হাদীসের নামে জালিয়াতি - অধ্যায়-৩১ - বার চাঁদের সালাত ও ফযীলত

. মুহাররাম মাস

বছরের বার মাসে বিভিন্ন মাসের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন আকৃতি প্রকৃতির সালাত সেগুলোর নামে আজগুবি উদ্ভট সব ফযীলতের বর্ণনা দিয়ে হাদীস বানিয়েছে জালিয়াতগণ। প্রচলিতবার চাঁদের ফযীলতজাতীয় গ্রন্থগুলো সব বাতিল কথায় ভরা। পাঠকদের সুবিধার্থে আমি আরবী মাসগুলোর উল্লেখ করে, সে বিষয়ক সহীহ বানোয়াট সালাত, সিয়াম, অন্যান্য আমল ফযীলতের কথা উল্লেখ করব। আল্লাহর তাওফীক চাই

. মুহাররাম মাস

() সহীহ হাদীসের আলোকে মুহার্রাম মাস

আরবী পঞ্জিকার প্রথম মাস মুহাররাম। সহীহ হাদীসের আলোকে আমরা মাসের ফযীলত সম্পর্কে নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারি:

() বৎসরের চারটিহারামমাস: মুহার্রাম, রজব, যিলকাদ যুলহাজ্জ মাস। মাসগুলো ইসলামী শরীয়তে বিশেষভাবে সম্মানিত। এগুলোতে ঝগড়াঝাটি বা যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেছেন: ‘‘আকাশমন্ডলী পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারটি, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং নিষিদ্ধ মাসগুলোর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না...[1]

()  মাসকে সহীহ হাদীসেআল্লাহর মাসবলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং মাসের নফল সিয়াম সর্বোত্তম নফল সিয়াম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ () বলেন:

أفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ المُحَرَّمُ

‘‘রামাদানের পরে সর্বোত্তম সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুহার্রাম মাস।[2]

( মাসের ১০ তারিখআশূরা দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। আশূরার সিয়াম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ () বলেন:

يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ

‘‘ দিনের সিয়াম গত এক বছরের পাপ মার্জনা করে।[3]

দিনে রাসূলুল্লাহ () নিজে সিয়াম পালন করতেন, তাঁর উম্মাতকে সিয়াম পালনে উৎসাহ দিয়েছেন এবং ১০ তারিখের সাথে সাথে বা ১১ তারিখেও সিয়াম পালন করতে উৎসাহ দিয়েছেন[4]

(সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, দিনে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল মূসা () তাঁর সঙ্গী বনী ইসরাঈলকে ফির্আউনের হাত থেকে উদ্ধার করেন এবং ফিরআউন তার সঙ্গীদেরকে ডুবিয়ে মারেন[5]

() অত্যন্ত দুর্বল হাদীস সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্য

সহীহ হাদীস থেকে মুহার্রাম মাস আশুরা সম্পর্কে শুধু এতটুকুই জানা যায়। পরবর্তীকালে অনেক বানোয়াট মিথ্যা কাহিনী এক্ষেত্রে প্রচলিত হয়েছে। এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়:

প্রথম বিষয়:  দিনটিকে ইহূদীগণ সম্মান করত। কারণে ইহূদীদের মধ্যে দিনটি সম্পর্কে অনেক ভিত্তিহীন কল্প-কাহিনী প্রচলিত ছিল। পরবর্তী যুগে ইসরাঈলী রেওয়ায়াত হিসাবে সেগুলো মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। প্রথম যুগে মুসলিমগণ এগুলো সত্য বা মিথ্যা বলে বিশ্বাস না করে ইসরাঈলী কাহিনী হিসাবেই বলেছেন। পরবর্তী যুগে তাহাদীসেপরিণত হয়েছে

দ্বিতীয় বিষয়: রাসূলুল্লাহ ()-এর ইন্তিকালের অর্ধ শতাব্দী পরে ৬১ হিজরীর মুহার্রাম মাসের ১০ তারিখে আশূরার দিনে তাঁর প্রিয়তম নাতি হুসাইন (রা) কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। ঘটনা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। হুসাইন (রা)-এর পক্ষের বিপক্ষের অনেক বিবেকহীন দুর্বল ঈমান মানুষআশূরারবিষয়ে অনেকহাদীসবানিয়েছে। কেউ দিনটিকেশোক দিবসহিসেবে এবং কেউ দিনটিকেবিজয় দিবসহিসেবে পালনের জন্য নানা প্রকারের কথা বানিয়েছেন। তবে মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতিতে সকল জালিয়াতি ধরা খুবই সহজ ছিল

মুহার্রাম আশূরা সম্পর্কে এজাতীয় প্রচলিত কথাবার্তাকে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি: () যে সকলহাদীসকোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করলেও, কেউ কেউ তা দুর্বল হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং যে সকলহাদীসঅত্যন্ত দুর্বল সনদে কোনো কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। বাহ্যত ইসরাঈলী বর্ণনার ভিত্তিতে তাঁরা এগুলি বলেছেন। (সকল মুহাদ্দিস যে সকল হাদীসকেজাল ভিত্তিহীন বলে একমত পোষণ করেছেন। এখানে আমরা প্রথম পর্যায়ের কিছু হাদীস মতামত উল্লেখ করছি:

1.     অত্যন্ত দুর্বল সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, দিনে আল্লাহ তাআলা আদম ()-এর তাওবা কবুল করেন

2.     অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, দিনে নূহ () এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামে

3.     অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, দিনে ঈসা () জন্মগ্রহণ করেন

4.     মুহার্রাম মাসে বা আশূরার দিনে দান-সাদকার বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ভিত্তিহীন রাসূলুল্লাহ () থেকে বিষয়ে কিছুই বর্ণিত হয় নি তবে অত্যন্ত দুর্বল অনির্ভরযোগ্য সূত্রে একজন সাহাবী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আশুরার দিনে সিয়াম পালন করলে যেহেতু এক বছরের সাওয়াব পাওয়া যায়, সেহেতু দিনে দান করলেও এক বছরের দানের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে ছাড়া দিনে দানের বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ভিত্তিহীন কথা[6]

5.     আশুরার দিনে ভাল খাওয়া-পরা একটি হাদীসে বলা হয়েছে:

مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ فِيْ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ، وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ فِيْ سَنَتِهِ كُلِّهَا

‘‘যে ব্যক্তি আশূরার দিনে তার পরিবারের জন্য প্রশস্তভাবে খরচ করবে, আল্লাহ সারা বছরই সে ব্যক্তিকে প্রশস্ত রিয্ক প্রদান করবেন।’’

হাদীসটি কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। বিভিন্ন সনদের কারণে বাইহাকী, ইরাকী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকেজালহিসেবে গণ্য না করেদুর্বলবলে আখ্যায়িত করেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকেঅত্যন্ত আপত্তিকর খুবই দুর্বলবলেছেন। অপরদিকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইবনু তাইমিয়া প্রমুখ মুহাদ্দিস একে জাল বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, প্রত্যেক সনদই অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার ফলে একাধিক সনদে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় না। এছাড়া হাদীসটি সহীহ হাদীসের বিরোধী। সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদীরা আশুররা দিনে উৎসব- আনন্দ করে- তোমরা তাদের বিরোধিতা করবে, দিনে সিয়াম পালন করবে এবং উৎসব বা আনন্দ করবে না[7]

1.     আশূরার দিনে সুরমা ব্যবহার একটি হাদীসে বলা হয়েছে:

مَنِ اكْتَحَلَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ بِالإِثْمِدِ، لَمْ تَرْمُدْ عَيْنُهُ أَبَداً

‘‘যে ব্যক্তি আশূরার দিনে চোখেইসমিদসুরমা ব্যবহার করবে কখনোই তার চোখ উঠবে না।’’

উপরের হাদীসটির মতই হাদীসটি একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সনদেই অত্যন্ত দুর্বল বা মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকেদুর্বলহিসাবে গণ্য করলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বানোয়াট হিসাবে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন, ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীগণ আশুরার দিনে সুরমা মাখার বিদআতটি চালু করেন। কথাটি তাদেরই বানানো। কোনো দুর্বল রাবী বেখেয়ালে তা বর্ণনা করেছেন[8]

() মুহাররাম মাস বিষয়ক মিথ্যা ভিত্তিহীন কথাবার্তা

উপরের কথাগুলো কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল বলে গণ্য করলেও কেউ কেউ তাদুর্বলবলে গণ্য করেছেন। নিচের কথাগুলো সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে জাল বলে স্বীকার করেছেন। এগুলোকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি: প্রথম, মুহার্রাম বা আশুরার সিয়ামের ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা, দ্বিতীয়, আশুরার দিনের বা রাতের জন্য বা মুহার্রম মাসের জন্য বিশেষ সালাত তার ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা এবং তৃতীয়, আশুরার দিনে অতীত ভবিষ্যতে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে বলে জাল কথা

. মুহার্রাম বা আশূরার সিয়াম

আশুরার সিয়াম পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহের কাফ্ফারা হবে বলে সহীহ হাদীসে আমরা দেখতে পেয়েছি। জালিয়াতগণ আরো অনেক কথা সম্পর্কে বানিয়েছে। প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি:

‘‘হাদীসে আছে- যে ব্যক্তি মহররমের মাসে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার দিন একটি রোযা রাখিবে সে দশ হাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহীদের দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে স্নেহ-পরবশ হইয়া কোন এতীমের মাথায় হাত ঘুরাইবে, আল্লাহতাআলা এতীমের মাথার প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তাহাকে বেহেশতের এক একটিদরজাপ্রদান করিবেন। আর যে ব্যক্তি উক্ত তারিখের সন্ধ্যায় রোযাদারকে খানা খাওয়াইবে বা ইফতার করাইবে, সে ব্যক্তি সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে খানা খাওয়াইবার ইফতার করাইবার ন্যায় ছওয়াব পাইবে

হযরত () আরও বলিলেন, যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে, সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি তারিখে বিমার পোরছী করিবে, সে সমস্ত আওলাদে আদমের বিমার-পোরছী করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।... তাহার পরিবারের ফারাগতি অবস্থা হইবে। ৪০ বৎসরের গুনাহর কাফ্ফারা হইয়া যাইবে।... (হাদীস)’[9]

অনুরূপ আরেকটি মিথ্যা কথা: ‘‘হযরত রাসূলুল্লাহ () এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা রাখিবে, সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবত দিনের বেলা রোজা রাখিল এবং রাত্রিবেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল। ... মহররম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল।... তোমরা আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিও। যেই ব্যক্তি মহররম মাসের সম্মান করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাকে জান্নাতের মধ্যে সম্মানিত করিবেন এবং জাহান্নামের আযাব হইতে বাঁচাইয়া রাখিবেন... মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা আদম () অন্যান্য নবীদের উপর ফরজ ছিল। এই দিবসে ২০০০ নবী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং ২০০০ নবীর দোয়া কবুল করা হইয়াছে ...[10]

মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলো সবই বানোয়াট কথা জাল হাদীস[11]

. মুহার্রাম মাসের সালাত

মুহার্রাম মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে এবং আশুরার দিবসে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের কোনো প্রকার নির্দেশনা বা উৎসাহ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। বিষয়ক সকল কথাই বানোয়াট। আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো পুস্তকে মুহার্রাম মাসের ১ম তারিখে দুই রাকআত সালাত আদায় করে বিশেষ দোয়া পাঠের বিশেষ ফযীলতের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট ভিত্তিহীন[12]

. আশুরার দিনে বা রাতে বিশেষ সালাত

আশুরার সিয়ামের উৎসাহ দেয়া হলেও, হাদীসে আশুরার দিনে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের বিধান দেওয়া হয় নি। তবে জালিয়াতগণ অনেক কথা বানিয়েছে। যেমন, যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে যোহর আসরের মধ্যবর্তী সময়ে ... অথবা আশুরার রাত্রিতে এত রাকআত সালাত অমুক অমুক সূরা এতবার পাঠ করে আদায় করবে ... সে এত পুরস্কার লাভ করবে। সরলপ্রাণ মুসলিমদের মন জয় করার জন্য জালিয়াতগণ সকল কথা বানিয়েছে, যা অনেক সময় সরলপ্রাণ আলিম বুযুর্গকেও ধোঁকা দিয়েছে[13]

. আশুরায় অতীত ভবিষ্যত ঘটনাবলির বানোয়াট ফিরিস্তি

মিথ্যাবাদীরা রাসূলুল্লাহ () এর নামে জালিয়াতি করে বলেছে:

1.     আশুরার দিনে আল্লাহ আসমান যমিন সৃষ্টি করেছেন

2.     দিনে তিনি পাহাড়, পর্বত, নদনদী.... সৃষ্টি করেছেন

3.     দিনে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন

4.     দিনে তিনি লাওহে মাহফূয সৃষ্টি করেছেন

5.     দিনে তিনি আরশ সৃষ্টি করেছেন

6.     দিনে তিনি আরশের উপরে সমাসীন হয়েছেন

7.     দিনে তিনি কুরসী সৃষ্টি করেছেন

8.     দিনে তিনি জান্নাত সৃষ্টি করেছেন

9.     দিনে তিনি জিবরাঈলকে () সৃষ্টি করেছেন

10.                        দিনে তিনি ফিরিশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন

11.                        দিনে তিনি আদমকে () সৃষ্টি করেছেন

12.                        দিনে তিনি আদমকে () জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন

13.                        দিনে তিনি ইদরীসকে () আসমানে উঠিয়ে নেন

14.                        দিনে তিনি নূহ ()-কে নৌকা থেকে বের করেন

15.                        দিনে তিনি দায়ূদের () তাওবা কবুল করেছেন

16.                        দিনে তিনি সুলাইমান ()-কে রাজত্ব প্রদান করেছেন

17.                        দিনে তিনি আইঊব ()-এর বিপদ-মসিবত দূর করেন

18.                        দিনে তিনি তাওরাত নাযিল করেন

19.                        দিনে ইবরাহীম () জন্মগ্রহণ করেন... খলীল উপাধি লাভ করেন

20.                        দিনে ইবরাহীম () নমরূদের অগ্নিকুন্ডু থেকে রক্ষা পান

21.                        দিনে ইসমাঈল () কে কুরবানী করা হয়েছিল

22.                        দিনে ইউনূস () মাছের পেট থেকে বাহির হন

23.                        দিনে আল্লাহ ইউসূফকে () জেলখানা থেকে বের করেন

24.                        দিনে ইয়াকুব () দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান

25.                        দিনে ইয়াকূব () ইউসূফের () সাথে সম্মিলিত হন

26.                        দিনে মুহাম্মাদ () জন্মগ্রহণ করেছেন

27.                        দিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে....

কেউ কেউ বানিয়েছে: মুহার্রামের তারিখে নূহ () প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন, তারিখে ইদরীসকে () আসমানে উঠানো হয়েছে, তারিখে ইবরাহীমকে () অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি

এরূপ অগণিত ঘটনা মাসে বা দিনে ঘটেছে এবং ঘটবে বলে উল্লেখ করেছে জালিয়াতরা তাদের সকল কল্প কাহিনীতে। মোট কথা হলো, আশুরার দিনে মূসা () তাঁর সাথীদের মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। আদমের () এর তাওবা কবুল, নূহ () এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামা ঈসা () জন্মগ্রহণ করার কথা অনির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী থেকে বর্ণিত। আশুরা বা মুহার্রাম সম্পর্কে আর যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা বাতিল কথা। দুঃখজনক হলো, আমাদের সমাজে মুহার্রাম বা আশূরা বিষয়ক বই পুস্তকে, আলোচনা ওয়াযে সমস্ত ভিত্তিহীন কথাবার্তা উল্লেখ করা হয়[14]

[1] সূরা () তাওবা, আয়াত, ৩৬
[2]
মুসলিম, আস-সহীহ /৮২১
[3]
মুসলিম, আস-সহীহ /৮১৯
[4]
ইবনু রাজাব, লাতাইফ /৬৮-৭৬; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯১-৯৪
[5]
বুখারী, আস-সহীহ /৭০৪, /১২৪৪; মুসলিম, আস-সহীহ /৭৯৬
[6]
ইবনু রাজাব, লাতাইফ /৭৮; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৫-৯৬
[7]
ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুস্সাস, পৃ. ৭৯, ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূআত /১১৩-১১৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী /১০৯-২১৩; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪২৭; আল-যারকশী, আত-তাযকিরা ৩৪, ১১৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৫০-১৫৭; ইবনু রাজাব, লাতাইফ /৭৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৪৪-২৪৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /১৩২-১৩৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০০-১০২
[8]
ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূআত /১১৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী /২১১; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪০১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৫৭; ইবনু রাজাব, লাতাইফ /৭৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২২২; মাসনূ, পৃ. ১৪১; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /১৩১-১৩২; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০০-১০২
[9]
মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ৪৩০-৪৩১ পুনশ্চ: মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ২৯৮-৩০০
[10]
মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩
[11]
ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূআত /১১২-১১৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী /১০৮-১০৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৪৯-১৫১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৯৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /১২৯-১৩০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৪-৯৫
[12]
মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১১-১২; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, নেক কানুন, পৃ. ২৯৮
[13]
ইবনুল জাওযী, মাওদূআত /৪৫-৪৬; সুয়ূতী, লাআলী /৫৪; ইবন আর্রাক, তানযীহ /৮৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৭৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯০, ১১০-১১১
[14]
ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত /১১২-১১৭; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ৫২; যাহাবী, মীযানুল তিদাল /১৯০; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান /১৬৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী /১০৮-১০৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৪৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩০০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৪-৯৭; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৭৭-২৭৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা /৫৫৭

 . সফর মাস

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, মুহার্রাম মাসের জন্য কোনো বিশেষ সালাত নেই, তবে মাসে বিশেষ সিয়ামের কথা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে এবং জন্য বিশেষ সাওয়াব ফযীলত রয়েছে। পক্ষান্তরে সফর মাসের জন্য কোনো বিশেষ সালাতও নেই, সিয়ামও নেই। মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে কোনো প্রকারের সালাত আদায়ের বিশেষ সাওয়াব বা ফযীলতে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি। অনুরূপভাবে মাসের কোনো দিনে সিয়াম পালনেরও কোনো বিশেষ ফযীলত কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ভিত্তিহীন কথা

মাসকে কেন্দ্র করেও অনেক মিথ্যা ভিত্তিহীন কথা মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে। এগুলোকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারি। প্রথম, সফর মাসেরঅশুভত্ববালা-মুসিবতবিষয়ক, দ্বিতীয়, সফর মাসের প্রথম তারিখে বা অন্য সময়ে বিশেষ সালাত তৃতীয়, আখেরী চাহার শোম্বা বা সফর মাসের শেষ বুধবার বিষয়ক

() সফর মাসের অশুভত্ব মাসের বালা-মুসিবত

কোনো স্থান, সময়, বস্ত্ত বা কর্মকে অশুভ, অযাত্রা বা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামী বিশ্বাসের ঘোর পরিপন্থী একটি কুসংস্কার। বিষয়ে আমরা পরবর্তীকালে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। এখানে লক্ষণীয় যে, আরবের মানুষেরা জাহেলী যুগ থেকেসফরমাসকে অশুভ বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করত। রাসূলুল্লাহতাদের কুসংস্কারের প্রতিবাদ করে বলেন:

لاَ طِيَرَةَ ، وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ

‘‘...কোনো অশুভ-অযাত্রা নেই, কোনো ভুত-প্রেত বা অতৃপ্ত আত্মা নেই এবং সফর মাসের অশুভত্বের কোনো অস্তিত্ব নেই।...’’[1]

অথচ এর পরেও মুসলিম সমাজে অনেকের মধ্যে পূর্ববর্তী যুগের সকল কুসংস্কার থেকে যায়। সকল কুসংস্কারকে উস্কে দেয়ার জন্য অনেক বানোয়াট কথা হাদীসের নামে বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে জালিয়াতগণ। সকল জাল কথার মধ্যে রয়েছে: মাস বালা মুসিবতরে মাস। মাসে এত লক্ষ এত হাজার... বালা নাযিল হয়।.. মাসেই আদম ফল খেয়েছিলেন। এমাসেই হাবীল নিহত হন। মাসেই নূহের কাওম ধ্বংস হয়। মাসেই ইবরাহীমকে () আগুনে ফেলা হয়। .... মাসের আগমনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ব্যথিত হতেন। মাস চলে গেলে খুশি হতেন.... তিনি বলতেন:

مَنْ بَشَّرَنِيْ بِخُرُوْجِ صَفَرٍ بَشَّرْتُهُ بِالْجَنَّةِ (بِدُخُوْلِ الْجَنَّةِ)

‘‘যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করার সুসংবাদ প্রদান করব।’’ .... ইত্যাদি অনেক কথা তারা বানিয়েছে। আর অনেক সরলপ্রাণ বুযুর্গও তাদের সকল জালিয়াতি বিশ্বাস করে ফেলেছেন। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, সফর মাসের অশুভত্ব বালা-মুসিবত বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন মিথ্যা।[2]

() সফর মাসের ১ম রাতের সালাত

উপরের মিথ্যা কথাগুলোর ভিত্তিতেই একটি ভিত্তিহীনসালাতেরউদ্ভাবন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ যদি সফর মাসের ১ম রাত্রিতে মাগরিবের পরে ... বা ইশার পরে.. চার রাকআত সালাত আদায় করে, অমুক অমুক সূরা বা আয়াত এতবার পাঠ করে .... তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, এত পুরস্কার পাবে... ইত্যাদি। এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা, যদিও অনেক সরলপ্রাণ আলিম বুযুর্গ এগুলো বিশ্বাস করেছেন বা তাদের বইয়ে বা ওয়াযে উল্লেখ করেছেন।[3]

() সফর মাসের শেষ বুধবার

বিভিন্ন জাল হাদীসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে বেশি অশুভ দিন এবং দিনে সবচেয়ে বেশি বালা মুসিবত নাযিল হয়। সব ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রাণ বুযুর্গ বিশ্বাস করেছেন। যেমন: ‘‘সফর মাসে একলাখ বিশ হাজারবালানাজিল হয় এবং সবদিনের চেয়েআখেরী চাহার শুম্বা-’তে (সফর মাসে শেষ বুধবার) নাজিল হয় সবচেয়ে বেশী। সুতরাং দিনে যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত নিয়মে চার রাকাত নামাজ পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে বালা থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হেফাজতে রাখবেন...’’[4]

এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা। তবে আমাদের দেশেআখেরী চাহার শুম্বা’- প্রসিদ্ধি কারণে নয়, অন্য কারণে। প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সফর মাসের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি সফর মাসের শেষ বুধবারে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তিকাল করেন। এজন্য মুসলিমগণ দিনে তাঁর সর্বশেষ সুস্থতা গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন

বিষয়ক প্রচলিত কাহিনীর সার-সংক্ষেপ প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘‘হযরত নবী করীম (ﷺ) দুনিয়া হইতে বিদায় নিবার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষণভাবে রোগে আক্রান্ত হইয়া ছিলেন। অতঃপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার দিন সুস্থ হইয়া গোসল করতঃ কিছু খানা খাইয়া মসজিদে নববীতে হাযির হইয়া নামাযের ইমামতী করিয়াছিলেন। ইহাতে উপস্থিত সাহাবীগণ অত্যধিক আনন্দিত হইয়াছিলেন। আর খুশীর কারণে অনেকে অনেক দান খয়রাত করিয়াছিলেন। বর্ণিত আছে, হযরত আবু বকর (রা) খুশীতে সহস্র দীনার এবং হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) সহস্র দীনার, হযরত ওসমান (রা) ১০ সহস্র দীনার, হযরত আলী (রা) সহস্র দীনার এবং হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা) ১০০ উট ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করিয়াছিলেন। তৎপর হইতে মুসলমানগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরণ অনুসরণ করিয়া আসিতেছে। হযরত নবী করীম (ﷺ) এর এই দিনের গোসলই জীবনের শেষ গোসল ছিল। ইহার পর আর তিনি জীবিতকালে গোসল করেন নাই। তাই সকল মুসলমানের জন্য এই দিবসে ওজু-গোসল করতঃ ইবাদৎ বান্দেগী করা উচিৎ এবং হযরত নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করতঃ সাওয়াব রেছানী করা কর্তব্য...’’[5]

উপরের কাহিনীটিই কমবেশি সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থে লেখা রয়েছে। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেও কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে ঘটনার কোনো প্রকারের উল্লেখ পাই নি। হাদীস তো দূরের কথা কোনো ইতিহাস বা জীবনী গ্রন্থেও আমি ঘটনার কোনো উল্লেখ পাই নি। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজেসফর মাসের শেষ বুধবারপালনের রেওয়াজ বা কাহিনী প্রচলিত আছে বলে আমার জানা নেই

. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সর্বশেষ অসুস্থতা

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সফর বা রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে হাদীস শরীফে কোনোরূপ উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। অগণিত হাদীসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থতা- কালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, তাঁর ইন্তিকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনো ভাবে কোনো দিন-তারিখ বলা হয় নি

২য় হিজরী শতক থেকে আলিমগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের ঘটনাবলি ঐতিহাসিক দিন-তারিখ সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন। তাঁর অসুস্থতার শুরু সম্পর্কে অনেক মত রয়েছে। প্রসঙ্গে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১ হি/৭৬৮ খৃ) বলেন:

اُبْتُدِئَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ بِشَكْوَاهُ الَّذِيْ قَبَضَهُ اللهُ فِيْهِ ... فِيْ لَيَالٍ بَقِيْنَ مِنْ صَفَرٍ، أَوْ فِيْ أَوَّلِ شَهْرِ رَبِيْعِ الأَوَّلِ.

‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সে অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষে কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে।’’[6]

কি বার থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তার অসুস্থতার শুরু হয়।[7] কয়দিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তিকাল করেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন, কেউ বলেছেন, ১২ দিন, কেউ বলেছেন ১৩ দিন, কেউ বলেছেন, ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকাল করেন।[8]

পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাব যে, তিনি কোন তারিখে ইন্তিকাল করেছিলেন, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ১লা রবিউল আউয়াল, কেউ বলেছেন, ২রা রবিউল আউয়াল এবং কেউ বলেছেন, ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তিকাল করেন

সর্বাবস্থায়, কেউ কোনোভাবে বলছেন না যে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোনো দিন তিনি সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই, ইন্তিকালের কয়েকদিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বুখারী সংকলিত হাদীসে আয়েশা (রা) বলেন:

إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ لَمَّا دَخَلَ بَيْتِي وَاشْتَدَّ بِهِ وَجَعُهُ قَالَ هَرِيقُوا عَلَيَّ مِنْ سَبْعِ قِرَبٍ ... لَعَلِّي أَعْهَدُ إِلَى النَّاسِ (لَعَلِّى أَسْتَرِيحُ فَأَعْهَدُ إِلَى النَّاسِ) ... ثُمَّ خَرَجَ إِلَى النَّاسِ ، فَصَلَّى لَهُمْ وَخَطَبَهُمْ

‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন আমার ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার উপরে মশক পানি ঢাল...; যেন আমি আরাম বোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি। তখন আমরা এভাবে তাঁর দেহে পানি ঢাললাম... এরপর তিনি মানুষদের কাছে বেরিয়ে যেয়ে তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন এবং তাদেরকে খুতবা প্রদান করলেন বা ওয়ায করলেন।’’[9]

এখানে সুস্পষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর অসুস্থতার মধ্যেই অসুস্থতা জ্বরের প্রকোপ কমানোর জন্য এভাবে গোসল করেন, যেন কিছুটা আরাম বোধ করেন এবং মসজিদে যেয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় নসীহত করতে পারেন

গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল তা হাদীসের কোনো বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় নি। তবে আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী সহীহ বুখারী সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদীসের সাথে হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তিকালের আগের বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ইন্তেকালের দিন আগে।[10] ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তিকাল হলে তা ঘটেছিল ৮ই রবিউল আউয়াল

উপরের আলোচনা থেকে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সুস্থ হওয়া, গোসল করা এবং এজন্য সাহাবীগণের আনন্দিত হওয়া দান-সাদকা করার সকল কাহিনীর কোনোরূপ ভিত্তি নেই। আল্লাহই ভাল জানেন

যেহেতু মূল ঘটনাটিই প্রমাণিত নয়, সেহেতু সে ঘটনা উদযাপন করা বা পালন করার প্রশ্ন ওঠে না। এরপরেও আমাদের বুঝতে হবে যে, কোনো আনন্দের বা দুঃখের ঘটনায় আনন্দিত বা দুঃখিত হওয়া এক কথা, আর প্রতি বছর সে দিনে আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশ করা বাআনন্দ দিবসবাশোক দিবসউদযাপন করা সম্পূর্ণ অন্য কথা। উভয়ের মধ্যে আসমান-যমীনের পার্থক্য

রাসূলুল্লাহর (ﷺ) জীবনে অনেক আনন্দের দিন বা মুহূর্ত এসেছে, যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন, শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহর দরবারে সাজদা করেছেন। কোনো কোনো ঘটনায় তাঁর পরিবারবর্গ সাহাবীগণও আনন্দিত হয়েছেন বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোনো সময়ে সে দিন বা মুহূর্তকে তারা বাৎসরিকআনন্দ দিবসহিসেবে উদযাপন করেন নি। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ বা সাহাবীদের কর্ম ছাড়া এরূপ কোনো দিন বা মুহুর্ত পালন করা বা এগুলোতে বিশেষ ইবাদত বিশেষ সাওয়াবের কারণ বলে মনে করার সুযোগ নেই

. আখেরী চাহার শোম্বার নামায

উপরের আলোচনা থেকে আমার জানতে পেরেছি যে, সফর মাসের শেষ বুধবারের কোনো প্রকার বিশেষত্ব হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। দিনে কোনোরূপ ইবাদত, সালাত, সিয়াম, যিকির, দোয়া, দান, সদকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য কোনো দিনের চেযে বেশি বা বিশেষ কোনো সাওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারণা করা ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। এজন্য আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী লিখেছেন যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে যে বিশেষ নফল সালাত বিশেষ কিছু সুরা, আয়াত দোয়া পাঠের মাধ্যমে আদায় করা হয়, তা বানোয়াট ভিত্তিহীন।[11]

[1] বুখারী, আস-সহীহ /২১৫৮, ২১৬১, ২১৭১, ২১৭৭; মুসলিম,আস-সহীহ /১৭৪২-১৭৪৫
[2]
সাগানী, আল-মাউদূআত, পৃ. ৬১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২২৫; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১১৬; আজলূনী, কাশফুল খাফা /৩০৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৫৩৯; নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল মুহিববীন, পৃ. ১০১; রাহাতুল কুলুব, পৃ. ১৩৮
[3]
খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল কুলুব, পৃ. ১৩৮-১৩৯; মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৪
[4]
খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১৩৯
[5]
মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৫
[6]
ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নববিয়্যাহ /২৮৯
[7]
কাসতালানী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া /৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩
[8]
কাসতালানী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া /৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩
[9]
বুখারী, আস-সহীহ /৮৩, /১৬১৪, /২১৬০; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /২৪৩; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১৪/৫৬৬
[10]
ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৪২
[11]
আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১১১

 . রবিউল আউয়াল মাস

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম ওফাতের মাস হিসাবে রবিউল আউয়াল মাস মুসলিম মানসে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। মাসের ফযীলত, আমল বিষয়ক হাদীস আলোচনা করার আগে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম ইন্তিকাল সম্পর্কে হাদীস ইতিহাসের আলোকে আলোচনা করব। মহান আল্লাহর তাওফীক চাই

() রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম দিবস

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম বার, জন্ম দিন, জন্ম মাস জন্ম তারিখ বিষয়ক হাদীস ঐতিহাসিক তথ্যাদি বিস্তারিত আলোচনা করেছিএহইয়াউস সুনানগ্রন্থে। এখানে সংক্ষেপে কিছু বিষয় আলোচনা করছি

সহীহ হাদীস থেকে সুস্পষ্টরূপে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন।[1] হাদীসে নাবাবী থেকে তাঁর জন্মমাস জন্মতারিখ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সাহাবীগণের মাঝেও বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট মত প্রচলিত ছিল না। পরবর্তী যুগের আলিম ঐতিহাসিকগণ তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কে অনেক মতভেদ করেছেন। বিষয়ে ১২টিরও বেশি মত রয়েছে। ইবন হিশাম, ইবন সা, ইবন কাসীর, কাসতালানী অন্যান্য ঐতিহাসিক বিষয়ে নিম্নলিখিত মতামত উল্লেখ করেছেন :

(). কারো মতে তাঁর জন্মতারিখ অজ্ঞাত, তা জানা যায় নি এবং জানা সম্ভব নয়। তিনি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এটুকুই শুধু জানা যায়, জন্ম মাস বা তারিখ জানা যায় না। বিষয়ে আলোচনা তারা অবান্তর মনে করেন

(). কারো কারো মতে তিনি মুহাররাম মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন

(). অন্য মতে তিনি সফর মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন

(). কারো মতে তিনি রবিউল আউআল মাসের তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক মুহাদ্দিস আবু মাশার নাজীহ বিন আব্দুর রাহমান আস-সিনদী (১৭০হি) মতটি গ্রহণ করেছেন

(). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ রবিউল আউয়াল মাসের তারিখ। আল্লামা কাসতালানী যারকানীর বর্ণনায় মতটিই অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন। মতটি দুজন সাহাবী ইবনু আববাস জুবাইর বিন মুতয়িম (রা) থেকে বর্ণিত। অধিকাংশ ঐতিহাসিক সীরাত বিশেষজ্ঞ মতটি গ্রহণ করেছেন বলে তারা উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত তাবিয়ী ইমাম মুহাম্মাদ ইবন মুসলিম ইবন শিহাব আয-যুহরী (১২৫ হি.) তাঁর উস্তাদ প্রথম শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস নসববিদ ঐতিহাসিক তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবন জুবাইর ইবন মুতয়িম (১০০ হি.) থেকে এই মতটি বর্ণনা করেছেন। কাসতালানী বলেন : ‘‘মুহাম্মাদ ইবন জুবাইর আরবদের বংশ পরিচিতি আরবদের ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর জন্মতারিখ সম্পর্কিত মতটি তিনি তাঁর পিতা সাহাবী জুবাইর বিন মুতয়িম থেকে গ্রহণ করেছেন। স্পেনের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ফকীহ আলী ইবন আহমাদ ইবন হাযম (৪৫৬ হি) মুহাম্মাদ ইবন ফাতুহ আল-হুমাইদী (৪৮৮ হি) মতটিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। স্পেনের মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসূফ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল বার (৪৬৩ হি) উল্লেখ করেছেন যে, ঐতিহাসিকগণ মতটিই সঠিক বলে মনে করেন। মীলাদের উপর প্রথম গ্রন্থ রচনাকারী আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবন দেহিয়া (৬৩৩ হি) ঈদে মীলাদুন্নবীর উপর লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ ‘‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশির আন নাযীর’’ - মতটিকেই গ্রহণ করেছেন

(). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ ১০ রবিউল আউয়াল। মতটি ইমাম হুসাইনের পৌত্র মুহাম্মাদ ইবন আলী আল বাকির (১১৪ হি) থেকে বর্ণিত। ১ম-২য় শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আমির ইবন শারাহিল শাবী (১০৪ হি.) থেকেও মতটি বর্ণিত। ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবন উমর আল-ওয়াকিদী (২০৭ হি) মত গ্রহণ করেছেন। ইবন সা তার বিখ্যাত ‘‘আত-তাবাকাতুল কুবরা’’- শুধু দুটি মত উল্লেখ করেছেন, তারিখ ১০ তারিখ।[2]

(). কারো মতে রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর জন্মতারিখ ১২ রবিউল আউয়াল। মতটি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (১৫১ হি) গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন : ‘‘রাসূলুল্লাহহাতির বছরে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।’’[3] এখানে লক্ষণীয় যে, ইবন ইসহাক সীরাতুন্নবীর সকল তথ্য সাধারণত সনদসহ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তথ্যটির জন্য কোনো সনদ উল্লেখ করেন নি। কোথা থেকে তিনি তথ্যটি গ্রহণ করেছেন তাও জানান নি বা সনদসহ প্রথম শতাব্দীর কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে মতটি বর্ণনা করেন নি। জন্য অনেক গবেষক মতটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন[4] তা সত্ত্বেও পরবর্তী যুগে মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইবন কাসীর উল্লেখ করেছেন যে জন সাহাবী জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) আব্দুল্লাহ ইবন আববাস (রা) থেকে মতটি বর্ণিত

(). অন্য মতে রাসূলুল্লাহরজন্ম তারিখ ১৭- রবিউল আউয়াল

(). অন্য মতে তাঁর জন্ম তারিখ ২২-শে রবিউল আউয়াল

(১০). অন্য মতে তিনি রবিউস সানী মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন

(১১). অন্য মতে তিনি রজব মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।

(১২). অন্য মতে তিনি রমযান মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। ৩য় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যুবাইর ইবন বাক্কার (২৫৬ হি.) থেকে মতটি বর্ণিত। তাঁর মতের পক্ষে যুক্তি হলো যে, রাসূলুল্লাহসর্বসম্মতভাবে রমযান মাসে নুবুওয়াত পেয়েছেন। তিনি ৪০ বছর পূর্তিতে নবুয়্যত পেয়েছেন। তাহলে তাঁর জন্ম অবশ্যই রমযানে হবে। এছাড়া কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহহজ্জের পবিত্র দিনগুলোতে মাতৃগর্ভে আসেন। সেক্ষেত্রেও তাঁর জন্ম রমযানেই হওয়া উচিত। মতের সমর্থনে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা) থেকে একটি বর্ণনা আছে বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন।[5]

() রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাত দিবস

বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সোমবার ইন্তিকাল করেন।[6] কিন্তু সোমবারটি কোন্ মাসের কোন্ তারিখ ছিল তা কোনো হাদীসে বলা হয় নি। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রামাদান মাসের ১১ তারিখে ইন্তিকাল করেন।[7] একক বর্ণনাটি ছাড়া মুসলিম উম্মাহর সকল ঐতিহাসিক মুহাদ্দিস একমত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন। কিন্তু কোন্ তারিখে তিনি ইন্তিকাল করেছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে

বুখারী-মুসলিম সংকলিত হাদীসে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিদায় হজ্জে ৯ই যুলহাজ্জ ছিল শুক্রবার।[8] থেকে আমরা জানতে পারি যে, সে বছর যুলহাজ্জ মাসের তারিখ ছিল বৃহস্পতিবার। আমরা জানি যে, বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে তিনি যুলহাজ্জ মাসের বাকি দিনগুলি এবং মুহার্রাম সফর মাস মদীনায় অবস্থান করেন এবং রবিউল আউয়াল মাসে তিনি ইন্তিকাল করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক উলেলখ করেছেন যে, তিনি বিদায় হজ্জের দিনের পরে ৮০ বা ৮১ দিন জীবিত ছিলেন। এরপর রবিউল আউয়াল মাসের শুরুতে তিনি ইন্তিকাল করেন।[9]

ওফাতের তারিখ সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরীর তাবিয়ী ঐতিহাসিকগণ এবং পরবর্তী ঐতিহাসিকগণের ৪টি মত রয়েছে: রবিউল আউয়াল, রবিউল আউয়াল, ১২ রবিউল আউয়াল ১৩ রাবিউল আউয়াল।[10]

সাধারণভাবে পরবর্তী কালে ১২ তারিখের মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কিন্তু এখানে একটি কঠিন সমস্যা রয়েছে। আমরা জানি যে, আরবী মাস ৩০ বা ২৯ দিন হয় এবং সাধারণত কখনোই পরপর তিনটি মাস ৩০ বা ২৯ দিনের হয় না। উপরের হাদীস থেকে আমরা জেনেছি যে, যুলহাজ্জ মাস শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার। আর বৃহস্পতিবার যুলহাজ্জ হলে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ কোনোভাবেই সোমবার হতে পারে না

যুলহাজ্জ, মুহার্রাম সফর তিনটি মাসই ৩০ দিনে ধরলে রবিউল আউয়াল হয় বুধবার। দুটি ৩০ একটি ২৯ ধরলে রবিউল আউয়াল হয় মঙ্গলবার। দুটি ২৯ একটি ৩০ ধরলে হয় রবিউল আউয়াল হয় সোমবার। আর তিনটি মাসই ২৯ দিন ধরলে রবিউল আউয়াল হয় রবিবার। আর কোনো হিসাবেই ১২ তারিখ সোমবার হয় না

সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য কেউ কেউ ১৩ তারিখের কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, তিনটি মাসই ৩০ দিনের ছিল এবং মদীনায় একদিন পরে চাঁদ দেখা গিয়েছিল। দুটি ব্যখ্যাই দূরবর্তী।[11]

দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী মুহাদ্দিস ঐতিহাসিক আল্লামা সুলাইমান ইবনু তারখান আত-তাইমী (৪৬-১৪৩ হি) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর অসুস্থতার শুরু হয় ২২ সফর শনিবার। ১০ দিন অসুস্থতার পর রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি ইন্তিকাল করেন।’’[12]

তাঁর মতঅনুসারে সে বছরে যুলহাজ্জ, মুহার্রাম সফর তিনটি মাসই ২৯ দিন ছিল, যা সাধারণত খুবই কম ঘটে জন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক গবেষক ১লা রবিউল আউয়ালের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে আল্লামা সুহাইলী, ইবনু হাজার প্রমুখ গবেষক মুহাদ্দিস ঐতিহাসিক তারিখের মতটিকেই গ্রহণ করেছেন। তিনটি কারণে তাঁরা মতটি গ্রহণ করেছেন। প্রথম, তাবিয়ীগণের যুগ থেকে সহীহ সনদে কথাটি পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়, মতটি বিদায় হজ্জের পরে তাঁর ৮০ বা ৮১ দিন জীবিত থাকার বর্ণনাটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তৃতীয়, যারা ১২ বলেছেন তাদের কথার একটি দূরবর্তী ব্যাখ্যা দেওয়া যায় যে, আরবীতে (ثاني شهر) কে (ثاني عشر) বামাসের দুই’-কেদশের দুই’ (১২) পড়ার একটি সম্ভাবনা থাকে। কেউ হয়ত -কে ১২ পড়েছিলেন লিখেছিলেন এবং অন্যরা তার অনুসরণ করেছেন।[13]

() রবিউল আউয়াল বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা

উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর জন্ম বা ওফাতের মাস হিসাবে রবিউল আউয়াল মাসের কোনো উল্লেখ হাদীস শরীফে নেই। মাসের কোনো বিশেষ ফযীলত বা বিশেষ আমল কোনো কিছুই হাদীসে বর্ণিত হয় নি

বিষয়ক মিথ্যা গল্প কাহিনীর মধ্যে রয়েছে: ‘‘ মাসের ১২ তারিখে বুজুর্গ তাবিয়ীগণ হযরত রাসূলে কারীম (ﷺ) এর রূহের মাগফিরাতের জন্য ২০ রাকয়া নফল নামায পড়িতেন। নামায দুই দুই রাকয়াতের নিয়তে আদায় করিতেন এবং প্রত্যেক রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পরে ১১ বার করিয়া সূরা ইখলাছ পড়িতেন। নামায শেষে আল্লাহর হাবীবের প্রতি সাওয়াব রেছানী করিতেন। তাহারা ইহার বরকতে খাবের মাধ্যমে হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দর্শন লাভ করিতেন এবং দোজাহানের খায়ের বরকত লাভ করিতেন। অন্য রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, কোন মুমিন ব্যক্তি নিম্নের দরূদ শরীফ মাসের যে কোন তারিখে এশার নামাযের পরে ১১২৫ বার পাঠ করিলে আল্লাহর রহমতে সে ব্যক্তি হযরত নবী করীম (ﷺ) কে স্বপ্নে দর্শন লাভ করিবে।...’’[14]

এরূপ আরো অনেক ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে দেখা যায়।[15] এগুলো সবই বানোয়াট কথা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ইন্তিকালের পরবর্তী তিন যুগ, সাহাবী, তাবিয়ী তাবি-তাবিয়ীগণের মধ্যে মাসটির কোনো পরিচিতিই ছিল না। মাসটি যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জন্ম মাস সে কথাটিই তখনো প্রসিদ্ধি লাভ করে নি

৪০০ হিজরীর দিকে সর্বপ্রথম মিসরের ফাতেমীয় শিয়া শাসকগণ মাসেমীলাদবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জন্ম দিবস পালনের প্রচলন করে। ৬০০ হিজরীতে ইরাকের ইরবিল শহরে ১২ রবিউল আউয়ালমীলাদবাঈদ মীলাদুন্নবীনামে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জন্ম উদযাপন শুরু হয়। অপরদিকে ভারত অন্যান্য দেশে ১২ রবিউল আউয়ালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাত উপলক্ষ্যেফাতেহাবাফাতেহায়ে দোয়াজদহমউদযাপন শুরু হয়। বিষয়ক সকল তথ্য বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছেএহইয়াউস সুনানগ্রন্থে

[1] মুসলিম, আস-সহহি /৮১৯; আহমাদ, আল-মুসনাদ /১৭২-১৭৩, নং ২৫০৬
[2]
ইবন সা, আত-তাবাকাতুল কুবরা /৮০-৮১
[3]
ইবন হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ /১৮৩
[4]
মাহদী রেজকুল্লাহ আহমাদ, আস-সীরাতুন নাবাবিয়াহ, ১০৯ পৃ
[5]
ইবন সা, আত-তাবাকাতুল কুবরা /১০০-১০১, ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া /২১৫, আল-কাসতালানী, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা /৭৪-৭৫, আল-যারকানী, শরহুল মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়্যা /২৪৫-২৪৮, ইবন রাজাব, লাতায়িফুল মায়ারিফ /১৫০
[6]
বুখারী, আস-সহীহ /২৬২, /১৬১৬; মুসলিম, আস-সহীহ /৩১৫; আবূ নুআইম ইসপাহানী, আল-মুসনাদ আল-মুসতাখরাজ আলা সহীহ মুসলিম /৪৩-৪৪
[7]
ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১২৯
[8]
বুখারী, সহীহ /২৫, /১৬০০, ১৬৮৩, /২৬৫৩; মুসলিম, সহীহ /২৩১২-২৩১৩
[9]
ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৩০
[10]
প্রাগুক্ত /১২৯
[11]
ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী /১২৯-১৩০
[12]
প্রাগুক্ত /১২৯
[13]
প্রাগুক্ত /১২৯-১৩০
[14]
মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৬-১৭
[15]
অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ৩০১-৩০২

 . রবিউস সানী মাস

রবিউস সানী বা রবিউল আখির মাসের কোনোরূপ বৈশিষ্ট্য, ফযীলত বা মাসের কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, দোয়া, যিক্র বা বিশেষ কোনো আমল হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি

রাসূলুল্লাহ () এর ইন্তিকালের প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর পরে, ৫৬১ হিজরী সালের রবিউস সানী মাসের ১০ তারিখে আব্দুল কাদির জীলানী (রাহ) ইন্তিকাল করেন। আমাদের দেশে অনেকে উপলক্ষ্যে ১১ রবিউস সানী গেয়ারভী শরীফ বা ফাতেহায়ে ইয়াযদহম উদযাপন করেন

স্বভাবতই এর সাথে হাদীসের কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। এমনকি জন্ম বা মৃত্যু উদযাপন করা বা জন্ম তারিখ বা মৃত্যু তারিখ উপলক্ষ্যে দোয়া খায়ের বা সাওয়াব রেসানী করার কোনো নির্দেশনা, প্রচলন বা উৎসাহ কোনো হাদীসে নেই। রাসুলুল্লাহ () এর জীবদ্দশায় তাঁর ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী অনেক আত্মীয় অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেছেন, যারা সকলেই আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম ওলীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি কখনো কারো মৃত্যুর পরের বছরে, বা পরবর্তী কোনো সময়ে মৃত্যুর দিনে বা অন্য কোনো সময়ে কোনো ফাতেহা বা কোনো অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন নি। রাসূলুল্লাহ () এর ওফাতের পরে তাঁর কন্যা ফাতিমা, জামাতা আলী, দৌহিত্র হাসান-হুসাইন, উম্মুল মুমিনীনগণ, খলীফায়ে রাশিদগণ, অন্যান্য সাহাবীগণ, তাবিয়ী-তাবি-তাবিয়ীগণ কেউ কখনো তাঁর ওফাতের দিনে বা অন্য কোনো সময়ে কোনোরূপ ফাতেহা, দোয়া বা কোনো অনুষ্ঠান করেন নি। অনুরূপভাবে কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী, চার ইমাম, তাদের ছাত্রগণ কেউ কখনো এরূপ ফাতিহা বা অনুষ্ঠান করেন নি

রবিউস সানী মাসের ফযীলত, আমল ইত্যাদি নামে যা কিছু প্রচলিত রয়েছে সবই বানোয়াট ভিত্তিহীন। যেমন ‘‘রবিউস-সানী মাসের প্রথম তারিখে রাত্রিবেলা চার রাকয়া নফল নামায আদায় করিতে হয়। উহার প্রতি রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ইখলাছ পড়িতে হয়। এই নামায আদায়কারীর আমল নামায় ৯০ হাজার বৎসরের সাওয়াব লিখা হইবে এবং ৯০ হাজার বৎসরের গুনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইবে।[1] এরূপ আরো অনেক আজগুবি মিথ্যা কথা প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে দেখা যায়[2]

[1] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৭-১৮
[2]
মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত,পৃ. ১৭-১৮; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, পৃ.৩০২

 . জমাদিউল আউয়াল মাস

জমাদিউল আউয়াল (জুমাদা আল-উলা) মাসের কোনোরূপ বৈশিষ্ট্য, ফযীলত বা মাসের কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, দোয়া, যিক্র বা বিশেষ কোনো আমল হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি। বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ভিত্তিহীন। যেমন: ‘‘রাসূলে করীম () এর সাহাবীগণ মাসের প্রথম তারিখে দুই রাকয়াতের নিয়তে মোট ২০ রাকয়া নামায আদায় করিতেন এবং ইহার প্রত্যেক রাকয়া'তে সূরা ফাতিহার পরে একবার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিতেন। নামাযের পরে নিম্নের দরূদ শরীফ ১০০ বার পাঠ করিতেন। এই নামাযীর আমল নামায় অসংখ্য নেকী লিখা হইবে এবং তাহার সমস্ত নেক নিয়ত পূর্ণ করা হইবে। ...কোন ব্যক্তি এই মাসের প্রথম তারিখে দিনের বেলা দুই রাকয়া'তের নিয়তে মোট রাকয়া নামায আদায় করিলে এবং উহার প্রত্যেক রাকয়া'তে ১১ বার করিয়া সূরা ইখলাস পাঠ করিলে..[1]  জাতীয় অনেক আজগুবি, ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা আমাদের দেশে প্রচলিতবার চাঁদের ফযীলত এই ধরনের পুস্তকাদিতে পাওয়া যায়

[1] মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৮; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন পৃ. ৩০৩

 . জমাদিউস সানী মাস

জমাদিউস সানী বা জমাদিউল আখির (জুমাদা আল-আখেরা) মাসের কোনোরূপ বৈশিষ্ট্য, ফযীলত বা এই মাসের কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, দোয়া, যিক্র বা বিশেষ কোনো আমল হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি। বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ভিত্তিহীন। যেমন, ‘‘জমাদিউস সানী মাসের পহেলা তারিখে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ দুই রাকয়াতের নিয়তে মোট ১২ রাকয়া নামায আদায় করিতেন। ইহার প্রত্যেক রাকয়া'তে সূরা ফাতিহার পরে ১১ বার করিয়া সুরা ইখলাছ পড়িতেন। আবার কেহ কেহ সূরা ইখলাছের পরে বার আয়াতুল কুরসী পাঠ করিতেন। এই নামাযে অসংখ্য নেকী লাভ হয়।...’[1]

সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা

[1] মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ.১৮-১৯; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন পৃ. ৩০৩

 . রজব মাস

 রজব মাসকে নিয়ে যত বেশি মিথ্যা হাদীস তৈরি করা হয়েছে, তত বেশি আর কোনো মাসকে নিয়ে করা হয় নি। সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানী, জমাদিউল আউয়াল জমাদিউস সানী মাসের ফযীলত বা খাস ইবাদত বিষয়ক যা কিছু বানোয়াট কথাবার্তা তা মূলত গত কয়েক শত বছর যাবত ভারতীয় উপমহাদেশেই প্রচলিত হয়েছে। ৫ম/৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত মাউযূ হাদীস বা ফযীলতের বইগুলোতেও সকল মাসের উল্লেখ পাওয়া যায় না। সকল যুগে যে সকল নেককার সরলপ্রাণ বুযুর্গ ফযীলত আমলের বিষয়ে সত্য-মিথ্যা সকল কথাই জমা করে লিখতেন তাদের বই-পুস্তকেও মাসগুলোর কোনো প্রকারের উল্লেখ নেই। তাঁরা মূলত রজব মাস দিয়েই তাদের আলোচনা শুরু করতেন এবং মুহার্রাম মাস দিয়ে শেষ করতেন

আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, রজব মাস ইসলামী শরীয়তেরহারামঅর্থাৎনিষিদ্ধ বাসম্মানিতমাসগুলির অন্যতম। জাহিলী যুগ থেকেই আরবরাইবরাহীম ()-এর শরীয়তঅনুসারে মাসগুলোর সম্মান করত। তবে ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে অনেক কুসংস্কার রসম-রেওয়াজ প্রবেশ করে। জাহিলী যুগে আরবরা মাসকে বিশেষ ভাবে সম্মান করত। মাসে তারাআতীরাহনামে এক প্রকারেরকুরবানীকরত এবং উৎসব করত। হাদীস শরীফে তা নিষেধ করা হয়েছে।[1]

হারামমাস হিসাবে সাধারণ মর্যাদা ছাড়ারজবমাসের মর্যাদায় কোনো সহীহ হাদীসে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয় নি। মাসের কোনোরূপ মর্যাদা, মাসের কোনা দিনে বা রাতে কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া, তিলাওয়াত বা কোনো বিশেষ ইবাদতের বিশেষ কোনো ফযীলত আছে মর্মে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনোরূপ কোনো হাদীস সহীহ বা গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। পরবর্তী যুগের তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ীগণ থেকে সামান্য কিছু কথা পাওয়া যায়। কিন্তু বিষয়ে অনেক জাল কথা প্রচলিত। যেহেতু আমাদের দেশে সাধারণভাবে ২৭ রজব ছাড়া অন্য কোনো দিবস বা রাত্রি কেন্দ্রিক জাল হাদীসগুলো তেমন প্রসিদ্ধ নয়, সেহেতু ২৭ রজবের বিষয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা বাকি বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনার ইচ্ছা করছি। মহান আল্লাহর দরবারে তাওফীক প্রার্থনা করছি

() সাধারণভাবে রজব মাসের মর্যাদা

সাধারণভাবেরজবমাসের মর্যাদা, মাসে কী কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এবং মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে কোনো সময়ে বা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকারের সালাত, সিয়াম, দান, দোয়া ইত্যাদি ইবাদত করলে কী অকল্পনীয় পরিমাণে সাওয়াব বা পুরস্কার পাওয়া যাবে তার বর্ণনায় অনেক জাল হাদীস বানানো হয়েছে। আমাদের দেশের প্রচলিতবার চাঁদের ফযীলত আমল-ওযীফা বিষয়ক বইগুলোতে এগুলোর সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়

যেমন, অন্য মাসের উপর রজবের মর্যাদা তেমনি, যেমন সাধারণ মানুষের কথার উপরে কুরআনের মর্যাদা... মাসে নূহ () তাঁর সহযাত্রীগণ নৌকায় আরোহণ করেন... মাসেই নৌকা পানিতে ভেসেছিল ... মাসেই রক্ষা পেয়েছিল। মাসেই আদমের তাওবা কবুল হয়। ইউনূস ()-এর জাতির তাওবা কবুল করা হয়। মাসেই ইবরাহীম () ঈসা () এর জন্ম। মাসেই মূসার জন্য সমুদ্র দ্বিখন্ডিত হয়। ....

মাসের প্রথম তারিখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন। মাসের ২৭ তারিখে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন।... মাসের ২৭ তারিখে তিনি মিরাজে গমন করেন। ... মাসে সালাত, সিয়াম, দান-সাদকা, যিক্র, দরুদ, দোয়া ইত্যাদি নেক আমল করলে তার সাওয়াব বৃদ্ধি পায় বা বহুগুণ বেড়ে যায়... ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা জাল হাদীস।[2]

পূর্ববর্তী অনেক বুযুর্গের আমল ফাযাইল বিষয়ক গ্রন্থে এগুলোর সমাবেশ রয়েছে। তবে আমাদের সমাজের সাধারণ ধার্মিক মুসলিমদের মধ্যে এগুলোর প্রচলন কম। এজন্য এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা বর্জন করছি

() রজব মাসের সালাত

রজব মাসে সাধারণভাবে এবং রজব মাসের তারিখ, ১ম শুক্রবার, , , তারিখ, ১৫ তারিখ, ২৭ তারিখ, শেষ দিন অন্যান্য বিশেষ দিনে বা রাতে বিশেষ সালাত আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি সেগুলোর অভাবনীয় পুরস্কারের ফিরিস্তি দিয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচারিত হয়েছে। পূর্ববর্তী যুগের আমল, ওযীফা ফাযাইল বিষয়ক পুস্তকাদিতে এবং আমাদের দেশের বার চান্দের ফযীলত, আমল-ওযীফা অন্যান্য পুস্তকে এগুলোর কিছু কথা পাওয়া যায়। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এগুলোর প্রচলন কম। এজন্য এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করছি না। মুহাদ্দিসগণ এক্ষেত্রে যে মূলনীতি উল্লেখ করেছেন তা বলেই শেষ করছি। আল্লামা ইবনু রাজাব, ইবনু হাজার, সুয়ূতী, মোল্লা আলী কারী অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে বলেছেন, রজব মাসে বিশেষ কোনো সালাত বা রজব মাসের কোনো দিনে বা রাতে কোনো সময়ে কোনো সালাত আদায় করলে বিশেষ সাওয়াব পাওয়া যাবে মর্মে একটি হাদীসও গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল বানোয়াট।[3]

() রজব মাসের দান, যিকর ইত্যাদি

রজব মাসের দান, যিক্র, দরূদ, দোয়া ইত্যাদি নেক আমলের বিশেষ কোনো সাওয়াব হবে বা সাধারণ সাওয়াব বৃদ্ধি পাবে মর্মে যা কিছু বর্ণিত প্রচলিত হয়েছে সবই বাতিল ভিত্তিহীন।[4]

() রজব মাসের সিয়াম

সবচেয়ে বেশি জাল হাদীস প্রচলিত হয়েছে রজব মাসের সিয়াম পালনের বিষয়ে। বিভিন্নভাবে মাসে সিয়াম পালনের উৎসাহ দিয়ে জালিয়াতগণ হাদীস জাল করেছে। কোনো কোনো জাল হাদীসে সাধারণভাবে রজব মাসে সিয়াম পালন করলে কত অভাবনীয় সাওয়াব তা বলা হয়েছে। কোনোটিতে রজব মাসের নির্ধারিত কিছু দিনের সিয়াম পালনের বিভিন্ন বানোয়াট সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। কোনোটিতে রজব মাসে টি সিয়ামের কি সাওয়াব, ২টি সিয়ামের কি সাওয়াব, ৩টির কি সাওয়াব.... ৩০টি সিয়ামের কত সাওয়াব ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, রজব মাসের সিয়ামের বিশেষ সাওয়াব বা রজব মাসের বিশেষ কোনো দিনে সিয়াম পালনের উৎসাহ জ্ঞাপক সকল হাদীসই ভিত্তিহীন বানোয়াট। বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো কথাই নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি।[5]

() লাইলাতুর রাগাইব

রজব মাস বিষয়ক জাল হাদীসের মধ্যে অন্যতম হলোলাইলাতুর রাগাইব সে রাত্রির বিশেষ সালাত বিষয়ক জাল হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে রাত্রির নামকরণ, ফযীলত, রাত্রির সালাতের ফযীলত, রাকআত সংখ্যা, সূরা কিরাআত, পদ্ধতি সব কিছুই বানোয়াট ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা। কিন্তু বিষয়টি অনেক মুসলিম দেশে ব্যাপক প্রচার লাভ করেছে

প্রথমে কিছু জালিয়াত রাত্রিটির নামকরণ বিষয়ক কিছু আজগুবি গল্প বানায়। ক্রমান্বয়ে বিষয়টি আকর্ষণীয় ওয়াযে পরিণত হয়। জাল হাদীসের একটি বৈশিষ্ট্য, তা সাধারণ মানুষের চিত্তাকর্ষক হয় এবং কোনো একটি জাল হাদীস একবারবাজার পেলেতখন অন্যান্য জালিয়াতও বিভিন্ন সনদ বানিয়ে তা বলতে থাকে। এভাবে অনেক জাল হাদীস সমাজে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। সালাতুর রাগাইব বিষয়ক হাদীসগুলোও সেরূপ। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পরে এই জাল হাদীসগুলো প্রচারিত প্রসিদ্ধি লাভ করলে সাধারণ মুসল্লীগণ অনেক দেশে উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ঘটা করে সালাতুর রাগাইব পালন করতে শুরু করেন। সকল সমাজেলাইলাতুর রাগাইবআমাদের দেশেরলাইলাতুল বারাত’-এর মতই উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়

বানোয়াট সালাতটি আমাদের দেশে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করে নি। এজন্য বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি না। এর সার সংক্ষেপ হলো, রজব মাসের প্রথম শুক্রবারের রাত্রি হলোলাইলাতুর রাগাইববাআশা-আকাঙক্ষা পূরণের রাত রজবের প্রথম বৃহস্পতিবারে সিয়াম পালন করে, বৃহস্পতিবার দিবাগত শুক্রবারের রাত্রিতে মাগরিব ইশার মধ্যবর্তী সময়ে ১২ রাকআত সালাত নির্ধারিত সূরা, আয়াত দোয়া-দরূদ দিয়ে আদায় করবে। .... তাহলে ব্যক্তি এত এত.... পুরস্কার লাভ করবে।... এর সাথে আরো অনেক কল্প কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে সকল জাল হাদীসে

সকল হাদীসের প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে মুহাদ্দিসগণ সেগুলির সূত্র উৎস নিরীক্ষা করে এর জালিয়াতির বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর সকল মুহাদ্দিস একমত যে, ‘লাইলাতুর রাগাইবসালাতুর রাগাইববিষয়ক সকল কথা মিথ্যা, জাল বানোয়াট।[6]

() রজব মাসের ২৭ তারিখ

বর্তমানে আমাদের সমাজে ২৭শে রজব মিরাজ-এর রাত বলেই প্রসিদ্ধ। সে হিসেবেই্আমাদের দেশের মুসলিমগণ দিনটি উদযাপন করে থাকেন। কিন্তু প্রসিদ্ধির আগেও রজব মাসের ২৭ তারিখ বিষয়ক আরো অনেক কথা প্রচলিত হয়েছিল এবং এই তারিখের দিবসে রাতে ইবাদত বন্দেগির বিষয়ে অনেক জাল কথা প্রচলিত হয়েছিল। প্রথমে আমরালাইলাতুল মিরাজসম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। এরপর দিন সম্পর্কে প্রচলিত বানোয়াট জাল হাদীসগুলো আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ

. লাইলাতুল মিরাজ

ইসরা মিরাজের ঘটনা বিভিন্নভাবে কুরআন কারীমে অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে প্রায় অর্ধশত সাহাবী থেকে মিরাজের ঘটনার বিভিন্ন দিক ছোট বা বড় আকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো হাদীসে রাসূলুল্লাহথেকে মিরাজের তারিখ সম্পর্কে একটি কথাও বর্ণিত হয় নি। সাহাবীগণ কখনো তাঁকে তারিখ সম্পর্কে প্রশ্নও করেছেন বলে জানা যায় না। পরবর্তী যুগের তাবিয়ীদেরও একই অবস্থা ; তাঁরা সকল হাদীস সাহাবীদের থেকে শিখছেন, কিন্তু তাঁরা তারিখ নিয়ে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করছেন না। কারণ, তাঁদের কাছে তারিখের বিষয়টির কোনো মূল্য ছিল না, এসকল হাদীসের শিক্ষা গ্রহণই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। ফলে তারিখের বিষয়ে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। মিরাজ একবার না একাধিকবার সংঘঠিত হয়েছে, কোন্ বছর হয়েছে, কোন্ মাসে হয়েছে, কোন্ তারিখে হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে এবং প্রায় ২০টি মত রয়েছে। মাসের ক্ষেত্রে অনেকেই বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের ২৭ তারিখ। কেউ বলেছেন রবিউস সানী মাসে, কেউ বলেছেন রজব মাসে, কেউ বলেছেন, রমযান মাসে, কেউ বলেছেন শাওয়াল মাসে, কেউ বলেছেন যিলকাদ মাসে এবং কেউ বলেছেন, যুলহাজ্জ মাসে। তারিখের বিষয়ে আরো অনেক মতবিরোধ আছে

দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে তাবিয়ী ঐতিহাসিকগণ মিরাজের ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করতে পারেন নি। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ঐতিহাসিকগণ মিরাজের তারিখ বিষয়ক মতভেদ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইবনু কাসীর (৭৭৪ হি.), ইবনু হাজার আসকালানী (৮৫২ হি.), আহমাদ বিন মুহাম্মাদ কাসতালানী (৯২৩হি.), মুহাম্মাদ বিন ইউসূফ শামী (৯৪২ হি.), আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪হি) অন্যান্যরা বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।[7]

এত মতবিরোধের কারণ হাদীস শরীফে বিষয়ে কিছুই বলা হয় নি এবং সাহাবীগণও কিছু বলেন নি। তাবি-তাবিয়ীদের যুগে তারিখ নিয়ে কথা শুরু হয়, কিন্তু কেউই সঠিক সমাধান না দিতে পারায় তাঁদের যুগ পরবর্তী যুগে এত মতবিরোধ হয়। মতবিরোধ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কয়েক শতক আগেওশবে মিরাজবলতে নির্দিষ্ট কোনো রাত নির্দিষ্ট ছিল না

এভাবে আমরা দেখছি যে, রজব মাসের ২৭ তারিখে মিরাজ হয়েছিল, বা তারিখটিলাইলাতুল মিরাজ’, এই কথাটি তাবিয়ী পরবর্তী যুগের ঐতিহাসিকগণের অনেক মতের একটি মত মাত্র। কথাটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে তারিখে মিরাজ হওয়া সম্পর্কে কোনো কিছুই সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি। বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই ঐতিহাসিকগণের মতামত অথবা বানোয়াট কথাবার্তা

আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, কোনো কোনো জাল হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, রজব মাসের ২৭ তারিখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন, নবুয়ত লাভ করেন ... ইত্যাদি। এগুলোও বাতিল মিথ্যা কথা

. ২৭ রজবের ইবাদত

মিরাজের রাত্রিতে ইবাদত বন্দেগি করলে বিশেষ কোনো সাওয়াব হবে বিষয়ে একটিও সহীহ বা যয়ীফ হাদীস নেই। মিরাজের রাত কোন্টি তাই হাদীসে বলা হয়নি, সেখানে রাত পালনের কথা কী-ভাবে আসে। তবে ২৭ রজবের দিনে এবং রাতে ইবাদত বন্দেগির ফযীলতের বিষয়ে কিছু জাল হাদীস প্রচলিত আছে। সকল জাল হাদীসে মিরাজের রাত হিসেবে নয়, বরং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নবুয়ত প্রাপ্তির দিবস হিসেবে বা একটি ফযীলতের দিন হিসেবে২৭ রজব’-কে বিশেষ মর্যাদাময় বলে উল্লেখ করা হয়েছে

এরূপ একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:

إِنَّ فِيْ رَجَبٍ يَوْماً وَلَيْلَةً مَنْ صَامَ ذَلِكَ الْيَوْمَ وَقَامَ تِلْكَ اللَّيْلَةَ كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ كَمَنْ صَامَ مِائَةَ سَنَةٍ وَقَامَ لَيَالِيَهَا وَهِيَ لِثَلاَثَةٍ بَقِيْنَ مِنْ رَجَبٍ وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِيْ بُعِثَ فِيْهِ مُحَمَّدٌﷺ، وَهُوَ أَوَّلُ يَوْمٍ نَزَلَ فِيْهِ جِبْرِيْلُ عَلَى مُحَمَّدٍﷺ.

‘‘রজব মাসের মধ্যে একটি দিন আছে, কেউ যদি সে দিনে সিয়াম পালন করে এবং সে দিনের রাত দাঁড়িয়ে (সালাতে) থাকে তাহলে সে ১০০ বছর সিয়াম পালন করার রাত জেগে সালাত আদায়ের সাওয়াব লাভ করবে। সে দিনটি রজব মাসের ২৭ তারিখ। দিনেই মুহাম্মাদ (ﷺ) নবুয়ত লাভ করেন, দিনেই সর্বপ্রথম জিবরাঈল মুহাম্মাদ (ﷺ) উপর অবতরণ করেন।’’[8]

অন্য একটি জাল হাদীস নিম্নরূপ:

مَنْ صَلَّى لَيْلَةَ سَبْعٍ وَعِشْرِيْنَ مِنْ رَجَبٍ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً يَقْرَأُ فِيْ كُلِّ رَكْعَةٍ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَسُوْرَةٍ، فَإِذَا فَرَغَ مِنْ صَلاَتِهِ قَرَأَ فَاتِحَةَ الْكِتَابِ سَبْعَ مَرَّاتٍ وَهُوَ جَالِسٌ ثُمَّ يَقُوْلُ سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ للهِ وَلاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ الْعَلِيِّ الْعَظِيْمِ أَرْبَعَ مَرَّاتٍ، ثُمَّ أَصْبَحَ صَائِماً حَطَّ اللهُ عَنْهُ ذُنُوْبَ سِتِّيْنَ سَنَةً وَهِيَ اللَّيْلَةُ الَّتِيْ بُعِثَ فِيْهَا مُحَمَّدٌ ﷺ.

‘‘যদি কেউ রজব মাসের ২৭ তারিখে রাত্রিতে ১২ রাকআত সালাত আদায় করে, প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতিহা অন্য একটি সূরা পাঠ করে, সালাত শেষ হলে সে বসা অবস্থাতেই বার সূরা ফাতিহা পাঠ করে এবং এরপর বারসুবহানাল্লাহ, ওয়ালহামদুলিল্লাহ, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীমবলে, অতঃপর সকালে সিয়াম শুরু করে, তবে আল্লাহ তার ৬০ বছরের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। রাতেই মুহাম্মাদ (ﷺ) নবুয়ত পেয়েছিলেন।’’[9]

অন্য একটি জাল হাদীসের ভাষা নিম্নরূপ:

بُعِثْتُ نَبِيًّا فِيْ السَّابِعِ وَالْعِشْرِيْنَ مِنْ رَجَبٍ فَمَنْ صَامَ ذَلِكَ الْيَوْمَ كَانَ كَفَّارَةَ سِتِّيْنَ شَهْراً

‘‘রজব মাসের ২৭ তারিখে আমি নবুয়ত পেয়েছি। কাজেই যে ব্যক্তি এই দিনে সিয়াম পালন করবে তার ৬০ মাসের গোনাহের কাফফারা হবে।’’[10]

আরেকটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, ‘‘ইবনু আববাস (রা) ২৭শে রজবের সকাল থেকে ইতিকাফ শুরু করতেন। যোহর পর্যন্ত সালাতে রত থাকতেন। যোহরের পরে অমুক অমুক সূরা দিয়ে চার রাকআত সালাত আদায় করতেন... এবং আসর পর্যন্ত দোয়ায় রত থাকতেন... তিনি বলতেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরূপ করতেন।’’[11] এগুলো সবই জঘন্য মিথ্যা কথা

২৭ রজবের ফযীলতে এবং দিনে রাতে সালাত, সিয়াম, দোয়া ইত্যাদি ইবাদতের ফযীলতে অনুরূপ আরো অনেক মিথ্যা কথা জালিয়াতগণ প্রচার করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, ২৭ রজব সম্পর্কে হাদীস নামে যা কিছু প্রচলিত সবই ভিত্তিহীন, বাতিল জাল। রজব মাস এবং মাসের কোনো দিন বা রাতের বিশেষ ফযীলতের বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীসই ভিত্তিহীন। ২৭ রজব বিষয়ক হাদীসগুলোও সকল বাতিলের অন্তর্ভুক্ত। ইবনু হাজার আসকালানী, মোল্লা আলী কারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আজলূনী, আব্দুল হাই লাখনবী, দরবেশ হূত প্রমুখ মুহাদ্দিস বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ২৭ রজবের ফযীলত, তারিখের রাত্রে ইবাদত বা দিনের সিয়াম পালনের বিষয়ে বর্ণিত সকল কথাই বানোয়াট, জাল ভিত্তিহীন।[12]

[1] বুখারী, আস-সহীহ /২০৮৩; মুসলিম, আস-সহীহ, /১৫৬৪; ইবনু রাজাব, লাতাইফ /১৯২-১৯৪
[2]
ইবনু রাজাব, লাতাইফ /১৯৯; ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. -৮০; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৬৬; আল-মাসনূ, পৃ. ৯৭; লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮-৯০
[3]
ইবনু রাজাব, লাতাইফ /১৯৪; ইবনু হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. -৮০; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৩৮; আল-মাসনূ, পৃ. ২০৮; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮-৯০, ১১১-১১৩
[4]
ইবনু রাজাব, লাতাইফ /১৯৭; ইবনু হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. -৮০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮-৯০
[5]
ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ৯৬; ইবনু রাজাব, লাতাইফ /১৯৫-১৯৭; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩৯২-৩৩০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, ৫৮-৭৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৫৩৯-৫৪১; আজলূনী, কাশফুল খাফা /৫৬৭
[6]
ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূআত /৪৬-৪৮; ইবনু রাজাব, লাতাইফ /১৯৪-১৯৫; ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৫৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী /৫৫-৫৬; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /৩০৩, ৩০৬, /৯০-৯১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩২৮; আল-মাসনূ, পৃ. ২০৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৫৩৯-৫৪১; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৬২-৭৭
[7]
দেখুন: ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া /৪৭০-৪৮০, শামী, সুবুলুল হুদা (সিরাহ শামিয়া), /৬৪-৬৬, কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ /৩৩৯-৩৯৮
[8]
জূযকানী, আল-আবাতীল, /৪৮; ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৩; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১১৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৬১; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১১৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৫৩৯; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮
[9]
ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৫২; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮
[10]
ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৬১
[11]
আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৭৮
[12]
ইবন হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৪; আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৮৯; আল-মাসনূ, পৃ. ২০৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা /৫৫৪; লাখনবী, আল-আসার ৭৭-৭৯

 . শাবান মাস - () সহীহ হাদীসের আলোকে শাবান মাস

() সহীহ হাদীসের আলোকে শাবান মাস

পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, সফর থেকে রজব পর্যন্ত মাসের কোনো বিশেষ ফযীলত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। শাবান মাস তদ্রূপ নয়। সহীহ হাদীসে শাবান মাসের নিম্নলিখিত ফযীলতগুলো প্রমাণিত:

. মাসে রাসূলুল্লাহ () বেশি বেশি সিয়াম পালন করতে ভালবাসতেন। তিনি সাধারণত মাসের অধিকাংশ দিন একটানা সিয়াম পালন করতেন বলে বুখারী মুসলিম সংকলিত সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি বুখারী মুসলিমের কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি শাবান মাস পুরোটাই নফল সিয়ামে কাটাতেন। তিনি মাসে কিছু সিয়াম পালন করতে সাহাবীগণকে উৎসাহ প্রদান করতেন[1]

. আহমাদ, নাসাঈ প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলিত মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বা হাসান পর্যায়ের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শাবান মাসে বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়; এজন্য এই মাসে বেশি বেশি নফল সিয়াম পালন করা উচিত[2]

. শাবান মাসের মধ্যম রজনী বা ১৫ই শাবানের রাতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে

সকল সহীহ হাসান হাদীসের পাশাপাশি মাসের ফযীলত ইবাদতের বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচলিত। জাল হাদীসগুলোকে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি: সাধারণভাবে শাবান মাস বিষয়ক . শাবান মাসের মধ্যম রজনী বাশবে বরাতবিষয়ক। আমাদের দেশে দ্বিতীয় বিষয়টিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এজন্য প্রথম বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে আমরা দ্বিতীয় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ

[1] বুখারী, আস-সহীহ /৬৯৫, ৭০০; মুসলিম, আস-সহীহ /৮১০-৮১১, ৮২০
[2]
নাসাঈ, আস-সুনান /২০১; আহমাদ, আল-মুসনাদ /২০১

 () শাবান মাস বিষয়ক জাল ভিত্তিহীন কথাবার্তা

বার চান্দের ফযীলতজাতীয় কোনো কোনো পুস্তকে শাবান মাসের প্রথম রজনীতে বিশেষ সূরা বা আয়াত দিয়ে কয়েক রাকআত সালাত আদায়ের কথা, ফাতিমার (রা) জন্য বখশিশ করার কথা, শাবান মাসে নির্ধারিত পরিমাণ দরূদ শরীফ পাঠের বিশেষ ফযীলতের কথা, শাবান মাসের যে কোনো জুমুআর দিবসে বিশেষ সূরা দ্বারা বিশেষ পদ্ধতিতে কয়েক রাকআত সালাত আদায়ের কথা এবং সেগুলোর কাল্পনিক সাওয়াবের কথা লিখা হয়েছে[1] এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। শাবান মাসে নফল সিয়াম পালন ব্যতীত অন্য কোনো প্রকারের বিশেষ ইবাদতের কথা কোনো হাদীসে বলা হয় নি

[1] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৮-১৯

 () শবে বরাত বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ জাল হাদীস

মধ্য শাবানের রজনীবাশবে বারাতবিষয়ক সকল সহীহ, যয়ীফ জাল হাদীস সনদ-সহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে শবে বরাত: ফযীলত আমল’’ নামক গ্রন্থে। এখানে আমি বিষয়ক জাল হাদীসগুলো আলোচনা করতে চাই। প্রসঙ্গত বিষয়ক সহীহ যয়ীফ হাদীসগুলোর বিষয়েও কিছু কথা আসবে

. মধ্য শাবানের রাত্রির বিশেষ মাগফিরাত

বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে:

إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ

‘‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’

অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে জন সাহাবী: আবূ মূসা আশআরী, আউফ ইবনু মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, মুয়ায ইবনু জাবাল, আবু সালাবা আল-খুশানী, আবূ হুরাইরা, আয়েশা আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে।[1] সকল হাদীসের সনদ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা উপর্যুক্ত গ্রন্থে করেছি। এগুলোর মধ্যে কিছু সনদ দুর্বল কিছু সনদহাসানপর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদীসটি সহীহ। শাইখ আলবানী বলেন, ‘‘হাদীসটি সহীহ। তা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।...[2]

হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাত্রিটি একটি বরকতময় রাত এবং রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন। কিন্তু ক্ষমা অর্জনের জন্য শিরক বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোনো আমল করার প্রয়োজন আছে কি না তা এই হাদীসে উল্লেখ নেই

. মধ্য শাবানের রাত্রিতে ভাগ্য লিখন

কিছু কিছু হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাত্রিতে ভাগ্য অনুলিপি করা হয় বা পরবর্তী বছরের জন্য হায়াত-মউত রিযক ইত্যাদির অনুলিপি করা হয়। হাদীসগুলোর সনদ বিস্তারিত আলোচনা করেছি উপর্যুক্ত পুস্তকটিতে। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল অথবা বানোয়াট। অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয় নি

এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন:

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

‘‘আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’’[3]

বাণীর ব্যাখ্যায় তাবিয়ী ইকরিমাহ, বলেন, এখানেমুবারক রজনীবলতেমধ্য শাবানের রাতকেবুঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ বলেন, রাতে গোটা বছরের সকল বিষয়ে ফয়সালা করা হয়।[4]

মুফাস্সিরগণ ইকরিমার মত গ্রহণ করেন নি। ইমাম তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরিমার ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পরে তার প্রতিবাদ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ইকরিমার মত ভিত্তিহীন। তিনি বলেন যে, সঠিক মত হলো, এখানেমুবারক রজনীবলতেলাইলাতুল কদর’-কে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ যে রাত্রিতে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন সে রাত্রিকে এক স্থানে লাইলাতুল কদর: ‘তাকদীরের রাতবামর্যাদার রাতবলে অভিহিত করেছেন[5] অন্যত্র রাত্রিকেইলাইলাতুম মুবারাকাবাবরকতময় রজনীবলে অভিহিত করেছেন। এবং রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামাদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, তিনি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন।[6] এথেকে প্রমাণিত হয় যে, মুবারক রজনী রামাদান মাসে, শাবান মাসে নয়।[7]

পরবর্তী মুফাস্সিরগণ ইমাম তাবারীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, ‘মুবারক রজনীবলতে এখানেমহিমান্বিত রজনীবালাইলাতুল কদরবুঝানো হয়েছে। তাঁদের মতেলাইলাতুম মুবারাকাএবংলাইলাতুল কদরএকই রাতের দুটি উপাধি। দুটি কারণে মুফাস্সিরগণ ইকরিমার তাফসীরকে বাতিল অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন:

() ইকরিমার মতটি কুরআনের সুস্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। কুরআনে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। অন্যত্র বলেছেন যে, একটি মুবারক রাত্রিতে একটি মহিমান্বিত রাত্রিতে তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। সকল আয়াতের সমন্বিত সুস্পষ্ট অর্থ হলো, আল্লাহ রামাদান মাসের এক রাত্রিতে কুরআন নাযিল করেছেন এবং সে রাতটি বরকতময় মহিমান্বিত। মুবারক রজনীকে শবে বরাত বলে দাবী করলে আয়াতগুলোর স্পষ্ট অর্থ বিভিন্ন অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করতে হয়

() বিভিন্ন সাহাবী তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরামুবারক রজনী’- ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, রাতটি হলোলাইলাতুল কদরবামহিমান্বিত রজনী সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবনু আববাস (রা) ইবনু উমার (রা) থেকে অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাবিয়ীগণের মধ্যে থেকে আবু আব্দুর রহমান আল-সুলামী (৭৪ হি), মুজাহিদ বিন জাবর (১০২ হি), হাসান বসরী (১১০ হি), ক্বাতাদা ইবনু দিআমা (১১৭ হি) আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম মাদানী (১৮২ হি) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সকলেই বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ অর্থ লাইলাতুল কদর।[8]

. মধ্য-শাবানের রাত্রিতে দোয়া-মুনাজাত

মধ্য শাবানের রজনীর ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত তৃতীয় প্রকারের হাদীসগুলোতে রাত্রিতে সাধারণভাবে দোয়া করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রাতে দোয়া করা, আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আকুতি জানানো এবং জীবিত মৃতদের পাপরাশি ক্ষমালাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস নেই। অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে কিছু হাদীস দুর্বল এবং কিছু হাদীস জাল

. অনির্ধারিত সালাত দোয়া

মধ্য শাবানের রাত্রি সম্পর্কে বর্ণিত কিছু হাদীসে রাত্রিতে সালাত আদায় দোয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সকল হাদীস রাত্রির সালাতের জন্য কোনো নির্ধারিত রাকআত, নির্ধারিত সূরা বা নির্ধারিত পদ্ধতি উল্লেখ করা হয় নি। শুধু সাধারণভাবে রাত্রিতে তাহাজ্জুদ আদায় দোয়া করার বিষয়টি সকল হাদীস থেকে জানা যায়। অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো প্রায় সবই বানোয়াট। দু-একটি হাদীস দুর্বল হলেও বানোয়াট নয়

. নির্ধারিত রাকআত, সূরা পদ্ধতিতে সালাত

শবে বরাত বিষয়ক অন্য কিছু হাদীসে রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে, বিশেষ সুরা পাঠের মাধ্যমে, নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক রাকআত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত মত অনুযায়ী এই অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট। হিজরী চতুর্থ শতকের পরে রাসুলুলাহ (ﷺ) -এর নামে বানিয়ে এগুলো প্রচার করা হয়েছে। এখানে জাতীয় কয়েকটি জাল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করছি

. ৩০০ রাকআত, প্রতি রাকআতে ৩০ বার সূরা ইখলাস

‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে প্রত্যেক রাকআতে ৩০বার সুরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাকআত সালাত আদায় করবে জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’’ হাদীসটি ইবনুল ক্বাইয়িম বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীস সমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন।[9]

. ১০০ রাকআত, প্রতি রাকআতে ১০ বার সুরা ইখলাস

মধ্য শাবানের রজনীতে পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী চতুর্থ শতকের পরে মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুহাদ্দিস ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হি. সনে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথম রাত্রিতে পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন শুরু হয়।[10] সময়ে বিভিন্ন মিথ্যাবাদী গল্পকার ওয়ায়িয অর্থে কিছু হাদীস বানিয়ে বলেন। অর্থে ৪টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বানোয়াট ভিওিহীন

এর প্রথমটি আলী (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে প্রচারিত: যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকআতে সুরা ফাতিহা ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে আল্লাহ তায়ালা তার সকল প্রয়োজন পূরণ করবেন। লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরির্বতন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে, আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ৭০ হাজার ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপরাশি মুছে দেবে, বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবে, এছাড়াও আল্লাহ তায়ালাআদনজান্নাতে ৭০ হাজার বা লাখ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা জান্নাতের মধ্যে তার জন্য শহর প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপন করবে... যে ব্যক্তি নামায আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে মহান আল্লাহ তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন

হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে বানোয়াট জাল। এর বর্ণনাকারীগণ কেউ অজ্ঞাত পরিচয় এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত।[11]

বিষয়ক দ্বিতীয় জাল হাদীসটিতে জালিয়াতগণ ইবনু উমার (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলেছে: ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে এক শত রাকআত সালাতে এক হাজার বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ১০০ জন ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, তন্মধ্যে ত্রিশজন তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে, ত্রিশজন তাকে জাহান্নমের আগুন থেকে নিরাপত্তার সুসংবাদ প্রদান করবে, ত্রিশজন তাকে ভুলের মধ্যে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং দশজন তার শত্রুদের ষড়যন্ত্রের জবাব দেবে।’’

হাদীসটিও বানোয়াট। সনদের অধিকাংশ রাবী অজ্ঞাতপরিচয়। বাকীরা মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত।[12]

বিষয়ক তৃতীয় জাল হাদীসটিতে মিথ্যাবাদীগণ বিশিষ্ট তাবিয়ী ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ আল বাকির (১১৫ হি) থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বরাতে বর্ণনা করেছে: ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাতে ১০০০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বেই মহান আল্লাহ তার কাছে ১০০ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন। ৩০ জন তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে, ৩০ জন তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিবে, ৩০ জন তার ভুল সংশোধন করবে এবং ১০ জন তার শত্রুদের নাম লিপিবদ্ধ করবে।’’

হাদীসটিও বানোয়াট। সনদের কিছু রাবী অজ্ঞাতপরিচয় এবং কিছু রাবী মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত।।[13]

১০০ রাকআত সংক্রান্ত বিশেষ পদ্ধতিটি হিজরী চতুর্থ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন গল্পকার ওয়ায়িযদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং যুগে যুগে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে ভারতীয় ওয়ায়িযগণ সালাতের পদ্ধতির মধ্যে প্রত্যেক দু রাকআতের পরে ‘‘তাসবীহুত তারাবীহ’’ প্রচলন করেন এবং ১০০ রাকআত পূর্ণ হওয়ার পর কতিপয় সাজদা, সাজদার ভিতরে বাহিরে কতিপয় দোয়া সংযুক্ত করেছেন

আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৬ হি) বানোয়াট ভিত্তিহীন হাদীস সমুহের মধ্যে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। যার সারমর্ম হলো, মধ্য শাবানের রাতে পঞ্চাশ সালামে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করতে হবে। প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতিহার পর ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। প্রত্যেক দুই রাকআত পরতাসবীহুত তারাবীহপাঠ করবে, এর পর সাজদা করবে। সাজদার মধ্যে কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে। অতঃপর সাজদা থেকে মাথা তুলবে এবং নবী (ﷺ) এর উপর দুরূদ পাঠ করবে কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে। অতঃপর দ্বিতীয় সাজদা করবে এবং তাতে কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে।[14]

. ৫০ রাকআত

ইমাম যাহাবী হাদীসটি ভিত্তিহীন বানোয়াট হাদীস হিসেবে হাদীসটির বর্ণনাকারী অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মাদ বিন সাঈদ আলমীলী আত তাবারীর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মাদ বিন সাঈদ হাদীসটি তার মতই অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন আমর আল বাজালী এর সনদে আনাস (রা) থেকে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেনঃ যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ৫০ রাকআত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার কাছে যত প্রকার প্রয়োজনের কথা বলবে তার সবটুকুই পূরণ করে দেয়া হবে। এমনকি লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগ্যবান হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে তাকে সৌভাগ্যবান করা হবে। এবং আল্লাহ তাআলা তার কাছে লাখ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার নেকী লিপিবদ্ধ করবে, অপর লাখ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার জন্য বেহেশতে প্রাসাদ নির্মাণ করবে ..... এবং ৭০ হাজার একত্ববাদীর জন্য তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে... ইমাম যাহাবী মিথ্যা হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, যে ব্যাক্তি হাদীসটি বানোয়াট করেছে আল্লাহ তাআলা তাকে লাঞ্চিত করুন।[15]

. ১৪ রাকআত

ইমাম বায়হাকী তাঁর সনদে আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-কে মধ্য শাবানের রাতে ১৪ রাকআত সালাত আদায় করতে দেখেছি। সালাত শেষে বসে তিনি ১৪ বার সূরা ফাতিহা, ১৪ বার সূরা ইখলাস, ১৪ বার সূরা ফালাক, ১৪ বার সূরা নাস, বার আয়াতুল কুরসী এবং সূরা তাওবার শেষ দু আয়াত তিলাওয়াত করেন, সব কাজের সমাপ্তির পর আমি তাঁকে এগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন: তুমি আমাকে যে ভাবে করতে দেখেছ এভাবে যে করবে তার আমলনামায় ২০টি কবুল হজ্জের সাওয়াব লেখা হবে এবং ২০ বছরের কবুল সিয়ামের সাওয়াব লিখা হবে। পরদিন যদি সে সিয়াম পালন করে তবে দু বছরের সিয়ামের সাওয়াব তার আমলনামায় লেখা হবে

হাদীসটি উল্লেখ করার পর ইমাম বায়হাকী বলেন: ইমাম আহমাদ বলেছেন যে, হাদীসটি আপত্তিকর, পরিত্যক্ত, জাল বানোয়াট বলে প্রতীয়মান। হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীগণ রয়েছে।[16]

অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করার বিষয়ে ইমাম বাইহাকীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। আল্লামা ইবনুল জাওযী ইমাম সুয়ুতী বলেন: হাদীসটি বানোয়াট, এর সনদ অন্ধকারাচ্ছন্ন। .... সনদের মধ্যে মুহাম্মাদ বিন মুহাজির রয়েছেন। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল বলেন: মুহাম্মদ বিন মুহাজির হাদীস বানোয়াট-কারী।[17]

১০. ১২ রাকআত, প্রত্যেক রাকআতে ৩০ বার সূরা ইখলাস

জালিয়াতগণ আবু হুরাইরা (রা) পর্যন্ত একটি জাল সনদ তৈরী করে তাঁর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছে: ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১২ রাকআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকাতে ৩০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, সালাত শেষ হওয়ার পূর্বেই বেহেশতের মধ্যে তার অবস্থান সে অবলোকন করবে এবং তার পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে জাহান্নাম নির্ধারিত হয়েছে এমন দশ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’’

হাদীসের সনদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই অজ্ঞাত। এছাড়াও সনদের মধ্যে কতিপয় দুর্বল পরিত্যাজ্য বর্ণনাকারী রয়েছে।[18]

উপরের আলোচনার মাধ্যমে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, মধ্য শাবানের রাতে নির্দ্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দ্দিষ্ট সূরার মাধ্যমে নির্দ্দিষ্ট রাকআত সালাত আদায় সংক্রান্ত হাদীস সমূহ বানোয়াট ভিত্তিহীন। মুহাদ্দিসগণ ব্যাপারে সকলেই একমত। কিন্তু কতিপয় নেককার সরলপ্রাণ ফকীহ মুফাস্সির তাঁদের রচনাবলিতে এগুলোর জালিয়াতি অসারতা উল্লেখ ছাড়াই এসকল ভিত্তিহীন হাদীস স্থান দিয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ এগুলোর উপর ভিত্তি করে ফতোয়া প্রদান করেছেন তদনুযায়ী আমল করেছেন, যা পরবর্তীতে রীতি প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে

মোল্লা আলী ক্বারী (১০১৪ হি) মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলোর অসারতা উল্লেখপূর্বক বলেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে, যারা সুন্নাতের ইলমের সন্ধান পেয়েছেন তারা এগুলো দ্বারা প্রতারিত হন কি করে! সালাত চতুর্থ হিজরী শতকের পর ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে যার উৎপত্তি হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে। এব্যাপারে অসংখ্য জাল হাদীস তৈরী করা হয়েছে যার একটিও সঠিক বা নির্ভরযোগ্য নয়।[19] তিনি আরো বলেন, হে পাঠক, সকল ভিত্তিহীন মিথ্যা হাদীসকুতুল কুলুব’, ‘এহয়িয়াউ উলুমিদ্দীন ইমাম সালাবীর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ থাকার কারণে আপনারা প্রতারিত বিভ্রান্ত হবেন না।[20] ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ আজলুনীও (১১৬২ হি) অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।[21]

আল্লামা শাওকানী (১২৫০ হি) শবে বরাতের রাত্রিতে আদায়কৃত সালাত সংক্রান্ত হাদীসের ভিত্তিহীনতা উল্লেখ পূর্বক বলেন, সকল হাদীস দ্বারা এক দল ফকীহ প্রতারিত হয়েছেন। যেমনএহয়িয়াউ উলূমিদ্দীনগ্রন্থকার ইমাম গাযালী অন্যান্যরা। এমনিভাবে কতিপয় মুফাস্সিরও প্রতারিত হয়েছেন। সালাতের বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের জাল হাদীস রচিত হয়েছে। সকল হাদীস মাউযূ বা বানোয়াট হওয়ার অর্থ হলো, এই রাত্রিতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত রাকআত সালাত আদায়ের প্রচলন বাতিল ভিত্তিহীন। তবে কোনো নির্ধারিত রাকআত, সূরা বা পদ্ধতি ব্যতিরেকে সাধারণ ভাবে রাত্রিতে ইবাদত বা দোয়া করার বিষয়ে দুই একটি যয়ীফ হাদীস রয়েছে।’’[22]

[1] ইবনু মাজাহ, আস- সুনান /৪৪৫; বাযযার, আল-মুসনাদ /১৫৭, ২০৭, /১৮৬; আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ /১৭৬; ইবনু আবি আসিম, আস-সুন্নাহ,পৃ ২২৩-২২৪; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবারানী, আল-মুজাম আল-কাবীর, ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মুজাম আল-আওসাত, /৬৮; বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান, /৩৮১; ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ /৩২৫-৩২৬
[2]
আলবানী, সাহীহাহ (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ) /১৩৫
[3]
সূরা (৪৪) দুখান: আয়াত -
[4]
তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯
[5]
সূরা (৯৭) কাদ্র: আয়াত
[6]
সূরা () বাকারা: আয়াত ১৮৫
[7]
তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯
[8]
নাহহাস, মাআনিল কুরআন /৩৯৫; যামাখশারী, আল-কাশশাফ /৪২৯; ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন /১৬৯০; ইবনু আতিয়্যাহ্, আল- মুহাররার আল ওয়াজীয /৬৮-৬৯; কুরতুবী, তাফসীর ১৬/১২৬; আবু হাইয়্যান, আল-বাহর আল-মুহীত /৩২-৩৩; ইবনু কাছীর, তাফসীর /১৪০; সুয়ূতী, আদদুররুল মানসূর /৭৩৮-৭৪২; আবুস সুউদ, তাফসীর--আবিস সুউদ /৫৮; শাওকানী, ফাতহুল ক্বাদীর /৫৭০-৫৭২; আলুসী, রূহুল মাআনী ১৩/১১০; থানবী, তাফসীর- আশরাফী /৬১৫-৬১৬; শানক্বীতী, মুহাম্মদ আমীন, আদওয়া আল- বায়ান /৩১৯; সাবুনী, মুহাম্মদ আলী, সাফওয়াতুত তাফাসীর /১৭০-১৭১; মুফতী শফী, মাআরেফ আল-কুরআন /৮৩৫-৮৩৬
[9]
ইবনুল কাইয়িম, নাক্বদুল মানকুল /৮৫
[10]
মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ /৩৮৮
[11]
ইবনুল জাওযী, আল-মাওদুআত /৪৯-৫০; সুয়ুতী, আল-লাআলী, /৫৭-৫৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ, /৯২-৯৩; মোল্লা ক্বারী, আল-আসরার, পৃ- ৩৩০-৩৩১; আল মাসনু’, পৃ- ২০৮-২০৯; শাওকানী, আল ফাওয়ায়েদ /৭৫-৭৬
[12]
ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত, /৫০-৫১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান /২৭১; সুয়ূতী, আল লাআলী, /৫৯; ফাকিহানী, মুহাম্মদ বিন ইসহাক্ব, আখবারু মাক্কাহ /৮৬-৮৭
[13]
ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত, /৫১; সুয়ূতী, আল-লাআলী, /৫৯
[14]
আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার আল-মারফুআ, পৃ- ১১৩-১১৪
[15]
যাহাবী, মীযানুল তিদাল, /১৬৮-১৬৯
[16]
বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, /৩৮৬ - ৩৮৭, হাদীস নং - ৩৮৪১
[17]
ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত, /৫২; সুয়ূতী, আল-লাআলী, /৫৯-৬০
[18]
ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত, /৫২; সুয়ূতী, আল-লাআলী, /৫৯
[19]
মোল্লাআলী ক্বারী, আল-আসরার, পৃ- ৩৩০-৩৩১; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার আল-মুনীফ, পৃ- ৮৯-৯৯
[20]
মোল্লা আলী ক্বারী, আল মাসনূ’, পৃষ্ঠা- ২০৮-২০৯
[21]
আজলুনী, কাশফুল খাফা, /৫৫৪-৫৫৫
[22]
শাওকানী, আল-ফাওয়ায়িদ /৭৬

() আরো কিছু জাল বা অনির্ভরযোগ্য হাদীস

 

. মধ্য শাবানের রাতে কিয়াম দিনে সিয়াম

আলী (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ- থেকে বর্ণিত একটি হাদীস নিম্নরূপ:

إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ أَلا مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ أَلا مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلا مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ أَلا كَذَا أَلا كَذَا حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ.

‘‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাতে (সালাতে- দোয়ায়) দন্ডায়মান থাক এবং দিবসে সিয়াম পালন কর। কারণ দিন সুর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন রিয্ক অনুসন্ধানকারী আছে কি? আমি তাকে রিয্ক প্রদান করব। কোন দুর্দাশাগ্রস্থ ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহ সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।’’

হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ তাঁর উস্তাদ হাসান বিন আলী আল-খাল্লাল থেকে, তিনি আব্দুর রাজ্জাক থেকে, তিনি ইবনু আবি সাব্রাহ থেকে, তিনি ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ থেকে, তিনি মুয়াবিয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন জাফর থেকে, তিনি তাঁর পিতা আব্দুলাহ বিন জাফর থেকে, তিনি আলী ইবনু আবী তালিব (রা) থেকে রাসূলুল্লাহ () থেকে বর্ণনা করেছেন[1]

ইবনু মাজাহ কর্তৃক সংকলিত হওয়ার কারণে হাদীসটি আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত, প্রচারিত আলোচিত। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল পর্যায়ের বলে চিহ্নিত করেছেন

হাদীসটি একমাত্র ইবনু আবি সাব্রাহ ব্যতীত অন্য কেউ বর্ণনা করেন নি। হাদীস আলী ইবনু আবি তালিব থেকে তাঁর কোন ছাত্র বর্ণনা করেন নি। আব্দুলাহ বিন জাফর বিন আবি তালিব থেকেও তাঁর কোন ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। এমনকি মুয়াবিয়া ইবরাহিম বিন মুহাম্মদ থেকেও তাঁদের কোনো ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেননি। শুধু ইবন আবি সাব্রাহ দাবী করেছেন যে, তিনি ইবরাহীম থেকে উক্ত সনদে হাদীসটি শ্রবণ করেছেন। তাঁর কাছ থেকে আব্দুর রাজ্জাক অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন

ইবনু আবি সাব্রাহ (১৬২ হি) -এর পূর্ণনাম আবু বাকর বিন আব্দুলাহ বিন মুহাম্মদ বিন আবি সাব্রাহ। তিনি মদীনার একজন বড় আলিম ফক্বীহ ছিলেন। কিন্তু তুলনামূলক নিরীক্ষা বিচারের মাধ্যমে হাদীসের ইমামগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতেন। অসংখ্য ইমাম তাঁকে মিথ্যা বানোয়াট হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তন্মধ্যে ইমাম আহমাদ, ইয়াহইয়া বিন মায়ীন, আলী ইবনুল মাদীনী, বুখারী, ইবনু আদী, ইবনু হিববান হাকিম নাইসাপূরী অন্যতম[2]

এরই আলোকে আল্লামা শিহাব উদ্দীন আহমাদ বিন আবি বকর আল-বুসীরী (৮৪০ হি) বলেন, ইবনু আবি সাব্রাহর দুর্বলতার কারণে সনদটি দুর্বল। ইমাম আহমাদ ইবনু মাঈন তাঁকে হাদীস বানোয়াটকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন[3] শাইখ আলবানী বলেছেন, অত্যন্ত দুর্বল বা বানোয়াট। তিনি আরো বলেন, সনদটি বানোয়াট[4]

. দুই ঈদ মধ্য-শাবানের রাত্রিভর ইবাদত

একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:

مَنْ أَحْيَا لَيْلَتَيْ الْعِيْدِ وَلَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوْتُ الْقُلُوْبُ

যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত মধ্য শাবানের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবেনা যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে[5]

হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী উপর্যুক্ত ঈসা ইবনু ইবরাহীম ইবনু তাহমান বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে সুপরিচিত। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন আবু হাতিম রাযি অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে তাকে পরিত্যক্ত বা মিথ্যাবাদী রাবী বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ঈসা ইবনু ইবরাহীম নামক এই ব্যক্তি তার উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন সেসালামা বিন সুলাইমানদুর্বল রাবী বলে পরিচিত। আর তার উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেমারওয়ান বিন সালিমমিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত[6] এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসটির সনদের রাবীগণ অধিকাংশই মিথ্যাবাদী বা অত্যন্ত দুর্বল। এরা ছাড়া কেউ হাদীস বর্ণনা করেন নি। কাজেই হাদীসটি বানোয়াট পর্যায়ের

এখানে উল্লেখ্য যে, আবূ উমামা (রা) অন্যান্য সাহাবী থেকে একাধিক দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবে না যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে। সকল বর্ণনায় দুই ঈদের রাতের সাথে মধ্য শাবানের রাতকে কেউ যুক্ত করেন নি[7]

. পাঁচ রাত্রি ইবাদতে জাগ্রত থাকা

মুয়ায ইবনু জাবাল (রা) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে,

مَنْ أَحْيَا اللَّيَالِيَ الْخَمْسَ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ لَيْلَةَ التَّرْوِيَةِ وَلَيْلَةَ عَرَفَةَ وَلَيْلَةَ النَّحْرِ وَلَيْلَةَ الْفِطْرِ وَلَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ

‘‘যে ব্যক্তি পাঁচ রাত (ইবাদতে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হবে: যুলহাজ্জ মাসের তারিখের রাত্রি, আরাফার রাত্রি, ঈদুল আযহার রাত্রি, ঈদুল ফিতরের রাত্রি মধ্য শাবানের রাত্রি।’’

হাদীসটি ইস্পাহানীতারগীবগ্রন্থে সুওয়াইদ ইবনু সাঈদ-এর সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন। সুওয়াইদ, আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আলআম্মী থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি ওয়াহ্ব ইবনু মুনাবিবহ থেকে, তিনি মুয়ায ইবনু জাবাল থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ () থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন

হাদীসটির বর্ণনাকারী আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল-‘আম্মী (১৮৪হি) নামক ব্যক্তি মিথ্যা জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়াহইয়া ইবনু মায়ীন, আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আবূ হাতিম রাযী, আবূ দাঊদ অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস ব্যক্তির মিথ্যাবাদিতার বিষয় উল্লেখ করেছেন। এজন্য হাদীসটি মাওযূ বা জাল হাদীস বলে গণ্য। ইবনুল জাওযী, ইবনু হাজার আসকালানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস বিষয়ে আলোচনা করেছেন[8]

. রাত্রিতে রহমতের দরজাগুলো খোলা হয়

আবুল হাসান আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আর্রাক (৯৬৩ হি) তাঁর মাউযূ বা জাল হাদীস সংকলনের গ্রন্থে ইবনু আসাকির-এর বরাত দিয়ে বানোয়াট ভিত্তিহীন হাদীস হিসেবে নিম্নের হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। উবাই ইবনু কা (রা) এর সূত্রে কথিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () বলেন:

‘‘মধ্য শাবানের রাতে জিবরাঈল () আমার কাছে আগমন করে বলেন, আপনি দাঁড়িয়ে নামায পড়ুন এবং আপনার মাথা হস্তদ্বয় উপরে উঠান। আমি বললাম, হে জিবরাঈল, এটি কোন্ রাত? তিনি বলেন, হে মুহাম্মাদ, রাতে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং রহমতের ৩০০ দরজা খুলে দেওয়া হয়। ... তখন রাসূলুল্লাহ () বাকী গোরস্তানে গমন করেন। তিনি যখন সেখানে সাজদারত অবস্থায় দোয়া করছিলেন, তখন জিবরাঈল সেখানে অবতরণ করে বলেন, হে মুহাম্মাদ, আপনি আকাশের দিকে মাথা তুলুন। তিনি তখন তাঁর মস্তক উত্তোলন করে দেখেন যে, রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক দরজায় একজন ফিরিশতা ডেকে বলছেন, রাত্রিতে যে সাজদা করে তার জন্য মহা সুসংবাদ...’’

হাদীসটি উদ্ধৃত করে ইবনু আর্রাক উল্লেখ করেছেন যে, হাদীস একটি মাত্র সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যে সূত্রের রাবীগণ সকলেই অজ্ঞাতপরিচয় এবং হাদীসটি বানোয়াট ভিত্তিহীন হিসেবে বিবেচিত[9]

. পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না

আবূ উমামার (রা) সূত্রে, রাসূলুল্লাহর () নামে কথিত আছে,

خَمْسُ لَيَالٍ لاَ تُرَدُّ فِيْهِنَّ الدَّعْوَةُ: أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ رَجَبٍ، وَلَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَان َوَلَيْلَةُ الْجُمُعَةِ، وَلَيْلَةُ الْفِطْرِ، وَلَيْلَةُ النَّحْرِ

‘‘পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না: রজব মাসের প্রথম রাত, মধ্য শাবানের রাত, জুমুআর রাত, ঈদুল ফিতর ঈদুল আযহার রাত।’’

হাদীসটি হাফিয আবুল কাসিম ইবনু আসাকির (৫৭১ হি) তারতারীখ দিমাশকগ্রন্থে আবু সাঈদ বুনদার বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ রূইয়ানির সূত্রে, তিনি ইবরাহীম বিন আবি ইয়াহয়িয়া থেকে, তিনি আবু কানাব থেকে, তিনি আবু উমামা বাহিলী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম সুয়ুতী তাঁর ‘‘আল জামে আল সাগীর’’ গ্রন্থে ইবন আসাকিরের উদ্ধৃতি দিয়ে হাদীসটি যয়ীফ হিসাবে উল্লেখ করেছেন[10] নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে বানোয়াট হিসেবে উল্লেখ করেছেন[11] কারণ হাদীসের মূল ভিত্তি হলো ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবী ইয়াহইয়া (১৮৪ হি) নামক একজন মুহাদ্দিস। ইমাম মালিক, আহমাদ, বুখারী, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইয়াহইয়া আল-কাত্তান, নাসাঈ, দারাকুতনী, যাহাবী, ইবনু হিববান অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে রাফিযী শিয়া, মুতাযিলী ক্বাদরিয়া আক্বীদায় বিশ্বাসী বলে অভিযুক্ত করেছেন এবং মিথ্যাবাদী অপবিত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম শাফিয়ী প্রথম বয়সে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন বিধায় কোনো কোনো শাফিয়ী মুহাদ্দিস তাঁর দুর্বলতা কিছুটা হাল্কা করার চেষ্টা করেন। তবে শাফিয়ী মাযহাবের অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ এবং অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস এক কথায় তাকে মিথ্যাবাদী পরিত্যক্ত বলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন

ইমাম শাফিয়ী নিজেও তাঁর শিক্ষকের দুর্বলতা অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি পরবর্তী জীবনে তার সূত্রে কোনো হাদীস বললে তার নাম উল্লেখ না করে বলতেন, আমাকে বলা হয়েছে, বা শুনেছি বা অনুরূপ কোনো বাক্য ব্যবহার করতেন[12]  হাদীসটির ক্ষেত্রেও ইমাম শাফিয়ী বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, আগের যুগে বলা হতো, পাঁচ রাতে দোয়া করা মুস্তাহাব.... ইমাম শাফিয়ী বলেন, সকল রাতে যে সব আমলের কথা বলা হয়েছে সেগুলোকে আমি মুসতাহাব মনে করি[13]

এছাড়া সনদের অন্য রাবী আবু সাঈদ বুনদার বিন উমরও মিথ্যাবাদী হাদীস জালকারী বলে পরিচিত[14]

এখানে উল্লেখ্য যে, হাফিয আব্দুর রায্যাক সানআনী হাদীসটি অন্য একটি সনদে ইবনু উমারের (রা) নিজস্ব বক্তব্য হিসাবে উদ্ধৃত করেছেন[15] আব্দুর রায্যাক সানআনী বলেন, আমাকে এক ব্যক্তি বলেছেন, তিনি বায়লামানীকে বলতে শুনেছেন, তার পিতা বলেছেন, ইবনু উমার বলেছেন, পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না। ....’’

সনদে আব্দুর রায্যাককে যিনি হাদীসটি বলেছেন, তিনি অজ্ঞাত পরিচয়। পরবর্তী রাবী মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রাহমান বিন বায়লামানী হাদীস-জালিয়াত হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন[16] উক্ত মুহাম্মাদের পিতা, সনদের পরবর্তী রাবী আব্দুর রাহমান বিন বায়লামানীও দুর্বল অনির্ভরযোগ্য রাবী[17]

. শবে বরাতের গোসল

শবে বরাত বিষয়ক প্রচলিত মিথ্যা কথাগুলোর অন্যতম হলো রাতে গোসল করার ফযীলত। বিষয়টি যদিও সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন জঘন্য বানোয়াট কথা, তবুও আমাদের সমাজে তা অত্যন্ত প্রচলিত। আমাদের দেশের প্রচলিত প্রায় সকল পুস্তকেই জাল কথাটি লিখা হয় এবং ওয়াযে আলোচনায় বলা হয়। প্রচলিত একটি বই থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘‘একটি হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি উক্ত রাত্রিতে এবাদতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করিবে, সে ব্যক্তির গোসলের প্রত্যেকটি বিন্দু পানির পরিবর্তে তাহার আমল নামায় ৭০০ (সাতশত) রাকাত নফল নামাযের ছওয়াব লিখা যাইবে। গোসল করিয়া দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল অজুর নামায পড়িবে।...’[18]

মিথ্যা কথা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কঠিন শীতের দিনেও অনেকে গোসল করেন। উপরন্তু ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ার আশায় শরীর মাথা ভাল করে মোছেন না। এর ফলে অনেকে, বিশেষত, মহিলারা বড় চুলের কারণে ঠান্ডা-সর্দিতে আক্রান্ত হন। আর কষ্ট শরীয়াতের দৃষ্টিতে পন্ডশ্রম ছাড়া কিছুই নয়। কারণ, সুন্নাতের আলোকে এই রাতে গোসল করে ইবাদত করা আর ওযু করে ইবাদত করার মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য নেই। অনুরূপভাবে রাতে গোসল করা এবং অন্য কোনো রাতে গোসল করার মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই

. রাতে নেক আমলের সুসংবাদ

বিষয়ে আমাদের দেশের প্রচলিত একটি কথা:

طُوْبَى لِمَنْ يَعْمَلُ فِىْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ خَيْراً

‘‘মহা সুসংবাদ তার জন্য সে শাবান মাসের মধ্যম রজনীতে নেক আমল করে...’’ কথাটি উপরে উল্লিখিত উবাই ইবনু কা (রা) এর নামে প্রচারিত জাল হাদীসটি থেকে গ্রহণ করা

. রাতে হালুয়া-রুটি বা মিষ্টান্ন বিতরণ

রত্রিতে হালুয়া-রুটি তৈরি করা, খাওয়া, বিতরণ করা, মিষ্টান্ন বিতরণ করা ইত্যাদি সবই বানোয়াট ভিত্তিহীন কর্ম। রাতে সকল ইবাদত করলে কোনো বিশেষ সাওয়াব বা অতিরিক্ত সাওয়াব পাওয়া যাবে মর্মে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি

. ১৫ শাবানের দিনে সিয়াম পালন

আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ () শাবান মাসের বেশি বেশি সিয়াম পালন করতেন, এমনকি প্রায় সারা মাসই সিয়ামরত থাকতেন। আমরা আরো দেখেছি যে, শাবান মাসের মধ্যম রজনীর ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই রাত্রিতে সাধারণভাবে দোয়া-ইসতিগফার বা সালাত আদায়ের উৎসাহ জ্ঞাপক কিছু যয়ীফ বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হাদীস রয়েছে। কিন্তু পরদিন সিয়াম পালনের বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য হাদীস পাওয়া যায় না। ইবনু মাজাহ সংকলিত আলী (রা)-এর নামে বর্ণিত হাদীসটিতে সিয়াম পালনের কথা বলা হয়েছে। তবে হাদীসটির সনদ নির্ভরযোগ্য নয়। শবে বরাতের রাতে ১৪ রাকআত সালাত আদায় বিষয়ক হাদীসেও পরদিন সিয়াম পালনের ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হাদীসটি জাল। বিষয়ক আরেকটি জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিত:

مَنْ صَامَ يَوْمَ خَامِسَ عَشَرَ شَعْبَانَ لَمْ تَمْسَسْهُ النَّارُ أَبَداً

‘‘যে ব্যক্তি শাবান মাসের ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করবে, জাহান্নামের আগুন কখনোই তাকে স্পর্শ করবে না।[19]

১০. প্রচলিত কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তার নমুনা

আমাদের দেশে প্রচলিত পুস্তকাদিতে অনেক সময় লেখকগণ বিশুদ্ধ অশুদ্ধকে একসাথে মিশ্রিত করেন। অনেক সময় সহীহ হাদীসের অনুবাদে অনেক বিষয় প্রবেশ করান যা হাদীসের নামে মিথ্যায় পরিণত হয়। অনেক সময় নিজেদের খেয়াল-খুশি মত বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি গ্রন্থের নাম ব্যবহার করেন। এগুলোর বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ দয়া করে আমাদের লেখকগণের পরিশ্রম কবুল করুন, তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন এবং আমাদের সকলকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করুন। শবে বরাত বিষয়ক কিছু ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি। প্রায় সকল পুস্তকেই কথাগুলো কম বেশি লিখা হয়েছে

‘‘হাদীসে আছে, যাহারা এই রাত্রিতে এবাদত করিবে আল্লাহ তাআলা আপন খাছ রহমত স্বীয় অনুগ্রহের দ্বারা তাহাদের শরীরকে দোজখের অগ্নির উপর হারাম করিয়া দিবেন। অর্থাৎ তাহাদিগকে কখনও দোজখে নিক্ষেপ করিবেন না। হযরত () আরও বলেন- আমি জিবরাইল (আঃ) এর নিকট শুনিয়াছি, যাহারা শাবানের চাঁদের ১৫ই তারিখের রাত্রিতে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে, তাহারা শবে ক্বদরের এবাদতের সমতুল্য ছওয়াব পাইবে

আরও একটি হাদীসে আছে, হযরত () বলিয়াছেন, শাবানের চাঁদের ১৫ই তারিখের রাত্রিতে এবাদতকারী আলেম, ফাজেল, অলী, গাউছ, কুতুব, ফকীর, দরবেশ ছিদ্দীক, শহীদ, পাপী নিষ্পাপ সমস্তকে আল্লাহ তাআলা মার্জনা করিবেন। কিন্তু যাদুকর, গণক, বখীল, শরাবখোর, যেনাকার, নেশাখোর, পিতা-মাতাকে কষ্টদাতা- এই কয়জনকে আল্লাহ তাআলা মাফ করিবেন না। আরও একটি হাদীসে আছে, আল্লাহ তাআলা শাবানের চাঁদের ১৫ই তারিখের রাত্রিতে ৩০০ খাছ রহমতের দরজা খুলিয়া দেন তাঁহার বান্দাদের উপর বে-শুমার রহমত বর্ষণ করিতে থাকেন

কালইউবী কিতাবে লিখিত আছে,- একদিন হযরত ঈসা () জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন হে খোদাতাআলা! যামানায় আমার চেয়ে বুযর্গ আর কেহ আছে কি? তদুত্তরে আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হাঁ, নিশ্চয়ই। সম্মুখে একটু গিয়াই দেখ। ইহা শুনিয়া ঈসা () সম্মুখের দিকে চলিতে লাগিলেন ..... তখন বৃদ্ধ বলিলেন, আমি এতদ্দেশীয় একজন লোক ছিলাম। আমার মাতার দোওয়ায় আল্লাহ তাআলা আমাকে এই বুযুর্গী দিয়াছেন। সুতরাং আজ ৪০০ বৎসর ধরিয়া আমি এই পাথরের ভিতরে বসিয়া খোদা তাআলার এবাদত করিতেছি এবং প্রত্যহ আমার আহারের জন্য খোদা তাআলা বেহেশত হইতে একটি ফল পাঠাইয়া থাকেন। ইহা শুনিয়া হযরত ঈসা (আঃ) ছেজদায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন। ... তখন আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হে ঈসা ()! জানিয়া রাখ যে, শেষ যমানার নবীর উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি শাবানের চাঁদের পনরই তারিখের রাত্রে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে সেদিন রোযা রাখিবে নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি আমার নিকট এই বৃদ্ধের চেয়েও বেশী বুযুর্গ এবং প্রিয় হইতে পারিবে। তখন ঈসা () কাঁদিয়া বলিলেন, হে খোদা তাআলা! তুমি আমাকে যদি নবী না করিয়া আখেরী যমানার নবীর উম্মত করিতে তাহা হইলে আমার কতই না সৌভাগ্য হইত! যেহেতু তাঁহার উম্মত হইয়া এক রাত্রিতে এত ছওয়াব কামাই করিতে পারিতাম। ... হাদীসে আছে, শাবানের চাঁদের চৌদ্দই তারিখের সূর্য অস্ত যাইবার সময় নিম্নলিখিত দোওয়া ৪০ বার পাঠ করিলে ৪০ বৎসরের ছগীরা গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে

لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ

... দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নামায পড়িবে ... সূরা ফাতেহার পর প্রত্যেক রাকাতেই সূরা এখলাছ দশবার করিয়া পাঠ করিবে এই নিয়মেই নামায শেষ করিবে। হাদীসে শরীফে আছে,- যাহারা এই নামায পড়িবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাহাদের চারিটি হাজত পুরা করিয়া দিবেন তাহাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন

তৎপর রাতে দুই দুই রাকাত করিয়া আরও চারি রাকাত নফল নামায পড়িবে। ... প্রত্যেক রাকাতে সূরা ক্বদর একবার সূরা এখলাছ পঁচিশবার পাঠ করিবে এবং এই নিয়মে নামায শেষ করিবে

হাদীস শরীফে আছে,- মাতৃগর্ভ হইতে লোক যেরূপ নিষ্পাপ হইয়া ভুমিষ্ট হয়, উল্লিখিত রাকাত নামায পড়িলেও সেইরূপ নিষ্পাপ হইয়া যাইবে। (মেশকাত) হাদীস শরীফে আছে,- যাহারা এই নামায পাঠ করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদের পঞ্চাশ বৎসরের গুনাহ মার্জনা করিয়ো দিবেন। (তিরমিজী) আরও হাদীসে আছে,- যাহারা উক্ত রাত্রে বা দিনে ১০০ হইতে ৩০০ মরতবা দরূদ শরীফ হযরত () এর উপর পাঠ করিবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাহাদের উপর দোজখ হারাম করিবেন। হযরত (দঃ) সুপারিশ করিয়া তাহাদিগকে বেহেশতে লইবেন। (সহীহ বোখারী) আর যাহারা উক্ত রাত্রিতে সূরা দোখান সাতবার সূরা ইয়াসীন তিনবার পাঠ করিবে, আল্লাহ তাহাদের তিনটি মকছুদ পুরা করিবেন। যথাঃ- () হায়াত বৃদ্ধি করিবেন। () রুজি-রেজক বৃদ্ধি করিবেন। () সমস্ত পাপ মার্জনা করেবেন।[20]

উপরের কথাগুলো সবই বানোয়াট। সবচেয়ে দুঃখজনক কথা যে, গ্রন্থকার এখানে মেশকাত, তিরমিযী বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন ভিত্তিহীন কিছু কথার জন্য, যে কথাগুলো গ্রন্থগুলো তো দূরের কথা কোনো হাদীসের গ্রন্থেই নেই। এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন সরলপ্রাণ বাঙালি পাঠক

[1] ইবনু মাজাহ, আস- সুনান /৪৪৪
[2]
ইবনু হাজার , তাক্বরীব, পৃ ৬৩২; তাহযীব, ১২/২৫-২৬
[3]
আল- বুসীরী, যাওয়ায়েদ ইবন মাজাহ, পৃষ্ঠা ২০৩
[4]
আলবানী, যায়ীফু সুনান ইবন মাজাহ, পৃ, ১০৬; যায়ীফাহ, /১৫৪
[5]
যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, /৩৮১-৩৮২; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান, /৩৯১
[6]
ইবনুল জাওযী, আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়া /৫৬২; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ফী তাময়ীযীস সাহাবা /৫৮০; তালখীস আল-হাবীর, /৬০৬
[7]
ইবনু মাজাহ, আস সুনান /৫৬৭; আল-বূসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ /৮৫
[8]
আল-মুনযিরী, তারগীব /৯৬; যাহাবী, মীযানুল তিদাল /৩৩৬; আলবানী, যায়ীফাহ /১২
[9]
ইবনু আর্রাক, তানযীহ্ /১২৬
[10]
সুয়ুতী, আল-জামে আস-সাগীর, /৬১০; দাইলামী, আল-ফিরদাউস, /১৯৬
[11]
আলবানী, যায়ীফুল জামে, পৃ ৪২০; যায়ীফাহ, /৬৪৯-৬৫০
[12]
ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন, /১০৫-১০৭; ইবনুআদী, আল-কামিল, /৩৫৩-৩৬৭; ইবনুল জাওযী, আদ-দুয়াফা /৫১; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, /১৮২-১৮৫; ইবনু হাজার, তাহযীব /১৩৭-১৩৯
[13]
শাফিয়ী, মুহাম্মাদ বিন ইদরীস, আল-উম্ম /২৩১; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা /৩১৯; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর /৬০৬
[14]
যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, /৭০; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান, /৬৪
[15]
আব্দুর রয্যাক, আল-মুসান্নাফ /৩১৭; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, /৩৪২
[16]
বুখারী, আততারীখুল কাবীর, /১৬৩; ইবনু আদী, আল-কামিল, /৩৮২-৩৮৬; ইবনুল জাওযী, আদ-দুআফা /৭৫; ইবনু হাজার, তাহযীব /১৩৫; /২৬১; তাক্বরীব, পৃ. ৪৯২
[17]
ইবনু হাজার, তাহযীব, /১৩৫; তাক্বরীব, পৃষ্ঠা ৩৩৭
[18]
মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ২৪০ আরো দেখুন: মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ২৬; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ৩০৯
[19]
মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ.২৩৫; মুফতী ছামদানী, বার চান্দ.. পৃ. ২৫
[20]
মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ২৩৬-২৪১

 . রামাদান মাস

রামাদান বা রমযান মাসের ফযীলত, ইবাদত, লাইলাতুল কাদরের গুরুত্ব, ইবাদত ইত্যাদি কুরআন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে এক্ষেত্রেও জালিয়াতগণ তাদের মেধা ব্যয় করেছেন। সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক জাল হাদীস তারা বানিয়েছেন। সহীহ হাদীসের মধ্যে কিছু জাল কথা ঢুকিয়েও তারা প্রচার করেছেন। যেহেতু মূল ফযীলত প্রমাণিত, সেহেতু সকল জাল হাদীসের বিস্তারিত আলোচনা করছি না। প্রচলিত কয়েকটি ভিত্তিহীন কথার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে রামাদান প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই

. আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি আযাব-মুক্তি

রামাদান, সিয়াম, সাহরী খাওয়া, ইফতার করা ইত্যাদির গুরুত্ব, মর্যাদা, সাওয়াব বরকতের বিষয়ে অগণিত সহীহ হাদীস রয়েছে। তা সত্ত্বেও এগুলোর বদলে অনেক আজগুবি বাতিল, ভিত্তিহীন জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিত। একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:

إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ نَظَرَ اللهُ إِلَى خَلْقِهِ الصُّيَّامِ، وَإِذَا نَظَرَ إِلَى عَبْدٍ لَمْ يُعَذِّبْهُ

‘‘যখন রমজান মাসের প্রথম রাত্রি উপস্থিত হয়, তখন আল্লাহ তাআলা মাখলুকাতের (তাঁর সিয়াম পালনকারী সৃষ্টির) প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করেন, আর আল্লাহ তাআলার রহমতের দৃষ্টি যাহার উপর পতিত হয়, সে কোন সময় শাস্তি ভোগ করিবে না।[1]

মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি জাল[2]

. সাহরীর ফযীলত সাহরী ত্যাগের পরিণাম

সাহরী খাওয়ার উৎসাহ প্রদান করে একাধিক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অন্তত এক চুমুক পানি পান করে হলেও সাহরী খেতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। সাহরীকে বরকতময় আহার বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ইহূদী খৃস্টানদের সিয়ামের সাথে আমাদের সিয়ামের পার্থক্য সাহরী

কিন্তু সকল সহীহ বা হাসান হাদীসের পাশাপাশি কিছু অতিরঞ্জিত বানোয়াট হাদীসও প্রচলিত হয়েছে। যেমন: ‘‘রাসূলুল্লাহ  ফরমাইয়াছেন .. ছেহেরীর আহারের প্রতি লোকমার পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা এক বৎসরের ইবাদতের সাওয়াব দান করিবেন।... যে সেহরী খাইয়া রোজা রাখিবে সে ইহূদীদের সংখ্যানুপাতে সাওয়াব লাভ করিবে।... তোমাদের মধ্য হইতে যে ব্যক্তি সেহরী খাওয়া হইতে বিরত থাকিবে, তাহার স্বভাব চরিত্র ইহূদীদের ন্যায় হইয়া যাইবে।...’[3]  সকল কথা সবই বানোয়াট কথা বলে প্রতীয়মান

. লাইলাতুল কাদ্র বনাম ২৭ রমযান

কুরআন-হাদীসেলাইলাতুল কাদরেরমর্যাদা ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ () ‘লাইলাতুল কাদ্রকে নির্দিষ্ট করে দেন নি। রামাদান মাসের শেষ দশ রাত এবং বিশেষ করে শেষ দশ রাতের মধ্যে বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কাদ্র সন্ধান করার নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবী-তাবিয়ীগণের কেউ কেউ ২৭ রামাদান লাইলাতুল কাদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ () থেকে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বর্ণিত হয় নি। কাজেই২৭ রমযানেরফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট বা বিকৃত

এরূপ কিছু বাতিল কথা: ‘‘হাদীসে আছে,- যে ব্যক্তি রমযানের ২৭ তারিখের রাত্রিতে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে। আল্লাহ তাআলা তাহার আমল নামায় এক হাজার বৎসরের এবাদতের ছওয়াব লিখিয়া দিবেন। আর বেহেশতে তাহার জন্য অসংখ্য ঘর নির্মাণ করাইবেন। ... আবূ বকর ছিদ্দীকের প্রশ্নের উত্তরে রাছূল  বলিয়াছিলেন: রমযানের ২৭ তারিখেই শবে কদর জানিও।...রমযান মাসের ২৭ তারিখের সূর্যাস্ত যাইবার সময় নিম্নলিখিত দোওয়া ৪০ বার পাঠ করলে ৪০ বৎসরের ছগীরা গুনাহ মার্জিত হইবে।[4]

অনুরূপ বানোয়াট কথা: ‘‘হযরত রাসূলুল্লাহ () এরশাদ করিয়াছেন, যেই ব্যক্তি রমজান মসের ২৭ তারিখের রজনীকে জীবিত রাখিবে, তাহার আমলনামায় আল্লাহ ২৭ হাজার বৎসরের ইবাদতের তুল্য সাওয়াব প্রদান করিবেন এবং বেহেশতের মধ্যে অসংখ্য মনোরম বালাখানা নির্মাণ করিবেন যাহার সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেহই অবগত নন[5]

. লাইলাতুল কাদ্রের গোসল

শবে বরাতের ন্যায় কাদ্রের রাত্রিতেও গোসল করার বিষয়ে জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিত। যেমন: ‘‘যাহারা শবে-ক্বদরের এবাদতের নিয়্যতে সন্ধ্যায় গোসল করিবে তাহাদের পা ধৌত করা শেষ না হইতেই পূর্বের পাপ মার্জিত হইয়া যাইবে।[6]

লাইলাতুল কাদ্র- গোসলের ফযীলতে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি। তবে যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () রামাদান মাসের শেষ ১০ রাতের প্রত্যেক রাতে মাগরিব ইশার সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে গোসল করতেন। এরূপ গোসলের ফযীলতে আর কোনো কিছু জানা যায় না[7]

. লাইলাতুল কাদ্রের সালাতের নিয়্যাত

আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, ‘নাওয়াইতু আন...’ বলে যত প্রকারের নিয়্যাত আছে সবই বানোয়াট। এখানে আরো লক্ষণীয় যে, আমাদের দেশে শবে বারাত, শবে কাদ্র ইত্যাদি রাতে বা কোনো মর্যাদাময় দিনে নফল সালাত আদায়ের জন্য বিভিন্ন বানোয়াট নিয়্যাত প্রচলিত আছে। কোনো নফল সালাতের জন্যই কোনো পৃথকনিয়্যাতনেই। লাইলাতুল কাদ্র বা যে কোনো রাতের সালাতের নিয়্যাত হবেসালাতুল লাইলবাকিয়ামুল্লাইল’-এর। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মুমিন দুই দুই রাকআত করে নফল সালাতের নিয়্যাত বা উদ্দেশ্য মনে নিয়ে যত রাকআত পারেন সালাত আদায় করবেন। যদি রাতটি সত্যই আল্লাহর কাছেলাইলাতুল কাদ্রবলে গণ্য হয় তাহলে বান্দা লাইলাতুল কাদ্রের সাওয়াব লাভ করবে। মুখেআমি লাইলাতুল কাদ্রের নামায পড়ছি...’ ইত্যাদি কথা বলা অর্থহীন ভিত্তিহীন

. লাইলাতুল কাদ্রের সালাতের পরিমাণ পদ্ধতি

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে লাইলাতুল কাদরেকিয়ামবাকিয়ামুল্লাইলকরতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কিয়ামুল্লাইল অর্থ রাত্রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নফল সালাত আদায় করা। এর জন্য কোনো বিশেষ রাকআত সংখ্যা, সূরা, আয়াত, দোয়া বা পদ্ধতি নেই। রাসুলুল্লাহ () নিজে সুদীর্ঘ কিরাআতে এবং সুদীর্ঘ রুকু সাজদার মাধ্যমে কিয়ামুল্লাইল করতেন। এজন্য সম্ভব হলে দীর্ঘ কিরাআত দীর্ঘ রুকু-সাজদা সহকারে সালাত আদায় করা উত্তম। না পারলে ছোট কিরাআতে রাকআত সংখ্যা বাড়াবেন। মুমিন তার নিজের সাধ্য অনুসারে সূরা, তাসবীহ, দোয়া ইত্যাদি পাঠ করবেন। প্রত্যেকে তার কর্ম অনুসারে সাওয়াব পাবেন

কাজেইলাইলাতুল কাদরের সালাতের রাকআত সংখ্যা, সূরার নাম, সালাতের পদ্ধতি, সালাতের মধ্যে বা পরে বিশেষ দোয়া ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় সবই মনগড়া এবং বাতিল কথা[8] অনেক প্রকারের মনগড়া কথাবাজারেপ্রচলিত। একটি মনগড়া পদ্ধতি তৎসংশ্লিষ্ট কিছু জাল হাদীস একটি প্রসিদ্ধ পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি

‘‘শবে-ক্বদরের নামাজ পড়িবার নিয়ম: এই রাত্রিতে পড়িবার জন্য নির্দিষ্ট ১২ রাকাত নফল নামায আছে। রাত্রিতে দুই রাকাত নফল নামায পড়িবে প্রথমে নিয়্যত করিবে, যথাঃ- ‘‘আমি আল্লাহর ওয়াস্তে ক্বেবলারোখ দাঁড়াইয়া শবে-ক্বদরের দুই রাকাত নামায পড়িতেছি’’ নিয়্যত তাকবীরে-তাহরীমা অন্তে-ছুবহানাকা, আউজুবিল্লাহ, বিছমিল্লাহ ছুরা ফাতেহারপর প্রত্যেক রাকাতেছুরা ক্বদরএকবার, ‘ছুরা এখলাছতিনবার পাঠ করিবে এবং এইরূপে নামায শেষ করিবে

হাদীছে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে সমস্ত শবে-ক্বদরের ছওয়াব বখশিশ করিবেন এবং হযরত ইদ্রীস, হযরত শোয়াইব, হযরত আইয়ুব, হযরত ইউছুফ, হযরত দাউদ হযরত নূহ আলাইহিচ্ছালাম এর সমস্ত পুণ্যের ছওয়াব তাহাদের আমলনামায় লিখিয়া দিবেন তাহাদের দোওয়া মকবুল হইবে এবং তাহাদিগকে বেহেশতের মধ্যে এই পৃথিবীর সমতুল্য একটি শহর দান করিবেন

অতঃপর দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নফল নামায পড়িবে। প্রথমতঃ নিয়্যত করিবে। নিয়্যত তাকবীরের তাহরীমা পাঠান্তে প্রত্যেক রাকাতেছুরা ফাতেহারপরছুরা ক্বদরএকবার ছুরা এখলাছ২৭ বার পড়িবে। ইহাও খেয়াল রাখিবে যে, প্রথমতঃ নিয়্যত করিয়া প্রথম রাকাতেছুরা ফাতেহারপূর্বে ছুবহানাকা, আউজুবিল্লাহ, বিছমিল্লাহ পড়িতে হয়। কিন্তু তৎপর যত রাকাতই হউক না কেন প্রত্যেক রাকাতে ছুরা ফাতেহার পূর্বে কেবল মাত্র বিছমিল্লাহ পড়িতে হইবে এবং উল্লিখিত নিয়মেই পড়িয়া নামায শেষ করিবে

হাদীসে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে এইরূপ নিষ্পাপ করিয়া দিবেন, যেমন অদ্যই মাতৃগর্ভ হইতে ভুমিষ্ঠ হইয়াছে। আর বেহেশতে তাহাদের জন্য হাজার বালাখানা তৈয়ার হইবে। - (মেশকাত) তৎপর দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নামায পড়িবে। প্রথমতঃ নিয়্যত করিবে, নিয়্যত তাকবীরে-তাহরীমার পাঠান্তে ছোবহানাকা, আউজুবিল্লাহ, বিছমিল্লাহ ছুরা ফাতেহার পরে প্রত্যেক রাকাতে, ছুরা ক্বদর তিনবার ছূরা এখলাছ ৫০ বার পড়িবে এবং এইরূপে নামায শেষ করিয়া ছেজদায় গিয়া দোওয়া একবার পড়িবে- যাহা সূর্যাস্ত যাইবার কালে পড়িবার জন্য লিখা হইয়াছে। হাদীছে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাহাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন তাহাদের দোওয়া খোদা তাআলার দরবারে মকবুল হইবে।[9]

এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা।মেশকাততো দূরের কথা কোনো হাদীস-গ্রন্থেই সকল কথা পাওয়া যায় না

. লাইলাতুল কাদ্রের কারণে কদর বৃদ্ধি

আমাদের দেশে প্রচলিত একটি পুস্তকে নিম্নের হাদীসটি লিখা হয়েছে:

مَنْ أَدْرَكَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ رَفَعَ اللهُ قَدْرَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

‘‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কাদ্র পাবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার কদর বা মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন।[10] কথাটি ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান হয়

. জুমুআতুল বিদা বিষয়ক জাল কথা

সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, জুমুআর দিনসাইয়েদুল আইয়ামবা সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। সূর্যের নিচে এর চেয়ে উত্তম দিবস আর নেই[11] অনুরূপভাবেরামাদানশ্রেষ্ঠ মাস[12] কাজেই রামাদান মাসের জুমু্আর দিনটির মর্যাদা সহজেই অনুমেয়। মুমিন স্বভাবতই প্রত্যেক জুমুআর দিনে সুন্নাত সম্মত নেক আমলগুলি বেশি বেশি পালনের চেষ্টা করেন। একইভাবে রামাদানের প্রত্যেক দিনেই মুমিন সাধ্যমত নেক কর্মের চেষ্টা করেন। আর রামাদানের জুমুআর দিনে উভয় প্রকারের চেষ্টা একত্রিত হয়। রামাদান মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফযীলত পূর্ণ দিন হলো শেষ দশ দিন। ছাড়া রামাদানের শেষে রামাদান চলে যাচ্ছে বলে মুমিনের কিছু অতিরিক্ত আগ্রহ বাড়াই স্বাভাবিক

ছাড়া রামাদান মাসের শেষ জুমুআর বা অন্য কোনো জুমাআর দিনের কোনো বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস বর্নিত হয় নি। তবে জালিয়াতগণ রামাদানের শেষ জুমুআর দিনের বাবিদায়ী জুমুআরবিশেষ কিছু ফযীলত বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দিনে কাযা সালাত বা উমরী কাযা আদায়ের ফযীলত দিনের বিশেষ দোয়া বিষয়ক কিছু জাল বানোয়াট কথা। যেমন:

مَنْ قَضَى صَلاَةً مِنَ الْفَرَائِضِ (الْخَمْسَ الصَّلَوَاتِ الْمَفْرُوْضَةَ) فِيْ آَخِرِ جُمُعَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ كَانَ ذَلِكَ جَابِراً لِكُلِّ صَلاَةٍ فَاتَتْهُ فِيْ عُمُرِهِ إِلَى سَبْعِيْنَ سَنَةً

‘‘যদি কোনো ব্যক্তি রামাদান মাসের শেষ জুমুআর দিনে এক ওয়াক্ত (অন্য জাল বর্ণনায় ওয়াক্ত) কাযা সালাত আদায় করে তবে ৭০ বৎসর পর্যন্ত তার সকল কাযা সালাতের ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে।’’

মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি জাল মিথ্যা কথা[13]

বাহ্যত জাল হাদীসটির প্রচলন ঘটেছে বেশ দেরি করে। ফলে ৬ষ্ঠ-৭ম শতাব্দীতে যারা জাল হাদীস সংকলন করেছেন তারা তা উল্লেখ করেন নি। ১০ হিজরী শতক থেকে মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি) অন্যান্য মুহাদ্দিস এর জালিয়াতির বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। আল্লামা শাওকানী (১২৫০হি) বলেন: ‘‘ কথাটি যে বাতিল তাতে কেনো সন্দেহ নেই। আমি কোনো মাউদূ হাদীসের গ্রন্থেও হাদীসটি পাই নি। কিন্তু আমাদের যুগে আমাদের সানআ (ইয়ামানের রাজধানী) শহরে অনেক ফকীহ ফিক্হ অধ্যয়নকারীর মধ্যে তা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এদের অনেকেই এর উপর আমল করে। জানি না কে জাল কথাটি বানিয়েছে। আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের অপমানিত করুন।[14]

কোনো কোনো আলিম জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে জাল ভিত্তিহীন কথাটি তাদের গ্রন্থে লিখেছেন। ৭ম-৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা হুসামুদ্দীন হুসাইন ইবনু আলী সাগনাকী (৭১০ হি) হেদায়া’- ব্যাখ্যাআন-নিহায়াগ্রন্থে কথাটিকেহাদীসহিসেবে উল্লেখ করছেন।আন-নিহায়াহেদায়ার অন্যতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ। পরবর্তী ব্যাখ্যাকারগণ গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছেন। ফলে হেদায়ার পরবর্তী অনেক ব্যাখ্যাকার জাল কথাটিহাদীসহিসেবে লিখেছেন। অনেক সময় বড় আলিমদের প্রতি মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা তাদের সকল কথা নির্বিচারে গ্রহণ করার প্রবণতা তৈরি করে। তাঁদের গ্রন্থে হাদীস উদ্ধৃত থাকাতে অনেক সাধারণ মানুষ জাল কথাটিকে সঠিক বলে মনে করতে পারেন; এজন্য মোল্লা আলী কারী বলেন:

بَاطِلٌ قَطْعاً لأَنَّهُ مُنَاقِضٌ لِلإِجْمَاعِ عَلَى أَنَّ شَيْئًا مِنَ الْعِبَادَاتِ لاَ يَقُوْمُ مَقَامَ فَائِتَةِ سَنَوَاتٍ ثُمَّ لاَ عِبْرَةَ بِنَقْلِ النِّهَايَةِ وَلاَ شُرَّاحِ الْهِدَايَةِ فَإِنَّهُمْ لَيْسُوْا مِنَ الْمُحَدِّثِيْنَ وَلاَ أَسْنَدُوْا الْحَدِيْثَ إِلَى أَحَدٍ مِنَ الْمُخَرِّجِيْنَ

‘‘ কথাটি নিঃসন্দেহে বাতিল। কারণ কথাটি মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যের বিরোধী। মুসলিম উম্মাহ একমত যে, কোনো একটি ইবাদত কখনোই অনেক বছরের পরিত্যক্ত ইবাদতের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না বা ক্ষতিপূরণ করতে পারে না। এরপরনেহায়া’- রচয়িতা এবং হেদায়ার অন্যান্য ব্যাখ্যাকারের উদ্ধৃতির কোনো মূল্য নেই; কারণ তাঁরা মুহাদ্দিস ছিলেন না এবং তারা কোনো হাদীস গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েও হাদীসটি উল্লেখ করেন নি।[15]

আল্লামা কারী হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র আঙিনাকে মিথ্যার নাপাকি থেকে পবিত্র রাখা বিষয়ে তিনি আপোষহীন। মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আলিমদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ভালবাসা তাঁকে আপোষের পথে পরিচালিত করতে পারি নি। অনেক আপোষকামী আলিমের মত তিনি বলতে পারতেন: হয়ত কোনো হাদীসের বইয়ে হাদীসটি ছিল... এত বড় আলিম যখন বলেছেন, হয়ত এর কোনো সূত্র ছিল। এরূপ বিভিন্ন ‘‘হয়ত’’ দিয়ে তিনি কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। কারণ, আলিমদের ভুল হতে পারে এবং তা স্বীকার করার মধ্যে কোনো অবমাননা বা অভক্তি নেই। কিন্তু কোনো হাদীসের সনদ নেই জানার পরেও তার জন্য অযুহাত খোঁজা জালিয়াতির মহাপাপের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। আর এজন্যই মোল্লা আলী কারীর কথার টীকায় বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হানাফী ফকীহ আল্লামা আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ বলেন:

أَحْسَنْتَ، أَحْسَنْتَ، جَزَاكَ اللهُ خَيْراً عَنْ حَدِيْثِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ

‘‘অত্যন্ত ভাল কথা বলেছেন! অত্যন্ত ভাল কথা বলেছেন!! রাসূলুল্লাহর  হাদীসে পক্ষ থেকে আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।[16]

. প্রচলিত কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তার নমুনা

ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, আমাদের দেশে প্রচলিত পুস্তকাদিতে অনেক সময় লেখকগণ সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে যয়ীফ জাল হাদীসের উপর নির্ভর করা ছাড়াও বিশুদ্ধ অশুদ্ধকে একসাথে এমনভাবে সংমিশ্রণ করেন যে, পূরা কথাটি রাসূলুল্লাহর () নামে মিথ্যায় পরিণত হয়। হাদীস-গ্রন্থের উদ্ধৃতিও অনেক সময় মনগড়াভাবে দেয়া হয়। একটি পুস্তকে বলা হয়েছে:

‘‘হযরত () বলিয়াছেন, যাহারা শবে-ক্বদরে বন্দেগী করিবে তাহারা শত বৎসরের নেকীর ছওয়াব পাইবে। হযরত () আরও বলিয়াছেন, যাহারা শবে-ক্বদরে এবাদত করিয়াছে দোজখের আগুন তাহাদের উপর হারাম হইবে। আর একটি হাদীসে আছে- যদি তোমরা তোমাদের গোরকে আলোকময় পাইতে চাও, তবে শবে-ক্বদরে জাগরিত থাকিয়া এবাদত কর। আরও হাদীসে আছে- যাহারা শবে-ক্বদরে জাগিয়া এবাদত করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদের ছগীরা, কবীরা সমস্ত পাপই মার্জনা করিবেন কেয়ামতের দিন তাহাদিগকে কিছুতেই নিরাশ করিবেন না। আর একটি হাদীসে আছে,- যে ব্যক্তি শবে-ক্বদর পাইবে নিশ্চয়ই আমি তাহাকে বেহেশতে লইবার জন্য জামিন হইব। .....’’

‘‘হাদীসে আছে: একদিন হযরত মূছা () আল্লাহ তায়ালাকে প্রশ্ন করিলেন, হে আল্লাহ তায়ালা তুমি উম্মতে মোহাম্মদীকে উৎকৃষ্ট কোন জিনিস দান করিয়াছ? তদুত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলিলেন, আমি হযরত মোহাম্মদ ()-এর উম্মতকে উৎকৃষ্ট রমযান মাস দান করিয়াছি। মুছা () বলিলেন, প্রভু, সেই মাসের কি ফযীলত মরতবা তাহা আমাকে শুনাও। তখন আল্লাহ তায়ালা বলিলেন, হে মূছা! রমযান মাসের ফযীলত মরতবার কথা কতই শুনাইব তবে সামান্য এতটুকুতেই বুঝিতে পারিবে যে, উহার মর্যাদা কি পরিমাণ! তোমাদের সাধারণের মধ্যে আমার মর্যাদা সম্মান যেরূপ অতুলনীয়, অন্যান্য মাস হইতে রমযান মাসের মর্যাদাও তেমনি অতুলনীয় জানিবে। (তিরমিযি)’’ ....হযরত () বলেছেন, যাহারা নিজের পরিবার পরিজনসহ সন্তোষের সহিত রমজান মাসের ৩০টি রোযা রাখিয়াছে, হালাল জিনিস দ্বারা ইফতার করিয়াছে, আল্লাহ তায়ালা তাহাদিগকে প্রকার ছওয়াব দিবেন, যেমন তাহারা মক্কা শরীফে মদীনা শরীফে রোযা রাখিয়াছে। হাদীসে আছে, যাহারা উক্ত স্থানসমূহে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তায়ালা তাহাদের ৭০ হাজার হজ্জ্বের, ৭০ হাজার ওমরার ৭০ হাজার রমযান মাসের ছওয়াব দিবেন পৃথিবীতে যত ঈমানদার বান্দা আছেন, সমস্তের নেকীর ছওয়াব দিবেন আর পরিমান পাপও তাহাদের আমলনামা হইতে কাটিয়া দিবেন। আর সপ্ত-আকাশে যত ফেরেস্তা আছে, তাহাদের সমস্তের পূণ্যের ছওয়াব তাহাদের আমলনামায় লিখিয়া দিবেন। (তিরমিজী)’[17]

সকল কথা এভাবে সুনান তিরমিযী তো দূরের কথা, অন্য কোনো হাদীস গ্রন্থে সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে জানতে পারি নি। শুধুমাত্র মক্কা মুকাররামায় রামাদান পালনের বিষয়ে দু একটি যয়ীফ বানোয়াট হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবত গ্রন্থকার এখানে ইবনু মাজাহ সংকলিত নিম্নের হাদীসটিরইচ্ছামতঅনুবাদ করেছেন:

ইবনু মাজাহ বলেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু আবী উমার বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল-আম্মী বলেছেন, তার পিতা থেকে, সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে, ইবনু আববাস থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেন:

مَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ بِمَكَّةَ فَصَامَ وَقَامَ مِنْهُ مَا تَيَسَّرَ لَهُ كَتَبَ اللَّهُ لَهُ مِائَةَ أَلْفِ شَهْرِ رَمَضَانَ فِيمَا سِوَاهَا وَكَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ عِتْقَ رَقَبَةٍ وَكُلِّ لَيْلَةٍ عِتْقَ رَقَبَةٍ وَكُلِّ يَوْمٍ حُمْلَانَ فَرَسٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَفِي كُلِّ يَوْمٍ حَسَنَةً وَفِي كُلِّ لَيْلَةٍ حَسَنَةً

‘‘যে ব্যক্তি মক্কায় রামাদান মাস পাবে, সিয়াম পালন করবে এবং যতটুকু তার জন্য সহজসাধ্য হবে ততটুকু কিয়ামুল্লাইল পালন করবে, আল্লাহ তার জন্য অন্যত্র এক লক্ষ রামাদান মাসের সাওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। এবং আল্লাহ তার জন্য প্রতি দিবসের পরিবর্তে একটি দাসমুক্তি এবং প্রতি রাতের পরিবর্তে একটি দাসমুক্তি, এবং প্রতি দিনের জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য ঘোড়াসাওয়ার পাঠানো এবং প্রতি দিনের জন্য একটি নেকি এবং প্রতি রাতের জন্য একটি নেকি লিপিবদ্ধ করবেন।[18]

হাদীসটি একমাত্র আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল-আম্মী (১৮৪ হি) নামক ব্যক্তি ছাড়া কেউ বর্ণনা করে নি। আব্দুর রাহীম একজন মিথ্যাবাদী জালিয়াত রাবী বলে প্রসিদ্ধ। ইমাম বুখারী, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী, জালিয়াত পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন[19]

[1] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ২৯-৩০
[2]
ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত /১০৪; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূআত, পৃ. ১৭৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী /১০০-১০১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৪৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /১২১
[3]
মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দে ফযীলত, পৃ. ৩৩-৩৪
[4]
মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ২৪৫-২৪৮
[5]
মুফতী ছামদানী, বার চান্দে ফযীলত, পৃ. ৩৯; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা, নেক কানুন, পৃ. ৩১৫
[6]
গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ ২৪৮; দুলাল, নেক কানুন , পৃ. ৩১৬
[7]
ইবনু রাজাব, লাতাইফ /৩০৯, ৩১৩-৩১৫
[8]
আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১১৫
[9]
মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ ২৪৮
[10]
প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৩
[11]
মুসলিম, আস-সহীহ /৫৮৯; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ /১১৫; ১১৮; ইবনু হিববান, আস-সহীহ /১৯১; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৪১২-৪১৩; মুনযিরী, তারগীব /২৭৭-২৮৫
[12]
বাইহাকী, শুআবুল ঈমান /৩১৪, ৩৫৫; হাইসামাী, মাজমাউয যাওয়াইদ /১৪০
[13]
মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৪২; আল-মাসনূ, পৃ. ১৫৬-১৫৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ, /৭৯; আজলূনী, কাশফুল খাফা /৩৫৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৮৫; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২২৫
[14]
শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৭৯
[15]
মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৪২; আল-মাসনূ, পৃ. ১৫৬-১৫৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৮৫
[16]
আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ, মোল্লা আলী কারীর আল-মাসনূ গ্রন্থের টীকা, ১৫৭ পৃ.
[17]
মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ২৭৪-২৪৫
[18]
ইবনু মাজাহ, আস-সুনান /১০৪১
[19]
ইবনু মাজাহ, আস-সুনান /১০৪১; বুসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ /২১৭; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান /৩৪৭, ৩৮৭; যাহাবী, মীযানুল তিদাল /৩৩৬-৩৩৭; ইবনু হাজার, তাহযীব /২৭৩; তাকরীব, পৃ. ৩৫৪; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৭৭৬; যায়ীফাহ /২৩২

 ১০. শাওয়াল মাস

() সহীহ হাদীসের আলোকে শাওয়াল মাস

শাওয়াল মাস হজ্জের মাসগুলোর প্রথম মাস। মাস থেকে হজ্জের কার্যক্রম শুরু হয়। এছাড়া সহীহ হাদীস দ্বারা মাসের একটি ফযীলত প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ  বলেন:

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ

‘‘যে ব্যক্তি রামাদান মাসের সিয়াম পালন করবে। এরপর সে শাওয়াল মাসে ৬টি সিয়াম পালন করবে, তার সারা বছর সিয়াম পালনের মত হবে।[1]

কোনো কোনো যয়ীফ হাদীসে পুরো শাওয়াল মাস সিয়াম পালনের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। একটি যয়ীফ হাদীসে বলা হয়েছে: ‘‘যে ব্যক্তি রামাদান এবং শাওয়াল মাস এবং (সপ্তাহে) বুধবার বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[2]

ছাড়া শাওয়াল মাসের আর কোনো ফযীলত প্রমাণিত নয়। মুমিন মাসে তার তাহাজ্জুদ, চাশত, যিক্র ওযীফা ইত্যাদি সাধারণ ইবাদত নিয়মিত পালন করবেন। সাপ্তাহিক মাসিক নফল সিয়াম নিয়মিত পালন করবেন। অতিরিক্ত এই ছয়টি সিয়াম পালন করবেন। এছাড়া মাসের জন্য বিশেষ সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া, দান বা অন্য কোনো নেক আমল, অথবা মাসে কোনো নেক আমল করলে বিশেষ সাওয়াবের বিষয়ে যা কিছু প্রচলিত বা কথিত সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। এগুলোর অনেক কথা সাধারণভাবে শাওয়াল মাসের ফযীলত ছয় রোযার বিষয়ে বানানো হয়েছে। আর কিছু কথা শাওয়াল মাসের প্রথম দিন বা ঈদুল ফিতরের দিনের বিশেষ নামায বা আমলের বিষয়ে বানানো হয়েছে

() শাওয়াল মাস বিষয়ক কিছু জাল হাদীস

. রোযা অন্যান্য ফযীলত

সকল বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ () ফরমাইয়াছেন : যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসে নিজেকে গুনাহের কার্য হইতে বিরত রাখিতে সক্ষম হইবে আল্লাহ তাআলা তাহাকে বেহেশতের মধ্যে মনোরম বালাখানা দান করিবেন। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলুল্লাহ () এরশাদ করিয়াছেন, যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসের প্রথম রাত্রিতে বা দিনে দুই রাকয়াতের নিয়তে চার রাকয়াত নামায আদায় করিবে এবং উহার প্রতি রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পর ২১ বার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিবে; করুণাময় আল্লাহ তাআলা তাহার জন্য জাহান্নামের ৭টি দরজা বন্ধ করিয়া দিবেন এবং জান্নাতের ৮টি দরজা উন্মুক্ত করিয়া দিবেন। আর মৃত্যুর পূর্বে সে তাহার বেহেশতের নির্দিষ্ট স্থান দর্শন করিয়া লইবে।... অন্য আর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ () ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে মৃত্যুবরণ করিবে সে ব্যক্তি শহীদানের মর্যাদায় ভূষিত হইবে।...’[3]

সবই হাদীসের নামে কথিত বানোয়াট ভিত্তিহীন কথা

শাওয়াল মাসে ৬টি সিয়ামের ফযীলত সহীহ হাদীসের আলোকে আমরা জেনেছি। বিষয়ে অতিরঞ্জিত অনেক জাল কথাও প্রচলন করা হয়েছে। যেমন: ‘‘হযরত রাসূলুল্লাহ () ফরমাইয়াছেন, যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখিবে, আল্লাহ তায়ালা তাহাকে শাস্তির শৃংখল কঠোর জিঞ্জিরের আবেষ্টনী হইতে নাজাত দিবেন.. অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলুল্লাহ () ফরমাইয়াছেন, যেই ব্যক্তি শাউয়াল মাসের ৬টি রোজা রাখিবে, তাহার আমলনামায় প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে সহস্র রোজার সাওয়াব লিখা হইবে।’’... ‘‘রাসূল () বলেছেন, ...যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে রোজা রাখেন আল্লাহ পাক তার জন্য দোজখের আগুন হারাম করে দেন।...যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখে, আল্লা-তায়ালা তার আমল নামায় সমস্ত মুহাম্মদী নেককার লোকের সাওয়াব লিখেন এবং সে হযরত সিদ্দিক আকবার (রা)-এর সঙ্গে বেহেস্তে স্থান পাবে।...যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে রোজা রাখে আল্লাহ তায়ালা তাকে লাল-ইয়াকুত পাথরের বাড়ী দান করবেন এবং প্রত্যেক বাড়ীর সম্মুখে দুধ মধুর নহর প্রবাহিত হতে থাকবে। ফেরেশতারা তাকে আসমান হতে ডেকে বলবেন, হে আল্লাহর খাস-বান্দা, আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন। শাওয়াল মাসে লূতের () কওম ধ্বংস হয়েছিল, নূহের ()কওম ডুবেছিল, হুদের () কওম ধ্বংস হয়েছিল....’[4]

এরূপ অসংখ্য মিথ্যা কথা দুঃসাহসের সাথে নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বলা হয়েছে। আমাদের সম্মানিত লেখকগণ একটুও চিন্তা যাচাই না করেই সেগুলো তাঁদের পুস্তকে লিখেন। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন

. ঈদুল ফিতরের দিনের বা রাতের বিশেষ সালাত

শাওয়ালের ১ম তারিখ ঈদুল ফিতর। একাধিক যয়ীফ হাদীসে ঈদুল ফিতরের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ইবাদতের কোনো নির্ধারিত পদ্ধতি, রাকআত, সূরা ইত্যাদি বলা হয় নি। ঈদের দিনে সালাতুল ঈদ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ নফল সালাতের কোনো নির্দেশনা কোনো সহীহ হাদীসে নেই

অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় বিষয়েও জালিয়াতগণ বিষয়ে কিছু হাদীস রচনা করেছে। শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখের দিনের বা রাতের রাকআত সালাত বিষয়ক একটি জাল হাদীস পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। বিষয়ক আরো একটি প্রচলিত জাল হাদীস উল্লেখ করছি: ‘‘যিনি আমাকে নবীরূপে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, জিবরাঈল আমাকে ঈসরাফীলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের রাত্রে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকআতে বার সূরা ফাতিহা এবং ১১ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, এরপর রুকতে এবং সাজদায় ... অমুক দোয়া ১০ বার পাঠ করবে, এরপর সালাত শেষে ১০০ বার ইসতিগফার পাঠ করবে। এরপর সাজদায় যেয়ে বলবে.... যদি কেউ এইরূপ করে তাহলে সাজদা থেকে ওঠার আগেই তার পাপ ক্ষমা করা হবে, রামাদানের সিয়াম কবুল করা হবে.... ইত্যাদি ইত্যাদি।[5]

. ঈদুল ফিতরের পরে রাকআত সালাত

ঈদুল ফিতরের দিনে কোনো বিশেষ সালাতের বিশেষ সাওয়াব বা বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু জালিয়াতগণ সালাতুল ঈদ আদায়ের পরে রাকআত সালাতের বিশেষ ফযীলতের কাল্পনিক কাহিনী বানিয়েছে। যেমন: ‘‘যদি কেউ সালাতুল ঈদ আদায় করার পরে রাকআত সালাত আদায় করে, প্রত্যেক রাকাআতে অমুক অমুক সূরা পাঠ করে, তবে সে যেন আল্লাহর নাযিল করা সকল কিতাব পাঠ করল, সকল এতিমকে পেটভরে খাওয়াল, তেল মাখালো, পরিষ্কার করল। তার ৫০ বছরের পাপ ক্ষমা করা হবে, তাকে এত এত পুরস্কার দেওয়া হবে...[6]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /৮২২
[2]
আহমাদ, আল-মুসনদা /৪১৬; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /১৯০; ইবনু রাজাব, লাতাইফ /৩৬০-৩৬১
[3]
মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, ৩৯; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, ৩১৯-৩২০
[4]
মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, ৪২-৪৩; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, ৩২০
[5]
ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূআত /৫২; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূআত, পৃ. ১৬৩; সুয়ূতী, আল-লাআলী /৬০-৬১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /৯৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৭৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৪৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, ৮৬
[6]
ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূআত /৫৩-৫৪; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূআত, পৃ. ১৬৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী /৬১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /৯৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৭৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৪৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, ৮৭

 ১১. যুলকাদ মাস

যুলকাদা মাসের সাধারণ দুটি মর্যাদা রয়েছে: () তা ৪টি হারাম মাসের একটি এবং () তা হজ্জের মাসগুলির দ্বিতীয় মাস। ছাড়া মাসের বিশেষ কোনো ফযীলত হাদীসে বর্ণিত হয় নি। তবে জালিয়াতগণ বিষয়ে কিছু মিথ্যা বানোয়াট কথা প্রচার করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:

‘‘রাসূলুল্লাহ () ফরমান, তোমরা যিলক্বদ মাসকে সম্মান করিবে, যেহেতু ইহা মর্যাদাবান মাসসমূহের মধ্যে প্রথম মাস। ... যেই ব্যক্তি যিলক্বদ মাসের ভিতরে একদিন রোজা রাখিবে, আল্লাহ তাআলা উহার প্রতি ঘন্টার পরিবর্তে একটি হজ্জের সাওয়াব তাহাকে দান করিবেন।... যেই ব্যক্তি এই মাসের যে কোন জুমুয়ার দিবসে দুই দুই রাকয়া'তের নিয়তে চার রাকয়া নামায আদায় করিবে, যাহার প্রতি রাকয়া'তে সূরা ফাতিহার পরে ১০ বার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাকে একটি হজ্জ একটি ওমরার সাওয়াব দান করিবেন। ... যেই ব্যক্তি যিলক্বদ মাসের প্রত্যেক রজনীতে দুই রাকয়া করিয়া নামায আদায় করিবে এবং ইহার প্রতি রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাছ তিনবার করিয়া পাঠ করিবে, আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তির আমলনামায় একজন হাজী একজন শহীদের পূণ্যের তুল্য সাওয়াব দান করিবেন এবং রোজ কেয়ামতে সেই ব্যক্তি আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করিবে।...’’ ‘‘... এই মাসের রোজাদারের প্রত্যেক নিঃশ্বাসে একটি গোলাম আজাদ করবার সাওয়াব প্রদান করেন। ... এই মাসকে গনীমত মনে করবে। যেহেতু যে ব্যক্তি এই মাসে একদিন এবাদত করে উহা হাজার বৎসর হতেও উৎকৃষ্ঠ। ... যিলক্বদ মাসের সোমবারের রোজা হাজার বৎসরের এবাদত হতেও উৎকৃষ্ঠ। ... এই চাঁদে যে একদিন রোজা রাখবে, আল্লাহ পাক তার জন্য প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে এক একটি মকবুল হজ্জের সাওয়াব দান করবেন। ... ইত্যাদি ইত্যাদি....[1]

এগুলো সবই দুঃসাহসিক নির্লজ্জ জালিয়াতগণের কথা। তারা এগুলো রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বানিয়ে প্রচার করেছে এবং জাহান্নামে নিজেদের আবাসস্থল তৈরি করেছে। দুঃখজনক হলো, অনেক আলিম বা লেখক যাচাই না করেই সমস্ত আজগুবি মিথ্যা কথাকে রাসূলুল্লাহ ()-এর হাদীস বলে উল্লেখ করছেন। অন্তত কোন্ গ্রন্থে হাদীসটি সংকলিত তা যাচাই করলেও এগুলোর জালিয়াতি ধরা পড়ে যেত। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন

[1] মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, ৪৪-৪৫; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, ৩২১-৩২২

 ১২. যুলহাজ্জ মাস

 

() সহীহ হাদীসের আলোকে যুলহাজ্জ মাস

যুলহাজ্জ বা যিলহাজ্জ মাস ৪টি হারাম মাসের অন্যতম। মাসেই হজ্জ আদায় করা হয় এবং মাসেই ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়। মাসের প্রথম ১০ দিনে বেশি বেশি নেক কর্ম করতে সহীহ হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ () এরশাদ করেন: ‘‘যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করা আল্লাহর কাছে যত বেশি প্রিয় আর কোনো দিনের আমল তাঁর কাছে তত প্রিয় নয়।[1] যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, দশ দিনের প্রতি দিনের সিয়াম এক বছরের সিয়ামের তুল্য এবং প্রত্যেক রাত লাইলাতুল কাদ্রের তুল্য[2] অন্য একটি দুর্বল হাদীসে বলা হয়েছে, দশ দিনের নেক আমলের ৭০০ গুণ সাওয়াব প্রদান করা হয়[3] অন্য একটি যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেছেন, কথিত আছে যে, যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন এক হাজার দিনের সমান এবং বিশেষত আরাফার দিন ১০ হাজার দিনের সমান[4]

যুলহাজ্জ হাজীগণ আরাফার মাঠে অবস্থান করেন। যারা হজ্জ করছেন না তাদের জন্য দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। আরাফাত দিবস বা যুলহাজ্জের সিয়ামের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ  বলেন, ‘‘তা বিগত বছর পরবর্তী বছরের পাপ মার্জনা করে।[5]

() যুলহাজ্জ মাস বিষয়ক কিছু বানোয়াট কথা

সকল সহীহ যয়ীফ হাদীসের পাশাপাশি এই মাসের ফযীলতে অনেক জাল হাদীস সমাজে প্রচালিত রয়েছে। সকল জাল হাদীসে মাসের জন্য বিশেষ বিশেষ সালাত সিয়ামের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া মাসের ১ম দশ দিনের ফযীলতের বিষয়েও অনেক জাল কথা তারা বানিয়েছে

. যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দিন

যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের অংশ হিসেবে দিনটির ফযীলত রয়েছে। কিন্তু জালিয়াতগণ অন্য ফযীলত প্রচার করেছে:

وُلِدَ إِبْرَاهِيْمُ فِيْ أَوَّلِ يَوْمٍ مِنْ ذِيْ الْحِجَّةِ فَصَوْمُ ذَلِكَ الْيَوْمِ كَصَوْمِ سَبْعِيْنَ سَنَةً (فَمَنْ صَامَ ذَلِكَ الْيَوْمَ كَانَ كَفَّارَةَ ثَمَانِيْنَ سَنَةً)

‘‘যুলহাজ্জ মাসের প্রথম তারিখে ইবরাহীম () জন্মগ্রহণ করেন। কাজেই যে ব্যক্তি দিনে সিয়াম পালন করবে সে ৭০ বছর সিয়াম পালনের সাওয়াব পাবে... তার ৮০ বছরের পাপের মার্জনা হবে...[6]

. যুলহাজ্জ মাসের তারিখ, ইয়াওমুত তারবিয়া

যুলহাজ্জ মাসের তারিখকেইয়াওমুত তারবিয়াবলা হয়। দিনে হজ্জের কার্যক্রম শুরু হয়। হাজীগণ দিনে হজ্জের জন্য মক্কা থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। হাজী ছাড়া অন্যদের জন্য দিনের বিশেষ কোনো আমল নেই। যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের অংশ হিসেবে এর মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু জালিয়াতগণ তারিখের দিনের রাতের জন্য বিশেষ সালাত সিয়ামের কাহিনী রচনা করেছে। ইতোপূর্বে শবে বরাত বিষয়ক জাল হাদীস আলোচনার সময়তারবিয়াররাত বা যুলহাজ্জ মাসের তারিখের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকার বিষয়ে কয়েকটি জাল বা অত্যন্ত দুর্বল হাদীস আমরা দেখতে পেয়েছি। আরেকটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:

مَنْ صَامَ يَوْمَ التَّرْوِيَةِ أَعْطَاهُ اللهُ مِثْلَ ثَوَابِ أَيُّوْبَ عَلَى بَلاَئِهِ

‘‘যে ব্যক্তি তারবিয়ার দিনে (যিলহাজ্জের তারিখে) সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তাকে সে পরিমাণ সাওয়াব প্রদান করবেন, যে পরিমাণ সাওয়াব আইয়ূব () তার বালা-মুসিবতের কারণে লাভ করেছিলেন।[7]

. যুলহাজ্জ মাসের তারিখ: আরাফার দিন

আরাফার দিনে সিয়াম পালনের ফযীলত আমরা জানতে পেরেছি। হাজীগণ ব্যতীত অন্য মুসলিমের জন্য তারিখের দিনে বা রাতে আর কোনো বিশেষ সালাত, দোয়া, যিকির বা অন্য কোনো নেক আমলের নির্ধারিত বিধান বা পদ্ধতি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। জালিয়াতগণ দিনের সালাত, যিক্র, দোয়া ইত্যাদির বিষয়েও অনেক জাল কথা প্রচার করেছে

. যুলহাজ্জ মাসের বানোয়াট সালাত

আমরা দেখেছি যে, যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন রাত অত্যন্ত গুরুত্ব পুর্ণ। সময়ে নফল সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া, দান ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদত বন্দেগি যথাসাধ্য বেশি বেশি করে পালন করা দরকার। যে যতটুকু করতে পারবেন ততটুকুর সাওয়াব পাবেন। এসকল দিনে বা যুলহাজ্জ মাসের কোনো দিন বা রাতের জন্য কোনোরূপ বিশেষ সালাত বা সালাতের বিশেষ পদ্ধতি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট। যেমন:

1.     যুলহাজ্জ মাসের প্রথম রাত্রির সালাত: রাকআত বা বেশি রাকআত ... সালাত, অমুক অমুক সূরা দ্বারা ... ইত্যাদি

2.     যুলহাজ্জ মাসের তারিখইয়াওমুত তারবিয়াররাতের সালাত: / ... ইত্যাদি রাকআত সালাত, অমুক অমুক সূরা দিয়ে...

3.     যুলহাজ্জ মাসের তারিখইয়াওমুত তারবিয়ারদিনের সালাত: / ...ইত্যাদি রাকআত সালাত, অমুক অমুক সূরা দিয়ে...

4.     আরাফার রাতের সালাত, ১০০ রাকআত, প্রত্যেক রাকআতে অমুক সূরা... অত বার ... ইত্যাদি

5.     আরাফার দিনের সালাত, /... ইত্যাদি রাকআত, প্রত্যেক রাকআতে অমুক সূরা... অত বার ... ইত্যাদি

6.     ঈদুল আযহার বা কুরবানীর দিনের রাতের সালাত, ১২/... ইত্যাদি রাকআত, প্রত্যেক রাকআতে অমুক সূরা অত বার....

7.     কুরবানীর দিন বা ঈদুল আযহার দিনের সালাত, ঈদুল আযহার পরে রাকআত সালাত, প্রত্যেক রাকআতে অমুক সূরা অত বার...

8.     যুলহাজ্জ মাসের শেষ দিনের সালাত, দুই রাকআত, প্রত্যেক রাকআতে অমুক সূরা অমুক আয়াত অত বার ...

সকল বানোয়াট সালাতের মধ্যে বা শেষে কিছু দোয়া বা যিক্র-এর কথাও উল্লেখ করেছে জালিয়াতগণ। তারা সকল সালাতের জন্য আকর্ষণীয় আজগুবি অনেক সাওয়াব ফলাফলের কথা উল্লেখ করেছে[8]

. যুলহাজ্জ মাসের বানোয়াট সিয়াম

যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দিন এবং বিশেষত আরাফার দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ সাওয়াব মর্যাদার কথা সহীহ যয়ীফ হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু জালিয়াতগণ ভাবে যে, সকল সাওয়াবে মুসলমানদের তৃপ্তি হবে না, এজন্য উদ্ভট সব ফযীলতের বর্ণনা দিয়ে সকল দিনে অন্যান্য দিনে সিয়াম পালনের বিষয়ে অনেক জাল হাদীস বানিয়েছে

. যুলহাজ্জের শেষ দিন মুহার্রামের প্রথম দিনের সিয়াম

একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:

مَنْ صَامَ آَخِرَ يَوْمٍ مِنْ ذِيْ الْحِجَّةِ وَأَوَّلَ يَوْمٍ مِنَ الْمُحَرَّمِ فَقَدْ خَتَمَ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ بِصَوْمٍ وَافْتَتَحَ السَّنَةَ الْمُسْتَقْبَلَةَ بِصَوْمٍ فَقَدْ جَعَلَ اللهُ لَهُ كَفَّارَةَ خَمْسِيْنَ سَنَةً

‘‘যে ব্যক্তি যুলহাজ্জ মাসের শেষ দিন এবং মুহার্রাম মাসের প্রথম দিন সিয়াম পালন করল, সে ব্যক্তি তার বিগত বছরকে সিয়াম দ্বারা সমাপ্ত করলো এবং আগত বছরকে সিয়াম দ্বারা স্বাগত জানালো। কাজেই আল্লাহ তার ৫০ বছরের কাফফারা বা পাপ মার্জনা করবেন।[9]

এরূপ আরো অনেক আজগুবি সনদহীন বানোয়াট মিথ্যা কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায়[10]

উপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, জালিয়াতদের মেধা উদ্ভাবনী শক্তি দেখানোর একটি বড় ক্ষেত্র হলো সাপ্তাহিক, মাসিক বাৎসরিক বিভিন্ন প্রকারের নেক আমলের ফযীলতের বিষয়ে জাল হাদীস তৈরি করা। এর বড় কারণ হলো, ধরনের জাল কথা সহজেই সরলপ্রাণ মুসলমানদের মন আকৃষ্ট করে এবং এগুলো দিয়ে সহজেই সরলপ্রাণ বুযুর্গ লেখকগণকে ধোকা দেওয়া যায়। তাঁরা আমল ভালবাসেন এবং আমলের ফযীলত বিষয়ক হাদীসগুলো সরল মনে গ্রহণ করেন

জাতীয় জাল কথা প্রচলিত হওয়ার কারণও এটাই। অন্যান্য জাল কথার চেয়ে আমলের ফযীলত বিষয়ক জাল কথা প্রসিদ্ধি লাভের কারণ হলো, অনেক বুযুর্গ ওয়ায়িয, দরবেশ বা লেখক এগুলোর মধ্যে ফযীলতের আধিক্য দেখে সরল মনে এগুলোকে গ্রহণ করেছেন এবং সাধারণ মানুষদের আকৃষ্ট করার জন্য এগুলি মুখে বলেছেন বা বইয়ে লিখেছেন। আর, একবার একজন লিখলে সাধারণত পরবর্তী লেখকগণ সেগুলো থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করতে থাকেন। অনেকেই যাচাই বাছাই করার সময় পান না। অনেকে ভাবেন, যাই হোক, এর দ্বারা তো কিছু মানুষ আমল করছে। ভালই তো!!

আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অনেক বুযুর্গ এগুলোর উপর আমল করেছেন, অনেকে ফল প্রভাব লাভ করেছেন। অনেকে এগুলো তাদের ওয়াযে বলেছেন বা বইয়ে লিখেছেন- তাঁরা কি সবাই গোনাহগার হবেন?

এখানে আমাদের বুঝতে হবে যে, সকল জাল হাদীসে সাধারণত, সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া, দান ইত্যাদি শরীয়ত সম্মত নেক আমলের উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। মুমিনের দায়িত্ব হলো, নফল সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া ইত্যাদি সকল প্রকার দৈনন্দিন, সাপ্তাহিক, মাসিক বাৎসরিক নেক আমল নিয়মিত পালন করা। হলো রাসূলুল্লাহ () তাঁর সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসারী সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি তাবিয়ী বুযুর্গগণের রীতি তরীকা। এরপর সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত মর্যাদাময় দিন রাতগুলিতে অতিরিক্ত ইবাদতের চেষ্টা করা। সকল মিথ্যা জাল হাদীস সাধারণত মুমিনকে সহীহ সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত ইবাদত থেকে দূরে নিয়ে যায়, অকারণ পরিশ্রম কষ্টের মধ্যে নিপতিত করে এবং সুন্নাত বিরোধী বিভিন্ন রীতি পদ্ধতির মধ্যে নিমজ্জিত করে। ছাড়া যে কোনো কথা শুনে বা পড়েই তাকে হাদীস বলে মেনে নেয়া, হাদীসের কোন্ গ্রন্থে সংকলিত আছে তা অন্তত যাচাই করার চেষ্টা না করা রাসূলুল্লাহ () এর নির্দেশনার বিরোধী দীনের বিষয়ে অবহেলার শামিল। এরপরও যারা অসাবধানতা, সরলতা বা অজ্ঞতা বশত এগুলোকে সঠিক মনে করে এগুলোর উপর আমল করেছেন, তারা সকল জাল হাদীসে বর্ণিত জাল বানোয়াট সাওয়াব পাবেন না, তবে মূল নেক আমালের সাধারণ সাওয়াব লাভ করবেন বলে আশা করা যায়

কিন্তু যদি কেউ এগুলোকে জাল বলে জানার বা শোনার পরেও এগুলো বলেন, লিখেন বা পালন করেন, বিষয়ে কোনো তাহকীক বা যাচাই করতে আগ্রহী না হন, তবে অবশ্যই তিনি রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বলার অপরাধে অপরাধী হবেন

[1] বুখারী, আস-সহীহ /৩২৯; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ /২৭৩; তিরমিযী, আস-সুনান /১৩০-১৩১
[2]
তিরমিযী, আস-সুনান /৩১৩
[3]
বাইহাকী, শুআবুল ঈমান /৩৫৬; মুনযিরী, আত-তারগীব /১২৮
[4]
বাইহাকী, শুআবুল ঈমান /৩৫৮; মুনযিরী, আত-তারগীব /১২৮
[5]
মুসলিম, আস-সহীহ /৮১৯
[6]
সুয়ূতী, যাইল, পৃ. ১১৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৬৫; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১১৯
[7]
সুয়ূতী, যাইল, পৃ. ১২১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৬৫; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১২১
[8]
আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৮৭-৮৯, ১১৫-১১৭
[9]
ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত /১১২; সুয়ূতী, আল-লাআলী /১৯৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৪৮; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১১৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /১২৯
[10]
মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত ৪৬-৫০ অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন ৩২২-৩২৭

No comments

Powered by Blogger.