হাদীসের নামে জালিয়াতি - অষ্টম অধ্যায় - মিথ্যা হাদীস বিষয়ক কিছু বিভ্রান্তি
৮. ১. হাদীস গ্রন্থ বনাম জাল হাদীস
অজ্ঞতাবশত অনেকে মনে করেন যে, কোনো হাদীস কোনো হাদীস-গ্রন্থে সংকলিত থাকার অর্থ হলো হাদীসটি সহীহ, অথবা অন্তত উক্ত গ্রন্থের সংকলকের মতে হাদীসটি সহীহ। যেমন কোনো হাদীস যদি সুনানু ইবনি মাজাহ বা মুসান্নাফু আব্দুর রায্যাক গ্রন্থে সংকলিত থাকে তার অর্থ হলো হাদীসটি নিশ্চয় সহীহ, নইলে ইবনু মাজাহ বা আব্দুর রায্যাকের মত অত বড় মুহাদ্দিস তা গ্রহণ করলেন কেন? অন্তত, ইবনু মাজাহ বা আব্দুর রায্যাকের মতে হাদীসটি সহীহ, নইলে তিনি তাঁর গ্রন্থে হাদীসটির স্থান দিতেন না।
আমরা দেখেছি যে, এ ধারণাটির উভয় দিকই ভিত্তিহীন। অধিকাংশ মুহাদ্দিসই তাঁদের গ্রন্থে সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ সকল প্রকার হাদীসই সংকলন করেছেন। তাঁরা কখনোই দাবি করেন নি বা পরিকল্পনাও করেন নি যে, তাঁদের গ্রন্থে শুধু সহীহ হাদীস সংকলন করবেন। আর যারা সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেছেন তাদের দাবিও মুহাদ্দিসগণ যাচাই না করে গ্রহণ করেন নি।
অধিকাংশ হাদীসগ্রন্থের মধ্যেই সহীহ, যয়ীফ, জাল ও বাতিল হাদীস বিদ্যমান; কারণ মুহাদ্দিসগণের উদ্দেশ্য ছিল সনদ-সহ সকল কথিত বিষয় সংকলন করা। ৯ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবনু হাজার আসকালানী (৮৫২হি) চতুর্থ শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম তাবারানীর (৩৬০হি) গ্রন্থগুলির মধ্যে বিদ্যমান অনেক জাল ও বাতিল হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন:
وهذا
أمر لا يختص به الطبراني فلا معنى لإفراده باللوم، بل أكثر المحدثين في الأعصار الماضية
من سنة مائتين وهلم جرا إذا ساقوا الحديث بإسناده اعتقدوا أنهم برؤا من عهدته
‘‘এটি তাবারানীর একক বিষয় নয় এবং এ বিষয়ে তাকে পৃথকভাবে দোষ দেওয়ার কিছু নেই; দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে পরবর্তী যুগগুলির অধিকাংশ মুহাদ্দিস মনে করতেন যে, সনদ-সহ হাদীস উল্লেখ করলেই দায়িত্ব পালিত হয়ে গেল এবং তাঁরা যিম্মাদারি থেকে মুক্ত হলেন।’’[1]
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবীকে প্রশ্ন করা হয়: ‘‘সুনান চতুষ্ঠয়: নাসাঈ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনু মাজাহ, বাইহাকীর লিখিত গ্রন্থসমূহ, দারাকুতনীর লিখিত গ্রন্থসমূহ, হাকিম, ইবনু আবী শাইবা, ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ ও বিশাল বিশাল হাদীসের গ্রন্থসমূহের হাদীসগুলি কি সহীহ? ... না কি হাসান ...? নাকি অন্য কিছু?’’ উত্তরে তিনি বলেন:
ليس
كل ما في هذه الكتب وأمثالها صحيحاً أو حسناً، بل هي مشتملة على الأخبار الصحيحة
والحسنة والضعيفة والموضوعة.
‘‘এ সকল গ্রন্থে এবং এ ধরনের অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে সংকলিত সকল হাদীস সহীহ বা হাসান নয়; বরং এ সকল গ্রন্থের মধ্যে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও জাল সকল প্রকারের হাদীস বিদ্যমান।’’[2]
এরপর তিনি সুদীর্ঘ আলোচনায় প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বুজুর্গগণের অনেক উদ্ধৃতি ও বিশ্লেষণ উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, তাঁরা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, এ সকল গ্রন্থের মধ্যে অনেক সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ ও জাল হাদীস বিদ্যমান। কাজেই সনদ বিচারে জাল প্রমাণিত হলে তাকে গ্রন্থকারের মর্যাদার অযুহাতে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ বা অনুমতি কোনো মুহাদ্দিস, ফকীহ বা বুজুর্গ দেন নি।[3]
আমাদের সমাজে ‘সিহাহ সিত্তাহ’[4] নামে প্রসিদ্ধ ৬ টি গ্রন্থের মধ্যে ২টি সহীহ গ্রন্থ: ‘‘সহীহ বুখারী’’ ও ‘‘সহীহ মুসলিম’’ ছাড়া বাকি ৪টির সংকলকও শুধুমাত্র সহীহ হাদীস বর্ণনা করবেন বলে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁরা তাঁদের গ্রন্থগুলিতে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক দুর্বল বা বানোয়াট হাদীসও সংকলন করেছেন। তবে তাঁদের গ্রন্থগুলোর অধিকাংশ হাদীস নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারণে পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ সাধারণভাবে তাঁদের গ্রন্থগুলোর উপর নির্ভর করেছেন, সাথে সাথে তাঁরা এসকল গ্রন্থে সংকলিত দুর্বল ও বানোয়াট হাদীস সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বিধান প্রদান করেছেন। আমরা দেখলাম যে, আব্দুল হাই লাখনবী সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, এ চারটি গ্রন্থে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও বানোয়াট সকল প্রকারের হাদীস রয়েছে।
ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহর বিবরণ দেখেছি। তিনি সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিযী: এ তিনটি গ্রন্থকে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত করেছেন, যে সকল গ্রন্থের হাদীসসমূহ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলোতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। কিন্তু তিনি ‘সুনান ইবন মাজাহ’-কে এই পর্যায়ে উল্লেখ করেন নি। এর কারণ হলো, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ ইবনু মাজাহ আল-কাযবীনী (২৭৫ হি) সংকলিত ‘সুনান’ গ্রন্থটিকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণযোগ্য গ্রন্থাবলির অন্তর্ভুক্ত করেন নি। হিজরী ৭ম শতক পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অতিরিক্ত এ তিনটি সুনানগ্রন্থকেই মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং হাদীস শিক্ষা ও শিক্ষাদানের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করতেন। ৫ম-৬ষ্ঠ হিজরী শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু তাহির মাকদিসী, আবুল ফাদল ইবনুল কাইসুরানী (৫০৭ হি) এগুলোর সাথে সুনান ইবন মাজাহ যোগ করেন।
তাঁর এ মত পরবর্তী ২ শতাব্দী পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেন নি। ৭ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আব্দুর রাহমান (৬৪৩ হি), আল্লামা আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-নাবাবী (৬৭৬ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসের মূল উৎস হিসাবে উপরের ৫টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। সুনান ইবন মাজাহ-কে তাঁরা এগুলোর মধ্যে গণ্য করেন নি। পরবর্তী যুগের অনেক মুহাক্কিক আলিম এদের অনুসরণ করেছেন। অপরদিকে ইমাম ইবনুল আসীর মুবারাক ইবনু মুহাম্মাদ (৬০৬ হি) ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস ৬ষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে ইমাম মালিকের মুআত্তাকে গণ্য করেছেন।
সুনান ইবন মাজাহকে উপরের ৩টি সুনানের পর্যায়ভুক্ত করতে আপত্তির কারণ হলো ইমাম ইবনু মাজাহর সংকলন পদ্ধতি এ তিন গ্রন্থের মত নয়। উপরের তিন গ্রন্থের সংকলক মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। বিষয়বস্তের প্রয়োজনে কিছু যয়ীফ হাদীস গ্রহণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলির দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে ইবনু মাজাহ তৎকালীন সাধারণ সংকলন পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, এসকল যুগের অধিকাংশ সংকলক সনদসহ প্রচলিত সকল হাদীস সংকলন করতেন। এতে সহীহ, যয়ীফ, মাউদূ সব প্রকারের হাদীসই তাঁদের গ্রন্থে স্থান পেত। সনদ বিচার ছাড়া হাদীসের নির্ভরতা যাচাই করা সম্ভব হতো না। ইবনু মাজাহও এ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তিনি সহীহ বা হাসান হাদীস সংকলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। তিনি সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ ও কিছু মাউযূ হাদীসও সংকলন করেছেন। তিনি এসকল যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীসের ক্ষেত্রে কোনো মন্তব্য করেন নি।
৮ম হিজরী শতক থেকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস সুনান ইবনি মাজাহকে ৪র্থ সুনানগ্রন্থ হিসাবে গণ্য করতে থাকেন। মুআত্তা ও সুনান ইবনি মাজাহর মধ্যে পার্থক্য হলো, মুআত্তা গ্রন্থের হাদীস সংখ্য কম এবং এ গ্রন্থের সকল সহীহ হাদীস উপরের ৫ গ্রন্থের মধ্যে সংকলিত। ফলে এ গ্রন্থটিকে পৃথকভাবে অধ্যয়ন করলে অতিরিক্ত হাদীস জানা যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে সুনান ইবন মাজাহর মধ্যে উপরের ৫ টি গ্রন্থের অতিরিক্ত সহস্রাধিক হাদীস রয়েছে। এজন্য পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ এ গ্রন্থটিকে ৪র্থ সুনান হিসাবে গ্রহণ করেছেন।
ইমাম ইবনু মাজাহর সুনান গ্রন্থে মোট ৪৩৪১টি হাদীস সংকলিত। তন্মধ্যে প্রায় তিন হাজার হাদীস উপরের পাঁচটি গ্রন্থে সংকলিত। বাকী প্রায় দেড় হাজার হাদীস অতিরিক্ত। ৯ম হিজরী শতকের মুহাদ্দিস আল্লামা আহমাদ ইবনু আবী বাকর আল-বূসীরী (৮৪০ হি) ইবনু মাজাহর এসকল অতিরিক্ত হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন। আল্লামা বূসীরী ১৪৭৬টি হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন, যেগুলো উপরের ৫টি গ্রন্থে সংকলিত হয় নি, শুধুমাত্র ইবনু মাজাহ সংকলন করেছেন। এগুলোর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সহীহ বা হাসান হাদীস এবং প্রায় একতৃতীয়াংশ হাদীস যয়ীফ। এগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধশত হাদীস মাউযূ বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন মুহাদ্দিসগণ।[5]
[1] ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৩/৭৪।
[2] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আজবিবাতুল ফাদিলাহ, পৃ. ৬৬।
[3] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আজবিবাতুল ফাদিলাহ, পৃ. ৬৬-১১৭।
[4] ‘সিহাহ সিত্তা’ পরিভাষাটি ভারতীয় ব্যবহার। এই ৬ টি গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা সুপরিচিত। তবে গ্রন্থগুলি ‘সহীহ’ নয়। বরং ২টি গ্রন্থ সহীহ ও বাকিগুলি সুনান। এজন্য মুহাদ্দিসগণের মধ্যে সুপরিচিত পরিভাষা হলো ‘আল-কুতুবুস সিত্তা’ ‘পুস্তক ছয়টি’। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও ‘সিহাহ সিত্তা’ পরিভাষাটি প্রচলিত নয়।
[5] ইবনুল কাইসুরানী, আবুল ফাদল মুহাম্মাদ ইবনু তাহির (৫০৭ হি), শুরুতুল আইম্মাহ আস-সিত্তাহ পৃ: ১৩, ২৪-২৬; বুসীরী, আহমাদ ইবনু আবী বাকর (৮৪০ হি), যাওয়াইদ ইবনি মাজাহ, কাত্তানী, আর-রিসালাহ আল-মুসতাতরাফাহ, পৃ: ১২-১৩।
৮. ২. আলিম-বুজুর্গগণের গ্রন্থ বনাম জাল হাদীস
হাদীসের গ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থে হাদীস উল্লেখ করা হয়। তাফসীর, ফিকহ, ওয়ায, আখলাক, ফযীলত, তাসাউফ, দর্শন, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকাদিতে অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়। সাধারণত এ সকল গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস উল্লেখ করা হয়। অনেকেই অজ্ঞতা বশত ধারণা করেন যে, এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ নিশ্চয় যাচাই বাছাই করে হাদীসগুলো লিখেছেন। সহীহ না হলে কি আর তিনি হাদীসটি লিখতেন?
এ ধারণাটিও ভিত্তিহীন, ভুল এবং উপরের ধারণাটির চেয়েও বেশি বিভ্রান্তিকর। সাধারণত প্রত্যেক ইল্মের জন্য পৃথক ক্ষেত্র রয়েছে। এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বিষয়ের আলিম অন্য বিষয়ে অত বেশি সময় দিতে পারেন না। মুফাস্সির, ফকীহ, ঐতিহাসিক, সূফী, ওয়ায়িয ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মরত আলিম ও বুযুর্গ স্বভাবতই হাদীসের নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনার গভীরতায় যেতে পারেন না। সাধারণভাবে তাঁরা হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচলিত গ্রন্থ, জনশ্রুতি ও প্রচলনের উপরে নির্ভর করেন। এজন্য তাঁদের গ্রন্থে অনেক ভিত্তিহীন, সনদহীন ও জাল কথা পাওয়া যায়।
আল্লামা নাবাবী তাঁর ‘‘তাকরীব’’ গ্রন্থে এবং আল্লামা সুয়ূতী তাঁর ‘‘তাদরীবুর রাবী’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরার ফযীলতে অনেক মিথ্যা কথাকে কিছু বুযুর্গ দরবেশ হাদীস বলে সমাজে চালিয়েছেন। কোনো কোনো মুফাসসির, যেমন - আল্লামা আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আস সা’লাবী নিশাপূরী (৪২৭ হি.) তাঁর ‘‘তাফসীর’’ গ্রন্থে, তাঁর ছাত্র আল্লামা আলী ইবন আহমাদ আল-ওয়াহিদী নিশাপূরী (৪৬৮ হি.) তাঁর ‘‘বাসীত’’, ‘‘ওয়াসিত’’, ‘‘ওয়াজীয’’ ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থে, আল্লামা আবুল কাসেম মাহমূদ ইবন উমার আয-যামাখশারী (৫৩৮ হি.) তাঁর ‘‘কাশ্শাফ’’ গ্রন্থে, আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবন উমার আল-বাইযাবী (৬৮৫ হি.) তাঁর ‘‘আনওয়ারুত তানযীল’’ বা ‘‘তাফসীরে বাইযাবী’’ গ্রন্থে এসকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এ কাজটি করে ভুল করেছেন। সুয়ূতী বলেন : ‘‘ইরাকী (৮০৬ হি.) বলেছেন যে, প্রথম দুজন - সা’লাবী ও ওয়াহিদী সনদ উল্লেখপূর্বক এসকল বানোয়াট বা জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন। ফলে তাঁদের ওজর কিছুটা গ্রহণ করা যায়, কারণ তাঁরা সনদ বলে দিয়ে পাঠককে সনদ বিচারের দিকে ধাবিত করেছেন, যদিও মাওযূ বা মিথ্যা হাদীস সনদসহ উল্লেখ করলেও সাথে সাথে তাকে ‘মাওযূ’ না বলে চুপ করে যাওয়া জায়েয নয়। কিন্তু পরবর্তী দুইজন - যামাখশারী ও বাইযাবী-এর ভুল খুবই মারাত্মক। কারণ, তাঁরা সনদ উল্লেখ করেন নি, বরং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে সরাসরি সুস্পষ্টভাবে এ সকল বানোয়াট কথা উল্লেখ করেছেন।[1]
৪র্থ হিজরী শতাব্দীর সুপ্রসিদ্ধ সূফী ও বুজুর্গ শাইখ আবূ তালিব মাক্কী মুহাম্মাদ ইবন আলী (৩৬৮হি)। তাঁর রচিত ‘কুতুল কুলূব’ বা ‘হৃদয়ের খোরাক’ বইটি তাসাউফের জগতে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। পরবর্তী যুগের প্রসিদ্ধতম আলিম ও সূফী হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবূ হামিদ গাযালী মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ (৫০৫ হি)। তাঁর রচিত ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থটি মুসলিম জগতের প্রসিদ্ধতম গ্রন্থগুলির অন্যতম। তাঁদের বুজুর্গি এবং তাঁদের গ্রন্থগুলির প্রতি শ্রদ্ধা-সহ উম্মাতের আলিমগণ এগুলির মধ্যে বিদ্যমান জাল হাদীসগুলি চিহ্নিত করেছেন। মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি) এ সকল গ্রন্থে বিদ্যমান জাল হাদীস সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন: ‘‘কুতুল কুলুব, এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন, তাফসীরে সা’লাবী ইত্যাদি গ্রন্থে হাদীসটির উল্লেখ আছে দেখে ধোঁকা খাবেন না।[2]
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী হানাফী ফিক্হের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলির নাম ও পর্যায় বিন্যাস উল্লেখ করে বলেন: ‘‘আমরা ফিকহী গ্রন্থাবলির নির্ভরযোগ্যতার যে পর্যায় উল্লেখ করলাম তা সবই ফিকহী মাসায়েলের ব্যাপারে। এ সকল পুস্তকের মধ্যে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর বিশুদ্ধতা বা নির্ভরযোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে এই বিন্যাস মোটেও প্রযোজ্য নয়। এরূপ অনেক নির্ভরযোগ্য ফিকহী গ্রন্থ রয়েছে যেগুলোর উপর মহান ফকীহগণ নির্ভর করেছেন, কিন্তু সেগুলো জাল ও মিথ্যা হাদীসে ভরপুর। বিশেষত ‘ফাতওয়া’ বিষয়ক পুস্তকাদি। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সকল পুস্তকের লেখকগণ যদিও ‘কামিল’ ছিলেন, তবে হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে তাঁরা অসতর্ক ছিলেন।’’[3]
এজন্য মুহাদ্দিসগণ ফিক্হ, তাফসীর, তাসাঊফ, আখলাক ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থে উল্লিখিত হাদীসগুলি বিশেষভাবে নিরীক্ষা করে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবন আবু বকর আল-মারগীনানী (৫৯৩ হি.) তাঁর লেখা ফিকাহ শাস্ত্রের প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘‘হেদায়া’’-য় অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি ফকীহ হিসাবে ফিকহী মাসায়েল নির্ধারণ ও বর্ণনার প্রতিই তাঁর মনোযোগ ও সার্বিক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন বা পড়েছেন তা বাছবিচার না করেই লিখেছেন। তিনি কোনো হাদীসের সহীহ বা যয়ীফ বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করতে যান নি। পরবর্তী যুগে আল্লামা জামালুদ্দীন আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবন ইউসূফ যাইলায়ী হানাফী (৭৬২ হি.), আল্লামা আহমাদ ইবন আলী ইবন হাজার আসকালানী (৮৫২ হি.) প্রমুখ মুহাদ্দিস এসকল হাদীস নিয়ে সনদভিত্তিক গবেষণা করে এর মধ্যথেকে সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস নির্ধারণ করেছেন।
অনুরূপভাবে ইমাম গাযালী এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থে ফিক্হ ও তাসাউফ আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি দার্শনিক ও ফকীহ ছিলেন, মুহাদ্দিস ছিলেন না। এজন্য হাদীসের সনদের বাছবিচার না করেই যা শুনেছেন বা পড়েছেন সবই উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে আল্লামা যাইনুদ্দীন আবুল ফাদ্ল আব্দুর রহীম ইবন হুসাইন আল-ইরাকী (৮০৬ হি.) ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তাঁর উল্লিখিত হাদীসসমূহের সনদ-ভিত্তিক বিচার বিশ্লেষণ করে সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীসগুলো নির্ধারণ করেছেন । এছাড়া ৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনু আলী সুবকী (৭৭১ হি) ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে উল্লেখিত কয়েক শত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস একটি পৃথক পুস্তকে সংকলিত করেছেন। পুস্তকটির নাম ‘আল-আহাদীস আল্লাতী লা আস্লা লাহা ফী কিতাবিল এহইয়া’, অর্থাৎ ‘এহইয়া.. গ্রন্থে উল্লিখিত ভিত্তিহীন হাদীসসমূহ’।
[1] জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৩৪১।
[2] মোললা আলী কারী, আল-আসরারুল মারফুয়া, পৃ: ২৮৯।
[3] আব্দুল হাই লাখনবী, আন-নাফি আল-কাবীর, পৃ. ১২-১৩।
৮. ৩. কাশফ-ইলহাম বনাম জাল হাদীস
সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় সুপ্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও আল্লাহর প্রিয় ওলী-রূপে প্রসিদ্ধ আলিমগণের বিষয়ে। যেহেতু তাঁরা ‘সাহেবে কাশফ’ বা কাশ্ফ সম্পন্ন ওলী ছিলেন, সেহেতু আমরা ধারণা করি যে, কাশফের মাধ্যমে প্রদত্ত তথ্যের বিশুদ্ধতা যাচাই না করে তো আর তাঁরা লিখেন নি। কাজেই তাঁরা যা লিখেছেন বা বলেছেন সবই বিশুদ্ধ বলে গণ্য হবে।
আল্লামা সুয়ূতী (৯১১ হি), আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪ হি) প্রমুখ আলিম এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইমাম গাযালীর (রাহ) ‘‘এহ্ইয়াউ উলুমিদ্দীন’’ ও অন্যান্য গ্রন্থে, আব্দুল কাদির জীলানী (রাহ) লিখিত কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লিখিত অনেক মাউযূ বা বানোয়াট হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন যে, কেউ হয়ত প্রশ্ন করবেন: এত বড় আলিম ও এত বড় সাহেবে কাশফ ওলী, তিনি কী বুঝতে পারলেন না যে, এ হাদীসটি বানোয়াট? তাঁর মত একজন ওলী কী-ভাবে নিজ গ্রন্থে মাউযু হাদীস উল্লেখ করলেন? তাঁর উল্লেখের দ্বারা কি বুঝা যায় না যে, হাদীসটি সহীহ? এই সন্দেহের জবাবে তাঁরা যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলোর ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
৮. ৩. ১. বুযুর্গগণ যা শুনেন তা-ই লিখেন
বস্ত্তত সরলপ্রাণ বুযুর্গগণ যা শুনেন তাই লিখেন। এজন্য কোনো বুযুর্গের গ্রন্থে তাঁর কোনো সুস্পষ্ট মন্তব্য ছাড়া কোনো হাদীস উল্লেখ করার অর্থ এটাই নয় যে, তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলে নিশ্চিত হয়েছেন। মূলত তাঁরা যা পড়েছেন বা শুনেছেন তা উল্লেখ করেছেন মাত্র। তাঁরা আশা করেছেন হয়ত এর কোনো সনদ থাকবে, হাদীসের বিশেষজ্ঞগণ তা খুঁজে দেবেন।
৮. ৩. ২. হাদীস বিচারে কাশফের কোনো ভূমিকা নেই
হাদীস বিচারের ক্ষেত্রে কাশফের কোনোই অবদান নেই। কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া নিয়ামত মাত্র, আনন্দ ও শুকরিয়ার উৎস। ইচ্ছামতো প্রয়োগের কোনো বিষয় নয়। আল্লাহ তা’আলা উমার (রা)-কে কাশফের মাধ্যমে শত শত মাইল দূরে অবস্থিত সারিয়ার সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখিয়েছিলেন, অথচ সে উমারকে (রা) হত্যা করতে তাঁরই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আবু লু’লুর কথা তিনি টের পেলেন না।
এছাড়া কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি দ্বারা কখনোই হক বাতিলের বা ঠিক বেঠিকের ফয়সালা হয় না। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মতবিরোধ ও সমস্যা ঘটেছে, কখনোই একটি ঘটনাতেও তাঁরা কাশফ, ইলহাম, স্বপ্ন ইত্যাদির মাধ্যমে হক বা বাতিল জানার চেষ্টা করেন নি। খুলাফায়ে রাশেদীন - আবু বাক্র, উমার, উসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর দরবারে অনেক সাহাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারীর ভুলভ্রান্তির সন্দেহ হলে তাঁরা সাক্ষী চেয়েছেন অথবা বর্ণনাকারীকে কসম করিয়েছেন। কখনো কখনো তাঁরা বর্ণনাকারীর ভুলের বিষয়ে বেশি সন্দিহান হলে তার বর্ণিত হাদীসকে গ্রহণ করেন নি। কিন্তু কখনোই তাঁরা কাশফে মাধ্যমে হাদীসের সত্যাসত্য বিচার করেন নি। পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন, শুনেছেন ও হাদীসের সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট নির্ধারণের জন্য সনদ বর্ণনার ব্যবস্থা নিয়েছেন। বর্ণনাকারীর অবস্থা অনুসারে হাদীস গ্রহণ করেছেন বা যয়ীফ হিসেবে বর্জন করেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা কাশফের উপর নির্ভর করেননি।
হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের জন্য সনদের উপর নির্ভর করা সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদীন ও সুন্নাতে সাহাবা। আর এ বিষয়ে কাশফ, ইলহাম বা স্বপ্নের উপর নির্ভর করা খেলাফে-সুন্নাত, বিদ‘আত ও ধ্বংসাত্মক প্রবণতা।
৮. ৩. ৩. কাশ্ফ- ইলহাম সঠিকত্ব জানার মাধ্যম নয়
ইসলামী আকীদায় কাশফ বা ইলহাম কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার মাপকাঠি নয়। ৬ষ্ঠ শতকের অন্যতম হানাফী আলিম উমার ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭ হি) তাঁর ‘‘আল-আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ’’ ও ৮ম শতকের প্রখ্যাত আলিম সা’দ উদ্দীন মাসঊদ ইবনু উমার আত-তাফতাযানী (৭৯১ হি.) তাঁর ‘‘শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ’’ -তে লিখেছেন :
اَلإِلْهَامُ
الْمُفَسَّرُ بِإِلْقَاءِ مَعْنًى فِيْ الْقَلْبِ بِطَرِيْقِ الْفَيْضِ لَيْسَ
مِنْ أَسْبَابِ الْمَعْرِفَةِ بِصِحَّةِ الشَّيْءِ عِنْدَ أَهْلِ الْحَقِّ
‘‘হক্কপন্থীগণের কাছে ‘ইলহাম’ যা ‘ফয়েযরূপে প্রদত্ত ইলকা’ নামে পরিচিত তা কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার কোনো মাধ্যম নয়।’’[1]
কোনো কোনো অনভিজ্ঞ বুযুর্গ স্বপ্ন, কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির ভিত্তিতে ‘হাদীসের’ বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের দাবি করলেও অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ বুযুর্গগণ এর কঠিন বিরোধিতা করেছেন। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ট বুযুর্গ ও সংস্কারক মুজাদ্দিদ-ই আলফ-ই সানী (রাহ) হক্ক-বাতিল বা বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা জানার ক্ষেত্রে কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির উপর নির্ভর করার কঠিন আপত্তি ও প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বারংবার উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন-হাদীসই কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির সঠিক বা বেঠিক হওয়ার মানদন্ড। কাশফ কখনোই হাদীস বা বা কোনো মতের সঠিকত্ব জানার মাধ্যম নয়।[2]
[1] সা’দ উদ্দীন তাফতাযানী, শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, পৃ: ২২।
[2] মুজাদ্দিদ আলফ সানী, মাকতুবাত শরীফ ১/১, পৃ. ৮৮, ১৭৮, ১৯৫, ১৯৬, ২১০, ১/২ পৃ. ৬৯, ১১০, ১১১, ১৩৩ (মাকতুব নং ৪১, ১০০, ১১২, ১৩১, ১৯১, ২০৯, ২১৭)
৮. ৩. ৪. সাহেবে কাশ্ফ ওলীগণের ভুলত্রুটি
বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, অনেক প্রখ্যাত সাধক, যাঁদেরকে আমরা সাহেবে কাশফ বলে জানি, তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে অনেক কথা লিখেছেন যা নিঃসন্দেহে ভুল ও অন্যায়। শাইখ আব্দুল কাদের জীলানী (৫৬১ হি.) লিখেছেন যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে। ঈমানের হরাস-বৃদ্ধি স্বীকার করাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ও ফেরকায়ে নাজিয়ার আলামত বলে গণ্য করেছেন এবং ঈমানের হরাস-বৃদ্ধি না মানাকে বাতিলদের আলামত বলে গণ্য করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, কোনো মুসলমানের উচিত নয় যে সে বলবে: ‘আমি নিশ্চয় মুমিন’, বরং তাকে বলতে হবে যে, ‘ইন্শা আল্লাহ আমি মুমিন’। ইমাম আবু হানীফা (রাহ) ও তাঁর অনুসারীগণ যেহেতু ঈমানের হরাস-বৃদ্ধি স্বীকার করেন না, আমলকে ঈমানের অংশ মনে করেন না এবং ‘ইনশা আল্লাহ আমি মুমিন’ বলাকে আপত্তিকর বলে মনে করেন, সে জন্য তিনি তাঁকে ও তাঁর অনুসারীগণকে বাতিল ও জাহান্নামী ফিরকা বলে উল্লেখ করেছেন।[1]
ইমাম গাযালী লিখেছেন যে, গান-বাজনা, নর্তন-কুর্দন ইত্যাদি আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার পথে সহায়ক ও বিদ‘আতে হাসানা। তিনি গান-বাজনার পক্ষে অনেক দুর্বল ও জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।[2]
এরূপ অগণিত উদাহরণ তাঁদের গ্রন্থে পাওয়া যায়। কাজেই, তাঁরা যদি কোনো হাদীসকে সহীহ বলেও ঘোষণা দেন তারপরও তার সনদ বিচার ব্যতিরেকে তা গ্রহণ করা যাবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা, সকল বানোয়াট কথাকে চিহ্নিত করা দীনের অন্যতম ফরয। কেউ সন্দেহযুক্ত হাদীস রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর নামে বর্ণনা করলেও তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কাজেই, এ ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতার অবকাশ নেই।[3]
এ প্রসঙ্গে আব্দুল হাই লাখনবীর অভিজ্ঞতা প্রণিধানযোগ্য। শাইখ আব্দুল কাদির জীলানীর গ্রন্থে বিদ্যমান ‘‘সালাতুল উসবূ’’ বা সপ্তাহের প্রত্যেক দিবস ও রাত্রির জন্য বিশেষ সালাত, আশূরার দিবস ও রাত্রির বিশেষ সালাত ইত্যাদি বিষয়ক হাদীসগুলি জাল বলে তিনি উল্লেখ করলে তাঁর এক বন্ধু তার সাথে বিতর্ক করেন। এ বিষয়ে আললামা লাখনবী বলেন:
عارضني
بعض الأعزة قائلاً: قد ذَكَرَ صلواتِ يوم عاشوراء وليلته وغيرهما من أيام السنة
ولياليها جَمْعٌ من المشايخ الصوفية في دفاترهم العلية وذكروا فيها أخباراً مروية،
فكيف لا يُعْمَلُ بِهَا ويُحْكَمُ بكونها مختلقة؟ فقلت: لا عبرة بذكرهم، فإنهم
ليسوا من المحدثين ولا أسندوا الحديث إلى أحد من المخرجين. فقال لي: ما تقول؟
تَفَكَّرْ فيما فيه تجول! إذا لم يُعْتَبَر بنقل هؤلاء الأكابر فمن هو يُعْتَبر
بنقله وذكره؟ فقلت: لا عجب، فإن الله تعالى جعل لكل مقام مقالاً وخلق لكل فن
رجالاً.... فعاد قائلاً: إن العَجَبَ كلَّ العَجَبِ أن أحداً من المشايخ العظام
كالإمام الغزالي ... ومولانا عبد القادر الجيلاني ... وأبي طالب المكي ... وغيرهم
ممن تقدمهم وتأخرهم وهم من الصوفية الكبار معدودون في طبقات الأولياء حملة ألوية
الأسرار يضع حديثا على رسول الله صلى الله عليه وسلم! مع اشتهار أن الكذب على رسول
الله صلى الله عليه وسلم لا يحل لمسلم فضلاً عن مثل هذا المسلم!! قلت؟ حاشاهم ثم
حاشاهم! عن أن يضعوا حديثاً ... فقال: فإذا لم ينسب الوضع إلى هؤلاء فمن هو
واضعها؟ فقلت: قوم من جهلة الزهاد أو قوم من أرباب الزندقة والإلحاد؛ فإن الرواة
الذين وقعت في رواياتهم المقلوبات والموضوعات ... على ما بسطه ابن الجوزي والسيوطي
... منقسمون على أقسام .... فقال: فكيف قَبِلَ تلك الأحاديثَ الموضوعةَ جَمْعٌ من
المشايخ الجامعين بين علوم الحقيقة والطريقة وأدرجوها في تصانيفهم السلوكية؟ فقلت:
لحسن ظنهم بكل مسلم وتخيُّلهم أنه لا يكذب على النبي ﷺ مسلم..
‘‘আমার এক সম্মানিত ভাই আমার কথার প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আশূরার দিনের ও রাতের সালাত ও বৎসরের অন্যান্য দিবস ও রাতের সালাতের কথা অনেক সূফী মাশাইখ তাদের মহামূল্যবান পুস্তকগুলিতে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এ বিষয়ে বর্ণিত অনেক হাদীসও উল্লেখ করেছেন। তাহলে কিভাবে আপনি বলছেন যে, এ সকল দিবস ও রাতের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলির উপর আমল করা যাবে না; বরং এগুলিকে জাল বলে গণ্য করতে হবে?’ আমি বললাম: ‘এ সকল মহাসম্মানিত সূফী মাশাইখদের উল্লেখের উপর নির্ভর করা যাবে না; কারণ তাঁরা মুহাদ্দিস ছিলেন না; আর তাঁরা এ সকল হাদীসের জন্য কোনো হাদীস-সংকলকের গ্রন্থের বরাতও দেন নি।’ তিনি আমাকে বললেন: ‘আপনি কী বলছেন? কী বিষয়ে আপনি পদচারণা করছেন তা ভেবে দেখুন!! যদি এ সকল মহান ব্যক্তিত্বের উদ্ধৃতির উপর নির্ভর করা না যায় তবে কার কথার উপর নির্ভর করতে হবে?
আমি বললাম: ‘অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ মহান আল্লাহ প্রত্যেক স্থানের জন্য পৃথক বক্তব্য রেখেছেন এবং প্রত্যেক বিষয়ের জন্য পৃথক বিশেষজ্ঞ তৈরি করেছেন।’ .... তিনি তাঁর বক্তব্যে এগিয়ে গেলেন: ‘বড়ই অবাক কথা! খুবই বিস্ময়ের বিষয়!! ইমাম গাযালী (৫০৫হি)..., মাওলানা আব্দুল কাদির জীলানী (৫৬১ হি).., আবূ তালিব মক্কী (৩৬৮হি)... এবং তাঁদের মত অন্যান্য পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মহান মর্যাদাময় মাশাইখ, যারা ছিলেন বড় বড় সূফী, আল্লাহর ওলীগণের অন্তর্ভুক্ত, গোপন জ্ঞানের বাহক, তাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে জাল হাদীস বানাবেন!!! অথচ এ কথা তো সর্বজন বিদিত যে, এ ধরনের মহান মুসলিম তো দূরের কথা একজন সাধারণ মুসলিমের জন্যও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে জাল হাদীস বানানো বৈধ নয়।’
আমি বললাম: ‘কখনোই নয়! কখনোই নয়!! এ সকল মহান ব্যক্তিত্ব কখনোই কোনো হাদীস জাল করেন নি।....’ তখন তিনি বললেন, ‘যদি এ সকল হাদীসের জালিয়াতির দায়ভার তাঁদের না হয় তাহলে এর জন্য দায়ী কারা?’ আমি বললাম: ‘এক শ্রেণীর জাহিল দীনদার সংসারত্যাগী, অথবা কতিপয় যিনদীক ও মুলহিদ- ধর্মদ্রোহী; কারণ যে সকল রাবীর হাদীসের মধ্যে জাল হাদীস পাওয়া যায় ইবনুল জাওযী, সুয়ূতী, .... প্রমুখ মুহাদ্দিস তাদের শ্রেণীভাগ করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন... এ সকল রাবীই এ সকল হাদীস জাল করার জন্য দায়ী। ....’ তিনি বললেন: ‘অনেক বড় বড় সূফী মাশাইখ, যারা ইলমে হাকীকত ও ইলমে তরীকত উভয় দিকেই পারদর্শী ছিলেন তাঁরা কিভাবে এ সকল জালিয়াত রাবীর বর্ণিত জাল হাদীসগুলি গ্রহণ করলেন এবং তরীকা-তাসাউফ বিষয়ক তাঁদের গ্রন্থগুলিতে সেগুলি উল্লেখ করলেন?’ আমি বললাম: ‘কারণ তাঁরা সকল মুসলিমের বিষয়েই ভাল ধারণা পোষণ করতেন এবং ধারণা করতেন যে, কোনো মুসলিম কখনোই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা কথা বলতে পারে না।’.....’’[4]
[1] আব্দুল কাদের জীলানী, গুনিয়াতুত তালিবীন, (অনুবাদ নুরুল আলম রঈসী), পৃ: ৬, ৭, ১৪৯, ১৫১, ১৫২, ১৫৫, ২১১, ২২৭।
[2] আবু হামিদ গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/২৯২-৩৩২।
[3] আব্দুল হাই লাখনবী, যাফরুল আমানী, পৃ: ৪১২-৪৩৩, ২২৪, আল-আজইবাতুল ফাযিলা, পৃ: ২৯-৩৫, আল-আসারুল মারফূয়া ফীল আখবারিল মাউযূয়া, পৃ: ৭-২০।
[4] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসারুল মারফূআ, ৮-১৮ পৃষ্ঠা।
৮. ৪. বুযুর্গগণের নামে জালিয়াতি
এখানে আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার। তা হলো, হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় নেককার বুযুর্গ ও ওলী-আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি হয়েছে প্রচুর। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:
(১) জালিয়াতগণ ‘ধর্মের’ ক্ষতি করার জন্য অথবা ধর্মের ‘উপকার’ করার জন্য ‘জালিয়াতি’ করত। বিশেষ করে যারা ধর্মের অপূর্ণতা দূর করে ধর্মকে আরো বেশি ‘জননন্দিত’ ও ‘আকর্ষণীয়’ করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদের জালিয়াতিই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। আর উভয় দলের জন্য এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় দলের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে জালিয়াতি করার চেয়ে ওলী-আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি করা অধিক সহজ ও অধিক সুবিধাজনক ছিল।
(২) বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি অধিকতর সুবিধাজনক এজন্য যে, সাধারণ মানুষদের মধ্যে তাঁদের নামের প্রভাব ‘হাদীসের’ চেয়েও বেশি। অনেক সাধারণ মুসলমানকে ‘হাদীস’ বলে বুঝানো কষ্টকর। তাকে যদি বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অমুক কাজ করেছেন, করতে বলেছেন ... তবে তিনি তা গ্রহণ করতেও পারেন আবার নাও পারেন। কিন্তু যদি তাকে বলা যায় যে, আব্দুল কাদির জীলানী বা খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বা ... অমুক ওলী এ কাজটি করেছেন বা করতে বলেছেন তবে অনেক বেশি সহজে তাকে ‘প্রত্যায়িত’ (convinced) করা যাবে এবং তিনি খুব তাড়াতাড়ি তা মেনে নেবেন। ইসলামের প্রথম কয়েক শতাব্দীর সোনালী দিনগুলোর পরে যুগে যুগে সাধারণ মুসলিমদের এ অবস্থা। কাজেই বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি বেশি কার্যকর ছিল।
(৩) ওলী-আল্লাহদের নামে জালিয়াতি সহজতর ছিল এজন্য যে, হাদীসের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর নিবেদিত প্রাণ মুহাদ্দিসগণ যেভাবে সর্তক প্রহরা ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছিলেন, এক্ষেত্রে তা কিছুই ছিল না বা নেই। কোনো নিরীক্ষা নেই, পরীক্ষা নেই, সনদ নেই, মতন নেই, ঐতিহাসিক বা অর্থগত নিরীক্ষা নেই... যে যা ইচ্ছা বলছেন। কাজেই অতি সহজে জালিয়াতগণ নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পারতেন।
(৪) হাদীস জালিয়াতির জন্যও এ সকল বুযুর্গের নাম ব্যবহার ছিল খুবই কার্যকর। এ সকল বুযুর্গের নামে বানোয়াট কথার মধ্যে অগণিত জাল হাদীস ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা। এ সকল বুযুর্গের প্রতি ‘ভক্তির প্রাবল্য’-র কারণে অতি সহজেই ভক্তিভরে এ সকল বিষ ‘গলাধঃকরণ’ করেছেন মুসলমানরা। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পেরেছে জালিয়াতগণ।
৮. ৪. ১. কাদিরীয়া তরীকা
আব্দুল কাদির জীলানী (রাহ) হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের প্রসিদ্ধতম ব্যক্তিত্ব। (জন্ম ৪৭১-মৃত্যু ৫৬১ হি) একদিকে তিনি হাম্বালী মাযহাবের বড় ফকীহ ছিলেন। অন্যদিকে তিনি প্রসিদ্ধ সূফী ছিলেন। তাঁর নামে অনেক তরীকা, কথা ও পুস্তক মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত। এ সকল তরীকা, কথা ও পুস্তক অধিকাংশ বানোয়াট। কিছু কিছু পুস্তক তাঁর নিজের রচিত হলেও পরবর্তীকালে এগুলোর মধ্যে অনেক বানোয়াট কথা ঢুকানো হয়েছে। এখানে আমরা তাঁর নামে প্রচলিত কাদিরিয়া তরীকা ও ‘সির্রুল আসরার’ পুস্তকটির পর্যালোচনা করব।
প্রচলিত কাদিরিয়া তরীকার আমল, ওযীফা, মুরাকাবা ইত্যাদি পদ্ধতির বিবরণ আব্দুল কাদির জীলানী (রাহ)-এর পুস্তকে পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন যে, আব্দুল কাদির জীলানী (রাহ)-এর ওফাতের প্রায় দুইশত বছর পরে তাঁর এক বংশধর ‘গাওস জীলানী’ ৮৮৭ হিজরী সালে (১৪৮২ খৃস্টাব্দে) ‘কাদিরীয়া তরীকা’-র প্রচলন করেন। বিভিন্ন দেশে ‘কাদিরীয়া তরীকার’ নামে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত। আব্দুল কাদির জীলানী (রাহ)-এর নিজের লেখা প্রচলিত বইগুলোতে যে সকল আমল, ওযীফা ইত্যাদি লিখিত আছে প্রচলিত ‘কাদিরীয়া তরীকার’ মধ্যে সেগুলো নেই।
আমাদের দেশে প্রচলিত ‘কাদিরীয়া তরীকা’র সূত্র বা ‘শাজারা’ থেকে আমরা দেখি যে, শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (১১৭৬ হি/১৭৬২খৃ) থেকে তা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু শাহ ওয়ালী উল্লাহ তাঁর ‘আল-কাওলুল জামীল’ গ্রন্থে কাদিরীয়া তরীকার যে বিবরণ দিয়েছেন তাঁর সাথে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলবীর (১২৪৬ হি/১৮৩১খৃ) ‘সিরাতে মুস্তাকীমের’ বিবরণের পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাঁদের দুজনের শেখানো পদ্ধতির সাথে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত কাদিরীয়া তরীকার ওযীফা ও আশগালের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলোর কোন্টি তাঁর নিজের প্রবর্তিত ও কোন্টি তাঁর নামে পরবর্তীকালে প্রবর্তিত তা জানার কোনো উপায় নেই।
৮. ৪. ২. সির্রুল আসরার
আব্দুল কাদির জীলানীর (রাহ) নামে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ একটি পুস্তক ‘সির্রুল আসরার’। পুস্তকটিতে কুরআন-হাদীসের আলোকে অনেক ভাল কথা রয়েছে। পাশাপাশি অনেক জাল হাদীস ও বানোয়াট কথা পুস্তকটিতে বিদ্যমান। অবস্থাদৃষ্টে বুঝা যায় যে, পরবর্তী যুগের কেউ এ বইটি লিখে তাঁর নামে চালিয়েছে। কয়েকটি বিষয় এই জালিয়াতি প্রমাণ করে:
১. এ পুস্তকের বিভিন্ন স্থানে লেখক ‘ফরীদ উদ্দীন আত্তার-এর বিভিন্ন বাণী ও কবিতার উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। যেমন এক স্থানে বলেছেন: ‘‘হযরত শাইখ ফরীদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ) বলেন...’’[1]। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ফরীদ উদ্দীন আত্তার ৫১২ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬২৬ হিজরীতে (১২২৯ খৃ) ইন্তেকাল করেন। আর আব্দুল কাদির জীলানী ৪৭১ হিজরীতে জন্মগহণ করেন এবং ৫৬১ হিজরীতে (১১৬৬ খৃ) ইন্তেকাল করেন। ফরীদ উদ্দীন আত্তার বয়সে তাঁর চেয়ে ৪০ বছরের ছোট এবং তাঁর ইন্তেকালের সময় ফরীদ উদ্দীন আত্তারের কোনো প্রসিদ্ধি ছিল না। কাজেই ‘হযরত শাইখ ...’ ইত্যাদি বলে তিনি আত্তারের উদ্ধৃতি প্রদান করবেন একথা কল্পনা করা যায় না।
২. এ পুস্তকে শামস তাবরীয-এর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। লেখক বলেন: ‘‘হযরত শামস তাবরীয (রঃ) বলেছেন...’’[2]। উল্লেখ্য যে, শামস তাবরীয ৬৪৪ হিজরীতে (১২৪৭ খৃ) ইন্তেকাল করেন। তাঁর জন্ম তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় নি। তবে ৫৬০ হিজরীর পরে তাঁর জন্ম বলে মনে হয়। অর্থাৎ আব্দুল কাদির জীলানীর মৃত্যুর সময় শামস তাবরীযের জন্মই হয় নি! অথচ তিনি তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করছেন!
৩. এ পুস্তকে বারংবার জালাল উদ্দীন রুমীর উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে। যেমন লেখক বলছেন: ‘‘আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী তাঁর অমর কাব্য মসনবীতে বলেছেন...।’’[3] লক্ষ্যণীয় যে, জালাল উদ্দীন রুমী (৬০৪- ৬৭৬ হি) আব্দুল কাদির জীলানীর (রাহ) ইন্তেকালের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে জন্মগ্রহণ করেন! রুমীর জন্মের অর্ধ শত বছর আগে তাঁর মসনবীর উদ্ধৃতি প্রদান করা হচ্ছে!!
এভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, এ পুস্তকটি পুরোটিই জাল, অথবা এর মধ্যে অনেক জাল কথা পরবর্তীকালে ঢুকানো হয়েছে। এ পুস্তকটির মধ্যে অগণিত জাল হাদীস ও জঘন্য মিথ্য কথা লিখিত রয়েছে। আর আব্দুল কাদির জীলানীর (রাহ) নামে এগুলো অতি সহজেই বাজার পেয়েছে।
[1] আব্দুল কাদের জীলানী, সিররুল আসরার, পৃ. ৩৭।
[2] আব্দুল কাদের জীলানী, সিররুল আসরার, পৃ. ২৭।
[3] আব্দুল কাদের জীলানী, সিররুল আসরার, পৃ. ২৫, ২৯।
৮. ৪. ৩. চিশতিয়া তরীকা
আমাদের দেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ বুযুর্গ খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী (৬৩৩ হি), কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কা’কী (৬৫৩ হি), ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ গঞ্জে শক্কর (৬৬৩ হি) ও নিযাম উদ্দীন আউলিয়া (৭২৫ হি), রাহিমাহুমুল্লাহ। এদের নামেই চিশতিয়া তরীকা প্রচলিত। এছাড়া এদের নামে অনেক কথা, কর্ম ও বই-পুস্তকও প্রচলিত। এগুলোর মধ্যে এমন অনেক কথা রয়েছে যা সুস্পষ্টতই মিথ্যা ও বানোয়াট। এখানে চিশতিয়া তরীকা ও এঁদের নামে প্রচলিত দুএকটি বইয়ের বিষয়ে আলোচনা করব।
বিভিন্ন দরবারের চিশতীয় তরীকার আমল-ওযীফার মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। উপর্যুক্ত বুযুর্গগণের নামে প্রচলিত পুস্তকাদিতে এ সকল ‘তরীকা’ বা পদ্ধতির কিছুই দেখা যায় না। আবার এ সকল পুস্তকে যে সকল যিকর-ওযীফার বিবরণ রয়েছে সেগুলোও প্রচলিত চিশতিয়া তরীকার মধ্যে নেই। চিশতিয়া তরীকার ক্ষেত্রেও শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর বিবরণের সাথে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলবীর বিবরণের পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাঁদের দুইজনের শেখানো পদ্ধতির সাথে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত চিশতিয়া তরীকার ওযীফা ও আশগালের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলোর কোন্টি ‘অরিজিনাল’ ও কোনটি ‘বানোয়াট’ তা জানার কোনো উপায় নেই।
৮. ৪. ৪. আনিসুল আরওয়াহ, রাহাতিল কুলুব... ইত্যাদি
এ সকল মহান মাশাইখ রচিত বলে কিছু পুস্তক প্রচলিত। এগুলো ‘উস্তাদ বা পীরের সাহচর্যের স্মৃতি ও আলোচনা হিসেবে রচিত।’ খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতী তাঁর উস্তাদ উসমান হারুনীর সাথে তাঁর দীর্ঘ সাহচর্যের বিবরণ লিখেছেন ‘আনিসুল আরওয়াহ’ নামক পুস্তকে। খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী তাঁর উস্তাদ মুঈন উদ্দীন চিশতীর সাথে তার সাহচর্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘দলিলুল আরেফীন’ পুস্তকে। খাজা ফরীদ উদ্দীন গঞ্জে শক্কর তাঁর উস্তাদ কুতুব উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতিগুলো লিখেছেন ‘ফাওয়ায়েদুস সালেকীন’ পুস্তকে। খাজা নিজাম উদ্দীন আউলিয়া তাঁর উস্তাদ ফরীদ উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতিগুলো লিখেছেন ‘রাহাতিল কুলুব’ পুস্তকে। প্রসিদ্ধ গায়ক আমীর খসরু তাঁর উস্তাদ নিজাম উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতি ও নির্দেশাবলি লিখেছেন ‘রাহাতুল মুহিববীন’ পুস্তকে।
এ সকল পুস্তক পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় যে এগুলো পরবর্তী যুগের মানুষদের রচিত জাল পুস্তক। অথবা তাঁরা কিছু লিখেছিলেন সেগুলোর মধ্যে পরবর্তী যুগের জালিয়াতগণ ইচ্ছামত অনেক কিছু ঢুকিয়েছে। এই পুস্তকগুলোতে কুরআন-হাদীস ভিত্তিক অনেক ভাল কথা আছে। পাশাপাশি অগণিত জাল হাদীস ও মিথ্যা কথায় সেগুলো ভরা। এ ছাড়া ঐতিহাসিক তথ্যাবলি উল্টোপাল্টা লেখা হয়েছে। এমন সব ভুল রয়েছে যা প্রথম দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে।
প্রত্যেক বুযুর্গ তার মাজালিসগুলোর তারিখ লিখেছেন। সন তারিখগুলো উল্টোপাল্টা লেখা। শাওয়াল মাসের ৪ তারিখ বৃহস্পতিবার ও ৭ তারিখ রবিবার লেখা হয়েছে। অর্থাৎ শাওয়ালের শুরু সোমবারে। কিন্তু ১৫ই জিলক্বদ সোমবার লেখা হয়েছে। অর্থাৎ যিলকাদের শুরুও সোমবারে! শাওয়াল মাস ২৮ দিনে হলেই শুধু তা সম্ভব![1] আবার পরের মাজলিস হয়েছে ৫ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার। জিলকাদের শুরু সোম, মঙ্গল বা বুধবার যেদিনই হোক, কোনোভাবেই ৫ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার হয় না! আবার পরের মাজলিস ২০শে জিলহজ্ব শনিবার! ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার হলে ২০ তারিখ শনিবার হয় কিভাবে? [2] ২০ শে রজব সোমবার এবং ২৭শে রজব রবিবার লেখা হয়েছে। ৫ই শাওয়াল শনিবার অথচ ২০ শে শাওয়াল বৃহস্পতিবার[3]. ... এরূপ অগণিত অসঙ্গতি ও জালিয়াতি প্রথম নজরেই ধরা পড়ে।
কাকী (রাহ) উল্লেখ করেছেন যে, ৬১৩ হিজরীতে তিনি বাগদাদে মুঈন উদ্দীন চিশতীর নিকট মুরীদ হন। এরপর কয়েক মাজলিস তিনি বাগদাদেই থাকেন। এরপর তিনি তাঁর সহচরদের নিয়ে আজমীরে আগমন করেন। এভাবে আমরা নিশ্চিত জানতে পারছি যে, ৬১৩ হি (১২১৬ খৃ)-এর পরে মুঈন উদ্দীন চিশতী ভারতে আগমন করেন। বখতিয়ার কাকী আরো উল্লেখ করেছেন যে, আজমীরে অবস্থান কালে আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমি পৃথ্বীরাজকে মুসলমানদের হাতে জীবিত বন্দী অবস্থায় অর্পণ করলাম। এর কয়েক দিন পরেই সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরীর সৈন্যগণ পৃথ্বীরাজকে পরাজিত ও বন্দী করে।[4]
অথচ ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করছেন যে, ৬১৩ হিজরীর প্রায় ২৫ বছর পূর্বে ৫৮৮ হিজরীতে (১১৯২ খৃস্টাব্দে) তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে সুলতান ঘোরী পৃথীরাজকে পরাজিত করে আজমীর দখল করেন। আর ৬১৩ হিজরীতে খাজা মুঈন উদ্দীনের আজমীর আগমনের ১০ বছর পূবে ৬০৩ হিজরীতে (১২০৬ খৃস্টাব্দে) শিহাবুদ্দীন ঘোরী মৃত্যুবরণ করেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, এ সকল কাহিনী সবই বানোয়াট। অথবা মুঈন উদ্দীন (রাহ) অনেক আগে ভারতে আসেন। এক্ষেত্রে আনিসুল আরওয়াহ, দলিলুল আরেফীন, ফাওয়ায়েদুস সালেকীন ইত্যাদি পুস্তকে লেখা সন-তারিখ ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি বানোয়াট।
এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় বুযুর্গদের নামেও জালিয়াতি হয়েছে ব্যাপকভাবে। হাদীসের ক্ষেত্রে যেমন সুনির্দিষ্ট নিরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে, বুযুর্গদের ক্ষেত্রে তা না থাকাতে এদের নামে জালিয়াতি ধরার কোনো পথ নেই। জালিয়াতগণ বুযুর্গদের নামে ‘জাল পুস্তক’ লিখে সেগুলোর মধ্যে জাল হাদীস উল্লেখ করেছে, এবং তাঁদের লেখা বইয়ের মধ্যে জাল হাদীস ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন এ সকল জাল হাদীসের বিরুদ্ধে কিছু বললেই সাধারণ মুসলিম বলবেন, অমুক বুযুর্গের পুস্তকে এই হাদীস রয়েছে, তা জাল হয় কিভাবে?! এভাবে জালিয়াতগণ এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে!
[1] খাজা মুঈন উদ্দীন, আনিসুল আরওয়াহ (ফাওয়ায়েদুস সালেকীন), পৃ. ১৩৫, ১৪৩, ১৪৪।
[2] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৭, ১৪৯
[3] নিযাম উদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল মুহিববীন, পৃ. ২৪, ৪৩, ৮৩, ৮৮।
[4] আনিসুল আরওয়াহ: (দলিুলল আরেফীন ও ফাওয়ায়েদুস সালেকীনসহ) পৃ. ৬২, ১১৯, ১৩৮।
৮. ৫. জাল হাদীস বনাম যয়ীফ হাদীস
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, জাল হাদীস দুর্বল হাদীসের একটি প্রকার। জাল হাদীসের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ যেরূপ কঠোরতা অবলম্বন করেছেন, ‘যয়ীফ’ হাদীসের বিষয়ে অনেক মুহাদ্দিস তদ্রূপ কঠোরতা অবলম্বন করেন নি। দুটি ক্ষেত্রে তাঁরা ‘যয়ীফ’ হাদীসের ব্যবহার বা উল্লেখ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন: (১) ‘আকীদা’ বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এবং (২) শরীয়তের আহকাম বা বিধানাবলির ক্ষেত্রে। প্রথম ক্ষেত্রে একমাত্র সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। শুধু তাই নয়, ‘আকীদা’ বা বিশ্বাস প্রমাণের ক্ষেত্রে মূলত ‘মুতাওয়াতির’ বা বহু সাহাবী ও তাবিয়ী বর্ণিত হাদীসের উপর অথবা সাহাবী-তাবিয়ীগণের মধ্যে প্রসিদ্ধ সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ‘সহীহ’ ও ‘হাসান’ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।[1]
[1] সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৩২; ইবনু জামায়াহ, আল-মানহালু রাবী, পৃ. ৩২, আব্দুল হাই লাখনবী, যাফরুল আমানী, পৃ. ৪৪-৪৭।
৮. ৫. ১. যয়ীফ হাদীস বর্ণনা ও পালনের শর্ত
পক্ষান্তরে তিনটি বিষয়ে ‘অল্প যয়ীফ’ হাদীস বলা বা আমল করা অনেকে অনুমোদন করেছেন: (১) কুরআনের ‘তাফসীর’ বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে, (২) ইতিহাস বা ঐতিহাসিক বর্ণনার ক্ষেত্রে এবং (৩) বিভিন্ন নেক আমলের ‘ফযীলত’-এর ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে তাঁরা নিম্নরূপ শর্তগুলো উল্লেখ করেছেন:
(১) যয়ীফ হাদীসটি ‘‘অল্প দুর্বল’ হবে, বেশি দুর্বল হবে না।
(২) যয়ীফ হাদীসটি এমন একটি কর্মের ফযীলত বর্ণনা করবে যা মূলত সহীহ হাদীসের আলোকে জায়েয ও ভালো।
(৩) যয়ীফ হাদীসকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা বলে বিশ্বাস করা যাবে না। এবং কোনোভাবেই তা আকীদা বা বিশ্বাসের জগতে প্রবেশ করবে না। যয়ীফ হাদীসের উপর আমল করার ক্ষেত্রে একথা মনে করা যাবে না যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ সত্যিই একথা বলেছেন। সাবধানতামূলকভাবে আমল করতে হবে। অর্থাৎ মনে করতে হবে, হাদীসটি নবীজী ﷺ -এর কথা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, তবে যদি সত্য হয় তাহলে এ সাওয়াবটা পাওয়া যাবে, কাজেই আমল করে রাখি। আর সত্য না হলেও মূল কাজটি যেহেতু সহীহ হাদীসের আলোকে মুস্তাহাব সেহেতু কিছু সাওয়াব তো পাওয়া যাবে।
(৪) এরূপ দুর্বল হাদীস নির্ভর কোনো আমল প্রকাশ্যে করা যাবে না; বরং একান্ত ব্যক্তিগতভাবে তা পালন করতে হবে।[1]
আল্লামা ইবন হাজার আসকালানী বলেন:
اشتهر
أن أهل العلم يتسامحون في إيراد الأحاديث في الفضائل وإن كان فيها ضعف، ما لم تكن
موضوعة. وينبغي مع ذلك اشتراط أن يعتقد العامل كون ذلك الحديث ضعيفا، وأن لا يشهر
بذلك، لئلا يعمل المرء بحديث ضعيف، فيشرع ما ليس بشرع، أو يراه بعض الجهال فيظن
أنه سنة صحيحة. وقد صرح بمعنى ذلك الأستاذ أبو محمد بن عبد السلام وغيره. وليحذر
المرء من دخوله تحت قوله صلى الله عليه وسلم: "من حدث عني بحديث يرى أنه كذب
فهو أحد الكذابين". فكيف بمن عمل به. ولا فرق في العمل بالحديث في الأحكام،
أو في الفضائل، إذ الكل شرع.
‘‘এ কথা প্রসিদ্ধ যে, ফাযায়িল বিষয়ে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আলিমগণ কিছুটা ঢিলেমি দেখান। এ বিষয়ক হাদীসটি যদি জাল না হয় তবে তাতে দুর্বলতা থাকলেও আলিমগণ তা বর্ণনা করেন। এর সাথে নিম্নের বিষয় শর্ত করা প্রয়োজন। তা হলো: যদি কেউ এরূপ হাদীস পালন করতে চায় তবে তাকে বিশ্বাস ও আকীদা পোষণ করতে হবে যে, হাদীসটিকে যয়ীফ। এছাড়া সে এরূপ দুর্বল হাদীস নির্ভর আমল প্রকাশ্যে করতে পারবে না। কারণ একজন মানুষ দুর্বল হাদীসের উপর আমল করে শরীয়তের মধ্যে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না যা মূলত শরীয়তের অংশ নয়। অথবা তার দুর্বল হাদীস নির্ভর আমলটি দেখে একজন মুর্খ মানুষ ধারণা করতে পারে যে, একটি একটি সহীহ সুন্নাত। (সপ্তম শতকের মুজাদ্দিদ ও সুলতানুল উলামা নামে খ্যাত) উসতায (ইয্যুদ্দীন আব্দুল আযীয) ইবন আব্দুস সালাম (৬৬০ হি) এবং অন্যান্য আলিম এ অর্থে সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসে ঘোষিত শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আত্মরক্ষা করা মুমিনের দায়িত্ব। তিনি বলেছেন: ‘‘যে হাদীসটির বিষয়ে ধারণা হয় যে তা মিথ্যা সে হাদীস যে বর্ণনা করে সেও একজন মিথ্যাবাদী।’’ এরূপ (সন্দেহভাজন বা দুর্বল) হাদীস বর্ণনা করার পরিণতি যদি এরূপ হয় তাহলে তার পালন বা আমল করার পরিণতি কী হতে পারে? আর কোনো হাদীস আমল বা পালন করার ক্ষেত্রে হালাল-হারাম এবং ফযীলত-সাওয়াব উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ হালাল-হারাম ও ফযীলত-সাওয়াব সবই শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত।’’[2]
‘যয়ীফ’ হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের এ মতটি ভুল বুঝে অনেক সময় এর মাধ্যমে সমাজে ‘জাল’ হাদীসের প্রচলন ঘটেছে। বস্ত্তত, বিভিন্ন মুসলিম সমাজে প্রচলিত অধিকাংশ জাল ও ভিত্তিহীন ‘হাদীস’ এ ‘পথ’ দিয়ে মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে। সমাজে অগণিত জাল হাদীসের প্রচলনের পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে: (১) অযোগ্য ও ইলমহীন মানুষদের ওয়ায, নসীহত ও বিভিন্ন দীনী দায়িত্ব পালন, (২) সাধারণ আলিমদের অবহেলা বা অলসতা, (৩) প্রসিদ্ধ ও যোগ্য আলিমদের ঢিলেমী, (৪) হেদায়েতের আগ্রহ এবং (৫) ইতিহাস, সীরাত ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুজিযা বর্ণনার আগ্রহ।
[1] বিস্তারিত আলোচনা দেখুন: ইবন হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ২; আব্দুল হাই লাখনবী, যাফরুল আমানী, পৃ: ২০৯-২২৪, আল-আজইবাতুল ফাযিলা লিল আসইলাহ আল-আশারাতিল কামিলা, পৃ: ৩৬-৬৫, সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৩৫০-৩৫১।
[2] ইবন হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রাজাব, পৃ. ২।
৮. ৫. ২. হিদায়াত ও ফযীলতে যয়ীফের নামে জাল হাদীস
জাল হাদীসের প্রচলনের ক্ষেত্রে শেষের কারণদ্বয় সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। হেদায়াতের আগ্রহে অনেক যোগ্য আলিম ওয়ায, ফাযায়িল, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক ‘যয়ীফ’ হাদীস উল্লেখ করেছেন। এ সকল ‘যয়ীফ’ হাদীসের মধ্যে অনেক জাল হাদীস তাঁদের পুস্তকে স্থান পেয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা এগুলোর জালিয়াতি বা দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেন নি। ফলে সাধারণ পাঠক এগুলোকে ‘সহীহ’ হাদীস বলেই গণ্য করেছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কুরআনের এত আয়াত, এত সহীহ হাদীস সব কিছু উল্লেখ করার পরেও বোধ হয় মানুষের মনে ‘হেদায়াতের’ কথাটি ঢুকানো গেল না। কিছু যয়ীফ বা অনির্ভরযোগ্য কথা না বললে বোধহয় মানুষের মনে ‘আসর’ করা যাবে না। কুরআনে ও সহীহ হাদীসে উল্লিখিত শাস্তির কথা এবং কুরআনে ও সহীহ হাদীসে উল্লিখিত পুরস্কার, সাওয়াব ও ফযীলতের কথা বোধ হয় মানুষের মনে সত্যিকার আখেরাতমুখিতা, আল্লাহ ভীতি ও আমলের আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। এজন্যই বোধহয় তাঁরা আয়াতে কুরআনী ও সহীহ হাদীসের পরে এ সকল যয়ীফ বা ভিত্তিহীন কথাগুলো উল্লেখ করেন।
৮. ৫. ৩. ইতিহাস ও সীরাতে যয়ীফের নামে জাল হাদীস
ইতিহাস, সীরাত ও মুজিযা বর্ণনার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যায়। সকল বিষয়ের লেখকই সে বিষয়ে সর্বাধিক তথ্য সংগ্রহ করতে চান। তথ্য সংগ্রহের এ আগ্রহের ফলে প্রথম যুগ থেকেই অনেক আলিম এ সকল ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল হাদীস গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরবর্তী যুগে এ আগ্রহের ফলে সীরাতুন্নবী গ্রন্থগুলোর মধ্যে অগণিত ভিত্তিহীন জাল হাদীস অনুপ্রবেশ করেছে।
ইতোপূর্বে শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবীর আলোচনা থেকে জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে প্রচলিত সকল হাদীসই ৪র্থ-৫ম শতাব্দীর মধ্যে সংকলিত হয়ে গিয়েছিল। এর পরবর্তী যুগে অতিরিক্ত যা কিছু সংকলিত হয়েছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগে বানানো জাল ও ভিত্তিহীন কথা। এ প্রকারের গ্রন্থগুলোকে তিনি ৪র্থ ও ৫ম পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন।
ইতিহাস, সীরাত ও মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থগুলোর অবস্থাও আমরা এথেকে বুঝতে পারব। প্রথম ছয় শত বছরে সংকলিত এ জাতীয় গ্রন্থগুলির অন্যতম: ইবনু ইসহাকের (১৫০হি) সীরাহ, ওয়াকিদীর (২০৭ হি) মাগাযী, ইবনু হিশামের (২১৮ হি) সীরাহ, ইবনু সা’দ (২৩০হি)-এর ‘তাবাকাত’, খালীফা ইবনু খাইয়াতের (২৪০ হি) তারীখ, বালাযুরির (২৭৯ হি) ফুতুহুল বুলদান, ফিরইয়াবীর (৩০১ হি) দালাইলুন নুবওয়াত, তাবারীর (৩১০ হি) তারীখ, মাসঊদীর (৩৪৫ হি) তারীখ, বাইহাকীর (৪৫৮ হি) দালাইলুন নুবওয়াত ইত্যাদি। এ সকল পুস্তকে প্রচুর ‘অত্যন্ত যয়ীফ’ হাদীস এবং কিছু জাল হাদীস গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও আমরা দেখি যে, পরবর্তী যুগের লেখকগণ আরো অনেক কথা সংগ্রহ করছেন যা এ সকল গ্রন্থে মোটেও পাওয়া যাচ্ছে না।
পরবর্তী যুগের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো সুয়ূতীর (৯১১ হি) আল-খাসাইসুল কুবরা, কাসতালানীর (৯২৩ হি) আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামীর (৯৪২ হি) সুবুলুল হুদা বা সীরাহ শামিয়াহ। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ দাবি করেছেন যে, তাঁরা তাঁদের গ্রন্থে যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করবেন, কিন্তু জাল হাদীস উল্লেখ করবেন না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তাঁরা এমন অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন, যেগুলোকে তাঁরা নিজেরাই অন্যত্র জাল ও মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন।
এর পরবর্তী পর্যায়ের গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো আলী ইবনু বুরহান উদ্দীন হালাবীর (১০৪৪ হি) সীরাহ হালাবিয়াহ, যারকানীর (১১২২ হি) শারহুল মাওয়াহিব ইত্যাদি গ্রন্থ। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ কোনো বাছ বিচারই রাখেন নি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল যত বেশি পারা যায় তথ্যাদি সংকলন ও বিন্যাস করা। এজন্য কোনোরূপ বিচার ও যাচাই ছাড়াই সকল প্রকার সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ ও সনদবিহীন বিবরণ একত্রিত সংমিশ্রিত করে বিন্যাস করেছেন। ফলে অগণিত জাল ও ভিত্তিহীন বর্ণনা এগুলোতে স্থান পেয়েছে। আর জাল হাদীসের মধ্যে নতুনত্ব ও আজগুবিত্ব বেশি। এজন্য এ সকল পুস্তকে সহীহ হাদীসের পরিবর্তে জাল হাদীসের উপরেই বেশি নির্ভর করা হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, কুরআন কারীম ও অসংখ্য সহীহ হাদীস দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নুবুওয়াত, মুজিযা ও মর্যাদা প্রমাণ করা বোধহয় সম্ভব হচ্ছে না, অথবা এ সকল মিথ্যা ও জাল বর্ণনাগুলো ছাড়া বোধহয় তাঁর মর্যাদার বর্ণনা পূর্ণতা পাচ্ছে না!!
এ পর্যায়ের গ্রন্থগুলোর লেখকগণ অধিকাংশ বর্ণনারই সূত্র উল্লেখ করেন নি। যেখানে সূত্র উল্লেখ করেছেন সেখানেও তাদের অবহেলা অকল্পনীয়। একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। সীরাহ হালাবিয়ার লেখক বলেন:
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ سَأَلَ جِبْرِيْلَ،
فَقَالَ يَا جِبْرِيْلُ، كَمْ عُمِّرْتَ مِنَ السِّنِيْنَ ... رواه البخاريtوَرَأَيْتُ
فِيْ كِتَابِ التَّشْرِيْفَاتِ فِيْ الْخَصَائِصِ وَالْمُعْجِزَاتِ لَمْ أَقِفْ
عَلَى اسْمِ مُؤَلِّفِهِ عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ
‘‘আমি ‘তাশরীফাত ফিল খাসাইস ওয়াল মু’জিযাত’ নামক একটি বই পড়েছি। এ বইটির লেখকের নাম আমি জানতে পারি নি। এ বইয়ে দেখেছি, আবূ হুরাইরা (রা) থেকে হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিব্রাঈল (আ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে জিব্রাঈল, আপনার বয়স কত? ... হাদীসটি বুখারী সংকলন করেছেন।’’[1]
এ হাদীসটি বুখারী তো দূরের কথা কোনো হাদীস গ্রন্থেই নেই। এ অজ্ঞাত নামা লেখকের বর্ণনার উপর নির্ভর করে গ্রন্থকার হাদীসটি উদ্ধৃত করলেন। একটু কষ্ট করে সহীহ বুখারী বা ইমাম বুখারীর লেখা অন্যান্য গ্রন্থ খুঁজে দেখলেন না। এভাবে তিনি পরবর্তী যুগের মুসলমানদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে একটি জঘন্য মিথ্যা কথা প্রচলনের স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমাদের দেশের আলিমগণ ‘‘সীরাহ হালাবীয়া’ জাতীয় পুস্তকের উপরেই নির্ভর করেন, ফলে অগণিত জাল কথা তাদের লিখনি বা বক্তব্যে স্থান পায়। প্রসিদ্ধ আলিম ও বুযুর্গ আব্দুল খালেক (রাহ) তাঁর ‘সাইয়েদুল মুরসালীন’ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মূলত এ ‘সীরাহ হালাবিয়া’ (সীরাত-ই হালাবী) গ্রন্থটির উপরেই নির্ভর করেছেন। স্বভাবতই তিনি গ্রন্থকারের প্রতি শ্রদ্ধাবশত কোনো তথ্যই যাচাই করেন নি। ফলে এই মূল্যবান গ্রন্থটির মধ্যে আমরা অগণিত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস দেখতে পাই।
আমরা দেখেছি যে, যয়ীফ হাদীসের উপর আমল জায়েয হওয়ার শর্ত হলো, বিষয়টি বিশ্বাস করা যাবে না, শুধু কর্মের ক্ষেত্রে সাবধানতামূলক কর্ম করা যাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, বিশ্বাস ও কর্ম বিচ্ছিন্ন করা মুশকিল। কারণ যয়ীফ হাদীসের উপর যিনি আমল করছেন তিনি অন্তত বিশ্বাস করছেন যে, এ আমলের জন্য এ ধরনের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। বিশেষত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনী ও মুজিযা বিষয়ক বর্ণনার ক্ষেত্রে একজন মুমিন কিছু শুনলে তা বিশ্বাস করেন। শুধু তাই নয়, এ সকল ‘যয়ীফ’ বা ‘জাল’ কথাগুলো তাঁর ‘ঈমানের’ অংশে পরিণত হয়। এভাবে তাঁর ‘বিশ্বাসের’ ভিত্তি হয় যয়ীফ বা জাল হাদীসের উপর।
[1] হালাবী, আলী ইবনু বুরহান উদ্দীন, সীরাহ হালাবিয়া ১/৪৯।
৮. ৬. নিরীক্ষা বনাম ঢালাও ও অনুমান-নির্ভর কথা
জাল হাদীসের ক্ষেত্রে জঘন্যতম ও সবচেয়ে মারাত্মক বিভ্রান্তি হলো, নিরীক্ষা ব্যতিরেকে ঢালাও মন্তব্য। আমরা ইতোপূর্বে বারংবার উল্লেখ করেছি এবং পূর্বের সকল আলোচনা থেকে নিশ্চিতরূপে বুঝতে পেরেছি যে, ওহী বা ধর্মীয় শিক্ষার বিশুদ্ধতা রক্ষা ও সূত্র সংরক্ষণ মুসলিম উম্মাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের ধর্মগ্রন্থ, ধর্ম-প্রচারক বা প্রবর্তকের শিক্ষা ও নির্দেশাবলীর বিশুদ্ধতা রক্ষায় এরূপ সচেষ্ট হয় নি।
সাহাবীগণের যুগ থেকে সকল যুগের মুসলিম আলিম ও মুহাদ্দিসগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে প্রচারিত প্রতিটি কথা চুলচেরা নিরীক্ষা ও যাচাই করে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অনেক ‘প্রাচ্যবিদ’, তাঁদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত অনেক মুসলিম ও অনেক অনভিজ্ঞ বা অজ্ঞ মুসলিম ‘চিন্তাবিদ’ বা ‘গবেষক’ হাদীসের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য ও মতামত ব্যক্ত করেন। হাদীস যেহেতু জাল হয়েছে, কাজেই কোনো হাদীসই নির্ভরযোগ্য নয়, অথবা অমুক হাদীসের অর্থ সঠিক নয় কাজেই তা জাল বলে গণ্য হবে .... ইত্যাদি। কেউ কেউ মনে করেন, মুহাদ্দিসগণ সম্ভবত শুধু সনদই বিচার করেছেন, অর্থ, শব্দ, বাক্য, ভাব ইত্যাদি বিচার ও নিরীক্ষা করেন নি। এগুলো সবই ভিত্তিহীন ধারণা ও উর্বর মস্তিকের বর্বর কল্পনা মাত্র। মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতির সাথে পরিচয়হীনতা এর মূল কারণ। এর চেয়েও বড় কারণ ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও ইসলাম থেকে মানুষদেরকে বিচ্যুত করার উদগ্র বাসনা।
ইহূদী-খৃস্টান প্রাচ্যবিদ পন্ডিতগণ, কাদিয়ানী, বাহাঈ ইত্যাদি অমুসলিম সম্প্রদায় ও শিয়া সম্প্রদায় ছাড়াও কিছু ‘জ্ঞানপাপী’ পন্ডিত হাদীসের বিরুদ্ধে এরূপ ঢালাও মন্তব্য করেন অথবা মর্জিমাফিক অর্থ বিচার করে হাদীস ‘জাল’ বলে ঘোষণা করেন। তারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করতে চান, কিন্তু ইসলাম পালন করতে চান না। এরা সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ, হালাল ভক্ষণ, পবিত্রতা অর্জন, ইত্যাদি কোনো ‘কর্ম’ই করতে রাজি নন। কুরআনে উল্লিখিত এ সকল বিষয়কে ‘ইচ্ছামত’ ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দিতে চান। কিন্তু ভয় হলো, হাদীস নিয়ে। হাদীস থাকলে তো ইচ্ছামত ব্যাখ্যা অচল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। এজন্য তারা নির্বিচারে হাদীসকে জাল বলে বাতিল করতে চান।
আশা করি, এ গ্রন্থের আলোচনা থেকে পাঠক এ সকল মানুষের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা ও বিচার পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক। তাঁরা সনদ, শ্রুতি, পান্ডুলিপি, ভাষা, অর্থ, ও প্রাসঙ্গিক সকল প্রমাণের আলোকে যে সকল হাদীসকে সহীহ বলে চিহ্নিত করেছেন সেগুলোর বিশুদ্ধতা ও যথার্থতা সম্পর্কে তথ্য-প্রমাণবিহীন ঢালাও সন্দেহ একমাত্র জ্ঞানহীন মুর্খ বা বিদ্বেষী জ্ঞানপাপী ছাড়া কেউই করতে পারে না। আর এ নিরীক্ষার ভিত্তিতে যে সকল হাদীসকে তাঁরা জাল ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলোকে গায়ের জোরে হাদীস বলে দাবি করাও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বলার ভয়ঙ্কর দুঃসাহস ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে তথ্য ভিত্তিক নিরীক্ষার দরজা সর্বদা উন্মুক্ত।
No comments