হাদীসের নামে জালিয়াতি - ত্রয়োদশ অধ্যায় - মহান স্রষ্টা বিষয়ক জাল হাদীস [স্রষ্টা, সৃষ্টি ও পূর্ববর্তী নবীগণ]

. আল্লাহকে কোনো আকৃতিতে দেখা

চক্ষু আল্লাহকে দেখতে পারে না বলে কুরআনে বলা হয়েছে:

لاَ تُدْرِكُهُ الأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الأَبْصَارَ

‘‘তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত।’’[1]

অন্যত্র আল্লাহ বলেন: ‘‘কোনো মানুষের জন্যই সম্ভব নয় যে, আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে বা পর্দার আড়াল থেকে ছাড়া তার সাথে কথা বলবেন।’’[2]

মূসা () মহান আল্লাহকে দেখতে চেয়েও দেখতে অক্ষম হন। আল্লাহ বলেন: ‘‘মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলো এবং তার প্রতিপালক তার সাথে কথা বললেন, তখন সে বলল, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে দর্শন দাও, আমি তোমাকে দেখব। তিনি বলেন: তুমি কখনই আমাকে দেখতে পাবে না। তুমি বরং পাহাড়ের প্রতি লক্ষ্য কর, তা স্বস্থানে স্থির থাকলে তুমি আমাকে দেখবে। যখন তার প্রতিপালক পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন তখন তা পাহাড়কে চুর্ণ-বিচুর্ণ করল এবং মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল...[3]

সকল সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে মুসলিম উম্মাহ একমত যে, পৃথিবীতে কেউ আল্লাহকে দেখতে পারে না। রাসূলুল্লাহথেকে একটি সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয় নি, যাতে তিনি বলেছেন: ‘‘আমি জাগ্রত অবস্থায় পৃথিবীতে বা মিরাজে চর্ম চক্ষে বা অন্তরের চক্ষে আল্লাহকে দেখেছি।’’ স্বপ্নের ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই। তবে রাসূলুল্লাহজাগ্রত অবস্থায় অন্তরের দৃষ্টিতে আল্লাহকে দেখেছেন কিনা সে বিষয়ে সাহাবীগণ মতভেদ করেছেন। আয়েশা (রা) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি বলে যে, মুহাম্মাদতাঁর প্রতিপালককে দেখেছেন, সে ব্যক্তি আল্লাহর নামে জঘন্য মিথ্যা কথা বলে।’’[4] ইবনু মাসঊদ (রা) অন্যান্য সাহাবীও মত পোষণ করেছেন। পক্ষান্তরে ইবনু আববাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, মিরাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে আল্লাহকে দেখেছিলেন। আল্লাহ যেমন মূসাকে () ‘কথা বলারমুজিযা প্রদান করেন, তেমনি তিনি মুহাম্মাদ ﷺ-কে অন্তরের দৃষ্টিতে দর্শনের মুজিযা দান করেন।[5]

যারারাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দর্শন দাবি করেছেন, তাঁরা একমত যে, দর্শন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য একটি বিশেষ মুজিযা, যা আর কারো জন্য নয় এবং দর্শন হৃদয়ের অনুভব, যেখানে কোনো আকৃতির উল্লেখ নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আল্লাহকে কোনোআকৃতি'তে দেখেছেন, অথবা তিনি ছাড়া কোনো সাহাবী আল্লাহকে দেখেছেন বলে যা কিছু বর্ণিত সবই জাল মিথ্যা

মিরাজের রত্রিতে বা আরাফার দিনে, বা মিনার দিনে বা অন্য কোনো সময়ে বা অবস্থায় রাসূলুল্লাহআল্লাহকে বিশেষ কোনো আকৃতিতে দেখেছেন অর্থে সকল হাদীস জাল। যেমন, তাকে যুবক দেখেছেন, তাজ পরিহিত দেখেছেন, উট বা খচ্চরের পিঠে দেখেছেন... ইত্যাদি সবই জাল মিথ্যা।[6]

এজাতীয় ভিত্তিহীন একটি বাক্য:

رَأَيْتُ رَبِّيْ فِيْ صُوْرَةِ شَابٍ أَمْرَدَ

‘‘আমি আমার প্রভুকে একজন দাড়ি-গোঁফ ওঠে নি এমন যুবক রূপে দেখেছি।’’ মুহাদ্দিসগণ বাক্যটিকে জাল বলে ঘোষণা করেছেন।[7]

অনুরূপভাবে উমরের (রা) নামে জালিয়াতগণ বানিয়েছে: ‘‘আমার প্রভুর নূর দ্বারা আমার অন্তর আমার প্রভুকে দেখেছে।’’ আলীর (রা) নামে জালিয়াতগণ বানিয়েছে: ‘‘যে প্রভুকে আমি দেখি না সে প্রভুর ইবাদত করি না।’’[8]

[1] সূরা () আনআম: ১০৩ আয়াত
[2]
সূরা (৪২) শূরা: ৫১ আয়াত
[3]
সূরা () রাফ: ১৪৩ আয়াত
[4]
বুখারী, আস-সহীহ /১১৮১, /১৮৪০, /২৬৮৭; মুসলিম, আস-সহীহ /১৫৯
[5]
ইবনু খুযাইমা, কিতাবুত তাওহীদ /৪৭৭-৫৬৩
[6]
ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ /১৩৭-১৩৯
[7]
ইবনুল জাওযী, আল-মাওযূআত /৮০-৮১, সুয়ূতী, আল- লাআলী /২৮-৩১, মোল্লা আলী কারী, আল আসরার, ১২৬ পৃ, আল-মাসনূয়, ৭১-৭৪পৃ
[8]
সিররুল আসরার, পৃ. ৫৭-৫৮

 . , ৭০ বা ৭০ হাজার পর্দা

সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহর নূরের পর্দা রয়েছে[1] তবে পর্দার সংখ্যা, প্রকৃতি ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না। কিছু হাদীসে আল্লাহর পর্দার সংখ্যার কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন ওয়াযে ‘‘৭০ হাজার নূরের পর্দা’’ ‘‘৭০ টি পর্দা’’, ‘‘৭টি পর্দা’’ ইত্যাদির কথা বলা হয়। মুহাদ্দিসগণ বিস্তারিত নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, অর্থের হাদীসগুলো কিছু সন্দেহাতীতভাবে মিথ্যা বানোয়াট কথা আর কিছু যয়ীফ, দুর্বল অনির্ভরযোগ্য কথা[2]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /১৬১
[2]
তাবারী, আত-তাফসীর ১৬/৯৫; কুরতুবী, আত-তাফসীর ১৫/২৯৫; ইবনু কাসীর, আত-তাফসীর /২৫০, /৩১৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৩৭, ১৪২; আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আসফাহানী, আল-আযামাহ /৬৬৭-৭২৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /৭৯-৮০; আবূ ইয়ালা, আল-মুসনাদ ১৩/৫২০; যাহাবী, মীযানুল তিদাল /২২৯; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত /৭৩-৭৪, সুয়ূতী, আল-লাআলী /১৪-১৯

 . আরশের নিচের বিশাল মোরগ বিষয়ে

 

আমাদের সমাজে ওয়াযে আলোচনায় অনেক সময় আরশের নিচের বিশাল মোরগ, এর আকৃতি, এর ডাক ইত্যাদি সম্পর্কে বলা হয়। সংক্রান্ত হাদীসগুলো ভিত্তিহীন বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল[1]

[1] সুয়ূতী, লাআলী /৬০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৫৫, ১৮৯

 . যে নিজেকে চিনল সে আল্লাহকে চিনল

আমাদের সমাজে ধার্মিক মানুষদের মাঝে অতি প্রচলিত একটি বাক্য:

مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ

‘‘যে নিজেকে জানল সে তার প্রভুকে (আল্লাহকে) জানল।’’ অথবা ‘‘যে নিজেকে চিনল সে তার প্রভুকে চিনল’’ অনেক আলিম তাদের বইয়ে বাক্যটিকে রাসূলুল্লাহ -এর কথা বা হাদীস বলে সনদবিহীন ভাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে বলছেন যে, বাক্যটি রাসূলুল্লাহ -এর কথা নয়, কোনো সনদেই তাঁর থেকে বর্ণিত হয়নি। কোনো কোনো মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, বাক্যটি ৩য় হিজরী শতকের একজন সূফী ওয়ায়েয ইয়াহইয়া ইবন মুয়ায আল-রাযী (২৫৮ হি:)- নিজের বাক্য। তিনি ওয়াজ নসিহতের সময় কথাটি বলতেন, তার নিজের কথা হিসাবে, হাদীস হিসাবে নয়। পরবর্তীতে অসতর্কতা বশত কোনো কোনো আলিম বাক্যটিকে হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন[1]

[1] সাখাবী, আল-মাকাসেদ, পৃ. ৪১৬; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ. ১৮৬ পৃ; মোল্লা আলী কারী, আল- আসরার, ২৩৮ পৃ; আল- মাসনুয়, ১৫৫ পৃ

 . মুমিনের কালব আল্লাহর আরশ

সমাজের বহুল প্রচলিত একটি বাক্য: ‘‘মুমিনের হৃদয় আল্লাহর আরশ’’: ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’!! বিষয়ে বিভিন্ন বাক্য প্রচলিত, যেমন:

الْـقَـلْـبُ بَـيْـتُ الـرَّبِّ : হৃদয় প্রভুর বাড়ি

قَلْـبُ الْمُـؤْمِنِ عَـرْشُ اللهِ : মুমিনের হৃদয় আল্লাহর আরশ

مَا وَسِعَنِيْ أَرْضِيْ وَلاَ سَمَائِيْ وَلَكِنْ وَسِعَنِيْ قَلْبُ عَبْدِيْ الْمُؤْمِن

আমার যমিন এবং আমার আসমান আমাকে ধারণ করতে পারে নি, কিন্তু আমার মুমিন বান্দার কলব বা হৃদয় আমাকে ধারণ করেছে

এগুলো সবই বানোয়াট হাদীস। কোনো কোনো আলিম বাক্যগুলি তাঁদের গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। মুহাদ্দিসগণ অনেক গবেষণা করেও এগুলোর কোন সনদ পান নি, বা কোন হাদীসের গ্রন্থে এগুলোর উল্লেখ পান নি। এগুলি সনদবিহীন জাল কথা[1]

[1] মোল্লা আলী কারী, আল আসরার, ১৭০ ২০৬ পৃ; আল-মাসনূয়, ১০০ ১৩০ পৃ; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ ১৪৬ ১৭১ পৃ; আহমাদ ইবন তাইমিয়া, আহাদীসুল কুসসাস, ৫৩-৫৫ পৃ; সাখাবী, আল-মাকাসিদ আল-হাসানা, ৩১৫ ৩৭৪ পৃ; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৪৮

 . আমি গুপ্তভান্ডার ছিলাম

প্রচলিত একটি বানোয়াট কথা যা হাদীস নামে পরিচিত:

كُنْتُ كَنْزًا لاً يُعْرَفُ فَأَحْبَبْتُ أَنْ أُعْرَفَ فَخَلَقْتُ الْخَلْقَ لأُعْرَفَ

‘‘আমি অজ্ঞাত গুপ্তভান্ডার ছিলাম। আমি পরিচিত হতে পছন্দ করলাম। তখন আমি সৃষ্টিজগত সৃষ্টি করলাম; যেন আমি পরিচিত হই।’’

ইতোপূর্বে বলেছি যে, প্রচলিত জাল হাদীসগুলো দু প্রকারের। এক প্রকারের জাল হাদীসের সনদ আছে এবং কোনো গ্রন্থে সনদসহ তা সংকলিত। সনদ নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসিগণ সেগুলোর জালিয়াতি ধরতে পেরেছেন। দ্বিতীয় প্রকারের জাল হাদীস যেগুলো কোনো গ্রন্থেই সনদসহ সংকলিত হয় নি। অথচ লোকমুখে প্রচলিত হয়ে গিয়েছে এবং লোকমুখের প্রচলনের ভিত্তিতে কোনো কোনো আলিম তার গ্রন্থে সনদ ছাড়া তা উল্লেখ করেছেন। প্রকারের সম্পূর্ণ অস্তিত্ববিহীন সনদবিহীন বানোয়াট একটি কথা বাক্যটি[1]

[1] ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুস্সাস, পৃ. ৫৫; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৪৮, মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ ১৭৯

 . কিয়ামতে আল্লাহ মানুষদেরকে মায়ের নামে ডাকবেন

আরেকটি বানোয়াট মিথ্যা কথা হলো: কিয়ামতের দিন আল্লাহ মানুষদেরকে মায়ের নামে ডাকবেন। বাক্যটি একদিকে বানোয়াট বাতিল কথা, অপরদিকে সহীহ হাদীসের বিপরীত। ইমাম বুখারী অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলিত বিভিন্ন সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন মানুষদের পরিচয় পিতার নামের সাথে প্রদান করা হবে। বলা হবে, অমুক, পিতা অমুক বা অমুক ব্যক্তির পুত্র অমুক[1]

[1] ইবনুআদী, আল কামিল /৫৫৮-৫৫৯; ইবনু হিববান, আল-মাজরুহীন /১৩৭-১৩৮; ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত /৪২০; যাহাবী, তারতীবুল মাউযূআত, পৃ: ৩১০; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানারুল মুনীফ, পৃ: ১৩৯; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ১৩৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী /৪৪৯; আন-নুকাতুল বাদীআত, পৃ: ২৬০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ /৩৮১, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ৭৬; আলবানী, যায়ীফাহ /৬২১-৬২৩

 . জান্নাতের অধিবাসীদের দাড়ি থাকবে না

জান্নাতের অধিবাসীগণের কোন দাড়ি থাকবে না। সবাই দাড়িহীন যুবক হবেন। শুধুমাত্র আদমের () দাড়ি থাকবে। কেউ বলেছে: শুধুমাত্র মূসার (), বা হারুনের () দাড়ি থাকবে বা ইবরাহীম () আবু বাকরের (রা) দাড়ি থাকবে। গুলো সবই বানোয়াট বাতিল কথা[1]

[1] যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল /৩৯৩; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ: ৭৫; আল-মাসনূ, পৃ: ৩৮-৩৯; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ৭৪

 . আল্লাহ জান্নাত-জাহান্নাম নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা

 

اَلتَّفَكُّرُ فِيْ عَظَمَةِ اللهِ وَجَنَّتِهِ وَنَارِهِ سَاعَةً خَيْرٌ مِنْ قِيَامِ لَيْلَةٍ

‘‘আল্লাহর মহত্ত্ব, জান্নাত জাহান্নাম নিয়ে এক মুহূর্ত চিন্তা বা ফিকির করা সারা রাত তাহাজ্জুদ আদায়ের চেয়ে উত্তম।’’ এটি জাল হাদীস[1]

[1] ইবনু আর্রাক, তানযীহ /১৪৮

No comments

Powered by Blogger.