হাদীসের নামে জালিয়াতি - একাদশ অধ্যায় - জাল হাদীস বিষয়ক কিছু প্রশ্ন

জাল হাদীস বিষয়ক কিছু প্রশ্ন

আমরা প্রথম পর্বের আলোচনা শেষ করেছি। দ্বিতীয় পর্বে আমরা আমাদের সমাজে প্রচলিত অনেক জাল হাদীস ভিত্তিহীন কথাবার্তা উল্লেখ করব। সকল জাল ভিত্তিহীন কথাবার্তা পাঠের সময় পাঠকের মনে বারংবার কয়েকটি প্রশ্ন জাগতে পারে। প্রশ্নগুলোর উত্তর পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি। তবুও এখানে প্রশ্নগুলো আলোচনা করতে চাই

আমরা দেখতে পাব যে, মিথ্যা বা বানোয়াট হাদীসের মধ্যে অনেক কথা আছে যা অত্যন্ত সুন্দর, অর্থবহ, মূল্যবান হৃদয়স্পর্শী। তখন আমাদের কাছে মনে হবে যে, কথাটি তো খুব সুন্দর, একে বানোয়াট বলার দরকার কি? অথবা এত সুন্দর মর্মস্পর্শী কথা হাদীস না হয়ে পারে না। অথবা কথার মধ্যে তো কোন দোষ নেই, এর বিরুদ্ধে লাগার প্রয়োজন কি? ইত্যাদি

এর উত্তরে আমাদের বুঝতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর শিক্ষা বাণীকে অবিকল নির্ভেজালভাবে হেফাযত করা উম্মতের প্রথম দায়িত্ব। তিনি বলেন নি, এমন কোন কথা তাঁর নামে বলাই জাহান্নামের নিশ্চিত পথ বলে তিনি বারবার বলেছেন। কাজেই কোন বাণীর ভাব মর্ম কখনোই আমাদের কাছে প্রথমে বিবেচ্য নয়। প্রথম বিবেচ্য হলো, তিনি বাক্যটি বলেছেন কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা। কোন কথার অর্থ যত সুন্দর হৃদয়স্পর্শী হোক সে কথাটিকে আমরা রাসূলুল্লাহ ()-এর কথা বা হাদীস বলতে পারি না, যতক্ষণ না বিশুদ্ধ সনদে তাঁর থেকে বর্ণিত না হয়। রাসূলুল্লাহ  যে কথা বলেছেন বলে আমরা নিশ্চিতরূপে জানি না সে কথা তাঁর নামে বলার মত কঠিনতম অপরাধ থেকে আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন

দ্বিতীয় বিষয় হলো, আমরা প্রায়ই দেখব যে, আমরা যে সকল হাদীসকে বানোয়াট বলে উল্লেখ করছি, সকল হাদীসকে অনেক বুযুর্গ তার কথায় বা গ্রন্থে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ক্ষেত্রে কেউ হয়ত বলতে পারেন: অমুক আলিম বা বুযুর্গ হাদীস বলেছেন, তিনি কি তাহলে জাহান্নামী?

আমরা দেখেছি যে, বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি হয়েছে অনেক। সকল জাল হাদীস বুযুর্গগণ সত্যই বলেছেন, না জালিয়াতরা তাঁদের নামে চালিয়েছে তা আমরা জানি না। যদি তাঁরা বলেও থাকেন, তবে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, একজন বুযুর্গের অসংখ্য কর্মের মধ্যে কিছু ভুল থাকতে পারে। তাঁদের অসংখ্য ভাল কাজের মধ্যে সকল ভুলভ্রান্তি কিছুই নয়। মূলত: তাঁরা মুজতাহিদ ছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা যথাসাধ্য সঠিক কথাটি লেখার বা বলার আন্তরিক চেষ্টা করেছেন। আর এক্ষেত্রে ভুল করলেও তাঁরা সাওয়াব পেয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘কেউ যদি কোনো হুকুম-বিধান প্রদানের ক্ষেত্রে ইজতিহাদ করে বা যথাসাধ্য সঠিক হুকুম-বিধান প্রদানের জন্য চেষ্টা করে এবং সফল হয় তবে তার জন্য দুটি পুরস্কার। আর যদি সে এভাবে ইজতিহাদ করে বিধান প্রদান করে ভুল করে তবে তার জন্য একটি পুরস্কার।’’[1]

কোনো আলিম বা বুজুর্গ যদি যথাসাধ্য সতর্কতা চেষ্টা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে ভুল বশত কোনো জাল হাদীস বলেন বা লিখেন তবে তিনি একটি পুরস্কার লাভ করবেন। এছাড়া মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘পুণ্যকাজ অবশ্যই পাপকে দূর করে দেয়।’’ (সূরা হূদ: ১১৪ আয়াত) এজন্য কোনো বুজুর্গ যদি এক্ষেত্রে অপরাধীও হন তবে তাঁর অন্যান্য অগণিত নেকআমলের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু তাঁর ভুলকে পুঁজি করে আমরা পাপ করতে পারি না

কোনো বুযুর্গ বা সত্যিকারের আল্লাহ-ওয়ালা মানুষ কখনোই জেনেশুনে কোনো জাল বা মিথ্যা কথা রাসূলুল্লাহ () এর নামে বলতে পারেন না। না-জেনে হয়ত কেউ বলে ফেলেছেন। কিন্তু তাই বলে আমরা জেনে শুনে কোনো জাল হাদীস বলতে পারি না। আমাদের দায়িত্ব হলো, কোনো হাদীসের বিষয়ে যদি আমরা শুনি বা জানি যে, হাদীসটিজালতবে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তা বলা পালন করা বর্জন করব। যদি বিষয়ে আমাদের মনে সন্দেহ হয় তবে আমরা মুহাদ্দিসগণের তথ্যাদির আলোকেতাহকীকবা গবেষণা করে প্রকৃত বিষয় জানতে চেষ্টা করব। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের কর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন, অন্য কারো কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। কাজেই আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বা সন্দেহজনক কিছু বলা থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে

তৃতীয় প্রশ্ন যা আমাদের মনে আসবে তা হলো, এতসব বুযুর্গ কিছু বুঝলেন না, এখন আমরা কি তাঁদের চেয়েও বেশী বুঝলাম? এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো, গ্রন্থে আলোচিত জাল হাদীসগুলোকে জাল বলার ক্ষেত্রে আমার মত অধমের কোন ভূমিকা নেই। এখানে আমি মূলত পূর্ববতী মুহাদ্দিসগণের মতামতই বর্ণনা করছি। পাঠক তা বিস্তারিত দেখবেন, ইনশা আল্লাহ

[1] বুখারী, আস-সহীহ /২৬৭৬; মুসলিম, আস-সহীহ /১৩৪২, নং ১৭১৬

No comments

Powered by Blogger.