ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ অধ্যায়-০৩ -বিভ্রান্তির তাত্ত্বিক পর্যালোচনা -অনুচ্ছেদ ০১-৩০

বিভ্রান্তির তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

আমরা আগেই বলেছি, ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের জন্মগত বা সহজাত অনুভূতি। একে নির্মূল করা যায় না এবং নির্মূলের প্রচেষ্টা বুমেরাং হয়। একে সঠিক স্বাভাবিক খাতে প্রবাহিত না করতে পারলে তা কখনো কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা বা অনৈতিকতার জন্ম দেয় এবং কখনো উগ্রতার জন্ম দেয়। এগুলির অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রেক্ষাপটগুলি অনুধাবন প্রয়োজন। আমরা দেখেছি যে, বিশ্বব্যপী মুসলিম নিধন, প্রতিকারের সকল পথ রুদ্ধ হওয়া, হতাশা পরিবর্তনের আবেগ অনেক মুসলিমকে উগ্রতার পথ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করছে। কখনো বা মুমিন পারিপার্শিক অত্যাচার বা নিধনযজ্ঞের প্রতিকার করার কোনো পথ না পেয়ে উগ্র হয়ে পড়েন এবং উগ্রতার পক্ষে কিছু ‘‘দলিল-প্রমাণ’’ খুঁজে নেন। কখনো বা একজন মুসলিম নিজের আবেগে পড়াশোনা করতে যেয়ে এরূপ ব্যাখ্যা উগ্রতার মধ্যে নিপতিত হন। এরপর তিনি হয়ত অন্যদেরকেও প্রভাবিত করেন। কখনো বা অন্যের মুখে এরূপ ব্যাখ্যা শুনে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। কখনো বা কোনো ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থ অর্জন করতে
ইসলামী শিক্ষার বিকৃত উপস্থাপনের মাধ্যমে এরূপ উগ্রতার প্রসার ঘটাতে চেষ্টা করেন

এছাড়া আমরা জানি যে,, ইহূদী খৃস্টান পন্ডিতগণও কুরআন হাদীস ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করেছেন। তাদের পক্ষেও কুরআনের কিছু আয়াত, কিছু হাদীস বা কিছু ফিকহী মতামত বিকৃৃতভাবে উপস্থাপন করে অজ্ঞ আবেগী যুবকদেরকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব। আমরা দেখেছি যে, মুসলিম দেশগুলিকে অশান্ত করে তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সামরিক প্রবৃদ্ধি থামিয়ে দেওয়া, সভ্যতার সংঘাতের থিওরির সত্যতা প্রমাণ করা, ‘‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’’ বা জঙ্গিবাদ দমনের নামে মুসলিম দেশগুলিকে দখল করা বা অধীনত রাখা, জঙ্গিবাদ দমনের নামে মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামী মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন ইসলামী শিক্ষা সংকোচন করা, ধার্মিক মুসলিম আলিমগণের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করা ইত্যাদি বহুবিধ উদ্দেশ্যে ইহূদী-খৃস্টান ইসলামবিদ্বেষী পন্ডিতগণ বা সংস্থা ইসলামের ছদ্মাবরণে এরূপ বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন। ইসলামী শিক্ষার ধরনের বিকৃতি রোধে বিকৃতি সংশি­ষ্ট সকল বিষয়ে কুরআন, হাদীস, সাহাবীগণ তাঁদের পরের সকল যুগের আলিমগণের মতামত কর্মধারার আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সমকালীন আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ, গবেষক সমাজসেবকদের সামষ্টিক চেষ্টা প্রয়োজন

এখানে লক্ষণীয় যে, বিকৃতি সংশি­ষ্ট বিষয়গুলি আধুনিক। সকল বিষয়ে কুরআন, হাদীস পূর্ববর্তী আলিমগণের সুস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা মতামত না পাওয়াই স্বাভাবিক। যেমন, উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশগুলির বিধান, সমকালীন প্রেক্ষাপটে দারুল ইসলাম বা ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচয়, ধর্মরিনপেক্ষ অমুসলিম দেশগুলির বিধান, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, পার্লামেন্ট, সার্বভৌমত্ব, ভোট ব্যবস্থা, এগুলিতে অংশ গ্রহণ বা বর্জন, সমকালীন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের নেতৃত্বে জিহাদের বিধান, বিদেশী আগ্রাসনের শিকার মুসলিম দেশগুলির আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলনের বিধান, এরূপ ক্ষেত্রে সশস্ত্র প্রতিরোধের বিধান ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক সমাধান দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতভেদ বা ভুল সিদ্ধান্ত অনেক মানুষকে কঠিন পাপের মধ্যে নিপতিত করতে পারে এবং উম্মাতের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে

আমরা লক্ষ্য করি যে, সকল বিষয়ে সমাজের প্রাজ্ঞ সুপ্রসিদ্ধ পীর-মাশাইখ, আলিম মুফতীগণের মতামত কম পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ‘‘চিন্তাবিদ’’ ‘‘আবেগী মুজাহিদগণ’’ সকল বিষয়ে ঝটপট অনেক সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেন। অনেকেই গতানুগতিক বাট্রেডিশনালআলিম বুজুর্গদের দুর্বলতা বা অজ্ঞতাকে এর কারণ হিসেবে মনে করেন। অনেকে মনে করেন সমাজের সব অন্যায় মেনে নেওয়ার মানসিকতাই এর জন্য দায়ী। এরূপ মত নিঃসন্দেহে অজ্ঞতা আবেগপ্রসূত জুলম। বিগত দেড় হাজার বৎসর দীনের ঝান্ডাকে ধরে রেখেছেন আলিমগণ। তাঁদেরই মাধ্যমে আমরা দীন পেয়েছি। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা সোচ্চার থেকেছেন। তবে সোচ্চার হওয়ার পদ্ধতিতে বিভিন্নতা ছিল। বস্ত্তত সকল আধুনিক বিষয়ে ‘‘ট্রেডিশনাল’’ আলিম মুফতীগণের সুস্পষ্ট মতামত না থাকার কারণ আধুনিক হওয়াতে এগুলির বিষয়ে কুরআন-হাদীস পূর্ববর্তী আলিমগণের সুস্পষ্ট মতামত পাওয়া যায় না। আর প্রাজ্ঞ আলিমগণ এরূপ সুস্পষ্ট মতামতের বাইরে ঝটপট কোনো সিদ্ধান্ত দিতে দ্বিধা করেন। পক্ষান্তরে একজন ‘‘চিন্তাবিদ’’ বা ‘‘আবেগী’’ মানুষ সাধারণত কুরআন হাদীসের দু একটি সাধারণ বক্তব্যকেই তার মত প্রকাশের জন্য যথেষ্ঠ বলে গণ্য করেন; কাজেই সাহাবী-তাবিয়ীগণের মতামত বা পূর্ববর্তী ফকীহগণের মতামতের জন্য তিনি অপেক্ষা করেন না। এমনকি আয়াত বা হাদীসটি কতখানি প্রাসঙ্গিক বা তার বিপরীতে অন্য কোনো আয়াত বা হাদীস রয়েছে কিনা তাও তত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন না। আলিমগণের মতামত ধীর হলেও তাতে ভুলের সম্ভাবনা কম থাকে। আর চিন্তাবিদ বা আবেগী মানুষের মতামত খুবই দ্রুত সুস্পষ্ট হলেও তাদের ভুলের সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।এছাড়া আমরা সমাজ সংস্কারে পূর্ববতী আলিম-উলামা পীর-মাশাইখের কর্মপদ্ধতি পর্যালোচনা করলে দেখব যে, তাঁরা সর্বদা বিনম্রতা, ওয়ায-নসীহত জনমত তৈরির মাধ্যমে তা করতে চেষ্টা করেছেন, কখনোই দ্রুত ফল লাভের জন্য ব্যস্ত হন নি। তাদের কর্মধারার আলোকেই সমকালীন প্রসিদ্ধ আলিমগণ মতামত ব্যক্ত করেন। দ্রুত ফললাভে আগ্রহী আবেগী মানুষদের কাছে মনে হয়, এরূপ মতামত ‘‘সবকিছু মেনে নেওয়ার’’ শামিল। এভাবে কি আর কিছু পরিবর্তন করা যাবে? এদের কাছে চিন্তাবিদ আবেগী তরুণ মুফতীদের মতামত বেশি পছন্দনীয় বলে মনে হয়

সকল আবেগ চাপের বাইরে থেকে কুরআন, হাদীস, সাহাবীগণের তৎপরবর্তী যুগের আলিমগণের কর্মধারার ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। দ্রুত ফললাভ, প্রতিশোধ বা অন্য কোনো আবেগের অধীনে অথবা দেশ, দল, গোষ্ঠী বা কারো চাপের অধীনে কুরআন হাদীসের একপেশে সিদ্ধান্ত নিলে তা সঠিক হবে না এবং সংশি­ষ্ট মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। উপরন্তু সিদ্ধান্ত মতামত প্রাসঙ্গিক তথ্যসমৃদ্ধ হতে হবে। ছাড়া যে সকল আয়াত হাদীসকে বিকৃতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেগুলির বিস্তারিত পর্যালোচনা প্রয়োজন
বর্তমান যুগে এককভাবে গ্রহণযোগ্য আলিম যেমন দুর্লভ, তেমনি সকল বিষয়ে এককভাবে ইজতিহাদ করার মত যোগ্যতাসম্পন্ন আলিমও দুর্লভ। এজন্য সকল বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আলিম ইসলামী চিন্তাবিদগণের মতবিনিময় সমবেত ইজতিহাদ প্রয়োজন। সমাজের গতানুগতিক অনেক বিষয়ের পাশাপাশি সকল বিষয়ে প্রাজ্ঞ আলিমগণের মতপ্রকাশ খুবই জরুরী। উম্মাতের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা দরদ নিয়ে আলিমগণকে একত্রে বসে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। সমবেত মতবিনিময়ে নিজের মত, অভিরুচী, প্রয়োজন স্বার্থের ঊধ্বে উম্মাতের বৃহত্তর কল্যাণে পূর্ববর্তী ইমাম আলিমগণের কর্মধারার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রথম চার প্রজন্মের এবং বিশেষ করে তিন প্রজন্মের নির্ভরযোগ্যতার সাক্ষ্য দিয়েছেন। এরা হলেন সাহাবীগণ, তাঁদের ছাত্রগণ (তাবিয়ীগণ), তাঁদের ছাত্রগণ (তাবি-তাবিয়ীগণ) তাদের ছাত্রগণ (আতবা আতবায়িত তাবিয়ীন) দীনের সকল বিষয়ে, বিশেষত মতভেদীয় জটিল বিষয়ে তিন চার প্রজন্মের আলিম, ফকীহ, ইমাম বুজুর্গগণের মতামতের কর্মধারার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজন

 . . বিভ্রান্তির সমকালীন প্রেক্ষাপট

খারিজী বাতিনীগণ কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করলেও সাধারণ মানুষদের মধ্যে তাদের বিভ্রান্তি প্রভাব ফেলতে পারে নি। কিন্তু বর্তমানে একদিকে বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিধন, মুসলিম দেশগুলিতে ধার্মিক মানুষদের প্রতি বৈষম্য, হয়রানি জুলুম, ইসলামী অনুশাসন বিষয়ক দাবিদাওয়াকে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে দমন করার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে তেমনি ইসলাম সম্পর্কে আবেগ ভালবাসার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের ব্যবহারিক সুন্নাত সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবে তাদের উগ্র মতামত সমাজের অনেক ধার্মিক মানুষকে প্রভাবিত করছে নিঃসন্দেহে কুরআন হাদীস ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস এবং প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব নিজে কুরআন হাদীস অধ্যয়ন করে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। সকল মুসলিম কুরআন-হাদীস অধ্যয়ন করবেন, কিন্তু সকল মুসলিমই বিশেষজ্ঞ হবেন না

আরবী ভাষার গভীর জ্ঞান, কুরআনের পরিপূর্ণ অধ্যয়ন, বিশাল হাদীস ভান্ডারের সকল হাদীস অধ্যয়ন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবীগণের কর্ম, চিন্তা, মতামত কুরআন-হাদীস ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া অধ্যয়ন সমস্যা সমাধানে সাহাবী, তাবিয়ী তাবিতাবিয়ীগণের মতামত কর্মধারা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভের পরেই একজন মানুষ প্রকৃত আলিম ফকীহ বলে গণ্য হন এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাষ্ট্রিয় সমস্যার ক্ষেত্রে ইসলামীফাতওয়াবা সিদ্ধান্তদানের যোগ্যতা অর্জন করেন। স্বভাবতই এরূপ আলিমদের সংখ্যা সমাজে কম থাকে। এজন্য মুসলিম উম্মাহর আলিমগণের রীতি হলো, জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে সমকালীন প্রাজ্ঞ আলিমগণের মতামত গ্রহণের পাশাপাশি পূর্ববর্তী প্রখ্যাত আলিম, ফকীহ ইমামদের মতামতের অনুসন্ধান তাদের মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত প্রদান। এক্ষেত্রে তাঁরা কুরআন হাদীসের নির্দেশনার আলোকে সাহাবীগণ তাঁদের পরবর্তী দুই প্রজন্মের আলিমদের মতামতের বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন

মূলনীতি লঙ্ঘন করার কারণেই সকল উগ্র মতের জন্ম হয়। প্রাচীন নব্য খারিজীগণ সাহাবীগণের এবং তাঁদের পরে সমাজের মূলধারার আলিমগণের মতামত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। নিজেদের মতামতকেই তারা চূড়ান্ত বলে মনে করেছে। তবে তারা এরূপ মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির বিশেষ ক্ষমতা বা আল্লাহর সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক, কাশফ, ইলহাম, গোপন জ্ঞান ইত্যাদির কোনো দাবি করে নি। বাতিনীগণ শীয়াগণও সর্বদা সাহাবী, তাবিয়ী সমাজের মূলধারার মুসলিম আলিমগণকে অবজ্ঞা ঘৃণা করেছে এবং কুরআন বা ইসলাম সম্পর্কে নিজেদের ‘‘বুঝ’’ চূড়ান্ত বলে মনে করেছে। পাশাপাশি তারা বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ গোপন জ্ঞান, কাশফ, ইলহাম, ইলকা, ইলম-লাদুন্নী, আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক বা বিশেষপদাধিকারদাবি করেছে। ফলে সকল কল্পিত নেতা বা নেতাদের নামে অন্য কেউ তাদের কঠিন বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত করেছে। উভয় পদ্ধতিতেই তাদের মধ্যে ধার্মিকতা, ধর্মপালন ধর্মজ্ঞান সম্পর্কে অপ্রতিরোধ্যঅহঙ্কারসৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে তারা ইসলাম সম্পর্কে তাদের বা তাদের নেতৃবৃন্দের ব্যাখ্যা বা মতকেই চূড়ান্ত সত্য বলে গ্রহণ করে বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়েছে। বর্তমানে সঠিক ইসলামী শিক্ষার অনুপস্থিতি, বিশেষত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক সমস্যাদির বিষয়ে সঠিক ধারণার অনুপস্থিতিতে আবেগতাড়িত ধ্যানধারণার প্রসারের বিশেষ প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে:

(
) গত প্রায় অর্ধ-সহস্র বৎসর যাবৎ মুসলিম উম্মাহর সকল দেশেই ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক মানগত অবনতি ঘটেছে। বিশেষত উপনিবেশাধীন সমাজে এবং এর পরেইসলামী শিক্ষারকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মাদ্রাসগুলির শিক্ষার মান কমেছে। সামাজিক রাষ্ট্রীয় সমর্থনের অভাব, মেধাবী শিক্ষার্থীর অভাব, গবেষণা উপকরণ পরিবেশের অভাব ইত্যাদি কারণে সকল প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া অধিকাংশেরই ইসলামী জ্ঞানের গভীরতা কম। সমাজ রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক সমর্থন মূল্যায়নের অভাবে গবেষণার সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত। পূর্ববর্তী আলিমগণ যে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন সেগুলি পাঠ মুখস্থ করা হলেও, আধুনিক সমস্যাবলিতে ইজতিহাদ সমাধান দেওয়ার যোগ্যতা গড়ে তোলার মত কোনো পরিবেশ বা ব্যবস্থা সকল প্রতিষ্ঠানে নেই বললেই চলে

(
) সকল ট্রেডিশনাল আলিমের পাশাপাশি বর্তমান যুগে আরেক শ্রেণীর ইসলামী চিন্তাবিদ রয়েছেন। এরা হচ্ছেন সে সকলসাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রাপ্তশিক্ষাবিদ, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা সাধারণ মানুষ জীবনের মাঝপথে এসে ধর্ম বিমুখতা থেকে ধার্মিকতার দিকে ফিরে আসেন। পর্যায়ে তাঁরা কুরআন, হাদীস ইসলামের ইতিহাস চর্চা শুরু করেন। এরা মূলত মেধাবী। এক সময়ে এদের অনেকে তাঁদের মেধা, মনন বুদ্ধি দিয়ে কুরআন-হাদীসের বিভিন্ন ব্যাখ্যা ফাতওয়াদিতে শুরু করেন। স্বভাবতই তাঁরা বিশাল হাদীস ভান্ডার, সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি পূর্ববর্তী আলিমগণের মতামত কিছুই জানেন না বা জানার গুরুত্বও অনুভব করেন না। সকল চিন্তাবিদদের মধ্যে যারা আরব তারা সমকালীন আরবী ভাষা জানলেও কুরআন, হাদীস ইসলামী ফিকহের পরিভাষার সাথে ততটা পরিচিত নন। বিশেষ করে তাফসীর, হাদীস, ফিকহের বিশাল ভান্ডার তাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত। আর এদের মধ্যে যারা অনারব তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। কুরআন-হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে তাঁরা মূলত অনুবাদ বা অনুবাদকের ‘‘বুঝ’-এর উপরেই নির্ভর করেন। তাঁদের জানা কুরআনের আয়াত এবং সীমিত কিছু হাদীসের শাব্দিক অর্থের সাথে নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি মননশীলতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাঁরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করতে থাকেন। তাঁদের বাগ্মিতা, আধুনিক জগত আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের গভীর জ্ঞান সাধারণ মুসলিমদেরকে আকৃষ্ট করে। আধুনিক বিষয়াদি সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান পান্ডিত্য অনেক হলেও আরবী ভাষা, কুরআন, হাদীস, সাহাবীগণের কর্মধারা প্রাচীন ইমামগণের মতামতের বিষয়ে তাঁদের জ্ঞানের দৈন্যতা সুস্পষ্ট

(
) অধিকাংশ ক্ষেত্রে উভয় শ্রেণীর আলিম গবেষক একে অপরকে ভাল চোখে দেখেন না। এছাড়া সাধারণভাবে আলিমউলামা গবেষকদের মধ্যে মতবিনিময়, গবেষণা, আলোচনা ইত্যাদির সুযোগ আগ্রহ নেই বললেই চলে। ফলে আধুনিক রাষ্টব্যবস্থা, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, নির্বাচন, উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশগুলির ইসলামী অবস্থান, এগুলিতে পরিপূর্ণ ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি, সকল রাষ্ট্রের প্রতি মুসলিম নাগরিকের সম্পর্ক, রাষ্ট্র বা সরকারের দীন বিরোধী কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা ইসলামী সমাধান প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অস্পষ্টতা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। প্রত্যেকেই কুরআন হাদীস থেকে অল্প বা বেশি উদ্ধৃতি প্রদান করে একটি মত প্রকাশ করছেন। প্রায় সকল ক্ষেত্রে দলিল প্রদান প্রক্রিয়া খারিজীগণের মত হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ কিছু আয়াত হাদীসের আলোকে মতামত প্রকাশ করা হলেও, যে বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা হচ্ছে, অনুরূপ কোনো বিষয় বা অবস্থা রাসূলুল্লাহ (সাঃ), সাহাবীগণ বা তাবিয়ীগণের সময়ে ছিল কিনা এবং সেক্ষেত্রে তারা কি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেগুলি বিবেচনা করা হচ্ছে না। এভাবে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন বিকৃত ধারণা জন্ম নিচ্ছে, যা ইসলামের নামে উগ্রতা সৃষ্টিতে সহায়তা করছে

(
) উপরের বিষয়গুলির পাশাপাশি রাষ্ট্র, প্রশাসন সমাজের অনাচার, পাপ, দুর্নীতি, নগ্নতা, অশ্লীলতা, জুলুম-অত্যাচার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনেক আলিমের নীরবতা আলিম-উলামা পীর-মাশাইখের পারস্পারিক মতভেদ, দলাদলি গালাগালি সমাজের আবেগী যুবকদের হতাশ বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। অবস্থায় উগ্রতার আহবানকারীদের নিষ্ঠা, সততা নির্ভীকতা তাদেরকে আকৃষ্ট করে। খারিজীগণ, বাতিনী শিয়াগণ জামাআতুল মুসলিমীন-এর বিভ্রান্তিআমরা কুরআন কারীম, সুন্নাতে নববী, সাহাবায়ে কেরামের কর্মপদ্ধতি এবং পূর্ববর্তী ইমাম, আলিম পীব-মাশাইখের কর্মধারার আলোকে পর্যালোচনা করতে চাই। কারণ ইসলামের নামে উগ্রতায় লিপ্ত মানুষদের তাত্ত্বিক বিভ্রান্তিগুলি প্রায় সবই একই প্রকৃতির। আমরা আল্লাহর তাওফীক প্রার্থনা করছি
পূর্বোক্ত বিভ্রান্ত গোষ্ঠীগুলির মতামত দাবি-দাওয়া পর্যালোচনা করলে আমরা কয়েকটি বিষয় দেখতে পাই:

(
) নিজের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেয়ে অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া
(
) করণীয় বর্জনীয়ের মধ্যে পার্থক্য না বুঝা
(
) ইসলামী শিক্ষার বিকৃত অনুধাবন উপস্থাপন

 . . নিজের জীবনে ইসলাম বনাম অন্যের জীবনে ইসলাম

ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতার পিছনে অন্যতম যে বিষয়টি দেখা যায় তা হলো, নিজের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেযে অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা। এটি আবেগপ্রসূত বিভ্রান্তিগুলির অন্যতম। দ্বীন প্রতিষ্ঠার দুটি পর্যায় রয়েছে: () নিজের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠা করা এবং () অন্যের জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করা। মুমিনের মূল দায়িত্ব নিজের জীবনে নিজের দায়িত্বাধীনদের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামে নিজের জীবনে পালনীয় ইবাদতগুলিকে আরকানে ইসলাম, ফরয আইন বা সুন্নাত আইন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। পক্ষান্তরে দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ, জিহাদ ইত্যাদি ‘‘অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার’’ দায়িত্ব বিষয়ক ইবাদতগুলিকে মূলতফরয কিফায়াবা সামষ্টিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং সুযোগ সাধ্যের আলোকে কম বেশি পালনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি ক্ষেত্রে ব্যক্তির দায়িত্ব দাওয়াত দেওয়া। কেউ বা সকলে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে বা অন্যায় পরিত্যাগ না করলে মুমিনের কোনোরূপ দায়বদ্ধতা থাকে না। কিন্তু উগ্রতায় লিপ্ত মানুষদেরকে আমরা এর উল্টো পথে চলতে দেখি। তারা মূলত ‘‘অন্যের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠাকে’’ ফরয আইন বড় ফরয এবং নিজের জীবনে দীন পালনকে ‘‘ছোট ফরয’’ বা গুরুত্বহীন বলে মনে করেন। তারা অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তিগতভাবে হারাম-মাকরূহ কর্মে লিপ্ত হচ্ছেন এবং এরূপ হারাম-মাকরূহ কর্মে লিপ্ত হওয়াকে নানাভাবে বৈধ, বরং জরুরী বা ফরয বলে দাবি করছেন

তাদের মনের একই চিন্তা, সমাজে বা দু&&নয়ায় অমুক অন্যায় হচ্ছে, আল্লাহর আইনের বিরোধিতা হচ্ছে, আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করা হচ্ছে, কিভাবে নীরব থাকবে মুমিন। কাজেই যেভাবে পার ঝাপিয়ে পড়ে সব অন্যায় মিটিয়ে দিয়ে বিশ্বের সর্বত্র সকলের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কর। বস্ত্তত এরূপ চিন্তা ভাল চিন্তার সাথে খারাপ চিন্তার সমন্বয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রতিবাদ মুমিনের মনে অবশ্যই থাকবে এবং মুমিন সাধ্যমত ইসলাম নির্দেশিত পথে তা প্রতিকারের চেষ্টা করবে বা দাওয়াত দিবে। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ মুমিনকে তাঁর নিজের নিজের দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাস করবেন, দুনিয়ার অন্য মানুষদের পাচাচার সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করবেন না। সাধ্যমত দাওয়াতের পরেও যদি মানুষ তা গ্রহণ না করে সে জন্য মুমিনের কোনোরূপ অপরাধ থাকে না। মহান আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ

‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপরে শুধু তোমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তাহলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।’’[1] বস্ত্তত সমাজ, রাষ্ট্রে বিশ্বে অন্যায়, পাপ অপরাধ থাকবেই, কখনো বেশি এবং কখনো কম। মুমিনের দায়িত্ব দাওয়াত দেওয়া, মুমিনের দায়িত্ব হিদায়াত করে ফেলা বা ভাল করে ফেলা নয়। মহান আল্লাহ তার মহান রাসূল (সাঃ)-কে বলেন:

إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ

‘‘তুমি যাকে ভালবাস তাকে তুমি হিদায়াত দিতে পারবে না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন।’’[2]
আল্লাহ আরো বলেন:

وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ

‘‘আর তুমি যতই চাও না কেন, অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাসী হবার নয়।’’[3]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:

وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّىٰ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ

‘‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই ঈমান আনত; তবে কি তুমি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষদের উপর জবরদস্তি করবে?’’[4] অনেক সময় আবেগী মুমিন সমাজের পাপাচারে বেদনাগ্রস্ত হয়ে দ্রুত সবকিছু ঠিক করে ফেলতে আগ্রহী হন। তিনি কুরআনসুন্নাহর নির্দেশ মানবজাতির পরিচালনায় আল্লাহর সুন্নাতের কথা ভুলে যান। দ্রুত ফলাফল লাভের জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। তিনি ভাবেন: ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে বা ইসলামের বিজয় আনতে হবে। অমুক বা তমুক পদ্ধতিতে তা আসবে না, বরং আমাদের পদ্ধতিতেই বিজয় দ্রুত হাতের মুঠোয় এসে যাবে। অমুক পদ্ধতিতে শত বৎসর বা হাজার বৎসর কাজ করলেও ইসলামের বিজয় আসবে না, কিন্তু আমাদের পদ্ধতিতে কাজ করলে অল্প সময়েই তা এসে যাবে। মনে হয় কে কত তাড়াতাড়ি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারল এর উপরেই আল্লাহ নবী-রাসূল মুসলমানদের হিসাব নিবেন!!

ফলাফল লাভের উন্মাদনা আবেগী মুমিনকে বিপথগামী করে। মুমিন চায় যে, সমাজ থেকে ইসলাম বিরোধী মানবতা বিরোধী সকল অন্যায় পাপ দূরীভুত হোক। কোনো মুমিনের মনে হতে পারে যে, এত ওয়ায, বক্তৃতা, বইপত্র, আদেশ নিষেধ ইত্যাদিতে কিছুই হলো না, কাজেই মেরেধরে জোরকরে সব অন্যায় দূর করে ফেলতে হবে। তখন তিনি দাওয়াতের শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি শরীয়ত নিষিদ্ধ পদ্ধতির মধ্যে বাছবিচার না করে ফলাফলের উন্মাদনায় শরীয়ত নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধ করতে চেষ্টা করেন

জাতীয় চিন্তভাবনা সবই কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষার সাথে সাংঘষিক। মুমিনের দায়িত্ব নিজের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠা দীনের দাওয়াত। দাওয়াতের দ্রুত ফলাফলের চিন্তা তো দূরের কথা, কোনো ফলাফলের চিন্তাই মুমিনের দায়িত্ব নয়। অগণিত নবী-রাসূল আজীবন দাওয়াত দিয়েছেন, কিন্তু অতি অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ তাদের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। এতে তাঁদের ‘‘দীন প্রতিষ্ঠার’’ বা ‘‘দাওয়াতের’’ দায়িত্ব পালনের কোনো ঘাটতি হয় নি

পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখব যে, ‘‘দ্রুত সকল অন্যায় মিটিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার’’ জন্য উদগ্রীব মানুষেরা কখনই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি, বরং সুন্নাত পদ্ধতিতে ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ বা দাওয়াত দীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সমাজ সংস্কারের কর্ম সম্পাদিত হয়েছে। কাজেই মুমিনের দায়িত্ব হলো নিজের জীবন দীন পালনের পাশাপাশি কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত পন্থায় দীনের দাওয়াত দেওয়া। দাওয়াতের দায়িত্ব দুভাবে আঞ্জাম দেওয়া হয়: () অরাষ্ট্রীয়, অর্থাৎ ব্যক্তিগত, দলগত বা গোষ্ঠীগতভাবে এবং () রাষ্ট্রীয়ভাবে। অরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার একটিমাত্রই মাধ্যম, তা হলোদাওয়াতবা সৎকাজে আদেশ অসৎকাজে নিষেধ

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দাওয়াতের পাশাপাশি আরো দুটি মাধ্যম রয়েছে: () আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা () প্রয়োজনে শত্রুরাষ্ট্রের কবল থেকে দীন, রাষ্ট্র, জনগণ, দুর্বল মুসলিম বা অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিহাদ বা কিতাল অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ করা। সকল পর্যায়ে ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশ হলো সহিংসতা সীমালঙ্ঘন বর্জন করা। শুধু সহিংসতা বর্জনই নয়, দাওয়াত, প্রচার, সৎকাজে আদেশ, অন্যায় থেকে নিষেধ ইত্যাদিদ্বীন প্রতিষ্ঠারসকল কর্মেঅহিংসতাদ্বারাসহিংসতা’- প্রতিরোধ করতে এবং সহিংসতার প্রতিবাদেউত্তমআচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন:

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ

‘‘কথায় কে উত্তম ব্যক্তি অপেক্ষা, যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি
আত্মসমর্পনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। ভাল এবং মন্দ সমান হতে পারে না। (মন্দ) প্রতিহত কর উৎকৃষ্টতর (আচরণ) দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত।’’[5]
অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে:

ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ ۚ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُونَ

‘‘মন্দের মুকাবিলা করুন যা উৎকৃষ্টতর তা দিয়ে, তারা যা বলে আমি সে সম্পর্কে বিশেষ অবহিত।’’[6]
বর্তমান বিশ্বে ইসলামী দাওয়াত বা ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্ঠা অনেক সময় ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিরোধ, অত্যাচার বা সহিংস আচরণের সম্মুখীন হয়। এতে দাওয়াতে লিপ্ত মুসলিমের মধ্যে প্রতিক্রিয়ামূলকসহিংসতা আবেগ তৈরি হয়। এর সাথেদ্রুত ফললাভেচিন্তাদাওয়াতবাদ্বীন প্রতিষ্ঠা কর্মে রত ব্যক্তিকে ইসলাম নির্দেশিত অহিংসপদ্ধতি পরিত্যাগ করে আবেগ নির্দেশিতসহিংসপথে যাওয়ার প্ররোচনা দেয়। তিনি ভাবতে থাকেনসহিংসতাবা কল্পিতজিহাদ দ্রুত ফললাভের বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ, যদিও প্রকৃত সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামের ইতিহাসে ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সহিংসতা, তথাকথিতজিহাদশাহাদতেরঅনেক ঘটনা আছে। তারা সকলেইদ্রুত ফললাভেরআবেগ নিয়ে বৈধ বা কল্পিতজিহাদেঝাপিয়ে পড়েশহীদহয়েছেন, কিন্তু কেউই দ্রুত বিজয় তো দূরের কথা কোনো স্থায়ী বিজয়ই অর্জন করতে পারেন নি। বস্ত্তত ইসলামের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ‘অহিংসমন্দের মুকাবিলায় উৎকৃষ্টতরআচরণই ইসলাম প্রতিষ্ঠা ইসলামের বিজয়ের একমাত্র পথ। পদ্ধতিতেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরবের কঠোর হৃদয় যাযাবরদের হৃদয় জয় করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। পরবর্তী সকল যুগে পদ্ধতির অনুসরণকারী আলিম দাঈগণই ইসলামের প্রতিষ্ঠা প্রসারে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন

[1] সূরা : মায়িদা, আয়াত ১০৫
[2]
সূরা ২৮: কাসাস: ৫৬ আয়াত
[3]
সূরা ১২: ইউসূস: ১০৩ আয়াত
[4]
সূরা ১০: ইউনুস: ৯৯ আয়াত

[5]
সূরা হা মীম সাজদা (ফুসসিলাত): ৩৩-৩৫ আয়াত
[6]
সূরা মুমিনূন, ৯৬ আয়াত

 . . করণীয় বর্জনীয়

মুমিন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, প্রতিকারের চেষ্টা করেন বা দাওয়াত দেন আল্লাহর সন্তুষ্টি সাওয়াবের জন্য, জাগতিক ফলালল বা নিজের স্বার্থের জন্য নয়। কাজেই এক্ষেত্রে শরীয়ত সম্মত সুন্নাত পদ্ধতিতে দাওয়াত দিতে হবে, দাওয়াতের জন্য কোনো হারাম বা মাকরুহ কর্ম করা তো দূরের কথা, দাওয়াতের জন্য কোনো মুস্তাহাব কর্ম বর্জন করাও সুন্নাত বিরোধী। ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ পুস্তিকাতে আমি বিষয়টি আলোচনা করেছি। কিন্তু সকল আবেগতাড়িত মানুষ অন্যের জীবনে বা সমাজে রাষ্ট্রে ‘‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা’’- জন্য নিজের জীবনে ‘‘পাপ প্রতিষ্ঠা’’ করেন। ইসলামের মূলনীতি, পূন্য অর্জনের চেয়ে পাপ বর্জন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি যদি কোনো কর্ম ফরয হওয়া বা হারাম হওয়ার দ্বিবিধ সম্ভাবনা থাকে তবে তা বর্জন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:

إذا أمرتُكُمْ بِشيءٍ فأْتُوا مِنْهُ ما استطعتُمْ ، و إذا نهيْتُكُمْ عن شيءٍ فدَعُوهُ

‘‘আমি যখন তোমাদেরকে কোনো কর্মের নির্দেশ প্রদান করি তখন তোমরা সে কর্মের যতটুকু পার পালন করবে। আর যখন আমি তোমাদেরকে কোনো কর্ম থেকে নিষেধ করি তখন তোমরা সে কর্ম সর্বোতভাবে বর্জন করবে।’’[1] খারিজীগণের বিভ্রান্তি অপনোদনে সাহাবীগণের বক্তব্যে আমরা বিষয়টি দেখতে পাব। অনেক সময় শয়তান আবেগের মাধ্যমে মুমিনকে মূলনীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে সাওয়াবের নামে পাপে লিপ্ত করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো দাওয়াত বা দীন প্রতিষ্ঠার নামে কোনো মানুষের অধিকার নষ্ট করা বা কারো সম্পদ, সম্ভ্রম বা প্রাণের সামান্যতম ক্ষতি করা। এভাবে মুমিন ইবাদত পালনের নামে কঠিনতম হারাম কর্মে লিপ্ত হন। ইবাদতটি যদি ফরযও হয় তাহলেও তা বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করলে শুধু আল্লাহর হক্ক নষ্ট হয়, যা আল্লাহ তাওবা বা ওজরের কারণে ক্ষমা করবেন। কিন্তু ইবাদত পালনের নামে মানুষের হক্ক নষ্ট করলে বা ক্ষতি করলে তা কঠিন হারাম হওয়া ছাড়াও ‘‘বান্দার হক্ক’’ সংশি­ষ্ট হওয়ার কারণে তাওবা করলেও আল্লাহ তা ক্ষমা করেন না
ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে সম্মানিত বস্ত্ত মানব জীবন মানুষের হক্ক বা অধিকার। মানুষকে আল্লাহ সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন। শুধুমাত্রআইনানুগ বিচারঅথবাযুদ্ধের ময়দানছাড়া অন্য কোনোভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করা, সন্ত্রস্ত করা, আঘাত করা, কষ্ট দেওয়া বা কোনোভাবে কারো ক্ষতি করা, কারো সম্পদ বা সম্ভ্রমের সামান্যতম ক্ষতি করা কঠিনতম হারাম কর্ম। বিধান সর্বজনীন। কোনো ধর্মের কোনো মানুষকেই উপরের দুটি অবস্থা ছাড়া হত্যা করা, আঘাত করা বা কষ্ট দেওয়া যাবে না

কুরআন হাদীসে বিষয়ে অগণিত নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতেমানব রক্তকঠিনতম হারাম। একমাত্র সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনেমানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্যইএকজন মানুষের হত্যা বৈধ করা হয়েছে শুধু দুটি ক্ষেত্রে। দুটি বিষয়ই সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা খুব সহজেই বুঝি যে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিচার, জিহাদ বা হত্যার অনুমতি থাকলে পৃথিবীর বুকে কোনো মানুষই বেঁচে থাকতে পারবে না। কারণ পৃথিবীর বুকে প্রায় প্রতিটি মানুষ অন্য কোনো না কোনো মানুষের দৃষ্টিতে জালিম, অনাচারী বা কাফির। কাজেই জুলম, অনাচার বা কুফরের কারণে যদি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত স্বচ্ছ বিচারপদ্ধতি বা জিহাদের মাধ্যম ছাড়া ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে বিচার জিহাদের ক্ষমতা বা অধিকার ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে দুনিয়াতে কেউই বেঁচে থাকতে পারবে না

বিচার জিহাদের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড বা হত্যার ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি যে, বিচারকের ভুলে নিরপরাধীর সাজা হওয়ার চেয়ে অপরাধীর বেঁচে যাওয়া বা সাজা কম হওয়া ভাল। অনুরূপভাবে জিহাদের নামে ভুল মানুষকে হত্যা করার চেয়ে জিহাদ না করা অনেক ভাল। জিহাদের নামে ভুল মানুষকে হত্যা করলে শত পুন্য করেও জান্নাত থেকে বঞ্চিত হতে হবে। পক্ষান্তরে সাধারণভাবে আজীবন জিহাদ না করলেও এরূপ শাস্তিলাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশেষত জিহাদের গুরুত্ব অনুধাবন করা সত্ত্বেও জিহাদের শর্ত না পাওয়ায় জিহাদ বর্জন করলে কোনোরূপ গোনাহ হবে বলে কুরআন কারীমে বা হাদীস শরীফে কোথাও উল্লেখ করা হয় নি।[2]

বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমাকে যদি নিহত হতে হয় সেও ভাল, তবে হত্যকারী হয়ো না। মুসলমানদের পারস্পরিক যুদ্ধ, সন্ত্রাস বা হানাহানির সময়ে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন:


ليكن عبد الله المقتول ولا يكن عبد الله القاتل ... ليكن كخير ابني ادم


‘‘
এরূপ পরিস্থিতিতে মুমিন নিহত হোক, কিন্তু সে যেন হত্যাকারী না হয়।’’ ‘‘সে যেন আদমের দু সন্তানের মধ্যে (হাবিল কাবিল) উত্তম জনের (হাবিলের) মত হয়।’’[3] সকল নির্দেশনার কারণে সাহাবীগণ হত্যাকে ভয়ঙ্করভাবে ভয় পেতেন। খলীফা উসমান ইবনু আফ্ফান (রা) বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হলে সেনাবাহিনী এবং সমাজের নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের অস্ত্রধারণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। ইসলামী শরীয়তে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বৈধ। কিন্তু উসমান (রা) বিদ্রোহীদের বুঝানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন, আর বিদ্রোহীরা সুযোগ পেয়ে তাকে হত্যা করে। উসমান (রা)-এর মূলনীতি ছিল, আমি নিহত হতে রাজি, কিন্তু কারো রক্তের দায়িত্ব নিয়ে আল্লাহর কাছে যেতে রজি নই


[1]
বুখারী, আস-সহীহ /২৬৫৮: মুসলিম, আস-সহীহ /৯৭৫
[2]
বুখারী, আস-সহীহ /১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৮৪, ৩১০; তিরমিযী, আস-সুনান /৩৩; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৪২৬; শাওকানী, মুহাম্মাদ ইবনু আলী (১২৫৫ হি.) নাইলুল আউতার, /২৭১-২৭২; আল-আমিদী, আলী ইবনু মুহাম্মাদ (৬৩১ হি.), আল-ইহকাম /১৩০, /৬৫
[3]
আবু দাউদ, আস-সুনান /১০০; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান /১৩১০; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল /১৪৩ হাদিসটি সহীহ

 . . রাষ্ট্রীয় ফরয বনাম ব্যক্তিগত ফরয

ইসলম পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এজন্য কুরআন হাদীসে মানব জীবনের সকল দিকের বিধিবিধান বিদ্যমান। কোনো বিধান ব্যক্তিগতভাবে পালনীয়, কোনো বিধান সামাজিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনীয়। প্রত্যেক বিধান পালনের জন্য নির্ধারিত শর্তাদি রয়েছে। কুরআনেসালাতপ্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবার কুরআনেচোরের হাত কাটার’, ‘ব্যভিচারীর বেত্রাঘাতের জিহাদ বা কিতালের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রথম ইবাদতটি ব্যক্তিগত, সামাজিক রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনীয়। অন্য কেউ পালন না করলেও মুমিনকে ব্যক্তিগভাবে পালন করতেই হবে। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ নির্দেশটিরাষ্ট্রীয় ভাবেপালনীয়। কখনোই একজন মুমিন তা ব্যক্তিগতভাবে বা দলগতভাবে পালন করতে পারেন না
এখানে লক্ষণীয় যে, কোনো ইবাদতের শর্তাবলি কুরআনে একত্রে বা একস্থানে উল্লেখ করা হয় নি। এছাড়া অধিকাংশ ইবাদতের সকল শর্ত কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। কুরআন হাদীসের সামগ্রিক বিধান বা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর সামগ্রিক জীবন সকল নির্দেশ পালনে তাঁর রীতি-পদ্ধতি থেকেই সেগুলির শর্ত পদ্ধতি বুঝতে হবে। তা নাহলে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। মহান আল্লাহ বলেন:


أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ


‘‘
সূর্য হেলে পড়ার পর হতে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করবে।’’[1]
নির্দেশের উপর নির্ভর করে যদি কেউ সূর্যাস্তের সময় সালাতে রত হন তবে তিনি নিজে যতই দাবি করুন, মূলত তা ইসলামী ইবাদাত বলে গণ্য হবে না, বরং তা পাপ হারাম কর্ম বলে গণ্য হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাদীস শরীফেসূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাত্রি পর্যন্তসময়ের মধ্যে সালাত আদায়ের বৈধ অবৈধ সময় চিহ্নিত করেছেন এবং সূর্যাস্তের সময় সালাত আদায় অবৈধ করেছেন। এভাবে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শিক্ষার বাইরে মনগড়াভাবে কুরআন কারীমের অর্থ বা ব্যাখ্যা করা আমাদেরকে ইবাদতের নামে পাপের মধ্যে লিপ্ত করে। অনুরূপভাবে কুরআনেশাস্তিকিতালেরনির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআন-হাদীসে ইবাদত পালনের অনেক শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ যদি সেগুলি পূরণ না করে হত্যা, রক্তপাত ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত হয়ে এগুলি জিহাদ বলে দাবি করেন, তবে তা কখনোই ইসলামী ইবাদাত বলে গণ্য হবে না, বরং তা হবে কঠিন পাপ হারাম কর্ম

শর্ত পূরণ ছাড়া সালাত পালনের চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর পাপ শর্ত পূরণ ছাড়া শাস্তি, বিচার বা হত্যায় লিপ্ত হওয়া। সালাত বিচার-হত্যার মধ্যে পার্থক্য হলো, সূর্যাস্তের সময় সালাত আদায় করলে উক্ত ব্যক্তি গোনাহগার হলেও, তাতে কোনো বান্দার হক নষ্ট হবে না। কিন্তু বিচার, শাস্তি কিতালের সাথেবান্দারহক জাড়িত। কারো ভীতি প্রদর্শন, রক্তপাত বা সম্পদ নষ্ট করা কঠিনতম কবীরা গোনাহ, যা সংশি­ষ্ট ব্যক্তির ক্ষমা ছাড়া আল্লাহ ক্ষমা করেন না। কোনো মানুষকে হত্যার বিষয়ে সামান্য সহযোগিতা বা চোখের ইশারাও ভয়ঙ্কর পাপ বলে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই রাষ্ট্রীয় অবকাঠামের মধ্যে আইনানুগ বিচারের বাইরে বা রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশে শত্রুবাহিনীর যোদ্ধাদের সাথে ঘোষিত আইনানুগ যুদ্ধের বাইরে যদি কেউ হত্যা, আঘাত, ভয় প্রদর্শন, সম্পদ-ধ্বংস ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হন, তবে ইবাদত কবুল না হওয়া এবং গোনাহগার হওয়া ছাড়াও তিনি বান্দার হক্ক নষ্ট করার ভয়ঙ্করতম পাপে লিপ্ত হবেন

[1] সূরা: ১৭ বানী ইসরাঈল, ৭৮ আয়াত

 . . বিচার হত্যা

বিচারের ক্ষেত্রে নরহত্যা, বিবাহিতের ব্যভিচার স্বেচ্ছায় বুঝে শুনে ইসলাম গ্রহণ করার পরে ইসলাম ত্যাগ করলে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বিধান আছে। জন্য অনেক কঠিন শর্ত রয়েছে। বিচারক সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন মৃত্যুদন্ড না দেওয়ার। অপরাধের পূর্ণতার বিষয়ে সামান্যতম সন্দেহ থাকলেও আর মৃত্যুদন্ড প্রদান করা যাবে না। কারণ, বিচারকের ভুলে নিরপরাধের শাস্তি বা কম অপরাধীর বেশি শাস্তি হওয়ার চেয়ে অপরাধীর মুক্তি বা বেশি অপরাধের কম শাস্তি হওয়া বাঞ্চনীয়
বিচার অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বিচারকের আদালতে যথাযথ সাক্ষ্য, প্রমাণ আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে হবে। মুমিনকে ন্যায়ের আদেশ এবং অন্যায়ের নিষেধ পরিবর্তন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাকে অন্যায়ের বিচার বা আইন হাতে তুলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় নি। আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:


مَن رأى مِنكُم مُنكرًا فليغيِّرهُ بيدِهِ ، فإن لَم يَستَطِع فبِلسانِهِ ، فإن لم يستَطِعْ فبقَلبِهِ . وذلِكَ أضعَفُ الإيمانِ


‘‘
তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় দেখে তবে সে তার বাহুবল দিয়ে তা পরিবর্তন করবে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে সে তার বক্তব্যের মাধ্যমে তা পবিবর্তন করবে। এতেও যদি সক্ষম না হয় তবে সে তার অন্তর দিয়ে তা পরিবর্তন (কামনা) করবে, আর ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’[1] প্রত্যেক মুমিনেরই দায়িত্ব অন্যায় দেখতে পেলে সাধ্য সুযোগ মত তার পরিবর্তন বা সংশোধন করা। যেমন মদপান একটি মুনকার বা অন্যায়। কেউ অন্য কাউকে মদপান করতে দেখলে সম্ভব হলে তাপরিবর্তনকরবেন। অর্থাৎ তিনি মদপান বন্ধ করবেন। তা সম্ভব না হলে তিনি মুখ দ্বারা তা নিষেধ করবেন। তাও সম্ভব না হলে তিনি অন্তর দিয়ে তা পরিবর্তন করবেন, অর্থাৎ তা পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করবেন বা ঘৃণা করবেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মুমিনমদপানেরঅপরাধে উক্ত ব্যক্তিকে বিচার করতে বা শাস্তি দিতে পারবেন না। প্রয়োজনে তিনি উক্ত ব্যক্তিকে আইনের হাতে সোপর্দ করবেন বা মদপানের ইসলামী শাস্তি প্রবর্তনের জন্য দাওয়াত অব্যাহত রাখবেন। কাউকে কোনো অপরাধে লিপ্ত দেখে তাকে বিচারকের নিকট সোপর্দ করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে বিচার ছাড়া কেউ শাস্তি দিতে পারেন না। প্রক্রিয়ার বাইরে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধান বিচারপতিও কাউকে শাস্তি দিতে পারেন না
খলীফা উমার (রা) আব্দুর রাহমান ইবনু আউফ (রা) -কে বলেন,

لو رأيت رجلا على حد زنا او سرقة وانت امير فقال شهادتك شهادة رجلا من المسلمين قال صدقت

‘‘আপনি শাসক থাকা অবস্থায় যদি কাউকে ব্যভিচারের অপরাধে বা চুরির অপরাধে রত দেখতে পান তাহলে তার বিচারের বিধান কী? (নিজের দেখাতেই কি বিচার করতে পারবেন?)’’ আব্দুর রাহমান (রা) বলেন, ‘‘আপনার সাক্ষ্যও একজন সাধারণ মুসলিমের সাক্ষ্যের সমান।’’ উমার (রা) বলেন, ‘‘আপনি ঠিকই বলেছেন।’’[2] অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান নিজের হাতে বিচার তুলে নিতে পারবেন না। এমনকি তার সাক্ষ্যের অতিরিক্ত কোনো মূল্যও নেই। রাষ্ট্রপ্রধানের একার সাক্ষ্যে কোনো বিচার হবে না। বিধিমোতাবেক দুইজন বা চারজন সাক্ষীর কমে বিচারক কারো বিচার করতে পারবেন না

অন্য ঘটনায় উমার (রা) রাত্রে মদীনায় ঘোরাফেরা করার সময় একব্যক্তিকে ব্যভিচারে লিপ্ত দেখতে পান। তিনি পরদিন সাহাবীগণকে জিজ্ঞাসা করেন, যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাউকে ব্যভিচারে লিপ্ত দেখতে পান তাহলে তিনি কি শাস্তি প্রদান করতে পারবেন? তখন আলী (রা) বলেন, কখনোই না। আপনি ছাড়া আরো তিনজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী যদি অপরাধের সাক্ষ্য না দেয় তাহলে আপনার উপরে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে।[3]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /৬৯
[2]
বুখারী, আস-সহীহ /২৬২২
[3]
আবদুর রহমান ইবনু আবী বাকর সালিহী (৮৫৬ হি.), আল-কানযুল আকবার /২২৭

 . . জিহাদ হত্যা - (. . . জিহাদ বিষয়ক অপপ্রচার)

ইসলাম বিষয়ক বিভ্রান্তি অপপ্রচারের মূলে রয়েছে ‘‘জিহাদ’’ অনেক সময় বলা হয়, ধর্মই সকল হানাহানির মূল, ধর্মের নামেই রক্তপাত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কী জঘন্য মিথ্যাচার!! কথা সত্য যে, অনেক সময় ধর্মকে হানাহানির হাতিয়ার বানানো হয়, আবার অনেক সময় ধর্ম সত্য ন্যায়ের স্বার্থে যুদ্ধের অনুমতি দেয়। কিন্তু কখনোই ধর্মের নামে সবচেয়ে বেশি রক্তপাত হয় নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কমুনিষ্ট চীনের সাথে কমুনিষ্ট ভিয়েতনামের যুদ্ধ, আমেরিকার সাথে ভিয়েতনামের যুদ্ধ ইত্যাদি যুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ মরেছে। কম্পূচীয়ায় কমুনিষ্ট খেমার রূজের হাতে লক্ষলক্ষ মানুষের ভয়ঙ্কর মৃত্যু, জোসেফ স্টালিনের নির্দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের হত্যা, মাওসেতুং-এর চীনে প্রায় দু কোটি মানুষের হত্যা, মুসোলিনির নির্দেশে ইটালির লক্ষ মানুষের মৃত্যু এরূপ অগণিত মানুষের হত্যা সবই কি ধর্মের নামে হয়েছে?
কখনো বলা হয়, ইসলামই ধর্মের নামে ‘‘জিহাদ’’ বা ‘‘ধর্মযুদ্ধ’’ বৈধ করেছে। এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কী হতে পারে? হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ মহাভারত রামায়ন পুরোটায় যুদ্ধ হানাহানি নিয়ে। গীতা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে যুদ্ধের নির্দেশ রয়েছে। বাইবেলে বারংবার যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে ‘‘বাইবেলীয় জিহাদ’’ ‘‘ইসালমের জিহাদ’’ বিষয়ে কিছু আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ
জিহাদ বিষয়ক আরেকটি বিভ্রান্তি জিহাদকে ‘‘পবিত্র যুদ্ধ’’ বা ‘‘ধর্মযুদ্ধ’’ বলে আখ্যায়িত করা। জিহাদ অর্থ কখনোই ‘‘পবিত্র যুদ্ধ’’ (holy war) বা ‘‘ধর্মযুদ্ধ’’ (relegious war/crusade) নয়। পবিত্র যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ, ক্রুসেড ইত্যাদি সবই খৃস্টান চার্চ যাজকদের আবিষ্কৃত পরিভাষা। আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে দেখব যে, ইসলামের পরিভাষায় জিহাদ অর্থ ‘‘রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ’’ মুসলিম রাষ্ট্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধকে ইসলামের জিহাদ বলা হয়েছে। সাধারণভাবে কাফির বা অমুসলিম রাষ্ট্রই মুসলিম রাষ্ট্রের শত্রুরাষ্ট্র; এজন্য জিহাদের ক্ষেত্রে শত্রুদেরকে ‘‘কাফির’’, ‘‘মুশরিক’’ বা অমুসলিম বলে উল্লেখ করা হয়েছে
জিহাদ বিষয়ে আরেকটি বিভ্রান্তি হলো, মুসলিমরা ধর্মপ্রচার বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করে বা ইসলাম তরবারীর জোরে প্রচারিত হয়েছে বলে দাবি করা। এটি শুধু জঘন্য মিথ্যাই নয়, বরং প্রকৃত সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, বাইবেলে ধর্মের কারণে মানুষ হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বারংবার বিধর্মীদের উপাসনালয় ভেঙ্গে ফেলার, দেশের বিধর্মী নাগরিকদের উৎসবে ডেকে এনে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার নিরিহ বির্ধমীদের ধরে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[1]

৩২৫ খৃস্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটাইন খৃস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেন। সেদিন থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত খৃস্টান চার্চ, পোপ, প্রচারক রাষ্ট্রগুলির ইতিহাস হলো রক্তের ইতিহাস। অধার্মিকতা বা heresy দমনের নামে অথবা ধর্ম প্রচারের নামে পরধর্ম অসহিষ্ণুতা, পরধর্মের প্রতি বিষোদ্গার, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, অন্য ধর্মাবলম্বীদের হত্যা, নির্যাতন বা জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করা খৃস্টান ধর্মের সুপরিচিত ইতিহাস। পক্ষান্তরে ইসলামে শুধু রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব নিরাপত্তার জন্যই যুদ্ধ বৈধ করা হয়েছে, ধর্ম প্রচারের জন্য নয়। ইসলামে যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কখনোই অমুসলিম হওয়ার কারণে কাউকে হত্যা করা হয় নি বা জোরপূর্বক মুসলিম বানানো হয় নি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর মদীনায় আগমনের পূর্বে তথাকার অনেকের সন্তান ইহূদী ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এরা ইসলাম গ্রহণের পরে তাদের সন্তানদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে এরূপ চাপ প্রয়োগ থেকে নিষেধ করেন এবং তাদেরকে তাদের পছন্দের ধর্ম পালনের অধিকার প্রদান করেন।[2]
দীন প্রতিষ্ঠা বা দীন প্রচারের জন্য হত্যা, জিহাদ বা যুদ্ধ তো দূরের কথা কোনোরূপ শক্তিপ্রয়োগও নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেছেন:

لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

‘‘দীনে কোনো জবরদস্তি নেই। ভ্রান্তি থেকে সত্য সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগূতকে অবিশ্বাস করবে এবং আল্লাহকে বিশ্বাস
করবে সে এমন এক মযবুত হাতল ধরবে যা কখনো ভাঙ্গবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা প্রজ্ঞাময়।’’[3]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

من قتل نفسًا معاهدًا لم يَرَحْ رائحةَ الجنةِ ، وإنَّ رِيحَها ليُوجدُ من مسيرةِ أربعين عامًا

‘‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক বা মুসলিম দেশে অবস্থানকারী অমুসলিম দেশের কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের সুগন্ধও লাভ করতে পারবে না, যদিও জান্নাতের সুগন্ধ ৪০ বৎসরের দুরত্ব থেকে লাভ করা যায়।’’[4]
বিধর্মীকে হত্যা তো দূরের কথা, বিধর্মীর সাথে অভদ্র আচরণ করতেও নিষেধ করা হয়েছে। তাদের ধর্মবিশ্বাস বা উপাস্যদেরকে গালি দিতে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলিম তাঁর নিজের বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করবেন, তবে কারো গালি দিবেন না বা কারো অনুভূতি আহত করবেন না। কারণ এতে পারস্পারিক গালাগালিই বাড়বে। প্রত্যেকেই তো তার ধর্মকে ভালবাসে। আল্লাহ মানব প্রকৃতি এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। আর কারো ভক্তি ভালবাসা আহত করার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। মহান আল্লাহ বলেন:

وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ كَذَٰلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّهِمْ مَرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

‘‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না; কারণ এতে তারাও সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিবে। এভাবেই আমি প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ সুশোভন করেছি; অতঃপর তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন, তখন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন।’’[5]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:


وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ


‘‘
তোমরা উত্তম পন্থায় ছাড়া অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের অনুসারীদের সাথে বিতর্ক করবে না, তবে তাদের মধ্যে যারা সীমালঙ্ঘন করেছে তারা ব্যতিক্রম।’’[6] জুইশ এনসাইক্লোপিডীয়া, অন্যান্য বিশ্বকোষ ইতিহাস প্রমাণ করে যে, বিগত দেড় হাজার বছরে ইউরোপের সকল খৃস্টান দেশে ইহূদীদের উপর বর্বর অত্যাচার করা হয়েছে, জোর পূর্বক তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, তাদেরকে গণহারে হত্যা করা হয়েছে, তাদেরকে গণ-আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছে এবং নানভাবে তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। অথচ সময়ে মুসলিম দেশগুলিতে ইহূদীরা পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস করেছেন

প্রায় দেড় হাজার বৎসর ধরে মুসলিমগণ আরববিশ্ব শাসন করেছেন। সেখানে দেড় কোটিরও বেশি খৃস্টান কয়েক লক্ষ ইহূদী এখন পর্যন্ত বংশপরম্পরায় বসবাস করছে। ভারতে মুসলিমগণ প্রায় একহাজার বছর শাসন করেছেন, সেখানে প্রায় শতকরা ৮০ জন হিন্দু। অথচ খৃস্টানগণ যে দেশই দখল করেছেন, জোরযবরদস্তি করে বা ছলে-বলে সেদেশের মানুষদের ধর্মান্তরিত করেছেন অথবা হত্যা বিতাড়ন করেছেন

ইসলাম যদি তরবারীর জোরেই প্রচারিত হবে তাহলে ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামী দেশ হলো কি করে? ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্স, ব্রুনাই অন্যান্য দেশে তো কোনো মুসলিম বাহিনী কখনোই যায় নি। বিগত অর্ধ শতাব্দি যাবৎ ইসলাম The firstest growing religion বা সর্বাধিক বর্ধনশীল ধর্ম। ইউরোপ আমেরিকা-সহ সকল দেশের হাজার হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছেন। কোন্ তরবারীর ভয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করছেন?

[1] বাইবেল, রাজাবলি ১৮/৪০; রাজাবলি ১০/১৮-২৮

[2]
আবু দাউদ, আস-সুনান (কিতাবুল জিহাদ, বাবুল আসীর ইউকরাহু) /৫৮ হাদিসটি সহীহ
[3]
সূরা বাকারা ২৫৬ আয়াত
[4]
বুখারী, আস-সহীহ /১১৫৫, /২৫৩৩; মুসলিম, আস-সহীহ /২২৭৮
[5]
সূরা : আনআম, ১০৮ আয়াত
[6]
সূরা ২৯: আনকাবুত, ৪৬ আয়াত

 . . . ইসলামী শরীয়তে জিহাদ তার পূর্বশর্ত

 জিহাদঅর্থ প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, পরিশ্রম ইত্যাদি।[1] আল্লাহর বিধান পালনের প্রচারের সকল শ্রম বা প্রচেষ্টাকেই কুরআন হাদীসে কখনো কখনোজিহাদবলা হয়েছে। যেমন, কাফির-মুনাফিকদের দাওয়াত দেওয়া তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদকে জিহাদ বলা হয়েছে।[2] যালিম শাসকের সামনে সত্য ন্যায়ের কথা বলাকে সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ বলা হয়েছে।[3] হজ্জকে জিহাদ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ বলা হয়েছে।[4] আল্লাহর আনুগত্য-মূলক বা আত্মশুদ্ধিমূলক যে কোনো কর্মের চেষ্টাকে জিহাদ বলা হয়েছে।[5] তবে ইসলামী পরিভাষায় ইসলামী ফিক্হে জিহাদ বলতে ‘‘কিতাল’’ বা মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় যুদ্ধকেই বুঝানো হয়। ফিকহের পরিভাষায় সর্বদা জিহাদ অর্থ কিতাল বলা হয়েছে।[6]

কতল অর্থ হত্যা করা। আর কিতাল অর্থ পরস্পরে যুদ্ধ। এজন্য জিহাদ বা কিতালের মূল শর্ত হলো সামনাসামনিযুদ্ধ পিছন থেকে হত্যা করা, না জানিয়ে হত্যা করা, গুপ্ত হত্যা করা এগুলি কখনোই ইসলামী কিতাল বা জিহাদ নয়। মদীনার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নেতৃত্বে মুসলিমগণ অনেককিতালকরেছেন। যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কাফিরদের দেশে যেয়ে গোপনে হত্যা, সন্ত্রাস, অগ্নি সংযোগ, বিষ প্রয়োগ ইত্যাদি কখনোই তিনি করেন নি বা করার অনুমতি প্রদান করেন নি। দুই-একটি ক্ষেত্রে যুদ্ধরত সামরিক নেতা বা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে যথাসম্ভব কম রক্তপাতে মৃত্যুদন্ড প্রদানের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গোপন ‘‘কমান্ডো’’ অভিযান পারিচালনা করার অনুমতি দেন তিনি। কাব ইবনু আশরাফ আবূ রাফি সালাম ইবনু আবিল হুকাইক-এর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে কমান্ডো অভিযান ছিল পর্যায়ের। এরূপ অভিযানের মাধ্যমে তিনি মুসলিম বাহিনী শত্রু বাহিনী উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা প্রায় শূন্যে আনতে সক্ষম হয়েছেন।[7] রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এরূপ কমান্ডো হামলা ছাড়া অন্য কোনোভাবে যুদ্ধের ময়দান বিচার ছাড়া তিনি হত্যার অনুমতি দেন নি। এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও অযোদ্ধাকে আঘাত করতে তিনি নিষেধ করেছেন

কিতাল বা যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইসলাম অনেক শর্ত আরোপ করেছে। সেগুলির অন্যতম () রাষ্ট্রের বিদ্যমানতা রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি, () রাষ্ট্র বা মুসলিমদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া, () সন্ধি শান্তির সুযোগকে প্রাধান্য দেওয়া () কেবলমাত্র যোদ্ধা লক্ষ্যবস্ত্ততে আঘাত করা

(
) রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদন
ইসলামে জিহাদের বৈধতার সর্বপ্রথম শর্ত হলো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। কিতাল বা জিহাদ কখনোই ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম নয়। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যমদাওয়াতবা প্রচার। কিতাল হলো প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সংরক্ষণ, রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তার মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। দাওয়াতের বিরুদ্ধে অমানবিক বর্বরতা সহিংস প্রতিরোধকে তিনি পরিপূর্ণ অহিংস উত্তম আচরণ দিয়ে মুকাবিলা করেছেন। আবূ বাকর, উমার, উসমান, আব্দুর রাহমান ইবনু আউফ মক্কার আরো অনেক শীর্ষস্থানীয় সামাজিক নেতা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাদের সাথে সাধারণ অনেক মুসলিম ছিলেন। তাঁরা সর্বদা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর কাছে অনুমতি চেয়েছেন কাফিরদের সহিংস আচরণকে প্রতিরোধ করতে বা তাদের বর্বরতার প্রতিবাদে অস্ত্র তুলে নিতে। কিন্তু কখনোই সে অনুমতি দেওয়া হয় নি। এক পর্যায়ে দাওয়াতের ভিত্তিতে মদীনার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলামী জীবনব্যবস্থা মেনে নেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাঁদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে গ্রহণ করেন। এভাবে দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মুশরিকগণ নতুন রাষ্ট্রটিকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে চেষ্টা করে। তখন রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জিহাদের বিধান প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রের বিদ্যমানতা রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি বা নির্দেশ জিহাদের বৈধতার শর্ত বলে উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:


إنما الإمامُ جُنةٌ . يُقاتلُ من ورائهِ

‘‘রাষ্টপ্রধান ঢাল, যাকে সামনে রেখে যুদ্ধ পরিচালিত হবে।’’[8]
এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবীগণ রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে যুদ্ধ বা কিতালে লিপ্ত হন নি। আলী (রা)-এর সাথে মুআবিয়া (রা)-এর যুদ্ধ ছিল রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ। ইয়াযিদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইনের যুদ্ধ উমাইয়া শাসকদের সাথে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের যুদ্ধ ছিল একান্তই রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ। মুআবিয়ার (রা) মৃত্যুর পরে কূফাবাসীগণ ইমাম হুসাইনকে (রা) রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাইয়াত করে পত্র লিখেন। তারা ইমাম হুসাইনকেই বৈধ রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ইয়াযিদের রাষ্ট্রক্ষমতার দাবি অস্বীকার করেন। এভাবে মুসলিম সমাজ দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের (রা) ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইরূপ ছিল। সকল বৈধ রাষ্ট্রীয় যুদ্ধও যেহেতু মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতো, সেজন্য সাহাবীগণ সাধারণত এগুলিতে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতেন, যদিও তাঁরা মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক বিদ্রোহী মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বৈধতা স্বীকার করতেন। আমরা দেখেছি যে, আলী (রা)-এর সময়ের যুদ্ধে ৩০ জনেরও কম সাহাবী অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ইবনু সিরীন, যদিও তখন হাজার হাজার সাহাবী জীবিত ছিলেন। ৭৩ হিজরীতে হাজ্জাজ ইবনু ইউসূফ যখন মক্কা অবরোধ করে ইবনু যুবাইরের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক আক্রমন চালাতে থাকে, তখন দুই ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা)-এর নিকট এসে বলে,


إنَّ الناسَ ضَيَّعوا وأنتَ ابنُ عُمَرَ، وصاحبُ النبيَّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم، فما يَمنَعُكَ أن تَخرُجَ ؟ فقال : يَمنَعُني أنَّ الله حَرَّمَ دمَ أخي
وفي رواية: ما حملك على أن تحج عاماً وتعتمر عاماً وتترك الجهاد في سبيل الله عز وجل وقد علمت ما رغب الله فيه قال يا ابن أخي بني الإسلام على خمس إيمان بالله ورسوله والصلوات الخمس وصيام رمضان وأداء الزكاة وحج البيت


মানুষেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আপনি ইবনু উমার, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর সাহাবী, আপনাকে বেরিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধা দিচ্ছে কিসে? তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহ আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন, - আমাকে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধা দিচ্ছে।’’ অন্য বর্ণনায় তারা বলে, ‘‘কি কারণে আপনি এক বছর হজ্জ করেন আরেক বছর উমরা করেন এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করেন? অথচ আপনি জানেন যে, আল্লাহ জিহাদের জন্য কী পরিমাণ উৎসাহ প্রেরণা দিয়েছেন?’’ তখন আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, ‘‘ভাতিজা, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচটি বিষয়ের উপর: আল্লাহ তাঁর রাসূলের (সাঃ) উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রামাযানের সিয়াম, যাকাত প্রদান বাইতুল্লাহর হজ্জ।’’[9]

এখানে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) জিহাদের আদেশ হত্যার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তুলনা করছেন। ইসলামের মূলনীতি, আদেশ পালনের চেয়ে নিষেধ বর্জন অগ্রগণ্য।[10] বিশেষত ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ কর্মটি কুরআন-হাদীসে বারংবার ভয়ঙ্করতম কবীরা গোনাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে

এছাড়া জিহাদ আরকানে ইসলামের মত মুমিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় বা উদ্দিষ্ট (Aimed at; intended) ইবাদত নয়; বরং তা উদ্দিষ্ট ইবাদতগুলি পালনের উপকরণ (accessory; equipment; apparatus) মাত্র। জিহাদের মাধ্যমে মূল ইবাদগুলি পালনের পরিবেশ রক্ষা করা হয়। পরিবেশ বিদ্যমান থাকলে আর জিহাদের প্রয়োজন থাকে না। উদ্দিষ্ট ইবাদত কখনো স্থগিত হয় না; উপকরণ স্থগিত হতে পারে। সালাত, সিয়াম ইত্যাদি ইবাদত সর্বদা সর্বাবস্থায় পালনীয়। পক্ষান্তরে ‘‘জিহাদ’’ কেবলমাত্র সকল ইবাদত পালনের বিঘ্ন ঘটলেই পালনীয়। সালাত, সিয়াম, তিলাওয়াত, যিক্র ইত্যাদি কর্ম সরাসরি ইবাদত। মুমিন যত বেশি পালন করবেন ততবেশি সাওয়াব লাভ করবেন। পক্ষান্তরে জিহাদ হলো অপরাধীর শাস্তি দেওয়ার মত ইবাদত। এক্ষেত্রে যত বেশি অপরাধীর শাস্তি দেওয়া হবে তত বেশি সাওয়াব হবে বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই। যদি অপরাধ প্রমাণিত হয় তাহলে শরীয়ত অনুসারে শাস্তি প্রদান ইবাদত বা দায়িত্বে পরিণত হয়। এজন্য ইসলামে শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া কঠিন করা হয়েছে এবং সামান্যতম সন্দেহের ক্ষেত্রে শাস্তিপ্রদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আর এজন্যই জিহাদ এড়ানোর জন্য ইসলামে সন্ধি শান্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে তা আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ

এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, জিহাদ মূলত ইসলামী রাষ্ট্রের সংরক্ষণ ইসলামী দাওয়াতকে এগিয়ে নেওয়ার ‘‘উপকরণ’’ প্রয়োজনে তা অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। তবে সর্বাবস্থায় চেষ্টা করতে হবে ব্যবস্থা এড়িয়ে সন্ধি বা শান্তির মাধ্যমে মূল উদ্দেশ্য সাধান করার। জিহাদের বারংবার আদেশ করা হলেও তার জন্য অনেক শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে, তাকে ফরয আইন বলে কোথাও উল্লেখ করা হয় নি এবং তা পরিত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কাজেই পরিত্যাগযোগ্য একটি কম পালনের জন্য মুমিন কখনোই ভয়ঙ্করতম একটি হারামে লিপ্ত হতে পারেন না। এক্ষেত্রে তাঁদের মূলনীতি ছিল যে, ভুল জিহাদের মানুষ হত্যা বা মানুষের ক্ষতি করার চেয়ে সঠিক জিহাদ বর্জন করা অনেক শ্রেয়
এভাবে আমরা দেখি যে, সাহাবীগণ সন্দেহের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে বৈধ জিহাদেও অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতেন। আর রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে কখনোই কোনো যুদ্ধ তারা বৈধ বলে মনে করেন নি। খারিজীগণের আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী বিষয়ক হাদীসগুলিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খারিজীদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি তিনি বলেছেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে পাবে তারা যেন তাদেরকে হত্যা করে।’’ সাহাবীগণ থেকে কখনোই বুঝেন নি যে, খারিজীদেরকে পেলেই হত্যা করতে হবে। তাঁরা কখনোই যুদ্ধের ময়দান ছাড়া অন্যত্র কোনো সুপরিচিত খারিজী নেতাকেও হত্যা করেন নি।[11]

(
) রাষ্ট্র বা মুসলিমের নিরাপত্তা
কিতালের অন্যতম শর্ত, শত্রুপক্ষ রাষ্ট্র আক্রমণ করবে বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। মহান আল্লাহ বলেন:

أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا

‘‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে।’’[12] মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকগণের নিরাপত্তা ছাড়াও অন্যদেশের নির্যাতিত মুসলিম নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ নিরাপত্তার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়ানো মুসলিম রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও জিহাদের প্রয়োজনে হতে পারে। যদি অন্য দেশের মুসলিম নাগরিকগণ কোনো মুসলিম দেশের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং সে দেশের সাথে মুসলিম দেশের কোনো চুক্তি বা কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকে তাহলে মুসলিম রাষ্ট্র প্রয়োজনে সে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারে বা তাদেরকে নির্যাতন থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নিতে পারে। আল্লাহ বলেন:


إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آوَوْا وَنَصَرُوا أُولَٰئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يُهَاجِرُوا مَا لَكُمْ مِنْ وَلَايَتِهِمْ مِنْ شَيْءٍ حَتَّىٰ يُهَاجِرُوا وَإِنِ اسْتَنْصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ


‘‘
নিশ্চয় যারা ঈমন এনছে, হিজরত করেছে (অমুসলিম সমাজ পরিত্যাগ করে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে) এবং নিজেদের সম্পদ জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে তারা একে অপরের অভিভাবক-বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে, কিন্তু হিজরত করেনি, তাদের অভিভাবকত্বের (সাহায্যের) কোনোরূপ দায়িত্ব তোমাদের নেই, যতক্ষণ না তারা হিজরত করে। আর যদি তারা দীনের বিষয়ে তোমাদের নিকট কোনো সাহায্য চায় তবে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে এরূপ জাতির বিরুদ্ধে নয় যাদের সাথে তোমাদের পারস্পরিক চুক্তি রয়েছে। আর তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ পূর্ণ দৃষ্টিমান।’’[13]


(
) সন্ধি শান্তির সুযোগ গ্রহণ
আমরা দেখেছি যে, জিহাদ উদ্দিষ্ট ইবাদত নয়, উদ্দিষ্ট ইবাদত পালনের পরিবেশ রক্ষার উপকরণ। জিহাদের উদ্দেশ্য রাষ্ট্র, নাগরিক ইসলামী দাওয়াতের নিরাপত্তা রক্ষা করা। উদ্দেশ্য যদি জিহাদ ছাড়া অর্জিত হয় তবে তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য ইসলামে সন্ধি শান্তির সুযোগ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন:

وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

‘‘আর যদি তারা সন্ধির প্রতি ঝুঁকে পড়ে, তবে তুমিও তার প্রতি ঝুঁকে পড়, আর আল্লাহর উপর নির্ভর কর, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’’[14] হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা কুরআন হাদীসের আলোকে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি যে, ইসলামী রাষ্ট্রের সংরক্ষণ, দাওয়াতের প্রসার দীনের বিজয়ে জিহাদের চেয়েও সন্ধির অবদান ছিল অনেক বেশি। জাগতিক বিচারে সন্ধি ছিল অপমানজনক, অবমাননাকর এবং কাফিরদেরকে সকল ছাড় দেওয়া। যে কোনো আবেগী বিচারে ছিল ‘‘সব কিছু মেনে নেওয়া’’ উমার (রা) অধিকাংশ সাহাবীই এরূপ ভেবেছেন। সময়ে মক্বাবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সকল অধিকার তাদের ছিল এবং যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সকল সুযোগ সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সন্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং কাফিরদের সকল দাবি মেনে নিয়ে সন্ধি করেছেন। আর ইসলামের কোনো জিহাদ, গাযওয়া, যুদ্ধ, অভিযান বা বিজয়কে ‘‘ফাতহ মুবীন’’ বা সুস্পষ্ট বিজয় বলা হয় নি। কিন্তু ‘‘সব কিছু মেনে নেওয়ার’’ সন্ধিকে কুরআনে ‘‘ফাতহ মুবীন’’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে

সন্ধি শান্তি রক্ষায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। এর একটি প্রকাশ হুদায়বিয়ার সন্ধি রক্ষার্থে নির্যাতিত মুসলিমদেরকে কাফিরদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। ছিল এমন একটি সিদ্ধান্ত যা প্রায় সকল সাহাবীকে বিক্ষুদ্ধ করেছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চুক্তি রক্ষায় অনড় ছিলেন। সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ে হুদাইবিয়ার ময়দানেই আবূ জানদাল (রা) নামক একজন নির্যাতিত মুসলিম শৃঙ্খলিত অবস্থাতেই মক্কা থেকে পালিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শর্ত মেতাবেক তাকে মক্কাবাসীদের হাতে সমর্পন করেন। উপস্থিত সাহাবীগণ বিষয়ে খুবই আবেগী হয়ে উঠেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। এরপর আরেক নির্যাতিত মুসলিম আবূ বাসীর (রা) মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকেও ফিরিয়ে দেন। একপর্যায়ে আবূ বাসীর (রা), আবূ জানদাল (রা) আরো অনেক নির্যাতিত মুসলিম মক্কা থেকে পালিয়ে সিরিয়ার পথেঈসনামক স্থানে সমবেত হন। সন্ধিচুক্তির কারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে মদীনার নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন নি। আর মদীনা রাষ্টের সাথে মক্কাবাসীদের সন্ধি থাকলেও নতুন জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের সন্ধি ছিল না; বরং তাদের মধ্যে পরিপূর্ণ যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছি। অবস্থায় তাঁরা সিরিয়াগামী কুরাইশ কাফিলাগুলির উপর আক্রমন চালাতে থাকেন। মক্কাবাসীরা বুঝতে পারে যে, এদেরকে মদীনা রাষ্টের নাগরিক মেনে সন্ধিচুক্তির অন্তর্ভুক্ত করাই তাদের জন্য নিরাপদ। তাদেরই অনুরোধে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সন্ধিচুক্তির সংশি­ষ্ট শর্তটি বাতিল করে তাঁদেরকে মদীনায় আশ্রয় গ্রহণের ব্যবস্থা করেন।[15]

এভাবে সকল প্রকার আবেগ বেদনা নিয়ন্ত্রণ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সন্ধি শান্তি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধ বা হত্যা এড়িয়ে শান্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলামে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধের ক্ষেত্রেও যুদ্ধ শুরুর পূর্বে শান্তির সুযোগ দানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শত্রুবাহিনীকে সন্ধি, আত্মসমর্পন, ইসলাম গ্রহণ, জিযিয়া বা কর প্রদান ইত্যাদির সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে, যুদ্ধ চলাকালে একেবারে অস্ত্রাঘাতের সময়ও যদি কোনো শত্রু সৈন্য নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে তবে তাকে আর আঘাত করা যাবে না। বস্ত্তত একজন ডাক্তার যেমন সর্বাত্মক চেষ্টা করেন রোগীর অঙ্গচ্ছেদ না করে চিকিৎসা করারএকান্ত বাধ্য হলেই কেবল তার কোনো অঙ্গ কেটে প্রাণ বাচানোর চেষ্টা করেন; তেমনি ইসলামে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিটি মানুষের প্রাণ রক্ষা করার


(
) কেবলমাত্র যোদ্ধা লক্ষ্যবস্ত্ততে আঘাত
কিতালের অন্য শর্ত, শুধু যারা যুদ্ধ করতে অস্ত্রধারণ করে সামনে এসেছে তাদেরই সাথে যুদ্ধ করতে হবে

وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

‘‘তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের সাথে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে। কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করবে না, আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।’’[16] নির্দেশের মাধ্যমে ইসলাম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যুদ্ধের নামে অযোদ্ধা লক্ষ্যবস্ত্ততে আঘাত করা, অযোদ্ধা মানুষদেরকে হত্যা করা ইত্যাদি সন্ত্রাসের পথ রোধ করেছে। যোদ্ধা ছাড়া কারো সাথে যুদ্ধ করা যাবে না এবং যুদ্ধের ক্ষেত্রেও সীমালঙ্ঘন, আগ্রাসন ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিষয়ে হাদীসের নির্দেশ:


لا تغدروا ولا تمثلواولا تقتلوا وليداً ولا اصحاب الصوامع ... ولا راهبا ... ولا امرأةً ولا شيخاً كبيراً ... ولا تذبحوا بغيراً ولا بقرةً الا لمأكل ... ولا تخربوا عمراناً ولا تقطعوا شجرة الا لنفع ...وأحسنوا ان الله يحب المحسنين

‘‘যুদ্ধে তোমরা প্রতারণা বা ধোঁকার আশ্রয় নেবে না, চুক্তিভঙ্গ করবে না, কোনো মানুষ বা প্রাণীর মৃতদেহ বিকৃত করবে না বা অসম্মান করবে না, কোনো শিশু-কিশোরকে হত্যা করবে না, কোনো মহিলাকে হত্যা করবে না, কোনো গীর্জাবাসী, সন্ন্যাসী বা ধর্মযাজককে হত্যা করবে না, কোনো বৃদ্ধকে হত্যা করবে না, কোনো অসুস্থ মানুষকে হত্যা করবে না, কোনো বাড়িঘর ধ্বংস করবে না, খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া গরু, উট বা কোনো প্রাণী বধ করবে না, যুদ্ধের প্রয়োজন ছাড়া কোনো গাছ কাটবে না... তোমরা দয়া কল্যাণ করবে, কারণ আল্লাহ দয়াকারী- কল্যাণকারীদেরকে ভালবাসেন।[17]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর জীবনের সকল যুদ্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব কম প্রাণহানি ঘটাতে। শুধু মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিক যোদ্ধাদের জীবনই নয়, উপরন্তু তিনি শত্রুপক্ষের নাগরিক যোদ্ধাদেরও প্রাণহানি কমাতে চেয়েছেন। বস্ত্তত ইসলাম যুদ্ধকে যে মানবিক রূপ প্রদান করেছে তা অন্য কোনো ধর্মেই পাওয়া যায় না। উপর্যুক্ত শর্তাবলির বিদ্যমানতায় জিহাদ শরীয়ত সম্মত ইবাদতে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে জিহাদ আত্মরক্ষামূলক (defensive) হতে পারে। আবার তা আক্রমনাত্মক বা নিবৃত্তিমূলক (offensive/preemptive) হতে পারে। রাষ্ট্র প্রধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন

[1] কুরতুবী, আল-জামিলি আহকামিল কুরআন /৫০/
[2]
সূরা তাওবা, ৭৩ আয়াত, সূরা ফুরকান, ৫২ আয়াত, সূরা তাহরীম আয়াত তাবারী, জামিউল বায়ান ১০/১৮৩ কুরতুবী, আল-জামি১৩/৫৮
[3]
তিরমিযী, আস-সুনান /৪৭১; আবু দাউদ, আস-সুনান /১২৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৫৫১
[4]
বুখারী, আস-সহীহ /৫৫৩, /১০২৬

[5]
তিরমিযী, আস-সুনান /১৬৫; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১১/২০৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৫৪
[6]
ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী /; যারকানী মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী (১১২২ হি.), শরহুল মুয়াত্তা /; আযীমআবাদী, মুহাম্মাদ শামসুল হক্ক, আওনুল মাবুদ /১১১; মুনাবী, আব্দুর রাউফ (১০৩১ হি.), ফাইদুল কাদীর /৩০; সানআনী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (৮৫২ হি.), সুবুলুস সালাম /৪১; শাওকানী, মুহাম্মাদ ইবনু আলী (১২৫৫ হি.), নাইলুল আওতার /২৫
[7]
বুখারী, আস-সহীহ /১৪৮১-১৪৮২; মুসলিম, আস-সহীহ /১৪২৫
[8]
বুখারী, আস-সহীহ /১০৮০; মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৭১
[9]
বুখারী, আস-সহীহ /১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৮৪, ৩১০
[10]
বুখারী, আস-সহীহ /২৬৫৮; মুসলিম, আস-সহীহ /১৮৩০
[11]
. নাসির আল-আকল, আল-খাওারিজ, পৃ. ৪৭-৫৭
[12]
সূরা (২২) হজ্জ, আয়াত ৩৯
[13]
সূরা () আনফাল: আয়াত ৭২
[14]
সূরা () আনফাল: আয়াত ৬১
[15]
বুখারী, আস-সহীহ /৯৭৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৩১১-৩১২
[16]
সূরা () বাকরা: আয়াত ১৯০
[17]
বাইহাকী, আহমাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি.), আস-সুনানুল কুবরা /৯০

 . . . জিহাদের ফযীলত বিধান

নিঃসন্দেহে জিহাদের মাধ্যমে জীবন সম্পদ কুরবানী দেওয়া অত্যন্ত বড় ত্যাগ এবং মানবীয় প্রকৃতির জন্য খুবই কষ্টকর। এজন্য ইবাদতের সাওয়াব পুরস্কারও অভাবনীয়। কুরআন হাদীসে জিহাদের অফুরন্ত সাওয়াব পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে এবং জিহাদের ইবাদত পালনের জন্য বিশেষ উৎসাহ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সকল আয়াত হাদীসের অর্থ জিহাদ যখন বৈধ বা শরীয়ত সম্মত হবে তখন যে ব্যক্তি মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠে জিহাদের দায়িত্ব পালন করবে তখন সে অভাবনীয় পুরস্কার লাভ করবে। এছাড়া জিহাদের আবেগ আগ্রহ মুমিনের হৃদয়ে থাকবে। জিহাদের মাধ্যমে জীবন সম্পদের কুরবানীর প্রতি অনীহা ঈমানের দুর্বলতা প্রমাণ করে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:


مَن مات ولم يَغزُ ، ولم يحدِّث به نفسَه ، مات علَى شُعبةٍ من نفاقٍ

‘‘যদি কেউ এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নি এবং যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণের কোনো কথাও নিজের মনকে কখনো বলে নি, তবে সে ব্যক্তি মুনাফিকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করল।’’[1] আমরা দেখব যে, সাধারণভাবে জিহাদ ফরয কিফায়া এবং রাষ্ট্র শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ফরয আইন। ফরয কিফায়া অবস্থায় যদি সকল মুসলিম তা পরিত্যাগ করে এবং ফরয আইন অবস্থায় যদি মুসলিমগণ তা পরিত্যাগ করে তবে তা তাদের জাগতিক লাঞ্ছনা বয়ে আনবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:


إذا تبًايعتم بًالعينة وأخذتم أذناب البقر ، ورضيتم بًالزرع ، وتركتم الجهاد سلط الله عليكم ذلا لا ينزعه حتى ترجعوا إلى دينكم

‘‘যখন তোমরা অবৈধ ব্যবসাবাণিজ্যে লিপ্ত হবে, গবাদিপশুরু লেজ ধারণ করবে, চাষাবাদেই তুষ্ট থাকবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দিবেন, দীনে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত যা তিনি অপসারণ করবেন না।’’[2] সকল আয়াত হাদীস থেকে অনেক সময় আবেগী মুমিন ভুল বুঝেন যে, জিহাদের বিষয়ে যেহেতু বেশি বেশি নির্দেশ উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং বেশি বেশি পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সেহেতু জিহাদ সালাত-সিয়ামের মতই ইবাদত অথবা সালাত সিয়ামের চেয়েও বড় ইবাদত। কারণ মহান আল্লাহ সালাত সিয়াম ফরয করেছেন এবং তিনিই জিহাদ ফরয করেছেন আল্লাহ বলেছেন (كتب عليكم الصيام) তোমাদের উপর সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হয়েছে’’[3] এবং তিনিই বলেছেন (كتب عليكم القتال) তোমাদের উপর কিতাল বা যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করা হয়েছে’’[4] কাজেই সালাত, সিয়াম জিহাদ-কিতালের মধ্যে পার্থক্য করলে বা সালাত পালন করে জিহাদ-কিতাল পালন না করলে ইসলাম পালন করা হবে না। আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের সাথে খারিজীগণের কথোপকথনে আমরা এর নমুনা দেখেছি

আমরা ইতোপূর্বে বলেছি যে, কুরআনে কোনো ইবাদতেরই বিস্তারিত বিধান শর্তাবলি উল্লেখ করা হয় নি। কুরআন সুন্নাতের সামগ্রিক নির্দেশনার আলোকে তা জানতে হয়। কুরআন সুন্নাতের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, জিহাদ সালাত সিয়াম ইত্যাদির মতফরয আইনবা দীনের রুকন নয়, বরং তা ফরয কিফয়া ইবাদত। জিহাদের শর্তগুলি পূরণ সাপেক্ষ জিহাদ বৈধ বা ফরয হলে উম্মাতের কিছু সদস্য তা পালন করবেন। এতে উম্মাতের সকলের দায়িত্ব পালিত হয়ে যাবে। অন্যরা পাপমুক্ত হবেন, তবে ইবাদত পালনের সাওয়াব তারা পাবেন না। যারা ইবাদত পালন করবেন তারা ইবাদত পরিত্যাগকারীদের চেয়ে অধিক মর্যাদা লাভ করবেন, তবে পরিত্যাগকারীরা পাপী হবেন না। বিষয়ে আল্লাহ বলেন:

لَا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ...

মুমিনদের মধ্যে যারা কোনো অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও (জিহাদ না করে) ঘরে বসে থাকে এবং যারা আল্লাহর পথে নিজেদের প্রাণ সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়। যারা নিজেদের প্রাণ সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন। উভয় প্রকারের মুমিনকেই আল্লাহ কল্যাণের (জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ....’’[5] এখানে মহান আল্লাহ সুস্পষ্টতই জানিয়েছেন যে, কোনোরূপ ওজর অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ জিহাদ পরিত্যাগ করে তবে সে পাপী হবে না, শুধু অতিরিক্ত সাওয়াব মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থে এক হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন,

أنَّ رجلًا أتى النبيَّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ فقال : أيُّ الناسِ أفضلُ ؟ فقال رجلٌ يجاهد في سبيلِ اللهِ بمالِه ونفسِه قال : ثم من ؟ قال مؤمنٌ في شِعبٍ من الشِّعابِ ، يعبدُ اللهَ ربَّه (وفي رواية: يقيم الصلاة ويؤتي الزكاة ويعبد ربه حتى يأتيه اليقين) ويدعُ الناسَ من شرِّه

‘‘একব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর নিকট আগমন করে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, সর্বোত্তম মানুষ কে? তিনি বলেন: যে মুমিন নিজের জীবন সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে। লোকটি বলে, এরপর সর্বোত্তম কে? তিনি বলেন: যে মুমিন মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী বিজন উপত্যাকায় থেকে তার প্রতিপালকের ইবাদত করে (দ্বিতীয় বর্ণনায়: এভাবে নির্জনে একাকী সে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়, মৃত্যু আগমন পর্যন্ত তার প্রতিপালকের ইবাদত করে) এবং মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।’’[6] এভাবে সমাজ জিহাদ পরিত্যাগ করে বিজনে নির্জনে একাকী বসবাস করে দীনের আরকান আহকাম পালনের কারণে দ্বিতীয় ব্যক্তি মর্যাদায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন, তবে পাপী বলে গণ্য হলেন না
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:


وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

‘‘মুমিনদের জন্য সংগত নয় যে, তারা সকলে একসঙ্গে অভিযানে বের হবে। তাদের প্রতিটি দল থেকে একাংশ বের হয় না কেন? যাতে তারা দীনের জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যেন তারা সতর্ক হয়।’’[7] বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পিতামাতার খেদমত বা অনুরূপ দায়িত্বের কারণে জিহাদ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা) বলেন:

جاءَ رجلٌ إلى النبيِّ صلى الله عليه وسلم فاستأذَنَهُ في الجهادِ فقالَ: أحيٌّ والداكَ ؟ قال: نعَم قال: ففيهِما فجاهِدْ (فارجع الى والديك فأحسن صحبتهما)

‘‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর কাছে এসে জিহাদে অংশগ্রহণের অনুমতি প্রার্থনা করে। তিনি বলেন: তোমার পিতামাতা কি জীবিত আছেন? সে বলে : হ্যাঁ। তখন তিনি বলেন : তোমার পিতামাতাকে নিয়ে তুমি জিহাদ কর। (অন্য বর্ণনায়: তাহলে তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং সুন্দরভাবে তাঁদের খেদমন সাহচার্যে জীবন কাটাও।’’[8] সকল আয়াত হাদীসের আলোকে মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ ফকীহগণ একমত যে, জিহাদ ফরয কিফায়া বা সামষ্টিক ফরয, কিছু মুসলিম তা পালন করলে অন্যদের ফরয আদায় হয়ে যায়। তবে যারা পালন করবেন তারাই শুধু সাওয়াব লাভ করবেন, অন্যরা গোনাহ থেকে মুক্ত হবেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে শত্রুবাহিনী যদি রাষ্ট্র দখল করে নেয়, বা রাষ্ট্র যদি বহির্শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, সেনাবাহিনীর পক্ষে আগ্রাসন রোধ সম্ভব না হয়, এবং রাষ্ট্রপ্রধান সকল নাগরিককে যুদ্ধে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেন তবে অবস্থায় জিহাদ ফরয আইনে পরিণত হয়। আল্লামা কুরতুবী বলেন:

الذي استقر عليه الإجماع أن الجهاد على كل امة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين

‘‘ যে বিষয়ে ইজমা বা ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হলো, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সকলের উপর জিহাদ ফরয কিফায়া। যখন কিছু মানুষ তা পালন করবে তখন অন্য সকলের দায়িত্ব অপসারিত হবে। তবে যখন শত্রুগণ ইসলামী রাষ্ট্রে অবতরণ করে তখন তা ফরয আইন হয়ে যায়।’’[9] তাফসীর, হাদীস-ব্যাখ্যা ফিকহের প্রায় সকল গ্রন্থেই বিভিন্ন শব্দে বাক্যে কথাই বলা হয়েছে

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /১৫১৭
[2]
আবু দাউদ, আস-সুনান /২৭৪; আলবানী, সহীহাহ /১৫ হাদিসটি সহীহ
[3]
সূরা () বাকারা: ১৮৩ আয়াত
[4]
সূরা () বাকারা: ২১৬ আয়াত
[5]
সূরা () নিসা: ৯৫ আয়াত
[6]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৫০৩
[7]
সূরা () তাওবা: আয়াত ১২২
[8]
বুখারী, আস-সহীহ /১০৯৪; মুসলিম, আস-সহীহ /১৯৭৫
[9]
কুরতুবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ (৬৭১ হি.), আল-জামি লি আহকামিল কুরআন /৩৮

 . . . কাফির যোদ্ধা হত্যা বনাম কাফির হত্যা

কুরআনে যেমন কোথাও কোথাও কাফিরদের বা মুশরিকদের হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তেমনি অন্যত্র শুধু যুদ্ধরতদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন আমরা দেখেছি যে, আল্লাহ বলেছেন: ‘‘আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে এবং সীমালঙ্ঘন করো না।’’ অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন:

بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَأَنَّ اللَّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ وَأَذَانٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ فَإِنْ تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَبَشِّرِ الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنْقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ يُظَاهِرُوا عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّوا إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَىٰ مُدَّتِهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ كَيْفَ يَكُونُ لِلْمُشْرِكِينَ عَهْدٌ عِنْدَ اللَّهِ وَعِنْدَ رَسُولِهِ إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ فَمَا اسْتَقَامُوا لَكُمْ فَاسْتَقِيمُوا لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ

‘‘আল্লাহ তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা মুশরিকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে তাদের প্রতি। সুতরাং তোমরা যমীনে বিচরণ কর চার মাস, আর জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না, আর নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের অপদস্থকারী। আর মহান হজ্জের দিন মানুষের প্রতি আল্লাহ তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে ঘোষণা, নিশ্চয় আল্লাহ মুশরিকদের থেকে দায়মুক্ত এবং তাঁর রাসূলও। অতএব যদি তোমরা তাওবা কর, তাহলে তা তোমাদের জন্য উত্তম। আর যদি তোমরা ফিরে যাও, তাহলে জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না। আর যারা কুফরী করেছে তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। তবে মুশরিকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছ, অতঃপর তারা তোমাদের সাথে কোনো ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তোমরা তাদেরকে দেওয়া চুক্তি তাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত পূর্ণ কর। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন। অতঃপর যখন নিষিদ্ধ মাসগুলো (ঘোষিত মাস) অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর, তাদেরকে পাকড়াও কর, তাদেরকে অবরোধ কর এবং তাদের জন্য প্রতিটি ঘাটিতে বসে থাক। তবে যদি তারা তাওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম করুণাম। আর যদি মুশরিকদের কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায়, তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনে, অতঃপর তাকে তার নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দাও। তা এজন্য যে তারা অজ্ঞ সম্প্রদায়। কীভাবে মুশরিকদের জন্য চুক্তি-অঙ্গীকার থাকবে আল্লাহর কাছে তাঁর রাসূলের কাছে? অবশ্য মসজিদে হারামের কাছে যাদের সাথে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছ তাদের কথা আলাদা। যতক্ষণ তারা তোমাদের জন্য ঠিক থাকে, ততক্ষণ তোমরাও তাদের জন্য ঠিক থাক। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন।’’[1]

এখানে আল্লাহ বলেছেন: ‘‘যখন নিষিদ্ধ মাসগুলো (ঘোষিত মাস) অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর ...’’ অনেক সময় অমুসলিম লেখকগণ এবং কখনো আবেগী মুজাহিদগণ কুরআনের অন্যান্য আয়াত বাদ দিয়ে এবং আয়াতগুলি আগের পরের বক্তব্য বাদ দিয়ে শুধু কথাগুলি উদ্ধৃত করে দাবি করেন যে, ইসলামে সকল কাফির বা অমুসলিমকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ অন্যান্য আয়াত বাদ দিলেও এখানের আয়াতগুলি খুবই স্পষ্ট। এখানে সুস্পষ্টতই বলা হয়েছে, যে সকল কাফির জনগোষ্ঠীর সাথে- তৎকালীন প্রেক্ষাপটে যে সকল কবীলা বা গ্রাম রাষ্টের সাথে- তোমাদের চুক্তি রয়েছে তাদের মধ্যে যারা চুক্তি ভঙ্গ করে নি তাদের চুক্তি বহাল থাকবে। আর যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে তাদেরকে তোমাদের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিল কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়ে চার মাসের সময় দাও। সময়ের মধ্যে তার যদি দীন গ্রহণ করে বা বশ্যতা গ্রহণ করে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে তবে তাদেরকে নিরাপত্তা দিবে। অন্যান্যদের ক্ষেত্রে ঘোষিত চারমাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করবে। তাদের বাহিনীকে যেখানে পাওয়া যাবে আক্রমন করা হবে এবং হত্যা বা বন্দী করা হবে

এখানে অযোদ্ধা মুশরিকদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয় নি। আয়াতের নির্দেশ পালনে কখনোই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অযোদ্ধা মুশরিকদেরকে পথে প্রান্তরে ধরে হত্যা করতে নির্দেশ দেন নি। এখানে মুশরিকগণ বলতে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়া হলো সে সকল চুক্তিভঙ্গকারী মুশরিক জনগোষ্ঠী বা কবীরা রাষ্ট্রের যোদ্ধাদেরকে বুঝানো হয়েছে। এখানে প্রথমে, শেষে মাঝে বারংবার চুক্তিরক্ষাকারীদের চুক্তি রক্ষা করতে নিরাপত্তাপ্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাকি সকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতর্কিত বা গোপন আক্রমন না করে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে চার মাসের সময় দেওয়া হয়েছে

ঘোষণার উদ্দেশ্য যথাসম্ভব বেশি জিহাদ করে বেশি মুশরিক হত্যা করা নয়, বরং ঘোষণার উদ্দেশ্য জিহাদের প্রয়োজনীয়তা সীমিত করা এবং যত বেশি সম্ভব মানুষকে বাঁচানো। আধুনিক যুগেও আগ্রহী অযোদ্ধাদের সুযোগ দেওয়ার জন্য বা যুদ্ধরত রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীর মনোবল দুর্বল করে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য এরূপ ঘোষণা দেওয়া হয়। যে কোনো আন্তর্জাতিক মানবিক বিচারে যুদ্ধের জন্য এর চেয়ে মানবিক যৌক্তিক ঘোষনা হতে পারে না। আমরা পরে দেখব যে, বাইবেলীয় জিহাদের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো নৈতিকতা রক্ষা করা হয় নি; বরং যে কোনোভাবে প্রতারণার মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব শত্রু হত্যাই সেখানে মূল লক্ষ্য বলে গণ্য করা হয়েছে

এভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের প্রায়োগিক সুন্নাত থেকে আমরা নিশ্চিতরূপে বুঝতে পারি যে, কাফির-মুশরিককে হত্যার নির্দেশের অর্থ যুদ্ধের ময়দানে কাফির যোদ্ধা হত্যা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনোই বিচারে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বা যুদ্ধরতকাফিরছাড়া অন্যদেরকে হত্যা করেন নি। তার রাষ্ট্রে অগণিত কাফির সকল নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস করেছেন। তিনি কখনোই তাদের হত্যা করেন নি বা হত্যার অনুমতি দেন নি। ঈমানের দাবিদার মুনাফিকগণকে তিনি চিনতেন। তাদেরকেও হত্যার অনুমতি তিনি দেন নি। উপরন্তু তিনি অযোদ্ধা সাধারণ অমুসলিম নাগরিককে হত্যা কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক বা অমুসলিম দেশের অমুসলিম
নাগরিককে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের সুগন্ধও লাভ করতে পারবেন না, যদিও জান্নাতের সুগন্ধ ৪০ বৎসরের দুরত্ব থেকে লাভ করা যায়।

আমরা পূর্ববর্তী হাদীসে দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খারিজীদেরকে যখন যেখানে পাওয়া যায় হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। থেকে সাহাবীগণ কখনোই ঢালাওভাবে ‘‘খারিজী’’ মতাবলম্বীদের যেখানে পাওয়া যায় হত্যা করার অনুমতি বুঝেন নি। বরং থেকে তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে খারিজী যোদ্ধাদেরকে হত্যার নির্দেশনা বুঝেছেন। খারিজীগণ অযোদ্ধা সাহাবী-তাবিয়ীগণ বা সাধারণ মুসলিমদের হত্যা করলেও সাহাবীগণ কখনোই যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কোনোভাবে খারিজীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন নি বা তাদেরকে হত্যা করেন নি। সমাজে তারা খারিজীদের সাথেএকত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছেন।[2]

[1] সূরা () তাওবা: - আয়াত
[2]
বিস্তারিত দেখুন, আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ৫৮২

. . . ইসলামের ইতিহাসে জিহাদ সন্ত্রাস

ইসলামের ইতিহাসে আমরা অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখতে পাই, যেগুলি যুদ্ধের ক্ষেত্রে কুরআন হাদীসে উলি­খিত শর্তগুলি পুরোপুরি পূরণ করে না। এগুলি মানবীয় দুর্বলতার ফল। ইসলামের দৃষ্টিতে মূলত এগুলি অবৈধ। তবে কোনো ক্ষেত্রেই যুদ্ধের ময়দানের বাইরে গুপ্ত হত্যা, নির্বিচার হত্যা ইত্যাদিতে উপর্যুক্ত কয়েকটি বিভ্রান্ত দল ছাড়া কেউ জড়িত হন নি। পরবর্তীকালের দুটিজিহাদআমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করে: () ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে (১৮১৮-১৮৩১খৃ) ভারতে বৃটিশ দখলদারদের বিরুদ্ধে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর জিহাদ () আফগান জিহাদ। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী জিহাদের শর্তগুলি পূরণ করেছিলেন। তিনি বৃটিশ সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে ভারতের ইসলামী রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্র রাষ্ট্রপ্রধানের শর্ত পূরণ করেছিলেন। তিনি বৃটিশদেরকে আক্রমণকারী দখলদার বাহিনী হিসেবে গণ্য করে জিহাদের বৈধতা প্রমাণ করেন

আফগান জিহাদও শুরু হয়েছিল প্রায় একইভাবে। সোভিয়েট বাহিনীর আক্রমণ জবরদখলের মুখে আফগান জনগণ আলিমদের নেতৃত্বে জিহাদ শুরু করেছিলেন। সাধারণভাবে মুসলিম বিশ্বে জিহাদ বৈধ জিহাদ বলেই মনে করা হয়। ফলে বিভিন্ন দেশের অনেক মুসলিম যুবক জিহাদে অংশ গ্রহণ করেন। সোভিয়েট বাহিনীর পরাজয়ের পরে জিহাদ আন্তঃদলীয় আন্তঃগোত্রীয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। দীর্ঘদিন যুদ্ধে অভ্যস্ত আফগান জনগণ অস্ত্রের ভাষাতেই কথা বললেন স্বদেশীয় স্বধর্মীয় বিরোধীদের সাথে। প্রত্যেকেই নিজের কাজকে জিহাদ এবং প্রতিপক্ষকে ইসলামের শত্রু বলে দাবি করলেন। বাইরে থেকে আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদগণ স্বভাবতই কোনো না কোনো আফগান পক্ষে থেকে একই কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন। অনেকে আফগান ত্যাগ করে নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এসব যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের অনেকের জন্যঅস্ত্রের ভাষাপরিত্যাগ করা কষ্টকর হয়ে যায়। এদের অধিকাংশই জিহাদের শর্তের চেয়ে জিহাদের ফযীলতের বিষয়েই বেশি জানতেন ভাবতেন। তারা নিজ দেশেওজিহাদীপরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করেন

 . . . বাইবেলীয় জিহাদ বনাম ইসলামের জিহাদ - প্রথম অংশ

উপরে আমরা ইসলামী শরীয়তে জিহাদের পরিচয়, তার উদ্দেশ্য শর্তাবলি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আমরা জানি যে, ইসলাম বিরোধী সকল প্রচারণার মূল দাবি যে, ইসলামই ধর্মের নামে যুদ্ধ বৈধ করেছে। বিশেষত খৃস্টান ধর্মগুরুগণ খৃস্টধর্মকে ‘‘ভালবাসা মানবতার ধর্ম’’ ইসলামকে যুদ্ধ, সহিংসতা সন্ত্রাসের ধর্ম বলে চিত্রিত করেন। ইউরোপে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে সন্ত্রাসী রূপে চিত্রিত করে কার্টুন ছাপা হচ্ছে এবং ‘‘কুরআন’’-কে সন্ত্রাসী গ্রন্থ বলে দাবি করে তা নিষিদ্ধ করতে দাবি জানানো হচ্ছে। ক্যাথলিক খৃস্টান জগতের বর্তমান ধর্মগুরু পোপ ১৬শ বেনিডিক্ট (Benedict XVI) ২০০৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জার্মানির রিগেনসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনায় বাইজানটাইন সম্রাট ম্যানুয়েল- এর ইসলামের প্রতি চরম বিদ্বেষমূলক নিম্নোক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন: "Show me just what Mhuammad brought that was new and there you will find things only evil and inhuman, such as his command to spread by the sword the faith he preached." ‘‘তুমি আমাকে দেখাও তো, মুহাম্মাদ (সাঃ) নতুন কি এনেছেন? তরবারীর মাধ্যমে তার ধর্ম প্রচার করার নির্দেশের মত অমানবিক অশুভ বিষয় ছাড়া আর কিছুই তুমি পাবে না।
মানবতার জন্য মুহাম্মাদ (সাঃ) সত্যিই কী নতুন শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন সে বিষয়ে বাইবেল অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সাথে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর শিক্ষার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে ‘‘কী নতুন নিয়ে এলেন মুহাম্মাদ (সাঃ)’’ নামে একটি গ্রন্থ রচনার একান্ত ইচ্ছা রয়েছে। মহান আল্লাহর কাছে তাওফীক প্রার্থনা করছি। এখানে ‘‘জিহাদ’’ পরিভাষার অপব্যবহার বিষয়ে আলোচনার পূর্বে আমরা জিহাদের বিষয়ে বাইবেলের নির্দেশাবলি পর্যালোচনা করতে চাই, যেন আমরা অন্তত জিহাদ বিষয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ) নতুন কী নিয়ে এসেছিলেন তা আমরা জানতে পারি

এখানে উলে­খ্য যে, ইহূদী-খৃস্টানগণের মধ্যে প্রচলিত বাইবেলের ‘‘ভার্সনগুলির’’ মধ্যে ব্যাপক বৈপরীত্য অমিল রয়েছে। ইহূদী বাইবেলের সাথে খৃস্টান বাইবেলের অমিল রয়েছে। তেমনি ক্যাথলিক খৃস্টানগণের বাইবেলের সাথে প্রটেস্ট্যান্ট খৃস্টানগণের বাইবেলের অমিল রয়েছে। সর্বাবস্থায় আমরা মুসলিমগণ বিশ্বাস করি যে, প্রচলিত বাইবেল কখনোই আল্লাহর কিতাব নয়। এর মধ্যে তাওরাত, যাবূর, ইঞ্জিল ইত্যাদি আসমানী গ্রন্থের কিছু অংশ থাকলেও তা পুরোহিতদের সংযোজন, বিয়োজন বিকৃতির সাথে সংমিশ্রিত হয়ে রয়েছে। যে সকল অমানবিক অশুভ বিষয় রয়েছে তা সবই এরূপ বিকৃত তথ্য।[1] তবে ইহূদী খৃস্টানগণ প্রচলিত বাইবেলকেই তাদের ধর্মগ্রন্থ আসমানী গ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করেন। ইহদীগণ শুধুপুরাতন নিয়মকেই ধর্মগ্রন্থ বলে বিশ্বাস করেন। আর খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, প্রচলিত বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়মের প্রতিটি শব্দ, বাক্য কথাই আল্লাহর বাণী[2] উপরন্তু তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বরের বাণী বা বিধান কখনো রহিত হতে পারে না। কাজেই বাইবেলের পুরাতন নতুন নিয়মের প্রতিটি বাণী বিধান কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য পালনীয় অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ।[3] বাইবেল থেকে জানা যায় যে, জিহাদ বা যুদ্ধের জন্যই যীশুখৃস্ট আগমন করেছিলেন। তিনি বলেন: Think not that I am come to send peace on earth: I came not to send peace, but a sword ‘‘মনে করিও না যে, আমি পৃথিবীতে শান্তি দিতে আসিয়াছি; শান্তি দিতে আসি নাই, কিন্তু খড়্গ দিতে আসিয়াছি।’’[4]

উপরন্তু যীশুখৃস্ট তার রাজত্বের বিরোধীদেরকে তাঁর সামনে জবাই করতে নির্দেশ দিয়ে বলেন: "But those mine enemies, which would not that I should reign over them, bring hither, and slay them before me", ‘‘পরন্তু আমার এই যে শত্রুগণ ইচ্ছা করে নাই যে, আমি তাহাদের উপরে রাজত্ব করি, তাহাদিগকে এই স্থানে আন, আর আমার সাক্ষাতে বধ কর।’’[5] বাইবেলে সুস্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, নেককার সাধু-সন্তুদের মূল কাজ হলো আল্লাহর প্রশংসা করা এবং সর্বদা দু-ধারি তরবারী সাথে নিয়ে কাফির-বিধর্মীদের কতল করা শাস্তি দেওয়া। আর এভাবে কাফির-বিধর্মীদের হত্যা, বন্দী বিচার করাই সাধুদের মূল কর্ম মর্যাদা:
"Let the saints be joyful in glory... Let the high praises of God be in their mouth, and a twoedged sword in their hand; To execute vengeance upon the heathen, and punishments upon the people; To bind their kings with chains, and their nobles with fetters of iron; To execute upon them the judgment written: this honour have all his saints. ‘‘
সাধুগণ গৌরবে উদ্ভাসিত হউক। ... তাহাদের কণ্ঠে ঈশ্বরের উচ্চ প্রশংসা, তাহাদের হস্তে দ্বি-ধার খড়্গ থাকুক; যেন তারা বিধর্মী-কাফিরদের[6] প্রতিফল দেয়, লোকবৃন্দকে শাস্তি দেয়; যেন তাহাদের রাজাগণকে, তাহাদের মান্যগণ্য লোকদিগকে লৌহ-নিগড়ে বদ্ধ করে; যেন তাহাদের বিরুদ্ধে লিখিত বিচার নিষ্পন্ন করে; ইহাই সমস্ত সাধুর মর্যাদা।’’[7]

বাইবেলের বিভিন্ন নির্দেশনা থেকে নারী, শিশু নিরস্ত্র মানুষদেরকে হত্যার ঢালাও অনুমোদন বুঝা যায় যেমন বলা হয়েছে: "Kill every male among the little ones, and kill every woman that hath known man by lying with him. But all the women children, that have not known a man by lying with him, keep alive for yourselves." ‘‘অতএব তোমরা বালক-বালিকাদের মধ্যে সমস্ত বালককে বধ কর, এবং শয়নে পুরুষের পরিচয়প্রাপ্ত সমস্ত স্ত্রীলোককেও বধ কর; কিন্তু যে বালিকারা শয়নে পুরুষের পরিচয় পায় নাই, তাহাদিগকে আপনাদের জন্য জীবিত রাখ।’’[8]

অন্যত্র বলা হয়েছে"And when the LORD the God hath delivered it tnto thine hands, thou shalt smite every male thereof with the edge of the swore; but the women, and the little ones, and the cattle, and all that is in the city, even all the spoil thereof, shalt thou take unto thyself; and thou shalt eat the spoil of thine enemies, which the LORD thy God hath given thee. Thus shalt thou do unto all the cities which are very far from thee, which are not of the cities of these nations. But of the cities of these which the LORD thy God doth give thee for an inheritance, thou shalt save alive nothing that breatheth; but thou shalt utterly destroy them." ‘‘পরে তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তাহা তোমার হস্তগত করিলে তুমি তাহার সমস্ত পুরুষকে খড়্গধারে আঘাত করিবে, কিন্তু স্ত্রীলোক, বালক-বালিকা পশুগণ প্রভৃতি নগরের সর্বস্ব সমস্ত লুটদ্রব্য আপনার জন্য লুট-স্বরূপে গ্রহণ করিবে, আর তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভুর দত্ত শত্রুদের লুট ভোগ করিবে। এই নিকটবর্তী জাতিদের নগর ব্যতিরেকে যে সকল নগর তোমা হইতে অতি দূরে আছে, তাহাদেরই প্রতি এইরূপ করিবে। কিন্তু এই জাতিদের যে সকল নগর তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু অধিকারার্থে তোমাকে দিবেন, সেই সকলের মধ্যে শ্বাসবিশিষ্ট কাহাকেও জীবিত রাখিবে না।’’[9]

এরূপ অনেক নির্দেশ রয়েছে যা বাহ্যত অমানবিক গণহত্যার নির্দেশ বলে মনে হবে। যুদ্ধের সম্ভাবনা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। রাষ্ট্র থাকলেই যুদ্ধের সম্ভাবনা স্বীকার করতে হবে এবং যুদ্ধের জন্য নিয়ম, আইন বিধান রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্র বা নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষা করতে অনেক সময় রাষ্ট্রকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। কিন্তু সকল শান্তিকামী মানুষই চেষ্টা করেন যুদ্ধকে যথাসম্ভব কম ধ্বংসাত্মক করতে এবং অযোদ্ধ মানুষদেরকে হত্যা না করতে। অযোদ্ধা মানুষদেরকে হত্যা করা বর্তমানেযুদ্ধ অপরাধবলে গণ্য। অথচ বাইবেলে এরূপই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু অযোদ্ধা মানুষই নয়, উপরন্তু গরু, ছাগল, উট, ভেড়া ইত্যাদি অবলা প্রাণীও নির্বিচারে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করতে নির্দেশ দিয়েছে বাইবেল। বিধর্মী বা অন্য দেবতার উপাসকদের হত্যা করার ঢালাও নির্দেশ দিয়ে বাইবেলে বলা হয়েছে: "He that sacrificeth unto any god, save unto the LORD only, he shall be utterly destroyed" ‘‘যে ব্যক্তি কেবল সদাপ্রভু ব্যতিরেকে কোন দেবতার কাছে বলিদান করে, সে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হইবে।’’[10]

ঈশ্বরের নির্দেশের সামান্য বিরোধিতা করলেই মৃত্যুদন্ড "Thou shalt not suffer a witch to live. Whosoever lieth with a beast shall surely be put to death". ‘‘তুমি মায়াবিনীকে জীবিত রাখিও না। পশুর সহিত শৃঙ্গারকারী ব্যক্তির প্রাণদন্ড অবশ্য হইবে।’’[11]
বিধর্মীর্দের ধর্মালয় ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছেঃ "Thou shalt not bow down to their gods, nor serve them, nor do after their works: but thou shalt utterly overthrow them, and quite break down their images." "But ye shall destroy their altars, break their images, and cut down their groves". ‘‘তুমি তাহাদের দেবগণের কাছে প্রণিপাত করিও না, এবং তাহাদের সেবা করিও না তাহাদের ক্রিয়ার ন্যায় ক্রিয়া করিও না; কিন্তু তাহাদিগকে সমূলে উৎপাটন করিও, এবং তাহাদের স্তম্ভ সকল ভাঙ্গিয়া ফেলিও।’’[12] ‘‘কিন্তু তোমরা তাহাদের বেদি সকল ভাঙ্গিয়া ফেলিবে, তাহাদের স্তম্ভ সকল খন্ড খন্ড করিবে, তথাকার আশেরা-মূর্তি সকল কাটিয়া ফেলিবে।’’[13]

বাইবেল থেকে জানা যায় যে, নির্বিচার গণহত্যার উপর্যুক্ত নির্দেশাবলি সুন্দরভাবে পালন করেছেন বাইবেলীয় ভাববাদীগণ। আমরা মুসলিমগণ কখনোই বিশ্বাস করি না যে, কোনো ভাববাদী (নবী) এরূপ গণহত্যা করতে পারেন। তবে বাইবেল তাদের বিষয়ে এরূপই লিখেছে এবং ইহূদী-খৃস্টানগণ এরূপই বিশ্বাস করেন। বস্ত্তত, লক্ষ-লক্ষ মানব সন্তানকে নির্বিচারের হত্যার অগণিত কাহিনীর সমন্বয় বাইবেল। পবিত্র ভাববাদীগণ, মহাযাজকগণ বা বিচারকর্তৃগন কিভাবে যুদ্ধ, ছলচাতুরি বা প্রবঞ্চনার মাধ্যমে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছেন তার অগণিত বিবরণ বাইবেলে রয়েছে। অযোদ্ধা যুদ্ধবন্দী নারী, পুরুষ শিশুদের নির্বিচারে গণহারে হত্যার বিষয়ে তাঁদের আগ্রহ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এছাড়া নিরীহ যুদ্ধবন্দীদের কত বেশি কষ্ট দিয়ে হত্যা করা যায় সে বিষয়েও তাদের আগ্রহ লক্ষণীয়। লোহার মইয়ের নিচে রেখে, লোহার কুড়ালির নিচে রেখে এবং ইটের পাঁজার মধ্যে ঢুকিয়ে বা অনুরূপভাবে বর্ণনাতীত যন্ত্রণা দিয়ে নিরস্ত্র মানুষদেরকে হত্যার কাহিনী বাইবেলে প্রচুর। এরূপ কর্মের জন্য ‘‘ভাববাদিগণকে’’ বাইবেলে বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয়েছে
যদি কেউ কষ্ট করে বাইবেলে যিহোশূয়ের পুস্তক (Joshua) বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ (Judges), শমুয়েলের পুস্তক (Samuel), রাজাবলি (The Kings), বংশাবলি (The Chronicles) ইত্যাদি গ্রন্থ পাঠ করেন তবে বর্বর গণহত্যা, কল্পনাতীত নিপীড়ন, উন্মাদ ধ্বংসযজ্ঞের লোমহর্ষক ঘটনাবলি দেখবেন। এগুলি পাঠ করলে একজন সাধারণ পাঠক অনুভব করবেন যে, বাইবেলের নির্দেশ অনুসাসের যুদ্ধ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য নয়, এমনকি অন্যের দেশ দখলের জন্যও যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ মূলত হত্যা ধ্বংসের মাধ্যমে আনন্দলাভের জন্য। বাইবেলের নতুন নিয়মেও সকল কর্মের জন্য ভাববাদীগণকে বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয়েছে।[14]
আমরা বলেছি যে, রাষ্ট্র থাকলেই যুদ্ধের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে যুদ্ধকে যথাসম্ভব কম ধ্বংসাত্মক করতে হবে এবং সকল অযোদ্ধা মানুষ, দ্রব্য বস্ত্তকে যুদ্ধের আওতা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ইসলামে কাজটিই সর্বোত্তমভাবে করা হয়েছে। তাত্বিকভাবে যেমন, তেমনি প্রায়োগিকভাবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব কম প্রাণহানি ঘটাতে। শুধু সত্য ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য বাধ্য হয়ে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং তার সারাজীবনের সকল যুদ্ধে মুসলিম কাফির মিলে সর্বমোট প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। যে দেশে প্রতি মাসেই শতশত মানুষ মারামারি করে খুন হতো, সে দেশে মাত্র সহস্র মানুষের জীবনের বিনিময়ে সকল আগ্রাসন রোধ করে তিনি বিশ্বব্যাপী চিরস্থায়ী শান্তির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পক্ষান্তরে বাইবেলের একেক যুদ্ধেই হাজার হাজার ‘‘কাফির’’ হত্যার গৌরবময় বিবরণ লেখা হয়েছে। মহাভারত, গীতা বা রামায়ণের যুদ্ধেরও কাছাকাছি অবস্থা

সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় যে, বাইবেলে যুদ্ধ, হত্যা প্রতিশোধের ক্ষেত্রে কোনোরূপ নীতি নৈতিকার প্রতি লক্ষ রাখা হয় নি। ইসলামে যুদ্ধের জন্য গোপনীয়তা শত্রুপক্ষকে বোকা বানানোর জন্য কৌশল অবলম্বন বৈধ করেছে। কিন্তু চুক্তিভঙ্গ করা, প্রবঞ্চনা করা, নিরস্ত্রকে আক্রমন করা, অযোদ্ধা লক্ষ্যবস্ত্ততে আঘাত করা, আহতদের হত্যা করা, মৃতদেহ অপমান করা ইত্যাদি কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এরূপ সকল কর্মই বাইবেলীয় জিহাদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই। বিধর্মী বিজাতীয়দের সাথে ইহূদীদের যুদ্ধ, ইহূদীদের সাথে ইহূদীদের যুদ্ধ, ইস্রায়েল রাজ্যের ইহূদীদের সাথে জুডাই রাজ্যের ইহূদীদের যুদ্ধ, একই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই আমরা চুক্তিভঙ্গ, মিথ্যাচার, অযোদ্ধাদেরকে হত্যা, মৃতদেহের অবমাননা ইত্যাদি অগণিত বিষয় দেখতে পাই। বাইবেলে সকল বিষয় অত্যন্ত গৌরবের সাথে প্রশংসনীয় কর্ম হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে

সম্ভবত এজন্যই ইস্রায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক শামির ১৯৪৮ সালে তার পরিচালিত সন্ত্রাসী বাহিনীদি স্টার্ন গ্যাং’’ কর্তৃক জেরুজালেমে জাতিসংঘ মধ্যস্থতাকারী কাউন্ট বার্ণাডোটকে গোপনে হত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন: ‘‘ইহূদী নৈতিকতা ইহূদী ঐতিহ্য কোনটিই সন্ত্রাসকে রণনীতির পরিপন্থী মনে করে না। জাতীয় সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ততার মূহূতে আমরা নৈতিক দ্বিধাগ্রস্ততা বহু দূরে ছুঁড়ে ফেলে রাখি। সর্বাগ্রে, আমাদের জন্য সন্ত্রাস হল রাজনৈতকি যুদ্ধের অংশ যা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই যথার্থ।’’[15]

এখানে লক্ষণীয় যে, ইহূদী নৈতিকতার আর খৃস্টান নৈতিকতা একই হওয়ার কথা; কারণ তাদের নৈতিকার ভিত্তি ধর্মগ্রন্থ এক। খৃস্টান পাদরি-প্রচারকগণ অনেক সময় মুসলিমদেরকে বলেন যে, যুদ্ধ, গণহত্যা বিধর্মী হত্যার উপর্যুক্ত নির্দেশাবলি বাইবেলের পুরাতন নিয়মের কথা বা তাওরাতের কথা, ইঞ্জিলের কথা নয়। আমরা আগেই বলেছি যে, খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, পুরাতন নতুন নিয়মের প্রতিটি শব্দই আল্লাহর বাণী এবং কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য পালনীয়। তাঁরা আরো বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর কোনো নির্দেশ বা বাণী কখনো ‘‘নসখ’’ বা রহিত হতে পারে না। সর্বোপরি স্বয়ং যীশু খৃস্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে পুরাতন নিয়মের সকল নির্দেশ চিরন্তন, অপবির্তনীয় অলঙ্ঘনীয় ঐশ্বরিক নির্দেশ যা কিয়ামত পর্যন্ত সকল খৃস্টানের জন্য পালনীয় এবং এগুলি পালন না করলে কেউ পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারবে না। তিনি বলেন "For verily I say unto you, Till heaven and earth pass, one jot or one tittle shall in no wise pass from the law, till all be fulfilled. Whosoever therefore shall break one of these least commandments, and shall teach men so, he shall be called the least in the kingdom of heaven: but whosoever shall do and teach them, the same shall be called great in the kingdom of heaven". ‘‘আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, যে পর্যনত আকাশ পৃথিবী লুপ্ত না হইবে, সেই পর্যনত ব্যবস্থার (তাওরাত বা পুরাতন নিয়মের বিধিবিধান) এক মাত্রা কি এক বিন্দুও লুপ্ত হইবে না, সমস্তই সফল হইবে। অতএব যে কেহ এই সকল ক্ষুদ্রতম আজ্ঞার মধ্যে কোন একটি আজ্ঞা লঙ্ঘন করে, লোকদিগকে সেইরূপ শিক্ষা দেয়, তাহাকে স্বর্গরাজ্যে অতি ক্ষুদ্র বলা যাইবে; কিন্তু যে কেহ সেই সকল পালন করে শিক্ষা দেয়, তাহাকে স্বর্গ-রাজ্যে মহান বলা যাইবে।’’[16] এছাড়া আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, বাইবেলের নতুন নিয়মেও যীশু তাঁর রাজত্বের প্রতি অনীহা পোষণকারীদের তার সামনে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, তরবারী বা যুদ্ধের জন্যই তাঁর আগমন
বাইবেলে অন্য ধর্ম বা বর্ণের মানুষদেরকে শূকর, কুকুর ইত্যাদি বলে গালি দেওয়া হয়েছে। -ইস্রায়েলীয়দেরকে কুকুর শূকর আখ্যায়িত করে তাদেরকে খৃস্টান ধর্মের দীক্ষা দিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যীশু বলেন: "Give not that which is holy unto the dogs, neither cast ye your pearls before swine...", ‘‘পবিত্র বস্ত্ত কুকুরদিগকে দিও না, এবং তোমাদের মুক্তা শূকরদের সম্মুখে ফেলিও না’’[17]

-ইস্রায়েলীয়দেরকে কুকুর আখ্যায়িত করে তাদের জন্য দুআ করতে বা তাদেরকে ঝাড়-ফুঁক দিতেও আপত্তি করেন যীশু খৃস্ট। মথি তাঁর সুসমাচারে লিখেছেন: "And, behold, a woman of Canaan came out of the same coasts, and cried unto him, saying, Have mercy on me, O Lord, thou Son of David; my daughter is grievously vexed with a devil. But he answered her not a word. And his disciples came and besought him, saying, Send her away; for she crieth after us. But he answered and said, I am not sent but unto the lost sheep of the house of Israel. Then came she and worshipped him, saying, Lord, help me. But he answered and said, It is not meet to take the children's bread, and to cast it to dogs."
‘‘
আর দেখ, অঞ্চলের এক জন কনানীয় স্ত্রীলোক আসিয়া এই বলিয়া চেঁচাইতে লাগিল, হে প্রভু, দায়ূদ-সনতান, আমার প্রতি দয়া করুন, আমার কন্যাটি ভূতগ্রস্ত হইয়া অত্যন্ত ক্লেশ পাইতেছে। কিন্তু তিনি তাহাকে কিছুই উত্তর দিলেন না। তখন তাঁহার শিষ্যেরা নিকটে আসিয়া তাঁহাকে নিবেদন করিলেন, ইহাকে বিদায় করুন, কেননা আমাদের পিছনে পিছনে চেঁচাইতেছে। তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, ইস্রায়েল-কুলের হারান মেষ ছাড়া আর কাহারও নিকটে আমি প্রেরিত হই নাই। কিন্তু স্ত্রীলোকটি আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল, প্রভু, আমার উপকার করুন। তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, সনতানদের খাদ্য লইয়া কুকুরদের কাছে ফেলিয়া দেওয়া ভাল নয়।’’[18]

[1] বিস্তারিত জানতে আল্লামা রাহমাতুল্লাহ রচিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিতইযহারুল হক্কগ্রন্থটি পাঠ করুন
[2] Ahmed Deedat, The Choice (Jeddah, Abul Qasim Publications, 1st print, 1994), Vol-2, p73-74.
[3] Carl Gottaleb Pfander, Balance of Truth (The Mizanul Haqq), Part-1 (The Good way, Rikon, Switzerland), p 17.
[4]
বাইবেল, মথি ১০/৩৪
[5]
লুক ১৯/২৭
[6]
এখানে ইংরেজীতে (heathen) বলা হয়েছে, যার অর্থ বিধর্মী বা কাফির এভাবে এখানে কাফির হত্যার ঢালাও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু বাংলা অনুবাদে বিষয়টিকে অস্পষ্ট করার জন্য heathen অর্থজাতিগনকেলেখা হয়েছে
[7]
গীতসংহিতা ১৪৯/-
[8]
গননা পুস্তক ৩১/১৭-১৮
[9]
দ্বিতীয় বিবরণ ২০/১৩-১৬
[10]
যাত্রাপুস্তক ২২/২০
[11]
যাত্রাপুস্তক ২২/১৮-১৯
[12]
যাত্রাপুস্তক ২৩/২৩-২৪
[13]
যাত্রাপুস্তক ৩৪/১২-১৩
[14]
নতুন নিয়ম, ইব্রীয় ১১/৩২-৩৪
[15]
আজহারুল ইসলাম, নিন্দিত বিশ্ব নন্দিত গন্তব্য, পৃ. ৫৯, from an August 1943 article tittled ‘Terror’ written by Yitzhak Shamir for Hazit the journal of Lehi.
[16]
মথি /১৮-২০
[17]
মথি /
[18]
মথি ১৫/২১-২৬

 . . . বাইবেলীয় জিহাদ বনাম ইসলামের জিহাদ - দ্বিতীয়/শেষ অংশ

প্রথম দৃষ্টিতেই যে কোনো পাঠকের কাছে কথাগুলি খুবই আপত্তিকর মনে হবে। জন্ম, বংশ বা ধর্মের কারণে মানুষকে কুকুর বলে অভিহিত করা! শুধুমাত্র বংশ বা ধর্মের কারণে তাকে মানবিক সাহায্য করতে অস্বীকার করা!! একজন খৃস্টধর্ম বিরোধী পাঠক দাবি করতে পারেন যে, বক্তব্য দ্বারা জাতিগত বৈষম্য জাতিগত বিদ্বেষ চিরস্থায়ী করা হয়েছে। তিনি দাবি করতে পারেন যে, বাইবেলের উপর্যুক্ত সকল গণহত্যা ধ্বংসযজ্ঞের মূল দর্শন যীশুর কথার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কেউ দাবীও করতে পারেন যে, বর্তমান যুগে ফিলিস্তিন, ইরাক অন্যান্য দেশে গণহতা ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়ে পোপ কোনো প্রতিবাদ না করে ইসলামের নবীর সমালোচনা করছেন এর কারণও কুকুরদর্শন। যে দর্শনের মূল হলো, ইহূদীখৃস্টানগণ ঈশ্বরের সন্তান। অন্য সকল মানুষ কুকুরের মতই মানবেতর প্রাণী। কুকুরকে যেমন পচা বা ছেড়া রুটির টুকরো ছুড়ে দেওয়া যায়, তেমনি এদেরকে মাঝে মাঝে কিছু সাহায্য করা যেতে পারে। কিন্তু ঈশ্বরের সন্তানদের স্বার্থের ক্ষতি করে তাদের কোনো উপকার করা যাবে না। যদি ঈশ্বরের সন্তানদের স্বার্থের ক্ষতি হয় তবে লক্ষকোটি সারমেয় সন্তানকে নির্বিচারে হত্যা করতে কোনো অসুবিধা নেই। এছাড়া ঈশ্বরের সন্তানগণ যদি কিছুটা আনন্দ তৃপ্তি লাভের জন্য দুচার হাজার বা দুচার লক্ষ সারমেয় সন্তানকে হত্যা করে ফেলেন তাতেও অসুবিধা কী?

বাইবেলে অন্যধর্মের অনুসারীদের ঠান্ডামাথায় হত্যার নির্দেশনা, এমনকি প্রতারণামূলকভাবে ডেকে এনে হত্যা করার নির্দেশনা রয়েছে। একটি ঘটনা দেখুন। ইহূদীদের প্রাচীন রাষ্ট্র ‘‘ইসরায়েলের’’ কিছু নাগরিক ‘‘বাল’’ দেবতার উপাসনা করত। ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র ইস্রায়েলের সম্রাট যেহূ (Jehu, the son of Jehoshaphat) ঈশ্বরের সঠিক ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ‘‘বাল’’ দেবতার উপাসকদের ঠান্ডা মাথায় গণহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, সম্রাট যেহূ বাল দেবতার সেবা করবেন। জন্য তিনি বাল দেবতার উপাসকদের এক মহা- সমাবেশের আয়োজন করেন। সেখানে তিনি দেবতার উদ্দেশ্যে ভেট উৎসর্গের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গোপনে উৎসবকেন্দ্র মন্দিরের চারিপাশে সেনাবাহিনী নিয়োগ করে উৎসবরত সকল ‘‘বিধর্মী’’-কে তরবারীর আঘাতে হত্যা করতে নির্দেশ দেন। এমনকি তিনি তাঁর সৈন্যদের বলেন, যদি একজন বিধর্মীও জীবন নিয়ে পালায় তবে তার বিনিময়ে একজন সৈন্য হত্যা করা হবে। এভাবে হাজার হাজার নিরীহ নিরস্ত্র নারী-পুরুষকে কেবলমাত্র ধর্মীয় বিরোধিতার কারণে কোনোরূপ সুযোগ না দিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেন।[1]

অন্য ঘটনায় বাইবেলীয় নবী এলিজাহ (Prophet Elijah) বাল দেবতার ৪৫০ জন উপাসককে ধরে ঠান্ডা মাথায় জবাই করেন। [2] সকল ঘটনা থেকে খৃস্টান পোপ, পাদরী বিশপগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, খৃস্টান দেশে বসবাস রত সকল অখৃস্টান নাগরিক এবং ভিন্নমতাবলম্বী খৃস্টানদেরকে হত্যা নির্মূল করা তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব অধিকার। প্রসিদ্ধ আরব প্রটেস্ট্যান্ট পাদরি আইজাক বাদারকান ১৮৪৯ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত তার লেখা ‘‘পুস্তিকা ত্রয়োদশ’’ গ্রন্থে লিখেছেন: রোম থেকে আরবী ভাষায় প্রকাশিত বাইবেল ইনডেক্সের ‘‘হা’’ অক্ষরের মধ্যে ‘‘হারতাকা’’ (heresy) বিষয়ে লেখা হয়েছে: ‘‘ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী বা বিদআতী ফিরকার (heretics) বিষয়ে আমাদের দায়িত্ব হলো তাদের নির্মূল নিশ্চিহ্ন করা; কারণ সম্রাট যেহূ প্রতারণার মাধ্যমে বাল দেবতার অনুসারীদের জমায়েত করে হত্যা করেছেনা এবং নবী এলিজাহ বাল দেবতার অনুসারীদের জবাই করেছেন। এথেকে প্রমাণিত হয় যে, বিধর্মীদের এভাবে হত্যা নির্মূল করা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব

খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বরের পবিত্র আত্মার প্রেরণায় ‘‘পোপ’’ নিষ্পাপ, নির্ভুল অভ্রান্ত (infallible) তাঁর সিদ্ধান্তই ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত। আর এরূপ অভ্রান্ত পোপগণের নেতৃত্বে খৃস্টধর্ম খৃস্টীয় চার্চ বিধর্মী নির্মূলের মহান দায়িত্ব সর্বোত্তমভাবেই পালন করেছেন। ৩২৫ খৃস্টাব্দে বাইজান্টাইন সম্রাট কন্সাটনাইন (Constantine) খৃস্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করেন। সেদিন থেকে প্রায় দেড় হাজার বৎসর পর্যন্ত খৃস্টধর্মের ইতিহাস ধর্মীয় সহিংসতা, হত্যা, অত্যাচার জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ইতিহাস। ‘‘শূন্য সহনশীলতা’’ (Zero tolerance) প্রদর্শন করে কঠোর বর্বরতার সাথে খৃস্টান চার্চ সকল বিধর্মী ভিন্নমতাবলম্বীকে নির্মূল করেছে। আর এজন্যই নোবেল বিজয়ী প্রসিদ্ধ দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell: 1872-1970) বলেন: "You find as you look around the world that every single bit of progress in human feeling, every improvement in the criminal law, every step towards the diminution of war, every step towards better treatment of coloured races, or every mitigation of slavery, every moral progress that there has been in the world, has been consistently opposed by the organized Churches of the world. I say quite deliberately that the Christian religion, as organized in the churches, has been and still is the principal enemy of moral progress in the world.

‘‘
বিশ্বের চারিদিকে তাকালে আপনি দেখবেন যে, বিশ্বের যেখানেই মানবীয় অনুভবের যে কোনো ক্ষুদ্রতম অগ্রগতি, অপরাধআইনের যে কোনো উন্নয়ন, যুদ্ধ হ্রাসে যে কোনো পদক্ষেপ, কাল বা -সাদা বর্ণের মানুষদের সাথে উন্নততর আচরণের ক্ষেত্রে যে কোনো পদক্ষেপ, দাসপ্রথা বিলুপ্তির যে কোনো প্রচেষ্টা এবং নৈতিক উন্নয়ন যে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তারই বিরোধিতা করেছে খৃস্টীয় চার্চ নিরবিচ্ছিন্নভাবে। আমি পরিপূর্ণ সতর্কতা সুচিন্তিতভাবে বলছি যে, চার্চ পরিচালিত খৃস্টধর্মই বিশ্বের নৈতিক উন্নয়নের প্রধান শত্রু ছিল এবং এখনো আছে।’’[3]

Vlasis Rassias
নামক একজন গবেষক (Demolish Them) নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেছেন গ্রীক ভাষায় ২০০০ খৃস্টাব্দে (ISBN 960-7748-20-4) পুস্তকে খৃস্টধর্মের সহিংসতার অনেক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সকল সহিংসতার তালিকায় রয়েছে:
Emperor Constantine began a centuries-long run of torture, destruction and extermination of all things not Christian like eradicating ancient Greek temples and stealing their treasures. Subsequent Roman Emperors in Constantinople executed everyone that did not accept the new Christian faith. Then libraries were burned and all contrary teachings outlawed....
For another thousand years, the primary occupation of state-sanctioned Christians was to exterminate those who would not accept the documents constructed into a Bible at the Council of Nicea. In 1493, Spanish monarchs Ferdinand and Isabella issued an edict demanding death for all those who would not accept 'the true faith'. Christopher Columbus and others began slaughtering natives of the Western Hemisphere by the millions, not because the would not accept the faith, but because they could not understand the question, because they could not speak Spanish!"


‘‘
খৃস্টান বিশ্বাসের পরিপন্থী সকল কিছুর বিরুদ্ধে সম্রাট কনস্টান্টাইন এক নিপীড়ন, ধ্বংসযজ্ঞ নির্মূল অভিযানের শুরু করেন যা শতাব্দীর পর শতাব্দী স্থায়ী হয়। যেমন প্রাচীন গ্রীক মন্দিরগুলি ধ্বংস করা হয় এবং সেগুলির ভান্ডার লুণ্ঠন করা হয়। নতুন খৃস্টীয় ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করতে রাজি নয় এমন সকলকে নির্মূল করেন কন্সটান্টিনোপলের পরবর্তী রোমান শাসকগণ। এরপর লাইব্রেরীগুলি পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং খৃস্টীয় বিশ্বাসের বিপরীত সকল কিছু নিষিদ্ধ করা হয়। ...নিকীয়া কাউন্সিলে যে বাইবেল তৈরি করা হয় সে বাইবেল যারা মানে না তাদেরকে নির্মূল করাই ছিল পরবর্তী হাজার বৎসর যাবৎ রাষ্ট্র পরিচালিত খৃস্টানগণের মূল কর্ম

১৪৯৩ খৃস্টাব্দে স্পেনের সম্রাট ফার্ডিনান্ড রাণী ইসাবেলা এক আদেশ জারি করেন যে, যারাসঠিক ধর্ম বিশ্বাস’ (খৃস্টধর্ম) গ্রহণ করবে না তাদেরকে হত্যা করতে হবে। ( আজ্ঞার ভিত্তিতে) ক্রিস্টোফার কলম্বাস অন্যান্যরা আমেরিকায় যেয়ে সেখানকার মিলিয়ন মিলিয়ন বাসিন্দাকে (রেড ইন্ডিয়ান) হত্যা করেন। খৃস্টধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করার কারণে তারা তাদেরকে হত্যা করেন নি। বরং স্প্যানিশ ভাষা না জানায় তারা খৃস্টধর্মের বিশ্বাস বুঝতে পারছিল না। অপরাধে তারা তাদেরকে হত্যা করেন।’’[4]

শুধু মুসলিম, ইহূদী বা অখৃস্টানদের বিরুদ্ধেই নয়, ভিন্নমতাবলম্বী খৃস্টানদের বিরুদ্ধেও ক্রসেড চালিয়েছেন খৃস্টান ধর্মগুরু পোপগণ এবং একেক যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছেন। আপনারা যে কোনো এনসাইক্লোপীডিয়াতে ক্রুসেড (Crusade), এ্যালবিজেনসিয়ান ক্রুসেড (the Albigensian Crusade), সেন্ট বার্থলমিউস দিবসের গণহত্যা (Massacre of Saint Bartholomew's Day), ইনকুইজিশন (Inquisition), ধর্মের যুদ্ধ (The Wars of Religion), ইহূদী বিরোধিতা (Anti-Semitism) ইত্যাদি আর্টির্কেল পড়লেই অনেক তথ্য জানতে পারবেন। যদিও আধুনিক গ্রন্থগুলিতে বিষয়গুলিকে খুবই হালকা করা হয়, নিহতদের সংখ্যা কম করা হয় এবং ‘‘ধর্ম’’ ‘‘চার্চ’’-কে বাঁচিয়ে অন্যদের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়। তারপরও যেটুক সত্য দেখবেন তাতেই গায়ের লোম শিউরে উঠবে! একেক যুদ্ধ বা হত্যাকান্ডে ১০/২০ হাজার থেকে লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কখনো যুদ্ধ করে এবং কখনো যুদ্ধ ছাড়াই অতর্কিত হামলা চালিয়ে

হলো ইহূদী-খৃস্টানদের একেকটি ধর্মযুদ্ধের বা ধর্মীয় হত্যাকান্ডের অবস্থা। সকল বর্বরতা কখনো খৃস্টান সম্রাটশাসকগণের নেতৃত্বে ঘটেছে এবং পোপগণ তা সমর্থন করেছেন। কখনো স্বয়ং পোপের নেতৃত্বে এরূপ বর্বর নিধনযজ্ঞ শুরু হয়েছে। বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য আমি পাঠককে আমার লেখা (Jihad of the Holy Bible and Jihad of Muhammad (সাঃ)) গ্রন্থটি পাঠ করতে অনুরোধ করছি
আধুনিক যুগের ধর্মনিরপেক্ষ (!) উদার (!) খৃস্টান বুদ্ধিজীবি রাজনৈতিক নেতাদের কথবার্তার মধ্যেও আমরা উপরের মানসিকতার ছায়া দেখতে পাই। আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জন্য আল-কায়েদাকে দায়ী করা হলেও এখন পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসন নিজের দেশের আদালতেও তা প্রমাণ করতে পারেন নি। তা সত্ত্বেও ‘‘আল-কায়েদার’’ অপরাধের জন্য সকল মুসলিম দেশ দখল করে নেতাদের হত্যা মুসলমানদের জোরপূর্বক খৃস্টান বানানোর দাবিদাওয়া জানাচ্ছেন তাদের অনেকেই। বিষয়ে প্রসিদ্ধ মার্কিন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ সমাজসেবী কলামিস্ট অ্যান কাল্টার (Ann Coulter) -এর বক্তব্য আমরা ইতোপূর্বে উদ্ধৃত করেছি

দ্যা সেভেইজ ন্যাশনসনামক রেডিও শোতে (১২ মে ২০০৩) প্রচারিত মাইকেল সেভেইজের মতামত পশ্চিমা দেশে বিশেষ করে আমেরিকায় প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করা হয়। তিনি তার শোতে বলেন: ‘‘আমার মনে হয় এই লোকগুলোকে (আরব মুসলমানদেরকে) জোর করে খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা উচিত। শুধুমাত্র এভাবেই সম্ভবত তাদেরকে মানুষে পরিণত করা যাবে।’’[5] এভাবে আরো অনেক প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য উদার, পরমতসহিষ্ণু ধর্মনিরপেক্ষ (?!) রাজনীতিবিদ, ধর্মপ্রচারক গবেষক মুসলমানদেরকে জোরপূর্বক খৃস্টধর্মে দীক্ষিত করার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছেন! আরেক মার্কিন সিনেটর দাবি করলেন যে, আমেরিকায় যে কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে বুঝতে হবে যে, তা মুসলিমগণ করেছে এবং কোনো প্রমাণ ছাড়ায় সঙ্গে সঙ্গে প্রতিশোধ হিসেবে মুসলিমদের পবিত্র স্থান মক্কা মদীনা ধ্বংস করে দিতে হবে। আর এধরনের বুদ্ধিজীবি রাজনীতিবিদগণ ক্রমান্বয়ে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব লাভ করছেন

অথচ মুসলিম মানস এমনভাবেই তৈরি যে, সে কখনোই অন্য মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার বা কাউকে জোর পূর্বক ধর্মান্তরিত করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। আমরা দেখছি যে, সবচেয়ে সহিংস মুসলিম সন্ত্রাসীও অন্যের ধর্মকে অবমাননা করার চেষ্টা করছে না বা অন্য ধর্মের মানুষকে জবরদস্তিকরে মুসলিম বানানোর আহবান করছে না। সুসভ্য, মানবতাবাদী যুক্তিবাদীধর্মনিরপেক্ষখৃস্টানগণ মুসলিমদের পবিত্র কুরআনকে অপবিত্র করেছে। মানবতাবাদী ভালবাসার প্রচারক (?!) খৃস্টান পাদরিগণ কুরআনকে টয়লেটে নিক্ষেপ করার দাবি সম্বলিত ফলক চার্চের সামনে টানিয়ে রাখছেন।[6] তারা মুসলিমদের পবিত্র নবীকে (সাঃ) নিয়ে ঘৃণ্য কার্টুন তৈরি করেছে

সারা বিশ্বের মুসলিমগণ ঘৃণ্য বর্বরতার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁরা মার্কিন বা ডেনিশ পতাকায় অথবা সব দেশের রাজনীতিবিদদের কুশপুত্তলিকায় অগ্নিসংযোগ করেছেন। কিন্তু কখনোই কোনো মুসলিম খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থের অবমাননা করেন নি। বাজার থেকে একটি বাইবেল কিনে তাতে পেশাব করেন নি বা তাতে অগ্নি সংযোগ করেন নি বা যীশু খৃস্টের অবমাননাকর কার্টুন প্রচার করেন নি। পাশ্চাত্যের সুসভ্য ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের দৃষ্টিতে একেবারে অশিক্ষিত, অসভ্য উগ্র কোনো মোল্লাও কখনো খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থকে অপবিত্র করতে বা যীশু নামে কার্টুন তৈরি করতে আহবান করেন নি। পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী উগ্র মৌলবাদীদের একজনকেও আমরা দেখছি না যে, সে খৃস্টানদেরকে জোরপূর্বক মুসলিম বানানোর জন্য আহবান জানাচ্ছে। তারা হয়ত মি. বুশকে হত্যার আহবান করছে। কিন্তু তা তার খৃস্টান হওয়ার কারণে নয়, আমেরিকান হওয়ার কারণে নয় বা গণতন্ত্র মানবাধিকারের সেবক হওয়ার কারণে নয়, বরং তাকে আগ্রাসক, জালিম হত্যাকারী বলে মনে করার কারণে। একই কারণে তারা হয়ত আমেরিকা বা ইস্রাইলের ধ্বংসের জন্য আহবান করছে। কিন্তু কখনোই তারা কোনো ইহূদী বা খৃস্টানকে জোরপূর্বক মুসলিম বানানোর জন্য আহবান করছে না

[1] The Holy Bible, 2 Kings 10/18-28
[2] The Holy Bible, 1 kings 18:40
[3] Bertrand Russell, Why I am not a Christian, pp 20-21, quatted from Dr. Abdul Hamid Qadri, Dimensions of Christianity, pp 40-41.
[4] Nasrine R Karim, War on Terror: What is it? The Independent, Dhaka, 20/02/2009.
[5]
আজহারুল ইসলাম, নিন্দিত বিশ্ব, পৃ. ১২৩-১২৪
[6]
আজহারুল ইসলাম, নিন্দিত বিশ্ব, পৃ. ১২৪

 . . জিহাদ বিষয়ক বিভ্রান্তি - (. . . জিহাদ শব্দের অতি-ব্যবহার)

খারিজী, বাতিনী অন্যান্যদের ভুলভ্রান্তির একটি মৌলিক বিষয় জিহাদ। জিহাদ বিষয়ক ভুলভ্রান্তিগুলির কয়েকটি দিক রয়েছে:

. . . জিহাদ শব্দের অতি-ব্যবহার
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, জিহাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রচেষ্টা বা সংগ্রাম। আর ইসলামী শরীয়তের পারিভাষায় জিহাদ অর্থ ‘‘কিতাল’’ বা রাষ্ট্র ইসলামী দাওয়াতের নিরাপত্তার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ। আল্লাহর নির্দেশ হুকুম-আহকাম পালনের সকল প্রচেষ্টাকেই শাব্দিক অর্থে জিহাদ বলা যায়, কিন্তু আভিধানিক অর্থের অতিব্যবহার পারিভাষিক অর্থের বিকৃতির সুযোগ করে দেয়। যেমনসালাত’-এর আভিধানিক অর্থ প্রার্থনা। যে কোনো প্রার্থনাকেই সালাত বলা যায় এবং কুরাআন-হাদীসে কখনো কখনো তা বলা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের পরিভাষায়সালাতএকটি নির্দিষ্ট ইবাদাতের নাম। সকল প্রার্থনাকেই সালাত বলে নামকরণ করলে তা দ্বিমুখি বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে। প্রথমত কেউ হয়ত যে কোনোভাবে প্রার্থনা করেইসালাতকায়েম হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করবেন। দ্বিতীয়ত, কেউ সালাতের ফযীলত বা আহকামের আয়াত হাদীসগুলি সকল প্রার্থনার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করবেন

কেউ যদি নিজের জীবনে দীন পালন, আত্মশুদ্ধির চেষ্টা, ইলম শিক্ষা, হালাল উপার্জন, আল্লাহর পথে দাওয়াত, অত্যাচারীর সামনে সত্য-ভাষণ, হজ্জ পালন বা দুর্নীতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রচেষ্টাকে জিহাদ বলেন তবে তা দূষণীয় নয়, বরং তা কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে এগুলিকে পারিভাষিক ‘‘জিহাদ’’ মনে করা হলে তা বহুমুখি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রে জিহাদের ফযীলত আহকামসমূহ সকল ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে প্রয়োগের প্রবণতা দেখা দেবে। কোনো কোনো আধুনিক গবেষক চিন্তাবিদ ইসলামী রাজনীতি বা রাজনৈতিক সামাজিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব বুঝাতে ‘‘জিহাদ’’ বলে অভিহিত করেছেন। ‘‘জামাআতুল মুসলিমীন’’ এরূপ ব্যবহারকে তাদের বিভ্রান্তির সমর্থনে ব্যবহার করেছে

‘‘
ইসলামী রাজনীতি’’ বা ‘‘ইসলামী আন্দোলন’’-এর মাধ্যমে ‘‘দীন প্রতিষ্ঠা’’ নামে মুমিন যে ইবাদতটি পালন করেন সে ইবাদতটির পারিভাষিক নাম হলো ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ বা ‘‘ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধ’’ কর্মকে ‘‘জিহাদ’’ বলায় অসুবিধা নেই। তবে কর্মই কুরআন-হাদীস নির্দেশিত পারিভাষিক জিহাদ বা বলে মনে করার মধ্যে রয়েছে সমূহ বিপদ। আমরা বলেছি যে, ইসলামের পরিভাষায় ‘‘জিহাদ’’ অর্থই ‘‘কিতাল’’ বা যুদ্ধ। সাহাবী-তাবিয়ীগণ ইমামগণের ব্যবহারে এবং ফিকহ, তাফসীর বা ইসলামী জ্ঞানের যে কোনো প্রাচীন গ্রন্থে ‘‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ তালাশ করলেই পাঠক তা জানতে পারবেন। বর্তমানে অনেক আধুনিক গবেষক ‘‘ইসলামী রাজনীতি’’ বা ‘‘ইসলামী আন্দোলন’’-কে ‘‘জিহাদ’’ নামে আখ্যায়িত করেন এবং একেই ইসলামী শরীয়তের পারিভাষিক জিহাদ বলে গণ্য করেন। অনেকে পারিভাষিকভাবে ‘‘জিহাদ’’ ‘‘কিতাল’’-এর মধ্যে পার্থক্য করেন। কিতালকে যুদ্ধ এবং জিহাদকে আন্দোলন বলে মনে করেন। এরূপ মতামত গবেষণা বা ব্যাখ্যা হিসেবে কেউ পেশ করতে পারেন। কিন্তু ইসলামী শরীয়তের পারিভাষা বলে গণ্য করার কারণে এবং রাজনীতি, দাওয়াত, আন্দোলন ইত্যাদিকে সদা-সর্বদা জিহাদ বলে আখ্যায়িত করার কারণে ত্রিমুখি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে:

প্রথমত, দাওয়াত, রাজনীতি, আন্দোলন ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত মানুষ শরীয়ত নিদের্শিত ‘‘জিহাদ’’ ইবাদতটি পালন করছেন বলে ধারণা করছেন এবং হাদীসে ফিকহে জিহাদের যে সকল বিধান, সুন্নাত আদব বর্ণনা করা হয়েছে তা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য পালনীয় বলে মনে করছেন

দ্বিতীয়ত, প্রচলিত রাজনীতি, আন্দোলন বা দলবদ্ধ দাওয়াতের সাথে সংশি­ষ্ট না হয়ে যারা ব্যক্তিগতভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে ওয়ায, লিখনী, শিক্ষাদান ইত্যাদি পদ্ধতিতে ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ বা ‘‘ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধের’’ ইবাদতটি পালন করছেন তারা শরীয়তের পারিভাষিক ‘‘জিহাদ’’ নামক ইবাদতটি পালন করছেন না বলে মনে করা হচ্ছে

তৃতীয়ত, প্রচলিত রাজনীতি, আন্দোলন বা দীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে শরীয়তের পারিভাষিক জিহাদ বলে বিশ্বাস করে জন্য বলপ্রয়োগ, অস্ত্রধারণ অনুরূপ বিধানকে বৈধ বলে মনে করা হচ্ছে। আমি ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে সকল বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[1]

বিশেষত তৃতীয় বিভ্রান্তিটি উগ্রতার জন্ম দিচ্ছে। যে সকল আলিম বা গবেষক সকল কর্মকে জিহাদ নামে আখ্যায়িত করছেন তাঁরা মূলত এগুলির গুরুত্ব বুঝাতে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আভিধানিক অর্থে তা করছেন। কোনো আলিম যখন দাওয়াত, দ্বীন প্রতিষ্ঠা, আন্দোলন, রাজনীতি, মিছিল ইত্যাদিকে জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেন, তখন তিনি বুঝান না যে, কর্মের জন্য অস্ত্র ধারণ করা যাবে, অথবা এর বিরোধীদেরকে আঘাত করা যাবে। কিন্তু তিনি না বুঝালেও শ্রোতা, পাঠক বা সংশি­ষ্ট অনেকেই তা বুঝছেন। জামাআতুল মুসলিমীন উগ্রতায় লিপ্ত অন্যান্য মানুষের লিখনি বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, সমকালীন আলিম গবেষকদের সকল বক্তব্য থেকে তারা এরূপই বুঝেছেন। সকল বক্তব্য থেকে তারা বুঝেছেন যে, মানুষদেরকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসার ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা ইসলামী রাষ্ট্র ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হলো জিহাদ। আর জিহাদ হলে তো মারামারি, অন্ত্রধারণ, যুদ্ধ হত্যা হবেই। বস্ত্তত, উগ্রতার ভিত্তি দুটি বিষয়ের উপর:
প্রথমত, জিহাদই ইসলাম প্রচার বা প্রতিষ্ঠার পথ বলে দাবি করা
দ্বিতীয়ত, জিহাদের জন্য অস্ত্রধারণ, হত্যা, মৃত্যুবরণ ইত্যাদিকে বৈধ বা আবশ্যকীয় বলে দাবি করা

কুরআন-হাদীস ইসলামের ইতিহাস থেকে দ্বিতীয় বিষয়টি প্রমাণ করা তাঁদের জন্য খুবই সহজ বিষয়। এজন্য তাঁদের বিভ্রান্তির মূল উৎস প্রথম বিষয়ের মধ্যে নিহিত। আমরা দেখেছি যে, পারিভাষিকজিহাদকখনোই ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যম নয়। জিহাদ প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র নাগরিক দীনী দাওয়াতের নিরাপত্তা রক্ষার মাধ্যম। কিন্তু জিহাদ শব্দের অতি-ব্যবহারে ফলে অনেকের মনেই বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, জিহাদই দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ বা একমাত্র পথ এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করা সকলের জন্য ফরয

জঙ্গিদের প্রচারকর্ম এতে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। তারা কিছু সরলপ্রাণ আবেগী যুবককে সহজেই একথা বুঝাতে পারছে যে, জিহাদই সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বপ্রথম ফরয, জিহাদ ছাড়া ইসলাম কায়েম হবে না। আর জিহাদ মানেই তো অস্ত্র, যুদ্ধ হত্যা, কাজেই এখনই আমাদের সে কাজে নেমে পড়তে হবে। এভাবেই গুরুত্বারোপের জন্য একটি পরিভাষার আভিধানিক অর্থের অতিব্যহার বিভিন্ন বিভ্রান্তির পথ উন্মুক্ত করছে

পক্ষান্তরে দীন প্রতিষ্ঠার সকল কর্মকে ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ নামে আখ্যায়িত করলে একদিকে যেমন সঠিক ইসলামী পরিভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে উপর্যুক্ত ত্রিবিধ অস্পষ্টতা বা বিভ্রান্তির পথ রুদ্ধ হবে, তেমনি অন্যদিকে সকল ইবাদত পালনের সঠিক সুন্নাত ইসলামী আদব জানা সহজ হবে। কারণ দীন প্রতিষ্ঠার সকল কর্মকে সর্বদা জিহাদ বলে আখ্যায়িত করার ফলে আগ্রহী মুমিন সকল কর্মের ইসলামী নির্দেশনা, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের সুন্নাত ইসলামী আদব জানার জন্য হাদীস ফিকহের ‘‘জিহাদ’’ অধ্যায় অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেন, ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ বা ‘‘ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধ’’ অধ্যায় অধ্যয়নের কথা তার মনে আসে না

আমরা আশা করি যে, দীনী দাওয়াতের সকল ময়দানে যারা কর্মরত এবং সকল বিষয়ে যারা গবেষণা করছেন, তারা সকল কর্মকান্ডের পারিভাষিক পরিচয় নিশ্চিত করবেন। এগুলিকে ‘‘ন্যয়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধ’’ বা ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ নামে আখ্যায়িত করলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ইসলামী দাওয়াতের আবেগ জযবাকে বিপথগামী করার বা সহিংসতায় পর্যবসিত করার একটি বড় পথ রুদ্ধ হবে বলে আশা করা যায়। মহান আল্লাহই ভাল জানেন এবং তিনিই তাওফীক দাতা

[1] এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৪৬০-৪৭৮ (উপকরণ, ইবাদত বিদআত: কতিপয় উদাহরণ)

 . . . জিহাদ ফরয আইন এবং বড় ফরয

নিজের জীবনের চেয়ে অন্যের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠার আবেগে প্রাচীন আধুনিক খারিজীগণ ‘‘জিহাদ’’ নামক ইবাদতকে ‘‘ফরয আইন’’ বা ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয বলে দাবি করেছেন। উপরন্তু তারা ‘‘জিহাদ’’-কে মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় ফরয বলে দাবি করেছে। প্রাচীন খারিজীগণের মতামত বর্ণনায় একজন গবেষক লিখেছেন:
"The second principle that flowed from their aggressive idealism was militancy, or jihād, which the Khawārij considered to be among the cardinal principles, or pillars, of Islām. Contrary to the orthodox view, they interpreted the Qurānic command about 'enjoining good and forbidding evil' to mean the vindication of truth through the sword"... "To these five, the Khawārij sect added a sixth pillar, the jihād".

‘‘খারিজীদের আগ্রাসী আদর্শবাদের দ্বিতীয় ভিত্তি ছিল জিহাদ
খারিজীগণ জিহাদকে ইসলামের মূল ভিত্তি বা রুকন বলে মনে করে। সাধারণ মুসলিমদের মতের বিপরীতে খারিজীগণ কুরআন নির্দেশিতসৎকাজে আদেশ অন্যায় থেকে নিষেধবলতে তরবারীর জোরে সত্য প্রতিষ্ঠা বুঝাতো।... তারা ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের সাথে জিহাদকে ষষ্ঠ স্তম্ভ হিসেবে যুক্ত করে...’’[1] আবেগী খারিজীগণ সর্বদা জিহাদের অতুলনীয় সাওয়াব গুরুত্ব বিষয়ক আয়াতগুলিকে তাদের মতের পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করত। তাদের উদ্ধৃত আয়াত হাদীস জিহাদের গুরুত্ব প্রমাণ করে। কিন্তু কখনোই তাকে সর্বোচ্চ বা সর্বশ্রেষ্ঠ ফরয বলে প্রমাণ করে না। প্রকৃত কথা যে, ইসলামে মুসলিমের উপর অনেক কর্ম ফরয করা হয়েছে। সকল ফরয কর্মই গুরত্বপূর্ণ। তবে সেগুলির মধ্যে কোনোটির চেয়ে কোনোটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। গুরুত্বের বেশিকম সাধারণভাবে সকলের জন্য হতে পারে আবার ব্যক্তিগত অবস্থার কারণে হতে পারে। সর্বাবস্থায় গুরুত্বের কমবেশি আবেগ বা যুক্তি দিয়ে নয়, বরংসুন্নাতেরআলোকে বা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আজীবনের কর্ম, শিক্ষা আচরণের মধ্য থেকে বুঝতে হবে। আর কুরআন, হাদীস এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের আচরিত প্রায়োগিক সুন্নাতের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, জিহাদ সবচেয়ে ফরয নয়, দীনের রুকনও নয় এবং ফরয আইনও নয়। বরং জিহাদ ফরয কিফায়া ইবাদত। আমরা ইতোপূর্বে বিষয়টি আলোচনা করেছি

[1] Encyclopaedia Britannica, Article: Islam-Khawarij.

 . . . খারিজীগণের বিভ্রান্তি অপনোদনে সাহাবীগণ

হাদীসের গ্রন্থগুলিতে সাহাবী-তাবিয়ীগণের সাথে খারিজীগণের বিভিন্ন সংলাপ উদ্ধৃত করা হয়েছে। এগুলি থেকে আমরা খারিজীগণের মতামত তাদের বিভ্রান্তি অপনোদনে সাহাবীগণের প্রচেষ্টার বিষয়ে জানতে পারি। সাহাবীগণের বক্তব্য থেকে নিম্নের বিষয়গুলি প্রতীয়মান হয়:

(
) আরকানে ইসলাম জাতীয় ইবাদতই মুমিনের মূল দায়িত্ব। এগুলিউদ্দিষ্টইবাদত বা এগুলি পালন করাই মুমিন জীবনের উদ্দেশ্য। এগুলি পালনের আবশ্যকতা কখনোই কমে না বা থামে না। পক্ষান্তরেজিহাদউদ্দিষ্ট ইবাদত নয়; বরং উদ্দিষ্ট ইবাদত পালনের অধিকার রক্ষার জন্যই জিহাদ। অধিকার বিদ্যমান থাকলে জিহাদের আবশ্যকতা থাকে না

(
) ফিতনা দূরীকরণ জিহাদের উদ্দেশ্য। তবে ফিতনা দূরীকরণ বলতে সমাজের সকল অন্যায়, অনাচার, কুফর, শিরক ইত্যাদি দূর করা নয়, বরং মুমিনকে জোরপূর্বক কুফরে লিপ্ত হওয়ার পরিস্থিতি দূরীকরণ বা দীনপালন দীনী দাওয়াতের স্বাধীনতা রক্ষা করা। এরূপ পরিস্থিতি ছাড়া জিহাদ মূলত ফিতনা দূর করে না, বরং ফিতনা সৃষ্টি করে

(
) জিহাদ করা আল্লাহর নির্দেশ এবং মানুষ হত্যা করা আল্লাহর নিষেধ। নিষেধের পাল­াকে ভারী রাখতে হবে এবং হারামে নিপতিত হওয়ার ভয় থাকলে জিহাদ পরিত্যাগ করতে হবে

(
) কাফির রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র, নাগরিক দীনী দাওয়াতের স্বাধীনতা বিজয় সংরক্ষণই মূলত জিহাদ। মুসলিম ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা হত্যা জিহাদ নয়। যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন বলে দাবি করে বালা ইলাহা ইল্লাল্লাহুমুখে স্বীকার করে তাকে জিহাদের নামে হত্যা করা পারলৌকিক ধ্বংসের অন্যতম কারণ
প্রসঙ্গে খারিজীদের সাথে ইবনু উমারের (রা) কিছু কথোপকথন আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। খারিজীগণের দাবি ছিল, মানুষ যখন অন্যায় অনাচারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তখন জিহাদ বাদ দিয়ে হজ্জ-উমরায় রত থাকা আপত্তিকর। এর উত্তরে ইবনু উমার (রা) বলেন যে, ফযীলত, পুরস্কার ইত্যাদি কখনোই কোনো ইবাদতের শ্রেষ্টত্ব প্রমাণ করে না, বরং জন্য কুরআন বা হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রয়োজন। কুরআন হাদীসের নির্দেশনা থেকে জানা যায় যে জিহাদ আরকানে ইসলামের মত কোনো ফরয ইবাদত নয়। যেখানে জিহাদের নামে মুসলিম হত্যা বা ভাতৃহত্যার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে ফযীলত অর্জনের চেয়ে হারাম বর্জন মুমিনের দায়িত্ব

পক্ষান্তরে হজ্জ ইসলামের পাঁচ রুকনের একটি, কাজেই সর্বাবস্থায় ইবাদত মুমিন পালন করতে পারে
অন্য হাদীসে দুব্যক্তি ইবনু উমারের (রা) কাছে এসে বলেন:


إنَّ الناسَ ضَيَّعوا وأنتَ ابنُ عُمَرَ، وصاحبُ النبيَّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم، فما يَمنَعُكَ أن تَخرُجَ ؟ فقال : يَمنَعُني أنَّ الله حَرَّمَ دمَ أخي، فقالا : ألم يقل الله : (وقاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ) . فقال : قاتَلْنا حتى لم تَكُن فِتنَةٌ، وكانَ الدِّينُ لِلَّهِ، وأنتُم تُريدونَ أن تُقاتِلوا حتى تَكونَ فِتنَةٌ، ويكُونَ الدِّينُ لغيرِ اللَّهِ

মানুষেরা (অন্যায় অনাচার পাপে) ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আপনি ইবনু উমার, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর সাহাবী, আপনি কেন বেরিয়ে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন না? তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন - আমাকে যুদ্ধে বেরোতে নিষেধ করছে। তারা বলে, আল্লাহ কি বলেন নি, ‘এবং তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাবৎ ফিতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত না হয়’? তখন তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ করেছিলাম এবং ফিতনা দূরীভূত হয়েছিল এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তোমরা চাচ্ছ যে, তোমরা যুদ্ধ করবে যেন ফিতনা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দীন আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য হয়।’’[1]

এখানেও আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) প্রথমত, জিহাদের আদেশ হত্যার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তুলনা করছেন, যা আমরা পূর্বের কথোপকথনেও দেখেছি। জিহাদের আদেশ করা হলেও তার পরিত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে মানুষের রক্তপাত ভয়ঙ্করতম হারাম। কাজেই পরিত্যাগযোগ্য একটি দায়িত্ব পালনের জন্য মুমিন কখনোই ভয়ঙ্করতম একটি হারামে লিপ্ত হতে পারেন না
দ্বিতীয়ত, তিনিজিহাদ-কিতালফিতনাবা সন্ত্রাসের মধ্যে পার্থক্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন যে, সাহাবীগণ যে কিতাল করেছিলেন তা ছিল ফিতনা রোধ করতে, আর খারিজীগণ যে কিতাল করছে তা ফিতনা প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্যের কারণ উল্লেখ করেন নি। আমরা দেখেছি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ ফিতনা বা সন্ত্রাসের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য যে, জিহাদ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ যা শুধু শত্রু যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এবং ফিতনা-সন্ত্রাস ব্যক্তি বা গোষ্ঠি পরিচালিত যুদ্ধ যা সাধারণত যোদ্ধা-অযোদ্ধা সকলের বিরুদ্ধে পরিচালিত। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশে নেতৃত্বেই জিহাদ-কিতাল পরিচালিত হবে। খারিজীগণ বিষয়টিকে ব্যক্তিগত গোষ্ঠিগত পর্যায়ে নিয়ে এসে সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। বস্ত্তত, হত্যা, বিচার, শক্তিপ্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় যদি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত না হয় তবে তা ফিতনার মহাদ্বার উন্মোচন করে। পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষই অন্য কোনো না কোনো মানুষের দৃষ্টিতে অন্যায়কারী অপরাধী। প্রত্যেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠি যদি নিজের মত অনুসারে বিচার, যুদ্ধ শক্তিপ্রয়োগ করতে থাকে তবে তার চেয়ে বড় ফিতনা আর কিছুই হতে পারে না। অন্য হাদীসে তাবিয়ী নাফি বলেন, এক খারিজী নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের (রা) নিকট এসে বলেন:

يا أبا عبدالرحمن ما حملك على أن تحج عاماً وتعتمر عاماً وتترك الجهاد في سبيل الله عز وجل وقد علمت ما رغب الله فيه قال يا ابن أخي بني الإسلام على خمس إيمان بالله ورسوله والصلوات الخمس وصيام رمضان وأداء الزكاة وحج البيت قال يا أبا عبد الرحمن ألا تسمع ما ذكر الله في كتابه (وإن طائفتان من المؤمنين اقتتلوا فأصلحوا بينهما فإن بغت إحداهما على الأخرى فقاتلوا التي تبغي حتى تفيء إلى أمر الله) (قاتلوهم حتى لا تكون فتنة) قال فعلنا على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم وكان الإسلام قليلاً فكان الرجل يفتن في دينه إما قتلوه وإما يعذبوه حتى كثر الإسلام فلم تكن فتنة

হে আবূ আব্দুর রাহমান, কি কারণে আপনি এক বছর হজ্জ করেন আরেক বছর উমরা করেন এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করেন? অথচ আপনি জানেন যে, আল্লাহ জিহাদের জন্য কী পরিমাণ উৎসাহ প্রেরণা দিয়েছেন? তখন ইবনু উমার (রা) বলেন, ভাতিজা, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচটি বিষয়ের উপর: আল্লাহ তাঁর রাসূলের (সাঃ) প্রতি ঈমান, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রামাযানের সিয়াম, যাকাত বাইতুল্লাহর হজ্জ। উক্ত ব্যক্তি বলে, হে আবূ আব্দুর রাহমান, আল্লাহ তাঁর কিতাবে কী বলেছেন তা কি আপনি শুনছেন না? তিনি বলেছেন: ‘মুমিনগণের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলের উপর সীমলঙ্ঘন করলে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে।’ (তিনি আরো বলেছেন): ‘এবং তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাবৎ ফিতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত না হয়’[2] তখন ইবনু উমার বলেন, আমরা তো রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর যুগে তা করেছিলাম। ইসলাম দুর্বল স্বল্প ছিল, ফলে মুসলিম ব্যক্তি তার দীনের কারণে ফিতনাগ্রস্থ হতেন। কাফিররা তাকে হত্যা করত অথবা তার উপর অত্যাচার করত। যখন ইসলাম বিস্তৃত হয়ে গেল তখন তো আর ফিতনা থাকল না।’’[3]

এখানেও খারিজীগণ কুরআনের দু-একটি আয়াতের উপর ভিত্তি করে ইবনু উমার (রা)-এর জিহাদ পরিত্যাগ করে হজ্জ উমরা পালনকে আপত্তিকর বলে দাবি করেছে। ইবনু উমার (রা) তাদের বিভ্রান্তি অপনোদনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর বক্তব্য থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় বুঝতে পারি:

প্রথমত, শুধু ফযীলত, নির্দেশনা বা প্রেরণামূলক আয়াত হাদীসের ভিত্তিতে কোনো ইবাদতের গুরুত্ব নির্ধারণ করা যায় না
কুরআন কারীম রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর সামগ্রিক শিক্ষার আলোকেই তা নির্ধারণ করতে হবে
দ্বিতীয়ত, কুরআন কারীমে সালাত, সিয়াম, যাকাত, জিহাদ, দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ ইত্যাদি অনেক ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এগুলির মধ্যে কোন্টি অধিকগুরুত্বপূর্ণ এবং কোনটি কম গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি ব্যক্তিগত এবং কোনটি কোনটি সামষ্টিক, কোনটি রাষ্ট্রীয়, কোন্টি সকলের জন্য সার্বক্ষণিক পালনীয়, কোন্টি বিশেষ অবস্থায় পালনীয় ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করা হয় নি। সকল কুরআনী নিদেশ যিনি গ্রহন করেছেন, তাঁর বাস্তব প্রয়োগ নির্দেশনা থেকেই সকল বিষয় বিস্তারিত জানা যায়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর শিক্ষা বাস্তব প্রয়োগ থেকে জানা যায় যে, কুরআনে উলি­খিত সকল নির্দেশের মধ্যে পাঁচটি কর্ম সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপর্ণ এবং এগুলির উপরেই দীনের ভিত্তি। জিহাদ, দাওয়াত, আদেশ-নিষেধ, দীন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ইবাদতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে সেগুলির পালনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির অবস্থার আলোকে যে ছাড় বা সুযোগ আছে তা আরকানে ইসলামের ক্ষেত্রে নেই। তাঁরা বুঝতেন যে, জিহাদ আরকানে ইসলামের মত ব্যক্তিগত ফরয ইবাদত নয় যে, তা পরিত্যগ করলে গোনাহ হবে। বরং বিভিন্ন হাদীসে শুধুমাত্র আরকানে ইসলাম পালনকারীকে পূর্ণ মুসলিম জান্নাতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[4] অন্যান্য হাদীসে জিহাদের গুরুত্ব বর্ণনার সাথে সাথে জিহাদ পরিত্যাগকারী আরকান পালনকারী মুমিনেরও প্রশংসা করা হয়েছে।[5] অনেক হাদীসে বিশৃঙ্খলা, ফিতনা বা হানাহানির সময়ে, আদেশ, নিষেধ, দাওয়াত জিহাদ পরিত্যাগের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।[6] অন্যত্র পিতামাতার খেদমত বা আনুষঙ্গিক প্রয়োজনের জন্য জিহাদ পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[7]

ইবনু উমার নিজেও কাফির রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় জিহাদে অংশগ্রহণ করতেন। তবে জিহাদের অনেক শর্ত রয়েছে, সেগুলির অন্যতম যে, জিহাদ শুধু যুদ্ধরত কাফিরের বিরুদ্ধেই হবে। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক মুসলিম বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ যদিও বৈধ করা হয়েছে, কিন্তু ইবনু উমার (রা) অন্যান্য অধিকাংশ সাহাবী এক্ষেত্রে দূরে থাকাই পছন্দ করতেন, কারণ ভুল জিহাদে কোনো মুসলিমকে হত্যা করার চেয়ে, সঠিক জিহাদ থেকে বিরত থাকা উত্তম

তৃতীয়ত, তাঁরা ফিতনা দূরীকরণ আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মুসলিমের দীন পালনের নিরাপত্তাটিই মূল বলে মনে করেছেন। মুসলিম যতক্ষণ দীন পালনের নিরাপত্তা ভোগ করছেন ততক্ষণ ফিতনা দূরীভূত করার নামে যুদ্ধ করার সুযোগ নেই। বরং দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ ইত্যাদির মাধ্যমে সমস্যা দূর করার চেষ্টা করতে হবে

চতুর্থত, তিনি আদেশ নিষেধের মধ্যে তুলনা করেছেন। খারিজীদের দাবি ছিল, আল্লাহ ফিতনা দূর করার জন্য যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষত মুমিনদের পারস্পারিক যুদ্ধের সময় জালিম মুমিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ। এরূপ সুস্পষ্ট নির্দেশের পরেও যুদ্ধ না করে বসে থাকা কোনো মুমিনের পক্ষে কিভাবে সম্ভব হয়? ইবনু উমার (রা) বুঝালেন যে, এখানে আদেশের বিপরীতে নিষেধ রয়েছে, আর এক্ষেত্রে নিষেধের পাল্লাই ভারী থাকবে। সকল আয়াতে যেমন কিতালের নির্দেশ দেওয়া তেমনি অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:


وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا

‘‘যে ব্যক্তি কোনো একজন মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে তার প্রতিফল জাহান্নাম, তথায় সে চিরস্থায়ী থাকবে এবং আল্লাহ তার উপর ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভয়ঙ্কর আযাব প্রস্ত্তত করেছেন।’’[8]

বস্ত্তত কুরআন কারীমে এর চেয়ে কঠিনতর ভাষায় কোনো পাপের শাস্তি বর্ণনা করা হয় নি। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো একজন মুমিনকে হত্যা করার জন্য পর্যায়ের শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যার একটি আরেকটির চেয়ে ভয়ঙ্করতর: জাহান্নাম, তথায় চিরস্থায়িত্ব, আল্লাহর ক্রোধ, আল্লাহর অভিশাপ এবং ভয়ঙ্কর শাস্তি। এর বিপরীতে শতভাগ নিশ্চিত ফরয জিহাদ পরিত্যাগ করলে এরূপ বা এর কাছাকাছি কোনো শাস্তির কথা বলা হয় নি

মুমিন হত্যা তো দূরের কথা মুসলিম সমাজে বসবাসরত কোনো অমুসলিম নাগরিক, অথবা শত্রু রাষ্ট্র থেকে আইনানুগ নিরাপত্তা নিয়ে মুসলিম দেশে আগত অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করলেও সে ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধি লাভ করতে পারবে না বলে হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই কোনো মুমিনই জিহাদ, কিতাল বা যুদ্ধের নামে এরূপ কঠিন পাপের মধ্যে নিজেকে নিপতিত করতে পারে না
সাহাবী জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ (৬০ হি) একবার খারিজীদের কতিপয় নেতাকে ডেকে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,


ومن يشاقق يشقق الله يوم القيامة ... ومن استطاع ان لا يحال بينه وبين الجنة بملء كفه من دم أهراقه فليفعل (كأنما يذبح دجاجة كلما تقدم لباب من ابواب الجنة حال بينه وبينه)

‘‘যে ব্যক্তি কাঠিন্য বা উগ্রতার পথ অবলম্বন করবে আল্লাহও কিয়ামতের দিন তার জন্য কাঠিন্যের পথ অবলম্বন করবেন
কেউ যদি কোনো মানুষের হাতের তালুতে রাখার মত সামান্য রক্তও প্রবাহিত করে (যেন যে মুরগী জবাই করছে) তবে সে রক্ত তার জান্নাতের মধ্যে বাধা হবে। (যখনই সে জান্নাতের কোনো দরজার দিকে অগ্রসর হবে, তখনই রক্ত তার জান্নাতে প্রবেশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে) কাজেই যদি কেউ পারে তবে সে যেন এরূপ রক্তপাত থেকে আত্মরক্ষা করে।’’ কথা শুনে উপস্থিত লোকগুলি খুব ক্রন্দন করতে লাগল। তখন জুনদুব (রা) বলেন, এরা যদি সত্যবাদী হয় তবে এরা মুক্তি পেয়ে যাবে।.. কিন্তু পরে আবার তারা উগ্রতার পথে ফিরে যায়।[9]

জুনদুব (রা) দুটি বিষয়ের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন:
প্রথমত, উগ্রতার ভয়াবহতা। উগ্রতার দুটি দিক রয়েছে। প্রথম দিক, নিজের ব্যক্তিগত জীবনে দীন পালনের জন্য নফল-মুস্তাহাব ইত্যাদি বিষয়ে অতি কষ্টদায়ক রীতি অনুসরণ করা। দ্বিতীয় দিক, অন্য মানুষদের ভুলভ্রান্তি সংশোধনকে নিজের অন্যতম বোঝা বলে গ্রহণ করা এবং সেজন্য উগ্রতার পথ অবলম্বন করা। দুটি বিষয়ই সুন্নাতের পরিপন্থী কর্ম যা মুমিনের জীবনে দীন পালনকে কঠিন করে তোলে

দ্বিতীয়ত, তিনি জিহাদের নামে হত্যা বা রক্তপাতের ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সালাত, সিয়াম, যিক্র ইত্যাদি ইবাদতের মত ইবাদত নয় জিহাদ। সকল ইবাদত যদি কোনো কারণে ভুল হয় তবে তাতে ইবাদতকারী কঠিন পাপের মধ্যে নিপতিত হয় না। পক্ষান্তরে জিহাদ বিচারের মত বান্দার হক জড়িত ইবাদত। আমরা দেখেছি যে, বিচারকের ভুলে নিরপরাধীর সাজা হওয়ার চেয়ে অপরাধীর বেঁচে যাওয়া বা সাজা কম হওয়া ভাল। অনুরূপভাবে জিহাদের নামে ভুল মানুষকে হত্যা করার চেয়ে জিহাদ না করা অনেক ভাল। জিহাদের নামে ভুল মানুষকে হত্যা করলে শত পুন্য করেও জান্নাত থেকে বঞ্চিত হতে হবে। পক্ষান্তরে জিহাদ বর্জনের কারণে এরূপ শাস্তিলাভের সম্ভাবনা নেই

এখানে লক্ষণীয় যে, জ্ঞান অনুভূতি আসার পরেও তারা উগ্রতা পরিত্যাগ করতে পারল না। এর কারণ সম্ভবত এদের মধ্যে সকলেই সৎ আন্তরিক ছিল না। সকল সন্ত্রাসী কর্মের মাধ্যমে ক্ষমতা, সম্পদ অন্যান্য জাগতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যও অনেকের ছিল। অথবা উগ্রতার উন্মাদনা সঙ্গীসাথীদের অপপ্রচার তাদেরকে আবারো বিপথগামী করে। খারিজীগণের বিভ্রান্তি অন্যতম ছিল ঈমানের দাবিদারকে বিভিন্ন যুক্তিতে কাফির বলে গণ্য করে তাকে হত্যা করা। আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে বিষয়টি আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। তাদের বিষয়ক বিভ্রান্তি অপনোদনের জন্য সাহাবীগণ বিভিন্নভাবে তাদেরকে হত্যার ভয়াবহতা বুঝাতেন। তাঁরা তাদেরকে বুঝাতেন যে, জিহাদের বা যুদ্ধের সকল শর্ত পূরণ হলেও যদি কেউ যুদ্ধের ময়দানে নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে তাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ

বিষয়ে এক হাদীসে তাবিয়ী সাফওয়ান ইবনু মুহরিয বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের ফিতনার সময়ে সাহাবী জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ বাজালী (রা) সকল সংঘাতের বিষয়ে আগ্রহী কতিপয় ব্যক্তিকে ডেকে একত্রিত করে তাদেরকেলা ইলাহা ইল্লাল্লাহুপাঠকারী ঈমানের দাবিদার কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করার পরিণতি থেকে সাবধান করার জন্য বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাফিরদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। যুদ্ধের মাঠে একজন কাফির সৈনিক দুর্দমনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করে এবং মুসলিম বাহিনীর অনেক সৈনিককে হত্যা করে। এক পর্যায়ে উসামা ইবনু যাইদ (রা) উক্ত কাফির সৈনিককে আক্রমন করেন। তিনি যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন তখন উক্ত কাফির সৈনিকলা ইলাহা ইল্লাল্লাহবলে। উসামা সে অবস্থাতেই তাকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উসামাকে বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুবলার পরেও তুমি তাকে কেন হত্যা করলে? তিনি বলেন, লোকটি মুসলিম বাহিনীকে অনেক কষ্ট দিয়েছে অমুক, অমুককে হত্যা করেছে, আমি যখন তরবারী উঠালাম সে তরবারীর ভয়েলা ইলাহা ইল্লাল্লাহুবলেছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তুমি তার হৃদয় চিরে দেখে নিলে না কেন, সে ভয়ে বলেছে না স্বেচ্ছায় বলেছে! কেয়ামতের দিন যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুউপস্থিত হবে তখন তুমি কী করবে? কেয়ামতের দিন যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুউপস্থিত হবে তখন তুমি কী করবে? এভাবে তিনি বারবারই বলতে লাগলেন, কেয়ামতের দিন যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুউপস্থিত হবে তখন তুমি কী করবে?[10]

এভাবে বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবীগণ ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলা তাকে হত্যা করার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে এদেরকে সাবধান করছেন

[1] বুখারী, আস-সহীহ /১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৮৪, ৩১০
[2]
সূরা বাকারা, ১৯৩ আয়াত
[3]
বুখারী, আস-সহীহ /১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৮৪, ৩১০
[4]
বুখারী, আস-সহীহ /২৫, ২৭, /৫০৬, ৯৫১, /১৭৯৩; মুসলিম, আস-সহীহ /৩৯-৪৪
[5]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৫০৩
[6]
হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৩১৫; ইবনু হিব্বান, মুহাম্মাদ আল-বুসতি (৩৫৪ হি.), আস-সহীহ /১০৮; তিরমিযী /২৫৭; আবু দাউদ, সুলায়মান ইবনু আশআস (২৭৫ হি.), আস-সুনান /১২৪; দানী, আবু আমর উসমান ইবনু সাঈদ (৪৪৪ হি.), আস-সুনানুল ওয়ারিদাতুল ফিল ফিতান /৩৬৩-৩৭০; মুনযিরী, আবদুল আযীম ইবনু আব্দুল কাবী (৬৫৬ হি.), আত-তারগীব ওয়াত তারহীব /২৯৫-২৯৯, ইবনু রাজব, আব্দুর রহমান ইবনু আহমাদ (৭৯৫ হি.), জামিউল উলূল ওয়াল হিকাম, পৃ. ৩২৩-৩২৪
[7]
বুখারী, আস-সহীহ /১০৯৪, /২২২৮, মুসলিম, আস-সহীহ /১৯৭৫; মুনযিরী, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব /২১৫-২১৮
[8]
সূরা () নিসা: ৯৩ আয়াত
[9]
বুখারী, আস-সহীহ /২৬১৫; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১৩/১২৯-১৩০
[10]
মুসলিম, আস-সহীহ /৯৬-৯৭; নাবাবী, শারহু সাহীহী মুসলিম /১০১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১২/১৯৬, ২০১

 . . তাকফীর বা কাফির কথন - (. . . কুফর তাকফীর)

কুফর অর্থ অবিশ্বাস। আর তাকফীর অর্থ কাউকে অবিশ্বাসী বা ধর্মত্যাগী বলে আখ্যায়িত করা। যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন বলে দাবি করেন তাকে কাফির বলে আখ্যায়িত করাকে ‘‘তাকফীর’’ বলা হয়। কোনো কাজকে কুফরী বলে গণ্য করা এবং কাজের জন্য কোনো মুসলিমকে কাফির বলার মধ্যে আসমান-যমীনের পার্থক্য রয়েছে। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, খারিজীগণের পূর্বসূরী যুল খুওয়াইসিরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর কর্মের কঠিন সমালোচনা করে, যা ছিল সুস্পষ্ট কুফরী। আমরা যে কেউ বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অন্যায় করেছেন বলে ধারণা করা বা তাঁর প্রতি অবিশ্বাস কুধারণা পোষণ করা কুফরী। কিন্তু খালিদ ইবনু ওয়ালিদ যখন ধর্মত্যাগের শাস্তি হিসেবে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: ‘‘না। হয়তবা লোকটি সালাত আদায় করে।’’ খালিদ (রা) বলেন, ‘‘কত মুসল্লীই তো আছে যে মুখে যা বলে তার অন্তরে তা নেই।’’ তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘‘আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় নি যে, আমি মানুষের অন্তর খুঁজে দেখব বা তাদের পেট ফেড়ে দেখব’’ অর্থাৎ লোকটি নিজেকে মুসলিম দাবি করে এবং ইসলামের ব্যাহ্যিক কিছু কর্ম করে। কাজেই লোকটি যে কুফরী কথা বলেছে তার কোনো ওযর আছে বলে ধরে নিতে হবে

পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যক্তির অনুগামীদের বিষয়ে জানান যে, এরা শিকারের দেহভেদকারী তীরের ন্যায় ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। তারা ইসলামে অনুসারীদের হত্যা করবে এবং প্রতিমা-পাথরের অনুসারীদের ছেড়ে দেবে। শেষে তিনি বলেন: ‘‘আমি যদি তাদেরকে পাই তবে সামূদ সম্প্রদায়কে যেভাবে নির্মুল করা হয়েছিল সেভাবেই আমি তাদেরকে হত্যা করে নির্মুল করব।’’ বিষয়টিও লক্ষণীয়। সকল মানুষ যখন মুসলিমদের হত্যাকান্ডে লিপ্ত হবে তখন তিনি তাদেরকে হত্যা করবেন বলে জানালেন। কিন্তু এরূপ পাপে লিপ্ত হওয়ার আগে তাদেরকে ধর্মত্যাগের অপরাধে মৃত্যুদন্ড দিতে রাজি হলেন না। কারণ যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন দাবি করছে তার কথার ওজর পাওয়া গেলে তা গ্রহণ করে তাকে মুসলিম বলে গণ্য করতে হবে। তবে সে যদি হত্যা, সন্ত্রাস বা অনুরূপ মৃত্যুদন্ড পাওয়ার মত কোনো অপরাধে লিপ্ত হয় তখন তাকে অপরাধের জন্য শাস্তি দিতে হবে

আমরা দেখেছি যে, পাপের কারণে মুমিনকে কাফির বলা খারিজী সন্ত্রাসের মূল ভিত্তি ছিল। পক্ষান্তরে সাহাবীগণ এবং তাঁদের পরে মুসলিম উম্মাহর ইমাম আলিমগণ একমত যে, পাপের কারণে মুমিনকে কাফির বলা যায় না। কারণ, কুরআন হাদীসে যেমন বিভিন্ন পাপকেকুফরীবলা হয়েছে, তেমনি কঠিন পাপে লিপ্ত ব্যক্তিকেও মুমিন বলা হয়েছে। সকল আয়াত হাদীসের আলোকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহচার্যে লালিত সাহাবীগণ বলতেন যে, কুরআন কারীমে ব্যবহৃত কুফর, নিফাক, ফিসক জুলম দু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে: কখনো তা অবিশ্বাস, ঈমানের অনুপস্থিতি চূড়ান্ত অন্যায় অর্থে এবং কখনো তা আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতার পাপ, মুনাফিকের গুণ সাধারণ পাপ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়ক আয়াত, হাদীস বিভিন্ন মতামত ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।[1]

উক্ত গ্রন্থে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা দেখেছি যে, ওযর, ব্যাখ্যা, অজ্ঞতা বা না-বুঝার কারণে সুস্পষ্ট কুফরী কর্ম বা কথা বলা সত্ত্বেও সংশি­ষ্ট ব্যক্তিকে কাফির বলে গণ্য করা হয় নি। দ্বারা উক্ত কর্ম বা কথাকে বৈধতা দেওয়া হয় নি, কিন্তু ব্যক্তির ওযর গ্রহণ করা হয়েছে। অজ্ঞতার ওযর সম্পর্কে এক হাদীসে হুযাইফা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:

يدرُسُ الإسلامُ كما يدرُسُ وَشْيُ الثَّوبِ حتَّى لا يدري ما صيامٌ، ولا صلاةٌ، ولا نسُكٌ، ولا صدقةٌ، ولَيسري (ويسرى النسيان) على كتابِ اللَّهِ عزَّ وجلَّ في ليلةٍ فلا يبقى في الأرضِ منْهُ آيةٌ، وتبقى طوائفُ منَ النَّاسِ الشَّيخُ الْكبيرُ والعجوزُ يقولونَ: أدرَكنا آباءَنا على هذِهِ الْكلمةِ لا إلَهَ إلَّا اللَّهُ فنحنُ نقولُها فقالَ لَهُ صلةُ: ما تُغني عنْهم لا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَهم لا يدرونَ ما صلاةٌ ولا صيامٌ ولا نسُكٌ ولا صدقةٌ؟ فأعرضَ عنْهُ حذيفةُ، ثمَّ ردَّها عليْهِ ثلاثًا كلُّ يعرِضُ عنْهُ حذيفةُ ثمَّ أقبلَ عليْهِ في الثَّالثةِ فقالَ: يا صِلةُ تنجيهِم منَ النَّارِ ثلاثًا

‘‘কাপড়ের নকশি যেমন মলিন হয়ে মুছে যায় তেমনি মলিন বিলীন হয়ে যাবে ইসলাম। এমনকি মানুষ জানবে না যে, সালাত কী? সিয়াম কী? হজ্জ কী, যাকাত কী? এক রাতে কুরআন অপসারিত হবে (বিস্মৃতি কুরআনকে আবৃত করবে) ফলে পৃথিবীতে কুরআনের কোনো আয়াত অবশিষ্ট থাকবে না। অনেক বয়স্ক নারীপুরুষ রয়ে যাবে যারা বলবে, আমার আমাদের পিতাপিতামদেরকে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’’ কালিমাটি বলতে শুনতাম কাজেই আমরা তা বলি।’’ তখন সিল্লাহ নামক এক শ্রোতা বলেন, ‘‘তারা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত কিছুই জানে না, কাজেই তাদের জন্যলা ইলাহা ইল্লাল্লাহুকোনো কাজে লাগবে না।’’ তখন হুযাইফা মুখ ফিরিয়ে নেন। সিল্লাহ তিনবার কথাটি বলেন এবং তিনবারই হুযাইফা মুখ ফিরিয়ে নেন। তৃতীয়বারে তিনি বলেন: ‘‘হে সিল্লাহ, কালিমাটি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে।’’ তিনি তিনবার একথাটি বললেন।’’[2]
ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলা সন্ত্রাস অশান্তির প্রথম পদক্ষেপ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিষয়ে তার উম্মাতকে সতর্ক করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:


إذا كفر الرجل أخاه فقد باء بها أحدهما إن كان كما قال وإلا رجعت عليه

‘‘যদি কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে, তবে কথা দু জনের একজনরে উপর প্রযোজ্য হবে। যদি তার ভাই সত্যিই কাফির হয় তবে ভাল, নইলে যে তাকে কাফির বলল তার উপরেই কুফরী প্রযোজ্য হবে।’’[3]
কোনো ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলা তাকে হত্যা করার মতই কঠিনতম অপরাধ। সাবিত ইবনু দাহহাক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

من رمى مؤمنًا بكفرٍ فهو كقتلِه

‘‘যদি কেউ কোনো মুমিনকে কুফরীতে অভিযুক্ত করে তবে তা তাকে হত্যা করার মতই অপরাধ।’’[4]
অর্থে /১০ জন সাহাবী থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কুরআন-হাদীসের সকল নির্দেশনার আলোকে এবং কুরআন-হাদীসের সকল বক্তব্যের সামগ্রিক সমন্বিত অর্থের উপর নির্ভর করে সাহাবীগণ এবং তাদের অনুসারী পরবর্তী সকল যুগে মুসলিম উম্মাহর মূলধারার, অর্থাৎ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মুসলিমগণ ঈমানের দাবিদার কাউকে কাফির বলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন

তাদের মুলনীতি - যে, মুমিন নিজের ঈমানের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকবেন। সকল কুফর, শিরক, পাপ, অন্যায়, অবাধ্যতা ইসলামী মূল্যবোধ বিরোধী চিন্তাচেতনা থেকে সতর্কতার সাথে আত্মরক্ষা করবেন। কিন্তু অন্যের ঈমানের দাবি গ্রহণ করার বিষয়ে বাহ্যিক দাবির উপর নির্ভর করবেন। কোনো ঈমানের দাবিদারকেই কাফির না বলার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন। ভুল করে কোনো মুমিনকে কাফির মনে করার চেয়ে ভুল করে কোনো কাফিরকে মুসলিম মনে করা অনেক ভাল নিরাপদ। প্রথম ক্ষেত্রে কঠিন পাপ নিজের ঈমান নষ্ট হওয়ার ভয় রয়েছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কোনোরূপ পাপ বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ এক্ষেত্রে মানুষের মুখের দাবির উপর নির্ভর করতেই হাদীসে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পেট চিরে মনের কথা বের করার নির্দেশ দেওয়া হয় নি
নীতির ভিত্তিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছেন, তাকে কোনো পাপের কারণেঅমুসলিম’, কাফির বা ধর্মত্যাগী বলে গণ্য করা যাবে না, তিনি তার পাপ থেকে তাওবা করুন, অথবা নাই করুন, যতক্ষণ না তিনি সুষ্পষ্টভাবে ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী কোনো বিশ্বাস পোষণ করার ঘোষণা দিবেন। ইসলামী আইন লঙ্ঘনকারী, বা আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী মুসলিম পাপী মুসলিম বলে গণ্য হবেন। কখনোই তাকে পাপের কারণে অমুসলিমবা ধর্মত্যাগী বলে গণ্য করা হবে না। তবে যদি তার পাপ বা অবাধ্যতাকে তিনি বৈধ মনে করেন বা ইসলামী বিধানকে বাজে, ফালতু, অচল বা অপালনযোগ্য বলে মনে করেন, তবে তা কুফরী বা ধর্মত্যাগ বলে গণ্য হবে

তিনি যদি এমন কোনো মতবাদ, বিশ্বাস, আকীদা বা মতাদর্শ গ্রহণ করার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেন যা ইসলামী বিশ্বাসের সাথে বাহ্যত সাংঘর্ষিক হলেও তার একটি ইসলাম গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান সম্ভব তবে তাকে তার মতবাদ বা আকীদার কারণে কাফির বলা হবে না, বরং বিভ্রান্ত বলা হবে। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী বিশ্বাস পোষণ করা বা কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত বিশ্বাস বা কর্ম অস্বীকার করার ক্ষেত্রে জেনে বুঝে সরাসরি অস্বীকার করা, ব্যাখ্যা সাপেক্ষ অস্বীকার করা এবং না জেনে অস্বীকার করার মধ্যে পার্থক্য করেছেন মুসলিম উম্মাহর ইমাম আলিমগণ।[5]

ঈমানের দাবিদার জেনে শুনে কুফরী করবেন না বলেই ধরে নিতে হবে। কারো কথা, মতামত বা কর্ম বাহ্যত কুফরী হলেও যদি তার কোনোরূপ ইসলাম সম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া যায় তবে দূরবর্তী হলেও ইসলামী ব্যাখ্যা গ্রহণ করে তাকে মুমিন বলে মেনে নিতে হবে। সর্বোপরি ঈমানের দাবিদার কোনো ব্যক্তি যদি সুস্পষ্ট কোনো কুফরী বা শিরকী কাজে লিপ্ত হয়, তবে তার কর্মকে কুফরী বলা হলেও ব্যক্তিগতভাবে তাকে কাফির বলার আগে বিষয়ে তার কোনো ওযর আছে কিনা তা জানতে হবে। সে ব্যক্তি অজ্ঞতা, ভয়, ব্যাখ্যা বা অন্য কোনো ওজরের কথা উল্লেখ করলে তা গ্রহণ করা হবে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত বা মূলধারার মুসলিম উম্মাহর দৃষ্টিতে হলো ইসলামের অন্যতম মূলনীতি।[6]

মূলনীতির কারণেই সাহাবীগণ কখনো খারিজীদেরকে কাফির বলেন নি। খারিজীগণ কুরআন-সুন্নাহর সাথে ব্যাহত সাংঘর্ষিক মতবাদ গ্রহণ করেছে, সাহাবীগণকে কাফির বলেছে, নির্বিচারে মুসলিমদেরকে হত্যা করেছে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, তারা ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে আবার তা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যাবে, তিনি এদের সাথে যুদ্ধ করতে এদেরকে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন, সাহাবীগণ তাদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু কখনো আলী (রা) বা অন্য কোনো সাহাবী তাদেরকে কাফির বলে ফাতওয়া দেন নি। বরং তাঁরা এদের সাথে মুসলিম হিসেবেই মিশেছেন, কথাবার্তা বলেছেন, আলোচনা করেছেন। এমনকি এদের ইমামতিতে সালাত আদায় করেছেন। যুদ্ধের ময়দানে বা বিচারের কাঠগড়ায় ছাড়া কখনোই এদেরকে হত্যা করার অনুমতি দেন নি।[7]

[1] কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃ. ৩৫৪-৫২২
[2]
ইবনু মাজাহ, আস-সুনান /১৩৪৪, হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৫২০, ৫৮৭; ইবনু কাসীর, আন-নিহায়াতু ফিল ফিতানি ওয়াল মালাহিম /১০; বুসিরী, মিসবাহুয যুজাজাহ /১৯৪; আলবানী, সহীহাহ /৮৭ সহীহু সুনানি ইবন মাজাহ /৩৭৮
[3]
বুখারী, আস-সহীহ /২২৬৩-২২৬৪; মুসলিম, আস-সহীহ /৭৯
[4]
বুখারী, আস-সহীহ /২২৪৭, ২২৬৪
[5]
কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃ. ৫১৭-৫২২, ৫৬৭-৫৬৮, ৫৯৭-৫৯৮
[6]
আবু হানীফা নুমান ইবনু সাবিত (১৫০ হি.), আল-ফিকহুল আকবার আকবার, মুল্লা কারীর শারহ সহ, পৃ. ১১৭; আবু জাফর তাহাবী, আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ (৩২১ হি.), আল-আকীদা আত-তাহাবীয়্যাহ, ইবনে আবীল হজ্জ হানাফীর শারহ সহ, পৃ. ৩১৬
[7]
তিরমিযী, আস-সুনান /১২৫; আবু দাউদ, আস-সুনান /৭৪, ১৪৬; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১১/১৫৫; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /৩১০, ৫৫৯, ৬৮৬; ইবনু তাইমিয়্যা, মাজমূউল ফাতাওয়া /২১৭-২১৮; . নাসির আল-আকল, আল-খাওারিজ, পৃ. ৪৭-৫৬

 . . . খারিজীগণের মতামত

কুরআন হাদীসের দুএকটি নির্দেশনাকে পুঁজি করে খারিজীগণ বাতিনীগণ পাপীকে কাফির বলে গণ্য করে। ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, অনেক কর্ম আছে যা কুরআন হাদীসের আলোকে স্পষ্টতই পাপ। যেমন, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মিথ্যাচার ইত্যাদি
খারিজীগণ শুধু এগুলিকেই কুফরী বলে গণ্য করেনি। উপরন্তু, তাদের মতের বিপরীত রাজনৈতিক কর্ম বা সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যার মাধ্যমেপাপবলে গণ্য করেছে, এরপর তারা সে পাপকে কুফরী বলে গণ্য করে সংশি­ষ্ট ব্যক্তিকে কাফির আখ্যা দিয়েছে। প্রকৃত পক্ষে খারিজীগণের কাফির-কথনের মূল ভিত্তিপাপনয়, বরংরাজনৈতিক মতাদর্শ তারা তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী নয় এরূপ সকল মুসলিমকে কাফির বলে গণ্য করত
আলী (রা) তাঁর পক্ষের মানুষেরা কেউ চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার বা কুরআন নির্দেশিত অনুরূপ কোনো পাপ বা অপরাধে লিপ্ত হন নি। আলী (রা) তাঁর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রক্তপাত বন্ধ করতে সালিসের বা আপোসের চেষ্টা করেছেন। তাঁর কর্মের পক্ষে কুরআন হাদীসের সমর্থন রয়েছে। অন্য অনেকে তার সাথে তার কর্মে অংশগ্রহণ না করলেও তাঁর কর্মের যৌক্তিকতা অনুভব করেছেন। খারিজীগণ তাদের মনগড়া ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এদের সকলকেই কাফির বলে আখ্যায়িত করেছে। এতেই তারা খান্ত হয় নি, তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে এবং তাদের ধনসম্পদ লুটতরাজ করে ইসলাম বা সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছে। পক্ষান্তরে তাদের অনেকেই তাদের মধ্যকার অনেক পাপীকেই কাফির মনে করত না।[1]

‘‘
জামাআতুল মুসলিমীন’’ ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার নীতি গ্রহণ করেন। মুমিনকে কাফির বলার ক্ষেত্রে তারা কোনোরূপ কৃপণতা করেন নি। তাদের কাফির কথনের পর্যায় নিম্নরূপ:
. কবীরা গোনাহ বা পাপে লিপ্ত মুমিনকে কাফির বলা
. তাদের মতের বিরোধী সকল আলিম মুসলিমকে কাফির বলা
. তাদের মতের সমর্থক কেউ কোনো বিষয়ে মতভেদ করলে বা দলত্যাগ করলে তাকে কাফির বলা
. সমকালীণ সকল মুসলিম দেশ, রাষ্ট্র সমাজকে কাফির বলা জাহিলী সমাজ বলে আখ্যায়িত করা
. যে সকল মুসলিম এরূপ ‘‘জাহিলী সমাজ’’ থেকে হিজরত করে তাদের নেতার হাতে বাইয়াত করে তাদের ‘‘জামাআতে’’ বা দলে যোগ দেয় নি তাদের সকলকে কাফির বলা
. তাদের মতে যারা কাফির তাদেরকে যারা কাফির বলে গণ্য না করে তাদেরকেও কাফির বলা।[2]

অনেক পাঠকের কাছে বিষয়টি হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত বিষয় হলো, মুমিনকে কাফির বলাই সকল উগ্রতা সন্ত্রাসের মূল। জন্য বিশেষভাবে ‘‘জামাআতুল মুসলিমীনের’’ কাফির কথন নীতি বিষয়ে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন। কারণ যে কোনো মুসলিম সমাজে যারা দীনের নামে উগ্রতা, সন্ত্রাস বা শক্তিপ্রয়োগে লিপ্ত তারা জেনে অথবা না জেনে এদের মতামতগুলি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। এছাড়া সমকালীন অনেক সুপ্রসিদ্ধ প্রাজ্ঞ আলিম গবেষকের লিখনির মধ্যে কিছু কথা মতামত অনেক সময় তাদের বিভ্রান্তির পক্ষে বলে বাহ্যত মনে হয় এবং তারা তাদের বিভ্রান্তির পক্ষে এগুলিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে। সকল আলিমের বক্তব্য যেন এভাবে ভুল বুঝা না হয় এবং অনুরূপ বিভ্রান্তির শিকার অন্যরা না হয় সেজন্য বিষয়গুলি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। তাদের দলের বাইরে সকল মুমিনকে কাফির বলার ক্ষেত্রে তাদের মতবাদের কয়েকটি দিক নিম্নরূপ:

[1] বাগদাদী, আল-ফারক, পৃ. ৭২-৭৩; . আহমদ, দিরাসাতুন আনিল ফিরাক, পৃ. ৬৩-৬৮
[2]
সালিম বাহনসাবী, আল-হুকুম ওয়া কাদিয়্যাতু তাকফীরিল মুসলিম; মুহাম্মাদ সুরুর ইবন নাইফ যানুল আবিদীন, আল-হুকুম বিগাইরি মা আনযালাল্লাহ ওয়া আহলুল গুলূ . নাসির ইবনু আব্দুল কারীম আল-আকল, আল-খাওারিজ, পৃ: ১৩২-১৪১, . আহমদ মুহাম্মাদ জলি, দিরাসাতুন আনিল ফিরাক, পৃ. ১০৮-১৪৯

 . . . আইন, শাসন, বিধান মতবাদ

জামাআতুল মুসলিমীনও প্রাচীন খারিজীদের মত দাবি করে যে, মুসলিম দাবিদার যদি ইসলামের কোনো অনুসাশন লঙ্ঘন করে তবে সে কাফির হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ্য করি যে, তারা মূলত রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীকেই কাফির বলেন। বড় ফরয ছোট ফরযে তত্ত্ব দিয়ে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে বড় ফরয বলে দাবি করে সে অযুহাতে ছোট ফরয নাম দিয়ে তারা অনেক ফরয ইবাদত বর্জন করত এবং হারাম কর্মে লিপ্ত হতো, যেগুলি কুরআন হাদীসে স্পষ্টতই পাপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ পাপের কারণে তারা অনেক আলিম ইসলামী ব্যক্তিত্বকে কাফির-মুরতাদ ফতওয়া প্রদান করে তাদের হত্যা করেছে। যেমন ‘‘ধর্মনিরপেক্ষ’’ বা ‘‘তাগূতী’’ সরকারকে সহযোগিতা করে বা মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে কাফির হয়ে গিয়েছেন বলে দাবি করে তারা সুপ্রসিদ্ধ আলিম গবেষক . যাহাবীকে হত্যা করে

খারিজীগণ ‘‘হুকম’’ বা বিধান প্রদানকে তাদের মতবাদের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করে। তারা তাদের মতবাদ প্রমাণের জন্য (إن الحكم إلا لله) অর্থাৎ ‘‘হুকুম কেবলমাত্র আল্লাহরই জন্য’’- কুরআনের বাণীটিকেই মূলত পেশ করে। বাণীর ভিত্তিতে কখনো তারা (لا حاكم إلا لله) ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো হাকিম (হুকমদাতা, আইনদাতা বা ফয়সালাকারী) নেই’’ কথাটিকে (لا اله الا الله) ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইল্লাহ (মাবূদ বা উপাস্য) নেই’’ কথাটির মত তাওহীদ ঈমানের মূল ভিত্তি হিসাবে গণ্য করেছে। কখনো তারা (لا اله الا الله) আল্লাহ ছাড়া কোনো ইল্লাহ নেই’’ কালিমাটির অর্থ করেছে ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো হাকিম বা হুকুমদাতা নেই’’ অর্থাৎ তার ইল্লাহ মানেই ‘‘হাকিম’’ বা ‘‘হুকুমদাতা’’ বলে দাবি করেছে

এভাবে তারা দাবি করত যে, আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম দানের অধিকার নেই কথা বিশ্বাস করাই ঈমান। আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম দেওয়ার অধিকার প্রদান করা বা কারো বিধান মানাই কুফর। আর পাপ মানেই তো আল্লাহ ছাড়া অন্যের হুকুম মানা। কারণ মানুষ শয়তান, নিজ প্রবৃত্তি বা অন্য কারো হুকুমেই আল্লাহর হুকুম অমান্য করে। তাদের সকল দাবি সত্য মিথ্যার সংমিশ্রন। এজন্য বিষয়ে আলী (রা) বলতেন:

(كلمة حق أريد بها الباطل)

‘‘একটি সত্য কথাকে বাতিল অর্থে পেশ করা হচ্ছে’’[1]
বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদের রুবূবিয়্যাত উলূহিয়্যাতের দুটি দিক আমাদের ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করা প্রয়োজন। তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত (প্রতিপালনের একত্ব) তাওহীদুল উলূহিয়্যাত (ইবাদতের একত্ব) বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে।[2] এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, আল্লাহর তাওহীদের দুটি দিক রয়েছে: রবব বা প্রতিপালক হিসেবে তার একত্ব এবং ইল্লাহ বা উপাস্য হিসেবে তার একত্ব। রবব বা প্রতিপলক হিসেবে তার একত্বের মধ্যে রয়েছে তাঁর মহান গুণাবলির একত্ব

উক্ত গ্রন্থে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ‘‘রবব’’ বলা যায়, কিন্তুইল্লাহ’’ বলা যায় না।ইল্লাহঅর্থ উপাস্য বা মাবূদ। যাকে উপাসনা, আরাধনা বা অলৌকিকভাবে ভক্তি করা হয় তাকেই ইল্লাহ বলা হয়। এজন্য আরবের মানুষেরা সূর্যকেইলাহাহবলত। এছাড়া কুরআনে মুর্তি প্রতিমাসমূহকে ইল্লাহ বলা হয়েছে। মুশরিকগণ এগুলির আনুগত্য করত না বা এগুলিকে হুকুমদাতা, আইনদাতা বা বিধানদাতা বলে বিশ্বাস করত না। বরং এগুলিকে আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিত্ব আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্কের কারণে মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গলে বিশেষ ক্ষমতা বা সুপারিশের মালিক বলে বিশ্বাস করে সাজদা, প্রণতি, মানত, প্রার্থনা ইত্যাদি কর্মের মাধ্যমে এগুলির ইবাদত, বন্দনা বা পূজা করত

হুকুম বা নির্দেশ প্রদান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের অংশ। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউআল্লাহর মত হাকিমহতে পারেন না, কিন্তু হাকিম হতে পারেন। কিন্তু কেউ আল্লাহর মত বা আল্লাহর চেয়ে নিম্নমানের মাবূদ হতে পারে না। কুরআন কারীমে অনেক স্থানে বলা হয়েছে যে, ‘‘হুকুম শুধু আল্লাহরই’’[3] এবং একমাত্র আল্লাহকেই ‘‘হাকিম’’ বা ‘‘হাকাম’’ বা হুকুমদাতা বা ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[4] আবার অনেক স্থানে আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে হুকুম, নির্দেশ, বিধান ফয়সালা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং মানুষকে হাকিম বা হাকাম অর্থাৎ হুকুমদাতা, বিধানদাতা বা ফয়সালাদাতা হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি নবী-রাসূলগণকে ‘‘হুকম’’ বা বিধান রায় প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেছেন।[5]

আল্লাহ বলেন:

وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا

‘‘আর তোমরা যদি তাদের (স্বামী-স্ত্রীর) উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন হুকুমদাতা (বিচারক) এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন হুকুমদাতা (বিচারক) পাঠাও। যদি তারা মিমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।’’[6]
এখানে মহান আল্লাহ মানুষের মধ্য থেকে বিধানদাতা নিয়োগের নির্দেশ প্রদান করেছেন, যারা নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি বিবেকের আলোকে বিষয়ে বিধান প্রদান করবেন। এছাড়া অন্যান্য স্থানে জাগতিক বিষয়াদিতে মানুষদেরকে বিধান প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[7]

এভাবে আমরা দেখছি যে, ‘‘হাকিম’’ বা ‘‘হাকাম’’ মহান আল্লাহর পবিত্র গুণবাচক নামসমূহের অন্যতম। এগুলি তাঁর রুবূবিয়্যাতের গুণাবলির অন্যতম। তবে ইল্লাহ অর্থহাকিমবাবিধানদাতানয়। ইল্লাহ অর্থ মাবূদ। আমরা একটু পরে ইবাদত আনুগত্যের পার্থক্য আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। ইবাদত বিষয়ক শিরক-কুফর আর হুকুম বিষয়ক শিরক-কুফর এক নয়। হুকুম বিষয়ক শিরক-কুফর সম্পর্কে আমি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি।[8]

ইসলামে আল্লাহ ছাড়া কাউকে কোনোভাবে ইবাদত করার বা ইবাদত গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় নি। আল্লাহর পক্ষ থেকে, আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে, অধস্তন হিসেবে বা অন্য কোনোভাবে কেউ ইবাদত পেতে পারে না বা মাবূদ হতে পারে না। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে বা নিজের স্বকীয়তার সাথে অন্য কেউ ‘‘হাকিম’’ হতে পারে বা হুকুম দিতে পারে। মানুষকে হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান, রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাইতুল মালের সম্পদে শাসকের যথেচ্ছ অধিকার প্রদান ইত্যাদি কুরআন বিরোধী বামানব রচিতআইনের কারণে খারিজীগণ আলী (রা), মুআবিয়া (রা) পরবর্তী শাসকদেরকে কাফির বলেছে। অনুরূপভাবে শুকরী তার অনুসারীরা উপনিবেশ-উত্তর মুসলিম দেশগুলির শাসকদেরকেইসলাম-বিরোধী আইন প্রচলনের জন্য কাফির বলে ঘোষণা করে। মিশরের সকল প্রসিদ্ধ আলিম এদের সকল কথার বিভ্রান্তি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন ইখওয়ানুল মুসলিমীন সংগঠনের নেতা হাসান হুদাইবী। তাদের বক্তব্যের সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ:[9]

প্রথমত: মানুষের জন্য আইন রচনা নিষিদ্ধ নয়। আল্লাহর দীন সকল যুগের সকল দেশের সকল মানুষের জন্য। এজন্য এর মধ্যে ব্যাপক প্রশস্ততা দান করেছেন আল্লাহ। সুনির্দিষ্ট কিছু বিধিবিধান মূলনীতি ছাড়া বাকি সকল ক্ষেত্রে দেশ, জাতি যুগের প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় আইনকানুন বিধিবিধান তৈরির সুযোগ নির্দেশ আল্লাহ মানুষদেরকে প্রদান করেছেন

দ্বিতীয়ত: ‘মানব রচিতসকল আইনই ইসলাম বিরোধী নয়। মুসলিম দেশগুলিতে কিছু ঔপননেবশিক আইন-কানুন রয়েছে যেগুলি ইসলাম বিরোধী, এছাড়া অধিকাংশ আইন বিচারপদ্ধতি ইসলাম সম্মত

তৃতীয়ত: আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান মত ফয়সালা না করাকে কুফরী বলা হলেও কুরআনে আল্লাহর বিধানের বিপরীত ফয়সালাকারীকেও মুমিন বলা হয়েছে। সাহাবীগণ মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ বলেন যে, যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামী বিধানানুসারে বিচার করা অপ্রয়োজনীয় অথবা ইসলামী আইনকে অচল বা বাতিল মনে করেন তবে তিনি কাফির বলে গণ্য হবেন। পক্ষান্তরে তিনি যদি ইসলামের নির্দেশকে সঠিক জেনেও অজ্ঞতা, ভয়, লোভ, বাধ্যবাধকতা বা অনুরূপ কোনো জাগতিক কারণে ইসলাম বিরোধী ফয়সালা দেন তবে তা কুফরী বলে গণ্য হবে না। যেমন, মদ ইসলামে হারাম মদপান প্রমাণিত হলে বেত্রাঘাতের বিধান দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি ইসলামের বিধান জানার পরেও মদ বৈধ মনে করেন অথবা মদপানের জন্য শাস্তি প্রদানকে আপত্তিকর বা অমানবিক মনে করেন তবে তিনি কাফির বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যদি কেউ মদের অবৈধতা বিশ্বাস করেন এবং মদপানের জন্য শাস্তি দেওয়াই সঠিক বলে মনে করেন, কিন্তু প্রচলিত আইনে সুযোগ না থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মদপানকারীকে শাস্তি দিতে অপারগ হন, অথবা জাগতিক কোনো প্রাপ্তি, লোভ বা স্বার্থের জন্য শাস্তি না দেন তবে তিনি পাপী বলে গণ্য হবেন। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম। কেউ যদি ইসলামের বিধানকে অচল, আপত্তিকর বা অমানবিক মনে করে তা রহিত করে আইন প্রণয়ন করে তবে তা কুফরী। অথবা কেউ যদি মনে করেন যে, আল্লাহ যে বিধানই প্রদান করুন না কেন, আমাদের অধিকার আছে আল্লাহর হারামকে হালাল করা বা হালালকে হারাম করা, তবে তিনিও কাফির বলে গণ্য হবেন। আর যদি কেউ ইসলামের বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে, বা ইসলামের বিধানকে সঠিক বিশ্বাস করা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রচলিত ইসলাম বিরোধী আইনগুলি ব্যক্তিগত বা দলগত অসুবিধা বা স্বার্থে পরিবর্তন না করেন তবে তিনি পাপী বলে গণ্য হবেন

চতুর্থত: আধুনিক বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ- যেমন সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির মধে ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়াদি রয়েছে। আবার সকল মতবাদের মধ্যে ইসলাম সমর্থিত অনেক বিষয় আছে। অজ্ঞতা আবেগের কারণে আধুনিক রাজনৈতিক মতবাদকে ‘‘কুফরী’’ বলার একটি উদাহরণ ‘‘গণতন্ত্র’’-কে কুফরী মতবাদ বলে আখ্যায়িত করা। ইসলাম গণতন্ত্র উভয় বিষয়ের প্রগাঢ় অজ্ঞতাই এরূপ মতপ্রকাশের কারণ। গণতন্ত্রের প্রয়োগ বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন রকম হলেও গণতন্ত্রের মূল প্রেরণা ইসলামের। গণতন্ত্র ইসলামের শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার বাস্তব প্রয়োগের একটি পথ। তবে ইসলামের নির্দেশ বাতিল বা পরিবর্তন করার ক্ষমতা গণপ্রতিনিধিদের আছে বলে বিশ্বাস করা কুফর। আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, ইসলাম যে রাষ্ট্রব্যবস্থা দিয়েছে তাকে আধুনিক পরিভাষায় ‘‘গণতান্ত্রিক’’ বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই

আল্লাহ মানবজাতিকে জাতি গোত্রে বিভক্ত করেছেন পরিচয়ের জন্য। জাতির প্রতি প্রেম, দায়িত্ববোধ জাতীয় পরিচয়ের গৌরব অর্থে জাতীয়তাবাদ ইসলমের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। মানুষ পিতামাতাকে যেমন ভালবাসে, তেমনি ভালবাসে নিজের দেশ জাতিকে। পিতামাতা বা দেশজাতির প্রতি ভালবাসা আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সাঃ) ইসলামের প্রতি ভালবাসার অন্তরায় নয়। তবে যদি যদি কেউ পিতামাতা বা দেশজাতির ভালবাসা পরিচয়কে আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সাঃ) ইসলামের প্রতি ভালবাসা ইসলামী পরিচয়ের চেয়ে বড় মনে করে তবে তা তার ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক। ধর্মরিপেক্ষতার দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, ধর্মকে সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ন্যায়বিচার, প্রশাসন, অর্থ রাষ্ট্রসংশি­ষ্ট ধর্মীয় বিধানগুলি বাতিল, অচল বা প্রয়োগঅযোগ্য বলে বিশ্বাস করা। প্রথম বিষয়টি ইসলাম নির্দেশিত ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি দ্বিতীয় বিষয়টি ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক কুফর

এভাবে আমরা দেখছি যে, বিভিন্ন আধুনিক রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় মতবাদের মধ্যে ভাল মন্দ রয়েছে। এগুলির মধ্যে বিদ্যমান ইসলামী মূল্যবোধ বিরোধী বিষয়াদির সমালোচনা করা মুমিনের দায়িত্ব। কিন্তু এগুলির কারণে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাফির বলা মুমিনের জন্য ভয়ঙ্কর বিষয়। মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘ ইতিহাসে ধরনের মতবাদের চেয়েও সুস্পষ্ট কুফরী মতবাদে বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তি বা ফিরকাকেও সাহাবী-তাবিয়ীগণ মূলধারার আলিমগণ কাফির বলে গণ্য করেন নি। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করে হলেও কাউকে মুমিন বলা সুযোগ রয়েছে বা ব্যাখ্যা করে হলেও তার কুফরী কথা বা মতকে কুফরী নয় বলে গণ্য করার সুযোগ রয়েছে ততক্ষণ তারা কাউকে কাফির বলেন নি।[10]

সকল ক্ষেত্রে যিনি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছেন, তার ইসলাম বিরোধী কাজের কারণে তাকে কাফির বলা যায় না। তিনি যদি এমন কাজ করেন, কথা বলেন বা মত গ্রহণ করেন যা কুফরী হতে পারে আবার পাপও হতে পারে, তবে কাজটিকে পাপ বলেই মনে করতে হবে, কুফরী মনে করা যাবে না, যতক্ষণ না তিনি নিজে স্পষ্টভাবে তার কুফরীর কথা ঘোষণা করবেন। এমনকি তারমুনাফিকীবা মিথ্যাচার বুঝা গেলেও সেই বুঝ দ্বারা তার সম্পর্কে বিধান প্রদান করা যাবে না, বরং তার বাহ্যিক কথার উপরেই নির্ভর করতে হবে।[11]

সর্বোপরি, রাষ্ট্র, সরকার, শাসক, বিচারক বা কোনো ব্যক্তিকে কাফির বলা বা তার কর্মকে কুফরী বলা এক কথা আর তাকে শাস্তি দেওয়া, বিচার করা বা কোনোভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া অন্য কথা। দুএর মধ্যে আসমান যমিনের দূরত্ব। একমাত্র রাষ্ট্র ছাড়া কেউ বিচার করতে পারে না বা শাস্তি দিতে পারে না। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে ব্যক্তি বা দল সে জন্য রাষ্ট্রকে আহবান করবে, দাবি করবে পরিবর্তনের চেষ্টা করবে, কিন্তু কখনোই আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না

[1] আব্দুর রাযযাক সানআনী, তাফসীর আব্দুর রাযযাক /১১৮
[2]
কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃ. ৮২-১১৪, ৩৬৬-৫১৭
[3]
সূরা () আনআম: আয়াত ৫৭; সূরা (১২) ইউসুফ: আয়াত ৪০ ৬৭; সূরা (২৮) কাসাস: ৭০ ৮৮
[4]
সূরা () আনআম: আয়াত ১১৪
[5]
সূরা আল ইমরান ৭৯ আয়াত; সূরা আনআম ৮৯; সূরা মারইয়াম: ১২ আয়াত; সূরা জাসিয়াহ: ১৬ আয়াত
[6]
সূরা () নিসা: আয়াত ৩৫
[7]
সূরা () মায়িদা: ৯৫ আয়াত
[8]
কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃ. ৮২-১১৪, ৩৬৬-৫১৭
[9]
. হাসান হুদাইবি, দুআতুন লা কুদাত; সালিম বাহনসাবী, আল-হুকুম ওয়া কাদিয়্যাতু তাকফীরিল মুসলিম মুহাম্মাদ সুরুর ইবন নাইফ যানুল আবিদীন, আল-হুকুম বিগাইরি মা আনযালাল্লাহ ওয়া আহলুল গুলূ . নাসির ইবনু আব্দুল কারীম আল-আকল, আল-খাওারিজ, পৃ: ১৩২-১৪১, . আহমদ মুহাম্মাদ জলি, দিরাসাতুন আনিল ফিরাক, পৃ. ১০৮-১৪৯
[10]
কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃ. ৫৯৭-৫৯৮
[11]
বিস্তারিত দেখুন: ইসলামী আকিদা, পৃ. ৫১৭-৫২২

 . . . আনুগত্য বনাম ইবাদত

ইল্লাহ অর্থ হুকুমদাতা বলে দাবি করার অপর দিক হলো হুকুম মানা বা আনুগত্য করাকেই ইবাদত বলে দাবি করা। প্রাচীন আধুনিক খারিজীগণ দাবি করেন যে, হুকুম প্রদানই উলূহিয়্যাত এবং হুকুম মানাই ইবাদত। কাজেই আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানা আনুগত্য করা শিরক। এজন্য সকল কাফির সরকারের আনুগত্যকারী সকল নাগরিকই কাফির। তারা দাবি করেন যে, আনুগত্যই যে ইবাদত তা কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে জানা যায়। যেমন আল্লাহ বলেছেন:

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পন্ডিতগণকে এবং সংসার-বিরাগীগণকে রবব-মালিক রূপে গ্রহণ করেছে, এবং মরিয়ম তনয় মাসীহকেও। কিন্তু তারা শুধু এক ইলাহের ইবাদত করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত কোনো ইল্লাহ নেই। তারা যা শরিক করে তা থেকে তিনি কত পবিত্র!’’[1] আয়াত থেকে জানা যায় যে, ইহূদী-খৃস্টানগণ তাদের পন্ডিত দরবেশগণকে আল্লাহ ছাড়া রবব হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদের ইবাদত করে। হাদীসের আলোকে জানা যায় যে, তারা পন্ডিত-দরবেশদের পূজা-অর্চনা বা সাজদা-প্রার্থনা করে নি। বরং তারা তাদের আনুগত্য করেছে

গুতাইফ ইবনু আইউন নামক দ্বিতীয় শতকের একজন প্রায় অজ্ঞাত- পরিচয় তাবি-তাবিয়ী বলেন, প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুসআব ইবনু সা ইবনু আবী ওয়াক্কাস (১০৩ হি) তাকে বলেছেন, সাহাবী আদী ইবনু হাতিম (রা) বলেন,

سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقرأُ في سورةِ براءةٌ (اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ) قالَ أما إنَّهم لم يَكونوا يعبدونَهم ولَكنَّهم كانوا إذا أحلُّوا لَهم شيئًا استحلُّوهُ وإذا حرَّموا عليْهم شيئًا حرَّموه

‘‘আমি শুনলাম রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সূরা তাওবায় পাঠ করছেন: ‘তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পন্ডিতগণকে এবং সংসার-বিরাগীগণকে রবব-মালিক রূপে গ্রহণ করেছে তিনি বললেন, ইহূদী-খৃস্টানগণ তাদের (আলিম-দরবেশদের) ইবাদত করত না বটে, কিন্তু তারা যখন তাদের জন্য কোনো কিছু হালাল করে দিত, তখন তারা তাকে হালাল বলে মেনে নিত। আর তারা যখন তাদের উপর কোনো কিছু হারাম করে দিত, তখন তারা তা হারাম বলে মেনে নিত।’’[2]
ইমাম তাবারী তাঁর তাফসীরে গুতাইফের সূত্রে হাদীসটি সংকলন করেছেন। তার বর্ণনায় হাদীসটির ভাষা নিম্নরূপ:

قلت يا رسول الله إنَّا لسنا نعبدُهم فقال : أليسَ يحرمونَ ما أحلَّ اللهُ فتحرِّمونَه ، ويحلُّونَ ما حرَّمَ اللهُ فتحلُّونَه ، قال : قلتُ : بلى ، قال : فتلك عبادتُهم

‘‘রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে উক্ত আয়াতটি পাঠ করতে শুনে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তো তাদের ইবাদত করি না! তিনি বলেন, আল্লাহ যা হালাল করেছেন তারা তা তোমাদের জন্য হারাম করলে তোমরা কি তা হারাম বলে বিশ্বাস কর না? আর আল্লাহ যা হারাম করেছেন তারা তা হালাল করলে তোমরা কি তা হালাল বলে মেনে নাও না? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেন, এই তাদের ইবাদত করা।’’[3]
তারা বলেন, থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে আনুগত্যই ইবাদত। আল্লাহর আইনের ব্যতিক্রম বা বিপরীত আইন প্রদানকারীর আনুগত্য করলেই শিরক হবে। এখানে লক্ষণীয় যে, হাদীসটির সনদ দুর্বল। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘ হাদীসটি গরীব, ... গুতাইফ ইবনু আইউন হাদীস বর্ণনায় পরিচিত নয়।[4]
অর্থে সাহাবীগণ থেকে তাফসীর বর্ণিত হয়েছে। হুযাইফা (রা), ইবনু আববাস (রা) প্রমুখ সাহাবী বলেছেন, ইহূদী-খৃস্টানদের পন্ডিত-দরবেশগণ যখন আল্লাহর বিধান উল্টে হালালকে হারাম হারামকে হালাল করত তখন তারা তা মেনে নিত। আর আনুগত্যই ছিল তাদের রব মানা।[5]
মহান আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেছেন:


وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰ أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

‘‘যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় নি তার কিছুই ভক্ষণ করো না। তা অবশ্যই পাপ। শয়তান তার বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররোচনা দেয়; যদি তোমর তাদের আনুগত্য কর তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হবে।’’[6]
তাদের মতে আয়াত প্রমাণ করে যে, আনুগত্যই শিরক; কারণ আল্লাহ বলেছেন, তোমরা তাদের আনুগত্য করলে মুশরিক হয়ে যাবে। তাদের সকল প্রমাণের বিভ্রান্তি বুঝতে হলে কুরআনের আলোকে ইবাদতের অর্থ বুঝতে হবে। এখানে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়:

(
) কুরআনে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবাদত এমন একটি কর্ম যা কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য করা যাবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন বলে বিশ্বাস করাই শিরক। পরবর্তী অনুচ্ছেদেতাগূতবিষয়ক আয়াতগুলি থেকে আমরা জানতে পারব যে, ঈমানের ভিত্তিই হলো একমাত্র আল্লাহকেই ইবাদতের যোগ্য বলে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতা আছে তা অস্বীকার করা। সকল যুগে সকল নবী-রাসূল তার উম্মাতকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন। এজন্য বিভিন্ন শরীয়তে বিধি-বিধানের পার্থক্য থাকলেও বিষয়ে কোনো পার্থক্য ছিল না। কোনো শরীয়তেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদতের অনুমতি দেওয়া হয় নি। আল্লাহ ছাড়া কারো সম্মানে সালাত আদায়, অন্য কারো উদ্দেশ্যে কুরবানী, উৎসর্গ বা বলি দেওয়া, অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা, অন্য কারো উপর নির্ভর করা, পূজা-অর্চনা করা ইত্যাদি সকল শরীয়তেই নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে আল্লাহ ছাড়া অন্যের আনুগত্যের অনুমতি নির্দেশ সকল শরীয়তেই প্রদান করা হয়েছে। আর যে কর্ম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য পালনের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে তা সরাসরি ইবাদত হতে পারে না। তবে বিশেষ অবস্থায় বা বিশেষ বিশ্বাসের সাথে তাইবাদতবলে গণ্য হতে পারে

(
) ইবাদত শব্দটি আভিধানিকভাবেআবদবাদাসশব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতেউবূদিয়্যাতইবাদতদুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবূদিয়্যাত ব্যবহৃত হয় লৌকিক বা জাগতিক দাসত্বের ক্ষেত্রে। আরইবাদতবুঝানো হয় অলৌকিক অজাগতিক দাসত্বের ক্ষেত্রে। সকল যুগে সকল দেশের মানুষই জীবন, মৃত্যু ইত্যাদি অতিপরিচিত শব্দের মতইইবাদতশব্দের অর্থ স্বাভাবিকভাবেই বুঝে। মানুষ অন্য মানুষের দাস হতে পারে বা দাসত্ব করতে পারে, তবে সে অন্য যে কোনো সত্তারইবাদতকরে না। শুধু মাত্র যার মধ্যে চূড়ান্ত ক্ষমতা, ইচ্ছা করলেই মঙ্গল করার বা অমঙ্গল করার বা তা রোধ করার সর্বময় বা বিশেষ শক্তি বা অলৌকিক অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা কল্পনা করে তারই ইবাদত করে
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ রাগিব ইসপাহানী (৫০২ হি) বলেন:

العبودية إظهار التذلل والعبادة أبلغ منها لأنها غاىة التذلل ولا يستحقها إلا من له غاية الأفعال (الإفضال)

উবূদিয়াত (slavery, serfdom, bondage) হলো বিনয়-ভক্তি বা নিজের হীনত্ব-ছোটত্ব প্রকাশ করা। আর ইবাদত (worship, veneration) এর চেয়েও অধিক গভীর অর্থজ্ঞাপক। কারণ ইবাদত হলো চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয় বা হীনত্ব প্রকাশ, যিনি চূড়ান্ত কর্ম-ক্ষমতা দয়ার মালিক তিনি ছাড়া কেউ চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয় পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।’’[7]
অন্যান্য আলিমও অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের ভাষায়:

العبادة على المعنى اللغوي غاية التذلل والافتقار والاستكانة

‘‘ইবাদতের আভিধানিক অর্থ হলো, চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয়, অসহায়ত্ব মুখাপেক্ষিত্ব।’’[8]

(
চূড়ান্ত বিনয়, অসহায়ত্ব ভক্তি প্রকাশ করে চূড়ান্ত ক্ষমতা করুণার অধিকারীর জন্য যে কর্ম করা হয় তা বিভিন্ন পর্যায়ের। তার কাছে যেমন প্রার্থনা করা হয় তেমনি তার প্রশংসাও করা হয়। সবই ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষ যা কিছু করে সবই ইবাদত বলে গণ্য। এজন্য ইবাদতের ব্যাখ্যায় বলা হয়:


اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة

‘‘আল্লাহ ভালবাসেন এরূপ সকল কথা, বাহ্যিক কর্ম হার্দিক বা মানসিক কর্ম সব কিছুই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।’’[9]
তবে সব কর্ম এক পর্যায়ের নয়। কিছু কর্ম আছে যা মানুষইবাদতহিসেবেই করে। যে সত্ত্বার এরূপ চূড়ান্ত ক্ষমতা আধিপত্য আছে তাকেই তা প্রদান করে। সকল সমাজের সকল ভাষার মানুষই এগুলি জানেন। পূজা, অর্চনা, বলি, কুরবানী, মানত, প্রার্থনা ইত্যাদি জাতীয় কর্ম। এগুলি শুধু ‘‘আস্তিকগণ’’- করেন, নাস্তিকগণ করেন না। ‘‘আস্তিক’’ ব্যক্তি তার বিশ্বাস অনুসারে যে সত্ত্বার মধ্যে ‘‘অলৌকিক’’ বাঐশ্বরিক’’ ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করেন তার জন্যই করেন। এগুলি সবই ‘‘চূড়ান্ত ভক্তি’’ বা ইবাদত। পাশাপাশি কিছু কর্ম আছে যা মানুষ ইবাদত হিসেবে করে, আবার জাগতিকভাবেও করে। যেমন প্রশংসা করা, ভয় করা, আনুগত্য করা ইত্যাদি। এগুলি মানুষ জাগতিকভাবে অন্য মানুষের জন্য করে। আবার তারমাবূদবা পূজিত সত্তার জন্যও করে। সকল কর্ম আস্তিক নাস্তিক সকলেই করেন। আস্তিক ব্যক্তি তার ‘‘উপাস্য’’-কে উদ্দেশ্য করেও করেন আবার জাগতিক বন্ধুবান্ধব গুরুজনদের উদ্দেশ্যেও করেন। নাস্তিক ব্যক্তি তার বন্ধুবান্ধব গুরুজনদের উদ্দেশ্যে সকল কর্ম করেন

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রথম প্রকারের কর্ম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করাই শিরক। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য সাজদা, মানত, বলি, উৎসর্গ, জবাই ইত্যাদি করা। এগুলি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করলে তা শিরক বলে গণ্য হবে। কারণ কারো ভিতরে ঈশ্বরত্ব (divinity, holiness, sacredness, sanctity) ঐশ্বরিক ক্ষমতা, চূড়ান্ত আধিপত্য, অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা, অলৌকিক শক্তি ইত্যাদি কল্পনা না করলে কেউ তার জন্য এরূপ কর্ম করে না। তবে ঈমানের দাবিদার কেউ তা করলে তার কাজকে শিরক বা কুফর বলা হলেও তাকে সরাসরি কাফির বা মুশরিক বলা হবে না। বরং সে অজ্ঞতার কারণে, ভুল করে বা বাধ্য হয়ে করেছে কিনা জানতে হবে এবং তার ব্যাখ্যাই গৃহীত হবে

(
পাশাপাশি অনেক কর্ম রয়েছে যা চূড়ান্ত পর্যায়ে ইবাদত বলে গণ্য হলেও সাধারণ ভাবে ইবাদত নয়। আনুগত্য, ভয়, ভালবাসা ইত্যাদি পর্যায়ের। ভয় আল্লাহর ইবাদত। কুরআন-হাদীসে বারংবার আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, উপরন্তু কেবলমাত্র আল্লাহকে ভয় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু এর মানে নয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা শিরক। মহান আল্লাহ বলেন:


وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَاهُ

‘‘তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছ আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন; তুমি মানুষদেরকে ভয় করছ, অথচ আল্লাকেই ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত।’’[10]
কেউই কল্পনা করবেন না যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মানুষকে ভয় করে শিরকে লিপ্ত হয়েছিলেন। বস্ত্তত, মানুষ প্রাকৃতিকভাবে মানুষ অন্যান্য সৃষ্টিকে ভয় পায়। এতে শিরক হবে বলে বলে কেউ মনে করবে না। এমনকি মানুষের ভয়ে, অস্ত্রের ভয়ে বা প্রাণ বাঁচানোর জন্য আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করাকেও কেউ শিরক বলবেন না। সর্বোপরি মানুষের ভয়ে বা জীবন বাঁচাতে সুস্পষ্ট শিরক করলেও তাকে শিরক বলে গণ্য করা হবে না।ভয়ইবাদত হওয়ার অর্থ হলো, শুধু চূড়ান্ত পর্যায়ের অলৌকিক, অপার্থিব বাআল্লাহর মত অন্য কাউকে ভয় পাওয়া শিরক বলে গণ্য হবে

পর্যায়ের ভয় মূলত কর্মের সাথে সম্পৃক্ত নয়, বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত।আল্লাহর মত অমুককে ভয় পাচ্ছেবললেই শিরক হয় না। বরং কোন্ বিশ্বাসের ভিত্তিতে সে ভয় পাচ্ছে তাই বিবেচ্য। মুলত বিশ্বাসই শিরক, কর্ম নয়। কেউ যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য সত্তাকে আল্লাহর মত অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অধিকারী বা কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক, জাগতিক নিয়মের বাইরে অলৌকিকভাবে ইচ্ছা করলেই ভাল-মন্দ করতে সক্ষম অথবা বা কোনোভাবে আল্লাহর ক্ষমতার অংশীদার বলে বিশ্বাস করে তবে তা শিরক হবে। বিশ্বাসজাত ভয়ের কারণে যদি সে রাস্তার ডান থেকে বামে চলে যায় তবুও তা শিরক। আর যদি মানবীয় ভয়ের কারণে সে আল্লাহর বিধানের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে শিরকে লিপ্ত হয়, তবুও তা শিরক বলে গণ্য হবে না

কাজেইভয়’-এর ক্ষেত্রে কর্ম নয় বিশ্বাসই বিবেচ্য। জবাই, উৎসর্গ, প্রার্থনা, সাজদা বা মানতের ক্ষেত্রে যেমন কর্মই মূলত শিরক প্রমাণ করে, ব্যাখ্যা তা দূরীভূত বা নিশ্চিত করে, ভয়-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টা। কর্ম কখনোই শিরক প্রমাণ করে না। কারো কোনো পরিমাণের ভয় দেখেই কথা বলা যায় না যে, লোকটির কর্ম শিরক, অথবা লোকটি কাফির বা মুশরিক। তবে যদি লোকটির বক্তব্য দ্বারা তার শিরকী বিশ্বাস প্রমাণিত হয় তবে তা শিরক বলে গণ্য হবে

(
) ‘আনুগত্য ভয়, ভালবাসা ইত্যাদি কর্মের মত কর্ম। কাউকে আল্লাহর মত চূড়ান্ত প্রশ্নাতীত সর্বময় আনুগত্যের যোগ্য চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করে তার আনুগত্য করলেই শুধু তা শিরক বলে গণ্য হবে। মূলত বিশ্বাসই শিরক, কর্ম নয়। এইরূপ বিশ্বাস নিয়ে যদি কারো হুকুম মত ইসলাম-অনুমোদিত বৈধ কর্মও করে তবুও তা শিরক। আর যদি মানবীয় ভালবাসা, ভয়, লোভ ইত্যাদি কারণে কারো নির্দেশ মত আল্লাহর বিধানের বিরোধী কাজ করে তবুও তা শিরক বলে গণ্য হবে না। আমরা দেখেছি যে, এরূপ ভয়জনিত আনুগত্যের ভিত্তিতে শিরক বা কুফরী কর্মে লিপ্ত হলেও তা শিরক-কুফর বলে গণ্য হবে না

(
) ইহূদী-খৃস্টানদের আনুগত্য ছিল শিরক পর্যায়ের আনুগত্য। অতীতে এবং বর্তমানেও তারা তাদের পন্ডিত, পাদরী, ধর্মগুরু বা পোপদের ক্ষেত্রে ঐশ্বরিক পবিত্রতা (divinity, holiness, sanctity) অভ্রান্ততা (infallibility) বাইসমত'- বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে যে, ধর্মগ্রন্থে কি আছে তা বিবেচ্য নয়, বরং পবিত্র-আত্মায় পূর্ণ হয়ে ধর্মগুরুগণ যা ব্যাখ্যা দিবেন তাই চূড়ান্ত। ইহূদী-খৃস্টান ধর্মের ইতিহাসের সাথে পরিচিত সকলেই তা জানেন
উপর্যুক্ত হাদীসগুলি থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তাদের শিরক ছিল বিশ্বাসে, কর্মে নয়। পাদরী-পোপ যা হালাল বা হারাম বলে ঘোষণা করত তারা তা হালাল বা হারাম বলে বিশ্বাস করত; কারণ তারা তাদের পবিত্রতায় (holiness, sacredness, sanctity) বিশ্বাস করত। ছিল তাদের শিরক। তারা সে হারামকে বর্জন করতো কিনা বা হালালকে পালন করতো কি না তা বিবেচ্য নয়
এরূপ আনুগত্যের পাশাপাশি ইহূদী-খৃস্টানগণ ধর্মগুরু দরবেশদের ইবাদতও করত। তারা তাদেরকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করত, তাদের বর লাভের জন্য তাদের সাজদা করত, অনেকের মূর্তি বানিয়ে সেখানে মানত, উৎসর্গ, সাজদা ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের ইবাদত করত

(
শয়তানের বন্ধু বা মুশরিকদের আনুগত্যের বিষয়টিও একইরূপ। এখানে আনুগত্য কর্মে নয়, বিশ্বাসে। এখানে আনুগত্য হলো মৃত প্রাণীর মাংস ভক্ষণ বৈধ বলে বিশ্বাস করা। মহান আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা হয়নি এমন পশুর মাংস ভক্ষণ করা হারাম। শয়তান তার বন্ধুদেরকে প্রেরণা দিল বিধান সঠিক নয় বলে প্রমাণ করে মুসলিমদের তাদের দলে নেওয়ার জন্য। তাদের যুক্তি ছিল, আমরা নিজেরা যা হত্যা করি তা খাওয়া বৈধ আর আল্লাহ যা হত্যা করেন (স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে) তা খাওয়া অবৈধ হয় কিভাবে? যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ যা হত্যা করেছেন, অর্থাৎ যা আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা হয় নি, বরং স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে তা ভক্ষণ করা বৈধ। মুসলিমদেরকে আল্লাহ জানান যে তোমরা যদি তাদের মত মেনে নাও এবং মৃতপ্রাণীর মাংস ভক্ষণ বৈধ বলে বিশ্বাস কর তবে তোমরাও তাদের মত মুশরিক হয়ে যাবে
আয়াতের অর্থ নয় যে, কেউ যদি বাধ্য হয়ে, লোভে পড়ে বা অন্য কোনো কারণে কোনো কাফিরের নির্দেশ মান্য করে মৃতপ্রাণীর মাংস ভক্ষণ করে তবে সে মুশরিক হয়ে যাবে। এর অর্থ, কেউ যদি মুশরিকদের দলিল-প্রমাণ যুক্তিতে প্রভাবিত হয়ে তাদের মতটিকে সঠিক বলে মেনে নেয় বা তাদেরবিশ্বাসগ্রহণ করে তবে বাস্তবে মৃতপ্রাণীর মাংস ভক্ষণ করুক অথবা না করুক সে মুশরিক বলে গণ্য হবে।[11]

[1] সূরা তাওবা, ৩১ আয়াত
[2]
তিরমিযী, আস-সুনান /২৭৮
[3]
তাবারী, তাফসীর ১০/১১৪
[4]
তিরমিযী, আস-সুনান /২৭৮
[5]
তাবারী, তাফসীর ১০/১১৪-১১৫
[6]
সূরা আনআম, ১২১ আয়াত
[7]
রাগিব, ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃ. ৩১৯
[8]
আযীম আবাদী, আউনুল মাবূদ /২৪৭; মুবারকপূরী, তুহফাতুল আহওয়াযী /২২০; মুনাবী, ফাইদুল কাদীর /৫৪০
[9]
উসাইমীন, মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ, আল-কাওলুল মুফীদ /১৬
[10]
সূরা আহযাব, ৩৭ আয়াত
[11]
তিরমিযী, আস-সুনান /২৬৩; আবু দাউদ, আস-সুনান /১০১, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান /১০৫৯; তাবারী, তাফসীর /১৫-২১; ইবনু কাসীর, তাফসীর /১৭২, কুরতুবী, তাফসীর /৭২-৭৭; হাসান হুদাইবি, দুআতুন লা কুদাত, পৃ. ১৫৫-১৬৮

. . . তাগুত বর্জন অবিশ্বাস

তাগুত অবিশ্বাস বর্জন বিষয়ক আয়াতগুলিকে জামাআতুল মুসলিমীন নেতৃবৃন্দ তাদের মতের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করতেন। তাগুত শব্দটি কুরআনে স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।[1] ইতোপূর্বে একটি আয়াতে দেখেছি যে আল্লাহ বলেছেন: ‘‘দীনে কোনো জবরদস্তি নেই। ... যে তাগূতকে অবিশ্বাস করবে এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করবে সে এমন এক মযবুত হাতল ধরবে যা কখনো ভাঙ্গবে না।’’ অন্যত্র আল্লাহ বলেন:


أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَىٰ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا

‘‘তুমি কি দেখ নি তাদেরকে যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাগূতকে অবিশ্বাস করার আর শয়তান চায় তাদেরকে ভিষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে? তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে এস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে।’’[2]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:


وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

‘‘আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি।’’[3]
এখানে তাগুতকে বর্জন করা বলতে তাগুতের ইবাদত বর্জন করা বুঝানো হয়েছে। বিষয়ে মহান আল্লাহ আরো বলেছেন:

وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْ يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَىٰ

‘‘যারা তাগূতের ইবাদত করা বর্জন করে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।’’[4]
তাগূত শব্দটি আরবীতুগইয়ানশব্দ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যার অর্থ সীমালঙ্ঘন করা। অবাধ্যতা, জুলুম বা অন্যায়ের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘনকারীকেতাগীবাসীমালঙ্ঘনকারীবলা হয়। অত্যধিক সীমলঙ্ঘনকারীকেতাগিয়াহবা তাগূত বলা হয়। এভাবে আমরা দেখছি যে, আভিধানিকভাবেতাগূতঅর্থমহা-সীমালঙ্ঘনকারী[5]

আভিধানিকভাবে সকল সীমালঙ্ঘনকারী বা অবাধ্যকেতাগূতবাতাগিয়াহবলা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কুরআনের পরিভাষায় মহা-সীমালঙ্ঘনকারীকে, কাফিরগণ যাকে বিশ্বাস করে এবং যার পথে যুদ্ধ করে, আর যাকে অবিশ্বাস যার ইবাদত বর্জন করা মুমিনের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ? যার কাছে বিচার প্রার্থনা করা মুনাফিকদের কর্ম? তাগুতের নিকট বিচারপ্রার্থনা বিষয়ক আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী বলেন:


قال جابر كانت الطواغيت التي يتحاكمون اليها في جهينه واحد وفي اسلم واحد وفي كل حي واحد كهان ينزل عليهم الشيطان وقال عمر ... الطاغوت الشيطان وقال عكرمة ... الطاغوت الكاهن

‘‘জাবির (রা) বলেন, তারা যে সকল তাগূতের নিকট বিচার প্রার্থনা করত তার একজন ছিল জুহাইনা গোত্রে, একজন ছিল আসলাম গোত্রে এবং প্রত্যেক গোত্রেই গণক-পুরোহিত ছিল যাদের উপর শয়তান অবতীর্ণ হতো। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন, তাগূত অর্থ শয়তান। ইকরিমা বলেছেন, তাগূত অর্থ কাহিন বা গণক-পুরোহিত।[6]
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী (৩১০ হি) তাঁর তাফসীরে বিভিন্ন সনদে মুফাসসির সাহাবী তাবিয়ীগণ থেকেতাগূতেরব্যাখ্যায় তিনটি মত উল্লেখ করেছেন। সাহাবী উমার (রা), তাবিয়ী মুজাহিদ, শাবী, কাতাদাহ, দাহ্হাক, সুদ্দী প্রমুখ মুফাস্সির বলেন, তাগূত অর্থ শয়তান। তাবিয়ী আবুল আলিয়াহ মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন বলেন, তাগূত অর্থ যাদুকর। সাহাবী জাবির (রা), তাবিয়ী সাঈদ ইবনু জুবাইর, রুফাই, ইবনু জুরাইজ প্রমুখ মুফাস্সির বলেছেন, তাগূত অর্থকাহিনবা গণকপুরোহিত।[7]

কুরআনে বিভিন্ন স্থানে তাগূত শব্দটির ব্যবহারের মধ্যে তুলনা করলে প্রথম ব্যাখ্যাটির শক্তিশালী বলে প্রতীয়মান হয় আল্লাহ বলেন:


اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ

‘‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান। আর যারা কুফরী করেছে তাদের অভিভাবক তাগূত। তারা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়।’’[8]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:


الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا

‘‘যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে। আর যারা কুফরী করেছে তারা তাগূতের পথে যুদ্ধ করে। অতএব তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল।’’[9]
দুটি আয়াতে স্পষ্টতই তাগুত বলতে শয়তান বুঝানো হয়েছে। প্রথম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাফিরদের বন্ধু তাগূত এবং পরের আয়াতে বলা হয়েছে যে, কাফিরগণ শয়তানের বন্ধ। এথেকে স্পষ্টত বুঝা যায় যে, তাগূত শয়তান একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় আয়াতে তাগূত শয়তান শব্দদ্বয়ের ব্যবহার থেকে বুঝা যায় যে, দুটি দ্বারা একই অর্থ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ কাফিরগণ তাগূতের পথে যুদ্ধ করে, কাজেই তোমরা তাগূতের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর
ইবনু কাসীর বলেন, ‘‘তাগূতের অর্থ শয়তান বলা অত্যন্ত জোরালো মত। কারণ মুর্তি, স্তম্ভ, পাথর, গাছপালা ইত্যাদির পূজা, এগুলির কাছে বিচার চাওয়া, এগুলির জন্য লড়াই করা ইত্যাদি জাহিলী যুগের সকল অকল্যাণের উৎস হলো শয়তান। কাজেই এক কথায় সকল অর্থ এসে যায়।’’[10]
হাদীস শরীফে মূর্তি-প্রতিমাকেতাগূতবাতাগিয়াহবলা হয়েছে। দেব-দেবীর নামে শপথের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,


لا تحلِفُوا بالطواغيتِ (بالطواغي) ولا تحلِفُوا بآبائِكم

‘‘তোমরা তাগুতদের নামে শপথ করবে না এবং তোমাদের পিতাদের নামে শপথ করবে না।’’[11]
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,


لا تقومُ الساعةُ حتى تضطَّرِبَ أليَاتُ نساءِ دَوْسٍ على (حولَ) ذي الخلَصَةِ طاغِيَةُ دَوْسٍ التي كانوا يعبدونَها في الجاهِلِيَّةِ

কিয়ামতের পূবেই দাওস গোত্রের মহিলাদের নিতম্ব দাওস গোত্রের তাগিয়াহযুল খালাসাপ্রতিমার নিকট আন্দোলিত হবে।[12] উপরের আয়াতগুলিতে আমরা দেখেছি যে, মহান আল্লাহ ঈমানের দুটি অংশ উল্লেখ করেছেন: আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং তাগূতকে অবিশ্বাস করা। আর অর্থে অন্যত্র বলা হয়েছে যে, আল্লাহর ইবাদত করতে হবে এবং তাগূতের ইবাদত বর্জন করতে হবে। অর্থে একটি হাদীস প্রণিধান যোগ্য। তারিক ইবনু আশইয়াম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,


من قالَ : لا إلهَ إلَّا اللَّهُ ، وكفر بما يُعبَدُ من دون اللَّهِ ، حُرِّم مالُهُ ودمُهُ . وحسابُهُ على اللَّهِ

‘‘যদি কেউলা ইলাহা ইল্লাল্লাহুবলে এবং আল্লাহ ছাড়া যা কিছু ইবাদত করা হয় তা অবিশ্বাস করে, তবে তার রক্ত সম্পদ নিষিদ্ধ হবে, তার হিসাব হবে আল্লাহর উপর।’’[13] উপরের আয়াতগুলির সাথে হাদীসের অর্থ সমন্বয় করলে বুঝা যায় যে, ‘তাগূতবলতেআল্লাহ ছাড়া যা কিছু ইবাদত করা হয়বুঝানো হয়েছে। পরবর্তী যুগের অনেক মুফাসসির প্রকারের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ইমাম মালিক (১৭৯ হি) থেকে বর্ণিত, আল্লাহকে ছাড়া যাকেই ইবাদত করা হয় সেই তাগূত।[14] ইমাম তাবারী (৩১০ হি) অর্থই সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন।’’[15] কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, ‘‘আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করা হয় অথবা আল্লাহর বিরোধিতায় যার আনুগত্য করা হয় সেই তাগূত।’’[16] এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয়েছে এবং হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ঈসা, উযাইর, ইয়াগূস, ইয়াউক, নসর অন্যান্য নবী, ওলী ফিরিশতাগণ। এদেরকে তো তাগূত বলা যায় না। তাহলে মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা কিভাবে গ্রহণ করা যাবে? এক্ষেত্রে তারা বলেছেন যে, যারা ইবাদত গ্রহণে তুষ্ঠ তাদেরকেই তাগূত বলা হবে; কারণ তারা আল্লাহর অবাধ্যতায় মহা-সীমালঙ্ঘনকারী। অথবা ইবাদতকারীদের কর্মের ভিত্তিতে তাদেরকে তাগূত বলা হবে। অর্থাৎ ইবাদতকারীগণ তাদের ইবাদত করে মহা-সীমালঙ্ঘনকারীতে পরিণত হয়েছে।[17]

এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং তাঁর ইবাদত করা এবং তাগূতকে অবিশ্বাস করা এবং তাগূতের ইবাদত বর্জন করা। শয়তানই তাগূত। এছাড়া শয়তানের নির্দেশে আল্লাহ ছাড়া যা কিছু ইবাদত করা হয়েছে সবই তাগূত। মুমিনের দায়িত্ব ইবাদতের অধিকার একমাত্র আল্লাহরই বলে বিশ্বাস করা, শুধু আল্লাহরই ইবাদত করা, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুর ইবাদত গ্রহণের অধিকার অবিশ্বাস করা এবং এবং অন্য কিছুর ইবাদত বর্জন করা। আল্লাহর যা অবতীর্ণ করেছেন তা এবং তাঁর রাসূল (সাঃ)-কে পরিত্যাগ করে অন্য ধর্মের গণক-পুরোহিতর নিকট বিচার প্রার্থনা করা বা আল্লাহ তাঁর রাসূলের (সাঃ) বিচারকে অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে অন্য কারো কাছে বিচার প্রার্থনা করা মুনাফিকদের কর্ম, যা কখনোই কোনো মুমিন করতে পারেন না। সকল বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। তবে মুফাসসিরগণের কোনো কথা আভিধানিক অর্থকে ভিত্তি করেজামাআতুল মুসলিমীননেতৃবৃন্দ দাবি করেন যে, আল্লাহর আইন ছাড়া বিচার-শাসনকারী সকল সরকারইতাগূতএবং এদেরকে বর্জন করা অবিশ্বাস করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই যে ব্যক্তি ঈমানের দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও এরূপ শাসক বা সরকারকে বর্জন করবে না বা সহযোগিতা আনুগত্য করবে, অথবা সকল দেশের আদালতে বিচার প্রার্থনা করবে সে কাফির, যদিও সে সালাত, সিয়াম ইসলামের অন্য সকল ইবাদত পালন করে। এক্ষেত্রে তাদের বিভ্রান্তি সুস্পষ্ট:

প্রথমত: তাঁরা ‘‘তাগুত’’-এর ব্যাখ্যায় সীমালঙ্ঘন করেছেন এবংতাগূতেরশাব্দিক কুরআনী অর্থের মধ্যে পার্থক্য নষ্ট করেছেন। সকল অবাধ্য পাপী সীমালঙ্ঘনকারীই আভিধানিকভাবেতাগূতবলে অভিহিত হতে পারে, কিন্তু কুরআনে যে তাগূতকে অবিশ্বাস করতে ইবাদত বর্জন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সে শয়তান এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে ইবাদত করা হয়

দ্বিতীয়ত: তাঁরা তাগূতের প্রতি মুমিনের দায়িত্বের বর্ণনায় সীমালঙ্ঘন করেছেন। কুরআনে তাগূতের প্রতি মুমিনের দুটি দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে: ‘‘অবিশ্বাস করা’’ ‘‘ইবাদত বর্জন করা’’ অবিশ্বাস অর্থ তার অস্তিত্বে বা রাষ্ট্রক্ষমতায় অবিশ্বাস নয়, তার ইবাদত পাওয়ার অধিকারে অবিশ্বাস করা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু ইবাদত করা হয় তা অবিশ্বাস করতে হবে। আমরা জানি, আল্লাহ ছাড়া অনেক ফিরিশতা নবীর () ইবাদত করা হয়েছে। এখানে এদের অস্তিত্ব বা এদের মর্যাদা অবিশ্বাস করতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি। বরংইবাদত পাওয়ার কোনোরূপ অধিকার এদের আছেতা অস্বীকার করতে হবে। অনুরূপভাবে ফিরাউন অন্যান্য শাসকের ইবাদত করা হয়েছে। তাদের প্রতি অবিশ্বাস অর্থ তাদের অস্তিত্বে বা রাজত্বে অবিশ্বাস নয়, বরং তাদেরইবাদত- যোগ্যতাঅবিশ্বাস করা

তৃতীয়ত: তারা ইবাদত আনুগত্যের পার্থক্য নষ্ট করেছেন। আমরা ইতোপূর্বে বিষয়টি আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, শয়তানই মূলত তাগূত। আর তাগূতের আনুগত্য বা সহযোগিতা করলেই যদি কুফর বা শিরক হয়, তবে প্রত্যেক মানুষই কাফির মুশরিক বলে গণ্য হবে। কারণ প্রতিটি মানুষই শয়তানের প্ররোচনাই বিভিন্ন ভাবে আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান আছে এরূপ কোনো মানুষই ধরনের কথা বলবেন বলে মনে হয় না

চতুর্থত: তাগূতের নিকট বিচারপ্রার্থনার ব্যাখ্যায় তারা সীমালঙ্ঘন করেছেন। অন্য ধর্মের গণক-পুরোহিত- যারা অলৌকিক বা গায়েবী জ্ঞান এবং সে জ্ঞানের ভিত্তিতে সঠিক বিচার করার যোগ্যতা অধিকার দাবি করেন- তাদের এরূপ জ্ঞান বিচারের যোগ্যতায় বিশ্বাস করা বা এরূপ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের কাছে বিচার চাওয়া নিঃসন্দেহে কুফরী। এছাড়া আল্লাহ তাঁর রাসূলের (সাঃ) নিকট ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না বা তাদের ফয়সালা অগ্রহণযোগ্য মনে করে অন্য যে কোনো ব্যক্তির নিকট বিচার চাওয়াও কুফরী। এখানে কুফরী বিশ্বাসে, অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর রাসূলের (সাঃ) বিচারকে অগ্রহণযোগ্য মনে করা বা অন্য কারো অলৌকিক জ্ঞান নির্ভুল বিচারের যোগ্যতা আছে বলে বিশ্বাস করা

আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, সমকালীন মুসলিম দেশগুলির অধিকাংশ আইনই ইসলামী বা ইসলাম সম্মত। কিছু আইন ইসলাম বিরোধী। কোনো মুমিন আল্লাহর আইনের শ্রেষ্ঠতে বিশ্বাস-সহ আল্লাহর আইনের অবিদ্যমানতার কারণে নিজের ন্যূনতম অধিকার রক্ষার জন্য এরূপ আইনের আশ্রয় নিলে তা কখনোই কুফরী বা পাপ বলে গণ্য নয়। মুফাস্সিরগণ সহীহ, যয়ীফ, বানোয়াট অনেক মতামত উদ্ধৃত করেন, যেগুলি ‘‘মতামত’’ মাত্র। হালাল-হারাম বা ঈমান-কুফর নির্ধারণে সনদবিচার সহীহ হাদীস প্রয়োজন। সকল ‘‘মতামত’’ সনদভিত্তিক বিচার না করে পছন্দভিত্তিক গ্রহণ করার কারণে আমরা অনেক সময় ভুলের মধ্যে নিপতিত হই। তাগূতের নিকট বিচারপ্রার্থনার আয়াতের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে

প্রসঙ্গে তাফসীরে যে সকল হাদীস বা সাহাবীগণের মতামত উল্লেখ করা হয়েছে তার অধিকাংশেরই কোনো নির্ভরযোগ্য সনদ নেই। এরূপ একটি ‘‘হাদীস’’ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয় যে, একজন ইহূদী মুনাফিক মুসলিমের মধ্যে কোনো বিষয়ে বিবাদ হয়। মুনাফিক ব্যক্তি একজন পুরোহিত বা ইহূদী নেতার কাছে বিচারপ্রার্থনা করতে চায়, কিন্তু ইহূদী লোকটি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর কাছে বিচারপ্রার্থনায় আগ্রহী ছিল। একপর্যায়ে তারা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর কাছে বিচার চাইলে তিনি সবকিছু শুনে ইহূদীর পক্ষে বিচার করেন। মুনাফিক ব্যক্তি এতে অসন্তুষ্ট হয়ে উমার (রা)-এর নিকট বিচার প্রার্থনা করেন। তিনি বাদী বিবাদীর বক্তব্য শোনার পর উক্ত মুনাফিককে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত ‘‘হাদীসটি’’ কোনো গ্রহণযোগ্য সনদ নেই। ইবনু কাসীর তা উল্লেখ করেছেন।[18]

বর্ণনা বিশুদ্ধ হলেও সমকালীন আদালতে বিচার প্রার্থনা কুফরী বলে প্রমাণিত হয় না। বাদী বিবাদীর কর্ম থেকে বুঝা যায় যে, মদীনার প্রশাসন-ব্যবস্থায় উমার (রা)-এর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছিল। আর মুনাফিক লোকটি নিজে উমার (রা)-এর কাছে বিচার চেয়েছে এবং স্বীকার করেছে যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর বিচার সে অপছন্দ করেছে। বিবাদীও তার বক্তব্য সঠিক বলে সাক্ষ্য দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর বিচারকে আপত্তিকর মনে করা কুফরী। যেহেতু ব্যক্তি নিজেই নিজের অপরাধের জন্য বিচার প্রার্থনা করেছে কাজেই তাকে তার পাওনা শাস্তি প্রদান বৈধ। কিন্তু জামাআতুল মুসলিমীন অন্যান্যরা এরূপ যয়ীফ বা অনির্ভরযোগ্য বর্ণনার উপর তাদের মতামতের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তাদের পছন্দমত এর ব্যাখ্যা করেন

[1] সূরা বাকারা, ২৫৬, ২৫৭, সূরা নিসা ৫১, ৬০, ৭৬, সূরা মায়িদা ৬০, সূরা যুমার, ১৭, সূরা নাহল, ৩৬ আয়াত
[2]
সূরা () নিসা: ৬০-৬১ আয়াত
[3]
সূরা নাহল, ৩৬ আয়াত
[4]
সূরা যুমার, ১৭ আয়াত
[5]
রাযী, মুখতাসারুল সিহাহ, পৃ. ৪০৩
[6]
বুখারী, আস-সহীহ /১৬৭৩
[7]
তাবারী, তাফসীর /১৮-১৯
[8]
সূরা বাকারা, ২৫৭ আয়াত
[9]
সূরা নিসা, ৭৬ আয়াত
[10]
ইবনু কাসীর, তাফসীর /৩১২
[11]
বুখারী, আস-সহীহ /২৪৫০, মুসলিম, আস-সহীহ /১২৬৮; আবূ আওয়ানা, আল-মুসনাদ /২৮; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১১/৫৩৬
[12]
বুখারী, আস-সহীহ /২৬০৪
[13]
মুসলিম, আস-সহীহ /৫৩
[14]
কুরতুবী, তাফসীর /২৪৮
[15]
তাবারী, তাফসীর /১৯
[16]
কুরতুবী, তাফসীর /২৪৮-২৪৯
[17]
উসাইমিন, মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ, আল-কাওলুল মুফীদ /৩০
[18]
ইবনু কাসীর, তাফসীর /৫২২

 . . . রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বনাম কুফ্রীর প্রতি সন্তুষ্টি

 জামাআতুল মুসলিমীন’-এর নেতৃবৃন্দ বলেন, সকল দেশের নাগরিকবৃন্দ যেহেতু আল্লাহর আইন অমান্যকারী রাষ্ট্রের সরকারের সাথে সহযোগিতা করেন, রাষ্ট্রের নির্বাচনে অংশ নিয়ে এসকল কাফিরদেরকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেন এবং এদের অধীনে চাকরী করেন, সেহেতু সকল দেশের সকল নাগরিকই কাফির বলে গণ্য। এখানে তারা পাপীর সাথে সহযোগিতা পাপে সহযোগিতার মধ্যে পার্থক্য না করে দুটি বিষয়কে এক পর্যায়ের বলে দাবি করেছেন। এরপর পাপের সহযোগিতার অভিযোগে সাধারণ মুসলিম জনসাধারণকে কাফির বলে দাবি করেছেন। তাদের বিভ্রান্তি অনুধাবন করতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি লক্ষণীয়:

(
) কুরআন-হাদীসে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব বা অন্তরঙ্গ ভালবাসার বন্ধন তৈরি করতে নিষেধ করা হয়েছে। কয়েকটি আয়াত দেখুন:

لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً

‘‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ব্যতীত কাফিরদিগকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না, তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর।’’[1]


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ

‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা ইয়াহূদী খৃস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে।’’[2]


لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ

‘‘তুমি পাবে না আল্লাহ আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায় যারা ভালবাসে আল্লাহ তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধচারীদেরকে, হোক না বিরুদ্ধচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা বা তাদের জ্ঞাতি গোত্র।’’[3]

আরো অনেক আয়াতে বিষয়ে তাকিদ দেওয়া হয়েছে। সকল আয়াতের আলোকে প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব, তার হৃদয় কর্মকে নিয়ন্ত্রন করা, যেন কাফির সম্প্রদায়ের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা হৃদয়ে স্থান না পায় এবং ভালবাসা প্রকাশক কোনো কর্ম যেন সে না করে। তবে একথা সুস্পষ্ট যে, ভালবাসা মূলত হৃদয়ের কর্ম। কাজেই কারো কোনো কর্মকেই নিশ্চিতরূপেকুফরীর প্রতি বা কাফিরের প্রতি ভালবাসাবলে নিশ্চিতরূপে চিহ্নিত করা যায় না, যতক্ষণ না তার সস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে তা নিশ্চিত হয়। এজন্য শুধু কাফিরদের সাথে সুসম্পর্ক, সহযেগিতা বা এরূপ কোনো কাজের ভিত্তিতে কাউকে কাফির বলা যায় না। ইসলামের প্রধান শত্রু মক্কাবাসীদের কাছে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর মক্কা আক্রমনের গোপন তথ্য ফাঁস করে হাতিব (রা) পত্র লিখেছিলেন। তার কর্ম নিঃসন্দেহে আল্লাহ তার রাসূলের শত্রুদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশক। কিন্তু শুধু কর্মের কারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে কাফির বলে ঘোষণা দেন নি। বরং তার কর্মের উদ্দেশ জানতে চেয়েছেন এবং তার ওযর কবুল করেছেন। এমনকি তাকে তাওবা করার নির্দেশও দেন নি।[4]

(
) জাগতিক সম্পর্ক সহযোগিতা কখনোইভালবাসাবা বন্ধুত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণ কাফিরদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। তাদের অধীনে চাকরী করেছেন। ইউসূফ (আঃ) মিসরের মুর্তি-পূজারী ফিরআউনের দেশে তারই রাজত্বে তারই অধীনে চাকরী করেছেন

(
) পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশগুলির শাসক, প্রশাসক বা সরকারকে ইহূদী, খৃস্টান বা মুশরিকদের মত কাফির মনে করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। এদের কারো কর্ম কঠিন পাপ বা কুফরী হলেও, এদের সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা কুফরী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই কাফির বলা যায় না। এরূপ সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বহাল রাখা এবং ইসলামবিরোধী নয় এরূপ বিষয়ে তার আনুগত্য করাই ইসলামের নির্দেশ। উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,


إنه يُسْتَعْملُ عليكُم أمراءُ فتَعْرِفونَ وتُنْكِرونَ فمن كرهَ فقد برئ ومن أنكرَ فقد سلمَ ولكن من رضىَ وتابعَ قالوا : يا رسولَ اللهِ ! ألا نقاتلهم ؟ قال : لا ما صلّوا

‘‘অচিরেই তোমাদের উপর অনেক শাসক প্রশাসক আসবে যারা ন্যায় অন্যায় উভয় প্রকারের কাজ করবে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায়কে ঘৃণা করবে সে অন্যায়ের অপরাধ থেকে মুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি আপত্তি করবে সে (আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে) নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে সকল অন্যায় কাজ মেনে নেবে বা তাদের অনুসরণ করবে (সে বাঁচতে পারবে না।)’’ সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বলেন, ‘‘না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করবে।’’[5]

যদি কোনো নাগরিক তার সরকারের অন্যায় সমর্থন করেন, অন্যায়ের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন বা অন্যায়ের ক্ষেত্রে সরকারের অনুসরণ করেন তবে তিনি তার সরকারের পাপের ভাগী হবেন। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা, চাকরী, কর্ম বা রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের কারণে কোনো নাগরিক পাপী হবে না। আউফ ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,


ألا مَن وُلِّي عليه والٍ، فرآه يأتي شيئًا من معصيةِ الله، فليَكرَه ما يأتي من معصيةِ الله، ولا ينزعَنَّ يدًا من طاعة

‘‘তোমরা হুশিয়ার! তোমাদের কারো উপরে যদি কোনো শাসক-প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং সে দেখতে পায় যে, উক্ত শাসক বা প্রশাসক আল্লাহর অবাধ্যতার কোনো কাজে লিপ্ত হচ্ছেন, তবে সে যেন আল্লাহর অবাধ্যতার উক্ত কর্মকে ঘৃণা করে, কিন্তু আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেবে না।’’[6]
অন্য বর্ণনায়:


إذا رأيتُم مِن وُلاتِكم شيئًا تَكْرَهُونَه ، فاكْرَهوا عمَلَه ولا تنْزِعوا يدًا مِن طاعَةٍ

‘‘যখন তোমরা তোমাদের শাসক-প্রশাসকগণ থেকে এমন কিছু দেখবে যা তোমরা অপছন্দ কর, তখন তোমরা তার কর্মকে অপছন্দ করবে, কিন্তু তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিবে না।’’[7]

[1] সূরা আল-ইমরান, ২৮ আয়াত
[2]
সূরা মায়িদা, ৫১ আয়াত
[3]
সূরা মুজাদালা, ২২ আয়াত
[4]
বুখারী, আস-সহীহ /১০৯৫; মুসলিম, আস-সহীহ /১৯৪১
[5]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৮০, ১৪৮১
[6]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৮২
[7]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৮১

 . . . জামাআত বাইআতের তত্ত্ব

বিশ্বের সকল সমাজের সকল মুসলিমকে কাফির বলে গণ্য করার ক্ষেত্রে তাদের একটি বড় তত্ত্ব ছিল জামাআত বাইআত তত্ত্ব। তারা দাবি করত যে সমকালীন সকল মুসলিম দেশ সমাজ কাফির জাহিলী সমাজ। এগুলির সাথে কুফরী সম্পর্কচ্ছেদ না করা পর্যন্ত কেউ মুমিন বলে গণ্য হবে না। আর কাউকে মুমিন বলে বা ‘‘দীনী ভাই’’ বলে চিনতে পারার একমাত্র মাধ্যম হলো বাইআত। শুধুমাত্রজামাআত বাইয়াতের মাধ্যমেই একজন মুসলিমকে অমুসলিম থেকে পৃথক করা যাবে। যতক্ষণ না কোনো মুসলিম তাদের ইমামের হাতে বাইয়াত করে তাদেরজামাআতেযোগ দিবে ততক্ষণ তাকে মুমিন বলে গণ্য কার যাবে না

দাবির পক্ষে তারা কুরআন হাদীসের বাইয়াত জামাআত বিষয়ক নির্দেশগুলিকে দলিল হিসেবে পেশ করে। তাদের দাবি মুর্খতা বিভ্রান্তির সংমিশ্রণ ছিল। কারণ তাদের পেশ করা দলিলের কোনোটিতেই বাইয়াত জামাআতকে ঈমানের পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয় নি। তারা পরিভাষাদ্বয়ের অর্থও বুঝতে পারে নি। ভাষাবিদগণ জানেন যে, ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের অর্থ যুগের আবর্তনে পরিবর্তিত হয়। আরবী ভাষা যদিও কুরআন, হাদীস ইসলামী সভ্যতার কারণে স্বাভাবিক বিবর্তন পরিবর্তন থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়েছে, তবুও অনেক আরবী শব্দের অর্থ আংশিক বা পরিপূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের যুগের ব্যবহৃত অর্থ এবং বর্তমানে প্রচলিত অর্থের মধ্যে অনেক সময় আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়

জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের বক্তব্য ব্যাপক অধ্যয়ন এবং প্রাচীন মুফাস্সির মুহাদ্দিসগণের ব্যাখ্যা অধ্যয়ন না করলে সকল ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ আরব পাঠকও বিভ্রান্ত হন। এরূপ বিভ্রান্তি শিকার হনজামাআতুল মুসলিমীননেতৃবৃন্দজামাআতশব্দের ক্ষেত্রে।জামাআতবাইআতইসলামের দুটি রাষ্ট্রনৈতিক পরিভাষা। জামাআত শব্দের অর্থ প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে।[1] এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, জামাআত শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘‘ঐক্য’’ বা ‘‘ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠী’’ যে কোনো স্থানে যে মানুষগুলি থাকেন তাদের সমষ্টিকে বা তাদের ঐক্যবদ্ধতাকে ‘‘জামাআত’’ বলা হয়। জামাআতের বিপরীত হলো ফিরকা বা হিযব, অর্থাৎ দল বা গ্রুপ

মনে করুন একটি মসজিদের মধ্যে ১০০ জন মুসল্লি আছেন। এরা মসজিদের জামাআত। এদের মধ্যে কম বা বেশি সংখ্যক মুসল্লী যদি পৃথকভাবে একত্রিত হয়ে মসজিদের এক দিকে বসেন তবে তারা একটি ফিরকা, কাওম বা হিযব, অর্থৎ দল, গ্রুপ বা সম্প্রদায় বলে গণ্য, কিন্তু তারা জামাআত বলে গণ্য নয়। যেমন, উপর্যুক্ত ১০০ জনের মধ্য থেকে জন এক দিকে পৃথক হয়ে বসলেন, আর দশ জন অন্য কোণে পৃথক হয়ে বসলেন এবং অন্য কোণে আরো কয়েকজন একত্রিত হলেন। এখন আমরা ফিরকা জামাআতের রূপ চিন্তা করি। মূলত মসজিদের জামাআত বা ঐক্য ভেঙ্গে ইফতিরাক বা দলাদলি এসেছে। তিনটি ফিরকা বা দল মূল জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আর বাকি যারা কোনোদলবা ফিরকা গঠন না করে দলবিহীনভাবে রয়ে গিয়েছেন তারা নিজেদেরকেজামাআতবলতে পারেন। আর অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ‘‘জামাআত’’ বলা হয়

এভাবে একটি ঘর, মসজিদ বা মাহফিলের মধ্যে বিদ্যমান সকল মানুষের বা অধিকাংশ মানুষের সমষ্টি বা তাদের ঐক্যবদ্ধতাকে উক্ত স্থানেরজামাআতবলা হয়। যেমন বলা হয়, মসজিদের জামাআত, ঘরের জামাআত, মহল­ার জামাআত, মাহফিলের জামাআত। অর্থাৎ ঘর, মহল্লাহ, মসজিদ বা মাহফিলের সকল মানুষ। অর্থে অল্প কিছু মানুষকেও জামাআত বলা যেতে পারে, তবে তাসকল মানুষের ঐক্যঅর্থে নয়, বরংনির্ধারিত স্থানের সকল মানুষের ঐক্যঅর্থে। কুরআন-হাদীসে ‘‘জামাআত’’ বলতে ‘‘জামাআতুল মুসলিমীন’’ বা সকল মুসলিমের বা অধিকাংশ মুসলিমের ঐক্য বুঝানো হয়েছে। কুরআন, হাদীস মূল আরবী ব্যবহার অনুসারেজামাআতঅর্থ জনগণ, জনগোষ্ঠী বা সমাজ (community, society). বিভিন্ন হাদীসেজামাআত’-এর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।জামাআত-বদ্ধথাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবংবিচ্ছিন্ন হতেনিষেধ করা হয়েছে। সকল নির্দেশের অর্থ, মুসলিম যে সমাজে বা জনগোষ্ঠীতে বসবাস করবেন, সে সমাজের মানুষদের রাজনৈতিক, সামাজিক সিদ্ধান্তাদির সাথে একমত থাকতে হবে, যদিও সে সিদ্ধান্ত তার বা তার গোষ্ঠীর মতামত বা স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়

মূলত রাষ্ট্রীয় বিষয়েই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সকল নির্দেশনা দিয়েছেন। জামাআত বাইয়াত বিষয়ক নির্দেশাদি একই সুত্রে বাঁধা। জামাআত অর্থ সমাজ বা রাষ্ট্রের জনগণ বা তাদের ঐক্য এবং বাইয়াত অর্থ রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের শপথ। আরবগণ প্রাচীন যুগ থেকেকাবীলাবা গোত্রতান্ত্রিক বিভক্ত সমাজে বসবাস করত। ইসলামের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিচ্ছিন্ন কবীলা বা গোত্র কেন্দ্রিক আরব সমাজকে বিশ্বের সর্বপ্রথম আধুনিক জনগণতান্ত্রিক পরামর্শভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে আনেন। আরবরা রাষ্ট্রিয় আনুগত্য বুঝতো না। তারা বুঝতো কবীলা বা গোত্র প্রধানের আনুগত্য। বিচ্ছিন্নভাবে ছোট বা বড় গোত্রের অধীনে তারা বাস করত। গোত্রের বাইরে কারো আনুগত্য বা অধীনতাকে তারা অবমাননাকর বলে মনে করত। এছাড়া ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ স্বাধীনতাবোধ তাদেরকে তাদের মতের বাইরে সকল সিদ্ধান্ত অমান্য করতে প্রেরণা দিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিচ্ছিন্ন জাতিকে প্রথমবারের মত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসেন। তিনি এজন্য বারবার তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ঐক্য আনুগত্যের মধ্যে অবস্থান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্য বর্জন করা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা করা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বাইরে বা রাষ্ট্রহীনভাবে বাস করাকে তিনি জাহিলী জীবন প্রকারের মৃত্যুকে জাহিলী মৃত্যু বলেছেন। কারণ জাহিলী যুগের মানুষ রাষ্ট্র চিনত না এবং রাষ্ট্রহীনভাবে বসবাস করত। কাজেই এভাবে থাকা নিঃসন্দেহে জাহিলী জীবন এভাবে মরা জাহিলী মরা। পছন্দ হোক বা না হোক রাষ্ট্র প্রশাসনের আনুগত্য করতে হবে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, কবীলা বা দলের মতামতের কারণে বা কোন অবস্থাতেই রাষ্ট্র বা সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। প্রয়োজনে রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রশাসনকে সৎকাজে আদেশ, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ সংশোধন করতে হবে। কিন্তু বিদ্রোহ, গৃহযুদ্ধ হানাহানি নিষিদ্ধ

অর্থে তিনি যে সকল নির্দেশনা দিয়েছেন তা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। তিনি মুসলিম উম্মাহকে সর্বদা রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য করতে বলেছেন। রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের প্রতীক ‘‘বাইয়াত’’ বা ‘‘আনুগত্যের শপথ’’ সর্বদা বজায় রাখতে বলেছেন। তিনি তাদেরকে ‘‘জামাআত’’ বদ্ধ থাকতে বলেছেন। সকল হাদীসের মর্মাথ একই। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে হবে এবং বিদ্রোহ, হানাহানি বা ক্ষমতা দখলের অবৈধ প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে।[2]
অর্থের হাদীসগুলি পর্যালোচনা করলেই আমরা তা বুঝতে পারব। ইবনু আববাস (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

من رأى من أميرِه شيئًا يكرهُه فليصبر عليه فإنَّهُ من فارقَ الجماعةَ شبرًا فمات (ليس أحد يفارق الجماعة شبراً فيموت) إلا مات ميتةَ جاهليةٍ

‘‘কেউ তার শাসক বা প্রশাসক থেকে কোন অপছন্দনীয় বিষয় দেখলে তাকে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। কারণ যদি কেউ জামাআতের (মুসলিম সমাজ বা রাষ্টের ঐক্যের) বাইরে এক বিঘতও বের হয়ে যায় এবং অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’[3]
আবু হুরাইরা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

من خرج من الطاعةِ ، وفارقَ الجماعةَ ، فماتَ ، ماتَ ميتةً جاهليّةً

‘‘যে ব্যক্তিতাআতবারাষ্ট্রীয় আনুগত্যথেকে বের হয়ে এবং জামাআত বা মুসলিম সমাজ জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যু বরণ করল সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’[4]
মুআবিয়া (রা) তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে রাষ্ট্র প্রধান পদে মনোনয়ন দান করেন এবং তার আনুগত্যের জন্য তিনি রাষ্ট্রের সকল নাগরিক থেকে বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। ৬০ হিজরীতে মুআবিয়া (রা)-এর ইন্তেকালের পরে ইয়াযিদ শাসনভার গ্রহণ করেন এবং চার বছর শাসন করে ৬৪ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেন। তার শাসনামলে ৬৩ হিজরীতে মদীনার অধিবাসীগণ ইয়াযিদের জুলুম-অত্যাচার, ইমাম হুসাইনের শাহাদত ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বিদ্রোহ করেন। তাদের বিদ্রোহ ছিল যুক্তিসঙ্গত এবং একান্তুই আল্লাহর ওয়াস্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনুপ্রেরণা নিয়ে। কিন্তু তা সত্বেও সে সময়ে জীবিত সাহাবীগণ বিদ্রোহে রাজী ছিলেন না। সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা) মদীনার বিদ্রোহের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু মুতি নিকট গমন করেন। তিনি তাকে সম্মানের সাথে বসতে অনুরোধ করেন। ইবনু উমর বলেন: আমি বসতে আসিনি। আমি তোমাকে একটি হাদীস শুনাতে এসেছি। আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি:


من خلع يدًا من طاعةٍ ، لقيَ اللهَ يومَ القيامةِ ، لا حُجَّةَ له . ومن مات وليس في عُنُقِه بَيعةٌ ، مات مِيتةً جاهليةً

‘‘যে ব্যক্তিতাআতবা রাষ্ট্রীয় আনুগত্য থেকে নিজেকে বের করে নিল সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হলে নিজের জন্য কোন ওজর পেশ করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল যে, তার গলায় কোনবাইআতবা রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের অঙ্গীকার নেই সে ব্যক্তি জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’[5]
রাষ্ট্রীয় ঐক্য বা ‘‘জামাআত’’ বিনষ্ট করা এত বড় অপরাধ যে, এর শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আরফাজা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:


إنه ستكون هنّاتٌ وهنّاتٌ فمن أرادَ أن يُفَرّقَ أمرَ هذهِ الأمةِ وهي جميعٌ ، فاضرِبُوهُ بالسيفِ كائنا من كانَ (من أتاكم وأمركُم جميعٌ على رجلٍ واحدٍ يريدُ أن يشقُّ عصاكُم أو يفرقَ جماعتكُم فاقتلوهُ)

‘‘ভবিষ্যতে অনেক বিচ্যুতি-অন্যায় সংঘটিত হবে। যদি এমন ঘটে যে, উম্মাতের ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় কেউ এসে সে ঐক্য বিনষ্ট করে বিভক্তি সৃষ্টি করতে চায় তবে সে যেই হোক না কেন তোমরা তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবে। অন্য বর্ণনায়: তোমাদের বিষয়টি একব্যক্তির বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় (একজন্য রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে থাকা অবস্থায়) কোনো একব্যক্তি যদি এসে তোমাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে বাজামাআতবিভক্ত করতে চায় তবে তাকে হত্যা করবে।’’[6]
আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:


إذا بُويِعَ لخليفتينِ ، فاقتلُوا الآخرَ منهما

‘‘যদি দুজন খলীফার বাইয়াত করা হয় তবে যে পরে বাইয়াত নিয়েছে তাকে হত্যা করবে।’’[7]
হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান বলেন, মানুষেরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে ভাল বিষয়াদি সম্পর্কে প্রশ্ন করত। আমি তাঁকে খারাপ বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করতাম, ভয়ে যে, কি জানি আমি কোনো খারাপের মধ্যে নিপতিত হয়ে যায় কিনা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা জাহিলিয়্যাত অকল্যাণের মধ্যে ছিলাম। তখন আল্লাহ আমাদেরকে কল্যাণ এনে দিলেন। এর পরে কি আবার কোনো অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, সে অকল্যাণের পরে কি আবার কল্যাণ ফিরে আসবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তবে তার মধ্যে কিছু জঞ্জাল-ময়লা থাকবে। আমি বললাম, সে জঞ্জাল-ময়লা কি? তিনি বলেন, কিছু মানুষ যারা আমার আদর্শ নীতি ছেড়ে অন্য আদর্শ রীতি অনুসরণ করবে। তুমি তাদের মধ্যে ভাল মন্দ দেখতে পাবে। আমি বললাম, ভাল অবস্থার পরে কি আবার খারাপ অবস্থা আছে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। জাহান্নামের দরজাগুলির দিকে আহবানকারীগণ (আবির্ভুত হবে), যারা তাদের ডাকে সাড়া দিবে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তাদের বর্ণনা দিন। তিনি বললেন, তারা আমাদেরই চামড়ার মানুষ-আমাদেরই স্বজাতি, আমাদের ভাষাতেই তারা কথা বলবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যদি অবস্থায় পড়ে যাই তবে আপনি আমাকে কি করতে বলেন, তিনি বলেন:


تلزمُ جماعةَ المسلمين ، وإمامَهم قلتُ فإن لم يكن لهم جماعةٌ ولا إمامٌ قال فاعتزل تلك الفِرقَ كلَّها ولو أن تعضَّ على أصلِ شجرةٍ حتى يُدرِكَك الموتُ وأنت على ذلك

‘‘তুমি মুসলিমদের জামাআত (সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগোষ্ঠী) তাদের ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান)-কে ধরে থাকবে। আমি বললাম, যদি তাদের কোনো জামাআত না থাকে এবং কোনো ইমামও না থাকে (জনগণ সকলেই ক্ষুদ্রক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাহীন বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকে), তিনি বললেন, সেক্ষেত্রে তুমি সে সকল দল সবগুলিকেই পরিত্যাগ করবে। যদি তোমাকে কোনো গাছের মূল কামড়ে ধরে পড়ে থাকতে হয় তাও থাকবে। এভাবে থাকা অবস্থাতেই যেন তোমার মৃত্যু এসে যায়।’’[8]
হারিস আশআরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,

أنا آمرُكم بخمسٍ ، اللهُ أمرني بهنَّ : السمعُ ، و الطاعةُ ، و الجهادُ ، و الهجرةُ ، والجماعةُ ، فإنه من فارق الجماعةَ قَيْدَ شبرٍ ، فقد خلع رِبقةَ الإسلامِ من عُنُقِه ، إلا أن يراجِعَ

‘‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি, যেগুলির নির্দেশ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন: শ্রবণ, আনুগত্য, জিহাদ, হিজরত জামাআত; কারণ যে ব্যক্তি জামাআত থেকে এক বিঘত সরে গেল সে ইসলামের রজ্জু নিজের গলা থেকে খুলে ফেলল, যদি না ফিরে আসে।’’[9]
এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসের পরিভাষায় জামাআত বলতে ‘‘রাষ্ট্রীয় ঐক্য’’ বা মুসলিম সমাজ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ঐক্য বুঝানো হয়েছে। তারা যখন কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তখন ব্যক্তিগতভাবে, দলগতভাবে বা গোষ্ঠীগতভাবে সে সিদ্ধান্ত অমান্য করা, নিজের মতের উপর অটল থাকা বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতের বিরোধিতা করা নিষিদ্ধ
উপরের হাদীসগুলি মূলত কুরআনের বিষয়ক নির্দেশের ব্যাখ্যা। মহান আল্লাহ বলেন:


وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا

‘‘তোমরা আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ কর ঐক্যবদ্ধভাবে; এবং দলেদলে বিভক্ত হয়ো না।’’[10]
এখানে আল্লাহজামাআতবা ঐক্যের নির্দেশ দিয়েছেন এবংতাফার্রুকবা দলাদলি করতে বা দলে দলে বিভক্ত হতে নিষেধ করেছেন। জামাআতের সর্বোচ্চ নির্দশন ছিলেন সাহাবীগণ। এছাড়া ধর্মীয় বিষয়েজামাআতবুঝাতে মুসলিম উম্মাহর আলিম সমাজের সমষ্টি বা ঐক্য বুঝানো হয়েছে বলে মনে করেছেন কোনো কোনো আলিম।[11] সর্বাবস্থায় সকলেইজামাআতবলতেসাধারণ জনগোষ্ঠীবা (society, community) বুঝিয়েছেন, কেউজামাআতবলতেদল’ (group, party) বুঝান নি। আরবীতে ‘‘দল’’ বা সংগঠন বুঝাতেফিরকা’, ‘হিযব’ ‘কাওমইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, ‘জামাআতনয়

আমরা আগেই বলেছি যে, একটি নির্ধারিত স্থানের সকল মানুষ বুঝাতেও ‘‘জামাআত’’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এরূপ সীমিত ‘‘জামাআত’’ বা ঐক্য অর্থে আধুনিক যুগে কখনো কখনো জামাআত বলতে ‘‘দলবদ্ধতা’’ বুঝানো হয়। অর্থাৎ কোনো উদ্দেশ্য সামনে রেখে কতিপয় মানুষের ঐক্য। এরূপ ঐক্য বা ‘‘জামাআত’’- ইসলাম নির্দেশিত। কোনো সফরে বা অন্য কোনো কর্মে বা উদ্দেশ্যে তিনজন মানুষ থাকলে একজনকে আমীর বা নেতা নিযুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)

অর্থে দীনী কর্মে ক্ষুদ্র পরিমন্ডলে মুসলিমগণ ‘‘জামাআতবদ্ধ’’ অর্থাৎ ‘‘একই কর্মে রত সকল মানুষ ঐক্যবদ্ধ’’ থাকতে পারেন; তবে উপরের আয়াত হাদীসগুলিতেজামাআতবলতে ক্ষুদ্র ঐক্য বা ‘‘দল’’ বুঝানো হয় নি; মুসলিমদের সামগ্রিক ঐক্য বুঝানো হয়েছে। কাজেই এরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলভুক্ত হওয়াকে ইসলাম পালনের অংশ মনে করার অর্থ ইবাদত পালনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে বিষয়কে শর্ত করেন নি তাকে যুক্তি দিয়ে শর্ত বানিয়ে নেওয়া। উপরন্তু এরূপ ধারণার দ্বারা ইসলাম নিষিদ্ধ ‘‘দলাদলি’’, ‘‘বিভক্তি’’ বা ‘‘বিচ্ছিন্নতা’’ একটি ইসলামী ইবাদত বলে পরিগণিত হবে! দীন পালন দীনী দাওয়াতে সামষ্টিক প্রচেষ্টা অধিকতর ফলদায়ক। ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ, দীন প্রতিষ্ঠা বা আল্লাহর পথে দাওয়াতের জন্য এরূপ ক্ষুদ্রতর বা আংশিক ‘‘জামাআত’’ (ঐক্য) একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারী উপকরন। কিন্তু দাওয়াতের জন্য ‘‘জামাআত’’ শরীয়ত-নির্দেশিত কোনো জরুরী বিষয় নয়।সালাতেরক্ষেত্রে ফরয সালাত একাকী পালন করলে সাওয়াব কম হবে বা গোনাহ হবে বলে সুন্নাত থেকে আমরা জানতে পারি। কিন্তুদাওয়াতেরক্ষেত্রে ইবাদত একাকী পালন করলে সাওয়াব কম হবে বা গোনাহ হবে বলে আমরা মনে করতে পারি না

এরূপ মনে করলে তা সুন্নাতের ব্যতিক্রম এবং বিদআতে পরিণত হবে। যেমন অধিক উপকার বা অনুরূপ কোনো যুক্তি দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ-সালাম, যিকর ইত্যাদি ইবাদত পালনের জন্যজামাআতবা দলবদ্ধতা, দন্ডায়মান হওয়া, চিৎকার করা ইত্যাদিকে উক্ত ইবাদতের অংশ মনে করা বা সকল ইবাদত একাকী পালন করলে, বসে পালন করলে বা মৃদু শব্দে পালন করলে সাওয়াব কম হবে বলে মনে করা

জামাআতুল মুসলিমীন’-এর বিভ্রান্তির কারণ হলো তারাজামাআতবিষয়ক প্রচলিত সংকীর্ণ অর্থকে ইসলামী পারিভাষিক অর্থ বলে দাবি করেন। এরপর সুন্নাতের নির্দেশনা ছাড়াই বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে দীন পালন দীন প্রতিষ্ঠার জন্য ‘‘দলবদ্ধতা’’ শর্ত বলে গণ্য করেন।জামাআতবিষয়ক উপরের হাদীসগুলির আলোকে তারা দাবি করেন যে, দলের মধ্যে থাকা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ দল বা জামাআত পরিত্যাগ করাকে জাহিলিয়্যাত বলা হয়েছে, আর জাহিলিয়্যাত অর্থই কুফরী। এছাড়া জামাআত পরিত্যাগ করাকে ইসলামের রজ্জু খুলে ফেলা বলে অভিহিত করা হয়েছে। এতে বুঝা যায়জামাআতত্যাগকারী কাফির বলে গন্য হবে। উপরের আয়াত হাদীসগুলির নির্দেশনা হলো, মুমিনগণ দলাদলি করবেন না। ইসলামের মধ্যে কোনো দলাদলি থাকবে না; বরং সকল মুসলিম ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। অন্তত মুমিন সকল মুমিনকে একদল বলে বিশ্বাস করবেন। দল, মত, বর্ণ, দেশ, কর্ম, মাযহাব ইত্যাদির পার্থক্যের কারণে এক মুসলিম আরেক মুসলিমকে ‘‘অন্যদল’’ বলে মনে করবেন না; বরং এগুলি-সহ সকল মুসলিমকে একদল বলে বিশ্বাস করবেন। কিন্তু কথার ব্যাখ্যায় জামাআতুল মুজাহিদীন নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘‘মুসলিম হতে হলে কোনো না কোনো দলে থাকতে হবে!’’ অর্থাৎ দলাদলি করতেই হবে! হলো কুরআন হাদীসের নির্দেশনার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ

ভুল অর্থের ভিত্তিতে তারা দাবী করেন যে, ইসলাম পালনের জন্য কোনো না কোনো দলের মধ্যে থাকতে হবে। আর যেহেতু একমাত্র তারাই দীন প্রতিষ্ঠা দীনের বিজয়ের জন্য চেষ্টা করছেন সেহেতু তাদের দলই একমাত্র সঠিক দল। যারা তাদের বিরোধিতা করেন তারা মূলত দীন প্রতিষ্ঠা দীনের বিজয় চাচ্ছেন না। এজন্য তারাও কাফির। জামাআতের পাশাপাশি তারাবাইআত’-কেও ঈমানের অংশ বলে গণ্য করেন, কারণ বাইয়াত পরিত্যাগ করাকে জাহিলিয়্যাত বলা হয়েছে। তারা বলেন দলের আমীরের হাতে বাইয়াতই হলো দলভূক্তির একমাত্র পথ। যে ব্যক্তি তাদের দলের আমীরের হাতে বাইয়াত করে তাদের দলে যোগদান করবে শুধু তারাই মুসলিম বলে গণ্য হবে। যারা এভাবে তাদের দলভুক্ত হতে অস্বীকার করবে তারা কাফির বলে গণ্য হবে। উপরের আলোচনা থেকে সকল বিষয়ের বিভ্রান্তি আমরা বুঝতে পেরেছি। বস্ত্তত মুসলিমকে বা যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছে তাকে কোনো কর্ম, দ্ব্যর্থবোধক কথা, অপছন্দনীয় বিশ্বাস, আকীদা বা মতবাদের কারণে কাফির বলে গণ্য করার প্রবণতা মুসলিম উম্মাতের জন্য সর্বদা বেদনা ক্ষতি বয়ে এনেছে। থেকে উম্মতের মধ্যে দলাদলি, মারামারি, সংঘর্ষ, সংঘাত সন্ত্রাসের জন্ম হয়েছে। সাহাবীগণ তাঁদের অনুসারী উম্মাতের মূলধারার আলিমগণ ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। পাপের কারণে তো নয়ই, এমনকি ইসলামী বিশ্বাসের সাথে আংশিক বা বাহ্যিক সাংঘর্ষিক মতবাদ, বিশ্বাস বা আকীদার কারণেও তারা ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলতেন না। তার কোনো ব্যাখ্যা বা ওজর আছে কিনা তা সন্ধান করতেন এবং ঈমানের বিষয়ে তার মুখের দাবির উপরেই নির্ভর করতেন। এজন্য খারিজী, শিয়া, মুতাযিলী, কাদারীয়া, জাবারিয়া ইত্যাদি বিভ্রান্ত বিশ্বাস বা মতবাদের অনুসারীরা কুরআনের অনেক আয়াত ইসলামী অনেক বিশ্বাস অস্বীকার করলেও তাদেরকে কাফির না বলে বিভ্রান্ত বা ভ্রান্তিতে নিপতিত মুসলিম বলে গণ্য করেছেন। আমি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সম্মানিত পাঠককে বইটি পড়তে অনুরোধ করছি

[1] কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃ. ৫৭৬-৫৮২
[2]
দেখুন: ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/, শাওকানী, নাইলুল আউতার /৩৫৬-৩৫৭
[3]
সহীহ বুখারী, /২৬১২, নং ৬৭২৪, সহীহ মুসলিম /১৪৭৭ নং ১৮৪৯
[4]
সহীহ মুসলিম /১৪৭৬-১৪৭৭ নং ১৮৪৮
[5]
সহীহ মুসলিম /১৪৭৮, নং ১৮৫১
[6]
সহীহ মুসলিম /১৪৭৮, নং ১৮৫১
[7]
সহীহ মুসলিম /১৪৭৮, নং ১৮৫১
[8]
সহীহ বুখারী, /১৩১৯, /২৫৯৫; সহীহ মুসলিম /১৪৭৫
[9]
তিরমিযী, আস-সুনান /১৪৮
[10]
সূরা () আল-ইমরান: ১০৩ আয়াত
[11]
শাতিবী, ইবরাহীম ইবনু মূসা (৭৯০ হি.), আল-তিসাম /২৫৮-২৬৫ . খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরান-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, ৫৭৬-৫৮২

 . . ইসলামী রাষ্ট্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা - (. . . ইসলাম রাষ্ট্র)

ইসলাম ধর্ম ইসলামী সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র বিশ্বকে নিয়ে ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা। তবে ব্যক্তি, সমাজ রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাভাবিক পার্থক্য রক্ষা করা হয়েছে ইসলামে। রাষ্ট্র-ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ছাড়া সকল দেশের সকল সমাজের মানুষদের জন্য পালনীয় প্রশস্ততা রয়েছে ইসলামে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মুমিনের ধর্ম পালনের জন্য শর্ত বা মূল বিষয় বলে গণ্য করা হয় নি। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইসলামের একটি অংশ। ইসলামে রাষ্ট্র ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান আছে। তবে ইসলাম শুধু রাষ্ট্র ব্যবস্থার নাম নয়। মুমিন আরকানে ইসলাম অন্যান্য ফরয, নফল ইবাদত সাধ্যমত পরিপূর্ণভাবে পালনের মাধ্যমে নিজের জীবনে পূর্ণতমভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন। কোনো মুসলিম কোনো রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকলে তিনি তার দায়িত্ব আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে পালন করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। এক্ষেত্রে তার নিজ জীবনের অন্যান্য কর্মের মত রাষ্ট্রীয় কর্ম আল্লাহর হুকুম মত পালন করা তার দায়িত্ব। অন্যান্য মুসলিমের দায়িত্ব রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি বা পরিবারের সকল ক্ষেত্রে সবাইকে আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্য দাওয়াত দেওয়া। যে কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (সাঃ) নির্দেশ লঙ্ঘিত হলে সুযোগ সাধ্যমত কুরআন নির্দেশিত উত্তম আচরণ দ্বারা খারাপ আচরণের প্রতিরোধ পদ্ধতিতে দাওয়াত, ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধের মাধ্যমে তা সংশোধন পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। তবে চেষ্টা সফল না হলে মুমিনের দ্বীন-পালন ব্যাহত হয় বা সমাজ রাষ্ট্রের পাপের কারণে ব্যক্তি মুমিন পাপী হন এরূপ চিন্তার কোনো ভিত্তি নেই

 . . . ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি

ইসলাম সর্বকালের সর্বযুগগের সমগ্র মানব জাতির জন্য স্থায়ী জীবন ব্যবস্থা এবং বিশ্বজনীন সর্বজনীন ধর্ম। কুরআন কারীম, হাদীসে রাসূল (সাঃ) সাহাবীগণের জীবনপদ্ধতি থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এতে দুটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে: একদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছে যেন যুগ, সমাজ, সামাজিক রুচি আচার আচরণের পরিবর্তনের ফলে ইসলামের ধর্মীয় রূপে পরিবর্তন না আসে। অপর দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে যে, যুগ, সমাজ, আচার-আচরণ ইত্যাদির পরিবর্তনের কারণে ইসলামের আহকাম পালনে যেন কারো কোনো অসুবিধা না হয়। সকল যুগের সকল দেশের মানুষেরা যেন সহজেই জীবন ধর্ম ইসলাম পালন করতে পারে

মূলনীতির ভিত্তিতে ইসলামে মানব জীবনের কর্মকান্ডকে মূল দুভাগে ভাগ করা হয়েছে: () ইবাদাত () মুআমালাত। মানুষকে জীবন ধারণ করতে জাগতিক জৈবিক প্রয়োজনে যা করতে হয় এবং বিশ্বাসী-অবিশ্বাস ধার্মিক-অধার্মিক সকলেই যা করেন তা মুআমালাত বা জাগতিক কর্ম বলে গণ্য। আর জাগতিক প্রয়োজনের ঊর্দ্ধে শুধু মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য মানুষ যে কর্ম করে তা ইবাদত বলে গণ্য
ইবাদত মুআমালাতের পার্থক্য বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমার লেখা ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থটি পাঠ করতে পাঠককে অনুরোধ করছি। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইবাদতের ক্ষেত্রে ইসলামে বিস্তারিত খুটিনাটি নিয়ম-পদ্ধতি বিধিবিধান প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে কর্ম যেভাবে করেছেন অবিকল সেভাবে করার বিশেষ তাকিদ দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে মুআমালাত বা জাগতিক কর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রশস্ততা দেওয়া হয়েছে। কিছু মূলনীতি প্রদান করা হয়েছে এবং ফরয হারাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে সবই বৈধ বলে গণ্য হবে। মুআমালাতের ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তা বৈধ বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যা করেন নি তা করা নিষিদ্ধ। আর মুআমালাতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যা নিষেধ করেছেন শুধু তাই নিষিদ্ধ, যা তিনি নিষেধ করেন নি তা বৈধ

চাষাবাদ, চিকিৎসা, বাড়িঘর তৈরি ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ে যেমন প্রশস্ততা প্রদান করা হয়েছে, তেমনি প্রশস্ততা প্রদান করা হয়েছে ইবাদত পালনের জাগতিক উপকরণের ক্ষেত্রে। যেমন ইলম শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তবে শিক্ষার পদ্ধতি, উপকরণ ইত্যাদির বিষয় উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কেউ বলতে পারেন না যে, সাহাবীগণের যুগে ছাপানো বই ছিল না, পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল না বা সনদ প্রদানের পদ্ধতি ছিল না কাজেই তা নিষিদ্ধ। বরং যতক্ষণ না শরীয়তে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যাবে ততক্ষণ তা বৈধ

বিবাহ, পরিবারগঠন, আবাসন, চিকিৎসা ইত্যাদির মত রাষ্ট্রগঠন, রাষ্ট্রপরিচালনা বিষয়ক দায়িত্বাবলি ‘‘মুআমালাত’’ এজন্য ইসলামে বিষয়ে মৌলিক নীতিমালার মধ্যে প্রশস্ততা প্রদান করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর খুটিনাটি বিষয়ে দেশ, যুগ, জাতি পরিবেশের আলোকে ভিন্নতার অবকাশ রাখা হয়েছে। সকল মূলনীতির আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনার জন্য পৃথক গ্রন্থের প্রয়োজন। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্র ‘‘থিওক্র্যটিক’’ বা পুরোহিত-তান্ত্রিক নয়, বরং জনগণতান্ত্রিক। এখানে মোল্লা, পুরোহিত, ইমাম বা অন্য কোনো ধর্মীয় নেতাকে ‘‘আল্লাহর নামে’’ বা ‘‘আল্লাহর খলীফা’’ হয়ে শাসন করার ক্ষমতা বা সুযোগ দেওয়া হয় নি। ইসলামে কখনোই শাসককে ‘‘আল্লাহর খলীফা’’ হিসেবে গণ্য করা হয় নি, তাকে বিশেষ অধিকার, ক্ষমতা বা অভ্রান্ততা প্রদান করা হয় নি বা তাকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রাখা হয় নি। বরং শাসককে জনগণের প্রতিনিধি জনগণের কাছে জবাবাদিহী বলে গণ্য করা হয়েছে

কেবলমাত্রশীয়াসম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসে ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রাজতান্ত্রিক পুরোহিততান্ত্রিক বলে দাবি করা হয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রক্ষমতা আলী (রা)-এর বংশধরদের পাওনা। আর ‘‘রাষ্ট্রীয় নেতা’’ বা ইমাম আল্লাহর খলীফা হিসেবে বিশেষ জ্ঞান, ক্ষমতা অধিকার সংরক্ষণ করেন। রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তাঁর মতামতই চূড়ান্ত। তাঁর অনুপস্থিতি বা অদৃশ্য থাকা অবস্থায় ‘‘ফকীহ’’ তাঁর প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। কুরআন হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে সাহাবীগণ পরবর্তী মূলধারার মুসলিম আলিমগণ মত প্রত্যাখ্যান করেছেন। বস্ত্তত রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর আগমনের সময়ে পৃথিবীতে বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলির মধ্যে মূল তিনটি বিষয় দেখা যায়:

প্রথমত: রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস বংশ বা জবরদখল
রাজবংশের কেউ রাজা হবে এটাই ছিল সর্বজনস্বীকৃত রীতি। রাজতন্ত্রের বাইরে ক্ষমতা গ্রহণের একমাত্র উৎস ছিল অস্ত্র বা জবরদখল। রাজাকে হত্যা করে বা অস্ত্রের ক্ষমতায় রাজদন্ড গ্রহণ করা


দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রের মালিকানা বা সার্বভৌমত্ব রাজার রাজ্যের সকল সম্পদ নাগরিক রাজার মালিকানাধীন। তিনি সকল জবাবাদিহিতার ঊধ্বে। রাষ্ট্রের সম্পদ নাগরিকদের বিষয়ে তিনি ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন এবং তার সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত
এরূপ সর্বোচ্চ ক্ষমতা বুঝাতে ইংরেজিতে (sovereignty) শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শব্দটি প্রাচীন ফরাসী souverein, ল্যাটিন superanus/ super শব্দ থেকে এসেছে। এর মূল অর্থ (above) বা ঊধ্বে। যেহেতু রাজার ক্ষমতা সকলের ঊর্ধ্বে সেহেতু রাজাকে ইংরেজিত বলা হয় sovereign ইংরেজীতে sovereign অর্থই king বা রাজা। আরবী অভিধানেও sovereign অর্থ ملك (রাজা) (sovereignty) অর্থ বাংলায় রাজত্ব এবং আরবীতে মুলক (الملك) বা সিয়াদাত (السيادة) অর্থাৎ রাজত্ব বা কর্তৃত্ব
বাংলায় এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘‘সার্বভৌমত্ব’’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বাংলা শব্দটি ‘‘সর্বভূমি’’ থেকে গৃহীত। এর অর্থবিশ্বজনীনবা universal হওয়া উচিত। ইংরেজি (sovereign) বা সর্বোচ্চ শব্দের মূল অর্থের সাথে বাংলা সর্বভূম বা বিশ্বজনিন শব্দের মূল অর্থের মিল নেই। তবে প্রাচীন যুগে ‘‘সারা বিশ্বে পরিচিত’’ অর্থে শাসক বা বড় পন্ডিতকে ‘‘সার্বভৌম’’ উপাধি দেওয়া হতো। এভাবে রাজাকে ‘‘সার্বভৌম’’ বলার প্রচলন ঘটে। আর এথেকেই রাজত্বকে সার্বভৌমত্ব বলা হয়


তৃতীয়ত: রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা প্রতিভূ
প্রায় সকল সমাজেই রাজাকে কোনো না কোনোভাবে ঈশ্বরের পুত্র, প্রতিনিধি বা বংশধর বলে কল্পনা করে তাকে ঐশ্বরিক বা ধর্মীয় পবিত্রতা, অধিকার অভ্রান্ততা (infalliblity) প্রদান করা হয়েছে। বিশেষত খৃস্টীয় চতুর্থ শতকের শুরুতে বাইযান্টাইন- রোমান সাম্রাজ্যে খৃস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা প্রদানের পর থেকে ইউরোপে থিওক্র্যাটিক শাসনের শুরু হয় এবং ধর্মের নামে বা আল্লাহর নামে শাসক পুরোহিতদেরকে আল্লাহর প্রতিনিধি প্রতিভু হিসেবে বিশেষ পবিত্রতা প্রদান করা হয়। তাদের নির্দেশ আক্ষরিক পালন করা ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তাদের নির্দেশ অমান্য করা ধর্মদ্রোহিতা বলে গণ্য হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাষ্ট্রের বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মূলনীতি প্রদান করেন। তাঁর দেওয়া মূলনীতির প্রধান দিকগুলি নিম্নরূপ:

প্রথমত: রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস নাগরিকদের পরার্মশ
কুরআন কারীমে এবং হাদীস শরীফে মুমিন জীবনের সকল ক্ষেত্রে সংশি­ষ্ট সকলের পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মূলনীতি হাতে-কলমে শেখানোর জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাউকে তাঁর পরে রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য মানোনয়ন দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, যেন মুসলিমগণ পরামর্শ ব্যবস্থার বাস্তব প্রয়োগ করতে পারেন
মহান আল্লাহ মুমিনদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেন:

وَالَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِرَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ

‘‘যারা তাদের প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দিয়েছে, সালাত কায়েম করেছে, তাদের কর্ম তাদের মধ্যে পারস্পরিক পরামর্শভিত্তিক এবং তাদেরকে যা রিযকপ্রদান করেছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।’’[1]
তাহলে, মুমিনদের সকল কর্ম তাদের সকলের পরামর্শভিত্তিক। যে বিষয়ে আল্লাহর সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই এরূপ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশি­ষ্ট সকলের পরামর্শ গ্রহণই মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য। আর এরূপ বিষয়ের অন্যতম রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি, যা সকল নাগরিকের স্বার্থের সাথে সংশি­ষ্ট। শাসক, প্রশাসক, সরকার বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচন, নির্বাচনের মেয়াদ, সরকার পরিচালনা পদ্ধতি, বিষয়ক নীতি নির্ধারণ, জাতীয় আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে

কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা যে সংশি­ষ্ট সকলেই পরামর্শ প্রদান করবেন। নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাধারণ-অসাধারণ সকলের পরামর্শ গ্রহণ নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। কাউকে বাদ দেওয়ার কোনোরূপ নির্দেশনা নেই। যদি কেউ পরামর্শ দেন অন্যরা মেনে নেন তাহলেও অসুবিধা নেই

কুরআন-হাদীসে সংশি­ষ্ট সকলের পরামর্শ গ্রহণের তাকিদ দেওয়া হয়েছে, তবে পরামর্শ গ্রহণের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেওয়া হয় নি। বরং অন্যান্য জাগতিক উপকরণ সংশি­ষ্ট বিষয়াদির মত বিষয়কে যুগ, জাতি পরিবেশের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। সংশি­ষ্ট মানুষদের অবস্থা অনুসারে সরাসারি সকল নাগরিকের, তাদের প্রতিনিধিদের, গোত্রপতিদের, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের বা সামাজিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। এরূপ পরামর্শ গ্রহণ মুখে হতে পারে বা গোপন ব্যালটে হতে পারে। এক্ষেত্রে পরামর্শ গ্রহণের কোনো একটি পদ্ধতিকে ইসলামী বা ইসলাম বিরোধী বলে গণ্য করার কোনো সুযোগ নেই
সাহাবীগণের যুগে বা পরবর্তী যুগে ছিল না বলে বা প্রাচীন ফিকহের গ্রন্থে লেখা নেই বলে সার্বজনীন ভোট ব্যবস্থা, বা বৎসর পরে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা বা পরামর্শ গ্রহণের অনুরূপ কোনো পদ্ধতিকে ইসলাম বিরোধী বলে চিন্তা করা আর মাদ্রাসায় পরীক্ষা ব্যবস্থা, সনদ প্রদানের ব্যবস্থা, ছাপানো বই পড়ার ব্যবস্থা বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার ইসলাম বিরোধী বা নিষিদ্ধ বলে চিন্তা করা একই ধরনের অজ্ঞতা বিভ্রান্তি


দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রের মালিকান জনগণের
মালিকানা দু প্রকারের। সকল কিছুর প্রকৃত মালিকানা মহান আল্লাহর। তিনিই মালিক, রাজা বা sovereign পাশাপাশি জাগতিকভাবে মানুষকে দুনিয়াতে তার সম্পদের মালিকানা প্রদান করা হয়েছে এবং মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের
আমরা দেখেছি যে, প্রাচীন ব্যবস্থায় রাজা ছিলেন sovereign বা সার্বভৌম। রাজ্যের সকল সম্পদ নাগরিকের সর্বোচ্চ বা প্রশ্নাতীত মালিকানা (sovereignty) ছিল তার একার। তিনি নিজের প্রয়োজন, সুবিধা ইচ্ছামত তা ব্যবহার করবেন, এতে কারো কোনো আপত্তি বা প্রশ্ন করার অধিকার ছিল না। পক্ষান্তরে ইসলামে রাষ্ট্রের মালিকান নাগরিকগণের। নিজের মালিকানাধীন জমিন যেমন মুমিন আল্লাহর নির্দেশের আওতায় নিজের প্রয়োজন, সুবিধা ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারেন, তেমনি রাষ্ট্রের জনগণ রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা সম্পদ আল্লাহর নির্দেশের আওতায় থেকে নিজেদের প্রয়োজন সুবিধা অনুসারে ব্যবহার করবেন

নিজের মালিকানাধীন সম্পদ, অর্থ অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় রাষ্ট্রের বিষয়াবলিও আল্লাহর নির্দেশ মত পরিচালনা করার বিষয়ে জনগণ দায়বদ্ধ। দায় পালনের জন্য শাসক তাদের প্রতিনিধি এবং তাদের কাছে জবাবদিহী। শাসক রাষ্ট্রের মালিক নন, বরং জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালন করেন। তিনি জনগণের কাছে জবাবাদিহী। জনগণ তাকে যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে, শাসন সংশোধন করতে পারে। এজন্যই শাসক বা সরকার নির্বাচনে জনগণের পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশনা। জনগণের মধ্য থেকে তাদের পরামর্শে সরকার নির্বাচিত হবেন। আর তাদের কর্মকান্ডের জন্য তারা জনগণের কাছে জবাবদিহী থাকবেন

তৃতীয়ত: শাসকের কোনো অভ্রান্ততা বা পবিত্রতা নেই
ইসলামের দৃষ্টিতে শাসক কখনোই আল্লাহর খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত (successor/vicar) নন। অন্য সকল মানুষের মতই তিনি আল্লাহর বিধান ব্যবস্থার অধীন। মহান আল্লাহ রাষ্ট্র পরিচালনা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যে মূলনীতি প্রদান করেছেন তা পালন করতে তিনি বাধ্য। রাষ্ট্রপরিচালনা বিষয়ে ইসলাম কিছু মূলনীতি দিয়েছে, যেগুলির মধ্যে রয়েছে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের মৌলিক নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা সংরক্ষণ করা, জীবন, জীবিকা, ধর্ম, বাসস্থান পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জনগণের পরামর্শ গ্রহণ করা, বৈষম্যহীন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, অপরাধীর সঠিক শাস্তি নিশ্চিত করা ইত্যাদি। বিচার শাস্তির ক্ষেত্রে ইসলামে কিছু শাস্তি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যেগুলি সমাজের অপরাধ দমন করে শান্তি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করে। অন্যান্য অপরাধে শাসক, সরকার বা প্রশাসন প্রয়োজনীয় যুগোপযোগী শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। সকল মূলনীতি বিধিবিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে এবং ইসলামের নির্দেশনার ব্যাখ্যা প্রদানে শাসকের নিজস্ব কোনো পবিত্রতা বা অভ্রান্ততা নেই। জনগণের শাসনে, নির্দেশ দানে বা আল্লাহর বিধানের ব্যাখ্যায় তাঁর নিজের মতের কোনো বিশেষ মূল্য নেই। তার ব্যাখ্যা বা সিদ্ধান্ত ভুল বলে মনে হলে যে কেউ তার সমালোচনা এবং ভুল সংশোধন করতে পারেন

অন্যান্য মুআমালাতের ন্যায় রাষ্ট্রনীতি আইন-বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামে মূলনীতি দেওয়া হয়েছে এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রশস্ততা প্রদান করা হয়েছে। কয়েকটি অপরাধের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়া কঠিন করা হয়েছে। নীতি, বিধান ইত্যাদির ব্যাখ্যা প্রয়োগে কারো অভ্রান্ততা দেওয়া হয় নি। এজন্য মুসলিম দেশগুলিতে কখনোই ইউরোপের মত স্বৈরাচার বা থিওক্র্যাসি প্রতিষ্ঠিত হয় নি
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় আলিমগণ কখনো ধর্মের নামে ক্ষমতা গ্রহণ করেন নি। আলিমগণ কুরআন-হাদীসের নীতিমালা ব্যাখ্যা করেছেন আর শাসকগণ প্রয়োগ করেছেন। উভয় বিভাগেরই স্বকীয়তা স্বাধীনতা ছিল। ব্যাখ্যায় ভুল হয়েছে বলে মনে হলে শাসকগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন সকল আলিমের পরামর্শ নিয়েছেন। প্রয়োগে বাস্তবায়নে ভুল হয়েছে মনে করলে জনগণ আলিমগণ প্রতিবাদ করেছেন। সকল স্বৈরাচারের মধ্যেও শাসকের সমালোচনা, কম বেশি বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, গবেষনা মত প্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত ছিল। কখনোই কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে ধর্মের নামে ভিন্মমতাবলম্বী বা ভিন্নধর্মীয়দের উপর নিয়মতান্ত্রিক বা রাষ্ট্রীয় নির্যাতন করা হয় নি। খৃস্টীয় অষ্টম শতক থেকে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ইউরোপ, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের যে কোনো অমুসলিম দেশের সাথে সে যুগের মুসলিম দেশগুলির অবস্থা তুলনা করলে যে কোনো গবেষক নিশ্চিত হবেন যে, মুসলিম দেশগুলিতে সকল ধর্মের মানুষ সর্বোচ্চ নাগরিক অধিকার ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করেছেন

[1] সূরা (৪২) শূরা: আয়াত ৩৮

 . . . ইসলাম ‘‘তন্ত্র’’

 ‘‘তন্ত্র’’ বা cracy একটি আধুনিক পরিভাষা। বাংলায় ‘‘তন্ত্র’’ শব্দটির অনেক অর্থ রয়েছে, যেমন, শাস্ত্র, বিদ্যা, প্রাধান্য, রাজ্যশাসন পদ্ধতি ইত্যাদি। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য হলো ‘‘রাজ্যশাসন পদ্ধতি’’, যা ইংরেজি (cracy) শব্দের অনুবাদ হিসেবে ব্যবহৃত। ইংরেজি (cracy) শব্দটি গ্রীক (kratos) শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ (power, strength, rule) ক্ষমতা, শক্তি, শাসন ইত্যাদি। বিশ্বের অতীত বর্তমান বিভিন্ন ‘‘রাজ্যশাসন পদ্ধতি’’ পর্যালোচনা করলে আমরা বলতে পারি যে, রাজ্যশাসন পদ্ধতি মূলত দূ প্রকারের হতে পারে:
(
) জনগণের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এবং
(
) শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতার ভিত্তিতে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে শাসকের একচ্ছত্র অধিকার ক্ষমতার উৎস তার বংশ বা দখল হতে পারে বা ‘‘ঐশ্বরিক’’ হতে পারে। শাসক নিজের বংশ বা দখলের অধিকারে রাষ্ট্রের সকল কিছুর মালিকানা দাবি করবেন অথবা নিজেকে ‘‘ঈশ্বরের’’ প্রতিনিধি হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করবেন

আধুনিক পরিভাষায় ‘‘রাজ্যশাসনের’’ প্রথম পদ্ধতি ‘‘গণতন্ত্র’’ (Democracy) এবং দ্বিতীয় পদ্ধতি ‘‘স্বৈরতন্ত্র’’ (Autocracy) নামে পরিচিত। আর যদি শাসক বা শাসকগোষ্ঠী তাদের ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব বা ধর্মীয় অভ্রান্ততা দাবি করেন তাহলে তা ‘‘পুরোহিততন্ত্র’’, ‘‘যাজকতন্ত্র’’ বা (Theocracy) নামে পরিচিত। এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামের উপর্যুক্ত ‘‘রাজ্যশাসন পদ্ধতি’’-কে আমরা কোন্ প্রকারের বলে গণ্য করব?
আমরা অনেক সময় বলি যে, ইসলাম ইসলামই, একে কোনো তন্ত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কথাটির মধ্যে সত্যতা রয়েছে। তবে যে ব্যক্তি ইসলামকে ভালভাবে জানেন না, তাকে ইসলামের বিষয় বুঝাতে হলে তাঁর ভাষায় বা পরিভাষায় অনুবাদ করেই তাঁকে বুঝাতে হবে। এছাড়া ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ধর্ম, যার মধ্যে, বিশ্বাস, কর্ম, আচার আচরণ, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। ‘‘ইসলাম’’ বললে এগুলির সমষ্টি বুঝায়। রাজ্যশাসন পদ্ধতি বিষয়ে ইসলামের দিক নির্দেশনার সমষ্টিকে আমরা সহজবোধ্যভাবে কী বলতে পারি? ইসলামের রাজ্যশাসন পদ্ধতি কি গণতন্ত্র? না স্বৈরতন্ত্র? না পুরোহিততন্ত্র? অন্তত এর কোন্টির সবচেয়ে নিকটবর্তী?

উপরের আলোচনা থেকে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে, ইসলামের রাজ্যশাসন পদ্ধতি ‘‘গণতান্ত্রিক’’ কিন্তু ধর্মের সাথে সংশি­ষ্টতার কারণে পাশ্চাত্য গবেষকগণ একে (Theocracy) বলে উল্লেখ করেছেন। Theocracy শব্দটি গ্রীক (theokratia) থেকে আগত। এর অর্থ (government by a god) বা একজন দেবতার সরকার। ব্যবস্থায় দেবতা, ঈশ্বর বা মহান স্রষ্টাকে একচ্ছত্র ক্ষমতা সর্বোচ্চ মালিকানার অধিকারী (ংড়ষব ংড়াবৎবরমহ) এবং সকল আইনকে ঈশ্বরের নির্দেশ বলে গণ্য করা হয়। স্বভাবতই দেবতা বা ঈশ্বর নিজে শাসন করেন না। কাজেই ঈশ্বরের নামে পুরোহিতগণ বা রাজাই শাসন পরিচালনা করেন। তবে তারা নিজেদেরকে ‘‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি’’ বলে দাবি করেন এবং তাদের আদেশ নিষেধকে অলঙ্ঘনীয় ঐশ্বরিক নির্দেশ বলে গণ্য করেন
ইসলামে আল্লাহকে সর্বোচ্চ মালিকানার অধিকারী (sovereign) বলে বিশ্বাস করা হয়। তিনিই হুকুম, নির্দেশ বা বিধান প্রদানের অধিকারী। কিন্তু এর অর্থ নয় যে, ইসলামী শাসনব্যবস্থা থিওক্রাটিক। থিওক্র্যাসির সাথে ইসলামের মৌলিক পার্থক্য হলো, থিওক্র্যাসিতে রাজা বা পুরোহিতগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তারা ধর্মের নামে বা ঈশ্বরের নামে যে ব্যাখ্যা, আইন বা বিধান প্রদান করবেন তা মান্য করা জনগণের ‘‘ধর্মীয়’’ দায়িত্ব এবং অমান্য করা ‘‘ধর্মদ্রোহিতা’’ থিওক্রাসী হলো ঈশ্বরের বা ধর্মের নামে স্বৈরতন্ত্র

থিওক্র্যাসির মূল প্রেরণা বর্ণনা করে রাজা প্রথম জেমস (১৫৬৬-১৬২৫) বলেন: The state of monarchy is the supremest thing upon earth: for kings are not only god's lieutenants upon earth, and sit upon God's throne, but even by God himself they are called gods.
‘‘
রাজার অবস্থানই পৃথিবীর উপরে সর্বোচ্চ বিষয়। কারণ, রাজাগণ পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং ঈশ্বরের সিংহাসনে আসীন। শুধু তাই নয়, সর্বোপরি স্বয়ং ঈশ্বর তাদেরকে ঈশ্বর বলে আখ্যায়িত করেছেন।’’ (মাইক্রোসফট এনকার্টা)
পক্ষান্তরে ইসলামে আল্লাহর নির্দেশ, হুকুম বা বিধান সকল মানুষের জন্য উন্মুক্তভাবে প্রদান করেছেন। ‘‘রাজ্যশাসনবিষয়েও আল্লাহ মূলনীতি প্রদান করেছেন। এগুলি সবার জন্য উন্মুক্ত। এগুলি হলো সবার জন্য পালনীয় সংবিধানের মৌলিক নীতিমালার মত। এর প্রয়োগে, ব্যাখ্যায় বা আইন প্রণয়নে রাজা বা যাজকগণের কোনোরূপ বিশেষত্ব নেই। বরং রাজ্যশাসন বিষয়ক ইসলামের নীতিমালালিখিত সংবিধানেরমত স্বৈরতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ জনগণের অধিকার রক্ষার অন্যতম মাধ্যম

গণতন্ত্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব যে, গণতন্ত্র অর্থ নির্ধারিত কোনো সরকার ব্যবস্থা নয়। রাজ্যশাসন ব্যবস্থায় যে কোনোভাবে জনগণের অংশীদারিত্ব, পরামর্শগ্রহণ জনগণের নিকট জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলেই তাকে ‘‘গণতন্ত্র’’ বলা যায়। অর্থে মূলত ইসলামই সর্বপ্রথম একটি ‘‘গণতান্ত্রিক’’ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রদান করে। ইসলামের আগে গ্রীসে রোমে গণতন্ত্রের কিছু চর্চা হয়। এরপর তা বিলীন হয়ে যায় এবং বিশ্বের সর্বত্র রাজতান্ত্রিক বা যাজকতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম পরামর্শভিত্তিক প্রতিনিধিত্বমূলক ‘‘গণতান্ত্রিক’’ ব্যবস্থা প্রদান করেন। জনগণতান্ত্রিক নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ বাস্তবায়ন তৎকালীন প্রেক্ষাপটে কষ্টকর ছিল। খিলাফতে রাশেদার পরেই এর থেকে কমবেশি বিচ্যুতি শুরু হয়। তবে ইসলামের ইতিহাসের যে কোনো যুগের স্বৈরাচারী শাসকদের সাথে সে সময়ের ইউরোপের চার্চ খৃস্টান শাসকদের অবস্থা তুলনা করলে যে কোনো গবেষক নিশ্চিত হবেন যে, মূলনীতির প্রভাব সর্বদা বিদ্যমান ছিল

 . . . ইসলামী রাষ্ট্র ইসলামী আইন-বিচার

ইসলামের অপরাধ আইন (criminial law) সম্পর্কে ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি অপপ্রচার পাশ্চাত্যে মুসলিম সমাজগুলিতে বিদ্যমান। ইসলামী অপরাধ আইনের কিছু বিষয়কে আংশিকভাবে উপস্থাপন করে এগুলির ভিত্তিতে ইসলামী আইন, বিচার বিচারব্যবস্থাকে বর্বর, মধ্যযুগীয় এবং পুরোহিততান্ত্রিক বলে অপপ্রচার করা হয়। আবার অনেক আবেগী মুসলিম ইসলামী অপরাধ আইনের কয়েকটি দিককেই ‘‘ইসলামী আইন’’, এগুলির অনুপস্থিতিকে ইসলামী আইন বিচার ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং এগুলি প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামী রাষ্ট্রের একামত্র পরিচয় বলে মনে করেন

যে কোনো রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব () নাগরিকদের বৈষম্যহীন অধিকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা () বহির্শত্রুর আগ্রাসন থেকে রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইসলামেও দুটি বিষয়কে রাষ্ট্রের মূল দায়িত্বগুলির অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলামে ‘‘জিহাদ’’-এর বিধান প্রদান করা হয়েছে। আর প্রথম দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলামে আইন বিচারব্যবস্থা বিষয়ক নীতিমালা প্রদান করা হয়েছে

ইসলামী আইন আইন প্রয়োগের দুটি দিক রয়েছে: () আইন () বিচারব্যবস্থা। ইসলামী আইন বিষয়ে অনেক অপপ্রচার থাকলেও যে কোনো মতের ধর্মের গবেষক ইসলামী বিচারব্যবস্থার শ্রেষ্ঠতের বিষয়ে নিশ্চিত হবেন। বিচারকের নিরপেক্ষতা, বিচারের সচ্ছতা, সাক্ষ্য গ্রহণ, সাক্ষ্য-প্রমাণের সঠিকত্ব প্রমাণ, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, সন্দেহের সুযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকললের জন্য ন্যায়বিচার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম অত্যন্ত কার্যকর, মানবিক সচ্ছ বিচারব্যবস্থা প্রদান করেছে। আধুনিক বিশ্বের প্রায় সকল দেশের বিচারব্যবস্থার অনেক বিষয় ইসলামী বিচারব্যবস্থা থেকে গৃহীত

ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক, সাম্পদিক, অধিকার বিষয়ক অন্যান্য সকল দেওয়ানী (civil) আইনের বিষয়েও অবিকল একই কথা বলতে হবে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই বিচার ব্যবস্থার পাশাপাশি দেওয়ানী, সামাজিক, পারিবারিক অন্যান্য বিষয়ে ইসলামী আইন গৃহীত, প্রচলিত বা স্বীকৃত হয়েছে। আমাদের দেশের অন্যান্য মুসলিম দেশের বিচারব্যবস্থা দেওয়ানী আইন সবই মূলত ইসলামী

এগুলির পাশাপাশি ইসলামে ‘‘অপরাধ আইন’’ রয়েছে। বিশ্বের সকল দেশের অপরাধ-আইনের উদ্দেশ্য অপরাধীর শাস্তি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। ইসলামের অপরাধ আইনেরও একই উদ্দেশ্য। পার্থক্য শাস্তির প্রকৃতিতে। ইসলামে অল্প কয়েকটি অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট সকল অপরাধের ক্ষেত্রে যুগ, জাতি সমাজের প্রেক্ষাপটে শাসক, পার্লামেন্ট, সরকার বা বিচারক শাস্তির প্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারেন

ইসলামে নির্ধারিত শাস্তিগুলি নিম্নরূপ: () ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। () ইচ্ছাকৃত অঙ্গহানির শাস্তি অনুরূপ অঙ্গহানি। () চুরির শাস্তি কব্জি থেকে হাত কেটে দেওয়া। () ব্যভিচারের শাস্তি ১০০ বেত্রাঘাত বিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড। () কারো বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ করে তা জন সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে না পারলে অভিযোগকারী সাক্ষীগণের শাস্তি ৮০ বেত্রাঘাত। () জেনে বুঝে ইসলাম গ্রহণ করার পর ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। () মদপানের শাস্তি ৪০ বা ৮০ বেত্রাঘাত

সকল শাস্তি কেবলমাত্র মুসলিম নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য। বিশেষত ব্যভিচার মদপানের উপর্যুক্ত শাস্তি একান্তভাবেই মুসলিম অপরাধীর জন্য প্রযোজ্য। কোনো মুসলিম নাগরিক সকল অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন বলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে তিনি শাস্তি ভোগ করবেন। অমুসলিমদের জন্য সকল শাস্তি প্রযোজ্য নয়। তারা তাদের ধর্মীয় আইনে বা সামাজিক রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার শাস্তি ভোগ করবেন

হত্যা, অঙ্গহানি চুরি তিনটি অপরাধের বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। তবে শাস্তির প্রকৃতি সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। ইসলামী শাস্তিকে পাশ্চাত্য পন্ডিতগণ কঠোর বা মধ্যযুগীয় বলে দাবি করেন। ব্যভিচার, মদপান ধর্মত্যাগকে তারা অপরাধ বলে গণ্য করতে নারাজ। এগুলির শাস্তিপ্রদানকেও তারা মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা বলে আখ্যায়িত করেন। প্রকৃত সত্য হলো, ‘‘অপরাধ নিয়ন্ত্রণ’’-এর লক্ষ্য অর্জনে ইসলামী বিচারব্যবস্থা ইসলামী দেওয়ানী আইন-এর পাশাপাশি ইসলামী অপরাধ-আইনের সঠিক বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় সহায়ক। সকল আইন কঠোর হলেও তা অমানবিক বা বর্বর নয়; বরং মানবতার সংরক্ষণে বর্বরতা নিয়ন্ত্রণে তা সর্বোচ্চ সহায়ক। এখানে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়:

(
) ইসলামের সকল শাস্তি যেমন কঠোর করা হয়েছে প্রয়োগ তার চেয়ে অনেক কঠিন প্রায় অসম্ভব করা হয়েছে, যেন কোনোভাবেই নিরপরাধ বা কম অপরাধী শাস্তি না পায়। অপরাধ শতভাগ প্রমাণিত হওয়া, অপরাধে লিপ্ত হওয়ার কোনোরূপ ওযর না থাকা এবং অপরাধের শাস্তিযোগ্যতার পর্যায় নিশ্চিত হওয়া সকল নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগের পূর্বশর্ত। সামান্য সন্দেহ হলে বিচারক অপেক্ষাকৃত হালকা শাস্তি প্রদান করবেন। হত্যা, অঙ্গহানী ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিহতের উত্তরাধিকারিগণ বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ইচ্ছা করলে ক্ষতিপূরণ নিয়ে বা কিছু না নিয়ে ক্ষমা করতে পারেন। ব্যভিচারের ক্ষেত্রে চারজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী অথবা ব্যক্তির স্বেচ্ছায় স্বীকৃতির ভিত্তিতেই বিচার শুরু হতে পারে। সাক্ষীগণের সাক্ষ্য ত্রুটিপূর্ণ হলে সাক্ষীগণ অভিযোগকারী প্রত্যেকে ৮০ বেত্রাঘাত শাস্তি ভোগ করবেন। উপরন্তু সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বিচারিক সকল ক্ষেত্রে তাদেরকে স্থায়ীভাবে ‘‘সাক্ষ্যদানের অযোগ্য’’ বলে ঘোষণা দেওয়া হবে। স্বেচ্ছায় স্বীকৃতি প্রদানকারী ব্যক্তি পরে অস্বীকৃতি জানালে তার অস্বীকৃতিই কার্যকর হবে


(
) বস্ত্তত, সকল শাস্তির উদ্দেশ্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। সহজ শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হয় না। এছাড়া শাস্তি সহজ হলে নিরপরাধের শাস্তি পাওয়ার সুযোগ বেশি হয়। শাস্তি হালকা হওয়ার কারণে বিচারক সহজেই শাস্তি দেন এবং শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিরপরাধ হলেও তা মেনে নেন। আর কঠিন শাস্তির ক্ষেত্রে বিচারক, সমাজ, রাষ্ট্র, বিচারকৃত ব্যক্তি সকলেই অত্যন্ত সজাগ থাকেন, যেন নিরপরাধ শাস্তি না পায় বা অল্প অপরাধে কঠিন শাস্তি না হয়


(
) অপরাধ বিষয়ক গবেষণা প্রমাণ করে যে, অল্পসংখ্যক অপরাধীর শাস্তি দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা ইসলামী আইনের মাধ্যমেই সম্ভব। অতীতের মুসলিম সমাজগুলিতে খুব কম মানুষেরই হাত কাটা হয়েছে বা মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শাস্তির ভয়াবহতার কারণে অপরাধ কম সংঘটিত হয়েছে। বর্তমানেও সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান, উপসাগরীয় মধ্যপ্রাচীয় কয়েকটি দেশে সকল শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে খুব কম সময়ে সকল শাস্তি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু শাস্তির বিদ্যমানতার কারণে অপরাধী ভয় পায়। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হয় না, বরং অপরাধীর মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়


(
) পাশ্চাত্যে অধিকাংশ দেশেড্রাগসবামাদকদ্রব্যগ্রহণ বিপনন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও মদপান অপরাধ নয়। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি সমাজের ক্ষতির দিক থেকে মদ ড্রাগস উভয়ই সমান, বরং মদের ক্ষতি অধিক। প্রায় আড়াই শতাব্দী ধরে ইউরোপ আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনেক আন্দোলন হয়েছে। নারীরা সকল আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। সকল আন্দোলনের ভিত্তিতে গত শতাব্দীতে ইউরোপের অনেক দেশে মদ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। আমেরিকায় ১৯২০ সালে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু মদব্যবসায়ীদের চাপে ১৯৩৩ সালে তা আবার বৈধ করা হয়
মাদকাসক্তি/মদ-নির্ভরতা (Alcoholism/Alcohol Dependence) আধুনিক সভ্যতার ভয়ঙ্করতম ব্যধিগুলির অন্যতম। বিশ্বে অগণিত সফল ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, টেকনিশিয়ান, শ্রমিক অনুরূপ সফল মানুষের জীবন পরিবার ধ্বংস হয়েছে মদের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের ৭৬ মিলিয়ন মানুষ মদ পানের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রকমের কঠিন রোগে ভুগছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ এবং রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মদপান জনিত মারাত্মক রোগব্যধিতে ভুগছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ মদপান মদ-নির্ভরতাকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা বলে চিহ্নিত করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে বর্তমান বিশ্বের সকল রোগব্যাধির শতকরা . ভাগ মদপান জনিত। মদপান মাতলামির কারণে প্রতি বৎসর শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ১৮৫ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়।[1] ইসলাম ঈমান আল্লাহর ভয়ের পাশাপাশি আইনের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর ব্যাধিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। আইনে একমাত্র মদব্যবসায়ী ছাড়া কারো কোনো ক্ষতি হয় না, শাস্তিপ্রাপ্তের সংখ্যা বাড়ে না কিন্তু আইনের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর ব্যাধি নির্মূল হয় বা নিয়ন্ত্রিত হয়

(
) ইহূদীধর্ম, খৃস্টধর্ম অন্য সকল ধর্মেই ব্যভিচারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, বিশেষত বাইবেলে ব্যভিচার সকল প্রকার অবৈধ যৌনতাকে মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতায় ধর্ষণকে অপরাধ বলা হলেও ব্যভিচারকে বৈধ করা হয়েছে এবং বিষয়টিকে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তুড্রাগসবিক্রয় গ্রহণকে এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসেবে গণ্য করা হয় না। অথচ ব্যক্তি, সমাজ মানবসভ্যতার জন্য ড্রাগসের চেয়ে ব্যভিচার অনেক বেশি ক্ষতিকর। আধুনিক সভ্যতা প্রমাণ করেছে যে, ব্যভিচারের মাধ্যমে পরিবার নষ্ট হয়, সন্তানগণ পারিবারিক স্নেহ প্রতিপালন থেকে বঞ্চিত হয়, তাদের মধ্যে মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ ব্যহত হয় এবং হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। বস্ত্তত ড্রাগসের কারণে ব্যক্তির জীবন নষ্ট হয় আর ব্যভিচারের মাধ্যমে মানবসভ্যতা বিনষ্ট হয়। এজন্য ইসলামে মদপান, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, বিপনন ব্যভিচারকে কাছাকাছি পর্যায়ের কঠিন অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে
(
) ইহূদী-খৃস্টীয় ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে বিধর্মী ধর্মত্যাগীর মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। যদি কোনো গ্রাম বা নগরীর অধিবাসীরা ধর্মত্যাগ করে তাহলে তথাকার সকল মানুষকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে এবং সকল পশুও হত্যা করতে হবে। তথাকার সকল সম্পদ দ্রব্যাদি পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অগ্নিদগ্ধ জনপদটি চিরিকালীন ঢিবি হয়ে থাকবে। কখনোই আর তা পুনর্বার নির্মিত হবে না। উপরন্তু ধর্মের নির্দেশ সামান্য লঙ্ঘন করলেও মৃত্যুদন্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে। যেমন, শনিবারে খড়ি কুড়ালে বা কর্ম করলে তাকে জনসমক্ষে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।[2] ইসলাম অন্য ধর্মের অনুসারীদের ইসলাম গ্রহণের জন্য চাপপ্রয়োগ বা প্রলোভন নিষিদ্ধ করেছে। পাশাপাশি মুসলিমের জন্য অন্যধর্ম গ্রহণ মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের স্থিতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র রোধ করতেই বিধান দেওয়া হয়েছে। যারা বাইবেলকে ঈশ্বরের বাণী বলে বিশ্বাস করেন তাদের মুখে এবং আধুনিক যুগে যারা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার নামে অমানবিক আইন তৈরি করছেন বা সমর্থন করছেন তাদের মুখে ইসলামের আইনকে অমানবিক বলা মোটেও মানায় না


(
) মুমিন বিশ্বাস করেন যে, কিভাবে মানুষের অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং কোন্ অপরাধে কোন্ শাস্তি সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য তা মহান স্রষ্টা আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। আইনের বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ প্রশস্ততা দিয়েছেন এবং যুগ সমাজের আলোকে আইন তৈরির সুযোগ দিয়েছেন। শুধু যে সকল বিষয়ে প্রয়োজন সেক্ষেত্রেই তিনি শাস্তি নির্ধারিত করে দিয়েছেন
মুমিনের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ মহান আল্লাহর বিধানের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করা। সালাত, সিয়াম, বিবাহ ইত্যাদি সকল বিষয়ের ন্যায় বিচারব্যবস্থা, দেওয়ানী আইন অপরাধ আইনের ক্ষেত্রেও আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা মুমিনের ঈমান ইসলামের দাবী। যদি কোনো মানুষ মনে করেন যে, সালাতের ক্ষেত্রে কুরআনের নির্দেশ সর্বজনীন, সর্বকালীন এবং সর্বোত্তম, কিন্তু বিচারের ক্ষেত্রে কুরআনের নির্দেশ সর্বোত্তম নয় বা সর্বজনীন নয় তাহলে তিনি মুমিন বলে নিজেকে দাবি করতে পারেন না


(
) অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী যে কোনো দেশের জন্য ইসলামী আইনের বাস্তবায়ন আগ্রহ পূরণের অন্যতম সহায়ক। বিশেষত মুসলিম দেশগুলির আইন-শৃঙ্খলা নিরাপত্তা অবস্থার উন্নয়নে ইসলামী অপরাধ-আইন বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সকল মুসলিম দেশের সরকার প্রশাসনের দায়িত্ব আল্লাহর প্রতি ঈমান, ধর্মীয় প্রেরণা, দেশপ্রেম নাগরিকদের স্বার্থে ইসলামী আইনের সঠিক বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া


(
) আল্লাহর পথে আহবানকারী যেমন সালাত, সিয়াম, যিকর ইত্যাদি কুরআন নির্দেশিত ইবাদত বাস্তবায়নের আহবান করবেন, তেমনি কুরআন নির্দেশিত আইন, বিচার ইত্যাদির বাস্তবায়নের আহবান করবেন। সালাত পালনে আল্লাহর নির্দেশের অবহেলা যেমন তাকে ব্যথিত করে, বিচার পালনে আল্লাহর নির্দেশের অবহেলাও তাকে তেমনি ব্যথিত করে। তার ঈমানের দাবি। কুরআন-সুন্নাহর কোনো নির্দেশনার প্রতি অবহেলা দেখে ব্যথিত না হলে ঈমান থাকে না

(
১০) সালাত, সিয়াম ইত্যাদির দাওয়াতের ন্যায় আইন বিচার বিষয়ক দাওয়াতও বিনম্রতা, উত্তম আচরণ প্রজ্ঞার মাধ্যমে হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সহিংসতা বা বলপ্রয়োগ মুমিনের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর কোনো নির্দেশ অমান্য হতে দেখলে কোনোরূপ ব্যাথা আপত্তি হৃদয়ে অনুভব না করা ঈমান হারাণোর লক্ষণ। সাধ্য থাকা সত্ত্বেও দাওয়াত না দিয়ে নীরব থাকলে পাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্তত কেউই যদি কথা না বলেন তবে সকলেরই পাপী হওয়ার সম্ভাবনা। বিনম্রতা শোভন আচরণের সাথে দাওয়াতের দায়িত্ব আদায় করলে সুনিশ্চিত সাওয়াবের আশা করা যায়। আর অশোভন আচরণ, উগ্রতা, বলপ্রয়োগ বা সহিংসতার আশ্রয় গ্রহণ করলে সুনিশ্চিত কঠিন পাপ অর্জন ছাড়া কোনোই লাভ হবে না। এতে নিজের মনের ক্ষোভ বা প্রতিশোধস্পৃহা পূরণ হতে পারে এবং মুমিনকে জাহান্নমে নেওয়ার মুসলিম সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শয়তান তার অনুসারীদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি মুমিনের বা মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয় না। আমরা দেখছি যে, আমাদের দেশে বিচারব্যবস্থা, দেওয়ানী আইন কোনো কোনো অপরাধ-আইন ইসলাম নির্দেশিত বা ইসলাম সম্মত। আর কিছু ইসলামী আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এজন্য কি কোনো মুসলিম সমাজ রাষ্ট্রকে কাফির বা অনৈসলামিক রাষ্ট্র বলা বৈধ?

আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে তা পর্যালোচনা করতে চাই। মহান আল্লাহর কাছে তাওফীক প্রার্থনা করছি

[1] দেখুন: মাইক্রোসফট এনকার্টা, Articles: Alcohol, Alcoholism, Prohibition, Wine.
[2]
বিস্তারিত দেখুন: যাত্রাপুস্তক ৩২ অধ্যায়, ২২ অধ্যায়ের ২০ শ্লোক, ৩৫ অধ্যায়ের ২য় শ্লোক, গণনাপুস্তক: ১৫ অধ্যায়ের ৩২-৩৬ দ্বিতীয় বিবরণ ১৩ অধ্যায়: -১৬ শ্লোক; দ্বিতীয় বিবরণ ১৭ অধ্যায় - শ্লোক

 . . . ইসলামী রাষ্ট্র বনাম অনৈসলামিক রাষ্ট্র

আমরা দেখেছি যে, জামাআতুল মুসলিমীন বা ‘‘তাকফীর ওয়াল হিজরা’’ সংগঠন উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশগুলিকে কাফির রাষ্ট্র বলে গণ্য করে। বিষয়ে তাদের বিভ্রান্তি আমরা নিম্নরূপে বিন্যস্ত করতে পারি:
(
) আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলি কাফির রাষ্ট
(
) কাফির রাষ্ট্র উৎখাত করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা বড় ফরয
(
) ফরয পালনের জন্য জিহাদই একমাত্র পথ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু করা হয় সবই জিহাদ বলে গণ্য
(
) জিহাদ পালনে রাষ্ট্রের নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করা বৈধ। এভাবে তারা ইসলামী শিক্ষার বিকৃতি সাধন করেছেন। অজ্ঞতা, আক্রোশ আবেগ তাদেরকে পথে পরিচালিত করে
অথবা ইসলামকে কলঙ্কিত করতে এবং ইসলামী জাগরণকে থামিয়ে দিতে কৌশলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করে সকল কথা বলানো হয়েছে। তৃতীয় চতুর্থ বিষয়ের বিভ্রান্তি আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, জিহাদ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ নয়, জিহাদ প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার পথ। আর জিহাদ শুধু শত্রু বাহিনীর সশস্ত্র যোদ্ধাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হবে। পারিভাষিক জিহাদ বা রাষ্ট্রীয় যুদ্ধের বাইরে রাষ্ট্র সংস্কার বা রাষ্ট্রে ইসলামী মূল্যবোধ বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার কর্ম ইসলামী পরিভাষায় জিহাদ নয়, তা হলো ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ এবং ‘‘ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধ’’ একে পারিভাষিক জিহাদ বলে মনে করা বা এজন্য অস্ত্রধারণ হত্যা বৈধ মনে করা ইসলামী শিক্ষার কঠিনতম বিকৃতি ছাড়া কিছুই নয়। আমরা এখানে প্রথম দ্বিতীয় বিষয় আলোচনা করতে চেষ্টা করব। আর বিষয়ক বিভ্রান্তি বুঝতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে, কখন আমরা একটি রাষ্ট্রকে ‘‘ইসলামী রাষ্ট্র’’ বলে গণ্য করব এবং কখন আমার একটি রাষ্ট্রকে ‘‘কাফির রাষ্ট্র’’ বা অনৈসলামিক রাষ্ট্র বলে গণ্য করব?

আগেই বলেছি যে, সাধারণ খুটিনাটি বিষয়ে প্রশস্ততা দেওয়ার জন্য মুআমালাত বিষয়ে ইসলামে অনেক বিষয় উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তারই একটি প্রকাশ হলো ‘‘দারুল ইসলাম’’ বা ইসলামী রাষ্ট্র দারুল কুফর বা কুফরী রাষ্ট্র বিষয়ক কোনো সুনির্ধারিত সংজ্ঞা কুরআন-হাদীসে প্রদান করা হয় নি। এখন যদি আমাদের কাউকে ইসলামী বিবাহ কুফরী বিবাহ অথবা ইসলামী পরিবার কুফরী পরিবারের ‘‘সুনির্ধারিত সংজ্ঞা’’ জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে আমরা দেখব যে, বিষয়টি বেশ প্রশস্ত। পরিপূর্ণ ইসলামী বিবাহের বা পরিবারের যে ধারণা আমাদের রয়েছে তার কিছু বিচ্যুতি হলেই আমরা সে বিবাহ বা পরিবারকে ‘‘কুফরী’’ বলে গণ্য করতে পারছি না। বরং কুফরী বিবাহ বা পরিবারের ঊধ্বে উঠলেই তাকেইসলামীবলে মানতে বাধ্য হচ্ছি, যদিও পুরোপুরি ইসলামী নয় বলে বুঝতে পারছি


ইসলামী রাষ্ট্রের বিষয়টিও অনুরূপ। কুরআন হাদীসে ইসলামী রাষ্ট্রের কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করা হয় নি। মহান আল্লাহ বলেন:

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

‘‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে তাদেরকে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, অবশ্যই তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে স্থলাভিষিক্ত করবেন যেমন তিনি স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের জন্য তাদের দীনকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি অবশ্যই তাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার কোনো শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারাই সত্যত্যাগী।’’[1]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:

الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ

‘‘যাদেরকে আমি পৃথিবীতে ক্ষমতাবান করলে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, ন্যায়ের আদেশ করে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করে। আর কর্মসমূহের পরিণাম আল্লাহরই অধীনে।’’[2]
আয়াতদ্বয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম আয়াতে দীনের সুদৃঢ়তা, শান্তি-নিরাপত্তায় দীন পালনের স্বাধীনতা এবং নির্ভয়ে আল্লাহর শিরকমুত্ত ইবাদত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে সালাত, যাকাত, ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধের বিদ্যমানতা ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে

সকল আয়াতের আলোকে ফকীহগণ দারুল ইসলাম বা ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রকারের সংজ্ঞা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ মুসলমানদের রাজনৈতিক আধিপত্যকে মূল বলে গণ্য করেছেন এবং বলেছেন যে, দাওআত, যুদ্ধ, সন্ধি, স্বাধীনতা বা অন্য যে কোনোভাবে কোনো দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা মুসলিমদের হাতে আসলে সে দেশ দারুল ইসলাম।[3] অন্যান্য ফকীহ ইসলামী বিধি বিধানের প্রকাশকে মানদন্ড বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে যে কোনো দেশ, রাষ্ট্র বা জনপদে ইসলামের বিধিবিধান প্রকাশিত থাকলে তা দারুল ইসলাম বা ইসলামী রাষ্ট্র বলে গণ্য।[4]

এখানে লক্ষণীয় যে, ব্যক্তি মুমিনের ক্ষেত্রে যেমন পরিপূর্ণ আদর্শ মুমিনের পাশাপাশি কম বা বেশি পাপে লিপ্ত পাপী মুমিনদেরকেও মুসলিম বলে গণ্য করা হয়েছে, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী দেশের ইসলামের দাবি গ্রহণে প্রশস্ততা অবলম্বন করা হয়েছে। পাপের প্রকাশ, ইসলামী বিধিবিধানের অবমাননা, ইসলামী বিধান লঙ্ঘন, কুরআন বিরোধী বিধিবিধান বা আকীদা বিশ্বাসের প্রকাশের কারণে রাষ্ট্রকে কাফির রাষ্ট্র বলে গণ্য করা হয় নি। মুসলিম উম্মাহর ফকীহ ইমামগণ বারংবার উল্লেখ করেছেন যে, কোনো দেশ বা রাষ্ট্র মুসলিম শাসনাধীন হয়ে ‘‘দারুল ইসলামে’’ পরিণত হওয়ার পর শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন, অমুসলিমদের প্রাধান্য বা অন্য কোনো কারণে পুনরায় ‘‘দারুল কুফর’’ বা ‘‘দারুল হরব’’ অর্থাৎ অনৈসলামিক রাষ্ট্র বা শত্রু রাষ্ট্র বলে গণ্য করার ক্ষেত্রে ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিষয়ে ফকীহগণের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন, তিনটি শর্ত পূরণ হলে ইসলামী রাষ্ট্রকে কাফির রাষ্ট্র বলে গণ্য করা যাবে:
(
) কুফরের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়া,
(
) কাফির রাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত হওয়া এবং
(
) উক্ত রাষ্ট্রের মুসলিম অমুসলিম সকল নাগরিকের মুসলিমগণ প্রদত্ত নাগরিক অধিকার নিরাপত্তা বাতিল হওয়া।[5]

ইসলামের ইতিহাসে শীয়াগণ সর্বদা শীয়া রাষ্ট্র ছাড়া সকল সরকার রাষ্ট্রকে তাগূতী রাষ্ট্র বলে বিশ্বাস করেছেন। পক্ষান্তরে সাহাবীগণ তাঁদের অনুসারী আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমগণ কখনোই ধরনের মতামত পোষণ করেন নি। এমনকি বাতিনী শিয়া, কারামিতা, ফাতিমী শিয়া অন্যান্য গোষ্ঠী যারা প্রকাশ্যে সুস্পষ্টভাবে কুরআন-হাদীসের বিধানাবালি ব্যাখ্যা করে অস্বীকার অমান্য করত এবং এর ব্যতিক্রম বিধান প্রদান করত তাদের রাষ্ট্রকেও তাগূতী, জাহিলী বা কাফির রাষ্ট্র বলে গণ্য করেন নি। বরং এগুলিকে ইসলামী রাষ্ট্র বলেই গণ্য করেছেন

রাষ্ট্রীয় বিষয়ে কুরআনের বিধিবিধানের ব্যতিক্রম চলা বা ‘‘আল্লাহর আইনের’’ ব্যতিক্রম বিধান দান উমাইয়া যুগেই শুরু হয়েছে। বিশেষত আববাসী, ফাতিমী, বাতিনী, মোগল ইত্যাদি রাজ্যে ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক সুস্পষ্ট কুফরী বিশ্বাস মতবাদকে রাষ্ট্রীয় মতবাদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, ইসলামের আইন বিচার অনেকাংশেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এমনকি ইসলামের হারাম অনেক বিষয় বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বৈধ করা হয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ইহূদী, খৃস্টান, অগ্নিউপাসক বা পৌত্তলিকদের রাষ্ট্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আলিমগণ সাধ্যমত এগুলির কঠোর প্রতিবাদ করেছেন, অনেকে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছেন, শাস্তিভোগ করেছেন, কিন্তু কখনোই রাষ্ট্র প্রশাসনের সকল বিচ্যুতির কারণে সকল রাষ্ট্র বা সমাজকে কাফির রাষ্ট্র বা সমাজ বলে গণ্য করেন নি, রাষ্ট্র, সরকার বা তাদের অনুগতদের বা নাগরিকদের কাফির বলে গণ্য করেন নি বা ‘‘ইসলামী রাষ্ট্র’’ প্রতিষ্ঠার জন্য এরূপ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা যুদ্ধে লিপ্ত হন নি। বরং এরূপ রাষ্ট্রের আনুগত্য করেছেন, আইন মেনেছেন এবং এদের নেতৃত্বে কাফির রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জিহাদে শরীক হয়েছেন

উমাইয়া, আববাসী, স্পেনীয়, খারিজীয়, ফাতেমীয়, কারামিতীয়, বাতিনী, তাতার, মুগল ইত্যাদি সকল যুগের সকল রাষ্ট্রকেই মুসলিম আলিম ফকীহগণ দারুল ইসলাম বলে গণ্য করেছেন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের সকল বিধান সেখানে প্রয়োগ করেছেন। জুমুআ, জামাত, রাষ্ট্রের আনুগত্য, রাষ্ট্র প্রধানের নির্দেশে নেতৃত্বে শত্রুদেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ ইত্যাদি সকল বিধান সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে উল্লেখ করেছেন
বর্তমান বিশ্বের মুসলিম দেশগুলির অবস্থা উমাইয়া যুগ পরবর্তী যুগের মুসলিম দেশগুলি থেকে মোটেও ভিন্ন নয়, বরং কিছুটা ভালই বলতে হয়। শাসক নির্বাচন রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের পরামর্শ গ্রহণ, জনগণের নিকট জবাবদিহিতা, মানবাধিকার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, নিরপেক্ষভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা আইন প্রয়োগ ইত্যাদি ইসলামী নির্দেশনা পালনের ক্ষেত্রে সকল রাষ্ট্র পূর্ববর্তী রাষ্ট্রগুলি থেকে কিছুটা হলেও উন্নত হয়েছে। সকল দেশের অধিকাংশ আইন-কানুন বিচার ব্যবস্থা ইসলামী আইন বিচার ব্যবস্থা থেকে গৃহীত। ইসলমী বিধানের পরিপন্থী কিছু আইন-কানুনও বিদ্যমান, যেগুলির অপসারণ সংশোধনের জন্য মুমিন চেষ্টা দাওয়াত অব্যাহত রাখবেন। কিন্তু শাসকদের পাপ, রাষ্ট্র ব্যবস্থার পাপ বা কিছু ইসলাম-বিরোধী আইন-কানুনের জন্য কোনো রাষ্ট্রকে ‘‘দারুল কুফর’’ বা কাফির রাষ্ট্র মনে করার কোনোরূপ ভিত্তি নেই। উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশগুলির স্বৈরাচার, ইসলাম বিরোধী আচরণ বিধিবিধান, ধার্মিক মানুষদের প্রতি অত্যাচার ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে অনেক আবেগী মুসলিমই অনুভব করেন যে, তার দেশটি একটি অনৈসলামিক দেশ এবং এদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। আবেগ-তাড়িত মতামত বা কর্ম জাগতিক ফল বা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সহায়ক নয় আবেগ যাই বলুক না কেন, আমাদেরকে আবেগমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কুরআন-হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশনা, ইসলামের ইতিহাসের সকল যুগের রাষ্ট্রগুলির অবস্থা, সেগুলির সংস্কারে আলিম, উলামা, পীর, মাশাইখ বুজুর্গগণের কর্মধারার ভিত্তিতে আবেগমুক্ত হয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে


কুরআন-হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশনা, উমাইয়া যুগ পরবর্তী যুগগুলির বিষয়ে সাহাবী, তাবিয়ী তৎপরবর্তী আলিমগণের মতামতের আলোকে আমরা সুনিশ্চিত বুঝতে পারি যে, সমকালীন মুসলিম দেশগুলিকে কাফির রাষ্ট্র বলে গণ্য করার কোনো সুযোগ নেই। সমকালীন কোনো কোনো গবেষক মুসলিম রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। পার্থক্য একান্তই গবেষণা। ইসলামী শরীয়তের বিধান প্রদানের ক্ষেত্রে পার্থক্যের কোনো গুরুত্ব নেই। শরীয়তের বিধানের আলোকে এগুলি সবই দারুল ইসলাম। আল্লাহর পথে দাওয়াত বা ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধের অংশ হিসেবে মুমিন সকল রাষ্ট্রের অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন, সংশোধনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন, কিন্তু কখনোই রাষ্ট্রীয় আনুগত্য পরিত্যাগ করবেন না বা রাষ্ট্রদ্রোহিতায় লিপ্ত হবেন না

[1] সূরা (২৪) নূর: আয়াত ৫৫
[2]
সূরা (২২) হজ্জ: আয়াত ৪১
[3]
দেখুন: ইমাম শাফিয়ী, আল-উম্ম /১৯১; ইবনু হাজম, আল-মুহাল্লা ১১/২০০
[4]
দেখুন: সারাখসী, আল-মাসবূত ১০/১৪৪; কাসানী, বাদাইউস সানাইয় /১৩০
[5]
কাসানী, বাদাইউস সানাইয় /১৩০-১৩১; ইবনু আবেদীন, রদ্দুল মুহতার /২৫৩; আল-মাওসূআ আল-ফিকহিয়্যাহ, কুয়েত ২০/২০২

 . . . দীন প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্র সংস্কার

আমরা বলেছি যে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার একটি দিক রাষ্ট্র। ইসলামে রাষ্ট্র ব্যবস্থার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ উল্লেখ করেছেন যে, সমাজে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখা মুসলিমদের জন্য ফরয কিফায়া। তবে বিষয়ে খারিজীগণ, বিশেষত আধুনিক খারিজীগণ কিছু বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হন। তারা দাবি করেন যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা বড় ফরয। তাদের দাবীর দুটি বিশেষ দিক লক্ষণীয়: প্রথমত বিশ্বে কোথাও ‘‘ইসলামী রাষ্ট্র’’ নেই, বরং সকল মুসলিম রাষ্ট্রই ‘‘কাফির’’ রাষ্ট্র এবং দ্বিতীয়ত, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সবচেয়ে বড় ফরয। মূলধারার আলিমদের সাথে এদের দাবির পার্থক্য দুটি:
প্রথমত, মূলধারার আলিমগণের মতানুসারে মুসলিম সমাজে বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলি বিচ্যুতি পাপাচার সত্ত্বেও ‘‘ইসলামী রাষ্ট্র’’ বা ‘‘দারুল ইসলাম’’; কাজেই মুমিনের দায়িত্ব শূন্য থেকে প্রতিষ্ঠা নয়, বরং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে সংস্কার সংশোধন করা। সাধারণ নাগরিকদের দায়িত্ব রাষ্ট্র সংস্কার সংশোধন। আর রাষ্ট্র প্রশাসন সরকারের দায়িত্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত রাখা, শরীয়তের বাস্তবায়ন প্রয়োজনীয় জিহাদ পরিচালনা করা
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সংশোধন ইত্যাদির দায়িত্ব সাধারণভাবে ফরয কিফায়া, কখনো ফরয আইন, তবে কখনোই বড় ফরয নয়। এখানে লক্ষণীয় যে, সমকালীন প্রাজ্ঞ সুপ্রসিদ্ধ কোনো কোনো আলিম গবেষকের কিছু কিছু বক্তব্যজামাআতুল মুসলিমীনতাদের মতামতের দলীল হিসেবে পেশ করতেন। সকল বক্তব্য থেকে তারা যা প্রমাণ করতেন সকল আলিম সে অর্থে তাঁদের কথা বলেন নি। ইসলামী দাওয়াত, আন্দোলন, সমাজ পরিবর্তন, দীনের বিজয়, দীন প্রতিষ্ঠা, জাহিলী সমাজ বর্জন ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব বুঝাতে তারা যে সকল কথা বলেছেন সকল আবেগী যুবক সেগুলিকে ‘‘বেদবাক্যের’’ মত আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে তাদের আবেগকে আরো বেশি শানিত করেছেন। এভাবে আবেগতাড়িত উগ্রতায় নিপতিত হয়েছে। কখনো বা এভাবে তাদের আবেগ উজ্জীবিত করে তাদেরকে বিপথগামী করা হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে। খারিজীগণের প্রমাণাদির মধ্যে ছিল:


প্রথমত, জিহাদ বিষয়ক নির্দেশাবলি
তারা দাবি করতেন যে, জিহাদ বড় ফরয। আর জিহাদের উদ্দেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু করা হয় তা জিহাদ বলে গণ্য। কাজেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই জিহাদ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই বড় ফরয। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, ‘‘বড় ফরয’’ পরিভাষাটিই কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত নয়। কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়া কোনো ইবাদতকে ‘‘বড় ফরয’’ বলা যায় না। আরকানে ইসলামের পরে আর কোনো ইবাদতকে ঢালাওভাবে বড় ফরয বলার সুযোগ নেই। আমরা দেখেছি যে, জিহাদ সাধারণত ফরয কিফায়া এবং কখনো বা ফরয আইন। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় দাওয়াতের মাধ্যমে, জিহাদের মাধ্যমে নয়। রাষ্ট্র সংস্কারও হয় দাওয়াতের মাধ্যমে, জিহাদের মাধ্যমে নয়


দ্বিতীয়ত: প্রতিপালকের খিলাফাত
মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً

‘‘যখন তোমার প্রতিপালক মালাকগণকে বললেন: আমি পৃথিবীতে একজনস্থলাভিষিক্তসৃষ্টি করছি।’’[1]
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে বড় ফরয বলে দাবি করে তারা বলেন যে, মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর রুবূবিয়্যাত বা প্রতিপালনের খিলাফাত বা প্রতিনিধির দায়িত্ব প্রদান করেছেন। রুবূবিয়্যাতের দায়িত্ব পালনই মুমিনের বড় ফরয। আর দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা অপরিহার্য। বস্ত্তত তাদের ‘‘দলীল’’-টি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কুরআন হাদীসের অন্যান্য বাণী দ্বারা প্রমাণিত। তবে আয়াতটির সাথে দায়িত্বের কোনো সম্পকই নেই

খলীফা অর্থস্থলাভিষিক্তবাগদ্দিনশীন’, যিনি অন্যের অনুপস্থিতিতে তার স্থলে অবস্থান বা কর্ম করেন। আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি আদমকে পৃথিবীতেখলীফাবা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রেরণ করবেন, কার স্থলাভিষিক্ত তা বলেন নি। মুফাস্সিরগণ থেকে তিনটি মত প্রসিদ্ধ: () ইবনু আববাস (রা), ইবনু মাসঊদ (রা) প্রমুখ সাহাবীর মতে এখানেস্থলাভিষিক্তবলতে পূর্ববর্তী জিন্ন জাতির স্থলাভিষিক্ত বুঝানো হয়েছে। () ইবনু যাইদ অন্যান্য কোনো কোনো মুফাস্সিরের মতে এখানেখলীফাবা স্থলাভিষিক্ত বলতে বুঝানো হয়েছে যে, আদম সন্তানগণ এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম পৃথিবীতে বসবাস করবে এবং পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ববর্তীদের স্থলাভিষিক্ত হবে। () ইমাম তাবারী অন্যান্য কতিপয় মুফাস্সির বলেন যে, এখানে খলীফা অর্থ আল্লাহর খলীফাও হতে পারে। অর্থৎ আদম তাঁর সন্তানগণ পৃথিবীতে আল্লাহর নিয়ম-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরই স্থলাভিষিক্ত।[2]

খলীফা শব্দ, এর বহুবচন এবং এর ক্রিয়াপদ কুরআন কারীমে প্রায় ২০ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। সকল ব্যবহারের আলোকে সুস্পষ্ট যে, খলীফা বলতে পূর্ববর্তী প্রজন্মের স্থলাভিষিক্ত বুঝানো হয়। এজন্য কুরআনের ব্যবহারের আলোকে প্রথম দ্বিতীয় মতই অধিক গ্রহণযোগ্য

তৃতীয় মতটির বিষয়ে প্রথম যুগের অনেক আলিম আপত্তি করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, মানুষকে আল্লাহর খলীফা বলা ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী। কারণ, কারো মৃত্যু, স্থানান্তর বা অবিদ্যমানতার কারণেই তার স্থলাভিষিক্ত, গদ্দিনশীন বা খলীফার প্রয়োজন হয়। আর মহান আল্লাহ তো এরূপ কোনো প্রয়োজনীয়তা থেকে মহা পবিত্র। কুরআনে কোথাও মানুষকেআল্লাহর খলীফাবলা হয় নি। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে, আল্লাহই মানুষের খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত হন। যেমন সফরের দুআয় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলতেন: ‘‘আপনিই সফরে (আমাদের) সাথী এবং পরিবারে (আমাদের) খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত।’’[3] একব্যক্তি আবূ বাকর (রা)-কে সম্বোধন করে বলেন, হে আল্লাহর খলীফা। তখন তিনি বলেন, ‘‘আমি আল্লাহর খলীফা নই, বরং আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত।’’[4]
এতদসত্ত্বেও পরবর্তীকালে আয়াতের তাফসীরে তৃতীয় মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করে। শিয়াগণ ব্যাখ্যাকে তাদের মতের দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে মানুষ আল্লাহর খলীফা। আর আল্লাহর খিলাফাতের পরিপূর্ণতা ইমাম বা রাষ্ট্র প্রধানের মধ্যে বিদ্যমান থাকতে হবে। এজন্য তাদের বিশ্বাস অনুসারে ইমাম আল্লাহর গাইবী জ্ঞান ক্ষমতার অধিকারী এবং তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ধর্মীয় সিদ্ধান্ত বলে গণ্য


তৃতীয়ত, দীনের বিজয়
মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি দীনকে প্রকাশ বা বিজয় দান করবেন। সকল আয়াত থেকে তারা দাবি করেন যে, দীনকে বিজয় করার দায়িত্ব উম্মাতের বড় ফরয। আমরা উল্লেখ করেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের প্রায়োগিক সুন্নাত ব্যাখ্যা বর্জন করে, শুধু নিজের মন মনন দিয়ে কুরআনের অর্থ নির্ধারণ করা এবং অর্থের ভিত্তিতে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা খারিজীগণের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ ছিল। নিঃসন্দেহে দীনের বিজয় ইসলামের নির্দেশনা। তবে বিজয়ের অর্থ পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের মাধ্যমে জানতে হবে। আমরা এখানে সকল আয়াতের অর্থ এর ব্যাখ্যায় সাহাবী-তাবিয়ী পরবর্তী আলিমগণের মতামত আলোচনা করব
মহান আল্লাহ বলেন:


هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ

‘‘তিনিই প্রেরণ করেছেন তার রাসূলকে সঠিক পথের নির্দেশনা সত্য দীন-সহ; যেন তিনি তাকে প্রকাশ করেন সকল দীনের উপর; যদিও মুশরিকগণ তা অপছন্দ করে।’’[5] কুরআনে আরো দু স্থানে আল্লাহ অনুরূপ কথা বলেছেন।[6] সকল স্থানে আল্লাহ তাকে সকল দীনের উপর ‘‘ইযহার’’করবেন বলে উল্লেখ করেছেন। ইযহার অর্থ প্রকাশ করা। বিজয় করা অর্থেও তা ব্যবহৃত হয়। ইবনু আববাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আয়াতের অর্থ ‘‘আল্লাহ মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে সকল ধর্মের সকল তথ্য প্রকাশ করবেন বা জানিয়ে দিবেন; যদিও ইহূদী-খৃস্টান অন্যন্য ধর্মের অনুসারীরা তাদের সকল বিষয় প্রকাশ পাওয়া অপছন্দ করত।

অন্যান্য মুফাস্সির বলেছেন যে, এখানে প্রকাশ বা বিজয় বলতে তাত্ত্বিক প্রকাশ বা বিজয় বুঝানো হয়েছে। সকল দীনের উপর প্রকাশ বা বিজয় বলতে সকল দীনের অনুসারীদের দীন গ্রহণ করা বা সকল সমাজ রাষ্ট্রের উপরে মুসলিম রাষ্ট্রের বিজয় বুঝানো হয় নি। বরং তত্ত্বে, তথ্যে, প্রমাণে যুক্তিতে সকল দীনের উপর দিনকে আল্লাহ প্রকাশিত বিজয়ী করবেন বলে বুঝানো হয়েছে। আবূ হুরাইরা (রা) অন্যান্য মুফাস্সির থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, শেষ যুগে ঈসা ()-এর পুনরাগমণের মাধ্যমে মহান আল্লাহ দীনকে চূড়ান্ত বিজয় প্রকাশ দান করবেন। সে সময়ে বিশ্বের সকল মানুষ দীন গ্রহণ করবে এবং দীন একমাত্র আল্লাহরই হবে।[7]
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিম উম্মাহর ক্রমপ্রসারিত বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এক হাদীসে তিনি বলেন:


إنَّ اللهَ زوى لي الأرضَ,فرأيتُ مشارقَها ومغاربَها وإنَّ أُمَّتي سيبلغُ ملكها ما زُوِيَ لي منها

‘‘আল্লাহ আমার জন্য পৃথিবীকে সংকুচিত করেন, তখন আমি পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম দেখলাম। আর পৃথিবীর যতটুকু আমার জন্য সংকুচিত করা হয়েছিল তার তাবৎ স্থানে আমার উম্মাতের রাজত্ব পৌঁছে যাবে।’’[8]
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:

(ليبلغن هذا الأمر ما بلغ الليل والنهار) لا يبقى على ظهر الأرض بيت مدر ولا وبر الا ادخله الله كلمة الاسلام (هذا الدين) بعز عزيز أو ذل ذليل إما يعزهم الله عز وجل فيجعلهم من اهلها أو يذلهم فيدينون لها

‘‘দিবারাত্র যেখানে পৌঁছে সেখানেই দীন পৌঁছাবে। ধরাপৃষ্ঠে এমন একটি বাড়ি বা তাবুও অবশিষ্ঠ থাকবে না যেখানে দীন পৌঁছাবে না। প্রতিটি বাড়িতেই আল্লাহ দীন পৌঁছাবেন, কারো সম্মানের সাথে কারো লাঞ্ছনার সাথে। কাউকে আল্লাহ দীনের অনুসারী হওয়ার তাওফীক দিয়ে সম্মানিত করবেন। আর কেউ এর বশ্যতা স্বীকার করে অনুগত হবে।[9] বস্ত্তত আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন। তিনি তাঁর মহান রাসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে দীনকে প্রকাশিত বিজয়ী করেছেন। যুক্তি প্রমাণে তাঁর দীনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দীনকে প্রকাশিত বিজয়ী করেছেন। আর বিজয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে

এমন নয় যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মাধ্যমে অর্জিত বিজয় কোনো এক সময় একেবারে হারিয়ে যাবে এবং এরপর আমাদেরকে নতুন করে বিজয়ের যাত্রা শুরু করতে হবে। বরং বিজয়ের ধারা অব্যাহত রয়েছে। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা এবং সাহাবীগণ পূর্ববর্তীগণের কর্মধারার আলোকে আমাদের দায়িত্ব হলো, প্রত্যেকের নিজের জীবনে দীন পালন, নিজের সাধ্যমত দীনের দাওয়াত, দীনের শত্রুদের ষড়যন্ত্রের জাল উন্মোচন, ইসলাম বিরোধী প্রচারণার মিথ্যাচার উন্মোচন, ইসলামের সঠিক চিত্র বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরা ইত্যাদি। পাশাপাশি ইসলামী রাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, আদর্শিক দীনী সংস্কার ইত্যাদির জন্য যথাসাধ্য সচেষ্ট হওয়া। কিন্তু বিজয় অর্জনের নামে ইসলাম নিষিদ্ধ কোনো কর্ম বা সুন্নাত-বহির্ভুত কোনো পদ্ধতির অনুসরণ আমাদের দায়িত্ব নয়। অনুরূপভাবে ফলাফলের চিন্তা আমাদের দায়িত্ব নয়


চতুর্থত: দীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে বড় ফরয বলে দাবি করার জন্য তারা দীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশকে দলিল হিসেবে পেশ করতেন। তাদের মতে, দীন অর্থই রাষ্ট্র এবং ‘‘দীন প্রতিষ্ঠা’’- অর্থই ‘‘দীনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা’’ আর দায়িত্ব হলো সবচেয়ে বড় ফরয। কারণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হলে দীনের অন্যান্য অনেক দায়িত্ব পালন করা যায় না বা দীনের অন্যান্য অনেক বিষয় প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বস্ত্তত মহান আল্লাহ দীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থা দীনের অংশ। দীনের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় সুন্নাত নির্দেশিত পথে আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করতে হবে

মহান আল্লাহ বলেছেন:

شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ

‘‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে- আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকেএবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না।’’[10]

এখানে আল্লাহ সকল নবী-রাসূলকে দীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। অধিকাংশ মুফাস্সির উল্লেখ করেছেন যে, এখানে ‘‘দীন’’ বলতে ‘‘তাওহীদ’’ বুঝানো হয়েছে; কারণ সকল নবীর মূল দীন ছিল তাওহীদ। শরীয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। কুরআন কারীমে নবী রাসূলগণের দাওয়াতের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা থেকেও বিষয়টি বুঝা যায়। কুরআন কারীমে ২৫ জন নবী-রাসূলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া নাম উল্লেখ না করে অন্য নবীদের দাওয়াতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে

সকলের ক্ষেত্রেই ‘‘তাওহীদ’’-কেই তাদের দাওয়াতের মূল বিষয়ই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনের বর্ণনা অনুসারে তাদের সকলের দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, একমাত্র তাঁরই ইবাদত কর, তাঁকে ভয় কর এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, সকল বিপদে শুধু তাঁকেই ডাক, একমাত্র তাঁরই কাছে সাহায্য চাও, তাঁরই জন্য সাজদা কর, তাঁরই উপর নির্ভর কর, তাঁরই জন্য উৎসর্গ, কুরবানী জবাই কর। আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য যাদের বা যা কিছুর ইবাদত করা হয় তার ইবাদত বর্জন কর, তাদের ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতা অবিশ্বাস কর। অধিকাংশ নবী-রাসূলের ক্ষেত্রে ‘‘তাওহীদ’’ ছাড়া অন্য কোনো বিষয় উল্লেখ করা হয় নি। কয়েকজন নবী-রাসূলের ক্ষেত্রে তাওহীদের পাশাপাশি চারিত্রিক, সামাজিক রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান উল্লেখ করা হয়েছে। সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে

আল্লাহ বলেছেন যে, সকল নবীকেই ‘‘দীন প্রতিষ্ঠার’’ নির্দেশ দিয়েছেন, আর অধিকাংশ নবীই তাওহীদ ছাড়া অন্য কিছুর দাওয়াত দিয়েছেন বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। এজন্য অধিকাংশ মুফাস্সির বলেছেন যে, দীন প্রতিষ্ঠার অর্থ তাওহীদ পালন তাওহীদের দাওয়াত। অন্য অনেকে দীন বলতে তাওহীদ আহকামের সমষ্টি বুঝিয়েছেন। কারণ প্রত্যেক নবীকে তাঁকে প্রদত্ত দীন কায়েমের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[11]
‘‘
ইকামতের দীন’’ বা দীন প্রতিষ্ঠা বলতে অধিকাংশ মুফাস্সির ‘‘দীন পালন’’ বা ‘‘দীনের নির্দেশনা অনুসারে কর্ম করা’’ বুঝিয়েছেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী (৩১০ হি) বলেন:


وعنى بقوله: (أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ) أن اعملوا به على ما شرع لكم وفرض كما قد بينا فيما مضي قبل فى قوله: (أقيموا الصلاة). وبنحو الذى قلنا فى ذلك قال اهل التأويل ... عن السدى فى قوله، فى قوله (أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ) قال: اعملوا به

‘‘‘দীন প্রতিষ্ঠা করকথাটির অর্থ হলোদীন পালন করবাদীন অনুসারে কর্ম কর, যেভাবে তোমাদের জন্য তা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং ফরয করা হয়েছে’, যেমনটি আমরা ইতোপূর্বেসালাত প্রতিষ্ঠা করকথাটির অর্থ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি। পূর্ববর্তী (সাহাবী-তাবিয়ী-তাবি-তাবিয়ী যুগের) মুফাস্সিরগণ এরূপ ব্যাখ্যাই করেছেন। .... তাবিয়ী ইসমাঈল ইবনু আব্দুর রাহমান সুদ্দী (১২৮ হি) বলেনদীন প্রতিষ্ঠা করঅর্থ দীন পালন কর।’’[12]
অর্থে তাবিয়ী মুজাহিদ ইবনু জাবর (১০৪ হি) বলেন:


والإقرار بالله وطاعته فهو اقامة الدين

‘‘আল্লাহ যত নবী প্রেরণ করেছেন সকলকেই সালাত কায়েম করতে, যাকাত প্রদান করতে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের স্বীকৃতি দিতে তাঁর আনুগত্য করতে নির্দেশ দিয়েছেন, আর - হলো দীন প্রতিষ্ঠা করা।’’[13]
অন্য তাবিয়ী আবুল আলিয়া রুফাইয় ইবনু মিহরান (৯০ হি) বলেন:


اقامة الدين الا خلاص لله وعبادته

‘‘দীন প্রতিষ্ঠা হলো আল্লাহর জন্য ইখলাস তাঁর ইবাদত করা।’’[14]
কোনো কোনো মুফাস্সির বলেন:


والمراد باقامته: تعديل اركانه وحفظه من ان يقع فيه زيغ، والمواظبه عليه والتشمير فى القيام به

‘‘দীন প্রতিষ্ঠার অর্থ: তার রুকনগুলি যথাযথ পালন করা, তার মধ্যে বিকৃতির অনুপ্রবেশ থেকে তাকে সংরক্ষণ করা, দীন পালনে নিয়মানুবর্তী হওয়া এবং তা যথাযথ পালনের জন্য পূণউদ্দ্যোমী হওয়া।’’[15] এভাবে অধিকাংশ সাহাবী-তাবিয়ী প্রাচীন মুফাস্সিরের মতানুসারে পরিপূর্ণ পালনই প্রতিষ্ঠা করা। যেমন সালাত প্রতিষ্ঠা করার অর্থযেভাবে ফরয বিধিবদ্ধ করা হয়েছে সেভাবে তা আদায় করা আমরা দেখেছি যে, বিজন প্রান্তরের নির্জনবাসীআবিদবান্দার একাকী সালাত আদায়কেও হাদীসে ‘‘ইকামাতে সালাত’’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি তার জন্য যে ভাবে ফরয বিধিবদ্ধ করা হয়েছে সেভাবে তা পালন করেছেন

বস্ত্তত নিজের জীবনে দীনের পরিপূর্ণ পালন অর্থ নিজের জীবনে দীনকে প্রতিষ্ঠিত করা। অন্যের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ অন্য কোনো মানুষকে পরিপূর্ণ দীনের মধ্যে আনয়ন করা মুমিনের আয়ত্বাধীন নয়; এক্ষেত্রে মুমিনের আয়ত্বাধীন হলো অন্যকে দীন পরিপূর্ণ পালনের আহবান জানানো। কেউ আহবান প্রত্যাখ্যান করলে তাকে জবরদস্তি করে তা পালন করানোর ক্ষমতা বা দায়িত্ব মুমিনের নেই
উপরের আয়াতে উল্লেখিত চারজন রাসূল: নূহ, ইবরাহীম, মূসা ঈসা (আলাইহিমুস সালাম)-এর বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, তাঁদের মধ্যে নূহ, ইবরাহীম ঈসা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন নি বা রাষ্ট্র জিহাদ বিষয়ক কোনো দাওয়াত দেন নি। তাঁরা তাওহীদ, রিসালাত, ঈমান, নেক কর্ম, হালাল-হারাম ইত্যাদি বিষযক দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সমাজের অত্যন্ত অল্প মানুষ তাদের দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন। এতে তাঁদের দীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অপূর্ণ থাকে নি। মূসা () অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তার জাতিকে জিহাদের দাওয়াত দেন। তার জাতি তা পালন করতে অস্বীকার করে। তখন তিনি আল্লাহর কাছে তাঁর নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন:


قَالَ رَبِّ إِنِّي لَا أَمْلِكُ إِلَّا نَفْسِي وَأَخِي فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ

‘‘হে আমার প্রতিপালক, আমার নিজের আমার ভাইয়ের উপর ছাড়া আর কারো উপর আমার কর্তৃত্ব-মালিকানা নেই। সুতরাং তুমি আমাদের ফাসিক মানুষদের মধ্যে বিচ্ছেদ করে দাও।’’[16]
এভাবে আমরা দেখছি যে, সকল নবী-রাসূল মূলত নিজের জীবনে দীন পালন এবং দীনের দাওয়াতের বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেই দীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যরা গ্রহণ না করায় বা সমাজে বা রাষ্ট্রে দীন ক্ষমতাবান না হওয়ায় তার দীন পালনের দায়িত্ব অপূর্ণ থাকে নি
আমরা আরো দেখছি যে, অন্যরা গ্রহণ করুক অথবা না করুক তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া, অর্থাৎ নিজের জীবনে দীনের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা বাস্তবায়নের পাশাপাশি অন্যদেরকে দীনের দাওয়াত দেওয়া দীন পালনেরই অংশ। এজন্য কোনো কোনো মুফাস্সির দীন প্রতিষ্ঠা বলতে দীন পালন দীনের দাওয়াত বুঝেছেন। হিজরী ৭ম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ আলিম আব্দুল আযীয- ইয্য ইবনু আব্দুস সালাম (৬৬০ হি) আয়াতের তাফসীরে বলেন:


(أَقِيمُوا الدِّينَ) اعملوابه أو ادعوا اليه

‘‘দীন প্রতিষ্ঠা কর: অর্থাৎ দীন পালন কর অথব দীনের প্রতি আহবান কর।’’[17]
কোনো কোনো মুফাস্সির দীন প্রতিষ্ঠা করা বলতে ঐক্যবদ্ধভাবে দীনকে আঁকড়ে ধরা বুঝিয়েছেন; কারণ এখানে বলা হয়েছে ‘‘দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি করো না।’’ এথেকে বুঝা যায় যে, দীনের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়াই দীন প্রতিষ্ঠা করা এবং দীনের বিষয়ে দলাদলি করার অর্থ দীন প্রতিষ্ঠা না করা। মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াকূব ফিরোযআবাদী (৮১৭ হি) তার সংকলিত ‘‘তানবীরুল মিকবাস’’ নামক তাফসীর গ্রন্থে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি বলেছেন:


(أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ) أمر الله جملة الانبياء أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ: أن انفقوا في الدين (وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ) لا تختلفوا في الدين

‘‘‘দীন প্রতিষ্ঠা কর’: আল্লাহ সকল নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, দীন প্রতিষ্ঠা কর: অর্থাৎ দীনের বিষয়ে ঐকমত হওএবং তাতে দলাদলি করো নাঅর্থাৎ দীনের বিষয়ে মতভেদ করো না।’’[18]
ইমাম তাবারী অন্যান্য মুফাস্সির প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুফাস্সির কাতাদা ইবনু দিআমাহ (১১৫ হি) থেকেও অনুরূপ তাফসীর উদ্ধৃত করেছেন[19] বিষয়ে আল্লামা ইবনু কাসীর (৭৭৪ হি) বলেন:

(أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ) أي: وصى الله تعالى جميع الأنبياء عليهم السلام بالاءتلاف والجماعة ونهاهم عن الا فتراق والاختلاف

‘‘দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি করো না: অর্থাৎ মহান আল্লাহ সকল নবীকে (আলাইহিমুস সালাম) নির্দেশ দিয়েছেন ভালবাসা ঐক্যের এবং নিষেধ করেছেন দলাদলি মতভেদ থেকে।’’[20]
এখানে উলে­খ্য যে, কুরআন কারীমে আর কোথাও ‘‘ইকামাতে দীন’’ বাক্যাংশ ব্যবহার করা হয় নি। হাদীসে নববীতেও ‘‘ইকামতে দীন’’ কথাটি কোথাও কোনোভাবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা যায় না। ইসলামী ফিকহে ‘‘ইকামতে দীন’’ বলে কোনো পরিভাষা নেই। বাহ্যত এর কারণ হলো, দীন একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা। এর বহু দিক রয়েছে। প্রত্যেক দিকের জন্য পৃথক বিধান রয়েছে। সকল বিষয়ের সামষ্টিক পালন, দাওয়াত ঐক্যবদ্ধতা দীনের ইকামত। প্রত্যেক বিষয়ের ইকামত বা পালন, দাওয়াত ঐক্যবদ্ধতা ইকামতে দীনের অংশ। প্রত্যেক বিষয়ের ‘‘ইকামত’’ বা পালন, দাওয়াত ঐক্যবদ্ধতার পৃথক বিধান রয়েছে। কাজেই ‘‘ইকামতে দীন’’ নামে কোনো পৃথক পরিভাষা বা বিধান প্রদান করা হয় নি

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে দীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। আর দীন প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো নিজের জীবনে দীনকে প্রতিপালন করে প্রতিষ্ঠিত রাখা। পাশাপাশি অন্যদেরকে তা প্রতিষ্ঠিত রাখতে দাওয়াত দেওয়া এবং দীনের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকাও ইকামতে দীন বা দীন প্রতিষ্ঠার অন্তর্ভুক্ত

দীন ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা, যা বিশ্বাস, কর্ম, পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রের সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিধান প্রদান করেছে। সকল বিধানই দীন এবং প্রত্যেকের নিজের জীবনে যে বিধান প্রযোজ্য তা আল্লাহর নির্দেশনা মত পালন করা দীন প্রতিষ্ঠার অংশ। পাশাপাশি দীনের সকল বিষয়ের দাওয়াত প্রদানও দীন প্রতিষ্ঠার অংশ। তাওহীদ, ঈমান, সালাত, যাকাত, সিয়াম, পরিবার, হালাল-হারাম, বিচার-ব্যবস্থা, অর্থ-ব্যবস্থা, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ইত্যাদি সকল বিষয় আল্লাহর নির্দেশ মত পালন করা, পালনের দাওয়াত দেওয়া পালনে দাওয়াতে ঐক্যবদ্ধ থাকা দীন প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন দিক। দীনের যে কোনো বিষয় পালন দাওয়াতই দীন প্রতিষ্ঠার অংশ। যে মুমিন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে রয়েছেন তার জন্য দীনের অন্যান্য বিধানের ন্যায় রাষ্ট্রীয় বিষয়ে দীনের বিধান পালন করা দীন প্রতিষ্ঠার অংশ। আর অন্যান্য মুমিনের জন্য বিষয়ে তাকে অন্যান্য সকলকে দাওয়াত দেওয়া দীন প্রতিষ্ঠার অংশ

আমরা আগেই বলেছি, ইসলামে রাষ্ট্র ব্যবস্থার গুরুত্বের বিষয়ে দীন সম্পর্কে অভিজ্ঞ কোনো মুসলিমই দ্বিমত পোষণ করবেন না। তবে দীন অর্থ শুধু রাষ্ট্র বলে মনে করা, শুধু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে দীন প্রতিষ্ঠা বলে দাবি করা, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করলে বড় ফরয তরক হবে এবং অন্য কোনো ইবাদত কবুল হবে না ইত্যাদি চিন্তার কোনো শরীয়তসম্মত ভিত্তি নেই। রাষ্ট্রক্ষমতার গুরুত্বের বিষয়ে জামাআতুল মুসলিমীন তাদের লিখনি বক্তব্যে যে সকল যুক্তি পেশ করতেন সেগুলির অন্যতম হলো, রাষ্ট্রব্যবস্থা না হলে দীনের অনেক বিধান পালন করা যায় না এবং একমাত্র রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে থাকলেই সমাজের সর্বস্তরে দীন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব

তাদের কথার মধ্যে সত্যতা রয়েছে। রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ইসলামীকরণের গুরুত্ব বুঝাতে দীনী দাওয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এরূপ কথা বলেন। কিন্তু জামাআতুল মুসলিমীন কথাকে ভুল অর্থে ব্যবহার করতেন। যুক্তি দিয়ে তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে বড় ফরয বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করতেন। আমরা দেখেছি যে, কোনো ইবাদতকে কোনো যুক্তি দিয়ে বড় ফরয বলা যায় না, বরং এজন্য কুরআন-সুন্নহের সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন। যুক্তি দিয়ে তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য আরকানে ইসলাম, অন্যান্যফরয আইন’, ওয়াজিব বা ব্যক্তিজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বর্জন করা বা হারাম-মাকরূহ কর্মে লিপ্ত হওয়ার বৈধতা প্রমাণ করতেন। এগুলি সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি ছাড়া কিছই নয়

আমরা কুরআন, হাদীস সাহাবীগণের বক্তব্য থেকে দেখেছি যে, আরকানুল ইসলাম অন্যান্য ফরয-নফল ইবাদত পালনই মুমিনের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রে বা বিজন প্রান্তরে, সমাজে বা একাকী, মুসলিম দেশে বা অমুসলিম দেশে সকল অবস্থায় স্থানে মুমিন ইবাদত-বন্দেগী পালন করবেন। জিহাদ রাষ্ট্রক্ষমতা ইবাদতের নিরাপত্তা স্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যম বা উপকরণ। এরা বিষয়টিকে উল্টা করে বুঝেন। তারা বলেন, জিহাদ রাষ্ট্রক্ষমতাই মুমিন জীবনের মূল উদ্দেশ্য। আরকানুল ইসলাম অন্যান্য ইবাদত সবই জিহাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল সংরক্ষণের উপকরণ মাত্র। এজন্য রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য সবই করা যায় বা সবই বাদ দেওয়া যায় বলে তারা দবি করতেন

এছাড়া তারা বুঝাতেন যে, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের আগে তাওহীদ, আহকাম, ইলম, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদির পালন দাওয়াত গুরুত্বহীন। যারা এগুলির পালন দাওয়াতের মাধ্যমে দীন প্রতিষ্ঠার বা দীনের এদিকগুলি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন তাদেরকে দীন প্রতিষ্ঠার বিরোধী বলে গণ্য করতেন। একমাত্র রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের প্রচেষ্টাকেই তারা দীন প্রতিষ্ঠা বলে মনে করতেন। তাদের সকল মতামত দীন, দীন প্রতিষ্ঠায় নবী-রাসূলগণের কর্মপদ্ধতি, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের সুন্নাত, মানবপ্রকৃতি ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে প্রগাঢ় অজ্ঞতার সাথে আবেগের সংমিশ্রণের ফল
রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন বা দখল কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্মকান্ডের উপর নির্ভর করে না। হাজার বছরের মুক্তিযুদ্ধ, সশস্ত্র সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক কর্মকান্ড, প্রচার ইত্যাদির মাধ্যমেও ক্ষমতার পরিবর্তন বা দখল অসম্ভব হতে পারে। দখল হলেও তা বেদখল হতে পারে। দীন প্রতিষ্ঠা বা দাওয়াতকে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের অধীন বলে চিন্তা করা দীন প্রতিষ্ঠা দীনের বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক অবাস্তব চিন্তা


রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা এবং ব্যবস্থার প্রয়োগে নিয়োজিত মানুষ- দুয়ের সমন্বয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হয়। খিলাফাতে রাশিদার পরে ইসলামী ব্যবস্থা একইরূপ আছে, কিন্তু ব্যবস্থার প্রয়োগের মানুষের পরিবর্তন ঘটেছে। তাঁদের পরে আর কখনোই তাঁদের মত মানুষ আসবে না। এজন্যই বিভিন্ন হাদীসে বারংবার বলা হয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘‘মন্দ’’ ‘‘ভাল’’ আসবে, তবে কখনোই প্রথম সময়ের মত হবে না
আর খিলাফতে রাশিদার পর থেকে সকল মুসলিম সমাজের অবস্থা পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি যে, কোনো সরকারই সমাজের পাপ, অনাচার ইত্যাদি দূর করে নি। রাষ্ট্র বা সরকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা করেছে এবং ভাল বা মন্দভাবে আইনের প্রয়োগ করেছে। ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশ, ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ, আল্লাহর পথে দাওয়াত ইত্যাদি মূলত আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ দায়ীগণের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। ‘‘ভাল’’ ইসলামী রাষ্ট্র বড়জোর দাওয়াতের পরিবেশ রক্ষা করেছে। পক্ষান্তরে অনেক ‘‘খারাপ’’ ইসলামী রাষ্ট্র দাওয়াতকে বাধাগ্রস্ত করেছে। কাজেই রাষ্ট্র হলেই সব হয়ে যাবে অথবা রাষ্ট্র না হলে কিছুই হবে না- এরূপ চিন্তা মানব প্রকৃতি ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা-প্রসূত আবেগতাড়িত কথা। ‘‘মন্দ’’ বা ‘‘ভাল’’ উভয় অবস্থায় ‘‘দায়ী’’-গণ দাওয়াত এগিয়ে নিবেন। দাওয়াতের মাধ্যমেই রাষ্ট্রীয় বিষয়ে জুলূম, অনাচার, অত্যাচার ইসলামী বিধান লঙ্ঘন দূর করতে এবং ভাল বা দাওয়াত-বান্ধব (DawahFriendly) সরকার লাভ করতে চেষ্টা করবেন
অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের অবিদ্যমানতায় বা বিচ্যুতিতে মুমিনের দীন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মুমিন পাপী হয় বলে চিন্তা করার কোনো শরীয়ত সম্মত ভিত্তি নেই। কথা বলা যায় যে, বিবাহ না করলে, সম্পদ না থাকলে বা ক্ষমতা না থাকলে দীনের অনেক বিধান পালন করা যায় না। কিন্তু এর অর্থ নয় যে, বিবাহ করা, সম্পদ অর্জন করা বা ক্ষমতা লাভ করা সবচেয়ে বড় ফরয। অথবা বলা যায় না, যে মুমিন শরীয়ত সম্মত ওজরের কারনে বিবাহ করেন নি, সম্পদশালী হতে পারেন নি বা ক্ষমতাশালী হতে পারেন নি তিনি তার সাধ্যমত দীনের বিধানগুলি পালন করলেও তা কবুল হবে না বা তিনি পাপী বলে গণ্য হবেন

যারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে রয়েছেন তারা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে পাপী হবেন। যার সম্পদ আছে তার জন্য যাকাত দেওয়া যেমন ফরয, যার ক্ষমতা আছে তার জন্য ক্ষমতা আল্লাহর নির্দেশমত ব্যবহার করা, দুনীতি বন্ধ করা, অধিকার ন্যয়বিচার নিশ্চিত করাও তেমানি ফরয। অন্যরা বিষয়ে দাওয়াত দেওয়ার পরেও সংশি­ষ্টরা না মানলে তাদের পাপ থাকে না। কাজেই ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, আবেগ বা দ্রুত ফলাফলের জন্য শরীয়ত নিষিদ্ধ কোনো কাজকে ‘‘বড় ফরয’’ পালনের অযুহাতে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি দায়িত্ব পালনের অযুহাতে কোনো সুন্নাত-মুসতাহাব কর্ম পরিত্যাগও মুমিনের দায়িত্ব নয়। সুন্নাতের ব্যতিক্রম পদ্ধতি অনুসরণও মুমিনের জন্য ক্ষতিকর

[1] সূরা () বাকারা: ৩০ আয়াত
[2]
তাবারী, তাফসীর /১৯৯-২০০; কুরতুবী, আল-জামি লি আহকামিল কুরআন /২৬৩-২৭৫; ইবনু কাসীর, তাফসীর /৭০-৭১
[3]
মুসলিম, আস-সহীহ /৯৭৮
[4]
আহমদ, আল-মুসনাদ /১০; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /১৮৪, ১৯৮
[5]
সূরা () তাওবা: ৩৩ আয়াত
[6]
সূরা (৪৮) ফাতহ: ২৮ আয়াত সূরা (৬১) সাফ্: আয়াত
[7]
তাবারী, তাফসীর ১৪/২১৫-২১৬; কুরতুবী, আল-জামিউ লি আহকামিল কুরআন /১২১; ইবনুল জাওযী, যাদুল মাসীর /১৭০
[8]
মুসলিম আস-সহীহ /২২১৫
[9]
আহমদ, আল-মুসনাদ /১০৩; / হাদিসটি সহীহ আলবানী, সহীহাহ /৩২
[10]
সূরা শুরা: আয়াত ১৩
[11]
তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ২১/৫১৩; আবূ হাইয়ান মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ (৭৪৫ হি.), আল- বাহরুল মুহীত /৪৮২; ইবনু কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম /১৯৫; কুরতুবী আল-জামিউ লি আহকামিল কুরআন ১৬/১০
[12]
তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ২১/৫১৩
[13]
আবু হাইয়ান মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ (৭৪৫ হি.), আল-বাহরুল মুহীত /৪৮২
[14]
আবু হাইয়ান, আল-বাহরুল মুহীত /৪৮২
[15]
ইবনু আজীবাহ, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ (১২২৪), আল-বাহরুল মাদীদ /৪২৩
[16]
সূরা () মায়িদা: আয়াত ২৫
[17]
ইয্ ইবনু আব্দুস সালাম, তাফসীরুল ইয্ /১০৫১
[18]
ফিরোযআবাদী, তানবীরুল মিকবাস (শামিলা) /
[19]
তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ২১/৫১৩
[20]
ইবনু হাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (শামিলা) /১৯৫

 . ১০. সমাজ পরিবর্তনে সাহাবী পরবর্তীদের কর্মধারা

সমাজ-পরিবর্তন, সংস্কার, রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ক সমকালীন গবেষণার ক্ষেত্রে প্রায় সকলেই একটি বিশেষ ভুলের মধ্যে নিপতিত হন। তা হলে, তারা শূন্য থেকে শুরুর বিষয়ে চিন্তা করেন। তারা ধারণা করেন যে, ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র বলতে কিছুই বিদ্যমান নেই; কাজেই আমাদেরকে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যেমন একটি কাফির সমাজে দাওয়াত দিয়ে ইসলামী সমাজ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আমাদেরকেও তেমনি একটি কাফির সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে। পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা বুঝেছি যে, সকল চিন্তার ভিত্তি আরেকটি ভুলের উপর, তা হলো পাপের কারণে মুসলিম ব্যক্তি, সমাজ রাষ্ট্রকে ‘‘অমুসলিম’’ বলে গণ্য করা। জেনে বা না-জেনে অসতর্কভাবে আমর ভুলের মধ্যে নিপতিত হই

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইসলামী দীন, সমাজ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিতরূপে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন হাদীসে বারংবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, ব্যবস্থায় বিচ্যুতি আসবে, আবার কিছু ভাল হবে, আবার বিচ্যুতি আসবে। আবার কিছু ভাল হবে। কখনো হবে স্বৈরতান্ত্রিক রাজত্ব এবং কখনো হবে নুবুওয়াতের পদ্ধতিতে জনগণতান্ত্রিক খিলাফাত। এভাবেই চলতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। ব্যবস্থা একেবারে বিলীন হবে না, আবার খিলাফাতে রাশেদার মত পরিপূর্ণ ব্যবস্থাও আর আসবে না

কাজেই বর্তমান সমাজগুলিকে মক্কার কাফির সমাজের মত কল্পনা করার কোনো সুযোগ নেই বরং সকল সমাজ উমাইয়া, আববাসী, ফাতিমী, বাতিনী, কারামিতী, মোগল, তাতার অন্যান্য রাষ্ট্র সমাজের মত। এক্ষেত্রে দীনী দাওয়াত, পরিবর্তন বা সংস্কারের জন্য আমাদেরকে পূর্ববর্তী সমাজ রাষ্ট্রগুলিতে সাহাবী-তাবিয়ী পরবর্তী আলিমগণের কর্মধারা পর্যালোচনা করতে হবে। কুরআন-হাদীসের নির্দেশনার আলোকে এবং তাঁদের কর্মধারার ভিত্তিতে আমাদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে

No comments

Powered by Blogger.