কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম অধ্যায়-০২ -‘কিতাবুল মোকাদ্দস’বনাম ‘তওরাত-যাবূর-ইঞ্জিল’ কিতাব
২. ১. বাইবেলের ‘নতুন নিয়ম’-কে ‘ইঞ্জিল’ নামকরণ
বাংলাদেশে খৃস্টান প্রচারকগণ “ইঞ্জিল শরীফ” নামের একটি পুস্তক প্রচার করেন। ইঞ্জিল শব্দটির ইংরেজি ইভানজেল (evangel)। শব্দটি প্রাচীন গ্রীক (euaggelion/euaggelos) থেকে গৃহীত। এর অর্থ সুসংবাদ। ইংরেজিতে একে গসপেল (gospel)-ও বলা হয়। খৃস্টান বাইবেলের দ্বিতীয় অংশ “নতুন নিয়ম” (the New Testament)-এর মধ্যে মোট ২৭টি পুস্তক বিদ্যমান। এগুলির মধ্যে মাত্র ৪টি পুস্তককে খৃস্টানগণ “ইঞ্জিল” বলে দাবি করেছেন। এছাড়া বাকি ২৩টি পুস্তককে বিগত ২ হাজার বৎসরে কোনো একজন খৃস্টানও ‘ইঞ্জিল’ বলে দাবি করেন নি। মুসলিমদের সরল বিশ্বাসকে পুজি করে তাদেরকে ধর্মান্তর করার জন্য খৃস্টান প্রচারকগণ ২৭ গ্রন্থের এ পুস্তককে “ইঞ্জিল শরীফ” বলে চালাচ্ছেন। জেনে শুনেই তাঁরা এ মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(১) ইংরেজী ভাষায় এ গ্রন্থটির নাম (the New Testament)। আরবী ভাষায় এটির নাম (العهد الجديد), যার অর্থ নতুন নিয়ম বা নতুন সন্ধি। বিশ্বের কোনো ভাষাতেই খৃস্টানগণ এটির নাম ‘ইঞ্জিল’ বলে দাবি করেন নি। শুধু সরল মুসলিমদের প্রতারণা করার জন্য বর্তমানে কোনো কোনো মুসলিম দেশে এ বইটিকে “ইঞ্জিল” বলে চালাচ্ছেন তাঁরা। আগ্রহী পাঠক একটু কষ্ট করে যে কোনো ইংরেজি অভিধানে বা ইন্টারনেটে evangel লিখে সার্চ করলেই বিষয়টি জানতে পারবেন।
(২) ২৭টি বইয়ের মধ্যে মাত্র চারটি বইকে খৃস্টানগণ ইঞ্জিল বলে দাবি করেছেন। মূল গ্রীক বা ইংরেজি বাইবেলে এগুলির নাম নিম্নরূপ:
(১) The Holy Gospel of
Jesus Christ According to St. Matthew/ The Gospel
According To St. Matthew: সাধু মথির মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল
(২) The Holy Gospel of
Jesus Christ According to St. Mark/ The Gospel According To St. Mark: সাধু মার্কের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল
(১) The Holy Gospel of
Jesus Christ According to St. Luke/ The Gospel According
To St. Luke: সাধু লূকের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল
(১) The Holy Gospel of
Jesus Christ According to St. John/ The Gospel According To St. John: সাধু যোহনের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল
পাঠক, নাম থেকেই সহজেই বুঝতে পারছেন যে, এ চারটি পুস্তকও মূলত ইঞ্জিল নয়, বিভিন্ন মানুষের মতে এগুলি ইঞ্জিল বলে কথিত। ঈসা (আ) একটি ইঞ্জিল প্রচার করেছিলেন বলে সকলেই জানত। তবে কারো কাছেই এর কোনো কপি ছিল না। তাঁর তিরোধানের কয়েকশত বৎসর পরে অনেক মানুষ ‘ইঞ্জিল’ লিখে প্রচার করেন যে, এটি ঈসা (আ) এর ইঞ্জিল। এজন্য এগুলির এরূপ নামকরণ করা হয়: ‘অমুকের মতানুসারে এটি ইঞ্জিল’, সঠিক ইঞ্জিল কোনটি তা কেউ জানেন না।
২. ২. “মতানুসারে ইঞ্জিল”-কে “ঈসা নবীর প্রকৃত ইঞ্জিল” বলা
আমরা দেখলাম যে, “ইঞ্জিল শরীফ” নামের পুস্তকটি কখনোই ইঞ্জিল নয়। ২৭টির মধ্যে মাত্র চারটি পুস্তক “মতানুসারে ইঞ্জিল” বলে দাবি করেছেন খৃস্টানগণ।
এ সকল ‘মতানুসারে ইঞ্জিলের’ সাথে ‘ঈসা মাসীহের ইঞ্জিলের’ মুল পার্থক্য ঈসা (আ)-এর উপর নাযিলকৃত মূল ইঞ্জিলটি ছিল আল্লাহর কালাম। আর প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’ চারটির মধ্যে আল্লাহর কোনো কালাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এগুলির মধ্যে ঈসা মাসীহের বক্তব্যও কম। এগুলি মূলত তাঁর জীবনীগ্রন্থ। এগুলির মধ্যে ঈসা মাসীহ বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের গালগল্প সংকলন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এরূপ প্রায় অর্ধশত “মতানুসারে ইঞ্জিল” তৃতীয় শতকের খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এগুলির মধ্য থেকে সাধু পলের অনুসারী ত্রিত্ববাদী খৃস্টানগণ কোনোরূপ সুস্পষ্ট সনদ, ভিত্তি বা যুক্তি ছাড়া, শুধু নিজেদের পছন্দের উপর নির্ভর করে এ চারটিকে বাছাই করেন।
খৃস্টান পণ্ডিতদের লেখা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার biblical literature-এর বক্তব্য: As far as the New
Testament is concerned, there could be no Bible without a church that created
it; yet conversely, having been nurtured by the content of the writings
themselves, the church selected the canon. ... Indeed,
until c. AD 150, Christians could produce writings either anonymously or
pseudonymously—i.e., using the name of some acknowledged important biblical or
apostolic figure. The practice was not believed to be either a trick or fraud.
...
“নতুন নিয়মের বিষয়টি হলো যদি চার্চ (ধর্মগুরুদের মণ্ডলী) বাইবেল তৈরি না করত তাহলে কোনো বাইবেলই থাকতো না। অপরদিকে লিখনিগুলির বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে চার্চই বাইবেলের বইগুলি বাছাই করেছে। ... প্রকৃত বিষয় হলো, ১৫০ খৃস্টাব্দের দিকে যে কোনো খৃস্টান নাম প্রকাশ না করে, অথবা কোনো প্রসিদ্ধ বাইবেলীয় ব্যক্তিত্ব বা যীশুর শিষ্যদের নামে বই লিখতে পারত। এরূপ কর্মকে ছলচাতুরি বা প্রতারণা বলে গণ্য করা হতো না! ...”
কি ভয়ঙ্কর কথা! ১০০/১৫০ বৎসর পরে যে কোনো খৃস্টান সম্পূর্ণ মিথ্যাভাবে একটি বই লিখে প্রচার করছে, এটি লূক লিখিত ইঞ্জিল, এটি পিতর লিখিত ইঞ্জিল... এভাবে যীশুর শিষ্যদের বা সাধুদের নামে যে যা পারছে লিখে প্রচার করছে। এরূপ কর্মকে উক্ত ধার্মিক লেখক বা সমাজের অন্য কোনো ধার্মিক খৃস্টান কেউই অন্যায় বা পাপ বলে গণ্য করছেন না! এগুলি সমাজে এভাবে ইঞ্জিল নামে প্রসিদ্ধ হওয়ার আরো ১৫০ বৎসর পর এরূপ ধার্মিক খৃস্টানগণ “যীশুর শিষ্যদের নামে ১৫০ বৎসর পরে অজ্ঞাত ধার্মিক মানুষদের লেখা” অর্ধশত ইঞ্জিল থেকে শুধু বিষয়বস্তুর দিকে তাকিয়ে, বিষয়বস্তুগুলি নিজেদের পছন্দমত কিনা তা দেখে, ৪টি ইঞ্জিল বেছে নিয়ে “নতুন নিয়ম”-এর অন্তর্ভুক্ত করলেন।
মাইক্রোসফট এনকার্টায় Bible আর্টিকেলের বক্তব্য: The27books of theNew Testament are only a fraction of the
literary production of the Christian communities in their first three
centuries. ... As many as 50 Gospels were in circulation during this time. “খৃস্টান সম্প্রদায়গুলি প্রথম তিন শতকে যে সকল ধর্মগ্রন্থ লিখেছিল তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি হলো নতুন নিয়মের ২৭টি বই। তখন ৫০টির মত ইঞ্জিল তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।”
২. ৩. তিন ইঞ্জিল বনাম চার ইঞ্জিল
আমরা জানলাম যে, প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিল চারটি’ ২য় শতকের কতিপয় খৃস্টানের পরনামে (pseudonymously) লেখা বই। এগুলির মধ্যে বৈপরিত্যের শেষ নেই। এ চারটির মধ্যে প্রথম তিনটিকে খৃস্টান পণ্ডিত ও ধর্মগুরুগণ Synoptic Gospels বা ‘একমতীয় ইঞ্জিল’ বলে আখ্যায়িত করেন। চতুর্থ যোহন বা ইউহোন্নার মতানুসারে ইঞ্জিলটিকে ব্যতিক্রম বলে গণ্য করেন। প্রথম তিনটির সাথে চতুর্থটির বৈপরীত্য আরো বেশি। খৃস্টান গবেষকগণ প্রায় সকলেই একমত যে, মথি, মার্ক ও লূকের সুসমাচারের উৎস মূল একটি সংক্ষিপ্ত ‘ইঞ্জিল’। হারিয়ে যাওয়া এই মূল ইঞ্জিলটিকে খৃস্টান গবেষকগণ ‘কিউ’ (Q) বলে অভিহিত করেন। জার্মান Quelle শব্দের অর্থ source বা উৎস। যেহেতু এতে শুধু যীশুর বচন সংকলন করা হয়েছিল এজন্য গবেষকগণ একে Logia বলে অভিহিত করেন। (The New Encyclopedia Britannica, 15th Ed, V-10, Jesus Christ,
p 146) চতুর্থ ‘মতানুসারে ইঞ্জিলের’ উৎস, ভিত্তি, প্রেক্ষাপট ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খৃস্টান গবেষকদের মত ও ভিন্নমত জানতে যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়াতে “বাইবেল” বিষয়ক প্রবন্ধ অধ্যয়ন করতে পারেন।
২. ৪. ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল কোন্ ভাষায় নাযিল হয়েছিল?
ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল এবং এ সকল ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’-এর মধ্যে অন্যতম পার্থক্য ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল ছিল (Hebrew-Aramaic) হিব্রু-আরামিক ভাষায়। কিন্তু প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’-গুলি গ্রীক ভাষায় লেখা। সাধু পলের অনুসারীরা যীশুর পরে ১০০ বৎসরের মধ্যেই তাঁর আসল হিব্রু ইঞ্জিল গুম করে দেন।
খৃস্টান প্রচারকগণ “বাংলা”-য় ‘ইঞ্জিল শরীফ’ প্রচার করেন। আপনি তাকে বলুন: আপনার হাতের ইঞ্জিলটি তো বাংলায় লেখা! ঈসা মাসীহ কি বাঙালী ছিলেন? তা না হলে তিনি কোন্ ভাষায় কথা বলতেন? খৃস্টান প্রচারক স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ঈসা মাসীহ হিব্রু-আরামিক ভাষায় কথা বলতেন। আপনি তাকে বলুন: হিব্রু ইঞ্জিল কোথায়? যীশুর তিরোধানের পর থেকে ৫০০ বৎসরের মধ্যে লেখা একটি হিব্রু ইঞ্জিল যদি আপনি দেখাতে পারেন তবে আপনার ইঞ্জিল সত্য বলে মেনে নেব।
তারা বলেন, ইঞ্জিল গ্রীক ভাষায় লেখা হয়েছিল। কী উদ্ভট কথা! যীশু, তাঁর শিষ্যগণ এবং ফিলিস্তিনের মানুষের মাতৃভাষা এবং ধর্মীয় ভাষা ছিল হিব্রু। তবে সে সময়ে গ্রীকরা ফিলিস্তিন দখল করেছিল। ইয়াহূদীগণ বিজাতীয় ভাষা ঘৃণা করতেন এবং করেন। যীশু কি তাঁর নিজের ও জনগণের মাতৃভাষা ও ধর্মীয়ভাষা বাদ দিয়ে দখলদারদের অপরিচিত ও ঘৃণিত ভাষায় ইঞ্জিল প্রচার করতেন? যীশুর শিষ্যরা কি তাদের মাতৃভাষা ও ধর্মীয়ভাষা বাদ দিয়ে দখলদারদের ভাষায় ইঞ্জিল লিখবেন? কেউ যদি বলে রবীন্দ্র বা নজরুল সাহিত্য ইংরেজিতে রচিত তবে তাকে আপনি কী বলবেন?
বস্তুত এ সকল বেনামী ইঞ্জিলের লেখকগণ অ-ইয়াহূদী রোমান ছিলেন। তাঁরা হিব্রু ভাষা জানতেন না। যীশু হিব্রু ভাষায় ইস্রায়েল বংশের মানুষদের মধ্যে ইঞ্জিল প্রচার করেন। তিনি অ-হিব্রু বা অ-ইয়াহূদীদের কাছে ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেন। সাধু পল দাবি করেন যে, যীশু তাকে পয়গম্বর বানিয়েছেন। ফিলিস্তিনের খৃস্টানগণ তাঁর দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তখন তিনি দাবি করেন যে, যীশু তাঁকে অ-ইস্রায়েলীয়দের জন্য পয়গম্বর বানিয়েছেন। এভাবে তিনি গ্রীকভাষী মানুষদের মধ্যে তার বানোয়াট ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তিনি বারংবার বলেন, তাঁর নিজের ইঞ্জিল ছাড়া অন্য কোনো ইঞ্জিল, অর্থাৎ যীশুর ইঞ্জিল যদি কেউ প্রচার করে তবে সে অভিশপ্ত (গালাতীয় ১/৬, ৮-৯; ২-করিন্থীয় ১১/৪)। এভাবে ক্রমান্বয়ে তাঁর অনুসারী ত্রিত্ববাদী খৃস্টানগণ (Pauline Christaians) প্রাধান্য লাভ করে এবং একত্ববাদী হিব্রু খৃস্টানগণ (Judeo Christaians) কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সাধু পলের অনুসারী গ্রীক-ভাষী খৃস্টানগণ যীশু খৃস্টের ১০০/১৫০ বৎসর পরে “পবিত্র সাধুদের নামে” নিজেদের মনগড়া ইঞ্জিল লিখতে থাকেন। তাঁরা সমাজে ঈসা মাসীহের নামে প্রচলিত সত্য, মিথ্যা ও নিজের মনগড়া কথা লিখে ‘অমুকের লেখা ইঞ্জিল’ নামে প্রচার করেন।
২. ৫. পবিত্র আত্মার রচনা
খৃস্টান প্রচারকগণ দাবি করেন, পবিত্র আত্মা বা পাক রুহের তত্ত্বাবধানে ‘ইঞ্জিল’ লেখা হয়। এটিও ভিত্তিহীন দাবি ছাড়া কিছুই নয়। নতুন নিয়মে যীশু খৃস্টের শিষ্যদের পত্রে আমরা দেখি যে, তারা পবিত্র আত্মার মাধ্যমে কিছু জানতে পারলে তা উল্লেখ করতেন। কিন্তু ইঞ্জিল শরীফগুলির কোথাও লেখা নেই যে, এগুলি পবিত্র আত্মার মাধ্যমে লেখা। বরং লূক তার ইঞ্জিলের শুরুতে খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন যে, অনেকেই বিশ্বাসের ভিত্তিতে অনেক ইঞ্জিল লিখেছেন এবং তিনিও শোনা কথার উপর ভিত্তি করে সঠিক কথাগুলি লেখার চেষ্টা করেছেন। (লূক ১/১-৪)।
সর্বোপরি ইঞ্জিলগুলির মধ্যে এত বৈপরীত্য রয়েছে যে, পাক রূহ তো দূরের কথা কোনো নাপাক মানুষও এরূপ পরস্পর বিরোধী কথা লিখতে পারে না। পাঠক যদি প্রচলিত চারটি “মতানুসারে ইঞ্জিল” তুলনা করে অধ্যয়ন করেন তাহলে দেখবেন যে, চারটি ইঞ্জিলেই যীশু খৃস্টের জীবনের একই ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি ঘটনা চার ইঞ্জিলে পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২. ৬. কিতাবুল মোকাদ্দস ও ইঞ্জিলের বিকৃতির মজার মজার প্রমাণ
একটি ডকুমেন্ট বা দলিলের মধ্যে যদি সুস্পষ্ট স্ববিরোধী বা সর্বজনবিদিত সত্যের বিপরীত কিছু তথ্য থাকে, তবে অন্য কোনো বিচার ছাড়াই বিচারক তাকে জাল বলে গণ্য করেন। কিতাবুল মোকাদ্দস-এর মধ্যে বিদ্যমান এরূপ কিছু তথ্য দেখুন:
২. ৬. ১. নবীর কিতাবে তাঁরই মৃত্যু ও কবরের গল্প
আমরা জানি যে, তাওরাত মূসা (আ)-এর উপর অবতীর্ণ। অথচ প্রচলিত তাওরাতের দ্বিতীয় বিবরণের ৩৪ অধ্যায়ে মূসা (আ)-এর মৃত্যু, দাফন, কবর. তার উম্মাতের ত্রিশ দিন শোক পালন এবং যুগের আবর্তনের মূসার কবরটি হারিয়ে যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। আর ইঞ্জিলের বিষয় তো আরো অদ্ভূত। আমরা জানি যে, মহান আল্লাহ ঈসা (আ)-এর উপর ইঞ্জিল নাযিল করেন। ঈসা মাসীহ জীবদ্দশায় ইঞ্জিল প্রচার করেছেন (মথি ৪/২৩, ৯/৩৫, ১১/১৫; মার্ক ১/১৪, ১৫, ৮/৩৫; মার্ক ১০/২৯; লূক ৯/৬)। কিন্তু প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির সবগুলিতেই ঈসা মাসীহের মৃত্যু, কবর, কবর থেকে বের হওয়া... ইত্যাদি বিবরণ বিদ্যমান। পাঠক কি মনে করেন, আল্লাহ মূসার (আ) কিতাবে তার মৃত্যু ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলি এবং ঈসার (আ) কিতাবে তার মৃত্যু ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলির বিবরণ নাযিল করেছিলেন?
২. ৬. ২. কার অজ্ঞতায় এ বিভ্রাট? পবিত্র আত্মার না বেনামি লেখকের?
(ক) ৩, ৫ ও ১০-এর বিভ্রাট
বনী ইস্রায়েলের মূল পিতা ইসরায়েল (ইয়াকুব আ)-এর ১২ পুত্রের একপুত্র বিন্যামীন (বিন্ইয়ামীন)। তাঁর পুত্রগণের বিষয়ে সাংঘর্ষিক বর্ণনা লক্ষ্য করুন:
১-বংশাবলি ৭/৬: “বিন্যামীনের সন্তান- বেলা, বেখর ও যিদীয়েল, তিন জন।”
পক্ষান্তরে ১-বংশাবলি ৮/১: “বিন্যামীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র বেলা, দ্বিতীয় অস্বেল, তৃতীয় অহর্হ, চতুর্থ নোহা ও পঞ্চম রাফা।”
কিন্তু আদিপুস্তক ৪৬/২১: “বিন্যামীনের পুত্র বেলা, বেখর, অস্বেল, গেরা, নামন, এহী, রোশ, মুপ্পীম, হুপ্পীম ও অর্দ।”
বিন্যামিনের সন্তান সংখ্যা প্রথম বক্তব্যে তিনজন এবং দ্বিতীয় বক্তব্যে পাঁচজন। তাদের নামের বর্ণনাও পরস্পর বিরোধী, শুধু বেলার নামটি উভয় শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাকিদের নাম সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর তৃতীয় শ্লোকে বিন্যামীনের সন্তান সংখ্যা দশজন। নামগুলিও আলাদা। তৃতীয় শ্লোকের নামগুলির সাথে প্রথম শ্লোকের সাথে দুজনের নামের এবং দ্বিতীয় শ্লোকের দুজনের নামের মিল আছে। আর তিনটি শ্লোকের মিল আছে একমাত্র “বেলা” নামটি উল্লেখের ক্ষেত্রে।
(খ) মাত্র তিন লক্ষের হেরফের!
দায়ূদের নির্দেশে তাঁর সেনাপতি যোয়াব লোকসংখ্যা গণনা করেন। এ বিষয়ে শমূয়েলের দ্বিতীয় পুস্তকের ২৪ অধ্যায়ের ৯ম শ্লোকটি নিম্নরূপ: “পরে যোয়াব গণিত লোকেদের সংখ্যা রাজার কাছে দিলেন; ইস্রায়েলে খড়্গ-ধারী আট লক্ষ বলবান লোক ছিল; আর যিহূদার পাঁচ লক্ষ লোক ছিল।”
অপর দিকে বংশাবলি প্রথম খন্ডের ২১ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোক নিম্নরূপ: “আর যোয়াব গণিত লোকদের সংখ্যা দায়ূদের কাছে দিলেন। সমস্ত ইস্রায়েলের এগার লক্ষ খড়্গধারী লোক, ও যিহূদার চারি লক্ষ সত্তর সহস্র খড়্গধারী লোক ছিল।”
প্রথম বর্ণনায় ইস্রায়েলের যোদ্ধাসংখ্যা ৮ লক্ষ এবং যিহূদার ৫ লক্ষ। আর দ্বিতীয় বর্ণনামতে ১১ লক্ষ ও ৪ লক্ষ ৭০ হাজার। উভয় বর্ণনার মধ্যে বৈপরীত্যের পরিমাণ দেখুন! ইস্রায়েলের জনসংখ্যা বর্ণনায় মাত্র ৩ লক্ষের কমবেশি এবং যিহূদার জনসংখ্যার বর্ণনায় ত্রিশ হাজারের কমবেশি। পবিত্র আত্মার কারসাজি?!
(গ) ভুলটি কার? যীশুর? পবিত্র আত্মার? না বেনামি লেখকের?
মার্ক লিখেছেন ২/২৫-২৬: “তিনি (যীশু) তাহাদিগকে (ইয়াহূদী ফরীশীগণকে) কহিলেন, দায়ূদ ও তাঁহার সঙ্গীরা খাদ্যের অভাবে ক্ষুধিত হইলে তিনি যাহা করিয়াছিলেন, তাহা কি তোমরা কখনো পাঠ কর নাই? তিনি ত অবিয়াথর মহাযাজকের সময়ে ঈশ্বরের গৃহে প্রবেশ করিয়া, যে দর্শন-রুটী যাজকবর্গ ব্যতিরেকে আর কাহারও ভোজন করা বিধেয় নয়, তাহাই ভোজন করিয়াছিলেন, এবং সঙ্গিগণকেও দিয়াছিলেন।”
১ শমূয়েল ২১ ও ২২ অধ্যায় থেকে প্রমাণিত যে, এ কথাটি ভুল। কারণ ‘দর্শন-রুটী’ ভোজন করার সময় দায়ূদ ‘একা’ ছিলেন, তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। কাজেই ‘ও তাঁহার সঙ্গীরা’ এবং ‘সঙ্গিগণকেও দিয়াছিলেন’ দুটি কথাই ভুল। এছাড়া এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট মহাযাজকের নাম ছিল ‘অহীমেলক’। ‘অবিয়াথর’ এ সময়ে যাজক ছিলেন না। অর্থাৎ যীশু অথবা পবিত্র আত্মা কিতাবুল মোকাদ্দস জানতেন না!
অন্যত্র ঈসা মাসীহ বলেছেন: “আর স্বর্গে কেহ উঠে নাই; কেবল যিনি স্বর্গ হইতে নামিয়াছেন, সেই মনুষ্যপুত্র, যিনি স্বর্গে থাকেন।” (যোহন ৩/১৩) তাওরাতের ভাষ্যে এ কথাটি ভুল। কারণ হনোক (Enoch: ইদরীস) এবং এলিয় (Eli'jah: আল-ইয়াসা’) উভয়ে স্বর্গে গমন করেছেন (আদিপুস্তক ৫/২৩-২৪; ২ রাজাবলি ২/১-১১।) অর্থাৎ যীশু বা ইঞ্জিল লেখক পবিত্র(!) আত্মা ‘আল্লাহর কালাম’ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন।
যীশুর পিতামাতা তাঁকে নিয়ে মিসর থেকে ফিলিস্তিনে ফিরে নাসরৎ নামক শহরে বসবাস করতে থাকেন। এ বিষয়ে মথি বলেন: “এবং নাসরৎ নামক নগরে গিয়া বসতি করিলেন; যেন ভাববাদিগণের দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হয় যে, তিনি নসরতীয় বলিয়া আখ্যাত হইবেন।” (মথি ২/২৩) ইঞ্জিলের এ কথাটি অসত্য; কোনো ভাববাদীর কোনো পুস্তকেই এ কথা নেই। কিন্তু পবিত্র আত্মা তা জানতেন না!
ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা ৩০ রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে যীশুকে ইয়াহূদীদের কাছে ধরিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে মথি বলেন ২৭/৯: “তখন যিরমিয় ভাববাদী দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হইল, ‘আর তাহারা সেই ত্রিশ রৌপ্যমুদ্রা লইল।” কথাটি অসত্য। এ বাক্যটি বা এ অর্থে কোনো বাক্য যিরমিয় ভাববাদীর পুস্তকের কোথাও নেই।
যীশুর বংশাবলি-পত্রে লূক লিখেছেন (৩/২৭): “ইনি যোহানার পুত্র, ইনি রীষার পুত্র, ইনি সরুববাবিলের পুত্র, ইনি শল্টীয়েলের পুত্র ইনি নেরির পুত্র”।
পুরাতন নিয়ম থেকে প্রমাণিত যে এখানে তিনটি অসত্য তথ্য রয়েছে: প্রথমত: “রীষা সরুববাবিলের পুত্র” কথাটি অসত্য। মথি লিখেছেন (১/১২-১৩) “সরুববাবিলের পুত্র অবীহূদ।” লূক ও মথি দুজনের কথাই অসত্য। কারণ ১ বংশাবলি ৩/১৯-এ রয়েছে যে, সরুববাবিলের ৫টি পুত্র ছিল, তাদের মধ্যে (রীষা) বা (অবীহূদ) নামে কোনো পুত্র ছিল না। দ্বিতীয়ত: সরুববাবিল শল্টীয়েলের পুত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন পদায়ের পুত্র। হ্যাঁ, তিনি শল্টীয়েলের ভাতিজা ছিলেন। (১ বংশাবলি ৩/১৭-১৮) তৃতীয়ত: শল্টীয়েলের পিতার নাম নেরি ছিল না। তার পিতার নাম ছিল যিকনিয় (যিহোয়াখীন)। (১ বংশাবলি ৩/১৭ ও মথি ১/১২)
(ঘ) যীশুর পিতার দুজন পিতা!
আমরা দেখেছি যে, প্রচলিত ইঞ্জিল আল্লাহর কালাম নয়। এর মধ্যে আল্লাহর কোনো বাণী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর মূল বিষয় যীশু খৃস্ট। অথচ যীশু খৃস্টের পরিচয়েও ভয়ঙ্কর বৈপরীত্য! এক ব্যক্তির দুজন পিতা!!
মথি এবং লূক উভয়ে যীশুর বংশ তালিকা প্রদান করেছেন (মথি: ১/১-১৬ ও লূক: ৩/২৩-৩৮)। যদি কেউ উভয় তালিকার তুলনা করেন তাহলে উভয়ের মধ্যে অনেক বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা দেখতে পাবেন, যেগুলির মধ্যে রয়েছে:
1. যীশুর দাদার নাম: মথি বলেন: যাকোব কিন্তু লূক বলেন: এলি। দু পিতার একপুত্র!
2. মথি থেকে জানা যায় যে, যীশু দায়ূদের পুত্র শলোমনের বংশধর। লূক থেকে জানা যায় যে, যীশু দায়ূদের পুত্র নাথন-এর বংশধর।
3. মথির ভাষ্যে দায়ূদ থেকে ব্যবিলনের নির্বাসন পর্যন্ত যীশুর পূর্বপুরুষগণ সকলেই সুপ্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন। লূকের বর্ণনায় দায়ূদ ও নাথন বাদে যীশুর পুর্বপুরুষগণের মধ্যে কেউই রাজা বা কোনো প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন না।
4. মথির বিবরণ অনুযায়ী দায়ূদ থেকে যীশু পর্যন্ত উভয়ের মাঝে ২৬ প্রজন্ম। আর লূকের বর্ণনা অনুযায়ী উভয়ের মাঝে ৪১ প্রজন্ম।
5. মথি বলেন (১/১৭): “এভাবে ইব্রাহিম থেকে দাউদ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; ব্যাবিলনে বন্দী হবার পর থেকে মসীহ্ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ।”
এখানে দুটি সুনিশ্চিত ও প্রমাণিত অসত্য তথ্য বিদ্যমান:
প্রথমত, এখানে বলা হলো: যীশুর বংশতালিকা তিন অংশে বিভক্ত, প্রত্যেক অংশে ১৪ পুরুষ, তাহলে মোট ৪২ পুরুষ। এ কথাটি সুস্পষ্ট ভুল। মথির ১/১-১৭-র বংশ তালিকায় যীশু থেকে আবরাহাম পর্যন্ত ৪২ পুরুষ নয়, বরং ৪১ পুরুষের উল্লেখ রয়েছে। যে কোনো পাঠক গণনা করলেই তা জানতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, মথির বক্তব্য: “দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ”- মারাত্মক ভুল। ১ বংশাবলির ১ম অধ্যায় থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, এ পর্যায়ে ১৮ পুরুষ ছিল, ১৪ পুরুষ নয়। আরো লক্ষণীয় যে, বংশাবলি ও মথি- বাইবেলের দু স্থানেই স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী ব্যক্তি পরবর্তী ব্যক্তির জনক। মথি তালিকার বিভিন্ন স্থান থেকে চার পুরুষ ফেলে দেওয়া সত্ত্বেও লিখেছেন যে, পূর্ববতী ব্যক্তি পরের ব্যক্তির সরাসরি জনক। তিনি এতেও ক্ষান্ত হন নি। উপরন্তু এদের মাঝে যে আর কেউ ছিল না নিশ্চিত করতে এ পর্যায়ে সর্বমোট ১৪ পুরুষ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন।
এজন্য প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ কার্ডিনাল জন হেনরী নিউম্যান (১৮০১-১৮৯০) আফসোস করে বলেন, “খৃস্টধর্মে একথা বিশ্বাস করা জরুরী যে, তিনে এক হয় বা তিন ও এক একই সংখ্যা। কিন্তু এখন একথাও বিশ্বাস করা জরুরী হয়ে গেল যে, ১৪ এবং ১৮ একই সংখ্যা; কারণ পবিত্র গ্রন্থে কোনো ভুল থাকার সম্ভাবনা নেই!”
আমরা তার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে পারি, ৪১ ও ৪২ একই সংখ্যা!
২. ৬. ৩. মহান আল্লাহ সম্পর্কে অপবিত্র কথাবার্তা
‘কিতাবুল মোকাদ্দস’-এ আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় নবীগণের বিষয়ে অনেক ঘৃণ্য কথা বিদ্যমান। বাইবেলের ভাষ্যে স্রষ্টা অনেক কিছুই দেখতে বা শুনতে পারেন না। কেউ গাছের আড়ালে গেলে তাকে দেখতে পান না; বরং তাকে ডেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হন যে, তুমি কোথায়? (আদিপুস্তক ৩/৯)। দূরের মানুষদের অবস্থা দেখতে তাকে নিচে নেমে আসতে হয় (আদিপুস্তক ১১/৫)। পৃথিবীর মানুষদের চিৎকার তাঁর কানে পৌঁছালেও তাদের কর্ম তিনি দেখতে পান না (আদিপুস্তক ১৮/২০-২১)। স্রষ্টা না বুঝে কাজ করেন এবং পরে অনুশোচনা করেন। মানুষ সৃষ্টি করার পর যখন মানুষেরা পাপ করতে থাকে তখন তিনি মানুষ সৃষ্টি করে ভুল করেছেন ভেবে আফসোস করেন এবং মনের ব্যথ্যায় কষ্ট পেতে থাকেন। (আদিপুস্তক ৬/৬-৭)। তিনিই তালূত বা শৌলকে ইয়াহূদীদের রাজা বানান এবং তাকে ‘মাসীহ’ হিসেবে অভিষিক্ত করেন। রাজা হয়ে এ ‘মাসীহ’ যে অন্যায় করবে তা তিনি বুঝতে পারেন নি! রাজা হওয়ার পরে তালূত অন্যায় করলে খোদা অনুশোচনায় ভেঙ্গে পড়েন! (১ শমূয়েল ১৫/১১, ৩৫)
কিতাবুল মোকাদ্দসের ভাষ্যে আল্লাহ বিনা অপরাধে শাস্তি দেন! তিনি মানুষের পাপের অপরাধে নিরপরাধ পশু-পাখীকে ধ্বংস করেন (আদিপুস্তক ৬/৬-৭)। তিনি ইয়াহূদীদেরকে তিন নির্দেশ দেন, ইয়াহূদীদের চেয়েও বড় ৭ টি জাতির সকল নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর লক্ষলক্ষ মানুষকে নির্দয়ভাবে গণহত্যা করতে (দ্বিতীয় বিবরণ ৭/২-১৬)। অনুরূপভাবে শমরীয়দের গণহত্যা করতে, বিশেষভাবে ‘শিশুদেরকে আছড়াইয়া খণ্ড খণ্ড’ করতে এবং ‘গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের উদর বিদীর্ণ’ করতে নির্দেশ প্রদান করেন (হোশেয় ১৩/১৬)।
বাইবেলের বর্ণনায় দেখা যায় যে, স্রষ্টা অপরাধীর অপরাধের জন্য নিরপরাধকে শাস্তি দেন। পিতার অপরাধের কারণে ৪ পুরুষ পর্যন্ত বংশধরগণ শাস্তি পাবে বলে বিধান দিয়েছেন। (যাত্রাপুস্তক ৩৪/৭) এমনকি ৯/১০ পুরুষ আগের পূর্বপুরুষের অপরাধের কারণে ৪০০ বৎসর পরের উত্তরপুরুষদের প্রতিটি মানুষকে এবং সকল সম্পদকে নির্দয়ভাবে ধ্বংস করতে নির্দেশ দেন। এমনকি “স্ত্রী ও পুরুষ, বালক-বালিকা ও স্তন্যপায়ী শিশু, গরু ও মেষ, উষ্ট্র ও গর্দভ সকলকেই বধ” করতে নির্দেশ দেন। (১ শমূয়েল ১৫/১-৩)
অন্য গল্পে নূহ (আ) মদপান করে মাতাল হয়ে উলঙ্গ হন (নাঊযু বিল্লাহ)। তাঁর ছোট ছেলে হাম হঠাৎ পিতাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলেন। মাতলামি কাটার পর বিষয়টি জেনে নূহ (আ) ক্রুদ্ধ হয়ে হামের ছেলে কনানকে অভিশাপ দেন এবং ঈশ্বর সে অভিশাপ বাস্তবায়নও করেন!!!! (আদিপুস্তক ৯/১৮-২৫)
মাতাল হয়ে উলঙ্গ হওয়ায় নূহের কোনো অপরাধ হলো না কিন্তু অসতর্কভাবে তা দেখে ফেলায় হামের অপরাধ হলো! ভয়ঙ্কর বিষয় হলো অপরাধ করলো হাম কিন্তু অভিশাপ ও শাস্তি পেল হামের এক ছেলে কনান!! অপরাধী হামের চারটি পুত্র ছিল: কূশ, মিসর, পূট ও কনান। (আদিপুস্তক ১০/৬) তাদের মধ্য থেকে শাস্তির জন্য শুধু কনানকে বেছে নেওয়ার কারণটিই বা কী?
অনুরূপ আরেকটি উদ্ভট গল্প! ইসহাক নবীর দুই ছেলে: বড় ছেলে এযৌ ও ছোটে ছেলে ইয়াকুব। ইসহাক তার বড় ছেলে এযৌকে ভালবাসতেন। বৃদ্ধ বয়সে ইসহাক অন্ধ হয়ে যান। তিনি আল্লাহর বিধান মত বড় ছেলে এযৌকে আশীর্বাদ করে “গদ্দীনশীন” করতে চান। কিন্তু ইয়াকূব প্রতারণা করে এযৌ-এর বেশ ধরে পিতার কাছে এসে আশীর্বাদ প্রার্থনা করলে ইসহাক না বুঝে এযৌ মনে করে তাকে আশীর্বাদ করেন। (আদিপুস্তক ২৭ অধ্যায়) মজার কথা, ইসহাক অন্ধ হওয়ার কারণে এযৌ ভেবে ইয়াকুবকে আশীর্বাদ করলেন এবং ঈশ্বরও অন্ধের মতই তা কবুল করে নিলেন! প্রতারককে শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, ঈশ্বর ঘোষণা দিলেন, কোনো অপরাধ ছাড়াই তিনি এযৌকে ঘৃণা করলেন, শাস্তি দিলেন এবং অপরাধী প্রতারক ইয়াকূবকে প্রেম করলেন (মালাখি ১ম অধ্যায়: ২-৩)
আরেকটি গল্পে আল্লাহ সারা রাত ধরে ইয়াকুবের (আ) সাথে রেসলিং বা মল্লযুদ্ধ করেন!! শেষ রাতে ইয়াকুব তাকে ছেড়ে দেন!! এজন্য ইয়াকূবের নাম হলো “ইস্রায়েল” অর্থাৎ আল্লাহর সাথে মল্লযুদ্ধকারী!!! (আদিপুস্তক ৩২/২৪-৩০)
২. ৬. ৪. নবীগণ, ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ-এর ব্যভিচার-ধর্ষণ ও হত্যা!
কিতাবুল মোকাদ্দসের বর্ণনায় নবী-রাসূলগণ ও তাদের সন্তানগণ ছিলেন ব্যভিচারী ও ধর্ষক (আদিপুস্তক: ১৯: ৩৩-৩৮, ৩৫: ২২; ৩৮: ১৫-১৮, ২৭-৩০..), মদ্যপ (আদিপুস্তক ৯/২০), মিথ্যাবাদী (যাত্রাপুস্তক ৩/১৭-১৮, ৫/৩, ১১/২, ১২/৩৫; ১ শমূয়েল ১৬/১-৪), তাঁরা মানুষের মল ও গোবিষ্ঠা ভক্ষণ করতেন (যিহিষ্কেল ৪/৪-১৫), উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করতেন (যিশাইয় ২০/২-৪), মদপান করে উলঙ্গ হতেন (আদিপুস্তক ৯/২০), মূর্তিপূজা করতেন (যাত্রাপুস্তক ৩২ : ১-৩৫; ১ রাজাবলি ১১ : ১-১৩)... .... ইত্যাদি।
যে পাপের কথা চিন্তা করলেও গা শিউরে উঠে এবং যে পাপ করতে পাপীও রাজি হয় না সে পাপও নবীগণ ও তাদের সন্তানগণ করতেন বলে বাইবেলে বলা হয়েছে। যেমন নিজের কন্যাদের সাথে ব্যভিচার করা (আদিপুস্তক ১৯/৩৩-৩৮), পিতার স্ত্রীকে ধর্ষণ করা (আদিপুস্তক ৩৫/২২), নিজের বোনকে ধর্ষণ করা (২ শমূয়েল ১৩/১১-১৪), সকল মানুষের সামনে নিজের পিতার স্ত্রীগণকে গণধর্ষণ করা (২ শমুয়েল ১৬/২২), নিজের পুত্রবধুর সাথে ব্যভিচার করা (আদিপুস্তক ৩৮/১৫-১৮, ২৭-৩০) ইত্যাদি।
এত পাপাচারের পরেও ঈশ্বর তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন নি। বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে জারজ সন্তানদের প্রতি ঈশ্বরের মায়া মনে হয় একটু বেশিই। ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ ‘দায়ূদ’ এবং ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ ঈসা: দুজনই জারজ সন্তানের বংশধর। (দ্বিতীয় বিবরণ: ২: ১৭-১৯ এবং ২০: ১৩-১৬, মথি: ১: ১-৩)।
ইয়াহূদী-খৃস্টানদের প্রাণপুরুষ দাউদ (আ)। দাউদের বংশধর হওয়া যীশুখৃস্টের শ্রেষ্ঠ গৌরব। বাইবেলের ভাষ্যে দায়ূদ ঈশ্বরের প্রথমপুত্র, ঔরসজাত পুত্র ও ঈশ্বরের মাসীহ বা খৃস্ট। “সদাপ্রভু আমাকে কহিলেন, তুমি আমার পুত্র, অদ্য আমি তোমাকে জন্ম দিয়াছি” (যাবুর ২/৭) “আমার দাস দায়ূদকেই পাইয়াছি, আমার পবিত্র তৈলে তাহাকে অভিষিক্ত করিয়াছি (with my holy oil have I anointed him)।...সে আমাকে ডাকিয়া বলিবে, তুমি আমার পিতা, আমার ঈশ্বর।আবার আমি তাহাকে প্রথমজাত (my firstborn) করিব ..।” (যাবূর ৮৯/২০-২৭)
এ দায়ূদ (আ)-কেও বাইবেলে ব্যভিচারী ও ধর্ষক বলে চিত্রিত করা হয়েছে। উরিয়া নামে দাউদের এক প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধরত ছিলেন। দায়ূদ উরিয়ার স্ত্রীকে এক নজর দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। মহিলা এ ধর্ষণে গর্ভবতী হয়ে যান। দায়ূদ সেনাপতিকে চিঠি লিখে কৌশলে উরিয়াকে হত্যা করান এবং উক্ত মহিলাকে বিবাহ করেন। (২ শমূয়েল: ১১/১৪: ১৭)
ধর্ষণ ও হত্যা একত্রে! একজন মহাপাপীও এমন করবেন না। একজন পাপী বয়স্ক মানুষ, যার অর্ধশতাধিক স্ত্রী বিদ্যমান, তিনি একজন মহিলাকে একনজর দেখেই তাকে ধর্ষণ করতে ব্যস্ত হবেন এবং তাঁর স্বামীকে হত্যা করবেন?
তাওরাতে বিধান ব্যভিচারীকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে। কিন্তু তাওরাতের ঈশ্বর অপরাধীর চেহারা দেখে বিচার করেন বলে মনে হয়। সম্ভবত দায়ূদ যেহেতু ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ, সেহেতু ঈশ্বর দাউদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিলেন দায়ূদের বৈধ স্ত্রীদেরকে। তিনি দায়ূদকে বলেন, তুমি যেহেতু ব্যভিচার ও হত্যায় লিপ্ত হলে, সেহেতু তোমার সামনে তোমার স্ত্রীদের গণধর্ষণের ব্যবস্থা করব। কী অদ্ভুত বিচার ব্যবস্থা!! একটি পাপের শাস্তি হিসেবে আরেকটি পাপের ব্যবস্থা ও ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে নিরপরাধকে ধর্ষণের ব্যবস্থা করা!! (২ শমূয়েল ১২: ১১-১২)। ইঞ্জিলের বর্ণনা অনুসারে ঈসা মাসীহও ভয়ঙ্কর সব পাপ ও অশোভন কর্মে লিপ্ত হতেন। আমরা “নবীগণের পাপ ও পাপীর শাফা‘আত” প্রসঙ্গে তা আলোচনা করব।
এরূপ অগণিত স্ববিরোধী এবং অপবিত্র বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, কিতাবুল মোকাদ্দস পুরোটাই জাল অথবা এর মধ্যে অনেক জালিয়াতি বিদ্যমান। কুরআন দ্বিতীয় বিষয়টিই নিশ্চিত করে। কুরআন বলে যে, ইয়াহূদী-খৃস্টানগণ তিনভাবে তাওরাত-ইঞ্জিল নষ্ট করে: (ক) ভুলে যাওয়া (খ) বিকৃত করা (মায়িদা: ১৩, ১৪ ও ৪১), ও (গ) জাল কথা ও বই সংযোজন করা (বাকারা ৭৯ আল-ইমরান ৭৮)। এ সকল বিকৃতি ও জালিয়াতির পাশাপাশি এগুলির মধ্যে কিছু কিছু ভালোকথা বিদ্যমান। তবে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কোনো পথ নেই। এজন্য আল্লাহ কুরআনকে যাচাইয়ের মানদণ্ড করেছেন এবং এগুলির মূল শিক্ষা কুরআনের মধ্যে উদ্ধৃত ও সংরক্ষিত করেছেন। (সূরা ৫-মায়িদা: ৪৮)। আর গত ২০০ বৎসর যাবৎ ইউরোপ-আমেরিকার ইয়াহূদী-খৃস্টান গবেষকগণ এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করেছেন।
২. ৭. বিকৃতির ধারাবাহিকতা
বিকৃতি ও জালিয়াতির ধারা কুরআন নাযিলের পরেও অব্যাহত আছে। আপনি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বিগত ২০০ বৎসরের বাইবেলগুলি একত্রে অধ্যয়ন করলেই দেখবেন যে, প্রত্যেক সংস্করণেই অনেক পরিবর্তন। ভাষার পরিবর্তন নয়, বরং তথ্যের পরিবর্তন, বিকৃতি, এমনকি অনেক আয়াত বা শ্লোক পর্যন্ত বাদ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস-এর সময়ে ১৬১১ খৃস্টাব্দে ইংরেজি ভাষায় ‘বাইবেলের’ বিশুদ্ধ অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। এটিই অন্যান্য ভাষার কিতাবুল মোকাদ্দসের মূল ভিত্তি। এটি কিং জেমস ভার্শন (King James Version:
KJV) এবং অথোরাইযড ভার্শন (Authorised Version: AV) নামে পরিচিত। ১৯৫২ খৃস্টাব্দে আমেরিকার ৩২ জন খৃস্টান ধর্মগুরু একত্রিত হয়ে কিং জেমস বাইবেলের ভুলভ্রান্তিদূর করে রিভাইযড স্টান্ডার্ড র্ভাশন (Revised Standerd Version)। এখানে এ দুটি সংস্করণের মধ্যে বিদ্যমান বৈপরীত্য ও প্রমাণিত কয়েকটি বিকৃতি উল্লেখ করছি।
২. ৭. ১. ইঞ্জিল থেকে ইচ্ছাকৃত বিয়োজন
যীশু তার শিষ্যদেরকে কিয়ামত সম্পর্কে উপদেশ প্রদান করেন বলে মথি, মার্ক ও লূক উল্লেখ করেছেন। মথির বর্ণনা অনুসারে এ প্রসঙ্গে যীশু বলেন: (মথি ২৪/৩৪-৩৬) “(৩৪) আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, এই কালের লোকদের লোপ হইবে না, যে পর্যন্ত না এ সমস্ত সিদ্ধ হয়। (৩৫) আকাশের ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইবে না। (৩৬) কিন্তু সেই দিনের ও সেই দণ্ডের কথা কেহই জানে না, স্বর্গের দূতগণও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।” এ হলো অথোরাইযড ভার্শন বা কিং জেমস ভার্শন (AV/ KJV)-এর ভাষ্য (But of that day and
hour knoweth no man, no, not the angels of heaven, but my Father only.)
আধুনিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, এখানে তিনটি শব্দ বাদ দেওয়া হয়েছিল। শব্দগুলি নিম্নরূপ (neither the Son): “পুত্রও জানেন না”। রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্সন (RSV)-এ শব্দগুলি সংযোজন করা হয়েছে। সংযোজিত বাক্যাংশটুকু-সহ শ্লোকটির অর্থ হচ্ছে: “কিন্তু সেই দিনের বা সেই দণ্ডের তত্ত্ব কেহই জানে না, স্বর্গস্থ দূতগণও জানেন না, পুত্রও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।”
এ কথা-সহ এ শ্লোকটি প্রমাণ করে যে, যীশু বা যীশুর মধ্যে বিদ্যমান “পুত্র” সত্ত্বা ঈশ্বর ছিলেন না। এমনকি কিয়ামত কখন হবে সে জ্ঞানও তাঁর ছিল না। যীশুকে ঈশ্বর বলে যারা বিশ্বাস করেন তাদের জন্য কথাটি মেনে নেওয়া অসম্ভব। এজন্য বাইবেল লেখকগণ এ বাক্যাংশটুকু মুছে দিয়েছিলেন। আরো মজার ব্যাপার হলো লূকের বাইবেল থেকে এ শ্লোকটি পুরোই ফেলে দেওয়া হয়েছে। লূক ২১/৩২-৩৪ নিম্নরূপ: “(৩২) আমি তোমাদেরকে সত্য বলিতেছি, যে পর্যন্ত সমস্ত সিদ্ধ না হইবে সেই পর্যন্ত এই কালের লোকদের লোপ হইবে না। (৩৩) আকাশের ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইবে না। (৩৪) কিন্তু আপনাদের বিষয়ে সাবধান থাকিও, পাছে ভোগপীড়ায় ও মত্ততায় এবং জীবিকার চিন্তায় তোমাদের হৃদয় ভারগ্রস্ত হয়, আর সেই দিন হঠাৎ ফাঁদের ন্যায় তোমাদের উপর আসিয়া পড়ে।”
২. ৭. ২. ইঞ্জিলের মধ্যে ইচ্ছাকৃত সংযোজন
কিং জেমস ভার্শন অনুসারে যোহনের প্রথম পত্রের ৫/৭-৮ নিম্নরূপ: “কারণ স্বর্গে তিন জন রহিয়াছেন যাঁহারা সাক্ষ্য সংরক্ষণ করেন: পিতা, বাক্য ও পবিত্র আত্মা; এবং তাঁহারা তিন একই। এবং পৃথিবীতে তিন জন রহিয়াছেন যাঁহারা সাক্ষ্য প্রদান করেন: আত্মা, জল ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই। (For there are three
that bear record in heaven, the Father, the Word, and
the Holy Ghost; and the three are one. And there are three that bear witness in
earth, the spirit, and the water, and the blood: and these three agree in one.)।”
এভাবে সহস্রাধিক বৎসর বাইবেল পাঠ করা হয়েছে। এখন খৃস্টান পণ্ডিতগণ একমত যে, একথাগুলি ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সংযোজিত। এখানে মূল কথা ছিল “তিনজন সাক্ষী রয়েছেন: আত্মা, জল ও রক্ত, এবং এ তিনজনের সাক্ষ্য একই।” ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বাইবেল লেখকগণ অতিরিক্ত কথাগুলি সংযোজন করেন। রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শনের ভাষ্য নিম্নরূপ: There are three
witnesses , the Spirit, the water and the blood; and these three
agree." “বস্তুত তিনে সাক্ষ্য দিতেছেন, আত্মা, জল, ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই।”
২. ৭. ৩. ইঞ্জিলের মধ্যে ইচ্ছাকৃত বিকৃতি
প্রেরিত ৩/১৩ কিং জেমস ভার্শনে নিম্নরূপ: (The God of Abraham,
and of Isaac, and of Jacob, the God of our fathers, hath glorified his Son
Jesus...) অব্রাহামের, ইসহাকের ও যাকোবের ঈশ্বর, আমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর আপনার (নিজের) পুত্র যীশুকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন...”
কিন্তু রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শনে কথাটি নিম্নরূপ: (.... hath glorified his servant Jesus...) অব্রাহামের, ইসহাকের ও যাকোবের ঈশ্বর, আমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর আপনার বান্দা (নিজের গোলাম) যীশুকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন...”
অর্থাৎ ঈসা মাসীহ আল্লাহর বান্দা ছিলেন এ কথাটি গোপন করতে ‘বান্দা’ শব্দটি ‘পুত্র’ বানানো হয়েছিল। একইরূপ জালিয়াতি দেখুন প্রেরিত ৪/২৭। সেখানেও (thy holy servant Jesus: RSV) “তোমার পবিত্র দাস যীশু” কথাটি বিকৃত করে (thy holy child Jesus:
KJV) “তোমার পবিত্র পুত্র যীশু" বানানো হয়েছিল।
২. ৮. কুরআন দিয়ে ইঞ্জিলের বিশুদ্ধতা দাবি
খৃস্টান ধর্মগুরুগণ উপরের তথ্যগুলি গোপন করে মুসলিমদেরকে ধোঁকা দিতে কুরআনের আয়াতের আংশিক বিকৃত অর্থ দিয়ে দাবি করেন যে, প্রচলিত তাওরাত-ইঞ্জিল সঠিক। এরূপ দুটি বিষয় উল্লেখ করছি।
- আল্লাহ
বলেন:
“জেনে
রাখ!
আল্লাহ্র
বন্ধুদের
কোনো
ভয়
নেই
এবং
তারা
দুঃখিতও
হবে
না;
যারা
ঈমান
আনে
ও
তাক্ওয়া
অবলম্বন
করে।
তাদের
জন্য
আছে
সুসংবাদ
দুনিয়া
ও
আখিরাতে,
আল্লাহ্র
বাক্যাবলির
কোনো
পরিবর্তন
নেই;
ওটাই
মহাসাফল্য।
(সূরা
১০-ইউনূস:
৬২-৬৪)।
এখানে আল্লাহ বলেছেন যে, আল্লাহর বন্ধুদের সুসংবাদ ও সাফল্যের বিষয়ে আল্লাহর বাক্য, বাণী বা বিধান কেউ রদ্দ বা পরিবর্তন করতে বা আল্লাহর বন্ধুদের ব্যর্থ করতে পারবে না। খৃস্টান প্রচারকগণ সকল কথা বাদ দিয়ে (লা তাবদীলা লিকালিমাতিল্লাহ) ‘আল্লাহর বাক্যবালির পরিবর্তন নেই’ কথাটি দিয়ে দাবি করেন যে, তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদি আল্লাহর কালাম, সেহেতু কেউ তা পরিবর্তন করতে পারবে না। অতএব প্রচলিত তাওরাত-ইঞ্জিল আদি ও অকৃত্রিম আল্লাহর কালাম!
পাঠক হয়ত প্রতারণা ধরতে পারছেন না। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(ক) এখানে আল্লাহর কালেমা বা বাক্যের কথা বলা হয়েছে, আল্লাহর কিতাবের কথা বলা হয় নি। আল্লাহ যে কথা বলেন তা আল্লাহর বাক্য বা কালেমা। আর আল্লাহর কালামের লিখিত রূপ ‘কিতাব’। এখানে বলা হয়েছে, আল্লাহর বাক্য বা কথা পরিবর্তন হয় না; কারণ আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। কিন্তু আল্লাহর কালামের লিখিত গ্রন্থ বিকৃত হয় না তা কখনোই আল্লাহ বলেন নি। বরং তিনি বারংবার বলেছেন যে, ইয়াহূদী-খৃস্টানগণ আল্লাহর কালামের লিখিত রূপ পরিবর্তন করেছে, অনেক কালাম ভুলে গিয়েছে বা হারিয়ে ফেলেছে এবং অনেক জাল বই লিখে আল্লাহর নামে চালিয়েছে। (২-বাকারা ৭৯, ৪-আল ইমরান: ৭৮, ৫-মায়িদা ১৩, ১৪, ৪১)
(খ) কিতাবুল মোকাদ্দস প্রমাণ করে যে, আল্লাহ কালামের পরিবর্তন হয়, হারিয়ে যায় এবং জালিয়াতি করা হয়। বর্তমান প্রচলিত ‘কিতাবুল মোকাদ্দসের মধ্যে কয়েক ডজন আল্লাহর কিতাবের নাম আছে যেগুলির অস্তিত্ব দুনিয়াতে নেই। যেমন: (১) ‘সদাপ্রভুর যুদ্ধপুস্তক’ (গণনা পুস্তক ২১/১৪), (২) ‘যাশের পুস্তক (যিহোশূয় ১০/১৩), (৩) শলোমন রচিত ‘এক হাজার পাঁচটি গীত’, (৪) শলোমন রচিত ‘প্রাণী জগতের ইতিবৃত্ত’, (৫) শলোমন রচিত ‘তিন হাজার প্রবাদ বাক্য’ (১ রাজাবলি ৪/৩২-৩৩), (৬) শমূয়েল ভাববাদীর রাজনীতির পুস্তক (১ শময়েল ১০/২৫), (৭) শমূয়েল দর্শকের পুস্তক, (৮) নাথন ভাববাদীর পুস্তক, (৯) গাদ দর্শকের পুস্তক (১ রাজাবলি ২৯/২৩), (১০) শময়িয় ভাববাদীর পুস্তক, (১১) ইদ্দো দর্শকের পুস্তক (২ বংশাবলি ১২/১৫), (১২) অহীয় ভাববাদীর ভাববানী, (১৩) ইদ্দো দর্শকের দর্শন (২ বংশাবলি ৯/২৯), (১৪) হনানির পুত্র যেহুর পুস্তক (২ বংশাবলি ২০/৩৪), (১৫) যিশাইয় ভাববাদী রচিত উষিয় রাজার আদ্যোপান্ত ইতিহাস (২ বংশাবলি ২৬/২২), (১৬) যিশাইয় ভাববাদীর দর্শন-পুস্তক হিষ্কিয় রাজার ইতিহাস সম্বলিত (২ বংশাবলি ৩২/৩২), (১৭) যিরমিয় ভাববাদী রচিত যোশিয় রাজার বিলাপগীত (২ বংশাবলি ৩৫/ ২৫), (১৮) বংশাবলি পুস্তক (নহিমিয় ১২/২৩), (১৯) মোশির ‘নিয়মপুস্তক’ (যাত্রাপুস্তক ২৪/৭) এবং (২০) শলোমনের বৃত্তান্ত-পুস্তক (১ রাজাবলি ১১/৭)।
কিতাবুল মোকাদ্দস বলছে যে, এগুলি সবই আল্লাহর কিতাব। ইয়াহূদী-খৃস্টানগণ স্বীকার করতে বাধ্য যে, কিতাবগুলি তাদের কাছে নেই। আপনি খৃস্টান প্রচারককে বলুন: ২০টি আস্ত কিতাব যদি হারিয়ে যেতে পারে তাহলে বিদ্যমান কিতাবগুলির কয়েক হাজার আয়াত হারানো বা বিকৃত হওয়া অসম্ভব হবে কেন?
(গ) কিতাবুল মোকাদ্দস প্রমাণ করে যে আল্লাহর কিতাবের জালিয়াতি হয়। ক্যাথলিকদের কিতাবুল মোকাদ্দসে বইয়ের সংখ্যা ৭৩; কিন্তু প্রটেস্ট্যান্টদের কিতাবুল মোকাদ্দসে বইয়ের সংখ্যা ৬৬। ৭টি বই-ই বেশি কম। উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান বইগুলির মধ্যেও আয়াত ও অধ্যায়ে অনেক বৈপরীত্য। আবার প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলের কিং জেমস ভার্শন ও রিভাইযবড স্টান্ডার্ড ভার্শনের মধ্যে শতশত আয়াত ও হাজার হাজার শব্দের পার্থক্য। একটি সঠিক হলে অন্যটিকে জাল। অথবা সবগুলিই জাল।
(ঘ) কিতাবুল মোকাদ্দসে বারংবার আল্লাহর কিতাবের জালিয়াতির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ভণ্ড নবীগণ বা ভণ্ড শিষ্যগণ আল্লাহর বা মাসীহের নামে জাল কথা প্রচার করবে (মথি ৭/১৫, ২৪/১১, ২৪/২৪, মার্ক ১৩/২২)। সাধু পল লিখেছেন: “আমার আশ্চর্য বোধ হইতেছে যে, খৃস্টের অনুগ্রহে যিনি তোমাদিগকে আহ্বান করিয়াছেন, তোমরা এত শীঘ্র তাঁহা হইতে অন্যবিধ ইঞ্জিলের (unto another gospel) দিকে ফিরিয়া যাইতেছ।” (গালাতীয় ১/৬। আরো দেখুন: ২ করিন্থীয় ১১/৪, গালাতীয় ১/৮-৯) খৃস্টান প্রচারককে বলুন, আল্লাহর নামে যদি জাল কথা বলা ও জাল ইঞ্জিল লেখা অসম্ভব হয় তাহলে ভণ্ড নবী, ভণ্ড খৃস্ট ও জাল ইঞ্জিল কিভাবে হলো?
(ঙ) খৃস্টান প্রচারককে বলুন, সত্যই তো পরিবর্তন ও বৈপরীত্য তো আল্লাহর বিশুদ্ধ কালামের মধ্যে থাকে না। তবে আল্লাহর নামে জাল করা শয়তানী কালামের মধ্যে পরিবর্তন ও স্ববিরোধিতা থাকে। প্রচলিত কিতাবুল মোকাদ্দসের মধ্যে বিদ্যমান স্ববিরোধিতাই প্রমাণ করে যে, তা আল্লাহর কালাম নয়।
- অন্যত্র
আল্লাহ
বলেন:
“আমি
বনী
ইস্রাঈলকে
উৎকৃষ্ট
আবাসভূমিতে
বসবাস
করালাম
এবং
আমি
ওদেরকে
উত্তম
জীবনোপকরণ
দিলাম,
তারপর
ওদের
কাছে
জ্ঞান
আসলে
ওরা
বিভেদ
সৃষ্টি
করল।
ওরা
যে
বিষয়ে
বিভেদ
সৃষ্টি
করেছিল
আপনার
প্রতিপালক
অবশ্যই
তাদের
মধ্যে
কিয়ামতের
দিনে
ওটার
ফয়সালা
করে
দেবেন।
আমি
আপনার
প্রতি
যা
নাযিল
করেছি
তাতে
যদি
আপনার
সন্দেহ
থাকে
তবে
আপনার
আগের
কিতাব
যারা
পাঠ
করে
তাদেরকে
জিজ্ঞেস
করুন;
আপনার
প্রতিপালকের
কাছ
থেকে
আপনার
কাছে
সত্য
এসেছে।
আপনি
কখনো
সন্দেহপ্রবণদের
অন্তর্ভুক্ত
হবেন
না,
এবং
যারা
আল্লাহ্র
নিদর্শন
প্রত্যাখ্যান
করেছে
আপনি
কখনো
তাদের
অন্তর্ভুক্ত
হবেন
না,
তাহলে
আপনি
ক্ষতিগ্রস্তদের
অন্তর্ভুক্ত
হবেন।”
(সূরা
১০-ইউনুস
৯৩-৯৫)
মিশনারিগণ প্রথম ও শেষ বাদ দিয়ে মাঝের অংশটুকু উল্লেখ করে বলেন, কুরআনের বিষয়ে সন্দেহ হলে বাইবেল থেকে সত্য জানতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, কিতাবুল মোকাদ্দস সত্য এবং তা পালন করা জরুরী!
সম্মানিত পাঠক, এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে আল্লাহ প্রত্যেক কুরআন পাঠকারীকে সম্বোধন করে বললেন যে, বনী ইসরাঈল বিষয়ক তথ্যগুলির বিষয়ে কারো সন্দেহ হলে পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলি থেকে যাচাই করতে পার। মহান আল্লাহ কোনো জাতিকে অনুগ্রহসিক্ত করার পরেও যদি তারা অবাধ্য হয় এবং মতভেদ ও হানাহানি করে তবে তাদের কিরূপ শাস্তি হবে তা মুসলিমদের জানা প্রয়োজন, যেন তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামত পাওয়ার পরে অবাধ্যতা ও হানাহানিতে লিপ্ত না হয়। আর এ বিষয়ে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ একটি বিশ্বকোষ! আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে কত প্রকারের নিয়ামত দিয়েছেন, নিয়ামত পাওয়ার পরেও কতভাবে তারা আল্লাহর কিতাবে অবিশ্বাস, কিতাব প্রত্যাখ্যান, সন্দেহ, শির্ক, কুফর, মুর্তিপূজা, পাপাচার ও হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে এবং এর শাস্তিতে কত প্রকারের গযব আল্লাহ তাদের দিয়েছেন তা বিস্তারিত এ গ্রন্থে সংকলিত। এজন্য আল্লাহ বললেন যে, হে কুরআনের পাঠক, যদি তোমার মনে পূর্ববর্তী জাতিদের পরিণতির বিষয়ে কোনো সন্দেহ আগমন করে তবে তুমি পূর্ববর্তী কিতাবগুলি যারা পাঠ করে তাদেরকে প্রশ্ন করলেই জানবে যে, এ বিষয়ে কুরআনের তথ্য নির্ভুল।
সম্মানিত পাঠক, যে কোনো গবেষক যদি বিশ্বসৃষ্টি, পূর্ববর্তী জাতিগণের ইতিহাস ও পরিণতি সম্পর্কে কুরআন মাজীদ অধ্যয়ন করেন এবং বাইবেলের সাথে তা তুলনা করেন তবে নিশ্চিত হবেন যে, কুরআন সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহর কিতাব। ডা. মরিস বুকাইলি (Dr. Maurice Bucaile) রচিত (The Bible, the Qur'an
and the Science ) বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ বইটি পড়লেই তা জানা যায়।
২.৯. কুরআন অবিকৃত অথচ তাওরাত-ইঞ্জিল বিকৃত কিভাবে?
খৃস্টীয় প্রচারকগণ বলেন, কুরআন যেমন লাখলাখ মানুষ পড়ে, বিকৃত করা যায় না, তেমনি তাওরাত-ইঞ্জিলও বিকৃত করা সম্ভব ছিল না। কথাগুলি একেবারে ভিত্তিহীন। কারণ সর্বশেষ ওহী হিসেবে আল্লাহ কুরআনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যা পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলির ক্ষেত্রে করেন নি। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(ক) কুরআন মূলতই লিখিত বই নয় বরং অগণিত মানুষের মুখস্থ বই। অবতরণের শুরু থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণ তা মুখস্থ করেছেন। প্রতি সপ্তাহে, মাসে ও বৎসরে তাহাজ্জুদে, তারাবীহে ও তিলাওয়াতে অগণিতবার খতম করেছেন। সকল যুগেই একই অবস্থা। কুরআনের লিখিতরূপ শুধু সহায়ক মাত্র। পক্ষান্তরে তাওরাত-ইঞ্জিল কখনোই মুখস্থ করা হয়নি এবং মুখস্থ করা সম্ভবও নয়।
(খ) কুরআন প্রথম অবতরণ থেকেই প্রতিটি মুমিনের প্রতিদিনের পাঠ্য বই। প্রতিদিন নিজের নামাযে, জামাতে নামাযে ও সাধারণভাবে প্রত্যেক মুমিন তা তিলাওয়াত করেন বা শুনেন। পক্ষান্তরে তাওরাত-ইঞ্জিল কখনোই সাধারণ মানুষের পাঠ্য বই ছিল না। বরং কতিপয় “ধর্মগুরু” বা “পুরোহিত” বছরে দু-একটি অনুষ্ঠানে বা প্রয়োজনে তা পড়তেন। সাধারণ মানুষের জন্য বাইবেল পাঠ নিষিদ্ধ ছিল। কয়েকশত বৎসর আগেও “বাইবেল” পাঠ করলে আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো।
(গ) মূসা (আ) তাওরাতের একটি মাত্র কপি ‘নিয়ম সিন্দুকের” মধ্যে রেখে গিয়েছেন, প্রতি সাত বৎসর পরপর তা পড়ার জন্য। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর শতবৎসরের মধ্যেই ইয়াহূদীরা তাঁর ধর্ম ত্যাগ করে শির্ক কুফরে লিপ্ত হয়। এভাবে তাওরাতের পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। শতশত বৎসর পরে লোকমুখের প্রচলনে তা লেখা হয়।
(ঘ) যীশুর শিষ্যগণ তাঁর ইঞ্জিল লিখেন নি। কারণ তিনি তাঁদেরকে বলেছিলেন যে, তাঁরা জীবিত থাকতেই কিয়ামত হবে (১৬/২৭-২৮)। শিষ্যগণ এ কথাই বিশ্বাস ও প্রচার করতেন যে, তাঁরা জীবিত থাকতেই কিয়ামত হবে (১ থিষলনীকীয় ৪/১৫-১৭; ১ করিন্থীয় ১৫/৫১-৫২) এজন্য আল্লাহর কালাম লিখতে নিষেধ করা হয়েছে: “আর তিনি আমাকে কহিলেন, তুমি এ গ্রন্থের ভাববাণীর বচন সকল মুদ্রাঙ্কিত করিও না (লিখিও না); কেননা সময় সন্নিকট।” (প্রকাশিত বাক্য ২২/১০-১১)
(ঙ) খৃস্টান গবেষকগণ একমত যে, যীশুর তিরোধানের পরে দুইশত বৎসরের মধ্যে প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির কোনো নামও কোথাও পাওয়া যায় না। এ সময়ে খৃস্টানগণ অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে বিভিন্ন দেশে খৃস্টধর্ম প্রচার করেছেন, কিন্তু কেউই যীশুর ইঞ্জিলের কোনো লিখিত রূপ সংরক্ষণ করেন নি। প্রথম শতাব্দীর মধ্যেই এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে খৃস্টান চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিশপ নিযুক্ত হয়েছে। এ সকল বিশপের অনেক চিঠি ও বই এখনো সংরক্ষিত আছে। কিন্তু সেগুলোতে প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির কোনো নামও উল্লেখ নেই। ২০০ বৎসর পর্যন্ত কোনো চার্চে কোনো ইঞ্জিল শরীফ সংরক্ষিত রাখা বা পঠিত হওয়া তো দূরের কথা এগুলির কোনো উল্লেখই পাওয়া যায় না। অর্থাৎ মথি, মার্ক, লূক ও যোহনের লেখা ইঞ্জিল নামে কোনো পুস্তক যে পৃথিবীতে বিদ্যমান এ কথাটিই ২০০ বছর পর্যন্ত কেউ জানত না। এটি কোনো বিতর্কিত তথ্য নয়, বরং সকল খৃস্টান কর্তৃক স্বীকৃত সত্য।
(চ) এরপর সমাজে অগণিত ইঞ্জিল প্রকাশ পেতে থাকে। যাজকগণ এ সকল ইঞ্জিলের মধ্য থেকে তাঁদের পছন্দসই ইঞ্জিলগুলোকে ‘সঠিক’ (canonical) এবং বাকি ইঞ্জিলগুলোকে “সন্দেহজনক” (non-canonical/ Apocryphal) বলে দাবী করেন। কোনটি সঠিক এবং কোনটি সন্দেহজনক তা নিয়েও তাদের মতভেদের অন্ত নেই। আবার “সঠিক” ইঞ্জিলগুলির পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যেও অগণিত বৈপরীত্য বিদ্যমান।
(ছ) খৃস্টান প্রচারকগণ বলতে চান যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের ৩০ বৎসর পরে উসমান (রা) কুরআন সংকলন করেন। ত্রিশ বৎসরে বিকৃতির সম্ভাবনা ছিল! যাদের ধর্মগ্রন্থ ৩০০ বৎসর পরে সংকলিত তারা ত্রিশ বৎসর নিয়ে চিন্তা করেন! তাদের এ কথা পুরোটাই মিথ্যা। আমরা আগেই বলেছি, কুরআন মূলত মুখস্থ বই। প্রায় সকল মুসলিম তা মুখস্থ রাখতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়েই সাহাবীগণ তা লিখেও রাখতেন। ১১ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পরের বৎসর ১২ হিজরীতে আবূ বকর (রা) কুরআনের লিখিত পাণ্ডুলিপি সংকলন করে রাখেন। যখন ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিসর বিভিন্ন দেশের অগণিত মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন তখন নতুন মুসলিমদের জন্য লিখিত কুরআনের প্রয়োজন হতো। অনেকে নিজের ইচ্ছামত কারো মুখে শুনে কুরআন লিখতে শুরু করেন। এতে ভুল পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এজন্য ২৩ হিজরী সালে, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের ১২ বৎসরের মাথায় উসমান (রা) খলীফা হওয়ার পরে আবূ বকর (রা)-এর পাণ্ডুলিপিটিকে কয়েকটি কপি করে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র প্রেরণ করেন।
(জ) খৃস্টানগণ বলেন, উসমানের (রা) সময়ে কুরআনের এক কপি রেখে অন্যান্য কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়; কাজেই কুরআনের বিকৃতির সম্ভাবনা আছে। আপনি বলুন, বর্তমানে যদি কুরআনের সবকপি পুড়িয়ে ফেলা হয় তাহলে কি কুরআন বিকৃত হবে? না হাফিযগণ অবিকৃতভাবেই তা তিলাওয়াত করবেন? বর্তমান সময়ের চেয়ে সাহাবীদের যুগে কুরআন মুখস্থ করার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। হাজার হাজার হাফিয সাহাবী-তাবিয়ী মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে ছিলেন। আরবী লিখনপদ্ধতির ভুলে যেন লিখিত কুরআনের মধ্যে কোনো ভুল ঢুকে না পড়ে এজন্য উসমান (রা) আবূ বকর (রা)-এর সংকলিত পাণ্ডুলিপিটির কয়েকটি কপি সর্বত্র প্রেরণ করেন এবং নির্দেশ দেন যে, এ পাণ্ডুলিপির সাথে যে সকল লিখিত কুরআনের মিল হবে না, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে, যেন অ-হাফিয সাধারণ মুসলিম ভুল পড়া থেকে রক্ষা পান।
No comments