হাদীসের নামে জালিয়াতি - অধ্যায়-২৮ - সালাত ও আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গ - (খ) মসজিদ ও আযান বিষয়ক

. মসজিদে দুনিয়াবী কথাবার্তা

মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্য সালাত আদায়, আল্লাহর যিকির, দীনের আলোচনা ইত্যাদি। মসজিদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ () বলেন:

إِنَّمَا هِىَ لِذِكْرِ اللَّهِ وَالصَّلاَةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ

‘‘এগুলো শুধু আল্লাহর যিক্র, সালাত কুরআন তিলাওয়াতের জন্য[1]

মসজিদের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় করতে এবং হারানো বা পলাতক কিছু খোঁজ করতে, উচ্চস্বরে কথা বলতে বা চিৎকার করতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে[2]  ছাড়া সাধারণ জাগতিক কথাবার্তা বলার কোনো সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা কোনো সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয় নি। সাহাবীগণ মসজিদের মধ্যেই কবিতা পাঠ করতেন, জাহিলী যুগের গল্প-কাহিনী আলোচনা করতেন। জাবির (রা) বলেন:

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ  إِذَا صَلَّى الْفَجْرَ جَلَسَ فِي مُصَلاَّهُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ فَيَتَحَدَّثُ أَصْحَابُهُ وَيَذْكُرُونَ حَدِيثَ الْجَاهِلِيَّةِ وَيُنْشِدُونَ الشِّعْرَ وَيَضْحَكُونَ وَيَتَبَسَّمُ .

‘‘রাসূলুল্লাহ  যে স্থানে ফজরের সালাত আদায় করতেন সেখানে সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে থাকতেন। সূর্যোদয়ের পরে তিনি উঠতেন। তাঁর বসা অবস্থায় সাহাবীগণ কথাবার্তা বলতেন, জাহেলী যুগের কথা আলোচনা করতেন, কবিতা পাঠ করতেন এবং হাসতেন। আর তিনি শুধু মুচকি হাসতেন।[3]

আমাদের দেশে প্রচলিত কয়েকটি জাল হাদীসে মসজিদের মধ্যেদুনিয়ার কথাবলার কঠিন নিন্দা করা হয়েছে। একটি জাল হাদীস নিম্নরূপ:

مَنْ تَكَلَّمَ بِكَلاَمِ الدُّنْيَا فِيْ الْمَسْجِدِ أَحْبَطَ اللهُ أَعْمَالَهُ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً

‘‘যে ব্যক্তি মসজিদের মধ্যেদুনিয়াবী কথাবলবে, আল্লাহ তার চল্লিশ বছরের আমল বাতিল বা বরবাদ করে দিবেন।’’

আল্লামা সাগানী, তাহির পাটনী, মোল্লা আলী কারী, আজলূনী প্রমুখ মুহাদ্দিস একবাক্যে হাদীসটিকে জাল বলেছেন। মোল্লা কারী বলেন: ‘‘ কথাটি যেমন সনদগতভাবে বাতিল, তেমনি এর অর্থও বাতিল।[4]

অনুরূপ আরেকটি জাল বানোয়াট কথা:

اَلْحَدِيْثُ فِيْ الْمَسْجِدِ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ الْبَهِيْمَةُ الْحَشِيْشَ

‘‘মসজিদে কথাবার্তা নেক আমল খায়, যেরূপ পশু ঘাস-খড় খায়।’’

একই অর্থে আরেকটি জাল ভিত্তিহীন কথা

اَلْكَلاَمُ فِيْ الْمَسْجِدِ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ

‘‘মসজিদে কথাবার্তা নেক আমল খায়, যেরূপ আগুন কাঠ খায়।’’

কোনো কোনো প্রসিদ্ধ আলিম জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে বাক্যটিকে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইরাকী, ফাইরোযআবাদী, তাহির পাটনী, মোল্লা আলী কারী অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একমত যে, বাক্যটি বানোয়াট, ভিত্তিহীন সনদহীন একটি কথা যা রাসূলুল্লাহ () এর নামে বলা হয়েছে[5]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /২৩৬
[2]
বুখারী, আস-সহীহ /১৭৯; মুসলিম, আস-সহীহ /৩৯৭; তিরমিযী, আস-সুনান /৬১০; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ /২৭৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৬৫; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা /৪৪৭
[3]
সহীহ মুসলিম /৪৬৩, নং ৬৭০, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা /৪০৪, /৫১
[4]
সাগানী, আল-মাউদূআত, পৃ ৩৯; তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূআত, পৃ ৩৬; মোল্লা কারী, আল-আসরার পৃ. ২২৭; আল-মাসনূ, পৃ. ১৪৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৪৪
[5]
তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূআত, পৃ. ৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ১১৩; আল-মাসনূ, পৃ. ৬৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৪৪

 . মসজিদে বাতি জ্বালানো ঝাড়ু দেয়া

মসজিদ পরিষ্কার করা, ঝাড়ু দেয়া, বাতি জ্বালানো ইত্যাদি সাধারণভাবে নেক কর্ম। কিন্তু অন্যান্য সকল বিষয়ের মত বিষয়েও বিশেষ পুরস্কারের নামে কিছু জাল হাদীস বানানো হয়েছে। মসজিদে বাতি জ্বালালে এত এত সাওয়াব, বা এত হাজার ফিরিশতা তার জন্য দোয়া করবে, এত হজ্জ বা এত উমরার সাওয়াব মিলবে... ইত্যাদি সকল কথা বানোয়াট[1]

[1] তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূআত, পৃ. ৩৭

 . আযানের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি চোখে বুলানো

আমাদের দেশে অনেক ধার্মিক মুসলিম আযানের সময় ‘‘আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’’ বাক্যটি শুনলে দুই হাতের আঙুলে চুমু খেয়ে তা দিয়ে চোখ মুছেন। মর্মে একটি বানোয়াট মিথ্যা হাদীসকে সত্য মনে করেই তাঁরা কাজ করেন। বানোয়াট হাদীসটি বিভিন্ন ভাবে প্রচারিত। এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আযানের বাক্যটি শুনে নিজে মুখে বলবে:

أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِالله رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ  نَبِيًّا

‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ () তাঁর বান্দা রাসূল, আমি পরিতৃপ্ত হয়েছি আল্লাহকে প্রভু হিসাবে, ইসলামকে দীন হিসাবে মুহাম্মাদ ﷺ-কে নবী হিসাবে গ্রহণ করে’’, আর কথা বলার সাথে দু হাতের শাহাদত আঙ্গুলের ভিতরের দিক দিয়ে তার দু চক্ষু মুছবে তার জন্য শাফায়াত পাওনা হবে

কেউ কেউ বলেন: আযানের বাক্যটি শুনলে মুখে বলবে:

مَرْحَباً بِحَبِيْبِيْ وَقُرَّةِ عَيْنِيْ مُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ

‘‘মারহাবা! আমার প্রিয়তম আমার চোখের শান্তি মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহকে’’, এরপর তার বৃদ্ধাঙ্গলিদ্বয়কে চুমু খাবে এবং উভয়কে তার দু চোখের উপর রাখবে। যদি কেউ এরূপ করে তবে কখনো তার চোখ উঠবে না বা চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হবে না

জাতীয় সকল কথাই বানোয়াট। কেউ কেউ সকল কথা আবু বাক্র (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। মোল্লা আলী কারী বলেন, ‘‘আবু বাক্র (রা) থেকে বর্ণনা প্রমাণিত হলে তা আমল করার জন্য যথেষ্ট হবে।’’ তবে হাদীসটি আবু বাকর (রা) থেকেও প্রমাণিত নয়। ইমাম সাখাবী অন্যান্য মুহাদ্দিস তা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মোল্লা আলী কারীর বক্তবব্যের টীকায় বর্তমান যুগের অন্যতম হানাফী ফকীহ, মুহাদ্দিস সুফী আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ লিখেছেন, তাঁর উস্তাদ প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ যাহিদ কাওসারীর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মোল্লা আলী কারী বিষয়ে ইমাম সাখাবীর বিস্তারিত আলোচনা জানতে পারেন নি। ফলে তার মনে দ্বিধা ছিল। প্রকৃত বিষয় হলো, আবু বাকর (রা) বা অন্য কোনো সূত্রে হাদীসটির কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় নি। মুহাদ্দিসগণ একমত হয়েছেন যে, বিষয়ক সকল বর্ণনা বানোয়াট[1]

এখানে তিনটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:

() রোগমুক্তি, সুস্থতা ইত্যাদির জন্য বিভিন্নআমলঅনেক সময় অভিজ্ঞতার আলোকে গ্রহণ করা হয়। এজন্য প্রকারেরআমলকরে ফল পাওয়ার অর্থ এটাই নয় যে, এগুলো হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কেউ রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে কোনো শরীয়ত সম্মত আমল করতে পারেন। তবে বিশুদ্ধ সনদ ছাড়া এরূপআমল’-কে হাদীস বলা যায় না

(রাসূলুল্লাহ ()-কে মহববত করা ঈমানের অংশ অত্যন্ত বড় নেককর্ম। যদি কেউ জাল হাদীসটির জালিয়াতি অবগত না হওয়ার কারণে এর উপর আমল করেন এবং রাসূলুল্লাহ ()-এর নাম শুনে হৃদয়ে মহববত ভালবাসা নিয়ে এভাবে আঙুলে চুমু খান, তবে তিনি জাল হাদীসে বর্ণিত সাওয়াব না পেলেও, মূল মহববতের সাওয়াব পাবেন, ইনশা আল্লাহ। তবে জেনেশুনে জাল হাদীসের উপর আমল করা জায়েয নয়

( জাল হাদীসের পরিবর্তে মুমিন একটি সহীহ হাদীসের উপর আমল করতে পারেন। দু হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখ মুছার বিষয়টি বানোয়াট হলেও উপরের বাক্যগুলো মুখে বলার বিষয়ে অত্যন্ত বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ  বলেছেন: ‘‘যদি কেউ মুআযযিনকে শুনে বলে:

أَشْهَدُ (وَأَنَا أَشْهَدُ) أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَحْدهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِالله رَبًّا وَبِمُحَمَّدٍ  رَسُوْلاً وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا

‘‘এবং আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। এবং মুহাম্মাদ () তাঁর বান্দা রাসূল। আমি তুষ্ট সন্তুষ্ট আছি আল্লাহকে প্রভু হিসেবে, ইসলামকে দীন হিসেবে এবং মুvহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হিসেবে।’’

রাসূলুল্লাহ () বলেন, যদি কেউ এভাবে উপরের বাক্যগুলো বলে, তবে তার সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।[2]

[1] দেখুন: ইমাম সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৮৩-৩৮৪, নং ১০২১, মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ২১০, নং ৮২৯, আল-মাসনূ, পৃ: ১৩৪, নং ৩০০, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৭৪, নং ৯৪০, আল-আজলূনী, কাশফুল খাফা /২০৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৩৯
[2]
মুসলিম১/২৯০, নং ৩৮৬, ইবনু খুযাইমাহ /২২০, ইবনু হিববান /৫৯১

 . আযানের জাওয়াবেসাদাকতা বারিরতা

ফজরের আযানেআস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউমশুনলে উত্তরে বলা হয়: ‘‘সাদাকতা বারিরতা (বারারতা)’ কথাটি ভিত্তিহীন বানোয়াট

বুখারী মুসলিম বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ  বলেছেন: ‘‘মুয়াযযিনকে যখন আযান দিতে শুনবে তখন মুয়াযযিন যা যা বলবে তোমরা তাই বলবে।[1] অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ()-এর কাছে ছিলাম। তখন বিলাল দাঁড়িয়ে আযান দিলেন। বিলাল আযান শেষ করলে রাসূলুল্লাহ  বললেন : ‘‘ ব্যক্তি (মুয়াযযিন) যা বলল, তা যদি কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলে তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[2]

উপরের হাদীসদ্বয় থেকে বুঝা যায় যে, মুয়াযযিন যা বলবেন, আযান শ্রবণকারী তাই বলবেন। কোনো ব্যতিক্রম বলতে বলা হয় নি। তবে মুসলিম সংকলিত অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ () এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম শিক্ষা দিয়েছেন, তা হলো, মুয়াযযিনহাইয়া আলাস সালাহহাইয়া আলাল ফালাহবললে, শ্রোতালা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহবলবেন। হাদীসে তিনি বলেছেন : ‘‘এভাবে যে ব্যক্তি মুয়াযযিনের সাথে সাথে আযানের বাক্যগুলো অন্তর থেকে বলবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[3]

তাহলে, উপরের দুটি বাক্য ছাড়া বাকি সকল বাক্য মুয়ায্যিন যেভাবে বলবেন, ‘জওয়াব দানকারীওঠিক সেভাবেই বলবেন।আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউমবাক্যটিও এর ব্যতিক্রম নয়। এর জওয়াবেও বাক্যটিই বলতে হবে। বাক্যটির জন্য ব্যতিক্রম কিছু বলতে হবে তা কোনো হাদীসে বলা হয় নি। এজন্য মোল্লা আলী কারী ‘‘সাদাকতা ওয়া বারিরতা’’ বাক্যটিকে জাল হাদীসের তালিকাভুক্ত করে বলেছেন: ‘‘শাফিয়ী মাযহাবের লোকেরা বাক্যটি বলা মুস্তাহাব বলেছেন, তবে হাদীসে এর কোন অস্তিত্ব নেই।[4]

[1] বুখারী /২২১, মুসলিম /২৮৮
[2]
হাদীসটি হাসান সহীহ ইবনু হিববান /৫৫৩, মুসতাদরাক হাকিম /৩২১, মুসনাদ আহমাদ /৩৫২, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা /৫১০, /১৪৬, সহীহুত তারগীব /১৭৭
[3]
সহীহ মুসলিম /২৮৯, নং ৩৮৫
[4]
দেখুন: মোল্লা আলী কারী, আল আসরারুল মারফুয়া, ১৪৬ পৃ

 . আযানের দোয়ার মধ্যেওয়াদ দারাজাতার রাফীয়াহ

রাসূলুল্লাহ  বলেন: ‘‘যখন তোমরা মুয়াযযিনকে আযান দিতে শুনবে, তখন সে যেরূপ বলে তদ্রূপ বলবে। এরপর আমার উপর সালাত পাঠ করবে ; কারণ যে ব্যক্তি আমার উপর একবার সালাত পাঠ করবে, আল্লাহ তাঁকে দশবার সালাত (রহমত) প্রদান করবেন। এরপর আমার জন্যওসীলাচাইবে ; কারণওসীলাহলো জান্নাতের এমন একটি মর্যাদা যা আল্লাহর একজন মাত্র বান্দাই লাভ করবেন এবং আমি আশা করি আমিই হব সে বান্দা। যে ব্যক্তি আমার জন্যওসীলাপ্রার্থনা করবে, তাঁর জন্য শাফায়াত প্রাপ্য হয়ে যাবে।[1]

অন্যান্য হাদীসে তিনিওসীলাপ্রার্থনার নিম্নরূপ পদ্ধতি শিখিয়েছেন:

اللَّهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ وَالصَّلاَةِ الْقَائِمَةِ آتِ مُحَمَّدًا الْوَسِيلَةَ وَالْفَضِيلَةَ وَابْعَثْهُ مَقَاماً مَحْمُوْداً (الْمَقَامَ الْمَحْمُودَ) الَّذِي وَعَدْتَهُ

‘‘হে আল্লাহ, এই পরিপূর্ণ আহবান এবং আসন্ন সালাতের প্রতিপালক, আপনি প্রদান করুন মুহাম্মাদকে () ওসীলা এবং মহামর্যাদা এবং তাঁকে উঠান সম্মানিত অবস্থানে, যা আপনি তাঁকে ওয়াদা করেছেন।’’

তিনি বলেছেন, ‘‘মুয়াযযিনের আযান শুনে যে ব্যক্তি উপরের বাক্যগুলো বলবে, তাঁর জন্য কিয়ামতের দিন আমার শাফাআত পাওনা হয়ে যাবে।[2]

ইমাম বুখারীসহ সকল মুহাদ্দিস এভাবেই দোয়াটি সংকলন করেছেন। আমাদের দেশে প্রচলিত আযানের দোয়ার মধ্যে দুটি বাক্য অতিরিক্ত রয়েছে, যা উপরের দোয়াটিতে নেই। প্রথম বাক্যটিতে (والفضيلة : ওয়াল ফাদীলাতা)- পরে والدرجة الرفيعة(এবং সুঊচ্চ মর্যাদা) বলা এবং দ্বিতীয় বাক্যটি দোয়ার শেষে :إنك لا تخلف الميعااد’ (নিশ্চয় আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না) বলা। দ্বিতীয় বাক্যটি একটি দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে[3] আর প্রথম বাক্যটি (ওয়াদ-দারাজাতার রাফীআহ) একেবারেই ভিত্তিহীন মিথ্যা হাদীস নির্ভর। ইবনু হাজার, সাখাবী, যারকানী, মোল্লা আলী কারী অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এই বাক্যটি (ওয়াদ-দারাজাতার রাফীয়াহ) বানোয়াট[4]

[1] সহীহ মুসলিম /২৮৮, নং ৩৮৪
[2]
সহীহ বুখারী /২২২, নং ৫৮৯, /১৭৪৯, নং ৪৪৪২
[3]
বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা /৪১০ (৬০৩-৬০৪)
[4]
ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর /২১১, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ২২২-২২৩, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ. ১০৭, মোল্লা আলী কারী আল-মাসনূ’, পৃ. ৭০-৭১, আল-আসরার, পৃ. ১২২, মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী, পৃ. /৫৩২

 . আযানের দুআয়: ‘‘ওয়ারযুকনা শাফাআতাহু’’

কেউ কেউ আযানের দুআর মধ্যে আরেকটি বাক্য সংযোজন করে বলেন: (وارزقنا شفاعته): ‘‘এবং আমাদেরকে তাঁর শাফাআত রিযক দান করুন/ প্রদান করুন’’ বাক্যটিও ভিত্তিহীন। কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে আযানের দুআর মধ্যে বাক্যটি বর্ণিত হয় নি। আল্লাহর কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফাআতের রিযক লাভের জন্য দুআ করার মধ্যে কোনো দোষ নেই। তবে দুটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়:

প্রথম: মাসনূন দুআর মধ্যে অতিরিক্ত কোনো শব্দ বা বাক্য সংযোজন বা পরিবর্তন হাদীস শরীফে নিষেধ করা হয়েছে এবং সাহাবীগণ এরূপ কর্মের প্রতিবাদ করতেন। ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বস্ত্তত কখন কোন্ দুআ করলে আল্লাহ সবচেয়ে খুশি হন এবং মুমিনের সবচেয়ে বেশি লাভ হয় তা সবচেয়ে ভাল জানতেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাজেই তাঁর শেখানো কোনো দুআর মধ্যে পরিবর্তন বা সংযোজনের অর্থ হলো তাঁর দুআটিকে অসম্পূর্ণ বলে ধারণা করা বা মাসনূন দুআতে পরিপূর্ণ ফযীলত, বরকত বা কামালাত লাভ হলো না বলে কল্পনা করা। এতে সুন্নাতকে অপছনদ করা হয় বিদআতের উৎপত্তি হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: (مَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ): যে আমার সূন্নাতকে অপছন্দ করবে তার সাথে আমার সম্পর্ক নেই (সে আমার উম্মাত নয়)’’[1]

দ্বিতীয়: আযানের দুআয় শাফাআত প্রার্থনা সংযোজন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতিশ্রুতিতে অনাস্থা প্রমাণ করে। কারণ তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি তাঁর শেখানো বাক্যে তাঁর জন্য ‘‘ওয়াসীলা’’ প্রার্থনা করবে তাঁর শাফাআত তার জন্য ওয়াজিব হবে। কাজেই মুমিন দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে মাসনূন দুআ পাঠ করে দৃঢ় আশা করবেন যে, তাঁর জন্য শাফাআত পাওনা হলো

[1] বুখারী, আস-সহীহ /১৯৪৯; মুসলিম, আস-সহীহ /১০২০, নং ১৪০১

 . আযানের সময় কথা বলার ভয়াবহ পরিণতি!

আযানের সময় কথা বলার নিষেধাজ্ঞা বুঝাতে হাদীসটিবলা হয়:

مَنْ تَكَلَّمَ عِنْدَ الأَذَانِ خِيْفَ عَلَيْهِ زَوَالُ الإِيْمَانِ

‘‘যে ব্যক্তি আযানের সময় কথা বলবে, তার ঈমান বিনষ্ট হওয়ার ভয় আছে।’’ আল্লামা সাগানী, আজলূনী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, বাক্যটি হাদীসের নামে বানানো ভিত্তিহীন জাল কথা। আযানের সময় কথা বলা যাবে না মর্মে কোনো নির্দেশনা হাদীসে বর্ণিত হয় নি[1]

[1] সাগানী, আল-মাউদূআত, পৃ. ৮০; আজলূনী, কাশফুল খাফা /২৯৫, ৩১৫

No comments

Powered by Blogger.