসেবে এ বাক্যটির কোন অস্তিত্ব নেই।’’[1]
[1] মোল্লা আলী কারী, আল আসরারু, ২৫৫ পৃ।
২৪. মুর্খের ইবাদতের চেয়ে আলিমের ঘুম উত্তম
অনুরূপ আরেকটি ভিত্তিহীন জাল কথা:
نَوْمُ
الْعَالِمِ خَيْرٌ/أَفْضَلُ مِنْ عِبَادَةِ الْجَاهِلِ
‘‘মুর্খের ইবাদতের চেয়ে আলিমের ঘুম উত্তম।’’
দুটি বাক্যই জাল। সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ কোনো সনদেই এ কথা দুটির কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে কাছাকাছি অর্থে একটি যয়ীফ হাদীস আছে:
نَوْمٌ
عَلَى عِلْمٍ خَيْر مِن صَلاة عَلَى جَهْل
‘‘ইলম-সহ নিদ্রা যাওয়া মুর্খতা-সহ সালাত আদায় করা থেকে উত্তম।’’[1]
[1] আবূ নুয়াইম ইসপাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৪/৩৮৫; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৫৫; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৮৬১।
২৫. আলিমের সাহচর্য হাজার রাকআত সালাতের চেয়ে উত্তম
এ বিষয়ে অন্য একটি বানোয়াট হাদীস:
حُضُور
مَجْلِسِ عَالِمٍ أَفْضَلُ من صلاة ألفِ ركعةٍ
‘‘একজন আলিমের মাজলিসে উপস্থিত হওয়া এক হাজার রাক‘আত নামায পড়ার চেয়ে উত্তম।’’
মুহাদ্দিসগণ বাক্যটিকে মিথ্যা হাদীস বলে গণ্য করেছেন।[1] এ জাল হাদীসটির উপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে আরেকটি কথা তৈরি করা হয়েছে: ‘ওলীদের সাহচর্যে এক মুহূর্ত থাকা একশত বৎসর রিয়াহীন নামায পড়ার চেয়েও উত্তম।’’ সৎ ও নেককার মানুষদের সাহচর্যে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু সাহচর্যের এ ফযীলত বানোয়াট।
[1] মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ১১৩; আল-মাসনূ, পৃ. ৬৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৩৬৬।
২৬. আসরের পরে লেখাপড়া না করা
আমাদের দেশে অনেক আলিম ও তালিবুল ইলমদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, আসরের পরে লেখাপড়া করলে চোখের ক্ষতি হয়। একটি বানোয়াট হাদীস থেকে ধারণাটির উৎপত্তি। উক্ত বানোয়াট হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنْ
أَحَبَّ كَرِيْمَتَيْهِ فلا يَكْتُبَنَّ بَعْدَ الْعَصْرِ
‘‘যে ব্যক্তি তার চক্ষুদ্বয়কে ভালবাসে সে যেন আসরের পরে না লেখে।’’
কথাটি হাদীস নয়। এর কোন ভিত্তি নেই। কম আলোতে, অন্ধকারে বা আলো-আঁধারিতে লেখাপড়া করলে চোখের ক্ষতি হতে পারে। ডাক্তারগণ এ বিষয়ে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোন হাদীসে নেই।[1]
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৯৭; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ: ২১৬; আল-মাসনূ‘, পৃ: ১৪১; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৭৮।
২৭. চীনদেশে হলেও জ্ঞান সন্ধান কর
আমাদের দেশের বহুল পরিচিত একটি কথা:
اُطْلُبُوْا
الْعِلْمَ وَلَوْ بِالصِّيْنِ
‘‘চীনদেশে হলেও জ্ঞান সন্ধান কর।’’
অধিকাংশ মুহাদ্দিস একে জাল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ একে অত্যন্ত দুর্বল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। সনদ বিচারে দেখা যায় দু’জন অত্যন্ত দুর্বল রাবী, যারা মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করতেন শুধুমাত্র তারাই হাদীসটিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসাবে প্রচার করেছেন।[1]
[1] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/২৯২, ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত ১/১৫৪, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৮৩, নং ১২৫, সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/১৯৩, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ৬১, নং ১০৯, আলবানী, সিলসিলাতুল যায়ীফা ১/৬০০, নং ৪১৬, ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২৫৮।
২৮. রাতের কিছু সময় ইলম চর্চা সারা রাত ইবাদতের চেয়ে উত্তম
একজন লেখক বলেন: ‘‘বোখারী শরীফের আরও একটি হাদীসে আছে:
تَدَارُسُ
الْعِلْمِ سَاعَةً مِنَ اللَّيْلِ خَيْرٌ مِنْ إِحْيَائِهَا
অর্থাৎ: হযরত (দ:) বলিয়াছেন, রাত্রির এক ঘন্টা পরিমাণ (দ্বীনী) ইলেম শিক্ষা করা সমস্ত রাত্রি জাগরিত থাকিয়া ইবাদত করার চেয়েও ভাল।’’[1]
এ কথাটি সহীহ বুখারী তো দূরের কথা অন্য কোনো হাদীস গ্রন্থেই রাসূলুল্লাহর ﷺ বাণী হিসাবে সংকলিত হয় নি। সুনান দারিমীতে অত্যন্ত দুর্বল সনদে ইবনু আববাসের (রা) বাণী হিসাবে কথাটি সংকলিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে এ অর্থে যা কিছু বলা হয়েছে সবই জাল ও বানোয়াট।[2]
[1] মো. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ২৫।
[2] দারিমী, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রাহমান (২৫৫ হি), আস-সুনান ১/৯৪, ১৫৭; সিদ্দীক হাসান কান্নূজী (১৩০৭ হি), আবজাদুল উলূম ১/৯৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২৭৮।
২৯. ইলম, আমল ও ইখলাসের ফযীলত
ইলম, আমল ও ইখলাসের গুরুত্ব সম্পর্কে কুরআন-হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। পাশাপাশি কিছু জাল হাদীস সমাজে প্রচলিত। যেমন:
اَلنَّاسُ
كُلُّهُمْ مَوْتَى/هَلْكَى إِلاَّ الْعَالِمُوْنَ وَالْعَالِمُوْنَ كُلُّهُمْ
هَلْكَى إِلاَّ الْعَامِلُوْنَ وَالْعَامِلُوْنَ كُلُّهُمْ غَرْقَى إِلاَّ
الْمُخْلِصُوْنَ وَالْمُخْلِصُوْنَ عَلَى خَطَرٍ عَظِيْمٍ
‘‘সকল মানুষ মৃত/ ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত, শুধু আলিমগণ ছাড়া। আলিমগণ সকলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত শুধু আমলকারীগণ ছাড়া। আমলকারীগণ সকলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত/ডুবন্ত শুধু মুখলিসগণ ছাড়া। মুখলিসগণ কঠিন ভয়ের মধ্যে।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ কথাগুলো জাল। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ সনদেও তা রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হয় নি। দরবেশ হূত বলেন: ‘‘সামারকানদী তার ‘তানবীহুল গাফিলীন’ পুস্তকে এ ‘হাদীস’টি উল্লেখ করেছে। আর ওয়াযিযগণ তা নিয়ে মাতামাতি করেন। এ পুস্তকটিতে অনেক মিথ্যা ও মাউযূ হাদীস রয়েছে। এজন্য পুস্তকটির উপর নির্ভর করা যায় না।’’[1]
[1] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ ২৪৬। আরো দেখুন: সাগানী, আল-মাউদূ‘আত, পৃ. ৩৮, আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৪১৫; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১৭৪।
৩০. ইল্ম সন্ধান করা পূর্বের পাপের মার্জনা
ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনান গ্রন্থে নিম্নের হাদীসটি সংকলন করেছেন:
مَنْ
طَلَبَ الْعِلْمَ كَانَ كَفَّارَةً لِمَا مَضَى
‘‘যদি কোনো ব্যক্তি ইলম শিক্ষা করে, তবে তা তার পূর্ববর্তী পাপের জন্য ক্ষতিপূরণ (বা পাপমোচনকারী) হবে।’’[1]
ইমাম তিরমিযী ছাড়াও দারিমী, তাবারানী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। সকলেই ‘অন্ধ আবূ দাঊদ’ নুফাই ইবনুল হারিস-এর মাধ্যমে হাদীসটি সংকলন করেছেন। তিনি ১৫০ হিজরীর দিকে ইন্তিকাল করেন। সমসাময়িক ও পরবর্তী যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, এ ব্যক্তি হাদীসের নামে মিথ্যা বলতেন।
সমসাময়িক প্রসিদ্ধ তাবিয়ী কাতাদা ইবনু দি‘আমা (১১৭ হি) তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, প্রসিদ্ধ তাবে-তাবিয়ী হাম্মাম ইবনু ইয়াহইয়া (১৬৫ হি) বলেন, ‘অন্ধ আবূ দাউদ’ আমাদের কাছে এসে হাদীস বলতে থাকেন। তিনি সাহাবী বারা ইবনু আযিব (৭৩ হি), সাহাবী যাইদ ইবনু আরকাম (৬৮ হি) প্রমুখ সাহাবী থেকে হাদীস শুনেছেন বলে দাবি করেন। তিনি দাবি করেন যে, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১৮ জন সাহাবী থেকে তিনি হাদীস শিক্ষা করেছেন। তখন আমরা প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস কাতাদার কাছে তার বিষয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি বলেন লোকটি মিথ্যা বলছে। সে এ সকল সাহাবীকে দেখে নি বা তাদের থেকে কোনো কিছু শুনে নি। কারণ কয়েক বছর আগে মহামারীর সময়েও তাকে আমরা দেখেছি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়াতে।[2]
ইমাম বুখারী, আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আবু হাতিম রাযী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী বলে উল্লেখ করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু মায়ীন, নাসাঈ, ইবনু হিববান প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন। এই ব্যক্তিটি ছাড়া অন্য কেউ কোনো সনদে এ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। এ ব্যক্তি দাবি করেন যে, তাকে আব্দুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ নামক এক ব্যক্তি বলেছেন, তাকে তার পিতা সাখবারাহ বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ কথাটি বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ নামক ব্যক্তিটিও অপরিচিত। অন্ধ আবূ দাঊদ ছাড়া আর কেউ তার নাম উল্লেখ করেন নি বা তাকে চিনেন বলে উল্লেখ করেন নি। অনুরূপভাবে এ ‘সাখবারাহ’ নামক সাহাবীর কথাও এ ‘অন্ধ আব্দুল্লাহ’ ছাড়া কেউ কখনো উল্লেখ করেন নি। এ নামে কোনো সাহাবী ছিলেন বলে অন্য কোনো সূত্র থেকে জানা যায় না।[3]
হাদীসটি উল্লেখ করে উপরের বিষয়গুলোর দিকে ইঙ্গিত করে ইমাম তিরমিযী বলেন: ‘‘এ হাদীসটির সনদ দুর্বল। আবূ দাঊদ দুর্বল। আব্দুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ এবং তার পিতার বিশেষ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। এ অন্ধ আবূ দাঊদের বিষয়ে কাতাদা এবং অন্যান্য আলিম কথা বলেছেন।[4]
ইমাম তিরমিযী এখানে হাদীসটির সনদ দুর্বল বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন। দুর্বলতার পর্যায় উল্লেখ করেন নি। আমরা জানি যে, দুর্বল বা যয়ীফ হাদীসের এক প্রকার ‘জাল’ হাদীস। যে দুর্বল হাদীসের বর্ণনাকারী মিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত সে দুর্বল হাদীসকে জাল হাদীস বলে গণ্য করা হয়। এ কারণে পরবর্তী কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘জাল’ বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা নূরুদ্দীন হাইসামী এই হাদীস উল্লেখ করে বলেন:
فِيْهِ
أَبُوْ دَاوُدَ الأَعْمَى وَهُوَ كَذَّابٌ
‘‘এর সনদে অন্ধ আবূ দাউদ রয়েছেন যিনি একজন প্রসিদ্ধ মিথ্যাবাদী।’’[5]
[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৯।
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১-২২।
[3] ইবনু হাজার, তাহযীব ১০/৪১৯; তাকরীব, পৃ: ৫৬৫; আল ইসাবা ৩/৩৫।
[4] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৯।
[5] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১২৩। আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ ৮১৯।
৩১. খালি পায়ে ভাল কাজে বা ইলম শিখতে যাওয়া
ইলম শিক্ষার জন্য বা কোনো ভাল কাজে পথ চলার জন্য খালি পায়ে চললে বেশি সাওয়াব হবে বলে কিছু কথা প্রচলিত আছে। এগুলো সবই বাতিল কথা ও জাল হাদীস।[1]
[1] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/১৫৫-১৫৭, সুয়ূতী, লাআলী ১/১৯৪-১৯৬; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২৫১-২৫২।
৩২. ইলম যাহির ও ইলম বাতিন
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী, সুয়ূতী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, ইলমুল বাতিন বা বাতিনী ইলমকে যাহেরী ইলম থেকে পৃথক বা গোপন কোন বিষয় হিসাবে বর্ণনা করে যে সকল হাদীস প্রচলিত সেগুলো সবই বানোয়াট ও মিথ্যা।[1]
আমাদের সমাজে এ বিষয়ে সত্য ও মিথ্যা অনেক সময় মিশ্রিত হয়েছে এবং অনেক সহীহ বা হাসান হাদীসকে বিকৃত অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা জানি যে, মানুষের জ্ঞানের দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় হলো কোনো কিছু ‘জানা’। দ্বিতীয় পর্যায় হলো, এ ‘জানা’ মনের গভীরে বা অবচেতনে বিশ্বাসে পরিণত হওয়া। যেমন, একজন মানুষ জানেন যে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, অথবা ‘ধূমপানে বিষপান’। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ধূমপান করেন। কিন্তু তিনি কখনই বিষপান করেন না। কারণ তার এ জ্ঞান সুগভীর বিশ্বাসে পরিণত হয় নি। যখন তা বিশ্বাসে পরিণত হবে তখন তিনি আর ধূমপান করতে পারবেন না, যেমন তিনি বিষপান করতে পারেন না।
ধর্মীয় বিধিবিধানের বিষয়েও জ্ঞানের এরূপ দু’টি পর্যায় রয়েছে। একজন মানুষ জানেন যে প্রজ্জ্বলিত আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিলে তিনি পুড়ে যাবেন। একারণে তিনি কখনোই আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিবেন না। তাকে ধাক্কা দিয়ে আগুনে ফেলতে গেলেও তিনি প্রাণপণে বাধা দিবেন। আবার এ মানুষটিই ‘জানেন’ ও ‘বিশ্বাস করেন’ যে, ‘নামায কাযা করলে জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত আগুনে পুড়তে হবে’, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ‘নামায কাযা’ করেন। কারণ তার এ ‘জ্ঞান’ ও ‘বিশ্বাস’ প্রকৃত পক্ষে মনের গভীরে বা অবচেতন মনের গভীর বিশ্বাসের জ্ঞানে পরিণত হয় নি। যখন এ জ্ঞানটি তার গভীর বিশ্বাসের জ্ঞানে পরিণত হবে তখন তিনি কোনো অবস্থাতেই নামায কাযা করতে পারবেন না, যেমনভাবে তিনি কোনো অবস্থাতেই আগুনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন না। তিনি জাহান্নামের আগুন হৃদয় দিয়ে অবলোকন ও অনুভব করতে পারবেন।
এজন্য আমরা জানি যে, একজন সাধারণ ধামির্ক মুসলিম, যিনি সাধারণভাবে ফজরের নামায জামাআতে আদায় করেন, তিনি যদি রাতে দেরি করে ঘুমাতে যান তাহলে হয়ত ফজরের জামাতের জন্য তার ঘুম ভাঙ্গবে না। কিন্তু এ ব্যক্তিরই যদি ভোর ৪টায় ট্রেন বা গাড়ি থাকে তাহলে কয়েকবার রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাবে। কারণ গাড়ি ফেল করলে কিছু অসুবিধা হবে বা ক্ষতি হবে এই জ্ঞানটি তার অবচেতন মনের বা ‘কালবের’ জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নামাযের জামাআত ফেল করলে কিছু ক্ষতি হবে এ জ্ঞানটি সে প্রকারের গভীর জ্ঞানে পরিণত হয় নি। যখন তা এরূপ গভীর জ্ঞানে বা ‘কালবেরর জ্ঞানে’ পরিণত হবে তখন ফজরের জামাআতের জন্যও তার বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
প্রথম পর্যায়ের জ্ঞানের পালন ও আচরণই জ্ঞানকে দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়। সকল ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। ‘ধূমপানে বিষপান’ এ জ্ঞানটিকে যদি কারো মনে বারংবার উপস্থিত করা হয়, সে তা পালন করে, ধূমপানের অপকারিতার দিকগুলো বিস্তারিত পাঠ করে, এ বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা ইত্যাদিতে উপস্থিত হয়, তবে এক পর্যায়ে এ জ্ঞান তার গভীর জ্ঞানে পরিণত হবে এবং তিনি ধূমপান পরিত্যাগ করবেন। অনুরূপভাবে ‘গীবত জাহান্নামের পথ’ এ জ্ঞানটি যদি কেউ বারংবার আলোচনা করেন, এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলো বারংবার পাঠ করেন, আখিরাতের গভীর বিশ্বাসে তিনি এর শাস্তি মন দিয়ে অনুভব করেন... তবে এক পর্যায়ে তিনি ‘গীবত’ পরিত্যাগ করবেন। তার মনই তাকে ‘গীবত’ করতে বাধা দিবে।
আমরা জানি, দু পর্যায়ের জ্ঞানই জ্ঞান। প্রথম পর্যায়ের জ্ঞানের আলোকে আল্লাহ বান্দাদের হিসাব নিবেন। যে ব্যক্তি জেনেছে যে, নামায কাযা করা হারাম, কিন্তু তার পরও সে তা কাযা করেছে, তার জন্য তার কর্মের শাস্তি পাওনা হবে। আর জ্ঞান যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হয় তখন তা মানুষের জন্য আল্লাহর পথে চলা অতি সহজ ও আনন্দদায়ক করে তোলে। হাদীসে জ্ঞানকে এ দিক থেকে দু পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এ অর্থে ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন,
إِنَّ
قَوْمًا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ ، وَلَكِنْ إِذَا
وَقَعَ فِى الْقَلْبِ فَرَسَخَ فِيهِ نَفَعَ
‘‘অনেক মানুষ কুরআন পাঠ করে; কিন্তু তা তাদের গলার নিচে নামে না (হৃদয়ে গভীর জ্ঞানে পরিণত হয় না)। কিন্তু যখন তা অন্তরে পৌঁছে যায় এবং গভীর ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন তা তার কল্যাণ করে।’’[2]
প্রখ্যাত তাবিয়ী হাসান বসরী (১১০ হি) বলেছেন:
الْعِلْمُ
عِلْمَانِ: عِلْمٌ عَلَى اللِّسَانِ فَتِلْكَ (فَذَلِكَ) حُجَّةُ اللهِ عَلَى
عِبَادِهِ (ابْنِ آَدَمَ)، وَعِلْمٌ فِي الْقَلْبِ فَذَاكَ الْعِلْمُ النَّافِعُ.
‘‘ইলম বা জ্ঞান দুই প্রকারের: (১) জিহবার জ্ঞান, যা আদম সন্তানের বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রমাণ ও (২) অন্তরের জ্ঞান। এ জ্ঞানই উপকারী জ্ঞান।’’[3]
হাসান বসরীর এ উক্তিটির সনদ নির্ভরযোগ্য। তবে অন্য সনদে এ ‘উক্তিটি’ হাসান বসরীর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বর্ণিত হয়েছে। এক সনদে পরবর্তী এক রাবী দাবি করেছেন, হাসান বসরী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উপরের বাক্যটি বলেছেন। অন্য সনদে পরবর্তী রাবী দাবি করেছেন, হাসান বসরী বলেছেন, জাবির (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উপরের বাক্যটি বলেছেন। এ দুটি সনদকে কোনো কোনো আলিম দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে আল্লামা মুনযিরী হাদীসটির সনদ হাসান বলে উল্লেখ করেছেন।[4]
এখানে উল্লেখ্য যে, এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেছেন:
حَفِظْتُ
مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وِعَاءَيْنِ فَأَمَّا
أَحَدُهُمَا فَبَثَثْتُهُ وَأَمَّا الآخَرُ فَلَوْ بَثَثْتُهُ قُطِعَ هَذَا
الْبُلْعُومُ
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে ইলম-এর দুটি পাত্র সংরক্ষণ করেছি। একটি পাত্র প্রচার করেছি। অন্য পাত্রটি যদি প্রচার করি তবে আমার গলা কাটা যাবে।’’[5]
এ হাদীসটিকে কেউ কেউ ইলমুল বাতিন-এর প্রতি ইঙ্গিত বলে বুঝাতে চেয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে এখানে আবূ হুরাইরা (রা) উমাইয়া যুগের যালিম শাসকদের বিষয়ে ইঙ্গিত করছেন। খিলাফতে রাশিদার পরে যালিম শাসকদের আগমন, দ্বীনি বিষয়ে অবহেলা ইত্যাদি বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন এবং ইয়াযীদ ও অন্যান্য যালিম শাসকের নামও বলেছিলেন। আবূ হুরাইরা এবং অন্যান্য অনেক সাহাবী উমাইয়া যুগে এ বিষয়ক হাদীসগুলো বলার ক্ষেত্রে এ ধরনের কথা বলতেন।[6]
এভাবে মুহাদ্দিসগণ একমত করেছেন যে, ‘ইলমুল বাতিন’ শব্দ কোনো সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি। এছাড়া ইলম যাহির ও ইলম বাতিনের বিভাজনও কোনো হাদীসে করা হয় নি। ‘‘ইলম যাহির’’ ও ‘‘ইলম বাতিন’’ পরিভাষায় দুটির উদ্ভাবন ও বিভাজন বিষয়ক সকল কথাই শিয়াদের জালিয়াতি ও অপপ্রচার। তবে পরবর্তী যুগের অনেক সুন্নী আলিম ও বুজুর্গ ‘‘ইলম যাহির’’ ও ‘‘ইলম বাতিন’’ পরিভাষাদ্বয় ব্যবহার করেছেন। তারা উপরের হাদীসে উল্লিখিত দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্ঞান ‘ইলমুল ক্বাল্ব’ বা অন্তরের জ্ঞানকে অনেক সময় ‘ইলমুল বাতিন’ বলে অভিহিত করেছেন। এ জ্ঞান কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান বা শরীয়তের জ্ঞান থেকে ভিন্ন কিছু নয়। বরং এ জ্ঞান হলো কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানের প্রকৃত ও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়। কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়তের জ্ঞান অবিরত চর্চা, পালন ও অনুশীলনের মাধ্যমে যখন অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে এবং অবচেতন মন থেকে মানুষের র্কম নিয়ন্ত্রণ করে তখন তাকে ‘ইলুমুল ক্বালব’ বা ‘ইলমুল বাতিন’ বলা হয়।
উভয় ক্ষেত্রেই ‘‘ইলম’’ বা জ্ঞান একই, তা হলো, কুরআন ও সুন্নাহের জ্ঞান। এ জ্ঞান যদি ‘‘যাহির’’ অর্থাৎ মানুষের প্রকাশ্য অঙ্গ জিহবায়, মুখে বা কথায় অবস্থান করে তবে তাকে ‘‘ইলমুলয যাহির’’ বা প্রকাশ্য অঙ্গের ইলম’’ বলা হয়। আর যদি তা আভ্যন্তরীণ অঙ্গ বা ‘‘কালব’’-এ অবস্থান করে তবে তাকে ‘‘ইলমুল বাতিন’’ বা লুক্কায়িত অঙ্গের ইলম বলা হয়। আরবী ব্যাকরণ অনুসারে ‘‘যাহির’’ ও ‘‘বাতিন’’ শব্দদ্বয় ইলমের বিশেষণ নয়, বরং ইলমের ইযাফত বা অবস্থান বুঝায়। কিন্তু শিয়াদের প্রচারণা ও সাধারণ আলিম ও বুজুর্গগণের অসতর্কতায় যাহির ও বাতিন শব্দদ্বয়কে ইলমের বিশেষণ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছে যে, ইলমই দু প্রকারের এক প্রকারের ইলম যাহির বা প্রকাশ্য যা কুরআন, হাদীস, ফিকহ ইত্যাদি পাঠে জানা যায়। আরেক প্রকারের ইলম বাতিন বা লুক্কায়িত, এ ইলম বই পত্র পড়ে জানা যায় না, বরং অন্য কোনোভাবে জানতে হয়। আর এ ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন এবং সকল বিভ্রান্তির দরজা উন্মোচন করে।
এভাবে ইলম যাহির ও ইলম বাতিন নামে অনেক প্রকারের ইসলাম বিরোধী কুসংস্কার মুসলিম সমাজে ছড়ানো হয়েছে। ইলম বাতিনকে গোপন কিছু বিষয় বা কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানের বাইরে অর্জনীয় কোনো বিষয় বলে দাবি করা হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু হাদীসও জালিয়াতগণ তৈরি করেছে। ‘ইলম বাতিন ইলম যাহির থেকে পৃথক বা গোপন কোনো ইলম’ এ অর্থে প্রচলিত সকল কথাই জাল। এ জাতীয় কয়েকটি জাল হাদীস উল্লেখ করছি:
[1] সুয়ূতী, যাইলুল মাউযূ‘আত, পৃ: ৪৪, মোল্লা কারী, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ৯৩।
[2] ইবনু রাজাব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ ৩৪৩।
[3] দারিমী, আস-সুনান ১/১১৪।
[4] দারিমী, আস-সুনান ১/১১৪; ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ ১/৪০৭; রাবীয় ইবনু হাবীব, আল-মুসনাদ, পৃ. ৩৬৫; ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৭/৮২; খতীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ ৪/৩৪৬; ইবনুল জাওযী, আল-ইলালুল মুতানাহিয়া ১/৮২-৮৩; আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ১/৫৮।
[5] বুখারী, আস-সহীহ ১/৫৬।
[6] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/২১৬-২১৭।
৩৩. বাতিনী ইলম গুপ্ত রহস্য নবী-ফিরিশতাগণও জানে না!
জালিয়াতগণ হাসান বসরী পর্যন্ত জাল সনদ তৈরি করে বলেছে, হাসান বসরী (২২-১০৯হি) বলেছেন, আমি সাহাবী হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে (৩৬ হি) জিজ্ঞাসা করলাম, ইলম বাতিন কী? তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইলম বাতিন কী? তিনি বলেন, আমি জিবরীলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইলম বাতিন কী? তিনি বলেন, আমি আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইলম বাতিন কী? আল্লাহ বলেন,
يَا
جِبْرِيْلُ، هُوَ سِرٌّ بَيْنِيْ وَبَيْنَ أَحِبَّائِيْ وَأَوْلِيَائِيْ
وَأَصْفِيَائِيْ أُوْدِعُهُ فِيْ قُلُوْبِهِمْ لاَ يَطَّلِعُ عَلَيْهِ مَلَكٌ
مُقَرَّبٌ وَلاَ نَبِيٌّ مُرْسَلٌ
‘‘হে জিবরীল, তা হলো, আমার ও আমার প্রিয়পাত্র ও ওলীগণের মধ্যকার গোপন বিষয়। আমি তা তাদের অন্তরের মধ্যে প্রদান করি। কোনো নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতা বা কোনো নবী-রাসূলও তা জানতে পারেন না।’’
৫ম-৬ষ্ঠ হিজরী শতকের আলিম শীরাওয়াইহি ইবনু শাহরদার দাইলামী (৫০৯ হি) তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আল-ফিরদাউস’-এ এ কথাটিকে হাদীস হিসাবে সংকলিত করেছেন। কিন্তু আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী, জালালুদ্দীন সুয়ূতী, ইবনু আর্রাক কিনানী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিস হাদীসটির জালিয়াতি উদ্ঘাটন করেছেন। হাদীসটির বর্ণনাকারীগণ মিথ্যাবাদী ও হাদীস জালিয়াতি করতেন বলে প্রমাণিত। শুধু তাই নয়। জালিয়াতগণের কাজে কিছু ভুল থেকে যায়। এখানে তারা বলেছে, হাসান বসরী হুযাইফাকে (রা) প্রশ্ন করেছিলেন। অথচ প্রকৃত পক্ষে হাসান বসরী জীবনে হুযাইফাকে দেখেনও নি, তার কাছ থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করা তো দূরের কথা।[1]
[1] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ২/৩১২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২৮০, মোল্লা কারী, আল-মাসনূ, পৃ ৯২-৯৩।
৩৪. বাতিনী ইলম গুপ্ত রহস্য আল্লাহ ইচ্ছামত নিক্ষেপ করেন
এ জাতীয় আরেকটি জাল ও বাতিল কথা হলো:
عَلْمُ
الْبَاطِنِ سِرٌّ مِنْ أَسْرَارِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَحُكْمٌ مِنْ أَحْكاَمِ
اللهِ، يَقْذِفُهُ فِيْ قُلُوْبِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ.
‘‘বাতিনের ইল্ম আল্লাহর গুপ্ত রহস্যগুলোর একটি এবং আল্লাহর বিধানাবলির একটি। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার অন্তরে চান তা নিক্ষেপ করেন।’’
এ বাতিল কথাটি কেউ কেউ অন্যভাবে বলেছেন:
عِلْمُ
الْبَاطِنِ سِرٌّ مِنْ سِرِّيْ أَجْعَلُهُ فِيْ قَلْبِ عِبَادِيْ وَلاَ يَقِفُ
عَلَيْهِ أَحَدٌ غَيْرِيْ
‘‘বাতিনের ইল্ম আমার গুপ্ত রহস্যসমূহের একটি আমি আমার বান্দাদের অন্তরে স্থাপন করি। আর আমি ছাড়া কেউ তা জানে না।’’[1]
হাদীসটির একটি সনদ আছে। সনদটি অজ্ঞাত পরিচয় রাবীগণের সমষ্টি। আল্লামা যাহাবী, সুয়ূতী, ইবনু আর্রাক প্রমুখ হাদীসটিকে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, আল্লামা সুয়ূতী নিজে হাদীসটিকে জাল হিসাবে চিহ্নিত করে তার ‘যাইলুল লাআলী’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর ‘আল-জামিউস সাগীর’ গ্রন্থে হাদীসটি ‘যয়ীফ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনি দাবি করেছেন যে, ‘জামি সাগীর’ পুস্তকে তিনি কোনো জাল হাদীস উল্লেখ করবেন না। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, সকল প্রাজ্ঞ আলেমেরই ভুল হতে পারে এবং কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করা যায় না।[2]
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ২৩।
[2] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৪২; ইবনুল জাওযী, আল-ইলালুল মুতানাহিয়া ১/৮৩; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৪৪; আল-জামি আস-সাগীর ২/১৬০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২৮০; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৫৪৫; যায়ীফাহ ৩/৩৭১।
৩৫. মানুষই আল্লাহর গুপ্ত রহস্য
একটি জাল ‘হাদীসে কুদসী’-তে বলা হয়েছে:
اَلإِنْسَانُ
سِرِّيْ وَأَنَا سِرُّهُ
‘‘মানুষ আমার গুপ্ত রহস্য এবং আমি মানুষের গুপ্ত রহস্য।’’
কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন, সনদবিহীন বানোয়াট কথা।[1]
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ২৩, ৩১।
৩৬. বাতিনী ইলম লুক্কায়িত রহস্য শুধু আল্লাহওয়ালারাই জানেন
এ অর্থে আরেকটি অত্যন্ত দুর্বল, অনির্ভরযোগ্য বা জাল কথা:
إِنَّ
مِنَ الْعِلْمِ كَهَيْئَةِ الْمَكْنُوْنِ لاَ يَعْلَمُهُ إِلاَّ الْعُلَمَاءُ
بِاللهِ فَإِذَا نَطَقُوْا بِهِ لاَ يُنْكِرُهُ إِلاَّ أَهْلُ الْغِرَّةِ بِاللهِ
‘‘ইলমের মধ্যে এমন এক ইলম রয়েছে যা গোপনীয় বস্ত্তর মত। যে ইলম আল্লাহওয়ালা আলিমগণ ছাড়া কেউ জানে না। তাঁরা যখন তা উচ্চারণ করেন তখন আল্লাহর সম্পর্কে ধোকাগ্রস্ত ছাড়া কেউ তা অস্বীকার করে না।’’
দাইলামী ও অন্যান্য আলিম এ হাদীসটি সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে নাসর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু হারিস নামক এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির সূত্রে বলেছেন, এ ব্যক্তি বলেছেন, তাকে আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ আবুস সালত হারাবী বলেছেন, সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা থেকে, ইবনু জুরাইজ থেকে, আতা থেকে, আবূ হুরাইরা থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন...।
হাদীসটির রাবী নাসর ইবনু মুহাম্মাদ অজ্ঞাত পরিচয়। তার উস্তাদ হিসাবে উল্লিখিত আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। মিথ্যার প্রকারভেদ অনুচ্ছেদে আমরা তার বিষয়ে আলোচনা করেছি। একমাত্র এ মিথ্যাবাদী ছাড়া অন্য কারো সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণিত হয় নি।[1]
[1] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ১/২১০; আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ১/৫৮-৫৯; ইরাকী, তাখরীজ এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/৩২; আলবানী, যায়ীফাহ ২/২৬২।
৩৭. মি’রাজের রাতে ত্রিশ হাজার বাতিনী ইলম গ্রহণ
আমরা আগেই বলেছি যে, বুজুর্গগণের নামে জাল গ্রন্থ রচনা বা তাদের গ্রন্থের মধ্যে জাল হাদীস ঢুকানো জালিয়াতগণের প্রিয় কর্ম। শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (রাহ)-এর নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ নামক পুস্তকে নিম্নরূপে লেখা হয়েছে: ‘‘এ একান্ত গুপ্ত ত্রিশ হাজার এলম মেরাজ শরীফের রাতে আল্লাহ তাআলা হুযুর (ﷺ)-এর কলব মোবারকে আমানত রাখেন। হুযুর (ﷺ) তাঁর অত্যাধিক প্রিয় সাহাবা এবং আসহাবে সুফ্ফাগণ ব্যতীত অন্য কোনো সাধারণ লোকের কাছে সে পবিত্র আমানত ব্যক্ত করেন নি।...’’[1]
যারা শাইখ আব্দুল কাদির (রাহ)-এর নামে এ জাল কথা প্রচার করেছে সে জালিয়াতগণকে আল্লাহ তাদের প্রাপ্য প্রদান করবেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) নামে কী জঘন্য ডাহা মিথ্য কথা! রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একজন প্রিয় সাহাবী বা একজন সুফ্ফাবাসী থেকেও এইরূপ কোনো কথা সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি।
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ৪৫।
৩৮. রাসূলুল্লাহর (ﷺ) বিশেষ বাতিনী ইলম
জালিয়াতদের বানানো একটি কথা যা হাদীস বলে প্রচলিত:
لِيْ
مَعَ اللهِ وَقْتٌ لاَ يَسَعُ فِيْهِ مَلَكٌ مُقَرَّبٌ وَلاَ نَبِيٌّ مُرْسَلٌ
‘‘আল্লাহর সাথে আমার এমন একটি সময় আছে, যেখানে কোনো নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতা বা প্রেরিত নবীর স্থান সংকুলান হয় না।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি ভিত্তিহীন সনদহীন একটি জাল কথা, যদিও সুফিয়ায়ে কেরামের মধ্যে তা প্রচলন পেয়েছে। সূফী-দরবেশগণ সরল মনে যা শুনতেন তাই বিশ্বাস করতেন। ফলে জালিয়াতগণ তাদের মধ্যে জাল কথা ছড়াতে বেশি সক্ষম হতো।[1]
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩৫৮, মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৯৭, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ. ১৬৪।
৩৯. আলিম বা তালিব ইমলের জন্য ৪০ দিন কবর আযাব মাফ
প্রচলিত একটি সনদবিহীন জাল হাদীস:
إِنَّ
الْعَالِمَ وَالْمُتَعَلِّمَ إِذَا مَرَّا بِقَرْيَةٍ فَإِنَّ اللهَ يَرْفَعُ
الْعَذَابَ عَنْ مَقْبَرَةِ تِلْكَ الْقَرْيَةِ أَرْبَعِيْنَ يَوْماً
‘‘কোনো আলিম বা তালিব ইলম কোনো গ্রাম দিয়ে গমন করলে মহান আল্লাহ ৪০ দিনের জন্য সে গ্রামের গোরস্থানের আযাব উঠিয়ে নেন।’’
কথাটি বানোয়াট ও মিথ্যা।[1]
[1] মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ৭৪, নং ২৬১, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ৩৮, নং ৫৭।
৪০. আলিমের সাথে সাক্ষাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে সাক্ষাত
প্রচলিত একটি জাল হাদীস:
مَنْ
زَارَ عَالِماً/ الْعُلَمَاءَ فَكَأَنَّمَا (فَكَمَنْ) زَارَنِيْ وَمَنْ صَافَحَ
عَالِماً/ الْعُلَمَاءَ فَكَأَنَّمَا (فَكَمَنْ) صَافَحَنِيْ وَمَنْ جَالَسَ
عَالِماً/ الْعُلَمَاءَ فَكَأَنَّمَا (فَكَمَنْ) جَالَسَنِيْ وَمَنْ جَالَسَنِيْ
فِيْ دَار الدُّنْيَا أَجْلَسَهُ اللهُ تَعَالَى مَعِيْ غَداً فِيْ الجَنَّةِ/
أَجْلَسَهُ رَبِّيْ مَعِيْ فِيْ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ (أُجْلِسَ إِلَيَّ
يَوْمَ الْقِيَامَةِ)
‘‘যে ব্যক্তি কোনো একজন আলিম/আলিমগণের সাথে সাক্ষাৎ করল, সে যেন আমার সাথেই সাক্ষাৎ করল, যে ব্যক্তি কোনো একজন আলিম/ আলিমগণের সাথে মুসাফাহা করল, সে যেন আমার সাথেই মুসাফাহা করল, যে ব্যক্তি কোনো একজন আলিম/আলিমগণের মাজলিসে বসল, সে যেন আমার মাজলিসেই বসল। আর যে দুনিয়াতে আমার মাজলিসে বসেছে মহান আল্লাহ তাকে আগামীকাল (কিয়ামতের দিন) আমার সাথে জান্নাতে বসাবেন।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে কথাটি জাল ও মিথ্যা।[1]
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন ও হাদীসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে: (১) ইলম শিক্ষা করা, (২) নেককার মানুষদের সাহচর্যে থাকা এবং (৩) নেককার মানুষেদের আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা ও তাঁদের সাথে দেখা সাক্ষাত করা। এ তিনটি ইবাদত মুমিনের নাজাতের অন্যতম উপকরণ। আলিমগণের সাহচর্য থেকেই এ তিনটি ইবাদত পালন করা যায়।
আলিমের নিজস্ব কোনো ফযীলত নেই। তাঁর ফযীলত নির্ভর করবে তিনি কুরআন ও হাদীস থেকে যতটুক ইলম ও আমল গ্রহণ করবেন তার উপর। অর্থাৎ আলিমের ফযীলত দুটি: ইলম ও আমল। নেককার আলিমের সাহচর্যের গুরুত্ব তিনটি: নেককার মানুষের সাহচর্যের সাধারণ মর্যাদা, নেককার মানুষের মহববতের সাধারণ মর্যাদা ও ইলম শিক্ষার সুযোগ...। এছাড়া আলিমের পিছনে সালাত আদায়, মাজলিসে বসা, সাক্ষাত করা, মুসাফাহা করা ইত্যাদির বিশেষ ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই ভিত্তিহীন ও জাল কথা।
[1] সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৩৫; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২৭২-২৭৩; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৩২।
৪১. যে দিন আমি নতুন কিছু শিখি নি সে দিন বরকতহীন
প্রচলিত একটি বাতিল কথা যা হাদীস নামে প্রচলিত:
إِذَا
أَتَى عَلَيَّ يَوْمٌ لاَ أَزْدَادُ فِيْهِ عِلْماً يُقَرِّبُنِيْ إِلَى اللهِ
تَعَالَى فَلاَ بُوْرِكَ لِيْ فِيْ طُلُوْعِ شَمْسِ ذَلِكَ الْيَوْمِ
‘‘যদি আমার জীবনে এমন একটি দিন আসে যে দিনে আমি আল্লাহর নৈকট্য প্রদানকারী কোনো ইলম বৃদ্ধি করতে পারি নি, সে দিনের সূর্যোদয়ে আমার জন্য কোনো বরকত না হোক্।’’
হাদীসটি আবূ নু‘আইম ইসপাহানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাকাম ইবনু আব্দুল্লাহ নামক দ্বিতীয় শতকের এক ব্যক্তির সূত্রে বর্ণনা করেছেন। হাকাম বলেন ইবনু শিহাব যুহরী তাকে এ হাদীসটি বলেছেন, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব থেকে আয়েশা থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে। আবূ নু‘আইম বলেন: ‘‘এ হাদীসটি একমাত্র হাকাম ছাড়া কেউ বর্ণনা করে নি।’’[1]
হাকাম নামক এ ব্যক্তি সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, লোকটি একজন জালিয়াত ও জঘন্য মিথ্যাবাদী ছিল। ইমাম আবূ হাতিম রাযী বলেন, লোকটি জঘন্য মিথ্যাবাদী ছিল। ইমাম দারাকুতনী, ইবনু আদী প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেন, এ লোকটি কঠিন জালিয়াত ছিল। সে একটি জাল পান্ডুলিপি বানিয়ে তাতে ৫০টিরও অধিক জাল হাদীস লিখে সেগুলো ইমাম যুহরীর নামে সাঈদ ইবনু মুসাইয়িবের সূত্রে প্রচার করে। এগুলো সবই জাল ও ভিত্তিহীন। এছাড়া আরো অনেক জাল সনদ তৈরি করে সে অনেক জাল হাদীস প্রচার করেছে। সকল মুহাদ্দিস একমত যে লোকটি পরিত্যক্ত, মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত।[2]
হাকামের বানানো এ জাল হাদীসটির আরেকটি বর্ণনা:
إِذَا
أَتَى عَلَيَّ يَوْمٌ لَمْ أَزْدَدْ فِيْهِ خَيْراً يُقَرِّبُنِيْ إِلَى اللهِ
فَلاَ بُوْرِكَ لِيْ فِيْ ذَلِكَ الْيَوْمِ
‘‘যদি আমার জীবনে এমন একটি দিন আসে যে দিনে আমি আল্লাহর নিকটবর্তী করার মত কোনো একটি ভাল কর্ম বৃদ্ধি করতে পারি নি, সে দিনে আমার জন্য কোনো বরকত না হোক্।’’[3]
[1] আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৮/১৮৮।
[2] নাসাঈ, আদ-দু‘আফা, পৃ. ২৯; ইবনু আদী, আল-কামিল ২/৭৯, ২০২-২১৪; ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ১/২২৭; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/৩৩৭; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ২/৩৩২-৩৩৩।
[3] ইবনু আদী, আল-কামিল ২/৭৯, ৩/২৯৪; ইবনুল জাওযী, মাউযূআত ১/১৬৯; যাহাবী, তারতীব, পৃ. ৫৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২৫৬, ২/২৮৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৩৫৫; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ. ১৫২; আলবানী, যায়ীফাহ ১/৫৫৭-৫৫৯।
৪২. কুরআন দিয়ে হাদীস বিচার
ইসলামী ইলম-এর মূল উৎস দু’টি: কুরআন ও হাদীস। আমরা দেখেছি যে, হাদীসের জ্ঞান কুরআনের জ্ঞানের অতিরিক্ত। তা কুরআনের ব্যাখ্যা হতে পারে বা কুরআনের সংযোজন হতে পারে। প্রথম পর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, এ মূলনীতির ভিত্তিতেই সাহাবীগণের যুগ থেকে সকল যুগে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ হাদীসের বিশুদ্ধতা, সূত্র, উৎস, অর্থ ইত্যাদি বিচার করেছেন। এ ক্ষেত্রেও জালিয়াতগণ বিভিন্ন রকমের জালিয়াতি করেছে। এ সকল জালিয়াতির উদ্দেশ্য হলো, ‘ডকুমেন্টারী’ নিরীক্ষা না করে ‘ইচ্ছামাফিক’ ‘অর্থ’ বিচার করে হাদীস ‘গ্রহণ’ বা বর্জন করা। কেউ ‘কুরআন দিয়ে হাদীস বিচার’ করার পক্ষে জাল হাদীস বানিয়েছে। কেউ ‘ভাল-মন্দ’ অর্থ দেখে হাদীস বিচারের জন্য জাল হাদীস বানিয়েছে। কেউ নির্বিচারে ‘ভক্তিভরে’ হাদীস গ্রহণ করার জন্য জাল হাদীস বানিয়েছে। এ জাতীয় একটি হাদীসে বলা হয়েছে:
إِذَا
رُوِيَ عَنِّيْ حَدِيْثٌ (إِذَا حُدِّثْتُمْ عَنِّيْ حَدِيْثاً) فَاعْرِضُوْهُ
عَلَى كِتَابِ اللهِ، فَإِذَا وَافَقَهُ فَاقْبَلُوْهُ، وَإِنْ خَالَفَهُ
فَرُدُّوْهُ
‘‘যখন তোমাদেরকে আমার থেকে কোনো হাদীস বলা হবে, তখন তোমরা তা আল্লাহর কিতাবের উপরে পেশ করবে (কুরআনের সাথে মিলিয়ে দেখবে।) যদি তা আল্লাহর কিতাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে তা গ্রহণ করবে। আর যদি তা তার বিরোধী হয় তবে তা প্রত্যাখ্যান করবে।’’
এ ‘হাদীস’টি এবং এ অর্থে বর্ণিত বিভিন্ন ‘বাক্য’ সবই ভিত্তিহীন। এ অর্থের অধিকাংশ বক্তব্যই সনদবিহীন মিথ্যা কথা। দু একটি বাক্য এ অর্থে সনদসহও বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোর সনদে মাতরূক, মুনকার বা ‘পরিত্যক্ত’ ও মিথ্যায় অভিযুক্ত রাবী বিদ্যমান। মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে ইসলামের গোপন শত্রু যিনদীকগণ এ সকল হাদীস তৈরি করে প্রচার করে।
স্বভাবতই কোনো হাদীসই কুরআন ‘বিরোধী’ হয় না। তবে ‘ডকুমেন্টারী’ প্রমাণ ছাড়া যদি ‘কুরআন’ দিয়ে হাদীস বিচার করা হয় তবে প্রত্যেকেই তার নিজ ‘মর্জি’ দিয়ে হাদীস বিচার করবে। একজন সহজেই বলতে পারবে যে, কুরআনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা নেই অতএব পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের হাদীসগুলো কুরআন বিরোধী, কাজেই তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। অন্য ব্যক্তি বলবে, বৎসরপূর্তির পরে ‘যাকাত’ প্রদানের বিধান কুরআন বিরোধী। আরেকজন সহজেই বলতে পারবে, ‘উকাশার প্রতিশোধ গ্রহণের কাহিনী’ কুরআনের ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কাজেই তা সহীহ। অথবা কুরআনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ বলা হয়েছে, কাজেই ‘আপনি না হলে বিশ্ব সৃষ্টি করতাম না’ হাদীসটি সহীহ। অথবা কুরআনে সাহাবীদের প্রশংসা করা হয়েছে, কাজেই ‘আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য’ হাদীসটি সহীহ। এভাবে প্রত্যেকেই নিজের মর্জি মত দাবি দাওয়া করতে থাকত এবং মুসলিম উম্মাহ অন্তহীন বিভ্রান্তির আবর্তে পড়তেন। এ উদ্দেশ্যেই যিনদীকগণ এ হাদীসগুলো বানিয়েছিল। তবে মুহাদ্দিসগণের সনদ নিরীক্ষার ফলে তাদের জালিয়াতি ধরা পড়েছে।[1]
[1] সাগানী, আল-মাউদূ‘আত, পৃ. ৭৬; ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুস্সাস, পৃ ৮১; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৭০; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৮৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৩৭৪।
৪৩. ‘ভাল’ অর্থ দেখে হাদীস বিচার
দ্বিতীয় পর্যায়ের হাদীসগুলোর মধ্যে রয়েছে:
مَا
جَاءَكُمْ عَنِّيْ مِنْ خَيْرٍ قُلْتُهُ أَوْ لَمْ أَقُلْهُ فَأَنَا أَقُوْلُهُ
وَمَا أَتَاكُمْ مِنْ شَرٍّ فَإِنِّيْ لاَ أَقُوْلُ الشَّرَّ
‘‘আমার পক্ষ থেকে কোনো ‘কল্যাণ’ বা ‘ভালো’ তোমাদের কাছে পৌঁছালে আমি বলি অথবা না-ই বলি, আমি তা বলি (তোমরা তা গ্রহণ করবে)। আর তোমাদের কাছে কোনো ‘খারাপ’ বা ‘অকল্যাণ’ পৌঁছালে (তা গ্রহণ করবে না); কারণ আমি ‘খারাপ’ বলি না।’’
এ অর্থের অন্য একটি জাল হাদীস নিম্নরূপ:
إِذَا
حُدِّثْتُمْ عَنِّيْ بِحَدِيْثٍ يُوَافِقُ الْحَقَّ فَصَدِّقُوْهُ وَخُذُوْا بِهِ
حَدَّثْتُ بِهِ أَوْ لَمْ أُحَدِّثْ
‘‘যখন আমার পক্ষ থেকে কোনো হাদীস তোমাদেরকে বলা হবে যা ‘হক্ক’ বা সত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তখন তোমরা তা গ্রহণ করবে- আমি তা বলি অথবা নাই বলি।’’
এরূপ ‘ভালমন্দ’ অর্থ বিচার করে হাদীস গ্রহণের বিষয়ে আরো কয়েকটি ‘হাদীস’ বর্ণিত হয়েছে। এ অর্থে বর্ণিত কিছু হাদীস সন্দেহাতীতভাবে জাল ও মিথ্যা বলে প্রমাণিত। এগুলোর সনদে সুপরিচিত মিথ্যাবাদী রাবী বিদ্যমান। আর কিছু হাদীস অত্যন্ত দুর্বল সনদে বর্ণিত, যেগুলোকে কেউ ‘যয়ীফ’ বলেছেন এবং কেউ ‘মাউযূ’ বলেছেন।
আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণের যুগ থেকেই হাদীস যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ‘অর্থ’ বিচার করা হয়। তবে যে কোনো হাদীসের ক্ষেত্রে সর্ব-প্রথম বিচার্য হলো, কথাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন বলে প্রমাণিত কিনা। তিনি বলুন অথবা না বলুন, হক্ক, সত্য বা ভালর সাথে মিল হলেই তা ‘নির্বিচারে’ ‘হাদীস’ বলে গ্রহণ করার অর্থই হলো তিনি যা বলেন নি তা তাঁর নামে বলার পথ প্রশস্ত করা। আর অগণিত হাদীসে তা নিষেধ করা হয়েছে। এজন্য মুহাদ্দিসগণ এ বিষয়ক ‘দুর্বল’ হাদীসগুলোকেও অর্থগতভাবে বাতিল বলে গণ্য করেছেন। অনেক দুর্বল রাবী ভুল বশত এক হাদীসের সনদ অন্য হাদীসে জুড়ে দেন, মতন পাল্টে ফেলেন। এজন্য কখনো কখনো দুর্বল বা অজ্ঞাত পরিচয় রাবীর হাদীসও অর্থ বিচারে মাউযূ বা বাতিল বলে গণ্য করা হয়।[1]
[1] আহমাদ, আল-মুসনাদ ২/৩৬৭, ৪৮৩; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৯; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/১৮৭-১৮৮; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৫৪; ইবনু হাজার, আল-কাউলুল মুসাদ্দাদ, পৃ. ৮৭-৮৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২১৩-২১৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২৬৪; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২৭-২৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৩৫৯-৩৬৩; আলবানী, যায়ীফাহ ৩/২০৩-২১১।
৪৪. ভক্তিতেই মুক্তি!
সাধারণ মানুষ যাতে ‘নির্বিচারে’ জাল হাদীসগুলো গ্রহণ করে, এজন্য জালিয়াতগণ ‘ভক্তিতেই মুক্তি’ মর্মে অনেক হাদীস বানিয়েছে। যেমন:
مَنْ
بَلَغَهُ عَنِ اللهِ شَيْءٌ فِيْهِ فَضِيْلَةٌ فَأَخَذَ بِهِ إِيْمَاناً بِهِ
وَرَجَاءَ ثَوَابِهِ أَعْطَاهُ اللهُ ثَوَابَ ذَلِكَ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ كَذَلِكَ/
وَإِنْ كَانَ الَّذِيْ حَدَّثَهُ كَاذِباً
‘‘যদি কারো কাছে কোনো ‘ফযীলতের’ বা সাওয়াবের কথা পৌঁছে এবং সে তা বিশ্বাস করে এবং সাওয়াবের আশায় তা গ্রহণ করে, তবে আল্লাহ তাকে সে সাওয়াব দান করবেন; যদিও প্রকৃত পক্ষে তা সঠিক না হয়। অথবা তাকে যে কথাটি বলেছে সে যদি মিথ্যাবাদীও হয়।’’
অনুরূপ আরেকটি মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস:
مَنْ
بَلَغَهُ عَنِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فَضِيْلَةٌ فَلَمْ يُصَدِّقْ بِهَا لَمْ
يَنَلْهَا
‘‘যদি কারো কাছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ফযীলত বা সাওয়াবের কথা পৌঁছে, কিন্তু সে তা সত্য বলে মেনে না নেয়, তবে সে ব্যক্তি সেই ফযীলতটি লাভ করবে না।’’
দাজ্জালদের বানানো আরেকটি বানোয়াট কথা:
لَوْ
حَسَّنَ أَحَدُكُمْ ظَنَّهُ بِحَجَرٍ لَنَفَعَهُ اللهُ بِهِ
‘‘যদি তোমাদের কেউ কোনো পাথরের ব্যাপারেও ভাল ধারণা পোষণ করে, তবে সে পাথর দ্বারাও আল্লাহ তার উপকার করবেন।’’
এ কথাগুলো এবং এ অর্থে বর্ণিত সকল কথাই জঘন্য মিথ্যা, যা মিথ্যাবাদী দাজ্জাদলগণ বানিয়েছে এবং এগুলোর জন্য সনদও বানিয়েছে। তবে সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনার জন্য সনদ বলার অপরিহার্যতার রীতি প্রচলনের ফলে মুসলিম উম্মাহ এদের জালিয়াতি থেকে আত্মরক্ষার পথ পেয়েছেন। মুহাদ্দিসগণ দেখেছেন যে, এ সকল হাদীসের প্রত্যেকটির সনদেই মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বিদ্যমান। এজন্য তাঁরা এ সকল হাদীস জাল বলে চিহ্নিত করেছেন। আর একাধিক সনদের কারণে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এগুলোকে ‘অত্যন্ত দুর্বল’ বলে উল্লেখ করে এগুলোর সহীহ হাদীস সম্মত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।[1]
[1] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৫৫৯-৫৬০; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/১৮৮; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩৪৪, ৪০২-৪০৩; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২১৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২৬৫; তাহির পাটনী, তাযকিরাহ, পৃ. ২৮; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৮৯-১৯০, ২২৪-২২৫; আলবানী, যায়ীফাহ ১/৬৪৭-৬৫৪।
৪৫. কিছু সময় চিন্তা-ফিকর হাজার বৎসর ইবাদত থেকে উত্তম
ইলমের ফযীলতে বানানো আরেকটি জাল হাদীস:
تَفَكُّرُ
سَاعَةٍ خَيْرٌ مِنْ عِبَادَةِ سَنَةٍ /سَبْعِيْنَ سَنَةً /أَلْفِ عَامٍ
‘‘এক মুহূর্ত বা কিছু সময় চিন্তা-ফিক্র করা এক বছর ইবাদত করা থেকে উত্তম’’। কেউ বলেছেন: ৭০ বছরের ইবাদত থেকে উত্তম। আর কেউ আরেকটু বাড়িয়ে বলেছেন: হাজার বৎসরের ইবাদত থেকে উত্তম।
মুহাদ্দিসগণ হাদীসটি জাল বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা হিসাবে তা মিথ্যা। কথাটি পূর্ববতী কোনো আলিমের উক্তি মাত্র।[1]
[1] মোল্লা কারী, আল-আসরার, ৯৭ পৃ, আলবানী, যায়ীফুল জামিয় ৫৮১ পৃ।
৪৬. চিন্তা-ফিক্র, মুরাকাবা ও ধ্যান
উপরের হাদীসটি জাল হলেও ইসলামে জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি হিসেবে চিন্তা-গবেষণাকে উৎসাহ দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত। কুরআন ও হাদীসে ‘তাফাক্কুর’ ও ‘তাদাববুর’-কে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কুরআনের আয়াতসমূহ নিয়ে, পূর্ববর্তী জাতিগুলোর পরিণতি নিয়ে, মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টি, প্রাণী, গ্রহ, নক্ষত্র, মানবীয় প্রকৃতি ইত্যাদি নিয়ে তাফাক্কুর বা চিন্তা-ভাবনা করতে কুরআনে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[1] তবে প্রচলিত অর্থে ধ্যান করতে কুরআন হাদীসে কোথাও নির্দেশ দেওয়া হয় নি।
এছাড়া পরবর্তী যুগের সূফীগণের মধ্যে প্রচলিত ‘মুরাকাবা’ শব্দটিকে এক্ষেত্রে বিকৃত অর্থে ব্যবহার করা হয়। মুরাকাবা অর্থ ধ্যান নয়। মুরাকাবা অর্থ পর্যবেক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণ (supervision/control)। ইমাম গাযালীর এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ও তাসাউফ বিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থ পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, তাসাউফের পরিভাষায় ‘মুরাকাবা’ অর্থ আত্ম-পর্যবেক্ষণ বা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ সর্বদা নিজের কর্মকান্ড নিজেই পর্যবেক্ষণ করা এবং নিজের আমলের উন্মতি-অবনতির বিষয়ে আত্ম-সমালোচনা ও আত্ম-পর্যবেক্ষণ।
‘ধ্যান’ (meditation) বলতে বর্তমানে এক ধরনের মিথ্যা কল্পনার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখা বুঝানো হয়। এরূপ মিথ্যা কল্পনার মধ্যে ডুবে থেকে কিছু সময়ের জন্য নিজের মনকে বাস্তব দুশ্চিন্তা, হতাশা ইত্যাদি থেকে বিমুক্ত রাখা হয়। আত্ম-উন্নয়ন, মনোসংযোগ বৃদ্ধি, হতাশা-মুক্তি ইত্যাদির জন্য এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:
(ক) এরূপ মিথ্যা কল্পনায় নিমগ্ন থাকাকে ইসলামী তাফাক্কুর অথবা ‘মুরাকাবা’ বলে আখ্যায়িত করা ইসলামের নামে মিথ্যাচার।
(খ) আত্মউন্নয়ন, মনোসংযোগ এবং দুশ্চিন্তা-হতাশা থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর যিকর ও দুআ অনেক বেশি কার্যকর। জোর করে মনকে মিথ্যা কল্পনায় নিমগ্ন না রেখে যথাসম্ভব মনোযোগ সহকারে সামান্য সময় আল্লাহর যিকর ও দুআ করলে অনেক বেশি জাগতিক-মানসিক ফল পাওয়া যায়। পাশাপাশি সাওয়াব ও আত্মিক উন্নতি তো অপরিসীম।
[1] (২) বাকারা: ২১৯, ২৬৬; (৬) আনআম: ৫০; (৭) আরাফ ১৭৬; (১০) ইউনুস ২৪; (১৩) রা’দ: ৩; (১৬) নাহল: ১১, ৪৪, ৬৯; (৩০) রূম: ২১; (৩৯) যুমার: ৪২; (৪৫) জাসিয়া: ১৩; (৫৯) হাশর: ২১....।
৪৭. মারিফতের প্রাবল্যে আত্মবিলুপ্তি
যাহিরী ইলম, বাতিনী ইলম, মারিফাত, ফানা ইত্যাদি বিষয়ক দাজ্জাল জালিয়াতদের বানানো একটি গল্প একজন সরলপ্রাণ সুফীর বই থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘‘হজরত (রাসূলুল্লাহ ﷺ) ঐশী উন্মাদনার মধ্যে এরূপ আত্ম-বিলুপ্ত হইতেন যে, প্রিয় সহধর্ম্মিনী আয়েশাকেও চিনিতে পারিতেন না। একদা আঁ-হজরত স্বীয় স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন: ‘মান আন্তে’ (তুমি কে)? হজরত আয়েশা বলিলেন, ‘আনা আয়েশাতো’ (আমি আয়েশা)। পুনরায় আঁ-হজরত জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মান আয়েশাতো’ (আয়েশা কে)? তিনি বলিলেন, ‘বিন্-তুচ্ছ ছিদ্দীক’ (প্রথম খলিফা ছিদ্দিক কন্যা)। পুনরায় আঁ-হজরত জিজ্ঞাসা করিলেন, ছিদ্দিক কে? উত্তরে তিনি বলিলেন- ‘মুহাম্মদের শ্বশুর’। যখন পুনরায় আঁ-হজরত জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মুহাম্মদ কে?’ তখন হজরত আয়েশা স্বামীর অবস্থান্তর বুঝিতে পারিয়া নিবর্বাক রহিলেন।’’[1]
মহান আল্লাহ জালিয়াতদেরকে লাঞ্ছিত করুন, জালিয়াতির অপবিত্রতা থেকে তাঁর প্রিয়তম মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পবিত্র আঙ্গিনাকে মুক্ত করুন, জালিয়াতদের বানানো ‘‘জাল ইসলাম’’ থেকে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে রক্ষা করুন এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উম্মাতের সকলকে তাঁর রেখে যাওয়া কুরআন কারীম ও বিশুদ্ধ হাদীসের আলোকে জীবন গঠনের তাওফীক প্রদান করুন।
[1] আলহাজ্জ খান বাহাদুর আহছানউল্লা, ছুফী (ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২য় সংস্করণ ২০১১) পৃষ্ঠা ১৮।
No comments