হাদীসের নামে জালিয়াতি - অধ্যায়-৩৩ - মৃত্যু, জানাযা, দুআ, যিকর ইত্যাদি
(ক) মৃত্যু, জানাযা, যিয়ারত ইত্যাদি - ১. প্রতিদিন ২০ বার মৃত্যুর স্মরণে শাহাদতের মর্যাদা
আমাদের দেশের ওয়াযে ও পুস্তকে বহুল প্রচলিত একটি কথা:
يَكُوْنُ
مَعَ الشُّهَدَاءِ مَنْ ذَكَرَ الْمَوْتَ كُلَّ يَوْمٍ عِشْرِيْنَ مَرَّةً
‘‘যে ব্যক্তি মৃত্যুকে প্রতিদিন বিশবার স্মরণ করবে সে শহীদগণের সঙ্গী হবে বা শহীদের মর্যাদা লাভ করবে।’’
মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, এটি সনদবিহীন বানোয়াট কথা।[1]
[1] তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২১৩; শওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৩৩৬।
২. মৃত্যুর কষ্টের বিস্তারিত বিবরণ
মৃত্যুর যন্ত্রণা ও কষ্ট বা ‘সাকারাতুল মাউত’ বিষয়ক কিছু কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মৃত্যু যন্ত্রণার বিস্তারিত বিবরণ, তুলনা, উদাহরণ, প্রত্যেক অঙ্গের সাথে আত্মার কথাবার্তা ইত্যাদি বিষয়ক প্রচলিত হাদীসগুলো কিছু বানোয়াট ও কিছু অত্যন্ত দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে।[1]
[1] তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২১৩-২১৪।
৩. ইবরাহীম (আ)-এর মৃত্যু যন্ত্রণা
একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, ইবরাহীম (আ) যখন তাঁর প্রভুর সাথে সাক্ষাত করেন তখন তিনি বলেন, হে ইবরাহীম, মৃত্যুকে কেমন বোধ করলে? তিনি বলেন, আমার অনুভব হলো যে, আমার চামড়া টেনে তুলে নেয়া হচ্ছে। তখন আল্লাহ বলেন, তোমার জন্য মৃত্যু যন্ত্রণাকে সহজ করা হয়েছিল তার পরেও এরূপ...। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি জাল।[1]
[1] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৩৯৬; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূ‘আত,পৃ. ২৯৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৪১৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩৬২।
৪. চারদিক থেকে দশ পা করে জানাযা বহন
সালাতুল জানাযা আদায়, মৃতের অনুগমন, লাশ বহন, দাফনে অংশ গ্রহণ ইত্যাদি সুন্নাহ নির্দেশিত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। লাশ বহনের ক্ষেত্রে অনেক ফকীহ উল্লেখ করেছেন যে, চারিদিক থেকে অন্তত দশ পা করে লাশ বহন করা উচিত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে দুটি হাদীস বর্ণিত:
من
اتبع جَنَازَة فَأخذ بجوانب السرير الْأَرْبَع غفر لَهُ أَرْبَعُونَ ذَنبا كلهَا
من الْكَبَائِر
‘‘যে ব্যক্তি মৃতের অনুগমনের সময় খাটিয়ার চারিদিক থেকে ধরবে তার চল্লিশটি গোনাহ ক্ষমা করা হবে, সবগুলোই কবীরা গোনাহ।’’
من حمل قَوَائِم السرير
الْأَرْبَع إِيمَانًا واحتسابًا (حط) الله - عَزَّ وَجَلَّ - عَنهُ أَرْبَعِينَ
كَبِيرَةগ্ধ .
‘‘ যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সাথে খাটিয়ার চারিটি খুটি বহন করবে আল্লাহ তার চল্লিশটি কবীরা গোনাহ ক্ষমা করবেন।’’
প্রথম হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী সিওয়ার ইবন মুসআব হামাযানী (سوار بن مصعب الهمذاني) এবং দ্বিতীয় হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী আলী ইবন আবী সারা শাইবানী (علي بن أبي سارة)। ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন, বুখারী, নাসায়ী, ইবন আবী হাতিম, দারাকুতনী, ইবন হিববান, ইবন আদী, আবূ নুআইম ইসপাহানী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস ইমাম এদের দুজনকে একেবারেই দুর্বল, অগ্রহণযোগ্য, মুনকার ও মাতরূক বা পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[1] এজন্য হাদীসগুলোকে ইবনুল জাওযী, আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস মাউযূ বা মুনকার এবং সুয়ূতী, ইবনু আর্রাক প্রমুখ মুহাদ্দিস দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।[2]
ফকীহগণ এ প্রসঙ্গে নিম্নের হাদীসটি উল্লেখ করেছেন:
مَنْ
حَمَلَ جِنَازَةً أَرْبَعِينَ خُطْوَةً كَفَّرَتْ أَرْبَعِينَ كَبِيرَةً
‘‘যে ব্যক্তি চল্লিশ পা লাশ বহন করবে তার চল্লিশটি কবীরা গোনাহ ক্ষমা করা হবে।’’[3]
এ শব্দে এ হাদীসটি কোনো হাদীসের গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে বলে আমি জানতে পারি নি। বাহ্যত এটি উপরের দ্বিতীয় হাদীসটিরই আরেকটি ভাষ্য।
লক্ষ্যণীয় যে, চারিদিক থেকে খাটিয়া বহনের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হাদীসগুলো অগ্রহণযোগ্য হলেও সাহাবীগণ থেকে এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সনদে তাঁদের মতামত বর্ণিত। আবূ দারদা (রা) বলেন:
مِنْ
تَمام أَجْرِ الْجِنَازَة ... وَأَن يَحْمِلَ بأَرْكَانِهَا الأَرْبَعَة
‘‘জানাযার সাওয়াবের পূর্ণতার মধ্যে রয়েছে... খাটিয়ার চারটি খুটি ধরে তা বহন করা....।’’ হাদীসটির সনদ সহীহ।[4]
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) বলেন:
إِذا
تبع أحدكُم الْجِنَازَة فليأخذ بجوانب (السرير) الْأَرْبَعَة ثمَّ ليتطوع بعد أَو
ليذر؛ فَإِنَّهُ من السّنة
‘‘যখন তোমাদের কেউ লাশের অনুগমন করবে তখন সে যেন খাটিয়ার চারদিক থেকেই ধরে। এরপর ইচ্ছা করলে অতিরিক্ত কিছু করবে বা ছেড়ে দেবে। এটি সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।’’
ইবন মাসঊদের (রা) পুত্র আবূ উবাইদা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি নির্ভরযোগ্য। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন, তিনি তাঁর পিতা থেকে হাদীস নিজে শুনেন নি। এজন্য সনদ বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য। তবে অন্যান্য মুহাদ্দিস ইবন মাসঊদ (রা) থেকে আবূ উবাইদার বর্ণনা সহীহ বলে গণ্য করেছেন।[5]
তাবিয়ী আলী ইবন আব্দুল্লাহ আযদী বলেন:
رَأَيْتُ
ابْنَ عُمَرَ فِيْ جَنَازَةٍ حَمَلَ بِجَوَانِبِ السَّرِيْرِ الأَرْبَعِ قَالَ
بَدَأَ بِمَيَامِنِهَا
‘‘আমি আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা)-কে একটি জানাযায় দেখলাম। তিনি খাটিয়ার চারদিক থেকে বহন করলেন। তিনি ডান থেকে শুরু করলেন...।[6]
হাদীসটির সনদ বাহ্যত হাসান পর্যায়ের। এভাবে আমরা দেখছি যে, চারদিক থেকে খাটিয়া বহনের বিষয়টি সাহাবীগণের সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। তবে দশ পা করে বহনের বিষয়টি একেবারেই অপ্রমাণিত ও ভিত্তিহীন।
[1] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর, ৪/১৬৯, ৬/২৭৮; আদ-দুআফা আস-সাগীর, পৃষ্ঠা ৫৮; ইবন আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তাদীল ৪/২৭১-২৭২, ৬/১৮৯; ইবন হিববান, আল-মাজরূহীন ২/১০৪; আবূ নুআইম ইসপাহানী, আদ-দুআফা, পৃষ্ঠা ৯০; নাসায়ী, আদ-দুআফা, পৃ. ১৮৭; ইবন আদী, আল-কামিল ৩/৪৫৪-৪৫৬; ইবনুল জাওযী, আদ-দুআফা ওয়াল মাতরূকীন ২/১৯৩; যাহাবী, আল-কাশিফ ২/৪০, মীযানুল ই’তিদাল ৫/১৫৮; ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৭/২৮৫-২৮৬।
[2] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ৬/৯৯; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ২/৫৫; তালখীসুল হাবীর ২/১১১; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৩৮৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/২৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৪০৫; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩৬৬-৩৬৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২১৬-২১৭।
[3] সারাখসী, আল-মাবসূত ২/১০১; কাসানী, বাদাইউস সানাইঅ ১/৩০৯।
[4] ইবন আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ (মুহাম্মাদ আওয়ামা: শামিলা) ৩/২৮৩; ইবনুল মুলাক্কিন, আল-বাদরুল মুনীর (শামিলা) ৫/২২৪; ইবনুত তুরকমানী, আল-জাওহারুন নাকী ৪/২০।
[5] বিস্তারিত আলোচনা দেখুন: ইরশীফ মুলতাকা আহলিল হাদীস-১ (শামিলা ৩.২৮): আব্দুর রাহমান ফকীহ ৪১/৪০৬।
[6] আব্দুর রায্যাক, আল-মুসান্নাফ ৩/৫১৩; ইবন আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৩/২৮৩।
৫. নেককার মানুষদের পাশে কবর দেয়া
একটি প্রচলিত জাল হাদীসে বলা হয়েছে:
اِدْفَنُوْا
مَوْتَاكُمْ وَسَطَ قَوْمٍ صَالِحِيْنَ فَإِنَّ الْمَيِّتَ يَتَأَذَّي بِجَارِ
السُّوْءِ كَمَا يَتَأَذَّي الْحَيُّ بِجَارِ السُّوْءِ
‘‘তোমাদের মৃতদেরকে নেককার মানুষদের মাঝে দাফন করবে; কারণ জীবিত মানুষ যেমন খারাপ প্রতিবেশির দ্বারা কষ্ট পায়, মৃত মানুষও তেমনি খারাপ প্রতিবেশি দ্বারা কষ্ট পায়।’’
হাদীসটির সনদে মিথ্যাবাদি রাবী বিদ্যমান।[1]
[1] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ১/১০২; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৪১১-৪১২; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ৩০৬; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৩/৯৯; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৫৩; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩৭৩; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৭৪; আলবানী, যায়ীফাহ ২/৩৮-৩৯, ৭৯-৮২।
৬. কবর যিয়ারতের ফযীলত
কবর যিয়ারত করা একটি সুন্নাত নির্দেশিত নফল ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে মাঝে মাঝে কবর যিয়ারত করতেন। এছাড়া তিনি আখেরাতের স্মরণ, মৃত্যুর স্মরণ ও মৃতব্যক্তির সালাম ও দোয়ার জন্য কবর যিয়ারত করতে উম্মাতকে অনুমতি ও উৎসাহ দিয়েছেন।[1]
এ সাধারণ সাওয়াব ছাড়া যিয়ারতের বিশেষ সাওয়াবের বিষয়ে কিছু জাল হাদীস প্রচলিত আছে। যেমন: ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি তার পিতা, মাতা, ফুফু, খালা বা কোনো আত্মীয়ের কবর যিয়ারত করে তবে তার জন্য একটি মাবরূর হজ্জের সাওয়াব লিখা হবে....।’’[2]
[1] বুখারী, আস-সহীহ ১/৪৩০; মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১৮, ২/৬৬৯-৬৭২, ৩/১৫৬৩।
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৪১৩-৪১৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৪৪০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩৬৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৩৪৫।
৭. শুক্রবারে কবর যিয়ারতের বিশেষ ফযীলত
কবর যিয়ারত যে কোনো দিনে যে কোনো সময়ে করা যেতে পারে। কোনো বিশেষ দিনে বা বিশেষ সময়ে কবর যিয়ারতের জন্য বিশেষ ফযীলতের বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই। এ বিষয়ে একটি প্রচলিত হাদীস:
مَنْ
زَارَ قَبْرَ أَبَوَيْهِ أَوْ أَحَدِهِمَا كُلَّ جُمْعَةٍ، غُفِرَ لَهُ وَكُتِبَ
بَارًّا
‘‘যদি কোনো ব্যক্তি প্রত্যেক শুক্রবারে তার পিতামাতার বা একজনের কবর যিয়ারত করে তবে তার পাপ ক্ষমা করা হবে এবং তাকে পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হবে।’’
হাদীসটি ইমাম তাবারানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। তাঁরা হাদীসটি মুহাম্মাদ ইবনু নু’মান ইবনু আব্দুর রাহমান-এর সূত্রে সংকলন করেছেন। মুহাম্মাদ ইবনু নু’মান ইয়াহইয়া ইবনুল আলা আল-বাজালী থেকে, তিনি আব্দুল কারীম ইবনু আবীল মাখারিক থেকে, তিনি মুজাহিদ থেকে, তিনি আবূ হুরাইরা (রা) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
বর্ণনাকারী মুহাম্মাদ ইবনু নু’মান অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার উস্তাদ হিসেবে উল্লিখিত ইয়াহইয়া ইবনুল আলা আল-বাজালী পরিত্যক্ত ও মিথ্যায় অভিযুক্ত রাবী। ইমাম আহমাদ, ওকী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে স্পষ্টভাবে মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে অভিহিত করেছেন। তার উস্তাদ হিসেবে উল্লিখিত ‘আব্দুল কারীম’ও অত্যন্ত দুর্বল রাবী হিসেবে পরিচিত। এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল। বিশেষত ইয়াহইয়া নামক এ মিথ্যাবাদী রাবীর কারণে হাদীসটি জাল বলে গণ্য হয়।[1]
[1] তাবারানী, আল-আউসাত ৬/১৭৫; আস-সগীর ২/১৬০; হাকিম তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল ১/১২৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৪৯৫; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৬/২০১; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৫৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৪৪০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩৭৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৩৪৫।
৮. কবর যিয়ারতের সময় সূরা ইয়াসীন পাঠ
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কবর যিয়াতের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘‘আস-সালামু আলাইকুম দারা কাওমিন মু’মিনীন...’’ বা অনুরূপ বাক্য দ্বারা কবরবাসীকে সালাম প্রদান করতেন। এবং সালামের সাথেই সংক্ষিপ্ত কয়েকটি শব্দে দোয়া করতেন। তিনি সাহাবীগণকে এভাবে সালাম-দোয়া করতে শিক্ষা দিয়েছেন। একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, একরাতে তিনি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে হাত তুলে মৃতদের জন্য দোয়া করেন।[1]
এভাবে সালাম ও দোয়া ছাড়া কবর যিয়ারতের সময় কুরআন তিলাওয়াত বা কোনো সূরা পাঠের বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। কোনো কোনো ফকীহ যিয়ারতের পূর্বে আয়াতুল কুরসী, সূরা ইখলাস ইত্যাদি পাঠ করার কথা বলেছেন। তবে এ বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ক জাল হাদীসগুলোর মধ্যে রয়েছে:
مَنْ
زَارَ قَبْرَ وَالِدَيْهِ أَوْ أَحَدِهِمَا يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَرَأَ
(عِنْدَهُ) "يس" غُفِرَ لَهُ (بِعَدَدِ كُلِّ آَيَةٍ أَوْ حَرْفٍ)
‘‘যদি কেউ তার পিতামাতা বা উভয়ের একজনের কবর শুক্রবারে যিয়ারত করে এবং (তার কাছে) সূরা ইয়াসীন পাঠ করে, তবে তাকে ক্ষমা করা হবে। (পঠিত আয়াত বা অক্ষরের সংখ্যায় তাকে ক্ষমা করা হবে)।’’
ইবনু আদী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। তাঁরা আমর ইবনু যিয়াদ নামক এক রাবীর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এ ব্যক্তি বলেন, আমাদেরকে ইয়াহইয়া ইবনু সুলাইম বলেন, আমাদেরকে হিশাম ইবনু উরওয়া বলেন, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি আয়েশা (রা) থেকে, তিনি আবূ বাকর (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে...।
এ হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী ‘আমর ইবনু যিয়াদ’-ক মুহাদ্দিসগণ জালিয়াত ও হাদীস চোর বলে সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। এজন্য ইবনু আদী, যাহাবী, ইবনুল জাওযী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন। ইমাম সুয়ূতী এ হাদীসকে শুক্রবারে কবর যিয়ারত বিষয়ক হাদীসের সমার্থক বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আব্দুর রাঊফ মুনাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর প্রতিবাদ করে বলেন, প্রথমত, উভয় হাদীসের মধ্যে অর্থগত পার্থক্য রয়েছে। দ্বিতীয়ত, উভয় হাদীসের সনদেই জালিয়াত রাবী রয়েছে। জাল হাদীসের ক্ষেত্রে একাধিক হাদীসের সমন্বিত অর্থ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে না।[2]
[1] বিস্তারিত দেখুন: লেখকের অন্য বই, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৩৫৪-৩৫৫।
[2] ইবনু আদী, আল-কামিল ৫/১৫১; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৪১৩; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/৩১৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৪৪০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩৭৩; মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৬/১৪১; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১২৬-১২৮; যায়ীফুল জামি, পৃ. ৮০৮।
৯. কবর যিয়ারতের সময় সূরা ইখলাস পাঠ
প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে রয়েছে: ‘‘কবরস্থানে যেয়ে সূরা ইখলাস ১১ বার পাঠ করে মৃত ব্যক্তিগণের রূহের উপর বখশিয়া দিলে সে ব্যক্তি কবরস্থানের সমস্ত কবরবাসীর সম সংখ্যক নেকী লাভ করবে’’। মূলত কথাটি একটি জাল হাদীসের প্রচলিত অনুবাদ। জাল হাদীসটিতে বলা হয়েছে:
مَنْ
مَرَّ بِالْمَقَابِرِ فَقَرَأَ (قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ) إِحْدَى وَعِشْرِيْنَ
مَرَّةً ثُمَّ وَهَبَ أَجْرَهُ لِلأَمْوَاتِ أُعْطِيَ مِنَ الأَجْرِ بِعَدَدَ
الأَمْوَاتِ
‘‘যদি কেউ গোরস্থানের নিকট দিয়ে গমন করার সময় ২১ বার ‘সূরা ইখলাস’ পাঠ করে তার সাওয়াব মৃতগণকে দান করে তবে মৃতগণের সংখ্যার সমপরিমাণ সাওয়াব তাকে প্রদান করা হবে।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল।[1]
[1] সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১৪৪; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২১৯-২২০; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৭১; আলবানী, যায়ীফাহ ৩/৪৫২-৪৫৪।
১০. মৃত্যুর সময় শয়তান পিতামাতার রূপ ধরে আসে
সাধারণের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে শয়তান তার পিতামাতার রূপ ধরে আগমন করে এবং তাকে বিভিন্ন ওয়াসওয়াসার মাধ্যমে বিপথগামী করার চেষ্টা করে। ইমাম সুয়ূতী, ইবনু হাজার মাক্কী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এ বিষয়ে কোনো কথা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।[1]
[1] আলবানী, আহকামুল জানাইয, পৃ. ২৪৩।
১১. গায়েবানা জানাযা আদায় করা
যে মৃতব্যক্তির মৃত্যুর স্থানে একবার জানাযার সালাত আদায় করা হয়েছে তার জন্য পুনরায় ‘গায়েবী জানাযা’ আদায় করার পক্ষে কোনোরূপ হাদীস বর্ণিত হয় নি; বরং এ কর্মটি সুন্নাত বিরোধী একটি কর্ম। ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[1]
নিজামউদ্দীন আউলিয়ার নামে প্রচলিত ‘রাহাতিল কুলুব’ নামক বইয়ে আছে যে, ফরীদউদ্দীন গঞ্জেশক্কর বলেন: ‘‘গায়েবানা জানাজার নামাজ পড়ার বিধান রয়েছে। কেননা আমীরুল মুমেনীন হযরত হামযাহ ও অন্যান্যরা যখন শহীদ হলেন তখন হুজুর পাক (ﷺ) তাঁদের জন্য গায়েবানা জানাজার নামাজ পাঠ করেছিলেন। এমনকি প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক ভাবে পড়েছিলেন।’’[2]
এসকল কথা কি সত্যিই খাজা নিজামউদ্দীন (রাহ) লিখেছেন, না তাঁর নামে জালিয়াতি করা হয়েছে তা আমরা জানি না। তবে সর্বাবস্থায় এগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন কথা। একজন সাধারণ মুসলিমও জানেন যে, হামযা (রা) উহদের যুদ্ধে শহীদ হন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
[1] এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৩৩৫। আরো দেখুন: আলবানী, আহকামুল জানাইয, পৃ. ২৫২।
[2] খাজা নিজামউদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১২৬ (বিংশ মাজলিস)।
১২. মৃত লাশকে সামনে রেখে উপস্থিতগণকে প্রশ্ন করা
আমাদের দেশে অনেক সময় সালাতুল জানাযা আদায়ের পূর্বে বা পরে মৃতদেহ সামনে রেখে উপস্থিত মুসল্লীগণকে প্রশ্ন করা হয়, লোকটি কেমন ছিল? সকলেই বলেন: ভাল ছিল... ইত্যাদি। এ কর্মটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। হাদীস শরীফে এরূপ কোনো কর্মের উল্লেখ নেই। হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনো মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে যদি মানুষেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশংসা করেন তবে তা সেই ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর বলে গণ্য হবে।[1]
[1] বুখারী, আস-সহীহ ১/৪৬০; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৫৫।
১৩. মৃতকে কবরে রাখার সময় বা পরে আযান দেওয়া
প্রচলিত আরেকটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কর্ম হলো মৃতকে কবরে রাখার সময় বা পরে আযান দেওয়া। কোনো সহীহ যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসেও এরূপ কোনো কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা কোনো সাহাবী থেকে বর্ণিত হয় নি। এমনকি নামাযের ওয়াক্ত ছাড়া অন্য কোনো কারণে আযান দেয়ার কোনো প্রকারের ফযীলতও কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
১৪. ভূত-প্রেতের ধারণা
আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও ইসলাম বিরোধী ধারণা হলো ভুত-প্রেতের ধারণা। মৃত মানুষের আত্মা ভুত বা প্রেত হয়ে বা অন্য কোনোভাবে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, অবস্থান করে, ভাল বা মন্দ করতে পারে... ইত্যাদি সকল কথাই জঘন্য মিথ্যা ও ইসলামী বিশ্বাসের বিপরীত কথা। এ জাতীয় বাতিল কথা হলো, মৃতের আত্মা তার মৃত্যুর স্থানের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়... ইত্যাদি।
১৫. মৃত্যুর পরে লাশের নিকট কুরআন তিলাওয়াত করা
মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ মুহূর্তগুলোতে সূরা ইয়াসীন পাঠ করে শুনানোর বিষয়ে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[1] কিন্তু মৃত্যুর পরে লাশের কাছে কুরআন তিলাওয়াত করার বিষয়ে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস বর্ণিত হয় নি।
[1] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৩/১৯১।
১৬. লাশ বহনের সময় সশব্দে কালিমা, দোয়া বা কুরআন পাঠ
এটি একটি বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও সুন্নাতের বিপরীত কর্ম। লাশ বহনের সময় পরিপূর্ণ নীরবতাই সুন্নাত। মনের গভীরে শোক ও মৃত্যু চিন্তা নিয়ে নীরবে পথ চলতে হবে। পরস্পরে কথাবার্তা বলাও সুন্নাত বিরোধী। ইমাম নাবাবী বলেন, লাশ বহনের সময় সম্পূর্ণ নীরব থাকাই হলো সুন্নাত সম্মত সঠিক কর্ম যা সাহাবীগণ ও পরবর্তী যুগের মানুষদের রীতি ছিল। প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা কাসানী বলেন:
وَيُطِيلُ
الصَّمْتَ إذَا اتَّبَعَ الْجِنَازَةَ وَيُكْرَهُ رَفْعُ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ
لِمَا رُوِيَ عَنْ قَيْسِ بْنِ عُبَادَةَ أَنَّهُ قَالَ : كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ
اللَّهِ ﷺ يَكْرَهُونَ
الصَّوْتَ عِنْدَ ثَلاثَةٍ: عِنْدَ الْقِتَالِ، وَعِنْدَ الْجِنَازَةِ،
وَالذِّكْرِ؛ وَلأَنَّهُ تَشَبُّهٌ بِأَهْلِ الْكِتَابِ فَكَانَ مَكْرُوهًا .
‘‘লাশের অনুগমনকারী তার নীরবতাকে প্রলম্বিত করবে। এ সময় সশব্দে যিকর করা মাকরূহ। কাইস ইবনু উবাদাহ বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ তিন সময়ে শব্দ করতে অপছন্দ করতেন: যুদ্ধ, জানাযা এবং যিক্র। এছাড়া লাশ বহনের সময় সশব্দে যিক্র করা ইহূদী-নাসারাগণের অনুকরণ; এজন্য তা মাকরূহ।’’[1]
[1] কাসানী, বাদাইউস সানাই’ ১/৩১০।
১৭. কবরের কাছে দান-সাদকা করা
হাদীস শরীফে সন্তানকে তার মৃত পিতামাতার জন্য দান-সাদকা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ দান কবরের নিকট করলে কোনো অতিরিক্ত সাওয়াব বা সুবিধা আছে বলে কোনো হাদীসে কোনোভাবে বর্ণিত হয় নি। বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে দান করার একই অবস্থা।
১৮. সন্তান ছাড়া অন্যদের দান সাদকা
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, সন্তান-সন্ততি বা পরিবারবর্গ ছাড়া অন্য কেউ দান করলে মৃত ব্যক্তি সাওয়াব পাবেন বলে কোনো হাদীসে কোনোভাবে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় বা করা হয় সবই আলিমদের মতামত ভিত্তিক, অথবা মনগড়া ও বানোয়াট।
কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুমিনগণের দায়িত্ব হলো মৃত মুমিনগণের জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করা। আর সন্তানদের দায়িত্ব হলো মৃত পিতামাতার জন্য দোয়া ও ইসতিগফার ছাড়াও দান করা। সন্তান-সন্ততি ছাড়া অন্যান্য মানুষ দোয়া করলে মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন বলে আমরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিশ্চিত জানতে পারি। কিন্তু সন্তান ছাড়া কেউ দান করলে মৃত ব্যক্তি সাওয়াব পাবেন বলে কোনো সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি।
তবে অধিকাংশ আলিম মনে করেন যে, সন্তানের দানের সাওয়াব যেহেতু মৃত ব্যক্তি লাভ করবেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সেহেতু আমরা আশা করতে পারি যে, অন্যান্য মানুষের দানের সাওয়াবও মৃত ব্যক্তি পেতে পারেন। কোনো কোনো আলিম বলেন যে, এক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসের বাইরে আশা পোষণের কোনো ভিত্তি বা যুক্তি নেই। কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে কোনো মুসলিম যে কেনো মৃত মুসলিমের জন্য দোয়া করবেন। আর সন্তানসন্ততি পিতামাতার জন্য দোয়া ছাড়াও দান করবে। আমাদের এর বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।[1]
অধিকাংশ আলিমের ‘আশা’ মেনে নিলেও এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। যেহেতু কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারছি যে, দোয়া ও ইসতিগফার করলেই মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন এবং দোয়ার বিনিময়েই তাকে নেকি ও সাওয়াব দান করা হবে, সেহেতু কুরআন-হাদীসের নির্দেশের বাইরে দান করার প্রয়োজনীয়তা কী? যখন আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারছি যে, ‘হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তিকে আপনি ক্ষমা করুন, তাঁকে মর্যাদা দান করুন... ইত্যাদি’ বলে দোয়া করলেই সে ব্যক্তি উপকৃত হবেন, তখন আমাদের প্রয়োজন কী যে আমরা বলব: ‘‘হে আল্লাহ, আমার এ দানের সাওয়াব অমুককে প্রদান করুন এবং এর বিনিময়ে তাকে ক্ষমা করুন, মর্যাদা বা নেকি দান করুন’’?
সম্ভবত আমরা মনে করি যে, দান-সাদকাসহ দোয়া করলে মৃতব্যক্তি বেশি সাওয়াব লাভ করবে। ‘গাইবী’ বিষয়ে নিজেরা ‘মনে’ করার চেয়ে ‘ওহী’-র উপর নির্ভর করা উত্তম। কুরআন ও হাদীসে দোয়া ও ইসতিগফারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে আজীবন অগণিত মুমিন-মুমিনার জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করেছেন, কিন্তু কখনোই শেখান নি যে, কবর যিয়ারত বা অন্য সময়ে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া-ইসতিগফারের পূর্বে, পরে বা অন্য সময়ে কিছু দান-সাদকা বা খানা বিতরণ করা ভাল। তিনি নিজেও কখনো তা করেন নি এবং কাউকে তা শিক্ষাও দেন নি। সাহাবীগণও মৃতদের জন্য দোয়া-ইসতিগফার করেছেন এবং কবর যিয়ারত করেছেন, কিন্তু কখনোই কবরের পাশে বা অন্য কোথাও মৃতদের ‘সাওয়াব রেসানী’-র জন্য দান-খয়রাত করেছেন বলে সহীহ সনদে বর্ণিত হয় নি। আমাদের উচিত সুন্নাতের শিক্ষার মধ্যে থাকা। সকল মুমিনই নিজের সাওয়াব অর্জন, বিপদ মুক্তি ও বরকতের জন্য সর্বদা বেশি বেশি দান-সাদকা করতে চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি সন্তান-সন্ততি তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য দোয়া, ইসতিগফার ও দান করবে। আর অন্য সকল মুসলমান সকল মৃত মুমিন-মুমিনার জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করবে।
[1] এ বিষয়ক আয়াত, হাদীস ও আলিমদের মতামত বিস্তারিত দেখুন: ইবনুল কাইয়িম, আর-রূহ, পৃ. ৩৫৩-৪০৯; সুয়ূতী, শরাহুস সুদূর, পৃ. ৩০১-৩১৪।
১৯. মৃতের জন্য জীবিতের হাদিয়া
প্রচলিত ওয়ায-আলোচনায় একটি হাদীসে বলা হয় যে, মৃতব্যক্তি হলো ডুবন্ত মানুষের মত, জীবিতদের পক্ষ থেকে কুরআন, কালিমা, দান-খাইরাত ইত্যাদির সাওয়াব ‘হাদিয়া’ পাঠালে সে উপকৃত হয়। প্রকৃতপক্ষে হাদীসটিতে শুধু দোয়া-ইসতিগফারের কথা বলা হয়েছে, বাকি কথাগুলি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। মূল হাদীসটিও অত্যন্ত দুর্বল। ইমাম বাইহাকী তৃতীয় শতকের এজন অজ্ঞাত পরিচয় রাবী মুহাম্মাদ ইবনু জাবির ইবনু আবী আইয়াশ আল-মাসীসীর সূত্রে হাদীসটি সংকলন করেছেন। এ ব্যক্তি বলেন, তাকে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, তাকে ইয়াকূব ইবনু কা’কা বলেছেন, মুজাহিদ থেকে, তিনি ইবনু আববাস থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
مَا
الْمَيِّتُ فِيْ الْقَبْرِ إِلاَّ كَالْغَرِيْقِ الْمُتَغَوِّثِ يَنْتَظِرُ
دَعْوَةً تَلْحَقُهُ مِنْ أَبٍ أَوْ أُمٍّ أَوْ أَخٍ أَوْ صَدِيْقٍ فَإِذَا
لَحِقَتْهُ كَانَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا وَإِنَّ اللهَ
لَيُدْخِلُ عَلَى أَهْلِ الْقُبُوْرِ مِنْ دُعَاءِ أَهْلِ الأَرْضِ أَمْثَالَ
الْجِبَالِ وَإِنَّ هَدِيَّةَ الأَحْيَاءِ إِلَى الأَمْوَاتِ الاسْتِغْفَارُ
لَهُمْ
‘‘ডুবন্ত ত্রাণপ্রার্থী ব্যক্তির যে অবস্থা, অবিকল সে অবস্থা হলো কবরের মধ্যে মৃতব্যক্তির। সে দোয়ার অপেক্ষায় থাকে, যে দোয়া কোনো পিতা, মাতা, ভাই বা বন্ধুর পক্ষ থেকে তার কাছে পৌঁছাবে। যখন এরূপ কোনো দোয়া তার কাছে পৌঁছে তখন তা তার কাছে দুনিয়া ও তন্মধ্যস্থ সকল সম্পদের চেয়ে প্রিয়তর বলে গণ্য হয়। এবং মহিমাময় পরাক্রমশালী আল্লাহ পৃথিবীবাসীদের দোয়ার কারণে কবরবাসীদেরকে পাহাড় পরিমাণ (সাওয়াব) দান করেন। আর মৃতদের প্রতি জীবিতদের হাদিয়া হলো তাদের জন্য ইসতিগফার বা ক্ষমা-প্রার্থনা করা।’’
ইমাম বাইহাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, একমাত্র মুহাম্মাদ ইবনু জাবির ইবনু আবী আইয়াশ নামক এ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সূত্রে কোনোভাবে এই হাদীসটি বর্ণিত হয় নি।[1] ইমাম যাহাবী এ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেন: ‘‘এ ব্যক্তির কোনো পরিচয়ই আমি জানতে পারি নি। এ ব্যক্তি বর্ণিত হাদীসটি অত্যন্ত আপত্তিকর বা খুবই দুর্বল (منكر جدا)।’’[2]
[1] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৬/২০৩, ৭/১৬।
[2] যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/৮৬; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৫/৯৯; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২১৬; আলবানী, যায়ীফাহ ২/২১১।
২০. মৃতের জন্য খানাপিনা, দান বা দোয়ার অনুষ্ঠান
মৃত ব্যক্তির জন্য মৃত্যুর পরে ৩য় দিন, ৭ম দিন, ৪০তম দিন, অন্য যে কোনো দিনে, মৃত্যু দিনে বা জন্ম দিনে খানাপিনা, দান-সাদকা, দোয়া-খাইর ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত রীতি। তবে রীতিটি একেবারেই বানোয়াট। এ সকল দিবসে মৃতের জন্য কোনো অনুষ্ঠান করার বিষয়ে কোনো প্রকার হাদীস বর্ণিত হয় নি। কোনো মানুষের মৃত্যুর পরে কখনো কোনো প্রকারের অনুষ্ঠান করার কোনো প্রকারের নির্দেশনা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। সদা সর্বদা বা সুযোগমত মৃতদের জন্য দোয়া করতে হবে। সন্তানগণ দান করবেন। এবং সবই অনানুষ্ঠানিক। এ বিষয়ে ‘এহইয়াউ সুনান’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[1]
[1] এহইয়াউস সুনান পৃ. ৩৪৭-৩৫৯।
২১. অসুস্থ ও মৃত ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন প্রকারের খতম
খতমে তাহলীল, খতমে তাসমিয়া, খতমে জালালী, খতমে খাজেগান, খতমে ইউনূস ইত্যাদি সকল প্রকার ‘খতম’ পরবর্তী কালে বানানো। এ বিষয়ে হাদীস নামে প্রচলিত বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে আছে, হযরত (ﷺ) ফরমাইয়াছেন, যখন কেহ নিম্নোক্ত কলেমা (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার পড়িয়া কোন মৃত ব্যক্তির রূহের উপর বখশিশ করিয়া দিবে, তখন নিশ্চয়ই খোদাতাআলা উহার উছিলায় তাহাকে মার্জনা করিয়া দিবেন ও বেহেশ্তে স্থান দিবেন।’’[1] এগুলো সবই বানোয়াট কথা।
[1] গোলাম রহমান, মোকছুদোল মো'মেনীন, পৃ. ৪০৭।
২২. মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন খতম
আমাদের দেশের অতি প্রচলিত কর্ম কারো মৃত্যু হলে তার জন্য কুরআন খতম করা। এ কর্মটি কোনো হাদীস ভিত্তিক কর্ম নয়। কোনো মৃত মানুষের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ কখনো কুরআন খতম করেন নি। এছাড়া কারো জন্য কুরআন খতম করলে তিনি সাওয়াব পাবেন এরূপ কোনো কথাও কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, কুরআন ও হাদীসে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সন্তানগণকে মৃত পিতামাতার জন্য দান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ, সিয়াম পালন, হজ্জ ও উমরা পালনের কথাও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন খতম, তাসবীহ তাহলীল পাঠ ইত্যাদি ইবাদতের কোনো নির্দেশনা হাদীসে বর্ণিত হয় নি। তবে অধিকাংশ আলিম বলেছেন যে, যেহেতু দান, সিয়াম, হজ্জ, উমরা ও দোয়ার দ্বারা মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সেহেতু আশা করা যায় যে, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ তাহলীল ইত্যাদি ইবাদত দ্বারাও তারা উপকৃত হবেন। তবে এজন্য আনুষ্ঠানিকতা, খতম ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
২৩. দশ প্রকার লোকের দেহ পচবে না
প্রচলিত একটি পুস্তকে রয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, নিম্নলিখিত দশ প্রকার লোকের দেহ কবরে পচবে না: ১- পয়গম্বর, ২-শহীদ, ৩- আলেম, ৪- গাজী, ৫- কুরআনের হাফেয, ৬- মোয়ায্যিন, ৭- সুবিচারক বাদশাহ বা সরদার, ৮-সূতিকা রোগে মৃত রমণী, ৯-বিনা অপরাধে যে নিহত হয়, ১০-শুক্রবারে যার মৃত্যু হয়।’’[1]
এদের অনেককেই হাদীসে শহীদ বলা হয়েছে। তবে একমাত্র নবীগণ বা পয়গম্বরগণের দেহ মাটিতে পচবে না বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। অন্য নয় প্রকারের মৃতগণের মৃতদেহ না পচার বিষয়ে কোনো হাদীস আছে বলে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করেও জানতে পারি নি। আল্লাহই ভাল জানেন।
[1] মৌলভী শামছুল হুদা, নেয়ামুল কোরআন ২৪৫।
(খ) কুরআন সংশ্লিষ্ট দুআ-তদবীর
আমাদের দেশে কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরা বা আয়াত বিষয়ক দু প্রকারের কথা প্রচলিত। এক প্রকারের কথা ফযীলত বা আখিরাতের মর্যাদা, সাওয়াব, আল্লাহর দয়া ইত্যাদি বিষয়ক। দ্বিতীয় প্রকারের কথা ‘তদবীর’ বা দুনিয়ায় বিভিন্ন ফলাফল লাভ বিষয়ক।
উমার আল-মাউসিলীর আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন সূরা ও আয়াতের ফযীলতে কিছু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া প্রচলিত বাকি হাদীসগুলো অধিকাংশই যয়ীফ অথবা বানোয়াট। বিশেষত, তাফসীর কাশ্শাফ ও তাফসীর বায়যাবীর প্রতিটি সূরার শেষে সে সূরার ফযীলত বিষয়ক যে সকল কথা বলা হয়েছে তা মূলত এ বিষয়ক দীর্ঘ জাল হাদীসটি থেকে নেওয়া হয়েছে। আমাদের সমাজে প্রচলিত পাঞ্জ-সূরার ফযীলত বিষয়ক অধিকাংশ কথাই যয়ীফ অথবা জাল। এ বিষয়ক যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এগুলোর বিস্তারিত আলোচনার জন্য পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন। এ বইয়ের কলেবর ইতোমধ্যেই অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এজন্য আমরা এ বইয়ে ফযীলত বিষয়ক যয়ীফ ও জাল হাদীসগুলো আর আলোচনা করছি না। বরং এখানে আমল-তদবীর বিষয়ক কিছু কথা উল্লেখ করছি।
কুরআনের আয়াত দ্বারা ঝাড়ফুঁক দেওয়া বা এগুলোর পাঠ করে রোগব্যাধি বা বিপদাপদ থেকে মুক্তির জন্য ‘আমল’ করা বৈধ। হাদীস শরীফে ‘কুরআন’ দ্বারা ‘রুক্ইয়া’ বা ঝাড়ফুঁক করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া হাদীসের দোয়া বা যে কোনো ভাল অর্থের বাক্য দ্বারা ঝাড়ফুঁক দেয়া বৈধ।
ঝাড়ফুঁক বা তদবীর দুই প্রকারের। কিছু ঝাড়ফুঁক বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ প্রকারের ঝাড়ফুঁক ও আমল সীমিত। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ঝাড়ফুঁক, আমল ইত্যাদি পরবর্তী যুগের বুযুর্গদের অভিজ্ঞতার আলোকে বানানো। যেমন, অমুক সূরা বা অমুক আয়াতটি এত বার বা এত দিন বা অমুক সময়ে পাঠ করলে অমুক ফল লাভ হয় বা অমুক রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এইরূপ সকল আমল বা তদবীরই বিভিন্ন বুযুর্গের অভিজ্ঞতা প্রসূত।
কেউ ব্যক্তিগত আমল বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ‘তদবীর’ বা ‘রুকইয়া শরঈয়্যা’ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। তবে এগুলির কোনো খাস ফযীলত আছে বা এগুলি হাদীস-সম্মত এরূপ ধারণা করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে মিথ্যা বলা হবে। এছাড়া তদবীর বা আমল হিসেবেও আমাদের উচিত সহীহ হাদীসে উল্লিখিত তদবীর, দোয়া ও আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা। ঝাড়ফুঁক, ও দুআ-তাবীজ, যাদু-জিন ইত্যাদি বিষয়ক মাসনূন, জায়েয ও নিষিদ্ধ বিষয়াদি বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘রাহে বেলায়াত’ বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে।
(গ) আমল-তদবীর ও খতম
হাদীসের নামে যে সকল বানোয়াট ‘আমল’ বা ‘তদবীর’ আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. লা হাওলা .... দারিদ্র্য বিমোচনের আমল
(লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ) এ যিক্রটির ফযীলতে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে এ বাক্যটিকে বেশিবেশি করে বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বাক্যটি জান্নাতের অন্যতম ধনভান্ডার, গোনাহ মাফের ও অফুরন্ত সাওয়াব লাভের অসীলা বলে বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে। এ বিষয়ক কিছু সহীহ হাদীস আমি ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থে হাদীস হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি এ বাক্যটি প্রত্যহ ১০০ বার পাঠ করবে সে কখনো দরিদ্র থাকবে না।’ কথাটি দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত।[1]
অনুরূপভাবে অন্য একটি দুর্বল সনদের হাদীসে বলা হয়েছে যে, ‘লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম’ ৯৯ টি রোগের প্রতিষেধক, সেগুলোর সহজতম রোগ দুশ্চিন্তা।’’[2]
২. ঋণমুক্তির আমল
আলী (রা) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, নিম্নের বাক্যটি বললে পাহাড় পরিমাণ ঋণ থাকলেও আল্লাহ তা পরিশোধ করাবেন:
اللَّهُمَّ
اكْفِنِي بِحَلَالِكَ عَنْ حَرَامِكَ وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ
‘‘হে আল্লাহ, আপনি আপনার হালাল প্রদান করে আমাকে হারাম থেকে রক্ষা করুন এবং আপনার দয়া ও বরকত প্রদান করে আমাকে আপনি ছাড়া অন্য সকলের অনুগ্রহ থেকে বিমুক্ত করে দিন।’’ হাদীসটি সহীহ।[3]
কিন্তু কোনো বিশেষ দিনে বা বিশেষ সংখ্যায় দোয়াটি পাঠ করার বিষয়ে কোনো নির্দেশ কোনো হাদীসে দেওয়া হয় নি। প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি শুক্রবার দিনে ৭০ বার এ দোয়া পড়বে, অল্প দিনের মধ্যে আল্লাহ তাকে ধনী ও সৌভাগ্যশালী করে দিবেন। হযরত আলী (রা) বলেছেন: শুক্রবার দিন জুমুয়ার নামাযের পূর্বে ও পরে ১০০ বার করে দরুদ পড়ে এ দোয়া ৫৭০ বার পাঠ করলে পাহাড় পরিমান ঋণ থাকলেও তাহা অল্প দিনের মধ্যে পরিশোধ হয়ে যাবে...।’’ এ বর্ণনাগুলো ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে প্রতীয়মান হয়।
৩. সূরা ফাতিহার আমল
সূরা ফাতিহার ফযীলতে বলা হয় :
اَلْفَاتِحَةُ
لِمَا قُرِئَتْ لَهُ
‘‘ফাতিহা যে নিয়েতে পাঠ করা হবে তা পুরণ হবে।’’
এ কথাটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। আরেকটি কথা বলা হয়:
فَاتِحَةُ
الْكِتَابِ شِفَاءٌ مِنْ كُلِّ دَاءٍ
‘‘সূরা ফাতিহা সকল রোগের আরোগ্য বা শেফা।’’
এ কথাটি একটি যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।[4]
৪. বিভিন্ন প্রকারের খতম
বিভিন্ন প্রকারের ‘খতম’ প্রচলিত আছে। সাধারণত, দুটি কারণে ‘খতম’ পাঠ করা হয়: (১) বিভিন্ন বিপদাপদ কাটানো বা জাগতিক ফল লাভ ও (২) মৃতের জন্য সাওয়াব পাঠানো। উভয় প্রকারের খতমই ‘বানোয়াট’ ও ভিত্তিহীন। এ সকল খতমের জন্য পঠিত বাক্যগুলো অধিকাংশই খুবই ভাল বাক্য। এগুলো কুরআনের আয়াত বা সুন্নাত সম্মত দোয়া ও যিক্র। কিন্তু এগুলো এক লক্ষ বা সোয়া লক্ষ বার পাঠের কোনো নির্ধারিত ফযীলত, গুরুত্ব বা নির্দেশনা কিছুই কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে বলা হয় নি। এ সকল ‘খতম’ সবই বানোয়াট। উপরন্তু এগুলোকে কেন্দ্র করে কিছু হাদীসও বানানো হয়েছে।
‘বিসমিল্লাহ’ খতম, দোয়া ইউনুস খতম, কালেমা খতম ইত্যাদি সবই এ পর্যায়ের। বলা হয় ‘সোয়া লাখ বার বিসমিল্লাহ পড়লে অমুক ফল লাভ করা যায়’ বা ‘সোয়া লাখ বার দোয়া ইউনূস পাঠ করলে অমুক ফল পাওয়া যায়’ ইত্যাদি। এগুলো সবই বুযুর্গদের অভিজ্ঞতার আলোকে বানানো এবং কোনোটিই হাদীস নয়। তাসমিয়া বা (বিসমিল্লাহ), তাহলীল বা (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও দোয়া ইউনুস-এর ফযীলত ও সাওয়াবের বিষয়ে সহীহ হাদীস রয়েছে।[5] তবে এগুলি ১ লক্ষ, সোয়া লক্ষ ইত্যাদি নির্ধারিত সংখ্যায় পাঠ করার বিষয়ে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি। খতমে খাজেগানের মধ্যে পঠিত কিছু দোয়া মাসনূন ও কিছু দোয়া বানানো। তবে পদ্ধিতিটি পুরোটাই বানানো।
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, এ সকল খতমের কারণে সমাজে এ ধরনের ‘‘পুরোহিততন্ত্র’’ চালু হয়েছে। ইসলামের নির্দেশনা হলো, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি ইউনূস (আ)-এর মতই নিজে ‘‘দুআ ইউনূস’’ বা অন্যান্য সুন্নাত সম্মত দুআ পড়ে মনের আবেগে আল্লাহর কাছে কাঁদবেন এবং বিপদমুক্তি প্রার্থনা করবেন। একজনের বিপদে অন্যজন কাঁদবেন, এমনটি নয়। বিপদগ্রস্ত মানুষ অন্য কোনো নেককার আলিম বা বুজুর্গের কাছে দুআ চাইতে পারেন। তবে এখানে কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে:
(১) অনেকে মনে করেন, জাগতিক রাজা বা মন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে যেমন মধ্যস্থতাকারী বা সুপারিশকারীর প্রয়োজন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেও অনুরূপ কিছুর প্রয়োজন। আলিম-বুজুর্গের সুপারিশ বা মধ্যস্থতা ছাড়া আল্লাহর কাছে দুআ বোধহয় কবুল হবে না। এ ধরনের চিন্তা সুস্পষ্ট শিরক। আমি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। জাগতিক সম্রাট, মন্ত্রী, বিচারক বা নেতা আমাকে ভালভাবে চিনেন না বা আমার প্রতি তার মমতা কম এ কারণে তিনি হয়ত আমার আবেদন রাখবেন না বা পক্ষপাতিত্ব করবেন। কিন্তু মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে কি এরূপ চিন্তা করা যায়? ইসলামের বিধিবিধান শিখতে, আত্মশুদ্ধির কর্ম শিখতে, কর্মের প্রেরণা ও উদ্দীপনা পেতে বা আল্লাহর জন্য মহববত নিয়ে আলিম ও বুজুর্গগণের কাছে যেতে হয়। প্রার্থনা, বিপদমুক্তি ইত্যাদির জন্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হয়।
(২) কুরআন কারীম ও বিভিন্ন সহীহ হাদীসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, যে কোনো মুমিন নারী বা পুরুষ যে কোনো অবস্থায় আল্লাহর কাছে নিজের মনের আবেগ প্রকাশ করে দুআ করলে ইবাদত করার সাওয়াব লাভ করবেন। এছাড়া আল্লাহ তার দুআ কবুল করবেন। তিনি তাকে তার প্রার্থিত বিষয় দান করবেন, অথবা এ প্রার্থনার বিনিময়ে তার কোনো বিপদ কাটিয়ে দিবেন অথবা তার জন্য জান্নাতে কোনো বড় নিয়ামত জমা করবেন। ‘‘রাহে বেলায়াত’’ গ্রন্থে আমি এ বিষয়ক হাদীসগুলো সনদ-সহ আলোচনা করেছি।
(৩) নিজে দুআ করার পাশাপাশি জীবিত কোনো আলিম-বুজুর্গের কাছে দুআ চাওয়াতে অসুবিধা নেই। তবে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নিজের জন্য নিজের দুআই সর্বোত্তম দুআ। এছাড়া দুআর ক্ষেত্রে মনের আবেগ ও অসহায়ত্বই দুআ কবুলের সবচেয়ে বড় অসীলা। আর বিপদগ্রস্ত মানুষ যতটুকু আবেগ নিয়ে নিজের জন্য কাঁদতে পারেন, অন্য কেউ তা পারে না।
(৪) অনেকে মনে করেন, আমি পাপী মানুষ আমার দুআ হয়ত আল্লাহ শুনবেন না। এ চিন্তুা খুবই আপত্তিকর ও আল্লাহর রহমত থেকে হতাশার মত পাপের পথ। কুরআনে একাধিক স্থানে বলা হয়েছে যে, কাফির-মুশরিকগণও যখন অসহায় হয়ে মনের আবেগে আল্লাহর কাছে দুআ করত, তখন আল্লাহ তাদের দুআ কবুল করতেন। কুরআন ও হাদীসে বারংবার বলা হয়েছে যে, পাপ-অন্যায়ের কারণেই মানুষ বিপদগ্রস্ত হয় এবং বিপদগ্রস্ত পাপী ব্যক্তির মনের আবেগময় দুআর কারণেই আল্লাহ বিপদ কাটিয়ে দেন।
(৫) হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে, ‘‘দুআ ইউনূস’’ পাঠ করে দুআ করলে আল্লাহ কবুল করবেন। (লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যালিমীন) অর্থ- আপনি ছাড়া কোনো মাবূদ নেই, আপনি মহা-পবিত্র, নিশ্চয় আমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছি। এর মর্মার্থ হলো: ‘‘বিপদে ডাকার মত, বিপদ থেকে উদ্ধার করার মত বা বিপদে আমার ডাক শুনার মত আপনি ছাড়া কেউ নেই। আমি অপরাধ করে ফেলেছি, যে কারণে এ বিপদ। আপনি এ অপরাধ ক্ষমা করে বিপদ কাটিয়ে দিন।’’ আল্লাহর একত্বের ও নিজের অপরাধের এ আন্তরিক স্বীকারোক্তি আল্লাহ এত পছন্দ করেন যে, এর কারণে আল্লাহ বিপদ কাটিয়ে দেন।
(৬) ‘‘খতম’’ ব্যবস্থা চালু করার কারণে এখন আর বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে দুআ ইউনূস পাঠ বা খতম করে কাঁদেন না। বরং তিনি নির্দিষ্ট সংখ্যক আলিম-বুজুর্গকে দাওয়াত দেন। যারা সকলেই বলেন: ‘‘নিশ্চয় আমি যালিম বা অপরাধী’’। আর যার অপরাধে আল্লাহ তাকে বিপদ দিয়েছেন তিনি কিছুই বলেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দাওয়াতকৃত আলিমগণ প্রত্যেকেই যালিম বা অপরাধী, শুধু দাওয়াতকারী বা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিই নিরপরাধ! মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবনের তাওফীক প্রদান করুন।
[1] মুনযিরী, আত-তারগীব ২/২৯৫; আলবানী, যায়ীফুত তারগীব ১/২৪৬
[2] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২৭২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১০/১২০; আলবানী, যায়ীফুত তারগীব ১/২৪৩, ২৮৬; সাহীহাহ ৪/১০২ (নং ১৫২৮ প্রসঙ্গে)
[3] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৬০, নং ৩৫৬৩, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭২১।
[4] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩০৫, নং ৭৩৪, মুল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৬৫, নং ৬৩৩, ৬৩৪, আলবানী, যায়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ: ৫৭৬, নং ৩৯৫১।
[5] দেখুন, লেখকের অন্য বই: রাহে বেলায়াত, পৃ. ৮১-৯৩, ১৩৩-১৩৪।
(ঘ) যিক্র, দুআ ও ওযীফা
১. মহান আল্লাহর নামের ওযীফা বা আমল
মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلِلَّهِ
الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي
أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ ; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামে ডাকবে। যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করবে। তাদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই তাদেরকে প্রদান করা হবে।’’[1]
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত হাদীসে আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন :
إِنَّ
لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلاَّ وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا
دَخَلَ الْجَنَّةَ
‘‘নিশ্চয় আল্লাহর ৯৯টি নাম আছে, ১০০’র একটি কম, যে ব্যক্তি এ নামগুলো সংরক্ষিত রাখবে বা হিসাব রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[2]
এ হাদীসে নামগুলো বিবরণ দেয়া হয় নি। ৯৯ টি নাম সম্বলিত একটি হাদীস ইমাম তিরমিযী, ইবনু মাজাহ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন।[3] কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিস উক্ত বিবরণকে যয়ীফ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী নিজেই হাদীসটি সংকলন করে তার সনদের দুর্বলতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেন, ৯৯ টি নামের তালিকা রাসূলুল্লাহ ﷺ বা আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত নয়। পরবর্তী রাবী এগুলো কুরআনের আলোকে বিভিন্ন আলিমের মুখ থেকে সংকলিত করে হাদীসের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। কুরআন করীমে উল্লেখিত অনেক নামই এ তালিকায় নেই। কুরআন করীমে মহান আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ডাকা হয়েছে ‘রাবব’ বা প্রভু নামে। এ নামটিও এ তালিকায় নেই।[4]
এক্ষেত্রে আগ্রহী মুসলিম চিন্তা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ৯৯ টি নাম হিসাব রাখতে নির্দেশনা দিলেন কিন্তু নামগুলোর নির্ধারিত তালিকা দিলেন না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে উলামায়ে কেরাম বলেন যে, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আংশিক গোপন রাখা হয়, মুমিনের কর্মোদ্দীপনা বৃদ্ধির জন্য। যেমন, লাইলাতুল কাদ্র, জুম’আর দিনের দোয়া কবুলের সময়, ইত্যাদি। অনুরূপভাবে নামের নির্ধারিত তালিকা না বলে আললাহর নাম সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যেন বান্দা আগ্রহের সাথে কুরআন কারীমে আল্লাহর যত নাম আছে সবই পাঠ করে, সংরক্ষণ করে এবং সে সকল নামে আল্লাহকে ডাকতে থাকে এবং সেগুলির ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে।[5]
কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইমাম তিরমিযী সংকলিত তালিকাটিকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন।[6] সর্বাবস্থায় আগ্রহী যাকির এই নামগুলো মুখস্থ করতে পারেন। এছাড়া কুরআন কারীমে উল্লেখিত আল্লাহর সকল মুবারাক নাম নিয়মিত কুরআন পাঠের মাধ্যমে সংরক্ষিত রাখতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলার বরকতময় নামের ওসীলা দিয়ে কিভাবে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে হবে, মহিমাময় আল্লাহর ‘ইসমু আ’যম’ কি এবং এর মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহ মহান দরবারে দোয়া করতে হবে সে বিষয়ক সহীহ হাদীসগুলি আমি ‘রাহে বেলায়েত’ গ্রন্থে সনদের আলোচনা সহ উল্লেখ করেছি।
আমাদের দেশের প্রচলিত অনেক বইয়ে এ সকল নামের আরো অনেক ফযীলত লেখা হয়েছে। যেমন প্রত্যহ এগুলো পাঠ করলে অন্নকষ্ট হবে না, রোগ ব্যাধি দূর হবে, স্বপ্নযোগে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর যিয়ারত হবে, মনের আশা পূর্ণ হবে, দৈনিক এত বার অমুক নামটি এত দিন পর্যন্ত পড়লে বা লিখলে অমুক ফল লাভ করা যাবে অথবা অমুক নাম প্রতিদিন এত বার এ পদ্ধতিতে করলে অমুক ফল পাওয়া যাবে, অথবা অমুক নাম এতবার পাঠ করতে হবে, ইত্যাদি। এ ধরনের কোনো কথাই কুরআন-হাদীসের কথা নয়। কেউ হয়ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কোনো তদবীর করেছেন বা শিখিয়েছেন। তবে এগুলোকে আল্লাহর কথা বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা মনে করলে বা হাদীস হিসেবে বর্ণনা করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে মিথ্যা বলা হবে।
এ বিষয়ক প্রচলিত জাল হাদীসগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ
২. আল্লাহর যিকর সর্বোত্তম যিকর
বিভিন্ন পুস্তকে হাদীস হিসেবে নিম্নের বাক্যটির উল্লেখ দেখা যায়:
أَفْضَلُ
الذِّكْرِ ذِكْرُ اللهِ
‘‘আল্লাহর যিকর সর্বোত্তম যিকর।’’
অর্থের দিক থেকে কথাটি ঠিক। আল্লাহর যিক্র তো সর্বোত্তম যিক্র হবেই। আল্লাহর যিক্র ছাড়া আর কার যিকির সর্বোত্তম হবে? তবে কথাটি হা্দীস নয়। কোনো সহীহ বা যায়ীফ সনদে তা বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় না।
৩. যিকরে কলবে ও কবরে নূর
একটি ভিত্তিহীন কথা: ‘‘যে ব্যক্তি রাত্রিতে আল্লাহর নাম যিক্র করে তাহার অন্তরে এবং মৃত্যু হইলে তাহার কবরে নূর চমকাইতে থাকিবে।’’[7]
৪. ১০০ বার আল্লাহ নাম ও ৬টি নামের যিকর:
‘‘যে ব্যক্তি ফজরের সময় ‘আল্লাহ’ নামটি ১০০ বার যিক্র করে নিম্নোক্ত ৬টি নাম (জাল্লা জালালুহু, ওয়া আম্মা নাওয়ালুহূ, ওয়া জাল্লা সানাউহু, ওয়া তাকাদ্দাসাত আসমাউহূ, ওয়া আ’যামা শানুহু, ওয়া লা ইলাহা গাইরুহু) একবার করে পড়বে, সে ব্যক্তি গোনাহ হতে এমনভাবে মুক্ত হবে যেন সে এই মাত্র মাতৃগর্ভ হতে জন্মলাভ করল। তার আমলনামা পরিষ্কার থাকবে এবং সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই বেহেশতে প্রবেশ করবে।’[8]
এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা যা রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নামে বলা হয়েছে।
৫. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার খাস যিকর
আল্লাহর যিক্র-এর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘সর্বোত্তম যিকির ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’[9]। আরো বলেন: ‘‘তোমরা বেশি বেশি করে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে।’’[10] অন্যত্র তিনি বলেন: ‘‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বাক্য চারটি : ‘সুব‘হা-নাল্লাহ’, ‘আল-হামদুলিল্লাহ’, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং ‘আল্লা-হু আকবার’। তুমি ইচ্ছামতো এ বাক্য চারটির যে কোনো বাক্য আগে পিছে বলতে পার।’’[11]
এ সকল যিকর-এর গুরত্ব, ফযীলত, সংখ্যা ও সময় বিষয়ক অনেক সহীহ ও হাসান হাদীস আমি ‘রাহে বেলায়াত’ পুস্তকে আলোচনা করেছি। আমরা সেখানে দেখেছি যে, এ সকল যিক্র যপ করার বা উচ্চারণ করার জন্য কোনো বিশেষ পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শেখান নি। কোথাও কোনো একটি সহীহ বা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাউকে টেনে টেনে, বা জোরে জোরে, বা ধাক্কা দিয়ে, বা কোনো ‘লতীফা’র দিকে লক্ষ্য করে, বা অন্য কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে যিক্র করতে শিক্ষা দিয়েছেন। মূল কথা হলো, মনোযোগের সাথে বিশুদ্ধ উচ্চারণে যিক্র করতে হবে এবং প্রত্যেকে তাঁর মনোযোগ ও আবেগ অনুসারে সাওয়াব পাবেন।
পরবর্তী যুগের বিভিন্ন আলিম, পীর ও মুরশিদ মুরিদগণের মনোযোগ ও আবেগ তৈরির জন্য কিছু বিশেষ পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। এগুলো তাঁদের উদ্ভাবন এবং মুরিদের মনোযোগের জন্য সাময়িক রিয়াযত বা অনুশীলন।
তবে জালিয়াতরা এ বিষয়েও কিছু কথা বানিয়েছে। এ জাতীয় একটি ভিত্তিহীন কথা ও জাল হাদীস নিম্নরূপ: ‘‘একদা হযরত আলী (রা) হুযুর (ﷺ)-কে বলিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের জন্য আমাকে সহজ সরল পন্থা বলিয়া দিন। হুযূর (ﷺ) বলিলেন- একটি যিকর করিতে থাক। হযরত আলী বলিলেন- কিভাবে করিব? এরশাদ করিলেন- চক্ষু বন্ধ কর এবং আমার সাথে তিনবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বল। হযরত আলী (রা) ইহা হযরত হাসান বসরীকে এবং হযরত হাসান বসরী হইতে মুরশিদ পরম্পরায় আমাদের নিকট পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে।’’
এ গল্পটির আরেকটি ‘ভার্সন’ নিম্নরূপ: ‘‘আলী (রা) বলেন, খোদা-প্রাপ্তির অতি সহজ ও সরল পথ অবগত হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওহীর অপেক্ষায় থাকেন। অঃপর জিবরাঈল (আ) আগমন করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা’ কালেমা শরীফ তিনবার শিক্ষা দিলেন। জিবরাঈল (আ) যে ভাবে উচ্চারণ করলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও সেভাবে আবৃত্তি করলেন। অতঃপর তিনি আলী (রা)-কে তা শিখিয়ে দিলেন। আলী (রা) অন্যান্য সাহাবীকে তা শিখিয়ে দিলেন।’’
এ হাদীসটি লোকমুখে প্রচলিত ভিত্তিহীন কথা মাত্র। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ সনদেও হাদীসটি কোনো গ্রন্থে সংকলিত হয় নি। এ জন্য শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী উল্লেখ করেছেন যে, তরীকার বুযুর্গগণের মুখেই শুধু এ কথাটি শোনা যায়। এছাড়া এর কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় না।[12]
৬. পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে ওযীফা
অগণিত সহীহ হাদীসে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে বিভিন্ন প্রকারের যিক্র, দোয়া বা ওযীফার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে পালন করতেন বা সাহাবীগণকে ও উম্মাতকে পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এগুলো ছাড়াও কিছু ওযীফা আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত, যা পরবর্তী যুগের মানুষদের বানানো, কোনো হাদীসে তা পাওয়া যায় না। নিম্নের ওযীফাটি খুবই প্রসিদ্ধ:
ফজর নামাযের পরে ১০০ বার (هو الحي القيوم), যোহরের নামাযের পরে ১০০ বার (هو العلي العظيم), আসরের নামাযের পরে ১০০ বার (هو الرحمن الرحيم), মাগরিবের নামাযের পরে ১০০ বার (هو الغفور الرحيم) এবং ঈশার নামাযের পরে ১০০ বার (هو اللطيف الخبير) পাঠ করা।
এ বাক্যগুলো সুন্দর এবং এগুলোর পাঠে কোনো দোষ নেই। কিন্তু এগুলোর কোনোরূপ ফযীলত, এগুলোকে এত সংখ্যায় বা অমুক সময়ে পড়তে হবে এমন কোনো প্রকারের নির্দেশনা কুরআন বা হাদীসে নেই। আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শেখানো ওযীফাগুলো পালন করা।
৭. ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম...-এ সংযোজন
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরয নামাযের সালাম ফিরিয়ে বলতেন:
اللهُمَّ
أَنْتَ السَّلاَمُ وَمِنْكَ السَّلاَمُ تَبَارَكْتَ ذَا الجَلاَلِ وَالإِكْرَامِ
‘‘হে আল্লাহ, আপনিই সালাম (শান্তি), আপনার থেকেই শান্তি, হে মহাসম্মানের অধিকারী ও মর্যাদা প্রদানের অধিকারী, আপনি বরকতময়।’’[13]
অনেকে এ বাক্যগুলোর মধ্যে কিছু বাক্য বৃদ্ধি করে বলেন:
إِلَيْكَ
يَرْجِعُ السَّلاَمُ، فَحَيِّنَا رَبَّنَا بِالسَّلاَمِ، وَأَدْخِلْنَا دَارَكَ
دَارَ السَّلاَمِ...
মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি), আল্লামা আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ তাহতাবী হানাফী (১২৩১ হি) প্রমুখ আলিম বলেছেন যে, এ অতিরিক্ত বাক্যগুলো ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। কিছু ওয়ায়িয এগুলো বানিয়েছেন।[14]
৮. দোয়ায়ে গঞ্জল আরশ
প্রচলিত মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়াগুলোর অন্যতম দোয়ায়ে গঞ্জল আরশ বা কানযুল আরশ। এর মধ্যে যে বাক্যগুলো বলা হয় তার অর্থ ভাল। তবে এভাবে এ বাক্যগুলো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বাক্যগুলোর সম্মিলিতরূপ এভাবে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বাক্যগুলোর ফযীলত ও সাওয়াবে যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা কথা।
৯. দোয়ায়ে আহাদ নামা
অনুরূপ একটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়া ‘দোয়ায়ে আহাদ নামা’। প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে এ দোয়াটি বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দোয়ার মূল বাক্যগুলো একাধিক যয়ীফ সনদে বর্ণিত হাদীসে পাওয়া যায়। এ সকল হাদীসে এ দোয়াটি সকালে ও সন্ধ্যায় পাঠ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফযীলত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি কেউ এ দোয়াটি সকাল সন্ধ্যায় পাঠ করেন তবে কিয়ামতের দিন সে মুক্তি লাভ করবে...।[15]
এছাড়া এ দোয়ার ফযীলত ও আমল সম্পর্কে প্রচলিত সব কথাই বানোয়াট। এরূপ বানোয়াট কথাবার্তার একটি নমুনা দেখুন: ‘‘তিরমিজী, শামী ও নাফেউল খালায়েক কিতাবে ‘দোয়ায়ে আহাদনামা’ সম্পর্কে বহু ফজীলতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি ইসলামী জিন্দেগী যাপন করে জীবনে আহাদনামা ১০০ বার পাঠ করবে সে ঈমানের সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে এবং আমি তার জান্নাতের জামিন হব।... হজরত জাবির (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে শুনেছি, মানব দেহে আল্লাহ তায়ালা তিন হাজার রোগব্যাধি দিয়েছেন। এক হাজার হাকিম ডাক্তারগণ জানেন এবং চিকিৎসা করেন। দু’হাজার রোগের ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া কেহ জানেন না। যদি কেহ আহাদনামা লিখে সাথে রাখে অথবা দু’বার পাঠ করে আল্লাহ তায়ালা তাকে দু’হাজার ব্যাধি থেকে হিফাজত করবেন। ...’’[16]
এগুলো সবই ভিত্তিহীন ও জাল কথা। সুনানুত তিরমিযী বা অন্য কোনো হাদীস-গ্রন্থে এ সকল কথা সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি।
১০. দোয়ায়ে কাদাহ
প্রচলিত আরেকটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়া ‘দোয়ায়ে কাদাহ’। এ দোয়াটির ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা।
১১. দোয়ায়ে জামীলা
দোয়ায়ে জামীলা ও এর ফযীলত বিষয়ক যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা।
১২. হাফতে হাইকাল
হাফতে হাইকাল নামক এ দোয়ায় মূলত কুরআনের বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতগুলোর এরূপ বিভক্তি, বণ্টন ও ব্যবহার কোনো কোনো বুযুর্গের বানানো ও অভিজ্ঞতালব্ধ। এগুলোর ব্যবহার ও ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বিভিন্ন মানুষের কথা, রাসূলুল্লাহর ﷺ কথা বা হাদীস নয়।
১৩. দোয়ায়ে আমান
প্রচলিত আরেকটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়া ‘দোয়ায়ে আমান। এ দোয়ার বাক্যগুলোর অর্থ ভাল। তবে এভাবে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি এবং এর ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট।
১৪. দোয়ায়ে হিযবুল বাহার
প্রচলিত একটি দোয়া ও আমল হলো ‘দোয়ায়ে হিযবুল বাহার’। এ দোয়াটির মধ্যে ব্যবহৃত অনেক বাক্য কুরআন ও হাদীস থেকে নিয়ে জমা করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে এ দোয়াটি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এর কোনোরূপ ফযীলত, গুরুত্ব বা ফায়দাও হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
অনেক বুযুর্গ এগুলোর আমল করেছেন। অনেকে ‘ফল’ পেয়েছেন। অনেকে হয়ত মনে করতে পারেন যে, এসকল দোয়াকে হাদীস বা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা মনে করলে অন্যায় হবে। কিন্তু বুযুর্গদের বানানো দোয়া হিসাবে আমল করতে দোষ কি?
এ সকল দুআ বুজুর্গদের বানানো হিসেবে আমল করা নিষিদ্ধ নয়। মুমিন যে কোনো ভাল বাক্য দিয়ে দোয়া করতে পারেন। তবে এ সকল দোয়ার কোনো সাওয়াব বা ফলাফল ঘোষণা করতে পারেন না। এছাড়া সহীহ হাদীসে অনেক সংক্ষিপ্ত ও সুন্দর দুআ উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলো পালন করলে এরূপ বা এর চেয়েও ভাল ফল পাওয়া যাবে বলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন। এ সকল বানোয়াট ‘সুন্দর সুন্দর’ দোয়ার প্রচলনের ফলে সে সকল ‘নাবাবী’ দোয়া অচল ও পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছে। এ সকল দুআয় বুযুর্গীর ছোয়া থাকলেও নবুওতের নূর নেই। আমাদের জন্য উত্তম নবুওতের নূর থেকে উৎসারিত দুআগুলো পালন করা। এতে দুআ করা ও ফল লাভ ছাড়াও আমরা সুন্নাতকে জীবিত করার এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ভাষায় দুআ করার অতিরিক্ত সাওয়াব ও বরকত লাভ করব। আমি ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে সহীহ হাদীস থেকে অনেক দুআ, মুনাজাত, যিক্র ও ওযীফা উল্লেখ করেছি।
[1] সূরা আ’রাফ : ১৮০।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ২/৯৮১, নং ২৫৮৫, মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৬৩, নং ২৬৭৭।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৩০, নং ৩৫০৭, ইবন মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৬৯, নং ৩৮৬১, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬২-৬৩।
[4] ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১১/২১৭।
[5] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১১/২১৭-২১৮, ১১/২২১, নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম ১৭/৫।
[6] নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১৫১, মাওয়ারিদুয যামআন ৮/১৪-১৬, জামিউল উসূল ৪/১৭৩-১৭৫।
[7] মৌলবী মো. শামছুল হুদা, নেয়ামুল-কোর্আন, পৃ. ১৭।
[8] প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬।
[9] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৪৬২, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৪৯, ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৩/১২৬, হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩২৬-৩২৯, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৭৬, ৬৮১।
[10] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/২৮৫, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৫২, ২/২১১, ১০/৮২, আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৩৯৪।
[11] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬৮৫, নং ২১৩৭।
[12] শাহ ওয়লীউল্লাহ, আল-কাউলূল জামিল, পৃ. ৩৮-৩৯; সিররুল আসরার, পৃ. ৪০।
[13] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪১৪, নং ৫৯১।
[14] মোল্লা আলী কারী, আল-আসরারুল মারফূ’আ, পৃ. ২৯০, নং ১১৩৪, তাহতাবী, হাশিয়াতু তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ, পৃ. ৩১১-৩১২।
[15] আহমাদ, আল-মুসনাদ ১/৪১২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৪০৯; হাকিম তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল ২/২৭২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৭৪, ১৮৪; তাবারী, আত-তাফসীর ১১/১৫৪।
[16] মাও. মুহাম্মাদ আমজাদ হুসাইন; অজীফায়ে ছালেহীন পৃ. ১৪৪।
(ঙ) দরুদ-সালাম
মহান আল্লাহ মুমিনগণকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর মহান নবীর (ﷺ) উপর সালাত (দরুদ) ও সালাম পাঠ করতে। হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও নেক কর্ম। সহীহ হাদীসের আলোকে দরুদ ও সালামের ফযীলতের বিষয়গুলো ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এ সকল ফযীলতের মধ্যে রয়েছে:
(১). সালাত ও সালাম পাঠকারীর উপর আল্লাহ নিজে সালাত (রহমত) ও সালাম প্রেরণ করেন। একবার সালাত (দরুদ) পাঠ করলে মহান আল্লাহ সালাত পাঠকারীকে ১০ বার সালাত (রহমত) প্রদান করবেন, তার ১০টি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন, ১০টি সাওয়াব লিখবেন এবং ১০টি গোনাহ ক্ষমা করবেন। একবার সালাম পাঠ করলে আল্লাহ তাকে ১০ বার সালাম জানাবেন।
(২). সালাত বা দরুদ পাঠকারী যতক্ষণ দরুদ পাঠে রত থাকবেন ততক্ষণ ফিরিশতাগণ তার জন্য দোয়া করতে থাকবেন। একবার সালাত (দরুদ) পাঠ করলে আল্লাহ এবং তাঁর ফিরিশতাগণ তাঁর উপর সত্তর বার সালাত (রহমত ও দোয়া) করবেন।
(৩). সালাত ও সালাম পাঠকারীর সালাত ও সালাম তার পরিচয়সহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে পৌঁছান হবে।
(৪). রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে সালাত পাঠকারীর জন্য দোয়া করবেন।
(৫). দরুদ পাঠ কেয়ামতে নবী (ﷺ)-এর শাফায়াত লাভের ওসীলা।
(৬). মহান আল্লাহ সালাত (দরুদ) পাঠকারীর দোয়া কবুল করবেন এবং সকল দুনিয়াবী ও পারলৌকিক সমস্যা মিটিয়ে দেবেন।
সালাতের এত সহীহ ফযীলত থাকা সত্ত্বেও কতিপয় আবেগী মানুষ এর ফযীলতে আরো অনেক বানোয়াট কথা হাদীস নামে প্রচার করেছেন।
‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ’ এটুকু কথা হলো দরুদের ন্যূনতম পর্যায়। এর সাথে ‘সালাম’ যোগ করলে সালামের ন্যূনতম পর্যায় পালিত হবে। যেমন, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও সাল্লিম’। অথবা ‘সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদিও ওয়া সাল্লামা।’ সহীহ হাদীসে দরুদ পাঠের জন্য দরুদে ইবরাহিমী ও ছোট বাক্যের দুই একটি দরুদ পাওয়া যায়। হাদীসে বর্ণিত দরুদের বাক্যগুলো ‘রাহে বেলায়াত’ ও ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থদ্বয়ে উল্লেখ করেছি। আমাদের সমাজে প্রচলিত দরুদের বিভিন্ন নির্ধারিত বাক্য সবই বানোয়াট।
দরুদ-সালাম বিষয়ক কিছু প্রচলিত বানোয়াট বা অনির্ভরযোগ্য কথা:
১. জুমু‘আর দিনে নির্দিষ্ট সংখ্যায় দরুদের ফযীলত
জুমুআর দিনে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করতে সহীহ হাদীসে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এ দিনে নির্ধারিত সংখ্যক দরুদ পাঠের বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ দিনে বা রাতে ৪০ বার, ৫০ বার, ১০০ বার, ১০০০ বার বা অনুরূপ কোনো সংখ্যায় দরুদ পাঠ করলে ৪০, ৫০ ১০০ বছরের গোনাহ মাফ হবে, বা বিশেষ পুরস্কার বা ফযীলত অর্জন হবে অর্থে কোনো সহীহ হাদীস নেই। মুমিন যথাসাধ্য বেশি বেশি দরুদ ও সালাম এ দিনে পাঠ করবেন। নিজের সুবিধা ও সাধ্যমত ‘ওযীফা’ তৈরি করতে পারেন। যেমন আমি প্রতি শুক্রবারে অথবা প্রতিদিন ১০০, ৩০০ বা ৫০০ বার দরুদ ও সালাম পাঠ করব।
২. দরুদে মাহি বা মাছের দরুদ
দরুদে মাহি ‘মাছের দরুদ’-এর কাহিনীতে বর্ণিত ঘটনাবলি সবই মিথ্যা ও বানোয়াট। অনুরূপভাবে এ দরুদের ফযীলতে বর্ণিত সকল কথাই বানোয়াট ও মিথ্যা কথা। এ বানোয়াট কাহিনীটিতে বলা হয়েছে, যে, রাসূলুল্লাহর (ﷺ) যুগে একব্যক্তি নদীর তীরে বসে দরুদ পাঠ করতেন। ঐ নদীর একটি রুগ্ন মাছ শুনে শুনে দরুদটি শিখে ফেলে এবং পড়তে থাকে। ফলে মাছটি সুস্থ হয়ে যায়। পরে এক ইহূদীর জালে মাছটি আটকা পড়ে। ইহূদীর স্ত্রী মাছটিকে কাটতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে মাছটিকে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। মাছটি ফুটন্ত তেলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দরুদটি পাঠ করতে থাকে। এতে ঐ ইহূদী আশ্চার্যান্বিত হয়ে মাছটিকে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) দরবারে উপস্থিত হয়। তাঁর দোয়ায় মাছটি বাকশক্তি লাভ করে এবং সকল বিষয় বর্ণনা করে। .... পুরো ঘটনাটিই ভিত্তিহীন মিথ্যা।
৩. দরুদে তাজ, দরুদে হক্কানী, তুনাজ্জিনা, ফুতুহাত, শিফা ইত্যাদি
দরুদে তাজ, দরুদে হক্কানী, দরুদে তুনাজ্জিনা, দরুদে ফুতুহাত, দরুদে রু‘ইয়াতে নবী (ﷺ), দরুদে শিফা, দরুদে খাইর, দরুদে আকবার, দরুদে লাখী, দরুদে হাজারী, দরুদে রূহী, দরুদে বীর, দরুদে নারীয়া, দরুদে শাফেয়ী, দরুদে গাওসিয়া, দরুদে মুহাম্মাদী .....।
এ সকল দরুদ সবই পরবর্তী যুগের মানুষদের বানানো। এগুলোর ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।
এ সকল দরুদের বাক্যগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাল কথার সমন্বয়। তবে এভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বিশেষ ভাবে পড়ার জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। এ সকল দরুদের বাক্যগুলো বিন্যাস পরবর্তী মানুষদের তৈরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো পাঠ করলে দরুদ পাঠের সাধারণ ফযীলত লাভ হতে পারে। তবে এগুলোর বিশেষ ফযীলতে বর্ণিত কথাগুলো বানোয়াট।
যেমন, (আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি) হাদীস সম্মত একটি দরুদ। আবার (আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন বি ‘আদাদি কুল্লি দায়িওঁ ওয়া বি ‘আদাদি কুল্লি ইল্লাতিওঁ ওয়া শিফা) কথাটির মধ্যে কোনো দোষ নেই। এ বাক্যের মাধ্যমে দরুদ পাঠ করলে দরুদ পাঠের সাধারণ সাওয়াব পাওয়ার আশা করা যায়। তবে এগুলোর জন্য কোনো বিশেষ ফযীলতের কথা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নয়। সকল বানানো দরুদেরই একই অবস্থা। কোনো কোনো বানানো দরুদের মধ্যে আপত্তিকর কথা রয়েছে।
No comments