হাদীসের নামে জালিয়াতি - অধ্যায়-২৯ - সালাত ও আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গ - (গ) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত বিষয়ক

. সালাতের প্রকার ফযীলত ১৫ প্রকার শাস্তি

কুরআন-হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, ওয়াক্ত ফরয সালাত যথাসময়ে আদায় করা মুমিনের সর্বপ্রথম সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব। সালাতই মুমিনের পরিচয় এবং ঈমান কুফরীর মধ্যে পার্থক্য। সালাত পরিত্যাগকারীকাফিরদের দলভুক্তবলে গণ্য হবে। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম সালাতেরই হিসাব গ্রহণ করা হবে। এভাবে অগণিত সহীহ হাদীস থেকে আমার ফরয সালাতের গুরুত্ব সালাতে অবহেলার ভয়াবহ পরিণতি জানতে পারি

কিন্তু সাধারণ মানুষদের অবাক করার জন্য জালিয়াতগণ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, সমাজে প্রচলিত অনেক গ্রন্থেই কুরআনের আয়াত সহীহ হাদীসের পরিবর্তে সকল বানোয়াট ভিত্তিহীন কথাগুলো লেখা হয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকারের ক্যালেন্ডার, পোস্টার ইত্যাদিতেও সকল বানোয়াট কথাগুলি লিখে প্রচার করা হয়। বিষয়ে একটি দীর্ঘ জাল হাদীস আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। জাল হাদীসটির সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ:

যে ব্যক্তি যথারীতি গুরুত্ব সহকারে নামায আদায় করবে আল্লাহ পাক তাকে পাঁচ প্রকারে সম্মানিত করবেন: রুজী রোজগার জীবনের সংকীর্ণতা হতে তাকে মুক্ত করবেন, তার উপর হতে কবরের আযাব উঠিয়ে দিবেন, কিয়ামতের দিন তার আমলনামা ডান হাতে দান করবেন, সে ব্যক্তি পুলসিরাতের উপর দিয়ে বিদ্যুতের মত পার হয়ে যাবে এবং বিনা হিসাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি নামাযের ব্যাপারে অলসতা করে তাকে পনের প্রকারের শাস্তি দেওয়া হয়। তন্মধ্যে পাঁচ প্রকার দুনিয়াতে, তিন প্রকার মৃত্যুর সময় তিন প্রকার কবরে এবং তিন প্রকার কবর হতে বের হওয়ার পর। পনের বা চৌদ্দ প্রকারের শাস্তির বিস্তারিত বিবরণ প্রায় সকল প্রচলিত নামায শিক্ষা, আমলিয়াত ইত্যাদি বইয়ে পাওয়া যায়। এজন্য মিথ্যা ভিত্তিহীন কথাগুলো লিখে বইয়ের কলেবর বাড়াচ্ছি না

দীর্ঘ হাদীসটি পুরোটিই ভিত্তিহীন জাল। কোনো হাদীসগ্রন্থে হাদীসটি পাওয়া যায় না। পরবর্তী যুগের কোনো কোনো আলিম তাদের ওয়ায নসীহত মূলক গ্রন্থে অন্য সকল প্রচলিত কথার সাথে এই কথাগুলোও হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের ইমামগণ সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছেন যে, এই কথাগুলো বাতিল জাল কথা। কোন্ ব্যক্তি জালিয়াতি করেছে তাও তাঁরা উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী, সয়ূতী, ইবনু আর্রাক প্রমুখ মুহাদ্দিস বিষয়ে আলোচনা করেছেন[1]

শাইখুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মাদ যাকারিয়া কান্ধলভী (রাহ) তাঁরফাযায়েলে নামাযগ্রন্থে জাল হাদীসটি আরবী ইবারত-সহ পুরোপুরি উল্লেখ করেছেন। তিনি হাদীসটি উল্লেখ করার আগে বলেছেন, কেউ কেউ বলেছেন, কথাটি নাকি হাদীসে আছে.... হাদীসটি উল্লেখ করার পরে তিনি সংক্ষেপে বলেছেন যে, ইমাম যাহাবী, ইমাম সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি জাল বাতিল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। এর সনদের জালিয়াতদের পরিচয়ও তাঁরা তুলে ধরেছেন[2]

এভাবে আল্লামা যাকারিয়া (রাহ) হাদীসটির জালিয়াতির বিষয়টি উল্লেখ করে তাঁর আমানত আদায় করেছেন। কিন্তু অনুবাদে আমানত রক্ষা করা হয় নি। আল্লামা যাকারিয়া (রাহ) -এর আলোচনা অনুবাদে উল্লেখ করা হয় নি। অনুবাদের শুরুতে বলা হয়েছে: ‘‘এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে..’’ শেষে শুধুমাত্র লেখা হয়েছেযাওয়াজির ইবন হাজার মাক্কী (রাহ)’ এতে সাধারণ পাঠক একে নির্ভরযোগ্য হাদীস বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ()-এর কথা বলেই বিশ্বাস করছেন। অথচ মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কোনো জাল হাদীসকেজালবলে উল্লেখ না করেহাদীসবলে বর্ণনা করা কঠিন হারাম। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন

[1] যাহাবী, মীযানুল তিদাল /২৬৪; ইবনু হাজার, মীযানুল তিদাল /২৯৫; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৯৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১১৩-১১৪
[2]
হযরত মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী, ফাযায়েলে আমল, পৃ. ১০৪-১০৮

 . সালাত মুমিনদের মিরাজ

একটি অতি প্রচলিত ভিত্তিহীন সনদহীন জাল হাদীস

اَلصَّلاَةُ مِعْرَاجُ الْمُؤْمِنِيْنَ

‘‘নামায মুমিনদের মিরাজ।[1]

এখানে লক্ষণীয় যে, অর্থের কাছাকাছি অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। মুমিন সালাতের মধ্যে আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করেন, সালাতে দাঁড়ালে আল্লাহ মুমিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন... ইত্যাদি সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এগুলোর পরিবর্তে অনেকে ভিত্তিহীন কথাটিকে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বলে তাঁর নামে মিথ্যা বলার অপরাধে অপরাধী হয়ে যান

[1] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১২৩

 . ৮০ হুক্বা বা হুকবা শাস্তি

‘‘মাজালিসুল আবরার নামক কেতাবে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ () ফরমাইয়াছেন, যেই লোক সময়মত নামায পড়িল না, নামাযের ওয়াক্ত শেষ হইবার পরে কাযা পড়িল, সেই লোকও জাহান্নামে ৮০ হুকবা শাস্তি ভোগ করিবে। ৮০ বছরে এক হুকবা আর ৩৬০ দিনে এক বৎসর। ৩৬০ * ৮০ = ২৮,৮০০ দিন। অতএব তাকে ২৮,৮০০ দিন এক ওয়াক্ত নামায না পড়িবার জন্য দোজখের আগুনে জ্বলিতে হইবে। আর আখেরাতের দিন হইবে দুনিয়ার এক সহস্র বৎসরের তুল্য। এই হিসাবে এক ওয়াক্ত নামায তরককারীকে দুই কোটি অষ্টাশি লক্ষ বৎসর জাহান্নামের আগুনে শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।[1]

শাইখুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া কান্ধালভী (রাহ) হাদীসটিকে তারফাযায়েলে নামাযগ্রন্থে নিম্নরূপে উদ্ধৃত করেছেন:

مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ حَتَّى مًضًى وًقْتُهَا ثُمَّ قَضَى عُذِّبَ فِيْ النَّارِ حُقْباً، وَالْحُقْبُ ثَمَانُوْنَ سَنَةً، وَالسَّنَةُ ثَلاَثُمِائَةٍ وَسِتُّوْنَ يَوْماً، كُلُّ يَوْمٍ مِقْدَارُهُ أَلْفُ سَنَةٍ.

‘‘যে ব্যক্তি ওয়াক্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত সালাত আদায় করল না, এবং এরপর সে কাযা করল, তাকে জাহান্নামে এক হুক্বা শাস্তি প্রদান করা হবে। এক হুকবা ৮০ বছর এবং এক বৎসর ৩৬০ দিন এবং প্রত্যেক দিনের পরিমাণ এক হাজার বৎসরের সমান।’’ হাদীসটি উদ্ধৃত করে তিনি বলেন:

كذا في مجالس الأبرار. قلت: لم أجده فيما عندي من كتب الحديث

‘‘মাজালিসুল আবরার নামক গ্রন্থে এভাবে লিখা হয়েছে। আমার বক্তব্য হলো, আমার নিকটে যত হাদীসের পুস্তক রয়েছে সেগুলোর কোনো পুস্তকেই আমি হাদীসটি দেখতে পাই নি।...’[2]

আর তাঁর মত একজন মুহাদ্দিস যে হাদীস কোনো হাদীসের গ্রন্থে খুঁজে পান নি সে হাদীসের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বস্ত্তত, হাদীসটি ভিত্তিহীন সনদহীন একটি বানোয়াট কথামাত্র। কোথাও কোনো প্রকার সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট সনদেও কথাটি সংকলিত হয় নি। জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে শেষ যুগের কোনো কোনো আলিম তা নিজ গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে সংকলন করেছেন

এখানে উল্লেখ্য যে, কথাটি যে কোনো হাদীসের গ্রন্থে নেই এবংমাজালিসুল আবরার’-এর লেখক সনদবিহীনভাবে তা উল্লেখ করেছেন, তা জানা সত্ত্বেও অনেক ভাল আলিম ওয়াযে-আলোচনায় এবং লিখনিতে হাদীস অনুরূপ অনেক জাল দুর্বল হাদীস উল্লেখ করেন। মানুষের হেদায়েতের আগ্রহেই তাঁরা তা করেন। মনে হয়, তাঁরা চিন্তা করেন, কুরআন কারীমের হাজার হাজার আয়াত এবং প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত হাজার হাজার সহীহ হাদীস মানুষদের হেদায়াত করতে আর সক্ষম নয়। কাজেই এগুলোর পাশাপাশি কিছু দুর্বল (!) হাদীসও আমাদের না বলে উপায় নেই!! অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, জাল বলে সন্দেহকৃত হাদীস উল্লেখ করাও হাদীস জালিয়াতির মতই কঠিনতম পাপ। আমরা কি অন্যের হেদায়তের আগ্রহে নিজেদের জন্য জাহান্নাম ক্রয় করব?!

[1] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩১
[2]
শাইখুল হাদীস যাকারিয়া কান্ধালভী, ফাযায়েলে নামায, পৃ. ৫৭-৫৮

 . জামাআতে সালাত আদায়ে নবীগণের সাথে হজ্জ

জামাআতে সালাত আদায় করা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। কুরআনে মুমিনগণকে একত্রে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অগণিত সহীহ হাদীসে জামাআতে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জামাআত ছেড়ে একা সালাত আদায়কারীকে মুনাফিক বলা হয়েছে। আযান শোনার পরেও যে ব্যক্তি অসুস্থতা বা ভয়ের ওযর ছাড়া জামাআতে না এসে একা সালাত আদায় করবে তার সালাত কবুল হবে না বলে সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে

জামাতে সালাত আদায়ের বিধান সম্পর্কে ফিকহী পরিভাষাগত মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, কেউ বলেছেন ওয়াজিব কেউ বলেছেন ফরয। মতভেদ একান্তই পরিভাষাগত। কারণ সকলেই একমত যে, পুরুষের জন্য ওযর ছাড়া ফরয সালাত একা আদায় করলে কঠিন গোনাহ হবে। সালাত হবে কি না সে বিষয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে

সকল সহীহ হাদীসের পাশাপাশি জালিয়াতগণ বিষয়ে অনেক জাল হাদীস তৈরি করেছে। আর বিষয়েও সহীহ হাদীসগুলো বাদ দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সব জাল হাদীসই বই পুস্তকে লেখা হয় ওয়াযে বলা হয়। সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, ইশা ফজরের সালাত জামাতে আদায় করলে সারারাত্র তাহাজ্জুদের সালাত আদায়ের সাওয়াব হবে, ফজরের সালাত জামাতে আদায় করলে আল্লাহর দায়িত্বে থাকা যাবে ... ইত্যাদি। কিনত সকলসামান্যসাওয়াবের কথায় মন না ভরায় জালিয়াতগন বানিয়েছে:

مَنْ صَلَّى صَلاَةَ الصُّبْحِ فِيْ الْجَمَاعَةِ فَكَأَنَّمَا حَجَّ مَعَ آَدَمَ خَمْسِيْنَ حَجَّةً..

‘‘যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাআতে আদায় করল সে যেন আদম () এর সাথে ৭০ বার হজ্জ করল ...’’ এভাবে প্রত্যেক ওয়াক্তের সাথে একজন নবীকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে...[1]

অনুরূপ বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: যে ব্যক্তি ফজর ইশার সালাত জামাতে আদায় করল, সে যেন আদমের () পিছনে সালাত আদায় করল... এভাবে এক এক সালাতের জন্য এক এক নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে...[2]

[1] সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ.৮৩; সাগানী, আল-মাউদূআত পৃ. ৪২; পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৩৯, ১০৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৫৫
[2]
অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, নেক কানুন, পৃ ১০২-১০৩

 . মুত্তাকী আলিমের পিছনে সালাত নবীর পিছনে সালাত

জামাআতে সালাত আদায়ের কারণে সাওয়াব বৃদ্ধির কথা সহীহ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি। বিভিন্ন হাদীসে কুরআনের তিলাওয়াত জ্ঞানে পারদর্শী, হাদীসের জ্ঞানে পারদর্শী, হিজরত অন্যান্য নেক আমলে অগ্রবর্তী ব্যক্তিগণকে ইমামতি প্রদানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে ইমামেরতাকওয়াবাইলমেরকারণে মুক্তাদিগণেরসাওয়াববাবরকতবেশি হবে, এরূপ অর্থে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। অর্থে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই অত্যন্ত যয়ীফ অথবা বানোয়াট। এইরূপ একটি ভিত্তিহীন কথা:

مَنْ صَلَّى خَلْفَ عَالِمٍ تَقِيٍّ، فَكَأَنَّمَا صَلَّى خَلْفَ نَبِيٍّ

‘‘যে ব্যক্তি কোনো মুত্তাকি আলিমের পিছনে সালাত আদায় করল, সে যেন একজন নবীর পিছনে সালাত আদায় করল।’’

ফিক্হের প্রসিদ্ধ গ্রন্থহেদায়া’- প্রণেতা আল্লামা আলী ইবনু আবী বাক্র মারগীনানী (৫৯২ হি) জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে কথাটিকে হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন কিন্তু মুহাদ্দিসগণ অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, কথাটি কোনো হাদীস নয়। কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে তা কোনো গ্রন্থে সংকলিত হয় নি। এজন্য আল্লমা যাইলায়ী, ইরাকী, ইবনু হাজার, সুয়ূতী, সাখাবী, তাহির পাটনী, মোল্লা আলী কারী, আজলূনী প্রমুখ মুহাদ্দিস কথাটিকে জাল হাদীস হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছেন[1]

[1] মারগীনানী, হেদায়া /৫৭; যাইলায়ী, নাসবুর রাইয়াহ /২৬; ইবনু হাজার, আদ-দিরাইয়া /১৬৮; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩১১; মোল্লা আলী কারী, আল-মাসনূ, পৃ. ১৫২; আল-আসরার, পৃ. ১৪৭, ২৩৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা /৩৭, ১২২, ৩৩৭; তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূআত, পৃ. ৪০; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৫৫

 . আলিমের পিছনে সালাত ৪৪৪০ গুণ সাওয়াব

এই জাতীয় আরেকটি বানোয়াট কথা হলো,

اَلصَّلاَةُ خَلْفَ الْعَالِمِ بِأَرْبَعَةِ آلاَفٍ وَأَرْبَعِمِائَةٍ وَأَرْبَعِيْنَ صَلاَةً

আলিমের পিছনে সালাতে ৪৪৪০ গুণ সাওয়াব।[1]

[1] মোল্লা আলী কারী, আল-মাসনূ, পৃ. ১৫২; আল-আসরার, পৃ. ১৪৭

 . পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রাকআত সংখ্যার কারণ

পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রাকআত সংখ্যা ১৭ হলো কেন, ফজর রাকআত, যুহর রাকআত, আসর রাকআত, মাগরিব রাকআত ইশা রাকআত হলো কেন, বিত্র রাকআত হলো কেন, ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত সকল কথাই ভিত্তিহীন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ওয়াক্তের সালাতকে বিভিন্ন নবীর আদায় করা বা প্রতিষ্ঠিত বলে যে সকল গল্প বলা হয় সবই ভিত্তিহীন। জাতীয় অনেক ভিত্তিহীন কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত। এখানে একটি গল্প উল্লেখ করছি

আমাদের দেশে অতি প্রসিদ্ধ কোনো কোনো পুস্তকে লেখা হয়েছে: ‘‘বেতের নামায ওয়াজিব হইবার কারণ এই যে, এরশাদুত্বালেবীন কিতাবে লিখিত আছে হযরত () মেরাজ শরীফে যাইবার সময়ে যখন বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত তাশরীফ নিয়াছিলেন তখন সমস্ত পয়গম্বরের রুহ মোবারক হযরত ()-এর সাক্ষাত আশীর্বাদের জন্য আসিলে জিব্রাইল () এর আদেশানুযায়ী হযরত () ইমাম হইয়া এক রাকাত নামায পড়িলেন। তার পর মিকাইল () ৭০ হাজার ফেরেশতা লইয়া হযরত ()-এর মোলাকাত দোয়ার প্রত্যাশী হইলে জিব্রাইল ()-এর আদেশ অনুযায়ী রাসূল () পূনরায় আরও এক রাকাত নামায পড়িলেন। ইহার পর ইস্রাফীল () ৭০ হাজার ফেরেশতা লইয়া হযরত ()-এর দোওয়ার প্রত্যাশী হইলে জিব্রাইল ()-এর হুকুম অনুযায়ী আবার হযরত () তাহাদিগকে মুক্তাদি করিয়া এক রাকাত নামায পড়িলেন। অতঃপর আজরাঈল () বহু ফেরেশতা লইয়া এরূপ বাসনা করিয়া উপস্থিত হইলে জিব্রাইল () বলিলেন, হে প্রিয় পয়গম্বর আপনি ইহাদিগকে সঙ্গে করিয়া দোওয়া কুনুত পাঠ করান। হযরত () তাহাই করিলেন সুতারং তিন রাকাত নামাযই আমাদের উপর ওয়াজিব হইয়াছে এবং বেতের নামাযে দোওয়া কুনূত পড়াও ওয়াজেব হইয়াছে।[1]

কোনো কোনো জালিয়াত ঘুরিয়ে বলেছে যে, তিনি মিরাজের রাত্রিতে মূসা () এর জন্য এক রাকআত, তাঁর নিজের জন্য আরেক রাকআত এবং শেষে আল্লাহর নির্দেশে তৃতীয় রাকআত সালাত আদায় করেন। ...[2]

[1] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ১৯২-১৯৩
[2]
অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, নেক কানুন, পৃ ১১৫

 . উমরী কাযা

সালাত মুমিনের জীবনের এমন একটি ফরয ইবাদত যার কোনো বিকল্প নেই বা কাফ্ফারা নেই। যতক্ষণ হুশ বা চেতনা থাকবে সালাত আদায় করতেই হবে। দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, দৌঁড়িয়ে, হেঁটে, ইশারায় বা যেভাবে সম্ভব সালাত আদায় করতে হবে। চেতনা রহিত হলে সালাত মাফ হয়ে যাবে

কোনো বিশেষ কারণে একান্ত বাধ্য হয়ে দুই এক ওয়াক্ত সালাত ছুটে গেলে কাযা করতে হবে। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক ওয়াক্তের সালাতের কাযা করার কোনোরূপ বিধান হাদীস শরীফে দেয়া হয় নি। কারণ, কোনো মুসলিম সালাত পরিত্যাগ করতে পারে, এরূপ চিন্তুা রাসূলুল্লাহ () সাহাবীগণের যুগে ছিল না। সাহাবীগণ বলতেন, একজন মুসলিম অনেক পাপ করতে পারে, কিন্তু মুসলিম কখনো সালাত পরিত্যাগ করতে পারে না

পরবর্তী যুগের মুসলিম ফকীহগণ বিষয়ে মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে এক ওয়াক্ত সালাত ত্যাগ করলে সে ব্যক্তি কাফির বা অমুসলিমে পরিণত হবে। কেউ বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তিসালাতেরগুরুত্ব পুরোপুরি স্বীকার করেন, কিন্তু অলসতা হেতু সালাত ত্যাগ করেছেন, তিনিকাফিরের মতকঠিন পাপী বলে গণ্য হবেন, কিন্তুকাফিরবা অমুসলিম বলে গণ্য হবেন না। আর যদি কেউ মনে করেন যে, ওয়াক্ত সালাত নিয়মিত আদায় না করেও তিনি নামাযী মুসলমানদের মতই মুসলমান, তাহলে সে ব্যক্তি সালাতের গুরুত্ব অস্বীকার করার কারণে প্রকৃত কাফির বলে গণ্য হবেন

সর্বাবস্থায় সকলেই একমত যে, ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘ সময়ের সালাত পরিত্যাগ করলে পরে সে সালাতেরকাযাকরার বিষয়ে হাদীসে কোনোরূপ বিধান দেয়া হয় নি। তবে জালিয়াতগণ বিষয়ে কিছু জাল হাদীস তৈরি করেছে। এছাড়া সমাজে কিছু প্রচলিত ভিত্তিহীন কথাবার্তাও বিষয়ে প্রচলিত আছে। দুটি ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। প্রথমত, উমরী কাযা দ্বিতীয়ত, কাফ্ফারা বা এস্কাত। বিষয়ে জালিয়াতদের বানানো একটি হাদীস:

قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! إِنِّيْ تَرَكْتُ الصَّلاَةَ، قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: فَاقْضِ مَا تَرَكْتَ. فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، كَيْفَ أَقْضِيْ؟ فَقَالَ: صَلِّ مَعَ كُلِّ صَلاَةٍ صَلاَةً مِثْلَهَا، قَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! قَبْلُ أَمْ بَعْدُ؟ قَالَ: لاَ بَلْ قَبْلُ

‘‘এক ব্যক্তি বলে, হে আল্লাহর রাসূল, আমি সালাত পরিত্যাগ করেছি। তিনি বলেন, তুমি যা পরিত্যাগ করেছ তাকাযাকর। লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমি কিভাবে তাকাযাকরব? তিনি বলেন, প্রত্যেক ওয়াক্তের সালাতের সাথে অনুরূপ সালাত আদায় কর। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আগে, না পরে? তিনি বলেন, না, বরং আগে।’’

মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল, ভিত্তিহীন বাতিল[1] যদি কোনো মুসলিম দীর্ঘদিন সালাতে অবহেলার পরে অনুতপ্ত হয়ে নিয়মিত সালাত শুরু করেন, তখন তার প্রধান দায়িত্ব হবে বিগত দিনগুলোর পরিত্যক্ত সালাতের জন্য বেশি বেশি করে কাঁদাকটি তাওবা করা। এর পাশাপাশি, অনেক ফকীহ বলেছেন যে, ব্যক্তি পরিত্যক্ত সালাতগুলো নির্ধারণ করে তাকাযাকরবেন। এভাবেউমরী কাযাকরার কোনো নির্ধারিত বিধান কুরআন বা হাদীসে নেই। হলো সাবধানতামূলক কর্ম। আশা করা যায় যে, তাওবা কাযার মাধ্যমে আল্লাহ তার অপরাধ ক্ষমা করবেন

[1] জূযকানী, আল-আবাতীল /৫০; ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূআত /২৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী /২৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /৮০; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৩৫

 . কাফ্ফারা এস্কাত

ইসলামে সিয়াম বা রোযার জন্য কাফ্ফারার বিধান রয়েছে। কোনো মুসলিম অপারগতার কারণে সিয়াম পালন করতে না পারলে এবং কাযার ক্ষমতাও না থাকলে তিনি তার প্রতিটি ফরয সিয়ামের পরিবর্তে একজন দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করবেন। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে প্রতিটি সিয়ামের পরিবর্তে একটি ফিত্রার পরিমাণ খাদ্য প্রদানের বিধান দিয়েছেন ফকীহগণ

কিন্তু সালাতের জন্য এরূপ কোনো কাফ্ফারার বিধান হাদীসে নেই। কারণ সিয়ামের ক্ষেত্রে যে অপারগতার সম্ভাবনা রয়েছে, সালাতের ক্ষেত্রে তা নেই। যতক্ষণ চেতনা আছে, ততক্ষণ মুমিন ইশারা-ইঙ্গিতে যেভাবে পারবেন সেভাবেই তার সাধ্যানুসারে সালাত আদায় করবেন। কাজেই অপারগতার কোনো ভয় নেই। আর দীর্ঘস্থায়ীভাবে চেতনা রহিত হলে সালাতও রহিত হবে

তবুও পরবর্তী যুগের কোনো কোনো ফকীহ সাবধানতামূলকভাবে সালাতের জন্যও কাফফারার বিধান দিয়েছেন। নিয়মিত সালাত আদায়কারী কোনো মুমিন যদি মৃত্যুর আগে অসুস্থতার কারণে কিছু সালাত আদায় করতে না পারেন, তবে মৃত্যুর পরে তার জন্য সিয়ামের মত প্রত্যেক সালাতের বদলে একটি করেফিতরাপ্রদানের বিধান দিয়েছেন

কেউ কেউ বিধানকে আবার আজীবন সালাত পরিত্যাগকারী সালাতকে অবজ্ঞা উপহাসকারীর জন্যও প্রয়োগ করেছেন। এরপর খাদ্যের বদলে কুরআন প্রদানের এক উদ্ভট বিধান দিয়েছেন। প্রচলিত একটি পুস্তকে বিষয়ে লিখা হয়েছে: ‘‘এস্কাত করিবার নিয়ম এই যে, প্রথমত মুর্দার বয়স হিসাব করিবে। তম্মধ্য হইতে পুরুষের বার বছর স্ত্রী লোকের বছর (নাবালেগী) বয়স বাদ দিয়া বাকী বয়সের প্রত্যেক বৎসর ৮০ তোলা সেরের ওজনের ১০ মন ১০ সের ময়দার মূল্য ধরিয়া মূল্যের পরিবর্তে নিজে এক জেলদ কোরআন শরীফ সকলের সম্মুখে কোন গরীব মিছকীনের নিকট হাদিয়া করিয়া দিবে। এবং সকলের মোকাবেলা বলিবে যে, অমুকের উপরোক্ত হুকুকের জন্য খোদায়ী পাওনা এত হাজার, এত শত, এত মণ ময়দার পরিবর্তে এই কালামুল্লাহ তোমার নিকট হাদীয়া করিলাম। গরীব বা মিছকীন দুইজন সাক্ষীর মোকাবিলা উহা কবুল করিলে কালামুল্লাহ তাহারই হইয়া গেল এবং ময়দা আদায় করা তাহার উপর ওয়াজিব হইয়া গেল।[1]

উদ্ভট নিয়মটি শুধু বানোয়াটই নয়, আল্লাহর দীনের সাথে চরম উপহাস! এর চেয়ে বড় উপহাস আর কি হতে পারে!! আজীবন সালাত অবমাননা করে, সালাতকে নিয়ে অবজ্ঞা উপহাস করে, মরার পরে এক জিলদকুরআনফকীরকে দিয়েই মাফ!!!

[1] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ১৮১

No comments

Powered by Blogger.