হাদীসের নামে জালিয়াতি - চতুর্দশ অধ্যায় - পূর্ববর্তী সৃষ্টি, নবীগণ ও তাফসীর বিষয়ক জাল হাদীস
পূর্ববর্তী সৃষ্টি, নবীগণ ও তাফসীর বিষয়ক জাল হাদীস
পূর্ববর্তী সৃষ্টি ও পূর্ববর্তী নবীগণ বিষয়ে কুরআন সংক্ষেপ আলোচনা করেছে। শুধু যে বিষয়গুলোতে মানুষের ইহলৌকিক বা পারলৌকিক শিক্ষা রয়েছে সেগুলোই আলোচনা করা হয়েছে। সৃষ্টি ও নবীগণের ঘটনা ইহূদীদের মধ্যে অনেক বিস্তারিতভাবে প্রচলিত। কুরআনে যেহেতু এ সকল বিষয়ে বিশদ বর্ণনা নেই, সে জন্য সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগ থেকেই অনেক মুফাস্সির এ সকল বিষয়ে ইহূদীদের বর্ণনা কৌতুহলের সাথে শুনতেন। পাশাপাশি তাবিয়ী পর্যায়ে অনেক ইহূদী আলিম ইসলাম গ্রহণ করার পরে এ সকল বিষয়ে তাদের সমাজে প্রচলিত অনেক গল্প কাহিনী মুসলিমদের মধ্যে বলেছেন।
এ সকল গল্প-কাহিনী গল্প হিসেবে শুনতে বা বলতে মূলত ইসলামে নিষেধ করা হয় নি। তবে এগুলোকে সত্য মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে। কোনো কোনো মুফাস্সির ও ঐতিহাসিক পূর্ববর্তী নবীগণ বিষয়ক বিভিন্ন আয়াতের তাফসীরে ও তাদের জীবন কেন্দ্রিক ইতিহাস বর্ণনায় ইহূদী-খৃস্টানগণের বিকৃত বাইবেল ও অন্যান্য সত্য-মিথ্যা গল্পকাহিনীর উপর নির্ভর করেছেন। প্রথম যুগগুলোতে মুসলিমগণ গল্প হিসেবেই এগুলো শুনতেন। তবে পরবর্তী যুগে এ সকল কাহিনীকে মানুষেরা সত্য মনে করেছেন। কেউ কেউ এগুলোকে হাদীস বলে প্রচার করেছেন।
কুরআন বলেছে, ইহূদী ও খৃস্টানগণ তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিলকে বিকৃত করেছে। অনেক কথা তারা নিজেরা রচনা করে আল্লাহর কালাম বলে চালিয়েছে। এজন্য হাদীস শরীফে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের কথা বর্ণনা করা যাবে, তবে শর্ত হলো, কুরআনের সত্যায়ন ছাড়া কোনো কিছুকে সত্য বলে গ্রহণ করা যাবে না। সাহাবীগণ ইহূদী-খৃস্টানদের তথ্যের উপর নির্ভর করার নিন্দা করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা) বলেন:
كَيْفَ
تَسْأَلُونَ أَهْلَ الْكِتَابِ عَنْ شَيْءٍ وَكِتَابُكُمْ الَّذِي أُنْزِلَ عَلَى
رَسُولِ اللَّهِ ﷺ أَحْدَثُ تَقْرَءُونَهُ
مَحْضًا لَمْ يُشَبْ وَقَدْ حَدَّثَكُمْ أَنَّ أَهْلَ الْكِتَابِ بَدَّلُوا
كِتَابَ اللَّهِ وَغَيَّرُوهُ وَكَتَبُوا بِأَيْدِيهِمْ الْكِتَابَ وَقَالُوا هُوَ
مِنْ عِنْدِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلا أَلاَ يَنْهَاكُمْ مَا
جَاءَكُمْ مِنْ الْعِلْمِ عَنْ مَسْأَلَتِهِمْ؟
‘‘কিভাবে তোমরা ইহূদী খৃস্টানদেরকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা কর? ‘‘অথচ তোমাদের পুস্তক (অর্থাৎ কুরআন) যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপরে অবতীর্ণ হয়েছে তা নবীনতর, তোমরা তা বিশুদ্ধ অবস্থায় পাঠ করছ, যার মধ্যে কোনোরূপ বিকৃতি প্রবেশ করতে পারে নি। এ কুরআন তোমাদেরকে বলে দিয়েছে যে, পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের অনুসারীগণ (ইহূদী, খৃস্টান ও অন্যান্য জাতি) আল্লাহর পুস্তককে (তাওরাত-ইঞ্জিল ইত্যাদি) পরিবর্তন করেছে এবং বিকৃত করেছে। তারা স্বহস্থে পুস্তক রচনা করে বলেছে যে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত। পার্থিব সামান্য স্বার্থ লাভের জন্য তারা এরূপ করেছে। তোমাদের কাছে যে জ্ঞান আগমন করেছে (কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান) তা কি তোমাদেরকে তাদেরকে কিছু জিজ্ঞাসা করা থেকে নিবৃত করতে পারে না?’’[1]
এতকিছু সত্ত্বেও ক্রমান্বয়ে মুসলিম সমাজে অগণিত ‘ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াত’ প্রবেশ করতে থাকে। পরবর্তী যুগে মুসলিমগণ এগুলোকে কুরআনের বা হাদীসের কথা বলেই বিশ্বাস করতে থাকেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই বইয়ের পরিসরে সম্ভব নয়। এজন্য সংক্ষেপে কিছু বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করছি। আল্লাহর দয়া ও তাওফীক হলে এ বইয়ের পরবর্তী খন্ডগুলোতে এ সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।
[1] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৭৯।
১. বিশ্ব সৃষ্টির তারিখ বা বিশ্বের বয়স বিষয়ক
বিশ্ব সৃষ্টির তারিখ, সময়, বিশ্বের বয়স, আদম (আ) থেকে ঈসা (আ) পর্যন্ত বা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পর্যন্ত সময়ের হিসাব, আর কতদিন বিশ্ব থাকবে তার হিসাব ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা। জালিয়াতগণ এ বিষয়ে অনেক কথা বানিয়েছে।
ইহূদী ও খৃস্টানগণের ‘বাইবেলে’ বিশ্বের বয়স প্রদান করা হয়েছে। মানব সৃষ্টির সময় বলা হয়েছে। বাইবেলের হিসাব অনুসারে বর্তমানে বিশ্বের বয়স ৭০০০ (সাত হাজার) বছর মাত্র। এ সকল কথা ঐতিহাসিভাবে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল ও মিথ্যা বলে প্রমাণিত। এ সকল মিথ্যা ও ভুল তথ্যের উপর নির্ভর করে মুসলিম ঐতিহাসিকগণও অনেক কথা লিখেছেন। আর জালিয়াতগণ এ মর্মে অনেক জাল হাদীসও বানিয়েছে।
২. মানুষের পূর্বে অন্যান্য সৃষ্টির বিবরণ
মানব জাতির পূর্বে অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী এ বিশ্বে ছিল কিনা সে বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট কিছু বলা হয় নি। তবে মানুষের পূর্বে মহান আল্লাহ জিন জাতিকে মানুষের মতই বুদ্ধি, ইচ্ছাশক্তি ও ইবাদতের দায়িত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন বলে কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। জিন জাতির সৃষ্টির বিস্তারিত বিবরণ কুরআন কারীমে নেই। কোনো সহীহ হাদীসেও এ বিষয়ক বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় না।
জিন জাতির সৃষ্টি রহস্য, জিন জাতির আদি পিতা, জিন জাতির কর্মকান্ড, জিন জাতির নবী-পয়গম্বর, তাদের আযাব-গযব, তাদের বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ, নবী-রাসূলের নাম ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই ইহূদী খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার, লোককথা ও অনির্ভরযোগ্য গল্প-কাহিনী।
কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবলিস জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত। আদমকে সাজদা করার নির্দেশ অমান্য করে সে অভিশপ্ত হয়। এ ঘটনার পূর্বে তার জীবনের কোনো ইতিহাস সম্পর্কে কোনো সহীহ বর্ণনা নেই। ইবলিসের জন্ম-বৃত্তান্ত, বংশ ও কর্ম তালিকা, জ্ঞান-গরিমা, ইবাদত-বন্দেগি ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বিভিন্ন মানুষরে কথা, ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াত বা অনির্ভরযোগ্য বিবরণ। ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ জাতীয় পুস্তকগুলো এ সকল মিথ্যা কাহিনীতে পরিপূর্ণ।
৩. ১৮ হাজার মাখলুখাত
একটি বহুল প্রচলিত কথা হলো: ‘‘আঠারো হাজর মাখলুকাত’’, অর্থাৎ এ মহাবিশ্বে সৃষ্ট প্রাণীর জাতি-প্রজাতির সংখ্যা হলো ১৮ হাজার। এ কথাটি একান্তই লোকশ্রুতি ও কোনো কোনো আলিমের মতামত। আল্লাহর অগণিত সৃষ্টির সংখ্যা কত লক্ষ বা কত কোটি সে বিষয়ে কোনো তথ্য কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
৪. নবী-রাসূলগণের সংখ্যা: ১ বা ২ লক্ষ ২৪ হাজার
কুরআন কারীম থেকে জানা যায় যে, মহান আল্লাহ সকল যুগে সকল জাতি ও সমাজেই নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। এরশাদ করা হয়েছে:
وَإِنْ
مِنْ أُمَّةٍ إِلاَّ خَلاَ فِيْهَا نَذِيْرٌ
‘‘প্রত্যেক জাতিতেই সতর্ককারী প্রেরণ করা হয়েছে।’’[1]
এ সকল নবী-রাসূলের মোট সংখ্যা কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। বরং কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে যে, এ সব নবী-রাসূলগণের কারো কথা আল্লাহ তাঁর রাসূলকে (ﷺ) জানিয়েছেন এবং কারো কথা তিনি তাঁকে জানান নি। এরশাদ করা হয়েছে:
وَرُسُلا
قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَرُسُلا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ
অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা ইতোপূর্বে আপনাকে বলেছি এবং অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা আপনাকে বলি নি।’’[2]
আমাদের মধ্যে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ কথা যে নবী-রাসূলগণের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার বা ২ লক্ষ ২৪ হাজার। এখানে লক্ষণীয় যে, নবী-রাসূলগণের সংখ্যার বিষয়ে কোনো একটিও সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। একাধিক যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসে এ বিষয়ে কিছু কথা বর্ণিত হয়েছে। ২ লক্ষ ২৪ হাজারের সুস্পষ্ট বর্ণনা সম্বলিত কোনো সনদ-সহ হাদীস আমি কোথাও দেখতে পাই নি। তবে ১ লক্ষ ২৪ হাজার ও অন্য কিছু সংখ্যা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ:
ক. ১ লক্ষ ২৪ হাজার
একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী-রাসূলগণের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার। কিন্ত সবগুলো সনদই অত্যন্ত দুর্বল। কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ অর্থের হাদীসকে জাল বলে গণ্য করেছেন।
ইবনু হিববান প্রমুখ মুহাদ্দিস তাদের সনদে ইবরাহীম ইবনু হিশাম ইবনু ইয়াহইয়া আল-গাস্সানী (২৩৮ হি) নামক তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবীর সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ ইবরাহীম বলেন, আমাকে আমার পিতা, আমার দাদা থেকে, তিনি আবূ ইদরীস খাওলানী থেকে, তিনি আবূ যার গিফারী থেকে বলেছেন:
قُلْتُ
يَا رَسُوْلَ اللهِ كَمِ الأَنْبِيَاءُ قَالَ مِائَةُ أَلْفٍ وَأَرْبَعَةٌ
وَعِشْرُوْنَ أَلْفاً قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ كَمِ الرُّسُلُ مِنْهُمْ قَالَ
ثَلاَثُ مِائَةٍ وَثَلاَثَةَ عَشَرَ جَمٌّ غَفِيْرٌ
‘‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, নবীগণের সংখ্যা কত? তিনি বলেন, এক লক্ষ চবিবশ হাজার। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, এদের মধ্যে রাসূল কত জন? তিনি বলেন, তিন শত তের জন, অনেক বড় সংখ্যা।’’[3]
হাদীসটির বর্ণনাকারী ইবরাহীম ইবনু হিশামের বিষয়ে মুহাদ্দিসদের কিছুটা মতভেদ রয়েছে। তাবারানী ও ইবনু হিববান তাকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী রাবী বলে চিহ্নিত করেছেন। আবূ যুরআ বলেন: লোকটি কায্যাব বা মহা-মিথ্যাবাদী। আবূ হাতিম রাযী তার কাছে হাদীস গ্রহণ করতে গমন করেন। তিনি তার কাছ থেকে তার পান্ডুলিপি নিয়ে তার মৌখিক বর্ণনার সাথে মিলিয়ে অগণিত বৈপরীত্য ও অসামঞ্জস্য দেখতে পান। ফলে তিনি বলেন: বুঝা যাচ্ছে যে, লোকটি কখনো হাদীস শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয় করে নি। লোকটি মিথ্যাবাদী বলে মনে হয়। যাহাবী তাকে মাতরূক বা পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[4]
যেহেতু হাদীসটি ইবরাহীম ইবনু হিশাম ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করেন নি, সেহেতু ইবনুল জাওযী হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন।[5]
ইমাম আহমাদ এ অর্থে অন্য একটি হাদীস সংকলন করেছেন। এ হাদীসে মু‘আন ইবনু রিফা‘আহ নামক একজন রাবী বলেন, আমাকে আলী ইবনু ইয়াযিদ বলেছেন, কাসিম আবূ আব্দুর রাহমান থেকে, তিনি আবূ উমামা (রা) থেকে... নবীগণের সংখ্যা কত? তিনি বলেন ১ লক্ষ ২৪ হাজার... ।’’[6]
এ হাদীসের রাবী মু‘আন ইবনু রিফা‘আহ আস-সুলামী কিছুটা দুর্বল রাবী ছিলেন।[7] তার উস্তাদ আলী ইবনু ইয়াযিদ আরো বেশি দুর্বল ছিলেন। ইমাম বুখারী তাকে ‘মুনকার’ বা ‘আপত্তিকর’ বলেছেন। ইমাম নাসাঈ, দারাকুতনী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে ‘পরিত্যক্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন।[8] তার উস্তাদ কাসিম আবূ আব্দুর রাহমানও (১১২ হি) দুর্বল ছিলেন। এমনকি ইমাম আহমাদ, ইবনু হিববান প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেছেন যে, কাসিম সাহাবীগণের নামে এমন অনেক কথা বর্ণনা করেন যে,মনে হয় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এ ভুলগুলো বলছেন। তিনি দাবী করতেন যে, তিনি ৪০ জন বদরী সাহাবীকে দেখেছেন, অথচ তাঁর জন্মই হয়েছে প্রথম শতকের মাঝামাঝি।[9]
এ থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এ হাদীসটিও অত্যন্ত দুর্বল। আরো দু একটি অত্যন্ত দুর্বল সনদে এ সংখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে। সামগ্রিক বিচারে এ সংখ্যাটি ‘মাউযূ’ না হলেও দুর্বল বলে গণ্য। আল্লাহই ভাল জানেন।[10]
খ. ৮ হাজার পয়গম্বর
আবূ ইয়ালা মাউসিলী মূসা ইবনু আবীদাহ আর-রাবাযী থেকে, তিনি ইয়াযিদ ইবনু আবান আর-রাকাশী থেকে বর্ণনা করেছেন, আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
بَعَثَ
اللهُ ثَمَانِيَةَ آلاَفِ نَبِيٍّ أَرْبَعَةَ آلاَفٍ إِلَى بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ
وَأَرْبَعَةَ آلاَفٍ إِلَى سَائِرِ النَّاسِ
মহান আল্লাহ ৮ হাজার নবী প্রেরণ করেছেন। ৪ হাজার নবী বনী ইসরাঈলের মধ্যে এবং বাকী চার হাজার অবশিষ্ট মানব জাতির মধ্যে।’’[11]
এ হাদীসটিও দুর্বল। ইমাম ইবনু কাসীর বলেন, এ সনদটিও দুর্বল। আর-রাবাযী দুর্বল। তার উস্তাদ রাকাশী তার চেয়েও দুর্বল।’’ ইবনু কাসীর আলোচনা করেছেন যে, আরো একটি সনদে এ সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে। সনদটি বাহ্যত মোটামুটি গ্রহণযোগ্য।[12]
গ. এক হাজার বা তারও বেশি পয়গম্বর
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إنِّيْ
خَاتِمُ أَلْفِ نَبِيٍّ أَوْ أَكْثَرَ
‘‘আমি এক হাজার বা তারো বেশি নবীর শেষ নবী।’’[13]
ইবনু কাসীর, হাইসামী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, সংখ্যার বর্ণনায় অন্যান্য হাদীসের চেয়ে এ হাদীসটি কিছুটা গ্রহণযোগ্য, যদিও এর সনদেও দুর্বলতা রয়েছে।[14]
[1] সূরা (৩৫) ফাতির: আয়াত ২৪। আরো দেখুন, সূরা (১০) ইউনূস: ৪৭ আয়াত।
[2] সূরা (৫) নিসা: আয়াত ১৬৪। আরো দেখুন: সূরা (৪০) গাফির/মুমিন: আয়াত ৭৮।
[3] ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১/৭৬-৭৯।
[4] ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ওয়াল মাতরূকীন ১/৫৯; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/২০১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/১২২।
[5] ইবনু কাসীর, আত-তাফসীর ১/৫৮৬-৫৮৭।
[6] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৫/২৬৫। শাইখ আর্নাউত বলেন: হাদীসটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল।
[7] ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ৩/১২৬; ইবনু আদী, আল-কামিল ৬/৩২৮; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৪৫৫; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৭/৩৯১।
[8] নাসাঈ, আদ-দু‘আফা, পৃ. ৭৭, ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ২/২০০; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৪০৬।
[9] ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ৩/১৪; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/৪৫৩; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৪৫০।
[10] বিস্তারিত আলোচনা দেখনু, ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৭-৫৮৮; হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ১/১৯৬-১৯৮ (সম্পাদকের টীকা); মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১/৩৯৩; ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহের আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ২৮৮-২৯০।
[11] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৮; তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ১/২৩৬-২৩৭।
[12] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৮।
[13] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/৭৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৫৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৭/৩৪৬।
[14] ইবনু কাসীর, তাফসীর /৫৮৮; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/৩৪৬।
৫. নবী-রাসূলগণের নাম
কুরআনে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে: আদম[1], ইদরীস[2], নূহ[3], হুদ[4], সালিহ[5], ইবরাহীম[6], লূত[7], ইসমাঈল[8], ইসহাক[9], ইয়াকূব[10], ইউসূফ[11], আইয়ূব[12], শুয়াইব[13], মূসা[14], হারূন[15], ইউনূস[16], দাউদ[17], সুলাইমান[18], ইল্ইয়াস[19], ইল্ইয়াসা’[20], যুলকিফল[21], যাকারিয়া[22], ইয়াহইয়া[23], ঈসা[24], মুহাম্মাদ[25] (صلى الله عليهم وسلم)।[26]
কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উযাইরকে ইহূদীগণ আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করত।[27] কিন্তু তাঁর নবুয়ত সম্পর্কে কিছুই বলা হয় নি। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
مَا
أَدْرِيْ أعُزَيْرٌ نَبِيُّ هُوَ أَمْ لاَ
‘‘আমি জানি না যে, উযাইর নবী ছিলেন কি না।’’[28]
মূসার খাদেম হিসাবে ইউশা ইবনু নূন-এর নাম হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত কোনো সহীহ হাদীসে অন্য কোনো নবীর নাম উল্লেখ করা হয় নি। কোনো কোনো অত্যন্ত যয়ীফ বা জাল হাদীসে আদম (&আ) এর পুত্র ‘‘শীস’’-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কালুত, হাযকীল, হাযালা, শামূয়েল, জারজীস, শামঊন, ইরমিয়, দানিয়েল প্রমুখ নবীগণের নাম, জীবণবৃত্তান্ত ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই মূলত ইসরাঈলীয় বর্ণনা ও সেগুলোর ভিত্তিতে মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণের মতামত।
[1] ২৫ বার তাঁর নাম উলেলখ করা হয়েছে। দেখুন: সূরা বাকার ৩১ আয়াত ....
[2] ২ বার। দেখুন: সূরা মারইয়াম ৫৬ আয়াত ...
[3] ৪৩ বার। দেখুন: সূরা আল-ইমরান ৩৩ আয়াত ....
[4] ৮ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১২৪ আয়াত ....
[5] ৯ বার। দেখুন: সূরা আরাফ-৭৩ আয়াত ....
[6] ৬৯ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১২৪ আয়াত ....
[7] ১৭ বার। দেখুন: সূরা হুদ ৭০ আয়াত ....
[8] ১২ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১২৫ আয়াত ...
[9] ১৭ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১৩৩ আয়াত ....
[10] ১৬ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১৩২ আয়াত ....
[11] ২৭ বার। দেখুন: সূরা আনআম ৮৪ আয়াত ....
[12] ৪ বার। দেখুন: সূরা নিসা ১৬৩ আয়াত ....
[13] ১১ বার। দেখুন: সূরা আরাফ ৮৫ আয়াত ....
[14] ১৩৬ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ৫১ আয়াত ....
[15] ২০ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ২৪৮ আয়াত ....
[16] ৪ বার। দেখুন: সূরা নিসা ১৬৩ আয়াত ....
[17] ১৬ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ২৫১ আয়াত ....
[18] ১৭ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১০২ আয়াত ....
[19] ৩ বার। দেখুন: সূরা আনআম ৮৫ আয়াত ....
[20] ২ বার। দেখুন: সূরা আনআম ৮৬ ও সূরা সাদ ৪৮ আয়াত।
[21] ২ বার। দেখুন: সূরা আম্বিয়া ৮৫ ও সূরা সাদ ৪৮ আয়াত।
[22] ৭ বার তাঁর নাম উলেলখিত হয়েছে। দেখুন: সূরা আল-ইমরান ৩৭ আয়াত ....
[23] ৫ বার। দেখুন: সূরা আল-ইমরান ৩৯ আয়াত ....
[24] ২৫ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ৮৭ আয়াত ....
[25] ৪ বার তাঁর নাম উলেলখিত হয়েছে। সূরা আল-ইমরান ১৪৪, সূরা আহযাব ৪০, সূরা মুহাম্মাদ ২ ও সূরা ফাতহ ২৯ আয়াত। আললাহ কুরআনে সকল নবী-রাসূলের ক্ষেত্রে তাঁদের নাম ধরে সম্বোধন করেছেন এবং তাদের ঘটনা বর্ণনার সময় তাঁদের নাম উলেলখ করেছেন। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে কুরআনে ‘‘হে নবী’’ বা ‘‘হে রাসূল’’ বলে তাঁকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে ‘‘নবী’’ ‘‘রাসূল’’ বা ‘‘আবদ’’ বলা হয়েছে। এজন্য কুরআনে শুধুমাত্র ৪টি স্থান ছাড়া কোথাও তাঁর নাম উলেলখিত হয় নি।
[26] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৬; কুরতুবী, তাফসীর, ৩/৩১;
[27] সূরা ৯: তাওবা, আয়াত ৩০।
[28] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/২১৮; আযীম আবাদী, আউনুল মা’বুদ ১২/২৮০।
৬. আসমানী সহীফার সংখ্যা
মহান আল্লাহ কুবআন কারীমে বারংবার বলেছেন যে, তিনি নবী ও রাসূলগণকে গ্রন্থাদি প্রদান করেছেন। কিন্তু এ সকল কিতাব ও সহীফার কোনো সংখ্যা কুরআন কারীমে বা কোনো সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি। ‘১০৪’ কিতাব ও সহীফার কথাটি আমাদের দেশে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীসে কথাটি পাওয়া যায় না। উপরে ১ লক্ষ ২৪ হাজার পয়গম্বর’ বিষয়ক যে হাদীসটি আবূ যার (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, সে হাদীসের মধ্যে এ ১০৪ সহীফা ও কিতাবের কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, এ হাদীসটি জাল অথবা অত্যন্ত দুর্বল।
৭. নবী-রাসূলগণের বয়স বিষয়ক বর্ণনা
কুরআন কারীমে নূহ (আ)-এর বিষয়ে বলা হয়েছে যে, তিনি ৯৫০ বছর জীবিত ছিলেন। এছাড়া অন্য কোনো নবীর আয়ুষ্কাল কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয় নি। আদম (আ) এর আয়ুষ্কাল ১ হাজার বৎসর বলে একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ক আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। নবীগণের আয়ুষ্কাল বিষয়ক যা কিছু আমাদের দেশে প্রচলিত বই পুস্তকে লিখিত রয়েছে সবই ইহূদী খৃস্টানগণের বিকৃত গ্রন্থাবলি থেকে গৃহীত তথ্য।
৮. নবী-রাসূলগণের জীবন-বৃত্তান্ত
নবী-রাসূলগণের জীবনবৃত্তান্ত কুরআন বা হাদীসে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় নি। ইলইয়াস, ইলইয়াসা’ ও যুলকিফল (আ) সম্পর্কে শুধু নাম উল্লেখ ছাড়া কিছুই বলা হয় নি। ইদরীস (আ)-এর বিষয়টিও প্রায় অনুরূপ। অন্যান্য নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে তাঁদের জীবনের শিক্ষণীয় কিছু দিক শুধু আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রচলিত ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ ও বিভিন্ন নবীর জীবনী বিষয়ক পুস্তকাদিতে যা কিছু লিখা হয়েছে তার অধিকাংশই জাল, ভিত্তিহীন ও ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াতের সমষ্টি। এ গ্রন্থের পরিসরে এ সকল দিক বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। এখানে সংক্ষেপে কিছু বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করছি।
৯. আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-এর গন্দম ফল ভক্ষণ
আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত কথা যে, আদম (আ) গন্দম (গম) গাছের ফল খেয়েছিলেন। কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন এবং কুরআন বা হাদীসে কোথাও তা নেই। আদম ও হাওয়া (আ)-কে আল্লাহ একটি বিশেষ বৃক্ষের কাছে গমন করতে নিষেধ করেন। পরবর্তীতে তাঁরা শয়তানের প্ররোচনায় এ বৃক্ষ থেকে ভক্ষণ করেন। কুরআন ও হাদীসে বিভিন্ন স্থানে এ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ বৃক্ষ বা ফলের নাম কোথাও বলা হয় নি। পরবর্তী যুগে ইহূদীদের গল্পকাহিনীর ভিত্তিতে মুফাস্সিরগণ গম, আঙুর, খেজুর... ইত্যাদি বিভিন্ন গাছের নাম বলেছেন। এগুলো সবই অনুমানভিত্তিক কথা। হাদীসে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয় নি। মুমিনের দায়িত্ব হলো, এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, গাছের বা ফলের নাম জানা নয়। সর্বাবস্থায় এ সকল মানবীয় মতামতকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (ﷺ) কথা বলে মনে করা যাবে না।[1]
এ গন্দম ফল নিয়ে আরো অনেক বানোয়াট কথা আমাদের দেশের প্রচলিত কাসাসুল আম্বিয়া ও এ জাতীয় গ্রন্থে পাওয়া যায়। আদমের মনে কূটতর্ক জন্মে, জিবরাঈল তা বের করে পুতে রাখেন, সেখান থেকে গন্দম গাছ হয় .... ইত্যাদি...। সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।
বাইবেলে বলা হয়েছে যে, হাওয়া (আ) আগে ফল খান, এরপর আদম (আ)-কে প্ররোচিত করেন। এজন্য নারীকে জন্মগতভাবে অপরাধী বলে গণ্য করা হয়েছে (তীমথিয় ২/১২-১৪) কুরআন বা হাদীসে এভাবে কোথাও বলা হয় নি। কুরআনে সর্বদা ফলভক্ষণের জন্য আদমকে দায়ী করা হয়েছে।
[1] ইবনু কাসীর, কাসাসুল আম্বিয়া ১/১৯।
১০. আদম ও হাওয়ার (আ) বিবাহ ও মোহরানা
কুরআনের বর্ণনা থেকে বাহ্যত বুঝা যায় যে, আদম (আ)-এর জান্নাতে প্রবেশের পূর্বেই হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয় এবং উভয়কে একত্রে জান্নাতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সাহাবীগণের যুগ থেকে কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন, আদম জান্নাতে অবস্থানের কিছুদিন পরে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়।
কুরআনে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আদম থেকে হওয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে এ সৃষ্টি প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণ কুরআন বা হাদীসে দেয়া হয় নি। মুফাসসিরগণ বিভিন্ন কথা বলেছেন। প্রচলিত আছে যে, আদম ও হাওয়ার মধ্যে বিবাহের মোহরান ছিল দরুদ শরীফ পাঠ... ইত্যাদি। এ সকল কথার কোনো ভিত্তি বা সনদ আছে বলে জানা যায় না।
১১. ইবলিস কর্তৃক ময়ূর ও সাপের সাহায্য গ্রহণ
ইবলিস সাপ ও ময়ূরের সাহায্যে আদম ও হাওয়া (আ)-কে প্ররোচনা প্রদানের চেষ্টা করে বলে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। এগুলো ইহূদী-খৃস্টানদের থেকে গ্রহণ করা হয়েছে বলে গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন।[1]
[1] মুহাম্মাদ আবূ শাহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৭৮-১৮০।
১২. আদম-হাওয়া (আ)-এর পৃথিবীতে অবতরণের পরে
পৃথিবীতে অবতরণের পরে আদম ও হাওয়া (আ) সম্পর্কে কুরআনে কোনো কিছু বলা হয় নি। সহীহ হাদীসেও এ বিষয়ক বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। তাঁরা কোথায় অবতরণ করেছিলেন, কোথায় বসবাস করেছিলেন, কি কর্ম করতেন, কোন্ ভাষায় কথা বলতেন, কিভাবে ইবাদত বন্দেগি করতেন, সংসার ও সমাজ জীবন কিভাবে যাপন করতেন ইত্যাদি বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এ সকল বিষয়ে যা কিছু প্রচলিত প্রায় সবই মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণের মতামত বা বিভিন্ন গল্পকারদের গল্প। দু-একটি দুর্বল সনদের হাদীসও এ সকল বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন।
১৩. আদম কর্তৃক কা’বা ঘর নির্মাণ
আদম (আ) পবিত্র কা’বা ঘর নির্মাণ করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে। মূলত বিভিন্ন ঐতিহাসিক, মুফাস্সির বা আলিমের কথা এগুলো। এ বিষয়ক হাদীসগুলো দুর্বল সনদে বর্ণিত। কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ বিষয়ক সকল বর্ণনাই অত্যন্ত যয়ীফ ও বাতিল বলে গণ্য করেছেন। আল্লামা ইবনু কাসীর বাইতুল্লাহ বিষয়ক আয়াতগুলো উল্লেখ করে বলেন, এ সকল আয়াতে আল্লাহ সুস্পষ্ট জানিয়েছেন যে, একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য বিশ্বের সকল মানুষের জন্য নির্মিত সর্বপ্রথম বরকতময় ঘর ‘বাইতুল্লাহ'কে ইবরাহীম (আ) নির্মাণ করেন। এ স্থানটি সৃষ্টির শুরু থেকেই মহা সম্মানিত ছিল। আল্লাহ সে স্থান ওহীর মাধ্যমে তাঁর খলীলকে দেখিয়ে দেন। তিনি আরো বলেন:
لَمْ
يَجِئْ فِيْ خَبَرٍ صَحِيْحٍ عَنِ الْمَعْصُوْمِ أَنَّ الْبَيْتَ كَانَ مَبْنِيًّا
قَبْلَ الْخَلِيْلِ... كُلُّ هَذِهِ الأَخْبَارُ عَنْ بِنِيْ إِسْرَائِيْلَ وَقَدْ
قَرَّرْنَا أَنَّهَا لاَ تُصَدَّقُ وَلاَ تُكَذَّبُ.
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে একটিও সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি যে, ইবরাহীম (আ)-এর পূর্বে কাবা ঘর নির্মিত হয়েছিল... এ বিষয়ক সকল বর্ণনা ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াত। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, এগুলোকে সত্যও মনে করা যাবে না, মিথ্যাও বলা যাবে না।’’[1]
[1] ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ১/১৬৩। আরো দেখুন, তাফসীর ইবন কাসীর ১/১৭৩-১৭৪, ৩/২১৬: মুহাম্মাদ আবূ শাহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়্যাত, পৃ. ১৬৮-১৬৯।
১৪. নূহ (আ) এর নৌকায় মলত্যাগ করা ও পরিষ্কার করা
এ বিষয়ে অনেক মুখরোচক গল্প প্রচলিত রয়েছে। এগুলোর কোনো ভিত্তি কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে আছে বলে জানতে পারি নি। বাহ্যত এগুলো বানোয়াট গল্প যা গল্পকাররা বানিয়েছে। নূহ (আ) এর নৌকার বিবরণ, কোন্ কাঠে তৈরি, তাতে কোন্ প্রাণী কোথায় ছিল, শয়তান কিভাবে প্রবেশ করল ইত্যাদি বিষয়েও অগণিত বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কাহিনী প্রচলিত। এ সকল বিষয়ে সহীহ হাদীসে কোনো তথ্য দেয়া হয় নি।[1]
[1] মুহাম্মাদ আবূ শাহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়্যাত, পৃ. ২১৬-২১৮।
১৫. ইদরীস (আ)-এর সশরীরে আসমানে গমন
কুরআন কারীমে দু স্থানে ‘ইদরীস’ (আ)-এর উল্লেখ রয়েছে। একস্থানে এরশাদ করা হয়েছে: ‘‘এবং ইসমাঈল, এবং ইদরীস এবং যুল কিফ্ল সকলেই ধৈর্যশীলগণের অন্তর্ভুক্ত।’’[1] অন্যত্র বলা হয়েছে:
وَاذْكُـرْ
فِي الْكِـتَابِ إِدْرِيسَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَبِيًّا وَرَفَعْنَاهُ مَكَانًا
عَلِيًّا
‘‘এবং স্মরণ কর এ কিতাবের মধ্যে ইদরিসের কথা, সে ছিল সত্যনিষ্ঠ, নবী এবং আমি তাকে উন্নীত করেছিলাম উচ্চ স্থানে (মর্যাদায়)।’’[2]
হাদীস শরীফেও ইদরীস (আ) সম্পর্কে তেমন কোনো কিছু উল্লেখ করা হয় নি। তাঁর জন্ম, বংশ, পরিচয়, কর্মস্থল, ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় সবই ইসরাঈলীয় বর্ণনা বা গল্পকারদের বানোয়াট কাহিনী। বিশেষ করে আমাদের সমাজে প্রসিদ্ধ আছে যে, চার জন নবী চিরজীবী: খিযির ও ইলিয়াস (আ) পৃথিবীতে এবং ইদরীস ও ঈসা (আ) আসমানে। প্রচলিত আছে যে, ইদরীস (আ)-কে জীবিত অবস্থায় সশরীরের ৪র্থ বা ৬ষ্ঠ আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সেখানে জীবিত আছেন অথবা সেখানে তাঁর মৃত্যু হয় এবং এরপর আবার জীবিত হন....। এ সবই ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াত। ঈসা (আ) ছাড়া অন্য কোনো নবীর জীবিত থাকা, জীবিত অবস্থায় আসমানে গমন ইত্যাদি কোনো কথা রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি।
আল্লাহ তাঁকে উচ্চ স্থানে উন্নীত করেছেন অর্থ তাঁকে উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন। যে মর্যাদার একটি বিশেষ দিক হলো আল্লাহ ইন্তেকালের পরে তাঁকে অন্য কয়েকজন মহান নবী-রাসূলের সাথে রূহানীভাবে আসমানে স্থান দান করেছেন। সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মি’রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আসমানে ৮ জন নবীর সাথে সাক্ষাত করেন। ১ম আসমানে আদম, ২য় আসমানে ইয়াহইয়া ও ঈসা, ৩য় আসমানে ইউসূফ, ৪র্থ আসমানে ইদরীস, পঞ্চম আসমানে হারূন, ৬ষ্ঠ আসমানে মূসা ও ৭ম আসমানে ইবরাহীম (আ)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়।[3] শুধু ঈসা (আ) ব্যতীত অন্য সকল নবীকে এ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যুর পরে।[4]
[1] সূরা (২১) আম্বিয়া: ৮৫ আয়াত।
[2] সূরা (১৯) মরিয়ম: ৫৬-৫৭ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ১/১৩৬, ৩/১১৭৩, ১২১৬-১২১৭, ১৪১০-১৪১১; মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৪৮-১৫০।
[4] ইবনু কাসীর, কাসাসুল আমবিয়া ১/ ৬১-৬২; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৫।
১৬. হুদ (আ) ও শাদ্দাদের বেহেশত
শাদ্দাদের জন্ম কাহিনী, শাদ্দাদ ও শাদীদের জীবন কাহিনী, শাদ্দাদের বেহেশতের লাগামহীন বিবরণ, বেহেশতে প্রবেশের পূর্বে তার মৃত্যু ইত্যাদি যা কিছু কাহিনী বলা হয় সবই বানোয়াট, ভিত্তিহীন কথা। কিছু ইহূদীদের বর্ণনা ও কিছু জালিয়াগণের কাল্পনিক গল্প কাহিনী। এ বিষয়ক কোনো কিছুই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি। অনেকে আবার এ মিথ্যাকে আল্লাহর নামেও চালিয়েছেন। এক লেখক লিখেছেন: ‘‘সে বেহেশতের কথা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাও কোরআন পাকে উল্লেখ করেছেন যে, হে মুহাম্মাদ!, শাদ্দাদ পৃথিবীতে এমন বেহেশত নির্মাণ করেছিল, দুনিয়ার কোনো মানুষ কোনোদিনই ঐরূপ প্রাসাদ বানাতে পারে নাই...।’’[1]
আল্লাহর কালামের কি জঘন্য বিকৃতি!! এখানে কুরআনের সূরা ফাজ্র-এর ৬-৭ আয়াতের অর্থকে বিকৃত করে উপস্থাপিত করা হয়েছে। মূলত অনেক মুফাস্সির এ আয়াতের তাফসীরে সনদ বিহীনভাবে এ সকল বানোয়াট কাহিনী উদ্ধৃত করেছেন। আবার ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ জাতীয় গ্রন্থে সনদ বিহীনভাবে এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। সবই মিথ্যা কথা।
এ বিষয়ে ইবনু কাসীর বলেন: ‘‘অনেক মুফাস্সির এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইরাম শহর সম্পর্কে এ সকল কথা বলেছেন। এদের কথায় পাঠক ধোঁকাগ্রস্থ হবেন না। ... এ সকল কথা সবই ইহূদীদের কুসংস্কার ও তাদের কোনো কোনো যিনদীকের বানোয়াট কল্প কাহিনী। এগুলো দিয়ে তারা মুর্খ সাধারণ জনগণের বুদ্ধি যাচাই করে, যারা যা শোনে তাই বিশ্বাস করে।...’’[2]
[1] মাও. মো. আশরাফুজ্জামান, ছহী কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ২৩৫; এম এন. এম ইমদাদুল্লাহ, আদি ও আসল কাছাছুল আম্বিয়া ১/৯৮।
[2] ইবনু কাসীর, তাফসীর ৪/৫০৯; আবূ শাহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়্যাত, পৃ. ২৮২-২৮৬।
১৭. ইবরাহীম (আ)-এর পিতা
আল্লাহ কুরআনকে তাওরাত, যাবূর ও ইনজীলের বিশুদ্ধতা বিচারের মানদন্ড বলে ঘোষণা করেছেন, কিন্তু কোনো কোনো তাফসীরকারক বা আলিম বাইবেলের বর্ণনাকে বিশুদ্ধতার মাপকাঠি হিসাবে গণ্য করে তার ভিত্তিতে কুরআনের বর্ণনাকে ব্যাখ্যা করেন। এর একটি উদাহরণ হলো ইবরাহীম (আ) এর পিতার নাম। মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِذْ
قَالَ إِبْرَاهِيْمُ لأَبِيْهِ آزَرَ
‘‘এবং যখন ইবরাহীম তাঁর পিতা আযরকে বললেন’’[1]
এখানে সুস্পষ্টভাবে ইবরাহীমের পিতার নাম ‘আযর’ বলা হয়েছে। কিন্তু বাইবেলে বলা হয়েছে যে ইবরাহীমের পিতার নাম ছিল ‘তেরহ’[2]। কুরআন কারীমে সাধারণত নবুয়ত, দাওয়াত ও মু’জিযা বিষয়ক তথ্য ছাড়া নবীগণের পিতা, মাতা, জন্মস্থান, জীবনকাল ইত্যাদি বিষয়ে অতিরিক্ত তথ্য আলোচনা করা হয় না। কখনো কখনো ইহূদীদের মিথ্যাচারের প্রতিবাদের জন্য কিছু তথ্য প্রদান করা হয়। যেমন ইহূদীরা তাদের বাইবেল বিকৃত করে লিখেছে যে, আল্লাহ ৬ দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং ৭ম দিনে বিশ্রাম করেন। এ কুসংস্কার ও মিথ্যা অপসারণ করতে আল্লাহ বলেন: ৬ দিনে বিশ্ব সৃষ্টি করতে কোনোরূপ ক্লান্তি বা কষ্ট তাঁকে স্পর্শ করে নি (সূরা কাফ: ৩০ আয়াত)। এখানে ইবরাহীমের পিতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ সম্ভবত ইবরাহীমের পিতার নামের ক্ষেত্রে ইহূদীদের ভুলটি তুলে ধরা।
সর্বাবস্থায় মুমিনের জন্য কুরআন-হাদীসের বর্ণনার পরে আর কোনো বর্ণনার প্রয়োজন হয় না। এ জন্য অধিকাংশ প্রাজ্ঞ মুফাস্সির বলেছেন যে, ইবরাহীম (আ) -এর পিতার নাম ‘আযর’ ছিল। কুরআনের এ তথ্যই চূড়ান্ত। ইহূদী-খৃস্টানদের তথ্যের দিকে দৃষ্টি দেয়ার কোনো প্রয়োজন মুসলিম উম্মাহর নেই। বাইবেলের বর্ণনায় প্রভাবিত হয়ে কোনো কোনো মুফাস্সির সমন্বয় করতে চেয়েছেন। কেউ বলেছেন, আযর ও তেরহ দু’টিই ইবরাহীম (আ) -এর পিতার নাম ছিল। যেমন ইয়াকূব (আ)-এর আরেকটি নাম ইসরাঈল। কেউ বলেছেন, একটি ছিল তার উপাধি ও একটি ছিল তার নাম। অনুরূপ আরো কিছু মতামত আছে। এ সকল ব্যাখ্যায় কুরআনের বর্ণনাকে বিকৃত করা হয় নি। সকলেই একমত যে, এখানে ‘তাহার পিতা’ বলতে ইবরাহীমের জন্মদাতা পিতাকে বুঝানো হয়েছে এবং ‘আযর’ তারই নাম অথবা উপাধি...।[3]
তবে সবচেয়ে জঘন্য ও মিথ্যা একটি মত প্রচলিত যে, বাইবেলের বর্ণনাই ঠিক, ইবরাহীমের পিতার নাম ছিল তেরহ। তার নাম আযর ছিল না। তারা কুরআনের বর্ণনাকে সরাসরি মিথ্যা না বলে এর একটি উদ্ভট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, ইবরাহীমের এক চাচার নাম ছিল আযর। কুরআনে চাচাকেই ‘পিতা’ বলা হয়েছে। এভাবে তারা বাইবেলের বর্ণনাকে বিশুদ্ধতার মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করে কুরআনের আয়াতের সুস্পষ্ট অর্থকে বিকৃত করেছেন।
‘পিতা’ অর্থ ‘চাচা’ বলা মূলত কুরআনের অর্থের বিকৃতি। ‘পিতৃগণ’ বা ‘বাপদাদাগণ’ বলতে পিতা, দাদা, চাচাকে বুঝানো সকল সমাজেই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু ইবরাহীম (আ) আযরকে বারবার ‘হে পিতা’ বলে ডেকেছেন (সূরা মরিয়ম ৪২-৪৫)। আর জন্মদাতা পিতা ছাড়া কাউকে পিতা বলে ডাকার প্রচলন আরবী ভাষায় ছিল না এবং এখনো নেই। জন্মদাতা পিতা ছাড়া কাউকে নিজের পিতা বলা বা নিজেকে তার সন্তান বলে দাবি করা হাদীসে কঠোর ভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সর্বোপরি কুরআনের স্পষ্ট অর্থ অন্যান্য আয়াত বা হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছাড়া রূপক ভাবে ব্যাখ্যা করা বিকৃতির নামান্তর। সহীহ বুখারীতে সংকলিত হাদীস থেকেও আমরা জানতে পারি যে, আযরই ইবরাহীমের জন্মদাতা পিতা এবং এ আযরকেই ইবরাহীম কিয়ামতের দিন ভৎর্সনা করবেন এবং একটি জন্তুর আকৃতিতে তাকে জাহান্নামে ফেলা হবে।[4]
এ অপব্যাখ্যা সমর্থন করার জন্য কেউ কেউ দাবি করেন যে, ইবরাহীমের জন্মদাতা পিতা কাফির ছিলেন না; কারণ আদম (আ) থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ পর্যন্ত তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কাফির-মুশরিক ছিলেন না। এ কথাটি ভিত্তিহীন এবং কুরআন, সহীহ হাদীস ও ঐতিহাসিক তথ্যাদির সুস্পষ্ট বিপরীত। কুরআন এবং অনেক সহীহ হাদীসে বারংবার ইবরাহীমের পিতাকে কাফির বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব কুফরী ধর্মের উপর ছিলেন বলে বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর চাচা আবূ তালিবকে মৃত্যুর সময়ে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম গ্রহণে অস্বীকার করে বলেন আমি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্মের উপরেই থাকব।[5] স্বভাবতই আমর ইবনু লুহাই-এর যুগ থেকে আব্দুল মুত্তালিবের যুগ পর্যন্ত পূর্বপুরুষগণও শিরকের মধ্যে লিপ্ত ছিলেন, যদিও তাঁরা সততা, নৈতিকতা, জনসেবা ইত্যাদির জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।[6] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পূর্বপুরুষগণ সকলেই অনৈতিকতা, ব্যভিচার ও অশ্লীলতা মুক্ত ছিলেন।[7]
[1] সূরা (৬) আন‘আম: আয়াত ৭৪।
[2] বাইবেল, আদিপুস্তক ১১/২৪-৩২।
[3] তাবারী, তাফসীর ৭/২৪২-২৪৯; কুরতুবী, তাফসীর ৭/২২; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/১৫০-১৫১।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২২৩; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/৫০০।
[5] বুখারী, আস-সহীহ ১/৪৫৭, ৩/১৪০৯, ৪/১৭১৭, ১৭৮৮; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫৪, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৭/১৯৫। বিস্তারিত জানতে গ্রন্থকার রচিত ‘‘ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর আল-ফিকহুল আকবার: বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা’’ গ্রন্থটি পাঠ করুন।
[6] ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নববিয়্যাহ ১/৯৩-৯৪।
[7] তাবারী, আত-তাফসীর ১১/৭৬; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৪০৪।
১৮. ইবরাহীম (আ) এর তাওয়াক্কুল
ইবরাহীম (আ)-এর নামে প্রচলিত একটি বানোয়াট গল্প নিম্নরূপ: তাঁকে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তখন জিবরাঈল (আ.) এসে তাঁকে বলেন: আপনার কোনো প্রয়োজন থাকলে আমাকে বলুন। তিনি বলেন: আপনার কাছে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। জিবরাঈল (আ.) বলেন: তাহলে আপনি আপনার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করুন। তখন তিনি বলেন:
حَسْبِيْ
مِنْ سُؤَالِيْ عِلْمُهُ بِحَالِيْ
‘‘তিনি আমার অবস্থা জানেন, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট, অতএব আমার আর কোনো প্রার্থনার প্রয়োজন নেই।’’
এ কাহিনীটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। ইহুদিদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী, সনদহীনভাবে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। মুহাদ্দিসগণ একে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। কুরআন কারীমে ইবরাহীম (আ)-এর অনেক দোয়া উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি কখনো কোনো প্রয়োজনে দোয়া করেন নি এরূপ কোনো ঘটনা কুরআন বা হাদীসে বর্ণিত হয় নি।[1]
‘তাওয়াক্কুলের’ নামে দোয়া পরিত্যাগ করা কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার বিপরীত। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সকল বিষয় আল্লাহর কাছে চাইতে হাদীস শরীফে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সকল বিষয় বিস্তারিত জানার জন্য পাঠককে ‘রাহে বেলায়াত’ বইটি পাঠ করতে অনুরোধ করছি।
[1] ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২৫০, আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/১৩৬, আলবানী, যায়ীফাহ (সিলসিলাতুল আহাদীসিয যায়ীফাহ) ১/৭৪-৭৬, নং ২১।
১৯. ইসমাঈলের (আ) গলায় ছুরি চালানো
কুরআন কারীমে সূরা ‘সাফ্ফাত’-এ মহান আল্লাহ ইবরাহীম (আ) কর্তৃক পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যত হওয়ার বিষয় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন: ‘‘(ইবরাহীম বলল) হে আমার প্রতিপালক, আমাকে এক সৎকর্ম-পরায়ণ সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাকে এক স্থির-বুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করবার মত বয়সে উপনীত হল তখন ইবরাহীম বলল, বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবাই করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল? সে বলল, হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করল, তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, হে ইবরাহীম, তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্ম পরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করে থাকি।’’[1]
এখানে বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক মিথ্যা ও কুরআন-হাদীসের বর্ণনার বিপরীত কথা হাদীস ও তাফসীর হিসাবে প্রচলিত। কয়েকটি বিষয়ের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
(ক) কুরআন কারীমে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবরাহীম তার পুত্রকে জবাই করতে স্বপ্নে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম স্বপ্নে দেখেন যে, ‘তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্তকে কুরবানী কর।’ এ কথাটি ভিত্তিহীন; কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে এরূপ কথা বর্ণিত হয় নি।
(খ) কুরআনে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবরাহীম তাঁর পুত্রকে জানান যে, তিনি তাঁকে জবাই করার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম তাঁর স্ত্রীকে ও পুত্রকে দাওয়াত খাওয়া... ইত্যাদি মিথ্যা কথা বলে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যান। ... সর্বশেষ তিনি পুত্রকে সত্য কথাটি জানান। এ সকল কথা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয় নি। এ ছাড়া এই কথাগুলো নবীগণের মর্যাদার খেলাফ। আল্লাহর খলীল তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে কেন মিথ্যা কথা বলবেন?
(গ) প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম পুত্র ইসমাঈলকে দড়ি দিয়ে ভাল করে বাঁধেন। এরপর শুইয়ে তাঁর গলায় বারংবার ছুরি চালান....। এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা। কুরআনে তো সুস্পষ্টই বলা হচ্ছে যে, জবাই করার প্রস্ত্ততি নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান এসে যায়। কোনো ছুরি চালানোর ঘটনা ঘটে নি। হাদীস শরীফেও বর্ণিত হয়েছে যে, জবাইয়ের প্রস্ত্ততি নেওয়ার সময়েই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিকল্প জানোয়ার প্রদান করা হয়।[2]
এ বিষয়ে ত্রয়োদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ সিরিয় মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত (১২৭৬ হি) বলেন, ইবরাহীম (আ)-এর বিষয়ে যে গল্প প্রচলিত আছে যে, তিনি তাঁর পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন, কিন্তু কাটে নি... এ গল্পটি জাল, মিথ্যা এবং যিন্দীকদের বানানো...।[3]
[1] সূরা (৩৭) সাফ্ফাত: ১০০-১০৫ আয়াত।
[2] ইবনু কাসীর, তাফসীর ৪/১৬।
[3] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৮৩-২৮৪।
২০. আইঊব (আ)-এর বালা-মুসিবৎ
কুরআনে বলা হয়েছে যে, আইঊব (আ) বিপদগ্রস্থ হয়ে সবর করেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং তাকে বিপদাপদ থেকে উদ্ধার করেন। তাঁকে তাঁর সম্পদ ও সন্তান ফিরিয়ে দেন।[1]
আইঊব (আ)-এর বালা-মুসিবত বা বিপদাপদের প্রকৃতি, ধরন, বিবরণ, সময়কাল, তাঁর স্ত্রীর নাম, আত্মীয় স্বজনের নাম ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো বর্ণনা কুরআন কারীম বা সহীহ হাদীসে নেই। এ বিষয়ক যা কিছু বলা হয় সবই মূলত ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াত। অধিকাংশ বিবরণের মধ্যে লাগামহীন কাল্পনিক বর্ণনা রয়েছে। বিভিন্ন মুফাস্সির এ বিষয়ে বিভিন্ন কথা বলেছেন। বিশেষত, ওয়াহ্ব ইবনু মুনাবিবহ, কা’ব আল-আহবার প্রমুখ তাবিয়ী আলিম, যারা ইহূদী ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইহূদীদের ধর্মগ্রন্থ ও তাদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন তাঁরাই এ সকল গল্প ‘গল্প’ হিসেবে বলেছেন।[2]
এগুলোকে গল্প হিসাবে বলা যেতে পারে, কিন্তু কখনোই সত্য মনে করা যাবে না। বিশেষত এ সকল গল্পে আইয়ূব (আ)-এর রোগব্যাধির এমন কাল্পনিক বিবরণ রয়েছে যা একজন নবীর মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোনো সহীহ হাদীসে বর্ণিত হলে আমরা তা গ্রহণ করতাম ও ব্যাখ্যা করতাম। কিন্তু যেহেতু কোনো সহীহ হাদীসে এ বিষয়ে কিছুই বর্ণিত হয় নি এবং এগুলো ইসরাঈলীয় বর্ণনা ও গল্পকারদের গল্প, সেহেতু এগুলো পরিত্যাজ্য। এ বিষয়ে দরবেশ হূত (১২৭৬ হি) বলেন, ‘‘আইয়ূব (আ)-এর গল্পে বলা হয় যে, আল্লাহ তাঁর উপরে ইবলিসকে ক্ষমতাবান করে দেন। তখন ইবলিস তাঁর দেহের মধ্যে ফুঁক দেয়। এতে তাঁর দেহ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়। এমনকি তার শরীরের গোশত পচে যায় ও পোকা পড়তে থাকে ... ইত্যাদি। এগুলো গল্পকাররা বলেন এবং কোনো কোনো মুফাস্সির উল্লেখ করেছেন। ... এ সকল কথা সবই নির্ভেজাল জাল, মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। যে-ই একথা বলুন বা উদ্ধৃত করুন না কেন, তাঁর মর্যাদা যত বেশিই হোক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। এ সকল কথা আল্লাহর কিতাবে বলা হয় নি এবং তাঁর রাসূলের (ﷺ) কোনো হাদীসেও তা বর্ণিত হয় নি। এমনকি কোনো যয়ীফ বা বাতিল সনদের হাদীসেও তা বর্ণিত হয় নি। এ সবই সনদ বিহীন বর্ননা..।’’[3]
[1] সূরা (২১) আম্বিয়া: ৮৩-৮৪ আয়াত; সূরা (৩৮) সাদ: ৪১-৪৪ আয়াত।
[2] ইবনু কাসীর, কাসাসুল আম্বিয়া ১/২৩০-২৩৬; আবূ শুহবাহ, আল-ইসরাইলিয়্যাত, পৃ. ২৭৫-২৮২।
[3] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৮৪।
২১. দায়ূদ (আ) এর প্রেম
নবী দায়ূদ (আ) এর সম্পর্কে একটি অত্যন্ত নোংরা গল্প বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ ও পরবর্তী যুগের দুই একটি হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায়। গল্পটি মূলত ইহূদীদের বাইবেল থেকে ও তাবিয়ীগণের যুগে বিদ্যমান ইহূদী আলিমদের মুখ থেকে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো গ্রন্থে এ ঘটনাটিকে রাসূলুল্লাহর ﷺ নামেও প্রচার করা হয়েছে।
ইহূদী-খৃস্টানগণ তাওরাত-যাবুর-ইঞ্জিলের মধ্যে অনেক জাল অশ্লীল গল্প-কাহিনী সংযোজন করেছেন। সেগুলোর মধ্যে একটি দায়ূদ (আ)-এর নামে প্রেম, ব্যভিচার ও হত্যার কাহিনী। এ গল্পটি মুসলিম সমাজে কিছুটা সংশোধিতরূপে প্রচারিত। গল্পটির সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ: একদিন দায়ূদ (আ) হঠাৎ করে একজন গোসলরত মহিলাকে এক নজর দেখে ফেলেন। এতে তিনি মহিলাটির উপর অত্যন্ত আসক্ত হয়ে পড়েন। মহিলাটির স্বামীর নাম ছিল উরিয়া। তিনি একজন যোদ্ধা ছিলেন। দায়ূদ প্রধান সেনাপতির সাথে ষড়যন্ত্র করেন উরিয়াকে যুদ্ধের মাঠে হত্যা করার জন্য। এক পর্যায়ে উরিয়া যুদ্ধে নিহত হলে দায়ূদ ঐ মহিলাকে বিবাহ করেন।[1] বাইবেলে এ ঘটনাটি আরো অনেক নোংরাভাবে লেখা হয়েছে।[2]
এ ঘটনাটি শুধু মিথ্যা এবং নবীদের প্রকৃতির বিরোধীই নয়; উপরন্তু তা মানবীয় বুদ্ধিরও বিপরীত। একজন বিবেকবান বয়স্ক মানুষ, যার কয়েক ডজন স্ত্রী বিদ্যমান এবং যিনি একজন জনপ্রিয় শাসক- তিনি একটিবার মাত্র দৃষ্টি পড়ার ফলে এমন ভাবে প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়বেন এবং এরূপ হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেবেন তা কল্পনা করা যায় না।[3]
[1] ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৬/৩৪২-৩৪৪, তাবারী, আত-তাফসীর ২৩/১৪; আল-কুরতুবী, তাফসীর ১৫/১৬৬-১৮৫।
[2] বাইবেল, ২ শমূয়েল (2 Samuel), ১১ : ১-২৭।
[3] মুহাম্মাদ আবূ শাহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়্যাত, পৃ. ২৬৪-২৭০।
২২. হারুত মারুত
ইহূদীগণের মধ্যে যাদুর প্রচলন ছিল। তারা আরো দাবি করত যে, সুলাইমান (আ) যাদু ব্যবহার করেই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তারা আরো দাবি করত যে, স্বয়ং সুলাইমান (আ) এবং হারূত ও মারূত নামক দুই ফিরিশতা তাদেরকে যাদু শিক্ষা দিয়েছেন। এদের এ মিথ্যাচারের প্রতিবাদে কুরআন কারীমে সূরা বাকারার ১০২ আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে:
وَاتَّبَعُوا
مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ
وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنزِلَ
عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ
أَحَدٍ حَتَّى يَقُولا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلا تَكْفُرْ
‘‘এবং সুলাইমানের রাজত্বে শয়তানগণ যা আবৃত্তি করত তারা (ইহূদীরা) তা অনুসরণ করত। সুলামইমান কুফুরী করেন নি কিন্তু শয়তানরাই কুফুরী করেছিল। তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত। এবং যা বাবিলে হারূত ও মারূত ফিরিশতাদ্বয়ের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। তারা কাউকে শিক্ষা দিত না, এ কথা না বলা পর্যন্ত যে, ‘আমরা পরীক্ষা স্বরূপ, সুতরাং তোমরা কুফুরী করিও না।...’’
এ আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যায় সাহাবী ও তাবিয়ীগণের যুগ থেকেই মুফাসসিরগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা) ও অন্য কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন যে, হারূত ও মারূতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত আরবী (ما) অর্থ (না)। অর্থাৎ হারূত মারূত ফিরিশতাদ্বয়ের উপরেও যাদু অবতীর্ণ করা হয় নি। সুলাইমানের (আ) সম্পর্কে ইহূদীদের দাবি যেমন মিথ্যা, হারূত ও মারূত সম্পর্কেও তাদের দাবি মিথ্যা।
তবে অধিকাংশ মুফাস্সির বলেছেন যে, ইহূদীগণ যখন কারামত-মুজিযা ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য না করে সবকিছুকেই যাদু বলে দাবি করতে থাকে তখন আল্লাহ দু’জন ফিরিশতাকে দায়িত্ব প্রদান করেন যাদুর প্রকৃতি এবং যাদু ও মুজিযার মধ্যে পার্থক্য শিক্ষা দানের জন্য। তারা মানুষদেরকে এ পার্থক্য শিক্ষা দিতেন এবং বলতেন, তোমরা এই জ্ঞানকে যাদুর জন্য ব্যবহার করে কুফুরী করবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকেই যাদু ব্যবহারের কুফুরীতে নিমগ্ন হতো। কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন, তাঁরা দুইজন মানুষ ছিলেন; বিশেষ জ্ঞান, পান্ডিত্য বা সৎকর্মশীলতার কারণে তাদেরকে মানুষ ফিরিশতা বলে অভিহিত করতো। তাঁরা এভাবে মানুষদেরকে যাদুর অপকারিতা শিক্ষা দিতেন।
হারূত ও মারূত সম্পর্কে কুরআনে আর কোনো কিছুই বলা হয় নি। সহীহ হাদীসেও এ বিষয়ে কিছু পাওয়া যায় না। কিন্তু এ বিষয়ক অনেক গল্প-কাহিনী হাদীস নামে বা তাফসীর নামে তাফসীরের গ্রন্থগুলোতে বা সমাজে প্রচলিত। কাহিনীটির সার-সংক্ষেপ হলো, মানব জাতির পাপের কারণে ফিরিশতাগণ আল্লাহকে বলেন, মানুষের এত অপরাধ আপনি ক্ষমা করেন কেন বা শাস্তি প্রদান করেন না কেন? আল্লাহ তাদেরকে বলেন, তোমরাও মানুষের মত প্রকৃতি পেলে এরূপ পাপ করতে। তারা বলেন, কক্ষনো না। তখন তারা পরীক্ষার জন্য হারূত ও মারূত নামক দু’জন ফিরিশতাকে নির্বাচন করেন। তাদেরকে মানবীয় প্রকৃতি প্রদান করে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। তারা যোহরা নামক এক পরমা সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়ে মদপান, ব্যভিচার ও নরহত্যার পাপে জড়িত হন। পক্ষান্তরে যোহরা তাদের কাছ থেকে মন্ত্র শিখে আকাশে উড়ে যায়। তখন তাকে একটি তারকায় রূপান্তরিত করা হয়। ...
এ গল্পগুলো মূলত ইহূদীদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী। তবে কোনো কোনো তাফসীর গ্রন্থে এগুলি হাদীস হিসাবেও বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ক সকল হাদীসই অত্যন্ত দুর্বল বা জাল সনদে বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বিভিন্ন সনদের কারণে কয়েকটি বর্ণনাকে গ্রহণযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। অনেক মুহাদ্দিস সবগুলোই জাল বলে মত প্রকাশ করেছেন।
আল্লামা কুরতুবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস ও মুফাস্সির উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল গল্প ফিরিশতাগণ সম্পর্কে ইসলামী বিশ্বাসের বিপরীত। ইহূদী, খৃস্টান ও অন্যান্য অনেক ধর্মে ফিরিশতাগণকে মানবীয় প্রকৃতির বলে কল্পনা করা হয়। তাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্ত শক্তি আছে বলেও বিশ্বাস করা হয়। ইসলামী বিশ্বাসে ফিরিশতাগণ মানবীয় প্রবৃত্তি, নিজস্ব চিন্তা বা আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদের প্রবৃত্তি থেকে পবিত্র। তাঁরা মহান আল্লাহকে কিছু জানার জন্য প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা আল্লাহর কোনো কর্ম বা কথাকে চ্যালেঞ্জ করবেন এরূপ কোনো প্রকারের প্রকৃতি তাদের মধ্যে নেই। কাজেই এ সকল কাহিনী ইসলামী আকীদার বিরোধী।
এ বিষয়ে আল্লামা ইবনু কাসীর ও অন্যান্য কতিপয় মুহাদ্দিস সকল বর্ণনা একত্রিত করে তুলনামূলক নিরীক্ষার ভিত্তিতে বলেছেন যে, এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো প্রকার হাদীস সহীহ বা নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। তাঁর নামে বর্ণিত এ বিষয়ক হাদীসগুলো জাল। তবে সাহাবীগণ থেকে তাঁদের নিজস্ব কথা হিসাবে এ বিষয়ে কিছু কিছু বর্ণনার সনদ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। একথা খুবই প্রসিদ্ধ যে এ সকল বিষয়ে কোনো কোনো সাহাবী (রা) ইহূদীদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন কাহিনী শুনতেন ও বলতেন। সম্ভবত এ সকল বর্ণনার ভিত্তিতেই তারা এগুলি বলেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।[1]
[1] তাবারী, ১/৪৫১-৪৬৪; কুরতুবী, ২/৪১-৫৩; ইবনু কাসীর, ১/১৩৫-১৪৪; সুয়ূতী ও মুহাল্লী; তাফসীরুল জালালাইন, পৃ. ২২; ইবনু আবী হাতিম, আল ইলাল ২/৬৯-৭০; আল-আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৪৩৯-৪৪০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২০৯-২১০; মুহাম্মাদ আবূ শাহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়্যাত, পৃ. ১৫৯-১৬৬।
No comments