হাদীসের নামে জালিয়াতি - দ্বাদশ অধ্যায় - অশুদ্ধ হাদীসের বিষয়ভিত্তিক মূলনীতি
অশুদ্ধ হাদীসের বিষয়ভিত্তিক মূলনীতি
জাল ও অনির্ভরযেগা্য হাদীস সংকলনের একটি বিশেষ পদ্ধতি: যে সকল বিষয়ে সকল হাদীস বা অধিকাংশ হাদীস বানোয়াট বা অনির্ভরযোগ্য সে সকল বিষয়কে একত্রিত করে সংকলিত করা। বানোয়াট হাদীস চিহ্নিত করণের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে আগ্রহী মুসলিম বিভিন্ন গ্রন্থের সহায়তা ছাড়াই অতি সহজে বুঝতে পারেন যে, এ হাদীসটি বানোয়াট; কারণ হাদীসটি যে বিষয়ে বর্ণিত সে বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই। এ পদ্ধতিতে রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ ৭ম হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ও হানাফী ফকীহ উমার ইবনু বাদর আল-মাউসিলী (৫৫৭-৬২২ হি) রচিত ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থ। এছাড়া হিজরী একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি), ত্রয়োদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ, মুহাদ্দিস ও সূফী সাধক মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত (১২৭৬ হি) এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস এ বিষয়ক কিছু মূলনীতি উল্লেখ করেছেন।
(ক) উমার ইবনু বাদর মাউসিলী হানাফী
আল্লামা উমার ইবনু বাদর ইবনু সাঈদ আল-মাউসিলী হাদীস, তাফসীর, ফিক্হ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘‘আল-মুগনী আনিল হিফযি ওয়াল কিতাব বি-কাউলিহিম লাম ইয়াসিহ্ শাইউন ফী হাযাল বাব’’ নামক গ্রন্থটি। এ দীর্ঘ নামের প্রতিপাদ্য হলো: ‘মুহাদ্দিসগণ সে সকল বিষয়ে বলেছেন যে, এ বিষয়ে কোনো হাদীসই সহীহ নয় সে বিষয়গুলোর বিবরণ। এগুলোর জন্য অন্য কোনো গ্রন্থ পাঠ ও মুখস্থ করার আর কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।’ এ গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তিনি ১০১ টি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, যে সকল বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীসই অশুদ্ধ বলে মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন। কোনো বিষয়ে কিছু হাদীস বিশুদ্ধ হলে তা উল্লেখ করে বাকি সকল হাদীস অশুদ্ধ বলে জানিয়েছেন। তাঁর গবেষণায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে বর্ণিত সকল হাদীসই জাল অথবা অতি দুর্বল:
১. ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি
কুরআনে একাধিক স্থানে আল্লাহ বলেছেন যে, মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় (সূরা আনফাল ২ ও সূরা ফাতহ ৪ আয়াত)। তবে ঈমান বাড়ে এবং কমে অথবা বাড়ে না ও কমে না এবং কথা ও কর্ম ঈমানের অন্তর্ভুক্ত বা অন্তর্ভুক্ত নয়- এ অর্থে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল। কুরআন ও হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশনার আলোকে মুসলিম উম্মাহর ইমামগণ মতভেদ করেছেন।
২. মুরজিয়া, জাহমিয়া, কাদারিয়া ও আশআরিয়া
এ সকল সম্প্রদায় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী মূলক কোনো সহীহ হাদীস রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হয় নি। এদের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলি বানোয়াট অথবা অত্যন্ত দুর্বল। সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ ও ইমামগণ কুরআন ও সুন্নাহের নির্দেশনার আলোকে এ সকল সম্প্রদায়ের বিষয়ে কথা বলেছেন।
৩. আল্লাহর বাণী সৃষ্ট নয়
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত, বিভিন্ন হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশনা ও সাহাবীগণের মতামতের আলোকে তাবিয়ীগণ ও পরবর্তী ইমামগণ একমত যে, কুরআন আল্লাহর বাণী, তা তাঁর মহান গুণাবলির অংশ এবং সৃষ্ট নয়। বিভ্রান্ত মু’তাযিলা সম্প্রদায় কুরআনকে সৃষ্টবস্ত্ত বলে বিশ্বাস করতো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকে এ বিষয়টি মুসলিম সমাজের অন্যতম বিতর্ক-বিষয় ছিল। এজন্য অনেক জালিয়াত এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে হাদীস বানিয়ে প্রসিদ্ধি লাভের চেষ্টা করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত পোষণ করেছেন যে, কুরআন সৃষ্ট নয়। তবে এ মত প্রমাণের জন্য হাদীস জালিয়াতির সকল প্রচেষ্টা তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
৪. নূরের সমূদ্রে ফিরিশতাগণের সৃষ্টি
জিবরাঈল (আ) প্রতিদিন সকালে নূরের সমূদ্রে ডুব দিয়ে উঠে শরীর ঝাড়া দেন এবং প্রতি ফোটা নূর থেকে ৭০ হাজার ফিরিশতা সৃষ্টি করা হয়। এ অর্থে ও এ জাতীয় সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
৫. মুহাম্মাদ বা আহমাদ নাম রাখার ফযীলত
মুহাম্মাদ বা আহমাদ নাম রাখার ফযীলতে প্রচারিত সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এ বিষয়ে অনেক বানোয়াট হাদীস প্রচারিত হয়েছে। মুহাম্মাদ ও আহমাদ নামধারীদের আল্লাহ শাস্তি দিবেন না, যাদের পরিবারে কয়েক ব্যক্তির নাম মুহাম্মাদ হবে তাদের ক্ষমা করা হবে, বা বরকত দেয়া হবে ইত্যাদি বিভিন্ন কথা বানিয়ে হাদীসের নামে চালানো হয়েছে। এ নাম দুটি নিঃসন্দেহে উত্তম নাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মহববতে সন্তানদের এ নাম রাখা ভাল। তবে এ বিষয়ের বিশেষ ফযীলত জ্ঞাপক হাদীগুলো বানোয়াট।
৬. আকল অর্থাৎ বুদ্ধি বা জ্ঞানেন্দ্রিয়
বুদ্ধি বা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রশংসা বা ফযীলতে বর্ণিত সকল হাদীস ভিত্তিহীন। কুরআন ও হাদীসে জ্ঞান শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং জ্ঞানীগণের প্রশংসা করা হয়েছে। তবে ইন্দ্রিয়ের প্রশংসায় রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো হাদীস সহীহরূপে বর্ণিত হয় নি। জালিয়াতগণ বুদ্ধি বা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রশংসায় অনেক হাদীস বানিয়েছে। যেগুলোতে বুদ্ধির প্রশংসা করা হয়েছে, মানুষ কর্ম নয় বরং বুদ্ধি অনুসারে পুরস্কার লাভ করবে; বুদ্ধিহীন বা নির্বোধের সালাতের চেয়ে বুদ্ধিমানের সালাতের সাওয়াব বেশি.... ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট। কোনো জন্মগত বা বংশগত বিষয়ই আখিরাতের মুক্তি বা মর্যাদার বিষয় নয়। মানুষের ইচ্ছাকৃত কর্মই মূলত তার মুক্তির মাধ্যম। যার বুদ্ধি বেশি ও বুদ্ধি সৎকর্মে ব্যবহার করেন তিনি তার কর্মের জন্য প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হবেন। কিন্তু জন্মগত বা প্রকৃতিগত বুদ্ধি কোনো মুক্তি বা সাওয়াবের বিষয় নয়।
৭. খিযির (আ) ও ইলিয়াস (আ) এর দীর্ঘ জীবন
সূরা কাহাফে আল্লাহ মূসার (আ) সাথে আল্লাহর একজন বান্দার কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে এ বান্দার নাম উল্লেখ করা হয় নি। তবে সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বান্দার নাম ‘খাযির’ (প্রচলিত বাংলায়: খিযির)। এ একটি ঘটনা ছাড়া অন্য কোনো ঘটনায় খিযির (আ)-এর বিষয়ে কোনো সহীহ বর্ণনা জানা যায় না। তাঁর জন্ম, বাল্যকাল, কর্ম, নবুয়ত, কর্মক্ষেত্র, এ ঘটনার পরবর্তী কালে তার জীবন ও তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে কোনো প্রকারের কোনো বর্ণনা কোনো সহীহ হাদীসে জানতে পারা যায় না। তিনি আবে হায়াতের পানি পান করেছিলেন ইত্যাদি কথা সবই ইহূদী-খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত কথা মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে।
আল্লামা মাউসিলী বলেন, খিযির (আ) ও ইলিয়াস (আ) দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন, তাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে দেখেছেন বা কথা বলেছেন, তাঁর পরে বেঁচে আছেন, ইত্যাদি অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বালকে খিযির (আ) ও ইলিয়াস (আ) এর দীর্ঘ জীবন ও জীবিত থাকার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন... শয়তানই এ বিষয়টি মানুষদের মধ্যে প্রচারিত করেছে। ইমাম বুখারীকে প্রশ্ন করা হয়, খিযির (আ) ও ইলিয়াস (আ) কি এখনো জীবিত আছেন? ইমাম বুখারী বলেন, তা অসম্ভব; কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘তোমরা আজকের রাত্রিটির কথা মনে রাখবে। আজ রাত্রিতে পৃথিবীর বুকে যারা আছে আজ থেকে একশত বৎসরের মাথায় তাদের কেউই পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকবে না।’[1] ইবনুল জাওযী খিযির (আ) ও ইলিয়াস (আ) এর দীর্ঘজীবনের বিষয়ে বলেন, এই কথাটি কুরআনের আয়াতের পরিপন্থী। আল্লাহ বলেছেন[2]: ‘আপনার পূর্বে কোনো মানুষকেই আমি অনন্ত জীবন দান করি নি; সুতরাং আপনার মৃত্যু হলে তারা কি চিরজীবী হয়ে থাকবে?’।
উল্লেখ্য যে, কোনো কোনো আলিম খিযিরের জীবিত থাকার সম্ভাবনা স্বীকার করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন বুযুর্গের কথার উপর নির্ভর করেছেন। তবে এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয় নি।
[1] বুখারী, আস-সহীহ ১/৫৪; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৬৫, নং ২৫৩৭।
[2] সূরা (২১) আম্বিয়া: আয়াত ৩৪।
৮. কুরআনের বিভিন্ন সূরার ফযীলত
আল্লামা মাউসিলী বলেন, কুরআনের ফযীলতের বিষয়ে কিছু হাদীস সহীহ, তবে এ বিষয়ে অনেক বানোয়াট হাদীস সমাজে প্রচার করা হয়েছে। নিম্নলিখিত সূরা বা আয়াতের বিষয়ে বিশেষ মর্যাদা বা ফযীলত জ্ঞাপক সহীহ বা হাসান হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সূরা ফাতিহা, সূরা বাকারাহ, সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, আয়াতুল কুরসী, সূরা আল-ইমরান, সূরা কাহাফ, সূরা কাহাফের প্রথম বা শেষ দশ আয়াত, সূরা মুলক, সূরা যিলযাল, সূরা কাফিরূন, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস। এছাড়া অন্যান্য সূরার ফযীলতে বর্ণিত হাদীসগুলি বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল। এছাড়া উপরের সূরাগুলোর ফযীলতেও অনেক বানোয়াট কথা হাদীস নামে প্রচার করা হয়েছে।
৯. রোদে গরম করা পানি
রোদে গরম করা পানি ব্যবহার করলে অসুস্থতা বা অমঙ্গল হতে পারে অর্থে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত সকল হাদীস মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
আর কিছু ভিত্তিহীন বিষয়...
১০. আবু হানীফা (রাহ) ও শাফিয়ীর (রাহ) প্রশংসা বা নিন্দা
১১. যার দায়িত্বে সালাত (কাযা) রয়েছে তার সালাত হবে না
১২. মসজিদের মধ্যে জানাযার সালাত আদায়ে নিষেধাজ্ঞা
১৩. ওযুর পরে রুমাল ব্যবহার বা আদ্র অঙ্গগুলো মোছা
ইমাম মাউসিলী বলেন, এ সকল অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস ভিত্তিহীন।
১৪. সালাতের মধ্যে সশব্দে বিসমিল্লাহ পাঠ
আল্লামা মাউসিলী বলেন, ইমাম দারাকুতনী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতের মধ্যে সশব্দে ‘বিসমিল্লাহ...’ পাঠ করেছেন অর্থে বর্ণিত কোনো হাদীসই সহীহ নয়।
১৫. জানাযার তাকবীরগুলোতে হাত উঠানো
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানাযার প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্য কোনো তাকবীরের সময় হাত উঠিয়েছেন বলে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি।
১৭. সালাতুর রাগাইব
সালাতুর রাগাইব বা রজব মাসের প্রথম জুম‘আর দিনে বিশেষ নফল সালাতের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
১৭. শবে মি’রাজ-এর নামায
মি’রাজের রাত্রিতে বিশেষ নফল সালাত আদায়ের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
১৮. শবে বরাতের নামায
শবে বারাতের রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ কিছু রাক‘আত নফল সালাতের বিশেষ ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
১৯. সপ্তাহের দিন ও রাতের নফল সালাত
আল্লামা মাউসিলী বলেন, এ বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। তিনি আরো বলেন: নফল সালাতের বিষয়ে শুধুমাত্র নিম্নের সালাতগুলির বিষয়ে সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে: ফরয সালাতের আগে পরে সুন্নাত সালাত, তারাবীহ, দোহা বা চাশত, রাতের সালাত বা তাহাজ্জুদ, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ, তাহিয়্যাতুল ওযু, ইসতিখারার সালাত, কুসূফের (চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের) সালাত, ইসতিসকার সালাত।[1]
[1] সালাতুত তাসবীহ বিষয়ক একটি বর্ণনাকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস সহীহ বা হাসান বলেছেন।
২০. ঈদের তাকবীরের সংখ্যা
আল্লামা মাউসিলী বলেন, ইমাম আহমাদ বলেছেন, ঈদের তাকবীরের সংখ্যার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত সকল হাদীসই যয়ীফ।[1]
[1] ঈদের তাকবীর বিষয়ে সাহাবীগণ থেকে তাঁদের কর্ম হিসাবে এ বিষয়ে বিভিন্ন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন লেখকের অন্য বই: ‘‘হাদীসের সনদবিচার পদ্ধতি ও সহীহ হাদীসের আলোকে সালাতুল ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর’’।
২১. সুন্দর চেহারার প্রশংসা
সুন্দর চেহারার প্রশংসার বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট।
২২. আশুরার ফযীলত
আশুরার দিনে সিয়াম পালনের ফযীলত সহীহ হাদীসে প্রমাণিত। এছাড়া এ দিনে দান করা, খেযাব মাখা, তেল ব্যাবহার, সুরমা মাখা, বিশেষ পানাহার ইত্যাদি বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
২৩. রজব মাসে সিয়ামের ফযীলত
রজব মাসে বা এ মাসের কোনো তারিখে নফল সিয়াম পালনের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
২৪. ঋণ থেকে উপকার নেওয়াই সুদ
আল্লামা মাউসিলী বলেন, একটি কথা প্রচলিত আছে:
كُلُّ قَرْضٍ جَرَّ نَفْعاً
فَهُوَ رِباً
‘‘যে কোনো কর্জ থেকে উপকার নেয়াই সুদ।’’ এ অর্থে বর্ণিত হাদীসের সনদ সহীহ নয়। হাদীসে সুদের সুনির্ধারিত সংজ্ঞা ও পরিচিতি রয়েছে।
২৫. অবিবাহিতদের প্রশংসা
অবিবাহিতদের প্রশংসায় কথিত সকল কথা ভিত্তিহীন।
২৬. ছুরি দিয়ে গোশত কেটে খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা
একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, খাওয়ার সময় ছুরি ব্যবহার বা ছুরি দিয়ে গোশত কেটে খাওয়া আ’জামীদের আচরণ, মুসলমানদের তা পরিহার করতে হবে। এ হাদীসটি বানোয়াট পর্যায়ের। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ছুরি দিয়ে ছাগলের গোশত কেটে খেয়েছেন।
২৭-৩২. আর কিছু ভিত্তিহীন বিষয়...
1. আখরোট, বেগুন, বেদানা, কিশমিশ, গোশত, তরমুয, গোলাপ, ইত্যাদির উপকার বা ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
2. মোরগ বা সাদা মোরগের প্রশংসা বিষয়ক সকল কথা বানোয়াট।
3. আকীক পাথর ব্যবহার, বা অন্য কোনো পাথরের গুণাগুণ বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
4. স্বপ্নের কথা মহিলাদেরকে বলা যাবে না অর্থে বর্ণিত সকল কথা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
5. রাসূলুল্লাহ ﷺ ফার্সী ভাষায় কথা বলেছেন বা ফার্সী ভাষার নিন্দা করেছেন এ অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট বা ভিত্তিহীন।
6. জারজ সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবে না অর্থে বর্ণিত সকল কথা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
৩৩. ফাসেক ব্যক্তির গীবত করার বৈধতা
প্রচলিত বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: ‘‘ফাসিকের গীবত নেই’’ অর্থাৎ ফাসিক ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার মধ্যে বিরাজমান সত্য ও বাস্তব দোষের কথা উল্লেখ করলে তাতে গীবত হবে না বা গোনাহ হবে না। এ অর্থে বর্ণিত সকল কথা বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও বাতিল। এ প্রকার বানোয়াট কথা অগণিত মুমিনকে ‘গীবতের’ মত ভয়ঙ্কর পাপের মধ্যে নিপতিত করে।
৩৪. অমুক মাসে, অমুক সালে অমুক কিছু ঘটবে
অমুক মাসে, অমুক সালে অমুক কিছু ঘটবে এইরূপ সন, তারিখ ও স্থানভিত্তিক ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বানোয়াট।
৩৫. দাবা খেলার নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক
হাদীস শরীফে শরীরচর্চা মূলক খেলাধুলার উৎসাহ দেয়া হয়েছে। ‘নারদ’ অর্থাৎ সাতগুটি, লুডু, তাস ইত্যাদি ভাগ্যনির্ভর খেলাধুলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুদ্ধি নির্ভর কিন্তু শরীরচর্চা বিহীন দাবা খেলার বৈধতার বিষয়ে সাহাবীগণের যুগ থেকেই আলিমগণ মতভেদ করেছেন। অনেক সাহাবী এ খেলা কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লামা মাউসিলী বলেন, এ অর্থে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো হাদীস সহীহ সনদে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হাদীসগুলো দুর্বল বা বানোয়াট পর্যায়ের।
(খ) মোল্লা আলী কারী ও দরবেশ হূত
১০ম-১১শ হিজরী শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম ও হানাফী ফকীহ মোল্লা আলী ইবনু সুলতান মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন হারাবী কারী (১০১৪ হি) রচিত বিভিন্ন মূল্যবান পুস্তকের মধ্যে দুটি পুস্তক জাল হাদীস বিষয়ক। একটির নাম: ‘আল-আসরারুল মারফূয়া’ বা ‘আল-মাউদূ‘আত আল-কুবরা’ ও অন্যটির নাম ‘আল-মাসনূ ফিল হাদীসিল মাউদূ’ বা ‘আল-মাউদূ‘আত আস-সুগরা’। উভয় গ্রন্থের শেষে জাল হাদীস বিষয়ক কিছু মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে।
ত্রয়োদশ হিজরী শতকের সুপ্রসিদ্ধ সিরীয় আলিম ও সূফী মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত (১২০৯-১২৭৬ হি) । তাঁর রচিত মূল্যবান গ্রন্থগুলোর একটি ‘আসনাল মাতালিব’। এই গ্রন্থে তিনি সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন সহীহ, যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসের আলোচনা করেছেন। গ্রন্থের শেষে তিনি জাল হাদীস বিষয়ক কিছু মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। এ দুই আলিমের উল্লিখিত মূলনীতিগুলোর আলোকে আমি এখানে সংক্ষেপে কিছু বিষয় উল্লেখ করছি[1]:
[1] বিস্তারিত দেখনু, আল-আসরার, পৃ. ২৭৭-২৫৯; আল-মাসনূ, পৃ. ১৭৮-২২০; আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৬৯-৩০০।
১. ভবিষ্যতের যুদ্ধ-বিগ্রহ বিষয়ক বর্ণনাসমূহ প্রায় সবই অনির্ভরযোগ্য
ভবিষ্যদ্বাণী ও ভবিষ্যত ঘটনাবলির বিষয়ে অতি অল্প সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতের যুদ্ধ-বিগ্রহ, ফিতনা-ফাসাদ ইত্যাদি বিষয়ে বর্ণিত ও প্রচলিত অধিকাংশ হাদীসই অনির্ভরযোগ্য বা ভিত্তিহীন।
২-৬. আর কিছু ভিত্তিহীন বিষয়...
1. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুদ্ধবিগ্রহের বা জীবনের বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত ইতিহাস বিষয়ক অধিকাংশ হাদীসের কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্র পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে অল্প কিছু সহীহ হাদীস রয়েছে। বাকি সবই গল্পকারদের বৃদ্ধি। ইতিহাসের ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাকের ইতিহাস প্রসিদ্ধ। তিনিও ইহূদী-খৃস্টানদের থেকে তথ্য নিতেন।
2. তাফসীরের ক্ষেত্রে সহীহ সনদের তাফসীর ও শানে নুযূল খুবই কম। এ বিষয়ক অধিকাংশ ‘হাদীস’-ই নির্ভরযোগ্য সনদ বা সূত্র বিহীন। বিশেষত, মুহাম্মাদ ইবনু সাইব ‘কালবী’ (১৪৬হি) বর্ণিত সকল তাফসীরই ভিত্তিহীন। এছাড়া মুকাতিল ইবনু সুলাইমান (১৫০হি)-এর বর্ণিত তাফসীরও অনুরূপ। এরা জনশ্রুতি, ইহূদী-খৃস্টানদের ইসরাঈলীয় বর্ণনা ইত্যাদির সাথে অগণিত মিথ্যা মিশ্রিত করেছেন।
3. নবীগণের কবর সম্পর্কে প্রচলিত সব কথাই ভিত্তিহীন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাড়া অন্য কোনো নবীর কবর সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
4. মক্কা শরীফে অনেক সাহাবীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু তাঁদের কবরের স্থান সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। ‘মু‘য়াল্লা’ গোরস্থানে খাদীজাতুল কুবরা (রা)-এর ‘কবর’ বলে পরিচিত স্থানটিও কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয় নি। এক ব্যক্তি স্বপ্ন দেখে বলেন যে, এ স্থানটি খাদীজা (রা)-এর কবর। ক্রমান্বয়ে তা প্রসিদ্ধ হয়ে যায়।
5. মক্কায় ঠিক কোন্ স্থানটিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। এ বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে।
৭. কুদায়ীর ‘আশ-শিহাব’ গ্রন্থের অতিরিক্ত হাদীসসমূহ
৪র্থ হিজরী শতকের পরে কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীস সংকলন গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসকল হাদীস গ্রন্থের মধ্যে কিছু গ্রন্থে সংকলিত প্রায় সকল হাদীসই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এগুলোর অন্যতম হলো ৫ম হিজরী শতকের মিশরীয় আলিম কাযি আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু সালামাহ আল-কুদায়ী (৪৫৪ হি) প্রণীত ‘আশ-শিহাব’ নামক গ্রন্থটি। এ গ্রন্থটিতে তিনি প্রায় ১৫০০ হাদীস সংকলন করেছেন। এর মধ্যে কিছু হাদীস পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোতে সংকলিত ‘সিহাহ সিত্তা’ বা অন্যান্য প্রসিদ্ধ গ্রন্থে সংকলিত। অবশিষ্ট হাদীসগুলো তিনি নিজের সনদে সংকলন করেছেন। এ ধরনের হাদীসগুলো প্রায় সবই বানোয়াট, ভিত্তিহীন বা অত্যন্ত দুর্বল সনদে সংকলিত।
৮. ইবনু ওয়াদ‘আনের ‘চল্লিশ হাদীস’ গ্রন্থের সকল হাদীস
৫ম হিজরী শতকের অন্য একজন আলিম ইরাকের মাওসিলের কাযি আবূ নাস্র মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াদ‘আন (৪৯৪ হি)। তিনি ‘আল-আরবাঈন’ বা ‘চল্লিশ হাদীস’ নামে হাদীসের একটি সংকলন রচনা করেন। এ সংকলনের সকল হাদীসই জাল বা বানোয়াট কথা। ইমাম সুয়ূতী বলেন, এ ‘চল্লিশ হাদীস’ নামক গ্রন্থের হাদীস নামক জাল কথাগুলোর বক্তব্য খুবই সুন্দর। এগুলোর মধ্যে হৃদয় গলানো ওয়ায রয়েছে। কিন্তু কথা সুন্দর হলেই তো তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর কথা বলে গণ্য হবে না। বিশুদ্ধ সনদে তাঁর থেকে বর্ণিত হতে হবে। এ গ্রন্থের সকল হাদীসই জাল। তবে জালিয়াতগণ কোনো কোনো জাল হাদীসের মধ্যে সহীহ হাদীসের কিছু বাক্য ঢুকিয়ে দিয়েছে।
৯-১৭. আর কিছু ভিত্তিহীন বিষয়...
1. শারাফ বালখী রচিত ‘ফাযলুল উলামা’ বইয়ের সকল হাদীস।
2. ‘কিতাবুল আরূস’ নামক একটি প্রচলিত গ্রন্থ। এ গ্রন্থে নব দম্পতি ও বিবাহিতদের বিষয়ে অনেক জাল কথা সংকলিত। জালিয়াত বইটি ইমাম জাফর সাদিকের নামে প্রচার করেছে।
3. তৃতীয়-চতুর্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম ‘হাকিম তিরমিযী’ মুহাম্মাদ ইবনু আলী (মৃত্যু আনু. ৩২০ হি)। তিনি নাওয়াদিরুল উসূল’ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ পুস্তক রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থগুলোতে অনেক জাল হাদীস রয়েছে। এমনকি মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, তিনি তাঁর গ্রন্থগুলোকে জাল হাদীস দিয়ে ভরে ফেলেছেন। ফলে তাঁর গ্রন্থের কোনো হাদীস নিরীক্ষা ছাড়া গ্রহণ করা যাবে না।
4. ইমাম গাযালী (৫০৫ হি) রচিত ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে বিদ্যমান কোনো হাদীস নিরীক্ষা ছাড়া গ্রহণ করা যাবে না। ইমাম গাযালীর মহান মর্যাদা অনস্বীকার্য। তবে তিনি হাদীস উল্লেখের ব্যাপারে কোনো যাচাই বাছাই করেন নি। প্রচলিত কিছু গ্রন্থ ও জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে অনেক জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস তিনি তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
5. আল্লামা ইমাম আবুল লাইস সামারকান্দী নাস্র ইবনু মুহাম্মাদ (৩৭৩ হি) রচিত ‘তানবীহুল গাফিলীন’ গ্রন্থের অবস্থাও অনুরূপ। এ গ্রন্থে অনেক জাল ও বানোয়াট হাদীস রয়েছে।
6. ৬ষ্ঠ শতকের প্রসিদ্ধ আলিম শু‘আইব ইবনু আব্দুল আযীয খুরাইফীশ (৫৯৭ হি)। তিনি ওয়ায উপদেশ ও ফযীলত বিষয়ে ‘আর-রাওদুল ফাইক’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা প্রসিদ্ধি লাভ করে। এ গ্রন্থটিতেও অনেক জাল হাদীস স্থান পেয়েছে।
7. তাসাউফের গ্রন্থগুলোতে সূফী বুযুর্গগণের সরলতার কারণে অনেক জাল হাদীস স্থান পেয়েছে।
8. ইমাম হাকিম (৪০৫হি) তাঁর ‘আল-মুসতাদরাক’ গ্রন্থে অনেক যয়ীফ, মাউযূ ও বাতিল হাদীসকে ‘সহীহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে তিনি খুবই দুর্বলতা দেখিয়েছেন। এজন্য তাঁর মতামতের উপর নির্ভর করা যায় না।
9. কুদা‘য়ীর ‘আস-শিহাব’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন ৬ষ্ঠ শতকের একজন মুহাদ্দিস ‘মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ ইবনু হাবীব আল-আমিরী (৫৩০ হি)। তিনিও হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের বিষয়ে বিশেষ দুর্বলতা ও ঢিলেমি প্রদর্শন করেছেন। এ গ্রন্থের অনেক দুর্বল, জাল ও ভিত্তিহীন হাদীসকে সহীহ বা হাসান বলে উল্লেখ করেছেন। আব্দুর রাঊফ মুনাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর এ সকল ভুল উল্লেখ করেছেন। এজন্য নিরীক্ষা ছাড়া তাঁর মতামত অগ্রহণযোগ্য।
১৮. ‘আলীর প্রতি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ওসীয়ত’ নামে প্রচলিত ওসীয়ত
আলী (রা) এর নামে একাধিক জাল ওসীয়ত প্রচলিত। প্রসিদ্ধ একটি জাল ওসীয়তের শুরুতে বলা হয়েছে: হে আলী মূসা (আ)-এর কাছে হারূন (আ)-এর মর্যাদা যেরূপ, আমার কাছেও তোমার মর্যাদা সেরূপ। তবে আমার পরে কোনো নবী নেই।’ জালিয়াত এ বাক্যটি সহীহ হাদীস থেকে নিয়েছে। এরপর বিভিন্ন ভিত্তিহীন কথা উল্লেখ করেছে। যেমন, হে আলী, মুমিনের আলামত তিনটি... মুনাফিকের আলামত... হিংসুকের আলামত.... পুরো ওসীয়তটিই বাতিল, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা কথায় ভরা। মাঝে মধ্যে দুই একটি সহীহ হাদীসের বাক্য ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।[1] এ ছাড়াও আলী (রা) এর নামে আরো একাধিক ওসীয়ত জালিয়াতগণ তৈরি করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, ‘আলীর প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওসীয়ত’ নামে প্রচলিত সবই জাল। তবে এগুলোর মধ্যে জালিয়াতগণ দুই একটি সহীহ হাদীসের বাক্য ঢুকিয়ে দিয়েছে।
[1] এ জাল ওসীয়তটি পুরোটাই বাংলায় ছাপা হয়েছে। দেখন, আল্লামা সুয়ূতী, নবী করীম (সা)-এর ওসীয়ত, অনুবাদ মাওলানা মুহাম্মাদ রিজাউল করীম ইসলামাবাদী (ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ ২০০৩), পৃ. ১১-২৪।
১৯. আবূ হুরাইরার প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওসীয়ত
আবূ হুরাইরার (রা) উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওসীয়ত নামে আরেকটি জাল হাদীস প্রচলিত আছে। এ ওসীয়তটিও আগাগোড়া জাল ও মিথ্যা। তবে জালিয়াতগণ তাদের অভ্যাস মত এর মধ্যে অন্য সনদে বর্ণিত দু-চারটি সহীহ হাদীসের বাক্য জোড়াতালি দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে।[1]
[1] এ জাল ওসীয়তটিও পূর্বের ওসীয়তটির সাথে উপরের বইটিতে ছাপা হয়েছে: পৃ. ২৭-৩৮।
২০. বিলালের মদীনা ত্যাগ ও স্বপ্ন দেখে মদীনায় আগমনের কাহিনী
রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পরে বিলাল (রা) জিহাদের উদ্দেশ্যে মদীনা ছেড়ে সিরিয়া এলাকায় গমন করেন এবং সিরিয়াতেই বসবাস করতেন। কথিত আছে যে, একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে যিয়ারতের উৎসাহ দিচ্ছেন। তখন তিনি মদীনায় আগমন করেন.... ইত্যাদি। আল্লামা কারী বলেন, সুয়ূতী উল্লেখ করেছেন যে, এ কাহিনীটি বানোয়াট। সম্ভবত, ইবনু হাজার মাক্কী ইমাম সুয়ূতীর এ আলোচনা দেখতে পান নি; এজন্য তিনি এ জাল কাহিনীটিকে তার যিয়ারত বিষয়ক পুস্তকটিতে উল্লেখ করেছেন।
২১. সপ্তাহের বিভিন্ন দিনের বা রাতের জন্য বিশেষ নামায.......
সপ্তাহের বিভিন্ন দিনের বা রাতের জন্য বিশেষ নামাযের বিষয়ে বর্ণিত সব কিছু বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। অনুরূপভাবে আশুরার দিনের বা রাতের নামায, রজব মাসের প্রথম রাতের নামায, রজব মাসের অন্যান্য দিন বা রাতের নামায, রজব মাসের ২৭ তারিখের রাতের নামায ইত্যাদি সকল কথাই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
আল্লামা আলী কারী বলেন, কূতুল কুলূব, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন, তাফসীরে সা‘আলিবী ইত্যাদি গ্রন্থে এ সকল হাদীস রয়েছে দেখে পাঠক ধোঁকা খাবেন না। এগুলো সবই বানোয়াট।
২২-২৫. আরো কিছু বানোয়াট বিষয়...
1. হাসান বসরী আলী (রা) থেকে খিরকা বা সূফী তরীকা গ্রহণ করেছিলেন বলে যা কিছু প্রচলিত আছে সবই ভিত্তিহীন কথা।
2. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উমার (রা) ও আলী (রা)-কে তার জামা বা খিরকা দিয়েছিলেন উয়াইস কারনীকে পৌঁছে দেয়ার জন্য এবং তাঁরা তাঁকে তা পৌঁছে দিয়েছিলেন মর্মে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল।
3. কুতুব-আকতাব, গওস, নকীব-নুকাবা, নাজীব-নুজাবা, আওতাদ ইত্যাদি বিষয়ক সকল হাদীস বাতিল ও ভিত্তিহীন।
4. মেহেদি বা মেন্দির বিশেষ ফযীলত বা প্রশংসায় বর্ণিত সকল হাদীস ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। শুধুমাত্র মেহেদি দিয়ে খেযাব দেয়ার উৎসাহ জ্ঞাপক হাদীসগুলো নির্ভরযোগ্য।
২৬. আজগুবি সাওয়াব বা শাস্তি
মুহাদ্দিসগণ সনদ বিচার ছাড়াও যে সমস্ত অর্থ ও তথ্যগত বিষয়কে জাল হাদীসের চিহ্ন হিসাবে উল্লেখ করেছেন তার অন্যতম বিষয় অস্বাভাবিক সাওয়াব বা শাস্তির বিবরণ। বিভিন্ন প্রকারের সামান্য নফল ইবাদত বা অত্যন্ত সাধারণ ইবাদত, যিকির, দোয়া, কথা, কর্ম বা চিন্তার জন্য অগণিত আজগুবি সাওয়াবের বর্ণনা। এক্ষেত্রে জালিয়াতগণ কখনো সহীহ হাদীসে প্রমাণিত যিকির, সালাত, দোয়া বা ইবাদতের এরূপ আজগুবি সাওয়াব বলেছে। কখনো বা বানোয়াট যিকির, সালাত, সিয়াম ইবাদত তৈরি করে তার বানোয়াট আজগুবি সাওয়াব বর্ণনা করেছে। এসকল জাল হাদীসের ভাষা নিম্নরূপ:
যে ব্যক্তি একবার অমুক যিকির বলবে, অমুক বা অমুক কাজটি করবে তার জন্য এক লক্ষ নেকী, একলক্ষ পাপ মোচন...। অথবা তার জন্য জান্নাতে একলক্ষ বৃক্ষ রোপন, প্রত্যেক গাছের... গোড়া স্বর্ণের... ডালপালা... পাতা... ইত্যাদি কাল্পনিক বর্ণনা...। অথবা তার জন্য একলক্ষ শহীদের সাওয়াব, সিদ্দীকের সাওয়াব...। অথবা তার জন্য একটি ফিরিশতা/পাখি বানানো হবে, তার এত হাজার বা এত লক্ষ মুখ থাকবে... ইত্যাদি। অথবা অমুক দোয়া পাঠ করলে লোহা গলে যাবে, প্রবাহিত পানি থেমে যাবে.. প্রত্যেক অক্ষরের জন্য এত লক্ষ ফিরিশতা.... ইত্যাদি।
২৭. স্বাভাবিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিপরীত কথা
এ জাতীয় বানোয়াট কথাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. ‘বেগুন সকল রোগের ঔষধ’ বা ‘বেগুন যে নিয়্যাতে খাওয়া হবে সে নিয়্যাত পূরণ হবে’।
২. ‘যদি কেউ কোনো কথা বলে এবং সে সময়ে কেউ হাঁচি দেয় তাহলে তা সে কথার সত্যতা প্রমাণ করে।’
৩. তোমরা ডাল খাবে; কারণ ডাল বরকতময়। ডাল কলব নরম করে এবং চোখের পানি বাড়ায়। ৭০ জন নবী ডালের মর্যাদা বর্ণনা করেছেন।
৫. স্বর্ণকার, কর্মকার ও তাঁতীগণ সবচেয়ে বেশি মিথ্যাবাদী।
২৮. অপ্রয়োজনীয়, অবান্তর বা ফালতু বিষয়ের আলোচনা
যে সকল কথা সাধারণ জ্ঞানী মানুষেরা আলোচনা করতে ইচ্ছুক নয়, সকল জ্ঞানীর সরদার সাইয়িদুল বাশার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে বিষয়ে কথা বলতে পারেন না। এ জাতীয় কথাবার্তার মধ্যে রয়েছে:
1. চাউল যদি মানুষ হতো তাহলে ধৈর্যশীল হতো, কোনো ক্ষুধার্ত তা খেলেই পেট ভরে যেত।
2. আখরোট ঔষধ ও পনির রোগ। দুটি একত্রে পেটে গেলে রোগমুক্তি।
3. তোমরা লবণ খাবে। লবণ ৭০ প্রকার রোগের ঔষধ।
4. তারকাপুঞ্জ আরশের নিচে একটি সাপের ঘাম...।
5. আল্লাহ ক্রোধান্বিত হলে ফার্সী ভাষায় ওহী নাযিল করেন।
6. সুন্দর চেহারার দিকে তাকালে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পায়। সুন্দর চেহারাকে আল্লাহ জাহান্নামে শাস্তি দিবেন না।
7. চোখের নীল রং শুভ।
8. আল্লাহ মাথার টাকের মাধ্যমে কিছু মানুষকে পবিত্র করেছেন, যাদের মধ্যে প্রথম আলী (রা)।
9. নাকের মধ্যে পশম গজানো কুষ্ঠরোগ থেকে নিরাপত্তা দেয়।
10.
কান ঝিঁঝিঁ করা বা কান ডাকা বিষয়ক হাদীসগুলো বানোয়াট।
এ প্রকারের বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন গাছ, সবজি, ঔষধি ইত্যাদির উপকার বর্ণনায় প্রচারিত হাদীস। অনুরূপভাবে মোরগ, সাদা মোরগ ইত্যাদির ফযীলতে বানোয়াট হাদীসও এ পর্যায়ভুক্ত।
২৯. চিকিৎসা, টোটকা বা খাদ্য বিষয়ক অধিকাংশ কথাই বানোয়াট।
এ জাতীয় ফালতু কথাবার্তার মধ্যে রয়েছে:
১. অমুক অমুক কাজে স্মৃতিশক্তি কমে বা লোপ পায়। অমুক কাজে অমুক রোগ হয়। অমুক কাজ করলে অমুক রোগ দূর হয়... ইত্যাদি।
২. অমুক খাদ্যে কোমর মজবুত হয়। অমুক খাদ্যে সন্তান বেশি হয়। মুমিন মিষ্ট এবং সে মিষ্টি পছন্দ করে। ঝুটা মুখে খেজুর খেলে ক্রিমি মরে।
৩০. উজ পালোয়ান, কোহে কাফ ইত্যাদি বিষয়ক কথাবার্তা
এ জাতীয় ভিত্তিহীন বাতিল কথাবার্তার মধ্যে রয়েছে:
1. ঊজ ইবনু উনুক বা ওজ পালোয়ানের কাল্পনিক দৈর্ঘ...‘উজ পালোয়ান’ বিষয়ক সকল কথাই মিথ্যা ও বানোয়াট।
2. কোহে কাফ বা কাফ পাহাড়ের বর্ণনায় প্রচারিত ও বর্ণিত হাদীস সমূহ। এ বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন, জাল ও মিথ্যা।
3. পৃথিবী পাথরের উপর পাথর একটি ষাঁড়ের শিঙ-এর উপর। ..../ একটি মাছের উপরে .../ ষাঁড়টি নড়লে শিং নড়ে আর ভুমিকম্প হয়...। এ জাতীয় সকল কথাই মিথ্যা ও বানোয়াট, যা অসৎসাহসী ও নির্লজ্জ জালিয়াতগণ হাদীসের নামে প্রচার করেছে।
৩১. বিশুদ্ধ হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধী কথাবার্তা
কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা হলো, আখিরাতের মুক্তি নির্ভর করে কর্মের উপর, নাম বা বংশের উপর নয়। অনুরূপভাবে কর্মের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হলো ফরয, যা করা অত্যাবশক ও হারাম যা বর্জন করা অত্যাবশক। এরপর ওয়াজিব, সুন্নাত, মুসতাহাব ইত্যাদি কর্ম রয়েছে। সমাজে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে যা এ ইসলামী শিক্ষার স্পষ্ট বিরোধী। সনদ বিচারে সেগুলো দুর্বল বা জাল বলে প্রমাণিত। তবে সনদ বিচার ছাড়া শুধু অর্থ বিচার করলেও এর জালিয়াতি ধরা পড়ে।
যেমন, অনেক হাদীসে সামান্য মুস্তাহাব কর্মের পুরস্কার বা সাওয়াব হিসাবে বলা হয়েছে, এ কর্ম করলে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না বা তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে... ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মুহাম্মাদ বা আহমাদ নাম হওয়ার কারণে তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হবে। এ প্রকারের সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
No comments