আল-ফিকহুল আকবর অধ্যায়-০৬ - মহান আল্লাহর বিশেষণ, তাকদীর ইত্যাদি
মহান আল্লাহর বিশেষণ, তাকদীর ইত্যাদি
ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত (রাহ) বলেন:
لاَ يُشْبِهُ شَيْئاً مِنَ الأَشْيَاءِ مِنْ خَلْقِهِ، وَلاَ يُشْبِهُهُ شَيْءٌ
مِنْ خَلْقِهِ. لَمْ يَزَلْ وَلاَ يَزَالُ بِأَسْمَائِهِ وَصِفَاتِهِ
الذَّاتِيَّةِ وَالْفِعْلِيَّةِ. أَمَّا الذّاتِيَّةُ فَالْحَيَاةُ وَالْقُدْرَةُ
وَالْعِلْمُ وَالْكَلاَمُ وَالسَّمْعُ وَالْبَصَرُ وَالإِرَادَةُ، وَأَمَّا
الْفِعْلِيَّةُ فَالتَّخْلِيْقُ وَالتَّرْزِيْقُ وَالإِنْشَاءُ وَالإِبْدَاعُ
وَالصُّنْعُ وَغَيْرُ ذَلِكَ مِنَ صِفَاتِ الْفِعْلِ. لَمْ يَزَلْ وَلاَ يَزَالُ
بِأَسْمَائِهِ وَصِفَاتِهِ لَمْ يَحْدُثْ لَهُ اسْمٌ وَلاَ صِفَةٌ. لَمْ يَزَلْ
عَالِماً بِعِلْمِهِ وَالْعِلْمُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَقَادِراً بِقُدْرَتِهِ
وَالْقُدْرَةُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَمُتَكَلِّماً بِكَلاَمِهِ وَالْكَلاَمُ
صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَخَالِقاً بِتَخْلِيْقِهِ وَالتَّخْلِيْقُ صِفَةٌ فِيْ
الأَزَلِ، وَفَاعِلاً بِفِعْلِهِ وَالْفِعْلُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَالْفَاعِلُ
هُوَ اللهُ تَعَالَي وَالْفِعْلُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَالْمَفْعُوْلُ
مَخْلُوْقٌ وَفِعْلُ اللهِ تَعَالَي غَيْرُ مَخْلُوْقٍ. وَصِفَاتُهُ فِيْ الأَزَلِ
غَيْرُ مُحْدَثَةٍ وَلاَ مَخْلُوْقَةٍ. وَمَنْ قَالَ إِنَّهَا مَخْلُوْقَةٌ أَوْ
مُحْدَثَةٌ أَوْ وَقَفَ أَوْ شَكَّ فِيْهِمَا فَهُوَ كَافِرٌ بِاللهِ تَعَالَي.
وَالْقُرْآنُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَي فِيْ الْمَصَاحِفِ مَكْتُوْبٌ، وَفِيْ الْقُلُوْبِ مَحْفُوْظٌ، وَعَلَي الأَلْسُنِ مَقْرُوْءٌ، وَعَلَي النَّبِيِّ ﷺ مُنَزَّلٌ، وَلَفْظُنَا بِالْقُرْآنِ مَخْلُوْقٌ وَكِتَابَتُنَا لَهُ مَخْلُوْقَةٌ وَقِرَاءَتُنَا لَهُ مَخْلُوْقَةٌ وَالْقُرْآنُ غَيْرُ مَخْلُوْقِ. وَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِيْ الْقُرْآنِ حِكَايَةً عِنْ مُوْسَي وَغَيْرِهِ مِنَ الأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ، وَعَنْ فِرْعَوْنَ وَإِبْلِيْسَ، فَإِنَّ ذَلِكَ كُلَّهُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَي إِخْبَاراً عَنْهُمْ، وَكَلاَمُ اللهِ تَعَالَي غَيْرُ مَخْلُوْقٍ، وَكَلاَمُ مُوْسَي وَغَيْرِهِ مِنَ الْمَخْلُوْقِيْنَ مَخْلُوْقٌ، وَالْقُرْآنُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَي فَهْوَ قَدِيْمٌ، لاَ كَلاَمُهُمْ. وَسَمِعَ مُوْسَي عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَلاَمَ اللهِ تَعَالَي كَمَا فِيْ قَوْلِهِ تَعَالَي: "وَكَلَّم َاللهُ مُوْسيَ تَكْلِيْمًا". وَقَدْ كَانَ اللهُ تَعَالَي مُتَكَلِّماً وَلَمْ يَكُنْ كَلَّمَ مُوْسَي عَلَيْهِ السَّلاَمُ، وَقَدْ كَانَ اللهُ تَعَالَي خَالِقاً فِيْ الأَزَلِ وَلَمْ يَخْلُقِِ الْخَلْقَ، لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ. فَلَمَّا كَلَّمَ اللهُ مُوْسَي كَلَّمَهُ بِكَلاَمِهِ الَّذِيْ هُوَ لَهُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ.
وَصِفَاتُهُ كُلُّهَا بِخِلاَفِ صِفَاتِ الْمَخْلُوْقِيْنَ. يَعْلَمُ لاَ
كَعِلْمِنَا، وَيَقْدِرُ لاَ كَقُدْرَتِنَا، وَيَرَي لاَ كَرُؤْيَتِنَا،
وَيَسْمَعُ لاَ كَسَمْعِنَا وَيَتَكَلَّمُ لاَ كَكَلاَمِنَا، وَنَحْنُ نَتَكَلَّمُ
بِاْلآلاتِ وَالْحُرُوْفِ وَاللهُ تَعَالَي يَتَكَلَّمُ بِلاَ آلَةٍ وَلاَ
حُرُوْفٍ، وَالْحُرُوْفُ مَخْلُوْقَةٌ، وَكَلاَمُ اللهِ تَعَالَي غَيْرُ
مَخْلُوْقٍ.
وَهُوَ شَيْءٌ لاَ كَالأَشْيَاءِ وَمَعْنَي الشَّيْءِ إِثْبَاتُهُ بِلاَ جِسْمٍ
وَلاَ جَوْهَرٍ وَلاَ عَرْضٍ وَلاَ حَدَّ لَهُ وَلاَ ضِدَّ لَهُ وَلاَ نِدَّ لَهُ
"فَلاَ تَجْعَلُوْا للهِ أَنْدَاداً" وَلاَ مِثْلَ لَهُ. وَلَهُ يَدٌ
وَوَجْهٌ وَنَفْسٌ فَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِيْ الْقُرْآنِ مِنْ ذِكْرِ
الْوَجْهِ وَالْيَدِ وَالنَّفْسِ فَهُوَ لَهُ صِفَاتٌ بِلاَ كَيْفٍ. وَلاَ
يُقَالُ: إِنَّ يَدَهُ قُدْرَتُهُ أَوْ نِعْمَتُهُ؛ لأَنَّ فِيْهِ إِبْطَالَ
الصِّفَةِ. وَهُوَ قَوْلُ أَهْلِ الْقَدَرِ وَالاِعْتِزَالِ، وَلَكِنَّ يَدَهُ
صِفَتُهُ بِلاَ كَيْفٍ، وَغَضَبُهُ وَرِضَاهُ صِفَتَانِ مِنْ صِفَاتِهِ تَعَالَى
بِلاَ كَيْفٍ.
خَلَقَ اللهُ تَعَالَى الأَشْيَاءَ لاَ مِنْ شَيْءٍ، وَكَانَ اللهُ تَعَالَى
عَالِماً فِيْ الأَزَلِ بِالأَشْيَاءِ قَبْلَ كَوْنِهَا، وَهُوَ الَّذِيْ قَدَّرَ
الأَشْيَاءَ وَقَضَاهَا، أَلاَ يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَلاَ يَكُوْنُ فِيْ
الدُّنْيَا وَلاَ فِيْ الآَخِرَةِ شَيْءٌ إِلاَّ بِمَشِيْئَتِهِ وَعِلْمِهِ
وَقَضَائِهِ وَقَدَرِهِ وَكَتْبِهِ فِيْ اللَّوْحِ الْمَحْفُوْظِ، وَلَكِنَّ
كَتْبَهُ بِالْوَصْفِ لاَ بِالْحُكْمِ. وَالْقَضَاءُ وَالْقَدَرُ وَالْمَشِيْئَةُ
صِفَاتُهُ فِيْ الأَزَلِ بِلاَ كَيْفٍ. يَعْلَمُ اللهُ تَعَالَى الْمَعْدُوْمَ
فِيْ حَالِ عَدَمِهِ مَعْدُوْماً، وَيَعْلَمُ أَنَّهُ كَيْفَ يَكُوْنُ إِذَا
أَوْجَدَهُ، وَيَعْلَمُ اللهُ الْمَوْجُوْدَ فِيْ حَالِ وُجُوْدِهِ مَوْجُوْداً،
وَيَعْلَمُ أَنَّهُ كَيْفَ يَكُوْنُ فَنَاؤُهُ. وَيَعْلَمُ اللهُ تَعَالَى
الْقَائِمَ فِيْ حَالِ قِيَامِهِ قَائِماً، وَإِذَا قَعَدَ قَاعِداً فِيْ حَالِ
قُعُوْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَتَغَيَّرَ عِلْمُهُ أَوْ يَحْدُثَ لَهُ عِلْمٌ وَلَكِنَّ
التَّغَيُّرَ اخْتِلاَفُ الأَحْوَالِ يَحْدُثُ فِيْ الْمَخْلُوْقِيْنَ.
خَلَقَ اللهُ تَعَالَى الْخَلْقَ سَلِيْماً مِنَ الْكُفْرِ وَالإِيْمَانِ، ثُمَّ
خَاطَبَهُمْ وَأَمَرَهُمْ وَنَهَاهُمْ، فَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ بِفِعْلِهِ
وَإِنْكَارِهِ وَجُحُوْدِهِ الْحَقَّ بِخُذْلاَنِ اللهِ تَعَالَى إِيَّاهُ،
وَآَمَنَ مَنْ آَمَنَ بِفِعْلِهِ وَإِقْرَارِهِ وَتَصْدِيْقِهِ، بِتَوْفِيْقِ
اللهِ تَعَالَى إِيَّاهُ وَنُصْرَتِهِ لَهُ. أَخْرَجَ ذُرِّيَّةَ آَدَمَ مِنْ
صُلْبِهِ عَلَى صُوَرِ الذَّرِّ، فَجَعَلَهُمْ عُقَلاَءَ فَخَاطَبَهُمْ
"أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ؟ قَالُوْا بَلَى" وَأَمَرَهُمْ بِالإِيْمَانِ
وَنَهَاهُمْ عَنِ الْكُفْرِ فَأَقَرُّوا لَهُ بِالرُّبُوْبِيَّةِ، فَكَانَ ذَلِكَ
مِنْهُمْ إِيْمَاناً فَهُمْ يُوْلَدُوْنَ عَلَى تِلْكَ الْفِطْرَةِ "إِمَّا
شَاكِراً وَإِمَّا كَفُوْراً" وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَقَدْ بَدَّلَ
وَغَيَّرَ، وَمَنْ آَمَنَ وَصَدَّقَ فَقَدْ ثَبَتَ عَلَيْهِ وَدَاوَمَ. وَلَمْ
يُجْبِرْ أَحَداً مِنْ خَلْقِهِ عَلَى الْكُفْرِ وَلاَ عَلَى الإِيْمَانِ، وَلاَ
خَلَقَهُمْ مُؤْمٍناً وَلاَ كَافِراً، وَلَكِنْ خَلَقَهُمْ أَشْخَاصاً،
وَالإِيْمَانُ وَالْكُفْرُ مِنْ فِعْلِ الْعِبَادِ. وَيَعْلَمُ اللهُ مَنْ
يَكْفُرُ فِيْ حَالِ كُفْرِهِ كَافِراً، فَإِذَا آمَنَ بَعْدَ ذَلِكَ عَلِمَهُ
مُؤْمِناً فِيْ حَالِ إِيْمَانِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَتَغَيَّرَ عِلْمُهُ
وَصِفَتُهُ.
وَجَمِيْعُ أَفْعَالِ الْعِبَادِ مِنَ الْحَرَكَةِ وَالسُّكُوْنِ كَسْبُهُمْ عَلَى
الْحَقِيْقَةِ، وَاللهُ تَعَالَى خَالِقُهَا، وَهِيَ كُلُّهَا بِمَشِيْئَتِهِ
وَعِلْمِهِ وَقَضَائِهِ وَقَدَرِهِ. وَالطَّاعَاتُ كُلُّهَا كَانَتْ وَاجِبَةً
بِأَمْرِ اللهِ تَعَالَى وَبِمَحَبَّتِهِ وَبِرِضَاهُ وَعِلْمِهِ وَمَشِيْئَتِهِ
وَقَضَائِهِ وَتَقْدِيْرِهِ. وَالْمَعَاصِيْ كُلُّهَا بِعِلْمِهِ وَقَضَائِهِ
وَتَقْدِيْرِهِ وَمَشِيْئَتِهِ، لاَ بِمَحَبَّتِهِ وَلاَ بِرِضَاهُ وَلاَ
بِأَمْرِهِ.
বঙ্গানুবাদ
তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির কোনো কিছুর মত নন। তিনি অনাদি কাল থেকে অনন্ত কাল বিদ্যমান, তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) সিফাত (বিশেষণ)সমূহসহ। তাঁর সত্তীয় বিশেষণসমূহ: হায়াত (জীবন), কুদরাত (ক্ষমতা), ইলম (জ্ঞান), কালাম (কথা), সাম’ (শ্রবণ), বাসার (দর্শন) ও ইরাদা (ইচ্ছা)। আর তাঁর ফি’লী সিফাতসমূহের মধ্যে রয়েছে: সৃষ্টি করা, রিয্ক প্রদান করা, নবসৃষ্টি করা, উদ্ভাবন করা, তৈরি করা এবং অন্যান্য কর্মমূলক সিফাত বা বিশেষণ। তিনি তাঁর গুণাবলি এবং নামসমূহ-সহ অনাদিরূপে বিদ্যমান। তাঁর নাম ও বিশেষণের মধ্যে কোনো নতুনত্ব বা পরিবর্তন ঘটে নি। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর জ্ঞানে জ্ঞানী এবং জ্ঞান অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কথায় কথা বলেন এবং কথা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টি করা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কর্মে কর্মী, কর্ম অনাদিকাল থেকে তাঁর বিশেষণ। আল্লাহ তাঁর কর্ম দিয়ে যা সৃষ্টি করেন তা সৃষ্ট, তবে আল্লাহর কর্ম সৃষ্ট নয়। তাঁর সিফাত বা বিশেষণাবলি অনাদি। কোনো বিশেষণই নতুন বা সৃষ্ট নয়। যে ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহর কোনো সিফাত বা বিশেষণ সৃষ্ট অথবা নতুন, অথবা এ বিষয়ে সে কিছু বলতে অস্বীকার করে, অথবা এ বিষয়ে সে সন্দেহ পোষণ করে, তবে সে আল্লাহর প্রতি ঈমান-বিহীন কাফির।
কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম, মুসহাফগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ, হৃদয়গুলোর মধ্যে সংরক্ষিত, জিহবাসমূহ দ্বারা পঠিত এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপরে অবতীর্ণ। কুরআন পাঠে আমাদের জিহবার উচ্চারণ সৃষ্ট, কুরআনের জন্য আমাদের লিখনি সৃষ্ট, আমাদের পাঠ সৃষ্ট, কিন্তু কুরআন সৃষ্ট নয়। মহান আল্লাহ কুরআনের মধ্যে মূসা (আ) ও অন্যান্য নবী (আ) থেকে এবং ফিরাউন এবং ইবলীস থেকে যা উদ্ধৃত করেছেন তা সবই আল্লাহর কালাম (কথা), তাদের বিষয়ে সংবাদ হিসেবে। আল্লাহর কথা সৃষ্ট নয়, মূসা (আ) ও অন্য সকল মাখলূকের কথা সৃষ্ট। কুরআন আল্লাহর কথা কাজেই তা অনাদি, মাখলূকগণের কথা সেরূপ নয়। মূসা (আ) আল্লাহর কথা শুনেছিলেন, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ‘‘মূসার সাথে আল্লাহ প্রকৃত বাক্যালাপ করেছিলেন’’[1] মূসা (আ)-এর সাথে কথা বলার আগেই- অনাদিকাল থেকেই- মহান আল্লাহ তাঁর কালাম বা কথার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন, যেমন সৃষ্টজগত সৃষ্টি করার পূর্বেই- অনাদিকাল থেকেই- তিনি সৃষ্টিকর্তার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন। ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[2] যখন তিনি মূসা (আ)-এর সাথে কথা বলেন তখন তিনি তাঁর সেই অনাদি বিশেষণ কথার বিশেষণ দ্বারা কথা বলেন।
তাঁর সকল বিশেষণই মাখলূকদের বা সৃষ্টপ্রাণীদের বিশেষণের ব্যতিক্রম। তিনি জানেন, তবে তাঁর জানা আমাদের জানার মত নয়। তিনি ক্ষমতা রাখেন, তবে তাঁর ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়। তিনি দেখেন, তবে তাঁর দেখা আমাদের দেখার মত নয়। তিনি কথা বলেন, তবে তাঁর কথা বলা আমাদের কথা বলার মত নয়। তিনি শুনেন, তবে তাঁর শোনা আমাদের শোনার মত নয়। আমরা বাগযন্ত্র ও অক্ষরের মাধ্যমে কথা বলি, আর মহান আল্লাহ বাগযন্ত্র এবং অক্ষর ছাড়াই কথা বলেন। অক্ষরগুলি সৃষ্ট। আর আল্লাহর কথা (কালাম) সৃষ্ট নয়।
তিনি ‘শাইউন’: ‘বস্ত্ত’ বা ‘বিদ্যমান অস্তিত্ব’, তবে অন্য কোনো সৃষ্ট ‘বস্ত্ত’ বা ‘বিদ্যমান বিষয়ের’ মত তিনি নন। তাঁর ‘শাইউন’- ‘বস্ত্ত’ হওয়ার অর্থ তিনি বিদ্যমান অস্তিত্ব, কোনো দেহ, কোনো জাওহার (মৌল উপাদান) এবং কোনো ‘আরায’ (অমৌল উপাদান) ব্যতিরেকেই। তাঁর কোনো সীমা নেই, বিপরীত নেই, সমকক্ষ নেই, তুলনা নেই। ‘‘অতএব তোমরা কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।’’[3] তাঁর ইয়াদ (হস্ত) আছে, ওয়াজহ (মুখমন্ডল) আছে, নফস (সত্তা) আছে, কারণ আল্লাহ কুরআনে এগুলো উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ যা কিছু উল্লেখ করেছেন, যেমন মুখমন্ডল, হাত, নফস ইত্যাদি সবই তাঁর বিশেষণ, কোনো ‘স্বরূপ’ বা প্রকৃতি নির্ণয় ব্যতিরেকে। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ক্ষমতা অথবা তাঁর নিয়ামত। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর বিশেষণ বাতিল করা। এরূপ ব্যাখ্যা করা কাদারিয়া ও মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের রীতি। বরং তাঁর হাত তাঁর বিশেষণ, কোনো স্বরূপ নির্ণয় ব্যতিরেকে। তাঁর ক্রোধ এবং তাঁর সন্তুষ্টি তাঁর দুটি বিশেষণ, আল্লাহর অন্যান্য বিশেষণের মতই, কোনো ‘কাইফ’ বা ‘কিভাবে’ প্রশ্ন করা ছাড়াই।
মহান আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। সকল কিছুর সৃষ্টির আগেই অনাদিকাল থেকে তিনি এগুলোর বিষয়ে অবগত ছিলেন। সকল কিছুই তিনি নির্ধারণ করেছেন এবং বিধান দিয়েছেন। দুনিয়ায় ও আখিরাতে কোনো কিছুই তাঁর ইচ্ছা, জ্ঞান, বিধান, নির্ধারণ ও লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ-করণ ছাড়া ঘটে না। তাঁর লিখনি বর্ণনামূলক, নির্দেশমূলক নয়। বিধান প্রদান, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি বিশেষণ, কোনো স্বরূপ, কিরূপ বা কিভাবে অনুসন্ধান ছাড়া। সিদ্ধান্ত, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি-অনন্ত বিশেষণ, কোনো স্বরূপ জিজ্ঞাসা ছাড়া। মহান আল্লাহ অস্তিত্বহীন বিষয়কে অস্তিত্বহীন অবস্থায় অস্তিত্বহীন হিসেবে জানেন, এবং তিনি জানেন যে, তিনি তাকে অস্তিত্ব দিলে তা কিরূপ হবে। আল্লাহ অস্তিত্বশীল বিষয়কে তার অস্তিত্বশীল অবস্থায় জানেন এবং তিনি জানেন যে, তা কিভাবে বিলোপ লাভ করবে। আল্লাহ দন্ডায়মানকে দন্ডায়মান অবস্থায় দন্ডায়মান রূপে জানেন। এবং যখন সে উপবিষ্ট হয় তখন তিনি তাঁকে উপবিষ্ট অবস্থায় উপবিষ্ট জানেন। এরূপ জানায় তাঁর জ্ঞানের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না বা তাঁর জ্ঞানভান্ডারে কোনো নতুনত্ব সংযোজিত হয় না। পরিবর্তন ও নতুনত্ব সবই সৃষ্টজীবদের অবস্থার মধ্যে।
মহান আল্লাহ সৃষ্টজগত সৃষ্টি করেছেন ঈমান ও কুফর থেকে বিমুক্ত অবস্থায়। অতঃপর তিনি তাদেরকে সম্বোধন করেছেন এবং আদেশ ও নিষেধ প্রদান করেছেন। যে ব্যক্তি কুফরী করেছে সে নিজের কর্ম দ্বারা, অস্বীকার করে, সত্যকে অমান্য করে এবং আল্লাহর সাহায্য, রহমত ও তাওফীক থেকে বঞ্চিত হয়ে কুফরী করেছে। আর যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে সে তার কর্ম দ্বারা, স্বীকৃতি দ্বারা, সত্য বলে ঘোষণা করে এবং আল্লাহর তাওফীক ও সাহায্য লাভের মাধ্যমে ঈমান এনেছে।
তিনি আদমের পিঠ থেকে তাঁর বংশধরদেরকে পরমাণুর আকৃতিতে বের করে তাদেরকে বোধশক্তি প্রদান করেন এবং তাদেরকে সম্বোধন করেন ‘‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলে: হ্যাঁ’’[4]। তিনি তাদেরকে ঈমানের নির্দেশ দেন এবং কুফর থেকে নিষেধ করেন। তারা তাঁর রুবূবিয়্যাতের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছিল তাদের পক্ষ থেকে ঈমান। আদম সন্তানগণ এই ফিতরাতের উপরেই জন্মলাভ করে। এরপর যে কুফরী করে সে নিজেকে পরিবর্তন ও বিকৃত করে। আর যে ঈমান আনে এবং সত্যতার ঘোষণা দেয় সে তার সহজাত ঈমানের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
তিনি তাঁর সৃষ্টির কাউকে কুফরী করতে বাধ্য করেন নি এবং ঈমান আনতেও বাধ্য করেন নি। তিনি কাউকে মুমিনরূপে বা কাফিররূপে সৃষ্টি করেন নি। তিনি তাদেরকে ব্যক্তিরূপে সৃষ্টি করেছেন। ঈমান ও কুফর বান্দাদের কর্ম। কাফিরকে আল্লাহ তার কুফরী অবস্থায় কাফির হিসেবেই জানেন। যখন সে এরপর ঈমান আনয়ন করে তখন আল্লাহ তাকে তার ঈমানের অবস্থায় মুমিন হিসেবে জানেন এবং ভালবাসেন। আর এতে আল্লাহর জ্ঞান ও বিশেষণে কোনো পরিবর্তন হয় না।
বান্দাদের সকল কর্ম ও নিষ্কর্মতা- অবস্থান ও সঞ্চলন সবই প্রকৃত অর্থেই তাদের উপার্জন, আল্লাহ তা‘আলা সে সবের স্রষ্টা। এ সবই তাঁর ইচ্ছায়, জ্ঞানে, ফয়সালায় ও নির্ধারণে। আল্লাহর আনুগত্যের সকল কর্ম আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে জরুরী এবং তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি, জ্ঞান, ইচ্ছা, ফয়সালা ও নির্ধারণ অনুসারে। সকল পাপকর্ম আল্লাহর জ্ঞান, ফয়সালা, নির্ধারণ ও ইচ্ছার মধ্যে সংঘটিত, তবে তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সংঘটিত নয়।
[1] সূরা (৪) নিসা: ১৬৪ আয়াত।
[2] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ২২ আয়াত।
[4] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৭২ আয়াত।
১. ‘আল-ফিকহুল আকবার’ রচনার প্রেক্ষাপট
তাওহীদ ও শিরকের মূলনীতি উল্লেখ করার পর ইমাম আবূ হানীফা আকীদা বিষয়ক বিভ্রান্তিগুলো খন্ডন শুরু করলেন। বস্ত্তত বিভ্রান্তি দূর করে বিশুদ্ধ আকীদা প্রচারই ‘আল-ফিকহুল আকবার’ রচনার মূল উদ্দেশ্য। আমরা দেখেছি যে, ঈমানের ক্ষেত্রে মুমিনের দায়িত্ব কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা সহজ-সরল অর্থে বিশ্বাস করা ও সাহাবীগণের অনুসরণ করা। ঈমান-আকীদার বিষয়বস্ত্ত যেহেতু অপরিবর্তনীয় সেহেতু এ বিষয়ে ইজতিহাদ বা যুক্তি-কিয়াসের সুযোগ নেই। তবে উম্মাতের মধ্যে আকীদা বিষয়ক নতুন কোনো মত বা বিশ্বাসের উন্মেষ ঘটলে কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবী-তাবিয়ীগণের বিশ্বাস ও বক্তব্যের আলোকে সেগুলির পর্যালোচনা করা ও সঠিক বিশ্বাসের দিক নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব ইমাম, ফকীহ ও আলিমগণের উপর বর্তায়।
এ দায়িত্ব পালনের জন্যই কলম ধরেন ইমাম আযম আবূ হানীফা। তিনি ছিলেন উম্মাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ। তিনি তাঁর ফিকহী মাযহাব নিজে সংকলন করেন নি, কিন্তু আকীদার বিষয়ে তাঁর মাযহাব নিজের হাতে সংকলন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাওহীদ ও শিরক-এর মৌলিক বিষয়ে তেমন কোনো বিভ্রান্তি ইমাম আবূ হানীফার যুগে প্রকাশ পায় নি। এজন্য এ বিষয়টি তিনি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। এরপর তাঁর যুগে প্রকাশিত বিভ্রান্তিগুলোর ক্ষেত্রে সঠিক আকীদা বর্ণনা শুরু করলেন।
ইমাম আবূ হানীফার যুগে, অর্থাৎ হিজরী প্রথম শতকের শেষ ভাগ থেকে দ্বিতীয় শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময়ে মুসলিম সমাজে ইসলামী আকীদা বিষয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তির উন্মেষ ঘটে। এ সময়ে বিদ্যমান আকীদা ভিত্তিক দল-উপদলের মধ্যে অন্যতম ছিল: (১) খারিজী, (২) শীয়া, (৩) জাহমিয়া, (৪) জাবারিয়া, (৫) কাদারিয়া, (৬) মুতাযিলা, (৬) মুশাবিবহা ও (৭) মুরজিয়া ফিরকা। ইসলামী বিশ্বাস বিষয়ক প্রথম বিভ্রান্তির উন্মেষ ঘটে আলী (রা)-এর সময়ে (৩৫-৪০ হি)। এ সময়ে খারিজী ও শীয়া দুটি দলের উৎপত্তি ঘটে। এ দুটি ফিরকা ছিল মূলত রাজনৈতিক। এরপর প্রথম হিজরী শতকের শেষভাগ ও দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমাংশে অবশিষ্ট বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর জন্ম হয়। এদের বিভ্রান্তি মূলত দার্শনিক মতবাদ নির্ভর এবং আল্লাহর বিশেষণাদি (attribute) কেন্দ্রিক। রাজনৈতিক ও দার্শনিক সকল ফিরকার বিভ্রান্তির মূল কারণ ‘‘আকীদার উৎস’’ নির্ধারণে বিভ্রান্তি। এজন্য এ সকল ফিরকার বিভ্রান্তি অপনোদনে ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করার পূর্বশর্ত হিসেবে আমরা ইসলামী আকীদার ভিত্তি ও উৎস বিষয়টি পর্যালোচনা করতে চাই।
২. আকীদার উৎস / ২. ১. আকীদার উৎস ওহী
২. ১. আকীদার উৎস ওহী
বস্ত্তত আকীদা বিষয়ক সকল বিভক্তি ও বিভ্রান্তির মূল কারণ ‘‘আকীদা’’ বা ‘‘বিশ্বাস’’-এর উৎস নির্ধারণে বিভ্রান্তি, অস্পষ্টতা বা মতভেদ। এজন্য মোল্লা আলী কারী ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় আকীদা বা তাওহীদ-জ্ঞানের উৎস প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, যা আমরা একটু পরে উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ।
সাহাবীগণ, তাঁদের অনুসারী তাবিয়ীগণ, চার ইমাম ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে আকীদার একমাত্র উৎস ওহী। কারণ আকীদা বা বিশ্বাস অদৃশ্যের সাথে সম্পৃক্ত। আর অদৃশ্য বিষয়ে চূড়ান্ত ও সঠিক সত্য শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত ওহীর মাধ্যমেই জানা যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি দু প্রকারের ওহী প্রেরিত হয়েছে এবং দু ভাবে সংরক্ষিত হয়েছে: কিতাব বা কুরআন ও হিকমাহ বা হাদীস।[1]
[1] দেখুন: সূরা (২) বাকারা: ১২৯, ১৫১, ২৩১ আয়াত; সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৬৪ আয়াত; সূরা (৪) নিসা: ১১৩ আয়াত; সূরা (৩৩) আহযাব: ৩৪ আয়াত; সূরা (৬২) জুমুআ: ২ আয়াত।
২. ১. ১. কুরআন মাজীদ
কুরআন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে আক্ষরিকভাবে সেভাবেই তিনি ও সাহাবীগণ মুখস্থ করেছেন, প্রতিদিন সালাতে পাঠ করেছেন, রাতের সালাতে এবং নিয়মিত তিলাওয়াতে খতম করেছেন। এভাবে সাহাবীগণের যুগ থেকে অগণিত অসংখ্য মুসলিম কুরআন মুখস্থ ও তিলাওয়াতের মাধ্যমে সংরÿণ করেছেন। কুরআনই ঈমান, বিশ্বাস বা আকীদার মূল ভিত্তি।
আমরা পরবর্তীতে দেখব যে, কুরআনের বিষয়ে সাহাবী-তাবিয়ী ও তাঁদের অনুসারী আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি দুটি: (১) কুরআনের বক্তব্য সরল ও বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করা। কোনোরূপ ঘোরপ্যঁাচ বা তাফসীর-ব্যাখ্যার নামে আক্ষরিক ও সরল অর্থ পরিত্যাগ না করা। (২) কুরআনের সকল বক্তব্য সমানভাবে গ্রহণ ও বিশ্বাস করা। একটি বক্তব্যের অজুহাতে অন্য বক্তব্যকে ব্যাখ্যার নামে অর্থহীন না করা। বরং দুটি বক্তব্যই যথাসম্ভব সরল ও আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা। শীয়া, খারিজী, মুতাযিলী ও অন্যান্য সম্প্রদায় এক্ষেত্রে তাফসীরের নামে সরল অর্থ ত্যাগ করেছে এবং একটি বক্তব্যের অজুহাতে অন্য বক্তব্য বাতিল করেছে।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্য মূলনীতি কুরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুধাবনের ক্ষেত্রে সমস্যা হলে সাহাবীগণের অনুসরণ করা। তাঁরা যা বলেন নি তা আকীদার মধ্যে সংযোজন না করা।
২. ১. ২. সহীহ হাদীস
দ্বিতীয় প্রকারের ওহী ‘‘আল-হিকমাহ’’ বা প্রজ্ঞা। কুরআনের ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে যে শিক্ষা, তথ্য ও জ্ঞান প্রদান করেন তিনি তা নিজের ভাষায় সাহাবীগণকে শিক্ষা দেন। তাঁর এ শিক্ষা ‘‘হাদীস’’ নামে সংকলিত হয়েছে। হাদীসই ইসলামী আকীদার দ্বিতীয় ভিত্তি ও উৎস।
সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যে কথা বা হাদীস শুনতেন তা অন্যদেরকে শোনাতেন। কেউ তা লিখে রাখতেন এবং কেউ মনে রাখতেন এবং প্রয়োজনে বলতেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিমগণ সাহাবীগণ থেকে হাদীস শিখতেন এবং লিপিবদ্ধ করতেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরু থেকে হাদীস গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়।
হাদীসের বিষয়ে সাহাবীগণ ও পরবর্তী ইমামগণের মুলনীতি হাদীস নামে প্রচারিত বক্তব্য গ্রহণের আগে যাচাই করা। কেবলমাত্র ‘‘সহীহ’’ হাদীস গ্রহণ করা। অনির্ভরযোগ্য হাদীস বর্জন করা এবং হাদীসের নামে জালিয়াতির সর্বাত্মক বিরোধিতা করা। দুর্বল বা জাল হাদীস নিজেদের মতের পক্ষে হলেও তা বর্জন করে তার জালিয়াতি বা দুর্বলতা বর্ণনা করা এবং সহীহ হাদীস নিজেদের মতের বিরুদ্ধে হলেও তার বিশুদ্ধতা স্বীকার করে তার আলোকে নিজেদের মত সংশোধন ও সমন্বয় করা। সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ এবং চার ইমাম এ বিষয়ে অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন। ইমাম আযমের কিছু বক্তব্য আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। পাশাপাশি তাদের মূলনীতি হলো, সহীহ হাদীস বাহ্যিক ও সরল অর্থে গ্রহণ করা, ব্যাখ্যার নামে বিকৃত না করা এবং সকল সহীহ হাদীস যথাসম্ভব সমন্বিতভাবে গ্রহণ করা।
খারিজী, শীয়া, মুতাযিলা ও অন্যান্য গোষ্ঠী হাদীস বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি ও বৈপরীত্যের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। সেগুলির অন্যতম:
(১) হাদীস গ্রহণ না করা। শীয়াগণের মতে সাহাবীগণ বিশ্বস্ত ছিলেন না (নাউযূ বিল্লাহ); কাজেই তাঁদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। মুতাযিলীগণ হাদীসের বর্ণনায় ভুল থাকতে পারে অজুহাতে, কুরআন দিয়ে অথবা বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে হাদীস যাচাইয়ের নামে হাদীস প্রত্যাখ্যান করে।
(২) সনদ যাচাই নয়, বরং পছন্দ অনুসারে হাদীস গ্রহণ করা। তারা বিশুদ্ধতা যাচাই করে হাদীস গ্রহণ করেন না। বরং যে হাদীস তাদের মতের পক্ষে তা তারা গ্রহণ করেন ও প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। আর যে হাদীস তাদের মতের বিপক্ষে তা নানা অজুহাতে অগ্রহণযোগ্য বলে দাবি করেন।
(৩) হাদীসের নামে মিথ্যা বলা বা জাল হাদীস প্রচার ও গ্রহণ করা। এ বিষয়ে শীয়াগণ অগ্রগামী ছিলেন। এছাড়া ‘‘আহলুস সুন্নাত’’ নামে পরিচয় দানকারী ‘‘কার্রামিয়া’’ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ও নিজেদের মতের পক্ষে হাদীস জাল করা ও জাল হাদীস প্রচার করায় অগ্রণী ছিলেন। উপরন্তু আহলুস সুন্নাতের ইমামগণ যখন সনদ-বিচার করে সেগুলোর জালিয়াতি উদ্ঘাটন করতেন তখন তারা সনদ-প্রমাণের দিকে না যেয়ে তাঁদেরকে ‘নবীর (ﷺ) দুশমন’, ‘‘আলী-বংশের শত্রু’’, ‘‘এযিদের দালাল’’ ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করতেন। এভাবে তারা সরলপ্রাণ সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে তাদের জালিয়াতির গ্রহণযোগ্যতা ও মুহাদ্দিসগণের যাচাইয়ের প্রতি বিরূপ মানসিকতা তৈরি করতেন। অন্যান্য ফিরকা নিজেরা জালিয়াতির ক্ষেত্রে অতটা অগ্রসর না হলেও নিজেদের পক্ষের জাল হাদীস গ্রহণ ও প্রচার করতেন।
(৪) ব্যাখ্যার নামে সরল অর্থ বিকৃত করা। হাদীসের ক্ষেত্রেও ব্যাখ্যার নামে হাদীসের সরল অর্থ বিকৃত করা এ সকল বিভ্রান্ত গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য।
২. ১. ৩. মুতাওয়াতির ও আহাদ হাদীস
যে হাদীস সাহাবীগণের যুগ থেকেই বহু সনদে বর্ণিত তাকে ‘‘মুতাওয়াতির’’ (recurrent; frequent) বা বহুমুখে বর্ণিত হাদীস বলা হয়। মূলত কুরআনের পাশাপাশি এরূপ হাদীসই আকীদার ভিত্তি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে বিশুদ্ধতম আকীদা ও আমল শিখিয়ে গিয়েছেন। আমলের ক্ষেত্রে বিকল্প আছে। সব মুসলিমের উপর ফরয কিছু কাজ ব্যতীত বিভিন্ন ফযীলতমূলক নেক কর্ম একটি না করলে অন্যটি করা যায়। কিন্তু আকীদার ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প নেই। আকীদা সবার জন্য একই রূপে সর্বপ্রথম ফরয। যে বিষয়টি বিশ্বাস করা মুমিনের জন্য প্রয়োজন সে বিষয়টি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সকল সাহাবীকে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষাতে জানিয়েছেন এবং সাহাবীগণও এভাবে তাবিয়ীগণকে জানিয়েছেন। এতে আমরা বুঝতে পারি যে, আকীদার বিষয় সুস্পষ্টভাবে কুরআনে অথবা মুতাওয়াতির হাদীসে বর্ণিত।
দু-একজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীসকে ‘আহাদ’ বা ‘‘খাবারুল ওয়াহিদ’’ অর্থাৎ একক হাদীস বলা হয়। ইমাম আবূ হানীফাসহ প্রথম দু শতাব্দীর সকল ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে ‘মুতাওয়াতির’ ও ‘আহাদ’ উভয় প্রকার সহীহ হাদীসই আকীদার ভিত্তি ও উৎস হিসেবে গৃহীত। এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার একাধিক বক্তব্য আমরা দেখেছি এবং আরো দেখব। এক্ষেত্রে পার্থক্য হলো, মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয় অস্বীকার করলে তা কুফর বলে গণ্য আর ‘আহাদ’ পর্যায়ের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয় অস্বীকার করা বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা বলে গণ্য করা হয়।
২. ২. ওহী অনুধাবনে সাহাবী-তাবিয়ীগণের ঐকমত্য
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে কুরআনে ও হাদীসে যা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে তা সরলভাবে বিশ্বাস করা ইসলামী আকীদার মূল ভিত্তি। কুরআন ও হাদীসের বাণী অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (ﷺ) শিক্ষার মধ্যে কোনো জটিলতা, গোপনীয়তা বা স্ববিরোধিতা নেই। তারপরও কখনো জ্ঞানের দুর্বলতার কারণে কুরআন-হাদীস অনুধাবন বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য বা দ্বিধা সৃষ্টি হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ এবং পরবর্তী দু প্রজন্ম ‘তাবিয়ী’ ও ‘তাবি-তাবিয়ীগণের’ ব্যাখ্যা ও মতামতই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। বিশেষত তাঁদের ইজমা বা ঐকমত্য আকীদার প্রমাণ হিসেবে গণ্য। কুরআন ও হাদীসই তাঁদের বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছে। আমরা পরবর্তী আলোচনায় এ বিষয়ক কিছু আয়াত ও হাদীস দেখব, ইনশা আল্লাহ।
মুসলিম সমাজের প্রথম বিভ্রান্ত ফিরকা ‘‘খারিজীগণ’’ কুরআন ও হাদীসকে ইসলামী শরীয়ত ও আকীদার উৎস বলে স্বীকার করত। তাদের বিভ্রান্তির শুরু ‘‘জ্ঞানের অহঙ্কার’’ থেকে। ওহী অনুধাবনের জন্য সাহাবীগণের মতামত ও ব্যাখ্যার গুরুত্ব তারা অস্বীকার করত। এছাড়া ‘‘সুন্নাত’’-এর গুরুত্বও অস্বীকার করত। অর্থাৎ তাঁরা কুরআনের আয়াত বা হাদীস দিয়ে যে মতটি গ্রহণ করছে সে মত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কর্মধারা বা রীতির মধ্যে বা প্রায়োগিক সুন্নাতের মধ্যে আছে কিনা তা বিবেচনা করত না। সর্বোপরি তারা কুরআন ও হাদীসের কিছু বক্তব্যের ভিত্তিতে নিজেদের মত গ্রহণ করত। এর বিপরীতে কুরআন-হাদীসের অন্যান্য বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দিত। এভাবে আমরা দেখছি যে, খারিজীগণের বিভ্রান্তির উৎস (১) সুন্নাতের গুরুত্ব অস্বীকার, (২) সাহাবীগণের মতামত অস্বীকার ও (৩) ‘‘পছন্দ’’ অনুসারে কুরআন-হাদীসের কিছু বক্তব্য গ্রহণ ও কিছু ব্যাখ্যার নামে বাতিল করা।
২. ৩. ওহী বহির্ভূত ঐশিক-অলৌকিক জ্ঞান
মুসলিম সমাজের দ্বিতীয় ফিরকা ‘‘শীয়া’’। সাহাবীগণ বর্ণিত হাদীস তারা অস্বীকার করে। তাদের ইমামগণের নামে অগণিত জাল ও মিথ্যা কথা হাদীস নামে তাদের মধ্যে প্রচলিত। তাদের অনেকে কুরআনকেও অস্বীকার করে এবং বিকৃত বলে দাবি করে। তবে স্বীকার বা অস্বীকার এখানে মূল্যহীন। তাদের বিভ্রান্তির মূল কারণ কুরআন-সুন্নাহর বাইরে ‘‘আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান’’ গ্রহণের পথ আছে বলে বিশ্বাস করা। তাদের বিশ্বাসে ঈমান, আকীদা ও দীনের একমাত্র ভিত্তি আলী-বংশের ইমামগণ ও তাঁদের ‘খলীফা’ বা ‘ওলী’-গণের ‘গাইবী’ জ্ঞান। তারা এ গাইবী জ্ঞানকে ‘ওহী’, ‘ইলম লাদুন্নী’, ‘ইলহাম’, ‘ইলম বাতিন’, ‘কাশফ’, ‘ইলকা’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করত ও করে। তাদের মতে ইমামগণ, তাঁদের খলীফাগণ বা ওলীগণ আল্লাহর কাছ থেকে এভাবে যে ‘‘ঐশিক’’ বা ‘‘অলৌকিক’’ জ্ঞান লাভ করেন তা-ই আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তি। কুরআন-হাদীস সঠিকভাবে অনুধাবনের ক্ষমতাও তাঁদেরই আছে। তাঁরা মাসূম বা অভ্রান্ত, অর্থাৎ দীন বুঝার ক্ষেত্রে তাদের ভুল হতে পারে না। কুরআন-হাদীসের বক্তব্য গ্রহণ, বর্জন বা ব্যাখ্যা করতে হবে তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে।
ইসলামের প্রথম বরকতময় তিন শতাব্দীর পরে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শীয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ও সাধারণ ‘‘সুন্নী’’ মুসলিমগণও বিভিন্ন শীয়া আকীদা দ্বারা প্রভাবিত হন। এজন্য আমরা দেখি যে, শীয়াগণ ও শীয়াগণের দ্বারা প্রভাবিত অগণিত ‘‘সুন্নী’’ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভিন্ন গালভরা উপাধিতে ভুষিত করে বিভিন্ন বুজুর্গকে অভ্রান্ত বলে দাবি করে ‘‘শিরক ফিন-নুবুওয়াত’’ বা ‘নুবুওয়াতে শিরকের’’ মধ্যে নিপতিত হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের পছন্দমত বিভিন্ন বুজুর্গের নামে গাওস, কুতুব, ইমাম, মুজাদ্দিদ... ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার করে তাদেরকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (ﷺ) থেকে সরাসরি ‘‘ঐশী’’ বা অভ্রান্ত ইলম-প্রাপ্ত বলে দাবি করেছেন। উল্লেখ্য যে, গাওস, কুতুব ইত্যাদি কোনো উপাধি কুরআন-হাদীসে ব্যবহৃত হয় নি। ‘ইমাম’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব। উম্মাতের মধ্যে মুজাদ্দিদগণ থাকবেন। তবে কে মুজাদ্দিদ তা নিশ্চিতভাবে কেউই জানেন না। কাউকে মুজাদ্দিদ বলে চিহ্নিত করা একান্তই আন্দায ও অনুমান মাত্র। আর মুজাদ্দিদ দাবিতে কাউকে নির্ভুল মনে করা, মুজাদ্দিদকে ইলহাম বা কাশফ-সম্পন্ন হতে হবে বলে মনে করা বা কাউকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে তার মতামতকে দলীলের মান দেওয়া সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি।[1]
বস্ত্তত কুরআন ও হাদীসের পরে অন্য কিছুকে ভুলের ঊর্ধ্বে বা চূড়ান্ত বলে গণ্য করা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে অন্য কাউকে ভুলের ঊর্ধ্বে বলে গণ্য করা এবং কাশফ, ইলকা, স্বপ্ন ইত্যাদিকে ‘কারামত’ বা ব্যক্তিগত সম্মাননার পর্যায় থেকে বের করে ঈমান, আকীদা বা দীনের হক্ক-বাতিল নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা আকীদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। ইমামগণ এরূপ প্রবণতার ঘোর আপত্তি করেছেন। ইমাম মালিক (রাহ) বলেন:
كُلُّ أَحَدٍ يُؤْخَذُ مِنْ قَوْلِهِ وَيُتْرَكُ إِلاَّ صَاحِبَ هَذَا الْقَبْرِ
ﷺ.
‘‘এ কবরে যিনি শায়িত আছেন-রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাড়া অন্য সকল মানুষের ক্ষেত্রেই তার কিছু কথা গ্রহণ ও কিছু কথা বর্জন করতে হয়।।’’[2]
এজন্য আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে কোনো ব্যক্তির নিষ্পাপত্ব, অভ্রান্ততা বা বিশেষ জ্ঞানে বিশ্বাস না করা। তাঁরা কাশফ, ইল্হাম, ইত্যাদির অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন এবং এগুলিকে ব্যক্তি মুমিনের জন্য ‘কারামত’ ও নিয়ামত বলে গণ্য করেন। কিন্তু এগুলোকে আকীদার ভিত্তি বা কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন না। কোনো আলিম-বজুর্গই ‘মাসূম’ বা অভ্রান্ততার পদমর্যাদা পাবেন না। তার অনেক সঠিক মতের পাশাপাশি কিছু ভুল মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক ও সুনিশ্চিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করা হয় না, কুরআন-সুন্নাহ দিয়ে বিচার করে গ্রহণ করতে হয়। কারো কথা দিয়ে কুরআন বা সুন্নাহ বিচার করা যায় না বরং কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে প্রত্যেকের কথা বিচার করতে হয়।
আল্লামা উমর ইবন মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭ হি) ‘‘আল-আকাইদ আন-নাসাফিয়্যাহ’’ ও আল্লামা সা’দ উদ্দীন মাসঊদ ইবন উমর তাফতাযানী (৭৯১হি) ‘‘শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ’’-তে লিখেছেন:
اَلإِلْهَامُ الْمُفَسَّرُ بِإِلْقَاءِ مَعْنًى فِيْ الْقَلْبِ بِطَرِيْقِ
الْفَيْضِ لَيْسَ مِنْ أَسْبَابِ الْمَعْرِفَةِ بِصِحَّةِ الشَّيْءِ عِنْدَ أَهْلِ
الْحَقِّ.
‘‘হক্কপন্থীগণের নিকট ইলহাম বা ইলকা-ফয়েজ কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার কোনো মাধ্যম নয়।’’[3]
[1] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ফুরফুরার পীর আল্লামা আবু জাফর সিদ্দিকী রচিত আল-মাউযূআত: একটি বিশেস্নষণাত্মক পর্যালোচনা, পৃ. ৪৭-৫৮।
[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৮/৯৩।
[3] তাফতাযানী, সাদ উদ্দীন, শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, পৃ: ২২।
২. ৪. আকলী দলীল বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও দর্শন
জাহমিয়া, মুতাযিলা ও অন্যান্য ফিরকার বিভ্রান্তির কারণ ছিল ‘আকলী দলীল’, অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক যুক্তি-প্রমাণকে ওহীর উপরে স্থান দেওয়া। তাদের মতে আকীদার সত্য জানার জন্য ‘আকল’ই সুনিশ্চিত পথ। ‘আকলী দলীল’-এর নির্দেশনা ‘একীনী’ অর্থাৎ ‘সুনিশ্চিত’। পক্ষান্তরে ‘নকলী দলীল’ বা কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা ‘যান্নী’, অর্থাৎ ‘অস্পষ্ট’ বা ‘ধারণা প্রদানকারী’। ওহীর নির্দেশনা ‘আকলসম্মত’ হলে তা গ্রহণ করতে হবে। আর তা আকলসম্মত না হলে ব্যাখ্যা করে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
ইসলাম ‘আকল’, ‘আকলী দলীল’ ও যৌক্তিকতাকে গুরুত্ব প্রদান করেছে। কখনোই ধর্মের নামে মানবীয় জ্ঞান, যুক্তি বা ‘আকলী দলীলের’ সাথে সাংঘর্ষিক কিছু বিশ্বাস করতে শেখানো হয় নি। ‘আহলুস সুন্নাত’ ‘আকল’-এর গুরুত্ব স্বীকার করেন। কিন্তু আকীদা প্রমাণের ক্ষেত্রে আকলী দলীলকে ওহীর ঊর্ধ্বে স্থান দেন না। মানবীয় প্রকৃতি ও সহজাত অনুভূতির নিকট গ্রহণযোগ্য ও বুদ্ধিগ্রাহ্য ওহী নির্দেশিত বিশ্বাসকে ‘আকলী দলীলের’ নামে প্রত্যাখ্যানের নিন্দা করেন তাঁরা। মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি আল্লাহর অন্যতম নিয়ামত। আল্লাহ মানুষকে এ নিয়ামত দিয়েই সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন। যেহেতু আকল ও ওহী দুটিই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত নিয়ামত সেহেতু এ দুয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য থাকতে পারে না। তবে এ দুয়ের বিচরণ ক্ষেত্র পৃথক। গাইবী বিষয়ে ‘আকলী দলীল’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে অক্ষম। এক্ষেত্রে ওহীই নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে।
ওহীপ্রাপ্ত জাতিগুলোর বিভ্রান্তির বড় কারণ ওহীর বিপরীতে ‘আকলী দলীল’ বা ‘দার্শনিক যুক্তি’ পেশ করা। প্রচলিত খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সাধু পল ও তার অনুসারীগণ ত্রিত্ববাদ, যীশুর ঈশ্বরত্ব, মহান আল্লাহর মানবীয় দেহধারণ, আদিপাপ, প্রায়শ্চিত্ববাদ ইত্যাদি ওহী বিরোধী ও ঈসা মাসীহের বক্তব্য বিরোধী বিশ্বাসগুলোর পক্ষে ‘আকলী দলীল’ নামে যে সকল দলীল প্রদান করেছেন সেগুলো পর্যালোচনা করলে যে কেউ বুঝবেন যে, কত উদ্ভট কথা ‘আকলী দলীল’ নামে অগণিত আদম সমত্মান গ্রহণ করছেন।
সর্বোপরি, মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত। একজনের কাছে যা যৌক্তিক বা ‘নিশ্চিত আকলী দলীল’ অন্যের কাছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও জ্ঞান-বিরুদ্ধ। আবার একই ব্যক্তির বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেয়। দেবতার জন্য নরবলি প্রদানের পক্ষে অনেকে ‘আকলী দলীল’ প্রদান করছেন। আবার মানুষের জন্য মাংস ভক্ষণকে অনেকে মানবতা বিরোধী বলে ‘আকলী দলীল’ পেশ করছেন।
ধর্মের নামে যদি বলা হয় স্রষ্টা জন্ম, বর্ণ বা বংশের কারণে তাঁর কোনো সৃষ্টিকে ঘৃণা বা হেয় করেন, তিনি মানুষের বেশ ধরে পৃথিবীতে আসেন, তিনি একজনের পাপে অন্যজনকে শাস্তি দেন ... তবে তা ‘ওহী’ নয় বলে প্রমাণিত হবে। কারণ এ সকল বিষয় সহজাত বিবেকে ও জ্ঞানবুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক। পক্ষান্তরে যদি বলা হয় যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল-করুণাময় এবং তিনি ন্যায়বিচারক-শাস্তিদাতা তবে উভয় বিষয়ই মানবীয় বিবেকসম্মত ও যৌক্তিক। আকীদা বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর সকল নির্দেশনাই এরূপ মানবীয় বিবেকসম্মত ও বুদ্ধিগ্রাহ্য। এরূপ বিষয়ে যদি কেউ নিজের বুদ্ধি দিয়ে উভয় বিশেষণের মধ্যে বৈপরীত্য অনুভব করেন এবং বিভিন্ন যুক্তি বা দর্শন নির্ভর বক্তব্যকে ‘আকলী দলীল’ নাম দিয়ে ওহীর শিক্ষা বাতিল বা ব্যাখ্যা করেন তবে তা বিভ্রান্তি।
২. ৫. ওহী বনাম ওহীর ব্যাখ্যা
কোনো বক্তব্যের ব্যাখ্যা দু পর্যায়ের হতে পারে: (১) বাহ্যিক ও সরল অর্থ এবং (২) বাহ্যিক অর্থের ব্যতিক্রম বা অতিরিক্ত কোনো অর্থ যা বাহ্যিক অর্থ থেকে বুঝা যায় না। প্রথম পর্যায়ের ব্যাখ্যা মূলত ওহীরই অর্থ। দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাখ্যা ওহী অনুধাবনের বিভিন্ন ব্যক্তির মত। আমরা ব্যাখ্যা বলতে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাখ্যা বুঝাচ্ছি। বিভ্রান্ত সকল গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ওহীর এরূপ ব্যাখ্যাকে ওহীর সমতূল্য মনে করা। তাদের আকীদার ভিত্তিই ‘‘তাফসীর’’। একটি নমুনা দেখুন। আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا الَّذِينَ
يُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ
‘‘তোমাদের অভিভাবক-বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান গ্রহণ করেছে, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং তারা রুকু-রত।’’[1]
ইবন আব্বাস (রা), আলী (রা), আম্মার (রা), মুজাহিদ ইবন জাব্র প্রমুখ সাহাবী ও তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াতটি আলী (রা)-এর সম্পর্কে অবতীর্ণ। এ বিষয়ক বর্ণনাগুলোর অধিকাংশ সনদ অত্যন্ত দুর্বল। এ বর্ণনাগুলোর সার সংক্ষেপ এই যে, একজন ভিক্ষুক মসজিদের মধ্যে ভিক্ষা চান। কেউ তাকে কোনো ভিক্ষা প্রদান করেন না। আলী (রা) তখন মসজিদের মধ্যে নফল সালাত আদায়ে রত ছিলেন। তিনি এ সময় রুকুরত অবস্থায় ছিলেন। এ অবস্থাতেই তিনি ইশারায় ভিক্ষুককে ডাকেন এবং নিজের হাতের আংটি খুলে ভিক্ষুককে প্রদান করেন। ভিক্ষুক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে বিষয়টি জানান। তখন মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আয়াতটি পাঠ করে বলেন, ‘‘আমি যার বন্ধু আলীও তার বন্ধু। হে আল্লাহ, আলীকে যে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে তাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন এবং আলীর সাথে যে শত্রুতা করে আপনি তার সাথে শত্রুতা করুন।’’[2]
এ শানে নুযূল ও তাফসীরকে শীয়াগণ তাদের আকীদার ভিত্তি বানিয়েছেন। তারা বলেন, এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, আলীকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা বা তাঁর দলভুক্ত হওয়া ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই সাহাবীগণ ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সকল মুসলিমই আল্লাহর দুশমন। আলীকে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রদান না করে, তাঁর বিরোধিতা করে বা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আবূ বকর, উমার, উসমান, মুআবিয়া (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবী আল্লাহর দুশমন হয়েছেন। আর তাঁদের সমর্থকগণও আল্লাহর দুশমন। তাঁরা সকলেই কুরআনের নির্দেশ অস্বীকার করার কারণে কাফির-মুরতাদ বলে গণ্য (নাউযূ বিল্লাহ!)।
কুরআন ও তাফসীরের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করুন। কুরআনের নির্দেশ: মুমিনদের অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে এবং সালাত কায়েমকারী ও যাকাত প্রদানকারী মুমিনগণকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আলী (রা) ও সকল সাহাবী ও অন্যান্য মুমিন এর অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে আলী (রা)-এর বিশেষত্ব কুরআন দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং দুর্বল বা ‘আহাদ’ পর্যায়ের হাদীসে বর্ণিত এবং কোনো কোনো মুফাস্সিরের মত। এ সকল মত দ্বারা আলী (রা)-এর মর্যাদা জানা যায়, তবে অন্যান্য সাহাবীর অবমূল্যায়ন জানা যায় না। সর্বোপরি কখনোই বিষয়টিকে আকীদার অংশ বানানো যায় না। যে কোনোভাবে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (ﷺ) বিরোধিতা বা বিদ্বেষেপোষণ ঈমান বিনষ্টকারী। কিন্তু জাগতিক বা ইজতিহাদী কারণে আলী (রা)-এর বিরোধিতা করা তদ্রূপ নয়। কিন্তু শীয়াগণ তাফসীরকে বিশ্বাসের ভিত্তি বানিয়েছেন। আমরা দেখব যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আলী-বংশের ইমামগণের নূর (আলো) থেকে সৃষ্টি, তাদের গাইবী ইলম ইতাদি আকীদার ক্ষেত্রেও শীয়াগণ এরূপ তাফসীরের উপরেই নির্ভর করেন।
[1] সূরা (৫) মায়িদা: ৫৫ আয়াত।
[2] তাবারী, তাফসীর ৬/২৮৮-২৮৯; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৭২।
২. ৬. পছন্দ-নির্ভরতা ও অপব্যাখ্যা
বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর বৈশিষ্ট্য কুরআন-হাদীসের যে বক্তব্য তাদের মত বা পছন্দের সাথে মিলে তা গ্রহণ করা এবং অন্য সকল বক্তব্যের সরল অর্থ অপব্যাখ্যা করে বাতিল করা। পূর্ববর্তী উম্মাতগুলোর বিভ্রান্তিরও অন্যতম কারণ ছিল এ পছন্দ নির্ভরতা, যাকে কুরআনে ‘হাওয়া’ (الهوى) (love; liking, bias) বলা হয়েছে।
২. ৭. আকীদার উৎস বিষয়ে ইমাম আযমের মত
ফিকহ, আকীদা ও দীনের সকল বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর নির্ভরতার বিষয়ে ইমাম আযমের কিছু বক্তব্য আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। আমরা দেখেছি, ইমাম ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (১৫৮-২৩৩ হি) তাঁর সনদে ইমাম আবূ হানীফার নিম্নের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন:
‘‘আমি আল্লাহর কিতাবের উপর নির্ভর করি। আল্লাহর কিতাবে যা না পাই সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত ও নির্ভরযোগ্য রাবীদের সূত্রে নির্ভরযোগ্য রাবীদের থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসগুলোর উপর নির্ভর করি। কিতাব ও সুন্নাতে যা না পাই সে বিষয়ে সাহাবীগণের বক্তব্যের উপর নির্ভর করি। তাঁদের মধ্য থেকে যার মত ইচ্ছা গ্রহণ করি এবং যার মত ইচ্ছা বাদ দেই, তবে তাঁদের মত ছেড়ে অন্য কারো কথার দিকে যাই না। আর যখন বিষয়টি ইবরাহীম নাখয়ী, শা’বী, ইবন সীরীন, হাসান বসরী... পর্যায়ে আসে তখন তাঁরা যেমন ইজতিহাদ করেছেন আমিও তেমন ইজতিহাদ করি।’’[1]
এখানে ইমাম আবূ হানীফা কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করেছেন:
প্রথমত: দীনের মূল ভিত্তি কুরআন ও হাদীসের উপর। কুরআনে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট রয়েছে তা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। কুরআনে কোনো বিষয় সুস্পষ্ট না থাকলে হাদীসে তা অনুসন্ধান করতে হবে। কুরআন ও হাদীসের বিদ্যমান কোনো নির্দেশনার বিষয়ে অন্য কোনো ব্যক্তির বক্তব্য, ব্যাখ্যা বা ইজতিহাদ গ্রহণ করার সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়ত: হাদীসের ক্ষেত্রে রাবীদের নির্ভরযোগ্যতা ও সনদের পরম্পরার মাধ্যমে হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই করে গ্রহণ করা জরুরী।
তৃতীয়ত: ওহী বা কুরআন-হাদীসের পরেই ‘রিজালুল ওহী’ বা ‘রিজালুল্লাহ’ বা ‘ওহীর মানুষ’: সাহাবীগণ। কুরআনে তাঁদের সঠিক অনুসরণকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের পথ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[2] কাজেই তাঁদের মতের বাইরে যাওয়া মুমিনের জন্য বৈধ নয়। কুরআন-হাদীসে যে সকল বিষয় নেই সে সকল বিষয়ে এবং কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যার বিষয়ে তাঁদের ইজমা বা ঐকমত্য অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তাঁদের মতভেদ থাকলে তাঁদের মতের মধ্যেই থাকতে হবে; নতুন কোনো মত গ্রহণ করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে ইমাম আযমের ছাত্র ইমাম হাসান ইবন যিয়াদ লুলুয়ী (২০৪ হি) বলেন, ইমাম আবূ হানীফা বলতেন:
ليس لأحد أن يقول برأيه مع نص عن كتاب الله أو سنة عن رسول الله أو إجماع عن الأمة
وإذا اختلف الصحابة على أقوال نختار منها ما هو أقرب الى الكتاب أو السنه ونجتنب
عما جاوز ذلك
‘‘আল্লাহর কিতাবে অথবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতে কোনো বক্তব্য থাকলে অথবা উম্মাতের ইজমা বিদ্যমান থাকলে সে বিষয়ে কিয়াস বা ইজতিহাদ দ্বারা কথা বলার অধিকার কারো নেই। আর যদি সাহাবীগণ মতভেদ করেন তবে আমরা তাঁদের মতগুলোর মধ্য থেকে কুরআন অথবা সুন্নাতের অধিক নিকটবর্তী বক্তব্যটি গ্রহণ করি এবং এর ব্যতিক্রম সব কিছু পরিত্যাগ করি।’’[3]
চতুর্থত: সাহাবীগণের পর আর কারো এরূপ মর্যাদা নেই। তাবিয়ীগণ ও পরবর্তী সকল আলিমের মত বিচার ও যাচাই পূর্বক গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন:
ما جاء عن الله ورسوله لا نتجاوز عنه وما اختلف فيه الصحابة أخترناه وما جاء عن
غيرهم أخذنا وتركنا
‘‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) থেকে যা বর্ণিত তার বাইরে আমরা যাই না। যে বিষয়ে সাহাবীগণ মতভেদ করেছেন সে বিষয়ে আমরা একটি গ্রহণ করি। আর অন্যদের থেকে যা বর্ণিত তা আমরা গ্রহণ এবং বর্জন করি।’’[4]
হাদীসের ক্ষেত্রে সনদ সহীহ হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন:
إِذَا جَاءَ الْحَدِيْثُ الصَّحِيْحُ الإِسْنَادِ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ أَخَذْنَا
بِهِ وَلَمْ نَعْدُهُ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ সনদে হাদীস পাওয়া গেলে তাঁর উপরেই আমরা নির্ভর করব, তার বাইরে যাব না।’’[5]
আমরা দেখব যে, এ গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন:
وَسَائِرُ عَلاَمَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ عَلَى مَا وَرَدَتْ بِهِ الأَخْبَارُ
الصَّحِيْحَةُ حَقٌّ كَائِنٌ
‘‘কিয়ামতের অন্যান্য সকল পূর্বাভাস, যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই সত্য এবং ঘটবেই।’’[6]
ইমাম আযম খুব স্পষ্ট করে বলেছেন যে, আকীদার ভিত্তি কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীগণের মত। পরবর্তী যুগের নতুন বিষয়গুলো বিদআত। তিনি বলেন:
ما الأمر إلا ما جاء به القرآن، ودعا إليه النبي- صلى الله عليه وسلم -، وكان عليه
أصحابه حتى تفرق الناس. فأما ما سوى ذلك فمبتدَع محدَث.
‘‘বিষয় তো শুধু তাই যা কুরআন নিয়ে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যার দাওয়াত দিয়েছেন এবং মানুষদের দল-ফিরকায় বিভক্ত হওয়ার আগে তাঁর সাহাবীগণ যার উপরে ছিলেন। এগুলো ছাড়া যা কিছু আছে সবই নব-উদ্ভাবিত বিদআত।’’[7]
এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), ইমাম আবূ ইউসূফ (রাহ) ও ইমাম মুহাম্মাদের (রাহ) মত ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম আবূ জাফার তাহাবী (৩২১ হি) বলেন:
وَجَمِيْعُ مَا صَحَّ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ مِنَ الشَّرْعِ وَالبَيَانِ حَقٌّ. ...
وَكُلُّ مَا جَاءَ فِيْ ذَلِكَ مِنَ الْحَدِيْثِ الصَّحِيْحِ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ
ﷺ فَهُوَ كَمَا قَالَ...
‘‘শরয়ী বিধিবিধান এবং ঈমান-আকীদা বিষয়ক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যা কিছু সহীহভাবে বর্ণিত সবই সত্য। ... এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ হাদীসে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই তিনি যেরূপ বলেছেন সেরূপই বিশ্বাস করতে হবে।’’[8]
এভাবে আমরা দেখছি যে, দীনের সকল বিষয়ের ন্যায় আকীদার ক্ষেত্রেও মূল ভিত্তি হলো কুরআন কারীম, সহীহ হাদীস এবং এরপর সাহাবীগণের মত। আকীদা ও ফিকহের মৌলিক পার্থক্য হলো, ফিকহের ক্ষেত্রে ইজতিহাদ, কিয়াস, যুক্তি বা আকলী দলীলের প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু আকীদার ক্ষেত্রে এর কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীগণের অনুসরণই একমাত্র করণীয়। কারণ ফিকহের বিষয়বস্ত্ত পরিবর্তনশীল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা সাহাবীগণের যুগে ছিল না এমন কোনো নতুন বিষয়ে ফিকহী মত জানার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আকীদার বিষয়বস্ত্ত মহান আল্লাহর সত্তা, গুণাবলি, নবী-রাসূলগণ... ইত্যাদি। এগুলো অপরিবর্তনীয়। এক্ষেত্রে মুমিনের একমাত্র দায়িত্ব রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের আকীদা জানা ও মানা। এ বিষয়ে ইমাম আবূ ইউসূফ বলেন:
لَيْسَ التَّوْحِيْدُ بِالْقِيَاسِ.... لأَنَّ الْقِيَاسَ يَكُوْنُ فِيْ شَيْءٍ
لَهُ شِبْهٌ وَمِثْلٌ، فَاللهُ تَعَالَى وَتَقَدَّسَ لاَ شِبْهَ لَهُ وَلاَ مِثْلَ
لَهُ... فَقَدْ أَمَرَكَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ أَنْ تَكُوْنَ تَابِعاً سَامِعاً
مُطِيْعاً وَلَوْ يُوَسَّعُ عَلَى الأُمَّةِ الْتِمَاسُ التَّوْحِيْدِ وَابْتِغَاءُ
الإِيْمَانِ بِرَأْيِهِ وَقِيَاسِهِ وَهَوَاهُ إِذَنْ لَضَلُّوا، أَلَمْ تَسْمَعْ
إِلَى قَوْلِ اللهِ: (وَلَوِ اتَّبَعَ الْحَقُّ أَهْوَاءَهُمْ لَفَسَدَتِ
السَّمَوَاتُ وَالأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ) فَافْهَمْ مَا فُسِّرَ بِهِ ذَلِكَ.
‘‘তাওহীদ বা আকীদা কিয়াস দ্বারা শেখা যায় না। .... কারণ কিয়াস তো চলে এমন বিষয়ে যার তুলনা ও নমুনা আছে। আর মহান মহাপবিত্র আল্লাহর তো কোনো তুলনাও নেই এবং নমুনাও নেই। মহান আল্লাহ তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে তুমি অনুসরণ করবে, শুনবে ও আনুগত্য করবে। যদি উম্মাতকে তাওহীদ সন্ধান ও ঈমান অর্জনের জন্য নিজস্ব মত, কিয়াস ও পছন্দের সুযোগ দেওয়া হয় তবে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। তুমি কি শুন নি? মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘সত্য যদি এদের মতামত-পছন্দের অনুগত হতো তবে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ত আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সকল কিছু।’[9] কাজেই এ আয়াতের তাফসীর ভাল করে হৃদয়ঙ্গম কর।’’[10]
বস্ত্তত কিয়াস, ইজতিহাদ, আলিমগণের মত, যুক্তি ইত্যাদির ক্ষেত্র ইলমুল ফিকহ। গাইব বা আকীদার ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনাকে আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করাই নিরাপত্তার একমাত্র পথ। নিজের পছন্দ, বুদ্ধি বা অন্যের মতের উপর নির্ভর করে ওহীর বক্তব্যের সহজ অর্থকে ব্যাখ্যা করে ঘুরানো বিভ্রান্তির দরজা খুলে দেয়। পরবর্তীতে আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফা এরূপ ব্যাখ্যার কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। সকল ক্ষেত্রে কুরআনের বক্তব্যের স্বাভাবিক আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করতে ও ব্যাখ্যার নামে আক্ষরিক অর্থ বাতিল করতে নিষেধ করেছেন। হানাফী মাযহাবের ইমাম-ত্রয় ও আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি উল্লেখ করে ইমাম তাহাবী বলেন:
لا نَدْخُلُ فِي ذَلِكَ مُتَأَوِّلِينَ بِآرَائِنَا، وَلا مُتَوَهِّمِينَ
بِأَهْوَائِنَا ، فَإِنَّهُ مَا سَلِمَ فِي دِينِهِ إِلا مَنْ سَلَّمَ لِلَّهِ
عَزَّ وَجَلَّ وَلِرَسُولِهِ ﷺ.
‘‘আমরা আমাদের রায়, মত বা ইজতিহাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করে বা আমাদের পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে এ বিষয়ে প্রবেশ করি না। কারণ দীনের বিষয় মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) উপর পরিপূর্ণভাবে ন্যস্ত না করা পর্যন্ত কেউই নিজের দীনকে নিরাপদ করতে পারবে না।’’[11]
এ প্রসঙ্গে মোল্লা আলী কারী হানাফী ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় বলেন: ‘‘আমাদের রবব মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওহীদ বা দীনের ভিত্তির বিষয়ে অমুকের মত, তমুকের অনুভূতি, কারো পছন্দ বা কারো আবেগ-চিন্তার মুখাপেক্ষী করেন নি। (এ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো কিছুরই প্রয়োজন আমাদের নেই।) এজন্য আমরা দেখি যে, যারা কুরআন ও সুন্নাহ-এর ব্যতিক্রম করেছেন তারা মতভেদ ও দ্বিধার মধ্যে নিপতিত হয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন:
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي
وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلامَ دِينًا
‘‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।’’[12]
কাজেই দীনকে পূর্ণ করার জন্য আমাদের কুরআন ও সুন্নাহর বাইরে আর কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। আর আল্লাহ বলেছেন:
أَوَلَمْ يَكْفِهِمْ أَنَّا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ يُتْلَى عَلَيْهِمْ
‘‘তাদের জন্য কি এ-ই যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি যা তাদের উপর পঠিত হয়?’’[13]
আল্লাহ আরো বলেছেন[14]:
وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
‘‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তোমরা তা গ্রহণ করো, আর তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক।’’[15]
আমরা দেখেছি, ইমাম তাহাবী বলেছেন: ‘‘শরীয়ত ও ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহভাবে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই সত্য।’’[16] ইমাম তাহাবীর এ কথার ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবন আবিল ইয্য হানাফী বলেন: ‘‘প্রত্যেক বিদআতী ফিরকার মূলনীতি এই যে, কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যকে তারা তাদের বিদআতের মানদন্ডে অথবা যাকে তারা ‘আকলী’ বা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল’ ও ‘যুক্তি’ বলে কল্পনা করে তার মানদন্ডে বিচার করে। যদি কুরআন-হাদীসের বক্তব্য তাদের বিদআত বা ‘যুক্তি’র সাথে মিলে যায় তবে তারা সে বক্তব্যটিকে ‘মুহকাম’ বা দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট বলে দাবি করে, তা গ্রহণ করে এবং তাকে দলীল হিসেবে পেশ করে। আর কুরআন-হাদীসের যে বক্তব্য তাদের বিদআত বা ‘যুক্তি’-র সাথে না মিলে সে বক্তব্যকে তারা ‘মুতাশাবিহ’ বা দ্ব্যর্থবোধক ও অস্পষ্ট বলে উল্লেখ করে এবং তা প্রত্যাখ্যান করে। ... অথবা তারা এ বক্তব্যের অর্থ বিকৃত করে এবং এরূপ বিকৃতিকে তারা ‘ব্যাখ্যা’ বলে আখ্যায়িত করে। এজন্যই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কঠিনভাবে তাদের এ সকল কর্মের প্রতিবাদ করেছেন। আহলুস সুন্নাতের রীতি এই যে, কোনো ভাবেই তাঁরা কুরআন বা সহীহ হাদীসের কোনো বক্তব্য পরিত্যাগ করেন না বা তার বাইরে যান না। কুরআন বা সহীহ হাদীসের মুকাবিলায় কোনো ‘আকলী দলীল’ বা কোনো ব্যক্তির বক্তব্য তাঁরা পেশ করেন না। ইমাম তাহাবী এ বিষয়টির দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।’’[17]
[1] ইবনু মায়ীন, তারীখ (দূরীর সংকলন) ৪/৬৩; সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ৪২।
[2] সূরা (৯) তাওবা: ১০০ আয়াত।
[3] কুরাশী, আব্দুল কাদির, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ ২/৪৭৩।
[4] কুরাশী, আব্দুল কাদির, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ ২/৪৭৩।
[5] ইবনু আব্দিল বার, আল ইনতিকা ফী ফাযাইলিস সালাসাতিল আইম্মা, পৃ ১৪৪।
[6] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৯০-১৯২ ও ৩২৭।
[7] সায়িদ নাইসাপূরী, আল-ই’তিকাদ, পৃষ্ঠা ৯১।
[8] তাহাবী, ইমাম আবূ জাফর, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১০, ১৪।
[9] সূরা (২৩) মুমিনূন: ৭১ আয়াত।
[10] ইবন মানদাহ, আত-তাওহীদ ৩/৩০৪-৩০৬; যাকারিয়্যা, আশ-শিরক ১/৮৬-৮৮।
[11] ইমাম তাহাবী, আল-আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১০।
[12] সূরা (৫) মায়িদা: ৩ আয়াত।
[13] সূরা (২৯) আনকাবূত: ৫১ আয়াত।
[14] সূরা হাশর ৭ আয়াত।
[15] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৩।
[16] তাহাবী, ইমাম আবূ জাফর, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৪।
[17] ইবনু আবিল ইয্য হানাফী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয্যাহ, পৃ. ৩৫৪-৩৫৫।
২. ৮. আকীদার উৎস: সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র
এখানে আকীদার উৎস বিষয়ে সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারী আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি এবং পাশাপাশি শীয়া-রাফিযী, খারিজী, মুতাযিলা ও অন্যান্য বিভ্রান্ত গোষ্ঠীর মূলনীতি উল্লেখ করা হলো:
সাহাবীগণ ও আহলুস সুন্নাহ |
বিভ্রান্ত সম্প্রদায় |
|
১ |
কুরআন-হাদীস বা ওহীর বাইরে আকীদার জ্ঞান বা বিশ্বাসের কোনো নিশ্চিত উৎস নেই। |
আকীদার অন্যান্য নিশ্চিত উৎস আছে: ইলহাম, ইলকা, কাশফ, ইলম লাদুন্নী, দর্শন, বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ইত্যাদি। |
২ |
ওহীর সরল অর্থই ওহী। এর ব্যাখ্যায় আলিমদের মতামত মানবীয় জ্ঞান-প্রসূত কথা, তা ওহীর সমতুল্য নয়। |
মানবীয় তাফসীর-ব্যাখ্যাকে ওহীর মর্যাদা প্রদান এবং তাফসীরের নামে ওহীর সুস্পষ্ট অর্থ পরিত্যাগ। |
৩ |
হাদীস আকীদার উৎস ও ভিত্তি। |
হাদীসের গুরুত্ব অস্বীকার বা অবমূল্যায়ন। |
৪ |
যাচাই পূর্বক শুধু বিশুদ্ধ হাদীস গ্রহণ। |
যাচাই ছাড়া পছন্দমত হাদীস গ্রহণ। |
৫ |
কুরআন-হাদীসের বক্তব্য সুনিশ্চিত; দর্শন-যুক্তির প্রমাণে অনিশ্চয়তা আছে। দর্শন ও যুক্তিকে কুরআন-হাদীসের বক্তব্য দিয়ে যাচাই করতে হবে। |
দর্শন-যুক্তির প্রমাণ সুনিশ্চিত; কুরআন-হাদীসের বক্তব্য অস্পষ্ট ও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কুরআন-হাদীসের বক্তব্য দর্শন ও যুক্তি দিয়ে যাচাই করতে হবে। |
৬ |
অনির্ভরযোগ্য ও জাল হাদীস বর্জন। |
জাল হাদীস তৈরি বা গ্রহণ। |
৭ |
‘আকলী দলীল’ বা দার্শনিক যুক্তিকে ওহী দ্বারা যাচাই করে গ্রহণ বা বর্জন। |
ওহীকে ‘আকলী দলীল’ দিয়ে বিচার করে গ্রহণ বা বর্জন করা। |
৮ |
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে কারো নির্ভুলতা বা অভ্রান্ততা নেই। সকলের মতামত ওহী দিয়ে যাচাই করে গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। |
পরবর্তী অনেকেই ভুলের ঊর্ধ্বে । তাদের ভুল হতে পারে না। তাদের মতের আলোকে কুরআন-হাদীস গ্রহণ বা ব্যাখ্যা করতে হবে। |
৯ |
ওহী অনুধাবনে সাহাবীগণের অনুসরণ। |
সাহাবীগণের গুরুত্ব অস্বীকার। |
১০ |
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা সাহাবীগণ যা বলেন নি বা করেন নি তাকে দীনের অংশ না বানানো। |
পরবর্তী যুগের ব্যক্তিবর্গের মত ও কর্মকে দীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানানো। |
১১ |
উম্মতের- বিশেষত সাহাবীগণের- ইজমা বা ঐকমত্যকে গুরুত্ব দেওয়া। |
শুধু স্বপক্ষের আলিমগণের ঐকমত্যকে গুরুত্ব দেওয়া বা ইজমা বলে দাবি করা। |
৩. আল্লাহর বিশেষণ কেন্দ্রিক বিভ্রান্তি
প্রথম হিজরী শতকের শেষ থেকে মুসলিম সমাজে ইহূদী, খৃস্টান, পারশিয়ান ও হিন্দু ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটে। এগুলোর প্রভাবে এ সকল ধর্ম থেকে আগত মুসলিমগণ এবং অন্যান্য অনেক মুসলিম আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার বা ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন এবং অনেকে মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনীয় বলে দাবি করতে থাকেন। এ সময়ে মুসলিম সমাজে এ বিষয়ে নিম্নের তিনটি মত বিদ্যমান ছিল:
(১) মহান আল্লাহর বিশেষণের মানবীয়করণের মতবাদ
(২) মহান আল্লাহর বিশেষণ অস্বীকার করার মতবাদ
(৩) সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও মূলধারার ব্যাখ্যামুক্ত স্বীকৃতির মতবাদ
৩. ১. তুলনাকারী মুশাবিবহা-মুজাস্সিমা মতবাদ
মুশাবিবহা অর্থ তুলনাকারী এবং মুজাস্সিমা অর্থ দেহে বিশ্বাসী। এ মতবাদের অনুসারীগণ মহান আল্লাহর বিশেষণ ও কর্ম মানুষেরই মত এবং তিনি মানুষের মত দেহধারী বলে বিশ্বাস করত। সাবাইয়া, বায়ানিয়্যা, মুগীরিয়্যাহ, হিশামিয়্যা ইত্যাদি শীয়া রাফিযী ফিরকার মানুষেরা এরূপ বিশ্বাস করতেন। প্রসিদ্ধ মুফাস্সির আবুল হাসান মুকাতিল ইবন সুলাইমান বালখী (১৫০ হি) এ মতের প্রচারক ছিলেন।[1]
[1] বাগদাদী, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ২১৪-২১৬; যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/২০১-২২২।
৩. ২. ব্যাখ্যা ও অস্বীকারের জাহমী-মুতাযিলী মতবাদ
জা’দ ইবন দিরহাম (১১৮ হি) নামক একজন নতুন প্রজন্মের পারসিক মুসলিম মহান আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার করে তাঁকে ‘নির্গুণ’ বলে দাবি করতে থাকেন। তার ছাত্র জাহম ইবন সাফওয়ান সামারকান্দী (১২৮ হি)। তিনি এ মতটিকে জোরালোভাবে প্রচার করতে থাকেন এবং এর সাথে অনেক দর্শনভিত্তিক মতবাদ তিনি প্রচার করেন। জাহমের মতবাদ নিম্নরূপ:
(ক) বিশেষণের অস্বীকৃতি। তার মতে যে সকল বিশেষণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা কখনো স্রষ্টার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। তবে যে বিশেষণগুলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সেগুলি তাঁর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে, যেমন স্রষ্টা, জীবনদাতা, মৃত্যুদাতা... ইত্যাদি। কাজেই এ কথা বলা যাবে না যে, মহান আল্লাহ দেখেন, শুনেন, কথা বলেন, দয়া করেন, ক্রোধান্বিত হন, তিনি আরশের উপরে অধিষ্ঠিত, তাঁর হাত, চক্ষু বা মুখমন্ডল বিদ্যমান, তাঁকে আখিরাতে দেখা যাবে....। কারণ এ সকল বিশেষণ আল্লাহর ক্ষেত্রে আরোপ করলে তাঁর অতুলনীয়ত্ব নষ্ট হয় এবং তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়।
(খ) কুরআন সৃষ্ট। উপরের যুক্তির ভিত্তিতেই তিনি আল্লাহর কথার অনাদিত্ব অস্বীকার করতেন। তার মতে, আল্লাহর কালাম আল্লাহর সৃষ্টি। কাজেই কখনোই বলা যাবে না যে আল্লাহ কথা বলেছেন, বরং বলতে হবে যে, আল্লাহ কথা সৃষ্টি করেছেন।
(গ) আল্লাহ সর্বস্থানে। বিরোধীরা তাকে বলেন, কোনো বিশেষণই যখন আল্লাহর ক্ষেত্রে আরোপ করা যায় না তাহলে আমরা কিভাবে তাঁকে অনুভব করব? তিনি বলেন: আল্লাহ আত্মা বা বাতাসের মত, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। সকল স্থানেই তিনি রয়েছেন।
(ঘ) মারিফাতই সব। তার মতে মারিফাত বা জ্ঞানই ঈমান এবং জাহালত বা অজ্ঞতা-ই কুফর। অন্তরে মারিফাত বা জ্ঞান এসে গেলে মুখে স্বীকারোক্তি বা কর্মের কোনো প্রয়োজন থাকে না। এটি মুরজিয়া মতের ভিত্তি।
(ঙ) মানুষের অক্ষমতা। তিনি প্রচার করতেন যে, মানুষের কোনোরূপ ক্ষমতা নেই। চাঁদ, সূর্য ইত্যাদি যেমন ইচ্ছাহীনভাবে আবর্তন করে, মানুষও তেমনি ইচ্ছাহীন ক্ষমতাহীন ভাবে কলের পুতুলের মত চলমান।
(ঙ) জান্নাত-জাহান্নামের বিলুপ্তি। তার মতে এগুলোর বিলুপ্তি ঘটবে।[1]
এ সময়েই মুতাযিলী মতবাদের উদ্ভব হয়। ওয়াসিল ইবন আতা গাজ্জাল (৮০-১৩১ হি), আমর ইবন উবাইদ ইবন বাব (৮০-১৪৪ হি) এবং তাদের ছাত্রগণ এ মতের প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করেন। জাহমীদের মত তাঁরাও মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো অস্বীকার বা ব্যাখ্যা করতেন। তাদের বিশ্বাস যে, মহান আল্লাহর সত্তার অতিরিক্ত কোনো অনাদি-অনন্ত বিশেষণ বা কর্ম (attribute) নেই। শুধু তাঁর অস্তিত্ব ও সত্তাই অনাদি-অনন্ত। তাঁর সকল কর্ম ও বিশেষণ তাঁর সৃষ্টি মাত্র। তাদের মতে, অনাদি-অনন্ত হওয়াই মহান আল্লাহর মূল বিশেষণ। আল্লাহর কোনো বিশেষণকে অনাদি বিশ্বাস করার অর্থ একাধিক অনাদি সত্তায় বিশ্বাস করা এবং আল্লাহর এ মূল বিশেষণে শরীক করা।
এছাড়া তাদের মতে কুরআনে উল্লেখিত অধিকাংশ বিশেষণ আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। আর মহান আল্লাহ অতুলনীয়। এজন্য এ সকল বিশেষণের ব্যাখ্যা করা জরুরী। মহান আল্লাহকে জ্ঞান, ক্ষমতা, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি কোনো বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না। এ সকল বিশেষণ ব্যাখ্যা করতে হবে। বিভিন্নভাবে তারা ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেছেন: আল্লাহ জ্ঞানী অর্থ তিনি মুর্খ নন। কেউ বলেছেন: আল্লাহ জ্ঞানী অর্থ তাঁর সত্তার নাম বা অংশ জ্ঞান...।
আমরা আগেই বলেছি, তাদের মতে আকীদার সত্য জানার জন্য ‘‘আকল’’ (জ্ঞান-বুদ্ধি)-ই একমাত্র সুনিশ্চিত পথ। আকলের নির্দেশনা একীনী অর্থাৎ সুনিশ্চিত। পক্ষান্তরে ওহীর নির্দেশনা যান্নী, অর্থাৎ অস্পষ্ট’। ওহীর নির্দেশনা যদি আকল-সম্মত হয় তাহলে তা গ্রহণ করতে হবে। আর যদি তা না হয় তাহলে তা ব্যাখ্যা করে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। তাদের মতে আকল প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহ ‘জিসম’ বা দেহধারী নন। কাজেই কুরআন বা হাদীসে যে সকল বিশেষণ তাঁকে দেহবিশিষ্ট বলে মনে করায় সেগুলি ব্যাখ্যা করা বাধ্যতামূলক। যেমন মহান আল্লাহর হস্ত, চক্ষু, মুখমন্ডল, কথা বলা, ক্রোধ, ভালবাসা, আরশে সমাসীন হওয়া, আখিরাতে তাঁর দর্শন, ইত্যাদি বিশেষণ। তাদের মতে এগুলো বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করা কুফর; কারণ এরূপ বিশ্বাসের অর্থই আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা এবং তাঁকে দেহ বিশিষ্ট বলে বিশ্বাস করা।[2]
[1] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/২৬-২৭; সুবকী, তাবাকাতুশ শাফিয়িয়্যা আল-কুবরা ১/৯৪; ড. আলী সাল্লাবী, উমার ইবন আব্দুল আযীয ৩/৪৪৮-৪৪৯; বাগদাদী, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃষ্ঠা ১৯৯।
[2] কাযী আব্দুল জাববার ইবনু আহমদ হামাযানী, শারহুল উসূলিল খামসা, পৃষ্ঠা ২২৬-২২৯; আল-মুখতাসার ফী উসূলিদ্দীন: রাসয়িলুল আদলি ওয়াত তাওহীদ, গামিদী, আহমদ আতিয়্যা, আল-ইমাম আল-বাইহাকী ওয়া মাওকিফুহূ মিনাল ইলাহিয়্যাত, পৃষ্ঠা ১১২।
৩. ৩. তুলনা-মুক্ত স্বীকৃতি: সাহাবী-তাবিয়ীগণের মত
এ দু প্রান্তিক ধারার মাঝে ছিলেন সাহাবীগণের অনুসারী মুলধারার তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিমগণ, যাঁরা ‘‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’’ নামে পরিচিত। এ বিষয়ে তাঁদের মূলনীতি ছিল যে, কুরআন ও হাদীসে আল্লাহর যে সকল বিশেষণ বা কর্ম উল্লেখ করা হয়েছে তা সবকিছু সরল অর্থে বিশ্বাস করা। যুক্তিতর্ক দিয়ে এগুলোর প্রকৃতি হৃদয়ঙ্গমের চেষ্টা ও এগুলোকে মানবীয় বিশেষণের সাথে তুলনা করা যেমন নিষিদ্ধ তেমনি সৃষ্টির সাথে তুলনীয় হওয়ার ভয়ে এগুলো অস্বীকার বা ব্যাখ্যা করাও নিষিদ্ধ।
তাঁদের মতে গাইবী বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের একমাত্র নিশ্চিত উৎস ওহী। এক্ষেত্রে ‘আকল’ বা মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পূরক ও সহযোগী। ওহীর নিশ্চিত বক্তব্য এ সকল বিশেষণের কথা বলেছে এবং মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তিতে এগুলো অবাস্তব, অযৌক্তিক বা অসম্ভব নয়। কাজেই এগুলো সরল অর্থে বিশ্বাস করা আবশ্যক। ব্যাখ্যার নামে এগুলোর বাহ্যিক অর্থ অস্বীকার করা ওহী অস্বীকারের নামান্তর। ইমাম আযম এ পরিচ্ছেদে বিশেষণ বিষয়ে আহলুস সুন্নাতের এ আকীদা ব্যাখ্যা করেছেন।
৪. আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ে ইমাম আযমের মত / ৪. ১. বিভ্রান্তদের স্বরূপ উন্মোচন
৪. ১. বিভ্রান্তদের স্বরূপ উন্মোচন
ইমাম আযম বিভিন্ন বক্তব্যে মুতাযিলীগণের ইলম কালামের ভয়াবহতা, জাহমের ব্যাখ্যা-তত্ত্ব এবং মুকাতিলের তুলনা-তত্ত্ব বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলতেন:
أتانا من المشرق رأيان خبيثان جهم معطل ومقاتل مشبه
‘‘পূর্ব দিক (ইরান-খুরাসান) থেকে দুটি অপবিত্র নোংরা মতবাদ আমাদের নিকট আগমন করেছে: (১) মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো অকার্যকরকারী জাহমের মতবাদ এবং (২) মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনাকারী মুকাতিলের মতবাদ।’’[1]
তিনি আরো বলতেন:
لعن الله عمرو بن عبيد فإنه فتح للناس بابا إلى علم الكلام وقاتل الله جهم بن
صفوان ومقاتل بن سليمان هذا أفرط فى النفي وهذا أفرط فى التشبيه
‘‘আল্লাহ অভিশপ্ত করুন (মুতাযিলী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা-প্রচারক) আমর ইবন উবাইদকে; কারণ সে মানুষের জন্য ইলম কালামের দরজা খুলেছে; আল্লাহ ধ্বংস করুন জাহম ইবন সাফওয়ানকে ও মুকাতিল ইবন সুলাইমানকে; কারণ একজন অস্বীকারে সীমালঙ্ঘন করেছে এবং অন্যজন তুলনায় সীমালঙ্ঘন করেছে।’’[2]
ইমাম আবূ হানীফার আকীদা বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ সায়িদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আহমদ নাইসাপূরী (৩৪৩-৪৩২ হি) বলেন, জারূদ ইবন ইয়াযীদ বলেন:
سمعت أبا حنيفة- رضي الله عنه- يقول: نفى جهم، حتى قال: لا شيء، وغضب على
التنْزيل، قال: فقال له الجارود: ما تقول أنت رحمك الله؟ قال: أنا أقول كما قال
الله تعالى في تنْزيله، ورُوِي عن رسول الله ﷺ
‘‘আমি আবূ হানীফা (রা)-কে বলতে শুনলাম: জাহম (মহান আল্লাহর বিশেষণ) এমনভাবে অস্বীকার করল যে, সে বলল: (মহান আল্লাহ) কিছুই নন। আর সে কুরআনের উপরেও বিরক্ত-ক্রোধান্বিত। জারূদ বলেন, আমি বললাম: আল্লাহ আপনাকে রহম করুন, আপনার মত কী? তিনি বলেন: আমি তাই বলি যা মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে।’’[3]
[1] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/১৬৪; আইনী, মাগানীল আখইয়ার ৫/৮২।
[2] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৮২; কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ ১/৩১
[3] সায়িদ নাইসাপূরী, আল-ই’তিকাদ, পৃষ্ঠা ৯২-৯৩।
৪. ২. আল্লাহর গুণাবলির অস্তিত্ব ও অতুলনীয়ত্ব
এ পরিচ্ছেদের শুরুতে উদ্ধৃত ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এর বক্তব্যে আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন:
‘‘তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির কোনো কিছুর মত নন। তিনি অনাদি কাল থেকে অনন্ত কাল বিদ্যমান রয়েছেন তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) সিফাতসমূহ-সহ।
মুশাবিবহা সম্প্রদায়ের মূল বিভ্রান্তি ছিল মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো শব্দগতভাবে মানবীয় বা সৃষ্টিজগতের বিশেষণের মত প্রতীয়মান হওয়ায় তাঁকে সৃষ্টির মত এবং তাঁর গুণাবলিকে সৃষ্টির মত বলে দাবি করা। এভাবে তারা মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো বিশ্বাস করার নামে তাঁর ‘অতুনীয়ত্ব’ অবিশ্বাস করেছে। অপরপক্ষে জাহমিয়া-মুতাযিলা সম্প্রদায়ের মূল বিভ্রান্তি ছিল সৃষ্টির সাথে তুলনীয় হওয়ার অজুহাতে আল্লাহর বিশেষণ ব্যাখ্যার নামে অস্বীকার করা। তাদের মতে মহান আল্লাহর কোনো বিশেষণ স্বীকার করার অর্থই তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা। জ্ঞান, ক্ষমতা, কথা, শ্রবণ, দর্শন, হস্ত, মুখমন্ডল, চক্ষু ইত্যাদির অধিকারী হওয়া, আরশে সমাসীন হওয়া ইত্যাদি সবই মানবীয় বা সৃষ্টজগতের বিশেষণ। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টিকে এ সকল বিশেষণে বিশেষিত করা যায়। মহান আল্লাহর এরূপ বিশেষণ আছে বলে বিশ্বাস করলে তাঁকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। যেহেতু আল্লাহ বলেছেন, ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়’’ সেহেতু আল্লাহর ক্ষেত্রে এরূপ বিশেষণ আরোপ করা যাবে না। কুরআন-হাদীসের কোনো কথা দ্বারা এরূপ বিশেষণ বুঝা গেলে তা ব্যাখ্যা করতে হবে। এভাবে তারা ‘‘অতুলনীয়ত্ব’’ প্রমাণের নামে বিশেষণগুলো অস্বীকার করেছে।
পক্ষান্তরে সাহাবীগণ এবং মূলধারার তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের মূলনীতি ছিল কুরআন ও হাদীসে মহান আল্লাহর যত বিশেষণ ও কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা সবই সরল অর্থে বিশ্বাস করা। সৃষ্টির সাথে তুলনার অজুহাতে আল্লাহর কোনো বিশেষণ ব্যাখ্যা বা অস্বীকার করা যাবে না। বরং বিশেষণকে সরল অর্থে বিশ্বাস করে তুলনাকে অস্বীকার করতে হবে। আল্লাহ বলেছেন যে, কোনো কিছুই তাঁর তুলনীয় নয়। আবার তিনিই সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এ সকল বিশেষণ তাঁর নিজের ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন। মুমিনের দায়িত্ব আল্লাহর অতুলনীয়ত্ব ও তাঁর বিশেষণ উভয়কে সমানভাবে বিশ্বাস করা।
মুশাবিবহা ও জাহমী-মুতাযিলীদের বিশ্বাস দীনের মধ্যে উদ্ভাবিত ‘বিদআত’ ও কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার বিপরীত। সাহাবী-তাবিয়ীগণ কখনো কোনো বিশেষণকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করেন নি এবং তুলনার অজুহাতে কোনো বিশেষণকে ব্যাখ্যা করেন নি। কখনো জিজ্ঞাসিত হলে এরূপ ব্যাখ্যার কঠোর বিরোধিতা করেছেন।
এ সকল ‘বিদআত’ থেকে উম্মাতকে রক্ষা করার জন্য ইমাম আবূ হানীফা আল্লাহর সিফাত (বিশেষণ) বিষয়ক মূলনীতি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর উপরের বক্তব্য থেকে আমরা জানছি যে, আল্লাহর বিশেষণের ‘অতুলনীয়ত্ব’ ও ‘অস্তিত্ব’ সমানভাবে বিশ্বাস করতে হবে। উভয় বিষয়কে মেনে নেওয়া ‘আকল’ বা জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক নয়। ইমাম আবূ হানীফা বিষয়টি পরবর্তীতে আরো ব্যাখ্যা করবেন।
৪. ৩. আল্লাহর যাতী ও ফি’লী বিশেষণ
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘তিনি অনাদি কাল থেকে অনন্ত কাল বিদ্যমান তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) সিফাতসমূহ (বিশেষণসমূহ)-সহ। তাঁর সত্তীয় বিশেষণসমূহ: হায়াত (জীবন), কুদরাত (ক্ষমতা), ইলম (জ্ঞান), কালাম (কথা), সাম’ (শ্রবণ), বাসার (দর্শন) ও ইরাদা (ইচ্ছা)। আর তাঁর ফি’লী সিফাতসমূহের মধ্যে রয়েছে: সৃষ্টি করা, রিয্ক প্রদান করা, নবসৃষ্টি করা, উদ্ভাবন করা, তৈরি করা এবং অন্যান্য কর্মমূলক সিফাত বা বিশেষণ।’’
কুরআন-হাদীসে বর্ণিত মহান আল্লাহর বিশেষণসমূহ হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পরবর্তী আলিমগণ বিভিন্নভাবে এগুলোকে ভাগ করেছেন। আহলুস সুন্নাতের আলিমগণ এগুলোকে দু ভাগে ভাগ করেছেন: ‘যাতী’ ও ‘ফি’লী’। আধুনিক গবেষকগণ নিশ্চিত করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফাই সর্বপ্রথম এ শ্রেণী বিন্যাস করেন।[1]
‘যাত’ (الذات) শব্দটির অর্থ self: সত্তা, স্বকীয় ব্যক্তিত্ব, অহং ইত্যাদি। ‘যাতী সিফাত’ অর্থ সত্তীয় বিশেষণ। মহান আল্লাহর যে সকল সিফাত বা বিশেষণ তাঁর সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে ও চিরন্তনরূপে বিদ্যমান সেগুলিকে যাতী সিফাত বা সত্তাগত বিশেষণ (Attributes of essence) বলা হয়। ‘ফি’ল (الفعل) শব্দটির অর্থ ক্রিয়া বা কর্ম (action, work,
performance, doing)। ফি’লী সিফাত অর্থ কর্মীয় বিশেষণ বা কর্মগত বিশেষণ। মহান আল্লাহর যে সকল সিফাত বা বিশেষণ তাঁর ইচ্ছায় কর্মে পরিণত হয় সেগুলি ফি’লী সিফাত বা কর্মগত বিশেষণ।[2]
ইমাম আযম এখানে ৭টি যাতী সিফাত উল্লেখ করেছেন: (১) হায়াত (জীবন), (২) কুদরাত (ক্ষমতা), (৩) ইলম (জ্ঞান), (৪) কালাম (কথা), (৫) সাম’ (শ্রবণ), (৬) বাসার (দর্শন) ও (৭) ইরাদা (ইচ্ছা)। আমরা দেখব যে, তিনি তাঁর ‘আল- ফিকহুল আকবার’ ও ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ গ্রন্থে অন্যান্য যে সকল যাতী সিফাত উল্লেখ করেছেন সেগুলির মধ্যে রয়েছে: (৮) উলুও (العلو) অর্থাৎ ঊর্ধ্বত্ব বা উর্দ্ধে অবস্থান, (৯) ইয়াদ (اليد): হস্ত, (১০) আল-ওয়াজহ (الوجه): মুখমন্ডল ও (১১) নাফস (النفس): সত্তা।
ইমাম আযম এখানে ৫টি ফি’লী সিফাত উল্লেখ করেছেন: (১) সৃষ্টি করা, (২) রিয্ক প্রদান করা, (৩) নবসৃষ্টি করা, (৪) উদ্ভাবন করা ও (৫) তৈরি করা। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, তিনি তাঁর বিভিন্ন বইয়ে আরো যে সকল ফি’লী সিফাত উল্লেখ করেছেন সেগুলির মধ্যে রয়েছে: (৬) ইসতিওয়া (الاستواء) বা আরশের উপর অধিষ্ঠিত হওয়া, (৭) নুযূল (النزول) বা অবতরণ করা, (৮) গাদাব (الغضب) বা ক্রোধ, (৯) রিদা (الرضا) সন্তুষ্টি, (১০) মহববত (المحبة) ভালবাসা, ইত্যাদি। পরবর্তীতে আমরা এ সকল সিফাত বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
আমরা সহজেই যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) বিশেষণের পার্থক্য বুঝতে পারি। কর্মীয় বিশেষণগুলো মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যখন ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, রিযক দেন, আরশে অধিষ্ঠিত হন, অবতরণ করেন, ক্রোধান্বিত হন, সন্তুষ্ট হন বা ভালবাসেন। এগুলো বিশেষণ হিসেবে অনাদি ও চিরন্তন, কিন্তু তাঁর ইচ্ছায় কর্মে পরিণত হয় নতুনভাবে। এগুলো তাঁর পবিত্র সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে। তিনি কখনো ক্রোধান্বিত হতে পারেন এবং কখনো ক্রোধমুক্ত থাকতে পারেন।
পক্ষান্তরে যাতী বা সত্তীয় বিশেষণ তদ্রূপ নয়। এগুলি কখনোই তাঁর পবিত্র সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। আমরা বলতে পারি যে, মহান আল্লাহ যখন ইচ্ছা ক্রোধান্বিত হন এবং যখন ইচ্ছা ক্রোধ বিহীন থাকেন। কিন্তু আমরা বলতে পারি না যে, তিনি যখন ইচ্ছা ক্ষমতাবান হন এবং যখন ইচ্ছা ক্ষমতাহীন হন। সকল বিশেষণই এরূপ।
কিছু বিশেষণ ‘যাতী’’ (সত্তীয়) এবং ‘ফি’লী’ (কর্মীয়) হতে পারে, যেমন মহান আল্লাহর কালাম বা কথার বিশেষণ।
[1] ড. আলী সামী নাশ্শার, নাশআতুত তাফকীরিল ফালসাফী, ১/২৩২; আহমদ আতিয়্যাহ গামিদী, ইমাম বাইহাকী ওয়া মাওকিফুহূ মিনাল ইলাহিয়্যাত, পৃ. ১৮৪।
[2] বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত, খন্ড ১, পৃষ্টা ২৭৬-২৭৭; মুহাম্মাদ ইবনু খালীফা তামীমী, আস-সিফাতুল ইলাহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ৬৫-৬৬।
৪. ৪. আল্লাহর বিশেষণ অনাদি, চিরন্তন ও অসৃষ্ট
এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন: ‘‘তিনি তাঁর গুণাবলি এবং নামসমূহ-সহ অনাদি-রূপে বিদ্যমান। তাঁর নাম ও বিশেষণের মধ্যে কোনো নতুনত্ব বা পরিবর্তন ঘটে নি। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর জ্ঞানে জ্ঞানী এবং জ্ঞান অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কথায় কথা বলেন এবং কথা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টি করা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কর্মে কর্মী, কর্ম অনাদিকাল থেকে তাঁর বিশেষণ। আল্লাহ তাঁর কর্ম দিয়ে যা সৃষ্টি করেন তা সৃষ্ট, তবে আল্লাহর কর্ম সৃষ্ট নয়। তাঁর সিফাত বা বিশেষণাবলি অনাদি। কোনো বিশেষণই নতুন বা সৃষ্ট নয়। যে ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহর কোনো সিফাত বা বিশেষণ সৃষ্ট অথবা নতুন, অথবা এ বিষয়ে সে কিছু বলতে অস্বীকার করে, অথবা এ বিষয়ে সে সন্দেহ পোষণ করে, তবে সে আল্লাহর প্রতি ঈমানবিহীন কাফির।’’
কুরআন-হাদীসে উল্লেখকৃত আল্লাহর সকল বিশেষণ সরল অর্থে বিশ্বাস করার আরেকটি দিক এগুলোর অনাদিত্বে বিশ্বাস করা। সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও মূলধারার মুসলিমগণ বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ অনাদিকাল থেকেই তাঁর সকল বিশেষণে বিশেষায়িত। তিনি সকল বিশেষণসহই অনাদি ও চিরন্তন। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর সকল নাম ও বিশেষণ নিয়ে বিদ্যমান, তবে তাঁর নাম ও গুণাবলি সৃষ্টির কাছে প্রকাশিত হয়েছে পরবর্তী সময়ে।
পক্ষান্তরে মুতাযিলী ও জাহমীগণ যেহেতু মহান আল্লাহর সত্তার অতিরিক্ত কোনো অনাদি-অনন্ত বা চিরন্তন গুণ আছে বলে স্বীকার করতেন না সেহেতু তারা দাবি করতেন যে, মহান আল্লাহর যে সকল বিশেষণ কুরআন-হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি মূলত তাঁর সৃষ্ট ‘মাখলূক’ মাত্র, তাঁর নিজস্ব কোনো চিরন্তন বিশেষণ নয়। অনাদিকালে তাঁর কোনো ‘বিশেষণ’ ছিল না। যখন তিনি সৃষ্টি করলেন তখন তাঁর জন্য ‘সৃষ্টিকর্তা’ নামক বিশেষণটি জন্ম নিল। ‘সৃষ্টিকর্তা’ নামটি তখন থেকে তাঁর জন্য প্রযোজ্য। এ নামটি তাঁরই একটি সৃষ্টি মাত্র। ‘কথা বলা’ অনাদিকাল থেকে তাঁর ‘বিশেষণ’ নয়; অনাদিকালে তিনি ‘নির্গুণ’ ছিলেন। তিনি যখন শ্রবণের মত প্রাণী সৃষ্টি করলেন তখন তিনি কথা সৃষ্টি করলেন এবং তাঁর কথা তারা শুনলো। কথা তাঁর বিশেষণ নয়, তাঁর সৃষ্টি মাত্র। তাঁর সকল বিশেষণই তাঁরা এভাবে ব্যাখ্যা করেন। তারা দাবি করেন যে, মহান আল্লাহর কোনো অনাদি চিরন্তন বিশেষণ নেই; তাঁর নাম ও বিশেষণগুলো পরবর্তীকালে সৃষ্ট।
তাদের এরূপ বিশ্বাসের একটি বড় কারণ ছিল গ্রীক দর্শনভিত্তিক খৃস্টধর্মীয় বিশ্বাস। মহান আল্লাহ ঈসা (আ)-কে তাঁর ‘বাক্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন; কারণ পিতামাতার মাধ্যমে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ভাবে তাঁকে সৃষ্টি না করে তিনি তাঁকে ‘কুন’ বা ‘হও’ বাক্য দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, আল্লাহর ‘কালিমা’ অর্থাৎ কথা বা বাক্য যেহেতু তাঁর অনাদি বিশেষণ, সেহেতু ঈসা (আ) আল্লাহর মতই অনাদি ও চিরন্তন। তিনি অনাদিকাল থেকে আল্লাহর সাথে বিরাজমান ছিলেন এবং মানব রূপ ধারণ করে বা মানব রূপের সাথে মিশ্রিত হয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন। মুসলিমগণ যখন গ্রীক দর্শন অধ্যয়ন শুরু করেন তার আগেই খৃস্টান পন্ডিতগণ তাদের এ উদ্ভট আকীদা theory of Logos বা ‘বাক্যতত্ত্ব’ নামে গ্রীক দর্শনের সাথে মিশ্রিত করেছেন। মুতাযিলী পন্ডিতগণ মহান আল্লাহর সাথে শিরকের এ পথ বন্ধ করার জন্য দার্শনিক যুক্তিতর্ক দিয়েই প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন যে, মহান আল্লাহর কোনো বিশেষণই অনাদি বা চিরন্তন নয়, বরং সবই তাঁর সৃষ্টি।
তাঁদের উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক, বাস্তবে তারা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হন। তারা ইসলামী বিশ্বাসের মধ্যে একটি ‘বিদআত’ বা নব-উদ্ভাবিত বিশ্বাসের অনুপ্রবেশ ঘটান যা কুরআন, হাদীস ও সাহাবীগণের বিশ্বাসের মধ্যে ছিল না। সর্বোপরি এরূপ বিশ্বাস কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। মহান আল্লাহর বিশেষণকে সৃষ্ট বলে দাবি করার অর্থ তাঁর অনাদি-অনন্ত ও চিরন্তন পূর্ণতাকে অস্বীকার করা। মহান আল্লাহ তাঁর সকল বিশেষণ ও কর্মসহ অনাদি ও চিরন্তন। আর তিনি তাঁর বিশেষণ বা কর্মের দ্বারা যা সৃষ্টি করেন তা সৃষ্ট। কাজেই মহান আল্লাহর ‘কালিমা’ বা বাক্য অনাদি হলেও বাক্য দ্বারা সৃষ্ট ঈসা (আ) অনাদি নন। বিষয়টি এভাবে অনুধাবন করলেই মহান আল্লাহর চিরন্তন পূর্ণতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি একাধিক অনাদি সত্তায় বিশ্বাসের শিরক অপনোদন হয়।
লক্ষণীয় যে, গ্রীক দর্শনের অনুপ্রবেশই খৃস্টধর্মকে বিকৃত করে। সাধু পলের উদ্ভাবিত দর্শনভিত্তিক এ আকীদা বাদ দিয়ে যদি খৃস্টানগণ প্রচলিত চার ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান মহান আল্লাহর বক্তব্য ও ঈসা মাসীহের বক্তব্যের কাছে আত্মসমর্পন করতেন তবে তারাও এ সকল শিরক থেকে রক্ষা পেতেন। বর্তমানে প্রচলিত ও বহুভাবে বিকৃত চার-ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান এ সকল বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ঈসা মাসীহ আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, তিনি আল্লাহর বান্দা। আল্লাহর অবতার বা আল্লাহর কোনো বিশেষণের দেহরূপ হওয়া তো অনেক দূরের কথা, কোনো গাইবী ইলম বা মানুষকে মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁর নেই। ঈসা মাসীহের নামে অতিভক্তিতে মুক্তি মিলবে না, বরং তাওহীদ ও রিসালাতের বিশ্বাস ও শরীয়ত পালনই মুক্তির একমাত্র পথ।[1]
[1] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম।
৫. আল্লাহর কালাম বা কথা
জাহমী-মুতাযিলীগণ আল্লাহর কথাকে সৃষ্ট বলে দাবি করতেন। তারা বলতেন, আল্লাহ কথা বলেন না, তিনি কথা সৃষ্টি করেন। কুরআনও আল্লাহর একটি সৃষ্টি। কথা বলা সৃষ্টির কর্ম। আল্লাহ কথা বলেন বললে তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। আল্লাহ বলেছেন ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়’’[1], কাজেই তিনি কথা বলেন বলে বিশ্বাসকারী কুরআনের এ আয়াত অবিশ্বাস করার কারণে কাফির বলে গণ্য।
কুরআনে বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আল্লাহর কথা বলার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ নিজের বিষয়ে বা তাঁর রাসূল (ﷺ) তাঁর বিষয়ে যে বিশেষণ উল্লেখ করেছেন তা আল্লাহর পবিত্রতার অজুহাতে ব্যাখ্যা করে বাতিল করার অর্থ আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (ﷺ) কথা অগ্রহণযোগ্য বলে দাবি করা এবং নিজেকে তাঁদের চেয়েও বুদ্ধিমান ও ধার্মিক বলে দাবি করা। আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের বিশেষণটি যেমন কুরআন থেকে জানা যায়, তেমনি তাঁর কথা বলার বিশেষণটিও কুরআন থেকে জানা যায়। কোনো একটিকে গ্রহণ করতে অন্যটিকে ব্যাখ্যা করে বাতিল করার অর্থ নিজের বুদ্ধিকে ওহী গ্রহণ বা বর্জনের মানদন্ড বানানো। আর এটিই বিভ্রান্তির কারণ।
এজন্য মুসলিম উম্মাহর ইমামগণ একমত যে, ‘কালাম’ বা ‘কথা বলা’ আল্লাহর অনাদি বিশেষণসমূহের একটি। কুরআন আল্লাহর কালাম এবং তা সৃষ্ট নয়, বরং তা স্রষ্টার একটি বিশেষণ। আমরা দেখেছি, এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন:
কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম, মুসহাফগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ, হৃদয়গুলোর মধ্যে সংরক্ষিত, জিহবাসমূহ দ্বারা পঠিত এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপরে অবতীর্ণ। কুরআন পাঠে আমাদের জিহবার উচ্চারণ সৃষ্ট, কুরআনের জন্য আমাদের লিখনি সৃষ্ট, আমাদের পাঠ সৃষ্ট, কিন্তু কুরআন সৃষ্ট নয়। মহান আল্লাহ কুরআনের মধ্যে মূসা (আ) ও অন্যান্য নবী (আ) থেকে এবং ফিরাউন এবং ইবলীস থেকে যা উদ্ধৃত করেছেন তা সবই আল্লাহর কালাম (কথা), তাদের বিষয়ে সংবাদ হিসেবে। আল্লাহর কথা সৃষ্ট নয়, মূসা (আ) ও অন্য সকল মাখলূকের কথা সৃষ্ট। কুরআন আল্লাহর কথা কাজেই তা অনাদি, মাখলূকগণের কথা সেরূপ নয়। মূসা (আ) আল্লাহর কথা শুনেছিলেন, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ‘‘মূসার সাথে আল্লাহ প্রকৃত বাক্যালাপ করেছিলেন’’[2] মূসা (আ)-এর সাথে কথা বলার আগেই- অনাদিকাল থেকেই- মহান আল্লাহ তাঁর কালাম বা কথার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন, যেমন সৃষ্টজগত সৃষ্টি করার পূর্বেই- অনাদিকাল থেকেই- তিনি সৃষ্টিকর্তার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন। ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[3] যখন তিনি মূসা (আ)-এর সাথে কথা বলেন তখন তিনি তাঁর সেই অনাদি বিশেষণ কথার বিশেষণ দ্বারা কথা বলেন। তাঁর সকল বিশেষণই মাখলূকদের বা সৃষ্টপ্রাণীদের বিশেষণের ব্যতিক্রম। তিনি জানেন, তবে তাঁর জানা আমাদের জানার মত নয়। তিনি ক্ষমতা রাখেন, তবে তাঁর ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়। তিনি দেখেন, তবে তাঁর দেখা আমাদের দেখার মত নয়। তিনি কথা বলেন, তবে তাঁর কথা বলা আমাদের কথা বলার মত নয়। তিনি শুনেন, তবে তাঁর শোনা আমাদের শোনার মত নয়। আমরা বাগযন্ত্র ও অক্ষরের মাধ্যমে কথা বলি, আর মহান আল্লাহ বাগযন্ত্র এবং অক্ষর ছাড়াই কথা বলেন। অক্ষরগুলি সৃষ্ট। আর আল্লাহর কথা (কালাম) সৃষ্ট নয়।’’
এখানে তিনি যে মূলনীতিগুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলোর সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:
(১) কুরআন আল্লাহর কালাম, যা তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ করেন। কুরআন ‘‘মুসহাফ’’ বা গ্রন্থরূপ কুরআনের মধ্যে লিপিবদ্ধ, মুমিনদের অন্তরে মুখস্ত এবং মুমিনদের জিহবা দ্বারা পঠিত।
(২) কুরআন পাঠকারীর পাঠ বা উচ্চারণ তার নিজের কর্ম এবং তা মানবীয় কর্ম হিসেবে আল্লাহর সৃষ্ট। তবে কুরআন অনাদি ও অসৃষ্ট।
(৩) কুরআনে অনেক মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ সকল সৃষ্টি যে কথা পৃথিবীতে বলেছিলেন তা সৃষ্টির বক্তব্য হিসেবে সৃষ্ট। তবে মহান আল্লাহ তাঁর অনাদি বিশেষণে তাঁদের বিষয়ে যা বলেছেন তা সবই তাঁর অনাদি বিশেষণের অন্তর্ভুক্ত।
(৪) মহান আল্লাহ তাঁর নবী মূসা (আ)-এর সাথে কথা বলেন এবং সে কথা মূসা (আ) শ্রবণ করেন।
(৫) আল্লাহর সকল বিশেষণই মাখলূকের বিশেষণের ব্যতিক্রম ও অতুলনীয়।
এ প্রসঙ্গে ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:
وَإِنًّ الْقُرْآنَ كَلاَمُ اللهِ مِنْهُ بَدَأَ بِلاَ كَيْفِيَّةٍ قَوْلاً
وَأَنْزَلَهُ عَلَى رَسُوْلِهِ وَحْياً وَصَدَّقَهُ الْمُؤْمِنُوْنَ عَلَى ذَلِكَ
حَقًّا وَأَيْقَنُوا أَنَّهُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَى بِالْحَقِيْقَةِ لَيْسَ
بِمَخْلُوْقٍ كَكَلاَمِ الْبَرِيَّةِ. فَمَنْ سَمِعَهُ فَزَعَمَ أَنَّهُ كَلاَمُ
الْبَشَرِ فَقَدْ كَفَرَ. وَقَدْ ذَمَّهُ اللهُ وَعَابَهُ وَأَوْعَدَهُ بِسَقَرَ
حَيْثُ قَالَ تَعَالَى: "سَأُصْلِيْهِ سَقَرَ". فَلَمَّا أَوْعَدَ اللهُ
بِسَقَرَ لِمَنْ قَالَ: "إِنْ هَذَا إِلاَّ قَوْلُ الْبَشَرِ" عَلِمْنَا
وَأَيْقَنَّا أَنَّهُ قَوْلُ خَالِقِ الْبَشَرِ وَلاَ يُشْبِهُ قَوْلَ الْبَشَرِ.
‘‘আর নিশ্চয় কুরআন আল্লাহর কথা। কোনোরূপ স্বরূপ বা কিরূপ নির্ণয় ব্যতিরেকে কথা হিসেবে তাঁর থেকেই প্রকাশিত ও উদ্ভূত, তিনি তা তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর উপরে ওহীরূপে অবতীর্ণ করেছেন। আর মুমিনগণ তা সুনিশ্চিত সত্যরূপে বিশ্বাস ও গ্রহণ করেছেন এবং তারা সুদৃঢ়রূপে বিশ্বাস করেছেন যে, তা প্রকৃত ও আক্ষরিক অর্থেই আল্লাহর কালাম। তা সৃষ্টির কথার মত সৃষ্ট নয়। কাজেই যে ব্যক্তি ধারণা করবে যে তা মানুষের কথা, সে কাফির। আর এরূপ ব্যক্তিকে আল্লাহ নিন্দা করেছেন এবং জাহান্নামের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘অচিরেই আমি তাকে সাকার-জাহান্নামে প্রবিষ্ট করব’ । যে ব্যক্তি কুরআনের বিষয়ে বলে যে ‘এটি মানুষের কথা মাত্র’ [4] আল্লাহ তার এ পরিণতির কথা বলেছেন। এ থেকে আমরা জানলাম ও সুদৃঢ় বিশ্বাসে উপনীত হলাম যে, কুরআন মানুষের কথা নয়, মানুষের স্রষ্টার কথা।’’[5]
ইমাম তাহাবী আরো বলেন:
ولا نخوض في الله، ولا نماري في دين الله. ولا نجادل في القرآن، ونشهد أنه كلام رب
العالمين. نزل به الروح الأمين، فعلمه سيد المرسلين محمداً صلى الله عليه وعلى آله
وسلم. وهو كلام الله تعالى لا يساويه شيء من كلام المخلوقين. ولا نقول بخلقه، ولا
نخالف جماعة المسلمين... ونقول الله أعلم فيما اشتبه علينا علمه.
‘‘আমরা আল্লাহর সত্ত্বা সম্পর্কে অহেতুক চিন্তা-গবেষণায় প্রবৃত্ত হই না। আমরা পবিত্র কুরআনে ব্যাপারে কোন বিতর্ক-বাদানুবাদে জড়িত হই না। আমরা একথার সাক্ষ্য প্রদান করি যে, তা নিখিল বিশ্বের প্রভু-প্রতিপালকের বাণী, রূহুল আমীন জিবরাঈল (আ) তা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। অতঃপর তিনি নবীদের নেতা মুহাম্মদ ﷺ-কে তা শিক্ষা দিয়েছেন। কুরআন মহান আল্লাহর কালাম। সৃষ্টিজগতের কোন কালাম এর সমকক্ষ হতে পারে না। ‘‘কুরআন সৃষ্ট’’ এমন মন্তব্য আমরা করি না এবং আমরা এ ব্যাপারে মুসলিম জামা’আতের বিরুদ্ধাচারণ করি না। ... যে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান অস্পষ্ট সে সম্বন্ধে আমরা বলি: ‘‘আল্লাহই এ বিষয়ে সর্বাধিক জানেন।’’[6]
[1] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[2] সূরা (৪) নিসা: ১৬৪ আয়াত।
[3] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[4] সূরা (৭৪) মুদ্দাস্সির: ২৫ ও ২৬ আয়াত।
[5] তাহাবী, ইমাম আবূ জাফর, আল-আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৯।
[6] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩ ও পৃষ্ঠা ৮২।
৬. আল্লাহর হস্ত, মুখমন্ডল, সত্তা, ক্রোধ, সন্তুষ্টি
এ পরিচ্ছেদের শুরুতে ইমাম আযমের বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে: ‘‘তিনি ‘শাইউন’: ‘বস্ত্ত’ বা ‘বিদ্যমান অস্তিত্ব’, তবে অন্য কোনো সৃষ্ট ‘বস্ত্ত’ বা ‘বিদ্যমান বিষয়ের’ মত তিনি নন। তাঁর ‘শাইউন’- ‘বস্ত্ত’ হওয়ার অর্থ তিনি বিদ্যমান অস্তিত্ব, কোনো দেহ, কোনো জাওহার (মৌল উপাদান) এবং কোনো ‘আরায’ (অমৌল উপাদান) ব্যতিরেকেই। তাঁর কোনো সীমা নেই, বিপরীত নেই, সমকক্ষ নেই, তুলনা নেই। ‘‘অতএব তোমরা কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।’’ তাঁর ইয়াদ (হাত) আছে, ওয়াজহ (মুখমন্ডল) আছে, নফস (সত্তা) আছে, কারণ আল্লাহ কুরআনে এগুলো উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ যা কিছু উল্লেখ করেছেন, যেমন মুখমন্ডল, হাত, নফস ইত্যাদি সবই তাঁর বিশেষণ, কোনো ‘স্বরূপ’ বা প্রকৃতি নির্ণয় ব্যতিরেকে। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ক্ষমতা অথবা তাঁর নিয়ামত। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর বিশেষণ বাতিল করা। এরূপ ব্যাখ্যা করা কাদারিয়া ও মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের রীতি। বরং তাঁর হাত তাঁর বিশেষণ, কোনো স্বরূপ বা প্রকৃতি নির্ণয় ব্যতিরেকে। তাঁর ক্রোধ এবং তাঁর সন্তুষ্টি তাঁর দুটি বিশেষণ, আল্লাহর অন্যান্য বিশেষণের মতই, কোনো ‘কাইফ’ বা ‘কিভাবে’ প্রশ্ন করা ছাড়াই।’’
এ বক্তব্যে তিনি মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নিমেণাক্ত মূলনীতিগুলো উল্লেখ করেছেন:
৭. আল্লাহর সিফাত: অস্তিত্ব, স্বরূপ ও তুলনা
আল্লাহর বিশেষণসমূহের বিষয়ে মুশাবিবহা ও জাহমী সম্প্রদায়ের প্রান্তিকতার বিষয় আমরা জেনেছি। মুশাবিবহা সম্প্রদায়ের যুক্তি নিম্নরূপ: (১) কুরআন-হাদীসের বক্তব্য অনুসারে মহান আল্লাহর শ্রবণ, দর্শন, অবস্থান, হস্ত, চক্ষু, মুখমন্ডল ইত্যাদি বিদ্যমান। (২) মানুষের মধ্যেও এগুলো বিদ্যমান (৩) এ সকল বিশেষণের স্বরূপ ও প্রকৃতি আল্লাহর ক্ষেত্রেও অবশ্যই মানুষের মতই। (৪) কাজেই মহান আল্লাহ মানুষের মতই দেহধারী এবং বিশেষণধারী। তারা ‘কোনো কিছুই আল্লাহর মত নয়’ মর্মের আয়াতগুলিকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দেন।
জাহমিয়্যাহ-মু’তাযিলাদের যুক্তি নিম্নরূপ: (১) মানুষের শ্রবণ, দর্শন, হস্ত, চক্ষু, মুখমন্ডল ইত্যাদি রয়েছে। (২) এ সকল বিশেষণের স্বরূপ আল্লাহর ক্ষেত্রেও অবশ্যই মানুষের মতই হতে হবে। (৩) আল্লাহর এ সকল বিশেষণ আছে বলে বিশ্বাস করার একমাত্র অর্থ তাঁকে মানুষের সাথে তুলনীয় বলে বিশ্বাস করা। (৪) আল্লাহর অতুলনীয়ত্ব সমুন্নত রাখতে এ সকল বিশেষণ অস্বীকার, ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থে বিশ্বাস করা ফরয।
তাদের মতে আল্লাহর হাত অর্থ আল্লাহর ক্ষমতা বা নিয়ামত। আল্লাহর মুখমন্ডল অর্থ আল্লাহর অস্তিত্ব বা সত্তা। ক্রোধ ও সন্তুষ্টি মানসিক পরিবর্তন, আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বুঝায়। মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এগুলি প্রযোজ্য নয়। আল্লাহর ক্রোধ অর্থ শাস্তির ইচ্ছা, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্থ পুরস্কারের ইচ্ছা.... ইত্যাদি। এভাবে তারা আল্লাহর ‘অতুলনীয়ত্বে’ বিশ্বাস করার নামে আল্লাহর ওহীকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যা ব্যাখ্যা করেন নি, তা ব্যাখ্যা করাকে তারা দীনের জন্য জরুরী বানিয়েছে। কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য সরল অর্থে বিশ্বাস করাকে কুফরী বলে দাবি করেছে!
সাহাবীগণ ওহীর এ সকল নির্দেশনা সরল অর্থে বিশ্বাস করেছেন। তাঁরা ওহীর মধ্যে কোনো বৈপরীত্য কল্পনা করেন নি। কারণ আল্লাহর বিশেষণকে সৃষ্টজীবের বিশেষণের সাথে তুলনা করলেই বৈপরীত্যের কল্পনা আসে। ওহীর উভয় শিক্ষাকে আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করলে কোনো বৈপরীত্য থাকে না। এ মতের যুক্তি নিম্নরূপ:
(১) আল্লাহর বিশেষণ ও অতুলনীয়ত্ব উভয়ই ওহীর মাধ্যমে জ্ঞাত বিষয়। (২) বিশেষণের প্রকৃতি ও স্বরূপ অজ্ঞাত। (৩) অজ্ঞাত বিষয়ের অজুহাতে ওহীর জ্ঞাত বিষয় ব্যাখ্যা বা অস্বীকার করার অর্থ ওহীকে অস্বীকার করা। (৪) এজন্য অজ্ঞাত বিষয়কে অজ্ঞাত রেখে বিশেষণ ও অতুলনীয়ত্ব উভয় জ্ঞাত বিষয় বিশ্বাস করতে হবে।
মহান স্রষ্টার জন্য তাঁর মর্যাদার সাথে সুসমঞ্জস ও সৃষ্টির সাথে অতুলনীয় হস্ত, মুখমণ্ডল, সত্তা, ক্রোধ, সন্তুষ্টি ইত্যাদি বিশেষণ থাকা মানবীয় বুদ্ধির সাথে কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক নয়। যেহেতু তাঁর সৃষ্টির সাথে অতুলনীয় অস্তিত্ব আছে কাজেই তাঁর অস্তিত্বের সাথে সুসামঞ্জস্য অতুলনীয় বিশেষণাদি থাকাই স্বাভাবিক। আহলুস সুন্নাত এক্ষেত্রে দুটি মূলনীতি অনুসরণ করেছেন: (ক) ওহীর বক্তব্য বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করা এবং (খ) সাহাবীগণের অনুসরণ করা। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফার উপরের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ শাইখ আহমদ ইবন মুহাম্মাদ মাগনীসাবী (১০০০ হি) বলেন:
أصلها معلوم ووصفها مجهول لنا، فلا يبطل الأصل المعلوم بسبب التشابه والعجز عن
إدراك الوصف... قال الشيخ الإمام فخر الإسلام علي البزدوي في أصول الفقه: وكذلك
إثبات اليد والوجه عندنا معلوم بأصله متشابه بوصفه، ولن يجوز إبطال الأصل بالعجز
عن إدراك الوصف. وإنما ضلت المعتزلة من هذا الوجه؛ فإنهم ردوا الأصول لجهلهم
بالصفات
‘‘এ সকল বিশেষণের মূল অর্থ জ্ঞাত কিন্তু এগুলোর বিবরণ বা ব্যাখ্যা আমাদের অজ্ঞাত। জ্ঞাত মূল বিষয়টি বিবরণের অস্পষ্টতা বা তা জানতে অক্ষম হওয়ার কারণে বাতিল করা যায় না। ইমাম ফাখরুল ইসলাম আলী (ইবন মুহাম্মাদ) বাযদাবী (৪৮২ হি) ‘উসূলুল ফিকহ’ গ্রন্থে বলেন: হাত ও মুখমণ্ডল বিশ্বাস করা আমাদের নিকট তার মূল অর্থে জ্ঞাত কিন্তু তার বিবরণে দ্ব্যার্থবোধক বা অস্পষ্ট। বিবরণ জানতে অক্ষমতার কারণে মূল বিষয় বাতিল করা বৈধ নয়। এ দিক থেকেই মুতাযিলীগণ বিভ্রান্ত হয়েছে। বিবরণ বা ব্যাখ্যা না জানার কারণে তারা মূল বিষয়ই প্রত্যাখ্যান করেছে।’’[1]
মুতাযিলা-জাহমিয়াগণ সাধারণত আহলুস্ সুন্নাত-কে মুশাবিবহা (তুলনাকারী) বা মুজাসসিমা (দেহেবিশ্বাসী) বলে অপবাদ দেন। তাদের দাবি, মহান আল্লাহর হাত, মুখমন্ডল, চক্ষু, আরশের ঊর্ধ্বে থাকা ইত্যাদির কথা কুরআন-হাদীসে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেভাবে বিশ্বাস করার অর্থই তাঁকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করা এবং তাঁকে ‘দেহবিশিষ্ট’ বলে দাবী করা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন যে, আহলুস সুন্নাত এগুলোকে বিশেষণ হিসেবে বিশ্বাস করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, এগুলো কোনোভাবে সৃষ্টির কোনো বিশেষণের সাথে তুলনীয় নয়। এগুলোর প্রকৃতি আমরা জানি না এবং জানতে চেষ্টা করি না। তাঁরা তুলনা অস্বীকার করেন, কারণ আল্লাহ তুলনা অস্বীকার করেছেন, কিন্তু তাঁরা তুলনা অস্বীকারের নামে মূল বিশেষণ অস্বীকার বা ব্যাখ্যা করেন না, কারণ মহান আল্লাহই এ সকল বিশেষণ উল্লেখ করেছেন। তাঁকে কি বিশেষণে বিশেষিত করলে তাঁর মর্যাদা রক্ষা হয় তা তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন।
[1] মাগনীসাবী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ১৩-১৪; বাযদাবী, উসূলুল বাযদাবী, পৃষ্ঠা ১০।
৮. মহান আল্লাহর আরো দুটি বিশেষণ / ৮. ১. আরশের উপর ইসতিওয়া
৮. ১. আরশের উপর ইসতিওয়া
উপরে ইমাম আযম আল্লাহর কথা, হাত, মুখমন্ডল, ইত্যাদি বিশেষণ আলোচনা করেছেন। মহান আল্লাহর আরেকটি বিশেষণ আরশের উপর অধিষ্ঠান। কুরআনে সাত স্থানে বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ আরশের উপর ‘ইসতিওয়া’ করেছেন।[1] আরবীতে কোনো কিছুর উপর ‘ইসতিওয়া’ অর্থ তার ঊর্ধ্বে অবস্থান (rise over, mount, settle)। সালাতের নিষিদ্ধ সময় বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একজন প্রশ্নকারীকে বলেন:
حَتَّى تَسْتَوِىَ الشَّمْسُ عَلَى رَأْسِكَ كَالرُّمْحِ ، فَإِذَا اسْتَوَتْ
عَلَى رَأْسِكَ كَالرُّمْحِ فَدَعِ الصَّلاَةَ
‘‘(সালাত বৈধ থাকবে) যতক্ষণ না সূর্য তোমার মাথার উপরে তীরের মত ইসতিওয়া (ঊর্ধ্বে অবস্থান) করবে। যখন সূর্য তোমার মাথার উপর তীরের মত ইসতিওয়া (ঊর্ধ্বে অবস্থান) করবে তখন সালাত পরিত্যাগ করবে।’’[2] আমরা এ বইয়ে ‘ইসতিওয়া’-র অনুবাদে উপরে অবস্থান বা অধিষ্ঠান শব্দ ব্যবহার করব, ইনশা আল্লাহ।
জাহমী-মুতাযিলীগণ এ বিশেষণ অস্বীকার করেছেন। তারা দাবি করেন, আরশের উপরে অধিষ্ঠান বা স্থিতি গ্রহণ কোনোভাবেই মহান আল্লাহর বিশেষণ হতে পারে না; কারণ মহান আল্লাহর জন্য এভাবে অবস্থান পরিবর্তন বা কোনো কিছুর উপরে স্থিতি গ্রহণের মত মানবীয় কর্ম অশোভনীয় এবং তাঁর অতুলনীয়ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। এছাড়া মহান আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি বান্দার সাথে ও নিকটে।[3] কাজেই তিনি আরশের উপর থাকতে পারেন না। বরং তাঁরা দাবি করেন যে, মহান আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান; তাঁকে কোনো স্থান বা দিকে সীমাবদ্ধ করা তাঁর অতুলনীয়ত্বের পরিপন্থী। তারা দাবি করেন, আরশে অধিষ্ঠান গ্রহণের অর্থ আরশের নিয়ন্ত্রণ, দখল বা ক্ষমতা গ্রহণ।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকেই তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী ইমামগণ এবং পরবর্তী মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ জাহমীগণের এ মত কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং একে কুরআন অস্বীকার বলে গণ্য করেছেন। এ বিষয়ে তাঁরা উপরের মূলনীতি অনুসরণ করেছেন। মহান আল্লাহর আরশের উপরে অবস্থান বা আরশের ঊর্ধ্বে থাকার বিশেষণটি কুরআন ও হাদীস দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত। তবে এর প্রকৃতি ও স্বরূপ অজ্ঞাত। অজ্ঞাতকে অজ্ঞাত রেখে কুরআনের অন্যান্য বক্তব্যের ন্যায় এ বক্তব্যও স্বীকার ও বিশ্বাস করা মুমিনের জন্য জরুরী। তাঁরা বলেন: মহান আল্লাহ আরশের উপর অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। তাঁর এ অধিষ্ঠান বা অবস্থানের স্বরূপ আমরা জানি না এবং জানতে চেষ্টাও করি না। বরং বিশ্বাস করি যে, তাঁর এ অধিষ্ঠান কোনোভাবেই কোনো সৃষ্টির বিশেষণ বা কর্মের মত নয়। তাঁর অতুলনীয়ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান তিনি গ্রহণ করেন।
যখন মানুষ কল্পনা করে যে, মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মতই; তিনি একই সাথে আরশের উপরে এবং বান্দার নিকটবর্তী হতে পারেন না- তখনই কুরআনের এ দুটি নির্দেশনার মধ্যে বৈপরীত্য আছে বলে কল্পনা হয়। মূল বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মহান আল্লাহ সৃষ্টির মত নন। কাজেই নৈকট্য ও ঊর্ধ্বত্ব উভয়কে সমানভাবে বিশ্বাস করে এর স্বরূপ ও প্রকৃতি আল্লাহর উপর ন্যস্ত করলে কুরআনের সকল নির্দেশনা বিশ্বাস ও মান্য করা হয়। আর নৈকট্যের অজুহাতে তাঁকে সর্বত্র বিরাজমান বলে দাবি করলে, তিনি কোথায় আছেন তা জানি না বলে দাবি করলে, আরশ কোথায় তা জানি না বলে দাবি করলে বা তাঁর আরশের উপর অধিষ্ঠানের আয়াতগুলো ব্যাখ্যার নামে অস্বীকার করলে কুরআন ও হাদীসের অগণিত বক্তব্য অস্বীকার করা হয়, যা কুফরীর নামান্তর।
ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ তাঁর ‘ওসীয়াত’ গ্রন্থে লিখেছেন:
نُقِرُّ بِأَنَّ اللهَ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى، مِنْ غَيْرِ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ
حَاجَةٌ إِلَيْهِ وَاسْتِقْرَارٌ عَلَيْهِ، وَهُوَ الْحَافِظُ لِلْعَرْشِ وَغَيْرِ
الْعَرْشِ، فَلَوْ كَانَ مُحْتَاجاً إِلَيْهِ لَمَا قَدِرَ عَلَى إِيْجَادِ
الْعَالَمِ وَتَدْبِيْرِهِ كَالْمَخْلُوْقِين، وَلَوْ صَارَ مُحْتَاجاً إِلَى
الْجُلُوْسِ وَالْقَرَارِ فَقَبْلَ خَلْقِ الْعَرْشِ أَيْنَ كَانَ اللهُ تَعَالَى؟
فَهُوَ مُنَزَّهٌ عَنْ ذَلِكَ عُلُوًّا كَبِيْراً.
‘‘আমরা স্বীকার ও বিশ্বাস করি যে, মহান আল্লাহ আরশের উপর অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন, আরশের প্রতি তাঁর কোনোরূপ প্রয়োজন ব্যতিরেকে এবং আরশের উপরে স্থিরতা-উপবেশন ব্যতিরেকে। তিনি আরশ ও অন্য সবকিছুর সংরক্ষক। তিনি যদি আরশের মুখাপেক্ষী হতেন তাহলে বিশ্ব সৃষ্টি করতে ও পরিচালনা করতে পারতেন না, বরং তিনি মাখলূকের মত পরমুখাপেক্ষী হতেন। আর যদি তাঁর আরশের উপরে উপবেশন করার প্রয়োজনীয়তা থাকে তবে আরশ সৃষ্টির পূর্বে তিনি কোথায় ছিলেন? কাজেই আল্লাহ এ সকল বিষয় থেকে পবিত্র ও অনেক অনেক ঊর্ধ্বে।’’[4]
ইমাম আযমের এ বক্তব্য উল্লেখ করে মোল্লা আলী কারী হানাফী বলেন: ‘‘এ বিষয়ে ইমাম মালিক (রাহ) খুবই ভাল কথা বলেছেন। তাঁকে আল্লাহর আরশের উপরে ইসিতিওয়া বা অধিষ্ঠান বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:
اَلاِسْتِوَاءُ مَعْلُوْمٌ وَالْكَيْفُ مَجْهُوْلٌ وَالسُّؤَالُ عَنْهُ بِدْعَةٌ
وَالإِيْمَانُ بِهِ وَاجِبٌ
‘‘ইসতিওয়া বা অধিষ্ঠান পরিজ্ঞাত, এর পদ্ধতি বা স্বরূপ অজ্ঞাত, এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ‘আত এবং এ বিষয় বিশ্বাস করা জরুরী।’’[5]
ইমাম সায়িদ নাইসাপূরী হানাফী বলেন:
حكي عن أبي حنيفة في رسالته إلى مقاتل بن سليمان جواب كتابه، في فصل منها: وأما
قوله تعالى على العرش استوى حقا، فإنّما ننتهي من ذلك إلى ما وصف كتابُ ربنا في
قوله تعالى (ثم استوى على العرش)، وتَعْلَمَنَّ أنه كما قال، ولا ندعي في استوائه
على العرش علما، ونزعم أنه قد استوى، ولا يشبه استواؤه باستواء الخلق، فهذا قولنا
في الاستواء على العرش.
‘‘ইমাম আবূ হানীফা থেকে বর্ণিত, তিনি (তাঁর সমসাময়িক দেহে বিশ্বাসী মুফাস্সির) মুকাতিল ইবন সুলাইমান (১৫০ হি)-এর পত্রের উত্তরে লেখা তাঁর পত্রের একটি অনুচ্ছেদে লিখেন: ‘মহান আল্লাহ বলেছেন: তিনি আরশের উপর ইসিতওয়া (অধিষ্ঠান বা অবস্থান) গ্রহণ করেছেন। সত্যই তিনি তা করেছেন। আমাদের রবের কিতাব এ বিষয়ে যা বর্ণনা করেছেন সেখানেই আমরা থেমে যাই। আল্লাহ বলেছেন: ‘অতঃপর তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠান গ্রহণ করলেন।’ আপনি নিশ্চিত জানুন যে, তিনি যা বলেছেন বিষয়টি তা-ই। আমরা তাঁর অধিষ্ঠান বিষয়ে কোনো জ্ঞানের দাবি করি না। আমরা মনে করি তিনি অধিষ্ঠান গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর অধিষ্ঠান সৃষ্টির অধিষ্ঠানের অনুরূপ বা তুলনীয় নয়। আরশের উপর অধিষ্ঠানের বিষয়ে এটিই আমাদের বক্তব্য।’’[6]
আমরা বলেছি, মহান আল্লাহর আরশের ঊর্ধ্বে থাকা অস্বীকার করার জন্য জাহমী-মুতাযিলীগণ তাঁর নৈকট্য বিষয়ক আয়াতগুলোকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে দাবি করতেন যে, তিনি আত্মার মত বা বাতাসের মত। আত্মা যেমন দেহের সর্বত্র বিদ্যমান এবং বাতাস যেমন পৃথিবীর সর্বত্র বিদ্যমান তেমনি মহান আল্লাহ সৃষ্টি জগতের সর্বত্র বিরাজমান। এভাবে তাঁরা আল্লাহকে অতুলনীয় বলে প্রমাণ করার দাবিতে তাঁকে আত্মা ও বাতাসের সাথে তুলনা করতেন। উপরন্তু তারা তাঁকে সৃষ্টির অংশ বানিয়ে ফেলেন। বিশ্বজগত সৃষ্টির পূর্বে মহান আল্লাহ তাঁর অনাদি সত্তায় বিদ্যমান ছিলেন। তিনি তাঁর সত্তার বাইরে ও নিম্নে বিশ্বজগত সৃষ্টি করেন। তাঁর সত্তা বিশ্বজগতের সর্বত্র বিরাজমান বলার অর্থ একথা দাবি করা যে, মহান আল্লাহ বিশ্ব জগতকে তাঁর সত্তার অভ্যন্তরে সৃষ্টি করেছেন!! অথবা বিশ্ব জগত সৃষ্টির পরে তিনি এর অভ্যন্তরে সর্বত্র প্রবেশ করেছেন!!! এগুলো সবই মহান আল্লাহর নামে ওহী-বহির্ভুত বানোয়াট অশোভনীয় ধারণা।
আল্লাহর সত্তা যেমন সৃষ্টির মত নয়, তেমনি তাঁর বিশেষণাবলিও সৃষ্টির মত নয়। সকল মানবীয় কল্পনার ঊর্ধ্বে তাঁর সত্তা ও বিশেষণ। কাজেই মহান আল্লাহর আরশের উপরে অধিষ্ঠান এবং বান্দার নৈকট্য উভয়ই সত্য এবং মুমিন উভয়ই বিশ্বাস করেন। উভয়ের মধ্যে বৈপরীত্য কল্পনা করা মানবীয় সীমাবদ্ধতার ফসল। তদুপরি জাহমীদের এ বিভ্রান্তি দূর করতে ইমামগণ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম মালিক বলেন:
الله في السماء وعلمه في كل مكان لا يخلو من علمه مكان
‘‘আল্লাহ আসমানে (ঊর্ধ্বে) এবং তাঁর জ্ঞান সকল স্থানে। কোনো স্থানই মহান আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নয়।’’[7]
ইমাম আযম আবূ হানীফা থেকেও অনুরূপ বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন ইমাম বাইহাকী।[8] এ প্রসঙ্গে পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মালিকী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবন আব্দুল বার্র ইউসুফ ইবন আব্দুল্লাহ (৪৬৩ হি) বলেন:
علماء الصحابة والتابعين الذين حملت عنهم التآويل في القرآن قالوا في تأويل هذه
الآية هو على العرش وعلمه في كل مكان وما خالفهم في ذلك أحد يحتج بقوله
‘‘সাহাবী-তাবিয়ী আলিমগণ, যাদের থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়েছে, তারা এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, তিনি আরশের উপরে এবং তাঁর জ্ঞান সর্বত্র। দলিল হিসেবে গ্রহণ করার মত একজন আলিমও তাঁদের এ মতের বিরোধিতা করেন নি।’’[9]
ইমামদ্বয়ের বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট যে, ‘ইসতিওয়া’ শব্দটিকে তাঁরা সাধারণ আরবী অর্থেই গ্রহণ করেছেন। মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এ শব্দটির অর্থ অস্পষ্ট, দ্ব্যর্থবোধক, মুতাশাবিহ, রূপক বা অজ্ঞাত বলে দাবি করেন নি। বরং তাঁরা বলেছেন যে, এ শব্দটির অর্থ ‘জ্ঞাত বিষয়’, এর মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা, রূপকতা বা দ্ব্যর্থতা নেই। অর্থাৎ আরবী ভাষায় অন্যন্য সকল ক্ষেত্রে ‘ইসতিওয়া আলা’ বলতে যা বুঝানো হয় এখানেও সেই অর্থই গ্রহণ করতে হবে, অর্থাৎ ঊর্ধ্বত্ব। এখানে অর্থটি রূপক বা অজ্ঞাত বলে দাবি করার সুযোগ নেই। তবে ইসতিওয়ার স্বরূপ বা ব্যাখ্যা অজ্ঞাত (মুতাশাবিহ)। এ অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে জ্ঞাত বিষয়কে বিশ্বাস করাই মুমিনের দায়িত্ব।
কুরআন কয়েকটি বিষয় আমাদেরকে জানায়: (১) মহান আল্লাহ অনাদি অনন্ত, কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন এবং সবই তাঁর মুখাপেক্ষী, (২) মহান আল্লাহ কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন, (৩) মহান আল্লাহ সৃষ্টির এক পর্যায়ে আরশ সৃষ্টি করেন এবং আরশের উপর অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন এবং (৪) মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার নিকটবর্তী।
সাহাবীগণ বিষয়গুলো সবই সরল অর্থে বিশ্বাস করেছেন এবং এ বিষয়ে কোনো বৈপরীত্য অনুভব করেন নি। কারণ আল্লাহর অমুখাপেক্ষী হওয়া, অতুলনীয় হওয়া, নিকটবর্তী হওয়া এবং আরশের উপর অধিষ্ঠিত হওয়া কোনোটিই মানবীয় বুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক নয় বা অসম্ভব নয়। কাজেই ওহীর মাধ্যমে যা আল্লাহ জানিয়েছেন তা নিয়ে বিতর্ক করা বিভ্রান্তি বৈ কিছুই নয়। সমস্যার শুরু হয় যখন মানুষ এগুলোর গভীর স্বরূপ সন্ধানে ব্যস্ত হয়। আল্লাহ যদি অমুক্ষাপেক্ষী হন তাহলে আরশের ঊর্ধ্বে অধিষ্ঠানের দরকার কি? আরশের ঊর্ধ্বে অধিষ্ঠান গ্রহণ না করলে এ কথা বারবার বলার দরকার কী? অধিষ্ঠান অর্থ যদি ক্ষমতা গ্রহণ হয় তবে কাকে হটিয়ে তিনি ক্ষমতা দখল করলেন? শুধু আরশের ক্ষমতা গ্রহণের অর্থ কী? এরূপ জিজ্ঞাসা মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
এসবের সহজ সমাধান ওহীর সবগুলো বিষয় সরলভাবে বিশ্বাস করা। মহান আল্লাহ বলেছেন তিনি অমুক্ষাপেক্ষী ও অতুলনীয় এবং তিনিই বলেছেন তিনি আরশের ঊর্ধ্বে অধিষ্ঠান করেছেন। এ থেকে আমরা বুঝি যে, কোনোরূপ মুখাপেক্ষিতা বা প্রয়োজন ছাড়াই আল্লাহ তা করেছেন এবং তাঁর এ বিশেষণ কোনোভাবেই কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নয়। তবে কেন করেছেন, কিভাবে করেছেন বা এর স্বরূপ কী তা তিনি আমাদের বলেন নি। এগুলি নিয়ে প্রশ্ন করা বা উত্তরের সন্ধান করা দীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবন বা বিদ‘আত। কারণ সাহাবীগণ কখনো এরূপ প্রশ্ন বা উত্তর সন্ধান করেন নি।
ইমাম আবূ হানীফা উল্লেখ করেছেন যে, মানবীয় সহজাত প্রকৃতিই মহান আল্লাহর ঊর্ধ্বত্ব প্রমাণ করে। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহকে ডাকতে ঊর্ধ্বমুখি হয়। এছাড়া হাদীসে এ ঊর্ধ্বত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি বলেন:
مَنْ قَالَ لاَ أَعْرِفُ رَبِّيْ فِيْ السَّمَاءِ أَوْ فِيْ الأَرْضِ فَقَدْ
كَفَرَ وَكَذَا مَنْ قَالَ إَنَّهُ عَلَى الْعَرْشِ وَلاَ أَدْرِيْ الْعَرْشَ
أَفِيْ السَّمَاءِ أَوْ فِيْ الأَرْضِ لأَنَّ اللهَ يَقُوْلُ: الرَّحْمَنُ عَلَى
الْعَرْشِ اسْتَوَى وَاللهُ تَعَالَى يُدْعَى مِنْ أَعْلَى لاَ مِنْ أَسْفَلَ
لَيْسَ مِنْ وَصْفِ الرُّبُوْبِيَّةِ وَالأُلُوْهِيَّةِ فِيْ شَيْءٍ وَعَلَيْهِ
مَا رُوِىَ فِيْ الْحَدِيْثِ أَنَّ رَجُلاً أَتَى إِلَى النَّبِيِّ ﷺ بِأَمَةٍ
سَوْدَاءَ فَقَالَ: وَجَبَ عَلَيَّ عِتْقُ رَقَبَةٍ، أَفَتُجْزِئُ هَذِهِ؟ فَقَالَ
لَهَا النَّبِيُّ ﷺ: أَمُؤْمِنَةٌ أَنْتِ؟ فَقَالَتْ: نَعَمْ. فَقَالَ: أَيْنَ اللهُ
فَأَشَارَتْ إِلَى السَّمَاءِ. فَقَالَ: اعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ.
‘‘যদি কেউ বলে যে, ‘আমার রবব আকাশে না পৃথিবীতে তা আমি জানি না’ তবে সে কাফির হয়ে যাবে। যদি কেউ বলে যে, ‘তিনি আরশের উপরে, কিন্তু আরশ কোথায়- আসমানে না যমিনে- তা আমি জানি না’ তবে সেও অনুরূপ। কারণ আল্লাহ বলেছেন: ‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমাসীন’। মহান আল্লাহকে ডাকতে হয় ঊর্ধে, নিম্নে নয়। নিম্নে থাকা রুবূবিয়্যাত বা উলূহিয়্যাতের কোনো বিশেষত্ব নয়। আর এ অর্থেই হাদীসে বর্ণিত হয়েছে[10]: এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট একটি কাফ্রী দাসীকে নিয়ে আগমন করে বলে যে, তাকে একটি দাস মুক্ত করতে হবে। এ দাসীকে মুক্ত করলে কি তার দায়িত্ব পালন হবে? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উক্ত দাসীকে বলেন, তুমি কি ঈমানদার? সে বলে: হ্যাঁ। তিনি বলেন: আল্লাহ কোথায়? সে আসমানের দিকে ইশারা করে। তখন তিনি বলেন: একে মুক্ত করে দাও, এ নারী ঈমানদার।’’[11]
আকীদা তাহাবিয়ার ব্যাখ্যায় ইবন আবীল ইজ্জ হানাফী বলেন: ‘‘শাইখুল ইসলাম আবূ ইসমাঈল আনসারী (৪৮১ হি) তাঁর ‘‘আল-ফারূক’’ গ্রন্থে আবূ মুতী বালখী পর্যন্ত সনদে উদ্ধৃত করেছেন, আবূ মুতী বলেন, আবূ হানীফাকে (রাহ) প্রশ্ন করলাম: যে ব্যক্তি বলে, আমার রবব আসমানে না যমীনে তা আমি জানি না, তার বিষয়ে আপনার মত কি? তিনি বলেন: এ ব্যক্তি কাফির। কারণ আল্লাহ বলেছেন: ‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমাসীন’[12], আর তাঁর আরশ সপ্ত আসমানের উপরে। আমি (আবু মুতী) বললাম: যদি সে বলে, তিনি আরশের উপরে, কিন্তু সে বলে: আরশ কি আসমানে না যমীনে তা আমি জানি না, তাহলে কি হবে? তিনি (আবূ হানীফা) বলেন: তাহলেও সে কাফির। কারণ সে তাঁর আসমানে বা ঊর্ধে হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে, আর যে ব্যক্তি তাঁর ঊর্ধ্বত্ব অস্বীকার করবে সে কাফির। ...।’’[13]
ইসতিওয়া ও অন্যান্য বিশেষণ বিষয়ে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের মূলনীতি ও আকীদা ব্যাখ্যা করে আবূ বাকর খাল্লাল আহমদ ইবন মুহাম্মাদ (৩১১ হি) বলেন:
وكان يقول إن الله عز وجل مستو على العرش المجيد ... وكان يقول في معنى الاستواء
هو العلو والارتفاع ولم يزل الله تعالى عاليا رفيعا قبل أن يخلق عرشه فهو فوق كل
شيء والعالي على كل شيء وإنما خص الله العرش لمعنى فيه مخالف لسائر الأشياء والعرش
أفضل الأشياء وأرفعها فامتدح الله نفسه بأنه على العرش أستوى أي عليه علا ولا يجوز
أن يقال أستوى بمماسة ولا بملاقاة تعالى الله عن ذلك علوا كبيرا والله تعالى لم
يلحقه تغير ولا تبدل ولا تلحقه الحدود قبل خلق العرش ولا بعد خلق العرش. وكان ينكر
على من يقول إن الله في كل مكان بذاته لأن الأمكنة كلها محدودة وحكي عن عبد الرحمن
بن مهدي عن مالك أن الله تعالى مستو على عرشه المجيد كما أخبر وأن علمه في كل مكان
ولا يخلوا شيء من علمه وعظم عليه الكلام في هذا واستبشعه.
ইমাম আহমদ বলতেন, মহান আল্লাহ আরশের উপর অধিষ্ঠিত। ... অধিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ তিনি এর ঊর্ধ্বে। মহান আল্লাহ আরশ সৃষ্টির পূর্ব থেকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে এবং সকল কিছুর উপরে। এখানে আরশকে উল্লেখ করার কারণ আরশের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অন্য কোনো কিছুর মধ্যে নেই। তা হলো আরশ সবচেয়ে মর্যাদাময় সৃষ্টি এবং সব কিছুর ঊর্ধ্বে। মহান আল্লাহ নিজের প্রশংসা করে বলেছেন যে, তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠিত, অর্থাৎ তিনি আরশের ঊর্ধ্বে। আরশের উপরে অধিষ্ঠানের অর্থ আরশ স্পর্শ করে অবস্থান করা নয়। মহান আল্লাহ এরূপ ধারণার অনেক ঊর্ধ্বে। আরশ সৃষ্টির পূর্বে এবং আরশ সৃষ্টির পরে মহান আল্লাহ একই অবস্থায় রয়েছেন; কোনোরূপ পরিবর্তন তাঁকে স্পর্শ করে নি, কোনো গন্ডি বা সীমা তাঁকে সীমায়িত করতে পারে না। যারা বলেন যে, মহান আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান তাদের কথা তিনি অস্বীকার ও প্রতিবাদ করতেন। কারণ সকল স্থানই গন্ডি বা সীমায় আবদ্ধ। তিনি আব্দুর রাহমান ইবন মাহদী থেকে, তিনি ইমাম মালিক থেকে উদ্ধৃত করতেন: মহান আল্লাহ মহা-পবিত্র আরশের ঊর্ধ্বে সমাসীন এবং তাঁর জ্ঞান-ইলম সর্বত্র বিদ্যমান। কোনো স্থানই তাঁর জ্ঞানের আওতার বাইরে নয়। আল্লাহর সর্বত্র বিরাজমান কথাটি ইমাম আহমদ ঘৃণ্য বলে গণ্য করতেন।[14]
ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:
وَتَعَالَى عَنِ الْحُدُودِ وَالْغَايَاتِ، وَالأَرْكَانِ وَالأَعْضَاءِ
وَالأَدَوَاتِ، لا تَحْوِيهِ الْجِهَاتُ السِّتُّ كَسَائِرِ الْمُبْتَدَعَاتِ.
.... وَالْعَرْشُ وَالْكُرْسِيُّ حَقٌّ، وَهُوَ مُسْتَغْنٍ عَنِ الْعَرْشِ وَمَا
دُونَهُ، مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ
‘‘আল্লাহ্ তা’আলা সীমা-পরিধি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও উপাদান-উপকরণের বহু ঊর্ধ্বে। যাবতীয় উদ্ভাবিত সৃষ্ট বস্ত্তর ন্যায় তাঁকে ষষ্ঠ দিক পরিবেষ্টন করতে পারে না। আল্লাহর আরশ ও কুরসী (আসন) সত্য। আরশ ও তার নীচে যা কিছু বিদ্যমান সব কিছু থেকে তিনি অমুখাপেক্ষী। তিনি সকল কিছুকে পরিবেষ্টনকারী এবং সকল কিছুর ঊর্ধ্বে।’’[15]
অর্থাৎ তিনি তাঁর সৃষ্ট দিক, স্থান ও সীমার ঊর্ধ্বে। তবে সৃষ্টির সীমা যেখানে শেষ তার ঊর্ধ্বে তাঁর মহান আরশ। আরশ সকল সৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে বিদ্যমান। তিনি তারও ঊর্ধ্বে। কাজেই তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে এবং সকল কিছুকে পরিবেষ্টনকারী।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী বলেন:
وهو فوق العرش كما وصف نفسه، لكن لا بمعنى التحيز ولا الجهة، بل لا يعلم كنه هذا
التفوق والاستواء إلا هو...
‘‘তিনি আরশের ঊর্ধ্বে, যেভাবে তিনি নিজের বিষয়ে বলেছেন। এর অর্থ কোনো দিক বা স্থানে সীমাবদ্ধ হওয়া নয়। বরং এ ঊর্ধ্বত্বের এবং অধিষ্ঠানের প্রকৃতি তিনি ছাড়া কেউ জানে না...।’’[16]
[1] সূরা (৭) আ’রাফ ৫৪ আয়াত; সূরা (১০) ইউনূস: ৩ আয়াত; সূরা (১৩) রা’দ: ২ আয়াত; সূরা (২০) তাহা: ৫ আয়াত; সূরা (২৫) ফুরকান: ৫৯ আয়াত; সূরা (৩২) সাজদা: ৪ আয়াত; সূরা (৫৭) হাদীদ: ৪ আয়াত।
[2] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ২/৪৫৫; ইবন মাজাহ, আস-সুনান ১/৩৯৭। হাদীসটি সহীহ।
[3] সূরা (২) বাকারা: ১৫৩, ১৮৬, ১৯৪ আয়াত; সূরা (৪) নিসা: ১০৮ আয়াত; সূরা (৮) আনফাল: ১৯, ৪৬ আয়াত; সূরা (৯) তাওবা: ৩৬, ১২৩ আয়াত; সূরা (১১) হূদ: ৬১ আয়াত; সূরা (১৬) নাহল: ১২৮ আয়াত; সূরা (৩৪) সাবা: ৫০ আয়াত; সূরা (৫০) কাফ: ১৬ আয়াত; সূরা (৫৭) হাদীদ: ৪ আয়াত; সূরা (৫৮) মুজাদালা: ৭ আয়াত।
[4] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ওয়াসিয়্যাহ, পৃ. ৭৭।
[5] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ৭০।
[6] সায়িদ নাইসাপূরী, আল-ই’তিকাদ, পৃ ১৪৯।
[7] আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, আস-সুন্নাহ ১/১০৭, ১৭৪, ২৮০; আজুর্রী, আশ-শরীয়াহ ২/২২৪-২২৫; ইবন আব্দুল বার্র, আত-তামহীদ ৭/১৩৮।
[8] বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত ২/৩৩৭-৩৩৯।
[9] ইবন আব্দুল বার্র, আত-তামহীদ ৭/১৩৮-১৩৯।
[10] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭০ (কিতাবুল মাসাজিদ, বাবু তাহরীমিল কালাম ফিস সালাত)
[11] ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪৯-৫১। আল্লামা যাহিদ কাওসারীর টীকা দ্রষ্টব্য।
[12] সূরা (২০) তাহা: ৫ আয়াত।
[13] ইবন আবিল ইয্য, শারহুত তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৮৬; সামারকান্দী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৭।
[14] আহমদ ইবনু হাম্বাল, আল-আকীদাহ, আবূ বাকর খাল্লালের বর্ণনা, পৃষ্ঠা ১০২-১১১।
[15] তাহাবী, আল-আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১০।
[16] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-আকীদাতুল হাসানাহ, পৃষ্ঠা ৩।
৮. ২. অবতরণ
মহান আল্লাহর অন্য একটি বিশেষণ ‘নুযূল’ বা অবতরণ। এ অর্থের একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
يَنْزِلُ رَبُّنَا كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى
ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِى فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ
يَسْأَلُنِى فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ لَهُ
‘‘প্রতি রাতে যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে তখন আমাদের মহিমান্বিত মহা-কল্যাণময় প্রতিপালক নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন। তিনি বলেন: আমাকে ডাকার কেউ আছ কি? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছ কি? আমি তাকে প্রদান করব। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করব।’’[1]
এ বিশেষণও জাহমী-মু’তাযিলীগণ অস্বীকার করেন। তারা বলেন, স্থান পরিবর্তন আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি আরশ থেকে অবতরণ করলে আরশ কি শূন্য থাকে? তাঁরা বলেন: অবতরণ অর্থ নৈকট্য বা বিশেষ করুণা। কিন্তু প্রশ্ন হলো: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তো অনেক স্থানেই নৈকট্য ও করুণা শব্দ ব্যবহার করেছেন। এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নৈকট্য বা করুণা না বলে অবতরণ বললেন কেন? আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য বিশ্বাসকে কঠিন ও জটিল করতে চান? না সহজ করতে চান?
আহলুস সুন্নাতের ইমামগণ অন্যান্য বিশেষণের মত এটিকেও তুলনামুক্তভাবে মেনে নেন। তাঁরা বলেন: এটি মহান আল্লাহর একটি বিশেষণ। আমরা সরল অর্থে বিশ্বাস করি যে, মহান আল্লাহ অতুলনীয়, তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন এবং তিনি যখন এবং যেভাবে ইচ্ছা অবতরণ করেন। তাঁর অবতরণ কোনোভাবেই কোনো সৃষ্টির অবতরণের মত নয়। তাঁর অবতরণের স্বরূপ ও প্রকৃতি কি তা আমরা জানি না এবং জানার চেষ্টাও করি না। ইমাম আবূ হানীফা (রা) কে মহান আল্লাহর অবতরণ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন:
ينزل بلا كيف
‘‘মহান আল্লাহ অবতরণ করেন, কোনোরূপ পদ্ধতি বা স্বরূপ ব্যতিরেকে।’’[2]
[1] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৮৪; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২২ (মুসাফিরীন, তারগীব ফিদদুআ... আখিরিল্লাইল)
[2] বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত ২/৩৮০; মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ ৬৯।
৯. বিশেষণ বিষয়ে চার ইমাম ও সালাফ সালিহীন
আমরা মহান আল্লাহর বিশেষণ সম্পর্কে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও প্রসঙ্গত ইমাম মালিক (রাহ) ও ইমাম আহমদ (রাহ)-এর মত জানলাম। বস্ত্তত চার ইমামসহ ‘সালাফ সালিহীন’ বা ইসলামের প্রথম চার প্রজন্মের সকল বুজুর্গ একই আকীদা অনুসরণ করতেন। তাঁরা সকলেই কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত বিশেষণগুলোকে সরল অর্থে বিশ্বাস করতে এবং ব্যাখ্যা ও তুলনা বর্জন করতে নির্দেশ দিতেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী প্রথম হিজরী শতকের দুজন প্রসিদ্ধ তাবিয়ীর মত উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:
قال أبو العالية (استوى إلى السماء) ارتفع.. وقال مجاهد (استوى) علا (على العرش)
‘‘(প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও ফকীহ রুফাই ইবন মিহরান) আবুল আলিয়া (৯০ হি) বলেন: ‘আসমানের প্রতি ইসতিওয়া করেছেন অর্থ: আসমানের উপরে থেকেছেন।’ (অন্য প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুফাস্সির ও ফকীহ ইমাম) মুজাহিদ (১০৪ হি) বলেন: ‘আরশের উপর ‘ইসতিওয়া’ করেছেন অর্থ আরশের ঊর্ধ্বে থেকেছেন।’’[1]
সায়িদ নাইসাপূরী ইমাম আবূ হানীফার আকীদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন:
سئل محمد بن إسحاق بن خزيْمة عن الكلام في الأسماء والصفات، فقال: بدعة ابتدعوها،
ولم يكن أئمةُ المسلمين من الصحابة والتابعين وأئمة الدين وأرباب المذاهب، مثلُ
مالكِ بن أنس، وسفيان الثوري، والأوزاعي، وأبو حنيفة، وأبو يوسف، ومحمد بن الحسن،
والشافعي، وأحمد بن حنبل، وإسحاق الحنظلي، ويحيى بن يحيى، وعبد الله بن المبارك،
ومحمد بن يحيىরাঃ أي لم يكن يتكلمون في
ذلك، وينهون عن الخوض فيه، والنظرِ فى كتبهم بحال واللهَ أسأل أن يعيذَنا من مضلات
الفتن ما ظهر
منها وما بطن.
‘‘ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ইবন খুযাইমা (২২৩-৩১১ হি)-কে মহান আল্লাহর নাম ও বিশেষণ বিষয়ক কথাবার্তা বা ইলমুল কালাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন: এটি একটি বিদআত যা তারা উদ্ভাবন করেছে। মুসলিমদের ইমামগণ, অর্থাৎ সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ, প্রসিদ্ধ মাযহাবগুলোর ইমামগণ, যেমন মালিক ইবন আনাস, সুফিয়ান সাওরী, আওযায়ী, আবূ হানীফা, আবূ ইউসূফ, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, শাফিয়ী, আহমদ ইবন হাম্বাল, ইসহাক ইবন রাহওয়াইহি হানযালী, ইয়াহইয়া ইবন ইয়াহইয়া, আব্দুল্লাহ্ ইবনুল মুবারাক, মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহইয়া যুহলী- রাদিআল্লাহু আনহুম- কেউই এ বিষয়ে কথা বলতেন না। তাঁরা সকলেই এ বিষয়ে আলোচনা করতে নিষেধ করতেন এবং যারা এ সকল বিষয়ে কথা বলেন তাদের বইপত্র পড়তে নিষেধ করতেন। আমি মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, তিনি যেন আমাদেরকে প্রকাশ্য ও গোপন বিভ্রান্তিকর ফিতনা থেকে রক্ষা করেন।’’[2]
[1] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৯৮ (কিতাবুত তাওহীদ, ২২-বাব কানা আরশুহু আলাল মায়ি)
[2] সায়িদ নাইসাপূরী, আল-ই’তিকাদ, পৃ. ১৭৬-১৭৭।
তাবি-তাবিয়ী ইমাম সুফইয়ান ইবন উআইনা (১০৭-১৯৮ হি) ও ইমাম আবূ হানীফার অন্যতম প্রধান ছাত্র প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মাদ ইবন হাসান শাইবানী (১৮৯ হি) বলেন
প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ইমাম সুফইয়ান ইবন উআইনা (১০৭-১৯৮ হি) বলেন:
كل ما وصف الله به نفسه في القرآن فقراءته تفسيره، لا كيف ولا مثل
‘‘আল্লাহ কুরআনে নিজের বিষয়ে যে সকল বিশেষণ উল্লেখ করেছেন তার পাঠই তার ব্যাখ্যা কোনো ‘কাইফ’ (স্বরূপ) নেই এবং কোনো ‘মিসল’ (তুলনা) নেই।’’[1]
ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদ ফকীহ ইমাম আওযায়ী আব্দুর রাহমান ইবন আমর (১৫৭ হি) বলেন:
كنا والتابعون متوافرون نقول إن الله على عرشه ونؤمن بما وردت به السنة من صفاته
‘‘যে সময়ে তাবিয়ীগণ বহু সংখ্যায় বিদ্যমান ছিলেন সে সময়ে আমরা বলতাম: মহান আল্লাহ তাঁর আরশের উপরে এবং সুন্নাতে (হাদীসে) মহান আল্লাহর যা কিছু বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে তা আমার বিশ্বাস করি।’’[2]
প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ওয়ালীদ ইবন মুসলিম (১৯৫ হি) বলেন:
سألت الأوزاعي ومالكا والثوري والليث بن سعد عن الأحاديث التي فيها الصفة فقالوا
أمِرُّوهَا كما جاءت بلا كيف
‘‘ইমাম আওযায়ী (১৫৭ হি), ইমাম মালিক ইবন আনাস (১৭৯ হি), ইমাম সুফিয়ান সাওরী এবং ইমাম লাইস ইবন সা’দ (১৭৫ হি )-কে আমি মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক হাদীসগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তখন তাঁরা বলেন: এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই চালিয়ে নাও; কোনোরূপ স্বরূপ-প্রকৃতি ব্যতিরেকে।’’[3]
মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক মূলনীতি ব্যাখ্যা করে ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাষ্য ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ গ্রন্থে ইমাম আযম বলেন:
لاَ يُوْصَفُ اللهُ تَعَالَى بِصِفَاتِ الْمَخْلُوْقِيْنَ. وَغَضَبُهُ وَرِضَاهُ
صِفَتَانِ مِنْ صِفَاتِهِ بِلاَ كَيْفٍ، وَهُوَ قَوْلُ أَهْلِ السُّنَّةِ
وَالْجَمَاعَةِ. وَهُوَ يَغْضِبُ وَيَرْضَى وَلاَ يُقَالُ: غَضَبُهُ عُقُوْبَتُهُ
وَرِضَاهُ ثَوَابُهُ. وَنَصِفُهُ كَمَا وَصَفَ نَفْسَهُ أَحَدٌ صَمَدٌ لَمْ يَلِدْ
وَلَمْ يُوْلَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ حَيٌّ قَيُّوْمٌ قَادِرٌ
سَمِيْعٌ بَصِيْرٌ عَالِمٌ يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ لَيْسَتْ كَأَيْدِيْ
خَلْقِهِ وَلَيْسَتْ جَارِحَةٌ وَهُوَ خَالِقُ الأَيْدِيْ وَوَجْهُهُ لَيْسَ
كَوُجُوْهِ خَلْقِهِ وَهُوَ خَالِقُ كُلِّ الْوُجُوْهِ وَنَفْسُهُ لَيْسَتْ
كَنَفْسِ خَلْقِهِ وَهُوَ خَالِقُ كُلِّ النُّفُوْسِ: لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ
وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ
‘‘মহান আল্লাহ সৃষ্টির বিশেষণে বিশেষায়িত হন না। তাঁর ক্রোধ ও সন্তুষ্টি তাঁর বিশেষণসমূহের দুটি বিশেষণ, কোনো স্বরূপ নির্ণয় ছাড়া। এটিই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত-এর মত। মহান আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন এবং সন্তুষ্ট হন। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর ক্রোধ অর্থ তাঁর শাস্তি এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্থ তাঁর পুরস্কার। আল্লাহ নিজে নিজেকে যেরূপে বিশেষিত করেছেন আমরাও তাঁকে সেভাবেই বিশেষিত করি। তিনি একক, অমুখাপেক্ষী, তিনি কারো জন্ম দেন নি, তিনি জন্মপ্রাপ্ত নন, কেউ তাঁর তুলনীয় নয়। তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসংরক্ষক, ক্ষমতাবান, শ্রবণকারী, দর্শনকারী, জ্ঞানী, আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর, তাঁর হাত তাঁর সৃষ্টির হাতের মত নয়; তা অঙ্গ নয়; তিনি হস্তসমূহের স্রষ্টা। তাঁর মুখমন্ডল তাঁর সৃষ্টির মুখমন্ডলের মত নয়; তিনি সকল মুখমন্ডলের স্রষ্টা। তাঁর নফস তাঁর সৃষ্টির নফসের মত নয়, তিনি সকল নফসের স্রষ্টা। (আল্লাহ বলেন[4]) ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, এবং তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[5]
এখানে তিনি তিনটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন:
(১) মহান আল্লাহর বিশেষণগুলোর অতুলনীয়ত্বে বিশ্বাস করতে হবে।
(২) মহান আল্লাহ নিজের বিষয়ে যে সকল শব্দ, বাক্য, কর্ম বা বিশেষণ ব্যবহার করেছেন মুমিনের দায়িত্ব সেগুলো সর্বান্তকরণে গ্রহণ, বিশ্বাস ও ব্যবহার করা।
(৩) তাঁর বিশেষণ রূপক অর্থে ব্যবহৃত বলে দাবি করা বা ব্যাখ্যা করা যাবে না।
মহান আল্লাহর বিশেষণ ব্যাখ্যায় কিছু বলার অর্থ মহান আল্লাহ সম্পর্কে মানবীয় যুক্তি, বুদ্ধি বা ইজতিহাদ দিয়ে কিছু বলা। আর মহান আল্লাহর বিষয়ে ইজতিহাদ করে কিছু বলা যাবে না। এজন্য ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:
لا ينبغي لأحد أن ينطق في الله تعالى بشئ من ذاته، ولكن يصفه بما وصف سبحانه به
نفسه، ولا يقول فيه برأيه شيئاً تبارك الله تعالى رب العالمين.
‘‘মহান আল্লাহর বিষয়ে নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলা কারো জন্য বৈধ নয়; বরং তিনি নিজের জন্য যে বিশেষণ ব্যবহার করেছেন তাঁর বিষয়ে শুধু সে বিশেষণই ব্যবহার করতে হবে। এ বিষয়ে নিজের মত, যুক্তি বা ইজতিহাদ দিয়ে কিছুই বলা যাবে না। মহাপবিত্র, মহাসম্মানিত-মহাকল্যাণময় আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতিপালক।’’[6]
ইমাম আবূ হানীফার অন্যতম প্রধান ছাত্র প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মাদ ইবন হাসান শাইবানী (১৮৯ হি) বলেন:
اتفق الفقهاء كلهم من المشرق إلى المغرب على الإيمان بالقرآن والأحاديث التي جاء
بها الثقات عن رسول الله ﷺ في صفة الرب عز وجل من غير تغيير ولا وصف ولا تشبيه فمن
فسر اليوم شيئا من ذلك فقد خرج مما كان عليه النبي ﷺ وفارق الجماعة فإنهم لم يصفوا
ولم يفسروا ولكن أفتوا بما في الكتاب والسنة ثم سكتوا فمن قال بقول جهم فقد فارق
الجماعة؛ لأنه قد وصفه بصفة لا شيء.
‘‘পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সকল দেশের ফকীহগণ সকলেই একমত যে, মহান আল্লাহর বিশেষণ সম্পর্কে কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে, কোনোরূপ পরিবর্তন, বিশেষায়ন এবং তুলনা ব্যতিরেকে। যদি কেউ বর্তমানে সেগুলোর কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করে তবে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পথ ও পদ্ধতি পরিত্যাগকারী এবং উম্মাতের পূর্বসূরীদের ইজমার (ঐকমত্যের) বিরোধিতায় লিপ্ত। কারণ তাঁরা এগুলোকে বিশেষায়িত করেন নি এবং ব্যাখ্যাও করেন নি। বরং তাঁরা কুরআন ও সুন্নাতে যা বিদ্যমান তার ভিত্তিতে ফাতওয়া দিয়েছেন এবং এরপর নীরব থেকেছেন। কাজেই যে ব্যক্তি জাহম-এর মত গ্রহণ করবে সে সাহাবী-তাবিয়ীগণের ঐকমত্যের পথ পরিত্যাগ করবে; কারণ সে মহান আল্লাহকে নেতিবাচক ও অবিদ্যমানতার বিশেষণে বিশেষিত করে।’’[7]
[1] দারাকুতনী, আস-সিফাত, পৃ ৭০; বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত ২/১১৭।
[2] বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত, পৃষ্ঠা, ৫১৫; ইবন হাজার, ফাতহুল বারী ১৩/৪০৬।
[3] ইবন হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/৪০৭।
[4] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[5] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৫৭।
[6] সায়িদ ইবন মুহাম্মাদ, আল-ই’তিকাদ, পৃ, ৮৭-৮৯।
[7] সায়িদ নাইসাপূরী, আল-ই’তিকাদ, পৃ, ১৭০; লালকায়ী, ই’তিকাদ ৩/৪৩২; যাহাবী, আল-উলূ, পৃ ১৫৩।
ইমাম মুহাম্মাদের ছাত্র ইমাম আবূ উবাইদ কাসিম ইবন সাল্লাম বলেন
ইমাম মুহাম্মাদের ছাত্র ইমাম আবূ উবাইদ কাসিম ইবন সাল্লাম (২২৪হি) বলেন:
هذه الأحاديث صحاح حملها أصحاب الحديث والفقهاء بعضهم على بعض، وهي عندنا حق لا
نشك فيها، ولكن إذا قيل: كيف وضع قدمه؟ وكيف ضحك؟ قلنا: لا نُفَسِّرُ هذا ولا
سمعنا أحدًا يفسره
‘‘এগুলো সহীহ হাদীস। মুহাদ্দিসগণ ও ফকীহগণ পরস্পর এগুলো গ্রহণ ও বর্ণনা করেছেন। আমাদের মতে এগুলো সত্য ও সঠিক, এগুলোর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যদি বলা হয়: তিনি কিভাবে জাহানণামে পদ স্থাপন করলেন? তিনি কিভাবে হাসলেন? তবে আমরা বলব: আমরা এগুলোর ব্যাখ্যা করি না। পূর্ববর্তী কাউকে আমরা এগুলোর ব্যাখ্যা করতে শুনি নি।’’[1]
[1] দারাকুতনী, আস-সিফাত, পৃ ৬৮-৬৯; লালকায়ী, শারহ উসূলি ই’তিকাদ আহলিস সুন্নাহ ৩/৫২৬।
ইমাম সায়িদ ইবন মুহাম্মাদ নাইসাপূরী হানাফী বলেন
ইমাম সায়িদ ইবন মুহাম্মাদ নাইসাপূরী হানাফী বলেন:
فصل في رواية ما صح من الآثار في الصفات وترك الخوض فيها. وروي عن محمد بن الحسن
رحمه الله أنه قال في مثل هذه الأحاديث قد روتْها الثقات، ونحن نرويها،
ونُصدِّقها، ونؤمن بِها، ولا نفسرها
‘‘আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ে এবং এগুলো নিয়ে বিতর্ক না করার বিষয়ে সাহাবী-তাবিয়ীগণ থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত বক্তব্য বিষয়ক অনুচ্ছেদ।... মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (রাহ) থেকে বর্ণিত, তিনি এ সকল বিশেষণ বিষয়ক হাদীসগুলো সম্পর্কে বলেন: এ সকল হাদীস বিশ্বস্ত রাবীগণ বর্ণনা করেছেন। আমরাও এগুলো বর্ণনা করি এবং এগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করি ও বিশ্বাস করি। আমরা এগুলোর ব্যাখ্যা করি না।’’[1]
[1] সায়িদ নাইসাপূরী, আল-ই’তিকাদ, পৃ ১৬৭-১৭০।
ইমাম শাফিয়ীর ছাত্র রাবী ইবন সুলাইমান বলেন
ইমাম শাফিয়ীর ছাত্র রাবী ইবন সুলাইমান বলেন:
سألت
الشافعي عن صفات من صفات الله تعالى فقال حرام على العقول أن تمثل الله تعالى وعلى
الأوهام أن تحده وعلى الظنون أن تقطع وعلى النفوس أن تفكر وعلى الضمائر أن تعمق
وعلى الخواطر أن تحيط وعلى العقول أن تعقل إلا ما وصف به نفسه في كتابه أو على
لسان نبيه
‘‘আমি শাফিয়ীকে মহান আল্লাহর বিশেষণাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করি। তিনি বলেন: মহান আল্লাহর তুলনা বা নমুনা স্থাপন মানবীয় জ্ঞানের জন্য হারাম, তাঁকে সীমায়িত করা মানবীয় কল্পনার জন্য হারাম, এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া মানবীয় ধারণার জন্য হারাম, এ নিয়ে চিন্তা করা মানব প্রবৃত্তির জন্য হারাম, এর গভীরে যাওয় মানব অন্তরের জন্য হারাম এবং সব বুঝে ফেলার চেষ্টা করা মানবীয় বুদ্ধির জন্য হারাম। মহান আল্লাহ তাঁর গ্রন্থে বা তাঁর রাসূল ﷺ-এর জবানীতে তাঁর নিজের বিষয়ে যা কিছু উল্লেখ করে নিজেকে বিশেষিত করেছেন তা বিশ্বাস করা ছাড়া অতিরিক্ত কিছুই করা বৈধ নয়।’’[1]
[1] ইবন কুদামা, যাম্মুত তাবীল, পৃষ্ঠা ২৩; সুবকী, তাবাকাতুশ শাফিয়িয়্যা আল-কুবরা, খন্ড ৯, পৃষ্ঠা ৪০।
ইমাম শাফিয়ীর অন্য ছাত্র ইউনুস ইবন আব্দুল আ’লা বলেন
ইমাম শাফিয়ীর অন্য ছাত্র ইউনুস ইবন আব্দুল আ’লা বলেন:
سمعت أبا عبد الله الشافعي يقول- وقد سئل عن صفات الله تعالى وما يؤمن به - فقال:
لله أسماء وصفات جاء بها كتابه، وأخبر بها نبيه ﷺ أمته، لا يسع أحدا قامت عليه
الحجة ردها، لان القرآن نزل بها، وصح عن رسول الله ﷺ القول بها، فإن خالف ذلك بعد
ثبوت الحجة عليه، فهو كافر، فأما قبل ثبوت الحجة، فمعذور بالجهل، لأن علم ذلك لا
يدرك بالعقل، ولا بالروية والفكر، ولا نكفر بالجهل بها أحدا إلا بعد انتهاء الخبر
إليه بها، ونثبت هذه الصفات، وننفي عنها التشبيه، كما نفاه عن نفسه، فقال: (ليس
كمثله شئ وهو السميع البصير).
‘‘আবূ আব্দুল্লাহ শাফিয়ীকে মহান আল্লাহর বিশেষণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো। তখন তিনি বললেন: আল্লাহর নামসমূহ এবং বিশেষণসমূহ রয়েছে। কুরআনে সেগুলির উল্লেখ রয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতকে তা জানিয়েছেন। যার কাছে তা প্রমাণিত হয়েছে তার জন্য তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ কুরআনে তা অবতীর্ণ হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এগুলি বলেছেন। যদি কেউ তার কাছে বিষয়গুলো প্রমাণিত হওয়ার পরেও বিরোধিতা করে তবে সে ব্যক্তি কাফির। তবে যদি কেউ তা তার নিকট প্রমাণিত হওয়ার পূর্বে বিরোধিতা করে তবে সে ব্যক্তি অজ্ঞতার কারণে ওজর-অব্যাহতির যোগ্য (excusable, forgivable)। কারণ এ বিষয়ক জ্ঞান মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক, যুক্তি, গবেষণা ও চিন্তাভাবনার মাধ্যমে অর্জন করা যায় না। কাজেই কারো নিকট এ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের সংবাদ পৌঁছানোর আগে এ বিষয়ক অজ্ঞতার কারণে আমরা কাউকে কাফির বলে গণ্য করি না। আমরা এ সকল বিশেষণ প্রমাণ ও বিশ্বাস করি এবং এগুলি থেকে তুলনা বাতিল ও অস্বীকার করি। কারণ মহান আল্লাহ নিজেই নিজের তুলনীয় হওয়ার বিষয়টি বাতিল করে বলেছেন[1]: ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়; তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা’’।[2]
[1] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১০/৭৯-৮০; ইবনু কুদামা, যাম্মুত তাবীল, পৃষ্ঠা ২৩।
ইমাম শাফিয়ীর অন্য ছাত্র আবূ সাওর বলেন
ইমাম শাফিয়ীর অন্য ছাত্র আবূ সাওর বলেন, ইমাম শাফিয়ী বলেন:
القول في السُّنّة التي وردت وأنا عليها، ورأيتُ أصحابنا عليها أهل الحديث الذين
رأيتُهم وأخذتُ عنهم ـ مثل: سفيان الثّوريّ ومالك وغيرهما ـ : الإقرار بشهادة أن
لا إله إلا الله وأنّ محمّدًا رسول الله، وأنّ الله ـ تعالى ـ على عرشه في سمائه،
يقرب من خلقه كيف شاء، وأنّ الله تعالى ينزل إلى السّماء الدُّنيا كيف شاء.
‘‘সুফিয়ান সাওরী, মালিক ও অন্যান্য যে সকল মুহাদ্দিসকে আমরা দেখেছি এবং তাঁদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি, আমাদের সে সব সাথী এবং আমি যে সুন্নাত আকীদার উপর রয়েছি তা হলো এরূপ সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই, এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল, এবং মহান আল্লাহ তাঁর আরশের উপরে তাঁর আসমানের ঊর্ধ্বে, তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেন সেভাবে বান্দার নিকটবর্তী হন এবং তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেন সেভাবে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন।’’[1]
[1] যাহাবী, আল-উলুওউ লিল-আলিয়্যিল গাফ্ফার, পৃষ্ঠা ২০৫; হিশাম আব্দুল কাদির, মুখতাসারু মাআরিজিল কুবুল, পৃষ্ঠা ২৬৬।
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের মূলনীতি ও আকীদা ব্যাখ্যা করে তাঁর ছাত্র আবূ বাকর খাল্লাল বলেন
মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের মূলনীতি ও আকীদা ব্যাখ্যা করে তাঁর ছাত্র আবূ বাকর খাল্লাল বলেন:
ومذهب .. أحمد بن حنبل.. أن لله عز وجل وجها لا كالصور المصورة والأعيان المخططة
بل وجهه وصفه ....وليس معنى وجه معنى جسد عنده ولا صورة ولا تخطيط ومن قال ذلك فقد
ابتدع. وكان يقول إن لله تعالى يدان وهما صفة له في ذاته ليستا بجارحتين وليستا
بمركبتين ولا جسم ولا جنس من الأجسام ولا من جنس المحدود والتركيب والأبعاض
والجوارح ولا يقاس على ذلك لا مرفق ولا عضد ولا فيما يقتضي ذلك من إطلاق قولهم يد
إلا ما نطق القرآن به أو صحت عن رسول الله صلى الله عليه وسلم السنة فيه ... وذهب
أحمد بن حنبل رضي الله عنه إلى أن الله عز وجل يغضب ويرضى وأن له غضب ورضى ...
والغضب والرضى صفتان له من صفات نفسه لم يزل الله تعالى غاضبا على ما سبق في علمه
أنه يكون ممن يعصيه ولم يزل راضيا على ما سبق في علمه أنه يكون مما يرضيه. وأنكر
على من يقول بالجسم وقال إن الأسماء مأخوذة بالشريعة واللغة وأهل اللغة وضعوا هذا
الأسم على كل ذي طول وعرض وسمك وتركيب وصورة وتأليف والله تعالى خارج عن ذلك كله
فلم يجز أن يسمى جسما لخروجه عن معنى الجسمية ولم يجئ في الشريعة ذلك فبطل
‘‘আহমদ ইবন হাম্বালের মাযহাব এই যে, মহান আল্লাহর একটি ‘ওয়াজহ’ বা মুখমন্ডল আছে। তাঁর মুখমন্ডল প্রতিচ্ছবি বা আকৃতি নয় এবং আঁকানো বস্ত্তর মতও নয়। বরং মুখমন্ডল তাঁর একটি মহান বিশেষণ। ... তাঁর মতে মুখমন্ডল অর্থ দেহ, ছবি বা আকৃতি নয়। যদি কেউ তা বলে তাহলে সে বিদআতী। তিনি বলতেন: মহান আল্লাহর দুটি হস্ত বিদ্যমান। এদুটি তাঁর সত্ত্বার বিশেষণ। হস্তদ্বয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নয়, দেহের অংশ নয়, দেহ নয়, দেহ জাতীয় কিছু নয়, সীমা, সংযোজন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জাতীয় কিছুই নয়। এ বিষয়ে কিয়াস-যুক্তি অচল। এতে কনুই, বাহু ইত্যাদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনার সুযোগ নেই। কুরআন ও হাদীসে যতটুকু বলা হয়েছে তার অতিরিক্ত মানুষের ব্যবহার থেকে কিছু সংযোজন করা যাবে না। .... আহমদ (রাহ) বলতেন, আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন এবং সন্তুষ্ট হন। তাঁর ক্রোধ এবং সন্তুষ্টি আছে। ... তাঁর ক্রোধ ও সন্তুষ্টি তাঁর সত্তার বিশেষণগুলির মধ্যে দুটি বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকে তাঁর অনাদি-অনন্ত জ্ঞানে যাদেরকে অবাধ্য বলে জানেন তাদের প্রতি ক্রোধান্বিত রয়েছেন এবং তাঁর অনাদি অনন্ত জ্ঞানে যাদেরকে অনুগত বলে জানেন তাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট রয়েছেন। মহান আল্লাহকে যারা দেহবিশিষ্ট বলে দাবি করেন তিনি তাদের কথা অস্বীকার ও প্রতিবাদ করেন। কারণ নাম তো শরীয়াহ এবং ভাষার ব্যবহার থেকে গ্রহণ করতে হবে। ভাষার ব্যবহারে দেহ বলতে গন্ডি, সীমা, দৈর্ঘ, প্রস্থ, গভীরতা, অংশ, আকৃতি ও সংযোজন ইত্যাদির সমাহার বুঝানো হয়। মহান আল্লাহ এর সবকিছুর ঊর্ধ্বে। শরীয়াতেও মহান আল্লাহকে এ বিশেষণে বিশেষিত করা হয় নি। কাজেই মহান আল্লাহর দেহ আছে বা তিনি দেহবিশিষ্ট এরূপ কথা বাতিল।’’[1]
[1] আহমদ ইবনু হাম্বাল, আল-আকীদাহ, আবূ বাকর খাল্লালের বর্ণনা, পৃষ্ঠা ১০২-১১১।
ইমাম আহমদের পুত্র হাম্বাল বলেন
ইমাম আহমদের পুত্র হাম্বাল বলেন:
سألت أبا عبدالله عن الأحاديث التي تروى: "إن الله تبارك وتعالى ينزل كل ليلة
إلى السماء الدنيا"، و "أن الله يُرى"، و "إن الله يضع
قدمه"، وما أشبهه؟ فقال أبو عبدالله: نؤمن بها ونصدق بها، ولا كيف ولا معنى
‘‘বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহ প্রত্যেক রাতে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন, মহান আল্লাহকে দেখা যাবে, মহান আল্লাহ তাঁর পদ স্থাপন করেন, ইত্যাদি। এ ধরনের হাদীসগুলো সম্পর্কে আমি আমার পিতাকে প্রশ্ন করলাম। তিনি বলেন: আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, সত্য বলে গ্রহণ করি, কোনো ‘কিভাবে’ নেই এবং কোনো অর্থ নেই (স্বরূপ সন্ধান বা অর্থ সন্ধান ব্যতিরেকে)।’’[1]
এ প্রসঙ্গে ইমাম তিরমিযীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। একটি সহীহ হাদীসে রাসূলূল্লাহ ﷺ কিয়ামত দিবসের বর্ণনায় বিভিন্নভাবে মহান আল্লাহর দর্শন, জাহান্নামে তাঁর পদ স্থাপনের ফলে জাহান্নামের সংকুচিত হওয়া ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন:
وقد روي عن النبي ﷺ روايات كثيرة مثل هذا ما يذكر فيه أمر الرؤية... وذكر القدم
وما أشبه هذه الأشياء والمذهب في هذا عند أهل العلم من الأئمة مثل سفيان الثوري
ومالك بن أنس وابن المبارك وابن عيينة ووكيع وغيرهم أنهم رووا هذه الأشياء ثم
قالوا تروى هذه الأحاديث ونؤمن بها ولا يقال كيف؟ وهذا الذي اختاره أهل الحديث أن
تروى هذه الأشياء كما جاءت ويؤمن بها ولا تفسر ولا تتوهم ولا يقال كيف وهذا أمر
أهل العلم الذي أختاروه وذهبوا إليه
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এরূপ অনেক হাদীস বর্ণিত, যেগুলোতে বলা হয়েছে যে, মানুষেরা তাদের রবকে দেখবে, মহান আল্লাহর পায়ের কথা এবং এ জাতীয় বিষয়াদি উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুফিয়ান সাওরী, মালিক ইবন আনাস, ইবনুল মুবারাক, ইবন উ‘আইনা, ওকী ও অন্যান্য ইমাম ও আলিমের মাযহাব এ-ই যে, তাঁরা এগুলো বর্ণনা করেছেন এরপর বলেছেন যে, এ সকল হাদীস এভাবে বর্ণনা করা হবে এবং আমরা এগুলো বিশ্বাস করি। এ বিষয়ে ‘কাইফা’: কিরূপে বা কিভাবে বলা যাবে না। এভাবে মুহাদ্দিসগণের মত এ-ই যে, এ সকল বিষয় যেভাবে এসেছে সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে এবং এগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে। এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা করা যাবে না, কোনো কল্পনা করা যাবে না এবং একথাও বলা যাবে না যে, কিরূপে বা কিভাবে? আলিমগণ এ মতটিই গ্রহণ করেছেন এবং এটিই তাঁদের মাযহাব।’’[2]
এভাবে আমরা দেখেছি যে, মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো ব্যাখ্যা, তুলনা ও স্বরূপসন্ধান ব্যতিরেকে বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করা এবং এ অর্থের হাদীসগুলো আন্তরিকভাবে বর্ণনা করার বিষয়ে সালাফ সালিহীন ঐকমত্য পোষণ করেছেন। পাশাপাশি কখনো কখনো তাঁদের কেউ কেউ দু-একটি আয়াতের সহজবোধ্য ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন:
يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلا يَسْتَطِيعُونَ
স্মরণ করুন, সে দিনের কথা যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচিত হবে, সেদিন তাদেরকে ডাকা হবে সাজ্দা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না।’’[3]
এখানে ‘পায়ের গোছা’র ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস (রা) বলেছেন যে, এ দ্বারা কাঠিন্য বুঝানো হয়েছে, অর্থাৎ যেদিন কাঠিন্য উন্মোচিত হবে। তিনি বলেন:
يريد القيامة والساعة لشدَّتها
‘‘কিয়ামত দিবস ও পুনরুত্থান বুঝানো হয়েছে, তার কাঠিন্যের কারণে।’’[4]
কিয়ামত দিবসের বর্ণনায় মহান আল্লাহ বলেন:
وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا
‘‘এবং আগমন করলেন আপনার রব ও ফিরিশতাগণ কাতারে কাতারে।’’[5]
ইমাম ইবন কাসীর বলেন:
روى البيهقي ... عن حنبل أن أحمد بن حنبل تأول قول الله تعالى: (وجاء ربك) أنه جاء
ثوابه. ثم قال البيهقي: وهذا إسناد لا غبار عليه.
‘‘বাইহাকী তাঁর সনদে হাম্বাল থেকে বর্ণনা করেছেন, ইমাম আহমদ ‘আগমন করলেন আপনার প্রতিপালক’ কথাটির ব্যাখ্যায় বলেছেন: ‘আগমন করল তাঁর পুরস্কার’। এরপর বাইহাকী বলেন: বর্ণনাটির সনদে কোনো আপত্তি নেই।’’[6]
মহান আল্লাহ বলেন:
كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ
‘‘সকল বস্ত্তই ধ্বংস হবে শুধু মহান আল্লাহর মুখমণ্ডল ব্যতীত।’’[7]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী বলেন:
إلا ملكه ويقال إلا ما أريد به وجه الله
‘‘শুধু মহান আল্লাহর রাজত্ব ব্যতীত। বলা হয়: শুধু মহান আল্লাহর মুখম-লের (সন্তুষ্টির) জন্য পালিত কর্ম ব্যতীত।’’[8]
মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো ব্যাখ্যা ও তুলনামুক্তভাবে গ্রহণের বিষয়ে সালাফ সালিহীন থেকে বর্ণিত অসংখ্য নির্দেশনার পাশাপাশি এরূপ বিচ্ছিন্ন দু-একটি ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাঁরাও অন্যত্র বিশেষণ ব্যাখ্যার কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। এজন্য পরবর্তী প্রজন্মের আলিমগণ এ বক্তব্যগুলোকে বিশেষণের ব্যাখ্যার অনুমতি বলে গণ্য করেন নি; বরং নির্দিষ্ট একটি আয়াতের ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যাখ্যা বলে গণ্য করেছেন। পাশাপাশি বিশেষণ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলো ব্যাখ্যামুক্ত, তুলনামুক্ত ও স্বরূপ অনুসন্ধানমুক্তভাবে সরল অর্থে বিশ্বাস ও বর্ণনা করার বিষয়ে তাঁদের ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন। আমরা দেখলাম যে, ইমাম আবূ হানীফার অন্যতম ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শাইবানী, ইমাম তিরমিযী, ইমাম ইবন খুযাইমা ও অন্যান্য আলিম এ ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন।
এ ইজমার কারণেই প্রসিদ্ধ আশআরী কালামবিদ ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী জুওয়াইনী (৪৭৮ হি) আশআরী মতবাদের প্রসিদ্ধ মত ত্যাগ করে সালাফ সালিহীনের মত গ্রহণ করেন। তিনি আর-রিসালাহ আন-নিযামিয়্যাহ গ্রন্থে বলেন:
والذي نرتضيه رأيا وندين الله به عقيدة اتباع سلف الأمة للدليل القاطع على ان
إجماع الأمة حجة فلو كان تأويل هذه الظواهر حتما لأوشك أن يكون اهتمامهم به فوق
اهتمامهم بفروع الشريعة وإذا انصرم عصر الصحابة والتابعين على الإضراب عن التأويل
كان ذلك هو الوجه المتبع
‘‘আমরা যে মতটি গ্রহণ করছি এবং যে আকীদা গ্রহণ করে মহান আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পন করছি তা হলো উম্মাতের সালফ সালিহীনের অনুসরণ। কারণ উম্মাতের ইজমা বা ঐকমত্য একটি সুনিশ্চিত দলীল। যদি এ সকল বাহ্যিক বিশেষণগুলোর ব্যাখ্যা করা জরুরী হতো তবে নিঃসন্দেহে শরীয়তের ফিকহী মাসআলাগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেয়ে ঈমান-আকীদা বিষয়ক এ সকল আয়াত-হাদীসের ব্যাখ্যার বিষয়ে তাঁরা অনেক বেশি গুরুত্ব প্রদান করতেন। অথচ কোনোরূপ ব্যাখ্যা ছাড়াই সাহাবী ও তাবিয়ীগণের যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এতে প্রমাণিত হলো যে, ব্যাখ্যামুক্ত বিশ্বাসের এ মতটিই অনুসরণযোগ্য আকীদা।’’[9]
ইমামুল হারামাইনের উপরের বক্তব্যটি উদ্ধৃত করে নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও শাফিয়ী ফকীহ আল্লামা হাফিয ইবন হাজার আসকালানী বলেন:
فكيف لا يوثق بما اتفق عليه أهل القرون الثلاثة وهم خير القرون بشهادة صاحب
الشريعة
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাক্ষ্য অনুসারে প্রথম তিন প্রজন্মের মানুষেরাই উম্মতের সর্বোত্তম মানুষ। তাঁরা যে বিষয়ে একমত হয়েছেন সে বিষয়ের উপর নির্ভর না করার কোনোই কারণ নেই।’’[10]
সালফ সালিহীনের এ সকল বক্তব্য থেকে আরো স্পষ্ট যে, তাঁরা একমাত্র ওহী বা কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যকেই আকীদার উৎস ও ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আকীদা বিষয়ে ওহীর বাইরে কিছু বলতেই তাঁরা রাজি ছিলেন না।
তৃতীয় হিজরী শতকের শুরুতে আববাসী খলীফা মামুন (রাজত্ব ১৯৮-২১৮ হি) মুতাযিলী ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করেন এবং একে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। আমরা দেখেছি যে, মুতাযিলী আকীদার অন্যতম বিষয় ‘‘কুরআন সৃষ্ট বা মাখলূক’’ বলে বিশ্বাস করা এবং আখিরাতে আল্লাহর দর্শন অস্বীকার করা। দুটি বিষয়ই মহান আল্লাহর মর্যাদা ও অতুলনীয়ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তারা দাবি করেন। তাদের মতে কথা বলা, আরশে উপরে থাকা ইত্যাদি কর্মের জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রয়োজন হয়, মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এরূপ মানবীয় গুণ আরোপ করা কুফর। অনুরূপভাবে তাদের মতে মহান আল্লাহ নিরাকার। তাঁকে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করার অর্থই কোনো না কোনো ভাবে তাঁর আকৃতি দাবি করা। আর মহান আল্লাহর আকৃতি আছে বলে বিশ্বাস করা কুফরী। তাদের দাবিকৃত এ কুফরী থেকে মুসলিমদের বাঁচানোর জন্য খলীফা মামুন এবং পরবর্তী দুজন খলীফা মু’তাসিম (২১৮-২২৭ হি) ও ওয়াসিক (২২৮-২৩২ হি) এ আকীদা গ্রহণের জন্য সকল মুসলিমকে নির্দেশ দেন। এ মত গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী আলিমদেরকে গ্রেফতার করে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়। কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। প্রায় ৩০ বৎসরের এ কুফরী মতাদর্শের শাসন ও অত্যাচারের সময়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আলিমগণের অন্যতম নেতা ছিলেন ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি)।
ইমাম আহমদকে কারাগারের মধ্যে খলীফা মু’তাসিমের সম্মুখে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। বিচারপতি আহমদ ইবন আবী দুআদ ও অন্যান্য মুতাযিলী পণ্ডিত খলীফার সামনে ইমাম আহমদের সাথে বির্তক করেন। তিনি তাদেরকে বারবারই বলেন আপনারা যে আকীদা দাবি করছেন তার পক্ষে কুরআন বা হাদীস থেকে অন্তত একটি বক্তব্য প্রদান করুন। কুরআন, হাদীস বা সাহাবীগণের বক্তব্য থেকে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করুন যাতে বলা হয়ছে: কুরআন সৃষ্ট, আখিরাতে আল্লাহকে দেখা যাবে না অথবা মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক বক্তব্যগুলোকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা যাবে না।
মুতাযিলীগণ বিভিন্ন আকলী প্রমাণ পেশ করেন। ইমাম আহমদ সেগুলো খণ্ডন করেন এবং কুরআন বা হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করার দাবিতে অটল থাকেন। তখন বিচারপতি আহমদ ইবন আবী দুআদ বলেন: হে আমীরুল মুমিনীন, এ ব্যক্তি একজন মুশরিক। একে হত্যা করুন। এর রক্তের দায় আমি বহন করব। এ সময়ে তাঁকে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করা হয়। ÿত-বিÿত অর্ধমৃত ইমাম আহমদকে খলীফা বলেন, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, আপনি উম্মাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম ও ফকীহ। আপনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং আমার আনুগত্যের জন্য জনগণকে নির্দেশনা দেন। আমি আমার পুত্র হারূন-এর জন্য যেরূপ মমতা অনুভব করি আপনার জন্যও অনুরূপ মমতা অনুভব করি। তবে কুরআন আল্লাহর অনাদি বাণী, আখিরাতে আল্লাহকে দেখা যাবে ইত্যাদি কুফরী মতবাদ পরিত্যাগ না করলে আপনাকে আমি হত্যা করতে বাধ্য হব। আপনি এমন কিছু বলুন যে, আমি আপনাকে ছেড়ে দিতে পারি। আমি নিজে হাতে আপনার বাঁধন খুলে দেব। অর্ধমৃত ইমাম আহমদ বারবার বলতে থাকেন:
أعطوني شيئا من كتاب الله وسنة رسوله.
‘‘আমাকে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত থেকে কিছু প্রদান করুন।’’[11]
এভাবে আমরা দেখছি যে, প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী যুগের সকল ইমাম একমত হয়েছেন যে, আকীদার মূল সূত্র, ভিত্তি ও দলীল ওহী। ওহীর বক্তব্য সরল ও প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা, ওহী যা বলেছে তা-ই বলা এবং ওহীতে যা বলা হয় নি তা আকীদার অন্তর্ভুক্ত না করাই ইসলামী আকীদার মূলসূত্র।
আর এখানেই আহলুস সুন্নাহ ও আহলুল বিদআতের পার্থক্য। আহলুস সুন্নাহ কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যকে হুবহু বিশ্বাস ও মান্য করেন। তাঁরা ‘সুন্নাত’-এর সাথে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করতে রাজি হন না। পক্ষান্তরে আহলুল বিদআত কুরআন বা হাদীসের বক্তব্যের সাথে সংযোজন, বিয়োজন বা ব্যাখ্যা করে উক্ত সংযোজন বা ব্যাখ্যাকেই দীনের মূল বানিয়ে দেন। উপরন্তু যারা ওহীর বক্তব্যকে হুবহু গ্রহণ করেন তাঁদেরকে কাফির, বিভ্রান্ত ইত্যাদি বলে শোরগোল করেন এবং সম্ভব হলে শক্তি প্রয়োগ করে তাঁদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে সচেষ্ট হন। প্রসিদ্ধ মুতাযিলী পণ্ডিত আল্লামা যামাখশারীর ‘কাশ্শাফ’ নামক তাফসীর গ্রন্থে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্যগুলো অধ্যয়ন করলেই পাঠক বিষয়টি বুঝতে পারবেন।
[1] ইবন কুদামা, আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, যাম্মুত তাবীল, পৃ. ২২।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৬৯১ (সিফাতুল জান্নাহ, খুলুদু আহলিল জান্নাত: হাদীস নং ২৫৫৭)
[3] সূরা (৬৮) কালাম: ৪২ আয়াত।
[4] ফার্রা, মাআনিল কুরআন ৫/১২৯; তাবারী, তাফসীর ২৩/৫৫৯; বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত ২/১৮৪-১৮৬; সুয়ূতী, আদ-দুররুল মানসূর (দারুল ফিকর) ৮/২৫৫।
[5] সূরা (৮৯) ফাজর: ২২ আয়াত।
[6] ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১০/৩৬১।
[7] সূরা (২৮) কাসাস: ৮৮ আয়াত।
[8] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৭৮৭।
[9] ইবন হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/৪০৭।
[10] ইবন হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/৪০৭-৪০৮।
[11] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১১/২৪৬-২৪৮।
১০. আশ‘আরী, মাতুরিদী ও অন্যান্য মতবাদ / ১০. ১. কুল্লাবিয়া ও আশ‘আরী মতবাদ
১০. ১. কুল্লাবিয়া ও আশ‘আরী মতবাদ
ইমাম আবূ হানীফার প্রায় এক শতাব্দী পরে মূলধারার আলিমগণের মধ্যে চতুর্থ আরেকটি ধারা জন্মলাভ করে। তাঁরা ‘আহলুস সুন্নাহ’ বা সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও ইমামগণের মতের ধারক ছিলেন। পাশাপাশি মুতাযিলীদের দর্শনভিত্তিক মতবাদ খন্ডন করতে যেয়ে তাঁরাও দর্শন-প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তাঁরা আল্লাহর কিছু বিশেষণ স্বীকার করেন এবং কিছু বিশেষণ ব্যাখ্যা করেন। বাহ্যত দর্শনের প্রভাব এবং সাধারণ মানুষের মন থেকে তুলনার ধারণা অপসারণ করতেই তারা এরূপ ব্যাখ্যা করেন। উদ্দেশ্য মহৎ হলেও ক্রমান্বয়ে দর্শন নির্ভরতা ও ব্যাখ্যা প্রবণতা বাড়তে থাকে।
এ ধারার প্রবর্তকদের অন্যতম বসরার সুপ্রসিদ্ধ ‘ইলম কালাম’ বিশেষজ্ঞ ইমাম ইবন কুল্লাব: আবূ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবন সাঈদ আল-কাত্তান (২৪১ হি)। মুতাযিলীদের প্রতাপের যুগে মামুনের দরবারে তিনি আহলুস সুন্নাতের পক্ষে বিতর্কে মুতাযিলীদেরকে পরাস্ত করেন। তিনি মহান আল্লাহর ‘যাতী’ বা ‘সত্তীয়’ বিশেষণগুলো স্বীকার করতেন। তবে তিনি মহান আল্লাহর ‘ফিলী’ বা কর্ম বিষয়ক বিশেষণগুলো ব্যাখ্যা করতেন। ইবন কুল্লাবের ছাত্র ইমাম আবুল হাসান আলী ইবন ইসমাঈল আল-আশআরী (৩২৪ হি) তাঁর মত সমর্থন করেন এবং ‘‘আশআরী’’ মতবাদের জন্ম হয়।
১০. ২. ইমাম তাহাবী ও ইমাম মাতুরিদী
আমরা দেখেছি যে, মুতাযিলীগণ ফিকহী বিষয়ে হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিলেন এবং অনেক হানাফী ফকীহ স্বেচ্ছায় বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের জালে পড়ে মুতাযিলীগণের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এরপরও মূলধারার হানাফী ইমাম ও ফকীহগণ আকীদার বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা ব্যাখ্যাকৃত আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা অনুসরণ করতেন। পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে কুল্লাবিয়া ও আশআরী মতবাদের প্রভাবও তাদের মধ্যে প্রসারিত হয়। চতুর্থ হিজরী শতকের প্রথমার্ধে ইমাম আবুল হাসান আশআরীর সমসাময়িক দুজন হানাফী ইমাম আকীদার বিষয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেন:
(১) আবূ জাফর আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন সালামাহ তাহাবী (৩২১হি)
(২) আবূ মানসূর মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন মাহমূদ মাতুরিদী (৩৩৩ হি)
এরা দুজন সমসাময়িক হলেও দুজন মুসলিম বিশ্বের দু প্রান্তে বাস করেছেন। ইমাম তাহাবী মুসলিম বিশ্বের পশ্চিম প্রান্তে মিসরে এবং ইমাম মাতুরিদী মুসলিম বিশ্বের পূর্ব প্রান্ত সামারকান্দে বসবাস করেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে কোনো প্রকারের সাক্ষাৎ হয়েছে বলে জানা যায় না। অনুরূপভাবে তাঁদের সমসাময়িক ইমাম আবুল হাসান আশআরী (৩২৪ হি)-এর সাথে তাঁদের দুজনের কারো সাক্ষাৎ হয়েছে বলে জানা যায় না। তবে আকীদা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ইমাম মাতুরিদী ইমাম ইবন কুল্লাব ও ইমাম আশআরীর ইলম কালাম নির্ভর ধারা অনুসরণ করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম তাহাবী মূলত ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর দু সঙ্গীর আকীদা ব্যাখ্যা করেছেন।
পরবর্তী যুগে হানাফী ফকীহগণের মধ্যে, বিশেষত ইরাক, খুরাসান, সমরকন্দ, ভারত ও মুসলিম বিশ্বের পূর্বদিকের দেশগুলোর হানাফীগণের মধ্যে মাতুরিদী মতবাদ প্রসার লাভ করে। শাফিয়ী ফকীহগণের মধ্যে আশআরী মাযহাব প্রসার লাভ করে।
১০. ৩. পূর্ববর্তীদের সাথে পরবর্তীদের বৈপরীত্য
ইসলামী আকীদার বিভিন্ন দিকে আশআরী ও মাতুরিদী মতবাদ সাহাবী-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা অনুসরণ ও প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থেকেছে। তবে খুঁটিনাটি কিছু বিষয়ের পাশাপাশি দুটি বিষয়ে চার ইমাম ও সালাফ সালিহীনের মতের সাথে আশআরী-মাতুরিদী মতের বৈপরীত দেখা যায়: (১) ওহী-নির্ভরতা বনাম ‘আকল’-নির্ভরতা এবং (২) মহান আল্লাহর বিশেষণের ব্যাখ্যা।
১০. ৩. ১. ওহী-নির্ভরতা বনাম আকল-নির্ভরতা
আমরা দেখেছি যে, ‘সালাফ সালিহীন’ আকীদা বিষয়ে ওহী বা কুরআন-সুন্নাহের বক্তব্যের উপরে সার্বিকভাবে নির্ভর করতেন। পক্ষান্তরে আশআরী-মাতুরিদী মতের কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, আকীদা প্রমাণের ক্ষেত্রে ‘আকলী দলীল’ বা মানবীয় জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিই মূল। আকলী দলীল একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে। পক্ষান্তরে ‘নকল’ বা কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য একীন প্রদান করে না। বিশেষত আকীদা বিষয়ে তা একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। এ প্রসঙ্গে আশআরী মতবাদের সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও শাফিয়ী ফকীহ আল্লামা আব্দুর রাহমান ইবন আহমদ আযুদুদ্দীন ঈজী (৭৫৬) এবং সুপ্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ সাইয়িদ শরীফ আলী ইবন মুহাম্মাদ জুরজানী (৮১৬ হি) ‘আল-মাওয়াকিফ’ ও ‘শারহুল মাওয়াকিফ’ গ্রন্থে বলেন:
الدلائل النقلية هل تفيد اليقين بما يستدل بها عليه من المطالب أو لا؟ قيل: لا
تفيد، وهو مذهب المعتزلة وجمهور الأشاعرة لتوقفه.... فقد تحقق أن دلالتها أي دلالة
الأدلة النقلية على مدلولاتها يتوقف على أمور عشرة ظنية فتكون دلالتها أيضا ظنية
.... وإذا كانت دلالتها ظنية لم تكن مفيدة لليقين بمدلولاتها هذا ما قيل والحق
أنها أي الدلائل النقلية قد تفيد اليقين أي في الشرعيات بقرائن ....، نعم في
إفادتها اليقين في العقليات نظر
‘‘নকলী দলীল বা কুরআন-হাদীসের বক্তব্য যে অর্থে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয় সে অর্থে তা নিশ্চিত বিশ্বাস বা একীন প্রদান করে কি না? বলা হয় যে, তা নিশ্চিত বিশ্বাস বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। এটিই মুতাযিলীগণের মত এবং আশআরী মতবাদের অধিকাংশ আলিমের মত। কারণ নকলী দলীল বা কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের অর্থ অনুধাবন অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। .... এভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন-হাদীসের বক্তব্য তার প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত কি না তা জানার আগে দশটি ধারণা-নির্ভর বিষয় জানতে হয়। এজন্য ওহীর বক্তব্য অনুমান বা ধারণা প্রদানকারী মাত্র। .... আর যেহেতু ওহীর বক্তব্য ধারণা প্রদানকারী কাজেই ওহী দ্বারা তার অর্থের বিষয়ে একীন বা নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। এভাবেই এ বিষয়টি বলা হয়। তবে সঠিক বিষয় (আশআরী মতবাদের অল্পসংখ্যক আলিমের মত) হলো, কুরআন-হাদীসের বক্তব্য আনুষঙ্গিক প্রমাণাদির মাধ্যমে ফিকহী বিষয়ে কখনো কখনো নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করতেও পারে।... তবে আকীদার আকলী বিষয়ে কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদানের বিষয়ে আপত্তি আছে।’’[1]
আল্লামা মুহাম্মাদ আব্দুল আযীয ফারহারী (১২৩৯ হি) ‘নিবরাস’ গ্রন্থে বলেন:
قد ذهبت الأشاعرة إلى أن النص المخالف للدليل العقلي مصروف عن الظاهر: لأن صحة
النص إنما تعرف بالدليل العقلي، وهو أنه كلام صاحب المعجزة المصدوق من عند الله
تعالى. فالعقل هو أصل النقل فلا يدفع الأصل بالفرع. بل ذهب جمهورهم إلى أن النصوص
لا تفيد القطع بمعانيها أصلاً؛ لأن اللغة والنحو والصرف إنما نقلها الآحاد
كالأصمعي والخليل وسيبويه، ومع هذا فاحتمال المجاز والاشتراك قائم. ولكن الصحيح
خلافه إذ من العربية ما نقل بالتواتر، وقد تقدم القرائن على أن المراد هذا المعنى
دون ذلك، فلا يمتنع أن يفيد بعض النقليات القطع.
‘‘আশআরীগণের মাযহাব এই যে, আকলী (জ্ঞানবৃত্তিক) দলীলের বিপরীত ‘নস্স’ অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের বক্তব্যকে তার প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা যাবে না; বরং অন্য অর্থ গ্রহণ করতে হবে। কারণ কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের বিশুদ্ধতা তো কেবলমাত্র আকলী দলীল দ্বারাই প্রমাণিত হয়। আকলই নির্দেশ করে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যবাদী বলে প্রমাণিত মু’জিযার অধিকারী নবীর কথা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য আকলই হলো নকল বা কুরআন-হাদীসের দলীলের মূল ভিত্তি। কাজেই কোনো শাখা বা দ্বিতীয় পর্যায়ের দলীলের কারণে মূল বা প্রথম পর্যায়ের দলীলকে বাদ দেওয়া যাবে না। উপরন্তু আশআরীগণের অধিকাংশের মত এই যে, কুরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলো মূলতই তাদের অর্থের বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। কারণ ভাষা, শব্দতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় তো আসমায়ী, খলীল, সিবাওয়াইহি প্রমুখ একক ব্যক্তির বর্ণনা। এছাড়া ভাষার মধ্যে রূপক অর্থ ও একাধিক অর্থ গ্রহণের সম্ভাবনা বিদ্যমান। তবে তাদের কথা পুরো সঠিক নয়। কারণ আরবী ভাষার মধ্যে কিছু বিষয় রয়েছে যা মুতাওয়াতিরভাবে বর্ণিত এবং পারিপার্শিক প্রমাণ দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এ শব্দের এটিই অর্থ। কাজেই কুরআন-হাদীসের কোনো কোনো বক্তব্য দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান লাভ অসম্ভব নয়।’’[2]
[1] জুরজানী, আলী ইবন মুহাম্মাদ, শারহুল মাওয়াকিফ ২/৫১-৫৬।
[2] ফারহারী, আন-নিবরাস, পৃষ্ঠা ১১৯।
১০. ৩. ২. মহান আল্লাহর বিশেষণসমূহের ব্যাখ্যা
আমরা দেখেছি যে, আবূ হানীফা, মালিক, শাফিয়ী, আহমদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) ও প্রথম তিন/চার প্রজন্মের মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বুজৃর্গগণ কুরআন ও হাদীসে উল্লেখকৃত মহান আল্লাহর সকল বিশেষণ ব্যাখ্যা ও তুলনা ব্যতিরেকে সরল অর্থে গ্রহণ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা ফিকহুল আকবার, ফিকহুল আবসাত, ওসিয়্যাহ ও অন্যান্য গ্রন্থে ২১টি যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) সিফাত প্রমাণ করেছেন। পক্ষান্তরে আশআরী ও মাতুরীদী মতবাদে আল্লাহর ৭ বা ৮ টি বিশেষণকে স্বীকার করা হয়। সেগুলো নিম্নরূপ: (১) হায়াত (الحياة) বা জীবন, (২) কুদরত (القدرة) বা ক্ষমতা, (৩) ইলম (العلم) বা জ্ঞান, (৪) ইরাদা (الإرادة) বা ইচ্ছা, (৫) সামউ (السمع) বা শ্রবণ, (৬) বাসার (البصر) বা দর্শন, (৭) কালাম (الكلام) বা কথা, (৮) তাকবীন (التكوين) বা তৈরি করা।[1]
‘সুনিশ্চিত’, একীনী বা আকলী দলীলের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার যুক্তিতে এ বিশেষণগুলো ছাড়া সকল বিশেষণ ব্যাখ্যা করাকেই অধিকাংশ আশআরী-মাতুরিদী আলিম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মহান আল্লাহর মুখমণ্ডল, হাত, আরশের উপর অধিষ্ঠান, অবতরণ, ক্রোধ, সন্তুষ্টি, ভালবাসা, ইত্যাদি সকল বিশেষণই তারা রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে আরশের উপর অধিষ্ঠান বিশেষণ বিষয়ে ‘আল-মাওয়াকিফ’ ও ‘শারহুল মাওয়াকিফ’ গ্রন্থের নিম্নের বক্তব্য উদ্ধৃত করা যায়:
لا بد من العلم بعدم المعارض العقلي الدال على نقيض ما دل عليه الدليل النقلي إذ
لو وجد ذلك المعارض لقدم على الدليل النقلي قطعا بأن يؤول الدليل النقلي عن معناه
إلى معنى آخر مثاله قوله تعالى الرحمن على العرش استوى فإنه يدل على الجلوس وقد
عارضه الدليل العقلي الدال على استحالة الجلوس في حقه تعالى فيؤول الاستواء
بالاستيلاء أو يجعل الجلوس على العرش كناية عن الملك وإنما قدم المعارض العقلي على
الدليل النقلي إذ لا يمكن العمل بهما ... وتقديم النقل على العقل بأن يحكم بثبوت
ما يقتضيه الدليل النقلي دون ما يقتضيه الدليل العقلي إبطال للأصل بالفرع فإن
النقل لا يمكن إثباته إلا بالعقل ... ... فقد تحقق أن دلالتها أي دلالة الأدلة
النقلية على مدلولاتها يتوقف على أمور عشرة ظنية فتكون دلالتها أيضا ظنية ....
وإذا كانت دلالتها ظنية لم تكن مفيدة لليقين بمدلولاتها هذا ما قيل والحق أنها أي
الدلائل النقلية قد تفيد اليقين أي في الشرعيات بقرائن ....، نعم في إفادتها
اليقين في العقليات نظر
‘‘নকলী দলীল (কুরআন বা হাদীসের বক্তব্য) গ্রহণ করার পূর্বে জানতে হবে যে, ওহীর এ বক্তব্যটির বিপরীত অর্থ প্রকাশক কোনো আকলী দলীল বা জ্ঞানবৃত্তিক প্রমাণ বিদ্যমান নেই। কারণ যদি কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের বিপরীতে কোনো জ্ঞানবৃত্তিক প্রমাণ বিদ্যমান থাকে তবে নিশ্চিতভাবে জ্ঞানবৃত্তিক দলীলটিকে ওহীর বক্তব্যের উপরে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এজন্য নকলী দলীল বা ওহীর বক্তব্যকে তার অর্থ থেকে অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করতে হবে। এর উদাহরণ মহান আল্লাহর বক্তব্য: ‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।’ এ বক্তব্য থেকে উপবেশন প্রমাণ হয়। আর জ্ঞানবৃত্তিক দলীল প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহর জন্য উপবেশন অসম্ভব। কাজেই এখানে ইসতিওয়া (অধিষ্ঠান) শব্দটির ব্যাখ্যা হবে অধিকার করা বা দখল করা। অথবা আরশের উপর উপবেশন বলতে রাজত্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেহেতু দুটি দলীল একত্রে গ্রহণ করা সম্ভব নয় সেহেতু ওহীর বক্তব্যের উপরে জ্ঞানবৃত্তিক দলীলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যদি জ্ঞান ও যুক্তির দাবিকে উপেক্ষা করে ওহীর বক্তব্য গ্রহণ করা হয় তবে তা শাখাকে গ্রহণ করার জন্য মূলকে বাতিল করা বলে গণ্য হবে। কারণ ওহীর বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা জ্ঞানবৃত্তিক দলীল ছাড়া প্রমাণ করা যায় না। ....’’[2]
তাঁরা আল-মাওয়াকিফ ও শারহুল মাওয়াকিফ গ্রন্থে আরো বলেন:
أنه تعالى ليس في جهة ولا في مكان.... وخالف فيه المشبهة، وخصصوه بجهة الفوق ...
الاستدلال بالظواهر الموهمة بالتجسم من الآيات والأحاديث نحو قوله تعالى الرحمن
على العرش استوى وجاء ربك والملك صفا صفا... وحديث النزول، وقوله للخرساء أين الله
فأشارت إلى السماء فقرر، ... والجواب أنها ظواهر ظنية لا تعارض اليقينيات ومهما
تعارض دليلان وجب العمل بهما ما أمكن فتؤول الظواهر إما إجمالا ويفوض تفصيلها إلى
الله كما هو رأي من يقف على إلا الله وعليه أكثر السلف كما روي عن أحمد الاستواء
معلوم والكيفية مجهولة والبحث عنها بدعة وأما تفصيلا كما هو رأي طائفة فنقول
الاستواء الاستيلاء نحو قد استوى عمرو على العراق... والنزول محمول على اللطف
والرحمة ...
‘‘মহান আল্লাহ কোনো দিকে বা স্থানে নন। ... মুশাবিবহা বা তুলনাকারী ফিরকা এ বিষয়ে মতভেদ করেছেন। ঊর্ধ্ব দিক বা স্থানকে তারা তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করেছেন।... তাদের পক্ষে দলিল হিসেবে কুরআন ও হাদীসের কিছু বক্তব্য- আয়াত ও হাদীস- পেশ করা হয় যেগুলো থেকে বাহ্যত ধারণা হয় যে, মহান আল্লাহ দেহধারী। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে অধিষ্ঠান গ্রহণ করেছেন’’, ‘‘আগমন করলেন আপনার রব এবং ফিরিশতাগণ কাতারে কাতারে’’[3], .... মহান আল্লাহর প্রথম আসমানে অবতরণ বিষয়ক হাদীস, অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাকশক্তিহীন মহিলাকে বলেন: আল্লাহ কোথায়? তখন মহিলা আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার ইঙ্গিত মেনে নেন।... এ সকল আয়াত ও হাদীসের উত্তর এই যে, এগুলো সবই ‘যান্নী’ বা ধারণা প্রদানকারী (অস্পষ্ট) বাহ্যিক বক্তব্য (এগুলো একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না) কাজেই এগুলোকে একীনী প্রমাণগুলোর বিপরীতে পেশ করা যাবে না। আর যখন দুটো দলীল পরস্পর বিরোধী হয় তখন যথাসম্ভব উভয়ের মধ্যে সমন্বয় করে তা গ্রহণ করতে হয়। এজন্য কুরআন ও হাদীসের এ সকল বাহ্যিক বক্তব্য এজমালিভাবে বা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। যারা বিষয়টিকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেন তাদের মত হলো এজমালিভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা এবং বিস্তারিত আল্লাহর উপর সোপর্দ করা। অধিকাংশ সালফ সালিহীন (পূর্ববর্তী বুজুর্গ) এ মত গ্রহণ করেছেন। যেমন ইমাম আহমদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: অধিষ্ঠান জ্ঞাত, পদ্ধতি অজ্ঞাত এবং এ বিষয়ে গবেষণা বিদআত। বিস্তারিত ব্যাখ্যা এক দলের মত। এজন্য আমরা বলব: অধিষ্ঠান অর্থ দখল করা, যেমন বলা যায়: ‘উমার ইরাকের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছে’- অর্থাৎ ইরাক দখল করেছে বা ইরাকের ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। ... অবতরণ বলতে মমতা ও রহমত বুঝানো হয়েছে। ....’’[4]
মাতুরিদী মতবাদের প্রসিদ্ধ ইমাম আল্লামা মাসঊদ ইবন উমার সা’দুদ্দীন তাফতাযানী (৭৯২ হি) এ প্রসঙ্গে বলেন:
الأدلة القطعية قائمة على التنزيهات، فيجب أن يفوض علم النصوص إلى الله تعالى على
ما هو دأب السلف إيثارا للطريق الأسلم، أو يؤول بتأويلات صحيحة على ما اختاره
المتأخرون....
‘‘নিশ্চিত জ্ঞান প্রদানকারী দলীলগুলো প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহ মানবীয় বিশেষণাদি থেকে পবিত্র। কাজেই কুরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলোর জ্ঞান আল্লাহর কাছে সমর্পন করতে হবে। প্রথম যুগগুলোর সালাফ সালিহীন-এর এটিই রীতি এবং এটিই নিরাপদ পথ। অথবা এগুলোকে সঠিক ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যায়িত করতে হবে। পরবর্তী যুগের আলিমগণ এ মত গ্রহণ করেছেন....।’’[5]
উলেস্নখ্য যে, আশআরী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবুল হাসান আশআরী নিজে অধিকাংশ বিশেষণ স্বীকার ও প্রমাণ করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
قولنا الذي نقول به وديانتنا التي ندين بها التمسك بكتاب الله ربنا عز و جل وبسنة
نبينا محمد ﷺ وما روى عن السادة الصحابة والتابعين وأئمة الحديث ... وأن الله
تعالى استوى على العرش على الوجه الذي قاله وبالمعنى الذي أراده استواء منزها عن
الممارسة والاستقرار والتمكن والحلول والانتقال لا يحمله العرش بل العرش وحملته
محمولون بلطف قدرته ومقهورون في قبضته وهو فوق العرش وفوق كل شيء إلى تخوم الثرى،
فوقية لا تزيده قربا إلى العرش والسماء بل هو رفيع الدرجات عن العرش كما أنه رفيع
الدرجات عن الثرى وهو مع ذلك قريب من كل موجود وهو أقرب إلى العبد من حبل الوريد
وهو على كل شيء شهيد. وأن له سبحانه وجها بلا كيف كما قال: "ويبقى وجه ربك ذو
الجلال والإكرام". وأن له سبحانه يدين بلا كيف كما قال سبحانه: "خلقت
بيدي"، وكما قال: "بل يداه مبسوطتان"، وأن له سبحانه عينين بلا كيف
كما قال سبحانه: "تجري بأعيننا".
‘‘আমাদের মত, দীন ও ধর্ম এই যে, আমরা মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সুন্নাত এবং উম্মাতের পুরোধাগণ: সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ এবং হাদীসের ইমামগণ থেকে যা বর্ণিত হয়েছে তা সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরি...। আরো বলি যে, মহান আল্লাহ আরশের উপরে অধিষ্ঠান করেছেন, তিনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই এবং যে অর্থ তিনি উদ্দেশ্য করেছেন সে অর্থেই। এ অধিষ্ঠান স্পর্শ ও স্থিতি, উপবেশন, সংমিশ্রণ ও স্থানান্তর থেকে পবিত্র। আরশ তাঁকে বহন করে না; বরং আরশ ও আরশের বাহকগণ তাঁর সুক্ষ্ম ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রিত এবং তাঁর কবজার অধীন। তিনি আরশের ঊর্ধ্বে এবং মহাবিশ্বের সর্বনিম্ন স্তর থেকে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁর এ ঊর্ধ্বত্ব তাঁকে আরশের ও আসমানের অধিক নিকটবর্তী করে না। বরং তিনি আরশ থেকে যেমন সুউচ্চ মর্যাদায় তেমনি যমিন থেকেও সুউচ্চ মর্যাদায়। একই সাথে তিনি সকল সৃষ্টির নিকটবর্তী। তিনি কণ্ঠের শিরার চেয়েও বান্দার নিকটবর্তী। এবং তিনি সকল কিছুর প্রত্যÿকারী। আমরা আরো বলি যে, মহান আল্লাহর একটি মুখমণ্ডল আছে, কোনোরূপ স্বরূপ বা প্রকৃতি ছাড়াই; কারণ তিনি বলেছেন[6]: ‘‘এবং অবিনশ্বর শুধু আপনার প্রতিপালকের মহিমাময় মহানুভব মুখমণ্ডল’’। এবং মহান আল্লাহর দুটি হাত আছে, কোনোরূপ স্বরূপ-প্রকৃতি ব্যতিরেকে; কারণ তিনি বলেছেন[7]: ‘‘আমি সৃষ্টি করেছি আমার হস্তদ্বয় দ্বারা’’। তিনি আরো বলেছেন[8]: ‘‘বরং তাঁর উভয় হাতই প্রসারিত’’। এবং মহান আল্লাহর দুটি চোখ আছে কোনোরূপ স্বরূপ বা প্রকৃতি ব্যতিরেকে। কারণ আল্লাহ বলেছেন[9]: ‘‘যা চলছিল আমার অক্ষির সম্মুখে..।’’[10]
ইমাম আবূ হানীফার ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ নামে পরিচিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এর দ্বিতীয় ভাষ্যটির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম আবূ মানসূর মাতুরিদীর নামে মুদ্রিত। তবে গবেষকগণ নিশ্চিত করেছেন যে, গ্রন্থটি মূলত মাতুরিদীর ছাত্র পর্যায়ের প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আবুল লাইস সামারকান্দী নাসর ইবন মুহাম্মাদ (৩৭৩ হি)-এর রচিত। গ্রন্থটিতে বারবার ইমাম মাতুরিদীর বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং মাতুরিদী মাযহাবের ভিত্তিতেই গ্রন্থটি রচিত। এ গ্রন্থে গ্রন্থকার একস্থানে বলেন:
وقالت القدرية والمعتزلة إن الله تعالى في كل مكان، واحتجتا بقوله تعالى:
"وهو الذي في السماء إله وفي الأرض إله"، أخبر أنه في السماء وفي الأرض،
إلا أنا نقول: لا حجة لكم في الآية... المراد به نفوذ الإلهية في السماء وفي الأرض،
وبه نقول. وقول المعتزلة والقدرية في هذا أقبح من قول المشبهة؛ لأن قولهم يؤدي إلى
أن الله تعالى في أجواف السباع والهوام والحشرات، تعالى الله عن ذلك علوا كبيرا.
وأما مذهب أهل السنة والجماعة أن الله على العرش علو عظمة وربوبية، لا علو ارتفاع
مكان ومسافة
‘‘মুতাযিলী ও কাদারিয়াগণ বলেন, আল্লাহ সকল স্থানে। আল্লাহ বলেছেন: ‘‘আসমানে তিনি মাবূদ এবং পৃথিবীতে তিনি মাবূদ’’। এ আয়াত দিয়ে তারা বলে: তিনি তো বললেন যে, তিনি আসমানের মধ্যে এবং পৃথিবীর মধ্যে। আমরা বলি, এ আয়াত তোমাদের দাবি প্রমাণ করে না। ... এ আয়াতের অর্থ আসমান-যমীন সর্বত্র একমাত্র তাঁর ইবাদতই কার্যকর। ... মুতাযিলী ও কাদারিয়াদের কথা মুশাবিবহা বা তুলনাকারীদের কথার চেয়েও জঘন্যতর। কারণ তাদের দাবি অনুসারে মহান আল্লাহ বন্যপ্রাণী, পশুপাখী ও কীটপতঙ্গের দেহের মধ্যে রয়েছেন। এরূপ অবস্থা থেকে আল্লাহ অনেক ঊর্ধ্বে। আহলূস সুন্নাতের (মাতুরিদী) মত এই যে, আল্লাহ আরশের উপরে। তাঁর এ ঊর্ধ্বত্ব স্থান ও দূরত্বের ঊর্ধ্বত্ব নয়, বরং মর্যাদা ও প্রতিপালনের ঊর্ধ্বত্ব।’’[11]
ইমাম আশআরী ও ইমাম সামারকান্দীর বক্তব্যে আমরা দেখেছি যে, তাঁরা মহান আল্লাহর ‘বাহ্যত মানবীয়’ বিশেষণগুলো কিছুটা ব্যাখ্যা সাপেক্ষে গ্রহণ করেছেন। ‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’ মতটিকে ‘সর্বেশ্বরবাদ’ বলে গণ্য করেছেন। অথচ বর্তমানে অনেক মুসলিম এ বিভ্রান্ত মতটিকেই ইসলামী আকীদা বলে গণ্য করেন। ওহীর বর্ণনা অনুসারে মহান আল্লাহ বান্দার সাথে ও নিকটে এবং তাঁর জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান, তাঁর মহান সত্তা নয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ ইউসুফের মত দেখুন। বাশ্শার ইবন মূসা খাফ্ফাফ বলেন:
جاء بشر بن الوليد الكندي إلى القاضي أبي يوسف فقال له تنهاني عن الكلام وبشر
المريسي وعلي الأحول وفلان يتكلمون قال وما يقولون قال يقولون الله في كل مكان
فقال أبو يوسف علي بهم فانتهوا إليهم وقد قام بشر فجيء بعلي الأحول وبالآخر شيخ
فقال أبو يوسف ونظر إلى الشيخ لو أن فيك موضع أدب لأوجعتك فأمر به إلى الحبس وضرب
الأحول وطوف به
‘‘বিশর ইবন ওলীদ কিন্দী কাযী আবূ ইউসুফের নিকট আগমন করে বলেন: আপনি তো আমাকে ইলমুল কালাম থেকে নিষেধ করেন, কিন্তু বিশর আল-মারীসী, আলী আল-আহওয়াল এবং অমুক ব্যক্তি কালাম নিয়ে আলোচনা করছে। আবূ ইউসুফ বলেন: তারা কী বলছে? তিনি বলেন: তারা বলছে যে, আল্লাহ সকল স্থানে বিরাজমান। তখন আবূ ইউসুফ বলেন: তাদেরকে ধরে আমার কাছে নিয়ে এস। তখন তারা তাদের নিকট গমন করে। ইত্যবসরে বিশর আল-মারীসী উক্ত স্থান পরিত্যাগ করেছিলেন। এজন্য আলী আহওয়াল এবং অন্য একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে ধরে আনা হয়। আবূ ইউসুফ বৃদ্ধ ব্যক্তিটির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন: আপনার দেহে শাস্তি দেওয়ার মত স্থান থাকলে আমি আপনাকে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিতাম। তিনি উক্ত বৃদ্ধকে কারারুদ্ধ করার নির্দেশ দেন এবং আলী আহওয়ালকে বেত্রাঘাত করা হয় এবং রাসত্মায় ঘুরানো হয়।’’[12]
[1] তাফতাযানী, শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যাহ (এমদাদিয়া, দেওবন্দ), পৃষ্ঠা ৫১-৬৫।
[2] জুরজানী, শারহুল মাওয়াকিফ ২/৫১-৫৬।
[3] সূরা (৮৯) ফাজর, আয়াত: ২২।
[4] জুরজানী, শারহুল মাওয়াকিফ ৮/২২-২৮।
[5] তাফতাযানী, শারহুল আকায়িদিন নাসাফিয়্যাহ (এমদাদিয়া: দেওবন্দ), পৃষ্ঠা ৪২।
[6] সূরা (৫৫) রাহমান: ২৭ আয়াত।
[7] সূরা (৩৮) স্বাদ: ৭৫ আয়াত।
[8] সূরা (৫) মায়িদা: ৬৪ আয়াত।
[9] সূরা (৫৪) কামার: ১৪ আয়াত।
[10] আশআরী, আল-ইবানাহ আন উসূলিদ্দিয়ানাহ, পৃষ্ঠা ২০।
[11] আবূ মানসূর মাতুরিদী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ১৯।
[12] যাহাবী, আল-উলুওউ লিল আলিয়্যিল গাফ্ফার, পৃষ্ঠা ১৫১।
১০. ৪. বিশেষণ বিষয়ে প্রান্তিকতা
আশআরী-মাতুরিদী আলিমগণের মধ্যে অনেকেই ব্যাখ্যমুক্তভাবে বিশেষণগুলো বিশ্বাস করা উত্তম বলেছেন। কেউ ব্যাখ্যার পক্ষে কঠোরতা অবলম্বন করেছেন। মহান আল্লাহর হাত, চক্ষু, আরশের উপর অধিষ্ঠান, অবতরণ ইত্যাদি বিশেষণ তুলনামুক্তভাবে বিশ্বাসকারীদেরকে তাঁরা ঢালাওভাবে ‘মুশাবিবহা’ (তুলনাকারী), ‘মুজাস্সিমা (দেহে বিশ্বাসী) বা কাফির বলে গালি দিয়েছেন। এমনকি এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যামুক্ত, তুলনামুক্ত ও ‘কাইফ’ বা স্বরূপ সন্ধানমুক্ত অনুবাদ করাকেও তারা একইরূপ বিভ্রান্তি বলে গণ্য করেছেন। এর বিপরীতে সালফ সালিহীনের মত অনুধাবন ও ব্যাখ্যায়ও নানাবিধ প্রান্তিকতা বিদ্যমান। সালাফের অনুসরণের দাবিতে অনেকে আশআরী-মাতুরিদীগণকে ঢালাওভাবে ‘জাহমী’ বলেন। বিশেষণকে ব্যাখ্যামুক্তভাবে গ্রহণ করার পর অতুলনীয়ত্ব ব্যাখ্যায় কিছু বললেও তারা তা বিভ্রান্তি বলে গণ্য করেন।
প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবনুল জাওযী (৫৯৭ হি) উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম হাসান ইবন হামিদ (৪০৩ হি), কাযী আবূ ইয়ালা মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি), ইবনুয যাগওয়ানী আলী ইবন উবাইদুল্লাহ (৫২৭ হি) প্রমুখ প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ মহান আল্লাহর মুখগহবর, দাঁত, বক্ষ, উরু... ইত্যাদি আছে বলে বিশ্বাস করতেন। ইবনুল জাওযীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, কুরআন, সহীহ হাদীস, যয়ীফ হাদীস, তাবিয়ী যুগের কোনো কোনো আলিমের বক্তব্য সবকিছুকে একইভাবে ‘ওহীর’ মান প্রদানের ফলে তাঁরা এরূপ প্রান্তিকতায় নিপতিত হন। ব্যাখ্যাবিহীন গ্রহণের নামে তাঁরা ওহীর সাথে সংযোজনের মধ্যে নিপতিত হতেন।[1]
[1] বিস্তারিত দেখুন: ইবনুল জাওযী, দাফউ শুবাহিত তাশবীহ।
১১. পরবর্তীগণের মতপার্থক্য পর্যালোচনা / ১১. ১. বিশেষণগুলোর অর্থ অজ্ঞাত অথবা জ্ঞাত
১১. পরবর্তীগণের মতপার্থক্য পর্যালোচনা
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, জাহমী, মুতাযিলী ও সমমনা ফিরকা ছাড়াও সাহাবী-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীদের মধ্যেও নানাবিধ মতভেদ ও প্রান্তিকতা জন্ম নিয়েছে। নিম্নের কয়েকটি বিষয় হয়ত আমাদেরকে এ বিষয়ক প্রান্তিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে:
১১. ১. বিশেষণগুলোর অর্থ অজ্ঞাত অথবা জ্ঞাত
কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, সালাফ সালিহীন আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলো ‘‘অজ্ঞাতঅর্থ’’ বা ‘‘অর্থ বিহীন শব্দ’’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা এগুলোর অর্থ মানবীয় জ্ঞানের আওতা বহির্ভূত বলে গণ্য করেছেন এবং অর্থের বিষয়টি মহান আল্লাহর উপর সমর্পন করেছেন। সালাফ সালিহীনের দু-একটি বক্তব্যকে তাঁরা তাঁদের এ মতের পক্ষে প্রমাণ পেশ করেছেন। আমরা দেখেছি সুফইয়ান ইবন উআইনা বলেছেন: ‘‘আল্লাহ কুরআনে নিজের বিষয়ে যে সকল বিশেষণ উল্লেখ করেছেন তার পাঠই তার ব্যাখ্যা কোনো স্বরূপ নেই এবং তুলনা নেই।’’ আওযায়ী, মালিক, সুফিয়ান সাওরী, লাইস ইবন সা’দ প্রমুখ আলিম বলেছেন: ‘‘এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই চালিয়ে নাও; কোনোরূপ স্বরূপ-প্রকৃতি ব্যতিরেকে।’’ আহমদ ইবন হাম্বাল বলেছেন: ‘‘আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, সত্য বলে গ্রহণ করি, কোনো ‘কিভাবে’ নেই এবং কোনো অর্থ নেই। ’’ এ সকল বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তাঁরা বলেন যে, সালাফ সালিহীনের মতে মহান আল্লাহর বিশেষণগুলোর অর্থ ‘‘অজ্ঞাত’’।
কিন্তু আমরা যখন সালফ সালিহীনের বক্তব্যগুলো পূর্ণভাবে পাঠ করি তখন আমরা নিশ্চিত হই যে, তাঁরা এ সকল বিশেষণের অর্থ জ্ঞাত তবে ব্যাখ্যা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা অর্থ বিশ্বাস করেছেন এবং স্বরূপ, হাকীকত বা ব্যাখ্যার জ্ঞানকে আল্লাহর উপর সমর্পন করেছেন। তাঁরা সর্বদা বলেছেন, এ সকল বিশেষণ পাঠ বা শ্রবণ করলে যা বুঝা যায় তাই এর অর্থ এবং তুলনামুক্ত ও স্বরূপহীনভাবে এ অর্থ বিশ্বাস করতে হবে। এর অতিরিক্ত কোনো অর্থ, তাবীল বা ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করা যাবে না।
আমরা দেখেছি তাবিয়ী মুজাহিদ বলেছেন: ‘আরশের উপর ‘ইসতিওয়া’ করেছেন অর্থ আরশের ঊর্ধ্বে থেকেছেন।’’ তিনি বলেন নি যে, এ বাক্যটির অর্থ অজ্ঞাত। ‘ইসতিওয়া’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে ইমাম মালিক ও অন্যান্য ইমাম বলেন নি যে, আল্লাহর ক্ষেত্রে ইসতিওয়া কথাটির অর্থ আমরা জানি না। বরং তাঁরা স্পষ্টভাবেই বলেছেন ‘ইসতিওয়া’ একটি জ্ঞাত বিষয়, তবে তার পদ্ধতি, স্বরূপ বা প্রকৃতি অজ্ঞাত।
ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘তাঁর হস্ত আছে, মুখমন্ডল আছে, নফস আছে, কারণ আল্লাহ কুরআনে এগুলো উল্লেখ করেছেন।’’ এখানে লক্ষণীয় যে, এ কথাগুলো কুরআনের হুবহু বক্তব্য নয়। কুরআনের বক্তব্য: তিনি হস্ত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর হস্তদ্বয় প্রসারিত... ইত্যাদি। ইমাম আযমের বক্তব্য কুরআনের বক্তব্যের ‘আরবী অনুবাদ’। এ থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, তারা এগুলোর অর্থ পরিজ্ঞাত ও বাহ্যিক অর্থে ব্যবহৃত বলে গণ্য করেছেন। তাঁকে অবতরণ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন নি যে, তিনি অবতরণ করেন না অথবা অবতরণ শব্দের অর্থ অপরিজ্ঞাত। বরং তিনি বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহ অবতরণ করেন, কোনোরূপ পদ্ধতি বা স্বরূপ ব্যতিরেকে।’’
আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফা আল্লাহর বিশেষণসমূহ অনুবাদ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ ইসলাম সকল ভাষার মানুষের জন্য। অনুবাদ না করলে অন্য ভাষার মানুষেরা এ বিশেষণগুলো কিভাবে বিশ্বাস করবেন? ‘অর্থহীন শব্দ’- বিশ্বাস করবেন? না ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করবেন? ‘রহমান আরশের উপর অধিষ্ঠান করলেন’ কথাটির অনুবাদে কী লিখতে হবে? ‘ইসতিওয়া’ লিখলে অন্য ভাষার মুমিনগণ কী বিশ্বাস করবেন? আর ‘ক্ষমতা গ্রহণ’ লিখলে তো নিষিদ্ধ ব্যাখ্যা চাপিয়ে দেওয়া হলো। ‘আল্লাহর শেষ রাত্রে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন’ হাদীসটির অনুবাদ কিভাবে হবে? ‘নুযুল করেন’ লিখলে অনারব পাঠক কী বুঝবেন ও বিশ্বাস করবেন? আর ব্যাখ্যা লিখলে তো মুতাযিলা ও কাদারিয়াদের পথে চলা হলো। এতে সুস্পষ্ট যে, ইমামগণ এ সকল বিশেষণের অর্থ জ্ঞাত (মুহকাম) ও হাকীকত অজ্ঞাত (মুতাশাবিহ) বলে গণ্য করতেন।
১১. ২. বিশেষণগুলোর প্রকাশ্য অর্থ স্বীকৃত বা বর্জিত
উপরের অর্থেই কোনো কোনো আশআরী-মাতুরিদী আলিম বলেছেন, সালাফ সালিহীন একমত যে, এ সকল বিশেষণের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যক্ত। বাহ্যিক অর্থ বলতে যদি ‘তুলনাযুক্ত বাহ্যিক অর্থ’ বুঝানো হয় তবে কথাটি ঠিক। অর্থাৎ হাত, অধিষ্ঠান, চক্ষু, নফস, ক্রোধ, সন্তুষ্টি, অবতরণ ইত্যাদি শব্দ থেকে যদি কেউ সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান এ সকল বিশেষণ বা কর্ম কল্পনা করে তবে তা বাতিল। আর যদি বাহ্যিক অর্থ বলতে ‘তুলনামুক্ত আভিধানিক অর্থ’ বুঝানো হয় তবে এ কথাটি সঠিক নয়। সালাফ সালিহীনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তারা এগুলোকে আভিধানিক অর্থে তুলনামুক্ত ও স্বরূপমুক্তভাবে বিশ্বাস করেছেন। তাঁরা বারবার বলেছেন: এগুলো বিশ্বাস করতে হবে। যদি এগুলোর অর্থ অজ্ঞাত থাকে বা প্রকাশ্য অর্থ বর্জিত হয় তবে কী বিশ্বাস করতে হবে?
পাঠক, উপরে উদ্ধৃত চার ইমাম ও অন্যান্য সালাফ সালিহীনের বক্তব্য আরেকবার পাঠ করুন। আপনি নিশ্চিত হবেন যে, তাঁরা মহান আল্লাহর বিশেষণগুলোকে বাহ্যিক অর্থে তুলনার কল্পনা মন থেকে তাড়িয়ে স্বরূপবিহীনভাবে বিশ্বাস করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন:
هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا أَنْ يَأْتِيَهُمُ اللَّهُ فِي ظُلَلٍ مِنَ الْغَمَامِ
وَالْمَلَائِكَةُ وَقُضِيَ الأَمْرُ
‘‘তারা কি শুধু এর প্রতীক্ষায় রয়েছে যে, আল্লাহ্ ও ফিরিশ্তারা মেঘের ছায়ায় তাদের কাছে উপস্থিত হবেন? এবং সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে।’’[1]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বাগাবী হুসাইন ইবন মাসঊদ (৫১০ হি) বলেন:
والأولى في هذه الآية وما شاكلها أن يؤمن الإنسان بظاهرها ويكل علمها إلى الله
تعالى، ويعتقد أن الله عز اسمه منزه عن سمات الحدث، على ذلك مضت أئمة السلف وعلماء
السنة.
‘‘এ আয়াত এবং এ ধরনের আয়াতগুলোর বিষয়ে উত্তম এই যে, এগুলোর প্রকাশ্য অর্থ বিশ্বাস করবে এবং এর জ্ঞান আল্লাহর উপর সমর্পন করবে। এবং বিশ্বাস করবে যে, মহান আল্লাহ সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য থেকে পবিত্র। সালাফ সালিহীন ইমামগণ এবং আহলুস সুন্নাতের আলিমগণ এ বিশবাসের উপরেই থেকেছেন।’’[2]
মহান আল্লাহ জাহান্নামের মধ্যে পদ স্থাপন করবেন, তিনি হাসবেন, তিনি আনন্দিত হন ইত্যাদি অর্থের হাদীসগুলো উল্লেখ করে ইমাম বাগাবী বলেন:
فهذه ونظائرها صفات لله تعالى ورد بها السمع يجب الإيمان بها، وإمرارها على ظاهرها
معرضا فيها عن التأويل، مجتنبا عن التشبيه، معتقدا أن الباري سبحانه وتعالى لا
يشبه شيء من صفاته صفات الخلق، كما لا تشبه ذاته ذوات الخلق ... وعلى هذا مضى سلف
الأمة ، وعلماء السنة ، تلقوها جميعا بالإيمان والقبول ، وتجنبوا فيها عن التمثيل
والتأويل ، ووكلوا العلم فيها إلى الله عز وجل
‘‘এগুলো এবং এ ধরনের অন্যান্য বিষয় মহান আল্লাহর বিশেষণ। শ্রুতি বা ওহীর বর্ণনা এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ওয়াজিব হলো: এগুলোকে বিশ্বাস করা এবং বাহ্যিক অর্থের উপর এগুলো চালিয়ে নেওয়া। এগুলোর ব্যাখ্যা বর্জন করতে হবে এবং তুলনা পরিত্যাগ করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে যে, মহান সৃষ্টিকর্তার কোনো বিশেষণই সৃষ্টির বিশেষণের মত নয়; যেমন তাঁর সত্তা সৃষ্টির সত্তার মত নয়।... উম্মাতের সালাফ সালিহীন এবং আহলুস সুন্নাতের আলিমগণ এ বিশ্বাসের উপরেই থেকেছেন। তাঁরা সকলেই তা বিশ্বাসের সাথে গ্রহণ করেছেন এবং তুলনা ও ব্যাখ্যা বর্জন করেছেন। এর জ্ঞান মহান আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন।...।’’[3]
এ প্রসঙ্গে ইমাম যাহাবী বলেন: ‘‘বর্তমানে বাহ্যিক অর্থ দু প্রকার হয়ে গিয়েছে: একটি হক্ক ও অন্যটি বাতিল। ‘হক্ক বাহ্যিক অর্থ’ এ কথা বলা যে, মহান আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী, ইচ্ছাকারী, কথা বলেন, হায়াত বা প্রাণের অধিকারী চিরঞ্জীব, জ্ঞানী, তাঁর মুখমণ্ডল ছাড়া সব কিছুই ধ্বংস হবে, তিনি আদমকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেন, তিনি মুসার সাথে প্রকৃতই কথা বলেন, তিনি ইবরাহীমকে খলীল (বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেন... এবং অনুরূপ বিষয়াদি; এগুলোকে আমরা যেভাবে এসেছে সেভাবেই চালিয়ে নিই। এগুলো থেকে আমরা সম্বোধনের অর্থ বুঝি যা মহান আল্লাহর মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এর ব্যতিক্রম কোনো ব্যাখ্যা আছে বলে আমরা বলি না। আর অন্য ‘বাহ্যিক অর্থ’ বাতিল এবং বিভ্রান্তি। তা হলো অদৃশ্যকে দৃশ্যমানের উপর কিয়াস বা তুলনা করা এবং স্রষ্টাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করায় বিশ্বাস করা। মহান আল্লাহ এরূপ তুলনা থেকে পবিত্র ও ঊর্ধ্বে। বরং তাঁর বিশেষণও তাঁর সত্তার মতই। তার সমতুল্য নেই, বিপরীত নেই, নমুনা নেই, তুলনা নেই, প্রতিরূপ নেই, কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তাঁর সত্তার ক্ষেত্রেও নয় এবং তাঁর বিশেষণের ক্ষেত্রেও নয়। আর এ বিষয়টির ক্ষেত্রে আলিম-পণ্ডিত এবং সাধারণ মানুষ সকলেই সমান। মহান আল্লাহই ভাল জানেন।’’[4]
এভাবে আমরা দেখছি যে, সালাফ সালিহীন এগুলো ‘বাহ্যিক অর্থ’ জ্ঞাত বলে বিশ্বাস করেছেন এবং এগুলোকে বাহ্যিক অর্থে চালিয়ে নিতে ও বিশ্বাস করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি এর ‘বাহ্যিক তুলনা’ বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর ব্যাখ্যা ও হাকীকতের জ্ঞান আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন।
[1] সূরা (২) বাকারা: ২১০ আয়াত।
[2] বাগাবী, মাআলিমুত তানযীল: তাফসীর বাগাবী ১/২৪১।
[3] বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ (দিমাশক-বৈরুত, আল-মাকতাবুল ইসলামী, ২য় মুদ্রণ, ১৯৮৩ খৃ) ১/১৭০-১৭১।
[4] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৯/৪৪৯।
১১. ৩. ওহীর প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ তুলনা কি না
এ সকল বিশেষণের অর্থ অজ্ঞাত এবং এর প্রকাশ্য অর্থ পরিত্যক্ত- এ দুটি দাবির ভিত্তিতে কোনো কোনো আলিম তুলনামুক্তভাবে প্রকাশ্য অর্থে আল্লাহর বিশেষণ বিশ্বাসকারীকে মুজাস্সিমা (দেহে বিশ্বাসী) বা মুশাবিবহা (তুলনাকারী) বলে অভিযুক্ত করেন। অর্থাৎ যদি কেউ বলেন: ‘‘মহান আল্লাহর হস্ত আছে, মুখমণ্ডল আছে, তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠান করেছেন, শেষ রাত্রে অবতরণ করেন; স্বরূপ ছাড়া, সৃষ্টির মত নয়’’ তবে তাঁরা তাকে বিভ্রান্ত বলে গণ্য করেন। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। কেউ নিজ মুখে তুলনার দাবি না করলে তাকে তুলনাকারী বলা সঠিক নয়; বিশেষত কুরআন-হাদীসের বক্তব্য হুবহু বিশ্বাসের পাশাপাশি যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের স্বীকৃতি প্রদান করছেন। এছাড়া কুরআন বা হাদীস যা বলেছে হুবহু তা নিজের ভাষায় বললে বা বিশ্বাস করলে কোনো মুমিন অপরাধী হন বলে চিন্তা করাও মুমিনের জন্য কঠিন। এখানে প্রসঙ্গত ইমাম তিরমিযীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন:
... قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ إِنَّ اللَّهَ يَقْبَلُ الصَّدَقَةَ وَيَأْخُذُهَا
بِيَمِينِهِ .... قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ. ... وَقَدْ
قَالَ غَيْرُ وَاحِدٍ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ فِى هَذَا الْحَدِيثِ وَمَا يُشْبِهُ
هَذَا مِنَ الرِّوَايَاتِ مِنَ الصِّفَاتِ وَنُزُولِ الرَّبِّ تَبَارَكَ
وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا قَالُوا قَدْ تَثْبُتُ
الرِّوَايَاتُ فِى هَذَا وَيُؤْمَنُ بِهَا وَلاَ يُتَوَهَّمُ وَلاَ يُقَالُ كَيْفَ
هَكَذَا رُوِىَ عَنْ مَالِكٍ وَسُفْيَانَ بْنِ عُيَيْنَةَ وَعَبْدِ اللَّهِ بْنِ الْمُبَارَكِ
أَنَّهُمْ قَالُوا فِى هَذِهِ الأَحَادِيثِ أَمِرُّوهَا بِلاَ كَيْفٍ. وَهَكَذَا
قَوْلُ أَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ. وَأَمَّا
الْجَهْمِيَّةُ فَأَنْكَرَتْ هَذِهِ الرِّوَايَاتِ وَقَالُوا هَذَا تَشْبِيهٌ.
وَقَدْ ذَكَرَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِى غَيْرِ مَوْضِعٍ مِنْ كِتَابِهِ الْيَدَ
وَالسَّمْعَ وَالْبَصَرَ فَتَأَوَّلَتِ الْجَهْمِيَّةُ هَذِهِ الآيَاتِ
فَفَسَّرُوهَا عَلَى غَيْرِ مَا فَسَّرَ أَهْلُ الْعِلْمِ وَقَالُوا إِنَّ اللَّهَ
لَمْ يَخْلُقْ آدَمَ بِيَدِهِ. وَقَالُوا إِنَّ مَعْنَى الْيَدِ هَا هُنَا
الْقُوَّةُ. وَقَالَ إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ إِنَّمَا يَكُونُ التَّشْبِيهُ
إِذَا قَالَ يَدٌ كَيَدٍ أَوْ مِثْلُ يَدٍ أَوْ سَمْعٌ كَسَمْعٍ أَوْ مِثْلُ
سَمْعٍ. فَإِذَا قَالَ سَمْعٌ كَسَمْعٍ أَوْ مِثْلُ سَمْعٍ فَهَذَا التَّشْبِيهُ وَأَمَّا
إِذَا قَالَ كَمَا قَالَ اللَّهُ تَعَالَى يَدٌ وَسَمْعٌ وَبَصَرٌ وَلاَ يَقُولُ
كَيْفَ وَلاَ يَقُولُ مِثْلُ سَمْعٍ وَلاَ كَسَمْعٍ فَهَذَا لاَ يَكُونُ
تَشْبِيهًا وَهُوَ كَمَا قَالَ اللَّهُ تَعَالَى فِى كِتَابِهِ (لَيْسَ كَمِثْلِهِ
شَىْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ).
‘‘... রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: আল্লাহ দান কবুল করেন এবং তা তাঁর ডান হাত দ্বারা গ্রহণ করেন। .... আবূ ঈসা (তিরমিযী) বলেন: এটি হাসান সহীহ হাদীস। .... এ হাদীস এবং এ ধরনের যে সকল হাদীসে আল্লাহর বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে, মহান মহাপবিত্র প্রতিপালকের প্রথম আসমানে অবতরণের কথা বর্ণিত হয়েছে সে সকল হাদীস বিষয়ে আলিমগণ বলেছেন যে, হাদীস দ্বারা এগুলো প্রমাণিত এবং এগুলো বিশ্বাস করতে হবে, তবে কোনো কল্পনা করা যাবে না এবং ‘কিভাবে’ বলা যাবে না। মালিক, সুফিয়ান ইবন উআইনা, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক থেকে এ সকল হাদীসের বিষয়ে বর্ণিত যে, তোমরা এগুলোকে ‘কিভাবে’ (স্বরূপ সন্ধান) ব্যতিরেকে চালিয়ে নেও। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমদের এটিই মত। কিন্তু জাহমীগণ এ সকল হাদীস অস্বীকার করেছে। তারা বলে, এগুলো তুলনা। মহান আল্লাহ কুরআনের অনেক স্থানে হাত, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি বিশেষণ উল্লেখ করেছেন। জাহমীগণ এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করে। আলিমগণ এগুলোর যে ব্যাখ্যা করেছেন (স্বরূপ বিহীন বিশ্বাস করা) জাহমীদের ব্যাখ্যা তার বিপরীত। তারা বলে: আল্লাহ আদমকে তাঁর হাত দিয়ে সৃষ্টি করেন নি। তারা বলে: এখানে হাত অর্থ ক্ষমতা। ইসহাক ইবন ইবরাহীম (ইবন রাহওয়াইহি) বলেন: তুলনা তো তখনই হয় যখন কেউ বলে: হাতের মত হাত, অথবা হাতের সাথে তুলনীয় হাত, শ্রবণের মত শ্রবণ অথবা শ্রবণের তুলনীয় শ্রবণ। কাজেই যদি কেউ বলে শ্রবণের মত শ্রবণ বা শ্রবণের সাথে তুলনীয় শ্রবণ তবে তা ‘তুলনা’। আর যখন কেউ আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবে বলে: হাত, শ্রবণ, দর্শন, কিন্তু ‘কিভাবে’ বলে না এবং ‘শ্রবণের মত’ বা ‘শ্রবণের সাথে তুলনীয়’ও বলে না তখন তা তুলনা নয়। আল্লাহ কুরআনে এভাবেই বলেছেন: ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয় এবং তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[1]
এখানে ইসহাক ইবন রাহওয়াইহি বলেছেন যে, জাহমীগণের মতে আল্লাহর হাত, আল্লাহর শ্রবণ ইত্যাদি বলা বা বিশ্বাস করার অর্থই মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা। পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাত বলেন, তুলনা করলেই তো তুলনা হয়। কেউ যদি বলে মহান আল্লাহর হাত সৃষ্টির হাতের মত, তাঁর শ্রবণ সৃষ্টির শ্রবণের মত, তাঁর দর্শন সৃষ্টির দর্শনের সাথে তুলনীয়... তবেই তা তুলনা বলে গণ্য হবে। আর যদি কেউ আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবেই বলে তাহলে তা কখনোই তুলনা হতে পারে না।
[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৫০।
১১. ৪. ব্যাখ্যা সমস্যার সমাধান করে না
ব্যাখ্যাপন্থী আলিমগণ বলেন যে, বিশেষণগুলোর ব্যাখ্যার মাধ্যমে মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের বিশ্বাস রক্ষা করা যায়। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষণীয়:
প্রথমত: আশআরী-মাতুরিদীগণ ৮টি বিশেষণ স্বীকার এবং অন্যান্য বিশেষণ অস্বীকার করেছেন। যে যুক্তিতে তাঁরা অন্যান্য বিশেষণ অস্বীকার করেছেন সে যুক্তিতেই এ ৮ টি বিশেষণও অস্বীকার করেছেন জাহমী-মুতাযিলীগণ। জাহমীগণ বলেন: কর্ণ ছাড়া শ্রবণ, চক্ষু ছাড়া দেখা, বাগযন্ত্র ছাড়া কথা বলা, মানসিক পরিবর্তন ছাড়া ইচ্ছা ইত্যাদি কল্পনা করা যায় না। কর্ণ, চক্ষু, বাগযন্ত্র, মানসিক পরিবর্তন ইত্যাদি আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। জীবন, ক্ষমতা, ইলম, ইচ্ছা ইত্যাদি বিশেষণেরও একই অবস্থা। এগুলো সৃষ্টির বিশেষণ। মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এগুলো বিশ্বাস করার অর্থই মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনীয় ও দেহধারী বলে বিশ্বাস করা। এছাড়া আশআরী-মাতুরিদী আকিদাবিদগণ আখিরাতে আল্লাহর দর্শনে বিশ্বাসী। মুতাযিলীগণ তাদেরকে এজন্য মুজাস্সিমা-মুশাব্বিহা বলেন। কারণ অবয়ব ও কোনো স্থানে অবস্থান ছাড়া কাউকে দেখা সম্ভব নয়। তাদের মতে মহান আল্লাহকে আখিরাতে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করার অর্থই তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনীয় ও দেহধারী বলে বিশ্বাস করা।
আশআরী-মাতুরিদী আলিমগণ বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বলেন যে, মহান আল্লাহর শ্রবণ, দর্শন, জীবন ইত্যাদি কোনো বিশেষণই সৃষ্টির মত নয়। আখিরাতে আল্লাহকে দেখা আর দুনিয়াতে কোনো সৃষ্টিকে দেখা এক নয়। বাস্তবে এ যুক্তিগুলোই অবশিষ্ট যাতী ও ফি’লী সকল বিশেষণ স্বীকার ও বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য।
দ্বিতীয়ত: ব্যাখ্যার মাধ্যমে মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্ব রক্ষা করার দাবিও সঠিক নয়। যেমন, আরশের উপর অধিষ্ঠান বলতে ‘দখল’ বা ‘ক্ষমতা গ্রহণ’ বললেও একই সমস্যা থাকে। কারণ দখল বা ক্ষমতা গ্রহণও অধিষ্ঠানের মতই মানবীয় কর্ম। এ প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, মুফাস্সির ও হানাফী ফকীহ আল্লামা মাহমূদ ইবন আব্দুল্লাহ হুসাইনী আলূসী (১২৭০হি/১৮৫৪খৃ) বলেন: ‘‘জেনে রাখুন, অনেক মানুষ নকলী দলীল বা কুরআন-হাদীসের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত বিশেষণগুলো মুতাশাবিহ বা অস্পষ্ট অর্থবোধক বলে গণ্য করেন। যেমন আরশের উপর অধিষ্ঠান, হস্ত, পদ, প্রথম আসমানে অবতরণ, হাস্য, অবাক হওয়া ইত্যাদি বিশেষণ। সালফ সালিহীন বা প্রথম যুগের বুজুর্গদের মতানুসারে এগুলো সবই প্রমাণিত বিশেষণ, তবে এগুলোর প্রকৃতি মানবীয় জ্ঞানের অগম্য। এগুলোর অসিত্মত্বে বিশ্বাস করা ছাড়া আমাদেরকে অন্য কোনো (ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা প্রকৃতি উন্মোচনের) দায়িত্ব দেওয়া হয় নি। এগুলোর অসিত্মত্বে বিশ্বাসের সাথে সাথে বিশ্বাস করতে হবে যে এগুলো দেহ নয় এবং সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নয়। এভাবেই কুরআন-হাদীসের বক্তব্য ও জ্ঞানবৃত্তিক যুক্তির মধ্যে বৈপরীত্য দূরীভূত হয়।
পরবর্তী যুগের আলিমগণ এগুলো ব্যাখ্যা করার এবং এগুলো দ্বারা মহান আল্লাহ কি বুঝিয়েছেন তা নির্ধারণ করার মত গ্রহণ করেছেন। যেমন তারা বলেন: আরশের উপর অধিষ্ঠান অর্থ দখল গ্রহণ ও বিজয় লাভ। তাঁদের মতে মহান আল্লাহর আটটি বিশেষণ ছাড়া আর কোনো বিশেষণ নেই। আর দখল করা বা বিজয় লাভ করা আটটি বিশেষণের কোনো একটি বিশেষণের প্রকাশ মাত্র। .... শা’রানী (৯৭৩ হি) আদ-দুরারুল মানসূরাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সালফ সালিহীনের মাযহাবই অধিক নিরাপদ ও অধিক শক্তিশালী। কারণ ব্যাখাকারীগণ আরশের উপর অধিষ্ঠানের অর্থ করেছেন রাজ্য দখল করা। এভাবে দেহ ও স্থান থেকে পবিত্র করতে যেয়ে তারা অন্য একটি মানবীয় ও স্থান নির্ভর কর্মের সাথে তাঁকে সম্পৃক্ত করেছেন। বস্ত্তত তাদের জ্ঞান মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনায় শরীয়তের পূর্ণতায় পৌঁছাতে পারে নি। মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনায় শরীয়তের পূর্ণতা প্রকাশিত হয় কুরআনের বক্তব্যে: ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়’’। আরশের উপরে অধিষ্ঠানের ব্যাখ্যায় আরশের উপর ক্ষমতাবান বা দখলদার হওয়ার কথা বললেও সাথে সাথে এ কথা বলতেই হবে যে, মহান আল্লাহর আরশ দখল মানুষদের দেশ দখলের সাথে তুলনীয় নয়। বরং মহান আল্লাহ তাঁর মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো পদ্ধতিতে আরশের উপর ক্ষমতাবান হন। আর ‘অধিষ্ঠান’-কে ‘দখল গ্রহণ’ বলে ব্যাখ্যা করার পরেও যেহেতু এরূপ কিছু বলতে হচ্ছে, সেহেতু ব্যাখ্যার কষ্ট বহনের পূর্বেই তাদের বলা উচিত যে, মহান আল্লাহ আরশের উপরে অধিষ্ঠান গ্রহণ করেছেন, তবে তা মানবীয় অধিষ্ঠানের সাথে তুলনীয় নয়। তাঁর মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো পদ্ধতিতে তিনি তা করেছেন। মানবীয় জ্ঞান তাঁর ক্ষমতার প্রকৃতি জানতে অক্ষম। এরূপ বলাই আদবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ...।[1]
[1] আলূসী, রুহুল মাআনী (বৈরুত, দারু ইহইয়ায়িত তুরাস: শামিলা ৩.৫) ৩/৮৭-৮৮।
১১. ৫. সকল ব্যাখ্যাকারীই জাহমী কি না
এর বিপরীতে আমরা দেখি যে, সালাফ সালিহীনের কোনো কোনো অনুসারী আশআরী-মাতুরিদীগণকে ঢালাওভাবে জাহমী বলছেন বা মুতাযিলী, জাহমী, আশআরী, মাতুরিদী সকলকেই এক সারিতে দাঁড় করাচ্ছেন। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
(ক) আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সাথে ‘জাহমী-মুতাযিলী’ আকীদার পার্থক্য শুধু বিশেষণ বিষয়ে নয়। অনেক বিষয়ের মধ্যে বিশেষণ একটি বিষয়। সকল বিষয়ে বিভ্রান্তি এবং একটি বিষয়ে বিভ্রান্তিকে একই পর্যায়ের বলে গণ্য করা সঠিক নয়।
(খ) বিশেষণ বিষয়েও জাহমী-মুতাযিলীগণের মতবাদ ও আশআরী-মাতুরিদী মতবাদের মধ্যে ব্যাখ্যার বিষয়, পরিধি, মূলনীতি ও প্রকৃতিতে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। এজন্য বিশেষণ বিষয়েও উভয় মতকে এক পর্যায়ভুক্ত করা সঠিক নয়।
(গ) অনেক আলিম ব্যাখ্যাহীন বিশ্বাস ও ব্যাখ্যা উভয় মত স্বীকার করার পাশাপাশি কোনো কোনো বিশেষণ ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে ব্যাখ্যাহীন ও তুলনাহীন বিশ্বাসকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন কিন্তু কোনো কোনো বিশেষণ ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে তাঁদেরকেও ব্যাখ্যাকারী-অস্বীকারকারীদের কাতারভুক্ত করেন। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমরা দেখেছি যে, সালাফ সালিহীন এবং তাঁদের অনুসারী কোনো কোনো ইমাম থেকেও এরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত।
(ঘ) আমরা দেখেছি, ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘তাঁর হাত ... অঙ্গ নয়...’’, ‘‘আমরা বাগযন্ত্র ও অক্ষরের মাধ্যমে কথা বলি, আর মহান আল্লাহ বাগযন্ত্র এবং অক্ষর ছাড়াই কথা বলেন’’, ‘‘মহান আল্লাহ আরশের উপর অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন, ... আরশের উপরে স্থিরতা-উপবেশন ব্যতিরেকে’’...।
ইমাম আহমদ বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহ আরশের উপর অধিষ্ঠিত। ... অধিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ তিনি এর ঊর্ধ্বে ... অধিষ্ঠানের অর্থ আরশ স্পর্শ করে অবস্থান করা নয়,...’’, ‘‘মহান আল্লাহর ... মুখমন্ডল প্রতিচ্ছবি বা আকৃতি নয় এবং আঁকানো বস্ত্তর মতও নয়। বরং মুখমন্ডল তাঁর একটি মহান বিশেষণ। ... মুখমন্ডল অর্থ দেহ, ছবি বা আকৃতি নয়। ... মহান আল্লাহর দুটি হস্ত বিদ্যমান। ... হস্তদ্বয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নয়, দেহের অংশ নয়, দেহ নয়, দেহ জাতীয় কিছু নয়, সীমা, সংযোজন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জাতীয় কিছুই নয়। ... এতে কনুই, বাহু ইত্যাদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনার সুযোগ নেই।...।’’
অনেক আবেগী মুমিন এগুলোকে নিন্দনীয় ব্যাখ্যা বলে গণ্য করে প্রশ্ন করেন: তাঁর হস্ত অঙ্গ নয়, তাঁর কথা অক্ষর নয়, তাঁর ইসতিওয়া স্পর্শ নয়, তাঁর মুখমণ্ডল প্রতিচ্ছবি নয়... আমরা কিভাবে জানলাম? যেহেতু ওহীতে এ কথাগুলো নেই, সেহেতু এগুলো বলা যাবে না, বরং শুধু বলতে হবে আল্লাহর হস্ত, মুখমণ্ডল.. ইত্যাদি আছে এবং তা সৃষ্টির মত নয়। প্রকৃতপক্ষে ইমামগণের এ কথা বিশেষণের ব্যাখ্যা বা ওহীর সাথে কোনো সংযোজন নয়, বরং মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের ব্যাখ্যা। মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বিষয়ে বলেন নি যে, তাঁর মুখমণ্ডল প্রতিচ্ছবি, তাঁর হস্ত অঙ্গ, তাঁর ইসতিওয়া স্পর্শ ...। অথচ এ সকল বিশেষণ বর্ণনা বা শ্রবণ করলে মানবীয় ধারণায় এরূপ চিন্তা চলে আসে। এজন্য অতুলনীয়ত্ব নিশ্চিত করতেই ইমামগণ এরূপ বলেছেন।
(ঙ) ব্যাখ্যাকে ভুল বলা ও ব্যাখ্যাকারীকে বিভ্রান্ত বলা এক নয়। পারিপার্শিকতা বা যুগের প্রভাবে অথবা সাধারণ মানুষদেরকে তুলনায় নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে অনেক প্রসিদ্ধ আলিম মহান আল্লাহর কোনো কোনো বিশেষণ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের ইজতিহাদকে ভুল বলে গণ্য করা আর তাঁদের অবমূল্যায়ন করা এক নয়। ‘তাকফীর’ প্রসঙ্গে আমরা দেখব যে, ইবন তাইমিয়া ও অন্যান্য আলিম বলেছেন: ফিকহী বিষয়ের ন্যায় আকীদার বিষয়ে ইজতিহাদী ভুল ক্ষমাকৃত। এজন্য আমাদের উচিত জ্ঞানবৃত্তিক সমালোচনা করা। আমরা বলতে পারি, অমুকের অমুক বক্তব্য তুলনা বা অস্বীকারের পর্যায়ে চলে যায় বা কথাটি সঠিক নয়। পাশাপাশি সকল মুমিন, বিশেষত আলিমগণের প্রতি হৃদয়ের ভালবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ করা, মুমিনের বিষয়ে সুধারণা পোষণ এবং মুমিনের বক্তব্যের ভাল ব্যাখ্যা করাই আমাদের দায়িত্ব।
উপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা অনুধাবন করছি যে, মহান আল্লাহর অস্তিত্ব প্রতিটি মানুষই তার জন্মগত প্রকৃতি ও সহজাত অনুভূতি দিয়ে অনুভব করে। তবে তাঁর সত্তার ও বিশেষণের প্রকৃতি পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করা মানবীয় সাধ্যের বাইরে। এক্ষেত্রে ওহীর নিকট আত্মসমর্পনই নিরাপত্তার একমাত্র উপায়। ওহীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাঁর যে পরিচয় প্রদান করেছেন তাঁকে জানার বা তাঁর মারিফাত অর্জনের সেটিই আমাদের একমাত্র উপায়। পাশাপাশি এ বিষয়ক প্রান্তিকতা পরিহার করা প্রয়োজন।
১২. মহান আল্লাহর বিশেষণ অস্বীকার বা ব্যাখ্যা
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহর কোনো সিফাত বা বিশেষণ সৃষ্ট অথবা নতুন, অথবা এ বিষয়ে সে কিছু বলতে অস্বীকার করে, অথবা এ বিষয়ে সে সন্দেহ পোষণ করে, তবে সে আল্লাহর প্রতি ঈমান-বিহীন কাফির।’’
বিশেষণের ব্যাখ্যা করা বা বাহ্যিক অর্থের বাইরে কোনো রূপক অর্থ গ্রহণ করাকেও ইমাম আবূ হানীফা বিশেষণ অস্বীকার করা বা বাতিল করার সমপর্যায়ের বলে গণ্য করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘‘এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ক্ষমতা অথবা তাঁর নিয়ামত। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর বিশেষণ বাতিল করে দেওয়া। এরূপ ব্যাখ্যা করা কাদারিয়া ও মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের রীতি।’’
ইমাম আযমের এ কথার ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী বলেন: অনুরূপভাবে মহান আল্লাহর আরশের উপর অধিষ্ঠানের (ইসতিওয়ার) ব্যাখ্যায় ক্ষমতা গ্রহণ (ইসতিলা) বলা যাবে না। কারণ এরূপ ব্যাখ্যার দ্বারা বিশেষণটিকে পুরোপুরিই বাতিল করা হয়।[1]
ইমাম আবূ হানীফা আরো বলেছেন: ‘‘তাঁর ক্রোধ ও সন্তুষ্টি তাঁর বিশেষণসমূহের দুটি বিশেষণ, কোনো স্বরূপ নির্ণয় ছাড়া। এ-ই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত-এর মত। মহান আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন এবং সন্তুষ্ট হন। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর ক্রোধ অর্থ তাঁর শাস্তি এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্থ তাঁর পুরস্কার। আল্লাহ নিজে নিজেকে যেরূপে বিশেষিত করেছেন আমরাও তাঁকে সেভাবেই বিশেষিত করি।’’
বস্ত্তত কুরআন বা হাদীসের কোনো কিছু কোনো মুসলিম সরাসরি অস্বীকার করেন না। কিন্তু অনেক সময় ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করে দেন, যা অস্বীকার করারই নামান্তর। কোনো বিশেষণকে ব্যাখ্যা করে তার সরল অর্থের বাইরে নিয়ে যাওয়ার অর্থ বিশেষণটিকে বাতিল করা। আর এজন্যই ইমাম আবূ হানীফা ব্যাখ্যা বা রূপক অর্থ গ্রহণ করাও বিভ্রান্তি বলে উল্লেখ করেছেন।
[1] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ৬৭, ৬৯।
১৩. ইমামগণের ব্যাখ্যা-বিরোধিতার কারণ / ১৩. ১. আল্লাহর নির্দেশনা গ্রহণ ও অনুমান-নির্ভর কথা বর্জন
সালফ সালিহীন অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহর প্রথম যুগগুলোর বুজুর্গগণের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিভিন্ন কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর বিশেষণ ব্যাখ্যা করার বিরোধিতা করেছেন। তন্মধ্যে নিন্মের কারণগুলো অন্যতম:
১৩. ১. আল্লাহর নির্দেশনা গ্রহণ ও অনুমান-নির্ভর কথা বর্জন
মহান আল্লাহই তাঁর নিজের সত্তা ও বিশেষণাদি সম্পর্কে সঠিক জানেন। তিনি চান যে বান্দা তাঁর প্রকৃত মারিফাত অর্জন করে তাঁর ইবাদত করুক। এজন্যই তিনি কুরআন অবতরণ করেছেন, অনুধাবনের জন্য সহজ করেছেন, সকল মুমিনের জন্য সালাতে ও সালাতের বাইরে নিয়মিত কুরআন পাঠের বিধান করেছেন এবং কুরআনের মধ্যে তাঁর পরিচয় সহজ ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন। এজন্য মুমিনের বিশ্বাস করা উচিত যে, কুরআনে মহান আল্লাহ নিজের বিষয়ে যা বলেছেন তা সরলভাবে বিশ্বাস করা এবং এগুলো থেকে মহান আল্লাহর মারিফাত, ঈমান, মহববত ও ইবাদত অর্জন করাই মুমিনের দায়িত্ব। এ সকল বিশেষণের কোনো রূপক জানিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা, এগুলোর সরল অর্থ বাদ দিয়ে কোনো রূপক অর্থ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে বলেও আল্লাহ জানান নি। এজন্য এ সকল বিশেষণের কোনো রূপক অর্থ আছে বলে দাবি করা যেমন ওহীর ইলম ছাড়া আন্দাযে আল্লাহর বিষয়ে কথা বলা, তেমনি কোনো একটি বিশেষণের এক বা একাধিক রূপক অর্থ নির্ধারণ করাও ওহীর জ্ঞান ছাড়া অনুমানের উপর আল্লাহর নামে কথা বলা। মহান আল্লাহ তাঁর বিষয়ে আন্দাযে কথা বলতে বারবার নিষেধ করেছেন।[1] এ অর্থেই ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহর সত্তার বিষয়ে নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলা কারো জন্য বৈধ নয়; বরং তিনি নিজেকে যে বিশেষণে বিশেষিত করেছেন তাঁর বিষয়ে শুধু সে বিশেষণই আরোপ করতে হবে। এ বিষয়ে নিজের মত, যুক্তি বা ইজতিহাদ দিয়ে কিছুই বলা যাবে না।’’
[1] সূরা (২) বাকারা: ৮০, ১৬৯ আয়াত; সূরা (৭) আ’রাফ: ২৮, ৩৩ আয়াত; সূরা (১০) ইউনুস: ৬৮ আয়াত।
১৩. ২. সুন্নাতে নববী ও সাহাবীগণের অনুসরণ
মহান আল্লাহর প্রকৃত মর্যাদা ও বিশেষণ সবচেয়ে ভাল জানতেন তাঁর প্রিয় রাসূল (ﷺ)। মহান আল্লাহর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি সচেষ্টও ছিলেন তিনি। তিনি কখনো এ সকল বিশেষণের ব্যাখ্যা করেন নি। তাঁর পরে তাঁর সাহাবীগণও কখনো কোনো বিশেষণের ব্যাখ্যা করেন নি। সাহাবীগণের জীবদ্দশাতেই ইসলাম অমুসলিম দেশ ও সমাজগুলোতে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইহূদী, খৃস্টান, পারসিয়ান ও অন্যান্য ধর্মের লক্ষ লক্ষ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। সাহাবীগণ তাদের কাছে কুরআন ও সুন্নাহর অগণিত বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা এ সকল বিশেষণের ব্যাখ্যা করেন নি। তাঁরা এ সকল বিশেষণ প্রকাশ্য অর্থে পাঠ করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। মানুষেরা এগুলো থেকে ভুল বুঝবে বা মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্ব বিনষ্ট হওয়ার মত কোনো অর্থ গ্রহণ করবে ভেবে তাঁরা এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা তাদের সামনে করেন নি। এগুলোকে প্রকাশ্য অর্থে বুঝলে কোনো ক্ষতি হবে বলেও তাঁরা জানান নি।
তাবিয়ীগণের যুগও এভাবেই অতিক্রান্ত হয়ে যায়। দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমার্ধে, তাবিয়ীগণের যুগের শেষ দিকে, এ বিষয়ক বিতর্ক শুরু হয়। জাহম ইবন সাফওয়ান ও তার অনুসারীগণ মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিশেষণের ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থ প্রচার করতে থাকে। তখন তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণ সকলেই এরূপ ব্যাখ্যার প্রতিবাদ করেন এবং একবাক্যে ব্যাখ্যামুক্ত ও তুলনামুক্ত বিশ্বাসের কথা বলতে থাকেন। সুন্নাতে নববী ও সুন্নাতে সাহাবার ব্যতিক্রম কোনো কিছুই তাঁরা দীনের অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি ছিলেন না। কারণ দীন তো তা-ই যা কুরআন ও সুন্নাহ-এ বিদ্যমান এবং সাহাবীগণ কর্তৃক আচরিত। এর বাইরে কোনো কথা, ব্যাখ্যা, মত বা কর্মকে দীনের অন্তর্ভুক্ত করাই বিদআত। আর এ অর্থেই ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘বিষয় তো শুধু তাই যা কুরআন নিয়ে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যার দাওয়াত দিয়েছেন এবং মানুষদের দল-ফিরকায় বিভক্ত হওয়ার আগে তাঁর সাহাবীগণ যার উপরে ছিলেন। এগুলো ছাড়া যা কিছু আছে সবই নব-উদ্ভাবিত বিদআত।’’
কর্মে ও বর্জনে তাঁদের অনুসরণই ইসলাম। তাঁরা যা বলেছেন তা বলা যেমন দীন। তেমনি তাঁরা যা বলেন নি তা না বলাই দীন। যা কুরআনে নেই, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেন নি এবং সাহাবীগণও যা বলেন নি তা বলতেও তাঁরা রাজি ছিলেন না। এজন্য প্রচণ্ড নির্যাতনের মধ্যেও ইমাম আহমদ শুধু বলছিলেন: ‘‘আমাকে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাত থেকে কিছু প্রদান করুন।’’
এ মূলনীতি ব্যাখ্যা করে ইমামুল হারামাইন বলেছেন: ‘‘যদি এ সকল বাহ্যিক বিশেষণগুলোর ব্যাখ্যা জরুরী হতো তবে নিঃসন্দেহে শরীয়তের ফিকহী মাসআলাগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেয়ে ঈমান-আকীদা বিষয়ক এসকল আয়াত-হাদীসের ব্যাখ্যার বিষয়ে সাহাবী-তাবিয়ীগণ অনেক বেশি গুরুত্ব প্রদান করতেন। অথচ কোনোরূপ ব্যাখ্যা ছাড়াই সাহাবী ও তাবিয়ীগণের যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এতে প্রমাণিত হলো যে, ব্যাখ্যামুক্ত বিশ্বাসের এ মতটিই অনুসরণযোগ্য আকীদা।’’
১৩. ৩. ওহীর মানবীয় ব্যাখ্যাকে ওহীর মান প্রদান রোধ
ব্যাখ্যা নির্ভর আকীদার ভয়ঙ্কর একটি দিক মানবীয় ব্যাখ্যাকে ওহীর মান প্রদান। ওহীর বক্তব্য অনুধাবনের জন্য অনেক সময় সাধারণ ব্যাখ্যা কিছুটা সহায়ক হয়। তবে এরূপ ব্যাখ্যা মানবীয় বুদ্ধিপ্রসূত কথা ছাড়া কিছুই নয়। অনুধাবন, শিক্ষাগ্রহণ ইত্যাদি প্রয়োজনে এগুলোর সহায়তা নেওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এরূপ ব্যাখ্যাকে ওহীর মতই দীন, ঈমান বা আকীদার বিষয়বস্ত্ততে পরিণত করা দীনের বিকৃতির অন্যতম কারণ। খৃস্টধর্মের বিকৃতির বিষয়টি অধ্যয়ন করলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্ত দলগুলোর বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ ‘তাফসীর’ বা ব্যাখ্যাকে ওহীর মান প্রদান।
১৩. ৪. ব্যাখ্যার নামে ওহীর বাহ্যিক অর্থের পরিবর্তন রোধ
আমরা দেখেছি যে, ওহীর জ্ঞানই দীনের মূল। ওহীকে সরল ও বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করাই মুক্তির সুনিশ্চিত পথ। পক্ষান্তরে ওহীকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করার দরজা উন্মোচন করাই ধ্বংসের সুনিশ্চিত পথ। এক্ষেত্রে নিম্নের কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
(১) মহান আল্লাহ সকল মানুষের প্রেমময় স্রষ্টা। মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে মানুষ যে বিষয়ে নিশ্চিত সত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয় না বা মতভেদ সৃষ্টি করে সে বিষয়ে মতভেদ দূর করে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্যই মহান আল্লাহ ওহীসহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেন এবং ওহীর বক্তব্য সকলের জন্য সহজবোধ্য করেন।[1] সাধারণ উপদেশের ক্ষেত্রে অলঙ্কার-এর আশ্রয় নেওয়া সম্ভব হলেও ঈমান-আকীদার বিষয় অলঙ্কারের নামে অস্পষ্ট করার অর্থ মানুষের জন্য মুক্তির পথকে দুর্বোধ্য করা এবং মতভেদ দূরীভূত না করে তা আরো ঘনীভূত করা। ওহীকে ব্যাখ্যার নামে বাহ্যিক অর্থ ভিন্ন অন্য অর্থে ব্যবহার করার অর্থ ওহীকে অকার্যকর করা।
(২) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী ও কিতাব লাভের পরেও বিভ্রান্তির অতল গহবরে নিপতিত হওয়ার অন্যতম পথ ওহীর ব্যাখ্যা। সাধু পল কর্তৃক খৃস্টধর্মের বিকৃতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান ঈসা মাসীহের বক্তব্যের মধ্যে আল্লাহর একত্ববাদ, ঈসা মাসীহের মানবত্ব, তাঁর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, মুক্তি দানে তাঁর অপারগতা, মুক্তির জন্য শরীয়ত পালনের বাধ্যবাধকতা, মানুষের জন্মগত নিষ্পাপত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য বিদ্যমান। পক্ষান্তরে ত্রিত্ববাদ, ঈসা মাসীহের ঈশ্বরত্ব, শরীয়ত পালনের অপ্রয়োজনীয়তা, আদিপাপ, প্রায়শ্চিত্ববাদ, ঈসা মাসীহের পাপ বহন ইত্যাদি বিষয়ে একটিও সুস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য নেই। সাধু পল প্রথমে গ্রীক দর্শন ও রোমান পৌত্তলিক ধর্মের আদলে এ সকল বিভ্রান্তিকর কুফরী মতবাদ তৈরি করেন। এরপর বাইবেলের কিছু বক্তব্যের দূরবর্তী অপব্যাখ্যাকে তার এ কুফরী মতবাদের ‘‘দলীল’’ হিসেবে পেশ করেন। এরপর এগুলোর বিপরীতে তাওহীদ, রিসালাত, শরীয়ত, ঈসা মাসীহের মানবত্ব ইত্যাদি বিষয়ে ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান অগণিত সুস্পষ্ট বক্তব্যকে নানাবিধ উদ্ভট দূরবর্তী ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করতে থাকেন। আমার লেখা ‘‘কিতাবুল মুকাদ্দাস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম’’ বইটি পাঠ করলে পাঠক এ বিষয়ে অনেক তথ্য জানতে পারবেন। মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তদেরও একই অবস্থা। শীয়া, কাদিয়ানী, বাতিনী, মারিফতী-ফকীর সম্প্রদায় ও অন্যান্য সকল বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের সকল বিভ্রান্তির ভিত্তি ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থ গ্রহণ। কাজেই ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থের দরজা বন্ধ না করলে ওহীর কার্যকারিতা রক্ষা করা সম্ভব নয়।
(৩) ব্যাখ্যার নামে ওহীকে বাহ্যিক অর্থ থেকে বের করা মানব হৃদয়ের মহাব্যাধি। নিজের মন-মর্জির বিপরীত হলেই সে ইচ্ছামত ওহীর একটি রূপক অর্থ বা ব্যাখ্যা করে। আল্লাহর অধিষ্ঠান অর্থ ক্ষমতা দখল, হস্ত অর্থ ক্ষমতা ইত্যাদি বলার পরে জান্নাত, জাহান্নাম, আখিরাত ইত্যাদি বিষয়ক অপব্যাখ্যাও সহজ হয়ে যায়। আকীদা বিষয়ক ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হওয়ার পর ফরয-ওয়াজিব ও হালাল-হারাম বিষয়ক ব্যাখ্যাও গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থ করে সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি বর্জন করা এবং মদ, ব্যভিচার ইত্যাদি মহাপাপে লিপ্ত হওয়ার পথও উন্মুক্ত হয়ে যায়। আমরা দেখব যে, কিয়ামতের আলামত বিষয়ক হাদীসগুলো আন্তরিক অর্থ থেকে বের করে রূপক ব্যাখার মাধ্যমে মানুষ কিভাবে বিভ্রান্ত হয়েছে ও হচ্ছে। এজন্যই প্রথম যুগগুলোর ইমামগণ ব্যাখ্যা বা রূপক অর্থের নামে ওহীর কোনো শব্দ বা বাক্যকে বাহ্যিক অর্থের ব্যতিক্রম অর্থে গ্রহণ করার বিরোধিতা করেছেন।
[1] দেখুন: সূরা (২) বাকারা: ২১৩ আয়াত; সূরা (৫৪) কামার: ১৭, ২২, ৩২, ৪০ আয়াত।
১৪. আল্লাহর সৃষ্টি, ইলম, তাকদীর ও পাপ-পুণ্য
আল্লাহর বিশেষণের বিষয়ে বৈপরীত্য কল্পনার একটি দিক তাকদীর। কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা আল্লাহর অনাদি-অনন্ত, সর্বব্যাপী জ্ঞানের কথা, তাঁর ক্ষমতা ও ইচ্ছার কথা জানতে পারি এবং পাশাপাশি আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায়বিচার ও করুণার কথা জানতে পারি। অনেকে এ দু বিশেষণের মধ্যে বৈপরীত্য কল্পনা করেছেন।
প্রথম বিশেষণের মাধ্যমে আমরা জানি যে, মহান আল্লাহ অনাদিকাল থেকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কে, কখন, কিভাবে কি কর্ম করবে তা সবই জানেন। আমরা কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে জানি যে, মহান আল্লাহ তাঁর এ জ্ঞান লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। আমরা আরো জানি যে, মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের ন্যূনতম দাবি যে, তাঁর জ্ঞানের অগোচরে ও ইচ্ছার বাইরে পৃথিবীতে কিছুই ঘটতে পারবে না। এ থেকে কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, তাহলে মানুষ যা কিছু করে তা আল্লাহর নির্দেশেই করে, কাজেই মানুষের কর্মের জন্য তাকে অপরাধী বলে গণ্য করা যায় না। এরা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা ও কর্মফল বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলো বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বাতিল করেন। অপরদিকে কেউ কেউ মনে করেন যে, আল্লাহর জ্ঞান, লিখন ও ইচ্ছার এ সকল বিষয় তাঁর ন্যায়পরায়ণতার বিশেষণের সাথে সাংঘর্ষিক। কাজেই ন্যায়পরায়ণতার বিশেষণ গ্রহণ করে অন্যান্য বিশেষণ ব্যাখ্যা করে বাতিল করতে হবে।
আসলে এ সবই আল্লাহর বিশেষণকে মানুষের বিশেষণের সাথে তুলনা করার ফল। আল্লাহর ক্ষেত্রে তাঁর সর্বব্যাপী জ্ঞান, লিখনি ও ইচ্ছার সাথে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, ও ন্যায়বিচারের কোনোরূপ বৈপরীত্য নেই। মুমিন সরল ও সহজ অর্থে উভয় প্রকারের বিশেষণ বিশ্বাস করবেন। সমন্বয়ের জন্য এ বিষয়ক মূলনীতি অনুসরণ করবেন। কোনোভাবেই একটি প্রমাণ করার জন্য অন্যটি ব্যাখ্যা করে বাতিল করবেন না।
তাকদীরে বিশ্বাস ইতোপূর্বে আরকানুল ঈমানের ব্যাখ্যার সময় আলোচনা করেছি। ইমাম আবূ হানীফার সময়ে বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত দলগুলো ব্যাপক বিভ্রান্তি ছড়াতো। কাদারিয়াগণ ও মুতাযিলাগণ তাকদীর সম্পূর্ণ অস্বীকার করত। অপরদিকে জাবারিয়াগণ মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা সম্পূর্ণ অস্বীকার করত। এজন্য ইমাম এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ পরিচ্ছেদের শুরুতে উদ্ধৃত বক্তব্যে তিনি বলেছেন:
‘‘মহান আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। সকল কিছু সৃষ্টির আগেই অনাদিকাল থেকে তিনি এগুলোর বিষয়ে অবগত ছিলেন। সকল কিছুই তিনি নির্ধারণ করেছেন এবং বিধান দিয়েছেন। দুনিয়ায় ও আখিরাতে কোনো কিছুই তাঁর ইচ্ছা, জ্ঞান, বিধান, নির্ধারণ ও লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ-করণ ছাড়া ঘটে না। তাঁর লিখনি বর্ণনামূলক, নির্দেশমূলক নয়। বিধান প্রদান, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি বিশেষণ, কোনো স্বরূপ, কিরূপ বা কিভাবে অনুসন্ধান ছাড়া। সিদ্ধান্ত, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি-অনন্ত বিশেষণ কোনো স্বরূপ জিজ্ঞাসা ছাড়া। মহান আল্লাহ অস্তিত্বহীন বিষয়কে অস্তিত্বহীন অবস্থায় অস্তিত্বহীন হিসেবে জানেন, এবং তিনি জানেন যে, তিনি তাকে অস্তিত্ব দিলে তা কিরূপ হবে। আল্লাহ অস্তিত্বশীল বিষয়কে তার অস্তিত্বশীল অবস্থায় জানেন এবং তিনি জানেন যে, তা কিভাবে বিলোপ লাভ করবে। আল্লাহ দন্ডায়মানকে দন্ডায়মান অবস্থায় দন্ডায়মান রূপে জানেন। এবং যখন সে উপবিষ্ট হয় তখন তিনি তাঁকে উপবিষ্ট অবস্থায় উপবিষ্ট জানেন। এরূপ জানায় তাঁর জ্ঞানের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না বা তাঁর জ্ঞানভান্ডারে কোনো নতুনত্ব সংযোজিত হয় না। পরিবর্তন ও নতুনত্ব সবই সৃষ্টজীবদের অবস্থার মধ্যে।
মহান আল্লাহ সৃষ্টজগত সৃষ্টি করেছেন ঈমান ও কুফর থেকে বিমুক্ত অবস্থায়। অতঃপর তিনি তাদেরকে সম্বোধন করেছেন এবং আদেশ ও নিষেধ প্রদান করেছেন। যে ব্যক্তি কুফরী করেছে সে নিজের কর্ম দ্বারা, অস্বীকার করে, সত্যকে অমান্য করে এবং আল্লাহর সাহায্য, রহমত ও তাওফীক থেকে বঞ্চিত হয়ে কুফরী করেছে। আর যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে সে তার কর্ম দ্বারা, স্বীকৃতি দ্বারা, সত্য বলে ঘোষণা করে এবং আল্লাহর তাওফীক ও সাহায্য লাভের মাধ্যমে ঈমান এনেছে। তিনি আদমের পিঠ থেকে তাঁর বংশধরদেরকে পরমাণুর আকৃতিতে বের করে তাদেরকে বোধশক্তি প্রদান করেন এবং তাদেরকে সম্বোধন করেন ‘‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলে: হ্যাঁ’’। তিনি তাদেরকে ঈমানের নির্দেশ দেন এবং কুফর থেকে নিষেধ করেন। তারা তাঁর রুবূবিয়্যাতের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছিল তাদের পক্ষ থেকে ঈমান। আদম সন্তানগণ এই ফিতরাতের উপরেই জন্মলাভ করে। এরপর যে কুফরী করে সে নিজেকে পরিবর্তন ও বিকৃত করে। আর যে ঈমান আনে এবং সত্যতার ঘোষণা দেয় সে তার সহজাত ঈমানের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
তিনি তাঁর সৃষ্টির কাউকে কুফরী করতে বাধ্য করেন নি এবং ঈমান আনতেও বাধ্য করেন নি। তিনি কাউকে মুমিন রূপে বা কাফির রূপে সৃষ্টি করেন নি। তিনি তাদেরকে ব্যক্তি রূপে সৃষ্টি করেছেন। ঈমান ও কুফর বান্দাদের কর্ম। কাফিরকে আল্লাহ তার কুফরী অবস্থায় কাফির হিসেবেই জানেন। যখন সে এরপর ঈমান আনয়ন করে তখন আল্লাহ তাকে তার ঈমানের অবস্থায় মুমিন হিসেবে জানেন এবং ভালবাসেন। আর এতে আল্লাহর জ্ঞান ও বিশেষণে কোনো পরিবর্তন হয় না।
বান্দাদের সকল কর্ম ও নিষ্কর্মতা- অবস্থান ও সঞ্চলন সবই প্রকৃত অর্থেই তাদের উপার্জন, আল্লাহ তা‘আলা সে সবের স্রষ্টা। এ সবই তাঁর ইচ্ছায়, জ্ঞানে, ফয়সালায় ও নির্ধারণে। আল্লাহর আনুগত্যের সকল কর্ম আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে জরুরী এবং তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি, জ্ঞান, ইচ্ছা, ফয়সালা ও নির্ধারণ অনুসারে। সকল পাপকর্ম আল্লাহর জ্ঞান, ফয়সালা, নির্ধারণ ও ইচ্ছার মধ্যে সংঘটিত, তবে তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সংঘটিত নয়।’’
এখানে মূল বিষয় বান্দার নিজের দায়িত্ব অনুভব করা। মহান আল্লাহ বলেছেন, বান্দা তুমি কর্ম কর, আমি কখনোই কারো কর্মফল নষ্ট করব না বা কারো উপর জুলুম করব না। আবার তিনি বলেছেন, বান্দা আমি জানি তুমি কি করবে, আমি ইচ্ছা করলে তোমার কর্ম পরিবর্তন করতে পারি এবং আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তুমি যেতে পার না। এখন বান্দার সামনে দুটি বিকল্প: একজন বান্দা জানে যে আল্লাহ সবই জানেন এবং তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না, সে এও জানে যে আল্লাহ তাকে কর্ম করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখন তার মনে নানান প্রশ্ন। আল্লাহর ইলমে কী আছে আমার বিষয়ে? আল্লাহ যখন সবই জানেন তাহলে আর কষ্ট করে কী লাভ? আল্লাহ কাজ করতে বলেছেন বটে, তবে তাতে কী লাভ হবে? এভাবে বান্দা আল্লাহর জ্ঞান ও কর্মের হিসাব গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজের দায়িত্বে অবহেলা করে। এ বান্দা মূলত আল্লাহর নিদের্শেও বিশ্বাস করে নি এবং আল্লাহর ওয়াদাতেও বিশ্বাস করে নি। সে নিজেকে আল্লাহর কাজের হিসাব গ্রহণকারী বলে মনে করেছে। নিঃসন্দেহে সে ধ্বংসগ্রস্ত।
অন্য একজন বান্দা জানে যে, আল্লাহ সবই জানেন এবং তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না, সে এও জানে যে আল্লাহ তাকে কর্ম করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে জানে আল্লাহর মহান জ্ঞান ও ইচ্ছার প্রকৃতি অনুধাবন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমার দায়িত্বও নয়। আমি আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছায় বিশ্বাস করি এবং আল্লাহর ওয়াদা ও দয়ায় বিশ্বাস করি। আমি আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি এবং আল্লাহর সাহায্য ও দয়া চাইতে থাকি। নিঃসন্দেহে এ বান্দা সফলতার পথ পেয়েছে।
এ বিষয়ে ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:
وَأَصْلُ الْقَدَرِ سِرُّ اللَّهِ تَعَالَى فِي خَلْقِهِ، لَمْ يَطَّلِعْ عَلَى
ذَلِكَ مَلَكٌ مُقَرَّبٌ، وَلا نَبِيٌّ مُرْسَلٌ، وَالتَّعَمُّقُ وَالنَّظَرُ فِي
ذَلِكَ ذَرِيعَةُ الْخِذْلانِ، وَسُلَّمُ الْحِرْمَانِ، وَدَرَجَةُ الطُّغْيَانِ،
فَالْحَذَرَ كُلَّ الْحَذَرِ مِنْ ذَلِكَ نَظَرًا وَفِكْرًا وَوَسْوَسَةً، فَإِنَّ
اللَّهَ تَعَالَى طَوَى عِلْمَ الْقَدَرِ عَنْ أَنَامِهِ، وَنَهَاهُمْ عَنْ
مَرَامِهِ، كَمَا قَالَ اللَّهُ تَعَالَى فِي كِتَابِهِ (لاَ يُسْأَلُ عَمَّا
يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ)، فَمَنْ سَأَلَ: لِمَ فَعَلَ؟ فَقَدْ رَدَّ حُكْمَ
الْكِتَابِ، وَمَنْ رَدَّ حُكْمَ الْكِتَابِ كَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ.
‘‘মূল তাকদীর সৃষ্টিজগতে আল্লাহ্ তা’আলার এক রহস্য। এ সম্পর্কে আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত কোনো ফিরিশতাও অবগত নন, কোনো নবী রাসূলও অবগত নন। এ বিষয়ে গভীরভাবে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করা বা চিন্তা ভাবনা করার পরিণতি ব্যর্থতা, বঞ্চনা ও সীমালংঘন ব্যতীত আর কিছুই নয়। কাজেই, এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা ও কুমন্ত্রণা হতে পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, আল্লাহ্ স্বয়ং তাকদীরের জ্ঞান তাঁর সৃষ্টিকুল থেকে গোপন রেখেছেন এবং তাদেরকে এর তত্ত্ব উদঘাটনের প্রচেষ্টা চালানো থেকে বারণ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর পবিত্র কিতাবে বলেন: ‘‘তিনি যা করেন সে সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না বরং তারাই আপন কৃতকর্মের জন্য জিজ্ঞাসিত হবে।’’[1] সুতরাং যে ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, ‘তিনি কেন এ কাজ করলেন?’ সে আসলে আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করলো। আর যে ব্যক্তি কিতাবের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে সে কাফিরদের অর্ন্তভূক্ত হয়ে যায়।’’[2]
ইমাম তাহাবী আরো বলেন;
فَوَيْلٌ لِمَنْ صَارَ لِلَّهِ تَعَالَى فِي الْقَدَرِ خَصِيمًا، وَأَحْضَرَ
لِلنَّظَرِ فِيهِ قَلْبًا سَقِيمًا، لَقَدِ الْتَمَسَ بِوَهَمِهِ فِي فَحْصِ
الْغَيْبِ سِرًّا كَتِيمًا، وَعَادَ بِمَا قَالَ فِيهِ أَفَّاكًا أَثِيمًا.
‘‘অতএব, এমন লোকের ধ্বংস অবধারিত যে তাকদীরের ব্যাপারে আল্লাহর সাথে বিরোধে লিপ্ত হয় এবং বিকারগ্রস্ত হৃদয় নিয়ে এতে চিন্তা ভাবনায় প্রবৃত্ত হয়। নিশ্চয়ই সে নিজ ধারণার বশবর্তী হয়ে অদৃশ্য জগতের একটি গুপ্ত রহস্যের অনুসন্ধানে সচেষ্ট হলো এবং এ বিষয়ে অসঙ্গত অবাস্তব কথা বলে সে নিজেকে মিথ্যুক ও পাপিষ্ঠে পরিণত করলো।’’[3]
এ গ্রন্থের পরবর্তী কোনো কোনো অনুচ্ছেদে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তাকদীর বিষয়ক আরো কিছু প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন।
[1] সূরা আম্বিয়া: ২৩ আয়াত।
[2] তাহাবী, আল-আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১১-১২।
[3] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩।
No comments