রাহে বেলায়াত তৃতীয় অধ্যায় - অনুচ্ছেদ-৩৮, তৃতীয় প্রকার যিকর - তৃতীয় পর্ব: রাতের যিকর-ওযীফা - (৪) শেষ রাতের যিকর

তৃতীয় অধ্যায় - অনুচ্ছেদ-৩৮, 

তৃতীয় প্রকার যিকর - তৃতীয় পর্ব: রাতের যিকর-ওযীফা - () শেষ রাতের যিকর

কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ দরুদ পাঠ, দু

হাদীস শরীফে সাহাবী-তাবেয়ীগণের জীবনে আমরা দেখতে পাই যে, নফল ইবাদত ওযীফা পালনের অন্যতম সময় রাত। বিশেষত কুরআন তিলাওয়াত, নফল সালাত, দরুদ পাঠ দুআর অন্যতম সময় রাত। সাহাবী তাবেয়ীগণ এসকল ইবাদত রাত্রেই পালন করতেন, বিশেষত শেষ রাত্রে। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত রাতের কিছু সময়, বিশেষত শেষ রাতের কিছু সময় সকল ইবাদতে কাটানোর জন্য। প্রত্যেক যাকির নিজের সুবিধা অবস্থা অনুসারে কিছু সময় তাহাজ্জুদ আদায় করবেন। কুরআন কারীম সম্পূর্ণ বা আংশিক মুখস্থ থাকলে তাহাজ্জুদের মধ্যেই বেশি বেশি তিলাওয়াত করে তাহাজ্জুদ আদায় করবেন। অন্যথায় তাহাজ্জুদের পরে কিছু সময় কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ দু করা উচিত। আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, দু কবুল হওয়ার অন্যতম সময় রাত, বিশেষত রাতের শেষভাগ। এই সময়ে তাহাজ্জুদ দুআর জন্য বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত

কিয়ামুল্লাইল তাহাজ্জুদের গুরুত্ব মর্যাদা

কিয়ামুল্লাইলঅর্থ রাতের কিয়াম বা রাত্রিকালীন দাঁড়ানো। সালাতুল ইশার পর থেকে ফজরের ওয়াক্তের উন্মেষ পর্যন্ত সময়ে যে কোনো নফল সালাত আদায় করলে তাকিয়ামুল্লাইলবাসালাতুল্লাইলঅর্থাৎ রাতের দাঁড়ানো বা রাতের সালাত বলে গণ্য।তাহাজ্জুদঅর্থ ঘুম থেকে উঠা। রাতে ঘুম থেকে উঠে আদায় করা সালাতকে তাহাজ্জুদ বলা হয়। কেউ যদি ইশার সালাত আদায় করে রাত ৯টা বা ১০টায় ঘুময়ে পড়েন এবং ১১/১২টায় উঠে নফল সালাত আদায় করেন তবে তাকিয়ামুল্লাইলতাহাজ্জুদবলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে কেউ যদি ইশার পরে না ঘুমিয়ে রাত ১১/১২ টার দিকে কিছু নফল সালাত আদায় করেন তবে তাকিয়ামুল্লাইলবলে গণ্য হলেওতাহাজ্জুদবলে গণ্য নয়


ইসলামের অন্যতম নফল ইবাদত কিয়ামুল্লাইল। প্রথম রাতে বা শেষ রাতে, ঘুমানোর আগে বা ঘুম থেকে উঠে অন্তত কিছু নফল সালাত আদায় করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একটু ঘুমিয়ে উঠেতাহাজ্জুদ’-রূপে কিয়ামুল্লাইল আদায় করলে তার সাওয়াব মর্যাদা বেশি। রাতের শেষভাগে তা আদায় করা সর্বোত্তম। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, রাতের শেষভাগ রহমত, বরকত ইবাদত কবুলের জন্য সর্বোত্তম সময়। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীগণ সাধারণত সময়েই কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন


কুরআন কারীমে কোনো নফল সালাতের উল্লেখ করা হয়নি, এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতেরও বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু তাহাজ্জুদের সালাতের কথা বারংবার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মুমিন জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন হাদীসের নির্দেশনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারি যে, রাতের একাকী মুহূর্তে কিছু সময় আল্লাহর যিকরে, তার সাথে মুনাজাতে এবং তাঁরই (আল্লাহর) ইবাদতে ব্যয় করা মুমিনের জীবনের অবিচেছদ্য অংশ


কিয়ামুল্লাইল বা সালাতুল্লাইলের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এত বেশি নির্দেশনা দিয়েছেন যে, বিষয়ে বর্ণিত সহীহ হাদীসগুলি একত্রিত করলে একটি বৃহদাকৃতি পুস্তকে পরিণত হবে। বিষয়ে কয়েকটি হাদীস ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে দু কবুলের সময়ের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, আমর ইবনু আমবাসাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “মহান প্রতিপালক তাঁর বান্দার সবচেয়ে নিকটবর্তী হন রাতের শেষ অংশে। কাজেই তুমি যদি সে সময়ে আল্লাহর যিকরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পার তবে তা হবে।

এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

أفضل الصلاة بعد الصلاة المكتوبة (صلاة الليل) الصلاة في جوف الليل


ফরয সালাতের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ সালাত রাতের সালাত বা রাতের গভীরে আদায়কৃত সালাত।”[1]


অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

أَيُّهَا النَّاسُ أَفْشوا السَّلامَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصَلُّوا باللَّيْل وَالنَّاسُ نِيامٌ، تَدخُلُوا الجَنَّةَ بِسَلامٍ


হে মানুষেরা তোমরা সালামের প্রচলন কর, খাদ্য প্রদান কর, আত্মীয়তা রক্ষা কর এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সালাত আদায় কর, তাহলে তোমরা শান্তিতে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।হাদীসটি সহীহ।[2]


আবূ উমামা বাহিলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

عليكم بقيام الليل؛ فإنه دأب الصالحين قبلكم، وقربة إلى ربكم ومكفرة للسيئات، ومنهاة عن الإثم ومطردة للداء عن الجسدز


তোমরা অবশ্যই কিয়ামুল্লাইল পালন করবে। কারণ তা তোমাদের পূর্ববর্তী নেককার মানুষদের অভ্যাস, তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য, পাপের ক্ষমা, পাপ থেকে আত্মরক্ষার পথ এবং দেহ থেকে রোগব্যধির বিতাড়ন।হাদীসটি সহীহ।[3]


সাহাবীগণ কিয়ামুল্লাইল পরিত্যাগ পছনদ করতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেছেন:

لَا تَدَعْ قِيَامَ اللَّيْلِ فَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَدَعُهُ وَكَانَ إِذَا مَرِضَ أَوْ كَسِلَ صَلَّى قَاعِدًا


কখনো কিয়ামুল্লাইল ত্যাগ করবে না; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো তা ত্যাগ করতেন না। যদি কখনো অসুস্থ থাকতেন অথবা কিছুটা ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করতেন তাহলে তিনি বসে তা আদায় করতেন।”[4]


অনেক হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো সাহাবী তাহাজ্জুদ পালনে সামান্য অবহেলা করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) আপত্তি করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধারণতবিতর’-সহ মোট এগার রাকআত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। তিনি অধিকাংশ সময় শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। তিনি তাহাজ্জুদের আগে অনেক সময় কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করতেন। কখনো কিছু তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি যিকর করার পর তাহাজ্জুদ শুরু করতেন। তিনি তাহাজ্জুদের সালাতের তিলাওয়াত খুব লম্বা করতেন। এক রাকআতে অনেক সময় / পারা কুরআন তিলাওয়াত করতেন। রুকু সাজদাও অনুরূপভাবে দীর্ঘ করতেন। যতক্ষণ তিনি তিলাওয়াত করতেন প্রায় ততক্ষণ রুকুতে সাজদায় থাকতেন। আর তিলাওয়াতের সময় তিনি কুরআনের আয়াতের অর্থ অনুসারে থেমে থেমে দু করতেন। তাহাজ্জুদের সালাতের মধ্যে তিনি ক্রন্দন করতেন। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ আদায় করার কারণে অনেক সময় তাঁর মুবারক পদযুগল ফুলে যেত। আল্লাহর দরবারে সকাতরে প্রার্থনা করি, তিনি যেন গোনাহগার লেখককে সকল পাঠককে তাঁর মহান রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত অনুসারে তাহাজ্জুদ আদায়ের তাওফীক দান করেন; আমীন

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /৮২১।
[2]
তিরমিযী, আস-সুনান /৬৫২।
[3]
তিরমিযী, আস-সুনান /৫৫২; আলবানী, সহীহুত তারগীব /৩২৮, সহীহুল জামি /৭৫২।
[4]
হাদিসটি সহীহ। সুনানু আবী দাউদ /৩২, নং ১৩০৭, সহীহুত তারগীব /৩৩১

No comments

Powered by Blogger.