ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ অধ্যায়-০৩ -বিভ্রান্তির তাত্ত্বিক পর্যালোচনা -অনুচ্ছেদ ৩১-৫৪
৩. ১০. ১. মুসলিম সমাজে রাষ্ট্র সংস্কারে হাদীসের নির্দেশনা
আমরা দেখেছি যে, সমকালীন মুসলিম রাষ্ট্রগুলি উমাইয়া, আববাসী, ফাতিমী, বাতিনী ইত্যাদি মুসলিম রাষ্ট্রের মতই পাপে লিপ্ত মুসলিম রাষ্ট্র। এ সকল রাষ্ট্রে দীনের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় রাষ্ট্রীয় পাপ, অনাচার, অবিচার ও ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আপত্তি ও প্রতিবাদ করা এবং এগুলো দূর করার দাওয়াত দেওয়া দীন প্রতিষ্ঠার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাশাপাশি এ সকল রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রাখা ও আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখাও দীন প্রতিষ্ঠার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ বিষয়ে অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন। ইতোপূর্বে আনুগত্য, জামা‘আত, বাই‘আত ইত্যাদি প্রসঙ্গে এ বিষয়ক কয়েকটি হাদীস আমরা উল্লেখ করেছি।
(১) ‘‘কেউ তার শাসক বা প্রশাসক থেকে কোন অপছন্দনীয় বিষয় দেখলে তাকে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। কারণ যদি কেউ জামা‘আত (মুসলিম সমাজ বা রাষ্টের ঐক্য)-এর বাইরে এক বিঘতও বের হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’
(২) ‘‘যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে বের হয়ে এবং ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যু বরণ করল সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’
(৩) ‘‘যে ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় আনুগত্য থেকে নিজেকে বের করে নিল কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হলে সে নিজের জন্য কোন ওজর পেশ করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল যে, তার গলায় কোন ‘বাই‘আত’ বা রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের অঙ্গীকার নেই সে ব্যক্তি জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’
(৪) ‘‘অচিরেই তোমাদের উপর অনেক শাসক-প্রশাসক আসবে যারা ন্যায় ও অন্যায় উভয় প্রকারের কাজ করবে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায়কে ঘৃণা করবে সে অন্যায়ের অপরাধ থেকে মুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি আপত্তি করবে সে (আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে) নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে এ সকল অন্যায় কাজ মেনে নেবে বা তাদের অনুসরণ করবে (সে বাঁচতে পারবে না।)’’ সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বলেন, ‘‘না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করবে।’’
(৫) ‘‘হুশিয়ার থাকবে! তোমাদের কারো উপরে যদি কোনো শাসক-প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং সে দেখতে পায় যে, উক্ত শাসক-প্রশাসক আল্লাহর অবাধ্যতার কোনো কাজে লিপ্ত হচ্ছেন, তবে সে যেন আল্লাহর অবাধ্যতার উক্ত কর্মকে ঘৃণা করে, কিন্তু আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে না নেয়।’’
(৬) ‘‘যখন তোমরা তোমাদের শাসক-প্রশাসকগণ থেকে এমন কিছু দেখবে যা তোমরা অপছন্দ কর, তখন তোমরা তার কর্মকে অপছন্দ করবে, কিন্তু তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিবে না।’’
(৭) ‘‘ভবিষ্যতে অনেক বিচ্যুতি-অন্যায় সংঘটিত হবে। যদি এমন ঘটে যে, এ উম্মাতের ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় কেউ এসে সে ঐক্য বিনষ্ট করে বিভক্তি সৃষ্টি করতে চায় তবে সে যেই হোক না কেন তোমরা তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবে। অন্য বর্ণনায়: তোমাদের বিষয়টি একব্যক্তির বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় (একজন্য রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে থাকা অবস্থায়) কোনো একব্যক্তি যদি এসে তোমাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে বা ‘জামাআত’ বিভক্ত করতে চায় তবে তাকে হত্যা করবে।’’
(৮) ‘‘যদি দুজন খলীফার বাইয়াত করা হয় তবে যে পরে বাইয়াত নিয়েছে তাকে হত্যা করবে।’’
(৯) আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:
على المرءِ المسلمِ السمْعُ والطاعةُ . فيما أحبّ وكَرِهَ . إلا أن يُؤْمَرَ
بمعصيةٍ . فإن أُمِرَ بمعصيةٍ ، فلا سَمْع ولا طاعَةَ
‘‘মুসলিমের দায়িত্ব রাষ্ট্রের আনুগত্য করা, তার পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় সকল বিষয়ে, যতক্ষণ না কোনো পাপের নির্দেশ দেওয়া হয়। যদি কোনো পাপের নির্দেশ দেওয়া হয় তবে সে বিষয়ে কোনো আনুগত্য নেই।’’[1]
(১০) অন্য হাদীসে উবাদা ইবনুস সামিত বলেন:
على المرء المسلم
بايعْنا رسولَ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ
على السمعِ والطاعةِ . في العُسرِ واليُسرِ . والمَنشطِ والمَكرهِ . وعلى أَثَرةٍ
علينا . وعلى أن لا ننازعَ الأمرَ أهلَه . وعلى أن نقولَ بالحقِّ أينما كنّا . لا
نخافُ في اللهِ لومةَ لائمٍ (في لفظ: وأن لا تنازع الأمر أهله قال الا أن تروا
كفراً بواحاً عندكم من الله برهان)
‘‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর বাইয়াত করলাম যে, আমরা কষ্টে ও আরামে, উদ্দীপনায় ও আপত্তিতে এবং আমাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হলেও রাষ্ট্রের আনুগত্য করব, রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্তদের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব না এবং আল্লাহর বিষয়ে কারো নিন্দা-আপত্তির ভয়-তোয়াক্কা না করে যেখানেই থাকি না কেন হক্ক কথা বলব। অন্য বর্ণনায়: আমরা ক্ষমতাপ্রাপ্তদের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করব না, তবে তিনি বলেন: তোমরা যদি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাতীত কুফর দেখতে পাও, যে বিষয়ে তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে (তবে সেক্ষেত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্তরা তাদের এ অধিকার হারাবে)।’’[2]
(১১) হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান বলেন,
قلتُ : يا رسولَ اللهِ ! إنا كنا بشرٌ . فجاء
اللهُ بخيرٍ . فنحن فيه . فهل من وراءِ هذا الخيرِ شرٌّ ؟ قال ( نعم ) قلتُ : هل
من وراءِ ذلك الشرِّ خيرٌ ؟ قال ( نعم ) قلتُ : فهل من وراءِ ذلك الخيرِ شرٌّ ؟
قال ( نعم ) قلتُ : كيف ؟ قال ( يكون بعدي أئمةٌ لا يهتدون بهدايَ ، ولا يستنُّون
بسُنَّتي . وسيقوم فيهم رجالٌ قلوبُهم قلوبُ الشياطينِ في جُثمانِ إنسٍ ) قال قلتُ
: كيف أصنعُ ؟ يا رسولَ اللهِ ! إن أدركت ُذلك ؟ قال تسمعُ وتطيع للأميرِ . وإن
ضَرَب ظهرَك . وأخذ مالَك . فاسمعْ وأطعْ
‘‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা মন্দ অবস্থায় ছিলাম, এরপর আল্লাহ ভাল অবস্থা প্রদান করলেন, যার মধ্যে আমরা এখন রয়েছি। এরপর কি আবার মন্দ রয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, সে মন্দের পরে কি আবার ভাল রয়েছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। আমি বললাম, সে ভালর পরে কি আবার মন্দ রয়েছে? তিনি বলেন: হ্যাঁ। আমি বললাম, তা কেমন? তিনি বলেন, আমার পরে এমন অনেক শাসক হবে যারা আমার আদর্শ গ্রহণ করবে না এবং আমার রীতি পালন করবে না। তাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ থাকবে যাদের অন্তর হলো মানব দেহের মধ্যে শয়তানের অন্তর। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমি যদি এরূপ অবস্থায় পড়ি তাহলে কী করব? তিনি বলেন: তুমি শাসকের কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে, যদিও তোমার পৃষ্ঠদেশে আঘাত করা হয় এবং তোমার সম্পদ কেড়ে নেয়া হয় তবুও তুমি কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে।’’[3]
(১২) আবূ যার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে বলেন:
كيف أنت إذا كانت عليك أمراءُ يُؤخِّرونَ الصلاةَ عن وقتِها ، أو يُميتونَ الصلاةَ
عن وقتِها ؟ قال قلتُ : فما تأمرني ؟ قال صَلِّ الصلاةَ لوقتِها . فإن أدركتَها
معهم فصلِّ . فإنها لكَ نافلةً
‘‘যখন তোমার উপর এমন শাসক-প্রশাসকগণ থাকবে যারা সালাতকে তার সময়ের পরে আদায় করবে বা সালাতকে তার সময়ের পরে নিয়ে হত্যা করবে তখন তোমার কী অবস্থা হবে? আমি বললাম, আপনি আমাকে এমতাবস্থায় কী করতে নির্দেশ দেন? তিনি বলেন: তুমি ওয়াক্ত অনুসারে সালাত আদায় করবে। এরপর যদি তাদের সাথে সালাত পাও তাহলে তাদের সাথে তা আদায় করবে; আর তা তোমার জন্য নফল বলে গণ্য হবে।’’[4]
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, শাসক-প্রশাসকগণ যদি জাগতিক বা ধর্মীয় অপছন্দনীয় ও অন্যায় কর্মকান্ডে লিপ্ত হন তবে তাদের অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা, আপত্তি ও প্রতিবাদ সহ তাদের আনুগত্য ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস হাদীসগ্রন্থগুলি সংকলিত রয়েছে। সহীহ মুসলিমের ‘‘কিতাবুল ইমারাত’’ পাঠ করলে পাঠক এ বিষয়ক আরো অনেক হাদীস জানতে পারবেন। মূলত এ সকল হাদীস এ বিষয়ক কুরআনী নির্দেশনার ব্যাখ্যা। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا
اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ
فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ
بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, এবং আনুগত্য করা রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও; যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের উপর ঈমান রেখে থাক। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।’’[5] এ আয়াতে আল্লাহ তাঁর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর ‘‘উলিল আমর’’-এর আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। আরবীতে ‘‘উলূ’’ বা ‘‘উলী’’ শব্দের অর্থ মালিকগণ বা অধিকারিগণ। আর ‘‘আমর’’ অর্থ আদেশ। ‘‘উলুল আমর’’ অর্থ আদেশের মালিকগণ।
‘‘উলূল আমর’’ বা আদেশের মালিকগণ বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে তিনটি মত রয়েছে: (১) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মালিকগণ, (২) আলিম ও ফকীহগণ ও (৩) সাহাবীগণ। নিঃসন্দেহে আলিমগণ ও সাহাবীগণের অনুসরণ ও আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে ‘‘আদেশের মালিকানা’’ মূলত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারীদের; কারণ তারাই মূলত আদেশের মালিক, যাদের আদেশ পালন করতে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয় এবং যাদের আদেশ পালন না করলে অশান্তির সৃষ্টি হয়। এজন্য ইমাম তাবারী বলেন:
وأولى الأقوال في ذالك بالصواب، قول من قال: هم الأمراء والولاة، لصحة الأخبار عن
رسول الله صلى الله عليه وسلم بالأمر بطاعة الأئمة والولاة فيما كان [الله] طاعة،
وللمسلمين مصلحة
‘‘সঠিক মত হলো, যে ‘‘উলুল আমর’’ বা আদেশের মালিকগণ বলতে রাষ্ট্রীয় শাসক-প্রশাসকগণকে বুঝানো হয়েছে। কারণ বিভিন্ন সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে এবং মুসলিম সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্রপ্রধান, ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের আনুগত্য করতে নির্দেশ দিয়েছেন।’’[6] অর্থাৎ যারা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী বা মালিক তাদের নির্দেশ মান্য করা ও আনুগত্য করা মুমিনের দীনী দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের বিভিন্ন দিক উপরের হাদীসগুলিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইমাম তাবারী ও অন্যান্য মুফাস্সির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ও এ প্রসঙ্গে উপরের হাদীসগুলি ও সমার্থক অন্যান্য হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমাদের সমাজে অনেকে মনে করেন, খিলাফতে রাশেদার মত ‘‘ইসলামী রাষ্ট্রের’’ ক্ষেত্রেই এ আয়াত ও এ সকল হাদীস প্রযোজ্য, আমাদের মত রাষ্ট্রে সেগুলি প্রযোজ্য নয়। ধারণাটি সঠিক নয়; কারণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরূপ কোনো শর্ত আরোপ করেন নি।
বস্ত্তত এ হাদীসগুলি খিলাফাতে রাশেদার মত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বলা হয় নি। কারণ তাদের সময়ে শাসকগণ পাপ, অন্যায় বা ইসলাম বিরোধিতায় লিপ্ত হন নি। তাদের যুগে সালাত হত্যা করা হয় নি এবং মানুষের খোলসে শয়তানের অন্তর বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের আবির্ভাব হয় নি। এগুলি সবই পরবর্তী যুগের জন্য বলা হয়েছে। সাহাবীগণ ও পরবর্তী আলিমগণ উমাইয়া, আববাসী, ফাতিমী, বাতিনী, শিয়া, রাফিযী, মোগল, তাতার ও অন্যান্য সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই এ সকল নির্দেশ প্রযোজ্য বলে গণ্য করেছেন। আর সমকালীন মুসলিম দেশগুলি এ সকল রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছুই নয়। এ সকল রাষ্ট্রেও উপরের হাদীসগুলি ও সমার্থক হাদীসগুলির সামগ্রিক শিক্ষার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এ সকল হাদীসের আলোকে আমরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা রাষ্ট্র-সংস্কারের বিষয়ে কয়েকটি মূলনীতি লাভ করি:
(১) রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখা
উপর্যুক্ত সকল হাদীসের নির্দেশনা যে, মুসলিম সমাজে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে এবং মুমিনকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে। এ সকল হাদীসের আলোকে আলিমগণ বলেছেন যে, মুসলিম সমাজে ‘ইমাম নিয়োগ’ বা ‘খলীফা নিয়োগ’ ‘‘ফরয কিফায়া’’। এখানে ইমাম বা খলীফা বলতে রাষ্ট্রপ্রধান বুঝানো হয়েছে। এ রাষ্ট্রপ্রধানকে ইমাম, খলীফা, রাজা, সম্রাট, আমীরুল মুমিনীন, প্রেসিডেন্ট, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন, রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখা মুসলিম সমাজের উপর ফরয কিফায়া এবং রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রের আনুগত্য করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয আইন।[7]
(২) বাইয়াত, জামাআত ও তাআত
রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক। তার আনুগত্যের প্রতীক ‘‘বাইয়াত’’। মুমিনকে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের অঙ্গীকার বহন করতে হবে। সকল পরিস্থিতিতে ‘‘জামাআত’’ বা রাষ্ট্রীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ বা সংখ্যগারিষ্ট নাগরিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বা মেনে নিলে নিজের ব্যক্তিগত, দলগত বা গোষ্ঠীগত মতামত বর্জন করে রাষ্ট্র ও সমাজের ঐক্য বজায় রাখতে হবে। বাইয়াত ও জামাআতের পাশাপাশি ‘তা‘আত’ বা আনুগত্য বজায় রাখতে হবে। শাসক-প্রশাসকদের আনুগত্য ইসলাম নির্দেশিত দায়িত্ব। সরকারের জুলুম, অন্যায় বা পাপের কারণে আনুগত্যের এ দায়িত্ব রহিত হয় না। যে নির্দেশ বা আইন পাপ নয় তা মান্য করা মুমিনের দীনী দায়িত্ব।
(৩) পাপে ঐক্য বা আনুগত্য নেই
যে বিষয় কুরআন-হাদীস দ্বারা নিষিদ্ধ নয় এরূপ বিষয়েই ঐক্য ও আনুগত্যের বিধান। রাষ্ট্র যদি কোনো পাপের নির্দেশ দেয় তাহলে সে নির্দেশ মান্য করা বা সে বিষয়ে আনুগত্য করা মুমিনের জন্য নিষিদ্ধ। পাপের নির্দেশ মুমিন পালন করেন না। আবার পাপের নির্দেশের কারণে অন্যান্য সাধারণ বিধান ও আইন অমান্য করেন না।
(৪) ঘৃণা, আপত্তি বনাম স্বীকৃতি
রাষ্ট্র, রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার বা শাসক-প্রশাসকের পাপের ক্ষেত্রে মুমিনের দায়িত্ব ঘৃণা ও আপত্তি। শাসক-প্রশাসকদের পাপ দুপ্রকারের: তাদের জীবনের ব্যক্তিগত পাপ এবং পাপের নির্দেশনা বা পাপনির্ভর আইন, নীতি বা বিধান প্রণয়ন। সকল ক্ষেত্রে মুমিনের ন্যূনতম দায়িত্ব পাপকে ঘৃণা করা। এরপর মুমিন সাধ্যমত আপত্তি ও প্রতিবাদ করবেন। এরূপ পাপ মেনে নেওয়া, স্বীকৃতি দেওয়া, পাপের বিষয়ে তাদের অনুসরণ করা বা এর পক্ষে অবস্থান নেওয়া মুমিনের জন্য নিষিদ্ধ।
পাপের ঘৃণা, আপত্তি বা প্রতিবাদের অর্থ অন্যান্য বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রেখে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার মধ্যে ঘৃণা, আপত্তি ও প্রতিবাদ জানানো। অনেক সময় আবেগী মুমিন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, শৃঙ্খলা ভঙ্গ, আইন অমান্য, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বা অনুরূপ অন্যায় ও পাপে লিপ্ত হয়। খারিজীগণ ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের নামে এরূপ অন্যায়ে লিপ্ত হতো। সাহাবীগণ তাদেরকে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য ও আইন পালনের কথা বললে আপত্তি করত। এক ঘটনায় কতিপয় খারিজী হুযাইফা (রা)-কে বলে, আমরা কি ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে পারব না?! আপনি কি তা করবেন না?! তিনি বলেন:
ألا إن الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر لحسن ولكن ليس من السنة أن ترفع السلاح
على إمامك
‘‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ নিঃসন্দেহে ভাল কাজ। তবে তোমার রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে বা তার নির্দেশের বাইরে অস্ত্রধারণ, বলপ্রয়োগ বা বিদ্রোহ করা সুন্নাত সম্মত নয়।’’[8] উপরের মূলনীতিগুলির আলোকে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিষয়টি ভালভাবে উপলব্ধি করতে আমাদেরকে এ বিষয়ে সাহাবী-তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগগুলির প্রসিদ্ধ আলিম, ইমাম, পীর-মাশাইখ ও সংস্কারকগণের কর্মধারা পর্যালোচনা করতে হবে। সেজন্য মহান আল্লাহর নিকট তাওফীক প্রাথনা করছি।
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৬৯।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৮৮, ২৬৩৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৭০।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৭৬।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৪৮।
[5] সূরা (৪) নিসা: আয়াত ৫৯।
[6] তাবারী, তাফসীর (শামিলা) ৮/৫০২।
[7] বিস্তারিত দেখুন: আবদুল্লাহ ইবনু উমার দুমাইজী, আল-ইমামাতুল উযমা, পৃ. ৪৫-৭৫।
[8] ইবনু আবী শায়বা (২৩৫ হি.), আল-মুসান্নাফ ৭/৫০৮; বাইহাকী, আহমাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি.), শু’আবুল ঈমান, ৬/৬৩; দানী, আস-সুনানুল ওয়ারিদাতুল ফিল ফিতান, ২/৩৯১।
৩. ১০. ২. সাহাবী ও পরবর্তীদের কর্মধারা
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, খিলাফতে রাশিদার পর থেকে সকল ইসলামী রাষ্ট্রেই রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামী বিধিবিধানের কমবেশি লঙ্ঘন ঘটেছে। শাসক নির্বাচন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের পরামর্শ গ্রহণ, জনগণের নিকট জবাবদিহিতা, মানবাধিকার, আমানত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, নিরপেক্ষভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আইন প্রয়োগ ইত্যাদি অগণিত ইসলামী নির্দেশনা কম বা বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে এসকল রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসকগণ নিজেদেরকেই আইন বা আইনদাতা বলে মনে করেছেন। কুরআনী বিধিবিধান ও আইনকে বেপরোয়াভাবে অবহেলা করেছেন। এমনকি সালাতের সময়ও পদ্ধতিও পরিবর্তন করা হয়েছে।
এ সকল পরিস্থিতিতে সাহাবীগণ কিভাবে সংস্কার, প্রতিবাদ ও দীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেছেন তা আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ কুরআন-সুনণাহর নির্দেশনা অনুধাবনে ও পালনে তাঁরা উম্মাতের অনুকরণীয় আদর্শ। মহান আল্লাহ বলেন:
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ
الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ
اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا
الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
‘‘মুহাজির ও আনসারদিগের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছেন, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। এ মহাসাফল্য।’’[1]
এখানে মুমিনগণকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে: (১) প্রথম অগ্রগামী মুহাজিরগণ ও আনসারগণ এবং (২) তাঁদের পরবর্তীগণ। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, প্রথম ভাগের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তাদের জন্য জান্নাত প্রস্ত্তত করেছেন। আর দ্বিতীয় ভাগের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের পূর্বশত প্রথম শ্রেণীর সাহাবীগণকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করা। এভাবে আমরা দেখছি যে, অগ্রগামী মুহাজির ও আনসারগণের অনুসরণ সফলতার মাপকাঠি। তাদের অনুসরণের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে ছিলেন তাদের সমসাময়িক অন্যান্য সাহাবী। এরপর তাবিয়ী-তাবি-তাবিয়ীগণ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর উম্মাতকে তাঁর সাহাবীদের জীবন পদ্ধতি ও মতামতের উপর নির্ভর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي
فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ
الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا
بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ
بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। এক্ষেত্রে তোমাদের দায়িত্ব আমার সুন্নত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা। তোমরা দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে ধরবে, কোনো প্রকারেই তার বাইরে যাবে না। আর তোমরা (আমার ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের বাইরে) নতুন উদ্ভাবিত সকল বিষয় সর্বতোভাবে পরিহার করবে; কারণ সকল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদ‘আত এবং সকল বিদ‘আতই বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা।’’[2]
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদেরকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে মতবিরোধ সম্পর্কে সতর্ক করেন। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন, এক্ষেত্রে কোন্ দল সঠিক বলে গণ্য হবে? তিনি বলেন:
ما انا عليه (اليوم) واصحابى
‘‘আমি এবং আমার সাহাবী-সঙ্গীরা বর্তমানে যে মত ও পথের উপর আছি সেই মত ও পথের উপর যারা থাকবে তারাই সুপথপ্রাপ্ত।’’[3] সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী- এ তিন প্রজন্মের মানুষদের ধার্মিকতার প্রশংসা করেছেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। ইমরান ইবনু হুসাইয়িন (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
خيرُ أُمَّتِي قَرْنِي (الذى بعثت فيهم) ثُمَّ الذين يَلُونَهُمْ ثمَّ الذين
يَلُونَهُمْ
‘‘আমার উম্মতের সবচেয়ে ভালো যুগ আমার যুগ, যে যুগের মানুষের মধ্যে আমি প্রেরিত হয়েছি (অর্থাৎ সাহাবীগণ), আর তাদের পরে সবচেয়ে ভালো তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ (অর্থাৎ তাবিয়ীগন), আর এর পর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ (অর্থাৎ তাবি তাবিয়ীগণ)’’।[4]
এ অর্থে আবূ হুরাইরা, বুরাইদা আসলামী, নু’মান ইবনু বাশীর (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী থেকে পৃথক পৃথক সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো হাদীসে সাহাবীগণের পরে তিন প্রজন্মের কথা বলা হয়েছে।[5]
এজন্য কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা সঠিক অনুধাবন ও বাস্তবায়নের জন্য আমাদেরকে সাহাবীগণের কর্মধারা এবং তৎপরবর্তী তিন প্রজন্মের কর্মধারা বিবেচনা করতে হবে। উমাইয়া যুগে সাহাবীগণ রাষ্ট্র ও সরকারের এরূপ বিচ্যুতি প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু কখনোই তারা এ কারণে ‘রাষ্ট্র’ বা সরকারকে কাফির বা অনৈসলামিক বলে গণ্য করেন নি। বরং তাঁরা সাধ্যমত এদের অন্যায়ের আপত্তি জ্ঞাপন-সহ এদের আনুগত্য বহাল রেখেছেন। এদের পিছনে সালাত আদায় করেছেন এবং এদের নেতৃত্বে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন।
পরবর্তীকালেও কোনো ইমাম, ফকীহ বা আলিম এ কারণে এ সকল রাষ্ট্রকে ‘দারুল হরব’ বা ‘কাফির রাষ্ট্র’ বলে মনে করেন নি। তারা সাধ্যমত সংশোধন ও পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য ও সংহতি বজায় রেখেছেন।[6] তাঁরা সর্বদা শান্তিপূর্ণ পন্থায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে উৎসাহ দিতেন এবং জিহাদ বা আদেশ-নিষেধের নামে অস্ত্রধারণ, আইন-লঙ্ঘন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার উস্কানি ইত্যাদি নিষেধ করতেন। এ বিষয়ে তাঁদের অগণিত নির্দেশনা হাদীসগ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়েছে।[7] সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগে কখনো কখনো তাঁদের কেউ কেউ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তবে তা রাষ্ট্রকে কাফির মনে করে বা ‘‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য নয় বরং অন্যান্য পারিপার্শিক কারণে তা ঘটেছে।
[1] সূরা (৯) তাওবা: ১০০ আয়াত।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৪৪; আবু দাউদ, আস-সুনান ৪/২০০; ইবনু মাজাহ ১/১৫। তিরমিযী বলেন হাদিসটি হাসান সহীহ।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮; মাকদিসী, আল-আহাদীস আল-মুখতারাহ ৭/২৭৮; আলবানী সহীহু সুনানিত তিরমিযী ৬/১৪১ নং ২৬৪১।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩৩৫।
[5] ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, বুহুসুন ফী উলূমিল হাদীস, পৃ. ৩০-৩২।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৩৪, ২৬৫৪; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৬৯; ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩৭৯-৩৮৮।
[7] ইভবু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৭/৫০৮; দানী, আস-সুনানুল ওয়ারিদাতু ২/৩৮৮-৪০৫।
৩. ১০. ২. ১. যুদ্ধ বনাম সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা
কুরআন-হাদীসের উপরে আলোচিত নির্দেশাবলির আলোকে সাহাবী-তবিয়ীগণ ও তৎপরবর্তী যুগের আলিমগণ সরকার পরিবর্তনের নামে বিদ্রোহ, আইন অমান্য, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ও রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বর্জন নিষিদ্ধ বলে গণ্য করতেন।
সাধারণভাবে এ মূলনীতির বিষয়ে সকলে একমত হলেও, প্রথম যুগের কয়েকটি যুদ্ধ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এগুলি হলো, সাহাবীগণের যুগে আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে তালহা, যুবাইর, আয়েশা ও মুআবিয়া (রাঃ)-এর যুদ্ধ, ইয়াযিদের বিরুদ্ধে হুসাইন (রা)-এর যুদ্ধ এবং মারওয়ান ও আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রা)-এর যুদ্ধ। তাবিয়ী ও তাবিতাবিয়ীগণের যুগে আব্দুল মালিকের (খিলাফাত ৬৫-৮৬) বিরুদ্ধে আব্দুর রাহমান ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুল আস‘আসের (৮৫ হি) বিদ্রোহে তাবিয়ী সাঈদ ইবনু জুবাইর (৯৪হি) ও অন্যান্য কতিপয় তাবিয়ীর অংশগ্রহণ, উমাইয়া খলীফাদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইনের পৌত্র যাইদ ইবনু আলীর (১২২ হি) যুদ্ধ, এবং আববাসী খলীফা মানসূরের বিরুদ্ধে আলী (রা)-এর বংশধর, ‘নাফস যাকিয়্যাহ’ নামে পরিচিত প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ (৯২-১৪৭ হি)-এর বিদ্রোহ।
লক্ষণীয় যে, সাহাবীগণের যুগের যুদ্ধগুলি কোনোটিই ‘‘সরকার পরিবর্তনের জন্য’’ বিদ্রোহ ছিল না এবং তারা ‘‘সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বা কর্তৃত্বের স্বীকৃতি দেওয়ার’’ পরে সরকার পরিবর্তনের জন্য বিদ্রোহ বা যুদ্ধ করেন নি। মূলত এগুলি ছিল সরকারের কর্তৃত্ব স্বীকারের আগে তার কাছে শরীয়ত নির্দেশিত দাবি-দাওয়া পেশ করতে যেয়ে অনিচ্ছাকৃত যুদ্ধ, অথবা দুপক্ষেরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের দাবির কারণে।
আলী (রা)-এর সাথে তালহা, যুবাইর, আয়েশা ও মুআবিয়া (রাদিয়ালাহু আনহুম)-এর যুদ্ধ ছিল উসমান (রা)-এ হত্যাকারীদের বিচারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। আমরা খারিজী সম্প্রদায়ের আলোচনায় বিষয়টি উল্লেখ করেছি। হাদীস ও ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, আলীর বিরোধীরা সরকার অপসারণ বা ক্ষমতা দখলের জন্য যুদ্ধ করেন নি। উপরন্তু উভয় পক্ষ যুদ্ধ বর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল যুদ্ধের সময়ে বিবাদমান পক্ষগুলি শান্তি আলোচনা করে তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অতর্কিতে উভয় শিবিরের উপর হামলা শুরু হয়। উভয় পক্ষই মনে করেন যে, অপরপক্ষ বিশ্বাসঘাতকতা করে আক্রমন করেছে। এতে প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ঐতিহাসিকগণ এ সকল যুদ্ধের মধ্যে ইহূদীদের ষড়যন্ত্র ও দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিমদের আবেগ ও হটকারিতার কথা উল্লেখ করেছেন। এ সকল কারণে তৎকালীন পরিবেশে তারা যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হন নি।
ইয়াযিদের বিরুদ্ধে হুসাইন (রা) যুদ্ধাভিযান চালান নি। মুআবিয়া (রা) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দেন। ৬০ হিজরী সালে তাঁর মৃত্যুর পরে ইয়াযিদ খিলাফতের দাবি করলে তৎকালীন মুসলিম রাষ্ট্রের অধিকাংশ এলাকার মানুষ তা মেনে নেন। পক্ষান্তরে মদীনার অনেক মানুষ, ইরাকের মানুষ এবং বিশেষত কুফার মানুষেরা তা মানতে অস্বীকার করেন। কুফার মানুষেরা ইমাম হুসাইনকে (রা) খলীফা হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ সময়ে ইমাম হুসাইন (রা) মদীনায় অবস্থান করছিলেন। এরপর তিনি মদীনা থেকে মক্কায় আগমন করেন।
কুফার লক্ষাধিক মানুষ তাঁকে খলীফা হিসাবে বাইয়াত করে পত্র প্রেরণ করে। তারা দাবি করে যে, সুন্নাত পুনরুজ্জীবিত করতে ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে অবিলম্বে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রয়োজন। মদীনা ও মক্কায় অবস্থানরত সাহাবীগণ ও ইমাম হুসাইনের প্রিয়জনেরা তাকে কুফায় যেতে নিষেধ করেন। তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন যে, ইয়াযিদের পক্ষ থেকে বাধা আসলে ইরাকবাসীরা হুসাইনের পিছন থেকে সরে যাবে। সবশেষে হুসাইন (রা) কুফা গমনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কোনো সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা করেন নি। তিনি তাঁর পরিবারের ১৯ জন সদস্যসহ প্রায় ৫০ জন সঙ্গী নিয়ে কুফায় রওয়ানা হন। তিনি কুফাবাসীর বাইয়াতের ভিত্তিতে বৈধ শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে কুফা যাচ্ছিলেন।
ইমাম হুসাইনের আগমনের আগেই ইয়াযিদের বাহিনী কুফায় আগমন করে এবং কুফাবাসী হুসাইনের সমর্থন থেকে পিছিয়ে যায়। কুফার একটি বাহিনী কারবালার প্রান্তরে হুসাইনকে (রা) অবরোধ করে। হুসাইন (রা) তাদেরকে বলেন, আমি তো যুদ্ধ করতে আসি নি। তোমরা আমাকে ডেকেছ বলেই আমি এসেছি। এখন তোমরা কুফাবাসীরাই তোমাদের বাইয়াত ও প্রতিজ্ঞা পরিত্যাগ করেছ। তাহলে আমাদেরকে ছেড়ে দাও আমরা মদীনায় ফিরে যাই, অথবা সীমান্তে যেয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি, অথবা সরাসরি ইয়াযিদের কাছে যেয়ে তার সাথে বুঝাপড়া করি। কিন্তু কুফার বাহিনী এতে সম্মত না হয়ে তারা হুসাইনের পরিবার ও সাথীদের উপর হামলা চালায় ও তাঁকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করে। ৬৪ হিজরী সালে ইয়াযিদের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পরে মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রা) নিজেকে খলীফা হিসেবে ঘোষণা দেন। অধিকাংশ মুসলিম তাঁর বাইয়াত গ্রহণ করেন। ৭৩ হিজরী পর্যন্ত প্রায় ১০ বৎসর তিনি এভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
এ সময়ে ইয়াযিদের পরে তার পুত্র মুআবিয়া কয়েক দিনের জন্য এবং তারপর মারওয়ান ইবনু হাকাম এক বৎসর সিরিয়ায় শাসক হিসেবে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ৬৫ সালে মারওয়ানের মৃত্যুর পরে তার পুত্র আব্দুল মালিক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এ সময়ে ক্ষমতার উভয় দাবিদারের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। একপর্যায়ে ৭৩ হিজরীতে আব্দুল মালিকের বাহিনী আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরকে পরাজিত ও নিহত করতে সক্ষম হয়।
এভাবে আমরা দেখছি যে, ইমাম হুসাইন (রা) ও আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রা)-এর সময়ে মুসলিম সমাজ দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হয়। তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের যুগের যুদ্ধগুলিও কোনো সুপরিকল্পিত বিদ্রোহ বা ‘ধর্মদ্রোহিতার প্রতিবাদে দীন প্রতিষ্ঠার’ চেষ্টা ছিল ন। কখনো পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে, কখনো শাসকের অত্যাচারে হয়ে বাধ্য হয়ে এবং কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় নিজের অধিকারকে বৈধ মনে করে এ সকল যুদ্ধ হয়েছে। এগুলিতে অতি সামান্য সংখ্যক প্রসিদ্ধ আলিম জড়িত হয়েছেন বা সমর্থন করেছেন। তারা তা করেছেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আন্তরিকতা বা ব্যক্তিগত ইজতিহাদের কারণে। কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও অধিকাংশ সাহাবী-তাবিয়ীর মত ও কর্মের বিপরীতে এগুলিকে দীনের প্রামাণ্য দলীল হিসেবে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। এখানে কয়েকটি বিষয় আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার:
প্রথমত, মুসলিম উম্মাহর ইমাম ও ফকীহগণ বারংবার উল্লেখ করেছেন যে, কোনো বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলে সে বিষয়ে কোনো আলিম বা বুজুর্গের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা ইজতিহাদ আর প্রামাণ্য দলীল হিসেবে গণ্য হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে আলিম-বুজৃর্গের কর্ম তাঁদের ব্যক্তিগত ইজতিহাদ হিসেবে গণ্য হয়, ভুল হলে তা অনিচ্ছাকৃত ইজতিহাদী ভুল বলে গণ্য হয় এবং কুরআন বা হাদীসের মূল নির্দেশনার উপর নির্ভর করতে হয়। এ বিষয়ে আমি ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[1]
দ্বিতীয়ত, সাহাবী-তাবিয়ীগণের কর্মের ক্ষেত্রে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোনো মত বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তবে তার বিপরীতে কতিপয় ব্যক্তির মত বা সিদ্ধান্ত প্রামাণ্য দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরোধিতার কারণে তাঁদেরকে দায়ী করা হয় না, কারণ মুজতাহিদের অধিকার আছে নিজের ইজতিহাদের ভিত্তিতে কর্ম করার। কিন্তু পরবর্তীগণের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের মতটিই প্রামাণ্য বলে গণ্য।
তৃতীয়ত, কোনো বিষয়ে যদি বৈধতা ও নিষিদ্ধতা দুটি বিষয়ের সম্ভাবনা থাকে তাহলে নিষিদ্ধতার পালাকে ভারি করা হয়। কারণ ইসলামের মূলনীতি অনুসারে বৈধ বা জায়েয কর্ম পালন করার চেয়ে নিষিদ্ধ বা হারাম কর্ম বর্জন করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের প্রতিবাদে আবেগী হয়ে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বর্জন, আইন অমান্য বা বিদ্রোহ একদিকে যেমন কুরআন-সুন্নাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ, তেমনি তাতে অকারণ রক্তপাত ও উম্মাতের জানমালের ক্ষতি ছাড়া দীনের কোনোরূপ লাভ হয় না। এজন্য তাবিয়ীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর ইমাম ও ফকীহগণ এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বিষয়টিকে ইসলামী আকীদার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা, আবূ ইউসূফ, মুহাম্মাদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদার মূলনীতি ব্যাখ্যা করে ইমাম আবু জাফর তাহাবী (৩২১ হি) বলেন:
نرى الصلاة خلف كل بر وفاجر من أهل القبلة وعلى من مات منهم ولا ننزل أحداً منهم
جنة ولا ناراً ولا نشهد عليهم بكفر ولا بشرك ولا بنفاق، ما لم يظهر منهم شيء من
ذلك ونذر سرائرهم إلى الله تعالى ولا نرى السيف على أحد من أمة محمد صلى الله عليه
وسلم إلا من وجب عليه السيف ولا نرى الخروج على أئمتنا وولاة أمورنا وإن جاروا ولا
ندعو عليهم ولا ننزع يداً من طاعتهم ونرى طاعتهم من طاعة الله عز وجل فريضة، ما لم
يأمروا بمعصية وندعو لهم بالصلاح والمعافاة ... والحج والجهاد ماضيان مع أولي
الأمر من المسلمين برهم وفاجرهم إلى قيام الساعة، لا يبطلهما شيء ولا ينقضهما
‘‘আমরা কেবলাপন্থী সকল নেককার ও বদকার মুসলিমের পিছনে সালাত আদায় করা এবং তাদের মৃত ব্যক্তির জন্য জানাযার সালাত আদায় করা বৈধ মনে করি। আমরা তাদের কাউকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলে নিশ্চিত সাক্ষ্য প্রদান করি না। তাদের কারো উপর কুফরী, শিরক বা নিফাকের সাক্ষ্য প্রদান করি না, যতক্ষণ না এরূপ কিছু তাদের মধ্যে প্রকাশ্যভাবে দেখা দিবে। তাদের আভ্যন্তরীন বিষয়াদি আমরা আল্লাহ তা’আলার উপর ছেড়ে দিই। উম্মতে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কোনো লোকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ (জিহাদ, হত্যা বা শক্তিপ্রয়োগ) আমরা বৈধ মনে করি না, তবে যদি (রাষ্ট্রীয় বিচার বা জিহাদের মাধ্যমে) কারো বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায় তাহলে ভিন্ন কথা। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানগণ ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্তগণ অত্যাচার করলেও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বৈধ মনে করি না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে বদদোয়া বা অভিশাপ প্রদান করি না এবং তাদের আনুগত্যও বর্জন করি না। আমরা তাদের আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্যের অংশ হিসেবে ফরয মনে করি যতক্ষণ না তারা কোনো পাপ কর্মের নির্দেশ দেয়। আর তাদের সংশোধন ও সংরক্ষণের জন্য দু‘আ করি। ... মুসলিম শাসক- সে নেককার হোক আর পাপী-বদকার হোক- তার অধীনে হজ্জ্ব এবং জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কোনো কিছুই এ দুটকে বাতিল বা ব্যাহত করবে না।’’[2]
[1] এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৯৪-১০৮।
[2] আবু জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৫-১৬।
৩. ১০. ২. ২. আনুগত্যসহ নসীহত ও দাওয়াত
কুরআন-সুন্নাহর উপর্যুক্ত নির্দেশাবলির আলোকে সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারী মূলধারার আলিমগণ মূলত সরকার পরিবর্তনের চেয়ে সরকার সংশোধনের চেষ্টা করেছেন। সরকারের বা প্রশাসনের অন্যায়, অনাচার, কুরআন-সুন্নাহের বিরোধিতা বা ইসলাম বিরোধী আকীদা-বিশ্বাস ও আইন-কানুনের প্রতিবাদে তাঁরা রাষ্ট্রের আনুগত্য বজায় রেখে সরকারকে নসীহত, ওয়ায ও দাওয়াত দিতেন এবং জনগণকেও সচেতন করতেন। তবে বিদ্রোহ, হটকারিতা, বলপ্রয়োগ ও রক্তপাত কঠোরভাবে নিষেধ করতেন।
আমরা আগেই বলেছি যে, উমাইয়া যুগ থেকেই বিচ্যুতি শুরু হয়। আর কখনো কখনো এ বিচ্যুতি ছিল ভয়াবহ। ইয়াযিদের যুগ বা ৬০ হিজরী থেকে পরবর্তী প্রায় ৫০ বৎসর বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবী জীবিত ছিলেন। তাঁরা এ সকল বিচ্যুতি প্রত্যক্ষ করেছেন। সাধ্য ও সুযোগমত প্রতিবাদ করেছেন, নসীহত করেছেন, কিন্তু আবেগতাড়িত হন নি। সাহাবীগণের কয়েকটি সুপরিচিত ঘটনা উল্লেখ করে আমরা পরবর্তী যুগসমূহের কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করব। তারিক ইবনু শিহাব বলেন:
أوَّلُ من بدأَ بالخُطبةِ يومَ العيدِ قبلَ
الصَّلاةِ ، مروانُ . فقامَ إليهِ رجلٌ ، فقالَ: الصَّلاةُ قبلَ الخُطبةِ ، فقالَ:
قد ترِكَ ما هُنالِكَ ، فقالَ أبو سعيدٍ: أمَّا هذا فقد قضَى ما عليهِ سَمِعْتُ
رسولَ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عليهِ وسلَّمَ يقولُ: مَن رأى مِنكُم مُنكرًا
فليغيِّرهُ بيدِهِ ، فإن لَم يَستَطِع فبِلسانِهِ ، فإن لم يستَطِعْ فبقَلبِهِ .
وذلِكَ أضعَفُ الإيمانِ
‘‘প্রথম যে ব্যক্তি সালাতুল ঈদের খুতবা সালাতের আগে নিয়ে আসে সে মারওয়ান ইবনুল হাকাম। তখন এক ব্যক্তি তার দিকে দাঁড়িয়ে বলে, খুতবার আগে সালাত। মারওয়ান বলেন: তৎকালীন নিয়ম পরিত্যক্ত হয়েছে। তখন আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, এ ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে বলতে শুনেছি: ‘তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় দেখতে পায় তবে সে যেন তা তার বাহুবল দিয়ে পরিবর্তন করে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে সে যেন তার বক্তব্য দিয়ে তা পবিবর্তন করে। এতেও যদি সক্ষম না হয় তাহলে সে যেন তার অন্তর দিয়ে তা পরিবর্তন (কামনা) করে, আর এ হলো ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’[1]
উমাইয়া প্রশাসক ওয়ালীদ ইবনু উকবা মদপান করতেন। তিনি একদিন মাতাল অবস্থায় ফজরের সালাতে ইমামতি করেন। তার পিছনে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) জামাতে শরীক ছিলেন। ওয়ালীদ মাতাল অবস্থায় থাকার কারণে ফজরের সালাত চার রাকআত আদায় করেন এবং সালাম ফিরিয়ে বলেন: কম হলো কি? আরও লাগবে? তখন মুসল্লিগণ বলেন আজ সকালে তো আপনি বেশি বেশিই দিচ্ছেন (আপনি ইতোমধ্যেই দু রাকআত বেশি দিয়েছেন! আর লাগবে না!!)।’’[2]
উমাইয়া যুগের এক বিদ্রোহী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন মুখতার সাকাফী (১-৬৭ হি)। ৬৪ হিজরীতে ইয়াযিদের মৃত্যুর পরে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের পক্ষ থেকে তিনি কুফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কুফায় প্রবেশের পর তিনি নিজেকে আলী (রা)-এর পুত্র মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যার খলীফা বলে দাবি করেন এবং ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের প্রতিশোধ গ্রহণে তৎপর হন। হুসাইনের হত্যায় জড়িত সকলকেই তিনি হত্যা করেন। এভাবে তিনি কূফা ও পার্শবতী এলাকার শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি দাবি করেন যে, জিবরাঈল (আ) তার কাছে ওহী নিয়ে আগমন করেন। তিনি ধর্মদ্রোহিতা, বিভ্রান্তি ও কুফরী মতামতের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। ৬৭ হিজরীতে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের বাহিনী তাকে পরাজিত ও হত্যা করে। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) এ ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের সাধারণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।[3]
ইমাম বুখারী তাঁর আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে তাবিয়ী আব্দুল কারীম বাক্কা থেকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘‘আমি দশজন সাহাবীর সঙ্গ পেয়েছি যারা পাপী-জালিম শাসক-প্রশাসকদের পিছনে সালাত আদায় করতেন।’’[4]
সাহাবীগণের পরবর্তী যুগগুলির মধ্যে সরকারের ইসলাম বিরোধিতার সবচেয়ে খারাপ অবস্থাগুলির অন্যতম (১) আববাসী খলীফা মামুন, মু’তাসিম ও ওয়াসিকের সময়ে কুরআনের কিছু বিষয় অস্বীকার করার ও কুরআনকে মাখলূক বলার ‘কুফরী মতবাদ’ প্রতিষ্ঠা এবং (২) মোগল বাদশাহ আকবারের সময়ে ‘‘দীন-ই- ইলাহী’’ প্রতিষ্ঠা। এ দুটি ঘটনার মুকাবিলায় ও ঈমান-আকীদা সংরক্ষণে আলিমগণের পদক্ষেপ আমরা আলোচনা করব।
ক. আববাসী শাসকদের কুফরী মতবাদের প্রতিবাদে ইমাম আহমদ
তৃতীয় হিজরী শতকের শুরুতে আববাসী খলীফা মামুন (রাজত্ব ১৯৮-২১৮ হি) মুতাযিলী ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করেন এবং একে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। গ্রীক দর্শনের ভিত্তিকে কুরআনের নির্দেশনা ব্যাখ্যা করে এ মতবাদ তৈরি করা হয়। এ মতবাদে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক বিভিন্ন বিশ্বাস কয়েছে। এ সকল বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে ‘‘কুরআন আল্লাহর সৃষ্ট বা মাখলূক’’। এছাড়া এ মতবাদে জান্নাতে আল্লাহর দর্শন অস্বীকার করা হয়, যদিও কুরআনে সুস্পষ্টত বলা হয়েছে যে, জান্নাতে মুমিনগণ আল্লাহর দর্শনের সৌভাগ্য লাভ করবেন।
খলীফা মামুন রাষ্ট্রের সকলকে এ বিশ্বাস গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। ইমাম আহমদ ও আহলুস সুন্নতের আলিমগণ ঘোষণা দেন যে, কুরআন আল্লাহর কালাম এবং তাঁরই সিফাতের অংশ। আল্লাহর কোনো সিফাত বা বিশেষণ সৃষ্ট হতে পারে না। কাজেই কুরআনকে মাখলূক বা সৃষ্টবস্ত্ত বলে বিশ্বাস করা কুফরী। অনরূপভাবে জান্নাতে আল্লাহর দর্শন অস্বীকার করলে কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত অস্বীকার করা হয়, এজন্য এরূপ বিশ্বাস কুফরী।
এ মত প্রতিষ্ঠায় মামুন ছিলেন অনমনীয়। এ মত গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী আলিমদেরকে গ্রেফতার করে তিনি অবর্ণনীয় অত্যাচার করতে থাকেন। অত্যাচারের মুখে যারা মুতাযিলী মতবাদ মেনে নিত তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হতো। অন্যদেরকে আটক রেখে অত্যাচার চালানো হতো এবং কাউকে কাউকে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। মামুনের পরে পরবর্তী খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহ (২১৮-২২৭ হি) ও ওয়াসিক বিল্লাহ (২২৮-২৩২ হি) এভাবে এমত প্রতিষ্ঠর জন্য এরূপ অত্যাচার অব্যাহত রাখেন। পরবর্তী শাসক মুতাওয়ক্কিল (২৩২-২৪৭ হি) এ অত্যাচারের অবসান ঘটান।
সুদীর্ঘ প্রায় ৩০ বৎসরের এ কুফরী মতাদর্শের শাসন ও অত্যাচারের সময়ে মূলধারার আলিমগণের অন্যতম নেতা ছিলেন ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (২৪১ হি)। তিনি মু’তাযিলী মতবাদের কুফরী ও বিভ্রান্তি প্রকাশ করেন, শত অত্যাচারেও এ মতবাদের স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকেন এবং দীর্ঘ সময় কারাগারের অন্তরালে অবস্থান করেন। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রেখেছেন, জুমুআর খুতবায় খলীফা ও প্রশাসনের জন্য দুআ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি কখনোই বিদ্রোহ, আইন অমান্য বা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের অনুমতি দেন নি। সরকারের জুলুম ও সরকার পক্ষের আলিমগণের প্রচারণায় সাধারণ মানুষ ও সাধারণ আলিমগণ এ কুফরী মত গ্রহণ করতে থাকেন। পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাত বা মূলধারার আলিমগণ ও তাদের অনুসারী সাধারণ মুসলিমগণ অত্যাচারিত হওয়া ছাড়াও সাধারণের মধ্যে এরূপ কুফরী মতবাদের দ্রুত প্রসারে বিচলিত হয়ে পড়েন। অনেকেই সরকারের নির্দেশ অমান্য করে সমাজে হক্ক কথা দ্রুত প্রচারের বা সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে অস্ত্র ধারণের চিন্তা করেন। ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বাল তাদেরকে বিশেষভাবে নিষেধ করেন। তিনি বারবারই বলতেন:
هذه فتنة خاصة وإذا وقع السيف وسالت الدماء
صارت فتنة عامة إياكم والدماء إياكم والدماء إياكم والدماء
‘‘এখন তো ফিতনা ও অত্যাচারের শিকার অল্প কিছু মানুষ। আর যদি অস্ত্রধারণ করা হয় এবং রক্তপাত করা হয় তবে তা সাধারণ ফিতনা-ফাসাদে পরিণত হবে এবং সাধারণ জনগণ কষ্ট ও অত্যাচারের শিকার হবে। খবরদার! তোমরা রক্তপাত থেকে দূরে থাক! খবরদার! তোমরা রক্তপাত থেকে দূরে থাক! খবরদার! তোমরা রক্তপাত থেকে দূরে থাক!!!’’[5]
এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম আহমদ ও অন্যান্য আলিম মামুনের এ মতবাদকে কুফর বলে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু কখনোই মামুনকে বা যারা এ মত গ্রহণ করছিল তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে কাফির বলে গণ্য করেন নি, বরং তাদের আনুগত্য ও তাদের পিছনে সালাত আদায় অব্যাহত রেখেছেন। মুতাযিলী মতের বিভিন্ন আকীদা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাথে সাংর্ঘর্ষিক। এ বিশ্বাস পোষণের মাধ্যমে এ সকল আয়াতকে অস্বীকার করা হয়। কিন্তু মুতাযিলীগণ এ সকল আয়াতকে সরাসরি অস্বীকার করত না; বরং বিভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে তার অর্থ পরিবর্তন করে তারা তাদের এমতকে ‘‘কুরআন-সম্মত’’ বলে দাবি করত। তারা বলত না যে, আমরা কুরআন বা হাদীস অস্বীকার করি। বরং তারা বলত যে, কুরআনের এ কথাটি অমুক বা তমুক অর্থে আমরা গ্রহণ করি। আর আমরা আগেই দেখেছি যে, এক্ষেত্রে ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলা হয় না। বরং তাকে ‘সন্দেহের সুযোগ’ (Benefit of doubt) প্রদান করা হয় এবং মনে করা হয় যে, সে হয়ত সত্যিই না বুঝে এরূপ কুফরী মত গ্রহণ করেছে। এর অর্থ এ নয় যে, তার মত বা ব্যাখ্যা সঠিক বলে মেনে নেওয়া হলো। বরং তাকে বিভ্রান্তিতে নিপতিত মুসলিম বলে গণ্য করা হলো। আর এজন্যই ইমাম আহমদ ও অন্যান্য আলিম অনমনীয় দৃঢ়তার সাথে সঠিক মতটি বর্ণনা করেছেন এবং কোনো অত্যাচারেই রাষ্ট্রীয় মতবাদকে কুরআন-সুন্নাহ সম্মত বলে স্বীকৃতি দেন নি।
ইমাম আহমদ ও তাঁর সাথীরা এরূপ অনমনীয়তার পাশাপাশি ধৈর্য ধারণ করেছেন এবং দ্রুত অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করেন নি। বরং অত্যাচার ও কষ্ট নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে সাধারণ জনগণকে রক্তারক্তি ও হানাহানি থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থেকেছেন। এ সময়ে যারা কুফরী মতের প্রসার রোধে আইন ভঙ্গ করেছিলেন বা দ্রুত ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন তারা কেউ সফল হন নি। বরং তাদের কারণে অনেকেই কষ্টে নিপতিত হয়েছেন। কিন্তু ইমাম আহমদ ও তাঁর সাথীদের ধৈর্যসহ সত্যকথন এক সময় ফল প্রসব করে। দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বৎসর পর খলীফা মুতাওয়াক্কিল (২৩২-২৪৭ হি) মূলধারার আলিমদের মত গ্রহণ করেন।
মুতাযিলী ও অন্যান্যদেরও তাদের মতবাদ চর্চার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। এ বিষয়ক সকল রাষ্ট্রীয় জবরদস্তি থামিয়ে দেওয়া হয়। বস্ত্তত ইসলামের ইতিহাসে রাষ্ট্র কখনো ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে নি। সকল ধর্মের অনুসারীরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতার সাথে তাদের ধর্মপালন করেছেন এবং নাগরিক অধিকার ভোগ করেছেন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন মুসলিম ফিরকা তাদের মতামত অনুসরণ করেছেন। তারা পারস্পরিক দলাদলি করলেও রাষ্ট্রপ্রশাসন সাধারণত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে নি। ইউরোপের খৃস্টান দেশগুলির মত ধর্মদ্রোহিতা (heresy) নির্মূলের নামে ভিন্নধর্ম বা ভিন্নমতের অনুসারীদের নির্মুল করা হয় নি। মামুন, মুতাসিম ও ওয়াসিকের গ্রীক দর্শন ভিত্তিক এ মুতাযিলী শাসনামল ছিল ব্যতিক্রম।
খ. আকবারের দীনে ইলাহীর প্রতিরোধে ইমাম সিরহিন্দী
মোগল সম্রাট আকবরের (রাজত্ব ১৫৫৬-১৬০৫ খৃ) দীনে ইলাহীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কুফরী প্রতিষ্ঠার মত এমন ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। সম্রাট আকবরের সময়ে সামগ্রিকভাবে ভারতের মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবক্ষয় বিরাজ করছিল। আকবরের ‘‘দীন-ই-ইলাহী’’-র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সে অবক্ষয় চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে।
খৃস্টীয় ১২শ-১৩শ শতাব্দী বা হিজরী পঞ্চম-সপ্তম শতাব্দীতে দুশতাব্দীরও অধিককালব্যাপী পশ্চিম থেকে ইউরোপীয় খৃস্টানগণের একের পর এক বর্বর ক্রুসেড আক্রমনে ছিন্নভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের দুর্বল অবস্থার মধ্যেই খৃস্টীয় ১৩শ শতকে বা হিজরী ৭ম শতকে মুসলিম দেশগুলির উপর পূর্ব থেকে তাতার ও মোঙ্গলদের বর্বর হামলা শুরু হয়। একপর্যায়ে ১২৫৮ খৃ/৬৫৬ হিজরী সালে বাগদাদের পতন ঘটে। এভাবে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
এ সময়ে কেন্দ্রীয় শাসন, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। মূলত সুফীয়ায়ে কেরাম, সূফী দরবার ও খানকার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে দীনী শিক্ষার ধারা টিমটিম করে অব্যাহত থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে তাসাউফ ও তরীকতের নামে অগণিত ভন্ড দরবার, খানকা ও তরীকার সৃষ্টি হয়। তরীকতের নামে মুসলমানদেরকে ইসলামী শরীয়ত ও ইসলামী আকীদা বিশ্বাস পরিত্যাগ করে বিভিন্ন পাপ, কুফর ও শিরকী বিশ্বাসে নিমজ্জিত করা হয়। এ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশসহ সমগ্র ইসলামী জগতের অবস্থা।
এ সময়ে ইরানে ও ভারতে অনেকে প্রচার করতে থাকে যে, এক হাজার বৎসরের মাথায় ইসলাম ধর্ম ও মুহাম্মাদী নুবুওয়াতের যুগ শেষ হয়ে যাবে এবং নতুন মিলেনিয়ামে বা সহস্রাব্দে নতুন দীনের আবির্ভাব ঘটবে। এ মতবাদের ভিত্তিতে সে সময়ে নতুন নতুন নুবুওয়াতের দাবিদারের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। ৯১০ হিজরীতে জৌনপুরের সায়্যিদ মুহাম্মাদ নিজেকে প্রতিশ্রুত মাহদী বলে দাবি করে এবং দ্রুত সারা ভারতে তার মত ছড়িয়ে পড়ে। ৯৭৭ হিজরীতে মুল্লা মুহাম্মাদ ও তার যিক্রী দলের আবির্ভাব হয় এবং দ্রুত তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন করে। ভারতের সর্বত্র অনেক মুসলিম তার দীন গ্রহণ করে।
এসময়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মত ছিল ইরানের নুকতাবী মতবাদ। এ মতবাদের মূল কথা ছিল (ক) হাশর-নশর বলে কিছু নেই; (২) কুফরী-নাস্তিকতা বৈধ বিষয়; (গ) সব কিছ বৈধ; (ঘ) জান্নাত-জাহান্নাম এ দুনিয়ারই উন্নতি অবনতি; (ঙ) বিবর্তনবাদ; (চ) আরবী নুবুওয়াতের যুগ শেষ এখন আজমী নুবুওয়াতের যুগ শুরু হচ্ছে।
সম্রাট আকবর নিজে ধার্মিক মুসলিম ছিলেন। তিনি শাইখ মুবারক নাগুরী নামক একজন কথিত সুফীর ভক্ত ছিলেন। ইসলামী বিশ্বকোষে শাইখ মুবারক নাগুরীকে আকবারের দরবারে সুফীবাদের প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[6] শাইখ মুবারক নামক এ ‘‘সূফী’’ ছিলেন উপর্যুক্ত নুকতাবী মতবাদের অনুসারী। শাইখ মুবারাকের দু পুত্র, আকবরের নবরত্নসভার অন্যতম সদস্য আবুল ফযল ও ফৈযীও এ মতের অনুসারী ছিলেন।
এ সকল মানুষ নতুন একটি বিশ্বজনীন অনারব ধর্ম প্রবর্তন করতে এবং এ মহান ধর্মের প্রবর্তকের মর্যাদায় আসীন হতে আকবরকে প্ররোচিত করতে সক্ষম হন। তাদের প্ররোচনায় রাজত্ব গ্রহণের (১৫৫৬খৃ/৯৬৩হি) প্রায় ৩০ বৎসর পরে ১৫৮২খৃ/৯৯০ হিজরীতে আকবর দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন করেন। এ ধর্মের মূল দাবি ছিল হিন্দু, মুসলিম, খৃস্টান, পারসিয়ান ইত্যাদি সকল ধর্মের মূল শিক্ষা নিয়ে একটি ধর্ম প্রবর্তন করা। এ ধর্মের উপাস্যের প্রতীক ছিল সূর্য ও আগুন। এ ধর্মের প্রবর্তনের মাধ্যমে সালাত, সিয়াম, যাকাত ও ইসলামের সকল বিধান রহিত ও নিষিদ্ধ করা হয়, উপাস্যের প্রতীক সূর্য ও আগুনের পূজা চালু করা হয়। আর ‘আল্লাহর প্রতিনিধি’ ও ধর্মের প্রবর্তক বাদশাহকে সাজদা করার নিয়ম চালু করা হয়।
এ নতুন রাষ্ট্র ধর্মের মুল বৈশিষ্টাবলির মধ্যে ছিল:
(১) অগ্নি ও সূর্যের উপাসনা
(২) গঙ্গা নদীর পানিকে পবিত্র জ্ঞানে পান করা।
(৩) ছবি, মুর্তি, প্রতিকৃতি ইত্যাদির বৈধতা ঘোষণা।
(৪) সাজদায়ে তাহিয়্যাহ বা সালাম জ্ঞাপক সাজদাকে বৈধ বলে দাবি করে সম্রাটকে সাজদা করার আইন জারি করা।
(৫) ইসলামের ঈদ পরিত্যাগ করে নতুন নতুন বিভিন্ন পার্বন প্রচলন করা।
(৬) সালাত আদায় নিষিদ্ধ করা। রাজপ্রাসাদের মধ্যে প্রকাশ্যে কেউ সালাত আদায় করতে পারত না।
(৭) যাকাত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ফরমান জারি করা।
(৮) ইসলামের ঈমান, ইবাদত ও রীতিনীতি নিয়ে উপহাস করা।
(৯) ইসলামী আইন ও বিচারব্যস্থা বাতিল করে বিভিন্ন ধর্মের আইনের সংমিশ্রণে নতুন আইন চালু করা।
এ ধর্ম চালু করার প্রায় ১৫ বৎসর পরে ১৬০৫ খৃস্টাব্দে (১০১৪ হিজরীতে) আকবর মৃত্যুবরণ করেন। তার পর তার পুত্র নুরুদ্দীন জাহাঙ্গীর (রাজত্ব ১৬০৫-১৬২৭ খৃ/ ১০১৪-১০৩৬ হি) রাজ্যভার গ্রহণ করেন। জাহাঙ্গীরও পিতার ধর্মমত অনুসারে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন।
স্বভাবতই রাষ্ট্রের ধার্মিক মুসলিমগণ এ অবস্থাতে বিক্ষুদ্ধ হন। এ সময়ে দীনের ঝান্ডা গ্রহণ করেন মুজাদ্দিদে আলফে সানী শাইখ আহমদ ইবনু আব্দুল আহাদ সিরহিন্দী (১৫৬৪-১৬২৪খৃ/৯৭১-১০৩৪ হি)। তাসাউফের সঠিক ব্যাখ্যা, পরিপূর্ণ শরীয়ত অনুসরণের মাধ্যমে পরিপূর্ণ তরীকত অর্জন, বিদআতে হাসানা ও বিদআতে সাইয়েআহ- অর্থাৎ ভাল বিদআত ও খারাপ বিদআতের পার্থক্য অস্বীকার করে ভাল ও খারাপ উভয় প্রকারের বিদআতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বিশুদ্ধ সুন্নাত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, দীন-ইইলাহীর প্রতিবাদ ও ইসলামের পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দাওয়াত দিতে শুরু করেন।
ক্রমান্বয়ে সমগ্র ভারতে তার দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও তার দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারী আলিমগণ তাঁর বিরুদ্ধে ফাতওয়াবাজি শুরু করেন। সম্রাট তাঁকে গোয়ালিয়ার দুর্গে বন্দী করেন। এক পর্যায়ে সেনাপতি ও অন্যান্য প্রভাবশালী তাকে বলেন যে, তারা সম্রাটকে হত্যা করে তাঁকে (শাইখ আহমদকে) ক্ষমতায় বসাবেন। কিন্তু তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি কারাগারের অভ্যন্তরেও তাঁর শান্তিপূর্ণ দাওয়াত অব্যাহত রাখেন। পরে সম্রাট তাকে মুক্ত করেন এবং তাঁর দাওয়াতে প্রভাবিত হয়ে দীন-ই-ইলাহী পরিত্যাগ করে ইসলামী আকীদা ও শরীয়ত গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। রাষ্ট্র প্রশাসন ছাড়াও সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে শাইখ আহমদের দাওয়াত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।[7]
ইসলামের ইতিহাসে এরূপ আরো অনেক সংস্কার কার্যক্রম আমরা দেখতে পাই। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আমরা কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই:
(১) কুফর, ইলহাদ ও অনাচারের বিরুদ্ধে দাওয়াতে সোচ্চার হওয়া।
(২) ধৈর্য ও বিনম্রতার সাথে দাওয়াতের কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া।
(৩) ফলাফলের চিন্তা না করে দায়িত্ব পালনের অনুভুতিতে কর্ম করা।
(৪) সকল প্রকার উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা বর্জন করা। বিরোধীদের অসহিষ্ণুতা, অত্যাচার ও উগ্রতা উত্তম আচরণ ও ধৈর্য দিয়ে মুকাবিলা করা।
(৫) রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রাখা। পাপ নয় এমন রাষ্ট্রীয় নির্দেশ মান্য করা। এমনকি গৃহবন্দী করলে বা কথা বলতে বাধানিষেধ আরোপ করলে তা মেনে নিয়ে প্রদত্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই দাওয়াত অব্যাহত রাখা।
(৬) শাসকদের পরিবর্তনের চেয়ে সংশোধনকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
(৭) অন্যায়কে অন্যায় বলার পাশাপাশি ভাল ও কল্যাণের কাজে শাসক বা প্রশাসকদের প্রশংসা করা, সহযোগিতা করা এবং তাদের থেকে যতটুকু সম্ভব দীনের স্বার্থ উদ্ধার ও রক্ষা করা।
ইসলামের ইতিহাসের এ সকল রাষ্ট্র-সংস্কার আন্দোলনের একটি লক্ষণীয় বিষয় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলির নেতৃবৃন্দ নিজেরা ক্ষমতা গ্রহণ করতে চেষ্টা করেন নি, উপরন্তু ক্ষমতা বা দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব বা সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা ক্ষমতাসীন বা দায়িত্বে রত ‘সাধারণ’ মুসলিম বা ‘ফাসিক’ মানুষদের মাধ্যমে যথাসম্ভব সংশোধন ও উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন।
কোনো আলিম বা নেককার মানুষের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ ইসলামে নিষিদ্ধ বা আপত্তিকর নয়, বরং জরুরী ও কল্যাণকর হতে পারে। আফ্রিকার- বর্তমান নাইজেরিয়ার- প্রসিদ্ধ আলিম, পীর ও সফল সংস্কারক উসমান দান ফুদিও ( Usuman dan Fodio: 1754-1817) -র সংস্কার আন্দোলন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংস্কারকগণের দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতির এ দিকটির কারণ ও প্রেক্ষাপট হিসেবে নিম্নের বিষয়গুলি বিবেচ্য:
(১) তাঁরা অনুভব করতেন যে, ক্ষমতার সংশোধনের চেয়ে পরিবর্তন কঠিনতর। কোনো দেশেই ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ছাড়তে চান না। আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও বিভিন্নভাবে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা আকড়ে ধরতে চান। আর তৎকালীন পরিবেশে হত্যাকান্ড বা যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়া ক্ষমতার পরিবর্তন খুবই কঠিন ছিল। ক্ষমতার পরিবর্তন করতে রক্তারক্তির যে সম্ভাবনা সংস্কার ও সংশোধনের ক্ষেত্রে এর সম্ভাবন ততটা নয়। এক্ষেত্রে আলিম বা সংস্কারক নির্যাতিত হলেও সাধারণ অনুসারী ও নাগরিকগণ নির্যাতন ও রক্তপাত থেকে রক্ষা পান। এজন্য তারা ক্ষমতার পরিবর্তন না করে সংস্কার চেষ্টাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ, উদ্দেশ্য তো যতটুকু সম্ভব পাপ অন্যায় দূর করা এবং দীনী দাওয়াতের পরিবেশ তৈরি করা।
(২) তারা ক্ষমতাসীনদেরকে বার্তা দিয়েছেন যে, আমরা আপনাদের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্ধী নই। আমরা আপনাদের কল্যাণকামী মাত্র। আপনাদের ক্ষমতার স্থায়িত্ব, দুনিয়ার সফলতা ও আখিরাতের মুক্তির জন্য আপনাদেরকে অমুক বা তমুক কাজগুলি করতে বা বর্জন করতে হবে। এ ‘‘বার্তা’’-সহ সংস্কার ও পরিবর্তনের দাওয়াত অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের মনে প্রভাব ফেলে এবং পরিবর্তন সহজ হয়। পক্ষান্তরে কাউকে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্ধী মনে করলে ক্ষমতাসীনরা তার ভাল কথাও শুনতে রাজি হন না, বরং ক্ষমতার প্রতিদ্বন্ধী অতি আপনজনকেও আঘাত, হত্যা বা নিয়ন্ত্রণ করতে তৎপর হন।
(৩) ক্ষমতার পরিবর্তনে একজন বা একদল মানুষের পরিবর্তে অন্য মানুষ বা মানুষদের ক্ষমতায় বসাতে হয়। এক্ষেত্রে পরের মানুষগুলি ক্ষমতা গ্রহণের পরে পূর্ববর্তীদের চেয়ে অনেক ভাল বা পরিপূর্ণ ভাল হবেন বলে আশা করা কঠিন। কাজেই ক্ষমতা পরিবর্তন ছাড়াই যদি দাওয়তের উদ্দেশ্য আংশিক বা অনেকাংশে পূরণ হয় তাহলে তা মেনে নেওয়াই উত্তম।
(৪) আখিরাতমুখী আলিমগণ নিজে দায়িত্ব গ্রহণ করতে ভয় পেতেন। দায়িত্ব গ্রহণ করে বৈষম্যহীন ন্যায়বিচার, সকল নাগরিকের অধিকার আদায়, সম্পদের সঠিক ব্যবহার ইত্যাদি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি হয়ে গোনাহের মধ্যে নিপতিত হবেন বলে তারা ভীত হতেন। তারা ভাবতেন যে, মূল উদ্দেশ্য কুফর, ইলহাদ ও অনাচার দূর করা এবং দীন ও দাওয়াতের নিরাপত্তা রক্ষা করা। তা যখন অন্যের মাধ্যমে হয়ে যাচ্ছে তখন নিজের আখিরাতকে ঝুঁকিপূর্ণ করার দরকার কী?
(৫) রাষ্ট্রের সাথে অগণিত মানুষের অধিকার ও স্বার্থ জড়িত। এখানে সাধারণত কেউই সকল নাগরিকের কাছে বা সকল ধার্মিকের কাছে ‘‘ভাল’’ বা ‘‘যোগ্য’’ বলে গণ্য হতে পারেন না। বরং সকলেই বিতর্কিত হন এবং অনেকেই ব্যর্থ বলে গণ্য হন। সাধারণ বা ‘‘ফাসিক’’ ব্যক্তি যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয় তাহলে ব্যর্থতার দায়ভার তার নিজের ঘাড়ে পড়ে। আর যদি আলিম, ইমাম বা সংস্কারক ব্যর্থ হন তাহলে তার দায়ভার দীনের উপরেই পড়ে। এতে দীনী দাওয়াত বিতর্কিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৬৯।
[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা (শামিলা) ৩/৪১৪।
[3] আব্দুর রহমান ইবনু মুহাম্মাদ আল-হাম্বলী (১৩৯২ হি.); হাশিয়াতুর রাওদিল মুরবি’ শারহু যাদিল মুসতানকী ২/৩০৭।
[4] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৬/৯০।
[5] সালিহ আল-শায়খ, শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসিতিয়্যাহ ২/৩২১।
[6] ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ইসলামী বিশ্বকোষ ১/৭০।
[7] আবুল হাসান নদবী, রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দাওয়াত, ৩য় খণ্ড; গোলাম মোর্তাজা: ইতিহাসের ইতিহাস, পৃ. ১০২-১০৮; ইসলামী ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ ১/৭০-৭১; ৩/২৩৬-২৩৮; ১৯/৫৮৬-৫৮৭; ৬৯১-৬৯৪।
৩. ১১. জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে করণীয়
পূর্বের আলোচনায় আমরা জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা, সন্ত্রাস ও উগ্রতার পরিচয় এবং ইসলামের নামে উগ্রতা বা সহিংসতার কারণ ও প্রেক্ষাপট আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, সকল ধর্ম ও আদর্শের অনুসারীরাই বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাস বা জাঙ্গিবাদে লিপ্ত হয়েছে ও হচ্ছে। সন্ত্রাস অর্থই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে অস্ত্রধারণ ও শক্তি প্রয়োগ এবং বিশেষত অযোদ্ধা ব্যক্তি বা বস্ত্তকে আঘাত করা বা হত্যা করা। ইসলামে সন্ত্রাসের পথ সামগ্রিকভাবে রুদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামে মানব জীবনকে সর্বোচ্চ সম্মানিত বলে গণ্য করা হয়েছে এবং একমাত্র বিচার ও যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনোভাবে কোনো মানুষকে হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিচার ও যুদ্ধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে ইসলামে সন্ত্রাসের পথ পরিপূর্ণভাবে রূদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে আমরা সন্ত্রাসের ঘটনা দেখতে পাই না বললেই চলে। কিন্তু সমকালীন বিশ্বে উপনিবেশোত্তর বিভিন্ন মুসলিম দেশের দমন-পীড়ন নীতি, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও অন্যান্য স্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বিশ্বশক্তির সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী নীতি, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে মুসলিম নিধন ও মুসলিম সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, আবার প্রয়োজনে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ অপব্যবহার করে ‘‘মুজাহিদ’’ তৈরির উদ্দেশ্যে বিশেষ ‘‘মাদ্রাসা’’ তৈরি করে তাদেরকে জঙ্গিতে রূপান্তরিত করা ইত্যাদি বিষয় বিভিন্নভাবে উগ্রতা, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছে। এক্ষেত্রে উগ্রতা, সন্ত্রাস বা জাঙ্গিবাদের প্রচার ও প্রসারের জন্য ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ প্রকৃতিগতভাবে শান্তিপ্রিয়। এদেশে কখনো ধর্মীয় সংঘাত ও রক্তারক্তি দেখা দেয় নি। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা অন্যত্র যেমন বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে এবং একই ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ ও দলের মধ্যে হানাহানি ও রক্তারক্তির ঘটনা ঘটে থাকে বাংলাদেশে তা কখনোই ঘটে না। কিন্তু ইদানিং আমরা আমাদের দেশেও ধর্মীয় উগ্রতার উন্মেষ লক্ষ্য করছি। এ প্রবণতা রোধে আমাদের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৩. ১১. ১. সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয় - (৩. ১১. ১. ১. কারণ নিয়ন্ত্রণ)
আমরা সহজেই বুঝি যে, কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তার কারণগুলি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদের কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে:
(১) সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র,
(২) মুসলিম দেশে ইসলাম-দমন,
(৩) বেকারত্ব ও হতাশা এবং
(৪) ইসলামের শিক্ষার বিকৃতি।
প্রথম বিষয়টি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যতদিন এরূপ আগ্রাসন, নিপীড়ন ও ষড়যন্ত্র থাকবে ততদিন যে কোনো দেশে কিছু মানুষ অজ্ঞতা ও আবেগের প্রেষণে উগ্রতায় লিপ্ত হয়ে যেতে পারেন। এরূপ সম্ভাবনা একেবারে রহিত করা যায় না। অনুরূপভাবে যে মুসলিম দেশের ভৌগলিক বা অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে সে দেশে আধিপত্য বিস্তার করতে বা সে দেশের সরকারকে ছাড় দিতে বাধ্য করতে কিছু ‘‘জঙ্গি’’ তৈরি করা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য অত্যন্ত সহজ ও কার্যকরী পন্থা। তবে আমরা বাকি তিনটি কারণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং এতে প্রথম কারণটিও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে।
৩. ১১. ১. ২. বেকারত্ব, হতাশা ও অজ্ঞতা
বেকারত্ব, বঞ্চনা ও হতাশার পাশাপাশি জ্ঞানহীন আবেগ চরমপন্থা ও জঙ্গি কর্মকান্ডের জন্ম দেয়। আমাদের সমাজে যারা সর্বহারার রাজত্বের জন্য বা ইসলামী রাজত্বের জন্য সহিংসতায় লিপ্ত তাদের প্রায় সকলের জীবনেই আপনি এ বিষয়টি দেখতে পাবেন। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা শিক্ষিত বেকার যুবককে কেউ বুঝিয়েছে, এরূপ সহিংসতার মাধ্যমে অতি তাড়াতাড়িই তোমার ও অন্যদের কষ্ট ও বঞ্চনার সমাপ্তি ঘটবে এবং সর্বহারার রাজত্ব বা ইসলামী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তুমি ক্ষমতা ও কর্ম অথবা জান্নাত লাভ করবে। বঞ্চিত, বেকার ও হতাশ এ যুবক সহজেই এ কথা বিশ্বাস করে এ সকল কর্মে লিপ্ত হয়। কারণ তার অন্য কোনো কর্ম নেই এবং তার পাওয়ার আশার বিপরীতে হারানোর তেমন কিছই নেই।
৩. ১১. ১. ৩. জঙ্গি নির্মূল বনাম জঙ্গিবাদ নির্মূল
বেকারত্ব, সামাজিক অবহেলা, ন্যায় বিচারের দুর্লভতা, বঞ্চনা ও অজ্ঞতা দূর না করে শক্তি বা আইন দিয়ে কঠোর হস্তে ‘‘জঙ্গি’’ নির্মূলের চেষ্টা করলে জাতির ক্ষতি হবে। এতে এদেশের অনেক সন্তান ‘‘নির্মূল’’ হলেও ‘‘জঙ্গিবাদ’’ নির্মূল হবে না। যারা চরমপন্থা বা জঙ্গি কর্মকান্ডে লিপ্ত তারা আমাদের সামাজিক বঞ্চনা ও অবিচারের শিকার। তাদেরকে শত্রু বিবেচনা করে নির্মুল করার চেয়ে নাগরিক ও দেশের সন্তান বিবেচনা করে যথাসম্ভব সংশোধন করে সমাজের মূলধারায় সংযুক্ত করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষত যারা হত্যা বা অনুরূপ অপরাধে জড়িত হয় নি এরূপ যুবকদের সংশোধনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব পিতৃত্বের বা অভিভাবকের দরদ নিয়ে সকল নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি প্রদান এবং নিরপরাধকে শাস্তি থেকে রক্ষার পাশাপাশি কম অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া তাদের কর্তব্য। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, ইনসাফ, বৈষম্যহীন ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট শাসক ও প্রশাসকগণ আল্লাহর সর্বোচ্চ দয়া ও পুরস্কার লাভ করবেন।
৩. ১১. ১. ৪. অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বনাম নিরপরাধের শাস্তি
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর দিক হলো নিরপরাধের শাস্তি। জঙ্গিবাদ দমনের নামে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে নিরপরাধ মাদ্রাসা ছাত্র বা ধার্মিক মানুষদেরকে আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, কারাগারের অন্তরীন রাখা, রিমান্ডে নেওয়া ইত্যাদি কর্ম একদিকে মানবাধিকার ভূলণ্ঠিত করবে, এ সকল নিরপরাধ মানুষ ও তাদের আপনজনদেরকে জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং সর্বোপরি আমাদেরকে আল্লাহর গযব ও শাস্তির মধ্যে নিপতিত করবে। কারণ নিরপরাধের শাস্তি ও বিচারবহির্ভুত হত্যা, শাস্তি ও কষ্টদান যখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক রূপ প্ররিগ্রহণ করে তখন আল্লাহর গযব ও জাগতিক শাস্তি সে দেশের ভাল ও মন্দ সকল মানুষকে গ্রাস করে।
৩. ১১. ১. ৫. জঙ্গিবাদ বনাম ইসলামবাদ
আরো বেশি ভয়ঙ্কর বিষয় জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের নামে ইসলামী দাওয়াতের কণ্ঠরুদ্ধ করা। মাওবাদী সন্ত্রাসীগণ বা আমাদের দেশের চরমপনহী বলে কথিত ‘‘বামপন্থী জঙ্গিগণ’’ যে মতাদর্শ ও দাবিদাওয়া প্রচার করেন মূলধারার মার্কসবাদী, সাম্যবাদী, সমাজতন্ত্রী বা বামপন্থীগণও একই মতাদর্শ ও দাবিদাওয়া প্রচার করেন। অনুরূপভাবে ইসলামের নামে উগ্রতায় লিপ্ত বা জঙ্গিবাদীরা যে সকল মতাদর্শ ও দাবি দাওয়া পেশ করেন প্রায় একইরূপ মতাদর্শ ও দাবি দাওয়া প্রচার করেন মূলধারার ইসলমী রাজনীতিবিদ, আলিম, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও পীর-মাশাইখগণ। পার্থক্য হলো কর্মপদ্ধতিতে। চরমপন্থী ও জঙ্গিরা বলপ্রয়োগ, আইন অমান্য ও খুনখারাপির মাধ্যমে তাদের আদর্শ চাপিয়ে দিতে চান। পক্ষান্তরে মূলধারার মানুষেরা দেশের আইনের আওতায় গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন। গ্রহণ করা বা না করা জনগণের ইচ্ছাধীন।
সাম্যবাদী জঙ্গি বা সমাজতন্ত্রী সন্ত্রাসীদের কারণে কেউ মূলধারার সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রীদেরকে দায়ী করেন না বা ‘‘চরমপন্থা’’ দমনের নামে বামপন্থী রাজনীতি ও কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন না। কেউ বলেন না যে, সাম্যবাদী রাজনীতির কারণেই চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী জন্ম নিচ্ছে; কাজেই সাম্যবাদী রাজনীতি বন্ধ করা হোক। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যায়। জঙ্গিবাদ দমনের অযুহাতে অনেক সময় ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী আইন ও বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি বা ইসলামী মূল্যবোধ বিকাশের দাবি বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়।
অনেক সময় ‘‘ধর্মনিরপেক্ষতার’’ নামে বা ‘‘জঙ্গি’’ নির্মূল করার নামে ‘‘ইসলামী রাজনীতি’’ বা ইসলামী মূল্যবোধ প্রসারমূলক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের দাবি করা হয়। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার মূল দাবী হলো সকল ধর্মের মানুষকে তার ধর্ম পালন ও ধর্মের বিষয়ে তার নিজের ব্যাখ্যা ও মতবাদ প্রচারের সুযোগ দেওয়া। গ্রহণ করা বা না করা জনগণের ইচ্ছা। গণতান্ত্রিক অধিকারের আওতায় মতপ্রকাশের অধিকার দিলে উগ্রতার পথ রুদ্ধ হয়। অতীতে কোনোকোনো দেশে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি নিষেধ করার ফলে সমাজতান্ত্রিক জঙ্গিবাদের উন্মেষ ঘটে। পরবর্তীতে মূলধারায় সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সুযোগ দেওয়ার ফলে ‘‘সর্বহারার রাজত্বের’’ জন্য বা সাম্যবাদের নামে সন্ত্রাস ক্রমান্বয়ে কমে যায়।
বস্ত্তত, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে পারেন। যারা ইসলামী মূল্যবোধ, আখলাক-আচরণ, শিক্ষা ইত্যাদি সবকিছুকেই ‘‘আফিম’’, ‘‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’’ বা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক বলে বিশ্বাস করেন, অথবা তাদের বাণিজ্যিক, সাম্রাজ্যবাদী বা অনুরূপ স্বার্থের প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন তারা জঙ্গিবাদের অযুহাতে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ বিস্তারের বা ইসলামী আদর্শ বিস্তারের সকল কর্ম নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। মত প্রকাশের অধিকার তাদের আছে।
অনুরূপভাবে ‘‘ইসলামপন্থীরা’’ চরমপন্থা নির্মূল বা অনুরূপ কোনো অযুহাতে সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী আদর্শ প্রচার নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। মত প্রকাশের অধিকার তাদের আছে। তবে সরকার ও প্রশাসনকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। তাদের নিজস্ব কোনো মত বা পক্ষ থাকলেও সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের দায়িত্ব হয় সকলের অধিকার রক্ষা করা এবং দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা। আমাদের বুঝতে হবে যে, ভাল বা মন্দ কোনো কথারই ‘‘কণ্ঠ’’ রুদ্ধ করার প্রবণতা কখনোই ভাল ফল দেয় না। বিশেষত জঙ্গিবাদের নামে ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী আদর্শ প্রচার, শিক্ষা বিস্তার ও ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার আইনসম্মত দাওয়াতকে নিষিদ্ধ বা বাধাগ্রস্ত করলে তা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণের অপরাধ ছাড়াও দেশ ও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ দেকে আনবে। এ জাতীয় যে কোনো কর্ম জঙ্গিদেরকে সাহায্য করবে, তাদের প্রচার জোরদার করবে, তাদের নতুন রিক্রুটমেন্ট দ্রুত বাড়বে এবং দেশ ও জাতিকে এক ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী অশান্তির মধ্যে ফেলে দিবে।
৩. ১১. ১. ৬. ধর্ম-মুক্ত শিক্ষা বনাম ধর্ম-যুক্ত শিক্ষা
আমরা দেখেছি যে, ধর্মীয় আবেগের সাথে সঠিক ধর্মীয় জ্ঞানের অনুপস্থিতিই জঙ্গিবাদের মূল কারণ। এজন্য সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় অধিকতর ইসলামী ও নৈতিক শিক্ষার সংযোজন অতীব প্রয়োজনীয়। জঙ্গিবাদের অযুহাতে মাদ্রাসা শিক্ষা সংকোচন এবং সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ‘‘ধর্মনিরপেক্ষ’’ বা ‘‘অসামপ্রদায়িক’’ করার নামে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বিমুক্ত করা আন্তজার্তিক বেনিয়াচক্র ও সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনলেও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্যের দ্বার উন্মোচন করবে।
‘‘মাদ্রাসা-শিক্ষিত’’ ও ধার্মিক মানুষেরা জঙ্গি না হলেও তারা সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন বিরোধী এবং অশ্লীলতা, মাদকতা ও অনাচার বিরোধী। জঙ্গিবাদের অযুহাতে এদেশের মানুষদের মধ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন বিরোধী মানসিকতা অথবা অশ্লীলতা, মাদকতা ও অনাচার বিরোধী মানসিকতা নির্মূল করা যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয় তাহলে ভিন্ন কথা। আর যদি আমরা জাতির কল্যাণে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে চাই তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে হবে।
আমরা দেখছি যে, আমাদের দেশে ও বিশ্বের সকল দেশে জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িতদের অধিকাংশই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। জঙ্গি বলে কথিত ও প্রচারিত অধিকাংশ দল ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও তাত্ত্বিক গুরুগণও আধুনির শিক্ষিত। কিভাবে এদের দলে নতুন অন্তর্ভুক্তি নিয়ন্ত্রণ করবেন? আমরা কি শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা দিব যে, ধর্ম ভাল নয়, ধর্ম আফিম, ধর্ম পালন করো না, পরকাল বিশ্বাস করো না, ধার্মিকদের কাছে যেও না? এরূপ শিক্ষা তো কোনোভাবেই দিতে পারব না। আর দিলেও তাতে কোনো লাভ হবে না। জঙ্গিবাদ কমবে না, বরং জঙ্গিদের প্রচারণার সুযোগ অনেক বাড়বে, ধর্ম বিপন্ন বলে তারা আরো অনেক মানুষকে দলে ভেড়াবে। উপরন্তু এরূপ শিক্ষা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, এইডস, এসিড, যৌন হয়রানি, পারিবারিক সহিংসতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের মহাদ্বার উন্মোচন করবে।
তাহলে কী আমরা ধর্ম সম্পর্কে কিছুই শিক্ষা দিব না? ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার নামে কি আমরা ‘‘ধর্ম-মুক্ত’’ শিক্ষা দান করব? এতে তো আমাদের সমস্যা বাড়বে। কারণ এরূপ শিক্ষা শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় অনুভূতি নষ্ট করতে পারবে না, কিন্তু ধর্মীয় অজ্ঞতা তাদের ধর্মীয় অনুভূতির অপব্যবহারের সুযোগ বাড়িয়ে দেবে। বস্ত্তত ধর্মীয় অনুভুতি নির্মুল করা যায় না। সঠিক জ্ঞানের অভাবে তা বিপথগামী হয়। কখনো কুসংস্কার ও অনাচার এবং কখনো উগ্রতার পথ ধরে। কেউ ‘‘পাগল বাবা’’-র দরবারে ধর্না দিয়ে, মাজারে-দরগায় পাগল বা মস্তানের পিছনে ছুটে, গাঁজা খেয়ে, জিনের বাদশা বা অনুরূপ প্রতারক-পুরোহিতের কাছে যেয়ে মূল্যবান কর্মঘন্টা ও সম্পদ নষ্ট করে। আর কেউ উগ্রতা ও সহিংসতার পিছে ছুটে নিজের ও অন্যের মহামূল্যবান জীবন ও সম্পদ নষ্ট করে।
আমাদের দেশের ও পাশ্চাত্যের অনেক পন্ডিত ও রাজনৈতিক নেতা আমাদেরকে নীতি কথা শুনান এবং ‘‘দুর্নীতিমুক্তি’’ দেশ গড়তে নসীহত করেন। কিছুদিন পরে দেখা যায় যে, বড় বড় দুর্নীতি মামলায় তারা জড়িত। এর কারণ ধর্মীয় বিশ্বাস, আখিরাতমুখিতা ও আল্লাহর ভয় ছাড়া শুধুমাত্র নীতিকথা, নীতিশিক্ষা, প্রতিজ্ঞা বা অঙ্গীকার দিয়ে কখনোই দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয়, সহিংসতা, মাদকতা বা অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
বস্ত্তত ‘‘ধর্ম-মুক্ত’’ শিক্ষাব্যবস্থা জঙ্গিবাদ না কমিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে জঙ্গিবাদে আক্রান্ত হওয়ার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ (vulnerable) করে তোলে। পাশাপাশি অন্যান্য সকল প্রকারের দুর্নীতি, সহিংসতা ও অপরাধ বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা করে। এজন্য জঙ্গিবাদসহ অন্যান্য সকল সন্ত্রাস, সহিংসতা, দুর্নীতি, মাদকতা, অপরাধ প্রবণতা ও নৈতিক অবক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষার সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন ও ইসলামী ধর্মতত্ত্বে গভীর জ্ঞানী প্রাজ্ঞ গবেষক আলিম তৈরির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যেন তারা কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক মতামত প্রদানের মাধ্যমে যুবসমাজকে উগ্রতা থেকে রক্ষা করতে পারেন।
৩. ১১. ১. ৭. জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সম্পৃক্তি
যেহেতু এ বিষয়টির সাথে ধর্মীয় অনুভূতি জড়িত সেহেতু এর প্রতিরোধ, প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ বা আলিমদের সম্পৃক্ত করা অতীব জরুরী। উগ্রতার প্রসারে ইসলামী শিক্ষার যে বিষয়গুলিকে বিকৃত করা হয় সেগুলির তাত্বিক বিশে¬ষণ ও পর্যালোচনার জন্য সমাজের প্রাজ্ঞ আলিমগণকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গণমাধ্যমে সুযোগ দেওয়া অতীব জরুরী। একজন রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতা যদি বলেন ‘‘ইসলাম শান্তির ধর্ম... ইত্যাদি’’ তাতে সন্ত্রাসে লিপ্ত যুবক পরিতৃপ্ত বা ‘কনভিন্সড’ হবে না; তবে যদি একজন প্রাজ্ঞ নেককার আলিম এ বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করেন তাহলে তা হয়ত তাকে পরিতৃপ্ত বা ‘কনভিন্সসড’ করতে পারবে।
এতে যেমন সংশ্লিষ্ট অনেকে সংশোধিত হবে তেমনি নতুন অর্ন্তভুক্তি কমে যাবে। ইসলামের ধর্মীয় ব্যবস্থার মধ্যে আল্লাহ ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা রেখেছেন। এর অন্যতম হলো মসজিদ ও সালাতুল জুমুআ। জুমুআর খুতবা ও আলোচনা সাধারণভাবে মুমিনের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। সকল ব্যক্তিগত ও সামাজিক অপরাধ ও অবক্ষয়ের ন্যায় জঙ্গিবাদ বা উগ্রতা রোধেও ইমামগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এজন্য মসজিদগুলিতে যোগ্য ইমাম নিয়োগ দেওয়া এবং বিদ্যমান ইমামদের ধর্মীয় জ্ঞান ও যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। সরকার যদি নিয়ন্ত্রণের নামে ইমামদের কথা বলা বন্ধ করেন তাহলে তা কোনো ভাল ফল দিবে না; বরং উল্টো ফল দিবে। ইমামগণ যদি সামাজিক অন্যায়, অবক্ষয় ইত্যাদির বিরুদ্ধে কিছু না বলে শুধুই ফযীলত ও গল্পের ওয়ায করেন তাহলে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে কোনো লাভ হবে না। ইমামগণ যদি সমাজ বা সরকারের অন্যায়ের কোনো প্রতিবাদ না করে শুধু উগ্রতার নিন্দা করেন তাহলেও তা মানুষের মনে রেখাপাত করবে না। কেউ একপেশে কথা পছন্দ করেন না এবং তাতে প্রভাবিত হন না।
ইমামগণ যদি সামাজিক অন্যায়, অবক্ষয়, অশ্লীলতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুন্নাত-সম্মত পদ্ধতিতে কথা বলেন, এগুলির বিরুদ্ধে আপত্তি ও প্রতিবাদের সুন্নাত-সম্মত পদ্ধতি জানিয়ে দেন, উগ্রতা, বলপ্রয়োগ, আইন অমান্য ও বিদ্রোহের কারণে মুমিন দুনিয়া ও আখিরাতে কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং দীনী দাওয়াত কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্ন আঙ্গিকে তার তথ্যভিত্তিক আলোচনা করেন তাহলে তা খুবই ভাল ফল দিবে।
৩. ১১. ১. ৮. আসমানী কারণ নিয়ন্ত্রণ করুন
অনেক সময় আমরা ভাবি যে, অমুক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা অমুক অন্যায় নির্মূল করব বা উন্নয়ন নিশ্চিত করব। আমরা ভুলে যায় যে, আমাদের পরিকল্পনার বাইরে মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তই আমাদের সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিছু কিছু পাপ সমাজে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়লে আল্লাহ সে সমাজে সামাজিক অবক্ষয় ও অশান্তি ছড়িয়ে দেন। আমরা যদি অবক্ষয় ও অশান্তির এ সকল কারণ দূর করতে না পারি তবে শত পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার পরেও অবক্ষয় ও অশান্তি আমাদের দেশ ও সমাজকে গ্রাস করবেই। এক প্রকারের অশান্তি দূর করলে অন্য প্রকারের অশান্তি আমাদের গ্রাস করবে। আমরা মহান আল্লাহর গযব ও শাস্তি থেকে পালাতে পারব না। বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অশ্লীলতা, দুর্নীতি, ওজন, মাপ বা পরিমাপে কম দেওয়া, ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ইত্যাদি এ জাতীয় পাপের অন্যতম। মহান আল্লাহ বলেন:
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ
آمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ
فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ
بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ
‘‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক জনপদের যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিত, যেথায় আসত সবদিক থেকে প্রচুর জীবনোপকরণ, অতপর তারা আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল, ফলে তারা যা করত তার কারণে আল্লাহ তাদেরক আস্বাদ গ্রহণ করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছাদনের।’’ কাজেই আমরা যদি আল্লাহর নিয়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই থাকি আর পাশাপাশি ক্ষুধা ও ভয়-সন্ত্রাসের বেড়াজাল থেকে বের হতে চেষ্টা করি তবে চেষ্টা অনেক হলেও ফল আশানুরূপ হবে না। ক্ষুধা ও ভয়ের একটি জাল ছিন্ন করলে অন্য জাল আমাদের জড়াবে। আল্লাহ আরো বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا
لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ
وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘‘যারা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক তাদের জন্য পৃথিবীতে এবং আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।’’
কাজেই আমরা অশ্লীলতার প্রচার, প্রসার ও বিপনন অব্যাহত রেখে মহা-পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজ থেকে ‘যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি ’ দূর বা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হব বলে চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই।
এ অর্থের অন্যান্য আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, অশ্লীলতা, ভেজাল, মাপ বা পরিমাপে কম প্রদান, প্রতারণা, জুলুম, হত্যাকান্ড, ন্যায়বিচারের দুষ্প্রাপ্যতা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ না করলে বিভিন্নভাবে সমাজে আল্লাহর শাস্তি ও গযব আসবেই। এগুলি রোধ করতে এবং সকল নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীন ন্যায়বিচার লাভের সুযোগ নিশ্চিত করতে সমাজের সকল নাগরিক ও সরকারকে সচেতন প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এর পাশাপাশি সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও অন্যান্য সকল ‘দুনিয়াবী যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি’ সমাজ থেকে নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাতে হবে। তাহলেই আমরা আশানুরূপ ফল পাব, ইনশা আল্লাহ।
৩. ১১. ২. আলিম ও ‘দায়ী’গণের করণীয়
জঙ্গিবাদে যেহেতু ইসলামের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে সেহেতু এর নিয়ন্ত্রণে আলিম, ইমাম, আল্লাহর পথে দাওয়াতের লিপ্ত ব্যক্তি বা ‘‘দায়ী ইলাল্লাহ’’ এবং ধার্মিক মুসলিমদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। একথা সত্য যে, সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসন বিরোধী স্বাধীকার আন্দোলনকে জঙ্গিবাদ নাম দেওয়া হচ্ছে এবং জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে সারাবিশ্বে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষাকে নিন্দিত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি নিজেদের প্রয়োজনে ‘জঙ্গি’ তৈরি করেছে এবং তাদের কর্মকান্ডের জন্য ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষাকে দায়ী করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পাশাপাশি একথাও সত্য যে আমাদের দেশে ও বিভিন্ন দেশে কিছু মানুষ ইসলাম প্রতিষ্ঠা, ইসলামী রাষ্ট্র বা বিচার প্রতিষ্ঠা, অন্যায় প্রতিরোধ, অন্যায়কারীর শাস্তি ইত্যাদি ইসলাম-নির্দেশিত কর্মের নামে ইসলামনিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত হচ্ছেন। এদের বিভ্রান্তি দূর করার মূল দায়িত্ব আলিম ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের। জঙ্গিবাদের জন্য পাশ্চাত্যকে, সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণাকে বা ইসলামের শত্রুদেরকে দায়ী করে বক্তব্য দিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। পাশাপাশি বিভ্রান্তির তাত্ত্বিক পর্যালোচনা প্রয়োজন। ইসলামের নামে উগ্রতা বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত সকলেই অমুসলিমদের এজেন্ট বা ক্রীড়ানক বলে মনে করার কারণ নেই। এদের মধ্যে কেউ এমন থাকলেও অন্য অনেক মানুষ রয়েছেন যারা দীনী আবেগ নিয়ে সাওয়াবের ও নাজাতের উদ্দেশ্যে উগ্রতা, সহিংসতা ও খুনখারাপিতে লিপ্ত হচ্ছেন। এদেরকে সঠিক জ্ঞান প্রদান ও বিভ্রান্তি অপনোদনের দায়িত্ব আলিম সমাজের। ইসলামী শিক্ষার বিকৃতি রোধ করার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীগণের সুন্নাত অনুসারে ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ ও দীনী দাওয়াতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়া আলিমগণের দায়িত্ব।
৩. ১১. ২. ১. আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
আফগানিস্তান, সোমালিয়া বা ইরাকের মত ভৌগলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে বাংলাদেশের। কাজেই সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ও আন্তর্জাতিক বেনিয়া-চক্র যে কোনো মূল্যে এদেশের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চেষ্টা করবেন। কখনো তারা জঙ্গি তৈরি করবেন এবং কখনো জঙ্গিবাদের অযুহাতে ধার্মিক মানুষদের হয়রানি, অত্যাচার, ইসলাম প্রচারকদের কণ্ঠরোধ, ইসলামী শিক্ষা সংকোচন ইত্যাদির মাধ্যমে জঙ্গিবাদকে উস্কে দিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে সরকার ও প্রশাসনকে তাদের সহায়তা গ্রহণে বাধ্য করবেন।
এ ক্ষেত্রে আমাদের মত ক্ষুদ্র মানুষদের আল্লাহর কাছে ক্রন্দন করা ছাড়া তেমন কিছুই করার নেই। এ ‘‘ক্রন্দন’’-কে অবহেলা করবেন না। আমাদের সকলেরই দায়িত্ব নিজের ব্যক্তিগত কষ্টে-বিপদে যেভাবে হৃদয়ের পরিপূর্ণ আবেগ দিয়ে আল্লাহর কাছে কাঁদি, তেমনি পরিপূর্ণ আবেগ ও বেদনা নিয়ে দল-মত নির্বিশেষে উম্মাতের জন্য আল্লাহর কাছে স-ক্রন্দন দুআ করা। ঈমানের ন্যূনতম দাবী এ ক্রন্দন ও দুআ।
এখন প্রয়োজন এমন কিছু আল্লাহ-ওয়ালা আলিম ও ‘দায়ী’র যারা একদিকে সরকার, প্রশাসন ও দায়িত্বশীলদেরকে পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও ভালবাসার সাথে গঠনমূলক পরামর্শ দিবেন এবং তাদের জন্য দুআ করবেন। অপরদিকে দীনের দাওয়াতে আগ্রহী ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ধার্মিক মানুষদেরকে হটকারিতা, উগ্রতা ও হতাশা পরিত্যাগ করে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ অনুসারে ধৈর্য, প্রজ্ঞা, ‘সহিংসতার পরিবর্তে অহিংসতা’ ও ‘খারাপের মুকাবিলায় ভাল আচরণ’ দ্বারা দাওয়াতের কাজ অব্যাহত রাখার অনুপ্রেরণা দিবেন। তাঁরা হটকারিতার মাধ্যমে দাওয়াতকে সহিংসতায় লিপ্ত করার তাত্ত্বিক বিভ্রান্তিগুলি মুমিনদের জন্য প্রকাশ করবেন। তাঁদের ধার্মিকতা, ইখলাস, ইলম ও আমল মুমিনদেরকে তাদের পরামর্শ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে।
এরূপ আল্লাহ-ওয়ালা আলিম ও দায়ীদের অভাব আমরা অনুভব করি। অন্তত সমাজের মূলধারার আলিম-উলামা, চিন্তাবিদ ও পীর-মাশাইখ কিছুটা ঐক্যবদ্ধ হলে তাঁরা সমবেতভাবে এরূপ দায়িত্ব পালনে অধিকতর সক্ষম হতেন। তাঁরা যদি সুন্নাতের আলোকে কিছু মতভেদ মেনে নিয়ে ‘‘জামা‘আত’’ বা ঐক্য ও পারস্পরিক ভালবাসা প্রতিষ্ঠা করতেন এবং উম্মাতে মুহাম্মাদীর প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা নিয়ে সকলে মিলে জঙ্গিবাদের মত বিষয়ে মতবিনিময় করতে পারতেন তাহলে দীনের নামে সকল বিভ্রান্তি ও উগ্রতা সহজেই দূরীভূত করা সম্ভব হতো। কিন্তু বাহ্যত তা সম্ভব নয়। যদিও কুরআন-হাদীসে বারংবার ঐক্য ও ভালবাসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তবুও এ নির্দেশ প্রতিষ্ঠার সুযোগ বর্তমানে আমাদের আছে বলে মনে হচ্ছে না। ইন্না লিল¬াহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!
৩. ১১. ২. ২. উগ্রতার প্রসারে দায়ীগণের বিচ্ছিন্নতার ভূমিকা
আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ ও ‘‘দায়ী’’-গণের পারস্পরিক শত্রুতা, বিচ্ছিন্নতা, দলাদলি ও গালাগালিতে দীনের শত্রুদের ছাড়া আর কারো কল্যাণ হচ্ছে বলে আমরা দেখছি না। এরূপ বিভক্তির কারণে একদিকে যেমন ইসলামের দাওয়াত ব্যাহত হচ্ছে এবং দীনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে, অপরদিকে সমাজের অনেক আবেগী যুবক মূলধারার আলিম-উলামা ও পীর-মাশাইখদের বিষয়ে হতাশা ও কুধারণা পোষণ করে উগ্রতার আহবানকারীদের ক্ষপ্পরে পড়ে যাচ্ছে।
৩. ১১. ২. ৩. বিভক্তির পরিণতি
পতন ও অবক্ষয়ের যুগগুলিতে বিভক্তি ও দলাদলির এ অবস্থা থেকেছে। ক্রুসেড ও তাতার যুদ্ধের সময় শিয়া-সুন্নী, হানাফীশাফিয়ী, শাফিয়ী-হাম্বলী এরূপ হানাহানি চলেছে। বিবাদমান বিভিন্ন দল ক্রুসেডার বা তাতারদের বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, আমরা আপনাদের পক্ষের শক্তি, আমাদের প্রতিপক্ষরাই আপনাদের শত্রু, কাজেই তাদের ঘায়েল করুন। কিন্তু ক্রুসেডার বা তাতারগণ যখন হত্যাকান্ড চালিয়েছেন তখন পক্ষ-বিপক্ষ বিচার করেন নি, সকল পক্ষের সকল মুসলিম নারী-পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছেন।
বর্তমানে বোসনিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, সোমালিয়া ও অন্যান্য দেশে আমরা একই অবস্থা দেখতে পাই। আলিমগণ একে অপরকে খারাপ বলেছেন। আর দখলদার বাহিনী তাদের বোমাবর্ষণ ও গণহত্যাযজ্ঞে সকলকে নির্বিচারে হত্যা করেছেন, কে কোন্ মতের তা যাচাই করছেন না।
৩. ১১. ২. ৪. বিভক্তির আগুনে ঘৃতাহূতি না দেওয়া
এ বিভক্তি ও দলাদলি দুঃখজনক হলেও এজন্য হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এর মধ্য দিয়েই দীনী দাওয়াত এগিয়ে চলেছে ও চলবে। আমাদেরকেও দাওয়াত এগিয়ে নিতে হবে। আমরা হয়ত উম্মাতের এ বিভক্তি দূর করতে পারব না, তবে আমাদের দ্বারা যেন কোনো অবস্থাতেই উম্মাতের বিভক্তি ও বেদনা বৃদ্ধি না পায়। আমরা অনেক সময় ঐক্যের কথা বলি, তবে আমাদের বিভিন্ন মতবাদ আমাদের অজ্ঞাতসারেই অনৈক্য ও উগ্রতা উস্কে দেয়। এর অন্যতম বিষয় হলো ‘নিজেদের কর্ম বা কর্মপদ্ধতিকে’ একমাত্র ‘‘সঠিক’’ বা একমাত্র ‘‘পরিপূর্ণ’’ বলে দাবি করা।
অতীতে ও বর্তমানে আমাদের দেশে ও সকল মুসলিম দেশে ইসলামী দাওয়াতের দায়িত্ব বিভিন্নভাবে পালিত হয়েছে ও হচ্ছে। তন্মধ্যে চারটি ধারা উল্লেখযোগ্য: (১) শিক্ষা বিস্তার, (২) গণ-দাওয়াত, (৩) দরবার-খানকা ও (৪) রাজনীতি। এ চারটি ধারার মাধ্যমে সকলেই একটি ইবাদতই পালন করছেন, যার নাম ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’। প্রত্যেকে নিজের পদ্ধতিকে উত্তম প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন দলীল প্রমাণ পেশ করতে যেয়ে এমন ধারণা দিচ্ছেন যে, তার পদ্ধতির বাইরের পদ্ধতিগুলিতে যারা এ ইবাদত পালন করছেন তাদের ইবাদত হচ্ছে না বা কম মানের হচ্ছে। এভাবে মানের কারণে নয়, শুধু পদ্ধতির কারণে অন্যের কর্মকে অবমূল্যায়ন করার ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অপসারিত হচ্ছে, দলাদলি ও গালাগালি বৃদ্ধি পাচ্ছে, পারস্পরিক সহনশীলতা কমছে, উগ্রতা বাড়ছে এবং উগ্রতার পটভূমি প্রসারিত হচ্ছে। সর্বোপরি এভাবে বিচ্ছিন্নতা স্থায়ী হচ্ছে এবং উগ্রতা ও অন্যান্য অবক্ষয় রোধে ঐক্যবদ্ধ ইজতিহাদের সম্ভাবনা রহিত হচ্ছে।
৩. ১১. ২. ৫. সঠিক দাওয়াত ও বিকৃতি রোধ
আমাদের দায়িত্ব, সকল প্রতিকূলতার মধ্যে দীনী দাওয়াতকে অব্যাহত রাখা এবং পাশাপাশি দীনের যে সকল শিক্ষা বিকৃত করে একজন মুমিনকে উগ্রতায় লিপ্ত করা সম্ভব সেগুলির সঠিক চিত্র মুসলিম উম্মাহর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করা। আমরা এ গ্রন্থে আমাদের সীমিত যোগ্যতা ও সীমিত জ্ঞানের আলোকে এ বিষয়ক কিছু তথ্য উল্লেখ করেছি। আশা করছি, যোগ্য ও প্রাজ্ঞ আলিমগণ এগুলির ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে এ বিষয়ে আরো উন্নত গবেষণা উম্মাতের জন্য পেশ করবেন।
৩. ১১. ২. ৬. তাকফীর, ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা বর্জন
সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও সুন্নাতে নববী ও সুন্নাতে সাহাবার আলোকে আল্লাহর পথে দাওয়াতের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে যে সকল সাধারণ ভুলত্রুটি উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা ছড়াতে পারে তা সচেতনতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এগুলির অন্যতম হলো দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার কারণে বিরোধীদেরকে কাফির, ইসলামের শত্রু বা অনুরূপ বিশেষণে আখ্যায়িত করার প্রবণতা।
বস্ত্তত সমাজকে, সমাজের নেতৃবৃন্দকে বা আলিমগণকে ঘৃণা না করে কেউ সন্ত্রাসী, চরমপন্থী বা জঙ্গি কর্মে লিপ্ত হতে পারে না। আর আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ ও দীনের দাওয়াতে কর্মরত অনেকেই জেনে অথবা না জেনে এরূপ ঘৃণা ছড়াচ্ছেন।
‘‘তাকফীর’’ বা কাফির কথন আমাদের সমাজে বিভিন্নভাবে বিদ্যমান। আমাদের অনেকে খারিজী, মুতাযিলী ও অন্যান্য বিভ্রান্ত ফিরকার ন্যায় দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্য, মতামত, মতভেদীয় বিষয় বা মুসতাহাব-মাকরূহ বিষয়াদিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা ব্যাখ্যা দিয়ে কুফরী বলে প্রমাণের চেষ্টা করছেন। দলগত, পদ্ধতিগত বা মাসআলাগত মতভেদে বা কর্মপদ্ধতির ভিন্নতার কারণে একে অপরকে ‘‘ইসলামের শত্রু’’, ‘‘শত্রুদের দালাল’’, ‘‘ইহূদী-খৃস্টানদের এজেন্ট’’, ‘‘নবী-ওলীগণের দুশমন’’, ইত্যাদি বলে পারস্পারিক ঘৃণা উস্কে দিচ্ছেন। এ সবই ‘‘তাকফীর’’ বা কাফির কথনের বিভিন্ন রূপ। এসবই ধর্মীয় উগ্রতা উস্কে দিচ্ছে।
দলগত, পদ্ধতিগত বা মাসআলাগত মতভেদের কারণে ‘‘ইসলামের শত্রু’’, ‘শত্রুদের দালাল’ বা অনুরূপ কোনো বিশেষণে আখ্যায়িত করা বর্জন করতে হবে। কোনো আলিম বা ইসলামী ব্যক্তিত্ব আপনার মতের বিরোধিতা করলে, আপনার সাথে শত্রুতা করলে বা আপনার বিরুদ্ধে ফাতওয়া দিলে আপনি তাকে ইসলামের শত্রু বলে গণ্য করবেন না। বরং বিষয়টিকে তার ইজতিহাদ ও ভুল বলে গণ্য করে হৃদয়ে তার ভালবাসা, কর্মে তার সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ ও তার জন্য দুআ অব্যাহত রাখুন। আল্লাহ বলেছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ
قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَىٰ أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ
نِسَاءٍ عَسَىٰ أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ
وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ
وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
‘‘হে মুমিনগণ, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর সম্প্রদায়কে উপহাস-বিদ্রূপ না করে; হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। কোনো নারী যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ-উপহাস না করে; হতে পারে সে বিদ্রূপকারিনী অপেক্ষা উত্তম। আর তোমরা একে অপরকে নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপাধি দিয়ে ডেকো না। ঈমানের পর পাপী নাম পাওয়া খুবই খারাপ বিষয়। আর যারা তাওবা করে না তারাই যালিম।’’[1]
এ নির্দেশনা কার জন্য? আল্লাহর এ নির্দেশ কি পারস্পরিক (reciprocal)? অর্থাৎ যে আমাকে ভাল বলবে আমি তাকে ভাল বলব? নাকি এ নির্দেশ পালন আমার-আপনার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব? অন্যরা আপনাকে উপহাস-বিদ্রুপ করে, নিন্দা করে বা মন্দ উপাধি দেয় বলে আপনিও তাদেরকে অনুরূপ করবেন? এরূপ কোনো অনুমতি কি আল্লাহ দিয়েছেন? কেউ পালন করুক আর না করুক, আমি সর্বাবস্থায় আল্লাহর এ সকল নির্দেশ পালন করব-এরূপ সিদ্ধান্ত কি আমরা নিতে পারি না? অনেক মুসলিম অজ্ঞতা বা জাগতিক স্বার্থের কারণে দীনী দাওয়াতের বিরোধিতা করেন। তারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করেন, ইসলামের কিছু বিধান পালন করেন, কিন্তু আল্লাহর পথে আহবানকারীদের মতামতকে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি বলে মনে করেন। যেমন, অনেকে সালাতুল ঈদ, সালাতুল জানাযা, শবে-বরাতের সালাত ইত্যাদি আদায় করেন, কুরবানী, আকীকা, কুলখানী ইত্যাদি পালন করেন, কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের বিষয়ে বা পর্দাপালন, সুদ-বর্জন, নৃত্যগীতি-বর্জন ইত্যাদি বিষয়ে কড়াকাড়িকে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি বলে মনে করেন। তাদের এ অজ্ঞতার জন্য তাদের নিজেদের অবহেলার পাশাপাশি যুগযুগ ধরে সমাজের সাধারণ আলিমগণের দীন প্রচারের ক্ষেত্রে অবহেলা ও দুর্বলতাও দায়ী।
এদের বিরোধিতার কারণে আল্লাহর পথে আহবানকারীরা এদেরকে বিভিন্ন ভাবে ‘‘তাকফীর’’ করেন। তাদেরকে ‘কাফির’, ‘কাফির পর্যায়ের’ বা ‘ইসলামের শত্রু’ আখ্যায়িত করে কঠিনভাবে তাদের বিরুদ্ধে আক্রোশমূলক কথা বলেন। নামায-রোযা পালন করলেও তাদের কোনো লাভ হবে না বলে দাবি করেন। কালিমা পড়ে এবং নামায-রোযা পালন করেও তারা কাফির বা কাফির পর্যায়ের থাকবে বলে ঘোষনা করেন!! এরূপ আচরণ ও কথাবার্তা বিভিন্নভাবে সহিংসতা ছড়ায়। এগুলিকে হালকা করে দেখার কোনো উপায় নেই। কারণ এরূপ একটি উগ্রতা পরবর্তী অনেক উগ্রতার পথ খুলে দেয়।
আল্লাহর নির্দেশানুসারে খারাপের মুকাবিলায় উত্তম দিয়ে, সুন্দর উপদেশ, প্রজ্ঞা এবং উত্তম বিতর্কের মাধ্যমে তাদের বিভ্রান্তি চিহ্নিত করুন, এরূপ বিভ্রন্তি যে কুফরীতে নিপতিত করতে পারে তা বুঝান এবং তাদেরকে দীনের সঠিক জ্ঞান প্রদানের চেষ্টা করুন। কিন্তু কখনোই ‘‘ইসলামের শত্রু’’ ইত্যাদি বলে ‘‘তাকফীরের’’ মত কঠিন পাপের মধ্যে নিপতিত হবেন না। এদের অনেকেই ‘‘দায়ী’’ বা প্রচারকের ‘‘গরম’’ ও আক্রমনাত্মক কথা ও আচরণের কারণেই দাওয়াতের বিরোধিতা করেন। আর ‘‘দায়ী’’ নিজেকে ইসলামের প্রতিভূ বিবেচনা করে তার বা তার মতের সাথে শত্রুতার কারণে মুসলিমকে ইসলামের শত্রু বানিয়ে দেন। এভাবে উগ্রতার দরজা খুলে যায়।
আল্লাহ ‘হক্ক’ কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন কিন্ত ‘গরম’ কথা বলতে নির্দেশ দেননি। হক্ক কথাকে নরম করে বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম তাগূত খোদাদ্রোহী জালিম ফিরাউনের কাছে মূসা ও হারূন (আ) কে প্রেরণ করে তিনি নরম কথার নির্দেশ দিয়ে বলেন:
اذْهَبَا إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ
‘‘তোমর উভয়ে ফিরাউনের নিকট গমন কর, সে অবাধ্যতা ও সীমালংঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নরম কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে বা ভয় করবে।’’[2]
এ যদি হয় কাফিরকে আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রে নবী-রাসূলগণের প্রতি নির্দেশ, তাহলে যারা কালিমা পড়েছেন, মুসলিম বলে নিজেকে মনে করছেন তাদেরকে আদেশ নিষেধ করার ক্ষেত্রে আমাদের আরো কত বিনম্র ও বন্ধুভাবাপন্ন হওয়া উচিত তা একটু চিন্তা করুন। আল্লাহ আরো বলেন:
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ
عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ
‘‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে যাদের ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিবে না; কারণ ফলে তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিবে।’’[3]
এ যদি হয় কাফিরদের পূজনীয়দের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ, তাহলে মুসলিমকে আদেশ-নিষেধ করতে যেয়ে তাকে, তার ভ্রান্ত বা জাগতিক মতের নেতা বা সাথীদেরকে গালি দেওয়া কিভাবে বৈধ হবে? আল্লাহ বলেন:
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا
الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ
‘‘এবং তোমরা উত্তম আচরণে ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের অনুসারীদের সাথে বিতর্ক করো না; তাদের মধ্যে যারা জুলুম করেছে তাদের সাথে ছাড়া।’’[4]
ইহূদী-খৃস্টানগণ ‘‘কিতাব’’ মানার দাবি করেছে, কিন্তু কখনোই মানে নি, বরং উল্টো চলেছে এবং কিতাব বিকৃত করেছে বলে আল্লাহই জানিয়েছেন, তারপরও তাদের সাথে এরূপ উত্তম আচরণের নির্দেশ দিলেন আল্লাহ। তাহলে যে ব্যক্তি কুরআন মানার দাবি করছেন, কিন্তু মানছেন না বলে আপনি দাবি করছেন, তার সাথে আপনার আচরণ কিরূপ হওয়া দরকার? দীন প্রতিষ্ঠার কর্মে নিয়োজিত সকলকেই বুঝতে হবে যে, আমরা ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ নামক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালন করছি। এ ইবাদত যদি কুরআন-সুন্নাহর শেখানো পদ্ধতিতে সুন্নাত-সম্মত পন্থায় পালন করতে পারি, তবে আমরা অভাবনীয় সাওয়াব অর্জন করতে পারব। বিশেষত কুফর, ইলহাদ, ব্যক্তিমতপূজা, স্বার্থপরতা ও অবক্ষয়ের যুগে দাওয়াত ও আদেশ-নিষেধের দায়িত্ব পালন খুবই বড় কাজ। এ পরিস্থিতিতে সুন্নাতপদ্ধতিতে দাওয়াতের দায়িত্ব পালনকারী একজন মুমিন ৫০ জন সাহাবী বা সিদ্দীকের সাওয়াব লাভ করবেন বলে সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।[5] কিন্তু আমরা যদি এ ইবাদত কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পদ্ধতির ব্যতিক্রমভাবে পালন করি বা আমাদের প্রবৃত্তি ও প্রতিশোধস্পৃহার তাড়নায় উগ্রতায় লিপ্ত হই তাহলে আমরা কঠিন পাপে নিপতিত হওয়ার পাশাপাশি ইসলাম ও দীনী দাওয়াতকে কলঙ্কিত করব এবং প্রকৃত অর্থে আমরাই আল্লাহর কাছে ‘‘ইসলামের শত্রু’’ বলে গণ্য হব। নাউযূ বিল্লাহ মিন যালিকা! মুমিনের আচরণ ও প্রকৃতি বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
المُؤمِنُ يألَفُ ويُؤلَفُ ولا خيرَ فيمَنْ لا يألَفُ ولا يُؤلَفُ
‘‘মুমিন ঐ ব্যক্তি যে নিজে অন্যদেরকে ভালবাসে এবং অন্যেরাও তাকে ভালবাসে। যে ব্যক্তি নিজে অন্যদের ভালবাসে না এবং অন্যরাও তাকে ভালবাসে না তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।’’[6]
মুমিনের এ প্রকৃতি কাদের জন্য? যারা তার দলের, মতের বা তাকে ভক্তি করে তাদের জন্য? না জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য?
দেশের প্রায় ৯০% মুসলিম দীন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা রাখেন না। তারা ইসলাম বলতে যা বুঝেন তা তারা পালন ও প্রতিষ্ঠা করেন। তাদেরকে ইসলামের সঠিক জ্ঞান দান করা আলিম ও দায়ীগণের দায়িত্ব। কষ্ট করে দীনের দাওয়াত না দিয়ে আপনি রাতারাতি ইসলাম কায়েম করতে চান? পাপের কারণে আপনি পাপীদেরকে মেরে কমিয়ে ফেলতে চান? অথচ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাফিরদেরকে বাঁচাতে উদগ্রীব ছিলেন, হয়ত তাদের পরবর্তী প্রজন্মদের মধ্য থেকে কেউ মুসলিম হবে। মক্কাবাসীদের অত্যাচারে জর্জরিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তায়েফে যেয়ে পেলেন নির্মমতম অত্যাচার। সে সময়ে জিবরাঈল (আ) পাহাড়ের ফিরিশতাকে নিয়ে তাঁর নিকট আগমন করে বলেন, আপনার অনুমতি হলে পাহাড় উঠিয়ে এ সকল জনপদ ধ্বংস করে দেওয়া হবে। কঠিনতম কষ্টের সে
মুহুর্তেও তিনি বলেন,
بل أرجو أن يخرجَ اللهُ من أصلابهم من يعبد اللهَ وحده، لا يشركُ به شيئًا
‘‘না। বরং আমি আশা করি যে, আল্লাহ হয়ত এদের ঔরস থেকে এমন মানুষের জন্ম দেবেন যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কিছু শরিক করবে না।’’[7] যে কাফিরগণ তাঁর দেহকে রক্তরঞ্জিত করছে তাদেরই জন্য তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন, যেন তাঁকে আঘাতের কারণে আল্লাহ তাদের ধ্বংস না করেন। তিনি তাঁর কপালের রক্ত মুছছেন এবং বলছেন,
ربِّ اغفرْ لقومي فإنهم لا يعلمونَ
‘‘হে আমার প্রতিপালক, আমার জাতিকে আপনি ক্ষমা করে দিন, কারণ তারা জানে না।’’[8]
[1] সূরা হুজরাত: ১১ আয়াত।
[2] সূরা তাহা ৪৩-৪৪ আয়াত।
[3] সূরা আন’আমের ১০৮ আয়াত।
[4] সূরা (২৯) আনকাবুত: ৪৬ আয়াত।
[5] আবু দাউদ, আস-সুনান ৪/১২৩, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১৩৩০; তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৫৭; আলবানী, সহীহাহ ১/৮১২।
[6] আলবানী, সহীহুল জামি’ ২/১১৩০-১১৩১। হাদিসটি হাসান।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১১৮০; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪২০।
[8] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৮২, ৬/২৫৩৯; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৪৭; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৩/২৫৪; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ৬/৫২১, ৭/৩৭২-৩৭৩, ৮/৫০৮, ১১/১৯৬, ১২/২৮২।
৩. ১১. ২. ৭. দুনিয়ামুখিতা বা ফলাফল-মুখিতা
অন্য যে বিষয়টি উগ্রতার পথ উন্মুক্ত করে তা হলো দাওয়াতের দুনিয়ামুখিতা ও দুনিয়ার ফলাফল বিচার। রাতারাতি, অল্প কিছু দিনে বা বৎসরে বা পরিকল্পিত সময়ের মধ্যে সব কিছু ভাল করে ফেলার বা কোনো জাগতিক ‘‘ফল’’ অর্জন করার চিন্তা যেমন অবাস্তব ও আল্লাহর সুন্নাতের বিরোধী, তেমনি কিছুই হবে না বলে হতাশ হয়ে পড়া অথবা বলে কিছু লাভ হবে না মনে করে দাওয়াতের দায়িত্বে অবহেলা করাও ধ্বংসাত্মক ও আল্লাহর আদেশের বিরোধী। ইসলামের বিজয়ের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ দিয়েছেন এবং তিনিই একে এগিয়ে নিবেন। মুমিনের দায়িত্ব সুন্নাতের আলোকে নিজের কর্ম আঞ্জাম দেওয়া।
৩. ১১. ২. ৮. ইসলামের বিপন্নতায় হতাশা
হতাশা মানুষকে মরিয়া (ফবংঢ়বৎধঃব) করে তোলে। এতে মানুষ উগ্রতায় নিপতিত হয়। মুমিন সমকালীন পরিস্থিতি দেখে ইসলামের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ হয়ে এরূপ মরিয়া হয়ে উঠতে পারেন। ইসলাম বিপন্ন বলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। পোপের নির্দেশে ও অনুপ্রেরণায় ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ, ধর্ম প্রতিষ্ঠা ও বিনা-হিসাবে জান্নাত গমনের উন্মাদনা নিয়ে সমগ্র ইউরোপ একত্রিত হয়ে ১০৯৫ খৃ/৪৮৮ হি থেকে প্রায় ২ শত বৎসর বর্বর ক্রুসেড যুদ্ধ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধে। পঙ্গপালের মত মিলিয়ন মিলিয়ন ধর্মযোদ্ধা ক্রুশ উচিয়ে মুসলিম দেশগুলিতে ঝাপিয়ে পড়েছে, নারী, পুরুষ ও শিশু-সহ লক্ষলক্ষ মানুষ হত্যা করেছে এবং একের পর এক মুসলিম দেশ দখল করে নিয়েছে। ক্রুসেডারগণ দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, কয়েক বছরের মধ্যেই তারা মক্কা ও মদীনা দখল করে ইসলামকে চিরতরে নির্মুল করবেন। সমাজ সচেতন মুসলিম ও ‘দায়ী’গণ অনেকেই ভেবেছেন, ইসলাম বুঝি বিপন্ন। কিন্তু ইসলাম বিপন্ন হয় নি। পাপ, অনাচার, জুলুম, দলাদলি ও হানাহানিতে লিপ্ত মুসলিমগণ শাস্তি পেলেও ইসলাম বিজয়ী হয়েছে। মুসলিমদের ঐক্য ও প্রস্ত্ততি ছিল না। তার পরও মুসলিমগণ আগ্রাসী ক্রুসেডারদের সকল মুসলিম ভূমি থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছেন। উপরন্তু ক্রুসেড যুদ্ধের পরে এরই ধারাবাহিকতায় ক্রমান্বয়ে মুসলিমগণ পূর্ব ইউরোপের প্রায় অর্ধাংশ অধিকার করতে সক্ষম হন। ক্রুসেডারগণ চেয়েছিলেন ইসলামকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুছে দিতে। কিন্তু এ যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম ইউরোপে স্থায়ীভাবে তার আসন গেড়েছে।
ক্রুসেড যুদ্ধের পরেই পূর্ব থেকে তাতার আক্রমন শুরু হয়েছে। অকল্পনীয় বর্বর সে আক্রমনের সামনে একের পর এক মুসলিম দেশের পতন হয়েছে। লক্ষলক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ধ্বংস হয়েছে সম্পদ ও মানব ঐতিহ্য। মুসলিমগণ ভেবেছেন, ইসলাম বুঝি শেষ। কিন্তু পাপ, অনাচার ও বিচ্ছিন্নতায় আকণ্ঠ লিপ্ত মুসলিম সমাজের মানুষেরা শাস্তি পেলেও ইসলাম শেষ হয় নি। যে সময়ে তাতারদের হাতে ইরান, ইরাক, সিরিয়া অন্যান্য দেশের মুসলিমগণ নিহত হচ্ছেন, সে সময়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্স, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের অগণিত মানুষ ক্রমান্বয়ে ইসলামের ছায়াতলে আগমন করছেন। সর্বোপরি যে বর্বর তাতার জাতি অমানবিক আক্রোশে মুসলিম দেশগুলি ধ্বংস করেছে, মাত্র কয়েক বৎসরের মধ্যে তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং সারা বিশ্বে ইসলামী বিজয়ের ঝান্ডাকে এগিয়ে নিতে থাকে। মানব ইতিহাসের এ এক অলৌকিক বিষয়। একটি বিজয়ী জাতি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে একটি বিজিত জাতির ধর্ম গ্রহণ করে সে ধর্মের বিজয় তরান্বিত করতে লাগল!
অনুরূপভাবে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে মুসলিম দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ককে পরাজিত করে ক্রুসেডারগণ ভেবেছিলেন যে, ইসলামের রাজনৈতিক পরিচিতি মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে এবং অচিরেই মিশনারি কর্ম ও ধর্মান্তরের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মও বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সে চিন্তা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্বাধীন মুসলিম দেশগুলিতে পুনরায় ইসলামী জাগরণ ও ইসলমী জীবনব্যবস্থার দিকে ফিরে যাওয়ার আহবান জোরদার হতে থাকে। এ দাবী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হৃদয় স্পর্শ করে। তখনই এ দাওয়াতকে ‘‘উগ্রতা’’-র পথে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমীন ও অন্যান্য ইসলামী দাওয়াতী কর্মকান্ডকে জামাল আব্দুন নাসির ক্ষমতায় আরোহণের জন্য ব্যবহার করেন। এরপর অতর্কিত নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে এ সকল দাওয়াতী কর্মকান্ডকে উগ্রতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এতে জনপ্রিয় দাওয়াত জনবিচ্ছিন্ন উগ্রতায় পর্যবসিত হতে থাকে। যখন দাওয়াতের নেতৃবৃন্দ একে মধ্যপন্থায় আনতে চেষ্টা করেন, তখন আবার ‘‘জামাআতুল মুসলিমীন’’ ধরনের উগ্র দল সৃষ্টি করে আলিম, আল্লাহর পথে দাওয়াতদানকারী ও ধার্মিক মানুষদেরকে এবং ইসলামী জাগরণকে জনগণের কাছে ঘৃণ্য ও জনবিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চলে।
১৯৮৮-১৯৯২ সালে আলজেরিয়ায় ইসলামী দাওয়াত জনপ্রিয়তা লাভ করে। জাতীয় নির্বাচনে ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ইসলামপন্থীদেরকে উগ্রতার পথে ঠেলে দেওয়া হয়। আবেগতাড়িত হয়ে তারা অস্ত্র ও সহিংসতার পথে পা বাড়ায়। আর এর ফলে জনপ্রিয় একটি আন্দোলন জনবিচ্ছিন্ন ও জনধিকৃত সন্ত্রাসে রূপান্তরিত হয়। এভাবে সর্বদা জনপ্রিয় দীনী দাওয়াতকে উগ্রতার মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্নন ও জনধিকৃত বানিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রয়োজেন উগ্রতার প্রচারকদের রোপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহর পথে আহবানকারীদের সতর্ক হতে হবে।
জামাআতুল মুসলিমীনের কর্মকান্ড থেকে মিসর ও ইস্রায়েল সরকার সকল সুবিধা গ্রহণ করেছেন, কিন্তু দীনী দাওয়াত নির্বিচার নিপীড়ন ও নির্যাতন ছাড়া কিছুই পায়নি। ৯/১১ বা ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলা থেকে আমেরিকার নব্য-রক্ষণশীলগণ ও যায়নবাদী ইহদীগণ সকল প্রকার সুবিধা লাভ করেছেন, কিন্তু মুসলিম উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনুরূপ ‘‘জামাআতুল মুসলিমীন’’ বা ‘‘৯/১১’’ তৈরির চেষ্টা বারংবারই করা হবে। এর ক্ষপ্পরে যেন আবেগী যুবকগণ না পড়েন তা নিশ্চিত করতে দীন প্রতিষ্ঠা বা দীনী দাওয়াতের সুন্নাত-সম্মত পদ্ধতি এবং বিভ্রান্তির উৎসগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।
কোনো অবস্থাতেই হতাশ হওয়া বা দ্রুত ফল লাভের চেষ্টা করা মুমিনের কর্ম নয়। মুমিনের দায়িত্ব কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ অনুসারে নিজের দায়িত্ব পালন করা। কোনো মুসলিম রাষ্ট্র জিহাদের শর্ত পূরণ করে জিহাদের আহবান করলে সম্ভব হলে সে জিহাদে শরীক হওয়া। আর সর্বাবস্থায় কুরআন ও সুন্নাতের নির্দেশানুসারে সাহাবীগণ ও পরবর্তীগণের কর্মধারার আলোকে ধৈর্য, প্রজ্ঞা, ও বিনম্রতার সাথে দীনের দাওয়াত এগিয়ে নেওয়া।
ইসলামের ইতিহাস থেকে আমরা দেখি যে, সুন্নাতের আলোকে সাহাবীগণের পন্থাই ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও সংস্কারের সঠিক পন্থা। অন্যায় পরিবর্তনের আবেগ, দ্রুত ফল লাভের উদ্দীপনা বা অন্যায়ের প্রতি অপ্রতিরোধ্য ঘৃণা ইত্যাদির কারণে আবেগী হয়ে যারা সন্ত্রাস, সহিংসতা বা যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছেন তারা ইসলামের কোনো কল্যাণ করতে পারেন নি। খারিজীগণ, বাতিনীগণ ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের অনুসারীদের অনেক গরম ও আবেগী কথা বলেছেন এবং অনেক ‘পরিবর্তনের’ স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু তারা স্বল্প সময়ের কিছু ফিতনা ছাড়া কিছুই করতে পারেন নি। পক্ষান্তরে মধ্যপন্থা অনুসারী আলিমগণ বিদ্রোহ, উগ্রতা, শক্তিপ্রয়োগ, জোরপূর্বক সরকার পরিবর্তন ইত্যাদি পরিহার করে শান্তি-পূর্ণভাবে জনগণ ও সরকারকে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের মাধ্যমে যুগে যুগে মুসলিম সমাজের অবক্ষয় রোধ করেছেন।
শেষকথা
‘‘ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ’’-এর ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, কারণ, উত্তরণ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীগণের কর্মধারার আলোকে কিছু কথা লিখলাম। এর মধ্যে যদি কোনো কল্যাণকর কিছু থাকে তবে তা আমার করুণাময় প্রতিপালক আল্লাহ জাল¬া জালালুহুর একান্ত দয়া। আর এর মধ্যে ভুলভ্রান্তি যা আছে তা সবই আমার নিজের দুর্বলতা ও শয়তানের প্রবঞ্চনার কারণে। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সালাত ও সালাম তাঁর প্রিয়তম হাবীব ও খলীল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ), তাঁর পরিজন, সহচর ও অনুসারীগণের উপর। আর প্রথমে ও শেষে, সর্বদা ও সর্বত্র সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর নিমিত্ত।
গ্রন্থপঞ্জী
এ গ্রন্থে যে সকল গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে বা তথ্য গ্রহণ করা হয়েছে সেসকল গ্রন্থের একটি মোটামুটি তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলো। গ্রন্থগুলি গ্রন্থকারের মৃত্যুতারিখের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক ক্রম অনুসারে সাজানো হয়েছে।
১. আবু হানীফা নুমান ইবনু সাবিত (১৫০হি.), আল-ফিকহুল আকবার, মুল্লা কারীর শারহ সহ, (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৪)
২. শাফিয়ী, মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস (২০৪হি) আল-উম্ম (বৈরুত, দারুল মারিফাহ, ১৩৯৩ হি)
৩. আব্দুর রায্যাক সানআনী (২১১ হি), তাফসীরুল কুরআন (আল-মাকতাবুতশ শামিলা, ৩.৫ (www.sonnhonline.com)
৪. ইবনু আবী শাইবা, আবূ বাকর (২৩৫হি), আল-মুসান্নাফ (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৫)
৫. আহমদ ইবনু হাম্বাল (২৪১হি), আল-মুসনাদ (কাইরো, কুরতুবাহ, ও মা‘আরিফ, ১৯৫৮)
৬. দারিমী, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রাহমান (২৫৫ হি.), আস-সুনান (আল-মাকতাবাতুশ শামিলা, ৩.৫: http://www.islamiccouncil.com)
৭. বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (২৫৬হি), আস-সহীহ (বৈরুত, দারু কাসীর, ইয়ামাহ, ২য় প্রকাশ, ১৯৮৭)
৮. বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর (বৈরুত, লেবানন, দারুল ফিকর)
৯. মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২৬১হি), আস-সহীহ (কাইরো, এহইয়াইল কুতুবিল আরাবিয়্যা)
১০. আবূ দাউদ, সুলাইমান ইবনু আশ‘আস (২৭৫হি), আস-সুনান (বৈরুত, দারুল ফিকর)
১১. ইবনু মাজাহ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ (২৭৫ হি.), আস-সুনান (বৈরুত, দারুল ফিকর)
১২. তিরমিযী, মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা (২৭৯ হি), আস-সুনান (বৈরুত, দারু এহইয়ায়িত তুরাসিল আরাবী)
১৩. মুবার্রিদ, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ (২৮৫হি), আল-কামিল (বৈরুত, মুআস্সাসাতুর রিসাল্লাহ, ২য় প্রকাশ, ১৯৯৩)
১৪. নাসাঈ, আহমদ ইবনু শু‘আইব (৩০৪হি), আস-সুনানুল কুবরা (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ ১৯৯১)
১৫. তাবারী, আবু জা’ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর (৩১০ হি), তাফসীর: জামিউল বায়ান (বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪০৫ হি)
১৬. আবু আওয়ানা, ইয়াকূব ইবনু ইসহাক (৩১৬), আল-মুসনাদ (বৈরুত, দারুল মা’রিফাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৮)
১৭. আবু জা’ফর তাহাবী, আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ (৩২১হি.), আল-আকীদা আত-তাহাবীয়্যাহ, ইবনে আবীল ইজ্জ হানাফীর শারহ সহ, (বৈরুত, আলমাকতাবুল ইসলামী, ৯ম. ১৯৮৮)
১৮. আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, (কাইরো, মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৮)
১৯. ইবনু হিববান, মুহাম্মাদ আল-বুসতি (৩৫৪হি), আস-সহীহ (বৈরুত, মুআসসাসাতুর রিসাল্লাহ, ২য় প্রকাশ, ১৯৯৩)
২০. আল-আজুর্রী, মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন (৩৬০হি), আশ-শারী‘আহ (রিয়াদ, মাকতাবাতু দারিস সালাম, ১ম মুদ্রণ ১৯৯২)
২১. হাকিম নাইসাপূরী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ (৪০৫হি), আল-মুসতাদরাক (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০)
২২. বাগদাদী, আব্দুল কাহির ইবনু তাহির (৪২৯ হি), আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক (বৈরুত, দারুল মারিফাহ)
২৩. দানী, আবূ আমর উসমান ইবনু সাঈদ (৪৪৪ হি), আস-সুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান (রিয়াদ, দারুল আসিমা, ১ম মুদ্রণ, ১৪১৬ হি)
২৪. ইবনু হাযম, আলী ইবনু আহমদ (৪৫৬হি), আল-মুহাল্লা (বৈরুত, ইলমিয়্যাহ)
২৫. ৪৫৮ বাইহাকী, আহমাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি), আস-সুনানুল কুবরা (মাক্কা মুকাররামা, মাকতাবাতু দারিল বায, ১৯৯৪)
২৬. ৪৫৮ বাইহাকী, আহমাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি), শু‘আবুল ঈমান, (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০)
২৭. সারাখসী, আবু বাকর, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ (৪৯০ হি.), আল-মাবসূত (বৈরুত, দারুল মা’রিফাহ, ১৯৮৯)
২৮. রাগিব ইসপাহানী (৫০৭হি), আল-মুফরাদাত ফী গারিবিল কুরআন (বৈরুত. দারুল মারিফাহ, তা. বি.)
২৯. কাসানী, আলাউদ্দীন (৫৮৭হি) বাদাইউস সানাইয় (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)
৩০. ইবনুল জাওযী, আবুল ফারাজ আব্দুর রাহমান ইবনু আলী (৫৯৭ হি), তালবীসু ইবলিস (বৈরুত, দারুল ফিক্র, ১৯৯৪)
৩১. ইবনুল জাওযী, যাদুল মাসীর (আল-মাকতাবাতুশ শামিলা ৩.৫: www.altafsir.com)
৩২. ইবনুল আসীর, মুহাম্মাদ ইবনুল মুবারাক (৬০৬ হি), আন-নিহাইয়াহ ফী গারিবিল হাদীস (বৈরত, দারুল ফিকর)
৩৩. আল-আমিদী, আলী ইবনু মুহাম্মাদ (৬৩১ হি), আল-ইহকাম ( বৈরুত, দারুল কিতাব আল-আরাবী, ১ম মুদ্রণ, ১৪০৪)
৩৪. আল-মাকদিসী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহিদ (৬৪৩ হি), আল-আহাদীসুল মুখতারাহ (মক্কা মুকাররামা, মাকতাবাতুন নাহদাহ আল-হাদীসাহ, ১ম, ১৪১০ হি)
৩৫. মুনযিরী, আব্দুল আযীম ইবনু আব্দুল কাবী (৬৫৬ হি), আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (বৈরুত, দারুল কুতুবলি ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪১৭হি)
৩৬. ইয্য (আব্দুল আযীয) ইবনু আব্দুস সালাম (৬৬০হি), তাফসীরুল ইয্য (বৈরুত, দারু ইবন হায্ম, ১ম প্রকাশ ১৯৯৬)
৩৭. রাযী, মুহাম্মাদ ইবনু আবী বাকর (৬৬৬ হি), মুখতারুস সিহাহ (বৈরুত, মাকতাবাতু লুবনান, ১৯৯৫)
৩৮. কুরতুবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ (৬৭১ হি), আল-জামি লি আহকামিল কুরআন (কাইরো, দারুশ শা’ব, ২য় প্র.)
৩৯. নববী, ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ (৬৭৬ হি.), শারহু সহীহ মুসলিম, (বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৯৮১খ্রি.)
৪০. ইবনু তাইমিয়া, আহমদ ইবনু আব্দুল হালীম (৭২৮ হি) মাজমূউল ফাতাওয়া (রিয়াদ, দারুল ওয়াফা, ৩য় মুদ্রণ, ২০০৫)
৪১. আবূ হাইয়ান মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ (৭৪৫ হি), আল-বাহরুল মুহীত (আল-মাকতাবাতুশ শামিলা, ৩.৫:
http://www.altafsir.com)
৪২. যাহাবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ (৭৪৮ হি.) সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা (বৈরুত, মুআসসাসাতুর রিসাল্লাহ, ৯ম মুদ্রণ, ১৪১৩ হি)
৪৩. ইবনু কাসীর ইসমাঈল ইবনু উমার (৭৭৪ হি), আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (বৈরুত, দারুল ফিকর, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৬)
৪৪. ইবনু কাসীর, আন-নিহায়াতু ফিল ফিতানি ওয়াল মালাহিম (আল-মাকতাবাতুশ শামিলা, ৩.৫:
http://www.alwarraq.com)
৪৫. ইবনু কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (মদীনা, দারু তাইবা, ২য় প্র. ১৯৯৯)
৪৬. শাতিবী, ইবরাহীম ইবনু মূসা (৭৯০ হি), আল-ই’তিসাম (বৈরুত, দারুল মা’রিফাহ, ১৯৮৫)
৪৭. ইবনু আবিল ইজ্জ হানাফী (৭৯২হি), শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ (বৈরুত, আল-মাকতাব আল-ইসলামী, ৯ম প্র., ১৯৮৮)
৪৮. ইবনু রাজাব, আব্দুর রাহমান ইবনু আহমাদ (৭৯৫ হি.), জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম (বৈরুত, দারুল মারিফাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮হি)
৪৯. হাইসামী, নূরুদ্দীন আলী ইবনু আবী বাকর (৮০৭হি.) মাজমাউয যাওয়াইদ (বৈরুত, দারুল কিতাবিল আরাবী, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮২)
৫০. ফিরোযআবাদী, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াকূব (৮১৭হি) তানবীরুল মিকবাস (আল-মাকতাবাতুশ শামিলা ৩.৫: http://www.altafsir.com)
৫১. বূসীরী, আহমদ ইবনু আবী বাকর (৮৪০ হি), মিসবাহুয যুজাজাহ (বৈরুত, দারুল ম’রিফাহ, ২য় প্রকাশ, ১৪০৩ হি)
৫২. ইবনু হাজার আসকালানী, আহমদ ইবনু আলী (৮৫২ হি) ফাতহুল বারী শারহু সাহীহিল বুখারী (বৈরুত, লেবানন, দারুল ফিকর)
৫৩. সানআনী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (৮৫২ হি), সুবুলুস সালাম (বৈরুত, দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরাবী, ৪র্থ মুদ্রণ, ১৩৭৯ হি)
৫৪. আব্দুর রাহমান ইবনু আবী বাক্র সালিহী (৮৫৬হি), আল-কান্যুল আকবার (মাক্কা মুকার্রামা, মাকতাবাতু নিযার বায, ১ম মুদ্রণ, ১৯৯৭)
৫৫. সুয়ূতী, জালালুদ্দীন (৯১১) যাইলুল মাউযূআত (ভারত, আল-মাতবাউল আলাবী, ১৩০৩ হি)
৫৬. মোল্লা আলী কারী (১০১৪হি), আল মাসনু’ (হালব, সিরিয়া, মাকতাব আল-মাতবু‘আত আল-ইসলামিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৬৯)
৫৭. মুনাবী, আব্দুর রাঊফ (১০৩১ হি), ফাইদুল কাদীর (কাইরো, আল-মাকতাবাতুত তিজারিয়া আল-কুবরা, ১ম মুদ্রণ, ১৩৫৬ হি)
৫৮. যারকানী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী (১১২২হি), শারহুল মুয়াত্তা (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম মুদ্রণ, ১৪১১)
৫৯. ইবনু আজীবাহ, আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ (১২২৪), আল-বাহরুল মাদীদ (আল-মাকতাবাতুশ শামিলা, ৩.৫: http://www.altafsir.com)
৬০. শাওকানী, মুহাম্মাদ ইবনু আলী (১২৫৫ হি.) নাইলুল আউতার, (বৈরুত, দারুল জীল, ১৯৭৩)
৬১. ইবনু আবেদীন, মুহাম্মাদ আমীন (১২৫৬ হি), রাদ্দিল মুহতার (বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৯৭৯)
৬২. রাহমাতুল্লাহ ইবনু খলীলুর রহমান কীরানবী (১৩০৮ হি), ইযহারুল হক্ক, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অনূদিত (ইসলামিক ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ, ২০০৭)
৬৩. আযীমআবাদী, মুহাম্মাদ শামসুল হক্ক (১৩১০হি), আওনুল মা’বুদ (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ২য় মুদ্রণ, ১৪১৫হি)
৬৪. মুবারকপুরী, মুহাম্মাদ আব্দুর রাহমান (১৩৫৩হি), তুহফাতুল আহওয়াযী (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)
৬৫. আব্দুর রাহমান ইবনু মুহাম্মাদ আল-হাম্বালী (১৩৯২ হি); হাশিয়তুর রাওদিল মুরবি’ শরাহু যাদিল মুসতানকী (আল-মাকতাবাতুশ শামিলা, ৩.৫:
http://www.ahlalhdeeth.com)
৬৬. আবুল হাসান আলী নদবী (১৪২০ হি), রিজালুল ফিকরি ওয়াদ দাওয়াত (সিরিয়া, দার ইবন কাসীর, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৯)
৬৭. আলবানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন (১৪২০), সহীহুল জামিয়িস সাগীর (বৈরুত, আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় সংস্করণ, ১৯৮৮)
৬৮. আলবানী, সহীহুত তারগীব (রিয়াদ, মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ৩য মুদ্রণ, ১৯৮৮)
৬৯. আলবানী, যয়ীফু সুনানি ইবনি মাজাহ (সৌদি আরব, রিয়াদ, মাকতাবাতুল মাআরিফ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৭)
৭০. আলবানী, সহীহু সুনানি ইবনি মাজাহ (রিয়াদ, মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৭)
৭১. আলবানী, সিলসিলাতুল- যায়ীফাহ (রিয়াদ, মা‘আরিফ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯২)
৭২. আলবানী, সিলসিলাতুল- সাহীহাহ (রিয়াদ, মা‘আরিফ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯২)
৭৩. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল (বৈরুত, আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম, ১৯৭৯)
৭৪. আলবানী, সহীহু সুনানিত তিরমিযী (আল-মাকতাবাতুশ শামিলা, ৩.৫)
৭৫. মতিওর রহমান, ঐতিহাসিক অভিধান (ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৬৭)
৭৬. উসাইমীন, মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ, আল-কাওলুল মুফীদ (রিয়াদ, দারু ইবনুল জাওযী, ২য় প্রকাশ, ১৪২৪ হি)
৭৭. মুহাম্মাদ সুরূর বিন নাইফ, আল-হুকমু বিগাইরি মা আনযালাল¬াহু ও আহলুল গুলূ, (ব্রিটেন, বার্মিংহাম, দারুল আরকাম, ২য় প্রকাশ)
৭৮. গোলাম আহমদ মোর্তাজা; চেপে রাখা ইতিহাস (বর্ধমান, ভারত, ৮ম, ২০০০)
৭৯. গোলাম আহমদ মোর্তাজা; ইতিহাসের ইতিহাস (বর্ধমান, বিশ্ব-বঙ্গীয় প্রকাশন, ১৯৭৮)
৮০. আজহারুল ইসলাম, এ.কে.এম, নিন্দিত বিশ্ব নন্দিত গন্তব্য (চট্টগ্রাম, আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন,২০০৭)
৮১. সালিহ আল-শাইখ, শারহুল আকীদাহ আল-ওয়াসিতিয়্যাহ (আল-মাকতাবাতুশ শামিলা, ৩.৫)
৮২. ড. আহমদ মুহাম্মাদ জলী, দিরাসাতুন আনিল ফিরাক (রিয়াদ, কিং ফায়সাল ফাউন্ডেশন ফর রিসার্চ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ২য় মুদ্রণ ১৯৮৮)
৮৩. ড. ইবরাহীম জুমআ, আল-আতলাস আত-তারীখী লিদ-দাওলা আস-সাঊদিয়্যাহ (রিয়াদ, দারাতুল মালিক আব্দুল আযীয, ১৯৭৯)
৮৪. ইসমাঈল আহমদ ইয়াগী, তারীখুল আলাম আল-ইসলামী (রিয়াদ, মিরীখ, ১৯৯৩)
৮৫. ড. নাসির আল-আকল, আল-খাওয়ারিজ (রিয়াদ, দারুল ওয়াতান, ২য় প্রকাশ, ১৪১৭)
৮৬. শ্রী শৈলেন্দ বিশ্বাস, সংসদ বাংলা-ইংরেজি অভিধান (কলকাতা, শিশু সাহিত্য সংসদ, ১৯৭৯)
৮৭. সালিম বাহনসাবী, আল-হুকমু ওয়া কাদিয়্যাতু তাকফীরিল মুসলিম (কুয়েত, দারুল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ, ৩য় মুদ্রণ, ১৯৮৫)
৮৮. আব্দুল্লাহ ইবনু উমার দুমাইজী, আল-ইমামাতুল উযমা (রিয়াদ, দারু তাইবা, ২য় মুদ্রণ, ১৪০৯ হি)
৮৯. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা (ঝিনাইদহ, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ১ম প্রকাশ ২০০৭)
৯০. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান (ঝিনাইদহ, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ৫ম সংস্করণ ২০০৭)
৯১. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, বুহূসুন ফী উলূমিল হাদীস (ঝিনাইদহ, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ১ম প্রকাশ ২০০৭)
৯২. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি (ঝিনাইদহ, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ৩য় প্রকাশ ২০০৮)
৯৩. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, আল্লাহর পথে দাওয়াত (ঝিনাইদহ, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ২য় সংস্করণ ২০০৯)
৯৪. সম্পাদনা পরিষদ, আল-মাওসূআ আল-ফিকহিয়্যাহ: আল-ফিকহ বিশ্বকোষ (কুয়েত আওকাফ ও ইসলামিক এফেয়্যার্স মন্ত্রণালয় ও দারুস
সালাসিল, ২য় মুদ্রণ, ১৪২৭হি)
৯৫. সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)
৯৬. The Holy Bible, Authorized Version/King James Version,
reprinted and published by Bible
Society of South Africa, 1988.
৯৭. quoted from Dr. Abdul Hamid Qadri, Dimensions of Christianity,
(Islamabad, Pakistan, Da’wah
Academy, International Islamic University, 1st edition, 1989)
৯৮. Carl Gottaleb Pfander, Balance of Truth (The Mizanul Haqq),
part-1 (The Good Way, Rikon,
Switzerland)
৯৯. Encyclopaedia Britannica, CD Version, 2005
১০০. The Independent, Dhaka 14/1/2006.
18/02/2006, 8/9/2006, 20/02/2009
১০১. A. S. Hornby, Oxford Advanced Learner's Dictionary (Oxford
University Press, 5th edition,
1995)
১০২. Ahmed Deedat, The Choice (Jeddah, Abul Qasim Publications,
1st, 1994)
১০৩. Microsoft ® Encarta ® 2008. © 1993-2007 Microsoft Corporation.
No comments