আল-ফিকহুল আকবর অধ্যায়-০৭ - ইসমাতুল আম্বিয়া, সাহাবায়ে কেরাম, তাকফীর, সুন্নাত ও ইমামাত

ইসমাতুল আম্বিয়া, সাহাবায়ে কেরাম, তাকফীর, সুন্নাত ইমামাত

ইমাম যম আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিত (রাহ) বলেন:


اَلأَنْبِيَاءُ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ كُلُّهُمْ مُنَزَّهُوْنَ عَنِ الصَّغَائِرِ وَالْكَبَائِرِ وَالْكُفْرِ وَالْقَبَائِحِ، وَقَدْ كَانَتْ مِنْهُمْ زَلاَّتٌ وَخَطِيْئَاتٌ.


وَمُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِبُّهُ، وَعَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، وَصَفِيُّهُ وَنَقِيُّهُ، وَلَمْ يَعْبُدِ الصَّنَمَ وَلَمْ يُشْرِكْ بِاللهِ تَعَالَى طَرْفَةَ عَيْنٍ قَطُّ، وَلَمْ يَرْتَكِبْ صَغِيْرَةً وَلاَ كَبِيْرَةً قَطُّ.


وَأَفْضَلُ النَّاسِ بَعْدَ النَّبِيِّيْنَ عَلَيْهِمُ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ أَبُوْ بَكْرٍ الصِّدِّيْقُ ثُمَّ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ الْفَارُوْقُ ثُمَّ عُثْمَانُ بْنُ عَفَّانَ ذُوْ النُّوْرَيْنِ ثُمَّ عَلِيُّ بْنُ أَبِيْ طَالِبٍ الْمُرْتَضَى رِضْوَانُ اللهِ تَعَالَى عَلَيْهِمْ أَجْمَعِيْنَ، عَابِدِيْنَ ثَابِتِيْنَ عَلَى الْحَقِّ وَمَعَ الْحَقِّ كَانُوْا، نَتَوَلاَّهُمْ جَمِيْعاً وَلاَ نَذْكُرُ الصَّحَابَةَ إِلاَّ بِخَيْرٍ.


وَلاَ نُكَفِّرُ مُسْلِماً بِذَنْبٍ مِنَ الذُّنُوْبِ وَإِنْ كَانَتَ كَبِيْرَةً إِذَا لَمْ يَسْتَحِلَّهَا، وَلاَ نُزِيْلُ عَنْهُ اسْمَ الإِيْمَانِ، وَنُسَمِّيْهِ مُؤْمِناً حَقِيْقَةً وَيَجُوْزُ أَنْ يَكُوْنَ مُؤْمِناً فَاسِقاً غَيْرَ كَافِرٍ.


وَالْمَسْحُ عَلَى الْخُفَّيْنِ سُنَّةٌ، وَالتَّرَاوِيْحُ فِيْ لَيَالِيْ شَهْرِ رَمَضَانَ سُنَّةٌ


وَالصَّلاَةُ خَلْفَ كُلِّ بَرٍّ وَفَاجِرٍ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ جَائِزَةٌ.

বঙ্গানুবাদ
নবীগণ সকলেই সগীরা গোনাহ, কবীরা গোনাহ, কুফর অশালীন কর্ম থেকে পবিত্র বিমুক্ত ছিলেন। তবে কখনো কখনো সামান্য পদস্খলন ভুলত্রুটি তাঁদের ঘটেছে

এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর নবী, তাঁর বান্দা, তাঁর রাসূল, তাঁর মনোনীত নির্বাচিত, তাঁর বাছাইকৃত। তিনি কখনো মূর্তির ইবাদত করেন নি এবং কখনোই এক পলকের জন্যও আল্লাহর সাথে শিরক করেন নি। তিনি কখনোই কোনো সগীরা বা কবীরা কোনো প্রকারের পাপে লিপ্ত হন নি

নবীগণের () পরে মানব জাতির মধ্যে সর্বোত্তম সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আবূ বাক্র সিদ্দীক, তাঁর পরে উমার ইবনুল খাত্তাব আল-ফারূক, তাঁর পরে যুন্নুরাইন উসমান ইবন আফ্ফান, তাঁর পরে আলী ইবন আবী তালিব আল-মুরতাযা, রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন, আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাঁরা আজীবন আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে, সত্যের উপরে সত্যের সাথে সুপ্রতিষ্ঠিত থেকেছেন। আমরা তাঁদের সকলকেই ভালবাসি ওলী হিসেবে গ্রহণ করি। আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো একজন সাহাবীর বিষয়েও ভাল কথা ছাড়া কিছু বলি না

আমরা কোনো মুসলিমকে কোনো পাপের কারণে কাফির বলি না, যদিও তা কোনো কবীরা গোনাহ হয়, যতক্ষণ না সে ব্যক্তি উক্ত পাপটিকে হালাল বলে বিশ্বাস করে। আমরা পাপের কারণে কোনো মুসলিমেরঈমান’-এর নাম অপসারণ করি না। বরং আমরা তাকে প্রকৃতই মুমিন বলে আখ্যায়িত করি, সে কাফির না হয়ে একজন পাপী মুমিন হতে পারে

মোজাদ্বয়ের উপর মাস্হ করা (মোছা) সুন্নাত। এবং রামাদান মাসের রাত্রিগুলিতে তারাবীহ সুন্নাত

সকল নেককার পাপী মুমিনের পিছনে সালাত আদায় বৈধ

 . ইসমাতুল আম্বিয়া

ইসমাত (العصمة) শব্দটিআসামা’ (عَصَمَ) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ নিষেধ করা, সংরক্ষণ করা বা হেফাযত করা (prevent, guard, protect) ইসলামী পরিভাষায়ইসমাতবলতে বুঝানো হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ব্যক্তিকে পাপ বা ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষণ করা। সাধারণত একে অভ্রান্ততা, নিষ্কলঙ্কত্ব, পাপাক্ষমতা বা নিষ্পাপত্ব (infallibility, impeccability; sinlessness) বলা হয়। ইসমাতুল আম্বিয়া অর্থ নবীগণের অভ্রান্ততা বা নিষ্পাপত্ব। বিষয়ে ইমাম আযম (রাহ) বললেন: ‘‘নবীগণ সকলেই সগীরা গোনাহ, কবীরা গোনাহ, কুফর অশালীন কর্ম থেকে পবিত্র বিমুক্ত ছিলেন। তবে কখনো কখনো সামান্য পদস্খলন ভুলত্রুটি তাঁদের ঘটেছে।’’

মহান আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ

‘‘হে রাসূল, আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা আপনি প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষদের থেকে সংরÿ করবেন।[1]

কুরআন-হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, সকল নবী-রাসূলই আল্লাহর মনোনীত নিষ্কলুষ নিষ্পাপ প্রিয় বান্দা ছিলেন। আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, নবীগণ বিশেষভাবে আল্লাহর রহমত, হেদায়াত মনোনয়ন প্রাপ্ত। আল্লাহ বলেন:

أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آَدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا

‘‘এরা নবীগণের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ প্রদান করেছেন, তারা আদমের যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশোদ্ভুত, ইবরাহীম ইসরাঈলের বংশোদ্ভুত যাদেরকে আমি পথ-নির্দেশ করেছিলাম মনোনীত করেছিলাম।’’[2]

অর্থের বিভিন্ন আয়াত থেকে জানা যায় যে, বিশেষভাবে পবিত্র নিষ্কলুষ বাছাই করা ব্যক্তিদেরকেই আল্লাহ নুবুওয়াত প্রদান করেছেন। এছাড়া আল্লাহ বারংবার নবীগণকে পবিত্র, একনিষ্ঠ, সৎ ইত্যাদি বিশেষণে ভুষিত করেছেন।[3] সর্বোপরি আল্লাহ মানব জাতিকে নবী-রাসূলদেরইত্তিবাবা অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশও প্রমাণ করে যে, তাঁরানিষ্পাপছিলেন। কারণ যার থেকে পাপ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাকে নিঃশর্তইত্তিবাকরার নির্দেশ আল্লাহ দিবেন না। কুরআন হাদীসের সকল নিদের্শনার আলোকে মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাস এই যে, নবীগণ সকলেই আল্লাহর বিশেষ করুণাপ্রাপ্ত প্রিয় বান্দা ছিলেন। তাঁরা সবাই নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী নিষ্পাপ ছিলেন। মানবীয় ভুলত্রম্নটি ছাড়া কোনো পাপে তাঁরা লিপ্ত হন নি

[1] সূরা () মায়িদা: ৬৭ আয়াত
[2]
সূরা (১৯) মারইয়াম: ৫৮ আয়াত
[3]
সূরা () নিসা: ৬৯ আয়াত; সূরা () আনআম: ৮৪-৯০ আয়াত; সূরা (১৯) মারইয়াম: ৪১-৫৮ আয়াত

 . ইসমাতুল আম্বিয়া বিষয়ে খুঁটিনাটি মতভেদ

মূলনীতির উপর ঐকমত্যের পর খুঁটিনাটি কিছু বিষয়ে আলিমদের মতভেদ রয়েছে। আল্লামা উমর ইবন মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭হি.) বিষয়ে বলেন:

كُلُّهُمْ كَانُوْا مُخْبِرِيْنَ مُبَلِّغِيْنَ عَنِ اللهِ تَعَالَى صَادِقِيْنَ نَاصِحِيْنَ لِلْخَلْقِ

‘‘তাঁরা সকলেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ প্রদান করেছেন এবং প্রচার করেছেন, সত্যবাদী ছিলেন, সৃষ্টির উপদেশদাতা কল্যাণকামী ছিলেন।’’[1]

কথার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা সা উদ্দীন তাফতাযানী (৭৯১হি) বলেন:

‘‘এতে ইশারা করা হয়েছে যে, নবীগণ বিশেষভাবে শরীয়তের বিষয়ে, দীনের আহকাম প্রচারের বিষয়ে উম্মাতকে নির্দেশনা প্রদানের বিষয়ে মাসূম বা নির্ভুল সংরক্ষিত। এক্ষেত্রে তাঁরা ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল করেন না সে বিষয়ে সকলেই একমত। অধিকাংশের মতে এক্ষেত্রে তাঁরা অনিচ্ছাকৃত বা বেখেয়ালেও কোনো ভুল করতে পারেন না। অন্যান্য সকল পাপ থেকে তাঁদের মাসূম বা নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। বিস্তারিত আলোচনা নিম্নরূপ: মুসলিম উম্মাহর ইজমা এই যে, নবীগণ ওহী বা নুবুওয়াত লাভের পূর্বে পরে কুফরী থেকে সংরক্ষিত। অনুরূপভাবে অধিকাংশের মতে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া থেকেও মাসূম। হাশাবিয়া সম্প্রদায় বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। .... আর ইচ্ছাকৃত সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে অধিকাংশের মত এই যে, তা সম্ভব। তবে মুতাযিলী নেতা আল-জুবাঈ[2] তাঁর অনুসারীরা বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। আর নবীগণের জন্য অনিচ্ছাকৃত বা ভুলক্রমে সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া সকলের মতেই সম্ভব, তবে যে সকল সগীরা গোনাহ নীচতা প্রমাণ করে তা তাঁদের দ্বারা সম্ভব নয়, যেমন এক লোকমা খাদ্য চুরি করা, একটি দানা ওযনে কম দেওয়া, ইত্যাদি। এক্ষেত্রে (সগীরা গোনাহের ক্ষেত্রে) মুহাক্কিক আলিমগণ শর্ত করেছেন যে, নবীগণকে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাঁরা তা বর্জন করেন। মতভেদ সবই ওহী বা নুবুওয়াত প্রাপ্তির পরের অবস্থার সাথে সম্পর্কিত। নুবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে নবীগণ থেকে কবীরা গোনাহ প্রকাশ পাওয়া অসম্ভব বলে কোনো দলীল নেই। মুতাযিলাগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, নুবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও নবীগণ কর্তৃক কবীরা গোনাহ সংঘটিত হতে পারে না; কারণ এর ফলে জনগণের মধ্যে তাঁর প্রতি অভক্তি সৃষ্টি হয়, যা তাঁর অনুসরণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ফলে নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। সত্য কথা এই যে, যে কর্ম তাঁদের প্রতি অভক্তি সৃষ্টি করে তা তাঁরা করতে পারেন না, যেমন, মাতৃগণের সাথে অনাচার, অশ্লীলতা নীচতা জ্ঞাপক সগীরা গোনাহ। শীয়াগণ মনে করেন যে, নবীগণ থেকে নুবুওয়াতের পূর্বে পরে কখনোই কোনো সগীরা বা কবীরা গোনাহ প্রকাশিত বা সংঘটিত হতে পারে না। তবে তারা তাকিয়্যাহ বা আত্মরক্ষামূলকভাবে কুফর প্রকাশ সম্ভব বলেছে।’’[3]

মোল্লা আলী কারী বলেন, ইবনুল হুমাম বলেছেন: আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অধিকাংশ আলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য মত এই যে, নবীগণ কবীরা গোনাহ থেকে সংরক্ষিত, ভুলক্রমে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে একক সগীরা গোনাহ করে ফেলা থেকে সংরক্ষিত নন। আহলুস সুন্নাতের কেউ কেউ নবীদের ক্ষেত্রে ভুল করাও অসম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন। সঠিকতর বা সহীহ কথা এই যে, কর্মের মধ্যে ভুল হওয়া সম্ভব। সার কথা এই যে, আহলুস সুন্নাতের সকলেই একমত যে, নবীগণ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো নিষিদ্ধ কর্ম করতে পারেন না। তবে অসতর্কতা বা ভুলের কারণে যা ঘটে তা পদস্খলন বলে অভিহিত।[4]

[1] তাফতাযানী, শারহুল আকাইদ আন-নাসাফিয়্যাহ, পৃ. ১৩৯
[2]
আবূ আলী মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব আল-জুবাঈ (৩০৩ হি) তিনি মুতাযিলা সম্প্রদায়ের একজন প্রসিদ্ধ আলিম নেতা ছিলেন মুতাযিলাদের একটি সম্প্রদায়ের বা উপদলের নামজুবাইয়্যাহযারা তার অনুসারী ছিলেন দেখুন, বাগদাদী, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ১৮৩-১৮৪
[3]
তাফতাযানী, শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, পৃ. ১৩৯-১৪০
[4]
মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১০৪-১০৫

 . মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ইসমাত মর্যাদা

মুহাম্মাদ (ﷺ) এর নুবুওয়াত রিসালাতে বিশ্বাসের অর্থ আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। নবীগণের নিষ্পাপত্বে বিশ্বাস করার অর্থই সর্বশেষ সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিষ্পাপত্বে বিশ্বাস করা। তা সত্ত্বেও ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বিশেষভাবে তাঁর বিষয় উল্লেখ করে বলেছেন: ‘‘এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর নবী, তাঁর বান্দা, তাঁর রাসূল, তাঁর মনোনীত নির্বাচিত, তাঁর বাছাইকৃত। তিনি কখনো মূর্তির ইবাদত করেন নি এবং কখনোই এক পলকের জন্যও আল্লাহর সাথে শিরক করেন নি। তিনি কখনোই কোনো সগীরা বা কবীরা কোনো প্রকারের পাপে লিপ্ত হন নি।’’

ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শাইখ আহমদ ইবন মুহাম্মাদ মাগনীসাবী হানাফীশারহুল ফিকহিল আকবারগ্রন্থে বলেন:


ثم أشار الإمام الأعظم بقوله "وعبده" إلى فائدتين: أعني تشريف محمد (ﷺ) وحفظ الأمة عن قول النصارى. قال أبو القاسم سليمان الأنصاري: لما وصل محمد ﷺ إلى الدرجات العالية والمراتب الرفيعة في المعارج أوحى الله إليه: يا محمد بمَ أشرِّفك؟ قال: يا رب بنسبتي إلى نفسك (إليك) بالعبودية، فأنزل فيه "سبحان الذي أسرى بعبده ليلاً"، فقال ﷺ: "لا تطروني كما أطري عيسى بن مريم، وقولوا: عبد الله ورسوله. كذا في المشارق. أي لا تتجاوزوا عن الحد في مدحي كما بالغ النصارى في مدح عيسى عليه السلام حتى كفروا فقالوا إنه ابن الله، وقولوا في حقي: إنه عبد الله ورسوله، حتى لا تكونوا أمثالهم".

‘‘ইমাম আযমতাঁর বান্দাকথাটি এখানে উল্লেখ করে দুটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন: () মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মর্যাদা প্রকাশ এবং () খৃস্টানদের মত কথা বলা থেকে উম্মাতকে রক্ষা করা। আবুল কাসিম সুলাইমান আনসারী (৫১১ হি) বলেন[1]: যখন মুহাম্মাদ (ﷺ) মিরাজের সময় সুউচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হলেন তখন আল্লাহ তাঁর কাছে ওহী প্রেরণ করেন: হে মুহাম্মাদ, তোমাকে কিভাবে মর্যাদাম-- করব? তিনি বলেন: হে আমার প্রতিপালক, আমাকে আপনার সাথে দাসত্বের সম্পর্কে সম্পর্কিত করে মর্যাদাময় করুন। তখন আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন: ‘‘পবিত্র তিনি যিনি তাঁর দাসকে (বান্দাকে) রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছেন...’’[2] এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘খৃস্টানগণ যেরূপ ঈসা ইবনু মারিয়ামকে বাড়িয়ে প্রশংসা করেছে তোমরা সেভাবে আমার বাড়িয়ে প্রশংসা করবে না। আমি তো তাঁর বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা বলবে: আল্লাহর বান্দা তাঁর রাসূল।’’[3] মাশারিক গ্রন্থে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসের অর্থ: যেভাবে খৃস্টানগণ ঈসা ()-এর প্রশংসায় সীমালঙ্ঘন করে কাফির হয়ে গিয়েছে তোমরা আমার নাত-প্রশংসায় এভাবে সীমালঙ্ঘন করো না। খৃস্টানগণ সীমালঙ্ঘন করে বলেছিল: তিনি আল্লাহর পুত্র। তোমরা আমার সম্পর্কে বল: তিনি আল্লাহর বান্দা তাঁর রাসূল; যেন তোমরা তাদের মত না হও।’’[4]

বিষয়ে ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:


وإِنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ المصطَفى، ونبيُّه المجْتَبى، ورَسُولُهُ المُرْتَضَى. وإنَّه خَاتِمُ الأنبياءِ، وإِمَامُ الأتْقِيَاءِ، وسيِّدُ المرسَلينَ، وحَبيبُ ربِّ العالَمين. وكُلُّ دَعْوى النُّبوةِ بَعدَهُ فَغَيٌّ وَهَوى. وَهُو المبعوثُ إلى عَامَّةِ الجِنِّ وكَافَّة الوَرَى بالحقِّ والهدى، وبالنُّور والضِّياء.

‘‘নিশ্চয়, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর মনোনীত বান্দা (দাস), তাঁর নির্বাচিত নবী তাঁর সন্তোষভাজন রাসূল। তিনি সর্বশেষ নবী, সর্বকালের মুত্তাকীগণের ইমাম, রাসূলগণের নেতা এবং রাব্বুল আলামীনের একান্ত প্রিয়জন। তাঁর পরবর্তীকালে নবুওয়াতের সব দাবী ভ্রান্ত প্রবৃত্তিপ্রসূত। তিনি প্রেরিত হয়েছেন সমগ্র জিন মানবকুলের প্রতি সত্য, হেদায়ত, নূর আলো সহকারে।’’[5]

[1] আবুল কাসিম আনসারীর বক্তব্য ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর পিতার সূত্রে তাঁর প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন দেখুন: তাফসীর রাযী: মাফাতীহুল গাইব ২০/১১৭
[2]
সূরা (১৭) ইসরা (বনী ইসরাঈল): আয়াত
[3]
বুখারী, আস-সহীহ /১২৭১, /২৫০৫; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /৪৭৮
[4]
মাগনীসাবী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ২২-২৩
[5]
তাহাবী, আল-আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. -

 . সাহাবীগণের মর্যাদা

নবীগণের নিষ্পাপত্ব বর্ণনার পাশাপাশি সাহাবীগণের মর্যাদার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) আমরা দেখেছি যে, তিনি বলেছেন: ‘‘নবীগণের () পরে মানব জাতির মধ্যে সর্বোত্তম সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আবূ বাক্র সিদ্দীক, তাঁর পরে উমার ইবনুল খাত্তাব আল-ফারূক, তাঁর পরে যুন্নুরাইন উসমান ইবন আফ্ফান, তাঁর পরে আলী ইবন আবী তালিব আল-মুরতাযা, রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন, আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাঁরা আজীবন আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে, সত্যের উপরে সত্যের সাথে সুপ্রতিষ্ঠিত থেকেছেন। আমরা তাঁদের সকলকেই ভালবাসি ওলী হিসেবে গ্রহণ করি। আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো একজন সাহাবীর বিষয়েও ভাল কথা ছাড়া কিছু বলি না।’’

বক্তব্যটি অনুধাবনের জন্য নিম্নের বিষয়গুলো পর্যালোচনা প্রয়োজন:

 . . সাহাবীগণ বিষয়ক শীয়া বিভ্রান্তি

ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ঈমান-আকীদা বিষয়ক তাঁর যুগে বিদ্যমান বিভ্রান্তিঅপনোদন খন্ডন করেছেন। আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণের যুগেই মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে যে বিভ্রান্তি বিভক্তি দেখা দেয় তার অন্যতম ছিল ‘‘শীয়া’’ ‘‘খারিজী’’ মতবাদ

শীয়া খারিজী: মুসলিম উম্মাহর প্রথম প্রধান এদুটি ফিরকার উদ্ভব ঘটেছিল রাজনৈতিক কারণে। শীয়া (الشيعة) শব্দের অর্থ দল, অনুসারী বা সাহায্যকারী। পারিভাষিকভাবে শীয়া বলতেশীয়াতু আলী’ (شيعة علي) বা আলীর (রা) দল, আলীর অনুসারী বা আলীর সাহায্যকারী বুঝানো হয়। শীয়াগণ নিজেদেরকে আলী (রা)-এর অনুসারী বা তাঁর দল বলে দাবি করেন। শীয়া ফিরকার মূল ভিত্তি আলী (রা) তাঁর বংশধরদের জন্য রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের দাবি। দাবিকে কেন্দ্র করে অগণিত আকীদা তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে। সকল আকীদার অন্যতম বিষয় সাহাবীগণের অবমর্যাদা করা গালি দেওয়া। তারাআহল বাইতের (নবী-বংশের) ভালবাসা ভক্তির নামে সাহাবীগণের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচারে রত। ইমাম আবূ হানীফা এখানে তাদের মতবাদ খন্ডন করেছেন

 . . আহল বাইত বিষয়ে কুরআন সুন্নাহ

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্মান ভালবাসার অংশ তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্মান করা ভালবাসা। তাঁর সাহাবীগণকে, তাঁর পরিবার বংশধরদেরকে, তাঁর উম্মাতকে, তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারীদেরকে এবং তাঁর সুন্নাতের ধারক প্রচারকদেরকে তাঁর কারণে সম্মান করা ভালবাসা তাঁরই সম্মান ভালবাসার অংশ। বিশেষত তাঁর সাহাবী আহল বাইতের বিষয়টি কুরআন হাদীসে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে

ইসলাম বিশ্বজনীন ধর্ম। এখানে কোনো বংশ বা বর্ণেরঅলৌকিকত্ববা পবিত্রতা ঘোষণা করা হয় নি। ইসলামে মর্যাদার ভিত্তি তাকওয়া; বংশ বা রক্ত নয়। কুরআনে বংশ, বর্ণ বা দেশ নির্বিশেষে সকল সাহাবীর প্রশংসা করা হয়েছে তাঁদের কর্ম ত্যাগের কারণে, বংশ বা বর্ণের কারণে নয়। আর স্বভাবতই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশের যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন সকলেই প্রশংসা মর্যাদার মধ্যে শামিল হয়েছেন। কাজেই পৃথকভাবে ‘‘নবী-বংশের’’ মর্যাদার উল্লেখ করা হয় নি

কুরআনেআহল বাইতদুবার ব্যবহৃত হয়েছে। একস্থানে ইবরাহীম ()-এর স্ত্রীকে ফিরিশতারা ‘‘আহল বাইত’’ বলে সম্বোধন করেন।[1] অন্যত্র আল্লাহ বলেন:


يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلاً مَعْرُوفًا وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلاةَ وَآَتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

‘‘হে নবী-পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর তবে পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে যার অন্তরে ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন যুগের মত নিজদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তোমরা সালাত কায়েম করবে যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের অনুগত থাকবে। হে আহল বাইত (নবী-পরিবার)! আল্লাহ্ তো শুধু চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দুর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’’[2]

এখানে আমরা দেখছি যে, মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্ত্রীগণকে ‘‘আহল-বাইত’’ বা ‘‘নবী-পরিবার’’ বলে সম্বোধন করে তাঁদের পরিপূর্ণ পবিত্রতার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু ‘‘আহল-বাইত’’ বিষয়ে শীয়াগণের বিশ্বাস কুরআনের ঘোষণার সাথে সাংঘর্ষিক। তারা নবী-পত্নীগণকে ‘‘আহল বাইত’’ বলে স্বীকার করেন না। উপরন্তু তাঁদের বিষয়ে তারা অত্যন্ত অশস্নীল নোংরা ধারণা পোষণ করেন

শীয়াগণ মূলত আহল বাইত বলতে ‘‘আলী-বংশ’’ বুঝান। আর বিষয়ে কুরআন কারীমে কোনো নির্দেশনা নেই। একস্থানে আল্লাহ বলেন:


قُلْ لا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى

‘‘বল, ‘আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আত্মীয়তার সৌহার্দ্য ব্যতীত অন্য কোনো প্রতিদান চাই না।’’[3]

অর্থাৎ তোমাদের মাঝে দীন প্রচারের বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চাচ্ছি না। তবে তোমাদের সাথে আমার যে আত্মীয়তা রয়েছে সে আত্মীয়তার সৌহার্দ্য ভালবাসার দাবি যে, তোমরা আমাকে অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকবে এবং আমার সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করবে। আমি তোমাদের কাছে সৌহার্দ্যটুকু দাবি করছি

কারো কারো মতে আয়াতের অর্থ: ‘আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না, শুধু আমার আত্মীয়দের প্রতি তোমাদের সৌহার্দপূর্ণ আচরণ চাই।অর্থাৎ এখানে তাঁর আত্মীয়দের ভালবাসতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে

অর্থ কুরআনের স্বাভাবিক বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখানে তিনিআত্মীয়তার সৌহার্দ্যদাবি করেছেন, ‘আত্মীয়দের প্রতি বা আত্মীয়দের জন্য সৌহার্দ্যদাবি করেন নি। এছাড়া তাঁর আত্মীয়দের অধিকাংশই সে সময়ে কাফির ছিলেন এবং তাদের সাথে অন্যান্য কাফির সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতো। উপরন্তু তিনি মক্কার যে কাফিরগণকে কথা বলেছিলেন তারাই তো তাঁর আত্মীয় ছিলেন। কাজেই তাদের কাছে তিনি কিভাবে তাঁর আত্মীয়দের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ আচরণ দাবি করবেন

এদ্বারা তাঁর আত্মীয়দের অবমূল্যায়ন বা অবমর্যাদা উদ্দেশ্য নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সম্পৃক্ত সকলকে ভালবাসা ঈমানের স্বাভাবিক দাবি। তাঁর পরিবার বংশধরের প্রতি ভালবাসা তাঁরই ভালবাসার অংশ। তাঁর বংশের যারা ঈমান সাহচর্য গ্রহণ করেছেন তাঁদের মর্যাদাও কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনা। মর্যাদার পাশাপাশি আত্মীয়তার মর্যাদা তাঁদেরকে মহিমান্বিত করে। সর্বোপরি হাদীসে তাঁদের মর্যাদার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে

যাইদ ইবন আরকাম (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তীখুমনামক স্থানে আমাদের মাঝে বক্তৃতা করেন। তিনি আল্লাহর গুণগান করলেন, ওয়ায করলেন উপদেশ প্রদান করলেন। অতঃপর তিনি বললেন:


أَمَّا بَعْدُ أَلا أَيُّهَا النَّاسُ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رَسُولُ رَبِّي فَأُجِيبَ وَأَنَا تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللَّهِ فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ فَخُذُوا بِكِتَابِ اللَّهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ ... ثُمَّ قَالَ وَأَهْلُ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي... ثلاثا.

‘‘হে মানুষেরা, তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমি একজন মানুষ মাত্র। হয়ত শীঘ্রই আমার প্রভুর দূত এসে পড়বেন এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাব। আমি তোমাদের মধ্যে দুটি মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয় রেখে যাচ্ছি। প্রথমত আল্লাহর কিতাব, যার মধ্যে রয়েছে পথের দিশা আলো। তোমরা আল্লাহর কিতাবকে গ্রহণ করবে এবং দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে। .... এরপর তিনি বললেন : ‘এবং আমার বাড়ির মানুষ (আহল বাইত) আমি আমারআহল বাইতবিষয়ে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা মনে রাখতে উপদেশ প্রদান করছি। কথা তিনি তিনবার বলেন।’’[4]

ইবন আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,


أَحِبُّوا اللَّهَ (لِمَا يَغْذُوكُمْ مِنْ نِعَمِهِ) وَأَحِبُّونِي (بِحُبِّ اللَّهِ) وَأَحِبُّوا أَهْلَ بَيْتِي (بِحُبِّي)

‘‘তোমরা আল্লাহকে ভালবাসবে কারণ তিনি তোমাদেরকে অগণিত নিয়ামত প্রদান করেন, এবং আল্লাহর ভালবাসায় আমাকে ভালবাসবে এবং আমার ভালবাসায় আমারআহল বাইতবা বাড়ির মানুষদের (বংশধর আত্মীয়দের) ভালবাসবে।’’[5]

[1] সূরা (১১) হূদ: ৭৩ আয়াত
[2]
সূরা (৩৩) আহযাব: ৩২-৩৩ আয়াত
[3]
সূরা (৪২) শূরা: ২৩ আয়াত
[4]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৮৭৩ (কিতাব ফাযাইলুস সাহাবা, বাবুন মিন ফাযাইল আলী)
[5]
তিরমিযী, আস-সুনান /৬৬৪ (কিতাবুল মানাকিব, বাবু মানাকিবি আহলি বাইতিন নাবিয়্যি); হাকিম, আল-মুসতাদরাক /১৬২ হাদীসটিকে তিরমিযী হাসান এবং হাকিম যাহাবী সহীহ বলেছেন

 . . সাহাবীগণ বিষয়ে কুরআন সুন্নাহ

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরিজন বংশধরের প্রতি ভালবাসা ভক্তি কখনোই তাঁর সহচর সাহাবীগণের প্রতি ভালবাসার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কিন্তু শীয়াগণ পরিবার বংশধরের ভালবাসার নামে সাহাবীগণের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা কুৎসা রটনায় লিপ্ত হয় এবং সাহাবীগণের প্রতি বিদ্বেষকে ঈমানের অংশ বানিয়ে নেয়। তারা ইহূদীদের ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্ত হয়ে সাহাবীগণকে ইসলামের শত্রু বলে গণ্য করে। তারা নবী-পরিবারের ভালবাসাকে সাহাবীগণের ভালবাসার পরিপন্থী বলে গণ্য করে। বিষয়ে অগণিত মিথ্যা তারা প্রচার করে। গত কয়েক শতাব্দী যাবত পাশ্চাত্য-প্রাচ্যবিদগণও সাহাবীগণের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। সকল প্রচারের একটিই উদ্দেশ্য: ইসলামের মর্মমূলে আঘাত করা ইসলামের সৌধকে ভেঙ্গে ফেলা। সাহাবীগণের সততা প্রশ্নবিদ্ধ হলে ইসলামের সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়; কারণ কেবলমাত্র তাঁদের মাধ্যমেই ইসলাম প্রচারিত হয়েছে

সাহাবীগণের সততায় অবিশ্বাস করার অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নবুওয়ত অবিশ্বাস করা। যারা মনে করেন যে, অধিকাংশ সাহাবী স্বার্থপর, অবিশ্বাসী বা ধর্মত্যাগী ছিলেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে মনে করেন যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একজন ব্যর্থ নবী ছিলেন (নাঊযূ বিল্লাহ!) লক্ষ মানুষের সমাজে অজ্ঞাত অখ্যাত দু-চার জন মুনাফিক থাকা কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। কিন্তু সুপরিচিত সাহাবীগণের সততায় সন্দেহ পোষণ করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যর্থতার দাবি করা হয়। একজন ধর্ম প্রচারক যদি নিজের সহচরদের হৃদয়গুলিকে ধার্মিক বানাতে না পারেন, তবে তিনি কিভাবে অন্যদেরকে ধার্মিক বানাবেন! তাঁর আদর্শ শুনে, ব্যবহারিকভাবে বাস্তবায়িত দেখে তাঁর সাহচর্যে থেকেও যদি মানুষসততাঅর্জন করতে না পারে, তবে শুধু সে আদর্শ শুনে পরবর্তী মানুষদেরসততাঅর্জনের কল্পনা বাতুলতা মাত্র

আজ যিনি মনে করেন যে, কুরআন পড়ে তিনি সততা শিখেছেন, অথচ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কাছে কুরাআন পড়ে, জীবন্ত কুরআনের সাহচর্যে থেকেও আবূ বকর, উমার, উসমান, আবূ হুরাইরা, আমর ইবনুল আস, মুআবিয়া, আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) বা অন্য কোনো সাহাবী সততা শিখতে পারেন নি, তিনি মূলত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নবুওয়তকেই অস্বীকার করেন

শীয়াগণ কাউকে দেবতা কাউকে দানব বানিয়েছেন। দুটি বিষয়ই মানবীয় প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। মানবীয় দুর্বলতার সাথে সততার কোনো বৈপরীত্য নেই। সাহাবীগণ মানুষ ছিলেন; মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। মানবতার সর্বশ্রে্ষ্ঠ শিক্ষকের সাহচর্যে মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ সততা বেলায়াত তাঁরা অর্জন করেছিলেন। কোনো স্কুলের সফলতা যেমন ছাত্রদের পাশের হারের উপর নির্ভর করে, তেমনি ধর্মপ্রচারকের সফলতা নির্ভর করে তাঁর সাহচর্য-প্রাপ্তদের ধার্মিকতার উপর। কাজেই নুবুওয়াতে বিশ্বাসের অনির্বার্য দাবি সাহাবীগণের সততায় বিশ্বাস। আর বিশ্বাসই নিশ্চিত করেছে কুরআন হাদীস। এখানে সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি:

() কুরআনে বারবার সাহাবীগণের প্রশংসা করা হয়েছে, তাঁদের ধার্মিকতার সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে এবং তাঁদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। মক্কা বিজয়ের পূর্বের পরের সকল সাহাবীকে জান্ণাতের সুসংবাদ প্রদান করে আল্লাহ বলেন:


لا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُولَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الَّذِينَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوا وَكُلا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

‘‘তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং সংগ্রাম করেছে তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়; তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের চেয়ে যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে এবং সংগ্রাম করেছে। তবে আল্লাহ উভয়কেই কল্যাণের (জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’’[1]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সকল সাহাবীর ঢালাও প্রশংসা করে তাঁদের ধার্মিকতা, সততা বিশ্বস্ততার ঘোষণা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন:


وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمْ الإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمْ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُوْلَئِكَ هُمْ الرَّاشِدُونَ

‘‘কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তাকে তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন। তিনি কুফর, পাপ অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন। তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী।’’[2]

() বিশেষত প্রথম অগ্রবর্তী মুহাজির আনসারগণের জন্য আল্লাহ জান্নাত প্রস্ত্তত রেখেছেন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণ করাই অন্যদের জন্য জান্নাতের পথ বলে জানানো হয়েছে:


وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنْ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

‘‘মুহাজির আনসারদিগের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছেন, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। - মহাসাফল্য।’’[3]

() বাইয়াতুর রিদওয়ান তাবূক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টির নিশ্চয়তা জান্নাতের সুস্পষ্ট সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:


لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنْ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ

‘‘মুমিনগণ যখন বৃক্ষতলে আপনার নিকটবাইয়াতগ্রহণ করল, তখন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন।’’[4]

তাবূক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল সাহাবীর প্রশংসায় আল্লাহ বলেন:


لَكِنْ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ وَأُوْلَئِكَ لَهُمْ الْخَيْرَاتُ وَأُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ

‘‘কিন্তু রাসূল এবং যারা তার সংগে ঈমান এনেছে, তারা নিজ সম্পদ জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে; তাদের জন্যই কল্যাণ এবং তারাই সফলকাম।’’[5]Anchor

() মহান আল্লাহ কুরআনে প্রথমে মুহাজির এবং আনসারগণের উল্লেখ করে তাঁদের প্রশংসা করেন। এরপর পরবর্তী মুমিনদের বিষয়ে বলেন:


وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالإِيمَانِ وَلا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلا لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ

‘‘তাদের পরে যারা আগমন করল তারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রণী আমাদের পূর্ববর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা কর এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ রেখ না। হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি তো দয়াদ্র, পরমদয়ালু।’’[6]

এভাবে আমরা দেখছি যে, কুরআনের নির্দেশ অনুসারে পরবর্তী সকল প্রজন্মের মুমিনদের দায়িত্ব সকল আনসার মুজাহির সাহাবীর জন্য দু করা এবং তাঁদেরকে অন্তর দিয়ে ভালবাসা। অন্তরে কোনো সাহাবীর প্রতি হিংসা বা বিদ্বেষভাব ঈমানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়

() রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন :


أَكْرِمُوْا أَصْحَابِيْ (فَإِنَّهُمْ خِيَارُكُمْ)، ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ، ثُمَّ يَظْهَرُ الْكَذِبُ.

‘‘তোমরা আমার সাহাবীগণকে সম্মান করবে; কারণ তাঁরাই তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁদের পরে তাঁদের পরবর্তী যুগের মানুষেরা এবং এরপর তাঁদের পরবর্তী যুগের মানুষেরা। এরপর মিথ্যা প্রকাশিত হবে।’’[7]

আবূ হুরাইরা আবূ সাঈদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


لا تَسُبُّوا أَصْحَابِي فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلا نَصِيفَهُ

‘‘তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দেবে না। কারণ তোমাদের কেউ যদি উহদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করে তবুও সে তাদের কারো এক মুদ্দ (প্রায় অর্ধ কেজি) বা তার অর্ধেক দানের সমপর্যায়ে পৌঁছাবে না।’’[8]

কুরআন হাদীসের সকল নির্দেশনার আলোকে সাহাবীগণের বিষয়ে মুসলিমগণ নিম্নরূপ আকীদা পোষণ করেন:

() মানব জাতির মধ্যে নবীগণের পরেই সাহাবীগণের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সাহাবীগণের মধ্যে খুলাফায়ের রাশেদীনের শ্রেষ্ঠত্ব

() খুলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য তাঁদের খিলাফাতের দায়িত্বের ক্রম অনুসারে

() অন্য সকল সাহাবীও মহান মর্যাদার অধিকারী। কোনো সাহাবীকেই কোনো মুমিন সামান্যতম অমর্যাদা বা অবজ্ঞা করেন না। তাঁদের কারো বিষয়েই কোনো অমর্যাদাকর কথা কোনো মুমিন কখনো বলেন না

() সাহাবীগণের মধ্যে মতভেদ হয়েছে এবং কখনো কখনো যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে। ভুল বুঝাবুঝি, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে দুজন সৎ নিষ্ঠাবান ব্যক্তির মধ্যে বিরোধ, মামলা বা যুদ্ধ হতে পারে। শুধু যুদ্ধ বা বিরোধের কারণে কাউকে অপরাধী বলা যায় না

যুদ্ধবিগ্রহ ঐতিহাসিক সত্য। তবে সেগুলিতে কার কি ভূমিকা ছিল সে বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। বিষয়ক ইতিহাস লেখা হয়েছে ঘটনার প্রায় ২০০ বৎসর পর শীয়া মতবাদ প্রভাবিত আববাসী শাসনামলে শীয়াগণের বর্ণনার উপর নির্ভর করে। কুরআন হাদীস সাহাবীগণের মর্যাদা সততা নিশ্চিত করেছে। সকল যুদ্ধবিগ্রহের অযুহাতে তাঁদের কারো নামে কুৎসা রটনা বা বিদ্বেষ পোষণ করার অর্থ কুরআন হাদীসের অগণিত নির্দেশনা জনশ্রুতির কারণে বাতিল করে দেওয়া

কোনো কোর্টে যদি কোনো দলের নেতৃস্থানীয় কাউকে অপরাধী বলে রায় দেওয়া হয় তবে সে দলের অনুসারীরা রায়কে মিথ্যা বলবেন কিন্তু নেতার সততায় বিশ্বাস হারাবেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ অতি-সাম্প্রতিক বিষয়। তারপরও সকলেই শুধু ইতিহাস বিকৃতির কথা বলেন। ঐতিহাসিকরা যদি কোনো নেতার অপরাধের অনেক তথ্য পেশ করেন তবুও তার অনুসারীরা সে তথ্য বিশ্বাস করবেন না। তাহলে মুমিন কিভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সহচরদের বিষয়ে কুরআন প্রমাণিত সততার সাক্ষ্যের বিপরীতে ইতিহাসের বর্ণনার উপর নির্ভর করবেন?

আমরা শুধু এতটুকুই বলব যে, যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটেছে, কিন্তু কার কী ভূমিকা তা আমরা এতদিন পরে ইতিহাসের বর্ণনার উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করতে পারব না। তবে কুরআন হাদীসের বর্ণনার উপর নির্ভর করে আমরা তাঁদের পরিপূর্ণ সততা বেলায়াতে বিশ্বাস করি। আমরা মনে করি যে, তাঁদের যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি ভুল বুঝাবুঝি ইজতিহাদী মতপার্থক্যের কারণেই ঘটেছে। এতে তাঁদের তাকওয়া বেলায়াত (আল্লাহর ওলী হওয়ার মর্যাদা) ক্ষতিগ্রস্থ হয় নি

উপরের বিষয়গুলোই ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর ‘‘আল-ওয়াসিয়্যাহ’’ পুস্তিকায় বিষয়ে আরো বলেন:


وَنُقِرُّ بِأَنَّ أَفْضَلَ هَذِهِ الأُمَّةِ بَعْدَ نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ ﷺ أَبُوْ بَكْرٍ الصِّدِّيْقُ، ثُمَّ عُمَرُ، ثُمَّ عُثْمَانُ، ثُمَّ عَلِيٌّ، رِضْوَانُ اللهِ عَلَيْهِمْ أَجْمَعِيْنَ؛ لِقَوْلِهِ تَعَالَى: "وَالسَّابِقُوْنَ السَّابِقُوْنَ أُولَئِكَ الْمُقَرَّبُوْنَ فِيْ جَنَّاتِ النَّعِيْمِ"، وَكُلُّ مَنْ كَانَ أَسْبَقَ فَهُوَ أَفْضَلُ، وَيُحِبُّهُمْ كُلُّ مُؤْمِنٍ تَقِيٍّ، وَيُبْغِضُهُمْ كُلُّ مُنَافِقٍ شَقِيٍّ.

‘‘এবং আমরা স্বীকার বিশ্বাস করি যে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরে উম্মাতের শ্রেষ্ঠতম আবূ বাকর সিদ্দীক, অতঃপর উমার, অতঃপর উসমান, অতঃপর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম; কারণ আল্লাহ বলেছেন: ‘‘এবং অগ্রগামীগণ অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী, তারাই তো নৈকট্যপ্রাপ্ত, নিয়ামতপূর্ণ জান্নাতসমূহে’’[9] আর (সাহাবীগণের মধ্যে ইসলামগ্রহণে) যে যত বেশি অগ্রবর্তী তাঁর মর্যাদা তত বেশি। আর প্রত্যেক মুত্তাকী মুমিন তাঁদেরকে ভালবাসে এবং প্রত্যেক হতভাগা মুনাফিক তাঁদেরকে বিদ্বেষ করে।’’[10]

অনেক সময় আবেগ-তাড়িত মুমিন পরবর্তী প্রজন্মের কোনো একজন প্রসিদ্ধ বুজুর্গের নেককর্মের আধিক্য দেখে তাকে কোনো সাহাবীর চেয়ে অধিক মর্যাদাশালী বলে মনে করতে থাকেন। এভাবে শীয়াগণ অন্য অনেকে তাবিয়ী উমার ইবন আব্দুল আযীয (রাহ)-কে সাহাবী মুআবিয়া ইবন আবী সুফিয়ান (রা) থেকে উত্তম বলে মনে করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান ভালবাসার দুর্বলতা থেকে এরূপ ধারণার জন্ম হয়। মুমিনের ঈমানের দাবি যে, তিনি কোনোভাবেই রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সাহচর্যের সাথে কোনো নেককর্মের তুলনা করতে পারেন না। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহচর্য, ঈমানের সাথে দু চোখ ভরে তাঁকে দেখা, তাঁর মুখের কথা শোনার বা তাঁর সাথে জিহাদে অংশ নেওয়ার চেয়ে অধিক মর্যাদার কর্ম কি আর কিছু হতে পারে? তাঁর সাহচর্যের মাধ্যমে ঈমান, তাকওয়া বেলায়াতের যে গভীরতা অর্জন হয় তা কি আর কোনোভাবে সম্ভব? আর মুমিনের আমলের মর্যাদা শুধু বাহ্যিক পরিমাপ দ্বারা হয় না, বরং ঈমান তাকওয়ার গভীরতাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: পরবর্তীদের উহুদ পাহাড় পরিমাণ বা লক্ষ লক্ষ টন সম্পদ দান সাহাবীগণের অর্ধ মুদ্দ বা ২০০/৩০০ গ্রাম সম্পদ দানের সমকক্ষ হতে পারে না। আর এজন্যই পরবর্তী কোনো বুজুর্গ অনেক বেশি আমল করলেও মর্যাদায় কোনো অতি সাধারণ সাহাবীর সমকক্ষ হতে পারেন না। পরবর্তী কোনো প্রজন্মের কোনো বুজুর্গকে কোনো সাহাবীর সমকক্ষ বা উত্তম বলে মনে করলে মূলত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর এবং তাঁর সাহচর্যের অবমূল্যায়ন করা হয়

এজন্য ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) কোনো তাবিয়ীকে বা অন্য কোনো বুজুর্গকে মুআবিয়া (রা) বা কোনো সাহাবীর সাথে তুলনা করার প্রবণতার প্রবল বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন:


مقام أحدهم مع رسول الله ﷺ ساعة واحدة، خير من عمل أحدنا جميع عمره، وإن طال

‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে একজন সাহাবীর এক মুহূর্তের অবস্থান আমাদের আজীবনের আমলের চেয়েও উত্তম, আমাদের জীবন যতই দীর্ঘ হোক না কেন।’’[11]

অর্থে অন্য এক বুজুর্গ বলেন:


غبار دخل في أنف معاوية مع رسول الله ﷺ أفضل من عمل عمر بن عبد العزيز

‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহচর্যে মুআবিয়ার নাকের মধ্যে যে ধুলা প্রবেশ করেছে তাও উমার ইবন আব্দুল আযীযের আমলের চেয়ে উত্তম।’’[12]

ইমাম আবূ হানীফার আকীদা বর্ণনা প্রসঙ্গে চতুর্থ-পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ বিচারপতি সায়িদ নাইসাপূরী (৩৪৩-৪৩২ হি) বলেন:


روي عن ابن المبارك رحمه الله قال: كنت عند أبي حنيفة - رضي الله عنه - مع نوح بن أبي مريم، فقام، فقال: يا أبا حنيفة! إني قد كتبتُ هذه الكتبَ، وأريد أن أكتب من الآثار، فعمَّنْ أحمل؟ فقال: عن كل عدل في هواه إلا الرافضة، فإن أصل عقدِهم تضليلُ أصحاب النبي ﷺ. فَضِّلْ أبا بكر وعمر، وأحِبّ عليّا وعثمانَ، ولا تحمِلِ الآثار عمن لا يُحبّهم.

‘‘আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রাহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আবূ হানীফা (রাদি)-এর নিকট ছিলাম। আমার সাথে নূহ ইবন আবী মরিয়ম ছিলেন। তিনি দাঁড়িয়ে বললেন: হে আবূ হানীফা, আমি তো সকল (ফিকহী) কিতাব লেখাপড়া করলাম। এখন আমি হাদীস শিক্ষা করতে চাই। কার নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা করব? আবূ হানীফা বলেন: সকল সৎ-বিশ্বস্ত মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শিখবে, যদিও তার মধ্যে কিছু বিদআত থাকে। তবে শীয়া-রাফিযীদের থেকে কিছুই লেখা যাবে না। কারণ তাদের মতবাদের মূল ভিত্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণকে বিভ্রান্ত বলে দাবি করা। তুমি আবূ বকর (রা) উমার (রা)-কে সাহাবীগণের মধ্যে সর্বোত্তম বলে বিশ্বাস করবে এবং আলী (রা) উসমান (রা)-কে ভালবাসবে। যারা তাঁদেরকে ভালবাসে তারা ছাড়া আর কারো নিকট থেকে হাদীস শিখবে না।’’[13]

সম্মানিত পাঠক, ইমাম আবূ হানীফার কথাটি অনুধাবনের জন্য একটি বিষয় চিন্তা করুন। যদি ইহূদীদেরকে প্রশ্ন করা হয়: শ্রেষ্ঠ মানুষ কারা? তারা একবাক্যে বলবেন: আমাদের নবী মূসার () সহচরগণ। যদি খৃস্টানদেরকে প্রশ্ন করা হয়: শ্রেষ্ঠ মানুষ কারা? তারা একবাক্যে বলবেন: আমাদের নবী ঈসার () হাওয়ারী-সহচরগণ। আর যদি শীয়াদেরকে প্রশ্ন করা হয় নিকৃষ্ট-ঘৃণ্যতম মানুষ কারা? তবে তারা একবাক্যে বলবেন: আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সহচরগণ!!

শীয়াদেরকে প্রশ্ন করুন: সবচেয়ে ভাল মানুষ কারা? তারা বলবেন: আলী (রা)-এর সাথীগণ। তাদেরকে প্রশ্ন করুন: সবচেয়ে খারাপ মানুষ কারা? তারা একবাক্যে বলবেন: মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাথীগণ!!

সম্মানিত পাঠক, কাউকে ভালবাসার অতি স্বাভাবিক প্রকাশ তার সাথে জড়িত সকলকে ভালবাসা সম্মান করা। এমনকি তাদের কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলেও অজুহাত খুঁজে তা বাতিল করতে চেষ্টা করা। কারণ প্রিয়তমের সাথীদেরকে খারাপ কল্পনা করতে মন মানে না। আর কারো সঙ্গীসাথীকে সর্বোচ্চ ঘৃণা করার সুনিশ্চিত অর্থ ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা না থাকা। কাজেই মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাথীদেরকে পথভ্রষ্ট প্রমাণ করা তাঁদেরকে ঘৃণা করা যাদের ধর্মের মূল ভিত্তি তাঁদের থেকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর হাদীস বা দীন শিক্ষা করা কি সম্ভব?

সাহাবীগণ বিষয়ে ইমাম আযমের আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম তাহাবী বলেন:


وَنُحِبُّ أَصْحَابَ رسُولِ الله ﷺ، وَلاَ نُفْرِطُ في حُبِّ أَحَدٍ مِنْهُم؛ وَلاَ نَتَبَرَّأُ مِنْ أَحَدٍ مِنْهُم، وَنُبْغِضُ مَنْ يُبْغِضُهُم، وَبِغَيْرِ الخَيْرِ يَذْكُرُهُم، ولا نُذْكُرُهُم إِلاَّ بِخَيْرٍ, وَحُبُّهُم دِينٌ وإيمَانٌ وإحْسَانٌ، وَبُغْضُهُم كُفْرٌ ونِفَاقٌ وطُغْيَانٌ. وَنُثْبِتُ الْخِلافَةَ بَعْدَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ أَوَّلاً لأَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ َفْضِيلاً لَهُ وَتَقْدِيمًا عَلَى جَمِيعِ الأُمَّةِ، ثُمَّ لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ، ثُمَّ لِعُثْمَانَ ، ثُمَّ لِعَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ ، وَهُمُ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُونَ وَالأَئِمَّةُ الْمَهْدِيُّونَ. وَإِنَّ الْعَشَرَةَ الَّذِينَ سَمَّاهُمْ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ وَبَشَّرَهُمْ بِالْجَنَّةِ، نَشْهَدُ لَهُمْ بِالْجَنَّةِ عَلَى مَا شَهِدَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ، وَقَوْلُهُ الْحَقُّ، وَهُمْ: أَبُو بَكْرٍ، وَعُمَرُ، وَعُثْمَانُ، وَعَلِيٌّ، وَطَلْحَةُ، وَالزُّبَيْرُ، وَسَعْدٌ، وَسَعِيدٌ، وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عَوْفٍ، وَأَبُو عُبَيْدَةَ بْنُ الْجَرَّاحِ وَهُوَ أَمِينُ هَذِهِ الأُمَّةِ . وَمَنْ أَحْسَنَ الْقَوْلَ فِي أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ وَأَزْوَاجِهِ الطَّاهِرَاتِ مِنْ كُلِّ دَنَسٍ، وَذُرِّيَّاتِهِ الْمُقَدَّسِينَ مِنْ كُلِّ رِجْسٍ؛ فَقَدْ بَرِئَ مِنَ النِّفَاقِ. وَعُلَمَاءُ السَّلَفِ مِنَ السَّابِقِينَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنَ التَّابِعِينَ -أَهْلُ الْخَيْرِ وَالأَثَرِ، وَأَهْلُ الْفِقْهِ وَالنَّظَرِ-، لا يُذْكَرُونَ إِلاَّ بِالْجَمِيلِ، وَمَنْ ذَكَرَهُمْ بِسُوءٍ فَهُوَ عَلَى غَيْرِ السَّبِيلِ.

‘‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণকে ভালবাসি। তাঁদের কারো ভালবাসায় সীমালঙ্ঘন করি না এবং তাঁদের কারো প্রতি অভক্তি বা সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করি না। যারা সাহাবীগণকে বিদ্বেষ করে বা ঘৃণা করে বা ভালভাবে ছাড়া তাঁদের উল্লেখ করে আমরা তাদেরকে ঘৃণা করি। আমরা তাঁদেরকে ভাল কথা ছাড়া উল্লেখ করি না। তাঁদেরকে ভালবাসা দীন, ঈমান ইহসান। আর তাঁদেরকে বিদ্বেষ করা বা ঘৃণা করা কুফর, নিফাক অবাধ্যতা। আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পর আবু বাকর সিদ্দিক (রা)-এর খিলাফত স্বীকার করি এবং তা সমগ্র উম্মতের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব শীর্ষস্থানীয় হওয়ার কারণে। তারপর উমার ইবন খাত্তাব (রা), তারপর উসমান (রা) এবং তারপর আলী (রা)-এর খিলাফত স্বীকার করি। এরাই হলেন খুলাফায়ে রাশেদীন, (সুপথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দ) আয়িম্মাহ মাহদিয়ীন (মাহদী ইমাম বা হিদায়াতপ্রাপ্ত ইমামবৃন্দ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে দশজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করে তাঁদের জান্নাতবাসী হওয়ার সুসংবাদ দান করেছেন আমার তাঁর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁদের জান্নাতবাসী হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করি। কেননা, তাঁর উক্তি সত্য। এরা হলেন: আবু বাকর, উমার, উসমান, আলী, তালহা, যুবায়ের, সা (ইবন আবী ওয়াক্কাস), সাঈদ (ইবন যাইদ ইবন আমর), আব্দুর রহমান বিন ওফ এবং আবু উবায়দাহ বিন জাররাহ (রাঃ) আর শেষোক্তজন উম্মতের আমীন (বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি) হিসেবে আখ্যায়িত। আল্লাহ্ তাআলা তাঁদের সবাইর উপর সন্তুষ্ট হোন। যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ, তাঁর নিষ্কলুষ সহধর্মিনী পূত-পবিত্র নির্মল বংশধরগণ সম্পর্কে উত্তম মন্তব্য করলো সে নিফাক থেকে মুক্ত হলো। প্রথম যুগেরসালাফ সালিহীন’ (নেককার পূর্ববর্তীগণ) তাঁদের অনুসারী পরবর্তীকালের কল্যাণময় আলিমগণ, মুহাদ্দিস হাদীস অনুসারীগণ এবং ফকীহ-মুজতাহিদ ফিকহ-অনুসারীগণ, তাঁদের সকলকেই যথাযোগ্য সম্মান প্রশংসার সাথে স্মরণ উল্লেখ করতে হবে। আর যে ব্যক্তি তাঁদের সম্পর্কে কটুক্তি বা বিরূপ মন্তব্য করে সে ভ্রান্ত পথের অনুসারী।’’[14]

[1] সূরা (৫৭) হাদীদ: ১০ আয়াত
[2]
সূরা (৪৯) হুজুরাত, আয়াত
[3]
সূরা () তাওবা: ১০০ আয়াত
[4]
সূরা (৪৮) ফাত্হ: ১৮ আয়াত
[5]
সূরা () তাওবা: ৮৮ আয়াত
[6]
সূরা (৫৯) হাশর: ১০ আয়াত
[7]
নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা /৩৮৭; মাকদিসী, আল-আহাদীসুল মুখতারাহ /১৯৩, ২৬৬, ২৬৮; তাহাবী, শারহু মাআনীল আসার /১৫০; মামার ইবনু রাশিদ, আল-জামি ১১/৩৪১; আবদ ইবনু হুমাইদ, মুসনাদ, পৃ: ৩৭ হাদীসটির সনদ সহীহ
[8]
বুখারী, আস-সহীহ /১৩৪৩ (ফাযাইলু আসহাবিন নাবিয়্যি, বাবু কাওলিন নাবিয়্যি: লাও কুনতু মুত্তাখিযান....); মুসলিম, আস-সহীহ /১৯৬৭ (কিতাব ফাযাইলিস সাহাবা, বাবু তাহরীমি সাবিবস সাহাবা)
[9]
সূরা (৫৬) ওয়াকিয়া: ১০-১২ আয়াত
[10]
ইমাম আবূ হানীফ, আল-ওয়াসিয়্যাহ, পৃ. ৭৭.
[11]
মুওয়াফ্ফাক ইবন আহমদ মাক্কী (৫৬৮ হি), মানাকিবু আবী হানীফাহ, পৃষ্ঠা ৭৬
[12]
ইবন তাইমিয়া, মিনহাজুস সুন্নাতিন নববিয়্যাহ (কুরতুবা: শামিলা) /১৪০
[13]
সায়িদ নাইসাপূরী, আল-ইতিকাদ, পৃষ্ঠা ১৫৮
[14]
তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৮-১৯

 . . পূর্ববর্তী আলিমগণ

আমরা দেখছি যে, সাহাবীগণের বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা তাঁর সাথীদের আকীদা আলোচনা প্রসঙ্গে ইমাম তাহাবীসালাফ সালিহীনবা পূর্ববর্তী নেককারগণ তাঁদের অনুসারী পরবর্তী আলিম-বুজুর্গগণ বিষয়ক আকীদা ব্যাখ্যা করেছেন

বিষয়ক উগ্রতা তাঁর যুগে যেমন ব্যাপক ছিল, বর্তমান যুগেও তেমনি। আমরা দেখেছি যে, শীয়াগণ ভক্তির নামে আলী-বংশের ইমামগণ, তাঁদের খলীফাগণ এবং শীয়া সমাজের অগণিত আলিম, ইমাম পীরকে নির্ভুল, নিষ্পাপ, মাসূম বা ‘‘অভ্রান্ত’’ বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের কথা, কর্ম বা মতকেই দীনের জন্য চূড়ান্ত বলে গণ্য করেছেন এবং সেগুলোর ভিত্তিতে কুরআন হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য অস্বীকার, অমান্য বা ব্যাখ্যা বাতিল করেছেন। এভাবে তাঁদেরকে তারা নুবুওয়াতের মর্যাদায় সমাসীন করেছেন। পাশাপাশি সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ, চার ইমাম মূলধারার সকল আলিম-বুজুর্গর চরিত্র হরণ বিদ্বেষ প্রচারে বিভিন্ন প্রকারের জালিয়াতি নোংরামির আশ্রয় নিয়েছেন

অপরদিকে খারিজীগণ এবং তাদের পাশাপাশি মুতাযিলা অন্যান্য বিভ্রান্ত ফিরকা পূর্ববর্তী আলিমগণের ইলম, ইজতিহাদ, জ্ঞান মতের গুরুত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, উপরন্তু তারা তাঁদের বিষয়ে কটূক্তি করেছেন। পূর্ববর্তী আলিমগণ কেউ বা তাদের মধ্যকার অমুক-তমুক ইসলাম মোটেও বুঝেন নি, অজ্ঞ ছিলেন, দালাল বা দুনিয়ামুখি ছিলেন ইত্যাদি অশালীন নোংরা মন্তব্য তারা করেছে

দুটি বিভ্রান্ত ধারার পাশাপাশি ‘‘আহলুস সুন্নাত’’-এর হাদীসপন্থী ফিকহপন্থী নামধারীদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা পূর্ববর্তী মুহাদ্দিস ফকীহগণের বিষয়ে অশালীন মন্তব্য করা শুরু হয়। হাদীসপন্থীরা ফকীহদের বিষয়ে ঢালাওভাবে এবং কখনো কখনো বিশেষ কোনো ফকীহ, মুজতাহিদ বা ইমামের বিষয়ে ‘‘হাদীস-বিরোধী’’, ‘‘অজ্ঞ’’ ইত্যাদি মন্তব্য করতেন। এর বিপরীতে ফিকহপন্থী বা ফিকহ অনুসারীগণ মুহাদ্দিসদের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে বা কোনো কোনো মুহাদ্দিসের বিষয়ে ‘‘প্রজ্ঞাহীন মুখস্তকারী’’, ‘‘নির্বোধ’’, ‘‘তোতাপাখি’’ ইত্যাদি মন্তব্য করতেন। প্রেক্ষাপটে কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত সঠিক পথ নির্দেশনার জন্য ইমাম তাহাবী ইমাম আবূ হানীফার আকীদা উল্লেখ করে বলেন যে, উম্মাতের পূর্ববর্তী আলিম, মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজতাহিদ, ইমাম সকলকেই সম্মান প্রশংসার সাথে স্মরণ করতে হবে

বস্ত্তত সাধারণ মানুষ, এমনকি আলিম প্রাজ্ঞ মানুষেরাও মর্যাদার বিষয়ে বিশেষ প্রান্তিকতায় আক্রান্ত। তাঁরা মনে করেন যে, কাউকে সম্মান বা মর্যাদার আসনে বসানোর অর্থ তার সবকিছুকে সঠিক বলে গ্রহণ করা। অথবা মনে করা হয় যে, কারো কর্ম, মত বা কথার বিরোধিতা করার অর্থ তাকে অবমূল্যায়ন করা। কখনো মনে করা হয়, কারো মত বা কর্মে কিছু ভুল থাকার অর্থই তার অগ্রহণযোগ্যতা

কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা সাহাবীগণের কর্মধারা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। নবীগণ ছাড়া কেউ মাসূম, অভ্রান্ত বা নির্ভুল নন। ভুলের কারণে কোনো মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বা বুজুর্গি নষ্ট হয় না। তেমনি কারো বেলায়াত বা বুজুর্গির কারণে তাঁর ভুলগুলি সঠিকে পরিণত হয় না। সাহাবীগণ, প্রসিদ্ধ ইমামগণ পরবর্তী প্রসিদ্ধ আলিমগণ অনেক সাহাবী-তাবিয়ীর অনেক মত গ্রহণ করেন নি বা বিরোধিতা করেছেন। কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী মোজার উপর মাস্হ করা সর্বাবস্থায় নিষেধ করেছেন, কেউ মোজাবিহীন পা মাস্হ করেছেন, কেউ তিনবার মাথা মাস্হ করেছেন, কেউ সালাত-রত অবস্থায় মুসাফাহা করেছেন, কেউ রুকুর মধ্যে দু হাটুর মধ্যে হাত রেখেছেন...[1] সকল ক্ষেত্রে সুন্নাতে নববীর বিপরীতে দু-একজন সাহাবী বা তাবিয়ীর কর্ম, মত বা কথা তাঁরা গ্রহণ করেন নি। কিন্তু কখনোই কোনোভাবে তাঁরা বিরূপ মন্তব্য করেন নি। বরং তাঁদের প্রতি পরিপূর্ণ সম্মান ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। মুজতাহিদ তার সঠিক ইজতিহাদের জন্য দুটি সাওয়াব এবং ভুল ইজতিহাদের কারণে একটি সাওয়াব লাভ করেন।[2] তাঁর ভুল ইজতিহাদের কারণে তিনি অপরাধী হন না। কুরআন-সুন্নাহের আলোকে পূর্ববর্তী আলিমগণের মত আলোচনা, পর্যালোচনা, গ্রহণ বা বর্জনের অধিকার পরবর্তী আলিমগণের রয়েছে। কিন্তু তাঁদের কারো কোনো বক্তব্য, কর্ম বা ভুল ইজতিহাদের জন্য তাঁদের প্রতি বিরূপ ধারণা বা অশ্রদ্ধা প্রকাশ নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। ইমাম তাহাবী সে বিষয়টিই উল্লেখ করেছেন

এখানে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়:

প্রথমত: আলিমের গ্রহণযোগ্যতার জন্য নির্ভুল হওয়া শর্ত নয়; কারণ নবীগণ ছাড়া কেউ মাসূম নন। একজন প্রসিদ্ধ আলিমকে প্রশ্ন করা হয়, অমুক ব্যক্তি আলিম হয়ে কিভাবে সুন্নাতের বিরোধিতা করলেন? কিভাবে এরূপ ভুল করলেন? কিভাবে বিষয়টি জানলেন না বা বুঝতে পারলেন না? উত্তরে তিনি বলেন: ‘‘যেন আলিমগণ নবীগণের মত না হন সেজন্যই আল্লাহ ব্যবস্থা করেছেন।’’

দ্বিতীয়ত: আলিমগণের মর্যাদা কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত। আলিমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। হাদীস, ফিকহ কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সকল প্রকার ইলমই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কাজেই সকল আলিমকে শ্রদ্ধা করা ভালবাসা মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব। আকীদাহ তাহাবিয়্যার ব্যাখ্যাকারগণ, ইবন আবিল ইয্য হানাফী, সালিহ আল-ফাওযান, সালিহ ইবন আব্দুল আযীয আল-শাইখ অন্যান্য আলিম উল্লেখ করেছেন যে, এখানে ইমাম তাহাবী প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ সকল মুহাদ্দিস ফকীহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ভালবাসার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। তাঁদের কারো ইজতিহাদী ভুলের জন্য বিরূপ মন্তব্য করা, তাঁদের মর্যাদাহানি বা অবমূল্যায়নের উদ্দেশ্যে তাঁদের ভুলগুলি সংকলন বা প্রচার করা ইত্যাদি সবই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত সালফ সালিহীনের মত পথের সাথে সাংঘর্ষিক

তৃতীয়ত: তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ইসলামী জ্ঞানের অন্যান্য শাখার প্রসিদ্ধ আলিমগণের মাধ্যমেই উম্মাতের সাধারণ মানুষ দীন লাভ করেছেন। তাঁদের প্রতি বিরূপ ধারণা, মন্তব্য অশ্রদ্ধা সাধারণ মানুষের মনোজগতে দীনী ইলম চর্চায়-রত আলিমগণের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়, দীনের বিষয়ে তাঁদেরকে প্রশ্ন করতেও তারা উৎসাহ পায় না এবং ক্রমান্বয়ে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন বিভ্রান্তি বিচ্ছিন্নতার মধ্যে নিপতিত হয়। শাইখ সালিহ ইবন আব্দুল আযীয আল-শাইখ বলেন: ‘‘আলিমগণের বিষয়ে খারাপ মন্তব্য মূলত সাহাবীদের বিষয়ে খারাপ মন্তব্যের মতই। আর এজন্যই ইমাম তাহাবী সাহাবীদের পরে আলিমগণের কথা উল্লেখ করেছেন। সাহাবীদের বিষয়ে কু-ধারণা বা খারাপ মন্তব্য দীনের বিশুদ্ধতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। তেমনি প্রাজ্ঞ, প্রসিদ্ধ নেককার আলিম, ইমাম, ফকীহ, মুজতাহিদ বা মুহাদ্দিসগণের ইজতিহাদী ভুলভ্রান্তির কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য বা কু-ধারণাও দীন ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার।[3]

ভালবাসা শ্রদ্ধার প্রকাশসহ সমালোচনা ইসলাম সম্মত। কিন্তু বর্তমানে আমরা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে আলিমদের চরিত্রহননে লিপ্ত। এতে প্রত্যেক দলের অনুসারীরা খুশি হচ্ছেন। কিন্তু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ যুব সমাজ কোনো ধর্মীয় দলের অনুসারী না। তারা এতটুকুই বুঝছেন যে, আলিমরা অজ্ঞ, অসৎ অযোগ্য। ধর্মীয়, সামাজিক বা নৈতিক কোনো বিষয়ে তাঁদের সাথে কথা বলে লাভ নেই। খৃস্টান মিশনারি, কাদিয়ানী, বাহায়ী, নাস্তিক অন্যান্যরা বিষয়টি খুব ভালভাবে কাজে লাগাচ্ছেন

সম্মানিত পাঠক, আমরা দেখেছি, পূর্ববর্তীদের প্রতি পরবর্তীদের দায়িত্ব বর্ণনা করে আল্লাহ বলেছেন: ‘‘যারা তাদের পরে এসেছে, তারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে আমাদের যে সকল ভাই আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছেন তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু’’[4]

মহান আল্লাহ আমাদেরকে এভাবে পূর্ববর্তী আলিম-বুজুর্গদের জন্য দুআ করার এবং পূর্ববর্তী সমকালীন সকল আলিম মুমিনকে ভালবাসার এবং তাদের প্রতি অতিভক্তি বিদ্বেষ থেকে হৃদয়কে পবিত্র করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

[1] দেখুন: আব্দুর রাজ্জাক সানআনী, আল-মুসানণাফ /১৮-২৮, ১৯১-১৯৯; ইবনু আবী শাইবা, আল- মুসানণাফ /২৫-২৭; ১৬৯-১৭০, ২২২-২২৫; ৪১৮-৪১৯; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /৩০৫-৩০৯; মোললা আলী কারী, শারহুল ফিকহুল আকবার, পৃ: ১০৬, ৩০৪; . খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ১০৫-১০৭
[2]
বুখারী, আস-সহীহ /২৬৫২ (কিতাবুল ইতিসাম, বাবু আজরিল হাকিমি ইযাজতাহাদা) মুসলিম, আস-সহীহ /১৩১-১৩২ (কিতাবুল আকদিয়া, বাবু বায়ানি আজরিল হাকিমি ...)
[3]
সালিহ ইবনু আব্দুল আযীয আল-শাইখ, ইতহাফুস সায়িল বিমা ফিল আকিদাতি তাহাবিয়্যা, ৪৫/২১
[4]
সূরা (৫৯) হাশর: ১০ আয়াত

 . তাকফীর বা কাফির কথন

এরপর ইমাম আবূ হানীফাতাকফীরপ্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন: ‘‘আমরা কোনো মুসলিমকে কোনো পাপের কারণে কাফির বলি না, যদিও তা কোনো কবীরা গোনাহ হয়, যতক্ষণ না সে ব্যক্তি উক্ত পাপটিকে হালাল বলে বিশ্বাস করে। আমরা পাপের কারণে কোনো মুসলিমেরঈমান’-এর নাম অপসারণ করি না। বরং আমরা তাকে প্রকৃতই মুমিন বলে আখ্যায়িত করি, সে কাফির না হয়ে একজন পাপী মুমিন হতে পারে।

. . ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলা

 কুফর’ (الكُفْرُ) অর্থ আবৃত করা, অবিশ্বাস, অস্বীকার বা অকৃতজ্ঞতা (to disbelieve, to be ungrateful, to cover) ইসলামী পরিভাষায় বিশ্বাসের অবিদ্যমানতাই কুফর বা অবিশ্বাস। আল্লাহ, তাঁর রাসূল বা ঈমানের রুকনগুলিতে বিশ্বাস না থাকা- ইসলামের পরিভাষায়কুফরবলে গণ্য। অস্বীকার, সন্দেহ, দ্বিধা, হিংসা, অহঙ্কার, ইত্যাদি যে কোনো কারণে যদি কারো মধ্যেঈমানবা দৃঢ় প্রত্যয়ের বিশ্বাস অনুপস্থিত থাকে তবে তা ইসলামী পরিভাষায়কুফরবলে গণ্য। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে তাঁর সমতুল্য বা সমকক্ষ বা তাঁর সাথে তুলনীয় বলে বিশ্বাস করার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ব অতুলনীয়ত্ব অস্বীকার করাও কুফর। এজন্য কুফর বলতে শিরক, সন্দেহ সকল প্রকার অবিশ্বাস বুঝানো হয়

তাক্ফীর (التكفير) এবং ইক্ফার (الإكفار) অর্থ ‘‘কাফির বানানো’’ অর্থাৎ কাউকে কাফির বলা বা অবিশ্বাসী বলে অভিযুক্ত করা (to accuse of unbelief, charge with infidelity) যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন বা বিশ্বাসী বলে দাবি করছেন তাকে অবিশ্বাসী বা কাফির বলে আখ্যা দেওয়াকে সাধারণভাবে ‘‘তাকফীর’’ বলা হয়

মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রকাশিত প্রথম বিভ্রান্তিগুলোর অন্যতম ছিল ‘‘তাকফীর’’ বা মুসলিমকে কাফির বলা। দ্বিতীয় হিজরী শতকে বিদ্যমান বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর মধ্যে একটি বিষয়ে মিল ছিল, তা হলো, নিজেদের ছাড়া অন্যান্য মুসলিমকে কাফির বলে গণ্য করা। এদের মধ্যে ‘‘খারিজী’’ ফিরকার আকীদার মূল ভিত্তিই ছিল ‘‘তাকফীর’’ অন্যান্য ফিরকাও পাপের কারণে বা মতভেদীয় বিষয়ে ভিন্নমতের কারণে মুসলিমদেরকে ঢালাওভাবে কাফির বলতে থাকে। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর যুগে তাকফীর ছিল উম্মাতের অন্যতম ফিতনা বিভ্রান্তি। জন্য তিনি গ্রন্থে অন্যান্য পুস্তিকায় বিষয়টি আলোচনা ব্যাখ্যা করেছেন

 . . কাফির কথনের পদ্ধতিসমূহ

বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর ‘‘তাকফীর’’ পদ্ধতিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়:
(
) কুফর-এর পরিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে তাকফীর,
(
) ঈমান-এর পরিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে তাকফীর এবং
(
) কথা বা মতের পরিণতির অজুহাতে তাকফীর

 . . . কুফর-এর পরিধি বাড়ানো

 ‘‘কুফর’’-এর পরিধি বাড়ানো অর্থ যা কুফর নয় তাও কুফর বলে গণ্য করা। এর অন্যতম দিক কবীরা গোনাহকে কুফর বলে গণ্য করা। পদ্ধতিতে মুমিনকে কাফির বলার ধারা চালু হয় ‘‘খারিজী’’-গণের মাধ্যমে। তারা যে কোনো কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়াকে কুফর বলে গণ্য করে। খারাজা (خَرَجَ) অর্থ বাহির হওয়া, আনুগত্য ত্যাগ বা বিদ্রোহ করা। খারিজ বা খারিজী (الخارج/الخارجي) অর্থ দলত্যাগী, বিদ্রোহী, সমাজ পরিত্যাগকারী বা বিচ্ছিন্নতার পথ গ্রহণকারী

৩৭ হিজরী সালে আলী (রা)-এর সাথে মুআবিয়া (রা)-এর চলমান সিফ্ফীনের যুদ্ধের সময়ে একপর্যায়ে উভয় পক্ষ ‘‘সালিস’’-এর মাধ্যমে মীমাংসা করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে আলী (রা)-এর পক্ষের কয়েক হাজার যুবক সৈনিক পক্ষত্যাগ করে ‘‘বিদ্রোহী’’ বাহিনী তৈরি করেন। এদের মূলনীতি ছিল () তাকফীর, () জিহাদ () রাষ্ট্র। এরা দাবী করেন যে, আল্লাহর কোনো বিধান অমান্য করা বা কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়াই কুফরী। কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয আইন। এরূপ কাফির বা পাপী রাষ্ট্রপ্রধান তার পক্ষের মানুষদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয আইন। তারা দাবি করেন, আল্লাহ কুরআনে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।[1] আলী (রা) মুআবিয়া (রা) সে নির্দেশ অমান্য করে সালিস নিয়োগ করে কুফরী করেছেন। কাজেই তাঁরা তাঁদের অনুসারীরা সকলেই কাফির। এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে প্রকৃত মুসলিমদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ফরয

এরা ইসলামের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষ, যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের প্রায় সকলেই ছিলেন যুবক। এরা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, সৎ নিষ্ঠাবান আবেগী মুসলিম। সারারাত তাহাজ্জুদ আদায় সারাদিন সিয়াম, যিক্র কুরআন পাঠে রত থাকার কারণে এরাকুর্রাবাকুরআনপাঠকারী দলবলে সুপরিচিত ছিলেন। এদের বাহ্যিক ধার্মিকতা সততা ছিল অতুলনীয়। পাশাপাশি এদের হিংস্রতা সন্ত্রাস ছিল ভয়ঙ্কর। নিরপরাধ অযোদ্ধাসহ হাজার হাজার মুসলিমের প্রাণ নষ্ট হয় তাদের হিংস্রতা সন্ত্রাসের কারণে

মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন:


إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلّهِ

‘‘হুকুম, বা কর্তৃত্ব শুধু আল্লাহরই’’ বা ‘‘বিধান শুধু আল্লাহরই’’[2]

থেকে তারা বুঝাতেন যে, আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানাই কুফর। আর পাপ মানেই আল্লাহর অবাধ্যতায় শয়তানের আনুগত্য করা তার হুকুম মানা। কাজেই পাপ অর্থই কুফরী। মহান আল্লাহ আরো বলেন:


وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

‘‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির।’’[3]

থেকে তারা দাবি করতেন যে, আল্লাহর নাযিলকৃত যে কোনো হুকুমু বা বিধান অমান্য করাই কুফর। এছাড়া হাদীসে অনেক সময় পাপকে সুস্পষ্টভাবে কুফরী বলা হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ

‘‘মুসলিমকে গালি দেওয়া পাপ এবং তার সাথে যুদ্ধ করা কুফরী।’’[4]

কুরআন-হাদীসের সকল নির্দেশনার ভিত্তিতে তারা যে কোনো কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়াকে কুফরী বলে গণ্য করত, এরূপ ব্যক্তি, সরকার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ, যুদ্ধ হত্যা বৈধ জরুরী বলে দাবি করত

বস্ত্তত ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলে দাবি করা মুসলিম সমাজের সকল সংঘাত, হানাহানি ফিতনার মূল উৎস। সাহাবীগণ পরবর্তী যুগগুলোর সকল ইমাম, ফকীহ আলিম বিভ্রান্তি দূরীকরণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। আমি ‘‘ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ’’ গ্রন্থে ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, খারিজীদের বিভ্রান্তির কারণ স্বরূপ নিম্নরূপ:

() কুরআন-হাদীসের এক নির্দেশনা মান্য করার দাবিতে অন্য নির্দেশনা অস্বীকার, ব্যাখ্যা বা রহিত-মানসূখ বলে দাবি করা। কুরআনে একদিকে যেমন আল্লাহর বিধান বিরোধী ফয়সালা করা বা বিধান অমান্যকে কুফর বলা হয়েছে, অন্যদিকে বিধান বিরোধী ফয়সালা বা কর্মে লিপ্তদেরকে মুমিন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হাদীসে যেমন কোনো কোনো পাপকে কুফর বলা হয়েছে তেমনি অগণিত হাদীসে কঠিনতম পাপে লিপ্ত মুমিনকে ‘‘পাপী মুমিন’’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে

() কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা অনুধাবনের ক্ষেত্রে ‘‘সুন্নাত’’ বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যবহারিক রীতি কর্মকে গুরুত্ব না দেওয়া। তাঁর ব্যবহারিক সুন্নাত থেকে আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারি যে, তিনি কখনো কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুমিনদেরকে কাফির বলে গণ্য করেন নি

() কুরআন-হাদীস অনুধাবনের ক্ষেত্রে নিজেদের ‘‘বুঝ’’-কে চূড়ান্ত এবং সাহাবীগণের মত ব্যাখ্যাকে গুরুত্বহীন ভাবা। সাহাবীগণ কুরআন নাযিল প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এর ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যবহারিক প্রায়োগিক রীতি প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁরা সর্বসম্মতভাবে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, পাপের কারণে কোনো মুসলিমকে কাফির বলা বৈধ নয়। তাঁরা বারবার বলেছেন যে, কুরআন হাদীসে কুফর বলতে কখনো অবিশ্বাস এবং কখনো অকৃতজ্ঞতা বুঝানো হয়েছে। এছাড়া আল্লাহর বিধানের প্রতি বিশ্বাস আস্থাসহ তা অমান্য করা এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা অস্বীকৃতিসহ তা অমান্য করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে

[1] সূরা (৪৯) হুজুরাত: আয়াত
[2]
সূরা () আনআম: ৫৭ আয়াত; সূরা (১২) ইউসূফ: ৪০ ৬৭ আয়াত
[3]
সূরা () মায়িদা: ৪৪ আয়াত
[4]
বুখারী, আস-সহীহ /২৭ (কিতাবুল ঈমান, বাবু খাওফিল মুমিন), /২২৪৭, /২৫৯২; মুসলিম, আস-সহীহ /৮১ (কিতাবুল ঈমান, বাবু কাওলিন নাবিয়্যি... সিবাবুল মুমিন)

 . . . ওহী বহির্ভূত বিষয়কেঈমান’’ বানানো

তাকফীর বা মুমিনকে কাফির কথনের দ্বিতীয় দিক ঈমানের পরিধি বাড়িয়ে মুমিনকে কাফির বানানো। শীয়া, মুতাযিলা অন্যান্য বিভ্রান্ত দল নীতি অনুসরণ করে। ঈমানের ভিত্তি ওহীর জ্ঞান। কুরআনে বা সুপ্রসিদ্ধ সহীহ হাদীসে যে বিষয়গুলো সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর বাইরে অনেক বিষয়কে সকল বিভ্রান্ত সম্প্রদায় ‘‘ঈমানের অংশ’’ বানায় এবং এসকল বিষয় অস্বীকার বা অমান্য করার কারণে বিরোধীদেরকে কাফির বলে আখ্যায়িত করে

যেমন শীয়াগণ দাবি করেন যে, () আলী (রা)-কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পর মুসলিম উম্মাহর রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় নেতৃত্বে তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী ওসিয়তপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা, () সাহাবীগণ যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পরে আলী (রা)-কে খিলাফত প্রদান করেন নি সেহেতু তাঁদেরকে অবিশ্বাসী বা বিভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করা, () সাহাবীগণকে বিদ্বেষ করা তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেওয়া, () আলী তাঁর বংশের ইমামগণের ইমামতে, নিষ্পাপত্বে, গাইবী ইলমে অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করা... ইত্যাদি বিষয় ঈমানের অংশ। এগুলো অস্বীকার করা কুফর

সকল আকীদার কোনো কিছুই সুষ্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। আমরা আগেই বলেছি, শীয়গণের নিকট কুরআন ‘‘আকীদা’’ বা বিশ্বাসের উৎস নয়। তাদের বিশ্বাস যে, তাদের ভক্তিকৃত ইমাম, বুজুর্গ নেতৃবৃন্দইলম লাদুন্নীঅর্থাৎ আল্লাহ, তাঁর রাসূলবা আলী-বংশের ঈমামগণের নিকট থেকে প্রাপ্ত বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। কাজেই তাদেরতাফসীরবা মতই বিশ্বাসের ভিত্তি। এরপর বিভিন্ন ফযীলত বিষয়ক আয়াত, হাদীস, ঐতিহাসিক ঘটনা, জাল হাদীস, যুক্তিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে তারা এগুলো প্রমাণের চেষ্টা করেন। সর্বশেষ এগুলো অস্বীকার করাকে কুফর বলে গণ্য করে। অন্যান্য সকল বিভ্রান্ত ফিরকাও পদ্ধতি অনুসরণ করে

 . . . ‘‘কথার দাবি’’- অজুহাতে কাফির বানানো

বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভিন্নমতের মুমিনকে কাফির বলার বিষয়ে উদগ্রীবতা। তারা ভিন্নমতের মুমিনের কর্ম বা মতের ব্যাখ্যা করে সে ব্যাখ্যার অজুহাতে তাকে কাফির বলেন। আরবীতে একে বলা হয়লাযিমুল কাওল’ (لازم القول), বামাআল’ (مآل) অর্থাৎ কথার দাবি বা পরিণতি। অর্থাৎকথাটির অবশ্যম্ভাবী অর্থ বা পরিণতি আরকথা বললে সে নিশ্চিত কাফির। কাজেইকথাটি যে বলেছে সেও নিশ্চিত কাফির। যেমন মুতাযিলীগণ দাবি করত, যে ব্যক্তি আখিরাতে আল্লাহর দর্শন পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করে সে কাফির। কারণ () আল্লাহকে মাখলূকের সাথে তুলনা করা কুফর, () আল্লাহকে আখিরাতে দেখা যাবে বলার অর্থই তাঁকে মাখলুকের সাথে তুলনা করা, () অতএব এরূপ বিশ্বাসকারী কাফির

কুরআন এবং হাদীসে আখিরাতে আল্লাহর দর্শনের কথা বলা হয়েছে। এর বিপরীতে একটি আয়াত বা হাদীসেও বলা হয় নি যে, আখিরাতে আল্লাহর দর্শন অসম্ভব বা এরূপ বিশ্বাস কুফর। যে ব্যক্তি আখিরাতে আল্লাহর দর্শন লাভের বিশ্বাস পোষণ করেন তিনি কুরআন হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার উপর নির্ভর করেন। উপরন্তু তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন যে, আল্লাহ মাখলুকের সাথে তুলনীয় নন এবং তাঁকে তুলনীয় মনে করা কুফরী। কিন্তু মুতাযিলীগণ ঘোষণার প্রতি কর্ণপাত করতেন না। তাদের একই কথা ‘‘আখিরাতে আল্লাহর দর্শন লাভে বিশ্বাস করার অর্থই তাঁকে মাখলুকের সাথে তুলনা করা। কাজেই এরূপ ব্যক্তি যদি শতকোটিবারও বলে আল্লাহ মাখলূকের সাথে তুলনীয় নন, আমি তুলনাবিহীনভাবে তাঁর দর্শনে বিশ্বাস করি- তাহলেও তাকে কাফির বলে গণ্য করতে হবে।’’ এরূপ দাবির ভিত্তিতেই খলীফা মামুন, মুতাসিম ওয়াসিক ইমাম আহমদ-সহ অগণিত আলিমকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেন এবং কয়েকজনকে হত্যা করেন

শীয়াগণ বিশ্বাস করেন যে, আলী (রা) তাঁর বংশের ইমামগণ সাধারণ মানুষ নন। বরং তাঁরা নূরের তৈরি এবং গাইবী-অলৌকিক ইলম ক্ষমতার অধিকারী। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে এরূপ দাবি না করে শুধু ইমামদের নামে দাবি করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না, এজন্য তারা দাবি করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- নূরের তৈরি এবং গাইবী ইলম ক্ষমতার অধিকারী। যারা কথা মানেন না তারা কাফির। কারণ: () রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইমামগণের পরিপূর্ণ মর্যাদায় বিশ্বাস করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, () তাঁদের নূরত্ব এবং অলৌকিক ইলম ক্ষমতায় বিশ্বাস না করলে তাঁদের অবমর্যাদা করা হয়, () অতএব তাঁদের নূরত্ব, গাইবী ইলম ক্ষমতায় অবিশ্বাসকারী কাফির এবং নবী (ﷺ) নবী-বংশের দুশমন

আমরা জানি যে, কুরআন হাদীসে বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মানুষ ছিলেন এবং মানুষ মাটি থেকে সৃষ্ট। কুরআন-হাদীসে আরো বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ গাইব জানে না। বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলিমুল গাইব ছিলেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ওহীর জ্ঞান ছাড়া অন্য কোনো গাইব তিনি জানতেন না। তিনি তাঁর নিজের বা অন্যের কোনো কল্যাণ-অকল্যাণের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। অন্য কাউকে আল্লাহ কোনো ক্ষমতা প্রদান করেন নি। সকল সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যের বিপরীতে একটি আয়াতে বা সহীহ হাদীসেও বলা হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা ইমামগণ কেউ নূর দ্বারা সৃষ্ট, তাঁরা কেউ আলিমুল গাইব ছিলেন বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইমামগণের নূরত্ব, গাইবী ইলম ক্ষমতার বিষয় অস্বীকার করেন তাঁরা কুরআন হাদীসের সকল সুস্পষ্ট নির্দেশনার উপর নির্ভর করেন। পাশাপাশি তাঁরা বলেন: আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে ওহীর মাধ্যমে অগণিত গাইবের কথা জানিয়েছেন, তাঁর তাঁর বংশধরের বিষয়ে কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সকল মর্যাদায় আমরা বিশ্বাস করি এবং তাঁদের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা অকাতরে জীবন দিতে প্রস্ত্তত। কিন্তু শীয়াগণ সকল কথায় কর্ণপাত করেন নি; বরং বিভিন্ন যুক্তি, তর্ক অজুহাতে ভিন্নমতের মানুষদের কাফির বলেছেন, সুন্নী সমাজ রাষ্ট্রগুলোকে ‘‘তাগূতী’’ কাফির রাষ্ট্র বলে গণ্য করেছেন।[1]

কথার দাবি বা পরিণতি দিয়ে একে অন্যকে কাফির বলা উম্মাতের ভয়ঙ্কর ব্যাধি। বিভ্রান্ত সম্প্রদায়গুলোর পাশাপাশি অনেক সময় ভাল মানুষেরা এতে আক্রান্ত হন। বর্তমান যুগে জাতীয় তাকফীরের দুটি নমুনা দেখুন:

() যে ব্যক্তি মীলাদ-কিয়াম করে না.... রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে হাযির-নাযির বলে বিশ্বাস করে না, সে তাঁর মর্যাদায় বিশ্বাস করে না। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অমর্যাদা সর্বসম্মতভাবে কুফর। কাজেই যে মীলাদ-কিয়াম করে না.... সে কাফির!

() যে ব্যক্তি মীলাদ পড়ে, কিয়াম করে, কোনোরূপ লিপ্ত হয়, কোনো জাল হাদীস বলে সে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নুবুওয়াত সুন্নাতের পূর্ণতায় বিশ্বাস করে না। আর যে ব্যক্তি তাঁর নুবুওয়াত সুন্নাতের পূর্ণতায় বিশ্বাস করে না সে সর্বসম্মতভাবে কাফির। কাজেই যে ব্যক্তি মীলাদ পড়ে, কিয়াম করে... সে কাফির!

[1] বিস্তারিত দেখুন: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ১৭১-২৪০

 . . ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার নিষেধাজ্ঞা

ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলতে নিষেধ করে মহান আল্লাহ বলেন:


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا ضَرَبْتُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَتَبَيَّنُوا وَلا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا

‘‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা আল্লাহর পথে যাত্রা করবে তখন যাচাই করবে এবং যে ব্যক্তি তোমাদেরকে সালাম দেবে তাকে বলবে না যে, ‘তুমি মুমিন নও।’’’[1]

বিভিন্ন সাহাবী থেকে বর্ণিত মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِذَا كَفَّرَ الرَّجُلُ أَخَاهُ فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا (إِنْ كَانَ كَمَا قَالَ وَإِلا رَجَعَتْ عَلَيْهِ)

‘‘যদি কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে, তবে কথা দু জনের একজনরে উপর প্রযোজ্য হবে। যদি তার ভাই সত্যিই কাফির না হয় তবে যে তাকে কাফির বলল তার উপরেই কুফরী প্রযোজ্য হবে।’’[2]

ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলা হত্যার মতই পাপ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


مَنْ رَمَى مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهُوَ كَقَتْلِهِ

‘‘কোনো মুমিনকে কুফরীতে অভিযুক্ত করা তাকে হত্যা করার মত অপরাধ।’’[3]

[1] সূরা - নিসা: ৯৪ আয়াত
[2]
বুখারী, আস-সহীহ /২২৬৩-২২৬৪ (কিতাবুল আদব, বাবু মান আকফারা আখাহু); মুসলিম, আস-সহীহ /৭৯ (কিতাবুল ঈমান, বাবু বায়ানি হালি ঈমান মান কালা.. ইয়া কাফির)
[3]
বুখারী, আস-সহীহ /২২৪৭, ২২৬৪ (কিতাবুল আদাব, বাবুন নাহই আনিস সিবাব)

 . . তাকফীর বিষয়ে সাহাবীগণের আদর্শ

সকল নির্দেশনার আলোকে সাহাবীগণ ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও তাদেরকে কাফির বলার অনুমতি দেন নি। সিফফীনের যুদ্ধ চলাকালে আলী (রা)-এর পক্ষের এক ব্যক্তি মুআবিয়া (রা)-এর পক্ষের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়িমূলক কথা বললে আলী (রা) বলেন, এরূপ বলো না, তারা মনে করেছে আমরা বিদ্রোহী এবং আমরা মনে করছি যে, তারা বিদ্রোহী। আর এর কারণেই আমরা যুদ্ধ করছি। আম্মার ইবন ইয়াসার বলেন, সিরিয়া-বাহিনীকে কাফির বলো না, বরং আমাদের দীন এক, কিবলা এক, কথাও এক; তবে তারা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, তাই আমরা লড়াই করছি।’’[1]

আমরা ইতোপূর্বে বলেছি যে, খারিজীগণ আলী, মুআবিয়া তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সকল সাহাবী (রাঃ) সকল মুসলিমকে কাফির বলে গণ্য করত এবং তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, হত্যাযজ্ঞ লুটতরাজ চালাত। সাহাবীগণ তাদেরকে বিভ্রান্ত বলতেন, কাফির বলতেন না। যদিও বিভিন্ন হাদীসে খারিজীদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, তারা দীন থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাবে, তবুও সাহাবীগণ তাদেরকে কাফির বলতেন না। তাঁরা এদের সাথে মুসলিম হিসেবেই মিশেছেন, কথাবার্তা বলেছেন, আলোচনা করেছেন এমনকি এদের ইমামতিতে সালাত আদায় করেছেন। যুদ্ধের ময়দানে বা বিচারের কাঠগড়ায় ছাড়া কখনোই তাদেরকে হত্যা করার অনুমতি দেন নি।[2]

আলী (রা)-কে প্রশ্ন করা হয়: এরা কি কাফির? তিনি বলেন, এরা তো কুফরী থেকে বাঁচার জন্যই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বলা হয়, তবে কি তারা মুনাফিক? তিনি বলেন, মুনাফিকরা তো খুব কমই আল্লাহর যিক্র করে, আর এরা তো রাতদিন আল্লাহর যিক্রে লিপ্ত। বলা হয়, তবে এরা কী? তিনি বলেন, এরা বিভ্রান্তি নিজ-মত পূজার ফিতনার মধ্যে নিপতিত হয়ে অন্ধ বধির হয়ে গিয়েছে।[3]

[1] মুহাম্মাদ ইবনু নাসর আল-মারওয়াযী, তাযীমু কাদরিস সালাত /৫৪৪-৫৪৬
[2]
তিরমিযী, আস-সুনান /১২৫; আবূ দাউদ, আস-সুনান /৭৪, ১৪৬; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১১/১৫৫; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /৩১০, ৫৫৭, ৬৮৬; ইবনু তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া /২১৭-২১৮; . নাসির আল-আকল, আল-খাওয়ারিজ, পৃ. ৪৭-৫৬
[3]
ইবনুল আসীর, আন-নিহাইয়াহ ফী গারিবিল হাদীস /১৪৯

 . . তাকফীর বিষয়ে আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি

কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা সাহাবীগণের কর্মধারার আলোকেআহলুস সুন্নাতঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তাঁদের মুলনীতি হলো, মুমিন নিজের ঈমানের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। সকল কুফর, শিরক পাপ থেকে সতর্কতার সাথে আত্মরক্ষা করবেন। কিন্তু অন্যের ঈমানের দাবি গ্রহণ করার বিষয়ে বাহ্যিক দাবির উপর নির্ভর করবেন। কোনো ঈমানের দাবিদারকেই কাফির না বলার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন। ভুল করে কোনো মুমিনকে কাফির বলে মনে করার চেয়ে ভুল করে কোনো কাফির-মুশরিককে মুসলিম মনে করা অনেক অনেক ভাল নিরাপদ। প্রথম ক্ষেত্রে কঠিন পাপ নিজের ঈমান নষ্ট হওয়ার ভয় রয়েছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কোনোরূপ পাপ বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই

নীতির ভিত্তিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছেন, তাকে কোনো পাপের কারণেঅমুসলিম’, কাফির বা ধর্মত্যাগী বলে গণ্য করা যাবে না, তিনি তার পাপ থেকে তাওবা করুন, অথবা না করুন, যতক্ষণ না তিনি সুষ্পষ্টভাবে ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী কোনো বিশ্বাস পোষণ করার ঘোষণা দিবেন। ইসলামী আইন লঙ্ঘনকারী বা আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী মুসলিম পাপী মুসলিম বলে গণ্য হবেন। তবে যদি তার পাপ বা অবাধ্যতাকে তিনি বৈধ মনে করেন, ইসলামী বিধানকে অচল বাঅপালনযোগ্যবলে মনে করেন অথবা ইসলামের কিছু বিধান পরিত্যাগ করেও ভাল মুসলিম হওয়া যায় বলে মনে করেন তবে তা কুফর বা ধর্মত্যাগ বলে গণ্য হবে। কারো কর্ম দেখে ‘‘মনে করা’’- দাবি করা যাবে না। অর্থাৎ কারো ইসলাম বিরোধী কর্ম দেখে কথা দাবি করা যাবে না যে, সে নিশ্চয় পাপকে হালাল মনে করে বা আল্লাহর বিধানকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেই এরূপ করছে। বরং তার মুখের স্বীকৃতির উপর নির্ভর করতে হবে

ঈমানের দাবিদার জেনে শুনে কুফরী করবেন না বলেই ধরে নিতে হবে। কারো কথা বা কর্ম বাহ্যত কুফরী হলেও যদি তার কোনোরূপ ইসলাম সম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া যায় তবে দূরবর্তী হলেও ইসলামী ব্যাখ্যা গ্রহণ করে তাকে মুমিন বলে মেনে নিতে হবে। সর্বোপরি ঈমানের দাবিদার কোনো ব্যক্তি যদি সুস্পষ্ট কোনো কুফরী বা শিরকী কাজে লিপ্ত হয়, তবে তার কর্মকে কুফরী বলা হলেও ব্যক্তিগতভাবে তাকে কাফির বলার আগে বিষয়ে তার কোনো ওযর আছে কিনা তা জানতে হবে। সে ব্যক্তি অজ্ঞতা, ভয় বা অন্য কোনো ওজরের কথা উল্লেখ করলে তা গ্রহণ করা হবে

মুসলিম নামধারী ব্যক্তিকে ‘‘কাফির’’ বলা মূলত নির্ভর করে তার স্বীকৃতির উপর। যদি সে তাওহীদ, রিসালাত বা আরকানুল ঈমানের মৌলিক কোনো বিষয়কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অস্বীকার করে তাহলে তাকে কাফির বলে গণ্য করতে হবে

একটি উদাহরণ দেখুন। কুফরীর প্রতি সন্তুষ্টি কুফর। কেউ যদি অমুসলিম, নাস্তিক বা ইসলাম অবমাননাকারীর শিরক-কুফর মত বা কর্মের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে বা তারাও আখিরাতে মুক্তি লাভ করবে বলে বিশ্বাস করে তবে সে ব্যক্তি কাফির, যদিও সে ইসলামের সকল বিশ্বাস আহকাম পালন করে। কোনো মুসলিম নামধারী ব্যক্তি যদি এরূপ মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করে, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের সহযোগিতা করে তবে তার এরূপ অন্যায় কর্মের দ্বিবিধ কারণ থাকতে পারে: জাগতিক স্বার্থ, লোভ, ভয় বা না-বুঝে এরূপ করা অথবা কুফর, শিরক বা নাস্তিকতার প্রতি সন্তুষ্টির কারণে এরূপ করা। মুসলিম নামধারী ব্যক্তি প্রথম কারণেই এরূপ করছেন বলে ধরে নিতে হবে। তাকে তার কর্মের ভয়াবহতা বুঝাতে হবে, কিন্তু মুখের সুস্পষ্ট স্বীকৃতি ছাড়া তাকে কাফির বলে গণ্য করা যাবে না। ইমাম তাহাবী বলেন:


وَنُسَمِّي أَهْلَ قِبْلَتِنَا مُسْلِمِينَ مُؤْمِنِينَ، مَا دَامُوا بِمَا جَاءَ بِهِ النَّبِيُّ ﷺ مُعْتَرِفِينَ، وَلَهُ بِكُلِّ مَا قَالَ وَأَخْبَرَ مُصَدِّقِينَ... وَلا نُكَفِّرُ أَحَدًا مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ بِذَنْبٍ، مَا لَمْ يَسْتَحِلَّهُ، وَلا يَخْرُجُ الْعَبْدُ مِنَ الإِيمَانِ إِلاَّ بِجُحُودِ مَا أَدْخَلَهُ فِيهِ.

‘‘আমাদের কিবলাপন্থীদের ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মুমিন মুসলিম বলে আখ্যায়িত করব যতক্ষণ তারা নবী (ﷺ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা স্বীকার করবে এবং তিনি যা কিছু বলেছেন সব সত্য বলে সাক্ষ্য দিবে। ... আমাদের কিবলাপন্থী কোনো মুমিনকে কোনো পাপের কারণে আমরা কাফির বলি না, যতক্ষণ না সে পাপ হালাল মনে করবে। .... যেসব বিষয় বান্দাকে ঈমানের অন্তর্ভূক্ত করেছে, এমন কোনো বিষয় অস্বীকার না করলে, সে ঈমানের গণ্ডি হতে বের হয় না।’’[1]

প্রসঙ্গে মোল্লা আলী কারী (রাহ) উল্লেখ করেছেন যে, ‘আহলু কিবলাবলতে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলি যারা মেনে নিয়েছেন তাদেরকে বুঝানো হয়। তাওহীদ, রিসালাত, আরকানুল ঈমান আনুষঙ্গিক সকল বিষয় যা কুরআন কারীমে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, মুসলিম উম্মাহর সকল আলিম যে বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন বা যে বিষয়টি মুসলিম উম্মার মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ এরূপ কোনো বিষয় যদি কেউ অস্বীকার করেন বা অবিশ্বাস করেন তবে তাকেআহলু কিবলাবলা হয় না। যেমন তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত অস্বীকার করা, তাওহীদুল উলূহিয়্যাত অস্বীকার করা, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের সর্বজনীনতা বা খাতমুন নুবুওয়াত অস্বীকার করা, কাউকে কোনো পর্যায়ে তাঁর শরীয়তের ঊর্ধ্বে বলে বিশ্বাস করা, আখিরাত অস্বীকার করা ইত্যাদি। এরূপ অবিশ্বাসে লিপ্ত ব্যক্তি যদি আজীবন কিবলামুখি হয়ে সালাত পড়েন বা ইসলামের অন্যান্য বিধান পালন করেন তবুও তাকেআহলু কিবলাবলা হবে না। কারণ তিনি ঈমানই অর্জন করেন নি, কাজেই তার ইসলাম বা কিবলামুখি হওয়া অর্থহীন

তিনি উল্লেখ করেছেন যে, কোনো মুমিন মুসলিম যদি এমন কোনো কর্মে লিপ্ত হয় বা কথা বলে যা কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশ অনুসারে কুফর বা শিরক বলে গণ্য তবে তার কর্মকে অবশ্যই শির্ক বা কুফর বলা হবে, তবে উক্ত ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে কাফির বা মুশরিক বলার আগে দেখতে হবে যে, অজ্ঞতা, ব্যাখ্যা, ভুল বুঝা বা এজাতীয় কোনো ওযর তার আছে কিনা।[2]

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবূ হামিদ গাযালী (৫০৫হি) ‘‘কিতাবুত তাফরিকা বাইনাল ঈমান ওয়ায যানদাকা’’ (ঈমান বেঈমানীর মধ্যে পার্থক্য) গ্রন্থে বলেন:


إِنَّ التَّكْفِيْرَ هُوَ صَنِيْعُ الْجُهَّالِ، وَلاَ يُسَارِعُ إِلَى التَّكْفِيْرِ إِلاَّ الْجَهَلَةُ، فَيَنْبَغِيْ الاِحْتِرَازُ مِنَ التَّكْفِيْرِ مَا وَجَدَ الإِنْسَانُ إِلَى ذَلِكَ سَبِيْلاً، فَإِنَّ اسْتِبَاحَةَ الدِّمَاءِ وَالأَمْوَالِ مِنَ الْمُصَلِّيْنَ إِلَى الْقِبْلَةِ، الْمُصَرِّحِيْنَ بِقَوْلِ: "لاَ إِلَهَ إِلاّ اللهُ مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ"، خَطَأٌ. وَالْخَطَأُ فِيْ تَرْكِ أَلْفِ كَافِرٍ أَهْوَنُ مِنَ الْخَطَأِ فِيْ سَفْكِ مَحْجَمَةٍ مِنْ دَمِ مُسْلِمٍ. ... فَإِنَّ التَّكْفِيْرَ فِيْهِ خَطَرٌ، وَالسُّكُوْتُ لاَ خَطَرَ فِيْهِ!".

‘‘তাকফীর বা কাফির বলা মুর্খদের কর্ম। মুর্খরা ছাড়া কেউ কাউকে কাফির বলতে ব্যস্ত হয় না। মানুষের উচিত সাধ্যমত কাউকে কাফির বলা থেকে বিরত থাকা। কিবলাপন্থীগণ যারা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’’ বলে সাক্ষ্য দেন তাদের রক্ত সম্পদ নষ্ট করা কঠিন অপরাধ (কাফির বলা থেকেই এর সূত্রপাত) ভুলক্রমে এক হাজার কফিরকে পরিত্যাগ করা ভুল করে একজন মুসলিমের প্রাণ বা সম্পদের সামান্যতম ক্ষতি করা থেকে সহজতর। .... কাফির বলার মধ্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি, আর নীরব থাকায় কোনোই ঝুঁকি নেই।’’[3]

[1] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৩-১৫
[2]
মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৭-২৬২
[3]
আহমদ বুকরীন, আত-তাকফীর, পৃ. ৭৪; মুনাবী, ফাইযুল কাদীর /১৬৭

 . . কুফরী কর্ম বনাম কাফির ব্যক্তি

মোল্লা আলী কারীর বক্তব্য থেকে আমরা জানলাম যে, ঈমানের দাবিদার ব্যক্তি কুফরী কর্মে লিপ্ত হলে তার কর্মকে কুফর বলতে হবে, তাকে কুফরী পর্যায়ের পাপে লিপ্ত বলতে হবে, তবে তাকে কাফির বলার আগে তার কোনো ওজর আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। কিছু জানতে না পারলে ওজর আছে বলেই ধরে নিতে হবে। দ্বারা তার কুফরী কর্মকে অনুমোদন করা হয় না, বরং ভুলক্রমে মুমিনকে কাফির বলার মহাপাপ থেকে আত্মরক্ষা করা হয়। মুমিন সকল প্রকার কুফর-শিরককে ঘৃণা নিন্দা করার পাশাপাশি মুমিনকে কাফির বলার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। বিষয়ক বিভিন্ন বক্তব্য আমি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ এবং ‘‘ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ’’ বইয়ে আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

() আমরা দেখেছি যে, কুরআন কারীমে মহান আল্লাহর বিধান অনুসারে ফয়সালা না করাকে কুফর বলা হয়েছে। পাশাপাশি আল্লাহর বিধান বিরোধিতায় লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে মুমিন বলা হয়েছে। হাদীস শরীফে বিভিন্ন কর্মকে কুফর বলা হলেও এরূপ কর্মে লিপ্ত ঈমানের দাবিদারদের মুসলিম বলেই গণ্য করা হয়েছে

() রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘একব্যক্তি জীবনভর সীমালঙ্ঘন পাপে লিপ্ত থাকে। যখন তার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয় তখন সে তার পুত্রদেরকে ওসিয়ত করে বলে: আমার মৃত্যু হলে তোমরা আমাকে আগুনে পুড়াবে। এরপর আমাকে বিচুর্ণ করবে। এরপর ঝড়ের মধ্যে আমাকে (আমার দেহের বিচুর্ণিত ছাই) সমূদ্রের মধ্যে ছাড়িয়ে দেবে। কারণ, আল্লাহর কসম, যদি আমার প্রতিপালক আমাকে ধরতে সক্ষম হন তবে আমাকে এমন শাস্তি দিবেন যে শাস্তি তিনি অন্য কাউকে দেন নি। তার সন্তানগণ তার ওসিয়ত অনুসারে কর্ম করে। তখন আল্লাহ যমিনকে নির্দেশ দেন যে যা গ্রহণ করেছে তা ফেরত দিতে। তৎক্ষণাৎ লোকটি পুনর্জীবিত হয়ে তার সামনে দন্ডায়মান হয়ে যায়। তখন তিনি লোকটিকে বলেন: তুমি এরূপ করলে কেন? লোকটি বলে: হে আমার প্রতিপালক: আপনার ভয়ে। তখন তিনি তাকে এজন্য ক্ষমা করে দেন।’’[1]

আমরা দেখি যে, ব্যক্তি একটি কুফরী বিশ্বাস পোষণ করেছে। সে ধারণা করেছে যে, তার দেহ এভাবে পুড়িয়ে ছাই করে সমূদ্রে ছড়িয়ে দিলে আল্লাহ তাকে আর পুনরুজ্জীবিত করতে এবং শাস্তি দিতে পারবেন না। তবে তার ধারণা ছিল অজ্ঞতা প্রসূত। এজন্য তার মধ্যে বিদ্যমান নির্ভেজাল আল্লাহ-ভীতির কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। এভাবে আমরা দেখি যে, একটি বিশ্বাস সুনিশ্চিত কুফরী হলেও উক্ত বিশ্বাসে লিপ্ত ব্যক্তিকে কাফির বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে

() মক্কা বিজয়ের পূর্বে হাতিব ইবন আবী বালতা (রা) যুদ্ধের গোপন বিষয় ফাঁস করে মক্কার কাফিরদের নিকট একটি পত্র লিখেন। পত্রটি উদ্ধার করার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাতিব (রা)-কে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে, মুনাফিকী বা কুফরীর কারণে তিনি এরূপ করেন নি, বরং নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে এরূপ করেছেন। হাতিবের কর্ম বাহ্যত আল্লাহ তাঁর রাসূলের (ﷺ) সাথে খিয়ানত কুফর ছিল। এজন্য উমার (রা) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি অনুমতি দিন, আমি মুনাফিককে হত্যা করি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিষয়ে হাতিবের বক্তব্যকেই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করেছেন।[2]

অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে একটি কর্ম সুনিশ্চিত কুফর হতে পারে। তবে এরূপ কর্মে লিপ্ত মুমিন যদি এর কোনো ওযর বা ব্যাখ্যা দেন তবে তা গ্রহণ করতে হবে

() একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টন করছিলেন। এমতাবস্থায় যুল খুওয়াইসিরা নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে:


يَا مُحَمَّدُ، اتَّقِ اللَّهَ (مَا عَدَلْتَ)

‘‘হে মুহাম্মাদ, আল্লাহকে ভয় করুন, আপনি তো বে-ইনসাফি করলেন!’’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তাকওয়া বা ইনসাফের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা সুনিশ্চিত কুফর। এজন্য মাজলিসে উপস্থিত খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) লোকটিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘না। হয়তবা লোকটি সালাত আদায় করে।’’ খালিদ (রা) বলেন: ‘‘কত মুসল্লীই তো আছে যে মুখে যা বলে তার অন্তরে তা নেই।’’ তখন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘‘আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় নি যে, আমি মানুষের অন্তর খুঁজে দেখব বা তাদের পেট ফেড়ে দেখব।’’[3]

থেকে আমরা দেখছি যে, কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে মুসলিম দাবি করে এবং ইসলামের ব্যাহ্যিক কিছু কর্ম করে তবে তাকে মুসলিম বলে গণ্য করতে হবে এবং লোকটি কুফরী কথা বললে তার কোনো ওযর আছে বলে ধরে নিতে হবে

() অজ্ঞতার ওযর সম্পর্কে হুযাইফা (রা) বর্ণিত একটি হাদীস প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


يَدْرُسُ الإِسْلامُ كَمَا يَدْرُسُ وَشْيُ الثَّوْبِ حَتَّى لا يُدْرَى مَا صِيَامٌ وَلا صَلاةٌ وَلا نُسُكٌ وَلا صَدَقَةٌ وَلَيُسْرَى (وَيسْرِي النسيان) عَلَى كِتَابِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فِي لَيْلَةٍ فَلا يَبْقَى فِي الأَرْضِ مِنْهُ آيَةٌ وَتَبْقَى طَوَائِفُ مِنْ النَّاسِ الشَّيْخُ الْكَبِيرُ وَالْعَجُوزُ يَقُولُونَ أَدْرَكْنَا آبَاءَنَا عَلَى هَذِهِ الْكَلِمَةِ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ فَنَحْنُ نَقُولُهَا. فَقَالَ لَهُ صِلَةُ مَا تُغْنِي عَنْهُمْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَهُمْ لا يَدْرُونَ مَا صَلاةٌ وَلا صِيَامٌ وَلا نُسُكٌ وَلا صَدَقَةٌ فَأَعْرَضَ عَنْهُ حُذَيْفَةُ ثُمَّ رَدَّهَا عَلَيْهِ ثَلاثًا كُلَّ ذَلِكَ يُعْرِضُ عَنْهُ حُذَيْفَةُ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْهِ فِي الثَّالِثَةِ فَقَالَ يَا صِلَةُ تُنْجِيهِمْ مِنْ النَّارِ ثَلاثًا

‘‘কাপড়ের নকশি যেমন মলিন হয়ে মুছে যায় তেমনি মলিন বিলীন হয়ে যাবে ইসলাম। এমনকি মানুষ জানবে না যে, সালাত কী? সিয়াম কী? হজ্জ কী, যাকাত কী? এক রাতে কুরআন অপসারিত হবে (বিস্মৃতি কুরআনকে আবৃত করবে) ফলে পৃথিবীতে কুরআনের কোনো আয়াত অবশিষ্ট থাকবে না। অনেক বয়স্ক নারী-পুরুষ রয়ে যাবে যারা বলবে, আমার আমাদের পিতা-পিতামদেরকে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’’ কালিমাটি বলতে শুনতাম কাজেই আমরা তা বলি।’’ তখন সিলাহ নামক এক শ্রোতা বলেন, ‘‘তারা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত কিছুই জানে না, কাজেই তাদের জন্যলা ইলাহা ইল্লাল্লাহুকোনো কাজে লাগবে না।’’ তখন হুযাইফা মুখ ফিরিয়ে নেন। সিলাহ তিনবার কথাটি বলেন এবং তিন বারই হুযাইফা মুখ ফিরিয়ে নেন। তৃতীয় বারে তিনি বলেন: ‘‘হে সিলাহ, কালিমাটি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে।’’ তিনি তিনবার একথাটি বললেন।’’[4]

() ১৭ জন সাহাবী থেকে প্রায় ৫০টি পৃথক সূত্রের হাদীসে খারিজীগণের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণিত হয়েছে। সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বারবার বলেছেন যে, তারা ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে যাবে। সাহাবীগণ সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং সবাইকে সতর্ক করেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা খারিজীদেরকে কাফির বলে গণ্য করেন নি। তাঁরা সাহাবীগণকে কাফির বলেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তাঁদের নিরস্ত্র পরিজনদেরকে হত্যা করেছে, কিন্তু সাহাবীগণ তাদেরকে কাফির বলেন নি। যুদ্ধের ময়দান ছাড়া তাদের হত্যার অনুমতি দেন নি। তাদের পিছনে সালাত আদায় করেছেন এবং বৈবাহিক সম্পর্ক বহাল রেখেছেন।[5]

() চার ইমাম প্রথম যুগগুলোর অন্যান্য ইমাম খারিজী, শীয়া, মুতাযিলী, মুজাসসিমা, মুশাবিবহা, কাদারিয়া অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অনেক কর্মকে ‘‘কুফর’’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে সকল ফিরকার অনুসারীদের কাফির বলে গণ্য করেন নি। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বাল বারবার বলেছেন যে, কুরআনকে মাখলূক বা সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করা কুফর। পাশাপাশি তিনি কুফরী মতের প্রধান অনুসারী, প্রচারক পৃষ্ঠপোষক খলীফা মামুন, মুতাসিম ওয়াসিককে মুমিন বলে গণ্য করেছেন, কুফরী আকীদা পাপ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে তাঁদের আনুগত্যের জন্য জনগণকে নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের তাঁদের অনুসারী ইমামদের পিছনে জুমুআ ঈদের সালাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যান্য ইমামও একই পথ অনুসরণ করেছেন। বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর অনেক বিশ্বাস কর্ম কুফর বলে গণ্য হলেও সকল ফিরকার অনুসারী ব্যক্তি মুসলিমকে তারা কাফির বলে গণ্য করেন নি

শাইখুল ইসলাম তাকিউদ্দীন ইবন তাইমিয়া বলেন:


وَلا يَجُوزُ تَكْفِيرُ الْمُسْلِمِ بِذَنْبِ فَعَلَهُ وَلَا بِخَطَأِ أَخْطَأَ فِيهِ كَالْمَسَائِلِ الَّتِي تَنَازَعَ فِيهَا ... وَالْخَوَارِجُ الْمَارِقُونَ الَّذِينَ أَمَرَ النَّبِيُّ ﷺ بِقِتَالِهِمْ قَاتَلَهُمْ أَمِيرُ الْمُؤْمِنِينَ عَلِيُّ.. أَحَدُ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ. وَاتَّفَقَ عَلَى قِتَالِهِمْ أَئِمَّةُ الدِّينِ مِنْ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِينَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ. وَلَمْ يُكَفِّرْهُمْ عَلِيُّ وَسَعْدُ بْنُ أَبِي وَقَّاصٍ وَغَيْرُهُمَا مِنْ الصَّحَابَةِ بَلْ جَعَلُوهُمْ مُسْلِمِينَ ... وَإِذَا كَانَ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ ثَبَتَ ضَلَالُهُمْ بِالنَّصِّ وَالْإِجْمَاعِ لَمْ يُكَفَّرُوا مَعَ أَمْرِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ بِقِتَالِهِمْ فَكَيْفَ بِالطَّوَائِفِ الْمُخْتَلِفِينَ الَّذِينَ اشْتَبَهَ عَلَيْهِمْ الْحَقُّ فِي مَسَائِلَ غَلِطَ فِيهَا مَنْ هُوَ أَعْلَمُ مِنْهُمْ ؟ .. هَذَا مَعَ أَنَّ اللَّهَ أَمَرَ بِالْجَمَاعَةِ والائتلاف وَنَهَى عَنْ الْبِدْعَةِ وَالاخْتِلافِ ...

‘‘কোনো পাপের কারণে বা আকীদাগত মতভেদীয় কোনো বিষয়ে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়ার কারণে কোনো মুসলিমকে কাফির বলা বৈধ নয়। .... বিদ্রোহী খারিজীদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। খলীফায়ে রাশেদ আলী (রা) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বিষয়ে সাহাবী, তাবিয়ী পরবর্তী যুগের ইমামগণ সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন। এতদসত্ত্বেও আলী (রা), সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা) অন্যান্য সাহাবী কেউ তাদেরকে কফির বলেন নি, বরং তাদেরকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করেছেন।.... হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য ইজমার মাধ্যমে যাদের বিভ্রান্তি প্রমাণিত তাদের বিষয়েই এরূপ বিধান। অন্যান্য বিভ্রান্ত দল-উপদলের বিভ্রান্তি আরো অনেক অস্পষ্ট। যে সকল বিষয়ে তারা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে সে সকল বিষয়ে অনেক সময় তাদের চেয়ে অধিক অভিজ্ঞ আলিমেরও পদস্খলন হয়েছে। .... উপরন্তু মহান আল্লাহ জামাআত বা ঐক্যের সম্প্রীতির নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিদআত মতভেদ নিষেধ করেছেন।’’[6]

আমরা দেখেছি যে, আল্লাহর বিশেষণ অস্বীকার করা ইমাম আবূ হানীফা অন্যান্য ইমাম কুফর বলেছেন। এগুলো মূলত কর্মের বিধান। কিন্তু অনেকে বিষয়ে প্রান্তিকতায় নিপতিত হয়েছেন। হাম্বালী-সালাফী আশআরী-মাতুরিদীগণ প্রসঙ্গে একে অপরকে কাফির বলেছেন। এগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেকথার দাবিদ্বারা কাফির বলা। কেউ বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহর হাত, মুখমণ্ডল, চক্ষু, আরশের উপরে থাকা, অবতরণ ইত্যাদি যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে সে কাফির। কারণ সে মহান আল্লাহকে দেহধারী বলে বিশ্বাস করে।’’ এরাতুলনাযুক্ততুলনামুক্তবিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য করছেন না। কেউ বলছেন: ‘‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর হাত অর্থ ক্ষমতা, আরশে অধিষ্ঠান অর্থ ক্ষমতা গ্রহণ... বলে বা তাঁর ঊর্ধ্বত্ব অস্বীকার করে সে জাহমী-কাফির; কারণ সে কুরআন বা হাদীস অস্বীকার করে।’’ তারা ইজতিহাদী ব্যাখ্যা জেদপূর্বক অস্বীকারের মধ্যে পার্থক্য করছেন না

যে ব্যক্তি কুরআন-হাদীসের কোনো বক্তব্য বা বিশেষণ ইজতিহাদী কারণে ব্যাখ্যা করা জরুরী মনে করেন তার প্রসঙ্গে ইবন তাইমিয়া বলেন: তার ইজতিহাদ ভুল হলেও তিনি কাফির নন। মৃতদেহ পোড়ানোর ওসিয়তকারী আল্লাহরকুদরতবিশেষণ অবিশ্বাস করেছিল। এরপরও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন। বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন:


وَالْمُتَأَوِّلُ مِنْ أَهْلِ الِاجْتِهَادِ الْحَرِيصُ عَلَى مُتَابَعَةِ الرَّسُولِ أَوْلَى بِالْمَغْفِرَةِ مِنْ مِثْلِ هَذَا .

‘‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণে সচেষ্ট, তবে ইজতিহাদের কারণে এরূপ তাবীল-ব্যাখ্যা করেন তিনি ব্যক্তির চেয়ে ক্ষমা লাভের অধিক যোগ্য।’’[7]

ইবন তাইমিয়া আরো বলেন:


أَنِّي مِنْ أَعْظَمِ النَّاسِ نَهْيًا عَنْ أَنْ يُنْسَبَ مُعَيَّنٌ إلَى تَكْفِيرٍ وَتَفْسِيقٍ وَمَعْصِيَةٍ، إلَّا إذَا عُلِمَ أَنَّهُ قَدْ قَامَتْ عَلَيْهِ الْحُجَّةُ الرسالية الَّتِي مَنْ خَالَفَهَا كَانَ كَافِرًا تَارَةً وَفَاسِقًا أُخْرَى وَعَاصِيًا أُخْرَى وَإِنِّي أُقَرِّرُ أَنَّ اللَّهَ قَدْ غَفَرَ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ خَطَأَهَا : وَذَلِكَ يَعُمُّ الْخَطَأَ فِي الْمَسَائِلِ الْخَبَرِيَّةِ الْقَوْلِيَّةِ وَالْمَسَائِلِ الْعَمَلِيَّةِ.

‘‘কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কাফির বলা, ফাসিক বলা বা পাপী বলা আমি কঠোরভাবে নিষেধ করি। কেবলমাত্র যদি কারো বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সুনিশ্চিতভাবে কুফর, ফিসক বা পাপাচার প্রমাণিত হয় তবেই তা বলা যাবে। আমি নিশ্চিত যে, মহান আল্লাহ উম্মাতের ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করেছেন। আর ফিকহী মাসআলার ভুল এবং আকীদা বিষয়ক ভুল উভয় প্রকারের ভুলই ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত।’’[8]

আল্লামা আলাউদ্দীন হাসকাফী (১০৮৮ হি) বলেন:


لا يكفر بها حَتَّى الْخَوَارِجُ الَّذِينَ يَسْتَحِلُّونَ دِمَاءَنَا وَأَمْوَالَنَا وَسَبَّ الرَّسُولِ، وَيُنْكِرُونَ صِفَاتِهِ تَعَالَى وَجَوَازَ رُؤْيَتِهِ لِكَوْنِهِ عَنْ تَأْوِيلٍ وَشُبْهَةٍ بِدَلِيلِ قَبُولِ شَهَادَتِهِمْ، إلا الْخَطَّابِيَّةِ... وَإِنْ أَنْكَرَ بَعْضَ مَا عُلِمَ مِنْ الدِّينِ ضَرُورَةً كَفَرَ بِهَا

‘‘এমনকি খারিজীগণ, যারা আমাদের রক্তপাত ধনসম্পদ বৈধ বলে গণ্য করে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গালি প্রদান করে, মহান আল্লাহর বিশেষণসমূহ অস্বীকার করে এবং আখিরাতে তাঁর দর্শন অস্বীকার করে তাদেরও এগুলির কারণে কাফির বলা হয় না। কারণ তাদের সকল মতের কারণ ব্যাখ্যা কুরআন-সুন্নাহর প্রমাণ বুঝতে অস্পষ্টতা বা ভুল বুঝা। এর প্রমাণ যে, মুসলিমদের আভ্যন্তরীণ মামলা-মুকাদ্দামায় তাদের সাক্ষ্য কবুল করা হয়। তবে কেবল খাত্তাবিয়্যাহ ফিরকাকে কাফির বলা হয়েছে।[9] আর কোনো ফিরকা যদি দীনের কোনো অত্যাবশ্যকীয় সর্বজনজ্ঞাত বিশ্বাস অস্বীকার করে তবে এরূপ বিদআতের কারণে সে কাফির বলে গণ্য হবে।’’[10]

আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী বলেন:


نقل عن السلف - منهم إمامنا أبو حنيفة - أنا لا نكفر أحدا من أهل القبلة وعليه بنى أئمة الكلام عدم تكفير الروافض والخوارج والمعتزلة والمجسمة وغيرها من فرق الضلالة سوى من بلغ اعتقاده منهم إلى الكفر

‘‘সালাফ সালিহীন- আমাদের ইমাম আবূ হানীফাও তাঁদের অন্তর্ভূক্ত- থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আমরা কোনো আহলু কিবলাকে কাফির বলি না। বক্তব্যের ভিত্তিতেই আকীদাবিদগণ মূলনীতি তৈরি করেছেন যে, শীয়া-রাফিযী, খারিজী, মুতাযিলী, মুজাস্সিমা (দেহে বিশ্বাসী) অন্যান্য বিভ্রান্ত ফিরকাকে কাফির বলা যাবে না। তবে কারো আকীদা বিশ্বাস যদি কুফরী পর্যন্ত পৌঁছে যায় তবে ভিন্ন কথা।’’[11]

মোল্লা আলী কারী আল্লামা ইবন হাজার মাক্কীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন:


الصواب عند الأكثرين من علماء السلف والخلف أنا لا نكفر أهل البدع والأهواء إلا إن أتوا بمكفر صريح لا استلزامي لأن الأصح أن لازم المذهب ليس بلازم ومن ثم لم يزل العلماء يعاملونهم معاملة المسلمين في نكاحهم وإنكاحهم والصلاة على موتاهم ودفنهم في مقابرهم لأنهم وإن كانوا مخطئين غير معذورين حقت عليهم كلمة الفسق والضلال إلا أنهم لم يقصدوا بما قالوه اختيار الكفر وإنما بذلوا وسعهم في إصابة الحق فلم يحصل لهم لكن لتقصيرهم بتحكيم عقولهم وأهويتهم وإعراضهم عن صريح السنة والآيات من غير تأويل سائغ وبهذا فارقوا مجتهدي الفروع فإن خطأهم إنما هو لعذرهم بقيام دليل آخر عندهم مقاوم لدليل غيرهم من جنسه فلم يقصروا ومن ثم أثيبوا على اجتهادهم

‘‘সালাফ সালিহীন এবং পরবর্তী যুগের অধিকাংশ আলিমের নিকট সঠিক মত এই যে, বিদআতপন্থী এবং বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর অনুসারীদেরকে আমরা কাফির বলব না। তবে যদি তারা সুস্পষ্ট কোনো কুফরী কর্ম বা মত গ্রহণ করে তবে তাদেরকে কাফির বলা হবে কারো আকীদার দাবি বা পরিণতির অজুহাতে তাকে কাফির বলা যাবে না। কারণ সঠিক মত এই যে, কারো মতের দাবি বা পরিণতি তার মত বলে গণ্য নয়। আর এজন্যই সকল যুগেই আলিমগণ বিভ্রান্ত ফিরকার অনুসারীদের সাথে মুসলিম হিসেবেই আচরণ করেছেন, যেমন তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক, তাদের মৃতদের জানাযার সালাত আদায়, মুসলিমদের গোরস্থানে দাফন করা ইত্যাদি। সকল সম্প্রদায় ভুলের মধ্যে নিপতিত এবং তাদের ভুলের পক্ষে তাদের কোনো ওযর বা গ্রহণযোগ্য কারণ নেই। এজন্য তাদেরকে পাপী পথভ্রষ্ট বলতে হবে। তবে তাদের উদ্দেশ্য কুফরী করা নয়। তারা সত্য সন্ধানে ইজতিহাদ বা চেষ্টা করেছে তবে সত্যে পৌঁছাতে পারে নি। আকল বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির উপর নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করা এবং গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ছাড়া সুস্পষ্ট সুন্নাত এবং কুরআনের আয়াতগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণেই তারা সত্যে না পৌঁছে বিভ্রান্ত হয়েছে। আর এখানেই ফিকহী বিষয়ে ইজতিহাদকারীর সাথে তাদের পার্থক্য। ফিকহী বিষয়ে ইজতিহাদকারী ভিন্নমতের একটি দলীলের বিপরীতে একই পর্যায়ের অন্য দলীল থাকার কারণে ভিন্নমত পোষণ করেন। এজন্য তিনি ইজতিহাদের জন্য সাওয়াব লাভ করেন।’’[12]

ইমাম আবূ হানীফা পরিচ্ছেদে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা তাঁর অন্যান্য গ্রন্থেও তিনি বিষয়টি বারবার আলোচনা ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা দেখেছি যে, ইমাম আযম তাঁর ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ গ্রন্থে ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ বা শ্রেষ্ঠতম ফিকহের সংজ্ঞায় বলেছেন: ‘‘পাপের কারণে কোনো কিবলাপন্থী মুসলিমকে কাফির বলবে না এবং কারো ঈমান অস্বীকার করবে না।’’ পুস্তকে তাঁর আরেকটি বক্তব্য দেখুন:


قُلْتُ: أَرَأَيْتَ لَوْ أَنَّ رَجُلاً قَالَ: مَنْ أَذْنَبَ ذَنْباً فَهُوَ كَافِرٌ، مَا النَّقْضُ عَلَيْهِ؟ فَقَالَ: يُقَالُ لَهُ: قَالَ اللهُ تَعَالَى: "وَذَا النُّونِ إِذْ ذَهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لا إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ"، فَهُوَ ظَالِمٌ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ بِكَافِرٍ وَلاَ مُنَافِقٍ. وَإِخْوَةُ يُوْسُفَ قَالُوْا: "يَا أَبَانَا اسْتَغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا إِنَّا كُنَّا خَاطِئِينَ"، وَكَانُوْا مُذْنِبِيْنَ لاَ كَافِرِيْنَ. وَقَالَ اللهُ تَعَالَى لِمُحَمَّدٍ ﷺ "لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ"، وَلَمْ يَقُلْ: مِنْ كُفْرِكَ. وَمُوْسَى حِيْنَ قَتَلَ الرَّجُلَ كَانَ فِيْ قَتْلِهِ مُذْنِباً لاَ كَافِراً

‘‘আবূ মুতী বলেন: যদি কেউ বলে, যে পাপে লিপ্ত হয় সে- কাফির, তবে তার বক্তব্য কিরূপে খন্ডন করা হবে তা বলুন। তিনি (ইমাম আবূ হানীফা) বলেন: তাকে বলা হবে: আল্লাহ তাআলা বলেছেন[13]: ‘‘এবং স্মরণ কর যুন্নুন-ইউনূস-এর কথা যখন সে রাগান্বিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল যে, আমি তার উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করব না; অতঃপর সে অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিল, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র মহান, নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম।’’ তাহলে তিনি যালিম মুমিন, কাফিরও নন, মুনাফিকও নন। ইউসূফের ভাইগণ বলেছিলেন[14]: ‘‘হে আমাদের পিতা, আমাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন; নিশ্চয় আমরা ছিলাম অপরাধী’’; তাঁরা ছিলেন পাপী, কিন্তু তাঁরা কাফির ছিলেন না। আর মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বলেছেন[15]: ‘‘যেন আল্লাহ মার্জনা করেনতোমার ত্রুটিঅতীত ভবিষ্যতের’’, তিনি বলেন নি: ‘‘তোমার কুফর’’ আর মূসা () যখন সে মানুষটিকে হত্যা করলেন তিনি হত্যার কারণে অপরাধী হন, কাফির হন নি।’’[16]

আল-ফিকহুল আবসাত গ্রন্থে আবূ মুতী ইমাম আযমের আরেকটি কথোপকথন:


قُلْتُ لَهُ: مَا تَقُوْلُ فِيْ الْخَوَارِجِ الْمُحَكِّمَةِ؟ قَالَ: هُمْ أَخْبَثُ الْخَوَارِجِ. قُلْتُ لَهُ: أَتُكَفِّرُهُمْ؟ قَالَ: لاَ، وَلَكِنْ نُقَاتِلُهُمْ عَلَى مَا قَاتَلَهُمْ الأَئِمَّةُ مِنْ أَهْلِ الْخَيْرِ وَعَلِيٌّ وَعُمَرُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيْزِ؛ فَإِنَّ الْخَوَارِجَ يُكَبِّرُوْنَ وَيُصَلُّوْنَ وَيَتْلُوْنَ الْقُرْآنَ .... فَكُفْرُ الْخَوَارِجِ كُفْرُ النِّعَمِ كُفْرٌ بِمَا أَنْعَمَ اللهُ تَعَالَى عَلَيْهِمْ.

‘‘আমি (আবু মুতী) তাঁকে বললাম: হুকুম-পন্থী খারিজীগণ (যারা বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কাউকে হুকুম-বিধান-এর ক্ষমতা প্রদান বা কারো হুকুম-বিধান পালন করা কুফর)-এর বিষয়ে আপনি কী বলেন? তিনি (ইমাম আবূ হানীফা) বলেন: এরা হলো খারিজীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট দল। আমি বললাম: আপনি কি তাদেরকে কাফির বলেন? তিনি বলেন: না, তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি যেভাবে নেককার ইমাম-রাষ্ট্রপ্রধানগণ, আলী (রা) এবং উমার ইবন আব্দুল আযীয (রাহ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। .... কারণ খারিজীগণ তাকবীর বলে, সালাত আদায় করে, কুরআন তিলাওয়াত করে.... অতএব খারিজীদের কুফর হচ্ছে নিয়ামতের কুফর বা অকৃতজ্ঞতা, আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের অস্বীকার অকৃতজ্ঞতা।’’[17]

ইমাম আবূ হানীফা রচিত অন্য পুস্তিকা ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’’- এক স্থানে ইমাম আযমের সাথে আবূ মুকাতিলের আলোচনা প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ:


أَخْبِرْنِيْ عَمَّنْ يَشْهَدُ عَلَيْكَ بِالْكُفْرِ، مَا شَهَادَتُكَ عَلَيْهِ؟ فَقَالَ...: شَهَادَتِيْ عَلَيْهِ أَنَّهُ كَاذِبٌ، وَلاَ أُسَمِّيْهِ بِذَلِكَ كَافِراً، وَلَكِنْ أَسَمِّيْهِ كَاذِباً؛ لأَنَّ الْحُرْمَةَ حُرْمَتَانِ: حُرْمَةٌ تُنْتَهَكُ مِنَ اللهِ تَعَالَى، وَحُرْمَةٌ تُنْتَهَكُ مِنْ عَبِيْدِ اللهِ سُبْحَانَهُ، وَالْحُرْمَةُ الَّتِيْ تُنْتَهَكُ مِنْ عَبِيْدِ اللهِ، فَذَلِكَ مَا يَكُوْنُ بَيْنَهُمْ مِنَ الْمَظَالِمِ. وَلاَ يَنْبَغِيْ أَنْ يَكُوْنَ الَّذِيْ يَكْذِبُ عَلَى اللهِ وَعَلَى رَسُوْلِهِ ﷺ كَالَّذِيْ يَكْذِبُ عَلَىَّ؛ لأَنَّ الِّذِيْ يَكْذِبُ عَلَى اللهِ وَعَلَى رَسُوْلِهِ ذَنْبُهُ أَعْظَمُ مِنْ أَنْ لَوْ كَذَبَ عَلَى جَمِيْعِ النَّاسِ؛ فَالَّذِيْ شَهِدَ عَلَيَّ بِالْكُفْرِ فَهُوَ عِنْدِيْ كَاذِبٌ، وَلاَ يَحِلُّ لِيْ أَنْ أَكْذِبَ عَلَيْهِ لِكَذِبِهِ عَلَيَّ؛ لأَنَّ اللهَ تَعَالَى قَالَ: "وَلا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ عَلَى أَلا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى".

‘‘আবূ মুকাতিল বলেন: যে ব্যক্তি আপনাকে কাফির বলে সাক্ষ্য দিচ্ছে, তার বিষয়ে আপনি কি সাক্ষ্য দিবেন? উত্তরে ইমাম আবূ হানীফা বলেন: ‘‘তার বিষয়ে আমার সাক্ষ্য যে, সে মিথ্যাবাদী। এজন্য আমি তাকে কাফির বলে আখ্যায়িত করি না, বরং তাকে মিথ্যাবাদী বলি। কারণ মর্যাদা বা হক্ক দু প্রকার। এক হলো আল্লাহর হক্ক বা মর্যাদা নষ্ট করা, অন্যটি হলো আল্লাহর বান্দাদের হক্ক বা মর্যাদা নষ্ট করা। আল্লাহর বান্দাগণের মর্যাদা বা হক্ক নষ্ট করা হলো তাদের মধ্যকার জুলুম অন্যায়। আল্লাহ তাঁর রাসূলেরবিষয়ে যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তার অবস্থা আর আমার বিষয়ে যে মিথ্যা বলে তার অবস্থা এক হতে পারে না। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহ তাঁর রাসূলেরনামে মিথ্যা বলছে তার পাপ দুনিয়ার সকল মানুষের নামে মিথ্যা বলার চেয়েও ভয়ঙ্করতর। অতএব যে ব্যক্তি আমাকে কাফির বলে সাক্ষ্য দেয় সে ব্যক্তি আমার মতে মিথ্যাবাদী। তবে সে আমার বিষয়ে মিথ্যা বলেছে অজুহাতে তার বিষয়ে মিথ্যা বলা আমার জন্য বৈধ নয়। কারণ আল্লাহ বলেছেন[18]: ‘‘কোনো গোষ্ঠীর সাথে শত্রুতা যেন তোমাদেরকে বে-ইনসাফী করার প্ররোচনা না দেয়; তোমরা ইনসাফ করবে; ইনসাফ তাকওয়ার সাথে সুসমঞ্জস’’...’’[19]

এখানে ইমাম আযম আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কর্মধারা ব্যাখ্যা করেছেন, তা হলো প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতাবলম্বী মুমিনের বাহ্যত কুফরী কথা ব্যাখ্যা করে তাকে মুমিন বলে গণ্য করার চেষ্টা। আমরা দেখেছি যে, বিভ্রান্ত দলগুলো ভিন্নমতের মুমিনদেরকে কাফির বলতে উদগ্রীব থাকে। কোনো সুস্পষ্ট অজুহাত না পেলে তার কোনো একটি বক্তব্য ব্যাখ্যা করে তার ভিত্তিতে তাকে কাফির বলে। পক্ষান্তরে সাহাবীগণ আহলুস সুন্নাতের ইমামগণ ভিন্নমতের মুমিনকে মুমিন বলতে উদগ্রীব। তার কথার মধ্যে সুস্পষ্ট কুফরী থাকলেও তা ব্যাখ্যা করে তাকে মুমিন বলতে চেষ্টা করেন তারা। বিষয়টি ইমাম আবূ হানীফা এখানে ব্যাখ্যা করেছেন

আমরা দেখেছি যে, খারিজী অন্যান্য বিভ্রান্ত দল সুন্নাত অনুসারীদের কাফির বলত। ইমাম আবূ হানীফাকেও তারা কাফির বলেছে। প্রায় মুতাওয়াতির হাদীসে বলা হয়েছে যে, মুমিনকে কাফির বলা কুফরী। সকল হাদীসের দলীল দিয়ে ইমাম আযম বলতে পারতেন যে আমাকে কাফির বলে সে কাফির। কারণ () অনেকগুলো সহীহ হাদীস দ্বারা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত যে, মুমিনকে কাফির বলা কুফরী, () আমি নিশ্চিতভাবেই মুমিন, () কাজেই যে আমাকে কাফির বলেছে সে নিশ্চিতভাবেই কাফির। কিন্তু আহলুস সুন্নাত-এর ইমামগণ প্রতিপক্ষকে কাফির বানাতে উদগ্রীব ছিলেন না, বরং প্রতিপক্ষকে মুমিন বলে দাবি করতে উদগ্রীব ছিলেন। এজন্য অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণতার সাথে ইমাম আযম তাকে মিথ্যাবাদী মুমিন বলে ব্যাখ্যা করেছেন

‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ গ্রন্থের আরেকটি বক্তব্য দেখুন:


فَقُلْتُ: إِذَا أَنْكَرَ بِشَيْءٍ مِنْ خَلْقِهِ فَقَالَ: لاَ أَدْرِيْ مَنْ خَالِقُ هَذَا؟ قَالَ: فَإِنَّهُ كُفْرٌ لِقَوْلِهِ تَعَالَى "خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ"، فَكَأَنَّهُ قَالَ: لَهُ خَالِقٌ غَيْرُ اللهِ. وَكَذَلِكَ لَوْ قَالَ: لاَ أَعْلَمُ أَنَّ اللهَ فَرَضَ عَلَيَّ الصَّلاَةَ وَالصِّيَامَ وَالزَّكَاةَ، فَإِنَّهُ قَدْ كَفَرَ، لِقَوْلِهِ تَعَالَى "أَقِيْمُوْا الصَّلاَةَ وَآتُوْا الزَّكَاةَ" وَلِقَوْلِهِ تَعَالَى: "كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ"، وَلِقَوْلِهِ تَعَالَى: "فَسُبْحَانَ اللهِ حِيْنَ تُمْسُوْنَ وَحِيْنَ تُصْبِحُوْنَ وَلَهُ الْحَمْدُ فِيْ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ عَشِيًّا وَحِيْنَ تُظْهِرُوْنَ". فَإِنْ قَالَ: أُوْمِنُ بِهَذِهِ الآيَةِ وَلاَ أَعْلَمُ تَأْوِيْلَهَا وَلاَ أَعْلَمُ تَفْسِيرَهَا، فَإِنَّهُ لاَ يَكْفُرُ؛ لأَنَّهُ مُؤْمِنٌ بِالتَّنْزِيْلِ وَمُخْطِئٌ فِيْ التَّفْسِيْرِ.

‘‘আমি (আবূ মুতী বালখী) বললাম: যদি কেউ আল্লাহর কোনো সৃষ্টি অস্বীকার করে বলে, বস্ত্ত কে সৃষ্টি করেছেন তা আমি জানি না, তাহলে তার বিধান কী? তিনি (আবূ হানীফা) বলেন: তো কুফরী করল; কারণ আল্লাহ বলেছেন[20]: ‘‘তিনি সকল কিছুর সৃষ্টিকারী’’; আর উপরের কথা দ্বারা সে যেন বলল, দ্রব্যটির আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সৃষ্টিকর্তা আছে। অনুরূপভাবে যদি সে বলে, আল্লাহ আমার উপর সালাত, সিয়াম যাকাত ফরয করেছেন বলে আমি জানি না (অর্থাৎ এগুলির আবশ্যকতা সে অস্বীকার করে) তবে সে কাফির হবে। কারণ আল্লাহ বলেছেন: ‘‘সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর’’[21], এবং বলেছেন: ‘‘তোমাদের উপর সিয়াম বিধিবদ্ধ হলো’’[22] আল্লাহ আরো বলেছেন: ‘‘অতএব আল্লাহর তাসবীহ যখন তোমরা সন্ধ্যায় উপনীত হও এবং যখন তোমরা প্রভাতে উপনীত হও। এবং তাঁরই জন্য প্রশংসা আসমানসমূহ এবং যমীনে অপরাহ্নে এবং যখন তোমরা যুহরের সময়ে উপনীত হও।’’[23] ( আয়াতে আল্লাহ সময়ের উল্লেখ করে সালাতের নির্দেশ দিয়েছেন, কাজেই তা অস্বীকার করলে কাফির হবে।) যদি সে বলে আমি আয়াত বিশ্বাস করি, তবে এর ব্যাখ্যা জানি না, তাহলে সে কাফির বলে গণ্য হবে না। কারণ সে কুরআনকে বিশ্বাস স্বীকার করেছে, কিন্তু ব্যাখ্যায় ভুল করেছে।’’[24]

পুস্তকে আরো অনেক বিষয় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, যার মূল কথা একটিই: ঈমানের দাবিদারকে যথাসম্ভব ব্যাখ্যা ওজর-অজুহাতের মাধ্যমে মুমিন বলে গণ্য করার চেষ্টা করা। যদি কেউ কুরআনের সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন আয়াত দ্বারা প্রমাণিত কোনে বিষয় অস্বীকার করার ঘোষণা দেয় তবে সে কাফির। আর যদি সে ব্যাখ্যায় ভুল করে, বা কোনো বিশেষ ব্যাখ্যা অস্বীকার করে তাহলে তাকে কাফির বলা যাবে না।Anchor

প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান বলেন :


لا ينبغي لأحد من أهل الإسلام أن يشهد على رجل من أهل الإسلام بذنب أذنبه بكفر وإن عظم جرمه وهو قول أبي حنيفة والعامة من فقهائنا

‘‘কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে, কোনো মুসলিমকে কোনো পাপের কারণে কাফির বলে সাক্ষ্য দিবে, সে পাপ যতই বড় হোক না কেন। এটিই আবূ হানীফার মত এবং আমাদের ফকীহগণের সকলের মত।’’[25]

[1] বুখারী, আস-সহীহ /১২৮৩ (কিতাবুল আম্বিয়া, বাবু আম হাসিবতা...); মুসলিম, আস-সহীহ /২১১০ (কিতাবুত তাওবা, বাবুন ফী সাআতি রাহমাতিল্লাহ)
[2]
বুখারী, আস-সহীহ /১০৯৫ (কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার, বাবুল জাসূস); মুসলিম, আস-সহীহ /১৯৪১ (কিতাবু ফাদাইলিস সাহাবা, বাবুন মিন ফাদাইলি আহলি বাদর ওয়া কিস্সাতি হাতিব..)
[3]
বুখারী, আস-সহীহ /১২১৯, ১৩২১, /১৫৮১, ১৭১৪, /২২৮১, /২৫৪০, ২৭০২; মুসলিম, আস-সহীহ /৭৪১-৭৪৪
[4]
ইবনু মাজাহ, আস-সুনান /১৩৪৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৫২০, ৫৮৭; ইবনু কাসীর, আন-নিহায়াতু ফিল ফিতানি ওয়াল মালাহিম /১০; বুসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ /১৯৪; আলবানী, সাহীহাহ /৮৭ সহীহু সুনানি ইবন মাজাহ /৩৭৮
[5]
বিস্তারিত দেখুন: ইসলামের নামে জাঙ্গিবাদ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা
[6]
ইবন তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া /২৮২- ২৮৬
[7]
ইবন তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া /২৩১
[8]
ইবন তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া /২২৯
[9]
খাত্তাবিয়্যাহ সম্প্রদায় বিশ্বাস করত যে, আলী (রা) তাঁর বংশের ইমামগণ আল্লাহর সন্তান প্রিয়পাত্র, তাঁদের মধ্যেউলূহিয়্যাতবা আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্কের কারণে ইলাহ হওয়ার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল আল্লাহর সাথে সুস্পষ্ট শির্ক করার কারণে এদেরকে কাফির বলা হয়েছে দেখুন: বাগদাদী, আব্দুল কাহির, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ২৪৭
[10]
ইবনু আবেদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার /৫৬১
[11]
আব্দুল হাই লাখনবী, আত-তালীকুল মুমাজ্জাদ, ইমাম মুহাম্মাদের মুআত্তাসহ /৪০৪
[12]
মোল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ /৩০৬ (কিতাবুল ঈমান, ঈমান বিল কাদার)
[13]
সূরা (২১) আম্বিয়া: ৮৭ আয়াত
[14]
সূরা (১২) ইউসূফ: ৯৭ আয়াত
[15]
সূরা (৪৮) ফাতহ: আয়াত
[16]
ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৫৫-৫৬
[17]
ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪৫-৪৬
[18]
সূরা () মায়িদা: আয়াত
[19]
ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ৩২
[20]
সূরা () আনআম: ১০২ আয়াত
[21]
সূরা (২২) হাজ্জ: ৭৮ আয়াত; সূরা (৫৮): ১৩ আয়াত
[22]
সূরা () বাকারা: ১৮৩ আয়াত
[23]
সূরা (৩০) রূম: ১৭-১৮ আয়াত
[24]
ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪২-৪৩
[25]
মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-মুআত্তা /৪০৪

 . বন্ধুত্ব শত্রুতা

মুসলিম নামধারী ব্যক্তিকে কাফির বলার সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয়: বন্ধুত্ব শত্রুতা। কাফিরের কুফরের প্রতি ঘৃণা এবং মুমিনের ঈমানের প্রতি প্রেম ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য ইসলামী আকীদার অন্যতম আলোচ্য বিষয়আল-ওয়ালায়াতু ওয়াল বারাআত’ (الولاية والبراءة) (الـوِلايَـة) বিলায়াত বা ওয়ালায়াত অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব বা অভিভাবকত্ব। বারাআত (البراءة) অর্থ বিমুক্তি, সম্পর্কচ্ছিন্নতা, নির্দোষিতা বা অস্বীকৃতি

কুরআন-হাদীসে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মুমিনকে ভালবাসতে, তাঁর সাথে বিলায়াত (বন্ধুত্ব) প্রতিষ্ঠা করতে, কাফিরকে অপছন্দ করতে তার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে। মহান আল্লাহ বলেন:


وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

‘‘এবং মুমিন পুরুষগণ মুমিন নারীগণ একে অপরের বন্ধু-নিকটবর্তী বা ওলী। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।[1]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:


إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ

‘‘তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান গ্রহণ করেছে, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং তারা রুকু-রত।’’[2]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:


لا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً

‘‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ব্যতীত কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট হতে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর।’’[3]

এভাবে কুরআনে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, মুমিনগণ পরস্পর ভাই, বন্ধু, অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা হৃদয়ের প্রিয়জন। পক্ষান্তরে কাফির কখনো মুমিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু বা হৃদয়ের প্রিয়জন হতে পারে না। অমুসলিমের সাথে মুসলিমের সামাজিক বা লৌকিক সুসম্পর্ক মানবিক সহযোগিতা থাকবে, তবে হৃদয়ের প্রেম থাকবে না

বিষয়ে হাদীস শরীফেও বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ وَطَعْمَهُ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَأَنْ يُحِبَّ فِى اللَّهِ وَأَنْ يُبْغِضَ فِى اللَّهِ وَأَنْ تُوقَدَ نَارٌ عَظِيمَةٌ فَيَقَعُ فِيهَا أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يُشْرِكَ بِاللَّهِ شَيْئًا

‘‘তিনটি বিষয় যার মধ্যে থাকবে সে এগুলো দ্বারা ঈমানের মিষ্টত্ব স্বাদ লাভ করবে: () মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) অন্য সকলের চেয়ে তার নিকট প্রিয়তর হবে, () সে আল্লাহর জন্যই ভালবাসবে এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা বা অপছন্দ করবে এবং () বিশাল অগ্নিকুন্ড প্রজ্জ্বলিত করা হলে সে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপিয়ে পড়াকে সে আল্লাহর সাথে শিরক করা অপেক্ষা অধিক পছন্দ করবে।’’[4]

অন্য হাদীসে আবূ উমামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدْ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ

‘‘যে আল্লাহর জন্য ভালবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য প্রদান করে এবং আল্লাহর জন্য প্রদান থেকে বিরত থাকে সে ঈমান পরিপূর্ণ করেছে।’’[5]

সকল আয়াত হাদীসের নির্দেশনা খুবই সুস্পষ্ট। মুমিন ঈমান ঈামনদারদেরকে ভালবাসবেন এবং কুফর কুফরে লিপ্ত মানুষদেরক ঘৃণা করবেন বা অপছন্দ করবেন। ঈমান ঈমানদারকে ভালবাসা এবং কুফর কাফিরকে ঘৃণা করা মূলত ‘‘ঈমান’’-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য বিষয় ‘‘ঈমান’’ ‘‘আকীদা’’ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। তবে ‘‘তাকফীর’’-এর একটি প্রচ্ছন্ন ভয়াবহ রূপ কাফিরদের বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াত বা হাদীসকে মুমিনদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। ছিল খারিজী বিভ্রান্তির উৎস। তাদের বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন:


إِنَّهُمْ انْطَلَقُوا إِلَى آيَاتٍ نَزَلَتْ فِي الْكُفَّارِ فَجَعَلُوهَا عَلَى الْمُؤْمِنِينَ

‘‘কাফিরদের বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতগুলোর কাছে যেয়ে সেগুলোকে তারা মুমিনদের উপর প্রয়োগ করে।’’[6]

বন্ধুত্ব শত্রুতা বিষয়ক নির্দেশনাগুলোকে অনেক মুসলিম অন্য মুসলিমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। তারা পাপের কারণে, কর্মগত বা আকীদাগত মতভেদের কারণে ‘‘মুমিনগণকে’’ ঘৃণা করেন, বিদ্বেষ করেন বা শত্রুতা করেন এবং এরূপ ঘৃণা-বিদ্বেষকে ‘‘দীন’’ ইবাদত বলে গণ্য করেন

অনেক সময় মানবীয় দুর্বলতায় আমরা ভালবাসা বা ঘৃণায় আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়ি। ফলে এক্ষেত্রে ঈমানের নির্দেশনা অনুসারে সমন্বয় করতে পারি না। পাপ অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাও ঈমানের দাবি। তবে মুমিনের মধ্যে পাপের পাশাপাশি ‘‘ঈমান’’ অন্যান্য ‘‘পুণ্য’’ বিদ্যমান। এগুলির জন্য মুমিনকে ভালবাসা ঈমানের দাবি। যেহেতু ঈমান মুমিনের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম সেহেতু পাপে লিপ্ত মুমিনকে ঈমানের কারণে পরিমাণ ভালবাসতে হবে এবং অন্যান্য নেক আমলের মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি তার পাপের প্রতি আপত্তি দূরত্বও থাকতে হবে। পাপের জন্য ঘৃণার কারণে ঈমানের অবমূল্যায়ন করা ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক

মুমিনের ঈমানের দাবি যে, তিনি ‘‘ঈমান’’-কে সর্বোচ্চ ভালবাসবেন মূল্যায়ন করবেন। ভালবাসা মূল্যায়নের দাবি এই যে, যে হৃদয়ে ঈমানের ন্যূনতম আভা বা ছোঁয়া বিদ্যমান সে হৃদয় হৃদয়ের অধিকারীর প্রতি তার অন্তরের প্রেম, গভীর ভালবাসা সর্বোচ্চ মূল্যায়ন থাকবে। ভালবাসার অর্থ মুমিনের অন্যায়কে সমর্থন করা নয়। ‘‘ঈমানদার’’ বা মুসলিম নামধারী ব্যক্তি যদি অন্যায়ে লিপ্ত হয় তবে তাকে অন্যায় থেকে নিষেধ করা ভাল কাজে আদেশ করা তার বন্ধুত্ব প্রেমেরই দাবি। তবে মুমিনের অন্যায়ের কারণে তার ‘‘ঈমান’’ মূল্যহীন হয়ে যায় না। কুরআনের নির্দেশনা এটিই

পক্ষান্তরে ঈমানের ন্যূনতম দাবি যে, কুফরকে মুমিন সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করবে। যে হৃদয়ে ‘‘কুফর’’ বিদ্যমান সে হৃদয় হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিকে মুমিন কখনোই হৃদয়ের গভীরে ভালবাসতে পারে না। তাকে হৃদয়ের গভীরে ভালবাসার অর্থ তার ‘‘কুফর’’-কে স্বীকৃতি দেওয়া বা ‘‘কুফর’’-কে গুরুত্বহীন বলে গণ্য করা এবং কুফর-এর প্রতি হৃদয়ের আপত্তি অপসারিত হওয়া

পাপ বা মতভেদের কারণে মুমিনকে ঢালাওভাবে ঘৃণা করা বা তার প্রতি শত্রুতা পোষণ করা আর কোনো ভালকাজের কারণে কাফিরকে ভালবাসা তাকে হৃদয় দিয়ে প্রেম করা একই প্রকারের অপরাধ। উভয় ক্ষেত্রেই ‘‘ঈমান’’-এর অবমূল্যায়ন করা হয়। এরূপ ঘৃণা বিদ্বেষকে যতই আমরা ‘‘আল্লাহর জন্য ঘৃণা’’ বলে দাবি করি, মূলত তা আল্লাহর জন্য নয়, বরং নিজেদের মনমর্জি, দল, মত, নেতা, ইমাম, আমীর, পীর বা অন্য কিছুর জন্য। কারণ ভালবাসা শত্রুতা যদি আল্লাহর জন্য হয় তাহলে তা ঈমান, নেকআমল পাপের পরিমাণে সমন্বিত হবে

মুমিনের অন্যতম পরিচয় ‘‘ঈমান’’-কে ভালবাসা ঈমানের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা। এজন্য সুনিশ্চিত পাপ বা মতভেদীয় ‘‘পাপ’’-এর কারণে মুমিনের প্রতি আপত্তি বা ঘৃণা থাকলেও সাথে সাথে তার মধ্যে বিদ্যমান ঈমান অন্যান্য নেক আমলের পরিমাণ ভালবাসা থাকতে হবে। এভাবে ‘‘বিলায়াত’’ ‘‘বারাআত’’ অর্থাৎ বন্ধুত্ব শত্রুতা বা সম্পর্ক সম্পর্কহীনতা একত্রিত হবে। বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তাঁর ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’’ গ্রন্থে কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছেন:


قَالَ الْمُتَعَلِّمُ رَحِمَهُ اللهُ: ... أَخْبِرْنِيْ عَنْ تَفْسِيْرِ الْوَلاَيَةِ وَالْبَرَاءَةِ هَلْ تَجْتَمِعَانِ فِيْ إِنْسَانٍ وَاحِدٍ؟ قَالَ الْعَالِمُ رَحِمَهُ اللهُ: الْوَلاَيَةُ هِيَ الرِّضَا بِالْعَمَلِ الْحَسَنِ، وَالْبَرَاءَةُ هِيَ الْكَرَاهَةُ عَلَى الْعَمَلِ السَّيِّئْ، وَرُبَّمَا اجْتَمَعَا فِيْ إِنْسَانٍ وَاحِدٍ، وَرُبَّمَا لَمْ يَجْتَمِعَا فِيْهِ. فَهُوَ الْمُؤْمِنُ الَّذِيْ يَعْمَلُ صَالِحاً وَسَيِّئاً، وَأَنْتَ تُجَامِعُهُ وَتُوَافِقُهُ عَلَى الْعَمَلِ الصَّالِحِ وَتُحِبُّهُ عَلَيْهِ، وَتُخَالِفُهُ وَتُفَارِقُهُ عَلَى مَا يَعْمَلُ مِنَ السَّيِّءِ وَتَكْرَهُ لَهُ ذَلِكَ. فَهَذَا مَا سَأَلْتَ عَنِ الْوَلاَيَةِ وَالْبَرَاءَةِ تَجْتَمِعَانِ فِيْ إِنْسَانٍ وَاحِدٍ. وَالَّذِيْ فِيْهِ الْكُفْرُ لَيْسَ فِيْ شَيْءٍ مِنَ الصَّالِحَاتِ وَإِنَّكَ تُبْغِضُهُ وَتُفَارِقُهُ فِيْ جَمِيْعِ ذَلِكَ. وَالَّذِيْ تُحِبُّهُ وَلاَ تَكْرَهُ مِنْهُ شَيْئاً فَهُوَ الْمُؤْمِنُ الَّذِيْ قَدْ عَمِلَ بِجَمِيْعِ الصَّالِحَاتِ وَاجْتَنَبَ الْقَبِيْحَ، فَأَنْتَ تُحِبُّ كُلَّ شَيْءٍ مِنْهُ، وَلاَ تَكْرَهُ مِنْهُ شَيْئاً.

‘‘আবূ মুকাতিল বলেন: ওয়ালায়াত বারাআত: বন্ধুত্ব সম্পর্কছিন্নতার ব্যাখ্যা আমাকে বলুন। একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে কি উভয় বিষয় একত্রিত হতে পারে? ইমাম আবূ হানীফা বলেন: ‘ওয়ালায়াতঅর্থ ভাল কাজের প্রতি সন্তুষ্টি এবংবারাআতঅর্থ খারাপ কাজের প্রতি অসন্তুষ্টি বা অপছন্দ। অনেক সময় একই মানুষের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় একত্রিত হয় এবং অনেক সময় একত্রিত হয় না। যে মুমিন ব্যক্তি পুণ্য পাপ উভয় কর্মই করছে তার পুণ্য কর্মের বিষয়ে তুমি তার সাথে একত্রিত হবে, ঐকমত্য পোষণ করবে এবং এজন্য তুমি তাকে ভালবাসবে। আর সে যে অন্যায় কর্ম করছে সে জন্য তুমি তার বিরোধিতা করবে, তার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং তা অপছন্দ করবে। এরূপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব শত্রুতা বা সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টি একত্রিত হবে, যে বিষয়ে তুমি প্রশ্ন করেছ। আর যার মধ্যে কুফর বিদ্যমান সে কোনো নেককর্মের মধ্যে নেই; তুমি তাকে ঘৃণা কর এবং সব বিষয়ে তার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। আর যাকে তুমি ভালবাসবে এবং তার কিছুই অপছন্দ করবে না সে মুমিন যে সকল নেক কর্ম করে এবং পাপ-অন্যায় বর্জন করে। এরূপ মুমিনের সবই তুমি ভালবাসবে এবং তার কিছুই অপছন্দ করবে না।[7]

হলো ভালবাসা সম্পর্কছিন্নতার বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি। এজন্যই আলী (রা), সাহাবী, তাবিয়ী তাবি-তাবিয়ী ইমামগণ খারিজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু কখনোই তাদেরকে কাফিরের মত ঘৃণা করেন নি। যদিও খারিজীগণ তাঁদেরকে কাফির বলে ঘৃণা করেছে, কিন্তু তাঁরা তা করেন নি। বরং তাদের সাথে আত্মীয়তা করেছেন, তাদের মধ্যে যারা সৎ সত্যপরায়ণ ছিলেন তাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং হাদীস, ফিকহ, তাফসীর ইত্যাদির বর্ণনায় তাদের উপর নির্ভর করেছেন

বর্তমান মুসলিম বিশ্বে আমরা অনেকেই নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত বা সুন্নাত ঐক্যের অনুসারী বলে দাবি করলেও বিদআত বিভক্তির প্রতিই আমাদের আকর্ষণ বেশি। ঈমান, সালাত, যাকাত, সিয়াম, ইলম, কুরআন, তাকওয়া, আমল ইত্যাদির ভিত্তিতে আমরা মুসলিমদেরকে ভালবাসি না। বরং দলীয় মতামত পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদেরকে ভালবাসি। ধর্মীয় ক্ষুদ্রক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে আমরা বিভক্ত। আমার দল, গোষ্ঠীর নেতা বা গুরুর ‘‘অনুসারী’’ ব্যক্তি যদি ঈমান, আমল তাকওয়ায় অনেক পিছনেও থাকে তাহলেও সে আমার অতি প্রিয়জন। আর ভিন্ন দল, মত, নেতা বা গুরুর অনুসারী যদি ঈমান তাকওয়ার বিচারে অনেক ভালও হন তবুও তিনি আমার শত্রু বা অপছন্দিত

আবার এরূপ বিভক্তিকে দীনের রূপ দেওয়ার জন্য আমরা অনেক তথাকথিত ‘‘আকীদা’’ বা ‘‘ইবাদত-পদ্ধতি’’ উদ্ভাবন করেছি, যে সকল আকীদা বা পদ্ধতির কথা কুরআন-হাদীসে সরাসরি নেই, ইমাম আযমসহ চার ইমাম বা তাবিয়ী তাবি-তাবিয়ীগণ লিখেন নি অথবা তা মুস্তাহাব পর্যায়ের কোনো কর্ম মাত্র। সকল বিষয়ের অজুহাতে আমরা মুত্তাকী ব্যক্তিকে ঘৃণা করি এবং ফাসিক ব্যক্তিকে ভালবাসি। সর্বাবস্থায় মুমিনের ঈমান, ফরয-ওয়াজিব দায়িত্ব পালন, হারাম-মাকরূহ বর্জন, ইলম, কুরআন ইত্যাদির চেয়ে ‘‘আমার মতের সাথে শতভাগ মিল থাকা’’ বা ‘‘আমার পদ্ধতিতে ইবাদত পালন করা’’-কেই আমার ভালবাসার মূলনীতি বানিয়েছি। এভাবে আমরা মূলত ‘‘আমার পছন্দের ভিত্তিতে ভালবাসছি’’ কিন্তু একে আবার ‘‘আল্লাহর জন্য ভালবাসা’’ বলে আখ্যায়িত করছি

মুসলিম উম্মাহর সকল বিভক্তি, ফিতনা অবক্ষয়ের অন্যতম উৎসতাকফীর ইমাম আযমের সময়ে যেমন বিষয়টি অন্যতম ফিতনা ছিল, বর্তমানেও তা একইরূপ ফিতনা। রাজনৈতিক মতবাদ, মতভেদ, ধর্মীয় মতপার্থক্য ইত্যাদি কারণে কখনো বা মুসলিমদেরকে সরাসরি ‘‘কাফির’’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ‘‘ইসলামের শত্রু’’, ‘‘কুরআনের শত্রু’, ‘‘নবীর (ﷺ) শত্রু’’, ‘‘সুন্নাতের শত্রু’’, ‘‘ওলী-আউলিয়ার শত্রু’’, ‘‘কাফিরের চেয়েও খারাপ’’, ‘‘কাফিরদের দালাল’’ ইত্যাদি বলে প্রচ্ছন্ন কৌশলী তাকফীর করা হচ্ছে। এভাবে আমরা মুমিনকে কাফির বলার পাপে, বিদ্বেষের পাপে, দলাদলি বিভক্তির পাপে লিপ্ত হচ্ছি। সর্বোপরি জেনে বা না জেনে ইহূদী, খৃস্টান কাফিরগণ, যারা ইসলামের প্রকৃত শত্রু প্রকৃত কাফির তাদের স্বার্থরক্ষা ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র কার্যকর করার পরিবেশ তৈরি করছি। আমাদের উচিত, প্রত্যেকে নিজের মতে-পথে সুদৃঢ় থাকার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিমকে কাফির বলা থেকে বিরত থাকি, মত বা কর্মের সমালোচনা করলেও ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর প্রতি তাকফীর বা বিদ্বেষ প্রচার থেকে বিরত থাকি এবং সকল মুসলিমের হেদায়াত নাজাতের জন্য দুআ করি। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন

[1] সূরা () তাওবা: ৭১ আয়াত
[2]
সূরা () মায়িদা: ৫৫ আয়াত
[3]
সূরা () আল-ইমরান: ২৮ আয়াত
[4]
মুসলিম, আস-সহীহ /৪৮ (কিতাবুল ঈমান, বাবু খিসালিন মানিত্তাসাফা বিহিন্না ওয়াজাদা); নাসাঈ, আস-সুনান /৯৪ (কিতাবুল ঈমান শারাইউহু, বাবু তামুল ঈমান)
[5]
আবূ দাউদ, আস-সুনান (শামিলা) /৩৫৪ (কিতাবুস সুন্নাতি, বাবুদ দালীল আলা যিয়াদাতিল ঈমান..) হাদীসটি সহীহ
[6]
বুখারী, আস-সহীহ /২৫৩৯ (কিতাবু ইসতিতাবাতিল মুরতাদ্দীন, বাবু কাতলিল খাওয়ারিজ)
[7]
ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ৩৮-৩৯

. সুন্নাত বিদআত

এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘মোজাদ্বয়ের উপর মাস্হ করা (মোছা) সুন্নাত। এবং রামাদান মাসের রাত্রিগুলোতে তারাবীহ সুন্নাত।’’

ইমাম আযমের বক্তব্যটি অনুধাবনের জন্য সুন্নাত পরিভাষাটি প্রথমে বুঝতে হবে। এরপর বিষয়টি আকীদা প্রসঙ্গে উল্লেখের কারণ ব্যাখ্যা জানতে হবে

সুন্নাত শব্দের অর্থ বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে। এখানে অতি-সংক্ষেপে বলা যায় যে, আভিধানিকভাবে সুন্নাত অর্থ ছবি, কর্মধারা, জীবনপদ্ধতি বা রীতি। ইসলামী শরীয়তেসুন্নাতঅর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা, কর্ম, অনুমোদন বা এক কথায় তাঁর সামগ্রিক জীবনাদর্শ। সুন্নাতের দুটি অর্থ প্রচলিত। এক অর্থে সুন্নাত ফরয-ওয়াজিবের পরবর্তী পর্যায়ের ইবাদত। সুন্নাতের দ্বিতীয় অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রীতি পদ্ধতি। হাদীসেসুন্নাতশব্দটি অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি যে, কর্মে বর্জনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হুবহু অনুকরণই সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে কর্ম যেভাবে যতটুকু করেছেন সে কর্ম সেভাবে ততটুকু করা এবং তিনি যে কাজ করেন নি- অর্থাৎ বর্জন করেছেন- তা না করাই সুন্নাত। যে কর্ম যতটুকু গুরুত্ব দিয়ে পালন করেছেন তা ততটুকু গুরুত্ব দিয়ে পালন করা, যে কর্ম যতটুকু গুরুত্ব দিয়ে বর্জন করেছেন তা ততটুকু গুরুত্ব দিয়ে বর্জন করা। এক কথায় কর্মে বর্জনে, গুরুত্বে পদ্ধতিতে হুবহু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুকরণই সুন্নাত। সাহাবীগণ এবং পরবর্তী দু-প্রজন্মের কর্ম বর্জনও সুন্নাত-এর অন্তর্ভুক্ত।[1]

কথায়, কর্মে, বর্জনে, গুরুত্বে বা পদ্ধতিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যতিক্রম করা ‘‘খিলাফে সুন্নাত’’ বা ‘‘সুন্নাতের ব্যতিক্রম’’ তিনি যা করেছেন তা না করা অথবা তিনি যা করেন নি তা করা সুন্নাতের ব্যতিক্রম (খিলাফে সুন্নাত) সুন্নাতের ব্যতিক্রম বা সুন্নাত বিরোধী কর্ম বৈধ হতে পারে, কিন্তু দীন হতে পারে না। তিনি যা করেছেন তা বর্জন করা এবং তিনি যা করেন নি তা করা শরীয়তের অন্যান্য নির্দেশনার আলোকে জায়েয বা বৈধ হতে পারে, তবে কখনোই তা দীনের অংশ হতে পারে না

সুন্নাতের ব্যতিক্রম কোনো আকীদা বা কর্মকে দীনের অংশ মনে করাকে বিদআত বলে। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই বিদআতের উদ্ভাবন হয়। আল্লাহ বলেন:


وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا

‘‘কিন্তু সন্ন্যাসবাদ- তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তা উদ্ভাবন করেছিল, আমি তাদেরকে এর বিধান দেই নি, অথচ তাও তারা যথাযথভাবে পালন করে নি।’’[2]

হাদীসে ইসলামের মধ্যে যে কোনো প্রকার উদ্ভাবন বা নতুন বিষয় প্রবেশ করানোকে ‘‘বিদআত’’ (নব-উদ্ভাবন), ‘‘ইহদাস’’ (নতুন বানানো), ‘‘সুন্নাত অপছন্দ’’ ‘‘নিজ পছন্দের অনুসরণ’’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং বিদআতকে সকল বিভ্রান্তির মূল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বারংবার বিদআত বিদআতে লিপ্ত মানুষদেরকে জাহান্নামী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে

কুরআন, সুন্নাতে নববী সুন্নাতে সাহাবার ব্যতিক্রম বা অতিরিক্ত কোনো বিষয়কে দীন বা আকীদার অন্তর্ভূক্ত করাকেই ইমাম আবূ হানীফা বিদআত বলে গণ্য করেছেন। আমরা দেখেছি, তিনি বলেছেন: ‘‘বিষয় তো শুধু তাই যা কুরআন নিয়ে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যার দাওয়াত দিয়েছেন এবং মানুষদের দল-ফিরকায় বিভক্ত হওয়ার আগে তাঁর সাহাবীগণ যার উপরে ছিলেন। এগুলো ছাড়া যা কিছু আছে সবই নব-উদ্ভাবিত বিদআত।’’ বিষয়ে ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ গ্রন্থে তিনি বলেন:


 أَنَّهُ كَانَ يَقُوْلُ: إِنَّ شَرَّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِيْ النَّارِ.
tحَدَّثَنِيْ حَمَّادٌ عَنْ إِبْرَاهِيْمَ عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: وَمَنْ أَحْدَثَ حَدَثاً فِيْ الإِسْلاَمِ فَقَدْ هَلَكَ وَمَنِ ابْتَدَعَ بِدْعَةً فَقَدْ ضَلَّ وَمَنْ ضَلَّ فَفِيْ النَّارِ ... وَحَدَّثَنَا حَمَّادٌ عَنْ إِبْرَاهِيْمَ عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ

‘‘আমাকে হাম্মাদ ইবরাহীম থেকে ইবন মাসঊদ (রা) থেকে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোনো নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে সে ধ্বংস হবে। আর যে কোনো বিদআত উদ্ভাবন করবে সে বিভ্রান্ত হবে। আর যে বিভ্রান্ত হবে সে জাহান্নামী হবে।... আর আমাকে হাম্মাদ ইবরাহীম থেকে, ইবন মাসঊদ (রা) থেকে, তিনি বলতেন: নিশ্চয় কাজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ নতুন উদ্ভাবিত কাজ, প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবিত কাজই বিদআত, প্রত্যেক বিদআতই বিভ্রান্তি এবং প্রত্যেক বিভ্রান্তিই জাহান্নামী।’’[3]

এভাবে আমরা দেখছি, যে কর্ম বা বিশ্বাস রাসূলুল্লাহ তাঁর সাহাবীগণ দীন বা ইবাদত হিসেবে পালন করেন নি তাকে দীন, ইবাদত বা সাওয়াবের কর্ম বলে মনে করা বিদআত। এখানে বিদআতের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। বিস্তারিত জানতে পাঠককেএহইয়াউস সুনানগ্রন্থ পাঠ করতে অনুরোধ করছি

() বিদআত একান্তই ধার্মিকদের পাপ। ধার্মিক ছাড়া কেউ বিদআতে লিপ্ত হয় না। বিদআতই একমাত্র পাপ যা মানুষ পুণ্য মনে করে পালন করে

() কোনো কর্ম বিদআত বলে গণ্য হওয়ার শর্ত তাকে ইবাদত মনে করা। যেমন একজন মানুষ দাঁড়িয়ে, লাফিয়ে বা নর্তনকুর্দন করে যিকর বা দরুদ-সালাম পড়ছেন। এরূপ দাঁড়ানো, লাফানো বা নর্তন-কুর্দন শরীয়তে মূলত নিষিদ্ধ নয়। কেউ যদি জাগতিক কারণে এরূপ করেন তা পাপ নয়। দাঁড়ানো বা নর্তন কুর্দনের সময় যিকর বা দরুদ-সালাম পাঠ পাপ নয়। দরুদ-সালাম বা যিকরের সময় কোনো কারণে বা অনিয়ন্ত্রিত আবেগে দাঁড়ানো বা লাফানো পাপ নয়। কিন্তু যখন কেউদাঁড়ানো’, ‘লাফানোবানর্তন-কুর্দন’-কে দীন, ইবাদত বা ইবাদতের অংশ হিসেবে বিশ্বাস করেন তখন তা বিদআতে পরিণত হয়। ইবাদত মনে করার অর্থ: () যিকর বা দরুদ-সালাম দাঁড়ানো বা লাফানো ব্যতিরেকে পালন করার চেয়ে দাঁড়ানো বা লাফানো-সহ পালন করা উত্তম, অধিক আদব, অধিক সাওয়াব বা অধিক বরকত বলে মনে করা বা () দাঁড়ানো বা লাফানো ছাড়া যিকর বা দরুদ-সালাম পালন করতে অস্বস্তি অনুভব করার কারণে এপদ্ধতিতে সকল ইবাদত পালনকে রীতিতে পরিণত কর

() হাদীস শরীফে বিদআতের কয়েকটি পরিণতির কথা বলা হয়েছে: () তা প্রত্যাখ্যাত। অর্থাৎ কর্ম আল্লাহ কবুল করছেন না এবং এজন্য কোনো সাওয়াব হচ্ছে না। () তা বিভ্রান্তি। কারণ তিনি জেনে বা না-জেনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীগণের ইবাদতকে অপূর্ণ বলে মনে করছেন। () বিদআত অন্যান্য ইবাদত কবুল হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক। () বিদআতে সুন্নাত অপছন্দ সুন্নাতের মৃত্যু

() বিদআতের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক তা সুন্নাতের প্রতি অবজ্ঞা সৃষ্টি করে। বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তি নিজেকে সুন্নী বা আহলূস সুন্নাত মনে করেন। যে সুন্নাতগুলো তার বিদআতের প্রতিপক্ষ নয় সেগুলি তিনি পালন বা মহববত করেন। তবে তাঁর পালিত বিদআত সংশ্লিষ্ট সুন্নাতকে তিনি গ্রহণ করতে পারেন না। উপরের উদাহরণটি বিবেচনা করুন। যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বা লাফিয়ে যিকর বা সালাম পালন করছেন তিনি স্বীকার করবেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা সাহাবীগণ দাঁড়িয়ে বা লাফিয়ে যিকর বা সালাম পালন করেছেন বা করতে উৎসাহ দিয়েছেন বলে তিনি কোথাও দেখেন নি। তিনি স্বীকার করবেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীগণ বসেবসে যিকর, দরুদ সালাম পাঠ করতেন বলে তিনি অনেক হাদীস থেকে জেনেছেন। তারপরও তিনি বসে যিকর বা দরুদ-সালাম পালনে অস্বস্তিবোধ করবেন। বিভিন্নদলীলদিয়ে সকল ইবাদত বসে পালনের চেয়ে দাঁড়িয়ে বা নেচে পালন করা উত্তম বলে প্রমাণের চেষ্টা করবেন

তার বিদআতকে প্রমাণ করতে তিনি অনেক অপ্রাসঙ্গিক দলীল পেশ করবেন এবং সুন্নাত-প্রমাণিত পদ্ধতিকে অবজ্ঞা করতে তিনি বলবেন: ‘সবকিছু কি সুন্নাত মত হয়? ফ্যান, মাইক... কত কিছুই তো নতুন। ইবাদতটি একটু নতুন পদ্ধতিকে করলে সমস্যা কী? উপরন্তু সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ করে বসেবসে দরুদ, সালাম যিকর পালনকারীর প্রতি কম বা বেশি অবজ্ঞা অনুভব করবেন

() তাওহীদের বিশ্বাসের ঘাটতি থেকে শিরকের উৎপত্তি এবং রিসালাতের বিশ্বাসের ঘাটতি থেকে বিদআতের উৎপত্তি। বিদআত মূলত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের সাথে অন্য কাউকে শরীক করা বা রিসালাতের পূর্ণতায় অনাস্থা। শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি যেমন শিরক সংশ্লিষ্ট বিষয়েগাইরুল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া অন্য)-এর প্রতি হৃদয়ের আস্থা অধিক অনুভব করেন তেমনি বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তি বিদআতের ক্ষেত্রেগাইরুন্নবী’ (নবী ছাড়া অন্য)-এর অনুসরণ-অনুকরণে অধিক স্বস্তি বোধ করেন। তিনি সর্বদা সংশ্লিষ্ট বিষয়েসব কিছু কি নবীর তরীকায় হয়?’ বলে এবং নানাবিধদলীলদিয়ে ইত্তিবায়ে রাসূলগুরুত্বহীন বা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকেন। পাশাপাশি তারবিদআতআমল বা পদ্ধতিকে উত্তম প্রমাণ করতেগাইরুন্নবীঅর্থাৎ বিভিন্ন বুজুর্গের কর্মের প্রমাণ প্রদান করেন

() সকল পাপের ক্ষেত্রে মুমিন জানেন যে তিনি পাপ করছেন; ফলে তাওবার একটি সম্ভাবনা থাকে। পক্ষান্তরে বিদআত পালনকারী তার বিদআতকে নেক আমল মনে করেই পালন করেন। কাজেই এর জন্য তাওবার কথা তিনি কল্পনাও করেন না। এজন্য শয়তান বিদআতকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে

() বিদআতের অন্য অপরাধ তা সুন্নাত হত্যা করে। সুন্নাত বহির্ভুত কোনো কর্ম বা পদ্ধতি ইবাদতে পরিণত হওয়ার অর্থ সংশ্লিষ্ট মাসনূন ইবাদত বা পদ্ধতির মৃত্যু। যিনি দাঁড়িয়ে বা লাফিয়ে যিকর বা সালাম পাঠ উত্তম বলে গণ্য করছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীগণের পদ্ধতিতে বসে যিকর বা সালাম তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। সমাজের অন্যান্য মানুষেরা যখন এভাবে ইবাদতটি পালন করতে থাকবেন তখন সমাজ থেকেও সুন্নাতটি অপসারিত হবে

() বিদআত ‘‘সুন্নাতের খিলাফ’’ হলেও, ‘‘দলীলের খিলাফ’’ নয়। সকল বিদআতই ‘‘দলীল’’ নির্ভর। কুরআন-হাদীসের দলীল ছাড়া কোনো বিদআত উদ্ভাবিত হয় না। দলীল ছাড়া যা উদ্ভাবন করা হয় তা দীন বলে আখ্যায়িত করার সুযোগ থাকে না।দলীলনামের কোনো কিছু থাকলেই শুধু সুন্নাহ বিরোধী কোনো আকীদা বা আমলকেদীন’-এর অংশ বানানো যায়। আল্লামা ইবন নুজাইম (৭৯০ হি) বলেন:


الْبِدْعَةِ ... اسْمٌ مِنْ ابْتَدَعَ الأَمْرَ إذَا ابْتَدَأَهُ وَأَحْدَثَهُ ثُمَّ غَلَبَتْ عَلَى مَا هُوَ زِيَادَةٌ فِي الدِّينِ أَوْ نُقْصَانٌ مِنْهُ. وَعَرَّفَهَا الشُّمُنِّيُّ بِأَنَّهَا مَا أُحْدِثَ عَلَى خِلافِ الْحَقِّ الْمُتَلَقَّى عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ مِنْ عِلْمٍ أَوْ عَمَلٍ أَوْ حَالٍ بِنَوْعِ شُبْهَةٍ وَاسْتِحْسَانٍ وَجُعِلَ دِينًا قَوِيمًا وَصِرَاطًا مُسْتَقِيمًا.

‘‘বিদআত শব্দটি... ‘ইবতাদফি থেকে গৃহীত ইসম। এর অর্থ শুরু করা বা উদ্ভাবন করা। অতঃপর দীনের মধ্যে সংযোজন বা বিয়োজন অর্থে বিদআত শব্দটির ব্যবহার প্রাধান্য লাভ করে।শুমুন্নী বিদআতের সংজ্ঞায় বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে গৃহীত সত্যের ব্যতিক্রম যে জ্ঞান-মত, কর্ম বা অবস্থা কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্য ভুল বুঝার কারণে এবংমুসতাহসানবা ভাল মনে করে উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং যাকে সঠিক দীন সিরাতে মুস্তাকীম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই বিদআত’’[4]

এজন্য আমরা দেখি যে, সকল বিভ্রান্ত দলই কুরআন-হাদীস থেকে দলীল প্রদান করে, তবে তারা সুন্নাত প্রদান করতে পারে না। সকল দলীল দিয়ে তারা এমন একটি কথা বা কর্ম দীনের অংশ বলে দাবি করে, যা কখনো রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন নি বা করেন নি। ইতোপূর্বে বিভ্রান্ত গোষ্ঠীদের আকীদায় আমরা তা দেখেছি। দু-একটি বিষয় পর্যালোচনা করা যায়

কুরআনে বলা হয়েছে ‘‘কোনো কিছুই আল্লাহর সাথে তুলনীয় নয়’’ কিন্তু কোথাও বলা হয় নি যে, আল্লাহ কথা বলেন বিশ্বাস করলে তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। ছাড়া কোথাও বলা হয় নি যে, কুরআন সৃষ্ট। মুতাযিলীগণ কুরাআনের ‘‘দলীল’’ দিয়ে এমন একটি মত উদ্ভাবন করে যা কখনোই কুরআন-হাদীসে বলা হয় নি। এরপর তারা উদ্ভাবিত মতটিকে দীনের অংশ বানিয়ে নেয়। কেউ যদি কুরআনের কথাগুলি হুবহু বিশ্বাস করেন এবং শতকোটিবার স্বীকার করেন তবুও তারা তাকে মুমিন বলে স্বীকার করতে রাযি হয় নি; যতক্ষণ না যে তাদের উদ্ভাবিত কথাটি স্বীকার করতো

কুরআন সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন:


إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

‘‘আমি একে বানিয়েছি আরবী কুরআন; যাতে তোমরা তা বুঝতে পার।’’[5]

মুতাযিলীগণ দাবি করত যে, ‘‘বানানো’’ অর্থই সৃষ্টি করা; কাজেই কুরআন সৃষ্ট। তাদের দলীল ভিত্তিহীন। (جعل) বা বানানো অর্থ কখনো ‘‘সৃষ্টি’’ করা হতে পারে, তবে এর মূল অর্থ একটি বিশেষ রূপ দেওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর কালাম কুরআনকে আরবীরূপে প্রকাশ করেছেন। যেমন আল্লাহ হস্তীবাহিনীর বিষয়ে বলেছেন:


فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَأْكُولٍ

‘‘তিনি তাদেরকে ভক্ষিত শস্যপাতার মত বানালেন।’’[6]

এর অর্থ নয় যে, তিনি তাদেরকে ভক্ষিত শস্যপাতার ন্যায় সৃষ্টি করেছিলেন, বরং তিনি তাদেরকে ভক্ষিত শস্যপাতার রূপ দিয়েছিলেন

লক্ষণীয় যে, মুতাযিলীগণ তাদের উদ্ভাবিত অর্থকেই দীন বানিয়ে নেয়। ‘‘আল্লাহ কুরআনকে আরবীতে সৃষ্টি করেছেন’’- কথাটি বলা বিশ্বাস করাকে তারা দীন মনে করেছে; কাজেই কেউ যদি শতকোটিবার বলেন যে, ‘‘আল্লাহ কুরআনকে আরবী বানিয়েছেন’’ কিন্তু তাদের উদ্ভাবিত কথাটি না বলে তবে তাকে মুমিন বা প্রকৃত মুমিন বলে মানতে রাযি হয় নি

রাসূলুল্লাহ (ﷺ), আলী (রা) আলী-বংশের ইমামগণের গাইবী ইলম ক্ষমতা সম্পর্কে শীয়াগণের আকীদাও অনুরূপ। ‘‘ইমামগণ’’ বিষয়ে অতিভক্তিই শীয়াগণের মূল প্রেরণা। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বাদ দিয়ে তো আর তাঁদেরকেআলিমুল গাইববানানো যায় না। তাই তারা তাঁদের সকলের জন্য সামগ্রিক ইলম গাইব এবং ইমামগণের অনুসারীওলী’’ বা খলীফাগণের জন্য আংশিক ইলম গাইব দাবী করেন। শীয়াগণের প্রভাবে মূলধারার অনুসারী অনেক মুসলিম আলিম সাধারণ মানুষও পরবর্তী যুগে ধরনের আকীদা গ্রহণ করেছেন। তাদের আকীদা ‘‘উদ্ভাবিত’’; কারণ বিষয়ে তারা যা বলেন তা কখনোই এভাবে কুরআন কারীমে বা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয় নি। কুরআন-হাদীসের কিছু বক্তব্যের বিশেষ ব্যাখ্যা এবং অগণিত বানোয়াট কথা, গল্প কাহিনীর উপর ভিত্তি করে তারা এরূপ আকীদা উদ্ভাবন করেন।ইসলামী আকীদাহাদীসের নামে জালিয়াতিগ্রন্থদ্বয়ে বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছি

এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, কুরআন-হাদীসে বারবার বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ গাইব জানেন না, একমাত্র আল্লাহই আলিমুল গাইব, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অন্যান্য নবী-রাসূল গাইব জানতেন না, কিয়ামতের দিন তাঁরা সকলে একত্রিতভাবে সাক্ষ্য প্রদান করবেন। এর বিপরীতে কোথাও বলা হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা অন্য কেউ ‘‘গাইবের জ্ঞানী’’ বা ‘‘আলিমুল গাইব’’ তবে আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাঁকেগাইবের সংবাদজানিয়েছেন, অতীত-ভবিষ্যতের অদৃশ্য জগতের বিষয়াদি তাঁকে জানিয়েছেন। শীয়াগণ তাদের অনুসারীগণগাইবের অনেক সংবাদ জানানো’-কে ‘‘গাইবের সকল জ্ঞান প্রদান’’ অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। এরপর ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কুরআন-হাদীসের দ্ব্যর্থহীন অগণিত বক্তব্য বাতিল করেছেন। সর্বোপরি তারা তাদের ‘‘উদ্ভাবিত’’ ব্যাখ্যাকে ‘‘দীন’’ বানিয়েছেন। কেউ যদি কুরআন-হাদীসের বিষয়ক সকল নির্দেশ সরল অর্থে বিশ্বাস করে কিন্তু তাদের ‘‘উদ্ভাবিত’’ ব্যাখ্যা গ্রহণ না করে তবে তারা তাকেমুমিনবাখাঁটি মুমিনমানতে রাজি নন

মহান আল্লাহ কুরআনে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে শাহিদ/শাহীদ (شاهد/ شهيد) বলে উল্লেখ করেছেন।[7] এর অর্থ প্রমাণ, সাক্ষী বা উপস্থিত। জাতীয় আয়াত দিয়ে তাঁরা দাবি করেন যে, তিনি সদাসর্বদা উম্মাতের প্রত্যেকের নিকট ‘‘হাযির’’ বা উপস্থিত, ‘‘প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী’’, সবকিছু দেখছেন, শুনছেন এবং সকল গাইবের কথা জানেন

এখানেও মুতাযিলীদের পদ্ধতি লক্ষণীয়। শাহিদ বা শাহীদ শব্দদ্বয় কখনো ‘‘উপস্থিত’’ অর্থে ব্যবহৃত হলেও অধিকাংশ সময় প্রমাণ বা সাক্ষী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কুরআনে বারবার সকল মুমিনকে মানব জাতির জন্য ‘‘শাহীদ’’ বলা হয়েছে[8]; এতে প্রমাণিত হয় না যে, সকল মুমিনআলিমুল গাইববা ‘‘সদা-সর্বদা সর্বত্র উপস্থিত’’ ‘‘প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী’’ যদি কেউ বিশ্বাস স্বীকার করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শাহিদ শাহীদ, কিন্তু তিনি তাদের বিশেষ অর্থটি স্বীকার না করেন তাহলে তারা তাকেমুমিনবাপূর্ণ মুমিনবলে মানতে রাযি নন

রাসূলুল্লাহ (ﷺ), ফাতিমা (রা), আলী (রা) তাঁর বংশের ইমামগণ ‘‘নূর’’ দ্বারা সৃষ্ট ছিলেন বলে শীয়াগণের আকীদাও অনুরূপ। পরবর্তীতে সাধারণ ‘‘-শীয়া’’ মুসলিম সমাজেও আকীদা অনুপ্রবেশ করে। শীয়াগণ বিষয়ে অনেক জাল হাদীস তৈরি প্রচার করে।[9] এগুলোই তাদের ‘‘আকীদা’’- মূল ভিত্তি। পাশাপাশি তারা কুরআনের কিছু বাণীর কথিত ‘‘তাফসীর’’-কে দীনের অংশ বানিয়ে নেয়। যেমন, আল্লাহ বলেন:


قَدْ جَاءَكُمْ مِنْ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلامِ

‘‘আল্লাহর নিকট হতে এক নূর স্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে, যা দিয়ে হেদায়ত করেন আল্লাহ যে তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে তাকে শান্তির পথে...’’[10]

দ্বিতীয় আয়াতে ‘‘যা দিয়ে’’ বাক্যাংশে একবচনের ব্যবহার থেকে সুস্পষ্ট যে নূর কিতাব বলতে একটিই বিষয় বুঝানো হয়েছে, অর্থাৎ আল-কুরআন। ছাড়া কুরআনে অন্যান্য স্থানে বলা হয়েছে যে, কুরআনই নূর যা দিয়ে আল্লাহ মানুষদেরকে হেদায়াত করেন।[11] এরপরও কেউ কেউ বলেছেন যে, এখানে নূর অর্থ মুহাম্মাদ (ﷺ)[12]

শীয়াগণ তাদের পদ্ধতিতে মানবীয় তাফসীরকে ওহীর মান প্রদান করেন। এরপর তাফসীরের আবারতাফসীরকরে বলেন: মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নূর বলার অর্থ তিনি নূরের তৈরি। এরপর এরূপতাফসীরের তাফসীরকেতারা আকীদার মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। এমনকি যদি কেউ বলেন যে, আমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নূর বলে মানি, তবে নূরের তৈরি বলে মানি না, কারণ কুরআনে বা তাফসীরে তা বলা হয় নি, তবুও তারা তাকে মুমিন বা প্রকৃত মুমিন বলে মানতে রাজি নন

সর্বোপরি তারা আল্লাহর সত্তা বা বিশেষণকে সৃষ্টিজগতের নূর বা আলোর মত কল্পনা করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বংশধরকে আল্লাহর সত্তা বা বিশেষণের অংশ বলে বিশ্বাস করেন; ঠিক যেভাবে খৃস্টানগণ তাদের মূল আকীদা নাইসীন ক্রীড (Nicene creed)- ঈসা () কে আল্লাহর সত্তা থেকে সৃষ্ট ((of the same substance/ substance of the Father) নূরের তৈরি নূর (light of light) বলে বিশ্বাস করা বাধ্যতামূলক বলেছেন

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইমামগণের বা ওলীগণের গাইবী অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ক তাদের আকীদাও এভাবে উদ্ভাবিত বিদআত। আল্লাহর সিফাত, তাকদীর, তাকফীর, সাহাবীগণ, আহলু বাইত ইত্যাদি বিষয়ে জাহমী, মুতাযিলী, শীয়া, খারিজী ইত্যাদি সম্প্রদায়ের আকীদা সবই এরূপউদ্ভাবিতবা বিদআত আকীদা

[1] বিস্তারিত দেখুন: . খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ২৯-১১৪
[2]
সূরা (৫৭) হাদীদ: ২৭ আয়াত
[3]
ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৫৩
[4]
ইবনু নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক শারহু কান্যুদ-দাকাইক /৬১১
[5]
সূরা (৪৩) যুখরুফ: আয়াত
[6]
সূরা (১০৫) ফীল: আয়াত
[7]
দেখুন: সূরা () বাকারা: ১৪৩ আয়াত; সূরা () নিসা: ৪১ আয়াত; সূরা (১৬) নাহল: ৮৯ আয়াত; সূরা (২২) হাজ্জ: ৭৮ আয়াত; সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৫ আয়াত; সূরা (৪৮) ফাতহ: আয়াত; সূরা (৭৩) মুযযাম্মিল: ১৫ আয়াত
[8]
দেখুন: সূরা () বাকারা: ১৪৩ আয়াত; সূরা (২২) হাজ্জ: ৭৮ আয়াত
[9]
দেখুন: খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি, পৃ. ৩১০-৩৪৪
[10]
সূরা : মায়েদা, ১৫-১৬ আয়াত
[11]
দেখুন: সূরা : ৪২, শূরা, ৫২ আয়াত; সূরা : রাফ, ১৫৭ আয়াত
[12]
তাবারী, তাফসীর /১৬১; কুরতুবী, তাফসীর /১১৮; ইবনু কাসীর, তাফসীর /৩৫

 . মোজার উপর মাস্হ করা

মোজা বুঝাতে আরবীতে দুটি শব্দ রয়েছে: খুফ্ফ (الخف) অর্থাৎ চামড়ার মোজা এবং জাওরাব (الجورب) অর্থাৎ কাপড়, পশম ইত্যাদির মোজা।জাওরাব’-এর উপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাসহ করেছেন কিনা সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো সাহাবী তা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে ফকীহগণ মতভেদ করেছেন। ইমাম মুহাম্মাদ উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফার মতেজাওরাব’-এর উপর মাসহ করা বৈধ নয়। ইমাম আবূ ইউসুফ মুহাম্মাদের মতেজাওরাবযদি পুরু হয়, পায়ের চামড়া প্রকাশ না করে তবে তার উপর মাসহ করা বৈধ। ইমাম যাইলায়ী উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আযম মৃত্যুর পূর্বে নিজ মত পরিত্যাগ করে তাঁর ছাত্রদ্বয়ের মত গ্রহণ করেন।[1]

পক্ষান্তরে বহুসংখ্যক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ওযু অবস্থায় চামড়ার মোজা পরিধান করা হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওযূ করার সময় মোজা না খুলে মোজার উপর আদ্র হাত বুলিয়ে মুছে নিতেন বা মাস্হ করতেন। তিনি স্বগৃহে অবস্থানকারীর জন্য ২৪ ঘণ্টা এবং মুসাফিরের জন্য ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত এরূপ মাস্হ করার অনুমতি দিয়েছেন

খারিজীগণ মোজার উপর মাস্হ করার বৈধতা অস্বীকার করেন। শীয়াগণ মোজাবিহীন পদযুগল মাসহ করা বৈধ বলেন। বিষয়টি কর্মের, আকীদার বিষয় নয়। তবে চামড়ার মোজার উপর মাস্হ মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এরূপ বিষয়ের বৈধতা অস্বীকার করার অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত একটি কর্মকে অবৈধ বলে মনে করা, নিজেদেরকে তাঁর চেয়েও বেশি মুত্তাকী কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে তাঁর চেয়ে পারঙ্গম বলে মনে করা। এগুলি সবই কুফরের নামান্তর। এজন্যই ইমাম আবূ হানীফা অন্যান্য ইমাম বিষয়টি আকীদার মধ্যে উল্লেখ করেছেন

এখানে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন যে, খুফ্ফ বা চামড়ার মোজার উপর মাস্হ করা সুন্নাত। ওসিয়্যাহ গ্রন্থে তিনি একে ওয়াজিব বলেছেন। তিনি বলেন:


وَنُقِرُّ بِأَنَّ الْمَسْحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ وَاجِبٌ لِلْمُقِيْمِ يَوْماً وَلَيْلَةً، وَلِلْمُسَافِرِ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ وَلَيَالِيْهَا؛ لأَنَّ الْحَدِيْثَ وَرَدَ هَكَذَا، فَمَنْ أَنْكَرَهُ فَإِنَّهُ يُخْشَى عَلَيْهِ الْكُفْرُ؛ لأَنَّهُ قَرِيْبٌ مِنَ الْخَبَرِ الْمُتَوَاتِرِ.

‘‘নিজ গৃহে অবস্থানকারী বা মুকীমের জন্য এক দিন এক রাত মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত্রি মোজার উপর মাস্হ করা ওয়াজিব বলে আমরা স্বীকার করি। কারণ হাদীসে এরূপই বর্ণিত হয়েছে। যদি কেউ তা অস্বীকার করে তবে তার কাফির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ তা মুতাওয়াতির হাদীস হওয়ার নিকটবর্তী।’’[2]

অর্থাৎ, মোজার উপর মাস্হ করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবন-পদ্ধতি ইবাদত পদ্ধতির অংশ। তিনি যেভাবে যতটুকু গুরুত্ব দিয়ে তা করেছেন, সেভাবে ততটকু গুরুত্ব দিয়ে তা গ্রহণ করা সুন্নাত। একে সুন্নাহ নির্দেশিত বৈধ কর্ম হিসেবে বিশ্বাস করা ওয়াজিব। মোজার উপর মাস্হ না করলে গোনাহ হয় না। তবে মাস্হ না করে মোজা খুলে পা ধোয়াকে বেশি তাকওয়া মনে করা বা মাস্হ করাকে না-জায়েয মনে করা একটি বিদআত বা নব-উদ্ভাবিত বিশ্বাস। এরূপ আকীদা পোষণকারী সুন্নাহ নির্দেশিত ওয়াজিব আকীদা পরিত্যাগের জন্য পাপী

[1] মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-মাবসূত /৯১; যাইলায়ী, তাবয়ীনুল হাকায়িক /৫২
[2]
ইমাম আবূ হানীফা, আল-ওয়াসিয়্যাহ, পৃ. ৭৮

 . রামাদানের রাতে তারাবীহ / . . কিয়ামুল্লাইল তাহাজ্জুদ

. . কিয়ামুল্লাইল তাহাজ্জুদ

তারাবীহ (التراويح) বহুবচন, একবচন তারবীহাহ (الترويحة) এর অর্থ প্রশান্তি, আরাম, বিনোদন, শিথিলায়ন, শিথিল হয়ে বসা (refreshment, soothing, easing, relief, relaxation, recreation) ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় রামাদান মাসের রাত্রির কিয়ামুল্লাইল বা রাতের সালাতকে ‘‘তারাবীহ’’ বলা হয়

কিয়ামুল্লাইল তাহাজ্জুদের গুরুত্ব আমি ‘‘রাহে বেলায়াত’’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, কিয়ামুল্লাইল (قيام الليل) অর্থ রাতের কিয়াম বা রাত্রিকালীন দাঁড়ানো সালাতুল ইশার পর থেকে ফজরের ওয়াক্তের উন্মেষ পর্যন্ত সময়ে যে কোনো নফল সালাত আদায় করলে তাকিয়ামুল্লাইলবাসালাতুল্লাইলঅর্থাৎ রাতের দাঁড়ানো বা রাতের সালাত বলে গণ্য।তাহাজ্জুদঅর্থ ঘুম থেকে উঠা। রাতে ঘুম থেকে উঠে ‘‘কিয়ামুল্লাইল’’ আদায় করাকে ‘‘তাহাজ্জুদ’’ বলা হয়। কেউ যদি ইশার সালাত আদায় করে রাত ৯টা বা ১০টায় ঘুমিয়ে পড়েন এবং ১১/১২টায় উঠে নফল সালাত আদায় করেন তবে তাকিয়ামুল্লাইলতাহাজ্জুদবলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে কেউ যদি ইশার পরে না ঘুমিয়ে রাত / টার দিকে কিছু নফল সালাত আদায় করেন তবে তাকিয়ামুল্লাইল বলে গণ্য হলেওতাহাজ্জুদবলে গণ্য নয়

ইসলামের অন্যতম নফল ইবাদত কিয়ামুল্লাইল। প্রথম রাতে বা শেষ রাতে, ঘুমানোর আগে বা ঘুম থেকে উঠে অন্তত কিছু নফল সালাত আদায় করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একটু ঘুমিয়ে উঠেতাহাজ্জুদ’-রূপে কিয়ামুল্লাইল আদায় করলে তার সাওয়াব মর্যাদা বেশি। রাতের শেষভাগে তা আদায় করা সর্বোত্তম। কুরআন মাজীদে কোনো নফল সালাতের উল্লেখ করা হয় নি, এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতেরও বিস্তারিত উল্লেখ করা হয় নি। কিন্তু কিয়ামুল্লাইল তাহাজ্জুদের সালাতের কথা বারংবার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মুমিন জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে

কিয়ামুল্লাইল বা সালাতুল্লাইলের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এত বেশি নির্দেশনা দিয়েছেন যে, বিষয়ে বর্ণিত সহীহ হাদীসগুলি একত্রিত করলে একটি বৃহদাকৃতির পুস্তকে পরিণত হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিয়ামুল্লাইল তাহাজ্জুদকে যে গুরুত্ব দিয়েছেন, অন্য কোনো নফল বা সুন্নাত সালাতের সে গুরুত্ব দেন নি। তিনি কিয়ামুল্লাইল আদায় করতে তাকিদ দিতেন। কেউ আদায় না করলে আপত্তি করতেন। বিষয়গুলি বিবেচনা করলে সারা বৎসরইকিয়ামুল্লাইলসুন্নাতে মুআক্কাদা বলে গণ্য হয়। তবে ফকীহগণ সাধারণভাবেকিয়ামুল্লাইল’-কে নফল পর্যায়ের সুন্নাত বাসুন্নাতে গাইর মুআক্কাদাবলে গণ্য করেছেন

 . . রামাদানের কিয়ামুল্লাইল

রামাদানেকিয়ামুল্লাইলআদায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো অধিক তাকিদ প্রদান করেছেন। এজন্য রামাদানের কিয়ামুল্লাইলকে উম্মাতের আলিমগণ অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবংসুন্নাত মুআক্কাদাবলে গণ্য করেছেন

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে সাধারণত রামাদান অন্য সকল সময়ে প্রথম রাতে সালাতুল ইশা আদায় করে ঘুমিয়ে পড়তেন। এরপর মাঝরাতে উঠে / ঘণ্টা যাবৎ একাকী তাহাজ্জুদ-কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন। একবার তিনি ২৩, ২৫ ২৭ রামাদানের রাত্রিতে সাহাবীগণ, তাঁর পরিবারের সদস্যগণ স্ত্রীগণকে নিয়ে জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করেন। ২৩ তারিখে রাতে এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত (আনুমানিক রাত টা থেকে ১০/১১ টা পর্যন্ত / ঘণ্টা), ২৫ তারিখে মধ্য রাত পর্যন্ত (আনুমানিক রাত -১২= ঘণ্টা) এবং ২৭ তারিখের রত্রিতে সাহরীর সময় পর্যন্ত (আনুমানিক রাত - = ঘণ্টা) কিয়ামুল্লাইল আদায় করেন।[1]

তিন রাত্রিতে তিনি কত রাকআত কিয়াম করেছিলেন তা সহীহ বর্ণনায় স্পষ্ট নয়। তবে সাধারণত তিনি রামাদান অন্যান্য সময়ে তিন রাকআত বিতর ছাড়া রাকআত কিয়াম আদায় করতেন।[2] এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে রাকআত[3], রাকআত[4], রাকআত[5], ১০ রাকআত[6], এবং ১২ রাকআত[7] কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন বলে সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাঁর রাকআত সংখ্যা কমবেশি হলেও, সময়ের পরিমাণ বিশেষ কমবেশি হতো না। সাধারণত তিনি প্রায় / ঘণ্টা ধরে কিয়াম আদায় করতেন। রাকআতের সংখ্যা কমালে দৈর্ঘ্য বাড়াতেন

সাহাবীগণ রামাদানে তাঁর পিছনে জামাআতে কিয়ামুল্লাইল পালন করতে অতীব আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ফরয হওয়ার আশঙ্কায় তিনি একাকী তা আদায় করতেন এবং সাহাবীদেরকে এভাবে আদায় করতে পরামর্শ দেন।[8] উপরের হাদীসে আমরা দেখলাম যে, কয়েক রাত তিনি তা জামাতে আদায় করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি জামাআতে রামাদানের কিয়াম আদায়ের ফযীলতে বলেন:


مَنْ قَامَ مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ

‘‘যে ব্যক্তি ইমামের কিয়ামুল্লাইল শেষ করা পর্যন্ত ইমামের সাথে কিয়ামুল্লাইল আদায় করবে তার জন্য পুরো রাত কিয়াম পালনের সাওয়াব লেখা হবে।’’[9]

সাহাবীগণ পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিমগণ রামাদানের কিয়ামুল্লাইল আদায়ের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। যেহেতু শেষ রাতে উঠে তা আদায় করা অনেকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়, এজন্য অনেকেই সালাতুল ইশার পরেই মসজিদে বা বাড়িতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করে ঘুমাতেন। যারা কুরআনের ভাল কারী বা হাফিয ছিলেন না তারা অনেক সময় কোনো ভাল কারী বা হাফিযের পিছনে মসজিদে বা বাড়িতে ছোট জামাত করে তা আদায় করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়ে তাঁর ওফাতের পরে প্রায় কয়েক বৎসর এভাবেই চলে

খলীফা উমার (রা) লক্ষ্য করেন যে, এভাবে মদীনার মসজিদে নববীতে ছোট ছোট জামাতে বা পৃথকভাবে একাকী অনেকেই সালাতুল ইশার পরে কিয়ামুল্লাইল আদায় করছেন। তখন তিনি সাহাবী উবাই ইবন কাবকে বলেন, মানুষেরা দিবসে সিয়াম পালন করেন, কিন্তু অনেকেই ভাল হাফিয বা কারী নন; কাজেই আপনি তাদেরকে নিয়ে জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করেন। পাশাপাশি তিনি সুলাইমান ইবন আবী হাসমাহ (রা) নামক অন্য সাহাবীকে মহিলাদের নিয়ে মসজিদের শেষ প্রান্তে পৃথক জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করার নির্দেশ দেন। মহিলাদের জামাতের ইমামতি তামীম দারী (রা) নামক অন্য সাহাবীও করতেন। খলীফা উসমান ইবন আফ্ফনের (রা) সময়ে তিনি সুলাইমান ইবন আবী হাসমাহ (রা)-এর ইমামতিতে পুরুষ মহিলাদের এক জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায়ের ব্যবস্থা করেন।[10] অধিকাংশ মানুষ জামাতে কিয়ামুল্লাইল আদায় করতে থাকেন। তবে অনেক সাহাবী, তাবিয়ী যারা ভাল হাফিয আবিদ ছিলেন তারা সালাতুল ইশার পরে অথবা মধ্য রাতে শেষ রাতে একাকী রামাদানের কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন

[1] তিরমিযী, আস-সুনান /১৬৯ (কিতাবুস সাওম, বাব (৮১) মা জাআ ফী কিয়ামি শাহরি রামাদান) তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ
[2]
বুখারী, আস-সহীহ /৩৮৫ (কিতাবু সালাতিত তারাবীহ, বাবু ফাদলি মান কামা রামাদান); মুসলিম, আস-সহীহ /৫০৯ (কিতাবু সালাতিল মুসাফিরীন, বাবু সালাতিল লাইল....)
[3]
আহমদ, আল-মুসনাদ /৪০০
[4]
আবূ দাউদ, আস-সুনান /৪৬ (কিতাবুত তাতাওউ, বাবুন ফী সালাতিল লাইল); নাসাঈ, আস-সুনান /২২৬ (কিতাবু কিয়ামিল লাইল... , বাবু তাসবিয়াতিল কিয়ামি ওয়ার রুকু..)
[5]
আবূ দাউদ, আস-সুনান /৪৬ (কিতাবুত তাতাওউ, বাবুন ফী সালাতিল লাইল)
[6]
আবূ দাউদ, প্রাগুক্ত ; ইবনুল আসীর, জামিউল উসূল /৪৭
[7]
বুখারী, আস-সহীহ /৭৮, ৪০১, (কিতাবুল ওয়াদূ, বাবু কিরাআতিল কুরআন বাদাল হাদাসি) /৪০১, /১৬৬৬, ১৬৬৭; মুসলিম, আস-সহীহ /৫২৬, ৫৩১ (কিতাবু সালাতিল মুসাফিরীন, বাবুদ দুআ ফী সালাতিল লাইলি)
[8]
বুখারী, আস-সহীহ /২৫৬ (কিতাবুল জামাআত, বাবু সালাতিল্লাইল), /১৬৬৬, ১৬৬৭; মুসলিম, আস-সহীহ /১৮৮ (কিতাব সালাতিল মুসাফিরীন, বাবু ইসতিহবাবি সালাতিন নাফিলাতি ফী বাইতিহী)
[9]
তিরমিযী /১৬৯ (কিতাবুস সাওম, বাব মা জাআ ফী কিয়ামি শাহরি রামাদান) হাদীসটি সহীহ
[10]
মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-মুআত্তা (আব্দুল হাই লাখনবী, আত-তালীক আল-মুমাজ্জাদ-সহ) পৃ /৩৫৫; ইবনু আবী শাইবা; আল-মুসান্নাফ /২২২

 . . রামাদানের কিয়ামেরতারাবীহনামকরণ

উমার (রা)-এর সময় থেকেই রামাদানের কিয়ামুল্লাইলের জামাআত দীর্ঘ সময় ধরে আদায় করা হতো। সাধারণত শেষ রাতে সাহরীর সময়ে শেষ হতো। বর্তমান সময়ের হিসেবে রাত / টা থেকে / পর্যন্ত প্রায় / ঘণ্টা যাবত কিয়ামুল্লাইল আদায় করা হতো। ইমামগণ তিন-চার দিনে বা এক সপ্তাহে কুরআন খতম করতেন। কেউ কেউ রামাদানের কিয়ামুল্লাইলে দু-তিন খতম কুরআন পাঠ করতেন। রুকু সাজদাও দীর্ঘ করা হতো। এজন্য প্রতি চার রাকআত পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার নিয়ম প্রচলিত হয়ে যায়। কারণে রামাদানের কিয়ামুল্লাইলকে ‘‘সালাতুত তারাবীহ’’, অর্থাৎ বিশ্রামের বা শিথিলায়নের সালাত বলা হতে থাকে

সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, উমার (রা)-এর সময়ে রাকআত এবং ২০ রাকআত কিয়ামুল্লাইল আদায় করা হতো। ইমাম মালিক মুহাম্মাদ ইবন ইউসূফ থেকে, তিনি সাইব ইবন ইয়াযিদ (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, উমার (রা) ১১ রাকআত (বিতর-সহ) কিয়ামুল্লাইলের ব্যবস্থা করেন। তাঁরা শতশত আয়াত তিলাওয়াত করতেন এবং ফজরের সামান্য পূর্বে শেষ করতেন।[1] পক্ষান্তরে ইমাম আব্দুর রায্যাক সানআনী দাউদ ইবন কাইস অন্যান্যদের থেকে, তারা মুহাম্মাদ ইবন ইউসূফ থেকে, তিনি সাইব ইবন ইয়াযিদ (রা) থেকে, তিনি বলেন: উমার ২১ রাকআত (বিতর-সহ) কিয়ামুল্লাইলের ব্যবস্থা করেন।[2] ইমাম বাইহাকী ইয়াযিদ ইবন খাসীফার সূত্রে সাইব ইবন ইয়াযিদ থেকে উদ্ধৃত করেন: উমারের সময় তারা ২৩ রাকআত কিয়াম করতেন।[3] এগুলি সবই সহীহ হাদীস। হাদীসগুলোর রাবীগণ সকলেই সহীহ বুখারী সহীহ মুসলিমের রাবী। এছাড়াও অনেকগুলো সহীহ বা হাসান সনদে উমার (রা)-এর সময়ে ২০ রাকআত তারাবীহ আদায়ের কথা বর্ণিত হয়েছে

মুহাদ্দিসগণ বলেন, সম্ভবত প্রথমে দীর্ঘ সময় ধরে রাকআত আদায় করা হতো। পরে সময়ের দৈর্ঘ ঠিক রেখে রাকআত বিশ্রামের সংখ্যা বাড়ানো হয়। / ঘণ্টা ধরে রাকআতের চেয়ে ২০ রাকআত আদায় সহজতর। পরবর্তীকালে অধিকাংশ স্থানে ২০ রাকআত এবং কোথাও ৩৮ রাকআত পর্যন্ত তারাবীহ আদায় করা হতো

[1] মালিক, আল-মুআত্তা /১১৫
[2]
আব্দুর রায্যাক, আল-মুসান্নাফ /২৬০; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /২৫৩
[3]
বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা /৪৯৬

 . . তারাবীহ: আকীদা, সুন্নাত বিদআত

শীয়াগণ শীয়া প্রভাবিত মুতাযিলাগণ সাধারণভাবে সাহাবীগণের বিরুদ্ধে কুৎসা বিদ্বেষ প্রচার করেন। বিশেষত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)-এর বিরুদ্ধে তাদের অপপ্রচার বিদ্বেষ সীমাহীন। সকল অপপ্রচারের একটি বিষয় তারাবীহ। তারা তারাবীহকে বিদআত বলেন এবং উমার (রা)-কে বিদআতী বলেন। তারা বলেন, উমার (রা) ইসলামের মধ্যে নতুন কিছু বিষয় প্রচলন করেন যার একটি তারাবীহ। তারাবীহ বিদআত। উমার নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তা বিদআত। বুখারী অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ সংকলিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তারাবীহের জামাআত প্রচলনের পরে উমার বলেন: (نِعْمَتِ الْبِدْعَةُ هَذِهِ): ‘‘এটি ভাল বিদআত আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তো বলেছেন, সকল বিদআতই বিভ্রান্তি এবং জাহান্নামী! কাজেই উমার নিজের স্বীকারোক্তিতেই বিভ্রান্ত জাহান্নামী! নাউযূ বিল্লাহ!!

আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করলেই তাদের বিভ্রান্তি বুঝতে পারব। আমরা প্রথমে দেখব তারাবীহের মধ্যে কোনো নতুনত্ব আছে কি না? দ্বিতীয়ত দেখব নতুনত্বে খুলাফায়ে রাশেদীন সাহাবীগণের জন্য কোনো বিশেষ মর্যাদা আছে কিনা

তারাবীহের মধ্যে কী নতুনত্ব রয়েছে যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে ছিল না? তারাবীহ? না তার জামাআত? উভয় কর্মই সুন্নাতে নববী দ্বারা প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে রামাদানের কিয়ামুল্লাইল নিয়মিত পালন করেছেন, পালন করতে তাকিদ দিয়েছেন, কয়েকদিন জামাআতে পালন করেছেন, জামাআতে পালনের ফযীলত বর্ণনা করেছেন, তাঁর সময়ে পরবর্তী সময়ে ছোট ছোট জামাআতে বাড়িতে মসজিদে সাহাবীগণ তাবিয়ীগণ তা আদায় করেছেন। তাহলে আমরা দেখছি যে, উমার (রা) একটি সুন্নাত জীবন্ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরয হওয়ার আশঙ্কায় নিয়মিত জামাআতে তা আদায় করেন নি। তাঁর ওফাতের পরে ফরয হওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়, তবে বড় জামাআতে তারাবীহ আদায় না করার নিয়মটি রয়ে যায়। আবূ বাকর (রা)-এর দু বৎসরে তিনি দিকে নযর দিতে পারেন নি। এছাড়া সে সময়ে অধিকাংশ মুসলিমই ভাল হাফিয কারী ছিলেন, কাজেই জামাতে আদায়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতো কম। উমার (রা) বড় জামাতে তারাবীহ আদায়ের সুন্নাতটি পুনর্জীবিত করেন। তিনি কোনো বিদআত প্রচলন করেন নি, বরং সুন্নাত জীবন্ত করেছেন

এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে তিনি কেন একে ‘‘সুন্দর বিদআত’’ বললেন? এর উত্তর খুবই সুস্পষ্ট। তিনি এখানে বিদআত শব্দটি পারিভাষিক অর্থে নয়, বরং আভিধানিক অর্থে ব্যবহার করেছেন। আভিধানিক অর্থে বিদআত অর্থনতুনবা নব-উদ্ভাবন। আর কুরআন হাদীসের পরিভাষায় বিদআত অর্থ সুন্নাতের ব্যতিক্রম কোনো নতুন বিষয়কে দীনের বা ইসলামের অংশ বানানো। উমার (রা) এখানে বিদআত বলতে দ্বিতীয় অর্থ বুঝান নি। তিনি বুঝিয়েছেন যে, আমাদের দৃষ্টিতে এটি একটি নতুন বিষয়; কারণ নিয়মিত জামাতে তারাবীহ আদায় অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। তবে যেহেতু বিষয়টি মূলত সুন্নাত, বিশেষ কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তা নিয়মিত করেন নি; সেহেতু তা আপাত দৃষ্টিতে নতুন হলেও সুন্দর নতুন

যেমন আমরা বলি, ‘আল্লাহ প্রেমে মাদকতা বা উন্মত্ততা কতই না ভাল মাদকতা এর অর্থ নয় যে, কিছু কিছু মাদক দ্রব্য বৈধ অথবা আল্লার প্রেম মাদকতা হওয়ার কারণে তা অবৈধ। এর অর্থ বাহ্যিকভাবে একে মাদকতা বা উন্মত্ততা বলে মনে হলেও তা প্রশংসনীয়। ইমাম শাফিয়ী বলেন: ‘নবী-বংশের ভালবাসা যদি রাফিযী-মত হয় তাহলে জিন-ইনসান সকলেই সাক্ষী থাকুক যে, আমি রাফিযী-শীয়া।’[1] অর্থাৎ নবী-বংশের প্রেম শীয়াত্ব- নয় এবং নবী-বংশের ভালবাসায় কেউ শীয়া হয় না

তাহলে তারাবীহর মধ্যে কোনো বিদআত বা নতুনত্ব নেই, বরং সবই প্রমাণিত সুন্নাত। এবার আমরা দ্বিতীয় বিষয়টি পর্যালোচনা করব। খুলাফায়ে রাশেদীন সাহাবীগণ কি উম্মাতের অন্যদের মতই? না সুন্নাতের ব্যাখ্যায় তাঁদের বিশেষ কোনো মর্যাদা আছে? রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিভিন্ন নির্দেশনার পাশাপাশি যুক্তি বিবেক নিশ্চিত করে যে, তাঁদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সকল নির্দেশ সুন্নাতের প্রেক্ষাপট জানতেন। কোথায় সংযোজন, বিয়োজন বা ব্যতিক্রমের সুযোগ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রেখে গিয়েছেন তাও তাঁরা ভাল জানতেন। তাঁরা যদি সুন্নাতের কোনো ব্যাখ্যা দেন তা নতুন বলে মনে হলেও সুন্নাত বলে গণ্য হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ.

‘‘আমার পরে তোমরা যারা বেঁচে থাকবে তাঁরা অনেক মতবিরোধ দেখবে। কাজেই তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরের হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাত দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরবে। খবরদার! নব উদ্ভাবিত কর্মাদি থেকে সাবধান থাকবে; কারণ সকল নব উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত এবং সকল বিদআতই পথভ্রষ্টতা।’’[2]

হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের কর্মও সুন্নাত। বিদআত অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খুলাফায়ে রাশেদীনের কথা, কর্ম, রীতি বা সুন্নাতের ব্যতিক্রম উদ্ভাবিত বিষয়। কাজেই তাঁরা যদি সুন্নাতের ব্যতিক্রম কিছু করেন তাহলে তাকে বিদআত বলার অধিকার পরবর্তীদের নেই, কারণ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তা সুন্নাত বলে আখ্যায়িত করেছেন।[3]

‘‘তারাবীহ’’ প্রসঙ্গে উমার (রা)-এর বক্তব্যে ‘‘বিদআত’’ শব্দকে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত দাবি করে শীয়াগণ যেমন বিভ্রান্ত হয়েছেন, মূলধারার অনেক আলিমও তেমনি বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। কথা দিয়ে তাঁরা দুটি বিষয় প্রমাণ করতে চান: () পারিভাষিক বিদআত বা সুন্নাতের ব্যতিক্রম কোনো কিছুকে দীনের অংশ বানানো ভাল বলে গণ্য হতে পারে এবং () উমার (রা) যেমন তারাবীহের বিদআত প্রচলন করেছেন তেমনি নতুন নতুন বিদআত প্রচলনের অধিকার পরবর্তী যুগের মুসলিমদেরও আছে

আমি ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে বিষয়ক অস্পষ্টতা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলো উল্লেখ করা যায়:

() সকল হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘‘সকল বিদআতই পথভ্রষ্টতা’’ এর বিপরীতে একটি হাদীসেও বলা হয় নি যে, ‘কিছু বিদআত পথভ্রষ্টতা কিছু বিদআত ভাল কাজেই একটি বিশেষ কর্মকে কোনো সাহাবী আভিধানিক অর্থে বিদআত বলে থাকলে সে হাদীসের দ্বারা অন্যান্য সকল হাদীসের সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন অর্থ বাতিল করা যায় না। হাদীস শরীফে সর্বদা ‘‘বিদআত’’ শব্দকে নিন্দার অর্থে বলা হয়েছে। নিন্দার জন্য বিদআতের সাথে কোনো বিশেষণ যোগ করা হয় নি। উমারের বক্তব্য দ্বারা বিদআতের ভাল হওয়ার সম্ভাবনা স্বীকার করা আর ইমাম শাফিয়ীর বক্তব্য দ্বারা রাফিযী-শীয়া মতবাদ ভাল হওয়ার, কোনো কেনো রাফিযীর ভাল হওয়ার বা ইমাম শাফিয়ীর রাফিযী হওয়ার দাবী একই প্রকারের ভুল

() আমরা দেখেছি যে, উমার (রা)-এর কর্মটি কোনোভাবেই বিদআত নয়, নতুনও নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ, বাণী কর্ম দ্বারা প্রমাণিত সুন্নাত। কাজেই উমারের কথাকে যদি ‘‘ভাল বিদআত’’ বা বিদআতে হাসানার মানদন্ড ধরা হয় তাহলে বলতে হবে, যে কর্ম রাসূলুল্লাহ (ﷺ) করেছেন, করার ফযীলত উল্লেখ করেছেন কিন্তু বিশেষ কারণে নিয়মিত করতে পারেন নি বা তাঁর পরে অব্যাহত থাকে নি, সে কর্ম পুনরুজ্জীবিত করাকে বিদআতে হাসানা বা ভাল বিদআত বলা হয়

() রাসূলুল্লাহ (ﷺ) করেন নি, অথচ খুলাফায়ে রাশেদীন বা সাহাবীগণ করেছেন এরূপ কর্ম দু প্রকারের হতে পারে:

() তিনি নিজে বিশেষ কারণে না করলেও তা করার উৎসাহ বা অনুমতি তাঁর সুন্নাতে রয়েছে। যেমন কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলিত করা, খারিজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইত্যাদি। তারাবীহের জামাআতও পর্যায়ের
(
) তাঁরা জাগতিক প্রয়োজনে বা সুন্নাত পদ্ধতিতে ইবাদত পালনের উপকরণ হিসেবে তা উদ্ভাবন করেছেন। যেমন কুরআনে বিভক্তিচিহ্ন বা হরকত প্রদান, আরবী ব্যাকরণ শিক্ষার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নিয়মকানুন প্রচলন ইত্যাদি। এগুলিকে তাঁরা বা অন্য কেউ ‘‘দীনের অংশ’’ বানান নি। অর্থাৎ কেউ বলেন নি যে, কেউ যদি আরবী ব্যাকরণ শিক্ষা ছাড়াই বা বিভক্তিচিহ্ন ছাড়াই বিশুদ্ধভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মত সুন্নাত পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করে তাহলে ব্যাকরণ বা বিভক্তিচিহ্ন বাদ দেওয়ার কারণে তার সাওয়াব কম হবে

() আমরা দেখেছি যে, সুন্নাতে নববীর ব্যাখ্যার সুন্নাতের আলোকে কোনো কিছু প্রবর্তন করার যে অধিকার সাহাবীগণের ছিল, তা অন্যদের নেই এবং থাকতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তারাবীহের নিয়মিত জামাআত বর্জন করেন বিশেষ কারণে। খুলাফায়ে রাশেদীন সাহাবীগণ বুঝেন যে, কারণটি তিরোহিত হওয়ার পরে মাসনূন কর্মটিকে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গ্রন্থাকারে কুরআন সংকলনের নির্দেশ দিয়েছেন, গ্রন্থ দেখে কুরআন পাঠের ফযীলত বলেছেন, তবে ওহী নাযিলের ধারাবাহিকতা চলতে থাকায় চূড়ান্ত গ্রন্থায়ন করতে পারেন নি। তাঁর ওফাতের পরে সাহাবীগণ তা করেছেন। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাইতুল্লাহর তাওয়াফের সময় দৌড়ে দৌড়ে তাওয়াফ করেছিলেন মুশরিকদের শক্তি প্রদর্শনের বিশেষ উদ্দেশ্যে। খুলাফায়ে রাশেদীন সাহাবীগণ বুঝেন যে, কারণটি তিরোহিত হওয়ার পরেও আমলটি অব্যাহত রাখাই সুন্নাত

এভাবে সুন্নাতের সাথে ব্যাখ্যামূলক সংযোজন-বিয়োজন একমাত্র সাহাবীগণই করতে পারেন। সাহাবীগণের পরে আর কেউ কোনোভাবে কোনো কারণ বা অজুহাতে সুন্নাতের সামান্যতম ব্যতিক্রম কোনো কিছুকে দীনের অংশ বানাতে পারেন না। সাহাবীগণ সুন্নাতের ব্যতিক্রম কিছু প্রচলন করেছেন যুক্তিতে নতুন কোনো কথা, কর্ম বা রীতি উদ্ভাবন করে তাকে দীনের অংশ বানানোর অধিকার কারো নেই। এরূপ করলে কুরআন হাদীস সাহাবীদের যে মর্যাদা বিশেষত্ব দিয়েছে তা নষ্ট করা হয় এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহচর্যের অবমূল্যায়ন করা হয়

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, তারাবীহ একটি কর্ম, বিশ্বাসের বিষয় নয়, তবে তা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কর্মগত বৈশিষ্ট্য। এছাড়া বিভিন্ন বিভ্রান্ত গোষ্ঠী তারাবীহকে বিদআত উমার (রা)-কে বিদআতী বলার কারণে ইমাম আযম (রাহ) বিষয়টিকে আকীদা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন

[1] ইমাম শাফিয়ী,আদ- দিওয়ান, পৃ. ১৪
[2]
তিরমিযী, আস-সুনান (৪২-কিতাবুল ইলম, ১৬ বাব- আখয বিসসুন্নাহ) /৪৪, নং, ২৬৭৬; আবু দাউদ, আস-সুনান /৩২৯ (কিতাবুস সুনণাত, বাব লুযূমিস সুন্নাহ) নং ৩৯৯১/৪৬০৯;, ইবন মাজাহ, আস-সুনান (মুকাদ্দিমাহ, বাব ইত্তিবায়ি সুন্নাতিল খুলাফায়ির রাশিদীন) /১৫-১৬ নং ৪২ ৪৩ হাদীসটি সহীহ
[3]
বিস্তারিত দেখুন: যাহাবী, আল-মুনতাকা মিন মিনহাজিল ইতিদাল পৃ. ৫৪১; মোল্লা আলী কারী, শারহুর ফিকহিল আকবার, পৃ. ১২২; আলী ইবনু নাইফ শাহ্হূদ, আল-মুফাস্সাল ফির রাদ্দি আলা শুবুহাতি দাইল ইসলাম ১৩/, ১২৫, ১২৬, ১৯১; শুবুহাতুর রাফিযাতি হাওলাস সাহাবা /২৭৬; তুওয়াইজিরী, শারহুল ফাতওয়াল হামাবিয়্যাহ, পৃ. ৪৪৫; . খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৬১-৮৯ ৯৭-১০৭

 ১০. ইমামত রাষ্ট্র

এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘সকল নেককার পাপী মুমিনের পিছনে সালাত আদায় বৈধ।এখানে তিনি ইসলামী আকীদার অন্যতম একটি বিষয় অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি যে, ইসলামী আকীদার আলোচ্য বিষয় চারটি: () মহান আল্লাহ, () নুবুওয়াত, () ইমামাত বা রাষ্ট্রপ্রধানের পদ () আখিরাত। ইমাম আবূ হানীফা এখানে ইমামত প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন

ইসলামে সালাতের ইমামত রাষ্ট্রীয় ইমামত বা রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব পরস্পরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়ে এবং পরবর্তী কয়েক যুগে সর্বদা রাষ্ট্রপ্রধান বা তার নিযুক্ত আঞ্চলিক প্রধান, বিচারক বা কর্মকর্তাই সালাতের ইমামতি করতেন। জুমুআ ঈদের সালাতের জন্য রাষ্টের ইমামের ইমামতি বা অনুমোদন শর্ত বলে গণ্য করেছেন অধিকাংশ ফকীহ। বিষয়ে আহলুস সুন্নাতের বিশ্বাস বর্ণনা করেছেন ইমাম আযম একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে। তা হলো, পাপী পুণ্যবান সকলের পিছনেই সালাত বৈধ। সালাতের ইমাম অর্থই রাষ্ট্রীয় ইমাম বা তার নিয়োজিত ব্যক্তি। সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমামতির জন্য সর্বোত্তম বা সবচেয়ে মুত্তাকী ব্যক্তি হওয়া জরুরী নয়। যদি কোনো ফাসিক ব্যক্তি সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমামতি গ্রহণ করে তবে তার অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা যথাসাধ্য সৎকাজে আদেশসহ রাষ্ট্রীয় আনুগত্য রাষ্ট্রীয় ঐক্য বহাল রাখতে হবে। বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর আকীদা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম তাহাবী (রাহ) তিনি বলেন:


وَنَرَى الصَّلاةَ خَلْفَ كُلِّ بَرٍّ وَفَاجِرٍ مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ، وعَلَى مَنْ مَاتَ مِنْهُمْ. وَلا نُنَزِّلُ أَحَدًا مِنْهُمْ جَنَّةً وَلا نَارًا، وَلا نَشْهَدُ عَلَيْهِمْ بِكُفْرٍ وَلا بِشِرْكٍ وَلا بِنِفَاقٍ، مَا لَمْ يَظْهَرْ مِنْهُمْ شَيْءٌ مِنْ ذَلِكَ، وَنَذَرُ سَرَائِرَهُمْ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى. وَلا نَرَى السَّيْفَ عَلَى أَحَدٍ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ ﷺ إِلاَّ مَنْ وَجَبَ عَلَيْهِ السَّيْفُ. وَلا نَرَى الْخُرُوجَ عَلَى أَئِمَّتِنَا وَوُلاةِ أُمُورِنَا وَإِنْ جَارُوا، وَلا نَدْعُو عَلَيْهِمْ، وَلا نَنْزِعُ يَدًا مِنْ طَاعَتِهِمْ، وَنَرَى طَاعَتَهُمْ مِنْ طَاعَةِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فَرِيضَةً، مَا لَمْ يَأْمُرُوا بِمَعْصِيَةٍ، وَنَدْعُو لَهُمْ بِالصَّلاحِ وَالْمُعَافَاةِ. وَنَتَّبِعُ السُّنَّةَ وَالْجَمَاعَةَ، وَنَجْتَنِبُ الشُّذُوذَ وَالْخِلافَ وَالْفُرْقَةَ. وَنُحِبُّ أَهْلَ الْعَدْلِ وَالأَمَانَةِ، وَنُبْغِضُ أَهْلَ الْجَوْرِ وَالْخِيَانَةِ. ... وَالْحَجُّ وَالْجِهَادُ مَاضِيَانِ مَعَ أُولِي الأَمْرِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، بَرِّهِمْ وَفَاجِرِهِمْ إِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ، لا يُبْطِلُهُمَا شَيْءٌ وَلا يَنْقُضُهُمَا.

‘‘আমরা কেবলাপন্থী প্রত্যেক নেককার পাপী মুসলিমের পিছনে সালাত কায়েম করা এবং তাদের মৃত ব্যক্তির জন্য জানাযার সালাত আদায় করা বৈধ মনে করি। আমরা তাদের কাউকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলে নিশ্চিত সাক্ষ্য প্রদান করি না। তাদের কারো উপর কুফর, শিরক বা নিফাকের সাক্ষ্য প্রদান করি না যতক্ষণ না ধরণের কিছু তাদের মধ্যে প্রকাশ্যভাবে দেখা দিবে। তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়াদি আমরা আল্লাহ তাআলার উপর ছেড়ে দিই। ধর্মীয় বিধান মতে ফরয না হলে মুহাম্মদ ﷺ-এর উম্মাতের কোনো লোকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ আমরা বৈধ মনে করি না। আমাদের ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানগণ শাসকবর্গ অত্যাচার করলেও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বৈধ মনে করি না। আমরা তাদেরকে অভিশাপ প্রদান করি না এবং তাদের আনুগত্যও বর্জন করি না। আমরা তাদের আনুগত্যকে আল্লাহরই আনুগত্যের অংশ হিসেবে ফরয মনে করি যতক্ষণ না তারা কোনো পাপ কর্মের নির্দেশ দেয়। আর তাদের সংশোধন সংরক্ষণের জন্য দু করি। আমরা সুন্নাত এবং জামাআত (ঐক্য) অনুসরণ করি এবং বিচ্ছিন্নতা, অনৈক্য মতবিরোধিতা আমরা পরিহার করি। আমরা ন্যায়বিচারক দায়িত্ববান-আমানত আদায়কারী শাসকদের ভালবাসি এবং জালিম, দুর্নীতিবাজ বা দায়িত্বে খিয়ানতকারীদের ঘৃণা করি। মুসলিম শাসকের অধীনে- সে নেককার হোক আর পাপী-বদকার হোক- হজ্জ্ব এবং জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কোনো কিছুই zুটকে বাতিল বা ব্যাহত করতে পারে না।’’[1]

এখানে ইমাম তাহাবী নেককার বদকারের ইমামতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করার সাথে সাথে রাষ্ট্র নাগরিকের সম্পর্ক এবং বিদ্রোহ বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি জিহাদ হজ্জ দুটি ইবাদতকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পালনের কথা উল্লেখ করেছেন

[1] ইমাম তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৫-১৬

 ১০. . খারিজী শীয়া মতবাদ

আমরা দেখেছি যে, ইসলামের প্রথম দুটি ফিরকা- শীয়া খারিজী ফিরকা- উভয়ের উদ্ভব উন্মেষ ঘটেছিল রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভক্তি ঘটে। শীয়াগণ দাবি করেন যে, ইমামাত একমাত্র ‘‘নিষ্পাপ’’ ব্যক্তির প্রাপ্য। এজন্য পাপীর ইমামত অবৈধ। পাপী ব্যক্তিকে অপসারণ করে সর্বোচ্চ মুত্তাকীকে- তাদের বিশ্বাসে তাদের ইমাম বা তাঁর মনোনীত ব্যক্তিকে- রাষ্ট্রীয় ইমামতে অধিষ্ঠিত করাকে তারা অন্যতম ফরয দায়িত্ব বলে গণ্য করেন

খারিজীগণও বিষয়ে দুটি আকীদার উদ্ভাবন করে: () পাপী ব্যক্তির ইমামতের অবৈধতা এবং () পাপী ইমামের অপসারণের আবশ্যকতা। তাদের দাবি, পাপী ব্যক্তি কাফির, আর কাফির ব্যক্তি সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমামতি করতে পারে না। বরং মুমিনের জন্য ফরয যে, এরূপ ইমামের বিরুদ্ধে সৎকাজে আদেশ অসৎকাজে নিষেধের অংশ হিসেবে বিদ্রোহ করবে এবং জিহাদ করে তাকে অপসারণ করবে

কারণে শীয়াগণ খারিজীগণ সর্বদা বিদ্রোহ রাষ্ট্র পরিবর্তন প্রচেষ্টায় লিপ্ত থেকেছেন। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ছাড়া সকল রাষ্ট্রকে তাগূতী অনৈসলামিক রাষ্ট্র বলে গণ্য করেন। সকল দেশে তারা সালাতুল জুমুআ আদায় করেন না। সুন্নী ইমামদের পিছনে জামাআত আদায় করেন না। ছাড়া সকল দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বা গোপন যুদ্ধ করে তাদেরকে উৎখাত করে নিজ আকীদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা সচেষ্ট থাকেন। শীয়াগণ সাধারণত গোপন প্রচার, ষড়যন্ত্র ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করতেন। পক্ষান্তরে খারিজীগণ সাধারণত সরাসরি বিদ্রোহ যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। ইমাম আবূ হানীফা ইমাম তাহাবীর বক্তব্যের আলোকে আমরা বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ

 ১০. . সুন্নাতের আলোকে ইমাম জামাআত

জাহিলী যুগে আরবে কোনো রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ছিল না। তারা কবীলা বা গোত্রের আনুগত্যের মধ্যে বাস করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রথম সেখানে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ, স্বাধীনতাবোধ, কবীলার আনুগত্য, রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যায়, পাপ বা জুলুমের কারণে যেন রাষ্ট্রীয় ঐক্য, সংহতি শৃঙ্খলা বিঘ্ন না হয় সে জন্য তিনি বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। সকল নির্দেশনা অনুধাবনের জন্য বিষয়ক কয়েকটি পরিভাষা আলোচনা করা প্রয়োজন। পরিভাষাগুলির অন্যতম: ইমাম, বাইআত জামাআত। পরিভাষাগুলোর অর্থ ব্যবহার আলোচনা করেছি ‘‘ইসলামের নামে জাঙ্গিবাদ’’ ‘‘কুরআন-সুন্নাহ আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইমাম (الإمام) শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘‘নেতা’’ (Leader) ইসলামী পরিভাষায় সালাতের জামাআতের ইমাম রাষ্ট্রপ্রধান ইত্যাদি অর্থে ইমাম শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তবে হাদীস শরীফ প্রথম শতাব্দীগুলির আকীদা ফিকহের পরিভাষায় ইমাম শব্দটি যখন উন্মুক্তভাবে ব্যবহৃত হয় বা ‘‘ইমামুল মুসলিমীন’’ মুসলিমগণের ইমাম বলা হয় তখন এর অর্থ রাষ্ট্রপ্রধান। হাদীসে, ফিকহে আকীদায়ইমামপরিভাষাটি একমাত্র অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের যে প্রতিজ্ঞা করা হয় তাকে ‘‘বাইআত’’ (البيعة) বলা হয়

জামাআত (الجماعة) অর্থ ঐক্য বা ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠী, জনগণ বা সমাজ (community, society) অর্থে তা অধিক ব্যবহৃত হয়। এর বিপরীত শব্দ ইফতিরাক (الافتراق), অর্থাৎ বিভক্তি বা দলাদলি। ফিরকা (الفرقة) অর্থ দল বা গোষ্ঠী। হাদীসে ‘‘জামাআত’’ বা ‘‘জামাআতুল মুসলিমীন’’ বলতে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের মধ্যে বসবাসকারী ঐক্যবদ্ধ জনগণ বা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বুঝানো হয়েছে

নিষ্পাপ বা পাপমুক্ত রাষ্টপ্রধানের বাধ্যবাধকতা চিরন্তন সংঘাতের পথ খুলে দেয় এবং মুমিনকে অসাধ্য সাধনের পথে ধাবিত করে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাতের রাষ্টের ইমামতির জন্য ধার্মিক, সৎ যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগের উৎসাহ দিয়েছেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ঐক্য শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পাপী ইমামের পাপের প্রতিবাদের পাশাপাশি আনুগত্য বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়ক অনেক হাদীস উপর্যুক্ত গ্রন্থদ্বয়ে আলোচনা করেছি। এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি

মুআবিয়া (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ عَلَيْهِ إِمَامٌ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً

‘‘কোনো একজন ইমামের (রাষ্ট্রপ্রধানের) আনুগত্য-বিহীন অবস্থায় যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’[1]

আবু হুরাইরা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


مَنْ خَرَجَ مِنْ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً

‘‘যে ব্যক্তিরাষ্ট্রীয় আনুগত্যথেকে বের হয়ে এবংজামাআতবা ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যু বরণ করল সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’[2]

মুআবিয়া (রা) তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে রাষ্ট্র প্রধান পদে মনোনয়ন দান করেন এবং তার পক্ষে রাষ্ট্রের নাগরিকদের থেকে বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। ৬০ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকালের পরে ইয়াযিদ শাসনভার গ্রহণ করেন এবং চার বছর শাসন করে ৬৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তার শাসনামলে ৬৩ হিজরীতে মদীনার অধিবাসীগণ তার জুলুম, ইমাম হুসাইনের শাহাদত ইত্যাদি কারণে বিদ্রোহ করেন। তাদের বিদ্রোহ ছিল যুক্তিসঙ্গত, একান্তই আল্লাহর ওয়াস্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সময়ে জীবিত সাহাবীগণ বিদ্রোহে রাজী ছিলেন না। সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) মদীনার বিদ্রোহীদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবন মুতি নিকট গমন করেন। তিনি তাঁকে সম্মানের সাথে বসতে অনুরোধ করেন। ইবন উমার (রা) বলেন: আমি বসতে আসিনি। আমি তোমাকে একটি হাদীস শুনাতে এসেছি। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি:


مَنْ خَلَعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ لَقِيَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لا حُجَّةَ لَهُ وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةٌ (رواية ثانية: مَاتَ بِغَيْرِ إِمَامٍ) مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً

‘‘যে ব্যক্তিতাআতবা রাষ্ট্রীয় আনুগত্য থেকে নিজেকে বের করে নিল সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হলে নিজের জন্য কোন ওজর পেশ করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তিবাইআত’ (রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের অঙ্গীকার)-বিহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল (অন্য বর্ণনায়: যে ব্যক্তি ইমাম-বিহীনভাবে মৃত্যুবরণ করল) সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’[3]

ইবন আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


مَنْ رَأَى مِنْ أَمِيرِهِ شَيْئًا يَكْرَهُهُ فَلْيَصْبِرْ عَلَيْهِ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَمَاتَ إِلا مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً

‘‘কেউ তার শাসক-প্রশাসক থেকে কোন অপছন্দনীয় বিষয় দেখলে তাকে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। কারণ যদি কেউ জামাআতের (মুসলিম সমাজ বা রাষ্টের ঐক্যের) বাইরে এক বিঘতও বের হয়ে যায় এবং অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তাহলে সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করবে।’’[4]

এভাবে সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বহাল রাখা এবং ইসলামবিরোধী নয় এরূপ বিষয়ে সরকারের আনুগত্য করাই ইসলামের নির্দেশ। উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ سَلِمَ وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلا نُقَاتِلُهُمْ قَالَ لا مَا صَلَّوْا

‘‘অচিরেই তোমাদের উপর অনেক শাসক-প্রশাসক আসবে যারা ন্যায় অন্যায় উভয় প্রকারের কাজ করবে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায়কে ঘৃণা করবে সে অন্যায়ের অপরাধ থেকে মুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি আপত্তি করবে সে (আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে) নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে সকল অন্যায় কাজ মেনে নেবে বা তাদের অনুসরণ করবে (সে বাঁচতে পারবে না।)’’ সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বলেন, ‘‘না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করবে।’’[5]

যদি কোনো নাগরিক তার সরকারের অন্যায় সমর্থন করেন বা অন্যায়ের ক্ষেত্রে সরকারের অনুসরণ করেন তবে তিনি সরকারের পাপের ভাগী হবেন। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা, চাকরী, কর্ম বা রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের কারণে কোনো নাগরিক পাপী হবে না। আউফ ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


أَلا مَنْ وَلِيَ عَلَيْهِ وَالٍ فَرَآهُ يَأْتِي شَيْئًا مِنْ مَعْصِيَةِ اللَّهِ فَلْيَكْرَهْ مَا يَأْتِي مِنْ مَعْصِيَةِ اللَّهِ وَلا يَنْزِعَنَّ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ

‘‘হুশিয়ার! তোমাদের কারো উপরে যদি কোনো শাসক-প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং সে দেখতে পায় যে, উক্ত শাসক বা প্রশাসক আল্লাহর অবাধ্যতার কোনো কাজে লিপ্ত হচ্ছেন, তবে সে যেন আল্লাহর অবাধ্যতার উক্ত কর্মকে ঘৃণা করে, তবে সে আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেবে না।’’[6]

আরো অনেক হাদীসে পক্ষপাতিত্ব, যুলুম পাপে লিপ্ত শাসক বা সরকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরূপ শাসক বা সরকার কোনো ইসলাম বিরোধী নির্দেশ প্রদান করলে তা পালন করা যাবে না। আবার অন্যায় নির্দেশের কারণে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতাও করা যাবে না। বরং রাষ্ট্রীয় সংহতি আনুগত্য বজায় রাখতে হবে। তবে শাসক বা প্রশাসক সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত সুস্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত হলে বিদ্রোহ বা আনুগত্য পরিত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও ‘‘তাকফীর’’ বিষয়ক ইসলামের মূলনীতি অনুসরণ করতে হবে।[7]

উল্লেখ্য যে, খারিজী শীয়াগণ ‘‘ইমাম’’, ‘‘জামআত’’ ইত্যাদি পরিভাষার বিকৃতি সাধন করেন। শিয়াগণ ‘‘ইমাম’’ শব্দটির অর্থ বিকৃত করে। সাহাবীগণ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগণতান্ত্রিক জনগণের পরামর্শের মাধ্যমে ইমাম, খলীফা বা শাসক নিয়োগ লাভ করবেন। সবচেয়ে যোগ্য বা মুত্তাকী হওয়াও আবশ্যক নয়। কিন্তু শীয়া বিশ্বাস অনুসারে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা রাজতান্ত্রিক-যাজকতান্ত্রিক। রাষ্ট্রীয় ইমামত, খিলাফাত বা শাসকের পদ বংশগতভাবে নবী-বংশের পাওনা

তারা দাবি করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর ওফাতের পরে মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব আলী (রা) তাঁর বংশের নির্ধারিত কয়েক ব্যক্তিকে প্রদান করেন। কিন্তু আবু বকর, উমার, উসমান অন্যান্য সকল সাহাবী (রাঃ) মুরতাদ হয়ে (নাঊযু বিল্লাহ!) ষড়যন্ত্র করে তাঁদেরকে বঞ্চিত করেন। কাজেই আলী বংশের মানুষগুলিই প্রকৃতইমাম তারা ‘‘ইমাম’’ পদবীকে রাষ্ট্রপ্রধানের বাইরে ১২ ইমাম বা ইমামের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন। তাদের ইমামগণ লুক্কায়িত থাকতেন। বিশেষ করে তাদের বিশ্বাস অনুসারে দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মাদ আল-মাহদী কিশোর বয়সে ২৬৫ হিজরী সালের দিকে গায়েব হয়ে গিয়েছেন এবং এখন পর্যন্ত গাইবে থেকেই বিশ্ব শাসন করছেন। কাজেই ‘‘ইমাম’’-এর আনুগত্য বা বাইয়াত মুল বিষয় নয়, ‘‘পরিচয় জানা’’ মূল বিষয়। এজন্য তারা আনুগত্যের বদলে ‘‘পরিচয় জানা’’ মর্মে জাল হাদীস তৈরি করেন। এরূপ একটি জাল হাদীস:


مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَعْرِفْ إِمَامَ زَمَانِهِ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً

‘‘যে ব্যক্তি তার যুগের ইমামকে না জেনে মরল সে জাহিলী মৃত্যু মরল।’’[8]

পক্ষান্তরে সহীহ হাদীসে ইমামের পরিচয় লাভ নয়, আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে, তবে যুগের ইমাম নয়, বরং রাষ্ট্রের ইমাম

খারিজীগণ তাদের মতের বিরোধী সকল মুসলিমকে কাফির বলেন। এজন্য তারা তাদেরদল’-কেই ‘‘জামাআতুল মুসলিমীন’’ বলে দাবি করতেন। তাদের মধ্য থেকে কাউকে নেতা নির্বাচন করে তাকেই ‘‘ইমাম’’ বলে গণ্য করতেন। এভাবে তারা জামাআত শব্দটিকেফিরকাঅর্থে এবংইমামশব্দটিকেআমীরঅর্থে ব্যবহার করেন। ইসলামেজামাআতবা ঐক্যের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবংফিরকাতাফার্রুক’, অর্থাৎ দল, বিভক্তি দলাদলি নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু খারিজীগণের ব্যবহারে ফিরকা বা দলকেইজামাআতবলা হতে থাকল। উপরন্তু অনেকেবিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়াবাকোনো না কোনো দলে থাকা’-কে ফরয মনে করলেন এবং ফিরকার আমীরকেইইমামবলতে লাগলেন। এভাবে ইসলাম নিষিদ্ধদলাদলি’-কে তারা ফরয বানিয়ে ফেললেন। তাঁরা ইসলাম নিষিদ্ধ একটি বিষয়কেদীনবানালেন!

[1] আহমদ, আল-মুসনাদ, /৯৬, আবু ইয়ালা আল-মাউসিলী, আল-মুসনাদ ১৩/৩৬৬, ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১০/৪৩৪, তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর ১৯/৩৮৮, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /২১৮, ২২৫ আলবানী, যিলালুল জান্নাহ /২৪৬ আলবানী হাদীসটির সনদ হাসান বলেছেন
[2]
সহীহ মুসলিম /১৪৭৬-১৪৭৭ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবুল আমরি বিলুযূমিল জামাআতি)
[3]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৭৮ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবুল আমরি বিলুযূমিল জামাআতি); অন্য বর্ণনাটি: তায়ালিসী, আবু দাউদ, আল-মুসনাদ /২৫৯, নং ১৯১৩, আবু নুআইম ইসপাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া /২২৪ আবু নুআইম বলেন: বর্ণনাটির সনদ সহীহ
[4]
বুখারী, আস-সহীহ /২৫৮৮, ২৬১২ (কিতাবুল ফিতান, বাবু কাওলিন নাবিয়্যিসাতারাওনা বাদী উমূরান...কিতাবুল আহকাম, বাবুস সাময়ি..) মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৭৭ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবুল আমরি বিলুযূমিল জামাআতি)
[5]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৮০, ১৪৮১ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবু উজূবিল ইনকার আলাল উমারা)
[6]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৮২ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবু খিয়ারিল আইম্মাহ ওয়া শিরারিহিম)
[7]
বুখারী, আস-সহীহ /২৫৮৮ (কিতাবুল ফিতান, বাবু কাওলিন নাবিয়্যি (ﷺ): সাতারাওনা বাদী উমূরান..) মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৬৭ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবুল ওয়াফা বিবাইঅতিল খুলাফা); দানী, আস-সুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান - খন্ড
[8]
আলবানী, যায়ীফাহ /৫২৫

 ১০. . ব্যক্তির পাপ-পুণ্য বনাম সমাজ রাষ্ট্রের পাপ-পুণ্য

এখানে আরো লক্ষণীয় সমাজ বা রাষ্ট্রের পাপের কারণে মুমিনের নিজ ইবাদত পালনে অবহেলা। অনেক সময় আবেগী মুসলিম মনে করেন, ‘‘নামায পড়ব কার পিছে? সবাই তো বিভিন্ন পাপ বা অপরাধে জড়িত’’, অথবা মনে করেন: ‘‘এত পাপ, জুলুম বা কুফরের মধ্যে থেকে জুমুআ, জামাআত ইত্যাদি করে কি লাভ? অথবা আগে সকল পাপ, জুলুম ইত্যাদি দূর করি, এরপর জুমুআ-জামাআত পালন করব

আবেগ মুমিনকে ভুল পথে পরিচালিত করে। মুমিনের মূল দায়িত্ব নিজের জীবনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত অনুসারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইসলাম প্রতিষ্ঠা প্রতিপালন করা। পাশাপাশি তিনি অন্যদেরকে সাধ্যমত দীন পালন প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দিবেন। অন্যের পাপের দায়ভার তার নয়। তার সাধ্যমত দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ, আপত্তি বা ঘৃণার পরেও সমাজের সকল মানুষ, অধিকাংশ মানুষ এবং সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমাম পাপে লিপ্ত থাকলে সে জন্য তিনি দায়ী হবেন না বা তার দীনদারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। পাপের প্রতি ঘৃণা আপত্তি-সহ পাপী সমাজে বাস করা, পাপী ইমামের পিছনে সালাত আদায় করা বা পাপী শাসকের আনুগত্য করার অর্থ তার পাপের স্বীকৃতি দেওয়া নয় বা তার পাপের অংশী হওয়া নয়; বরং ঐক্য বাজামাআতরক্ষায় নিজের দীনী দায়িত্ব পালন করা। মহান আল্লাহ বলেন:


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ

‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর শুধু তোমাদের নিজেদের দায়িত্ব। তোমরা যদি সৎপথে থাক তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।’’[1]

পাপী শাসক-প্রশাসকদের পিছনে সালাতের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


يُصَلُّونَ لَكُمْ فَإِنْ أَصَابُوا فَلَكُمْ وَإِنْ أَخْطَئُوا فَلَكُمْ وَعَلَيْهِمْ

‘‘তারা তোমাদের জন্য সালাত আদায় করবে। যদি তারা সঠিক করে তবে তোমরা সাওয়াব পাবে। আর তারা যদি অপরাধ করে তবে তোমরা সাওয়াব পাবে এবং তারা পাপী হবে।’’[2]

৩৫ হিজরী সালে খলীফা উসমান (রা)-কে মদীনায় অবরুদ্ধ করে একদল বিদ্রোহী পাপাচারী এবং শেষে তারা তাঁকে নির্মমভাবে শহীদ করে। পাপিষ্ট বিদ্রোহীরা মসজিদে নববীর ইমামতি দখল করে। এরূপ ইমামের পিছনে সালাত আদায় বিষয়ে অবরুদ্ধ উসমান (রা)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:


الصَّلاةُ أَحْسَنُ مَا يَعْمَلُ النَّاسُ فَإِذَا أَحْسَنَ النَّاسُ فَأَحْسِنْ مَعَهُمْ وَإِذَا أَسَاءُوا فَاجْتَنِبْ إِسَاءَتَهُمْ

‘‘মানুষ যত কর্ম করে তার মধ্যে সালাত সবচেয়ে ভাল কর্ম। যখন মানুষ ভাল কর্ম করে তখন তাদের সাথে তুমিও ভাল কর্ম কর। আর যখন তারা অন্যায় করে তখন তুমি তাদের অন্যায় বর্জন কর।’’[3]

রাষ্ট্রীয় পাপ ইসলাম বিরোধিতার প্রসার ঘটে উমাইয়া যুগে। সাহাবীগণ পাপের বিরোধিতার পাশাপাশি পাপী ইমামের পিছনে সালাত আদায় করতেন তাদের নেতৃত্বে জিহাদ অন্যান্য ইবাদত পালন করতেন। তারিক ইবন শিহাব বলেন:


أَوَّلُ مَنْ بَدَأَ بِالْخُطْبَةِ يَوْمَ الْعِيدِ قَبْلَ الصَّلاةِ مَرْوَانُ فَقَامَ إِلَيْهِ رَجُلٌ فَقَالَ الصَّلاةُ قَبْلَ الْخُطْبَةِ فَقَالَ قَدْ تُرِكَ مَا هُنَالِكَ فَقَالَ أَبُو سَعِيدٍ أَمَّا هَذَا فَقَدْ قَضَى مَا عَلَيْهِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ

‘‘প্রথম যে ব্যক্তি সালাতুল ঈদের খুতবা সালাতের আগে নিয়ে আসে সে মারওয়ান ইবনুল হাকাম। তখন এক ব্যক্তি তার দিকে দাঁড়িয়ে বলে, খুতবার আগে সালাত। মারওয়ান বলেন: তৎকালীন নিয়ম পরিত্যক্ত হয়েছে। তখন আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি: ‘তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় দেখে তবে সে যেন তা তার বাহুবল দিয়ে পরিবর্তন করে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে সে যেন তার বক্তব্য দিয়ে তা পবিবর্তন করে। এতেও যদি সক্ষম না হয় তাহলে সে যেন তার অন্তর দিয়ে তা পরিবর্তন (কামনা) করে, আর হলো ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’[4]

এখানে অন্যায়্যের প্রতিবাদের সমর্থন-সহ আবূ সাঈদ খুদরী (রা) মারওয়ানের পিছনে সালাত আদায় করেছেন

প্রসিদ্ধ সাহাবী আবূ আইঊব আনসারী (রা) ইয়াযিদ ইবন মুআবিয়ার নেতৃত্বে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেন।[5] অন্যান্য প্রসিদ্ধ সাহাবীও উমাইয়া যুগে ইয়াযিদ অন্যান্য ফাসিক ইসলাম বিরোধী আইন-কানুন বিধিবিধানে লিপ্ত (খারিজী শীয়া বিচারে কাফির) শাসক আমীরদের অধীনে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন বা রাষ্ট্রীয় চাকরী দায়িত্ব পালন করেছেন। ইয়াযিদ পরবর্তী উমাইয়া শাসকদের সবচেয়ে কুখ্যাত প্রশাসক ছিলেন হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ। আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) অন্যান্য সাহাবী হাজ্জাজের ইমামতিতে আরাফার মাঠে সালাত আদায় করতেন।[6]

উমাইয়া প্রশাসক ওয়ালীদ ইবন উকবা মদপান করতেন। তিনি একদিন মাতাল অবস্থায় ফজরের সালাতে ইমামতি করেন। তার পিছনে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) জামাআতে শরীক ছিলেন। ওয়ালীদ মাতাল অবস্থায় থাকার কারণে ফজরের সালাত চার রাকআত আদায় করেন এবং সালাম ফিরিয়ে বলেন: কম হলো কি? আরও লাগবে? তখন ইবন মাসঊদ (রা) মুসল্লীগণ বলেন: আজ সকালে তো আপনি বেশি বেশিই দিচ্ছেন (ইতোমধ্যেই দু রাকআত বেশি দিয়েছেন! আর লাগবে না!)’’[7]

এখানে ইবন মাসঊদ (রা) ইমামের পাপ, মদপান ইত্যাদির কারণে বিদ্রোহ বা তার পিছনে সালাত পরিত্যাগ করে একাকী সালাতের মত প্রকাশ করেন নি। কারণ জুমুআ, সালাতের জামাআত ইত্যাদি ইসলামী সমাজের ঐক্য, সংহতি বাজামাআতেরমূল ভিত্তি। জামাআত রক্ষা করা অন্যতম দীনী দায়িত্ব। অন্যের পাপের কারণে মুমিন নিজের দীনী দায়িত্ব বর্জন করতে পারেন না

ইমাম বুখারী তাঁর আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে তাবিয়ী আব্দুল কারীম বাক্কা থেকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘‘আমি দশজন সাহাবীর সঙ্গ পেয়েছি যারা পাপী-জালিম শাসক-প্রশাসকদের পিছনে সালাত আদায় করতেন।’’[8]

[1] সূরা () মায়িদা: ১০৫ আয়াত
[2]
বুখারী, আস-সহীহ /২৪৬ (কিতাবুল জামাআত, বাবু ইযা লাম ইউতিম্মিল ইমাম...)
[3]
বুখারী, আস-সহীহ /২৪৬ (কিতাবুল জামাআত, বাবু ইমামাতিল মাফতূন ওয়াল মুবতাদি)
[4]
মুসলিম, আস-সহীহ /৬৯ (কিতাবুল ঈমান, বাবু ... নাহই আনিল মুনকারি মিনাল ঈমান)
[5]
ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী /১০৩
[6]
বুখারী, আস-সহীহ /৫৯৭ (কিতাবুল হাজ্জ, বাবুত তাহজীরি বির-রাওয়াহ ইয়াওমা আরাফা)
[7]
যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা /৪১৪
[8]
বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর /৯০

১০. . পাপীর পিছনে সালাতের বিধান

পাপী ইমামের পিছনে সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি নিম্নরূপ:

() সালাতের ইমাম যদি রাষ্ট্রপ্রধান, প্রশাসক বা রাষ্ট্র নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি হন তবে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন শিরক-কুফর প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তার পিছনে সালাত আদায় করতে হবে। তার পাপের প্রতি ঘৃণা, আপত্তি সাধ্যমত শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-সহ তার পিছনে সালাত আদায় রাষ্ট্রীয় জামাআত বা ঐক্য সংহতি বজায় রাখার জন্য ইসলামের নির্দেশনা সাহাবীগণের সুন্নাত

() যদি কোনো মসজিদের নিয়মিত নিযুক্ত ইমাম পাপী হন তবে তার নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ পাপী হবেন। সাধারণ মুসল্লী যদি অন্য কোনো ভাল ইমামের পিছনে সালাত আদায়ের সুযোগ পান তাহলে ভাল, নইলে এরূপ পাপী ইমামের পিছনেই সালাত আদায় করতে হবে। নেককার ইমামের পিছনে সালাত আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সুস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থহীন কুফর-শিরক না পাওয়া পর্যন্ত কোনো অজুহাতে জামাআত জুমুআ পরিত্যাগ করা যাবে না। কোনোভাবেইজামাআতবা ঐক্য নষ্ট করা যাবে না। ঐক্য বজায় রেখে উত্তম ইমামের জন্য চেষ্টা করতে হবে। বিষয়ে হানাফী ফকহীগণ বলেছেন:


وَلَوْ صلى خَلْفَ مُبْتَدِعٍ أو فَاسِقٍ فَهُوَ مُحْرِزٌ ثَوَابَ الْجَمَاعَةِ لَكِنْ لا يَنَالُ مِثْلَ ما يَنَالُ خَلْفَ تَقِيٍّ

‘‘যদি কেউ কোনো বিদআত-পন্থী বা ফাসিক-পাপাচারীর পিছনে সালাত আদায় করে তবে সে জামাআতের সাওয়াব লাভ করবে; তবে মুত্তাকী ইমামের পিছনে সালাত আদায়ের মত সাওয়াব পাবে না।’’[1]

() যার ইমাম নিয়োগ দেওয়ার বা মসজিদ বাছাই করার সুযোগ আছে তাকে অবশ্যই সুন্নাতের নির্দেশনা অনুসারে মুত্তাকী, কারী আলিম ইমাম নিয়োগের বা তার পিছনে সালাত আদায়ের চেষ্টা করতে হবে

[1] আল-ফাতাওয়া হিনদিয়্যাহ /৮৪ আরো দেখুন: ইবনুল হুমাম, শারহু ফাতহিল কাদীর /৩৫০; ইবন নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক /২২৯; বুরহান উদ্দীন ইবন মাযাহ, আল-মুহীত আল-বুরহানী /১০২; যাইলায়ী, তাবয়ীনুল হাকায়িক /১৫৯, ১৬২; তাহতাবী, হাশিয়াতুত তাহতাবী আলা মারাকীল ফালাহ /২০৪; শুরনুবলালী, মারাকিল ফালাহ, পৃ. ১৪৩

 ১০. . ব্যক্তিগত ইবাদত বনাম রাষ্ট্রীয় ইবাদত

ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। কুরআন হাদীসে মানব জীবনের সকল দিকের বিধিবিধান বিদ্যমান। কোনো বিধান ব্যক্তিগতভাবে পালনীয়, কোনো বিধান সামাজিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনীয়। প্রত্যেক বিধান পালনের জন্য নির্ধারিত শর্তাদি রয়েছে। কুরআনেসালাতপ্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবার কুরআনেচোরের হাত কাটার’, ‘ব্যভিচারীর বেত্রাঘাতেরজিহাদবাকিতালেরনির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রথম ইবাদতটি ব্যক্তিগত, সামাজিক রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনীয়। অন্য কেউ পালন না করলেও মুমিনকে ব্যক্তিগভাবে পালন করতেই হবে। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ নির্দেশটিরাষ্ট্রীয়ভাবেপালনীয়। কখনোই একজন মুমিন তা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত-ভাবে পালন করতে পারেন না। কোন্টি ব্যক্তিগত কোন্টি রাষ্ট্রীয় তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীগণের কর্মধারা থেকে জানতে হবে

 ১০. . . সালাত সালাতের জামাআত

আমরা দেখছি যে, সালাতের মধ্যে ব্যক্তিগত সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় দুটি দিক রয়েছে। সালাত ইসলামের অন্যতম রুকন। যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো স্থানে মুমিনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরয আইন ইবাদত ‘‘সালাত’’ আদায় করা। আর সালাতের একটি বিশেষ দিক ‘‘জামাআত’’ মুমিনের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত জামাআতে আদায় করা জরুরী। ফকীহগণের কেউ জামাআতফরয’, কেউওয়াজিবএবং কেউওয়াজিব পর্যায়ের সুন্নাতবলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে সকলেই একমত যে, বিশেষ ওজর ছাড়াজামাআতপরিত্যাগ করে একাকী সালাত আদায় করা কঠিন গোনাহের কাজ। আর জুমুআর সালাত ঈদের সালাত জামাআতে আদায় করা শর্ত

সুন্নাতের নির্দেশনা অনুসারে জামাআতের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা, যোগ্য ইমাম নিয়োগ ইত্যাদি মুমিনের ব্যক্তিগত ফরয ইবাদত নয়, রাষ্ট্র বা সমাজের সামষ্টিক ফরয বাফরয কিফায়াইবাদত। এক্ষেত্রে যাদের দায়িত্ব ক্ষমতা রয়েছে তারা অবহেলা করলে পাপী হবেন। ব্যক্তি মুমিন সাধ্যমত চেষ্টা, অন্যায়ের আপত্তি সত্যের দাওয়াত দিবেন। কিন্তু অন্যের পাপের কারণে বা অন্যের উপর রাগ করে নিজেরজামাআতরক্ষার দায়িত্ব নষ্ট করে নিজে পাপে লিপ্ত হবেন না। সমাজের পাপের প্রতিবাদে নিজেজামাত তরকেরপাপে লিপ্ত হওয়া ইসলামের নির্দেশনা সাথে সাংঘর্ষিক

 ১০. . . হজ্জ, ঈদুল আযহা ঈদুল ফিতর

সালাত ছাড়া আরো দুটি রাষ্ট্র-সংশ্লিষ্ট ইবাদতের কথা তাহাবী উল্লেখ করেছেন: হজ্জ জিহাদ। অন্যান্য আকীদাবিদ ফকীহ সালাতুল জুমুআ দু ঈদের কথাও উল্লেখ করেছেন। প্রসিদ্ধ কালামবিদ ইমাম আবুল হাসান আশআরী (৩২৪হি) বলেন:


ومن ديننا أن نصلي الجمعة والأعياد وسائر الصلوات والجماعات خلف كل بر وفاجر كما روى أن عبد الله بن عمر كان يصلي خلف الحجاج

‘‘আর আমাদের দীনের অন্যতম দিক যে, আমরা জুমুআর সালাত, ঈদগুলো এবং অন্যান্য সকল সালাত এবং জামাআত সকল নেককার বদকারের পিছনে আদায় করি। যেমনিভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের পিছনে সালাত আদায় করতেন।’’[1]

হজ্জ ইসলামের পাঁচ রুকনের শেষ রুকন। এটি মূলত ব্যক্তিগত ফরয ইবাদত। মুমিন যে কোনো অবস্থায় হজ্জ ফরয হলে তা আদায় করবেন। পাশাপাশি হজ্জের ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রীয় বিষয়। হজ্জের তারিখ ঘোষণা, কার্যক্রম পরিচালনা, আরাফাত, মুযদালিফা, মিনায় ইমাম নিযুক্ত করা ইত্যাদি কর্ম অবশ্যই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা বা রাষ্ট্রপ্রধানের পাপ, অন্যায়, ইসলাম বিরোধী মতামত বা জুলুমের কারণে এক্ষেত্রে হজ্জ বন্ধ করা বা রাষ্ট্র ঘোষিত চাঁদ দেখাকে বাতিল করে নিজেদের ইচ্ছামত হজ্জ আদায় করা মুমিনের জন্য বৈধ নয়

ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফিতরেরও একই বিধান। হাদীস শরীফেচাঁদ দেখে সিয়াম ঈদুল ফিতরেরনির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ নয় যে, যে কেউ যেখানে ইচ্ছা চাঁদ দেখলেই ঈদ করা যাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার সাক্ষ্য গৃহীত হলে বা চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলেই শুধু ঈদ করা যাবে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সমাজের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ঈদ পালন করতে নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


الْفِطْرُ يَوْمَ يُفْطِرُ النَّاسُ وَالأَضْحَى يَوْمَ يُضَحِّي النَّاسُ

‘‘যে দিন সকল মানুষ ঈদুল ফিত্র পালন করবে সে দিনই ঈদুল ফিত্র-এর দিন এবং যেদিন সকল মানুষ ঈদুল আযহা পালন করবে সে দিনই ঈদুল আযহার দিন।’’[2]

প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাসরূক বলেন, আমি একবার আরাফার দিনে, অর্থাৎ যিলহাজ্জ মাসের তারিখে আয়েশা (রা)-এর নিকট গমন করি। তিনি বলেন, মাসরূককে ছাতু খাওয়াও এবং তাতে মিষ্টি বেশি করে দাও। মাসরূক বলেন, আমি বললাম, আরাফার দিন হিসাবে আজ তো রোযা রাখা দরকার ছিল, তবে আমি একটিমাত্র কারণে রোযা রাখি নি, তা হলো, চাঁদ দেখার বিষয়ে মতভেদ থাকার কারণে আমার ভয় হচ্ছিল যে, আজ হয়ত চাঁদের দশ তারিখ বা কুরবানীর দিন হবে। তখন আয়েশা (রা) বলেন:


اَلنَّحْرُ يَوْمَ يَنْحَرُ الإِمَامُ وَالْفِطْرُ يَوْمَ يُفْطِرُ الإِمَامُ

যেদিন রাষ্ট্রপ্রধান কুরবানীর দিন হিসাবে পালন করবেন সে দিনই কুরবানীর দিন। আর যেদিন রাষ্ট্রপ্রধান ঈদুল ফিতর পালন করবে সে দিনই ঈদের দিন।’’[3]

মুমিনের জন্য নিজ দেশের সরকার জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে ঈদ করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ। অন্য দেশের খবর তো দূরের কথা যদি কেউ নিজে চাঁদ দেখেন কিন্তু রাষ্ট্র তার সাক্ষ্য গ্রহণ না করে তাহলে তিনিও একাকী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপরীতে ঈদ করতে পারবেন না। সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, এক্ষেত্রে ভুল হলেও ঈদ, হজ্জ, কুরবানী সবই আদায় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ভুলের জন্য মুমিন কখনোই দায়ী হবেন না।[4]

সরকারের পাপাচার বা ইসলাম বিরোধিতার অজুহাতে সকল ক্ষেত্রে সরকারী সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করা শরীয়ত নিষিদ্ধ। কোনো মুসলিম দেশকেদারুল হারববাতাগূতীরাষ্ট্র বলে গণ্য করা খারিজী শীয়াগণের পদ্ধতি। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত শাসক বা সরকারের পাপ বা কুফরীর কারণে মুসলিমদের দেশকে কাফিরের দেশ বানান নি। ইয়াযীদের জুলম-পাপের রাষ্ট্র, মামূনের কুফরী মতবাদের রাষ্ট্র, আকবারের দীন ইলাহীর রাষ্ট্র অন্যান্য সকল মুসলিম রাষ্ট্রকেই তারাদারুল ইসলামহিসেবে গণ্য করেছেন এবং জুমুআ, জামাআত, ঈদ, জিহাদ, হজ্জ ইত্যাদি সকল বিষয়ে এরূপ সকল দেশে দারুল ইসলামের আহকাম পালন করেছেন

বর্তমানেসারা বিশ্বে একদিনে ঈদবিষয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। তবেসকল দেশে একদিনে ঈদপালনের নামেএকই দেশে একাধিক দিনে ঈদপালন নিঃসন্দেহে ইসলামী নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। বিষয়টি নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণা মতবিনিময় অবশ্যই হতে পারে। রাষ্ট্র যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্য কোনো দেশের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করে ঘোষণা দেয় তবে জনগণ তা অনুসরণ করবে। তবে আমাদের বুঝতে হবে যে, মহান আল্লাহ ইসলামকে সহজ-পালনীয় করেছেন। বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে বিশ্বের কোথাও চাঁদ উঠলে সকল দেশেই তা জানা সম্ভব। কিন্তু অতীতে তা ছিল না। আর দূরবর্তী এলাকার চাঁদের খবর নিতে কেউ চেষ্টা করেন নি। মদীনায় চাঁদ দেখার পরে -ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহায় রাতারাতি বা দিনের মধ্যে- দ্রুত দূরবর্তী অঞ্চলে সংবাদ প্রদানের চেষ্টা বা সর্বত্র একই দিনে ঈদ হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার চেষ্টা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা খুলাফায়ে রাশেদীন করেন নি। সাহাবীগণের যুগ থেকেই একাধিক দিবসে ঈদ হয়েছে।[5] একাধিক দিনে ঈদ পালন বিষয়ক হাদীসটি উদ্ধৃত করে ইমাম তিরমিযী বলেন:


وَالْعَمَلُ عَلَى هَذَا الْحَدِيثِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ أَنَّ لِكُلِّ أَهْلِ بَلَدٍ رُؤْيَتَهُمْ

‘‘আলিমগণের সিদ্ধান্ত হাদীসের উপরেই: প্রত্যেক দেশের মানুষ তাদের নিজেদের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করবে।’’[6]

বস্ত্তত, সাহাবী-তাবিয়ীগণ পরবর্তী আলিমগণ বিভিন্ন দেশে একাধিক দিনে ঈদ পালনকে ইসলামী নির্দেশনার বিরোধী বলে গণ্য করেন নি। পক্ষান্তরে একই রাষ্ট্রের মধ্যে বা একই ইমামের (রাষ্ট্রপ্রধানের) অধীনে একাধিক দিনে ঈদ পালনকে সকলেই নিষিদ্ধ, অবৈধ ইসলামী নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক বলে গণ্য করেছেন

[1] আবুল হাসান আশআরী, আল-ইবানাহ, পৃষ্ঠা ২০
[2]
তিরমিযী, আস-সুনান /১৬৫ (কিতাবুস সাওম, বাবু মা জাআ ফিল ফিতরি ওয়াল আদহা মাতা ইয়াকূনু) তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন
[3]
বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা /১৭৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ /১৯০; মুনযিরী, তারগীব /৬৮ মুনযিরী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন
[4]
ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর /২৫৬
[5]
মুসলিম, আস-সহীহ /৭৬৫ (কিতাবুস সাওম, বাবু ... লিকুল্লি বালাদিন রুইয়াতুহুম)
[6]
তিরমিযী, আস-সুনান /৭৬ (কিতাবুস সাওম, বাবু ...লিকুল্লি আহলি বালাদিন রুইয়াতুহুম)

 ১০. . . জিহাদ

 জিহাদঅর্থ প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, পরিশ্রম বা কষ্ট। নিয়মিত পরিপূর্ণ ওযূ, জামাতে সালাত, হজ্জ, আল্লাহর আনুগত্য-মূলক বা আত্মশুদ্ধি-মূলক কর্ম, হক্কের দাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতকে হাদীস শরীফে ‘‘জিহাদ’’ বা ‘‘শ্রেষ্ঠতম জিহাদ’’ বলা হয়েছে। তবে ইসলামী পরিভাষায় জিহাদ অর্থ ‘‘মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ।’’ যুদ্ধেরই নাম কিতাল। পারিভাষিক ভাবে জিহাদ কিতাল একই বিষয়।[1]

জিহাদের মাধ্যমে জীবন সম্পদ কুরবানি দেওয়া অত্যন্ত বড় ত্যাগ। এজন্য ইবাদতের পুরস্কারও অভাবনীয়। কুরআন হাদীসে জিহাদের অফুরন্ত পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে এবং ইবাদত পালনের জন্য বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সকল আয়াত হাদীসের অর্থ জিহাদ যখন বৈধ বা জরুরী হবে তখন যে ব্যক্তি মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠে জিহাদের দায়িত্ব পালন করবে তখন সে পুরস্কার লাভ করবে

জিহাদের আগ্রহ মুমিনের হৃদয়ে থাকবে। জিহাদের মাধ্যমে জীবন সম্পদের কুরবানীর প্রতি অনীহা ঈমানী দুর্বলতার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ ، وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ

‘‘যদি কেউ এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, সে yুদ্ধ অংশগ্রহণ করে নি এবং যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণের কোনো কথাও নিজের মনকে কখনো বলে নি, তবে সে ব্যক্তি মুনাফিকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করবে।’’[2]

আমরা দেখব যে, সাধারণভাবে জিহাদ ফরয কিফায়া এবং কখনো কখনো ফরয আইন। ফরয কিফায়া অবস্থায় যদি সকল মুসলিম তা পরিত্যাগ করে এবং ফরয আইন অবস্থায় যদি মুসলিমগণ তা পরিত্যাগ করে তবে তা তাদের জাগতিক লাঞ্ছনা বয়ে আনবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِذَا تَبَايَعْتُمْ بِالْعِينَةِ، وَأَخَذْتُمْ أَذْنَابَ الْبَقَرِ، وَرَضِيتُمْ بِالزَّرْعِ، وَتَرَكْتُمْ الْجِهَادَ، سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ذُلا لا يَنْزِعُهُ حَتَّى تَرْجِعُوا إِلَى دِينِكُمْ

‘‘যখন তোমরা অবৈধ ব্যবসাবাণিজ্যে লিপ্ত হবে, গবাদিপশুর লেজ ধারণ করবে, চাষাবাদেই তুষ্ট থাকবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দিবেন, দীনে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত যা তিনি অপসারণ করবেন না।’’[3]

সকল ফযীলত নির্দেশনা বিষয়ক আয়াত হাদীসকে নিজেদের আবেগ অনুসারে ব্যাখ্যা করে খারিজীগণ জিহাদকে ফরয আইন বলে দাবি করেন। তারা ন্যায়ের আদেশ-অন্যায়ের নিষেধ এবং জিহাদের মধ্যে পার্থক্য করেন না। এমনকি তারা জিহাদকে ইসলামের ষষ্ঠ রুকন বা বড় ফরয বলে গণ্য করেন। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ, দীন প্রতিষ্ঠা বা জিহাদের নামে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে আইন হাতে তুলে নিয়েছেন বা সশস্ত্র প্রতিরোধ, আক্রমণ, হত্যা ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত হয়েছেন।[4]

তাদের বিপরীতে শীয়াগণ ‘‘মাসূম (নিষ্পাপ) ইমাম-এর নেতৃত্ব ছাড়া জিহাদ হবে না’’ বলে দাবি করেন। তাদের বিশ্বাসে দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মাদ আল-মাহদী (২৫৬-২৭৫ হি) ২৭৫ হিজরী সাল থেকে অদৃশ্য জগতে লুকিয়ে রয়েছেন। তিনিই ইমাম মাহদী হিসেবে আবির্ভূত হবেন। তাঁর আবির্ভাবের পরে তাঁর নেতৃত্বে জিহাদ করতে হবে।[5]

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত জিহাদকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সামষ্টিক ফরয বা ফরয কিফায়া বলে গণ্য করেছেন। ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধ মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে আদায় করতে পারেন। কিন্তু জিহাদ অবশ্যই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে হবে। খারিজী শীয়া মতের সাথে তাদের মৌলিক তিনটি পার্থক্য রয়েছে: () জিহাদ ফরয কিফায়া ইবাদত, () জিহাদের জন্য রাষ্টপ্রধানের নেতৃত্ব জরুরী এবং () রাষ্ট্রপ্রধানের মুত্তাকী বা নেককার হওয়া জরুরী নয়। আমরা তৃতীয় বিষয়টি ইতোপূর্বে জেনেছি। এখানে অন্য দুটি বিষয় পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ

[1] বিস্তারিত দেখুন: . খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ,পৃ. ১০৫-১০৬
[2]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৫১৭
[3]
আবূ দাউদ, আস-সুনান /২৭৪; আলবানী, সাহীহাহ /১৫ হাদীসটি সহীহ
[4]
বিস্তারিত দেখুন: . খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ,পৃ. ৬১-৮৪
[5]
ইবন আবিল ইয্য হানাফী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২৫৮; আব্দুল আযীয রাজিহী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২৯০

 ১০. . . জিহাদ ফরয কিফায়া

আমরা বলেছি যে, খারিজীগণ জিহাদকে ফরয আইন প্রমাণের জন্য জিহাদের ফযীলত নির্দেশ বিষয়ক সাধারণ আয়াত হাদীস পেশ করেন। উপরে কয়েকটি হাদীস আমরা উল্লেখ করেছি। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন:


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ فَانْفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انْفِرُوا جَمِيعًا

‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের সতর্কতা অবলম্বন কর এবং (যুদ্ধে) বেরিয়ে যাও দলে দলে অথবা বেরিয়ে যাও একত্রে।’’[1]

খারিজীগণ বলেন, সকল আয়াত হাদীসে মুমিনদেরকে জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং জিহাদ পরিত্যাগ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কারো অনুমতি বা নেতৃত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয় নি। এতে প্রমাণ হয় যে, জিহাদ ফরয আইন, এর জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই

তাঁরা বলেন: মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমাদের উপর সিয়াম লিপিবদ্ধ করা হলো’’[2] এবং তিনিই বলেছেন: ‘‘ তোমাদের উপর কিতাল (যুদ্ধ) লিপিবদ্ধ করা হলো’’[3] কাজেই সিয়াম যেমন ফরয আইন তেমনি কিতাল বা যুদ্ধও ফরয আইন

তাঁদের বিভ্রান্তির কারণ কুরআন-হাদীসের কিছু বক্তব্যকে সুন্নাতে নববীর সামগ্রিক আওতা থেকে বের করে অনুধাবনের চেষ্টা। কুরআন হাদীসে মানব জীবনের সকল দিকের বিধিবিধান বিদ্যমান। প্রত্যেক বিধান পালনের জন্য নির্ধারিত শর্তাদি রয়েছে। তবে কোনো ইবাদতের শর্তাবলি কুরআনে একত্রে বা একস্থানে উল্লেখ করা হয় নি। এছাড়া অধিকাংশ ইবাদতের সকল শর্ত কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। কুরআন হাদীসের সামগ্রিক বিধান বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সামগ্রিক জীবন সকল নির্দেশ পালনে তাঁর রীতি-পদ্ধতি থেকেই সেগুলোর শর্ত পদ্ধতি বুঝতে হবে। তা না হলে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হতে হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন:


أَقِمِ الصَّلاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ

‘‘সূর্য ঢলে পড়া থেকে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করবে।’’[4]

নির্দেশের উপর নির্ভর করে যদি কেউ সূর্যাস্তের সময় সালাতে রত হন তবে তিনি নিজে যতই দাবি করুন, মূলত তা ইসলামী ইবাদাত বলে গণ্য হবে না, বরং তা পাপ হারাম কর্ম বলে গণ্য হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাদীস শরীফেসূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাত্রি পর্যন্তসময়ের মধ্যে সালাত আদায়ের বৈধ অবৈধ সময় চিহ্নিত করেছেন এবং সূর্যাস্তের সময় সালাত আদায় অবৈধ করেছেন। এভাবে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষার বাইরে মনগড়াভাবে কুরআন কারীমের অর্থ বা ব্যাখ্যা করা আমাদেরকে ইবাদতের নামে পাপের মধ্যে লিপ্ত করে

জিহাদ বিষয়ক আয়াত হাদীসও অনুরূপ। কোথাও সাধারণ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং কোথাও এর স্তর বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। এক আয়াতে বলা হয়েছে:


لا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلاًّ وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى ...

মুমিনদের মধ্যে যারা কোনো অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও (জিহাদ না করে) ঘরে বসে থাকে এবং যারা আল্লাহর পথে নিজেদের প্রাণ সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়। যারা নিজেদের প্রাণ সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন। উভয় প্রকারের মুমিনকেই আল্লাহ কল্যাণের (জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ....’’[5]

আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, জিহাদ ফরয কিফায়া ইবাদত। কোনো অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ জিহাদ পরিত্যাগ করে তবে সে পাপী হবে না। তবে যারা ইবাদত পালন করবেন তাঁরাই শুধু এর সাওয়াব মর্যাদা লাভ করবেন

খারিজীগণ সাধারণভাবে ধার্মিক সমাজের পাপাচারে ব্যথিত। তবে দ্রুত সব কিছু ভাল করে ফেলার আবেগ এবং বিরোধী মানুষদেরকে নির্মূল করার আক্রোশ একত্রিত হয়ে তাদেরকে অন্ধ করে ফেলে। তারা দুটি বিষয়ের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন: () যে কোনো অজুহাতে মুসলিমকে কাফির বলে প্রমাণ করা এবং () যে কোনো অজুহাতে জিহাদের নামে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সশস্ত্র আক্রমণ বৈধ করা। জিহাদ ফরয কিফায়া এবং জিহাদের জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে যদি কোনো ফকীহের বক্তব্য তাদেরকে বলা হয় তবে তারা বলেন: আমরা আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর কথা ছাড়া কিছুই মানি না। আবার যখন তাদের মতের বাইরে কুরআন বা হাদীসের বক্তব্য তাদের সামনে পেশ করা হয় তখন বলেন: অমুক বা তমুক আলিম এগুলোকে মানসূখ বা রহিত বলেছেন! আর পদ্ধতিতেই তারা উপরের আয়াতটিকেও মানসূখ বা রহিত বলে দাবি করেন

কোনো কোনো আলিম মানসূখ শব্দটি ব্যাখ্যা সমন্বয় অর্থে ব্যবহার করতেন। যেমন আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, সক্ষম ব্যক্তি জিহাদ না করলে কোনো সময়ে কোনো অবস্থাতেই কোনো অপরাধ হবে না। কিন্তু সূরা তাওবায় আল্লাহ জানিয়েছেন যে, রাষ্ট্রপ্রধান নির্দেশ দেওয়ার পরে জিহাদ না করা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।[6] এজন্য কোনো আলিম বলেছেন যে, তাওবার আয়াত দ্বারা মায়িদার আয়াত মানসূখ। অর্থাৎ একটি বিশেষ সময়ে বিশেষ অবস্থায় জিহাদ ফরয কিফায়া হওয়ার বিধানটি রহিত হয় এবং জিহাদ পরিত্যাগকারী পাপী হয়। এটি হলো রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশের অবস্থা। এরূপ স্বাভাবিক সমন্বয় ছাড়া কুরআনের মধ্যে বিদ্যমান কোনো আয়াতকে রহিত বলে দাবি করার অর্থ মানুষের কথায় বা মানুষের মন-মর্জি অনুসারে ওহীকে বাতিল করা

হাদীস শরীফে বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَصَامَ رَمَضَانَ كَانَ حَقًّا عَلَى اللَّهِ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ هَاجَرَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ جَلَسَ فِي أَرْضِهِ الَّتِي وُلِدَ فِيهَا قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلَا نُنَبِّئُ النَّاسَ بِذَلِكَ قَالَ إِنَّ فِي الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ أَعَدَّهَا اللَّهُ لِلْمُجَاهِدِينَ فِي سَبِيلِهِ ... فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللَّهَ فَسَلُوهُ الْفِرْدَوْسَ ...

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ-এর উপর ঈমান আনবে, সালাত কায়েম করবে, রামাদানের সিয়াম পালন করবে আল্লাহ নিজ দায়িত্বে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, সে ব্যক্তি আল্লাহর রাসত্মায় হিজরত করুক অথবা যে মাটিতে সে জন্মগ্রহণ করেছে সেখাইে বসে থাকুক। তখন সাহাবীগণ বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি বিষয়টি মানুষদেরকে জানিয়ে দেব না? তখন তিনি বলেন: জান্নাতের মধ্যে ১০০টি মর্যাদার স্তর বিদ্যমান যেগুলোকে আল্লাহ তাঁর রাসত্মায় জিহাদকারীদের জন্য তৈরি করেছেন... তোমরা যখন চাইবে তখনফিরদাউস’- চাইবে... ’’[7]

অর্থাৎ ফরয আইন ইবাদতগুলো পালনের পর মুমিনের উচিত কাফির দেশ থেকে হিজরত করে দারুল ইসলাম বা ইসলামের রাষ্ট্রে এসে রাষ্ট্রপ্রধানের নেতৃত্বে জিহাদে শরীক হওয়া। যদি তিনি হিজরত জিহাদে অংশ গ্রহণ না করেন তবে পাপী বলে গণ্য হবেন না। বরং ফরয আইন ইবাদতগুলো পালন করার কারণে মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাত প্রদান করবেন। কিন্তু তা হলো সর্বনিম্ন মর্যাদার জান্নাত। জিহাদের মাধ্যমে মুমিন উচ্চতর মর্যাদার জান্নাত লাভ করেন। মুমিনের উচিত জিহাদের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ জান্নাতের বাসনা হৃদয়ে লালন করা আল্লাহর কাছে তা প্রার্থনা করা

অর্থে এক হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন:


إِنَّ رَجُلا أَتَى النَّبِيَّ ﷺ فَقَالَ أَيُّ النَّاسِ أَفْضَلُ ( يا رسول الله)؟ فَقَالَ رَجُلٌ يُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِمَالِهِ وَنَفْسِهِ قَالَ ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ مُؤْمِنٌ مُعْتَزِلٌ فِي شِعْبٍ مِنْ الشِّعَابِ يَعْبُدُ اللَّهَ رَبَّهُ (وفي رواية: يُقِيمُ الصَّلاةَ وَيُؤْتِي الزَّكَاةَ وَيَعْبُدُ رَبَّهُ حَتَّى يَأْتِيَهُ الْيَقِينُ) وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ

‘‘একব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, সর্বোত্তম মানুষ কে? তিনি বলেন: যে মুমিন নিজের জীবন সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে। লোকটি বলে, এরপর সর্বোত্তম কে? তিনি বলেন: যে মুমিন মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী বিজন উপত্যাকায় থেকে তার প্রতিপালকের ইবাদত করে (দ্বিতীয় বর্ণনায়: এভাবে নির্জনে একাকী সে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়, মৃত্যু আগমন পর্যন্ত তার প্রতিপালকের ইবাদত করে) এবং মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।’’[8]

এভাবে জিহাদকারী সর্বোত্তম মর্যাদা লাভ করলেন। এর বিপরীতে সমাজ জিহাদ পরিত্যাগ করে বিজনে নির্জনে একাকী বসবাস করে দীনের আরকান আহকাম পালনের কারণে দ্বিতীয় ব্যক্তি মর্যাদায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন। তিনি জিহাদের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হলেন, তবে পাপী বলে গণ্য হলেন না

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:


وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

‘‘মুমিনদের জন্য সংগত নয় যে, তারা সকলে একসঙ্গে অভিযানে বের হবে। তাদের প্রতিটি দল থেকে একাংশ বের হয় না কেন? যাতে তারা দীনের জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যেন তারা সতর্ক হয়।’’[9]

এখানে আল্লাহ সকলকে অভিযানে না অঅনা বেরিয়ে প্রত্যেক দল থেকে কিছু মানুষকে ইবাদত পালনের নির্দেশ দিলেন। ফরয আইন ইবাদতের ক্ষেত্রে এরূপ সুযোগ নেই। আমরা বলতে পারি না যে, মুমিনগণ সকলেই সালাত বা সিয়াম পালন করবে না, বরং কেউ তা পালন করবে এবং অন্যরা অন্য দায়িত্ব পালন করবে

ফরয আইন ইবাদত পালনের জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। উপরন্তু কেউ নিষেধ করলে বা বাধা দিলেও মুমিনের দায়িত্ব সকল বাধা উপেক্ষা করে তা পালন করা। পক্ষান্তরে ফরয কিফায়ার ক্ষেত্রে অনুমতি গ্রহণের অবকাশ আছে। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পিতামাতার অনুমতি বা খিদমতের দায়িত্বের কারণে জিহাদ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রা) বলেন:


جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ فَاسْتَأْذَنَهُ فِي الْجِهَادِ فَقَالَ أَحَيٌّ وَالِدَاكَ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَفِيهِمَا فَجَاهِدْ (فَارْجِعْ إِلَى وَالِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا)

‘‘একব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এসে জিহাদের অনুমতি প্রার্থনা করে। তিনি বলেন: তোমার পিতামাতা কি জীবিত আছেন? সে বলে: হ্যাঁ। তিনি বলেন: তোমার পিতামাতাকে নিয়ে তুমি জিহাদ কর। (অন্য বর্ণনায়: তাহলে তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং সুন্দরভাবে তাঁদের খেদমত সাহচর্যে জীবন কাটাও।’’[10]

অন্য হাদীসে আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন:


أَنَّ رَجُلاً هَاجَرَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ مِنَ الْيَمَنِ فَقَالَ: هَلْ لَكَ أَحَدٌ بِالْيَمَنِ؟ قَالَ: أَبَوَاىَ. قَالَ: أَذِنَا لَكَ؟ قَالَ: لاَ. قَالَ: ارْجِعْ إِلَيْهِمَا فَاسْتَأْذِنْهُمَا فَإِنْ أَذِنَا لَكَ فَجَاهِدْ وَإِلاَّ فَبِرَّهُمَا.

‘‘একব্যক্তি ইয়ামান থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট হিজরত করে আসে। তিনি তাকে বলেন: ইয়ামানে তোমার কেউ কি আছেন? লোকটি বলে: আমার পিতামাতা আছেন। তিনি বলেন: তারা কি তোমাকে অনুমতি দিয়েছেন? লোকটি বলে: না। তিনি বলেন: তুমি তাদের কাছে ফিরে যেয়ে অনুমতি চাও। যদি তারা অনুমতি দেন তবে জিহাদ করবে। তা নাহলে তুমি তাদের খিদমত করবে।’’[11]

সকল হাদীস প্রমাণ করে যে, জিহাদ ফরয কিফায়া। ফরয আইন হলে এরূপ বলা যায় না। আমরা বলতে পারি না যে, পিতামাতা অনুমতি না দিলে সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদিফরয আইনইবাদত না করে তাদের খিদমত করতে হবে

এজন্য আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ফকীহগণ একমত যে, জিহাদ ফরয কিফায়া বা সামষ্টিক ফরয, কিছু মুসলিম তা পালন করলে অন্যদের ফরয আদায় হয়ে যায়। তবে যারা পালন করবেন তারাই শুধু সাওয়াব লাভ করবেন, অন্যরা গোনাহ থেকে মুক্ত হবেন। তবে শত্রুবাহিনী যদি দেশ দখল করে নেয় অথবা রাষ্ট্রপ্রধান সকল নাগরিককে যুদ্ধে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেন তবে অবস্থায় জিহাদ ফরয আইনে পরিণত হয়। আল্লামা কুরতুবী বলেন:


الذي استقر عليه الإجماع أن الجهاد على كل أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين، إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين

‘‘যে বিষয়ে ইজমা বা ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হলো, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সকলের উপর জিহাদ ফরয কিফায়া। যখন কিছু মানুষ তা পালন করবে তখন অন্য সকলের দায়িত্ব অপসারিত হবে। তবে যখন শত্রুগণ ইসলামী রাষ্ট্রে অবতরণ করে (দখল করে নেয়) তখন তা ফরয আইন হয়ে যায়।’’[12]

[1] সূরা () নিসা: ৭১ আয়াত
[2]
সূরা () বাকারা: ১৮৩ আয়াত
[3]
সূরা () বাকারা: ২১৬ আয়াত
[4]
সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ৭৮ আয়াত
[5]
সূরা () নিসা: ৯৫ আয়াত
[6]
সূরা () তাওবা: ৩৮-৩৯ আয়াত
[7]
বুখারী, আস-সহীহ /২৭০০
[8]
মুসলিম, আস-সহীহ /১৫০৩
[9]
সূরা () তাওবা: আয়াত ১২২
[10]
বুখারী, আস-সহীহ /১০৯৪; মুসলিম, আস-সহীহ /১৯৭৫
[11]
আবূ দাউদ, আস-সুনান (১৫-কিতাবুল জিহাদ, ৩৩-বাবুন ফির রাজুলি ইয়াগযু ওয়া আবাওয়াহু কারহিানি); আলবানী, সহীহুত তারগীব /৩২৭ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ লি-গাইরিহী বলেছেন
[12]
কুরতুবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ (৬৭১ হি), আল-জামি লি আহকামিল কুরআন /৩৮

 ১০. . . জিহাদ পালনের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান পূর্বশর্ত

আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফার আকীদা বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম তাহাবী বলেছেন: ‘‘মুসলিম শাসকের অধীনে- সে নেককার হোক আর পাপী-বদকার হোক- হজ্জ্ব এবং জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কোনো কিছুই দুটোকে বাতিল বা ব্যাহত করতে পারে না।’’ থেকে আমরা দেখছি যে, জিহাদ পালনের জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের বিদ্যমানতা, অনুমোদন নেতৃত্ব পূর্বশত। এটি খারিজীগণের সাথে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মৌলিক পার্থক্য। জিহাদকে ফরয আইন গণ্য করার কারণে খারিজীগণ বলেন যে, এর জন্য নির্দিষ্ট কারো অনুমতি বা নেতৃত্বের প্রয়োজন নেই। কয়েকজন মানুষ একত্রে কাউকে নেতা বানিয়ে জিহাদ করতে পারেন। এখানেও তারা কুরআন-হাদীসের সাধারণ বক্তব্য, উৎসাহ নির্দেশকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। আহলূস সুন্নাত যে সকল দলীল পেশ করেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:

() আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِنَّمَا الإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ

‘‘রাষ্টপ্রধান ঢাল, যাকে সামনে রেখে যুদ্ধ পরিচালিত হবে।’’[1]

আমরা দেখেছি যে, হাদীস, ফিকহ আকীদার পরিভাষায়ইমামশব্দটি শুধু রাষ্ট্রপ্রধান অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এভাবে আমরা হাদীস থেকে কিতাল বা জিহাদের জন্য তিনটি শর্তের কথা জানতে পারছি: () রাষ্ট্রের বিদ্যমানতা, () রাষ্ট্রপ্রধানের বিদ্যমানতা এবং () রাষ্ট্রপ্রধানের নেতৃত্ব। কুরআন হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশনা বিষয়টি নিশ্চিত করে। এখানে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

() মুসলিমগণ যতদিন অমুসলিম রাষ্ট্র সমাজের অংশ হিসেবে বসবাস করেছেন ততদিন আল্লাহ জিহাদের অনুমতি দেন নি। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যখন মুসলিমগণ পৃথক রাষ্ট্রীয় সত্তায় পরিণত হন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন আল্লাহ জিহাদের অনুমতি প্রদান করেন। আল্লাহ বলেন:

أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا

‘‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে।’’[2]

() রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে মুসলিমগণ কোনো যুদ্ধ পরিচালনা করেন নি

() যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতির গুরুত্ব জানা যায় আবূ বাসীর (রা)-এর ঘটনা থেকে। হুদায়বিয়ার সন্ধির একটি চুক্তি ছিল মক্কা থেকে পলাতক মুসলিমদেরকে কাফিরদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ে হুদাইবিয়ার ময়দানেই আবূ জানদাল (রা) নামক একজন নির্যাতিত মুসলিম শৃঙ্খলিত অবস্থায় মক্কা থেকে পালিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শর্ত মোতাবেক তাঁকে মক্কাবাসীদের হাতে সমর্পন করেন। উপস্থিত সাহাবীগণ বিষয়ে খুবই আবেগী হয়ে উঠেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। এরপর আরেক নির্যাতিত মুসলিম আবূ বাসীর (রা) মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকেও ফিরিয়ে দেন। এক পর্যায়ে আবূ বাসীর (রা), আবূ জানদাল (রা) আরো অনেক নির্যাতিত মুসলিম মক্কা থেকে পালিয়ে সিরিয়ার পথেঈসনামক স্থানে সমবেত হন। মদীনা রাষ্ট্রের সাথে মক্কাবাসীদের সন্ধি থাকলেও নতুন জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের সন্ধি ছিল না; বরং তাদের মধ্যে পরিপূর্ণ যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। অবস্থায় তাঁরা সিরিয়াগামী কুরাইশ কাফিলাগুলোর উপর আক্রমণ চালাতে থাকেন। মক্কাবাসীরা বুঝতে পারে যে, এদেরকে মদীনা রাষ্ট্রের নাগরিক মেনে সন্ধিচুক্তির অন্তর্ভুক্ত করাই তাদের জন্য নিরাপদ। তাদেরই অনুরোধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সন্ধিচুক্তির সংশ্লিষ্ট শর্তটি বাতিল করে তাঁদেরকে মদীনায় বসবাসের ব্যবস্থা করেন।[3]

এভাবে মদীনা রাষ্ট্রে বসবাসরত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ বাসীর তাঁর সাথীদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেন নি। এজন্য তাঁরা মদীনা রাষ্ট্রের বাইরে অবস্থান করতে বাধ্য হন। থেকে আমরা দেখি যে, কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারীর জন্য সন্ধি, যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রপ্রধানের সিদ্ধান্ত মান্য করা ফরয

() কুরআন হাদীসে বারংবারউলুল আমরবা শাসকদের আনুগত্য করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[4] আর জিহাদ আনুগত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে আনুগত্যহীনতা মুসলিম জনপদকে গৃহযুদ্ধ বা পারস্পরিক হানাহানিতে লিপ্ত করতে পারে। যদি রাষ্ট্রীয় অনুমোদন আনুগত্যের বাইরে জিহাদ করার সুযোগ থাকে তবে নাগরিকগণ একে অপরের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করবেন। কখনো একে অপরকে কাফির বলে, কখনো অন্যায়ের প্রতিবাদের নামে পরস্পরে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এজন্য প্রসি্দ্ধ শাফিয়ী ফকীহ মুহাদ্দিস হাফিয ইবন হাজার আসকালানী বলেন:

لأنه يمنع العدو من أذى المسلمين ويكف أذى بعضهم عن بعض

‘‘রাষ্ট্রপ্রধানকে ঢাল বলা হয়েছে তার কারণ তিনি মুসলিমদেরকে শত্রুর ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন এবং মুসলিমদেরকে পারস্পরিক ক্ষতি থেকেও রক্ষা করেন।’’[5]

() জিহাদের উদ্দেশ্য শুধু প্রাণহানি নয়, বরং জিহাদের উদ্দেশ্য যথাসাধ্য কম প্রাণহানির মাধ্যমে সর্বোচ্চ বিজয় শান্তি প্রতিষ্ঠা। শত্রুর শক্তি দুর্বলতা বিষয়ক তথ্যাদি রাষ্ট্র প্রধান যেভাবে সংগ্রহ করতে পারেন অন্য কেউ তা পারে না। ফলে তার তত্ত্বাবধানে জিহাদ কাঙ্ক্ষিত বিজয় শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। এজন্য প্রসিদ্ধ মালিকী ফকীহ মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল আরাবী (৫৪৩ হি) বলেন:

أَمَرَ اللَّهُ سُبْحَانَهُ النَّاسَ بِالْجِهَادِ سَرَايَا مُتَفَرِّقَةً أَوْ مُجْتَمَعِينَ عَلَى الْأَمِيرِ، فَإِنْ خَرَجَتْ السَّرَايَا فَلَا تَخْرُجُ إلَّا بِإِذْنِ الْإِمَامِ؛ لِيَكُونَ مُتَحَسِّسًا إلَيْهِمْ وَعَضُدًا مِنْ وَرَائِهِمْ ، وَرُبَّمَا احْتَاجُوا إلَى دَرْئِهِ .

‘‘(হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের সতর্কতা গ্রহণ কর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে যাও অথবা একযোগে বেরিয়ে যাও[6] আয়াতে) মহান আল্লাহ মানুষদেরকে বিভিন্ন বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে অথবা আমীরের (শাসকের) নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে জিহাদে বের হওয়ার নির্দেশ দিলেন। বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে জিহাদে গমন করলে আমীরের (শাসকের) অনুমতি ছাড়া বের হবে না। কারণ শাসক মুজাহিদদের খোঁজখবর রাখবেন এবং তাদেরকে পিছন থেকে সহায়তা করবেন। মুজাহিদগণ অনেক সময় শাসকের প্রতিরক্ষার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন।’’[7]

ইমাম কুরতুবী (৬৭১ হি) একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন:

ولا تخرج السرايا إلا بإذن الإمام ليكون متجسسا لهم، عضدا من ورائهم، وربما احتاجوا إلى درئه.

‘‘রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনো বাহিনী যুদ্ধে বের হবে না। কারণ শাসক মুজাহিদদের খোঁজখবর রাখবেন এবং তাদেরকে পিছন থেকে সহায়তা করবেন। মুজাহিদগণ অনেক সময় শাসকের প্রতিরক্ষার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন।’’[8]

প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ইবন কুদামা আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ (৬২০ হি) বলেন:

وأمر الجهاد موكول إلى الإمام واجتهاده ويلزم الرعية طاعته فيما يراه من ذلك

‘‘জিহাদের বিষয়টি ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে অর্পিত এবং তার ইজতিহাদের উপর নির্ভরশীল। বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধান যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সে বিষয়ে তার আনুগত্য করা জনগণের জন্য জরুরী।’’[9]

ইবন কুদামা আকীদা বিষয়ক ‘‘লুমআতুল তিকাদনামক গ্রন্থে বলেন:

ونرى الحج والجهاد ماضياً مع طاعة كل إمام براً كان أو فاجراً، وصلاة الجمعة خلفهم جائزة

‘‘হজ্জ জিহাদ চালু থাকবে প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্যের সাথে; রাষ্ট্রপ্রধান নেককার হোক আর পাপাচারী হোক। তাদের পিছনে জুমুআর সালাত বৈধ।’’[10]

এভাবে আমরা দেখছি যে, জিহাদের ঘোষণা, শুরু পরিচালনার দায়িত্ব রাষ্ট্রপ্রধানের। কোনো মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান যদি প্রয়োজনের সময় জিহাদ বর্জন করেন তবে তিনি পাপের দায়ভার বহন করবেন। নাগরিকদের দায়িত্ব সরকারকে তার দায়িত্ব পালনের দাওয়াত দেওয়া, দায়িত্বহীনতার প্রতিবাদ করা। কিন্তু কোনো অবস্থায় নাগরিকগণ ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে জিহাদ ঘোষণা বা পরিচালনা করতে পারেন না

ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক জিহাদ ঘোষণা শুরু করার পরে যুদ্ধরত শত্রু রাষ্টের উপর আক্রমণ করার ক্ষেত্রেও অধিকাংশ ফকীহ ইমামের অনুমতি শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে কোনো রাষ্ট্র বা জনপদে শত্রুসৈন্য প্রবেশ করলে বা তা দখল করলে দেশকে দখলদার মুক্ত করতে নারী-পুরুষ প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জিহাদ করা ফরয হয়ে যায়। এরূপ যুদ্ধকে জিহাদুদ দিফা (جهاد الدفاع) বাপ্রতিরক্ষার জিহাদবলা হয়। এক্ষেত্রে নাগরিকগণ রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধ করবেন। সময়ে পিতামাতা বা স্বামীর অনুমতি গ্রহণেরও আবশ্যকতা থাকে না। প্রসঙ্গে ইবন কুদামা আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ হাম্বালী (৬২০ হি) রচিত ‘‘আল-মুকনিগ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় সমকালীন প্রসিদ্ধ সৌদী ফকীহ শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালিহ উসাইমীন বলেন:

لا يجوز غزو الجيش إلا بإذن الإمام مهما كان الأمر؛ لأن المخاطب بالغزو والجهاد هم ولاة الأمور، وليس أفراد الناس، فأفراد الناس تبع لأهل الحل والعقد، فلا يجوز لأحد أن يغزو دون إذن الإمام إلاّ على سبيل الدفاع، وإذا فاجأهم عدو يخافون كلَبه فحينئذ لهم أن يدافعوا عن أنفسهم لتعين القتال إذاً.

‘‘রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ব্যতীত কোনো বাহিনীর জন্য জিহাদ বৈধ নয়, পরিস্থিতি যা- হোক না কেন। কারণ কুরআন-হাদীসে বিদ্যমান জিহাদ-কিতাল বিষয়ক নির্দেশগুলোর দায়ভার রাষ্ট্রপ্রধানদের উপরেই, সাধারণ মানুষেরা আদেশগুলো দ্বারা সম্বোধিত নয়। বিষয়ে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অনুসরণ করবেন। কাজেই রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ব্যতীত কারো জন্য জিহাদ বা আক্রমণ বৈধ নয়। তবে প্রতিরক্ষার যুদ্ধ হলে ভিন্ন কথা। যদি শত্রুগণ কোনো জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ করে এবং তারা ভয় পায় যে, রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলে শত্রু তাদের ক্ষতি করবে তবে এক্ষেত্রে তারা নিজেদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করবেন। এরূপ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করা নিশ্চিত হয়ে যায়।’’[11]

[1] বুখারী, আস-সহীহ /১০৮০ (কিতাবুল জিহাদ, বাবু উকাতালু মিন ওয়ারায়িল ইমাম); মুসলিম, আস-সহীহ /১৪৭১ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবুন ফিল ইমামি ইযা আমারা..)
[2]
সূরা (২২) হজ্জ, আয়াত ৩৯
[3]
বুখারী, আস-সহীহ /৯৭৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক /৩১১-৩১২
[4]
বিষয়ক আয়াত হাদীসগুলো দেখুন: ইসলামের নামে জাঙ্গিবাদ ১৭৮-১৮৮, ২২৩-২২৭
[5]
ইবন হাজার, ফাতহুল বারী /১১৬
[6]
সূরা () নিসা: ৭১ আয়াত
[7]
ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন /৪১৪
[8]
কুরতুবী, আল-জামি লি আহকামিল কুরআন /২৭৫
[9]
ইবন কুদামা, আল-মুগনী ১০/৩৬৮
[10]
ইবন কুদামা, লুমআতুল তিকাদ, পৃষ্ঠা ৩০
[11]
ইবন উসাইমীন, আশ-শারহুল মুমতিআলা যাদিল মুসতানকী /২২

 ১০. . . কিতাল বনাম কতল

রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত জিহাদ সাময়িক আবেগ এবং কিছু ভাল খারাপ মানুষের রক্তপাত ছাড়া কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। তারপরও আবেগী মানুষেরা ভাবেন, যে কোনোভাবে কিছু খারাপ মানুষ মেরে ফেললে বোধহয় দুনিয়া ভাল হয়ে যাবে। তারা দেখেন যে, রাষ্ট্র তাদের আবেগ অনুসারে জিহাদের অনুমতি দিচ্ছে না। অথবা রাষ্ট্র নিজেই ভাল মানুষদের দমনে লিপ্ত। এক্ষেত্রে মুমিনের দায়িত্ব আল্লাহর নির্দেশমত সহনশীলতা মন্দের মুকাবিলায় ভাল দিয়ে দাওয়াত চালিয়ে যাওয়া এবং এভাবে জিহাদ করার মত একটি রাষ্ট্র অর্জন করা। আবেগী মানুষের এত ধৈর্য থাকে না। আল্লাহর নির্দেশমত ইবাদত পালনের চেয়ে নিজের মর্জিমত ফলাফল অর্জনে তার আগ্রহ বেশি। তিনি মনে করেন, এভাবে মানুষদেরকে আল্লাহর পথে এনে পছন্দমত সমাজ রাষ্ট্র অর্জন একটি অসম্ভব ব্যাপার। এজন্য তিনি বিভিন্ন অজুহাতে অনুমোদবিহীন জিহাদ বৈধ করতে চেষ্টা করেন। এরূপ একটি অজুহাত কতল বা হত্যার বিধান

ইসলামে হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হত্যাকারীকে শাস্তি দেন নি। কয়েকজন সাহাবী বর্ণিত মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, কারো জীবন, সম্পদ, পরিবার বা সম্ভ্রম আক্রান্ত হলে সে তা রক্ষার জন্য লড়তে পারবে। এজন্য তাৎক্ষনিক কারো অনুমতির প্রয়োজন তো নেইই, উপরন্তু এক্ষেত্রে সে নিহত হলে শহীদ বলে গণ্য হবে এবং আক্রমণকারী ডাকাত, লুটেরা বা সন্ত্রাসী নিহত হলে বিচারে হত্যাকারী শাস্তি থেকে রেহাই পাবে। অর্থের এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন: ‘‘একব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বলে: হে আল্লাহর রাসূল, যদি কেউ আমার কাছে এসে আমার সম্পদ কেড়ে নিতে চায় তবে আপনার মত কী? তিনি বলেন: তুমি তাকে তোমার সম্পদ দিবে না। লোকটি বলে: যদি সে আমার সাথে লড়াই করে? তিনি বলেন: তাহলে তুমিও তার সাথে লড়বে। লোকটি বলে: যদি সে আমাকে হত্যা করে? তিনি বলেন: তাহলে তুমি শহীদ হবে। লোকটি বলে: আর আমি যদি তাকে হত্যা করি? তিনি বলেন: সেক্ষেত্রে সে জাহান্নামী হবে।’’[1]

অর্থের হাদীসগুলোর ভিত্তিতে ফকীহগণ নিশ্চিত করেছেন এরূপ ক্ষেত্রে নিহত ডাকাত বা সন্ত্রাসীর রক্তবাতিল’; অর্থাৎ হত্যাকারী শাস্তি পাবে না

অন্য একটি হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বলেন: ‘‘এক অন্ধ ব্যক্তির একটি দাসী স্ত্রী ছিল। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে গালিগালাজ করত। লোকটি তাকে নিষেধ করত, কিন্তু মহিলা কিছুতেই নিবৃত হতো না। লোকটি তাকে ভয় দেখাত কিন্তু তাতে সে ভীত হতো না। এক রাতে মহিলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে গালিগালাজ ঘৃণ্য কথা বলতে শুরু করে। তখন অন্ধ লোকটি একটি ছুরি নিয়ে মহিলার পেটের উপর রাখে নিজের দেহ দিয়ে চেপে ধরে। এভাবে সে মহিলাকে হত্যা করে।... সকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে খুনের ঘটনা বলা হলে তিনি মানুষদেরকে সমবেত করে বলেন: আমি আল্লাহর নামে দাবি করছি, যে ব্যক্তি কাজ করেছে তার উপর যদি আমার কোনো অধিকার থেকে থাকে তবে সে যেন উঠে দাঁড়ায়। তখন উক্ত অন্ধ ব্যক্তি উঠে মানুষের ভিতর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সামনে এগিয়ে আসে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে বসে। সে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, আমিই তার হত্যাকারী। সে আপনাকে গালি দিত আপনার বিষয়ে ঘৃণ্য মন্তব্য করত। আমি তাকে নিষেধ করলেও নিবৃত হতো না এবং ধমক দিলেও ভয় পেত না। সে আমার জন্য মুক্তোর মত দুটি সন্তানন্ম দিয়েছে। সে আমার সাথে সদয় প্রেমময় আচরণ করত। গতরাতে সে যখন আপনাকে গালি দিতে নোংরা কথা বলতে শুরু করে তখন আমি ছুরি নিয়ে তার পেটের উপর রাখি এবং নিজের দেহ দিয়ে চেপে ধরি। এভাবে আমি তাকে হত্যা করি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

أَلاَ اشْهَدُوا أَنَّ دَمَهَا هَدَرٌ.

‘‘তোমরা সাক্ষী থাক যে, মহিলার রক্ত বাতিল।’’[2]

খারিজীগণ সকল হাদীস দিয়ে দাবি করেন যে, অন্ধ ব্যক্তি বা আক্রান্ত ব্যক্তি তো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুমতি ছাড়াই কাফির বা পাপীকে হত্যা করল এবং কোনো শাস্তি পেল না। এতে প্রমাণ হলো যে, রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ছাড়াও জিহাদ করা যায়!!

আবেগের অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হলে তারা বুঝতেন যে, কতল বা হত্যার হাদীসের সাথে কিতাল বা জিহাদের বিধানের সামান্যতম সম্পর্ক নেই। হাদীসগুলো আরো প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রীয় বিচার অনুমোদনের বাইরে কেউ কাউকে হত্যা করলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। তবে যদি বিচারের কাঠগড়ায় প্রমাণ হয় যে, সে আক্রান্ত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করেছে, অথবা নিহত ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে গালিগালাজ করছিল এবং তাকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তা থেকে বিরত হয় নি তবে সেক্ষেত্রে ইসলামী আইনে নিহত ব্যক্তির রক্ত বাতিল এবং হত্যাকারীর শাস্তি রহিত হবে

ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধের নামে দল-গোষ্ঠী পরিচালিত জিহাদের ক্ষতির বিষয়ে ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’- ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্য নিম্নরূপ:

قُلْتُ فَمَا تَقُوْلُ فِيْمَنْ يَأْمُرُ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ فَيَتَّبِعُهُ عَلَى ذَلِكَ نَاسٌ فَيَخْرُجُ عَلَى الْجَمَاعَةِ، هَلْ تَرَى ذَلِكَ؟ قَالَ: لاَ. قُلْتُ: وَلِمَ؟ وَقَدْ أَمَرَ اللهُ تَعَالَى وَرَسُوْلُهُ بِالأَمْرِ بِالْمَعْرُوْفِ وَالنَّهْيِ عَنِ الْمُنْكَرِ وَهَذَا فَرِيْضَةٌ وَاجِبَةٌ. فَقَالَ: هُوَ كَذَلِكَ، لَكِنْ مَا يُفْسِدُوْنَ مِنْ ذَلِكَ أَكْثَرُ مِمَّا يُصْلِحُوْنَ مِنْ سَفْكِ الدِّمَاءِ وَاسْتِحْلاَلِ الْمَحَارِمِ وَانْتِهَابِ الأَمْوَالِ، وَقَدْ قَالَ اللهُ تَعَالَى (وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِيْ تَبْغِيْ حَتَّى تَفِيْءَ إِلَى أَمْرِ اللهِ) قُلْتُ فَنُقَاتِلُ الْفِئَةَ الْبَاغِيَةَ بِالسَّيْفِ؟ قَالَ نَعَمْ تَأْمُرُ وَتَنْهَي فَإِنْ قَبِلَ وَإِلاَّ قَاتَلْتَهُ فَتَكُوْنُ مَعَ الْفِئَةِ الْعَادِلَةِ وَإِنْ كَانَ الإِمَامُ جَائِرًا لِقَوْلِ النَّبِيِّ عَلَيْهِ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ ( لاَ يَضُرُّكُمْ جَوْرُ مَنْ جَارَ وَلاَ عَدْلُ مَنْ عَدَلَ، لَكُمْ أَجْرُكُمْ وَعَلَيْهِ وِزْرُهُ )... فَقَاتِلْ أَهْلَ الْبَغْيِ بِالْبَغْيِ لاَ بِالْكُفْرِ وَكُنْ مَعَ الْفِئَةِ الْعَادِلَةِ وَالسُّلْطَانِ الْجَائِرِ، وَلاَ تَكُنْ مَعَ أَهْلِ الْبَغْيِ...

‘‘আমি (আবূ মুতী) বললাম, কোনো মানুষ ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধ করতে থাকেন। তখন কিছু মানুষ তার অনুগামী হয়। তখন তারা জামাআতের (রাষ্ট্র সমাজের) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এদের বিষয়ে আপনি কি বলেন? আপনি কি এরূপ কর্মের স্বীকৃতি দেন? ইমাম আবূ হানীফা বলেন: ‘‘না’’ আমি বললাম, কেন? মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ) তো ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর এতো একটি জরুরী ফরয। তিনি বলেন: তা ঠিক; তবে তারা এভাবে ন্যায়ের চেয়ে অন্যায়-ফাসাদ বেশি করে; কারণ তারা রক্তপাত করে, মানুষের ধন-সম্পদ সম্ভ্রম নষ্ট করার কঠিন হারামে নিপতিত হয়, ধনসম্পদ লুটপাট করে। মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘মুমিনদের দুদল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করবে; আর তাদের একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে যারা বিদ্রোহ করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে...’’ আমি বললাম: তাহলে কি আমি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করব? তিনি বলেন: হ্যাঁ। তুমি আদেশ নিষেধ করবে। যদি গ্রহণ করে তবে ভাল। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। তাহলে তুমি ন্যায়পন্থী দলের (রাষ্ট্র সমাজের) সাথে থাকবে, যদিও রাষ্ট্রপ্রধান জালিম হয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: জালিমের জুলম ন্যায়পরায়ণের ইনসাফ কোনোটিই তোমাদের ক্ষতি করবে না। তোমরা তোমাদের পুরস্কার লাভ করবে এবং তারা তাদের শাস্তি পাবে।... কাজেই তুমি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে বিদ্রোহের কারণে, কাফির হওয়ার কারণে নয়। আর ন্যায়পন্থী জনগোষ্ঠী (মূল সমাজ) জালিম শাসকের সাথে থাকবে, কিন্তু বিদ্রোহীদের সাথে থাকবে না।’’[3]

এখানে ইমাম আবূ হানীফা রাষ্ট্রপ্রধান জালিম বা পাপী হলেও রাষ্ট্র সমাজের পক্ষে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদের নামে অনিয়ন্ত্রিত জিহাদের ক্ষতির দিকটি তুলে ধরেছেন। এখানে তিনি সাহাবীগণের ধারা অনুসরণ করেছেন। সাহাবীগণও এরূপ অনিয়ন্ত্রিত জিহাদের ক্ষতিকর দিক আলোচনা করেছেন

৭৩ হিজরীতে হাজ্জাজ ইবনু ইউসূফ মক্কা অবরোধ করে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রা)-এর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালাতে থাকেন। তৎকালীন যুবকদের অনেকেই ভাবতে থাকে যে, হাজ্জাজের বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে এবং মুসলিম বিশ্ব চিরতরে কাফির-ফাসিক জালিমদের পদানত হয়ে যাবে। অনেক যুবকই প্রবল আবেগে আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা)-এর পক্ষে জিহাদে যোগ দিতে থাকেন। সময়ে দু ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা)-এর নিকট এসে বলেন:

إِنَّ النَّاسَ ضُيِّعُوا، وَأَنْتَ ابْنُ عُمَرَ وَصَاحِبُ النَّبِيِّ ﷺ فَمَا يَمْنَعُكَ أَنْ تَخْرُجَ فَقَالَ يَمْنَعُنِي أَنَّ اللَّهَ حَرَّمَ دَمَ أَخِي، وفي رواية: مَا حَمَلَكَ عَلَى أَنْ تَحُجَّ عَامًا وَتَعْتَمِرَ عَامًا وَتَتْرُكَ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَقَدْ عَلِمْتَ مَا رَغَّبَ اللَّهُ فِيهِ قَالَ يَا ابْنَ أَخِي بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ إِيمَانٍ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالصَّلاةِ الْخَمْسِ وَصِيَامِ رَمَضَانَ وَأَدَاءِ الزَّكَاةِ وَحَجِّ الْبَيْتِ وفي لفظ: فَقَالا أَلَمْ يَقُلِ اللَّهُ (وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ) فَقَالَ قَاتَلْنَا حَتَّى لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ وَكَانَ الدِّينُ لِلَّهِ وَأَنْتُمْ تُرِيدُونَ أَنْ تُقَاتِلُوا حَتَّى تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِغَيْرِ اللَّهِ

‘‘মানুষেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আপনি ইবনু উমার, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবী, আপনাকে বেরিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধা দিচ্ছে কিসে? তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহ আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন, তাই আমি যুদ্ধে অংশ নিচ্ছি না।’’ অন্য বর্ণনায় তারা বলেন: ‘‘কি কারণে আপনি এক বছর হজ্জ করেন আরেক বছর উমরা করেন এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করেন? অথচ আপনি জানেন যে, আল্লাহ জিহাদের জন্য কী পরিমাণ উৎসাহ দিয়েছেন?’’ তখন তিনি বলেন, ‘‘ভাতিজা, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচটি বিষয়ের উপর: আল্লাহ তাঁর রাসূলের (ﷺ) উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রামাযানের সিয়াম, যাকাত প্রদান বাইতুল্লাহর হজ্জ।’’[4] অন্য হাদীসে: ‘‘তারা বলে, আল্লাহ কি বলেন নি, ‘এবং তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষণ ফিতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত না হয়’? তখন তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, ফিতনা দূরীভূত হয়েছিল এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তোমরা চাচ্ছ যে, তোমরা যুদ্ধ করবে যেন ফিতনা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দীন আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য হয়।’’[5]

এক খারিজী নেতা ইবন উমার (রা)-কে জিহাদ ছেড়ে হজ্জ-উমরা নিয়ে মেতে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করে। তিনি তাকে আরকানুল ইসলামের কথা বললে সে বলে:

يَا أَبَا عَبْدِالرَّحْمَنِ أَلا تَسْمَعُ مَا ذَكَرَ اللَّهُ فِي كِتَابِهِ (وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ) (قَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ) قَالَ فَعَلْنَا عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى ﷺ وَكَانَ الإِسْلامُ قَلِيلا فَكَانَ الرَّجُلُ يُفْتَنُ فِي دِينِهِ إِمَّا قَتَلُوهُ وَإِمَّا يُعَذِّبُونَهُ حَتَّى كَثُرَ الإِسْلامُ فَلَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ

‘‘হে আবূ আব্দুর রাহমান, আল্লাহ তাঁর কিতাবে কী বলেছেন তা কি আপনি শুনছেন না? তিনি বলেছেন: ‘মুমিনগণের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলের উপর সীমলঙ্ঘন করলে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে।’ (তিনি আরো বলেছেন): ‘এবং তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষণ ফিতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত না হয়’[6] তখন ইবনু উমার বলেন, আমরা তো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে তা করেছিলাম। ইসলাম দুর্বল স্বল্প ছিল, ফলে মুসলিম ব্যক্তি তার দীনের কারণে ফিতনাগ্রস্থ হতেন। কাফিররা তাকে হত্যা করত অথবা তার উপর অত্যাচার করত। যখন ইসলাম বিস্তৃত হয়ে গেল তখন তো আর ফিতনা থাকল না।’’[7]

জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ বাজালী (রা) কয়েকজন খারিজী মুজাহিদকে ডেকে একত্রিত করে তাদেরকে ঈমানের দাবিদারকে হত্যা করার বিষয়ে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাফিরদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। যুদ্ধের মাঠে একজন কাফির সৈনিক মুসলিম বাহিনীর অনেক সৈনিককে হত্যা করে। এক পর্যায়ে উসামা ইবনু যাইদ (রা) উক্ত কাফির সৈনিককে আক্রমণ করেন তিনি যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন তখন সেলা ইলাহা ইল্লাল্লাহবলে। উসামা সে অবস্থাতেই তাকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উসামাকে বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুবলার পরেও তুমি তাকে কেন হত্যা করলে? তিনি বলেন, লোকটি অনেক মুসলিমকে হত্যা করে। আমি যখন তরবারী উঠালাম সে তরবারীর ভয়েলা ইলাহা ইল্লাল্লাহুবলেছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, তুমি তার হৃদয় চিরে দেখে নিলে না কেন, সে ভয়ে বলেছে না স্বেচ্ছায় বলেছে! ... তিনি বারবারই বলতে লাগলেন, কেয়ামতের দিন যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুউপস্থিত হবে তখন তুমি কী করবে?[8]

সাহাবীগণের সকল বক্তব্যের মধ্যে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

() আরকানে ইসলাম জাতীয় ইবাদতই মুমিনের মূল দায়িত্ব। এগুলোউদ্দিষ্টইবাদত (ইবাদতে মাকসূদা) এগুলো পালন করাই মুমিন জীবনের উদ্দেশ্য। এগুলি পালনের গুরুত্ব কখনোই কমে না বা থামে না। পক্ষান্তরেজিহাদউদ্দিষ্ট ইবাদত (ইবাদতে মাকসূদা) নয়; বরং উদ্দিষ্ট ইবাদত পালনের অধিকার রক্ষার জন্যই জিহাদ। অধিকার বিদ্যমান থাকলে জিহাদের আবশ্যকতা থাকে না

() জিহাদ করা আল্লাহর নির্দেশ এবং মানুষ হত্যা করা আল্লাহর নিষেধ। নিষেধের পাল্লাকে ভারী রাখতে হবে এবং হারামে নিপতিত হওয়ার ভয় থাকলে জিহাদ পরিত্যাগ করতে হবে

() কাফির রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র, নাগরিক দীনী দাওয়াতের স্বাধীনতা বিজয় সংরক্ষণই মূলত জিহাদ। মুসলিম ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা হত্যা জিহাদ নয়। যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন বলে দাবি করে বালা ইলাহা ইল্লাল্লাহুমুখে স্বীকার করে তাকে জিহাদের নামে হত্যা করা পারলৌকিক ধ্বংসের অন্যতম কারণ

() ফিতনা দূরীকরণ জিহাদের উদ্দেশ্য। তবে ফিতনা দূরীকরণ বলতে সমাজের সকল অন্যায়, অনাচার, কুফর, শিরক ইত্যাদি দূর করা নয়, বরং মুমিনকে জোরপূর্বক কুফরে লিপ্ত হওয়ার পরিস্থিতি দূরীকরণ বা দীনপালন দীনী দাওয়াতের স্বাধীনতা রক্ষা করা। এরূপ পরিস্থিতি ছাড়া জিহাদ মূলত ফিতনা দূর করে না, বরং ফিতনা সৃষ্টি করে। কারণ সকল সমাজেই অন্যায় জুলুম থাকে এবং সর্বদা ধর্মহীন পাপাচারীর সংখ্যা শক্তি ধার্মিক সৎ মানুষদের চেয়ে বহুগুণ বেশি হয়। যদি ধার্মিক মানুষেরা শান্তিপূর্ণ ধৈর্যপূর্ণ দাওয়াত, ন্যায়ের আদেশ অন্যায়ের নিষেধ না করে জিহাদ বা সশস্ত্র শাক্তি প্রয়োগ করেন তবে তা বহু মহাপাপ, হত্যা ফিতনার দরজা উন্মুক্ত করে। ইমাম মাহদী প্রসঙ্গে আমরা দেখব যে, দ্রুত অন্যায় দূর করেআদর্শ সমাজপ্রতিষ্ঠার আবেগী চেষ্টা রক্তপাত বিভ্রান্তি ছাড়া কোনো ফল দেয় নি

[1] মুসলিম, আস-সহীহ /১২৪, নং ১৪০
[2]
আবূ দাউদ, আস-সুনান /১২৭ (কিতাবুল হুদূদ, হুকম ফীমান সাববা..)
[3]
ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪৫, ৫২
[4]
বুখারী, আস-সহীহ /১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৮৪, ৩১০
[5]
বুখারী, আস-সহীহ /১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৮৪, ৩১০
[6]
সূরা () বাকারা, ১৯৩ আয়াত
[7]
বুখারী, আস-সহীহ /১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী /১৮৪, ৩১০
[8]
মুসলিম, আস-সহীহ /৯৬-৯৭; নাবাবী, শারহু সাহীহি মুসলিম /১০১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১২/১৯৬, ২০১

No comments

Powered by Blogger.