হাদীসের নামে জালিয়াতি - অধ্যায়-৩৪- শুভাশুভ, সাজসজ্জা, পানাহার ও বিবিধ
(ক) শুভ, অশুভ, উন্নতি, অবনতি ইত্যাদি
বিভিন্ন প্রচলিত ইসলামী গ্রন্থে এবং আমাদের সমাজের সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, অমুক দিন, বার, তিথি, সময় বা মাস অশুভ, অযাত্রা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মনে করা হয়, বিভিন্ন কাজের অশুভ ফল রয়েছে এবং এ সকল কাজের কারণে মানুষ দরিদ্র হয় বা মানুষের ক্ষতি হয়। এ বিশ্বাস বা ধারণা শুধু ইসলাম বিরোধী কুসংস্কারই নয়; উপরন্তু এরূপ বিশ্বাসের ফলে ঈমান নষ্ট হয় বলে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অশুভ, অযাত্রা, অমঙ্গল ইত্যাদি বিশ্বাস করতে এবং যে কোনো বিষয়ে আগাম হতাশা এবং নৈরাশ্যবাদ (pessimism) অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। পক্ষান্তরে তিনি সকল কাজে সকল অবস্থাতে শুভ চিন্তা, মঙ্গল-ধারণা ও ভাল আশা করা পছন্দ করতেন।[1] শুভ চিন্তা ও ভাল আশার অর্থ হলো আল্লাহর রহমতের আশা অব্যাহত রাখা। আর অশুভ ও অমঙ্গল চিন্তার অর্থ হলো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
الطِّيَرَة
شِرْكٌ، الطِّيَرَةُ شِرْكٌ، الطِّيَرَةُ شِرْكٌ
‘‘অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শির্ক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শির্ক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শির্ক।[2]
এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ যা কিছু নিষিদ্ধ করেছেন তাই অমঙ্গলের কারণ। বান্দার জন্য অমঙ্গল বলেই তো আল্লাহ বান্দার জন্য তা নিষিদ্ধ করেছেন। এ সকল কর্মে লিপ্ত হলে মানুষ আল্লাহর রহমত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহর নিষিদ্ধ হারাম দুই প্রকারের: (১) হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক্ক সম্পর্কিত হারাম ও (২) হক্কুল ইবাদ বা সৃষ্টির অধিকার সম্পর্কিত হারাম। দ্বিতীয় প্রকারের হারামের জন্য মানুষকে আখেরাতের শাস্তি ছাড়াও দুনিয়াতে পার্থিব ক্ষতির মাধ্যমে শাস্তি পেতে হবে বলে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে জানা যায়। জুলুম করা, কারো সম্পদ তার ইচ্ছার বাইরে চাঁদাবাজি, যৌতুক বা অন্য কোনো মাধ্যমে গ্রহণ করা, ওজন, পরিমাপ বা মাপে কম দেওয়া, পিতামাতা, স্ত্রী, প্রতিবেশী, দরিদ্র, অনাথ, আত্মীয়-স্বজন বা অন্য কোনো মানুষের অধিকার নষ্ট করা, কাউকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা, আল্লাহর কোনো সৃষ্টির বা মানুষের ক্ষতি করা বা সাধারণ ভাবে ‘হক্কুল ইবাদ’ নষ্ট করা পার্থিব অবনতির কারণ।
কিন্তু আল্লাহর কোনো সৃষ্টির মধ্যে, কোনো বার, তারিখ, তিথি, দিক ইত্যাদির মধ্যে অথবা কোনো মোবাহ কর্মের মধ্যে কোনো অশুভ প্রভাব আছে বলে বিশ্বাস করা কঠিন অন্যায় ও ঈমান বিরোধী। আমাদের সমাজে এ জাতীয় অনেক কথা প্রচলিত আছে। এগুলোকে সবসময় হাদীস বলে বলা হয় না। কিন্তু পাঠক সাধারণভাবে মনে করেন যে, এগুলো নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ কথা। তা না হলে কিভাবে আমরা জানলাম যে, এতে মঙ্গল হয় এবং এতে অমঙ্গল হয়? এগুলো বিশ্বাস করা ঈমান বিরোধী। আর এগুলোকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের ﷺ বাণী মনে করা অতিরিক্ত আরেকটি কঠিন অন্যায়।
শুভ, অশুভ. উন্নতি, অবনতি ইত্যাদি বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা
১. শনি, মঙ্গল, অমাবস্যা, পূর্ণিমা ইত্যাদি
শনিবার, মঙ্গলবার, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, কোনো তিথি, স্থান বা সময়কে অমঙ্গল অযাত্রা বা অশুভ বলে বিশ্বাস করা জঘন্য মিথ্যা ও ঘোরতর ইসলাম বিরোধী বিশ্বাস। অমুক দিনে বাঁশ কাঁটা যাবে না, চুল কাটা যাবে না, অমুক দিনে অমুক কাজ করতে নেই...ইত্যাদি সবই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কুসংস্কার। এগুলো বিশ্বাস করলে শির্কের গোনাহ হবে।
২. চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, রংধনু, ধুমকেতু ইত্যাদি
চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, রংধনু, ধুমকেতু ইত্যাদি প্রাকৃতিক নিদর্শনাবলি বিশেষ কোনো ভাল বা খারাপ প্রভাব রেখে যায় বলে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও মিথ্যা কথা। অমুক চাঁদে গ্রহণ হলে অমুক হয়, বা অমুক সময়ে রঙধনু দেখা দিলে অমুক ফল হয়, এ ধরনের কথাগুলো বানোয়াট।[3]
৩. বুধবার বা মাসের শেষ বুধবার
বুধবারকে বা মাসের শেষ বুধবারকে অমঙ্গল, অশুভ, অযাত্রা বা খারাপ বলে বা বুধবারের নিন্দায় কয়েকটি বানোয়াট হাদীস প্রচলিত আছে। এগুলো সবই মিথ্যা। আল্লাহর সৃষ্টি দিন, মাস, তিথি সবই ভাল। এর মধ্যে কোন কোন দিন বা সময় বেশি ভাল। যেমন শুক্রবার, সোমবার ও বৃহস্পতিবার বেশি বরকতময়। তবে অমঙ্গল, অশুভ বা অযাত্রা বলে কিছু নেই।[4]
৪. অবনতির কারণ বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা
বিভিন্ন প্রচলিত পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিম্নের কাজগুলোকে অশুভ, খারাপ ফলদায়ক বা দারিদ্র আনয়নকারী:
1. হাঁটতে হাঁটতে ও অযু ব্যতীত দরুদ শরীফ পাঠ করা।
2. বিনা ওযুতে কুরআন কিংবা কুরআনের কোনো আয়াত পাঠ করা।
এ কথা দুটি একদিকে যেমন বানোয়াট কথা, অপরদিকে এ কথা দ্বারা মুমিনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত থেকে বিরত রাখা হয়। গোসল ফরয থাকলে কুরআন পাঠ করা যায় না। ওযু ছাড়া কুরআন তিলাওয়াত জায়েয। রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণ ওযু ছাড়াও মুখস্থ কুরআন তিলাওয়াত করতেন। ওযু অবস্থায় যিক্র, দোয়া, দরুদ-সালাম ইত্যাদি পাঠ করা ভাল। তবে আল্লাহর যিক্র, দোয়া ও দরুদ-সালাম পাঠের জন্য ওযু বা গোসল জরুরী নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের সুন্নাত হলো, হাঁটতে, চলতে, বসে, শুয়ে ওযুসহ ও ওযু ছাড়া পাক-নাপাক সর্বাবস্থায় নিজের মুখ ও মনকে আল্লাহর যিক্র, দোয়া ও দরুদ পাঠে রত রাখা।
1. বসে মাথায় পাগড়ি পরিধান করা।
2. দাঁড়িয়ে পায়জামা পরিধান করা।
3. কাপড়ের আস্তিন ও আঁচল দ্বারা মুখ পরিষ্কার করা।
4. ভাঙ্গা বাসনে বা গ্লাসে পানাহার করা।
5. রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে খাওয়া।
6. খালি মাথায় পায়খানায় যাওয়া বা খালি মাথায় আহার করা।
7. পরিধানে কাপড় রেখে সেলাই করা।
8. লুঙ্গি-গামছা চেপার সময় পায়ে পানি ফেলা
9. ফুঁক দিয়ে প্রদীপ নেভানো।
10.
ভাঙ্গা চিরুনী ব্যবহার করা বা ভাঙ্গা কলম ব্যবহার করা।
11.
দাঁত দ্বারা নখ কাটা।
12.
রাত্রিকালে ঘর ঝাড়ু দেওয়া।
13.
কাপড় দ্বারা ঘর ঝাড়ু দেওয়া।
14.
ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখা বা রাত্রে আয়নায় মুখ দেখা।
15.
হাঁটতে হাঁটতে দাত খেলাল করা।
16.
কাপড় দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা।
17.
ঘরের ঝুলকালি বা মাকড়াসার বাসা পরিষ্কার না করা.......।
এরূপ আরো অনেক কথা প্রচলিত। সবই বানোয়াট কথা। কোনো জায়েয কাজের জন্য কোনোরূপ ক্ষতি বা কুপ্রভাব হতে পারে বলে বিশ্বাস করা কঠিন অন্যায়। আর এগুলোকে হাদীস বলে মনে করা কঠিনতর অন্যায়।
৫. উন্নতির কারণ বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা
মহান আল্লাহ বান্দাকে যে সকল কর্মের নির্দেশ দিয়েছেন সবই তার জন্য পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ, উন্নতি ও মঙ্গল বয়ে আনে। সকল প্রকার ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল-মুস্তাহাব কর্ম মানুষের জন্য আখিরাতের সাওয়াবের পাশাপাশি জাগতিক বরকত বয়ে আনে। আল্লাহ বলেন:
وَلَوْ
أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ
مِنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ
‘‘যদি জনপদবাসিগণ ঈমান এবং তাকওয়া অর্জন করতো (আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করতো ও নির্দেশিত কাজ পালন করতো) তবে তাদের জন্য আমি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর বরকত-কল্যাণসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম।’’[5]
এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈমান ও তাকওয়ার কর্মই বরকত আনয়ন করে। তবে সৃষ্টির সেবা ও মানবকল্যাণমূলক কর্মে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন এবং এরূপ কাজের জন্য মানুষকে আখিরাতের সাওয়াব ছাড়াও পৃথিবীতে বিশেষ বরকত প্রদান করেন বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অনেক বানোয়াট কথাও বলা হয়। যেমন বলা হয় যে, নিম্নের কাজগুলি করলে মানুষ ধনী ও সৌভাগ্যশালী হতে পারে:
1. আকীক পাথরের আংটি পরিধান করা।
2. বৃহস্পতিবারে নখ কাটা।
3. সর্বদা জুতা বা খড়ম ব্যবহার করা।
4. ঘরে সিরকা রাখা।
5. হলদে রঙের জুতা পরা।
6. যে ব্যক্তি জমরুদ পাথরের বা আকীক পাথরের আংটি পরবে বা সাথে রাখবে সে কখনো দরিদ্র হবে না এবং সর্বদা প্রফুল্ল থাকবে।
অনুরূপভাবে অমুক কাজে মানুষ স্বাস্থ্যবান ও সবল হয়, স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়, অমুক কাজে স্বাস্থ্য নষ্ট হয় বা স্মরণশক্তি নষ্ট হয়, অমুক কাজে দৃষ্টি শক্তি বাড়ে, অমুক কাজে দৃষ্টিশক্তি কমে, অমুক কাজে বার্ধক্য আনে, অমুক কাজে শরীর মোটা হয়, অমুক কাজে শরীর দুর্বল হয় ইত্যাদি সকল কথাই বানোয়াট।
[1] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৭১; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৪৫।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/১৬০; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১৩/৪৯১; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৪; আবূ দাঊদ, আস-সুনান ৪/১৭; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১১৭০। তিরমিযী, ইবনু হিববান, হাকিম প্রমুখ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[3] তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২২১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/১৭৮, ১৭৯, ১৯১; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৬৮।
[4] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/৩৭৪-৩৭৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৮১-৪৮৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩৬৪; মুল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৯৯-২০০, ২৭৫; আল-মাসনূ‘য় ১২৫; মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৬৬, ২০৮।
[5] সূরা (৭) আ‘রাফ: ৯৬ আয়াত।
(খ) সাজসজ্জা, পোশাক ও পানাহার বিষয়ক
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পোশাক’ ও ‘পোশাক-পর্দা ও দেহসজ্জা’ নামক গ্রন্থদ্বয়ে পোশাক বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও মাউদূ হাদীসগুলি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে এ বিষয়ক কিছু মাউযূ বা জাল হাদীস উল্লেখ করছি। এছাড়া পানাহার বিষয়ক কিছু জাল হাদীসও এ পরিচ্ছেদে উল্লেখ করছি।
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটিমাত্র জামা ছিল
আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে:
لم
يكن لرسول الله ﷺ إلا قميص واحد
‘‘রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর একটিমাত্র কামিস ছাড়া অন্য কোনো কামিস ছিল না।’’[1]
হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনু মাইসারাহ মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলতেন বলে ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন।[2]
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে মনে হয়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন প্রকারের জামা পরিধান করতেন। কোনোটির ঝুল ছিল টাখনু পর্যন্ত। কোনোটি কিছুটা খাট হাটুর নিম্ন পর্যন্ত ছিল। কোনোটির হাতা ছিল হাতের আঙ্গুলগুলোর মাথা পর্যন্ত। কোনোটির হাতা কিছুটা ছোট এবং কব্জি পর্যন্ত ছিল।
[1] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ৬/৩১; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১২১।
[2] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/২৩৩।
২. জামার বোতাম ছিল না
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জামার বোতাম ছিল, তবে তিনি সাধারণত বোতাম লাগাতেন না। বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে যে, ‘তাঁর জামার বোতামগুলো’ খোলা ছিল। এ থেকে মনে হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জামার তিন বা ততোধিক বোতাম ছিল। তিনি সাধারণত এ সকল বোতামের কোনো বোতামই লাগাতেন না।
কেউ কেউ বলেছেন যে, তাঁর জামার বোতাম ছিল না বা বোতামের স্থলে কাপড়ের তৈরি ঘুন্টি ছিল। এ বিষয়ক কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ইমাম গাযালী (৫০৫হি) লিখেছেন:
وَكَانَ
قَمِيْصُهُ مَشْدُوْدَ الأَزْرَارِ، وَرُبَّمَا حَلَّ الأَزْرَارَ فِيْ الصَّلاَةِ
وَغَيْرِهَا
‘‘তাঁর কামিস বা জামার বোতামগুলো লাগানো থাকত। কখনো কখনো তিনি সালাতে ও সালাতের বাইরে বোতামগুলো খুলে রাখতেন।’’[1]
[1] গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/৪০৫।
৩. দাঁড়িয়ে বা বসে পাজামা পরিধান
কোনো কোনো গ্রন্থে ‘বসে পাজামা পরিধান করা’ সুন্নাত বা আদব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস আমার নজরে পড়ে নি। বিষয়টি পরবর্তী যুগের আলিমদের মতামত বলেই মনে হয়।[1]
[1] মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৪/৩৬২।
৪. টুপির উপর পাগড়ী মুসলিমের চিহ্ন
আবু দাউদ ও তিরমিযী উভয়ে তাঁদের উস্তাদ কুতাইবা ইবনু সাঈদের সুত্রে একটি হাদীস সংকলিত করেছেন। তাঁরা উভয়েই বলেন: কুতাইবা আমাদেরকে বলেছেন, তাকে মুহাম্মাদ ইবনু রাবীয়াহ হাদীসটি আবুল হাসান আসকালানী নামক এক ব্যক্তি থেকে, তিনি আবু জা’ফর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু রুকানাহ নামাক এক ব্যক্তি থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে বলেছেন, রুকানার সাথে রাসূলুল্লাহ ﷺ কুস্তি লড়েন এবং তিনি রুকানাকে পরাস্ত করেন। রুকানা আরো বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি:
إِنَّ
فَـرْقَ مَا بَـيْـنَـنَا وَبَيْنَ الْمُشْرِكِينَ الْعَمَـائِمُ عَلَى
الْقَلانِسِ
‘‘আমাদের এবং মুশরিকদের মধ্যে পার্থক্য টুপির উপরে পাগড়ী।’’[1]
তিরমিযী হাদীসটি উল্লেখ করে এর সনদটি যে মোটেও নির্ভরযোগ্য নয় তা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী আবুল হাসান আসকালানী। এ ব্যক্তিটির পরিচয় কেউ জানে না। শুধু তাই নয়। তিনি দাবী করেছেন যে, তিনি রুকানার পুত্র থেকে হাদীসটি শুনেছেন। রুকানার কোনো পুত্র ছিল কিনা, তিনি কে ছিলেন, কিরূপ মানুষ ছিলেন তা কিছুই জানা যায় না। এজন্য হাদীসটির সনদ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
ইমাম তিরমিযীর উস্তাদ, ইমামুল মুহাদ্দিসীন ইমাম বুখারীও তাঁর ‘‘আত-তারীখুল কাবীর’’ গ্রন্থে এ হাদীসটির দুর্বলতা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: হাদীসটির সনদ অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষদের সমন্বয়। এছাড়া এদের কেউ কারো থেকে কোন হাদীস শুনেছে বলেও জানা যায় না।[2] ইমাম যাহাবী, আজলূনী প্রমুখ একে মাউযূ বা বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন।[3]
এছাড়া আব্দুর রাঊফ মুনাবী, মোল্লা আলী কারী, আব্দুর রাহমান মুবারাকপুরী, শামছুল হক আযীমাবাদী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আলোচনা করেছেন যে, এ হাদীসের অর্থ বাস্তবতার বিপরীত।[4] হাদীসটির দুইটি অর্থ হতে পারে: এক- মুশরিকগণ শুধু টুপি পরিধান করে আর আমরা পাগড়ী সহ টুপি পরিধান করি। দুই- মুশরিকগণ শুধু পাগড়ী পরিধান করে আর আমরা টুপির উপরে পাগড়ী পরিধান করি। উভয় অর্থই রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণের কর্মের বিপরীত। কারণ বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তাঁরা কখনো শুধু টুপি পরতেন এবং কখনো শুধু পাগড়ী পরতেন।
ইমাম গাযালী (৫০৫হি) বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো পাগড়ীর নিচে টুপি পরিধান করতেন। কখনো পাগড়ী ছাড়া শুধু টুপি পরতেন। কখনো কখনো তিনি মাথা থেকে টুপি খুলে নিজের সামনে টুপিটিকে সুতরা বা আড়াল হিসাবে রেখে সেদিকে মুখ করে নামায আদায় করেছেন।’’[5]
শামসুদ্দীন ইবনুল কাইয়িম (৭৫১হি:) বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ ﷺ পাগড়ী পরিধান করতেন এবং তার নিচে টুপি পরতেন। তিনি পাগড়ী ছাড়া শুধু টুপিও পরতেন। আবার টুপি ছাড়া শুধু পাগড়ীও পরতেন।’’[6]
[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/২৪৭; আবু দাউদ, আস-সুনান ৪/৫৫।
[2] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ১/৮২।
[3] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৫১১; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর ৫/৭১; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান ৫/১৭৫; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/১৪৫; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ৪/১৬২; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৫।
[4] মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৩৯৩; আযীমাবাদী, আউনুল মা’বুদ ১১/৮৮।
[5] গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/৪০৬।
[6] ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/১৩০।
৫. রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর পাঁচকল্লি টুপি
আবু হুরাইরা (রা)-এর নামে বর্ণিত:
رَأَيْتُ
عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ قَلَنْسُوَةً خُمَاسِيَّةً طَوِيْلَةً
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মাথায় একটি লম্বা পাঁচভাগে বিভক্ত টুপি দেখেছি।’’
হাদীসটি আল্লামা আবু নুআইম ইসপাহানী তাঁর সংকলন ‘মুসনাদুল ইমাম আবী হানীফা’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। তিনি বলেন: আমাকে আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু জা‘ফর ও আবু আহমাদ জুরজানী বলেছেন, আমাদেরকে আহমাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ বলেছেন, আমাদেরকে আবু উসামাহ বলেছেন, আমাদেরকে দাহহাক ইবনু হাজার বলেছেন, আমাদেরকে আবু কাতাদাহ হাররানী বলেছেন যে, আমাদেরকে আবু হানীফা বলেছেন, তাঁকে আতা’ আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি এ হাদীস বলেছেন।[1]
এ হাদীসটি জাল। ইমাম আবু হানীফা থেকে শুধুমাত্র আবু কাতাদাহ হাররানী (মৃ: ২০৭হি:) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাররানী ছাড়া অন্য কেউ এ শব্দ বলেন নি। ইমাম আবু হানীফার (রাহ) অগণিত ছাত্রের কেউ এ হাদীসটি এ শব্দে বলেন নি। বরং তাঁরা এর বিপরীত শব্দ বলছেন। অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণনা অনুসারে ইমাম আবু হানীফা বলেছেন, তাঁকে আতা’ আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাদা শামি টুপি ছিল।[2]
তাহলে আমরা দেখছি যে, অন্যান্যদের বর্ণনা মতে হাদীসটি (قلنسوة شامية) বা ‘শামী টুপি’ এবং আবু কাতাদার বর্ণনায় (قلنسوة خماسية) বা ‘খুমাসী টুপি’। এথেকে আমরা বুঝতে পরি যে, আবু হানীফা বলেছিলেন শামী টুপি, যা তাঁর সকল ছাত্র বলেছেন, আবু কাতাদাহ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ভুল বলেছে। অথবা সে (شامية) শব্দটিকে বিকৃতভাবে (خماسية) রূপে পড়েছে।
সর্বোপরি আবূ কাতাদা পরিত্যক্ত রাবী। ইমাম বুখারী বলেছেন, আবু কাতাদাহ হাররানী ‘মুনকারুল হাদীস’। ইমাম বুখারী কাউকে ‘‘মুনকারুল হাদীস’’ বা ‘‘আপত্তিকর বর্ণনাকারী’’ বলার অর্থ সে লোকটি মিথ্যাবাদী বলে তিনি জেনেছেন। তবে তিনি কাউকে সরাসরি মিথ্যাবাদী না বলে তাকে ‘‘মুনকারুল হাদীস’’ বা অনুরূপ শব্দাবলি ব্যবহার করতেন।
এছাড়া হাদীসটি আবু কাতাদাহ হাররানীর থেকে শুধুমাত্র দাহহাক ইবনু হুজর বর্ণনা করেছেন। দাহহাক ইবনু হুজরের কুনিয়াত আবু আব্দুল্লাহ মানবিজী। তিনিও অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী ছিলেন। তিনি মিথ্যা হাদীস বানাতেন বলে ইমাম দারাকুতনী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন।[3]
এজন্য আল্লামা আবু নু‘আইম ইসপাহানী হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন ‘‘এ হাদীসটি শুধুমাত্র দাহহাক আবু কাতাদা থেকে বর্ণনা করেছেন। আর কেউই আবু হানীফা থেকে বা আবু কাতাদাহ থেকে তা বর্ণনা করেন নি।’’[4]
[1] আবু নু‘আইম ইসপাহানী, মুসনাদুল ইমাম আবী হানীফা, পৃ: ১৩৭।
[2] মোল্লা আলী কারী, শারহু মুসনাদি আবী হানীফাহ, পৃ: ১৪২।
[3] ইমাম বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৫/২১৯; ইবনু আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তাদীল ৫/১৯১; যাহাবী, মুগনী ফী আল-দুআফা’ ১/৪৯৩, ৫৭৬; মীযানুল ই‘তিদাল ৪/৩১৯, ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৭/৭২।
[4] আবু নু‘আইম, মুসনাদুল ইমাম আবু হানীফা, পৃ: ১৩৭।
৬. পাগড়ীর দৈর্ঘ্য
পাগড়ী কত হাত লম্বা হবে বা পাগড়ীর দৈর্ঘ্যের বিষয়ে সুন্নাত কী? এ বিষয়ে অনেক কথা প্রচলিত আছে। সবই ভিত্তিহীন বা আন্দায কথা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পাগড়ীর দৈর্ঘ্য কত ছিল তা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।[1]
[1] আযীমাবাদী, আউনুল মা’বুদ ১১/৮৯; মুবারাকপূরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৩৩৮।
৭. দাঁড়িয়ে পাগড়ী পরিধান করা
কোনো কোনো গ্রন্থে ‘দাঁড়িয়ে পাগড়ী পরিধান করা’ সুন্নাত বা আদব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস আমার নযরে পড়ে নি। বিষয়টি পরবর্তী যুগের আলিমদের মতামত বলেই মনে হয়।[1]
[1] মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৪/৩৬২।
৮. পাগড়ীর রঙ: সাদা ও সবুজ পাগড়ী
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ সময় কাল রঙের পাগড়ী পরেছেন। হাদীস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি মদীনায়, সফরে, যুদ্ধে সর্বত্র কাল পাগড়ী ব্যবহার করতেন।
৮/৯ম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় থাকা অবস্থায় কাল পাগড়ী পরতেন এবং সফর অবস্থায় সাদা পাগড়ী ব্যবহার করতেন। এ দাবীর পক্ষে কোনো প্রমাণ বা হাদীস তারা পেশ করেন নি। এজন্য হিজরী ৯ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম সাখাবী (৯০২ হি) এ কথাকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।[1]
আমরা জানি ‘পাগড়ী’ পোশাক বা জাগতিক বিষয়। এ জন্য সাধারণ ভাবে হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ব্যতিরেকে কোনো রঙকে আমরা নাজায়েয বলতে পারব না। তবে কোনো রঙ সুন্নাত কিনা তা বলতে প্রমাণের প্রয়োজন। বিভিন্ন হাদীসে সাধারণ ভাবে সবুজ পোশাক পরিধানে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো পাগড়ীর ক্ষেত্রে সবুজ রঙ ব্যবহার করেছেন বলে জানতে পারি নি। ফিরিশতাগণের পাগড়ীর বিষয়েও তাঁরা কখনো সবুজ পাগড়ী পরিধান করেছেন বলে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস আমি দেখতে পাই নি। অনুরূপভাবে তিনি কখনো সাদা রঙের পাগড়ী পরিধান করেছেন বলেও জানতে পারি নি। কোন কোন সনদহীন ইসরাঈলীয় বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তাবিয়ী কা’ব আহবার বলেছেন: ঈসা (আ:) যখন পৃথীবিতে নেমে আসবেন তখন তাঁর মাথায় সবুজ পাগড়ী থাকবে।[2]
[1] শামী, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ, সীরাহ শামিয়াহ ৭/২৭৬।
[2] মুনাবী, ফযযুল কাদীর ২/৫৩৮।
৯. পাগড়ীর ফযীলত
বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণ পাগড়ী ব্যবহার করতেন। কিন্তু পাগড়ী ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান মূলক কোনো সহীহ হাদীস নেই। এ বিষয়ে যা কিছু বর্ণিত ও প্রচারিত সবই ভিত্তিহীন, বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল। এ বিষয়ক হাদীসগুলো দুই ভাগে ভাগ করা যায়: (ক) সাধারণ পোশাক হিসাবে পাগড়ী পরিধানের উৎসাহ প্রদান বিষয়ক হাদীস। (খ) পাগড়ী পরিধান করে নামায আদায়ের উৎসাহ প্রদান বিষয়ক হাদীস। উভয় অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই অত্যন্ত দুর্বল ও বানোয়াট পর্যায়ের। বিশেষত দ্বিতীয় অথে বর্ণিত সকল হাদীস সন্দেহাতীতভাবে জাল ও বানোয়াট।
এখানে উল্লেখ্য যে, ‘রাসূলুল্লাহর (ﷺ) পোশাক’ ও ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে পোশাক পর্দা ও দেহসজ্জা’ গ্রন্থদ্বয়ে এ সকল হাদীসের সনদের বিস্তারিত আলোচনা করেছি। প্রত্যেক সনদের মিথ্যাবাদী জালিয়াতের পরিচয়ও তুলে ধরেছি। এখানে সংক্ষেপে হাদীসগুলো উল্লেখ করছি। আগ্রহী পাঠক উপর্যুক্ত গ্রন্থদ্বয় থেকে বাকি আলোচনা জানতে পারবেন।
প্রথমত: সৌন্দয্য ও মর্যাদার জন্য পাগড়ী
সৌন্দর্য্য ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবে পাগড়ী পরিধানের উৎসাহ দিয়ে বর্ণিত জাল বা অত্যন্ত দুর্বল হাদীসগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১০. পাগড়ীতে ধৈর্যশীলতা বৃদ্ধি ও পাগড়ী আরবদের তাজ
একটি বানোয়াট হাদীসে বলা হয়েছে:
اِعْتَمُّوْا
تَزْدَادُوْا حُلُماً، وَالْعَمَائِمُ تِيْجَانُ الْعَرَبِ
‘‘তোমরা পাগড়ী পরিধান করবে, এতে তোমাদের ধৈর্যশীলতা বৃদ্ধি পাবে। আর পাগড়ী হলো আরবদের তাজ বা রাজকীয় মুকুট।’’[1]
[1] ইবনু আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ৩/১/২৯৫; তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর ১/২৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/২১৪; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৫/১৭৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১১৯; ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত ২/২৪২; যাহাবী, তারবীবুল মাউযূআত, পৃ ২৩১; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/২৫৯-২৬০; সাখাবী, আল-মাকাসিদৃ ২৯৭; আলবানী, মাকালাতুল আলবানী, পৃ ১৩২।
১১. পাগড়ী আরবদের তাজ পাগড়ী খুললেই পরাজয়
অন্য একটি বানোয়াট হাদীসে বলা হয়েছে:
اَلْعَمَائِمُ
تِيْجَانُ الْعَرَبِ فَإِذاَ وَضَعُوْا الْعَمَائِمَ وَضَعُوْا عِزَّهُمْ، أَوْ
وَضَعَ اللهُ عِزَّهُمْ
‘‘পাগড়ী আরব জাতির মুকুট। তারা যখন পাগড়ী ফেলে দেবে তখন তাদের মর্যাদাও চলে যাবে বা আল্লাহ তাদের মর্যাদা নষ্ট করে দেবেন।’’[1]
[1] প্রাগুক্ত।
১২. পাগড়ী মুসলিমের মুকুট, মসজিদে যাও পাগড়ী পরে ও খালি মাথায়
আরেকটি বানোয়াট হাদীসে বলা হয়েছে:
ايتوا
المساجد حسرا ومقنعين [معصبين] فان العمائم تيجان المسلمين
‘‘তোমরা মসজিদে একেবারে খালি মাথায় আসবে এবং পাগড়ী, পট্টি বা রুমাল মাথায় আসবে (অর্থাৎ সুযোগ ও সুবিধা থাকলে খালি মাথায় না এসে পাগড়ী মাথায় মসজিদে আসবে); কারণ পাগড়ী মুসলিমগণের মুকুট।’’[1]
[1] ইবনু আদী, আল-কামিল ৬/৪১৭-৪১৯; মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ১/৬৭; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ: ৬; যায়ীফাহ ৩/৪৫৯।
১৩. পাগড়ী মুমিনের গাম্ভীর্য ও আরবের মর্যাদা
অন্য একটি অত্যন্ত দুর্বল বা জাল হাদীসে বলা হয়েছে:
اَلْعَمَائِمُ
وَقَارُ الْمُؤْمِنِ وَعِزُّ الْعَرَبِ، فَإِذَا وَضَعَتِ الْعَرَبُ عَمَائِمَهَا
فَقَدْ خَلَعَتْ عِزَّهَا
‘‘পাগড়ী মুমিনের গাম্ভীর্য ও আরবের মর্যাদা। যখন আরবগণ পাগড়ী ছেড়ে দেবে তখন তাদের মর্যাদা নষ্ট হবে।’’[1]
[1] আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৪; আলবানী, মাকালাত, পৃ: ১৩৪।
১৪. পাগড়ী আরবদের তাজ ও জড়িয়ে বসা তাদের প্রাচীর
অন্য একটি বানোয়াট হাদীস:
اَلْعَمَائِمُ
تِيْجَانُ الْعَرَبِ، وَالاِحْتِبَاءُ حِيْطَانُهَا.
‘‘পাগড়ী আরবদের মুকুট, দুইপা ও পিঠ একটি কাপড় দ্বারা পেচিয়ে বসা তাদের প্রাচীর।’’[1]
[1] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৫/১৭৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ২৯৭।
১৫. পাগড়ীর প্রতি প্যাঁচে কেয়ামতে নূর
আরেকটি বানোয়াট হাদীস:
اَلْعِمَامَةُ
عَلَى الْقَلَنْسُوَةِ فَصْلُ مَا بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْمُشْرِكِيْنَ، يُعْطَي
يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِكُلِّ كَوْرَةٍ يُدَوِّرُهَا عَلَى رَأْسِهِ نُوْراً
‘‘মুশরিকগণ এবং আমাদের মধ্যে পার্থক্য হলো টুপির উপরে পাগড়ী। কেয়ামতের দিন মাথার উপরে পাগড়ীর প্রতিটি আবর্তনের বা পেঁচের জন্য নূর প্রদান করা হবে।’’[1]
[1] মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৪/৩৯২; আলবানী, মাকালাত, পৃ: ১৩১; যয়ীফুর জামিয়, পৃ: ৫৬৭।
১৬. পাগড়ী পরে পূর্ববর্তী উম্মাতদের বিরোধিতা কর
আরেকটি যয়ীফ বা বানোয়াট হাদীস:
اِعْتَمُّوْا
خَالِفُوْا عَلَى الأُمَمِ قَبْلَكُمْ
‘‘তোমরা পাগড়ী পরিধান করবে, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিদের বিরোধিতা করবে।’’[1]
[1] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৫/১৭৬।
১৭. পাগড়ী আর পতাকায় সম্মান
আরেকটি যয়ীফ বা বানোয়াট হাদীস:
أَكْرَمَ
اللهُ عَزَّ وَجَلَّ هَذِهِ الأُمَّةَ بِالْعَمَائِمِ وَالأَلْوِيَةِ
‘‘আল্লাহ তা’লা এ উম্মাতকে পাগড়ী ও পতাকা বা ঝান্ডা দিয়ে সম্মানিত করেছেন।’’[1]
[1] সাঈদ ইবনু মানসূর, আস-সুনান ২/২৪৬।
১৮. পাগড়ী ফিরিশতাগণের বেশ
আরেকটি বানোয়াট হাদীস:
عَلَيْكُمْ
بِالْعَمَائِمِ فَإِنَّهَا سِيْمَا الْمَلاَئِكَةِ وَأَرْخُوْهَا خَلْفَ
ظُهُوْرِكُمْ
‘‘তোমরা পাগড়ী পরবে; কারণ পাগড়ী ফিরিশতাগণের চিহ্ন বা বেশ। আর তোমরা পিছন থেকে পাগড়ীর প্রান্ত নামিয়ে দেবে।’’[1]
[1] তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর ১২/৩৮৩; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৫/১৭৬; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১২০; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৩১৫, ৬/২৯৪ ৭/২০৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১২০; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৪।
১৯. পাগড়ী কুফর ও ঈমানের মাঝে বাঁধা
আলীর (রা) নামে প্রচারিত একটি বানোয়াট হাদীস:
عَمَّمَنِيْ
رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يَوْمَ غَدِيْرِ خُمٍ بِعِمَامَةٍ سَدَلَهَا خَلْفِيْ، ثُمَّ
قَالَ: إِنَّ اللهَ أَمَدَّنِيْ يَوْمَ بَدْرٍ وَحُنَيْنٍ بِمَلاَئِكَةٍ
يَعْتَمُّوْنَ هَذِهِ الْعِمَامَةَ، وَقَالَ: إِنَّ الْعِمَامَةَ حَاجِزَةٌ بَيْنَ
الْكُفْرِ وَالإِيْمَانِ
‘‘গাদীর খুমের দিনে রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে পাগড়ী পরিয়ে দেন এবং পাগড়ীর প্রান্ত পিছন দিকে ঝুলিয়ে দেন। এরপর বলেন: বদর ও হুনাইনের দিনে আল্লাহ আমাকে এভাবে পাগড়ী পরা ফিরিশতাদের দিয়ে সাহায্য করেছেন। আরো বলেন: পাগড়ী কুফর ও ঈমানের মাঝে বেড়া বা বাঁধা।’’[1]
উপরের অধিকাংশ হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, তা জাল। দু-একটি হাদীসকে কেউ জাল এবং কেউ অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন।[2]
দ্বিতীয়ত: পাগড়ী-সহ সালাতের ফযীলত
রাসূলুল্লাহ ﷺ বা তাঁর সাহাবীগণ কখনো শুধু নামাযের জন্য পাগড়ী পরিধান করেছেন এরূপ কোন কথা কোথাও দেখা যায় না। তাঁরা সাধারণভাবে পাগড়ী পরে থাকতেন এবং পাগড়ী পরেই নামায আদায় করতেন। এখন প্রশ্ন হলো পাগড়ী-সহ সালাতের অতিরিক্ত কোন সাওয়াব আছে কিনা?
এবিষয়ে কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণ একমত যে, সেগুলো সবই বানোয়াট। সুপরিচিত মিথ্যাবাদী রাবীগণ এগুলো বানিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে আমি হাদীসগুলো উল্লেখ করছি। বিস্তারিত আলোচনার জন্য পোশাক বিষয়ক পুস্তকটি দ্রষ্টব্য।
[1] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ১০/১৪; বুসীরী, মুখতাসারু ইতহাফুস সাদাহ ৩/৩৮৫-৩৮৬; ইবনু হাজার, আল-মাতালিবুল আলিয়াহ ৩/৬; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৪২৬, ৪/৬৭; আল-মুগনী ১/৯১, ১/৩৩৩, ২/৭৮৪।
[2] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ২৯৭-২৯৮, নং ৭১৭; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৪।
২০. জুমু‘আর দিনে সাদা পাগড়ী পরিধানের ফযীলত
আনাস ইবনু মালিকের (রা) সূত্রে প্রচারিত একটি মিথ্যা কথা:
إِنَّ
للهِ مَلاَئِكَةً مُوَكَّلِيْنَ بِأَبْوَابِ الْجَوَامِعِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ
يَسْتَغْفِرُوْنَ لأَصْحَابِ الْعَمَائِمِ الْبِيْضِ
‘‘আল্লাহর কিছু ফিরিশতা আছেন, শুক্রবারের দিন জামে মসজিদের দরজায় তাদের নিয়োগ করা হয়, তারা সাদা পাগড়ী পরিধান কারীগণের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন।’’[1]
[1] খতীব বাগদাদী, তারিখ বাগদাদ ১৪/২০৬, নং ৭৪৯৪; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৭/১৮৯-১৯০; ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৬/২৬১।
২১. জুমু‘আর দিনে পাগড়ী পরিধানের ফযীলত
আবু দারদা(রা)-এর নামে বর্ণিত মিথ্যা কথা:
إِنَّ
اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى أَصْحَابِ الْعَمَائِمِ يَوْمَ
الْجُمُعَةِ
‘‘আল্লাহ এবং তাঁর ফিরিশতাগণ শুক্রবারে পাগড়ী পরিহিতদের উপর সালাত (দয়া ও দোয়া) প্রেরণ করেন।’’[1]
[1] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/১৭৬, ৫/১২১; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৪৬৩; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/৪৮৮; সাখাবী, মাকাসিদ, পৃ: ২৯৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৫।
২২. পাগড়ীর ২ রাক‘আত পাগড়ী ছাড়া ৭০ রাকআত
জাবির (রা)-এর নামে বর্ণিত জাল হাদীস:
رَكْعَتَانِ
بِعِمَامَةٍ خَيْرٌ مِنْ سَبْعِيْنَ رَكْعَةً بِلاَ عِمَامَةٍ [حَاسِراً]
‘‘পাগড়ী সহ দু রাক‘আত নামায পাগড়ী ছাড়া বা খালি মাথায় ৭০ রাক‘আত নামাযের চেয়ে উত্তম।’’[1]
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ,পৃ: ২৯৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৩, ৯৫; আলবানী, সিলসিলাতুল যায়ীফাহ ৩/২৪, ১২/৫৬৯৯; যায়ীফুল জামিয়, পৃ: ৪৫৯, নং ৩১২৯।
২৩. পাগড়ীর নামায ২৫ গুণ ও পাগড়ীর জুমু‘আ ৭০ গুণ
ইবনু উমরের (রা:) সূত্রে প্রচারিত একটি জাল কথা:
صَلاَةٌ
[صَلاَةُ تَطَوُّعٍ أَوْ فَرِيْضَةٍ] [إنَّ الصَّلاَةَ] بِعِمَامَةٍ تَعْدِلُ
خَمْساً وَعِشْرِيْنَ صَلاَةً وَجُمُعَةٌ بِعِمَامَةٍ تَعْدِلُ سَبْعِيْنَ
جُمُعَةً إِنَّ المَلاَئِكَةَ لَيَشْهَدُوْنَ الْجُمُعَةَ مُعْتَمِّيْنَ وَلاَ
يَزَالُوْنَ يُصَلُّوْنَ عَلَى أَصْحَابِ الْعَمَائِمِ حَتَّى تَغْرُبَ الشَّمْسُ
‘‘পাগড়ি সহ (ফরয অথবা নফল যে কোনো) একটি সালাত পচিশ সালাতের সমান এবং পাগড়ি সহ একটি জুমু‘আ ৭০ টি জুমু‘আর সমতুল্য। ফিরিশতাগণ পাগড়ি পরিধান করে জুমু‘আর সালাতে উপস্থিত হন এবং সূযাস্ত পর্যন্ত তাঁরা পাগড়ি পরিধানকারীদের জন্য দোয়া করতে থাকেন।’’
ইবনু হাজার আসকালানী, সাখাবী, সুয়ূতী, ইবন আর্রাক, যারকানী প্রমুখ মুহাদ্দিস একে বাতিল ও বানোয়াট হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন।[1]
উল্লেখ্য যে, আল্লামা সুয়ূতী তাঁর সংকলিত ‘আল-জামিউস সাগীর’-এর ভূমিকায় দাবি করেছেন যে, মাউযূ হাদীস তিনি এতে উল্লেখ করবেন না। অথচ তিনি এ গ্রন্থে এ হাদীসটি সংকলন করেছেন। আবার তিনি নিজেই ‘যাইলুল লাআলী’ বা ‘যাইলুল আহাদীসিল মাউদূ‘আহ’ নামক তাঁর জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থে এ হাদীসটি সংকলন করেছেন এবং হাদীসটি জাল বলে নিশ্চিত করেছেন।[2] এজন্য হাদীসের সনদবিচার ও জালিয়াতি নির্ণয়ে মুহাদ্দিসগণের সুস্পষ্ট মতামত ছাড়া শুধু ‘উল্লেখ’ করার উপর নির্ভর করা যায় না। মেল্লা আলী কারী তাঁর জাল হাদীস বিষয়ক ‘আল-মাসনূ’ নামক গ্রন্থে উপর্যুক্ত হাদীসটি জাল বলে উদ্ধৃত করেছেন। জাল হাদীস বিষয়ক ‘আল-আসরার আল-মারফূআ’ নামক অন্য গ্রন্থে তিনি হাদীসটির বিষয়ে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লামা আবুল খাইর মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রাহমান সাখাবী (৯০২ হি) এবং আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মানূফী (৯৩ হি) উভয়ে হাদীসটিকে মাউযূ ও বাতিল বলে উল্লেখ করেছেন। এরপর এ বিষয়ে নিজের দ্বিধা প্রকাশ করে বলেছেন: ‘‘ইবনু উমারের (রা) এ হাদীসটি সুয়ূতী ‘আল-জামিয়ুস সাগীর’ গ্রন্থে ইবনু আসাকিরের সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন এবং এ গ্রন্থে কোনো মাউযূ হাদীস উল্লেখ করবেন না বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।’’[3]
স্বভাবতই ইমাম সুয়ূতীর প্রতি সু-ধারণা বশত মোল্লা আলী কারী দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন। সম্ভবত তিনি ‘যাইলুল লাআলী’ গ্রন্থে হাদীসটির বিষয়ে সুয়ূতীর নিজের মতামত লক্ষ্য করেন নি। শুধু তাই নয়, মোল্লা আলী কারী তার ‘মিরকাত’ গ্রন্থে ‘পাগড়ি’ বিষয়ক আলোচনায় এ হাদীসটি প্রমাণ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। এমনকি এর দুর্বলতা বা এ বিষয়ে ইমাম সাখাবী ও মানূফীর মতামতও উল্লেখ করেন নি।[4]
[1] ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৩/২৪৪; সাখাবী, মাকাসিদ, পৃ: ২৯৮; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার আল-মারফূ‘আহ, পৃ: ১৪৭; আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ৮৭-৮৮; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ আল-হাসানাহ, পৃ: ১২; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৩, ৯৫।
[2] সুয়ূতী, যাইলুল লআলী, পৃ. ১১০; আল-জামিউস সাগীর ২/১০৮।
[3] মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার আল-মারফূ‘আ, পৃ: ১৪৭।
[4] মোল্লা আলী কারী, মিরকাত ৮/১৪৭।
২৪. পাগড়ীর নামাযে ১০,০০০ নেকি
আনাস ইবনু মালিকের (রা:) সূত্রে প্রচার করেছে মিথ্যাবাদীরা:
اَلصَّلاَةُ
فِيْ الْعِمَامَةِ بِعَشَرَةِ آَلاَفِ حَسَنَةٍ
‘‘পাগড়ীসহ নামাযে দশহাজার নেকী রয়েছে।’’[1]
এভাবে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, ‘পাগড়ী পরে নামায আদায়ের ফযীলতে’ যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই জাল ও বানোয়াট কথা।
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ২৯৮; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৪৭, নং ৫৬১-৫৬৪; আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ৮৭-৮৮, নং ১৭৭; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১২৫, নং ৫৮৪, ৫৮৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৩, ৯৫।
২৫. নতুন পোশাক পরিধানের সময়
রাসূলুল্লাহ ﷺ নতুন পোশাক পরিধানের জন্য কোনো সময়কে পছন্দ করতেন বলে কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে নিম্নের হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে, যাকে মুহাদ্দিসগণ জাল বলে গণ্য করেছেন:
كَانَ
رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِذَا اسْتَجَدَّ ثَوْباً لَبِسَهُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ
‘‘রাসূলুল্লাহ ﷺ নতুন পোশাক পরলে শুক্রবারে তা পরতেন।’’[1]
[1] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ৪/১৩৬; ইবনু আব্দিল বার্র, তামহীদ ২৪/৩৬; ইবনু হিববান, মাজরুহীন ২/২৬৭-২৬৮; ইবনু হাজার, তাহযীব ৯/২২৮; তাকরীব, পৃ ৪৮৮; ইবনুল জাওযী, আল-ইলালুল মুতানাহিয়া ২/৬৮২; আলবানী, যায়ীফুল জামিয়, পৃ: ৬২৯, যায়ীফাহ ৪/১১০-১১১।
২৬. দাড়ি ছাঁটা
ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনান গ্রনেহ বলেন: আমাদেরকে হান্নাদ বলেছেন, আমাদেরকে উমার ইবনু হারূন বলেছেন, তিনি উসামা ইবনু যাইদ থেকে, তিনি আমর ইবনু শু‘আইব থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তাঁর দাদা থেকে,
كَانَ
يَأْخُذُ مِنْ لِحْيَتِهِ مِنْ عَرْضِهَا وَطُولِهَا
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের দাঁড়ির দৈর্ঘ ও প্রস্থ থেকে কাটতেন।’’
ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন: ‘‘এ হাদীসটি গরীব (দুর্বল)। আমি মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (ইমাম বুখারী)-কে বলতে শুনেছি, উমার ইবনু হারূন কোনোরকম চলনসই রাবী (مقارب الحديث)। তার বর্ণিত যত হাদীস আমি জেনেছি, সবগুলোরই কোনো না কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়। কিন্তু এই হাদীসটির কোনোরূপ ভিত্তি পাওয়া যায় না। আর এই হাদীসটি উমার ইবনু হারূন ছাড়া আর কারো সূত্রে জানা যায় না।’’[1]
ইমাম তিরমিযীর আলোচনা থেকে আমরা তিনটি বিষয় জানতে পারি: (১) এ হাদীসটি একমাত্র উমার ইবনু হারূন ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে বর্ণিত হয় নি। একমাত্র তিনিই দাবি করেছেন যে, উসামা ইবনু যাইদ আল-লাইসী তাকে এ হাদীসটি বলেছেন। (২) ইমাম বুখারীর মতে উমার ইবনু হারূন একেবারে পরিত্যক্ত রাবী নন। (৩) উমার ইবনু হারূন বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের ভিত্তি পাওয়া গেলেও এ হাদীসটি একেবারেই ভিত্তিহীন।
অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস দ্বিতীয় বিষয়ে ইমাম বুখারীর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। বিষয়টির সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমাদেরকে মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতি এবং এ বিষয়ক মতভেদ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করবে।
উমার ইবনু হারূন ইবনু ইয়াযিদ বালখী (১৯৪ হি) ২য় হিজরী শতকের একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁর আরো একটি বিশেষ পরিচয় ছিল যে, তিনি মুহাদ্দিসগণের ও আহলূস সুন্নাতের আকীদার পক্ষে মুরজিয়াগণের বিপক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখতেন। ফলে অনেক মুহাদ্দিসই তাঁকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, তিনি তাঁর কোনো কোনো উস্তাদের নামে এমন অনেক হাদীস বলেন, যেগুলো সে সকল উস্তাদের অন্য কোনো ছাত্র বলেন না। মুহাদ্দিসগণের তুলনামূলক নিরীক্ষায় এগুলো ধরা পড়ে।
এর কারণ নির্ণয়ে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তাঁর প্রসিদ্ধি ও বিদ‘আত বিরোধী ভূমিকার ফলে অনেক মুহাদ্দিস তাঁর বিষয়ে ভাল ধারণা রাখতেন। তাঁরা তাঁর এ একক বর্ণনাগুলোর ব্যাখ্যায় বলেন যে, সম্ভবত তিনি অনেক হাদীস মুখস্থ করার ফলে কিছু হাদীসে অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল করতেন। এদের মতে তিনি ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলতেন না। এদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম বুখারী ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস।
অপরদিকে অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের নিরীক্ষায় তাঁর মিথ্যা ধরা পড়েছে। এদের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১৮১ হি)। তিনি বলেন, আমি ইমাম জাফর সাদিকের (১৪৮ হি) কাছ থেকে হাদীস শিক্ষা করার জন্য মক্কায় গমন করি। কিন্তু আমার পৌঁছানোর আগেই তিনি ইন্তিকাল করেন। ফলে আমি তাঁর কাছ থেকে কিছু শিখতে পারি নি। আর উমার ইবনু হারূন আমার পরে মক্কায় আগমন করে। এরপরও সে দাবি করে যে, সে ইমাম জাফর সাদিক থেকে অনেক হাদীস শুনেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, সে মিথ্যাবাদী।
আব্দুর রাহমান ইবনু মাহদী (১৯৪হি) বলেন, উমার ইবনু হারূন আমাদের কাছে এসে জাফর ইবনু মুহাম্মদ (ইমাম জাফর সাদিক)-এর সূত্রে অনেক হাদীস বলেন। তখন আমরা উমার ইবনু হারূনের জন্ম এবং তার হাদীস শিক্ষার জন্য মক্কায় গমনের তারিখ হিসাব করলাম। এতে আমরা দেখলাম যে, উমারের মক্কায় গমনের আগেই জা’ফর ইন্তিকাল করেন। (উমার ১২৫/১৩০ হিজরীর দিকে জন্মগ্রহণ করেন। জাফর সাদিক ১৪৮ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। এ সময়ে উমার হাদীস শিক্ষার জন্য বের হন নি।)
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল বলেন, উমার ইবনু হারূন একবার কিছু হাদীস বলেন। পরবর্তী সময়ে সে হাদীসগুলোই তিনি অন্য উস্তাদের নামে এবং অন্য সনদে বলেন। ফলে আমরা তার হাদীস পরিত্যাগ করি।
এভাবে অনেক মুহাদ্দিস উমার ইবনু হারূনকে মিথ্যাবাদী বা পরিত্যক্ত বলেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইয়াহইয়া কাত্তান, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, নাসাঈ, সালিহ জাযরাহ, আবূ নু‘আইম, ইবনু হিববান ও ইবনু হাজার।[2] এ জন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন।[3]
এখানে উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা), আবূ হুরাইরা (রা) প্রমুখ সাহাবী থেকে গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা হজ্জ বা উমরার পরে যখন মাথা টাক করতেন, তখন দাড়িকে মুষ্টি করে ধরে মুষ্টির বাইরের দাড়ি কেটে ফেলতেন।[4] এজন্য কোনো কোনো ফকীহ বলেছেন যে, এক মুষ্টি পরিমাণের বেশি দাড়ি কেটে ফেলা যাবে। অন্যান্য ফকীহ বলেছেন যে, দাড়ি যত বড়ই হোক ছাঁটা যাবে না, শুধুমাত্র অগোছালো দাড়িগুলো ছাঁটা যাবে।
[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৯৪।
[2] ইবনু হাজার, তাহযীব ৭/৪৪১-৪৪৩; তাকরীব, পৃ. ৪১৭।
[3] আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৬৫৩; যায়ীফাহ ১/৪৫৬-৪৫৭।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২০৯; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ২/২৫৫, ৬/৮২; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/১০৪; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১০/৩৫০।
২৭. আংটি ও পাথরের গুণাগুণ
সমাজে প্রচলিত অসংখ্য মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীসের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পাথরের গুণাগুণ বর্ণনার হাদীস। মুসলিমের ঈমান নষ্টকারী বিভিন্ন শয়তানী ওসীলার মধ্যে অন্যতম হলো জ্যোতিষী শাস্ত্র এবং সমাজের আনাচে কানাচে ছাড়িয়ে পড়া ভন্ড জ্যোতিষীর দল। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, কোন জ্যোতিষী বা ভাগ্য গণনাকারীর কাছে গেলে বা তার কথা বিশ্বাস করলে মুসলিম কাফির হয়ে যায় এবং তার ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। এ বিষয়ে এখানে আলোচনা সম্ভব নয়। জ্যোতিষীদের অনেক ভন্ডামীর মধ্যে রয়েছে পাথর নির্ধারণ। তারা বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন ধরনের পাথরের আংটি পরতে পরামর্শ দেন। কেউ কেউ আবার এ বিষয়ে হাদীসও উল্লেখ করেন। পাথরের মধ্যে কল্যাণ-অকল্যাণের শক্তি থাকার বিশ্বাস ঈমান বিরোধী বিশ্বাস। বিভিন্ন অমুসলিম সমাজ থেকে এ বিশ্বাস মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, পাথরের গুণাগুণ সম্পর্কিত সকল হাদীসই বানোয়াট। বিভিন্ন ধরনের পাথর, যেমন: যবরজদ পাথর, ইয়াকুত পাথর, যমররদ পাথর, আকীক পাথর ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণিত কোন হাদীসই নির্ভরযোগ্য নয়।[1]
[1] মোল্লা কারী, আল-আসরার ৯৩-৯৪ পৃ, আল-মাসনূ’ ৫১ পৃ, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, ৮৫পৃ, বাকর আবু যাইদ, আত-তাহদীস, ১৬৯ পৃ, ইবনুল কাইয়িম আল মানার, ১৩২পৃ, আবু ইসহাক আল হুয়াইনী, জুন্নাতুল মুরতাব, ৪৮৫-৪৮৬ পৃ।
২৮. আংটি পরে নামাযে ৭০ গুণ সাওয়াব
আংটির ফযীলতে বানোয়াট একটি হাদীস
صَلاَةٌ
بِخَاتَمٍ تَعْدِلُ سَبْعِيْنَ بِغَيْرِ خَاتَمٍ
‘‘আংটি পরে নামায আদায় করলে আংটি ছাড়া নামায আদায়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব হয়।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। রাসূলুল্লাহ ﷺ আংটি ব্যবহার করেছেন বলে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত। তবে আংটি পরতে উৎসাহ দিয়েছেন বলে কোন সহীহ হাদীস নেই।[1]
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ২৭১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৪৬; মাসনূ‘য়, পৃ: ৮৭; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১২৫।
২৯. নখ কাটার নিয়মকানুন
নিয়মিত নখ কাটা ইসলামের অন্যতম বিধান ও সুন্নাত। নখ কাটার জন্য কোন নির্ধারিত নিয়ম বা দিবস রাসূলুল্লাহ ﷺ শিক্ষা দেন নি। বিভিন্ন গ্রন্থে নখ কাটার বিভিন্ন নিয়ম, উল্টোভাবে নখ কাটা, অমুক নখ থেকে শুরু করা ও অমুক নখে শেষ করা, অমুক দিনে নখ কাটা বা না কাটা ইত্যাদির ফযীলত বা ফলাফল বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো সবই পরবর্তী যুগের প্রবর্তিত নিয়ম। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ বিষয়ে যা কিছু প্রচলিত সবই বাতিল ও বানোয়াট।
নখ কাটার জন্য এ সকল নিয়ম পালন করাও সুন্নাত বিরোধী কাজ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নখ কাটতে নির্দেশ দিয়েছেন। কোন বিশেষ নিয়ম বা দিন শিক্ষা দেন নি। কাজেই যে কোনভাবে যে কোন দিন নখ কাটলেই এ নির্দেশ পালিত হবে। কোন বিশেষ দিনে বা কোন বিশেষ পদ্ধতিতে নখ কাটার কোন ফযীলত কল্পনা করার অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষাকে অপূর্ণ মনে করা এবং তাঁর শিক্ষাকে পূর্ণতা দানের দু:সাহস দেখান। আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ সুন্নাতের মধ্যে জীবন যাপনের তাওফীক প্রদান করেন।[1]
[1] দেখুন: সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩১৩, ৪২১ নং ৭৭২, ১১৬৩, মুল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৭০, ২৪১, নং ৬৫৪, ৯৫২, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ৯৯, ১৫৬, নং ২১৫, ৩৫৭, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৪৬, ১৮৮, নং ৭১৬, ১০৬৫।
৩০. খাদ্য গ্রহণের সময় কথা না বলা
খাদ্য গ্রহণের সময় কথা বলা নিষেধ বা কথা না বলা উচিত অর্থে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট। শুধু বানোয়াটই নয়, সহীহ হাদীসের বিপরীত। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণ খাদ্য গ্রহণের সময় বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলতেন ও গল্প করতেন।[1]
[1] দেখুন: সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩২৫; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৭৪; আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ১০৩-১০৪; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৫০।
৩১. খাওয়ার সময় সালাম না দেওয়া
প্রচলিত ধারণা হলো খাওয়ার সময় সালাম দেয়া ঠিক না। বলা হয়:
لاَ
سَلاَمَ عَلَى آَكِلٍ
‘‘খাদ্য গ্রহণকারীকে সালাম দেয়া হবে না।’’
সাখাবী, মোল্লা কারী ও আজলূনী বলেন, হাদীসে এ কথার অস্তিত্ব নেই। তবে যদি কারো মুখের মধ্যে খাবার থাকে, তাহলে তাকে সালাম না দেওয়া ভাল। এ অবস্থায় কেউ সালাম দিলে উত্তর প্রদান ওয়াজিব নয়।[1]
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৪৬০; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ২৬৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৪৮৮; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ২০৩।
৩২. মুমিনের ঝুটায় রোগমুক্তি
আরেকটি প্রচলিত বানোয়াট কথা হলো:
سُؤْرُ
الْمُؤْمِنِ شِفَاءٌ... رِيْقُ الْمُؤْمِنِ شِفَاءٌ
‘‘মুমিনের ঝুটায় রোগমুক্তি বা মুমিনের মুখের লালাতে রোগমুক্তি।’’
কথাটি কখনোই হাদীস নয় বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা নয়।[1]
মুমিনের ঝুটা খাওয়া রোগমুক্তির কারণ নয়, তবে ইসলামী আদবের অংশ। রাসূলুল্লাহ ﷺ, তাঁর সাহাবীগণ ও পরবর্তী যুগের মুসলিমগণ একত্রে একই পাত্রে বসে খাওয়া-দাওয়া করেছেন এবং একই পাত্রে পানি পান করেছেন। এখনো এ অভ্যাস আরবে ও ইউরোপে প্রচলিত আছে। আমাদের দেশে ভারতীয় বর্ণ প্রথা ও অচ্ছুত প্রথার কারণে একে অপরের ঝুটা খাওয়াকে ঘৃণা করা হয়। এগুলো ইসলাম বিরোধী মানসিকতা।
[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ২৪১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ: ১২৯; আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ৭৫; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ পৃ: ১১৪।
৩৩. খাওয়ার আগে-পরে লবণ খাওয়ায় রোগমুক্তি
আমাদের সমাজে প্রচলিত আরেকটি জাল হাদীস:
إِذَا
أَكَلْتَ فَابْدَأْ بِالْمِلْحِ وَاخْتِمْ بِالْمِلْحِ فَإِنَّ الْمِلْحَ شِفَاءٌ
مِنْ سَبْعِيْنَ دَاءً
‘‘তুমি যখন খাদ্যগ্রহণ করবে, তখন লবণ দিয়ে শুরু করবে এবং লবণ দিয়ে শেষ করবে; কারণ লবণ ৭০ প্রকারের রোগের প্রতিষেধক...।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ কথাটি মিথ্যা ও বানোয়াট।[1]
[1] হাইসামী, যাওয়াইদ মুসনাদুল হারিস ১/৫২৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৩৩; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১৯২; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ২১০; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ৫৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/২১১, ৩৭৪-৩৭৫; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/২৪৩; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৪১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩০৩; আল-মাসনূ, পৃ. ৪৬, ১৯০; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৫৫৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/২০৮।
৩৪. লাল দস্তরখানের ফযীলত
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো লাল দস্তরখান ব্যবহার করেছেন বা করতে উৎসাহ দিয়েছেন বলে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে দেখা যায় না। এ বিষয়ে অনেক বানোয়াট কথা প্রচলিত। যেমন: ‘‘হযরত রাসূল মকবুল (ﷺ) ... লাল দস্তরখান ব্যবহার করা হতো। ... যে ব্যক্তি লাল দস্তরখানে আহার করে তার প্রতি লোকমার প্রতিদানে একশ’ করে ছাওয়াব পাবে এবং বেহেস্তের ১০০ টি দরজা তার জন্য নির্ধারিত হবে। সে ব্যক্তি বেহেস্তের মধ্যে সব সময়ই ঈসা (আ) ও অন্য নবীদের হাজার হাজার সালাম ও আশীর্বাদ লাভ করবে....। এরপর হযরত কসম খেয়ে বর্ণনা করলেন, কসম সেই খোদার যার হাতে নিহিত আছে আমার প্রাণ; যে ব্যক্তি লাল দস্তরখানে রুটি খাবে সে এক ওমরা হজ্বের ছাওয়াব পাবে এবং এক হাজার ক্ষুধার্থকে পেট ভরে আহার করানোর ছাওয়াব পাবে। সে ব্যক্তি এত বেশী ছাওয়াব লাভ করবে যেন আমার উম্মতের মধ্যে হাজার বন্দীকে মুক্ত করালেন...।’’ এভাবে আরো অনেক আজগুবি, উদ্ভট ও বানোয়াট কাহিনী ও সাওয়াবের ফর্দ দেয়া হয়েছে।[1]
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দস্তরখান ব্যবহার করতেন। তবে তা ব্যবহার করার কোনো নির্দেশ বা উৎসাহ তাঁর থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয় নি। দস্তরখান ছাড়া খাদ্যগ্রহণের বিষয়ে তিনি কোনো আপত্তিও করেন নি। আমরা দস্তরখান বিষয়ে যতটুকু গুরুত্ব প্রদান করি, অনেক ফরয বা হারামের বিষয়ে সেরূপ গুরুত্ব প্রদান করি না। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দস্তরখান ব্যবহার করতেন বলতে আমরা বুঝি যে, তিনি আমাদের মত দস্তরখানের উপর থালা, বাটি ইত্যাদি রেখে খানা খেতেন। ধারণাটি সঠিক নয়। তাঁর সময়ে চামড়ার দস্তরখান বা ‘সুফরা’ ব্যবহার করা হতো এবং কোনো থালা, বাটি, গামলা ইত্যাদি ছাড়াই সরাসরি ‘সুফরা’র উপরেই সরাসরি খেজুর, পনির, ঘি ইত্যাদি খাদ্য রেখে খাওয়া হতো।[2]
[1] শায়খ মুঈন উদ্দীন চিশতী, আনিসুল আরওয়াহ, পৃ. ৩০-৩১।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২০৫৯।
No comments