কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম অধ্যায়-০৩ -প্রচলিত ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’-এর আলোকে প্রচলিত ‘ঈসায়ীধর্ম’
৩. ১. সাধু পলের উদ্ভাবিত ধর্মকে ‘ঈসায়ীধর্ম’ বলা
পাঠক, আপনি হয়ত জানেন না! বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠিত অসত্য সাধু পল-এর বানানো ধর্মকে “ঈসায়ী” ধর্ম বা “খৃস্টধর্ম” নামকরণ। প্রচলিত খৃস্টধর্মের সাথে প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিলের’ মধ্যে বিদ্যমান ঈসা মাসীহের কথা ও কর্মের সাথে কোনো মিল নেই। সাধু পলের উদ্ভাবিত ঈসায়ী ধর্মের মূল ভিত্তি (১) ত্রিত্ববাদ, (২) যীশুর ঈশ্বরত্ব, (৩) আদমের পাপে সকল মানুষের জাহান্নামী হওয়া, (৪) তাওবা সত্ত্বেও মানুষদের ক্ষমা করায় আল্লাহর অক্ষমতা, (৫) মানুষদের মুক্তির জন্য আল্লাহর নিজ পুত্রকে কুরবানী করতে বাধ্য হওয়া, (৬) যীশুর ক্রুশে মরে অভিশপ্ত হওয়া, (৭) যীশুর নরকভোগ করা, (৮) শরীয়তের বিধিবিধান বাতিল হওয়া।... প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যেও এ সকল বিষয়ে ঈসা মাসীহের কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই বরং বিপরীত বক্তব্য রয়েছে।
৩. ২. সাধু পল ও তাঁর পয়গম্বর হওয়ার কাহিনী
সাধু পলের (Paul) মূল নাম সৌল (Saul)। তিনি বর্তমান তুরস্কের তারসূস (Tarsus) বা সাইলেশিয়ায় (Cilicia) জন্মগ্রহণ করেন (প্রেরিত ২১/৩৯, ২২/৩)। তিনি জাতিতে রোমান (প্রেরিত: ২২/২৮, ১৬/৩৭-৩৮, ২৩/২৭), মাতৃভাষা গ্রীক (প্রেরিত: ৯/২৯) এবং ধর্মে ইয়াহূদী ছিলেন। (রোমীয় ১১/১-২; করিন্থীয় ১১/২২; ফিলিপীয় ৩/৫)। ধর্মে ইয়াহূদী হলেও ইয়াহূদী ধর্ম ও ধর্মশাস্ত্রের সাথে তাঁর পরিচয় ছিল সামান্যই (রোমীয় ৭/৯; গালাতীয় ১৫/১); তবে তিনি গ্রীক-রোমান ধর্ম ও দর্শনে ব্যাপক অভিজ্ঞ ছিলেন (এনকার্টা: পল)। সাধু পল যীশুর সমসাময়িক ছিলেন, তবে যীশুর জীবদ্দশায় তিনি তাঁকে কখনো দেখেন নি (১ করিন্থীয় ৯/১, ১৫/৮)।
যীশুর তিরোধানের পর তিনি তাঁর অনুসারীদের হত্যা ও নির্যাতন করতেন (প্রেরিত: ৭/৫৮, ৮/৩, ৯/১-২; (২২/৪-৫ ও ২৬/৯-১১); গালাতীয়: ১/১৩)। এরপর তিনি যীশুর অনুসারী হওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি দাবি করেন যীশু তাকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন এবং তাকে শিষ্যত্ব প্রদান করেন। এরূপ হঠাৎ ধর্মান্তরের দাবি ছিল যে, সাধু পল দ্রুত ফিলিস্তিনে এসে হাওয়ারিদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং তাঁদের নিকট থেকে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল শরীফ শ্রবণ ও অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু তিনি তা না করে তাদের থেকে দূরে থাকেন (গালাতীয় ১/১৬-১৭)। তিনি ইঞ্জিল শরীফ সম্পর্কে কিছুই শিক্ষা না করেই শুধু একবার একটু আলো দেখা ও কথা শোনাকেই তার পয়গম্বরীর জন্য যথেষ্ট বলে গণ্য করেন। তিনি ধর্ম, শরীয়ত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে হাওয়ারিদের সাথে কোনোরূপ পরামর্শ না করে নিজেকে তাদের চেয়েও বড় ও সরাসরি ঈসা মাসীহের সাক্ষাৎপ্রাপ্ত শিষ্য বলে দাবি করতে থাকেন। হাওয়ারীদের কারো মতেরই কোনো দাম নেই বলে ঘোষণা করতে থাকেন (গালাতীয় ১/১১-১২, ১৫, ২/৬, ১-করিন্থীয় ৩/১০, ৪/১৫, ৯/১, ১১/৫-৬)।
ঈসা মাসীহ জীবদ্দশায় ইঞ্জিল প্রচার করেছেন (মথি ৪/২৩, ৯/৩৫, ১১/১৫; মার্ক ১/১৪, ১৫, ৮/৩৫; মার্ক ১০/২৯; লূক ৯/৬...)। সাধু পল কখনোই তাঁর বা শিষ্যদের থেকে ইঞ্জিল শুনেন নি বা শিক্ষা করেন নি। অথচ তিনি নিজেই ইঞ্জিলের রচয়িতা বলে প্রচার করতেন এবং বলতেন: (my gospel) “আমার ইঞ্জিল” (রোমীয় ২/১৬, ১৬/২৫; ২ তিমথীয় ২/৮)। তিনি বারংবার ঘোষণা দেন যে, তাঁর নিজের ইঞ্জিল ছাড়া অন্য কোনো ইঞ্জিল, অর্থাৎ ঈসা মাসীহের মূল ইঞ্জিল যদি কেউ প্রচার করে তবে সে অভিশপ্ত (গালাতীয় ১/৬, ৮-৯; ২-করিন্থীয় ১১/৪)।
সর্বাবস্থায় তাঁর যীশুর শিষ্য হওয়ার কাহিনীটি “প্রেরিত” নামক পুস্তকে ৯, ২২ ও ২৬ অধ্যায়ে তিন স্থানে তিনভাবে দেওয়া হয়েছে। ৯/৩-৭-এর বক্তব্য: “তখন হঠাৎ আকাশ হইতে আলোক তাঁহার চারিদিকে চমকিয়া উঠিল। তাহাতে তিনি ভূমিতে পড়িয়া শুনিলেন, তাঁহার প্রতি এই বাণী হইতেছে: শৌল, শৌল, কেন আমাকে তাড়না করিতেছ? ... কিন্তু উঠ, নগরে প্রবেশ কর, তোমাকে কি করিতে হইবে, তাহা বলা যাইবে। আর তাহার সহপথিকেরা অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহারা ঐ বাণী শুনিল বটে, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইল না (hearing a voice, but
seeing no man)।
পক্ষান্তরে ২২/৬-১০-এর ভাষ্য: “হঠাৎ আকাশ হইতে মহা আলো আমার চারিদিকে চমকিয়া উঠিল। তাহাতে আমি ভূমিতে পড়িয়া গেলাম ও শুনিলাম, এক বাণী আমাকে বলিতেছে, শৌল, শৌল, কেন আমাকে তাড়না করিতেছ?... আর যাহারা আমার সঙ্গে ছিল, তাহারা সেই আলো দেখিতে পাইল বটে, কিন্তু যিনি আমার সহিত কথা কহিতেছিলেন, তাঁহার বাণী শুনিতে পাইল না (And they that were with me saw indeed the light, and were afraid; but they heard not the voice of him that spake to me) প্রভু আমাকে কহিলেন, উঠিয়া দামেশকে যাও, তোমাকে যাহা যাহা করিতে হইবে বলিয়া নিরূপিত আছে, সে সমস্ত সেখানেই তোমাকে বলা যাইবে।”
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বর্ণনায় কি কোনো সাধারণ সুস্থ মানুষ এত স্ববিরোধী কথা বলতে পারে? প্রথম বর্ণনায় সহ-পথিকরা কথা শুনলো কিন্তু আলো দেখল না; আর দ্বিতীয় বর্ণনায় ঠিক তার উল্টো কথা: তারা আলো দেখল কিন্তু কথা শুনলো না!!! এ কি সাধু পলের স্ববিরোধী কথা? না ‘পাক রুহের’ অজ্ঞতার ফল?!
আরেকটি বিষয় দেখুন! উপরের দুস্থানে বলা হয়েছে যে, পলের কী করণীয় সে বিষয়ে যীশু তাকে কোনো নির্দেশ দিলেন না; শুধু বললেন, দামেশকে যাও, সেখানেই সব বলা হবে। অথচ ২৬ অধ্যায়ের ১৬-১৮ শ্লোকে বলা হয়েছে যে, সাধু পলের দায়িত্ব ও করণীয় বিস্তারিত সেখানেই তাকে জানানো হয়েছিল?
এ সকল স্ববিরোধী বক্তব্যের মধ্যে কোনটি সত্য? নাকি সবই মিথ্যা? আমরা জানি না। তবে আমরা দেখেছি যে, সাধু পল স্বস্বীকৃত মিথ্যাবাদী। তিনি জোর গলায় বলেছেন যে, ঈশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মিথ্যা বললে অসুবিধা নেই। তিনি যে বহুরূপী তা তিনি অন্যত্রও স্বীকার করেছেন (দেখুন: ১ করিন্থীয় ১৯-২১)।
তার এ সকল কথা সবই হয়ত মিথ্যা। ঈসা মাসীহের শিক্ষা বিনষ্ট করাকেই তিনি ঈশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধি বলে বিশ্বাস করতেন। এজন্যই তিনি তাঁর অনুসারীদের হত্যা ও নির্যাতন করতেন (প্রেরিত ২৬/৯-১১)। তিনি দেখলেন যে, হত্যা ও নির্যাতন করে যীশুর শিক্ষার বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না; কাজেই শিষ্য সেজে তা বিনষ্ট করতে হবে।
লক্ষণীয় যে, সাধু পল দাবি করেন যে, যীশু তাঁকে বলেছিলেন: “তোমার নিজের লোকদের (ইহুদীদের) এবং অ-ইয়াহূদীদের হাত থেকে আমি তোমাকে রক্ষা করব।” (প্রেরিত ২৬/১৭)। কিন্তু বাস্তবে এ ওয়াদা কার্যকর হয় নি। সাধু পলকে যীশু রক্ষা করেন নি; বরং তিনি নিহত হয়েছেন। ৬২ খৃস্টাব্দের দিকে রোমান সরকার তাকে বন্দী করে এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। (Microsoft® Encarta® 2008: Paul) এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, তিনি মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড নবী ছিলেন। কারণ, আমরা দেখব যে, ভণ্ড নবীর পরিণতি হত্যা বা অপমৃত্যু বলে কিতাবুল মোকাদ্দসে বলা হয়েছে।
বাহ্যত সাধু পল ও তাঁর অনুসারীদের সম্পর্কেই ঈসা মাসীহ বলেন: “ভণ্ড নবীদের বিষয়ে সাবধান হও। তারা তোমাদের কাছে ভেড়ার চেহারায় আসে, অথচ ভিতরে তারা রাক্ষুসে নেকড়ে বাঘের মত। তাদের জীবনে যে ফল দেখা যায় তা দিয়েই তোমরা তাদের চিনতে পারবে। ... যারা আমাকে ‘প্রভু প্রভু’ বলে তারা প্রত্যেকে যে বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে তা নয়। কিন্তু আমার বেহেশতী পিতার ইচ্ছা যে পালন করে সে-ই ঢুকতে পারবে। সেই দিন অনেকে আমাকে বলবে, ‘প্রভু প্রভু, তোমার নামে কি আমরা নবী হিসাবে কথা বলি নি? তোমার নামে কি ভূত ছাড়াই নি? তোমার নামে কি অনেক অলৌকিক কাজ করি নি? তখন আমি সোজাসুজিই তাদের বলব ‘আমি তোমাদের চিনি না। দুষ্টের দল! আমার কাছ থেকে তোমরা দূর হও।’ (মথি ৭/১৫-২৩)। তিনি আরো বলেন: “অনেক ভণ্ড মসীহ্ ও ভণ্ড নবী আসবে এবং ‘বড় বড় আশ্চর্য ও চিন্থ-কাজ করবে যাতে সম্ভব হলে আল্লাহ্র বাছাই করা বান্দাদেরও তাঁরা ঠকাতে পারে।” (মথি ২৪/২৪) যীশুকে প্রভু প্রভু বলেছেন, তাঁর নামে অলৌকিক কাজ ও চিন্থ-কাজ করেছেন এবং ‘আল্লাহর বাছাইকরা বান্দাদের’ অর্থাৎ যীশুর সাহাবী-শিষ্যদেরকেও ভুলাতে পেরেছেন এমন ব্যক্তি সাধু পল ছাড়া আর কাউকে আমরা দেখি না।
কেউ যদি ইঞ্জিলের ‘প্রেরিত’ পুস্তকটি ও পরবর্তী পত্রগুলি ভালোভাবে অধ্যয়ন করেন তবে ড. মরিস বুকাইলির নিম্নের বক্তব্যের সাথে অবশ্যই একমত হবেন:
Paul is the most controversial figure of Christianity, He was
considered to be a traitor to Jesus’ thought by the latter’s family and by
apostles who had stayed in Jerusalem in the circle around James. Paul created
Christianity at the expense of those whom Jesus had gathered around him to
spread his teachings”.
“পল খৃস্টধর্মের সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ঈসা মাসীহের পরিবার এবং শিষ্যগণ যেরুজালেমে (ঈসা মাসীহের ভাই) জেমসের (যাকোবের) চারিপাশে জমায়েত ছিলেন এবং তারা পলকে মাসীহের চিন্তা-চেতনার বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করতেন। ঈসা মাসীহ তাঁর শিক্ষা প্রচারের জন্য যাদেরকে জমায়েত করেছিলেন সাধু পল তাদের বিপরীতে একটি খৃস্টধর্ম তৈরি করেন।” (Dr. Maurice Bucaile, The Bible, the Qur'an and the Science, page 52)
No comments