হাদীসের নামে জালিয়াতি - অধ্যায়-৩০ - সালাত ও আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গ - (ঘ) সুন্নাত-নফল সালাত বিষয়ক

সুন্নাত-নফল সালাত বিষয়ক

ফরয সালাত যেমন মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত, তেমনি নফল সালাতও সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায়। ফরযের অতিরিক্ত কর্মকে ‘‘নফল’’ বলা হয়। কিছু সময়ে কিছু পরিমাণ ‘‘নফল’’ সালাত পালন করতে রাসূলুল্লাহউৎসাহ দিয়েছেন, বা তিনি নিজে তা পালন করেছেন। এগুলোকেসুন্নাত বলা হয়। যে সকল নফল সালাতের বিষয়ে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেগুলোকে ‘‘সন্নাতে মুয়াক্কাদাহ’’ বলা হয়। ধরনের কিছু সুন্নাত সালাত সম্পর্কে হাদীসে বেশি গুরুত্ব প্রদানের ফলে কোন ফকীহ তাকে ওয়াজিব বলেছেন

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে সাধারণভাবে যত বেশি পারা যায় নফল সালাত আদায়ের উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এক সাহাবী প্রশ্ন করেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কর্ম কী? উত্তরে রাসূলুল্লাহ () বলেন: ‘‘তুমি আল্লাহর জন্য বেশি বেশি সাজদা করবে (বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করবে); কারণ তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সাজদা কর, তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তোমার একটি পাপ মোচন করেন।[1]

অন্য এক যুবক সাহাবী রাসূলুল্লাহ -এর কাছে আবেদন করেন যে, তিনি জান্নাতে তাঁর সাহচর্য চান। তিনি বলেন: ‘‘তাহলে বেশি বেশি সাজদা করে (নফল সালাত পড়ে) তুমি আমাকে তোমার বিষয়ে সাহায্য কর।[2]

অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন : ‘‘সালাত সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়, কাজেই যার পক্ষে সম্ভব হবে সে যেন যত বেশি পারে সালাত আদায় করে।’’ হাদীসটি হাসান[3]

সাধারণভাবে নফল সালাত ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বা স্থানে বিশেষ সালাতের বিশেষ ফযীলতের কথাও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আমরা ইতোপূর্বে আল্লামা মাওসিলীর আলোচনা থেকে জানতে পেরেছি যে, সহীহ হাদীস থেকে নিম্নলিখিত বিশেষ সুন্নাত-নফল সালাতের কথা জানা যায়: ফরয সালাতের আগে পরে সুন্নাত সালাত, তারাবীহ, দোহা বা চাশত, রাতের সালাত বা তাহাজ্জুদ, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ, তাহিয়্যাতুল ওযু, ইসতিখারার সালাত, কুসূফের সালাত, ইসতিসকার সালাত সালাতুত তাসবীহ। এছাড়া পাপ করে ফেললে দু রাকআত সালাত আদায় করে তাওবা করার কথাও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। একটি যয়ীফ হাদীসেসালাতুল হাজাতবর্ণিত হয়েছে

সুন্নাত-নফল সালাতের বিষয়ে এত সহীহ হাদীস থাকা সত্ত্বেও জালিয়াতগণ বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচার করেছে। অন্যান্য জাল হাদীসের মতই এগুলোতে অনেক আকর্ষণীয় অবান্তর সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। জালিয়াতগণ দুটি ক্ষেত্রে কাজ করেছে। প্রথম, সহীহ হাদীসে উল্লিখিত সুন্নাত-নফল সালাতগুলোর জন্য বানোয়াট ফযীলত, সূরা বা পদ্ধতি তৈরি করেছে। দ্বিতীয়, বিভিন্ন সময়, স্থান বা কারণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির সালাতের উদ্ভাবন করে সেগুলোর কাল্পনিক সাওয়াব, ফযীলত বা আসরের কাহিনী বানিয়েছে। আমাদের দেশে প্রচলিত বিষয়ক কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তা বা জাল হাদীস এখানে উল্লেখ করছি

সহীহ হাদীসে প্রমাণিত সুন্নাত-নফল সালাত বিষয়ক জাল হাদীসগুলো বিস্তারিত আলোচনা করতে চাচ্ছি না। শুধুমাত্র সকল সালাত বিষয়ক মনগড়া পদ্ধতিগুলো আলোচনা করব। এরপর জালিয়াতগণ মনগড়াভাবে যে সকল সালাত তার ফযীলতের কাহিনী বানিয়েছে সেগুলো উল্লেখ করব

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /৩৫৩
[2]
মুসলিম, আস-সহীহ /৩৫৩
[3]
তাবারানী, আল-মুজামুল আউসাত /৮৪, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /২৪৯, আলবানী, সহীহুত তারগীব /২২৬

 

 . বিভিন্ন সালাতের জন্য নির্দিষ্ট সূরা বা আয়াত নির্ধারণ করা

সহীহ হাদীসে প্রমাণিত সকল সালাতের কোনো সালাতের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সূরা বা আয়াত নির্ধারণ করে দেয়া হয় নি। সকল সালাতের জন্য নির্ধারিত সূরা পাঠের বিষয়ে, বা অমুক রাকআাতে অমুক সূরা বা অমুক আয়াত এতবার পাঠ করতে হবে বলে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই বানোয়াট কথা। কাজেই ইসতিখারার সালাতের প্রথম রাকআতে অমুক সূরা, দ্বিতীয় রাকআতে অমুক সূরা, তাহাজ্জুদের সালাতে প্রথম রাকআতে অমুক সূরা, দ্বিতীয় রাকআতে অমুক সূরা বা আয়াত, চাশতের সালাতে প্রথম বা দ্বিতীয় রাকআতে অমুক সূরা বা আয়াত ... শবে কদরের রাতের সালাতে অমুক অমুক সূরা বা আয়াত পড়তে হবে.... ইত্যাদি সকল কথাই বানোয়াট

যে কোনো সূরা বা আয়াত দিয়ে সকল সালাত আদায় করা যাবে। কোনো নির্দিষ্ট সূরা বা আয়াতের কারণে সকল সালাতের সাওয়াব বা বরকতের কোনো হেরফের হবে না। সূরা বা আয়াতের দৈর্ঘ্য, মনোযোগ, আবেগ ইত্যাদির কারণে সাওয়াবের কমবেশি হয়

 

 . তারাবীহের সালাতের দোয়া মুনাজাত

রামাদানের কিয়ামুল্লাইলকেসালাতুত তারাবীহবাবিশ্রামের সালাতবলা হয়। রাসূলুল্লাহ () এর যুগে তিনি নিজে সাহাবীগণ রামাদান অন্যান্য সকল মাসেই মধ্যরাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত / ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একাকি কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদ তারাবীহ আদায় করতেন। উমার (রা) এর সময় থেকে মুসলিমগণ জামাআতে তারাবীহ আদায় করতেন। সাধারণত ইশার পর থেকে শেষরাত্র বা সাহরীর পূর্ব সময় পর্যন্ত / ঘণ্টা যাবৎ তাঁরা একটানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারাবীহের সালাত আদায় করতেন

যেহেতু এভাবে একটানা কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা খুবই কষ্টকর, সেহেতু পরবর্তী সময়ে প্রতি রাকআত সালাত আদায়ের পরে প্রায় রাকআত সালাতের সম পরিমাণ সময় বিশ্রাম নেয়ার রীতি প্রচলিত হয়। এজন্যই পরবর্তীকালে সালাতসালাতুত তারাবীহবলে প্রসিদ্ধ হয়

বিশ্রামসালাতের বা ইবাদতের কোনো অংশ নয়। বিশ্রাম না করলে সাওয়াব কম হবে বা বিশ্রামের কমবেশির কারণে সাওয়াব কমবেশি হবে এরূপ কোনো বিষয় নয়। বিশ্রাম মূলত ভালভাবে সালাত আদায়ের উপকরণ মাত্র। বিশ্রামের সময়ে মুসল্লী যে কোনো কাজ করতে পারেন, বসে বা শুয়ে থাকতে পারেন, অন্য নামায আদায় করতে পারেন, কুরআন তিলাওয়াত করতে পারেন বা দোয়া বা যিকর- রত থাকতে পারেন। বিষয়ে কোনো নির্ধারিত কিছুই নেই

গত কয়েক শতাব্দী যাবত কোনো কোনো দেশে প্রতি চার রাকআত পরে একটি নির্ধারিত দোয়া পাঠ করা হয় এবং একটি নির্ধরিত মুনাজাত করা হয়। অনেক সময় দোয়াটি প্রতি রাকআত অন্তে পাঠ করা হয় এবং মুনাজাতটি ২০ রাকআত অন্তে পাঠ করা হয়। দোয়াটি নিম্নরূপ:

سُبْحَانَ ذِي الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوتِ ، سُبْحَانَ ذِي الْعِزَّةِ وَالْعَظَمَةِ (وَالْهَيْبَةِ) وَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوتِ ، سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْحَيِّ الَّذِي لا يَنَامُ وَ) لا يَمُوتُ (أبَداً أَبَداً)، سُبُّوحٌ قُدُّوسٌ (رَبُّنَا وَ) رَبُّ الْمَلائِكَةِ وَالرُّوحِ، (لا إلَهَ إلا اللَّهُ نَسْتَغْفِرُ اللَّهَ ، نَسْأَلُك الْجَنَّةَ وَنَعُوذُ بِك مِنْ النَّارِ)

মুনাজাতটি নিম্নরূপ:

اَللّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلْكَ الْجَنَّةَ وَنَعُوْذُ بِكَ مِنَ النَّارِ يَا خَالِقَ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ بِرَحْمَتِكَ يَا عَزِيْزُ يَا غَفَّارُ يَا كَرِيْمُ يَا سَتَّارُ يَا رَحِيْمُ يَا جَبَّارُ يَا خَالِقُ يَا بَارُّ اَللّهُمَّ أَجِرْنَا مِنَ النَّارِ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ بِرَحْمَتِكَ يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ

দোয়া মুনাজাতের কথাগুলো ভাল, তবে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) শেখানো বা আচরিত নয়। তারাবীহের বিশ্রামের সময়ে এগুলো পড়লে কোনে বিশেষ সাওয়াব হবে বলে কোনো সহীহ, যয়ীফ বা জাল হাদীসেও বলা হয় নি। এমনকি অন্য কোনো সময়ে তিনি বাক্যগুলো এভাবে বলেছেন বা বলতে শিখিয়েছেন বলে বর্ণিত হয় নি। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বা অন্য কোনো ইমাম তারাবীহে দুআ-মুনাজাত পড়তে বলেন নি। ১০০০ হিজরী পর্যন্ত রচিত হানাফী ফিকহের কোনো গ্রন্থে দুআ মুনাজাতের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ফিরিশতাদের তাসবীহ হিসেবে দুআর কয়েকটি বাক্য বণিত। একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহর কিছু ফিরিশতা একটি নূরের সমুদ্রে দোয়াটি পাঠ করেন... যে ব্যক্তি কোনো দিবসে, মাসে বা বছরে দোয়াটি পাঠ করবে সে এত এত পুরস্কার লাভ করবে। তবে কিয়ামুল্লাইল বা তারাবীহের সাথে দুআকে জড়ানো একেবারেই ভিত্তিহীন[1]

আমাদের উচিত সকল বানোয়াট দোয়া না পড়ে সময়ে দরুদ পাঠ করা। অথবা কুরআন তিলাওয়াত বা মাসনূন যিক্র- মশগুল থাকা

কোনো কোনো প্রচলিত পুস্তকে তারাবীহের দু রাকআত অন্তে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করতে বলা হয়েছে[2]:

هَذَا مِنْ فَضْلِ رَبِّىْ يَا كَرِيْمَ الْمَعْرُوْفِ يَا قَدِيْمَ الإِحْسَانِ أَحْسِنْ إِلَيْنَا بِإِحْسَانِكَ الْقَدِيْمِ ثَبِّتْ قُلُوْبَنَا عَلَى دِيْنِكَ بِرَحْمَتِكَ يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ

দোয়াটিও ভিত্তিহীন বানোয়াট

[1] হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৯৩; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১৪৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /৩২৬; আজলূনী, কাশফুল খাফা /৫৩৮
[2]
মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ২২৮

 . সালাতুল আওয়াবীন

 

রাসূলুল্লাহ () নিজে তাঁর সাহাবীগণ মাগরিব ইশার মধ্যবর্তী সময়ে বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করতেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হুযাইফা (রা) বলেন, ‘‘আমি নবীজী ()- কাছে এসে তাঁর সাথে মাগরিবের সালাত আদায় করলাম। তিনি মাগরিবের পরে ইশা সালাত পর্যন্ত নফল সালাতে রত থাকলেন।’’ হাদীসটি সহীহ[1]

অন্য হাদীসে আনাস (রা) বলেন, ‘‘সাহাবায়ে কেরাম মাগরিব ইশা মধ্যবর্তী সময়ে সজাগ থেকে অপেক্ষা করতেন এবং নফল সালাত আদায় করতেন।’’ হাদীসটি সহীহ। তাবিয়ী হাসান বসরী বলতেন, মাগরিব ইশা মধ্যবর্তী সময়ের নামাযও রাতের নামায বা তাহাজ্জুদ বলে গণ্য হবে[2]

বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো কোনো সাহাবী তাবিয়ীগণকে সময়ে সালাত আদায়ের জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন[3]

সকল হাদীসের আলোকে জানা যায় যে, মাগরিব ইশার মধ্যবর্তী সময়ে মুমিন কিছু নফল সালাত আদায় করবেন। যিনি যত বেশি সালাত আদায় করবেন তিনি তত বেশি সাওয়াব লাভ করবেন। সময়ের সালাতের রাকআত সংখ্যা বা বিশেষ ফযীলতে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি

কিছু জাল বা অত্যন্ত যয়ীফ সনদের হাদীসে সময়ে রাকআত, রাকআত, ১০ বা ২০ রাকআত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। যেমন, যে ব্যক্তি সময়ে রাকআত সালাত আদায় করবে, সে এক যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধে জিহাদ করার সাওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি মাগরিবের পরে কোনো কথা বলার আগে রাকআত সালাত আদায় করবে তাঁর ৫০ বছরের গোনাহ ক্ষমা করা হবে। অথবা তাঁর সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। যে ব্যক্তি সময়ে ১০ রাকআত সালাত আদায় করবে, তাঁর জন্য জান্নাতে বাড়ি তৈরি করা হবে। যে ব্যক্তি সময়ে ২০ রাকআত সালাত আদায় করবে, তাঁর জন্য আল্লাহ জান্নাতে বাড়ি তৈরি করবেন। এসকল হাদীস সবই বানোয়াট বা অত্যন্ত যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী সময়ে রাকআত নামায আদায় করলে ১২ বছরের সাওয়াব পাওয়ার হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন[4]

আমাদের দেশে রাকআতে সূরা ফাতিহার পরে কোন্ সূরা পাঠ করতে হবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা

দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী বলেছেন, সালাতুল মাগরিবের পর থেকে সালাতুল ইশা পর্যন্ত যে নফল সালাত আদায় করা হয় তাসালাতুল আওয়াবীনঅর্থাৎবেশি বেশি তাওবাকারীগণের সালাত[5] বিভিন্ন সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ () চাশতের নামাযকেসালাতুল আওয়াবীনবলে আখ্যায়িত করেছেন[6]

[1] ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ /১৫; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা /৫১, /৮০; আলবানী, সহীহুত তারগীব /৩১৩
[2]
বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা /১৯; আবূ দাউদ, সুনান /৩৫, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /২৩০, ইবনু আবী শাইবা, মুসান্নাফ /১৫, আলবানী, সহীহুত তারগীব /৩১৩
[3]
ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ /১৪-১৬
[4]
তিরমিযী, সুনান /২৯৮, নং ৪৩৫, ইবনু মাজাহ, সুনান /৩৬৯, নং ১১৬৭, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা /১৯, ইবনু আবী শাইবা, মুসান্নাফ /১৪-১৫, বাইহাকী, শুআবুল ঈমান /১৩৩, ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ, পৃ. ৪৪৫-৪৪৬, শাওকানী, নাইলুল আউতার /৬৫-৬৭, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /২৩০
[5]
ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ /১৪; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা /১৯
[6]
মুসলিম, সহীহ /৫১৫-৫১৬; ইবনু খুযাইমা, সহীহ /২২৭-২২৮; হাকিম, মুসতাদরাক /৪৫৯

 

. সালাতুল হাজাত

ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনান গ্রন্থেসালাতুল হাজাতবাপ্রয়োজনের সালাত বিষয়ে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। হাদীসটিতে বলা হয়েছে, আল্লাহর কাছে বা কোনো মানুষের কাছে কারো কোনো প্রয়োজন থাকলে সে ওযু করে দুই রাকআত সালাত আদায় করবে এবং এর পর একটি দোয়া পাঠ করে আল্লাহর কাছে তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রার্থনা করবে

ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটির বর্ণনাকারী ফাইদ ইবনু আব্দুর রাহমান দুর্বল রাবী। এজন্য হাদীসটি দুর্বল। ব্যক্তিকে ইমাম বুখারী অন্যান্য মুহাদ্দিস মুনকার, মাতরূক মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন[1]

আমাদের দেশেসালাতুল হাজাতনামে আরো অনেক বানোয়াট পদ্ধতি প্রচলিত। যেমন: ‘‘হাজতের (খেজের .)-এর নামাজ। নামাজ রাকাত। ... মনের বাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য খেজের () জনৈক বোজর্গ ব্যক্তিকে শিক্ষা দিয়াছেন। প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা কাফেরুন দশবার.... ইত্যাদি।’’ এগুলো সবই বানোয়াট ভিত্তিহীন কথা[2]

[1] তিরমিযী, আস-সুনান /৩৪৪; ইবনু হাজার, তাহযীব /২২৯; তাকরীব, পৃ. ৪৪৪; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত /৬১; সুয়ূতী, আল-লাআলী /৪৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১১০
[2]
মো. বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৬৮

 

. সালাতুল ইসতিখারা

ইস্তিখারার জন্য সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওযু করে দুই রাকআত সালাত আদায় করেআল্লাহুম্মা ইন্নী আসতাখীরুকা বিইলমিকা...’ দোয়াটি পাঠ করতে হবে[1] কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে বিষয়ে বিভিন্ন বানোয়াট পদ্ধতি দোয়া উল্লেখ করা হয়েছে। একটি বানোয়াট পদ্ধতি নিম্নরূপ: ‘কোনো জিনিসের ভাল মন্দ জানিতে হইলে এশার নামাজের পর এস্তেখারার নিয়তে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়িয়া নিয়া পরে কয়েক মর্তবা দুরূদ শরীফ পাঠ করিয়াছুবহানাক লা ইলমা লানা ইল্লা মা আল্লামতানা ...’ ১০০ বার পাঠ করিয়া আবার ২১ বার দরূদ শরীফ পাঠ করিয়া পাক ছাপ বিছানায় শুইয়া থাকিবে...[2]

অন্য পুস্তকে বলা হয়েছে: ‘‘হযরত আলী (কার্রা) বলিয়াছেন যে, স্বপ্নে কোন বিষয়ের ভালমন্দ জানিতে হইলে নিম্নোক্ত নিয়মে রাত্রে শয়ন করিবার পূর্বে দুই রাকাত করিয়া ছয় রাকাত নামায পড়িবে। প্রথম রাকতে সূরা ফাতেহার পরে সূরা ওয়াশ্শামছে বার ....[3] এটিও ভিত্তিহীন কথা

[1] বুখারী, আস-সহীহ /৩৯১, /২৩৪৫, /২৬৯০; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১১/১৮৩
[2]
মো. বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৬৮
[3]
মো. শামছুল হুদা, নেয়ামুল কোর্আন, পৃ. ২০২-২০৩

 

 . হালকী নফল

রাসূলুল্লাহ () শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায়ের পরে বিত্র আদায় করতেন। এরপর দুই রাকআত নফল সালাত আদায় করতেন। একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিত্র-এর পরে দু রাকআত নফল সালাত আদায় করলেতাহাজ্জুদবা কিয়ামুল্লাইলের সাওয়াব পাওয়া যায়[1]

হাদীস দ্বারা এতটুকুই প্রমাণিত। বিষয়ক প্রচলিত জাল ভিত্তিহীন কথার মধ্যে রয়েছে: ‘‘বেতের নামাজ পড়ার পর দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করিলে একশত রাকাত নামাজ পড়ার ছওয়াব হাসিল হয়। প্রতি রাকাতে সুরা ফাতেহার পর সূরা একলাছ বার করিয়া পাঠ করিয়া নামাজ আদায় করিতে হয়... এগুলি সবই ভিত্তিহীন কথা বলে প্রতীয়মান হয়[2]

[1] দারিমী, আস-সুনান /৪৫২
[2]
মো. বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৬৮

 

 . আরো কিছু বানোয়াটনামায

বিভিন্ন নামে বিভিন্ন মনগড়া ভিত্তিহীন ফযীলতের বর্ণনা দিয়ে আরো কিছুনামাযপ্রচলিত রয়েছে সমাজে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হেফজুল ঈমান নামাজ, কাফফারা নামাজ, বুজুর্গী নামাজ, দৌলত লাভের নামাজ, শোকরের নামাজ, পিতামাতর হকের নামাজ, ইত্যাদি ইত্যাদি[1]

[1] লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০৩-১১৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৫৭-৮৫; মো. বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৬৮-১৭৫

 

. সপ্তাহের দিনের সালাত

সপ্তাহের দিনের দিবসে বা রাতে নির্ধারিত নফল সালাত তার ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীসই বানোয়াট ভিত্তিহীন কথা। মুমিন নিয়মিত তাহাজ্জুদ, চাশত ইত্যাদি সালাত আদায় করবেন। এছাড়া যথাসাধ্য বেশি বেশি নফল সালাত তিনি আদায় করবেন। এগুলোর জন্য সহীহ হাদীসে বর্ণিত সাওয়াবের আশা করবেন। কিন্তু জালিয়াতগণ কাল্পনিক সাওয়াব ফযীলতের কাহিনী দিয়ে অনেক হাদীস বানিয়েছে, যাতে সপ্তাহের প্রত্যেক দিনে রাতে বিশেষ বিশেষ সালাতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। শুক্রবার রাত্রির নফল নামায, শুক্রবার দিবসের নফল নামায, শনিবার রাত্রির নফল নামায, শনিবার দিনের নামায .... ইত্যাদি নামে প্রচলিত সবই বানোয়াট কথা

যেমন, আনাস (রা) অন্যান্য সাহাবীর নামে হাদীস হিসাবে বর্ণিত হয়েছে যে, বৃহস্পতিবার দিবাগত শুক্রবারের রাত্রিতে এত রাকআত সালাত আদায় করবে.... এতে জান্নাতে বালাখানা, ইত্যাদি অপরিমেয় সাওয়াব লাভ করবে। শুক্রবার দিবসে অমুক সময়ে অমুক পদ্ধতিতে এত রাকআত সালাত আদায় করবে... এতে এত এত পুরস্কার লাভ করবে... শনিবার রাত্রিতে যে ব্যক্তি এত রাকআত সালাত অমুক পদ্ধতিতে আদায় করবে সে অমুক অমুক পুরস্কার লাভ করবে। শনিবার দিবসে অমুক সময়ে অমুক পদ্ধতিতে এত রাকআত সালাত আদায় করলে অমুক অমুক ফল পাওয়া যাবে ....

ভাবে সপ্তাহের দিনের দিবসে রাত্রিতে বিভিন্ন পরিমাণে পদ্ধতিতে, বিভিন্ন সূরা বা দোয়া সহকারে যত প্রকারের সালাতের কথা বলা হয়েছে সবই বানোয়াট জাল কথা

আমাদের দেশে প্রচলিত বার চাঁদের ফযীলত, নেক আমল, ওযীফা ইত্যাদি সকল পুস্তকেই এই সব মিথ্যা কথাগুলো হাদীস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ মুহাদ্দিসগণ সকলেই এগুলোর জালিয়াতির বিষয়ে একমত

অনেক সময় অনেক বড় আলিমও জনশ্রুতির উপরে অনেক কথা লিখে ফেলেন। সবার জন্য সব কথাতাহকীকবা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না। সপ্তাহের দিন বা রাতের নামাযও কোনো কোনো বড় আলিম উল্লেখ করেছেন। তবে পূর্ববর্তী পরবর্তী সকল যুগের মুহাদ্দিসগণ একমত যে, অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই ভিত্তিহীন বানোয়াট। এদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার, জূযকানী, ইবনুল জাওযী, সুয়ূতী, মুহাম্মাদ তাহির পাটনী, মোল্লা আলী কারী, আব্দুল হাই লাখনবী, ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আজলূনী, শাওকানী প্রমুখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস[1]

সালাত বা নামায সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। মুমিন যত বেশি পারবেন তত বেশি নফল সালাত আদায় করতে চেষ্টা করবেন। তবে এর সাথে কোনো মনগড়া পদ্ধতি যোগ করা বা মনগড়া ফযীলতের বর্ণনা দেয়া বৈধ নয়

[1] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত /১১৩-১১৯; যাহাবী, তারতীবুল মাওদূআত, পৃ. ১৫৮-১৬০; ইবনুল কাইয়েম, আল-মানার, পৃ. ৪৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী /৪৯-৫২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /৫৮-৮৭; তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূআত, পৃ. ৪২; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৮৮, ২৯৫-২৯৭, ৩২৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা, /৫৫৬; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৪৭-৫৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ /৬৯-৭২

No comments

Powered by Blogger.