নবী-রাসূলগণের দা'ওয়াতী মূলনীতি, অধ্যায় -০১
নবী-রাসূলগণের দা‘ওয়াতী মূলনীতি - মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আত-তুওয়াইজিরী
১। দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণতা
(كمال دين الإسلام)
ক. সৃষ্টিজগতের চিরন্তন রীতি (السنن الكونية)
আল্লাহ তা‘আলা তার ক্ষমতাবলে জগৎসমূহ সৃষ্টি করেছেন। তিনি তার রীতি অনুযায়ী তা পরিচালনাও করেন, আর তার এ রীতি দ্বারাই তার ক্ষমতাকে গোপন করেন। মহাপবিত্র আল্লাহ তা‘আলা এ মহাজগত সৃষ্টি করে তাতে প্রতিটি সৃষ্টির জন্য নিয়ম পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন, যার উপর সৃষ্টি জগত পরিচালিত হয়। আর এর মাধ্যমে শ্রবণ, আনুগত্য, উপকারিতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়। অতঃপর চন্দ্র, সূর্য, দিন, রাত্রি, উদ্ভিদ, প্রাণি জগত, বাতাস, পানি, সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত, তারকারাজি, মেঘমালা এরূপ প্রতিটি সৃষ্টির জন্যই সুনির্দিষ্ট নিয়ম-পদ্ধতি রয়েছে, যার উপর এগুলো পরিচালিত হয় এবং আল্লাহর ইবাদত করে। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ ছাড়া এগুলো পরিবর্তন হয় না।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ
الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنْفُسِهِمْ وَمِمَّا
لَا يَعْلَمُونَ (36) وَآيَةٌ لَهُمُ اللَّيْلُ نَسْلَخُ مِنْهُ النَّهَارَ
فَإِذَا هُمْ مُظْلِمُونَ (37) وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ
تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ (38) وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى
عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ (39) لَا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ
تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ
يَسْبَحُونَ (40)﴾ [يس: 36 - 40]
‘পবিত্র সত্তা তিনি, যিনি সৃষ্টি করেছেন সকল জোড়া জোড়া, যমীন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদ এবং তাদের (মানুষের) নিজেদের মধ্য থেকেও (পুরুষ ও নারী) আর সে সব কিছু থেকেও যা তারা জানে না (৩৬) আর রাত তাদের জন্য একটি নিদর্শন; আমরা তা থেকে দিনকে সরিয়ে নেই। ফলে তখনই তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় (৩৭) আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট পথে, এটা মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ (আল্লাহ)-র নির্ধারণ (৩৮) আর চাঁদের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি মানযিলসমূহ, অবশেষে সেটি খেজুরের শুষ্ক পুরাতন শাখার মত হয়ে যায় (৩৯) সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, আর প্রত্যেকেই কক্ষ পথে সন্তরণ করে’ (৪০) (সূরা ইয়াসীন ৩৬: ৩৬-৪০)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ
لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ
وَالنُّجُومُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ
وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ وَمَنْ يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ
مُكْرِمٍ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ (18) ﴾ .. [الحج: 18]
‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করে যা কিছু রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু রয়েছে যমীনে, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পর্বতমালা, বৃক্ষলতা, জীব-জন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে। আবার অনেকের উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে আছে। আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন তার সম্মানদাতা কেউ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন’ (সূরা আল-হাজ্জ: ১৮)।
৩। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ
السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا
يُسَبِّحُبِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ
حَلِيمًا غَفُورًا (44)) [الإسراء: 44]
‘সাত আসমান ও যমীন এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে, সব কিছু তাঁর তাসবীহ পাঠ করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করে না; কিন্তু তাদের তাসবীহ তোমরা বুঝ না। নিশ্চয় তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ (সূরা বনী ইসরাঈল: ৪৪)।
৪। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ
خَلَتْ مِنْ قَبْلُ وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا (23)) [الفتح: 23]
‘তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে, তাদের ব্যাপারে এটি আল্লাহর নিয়ম; আর তুমি আল্লাহর নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবে না’ (সূরা আল-ফাতহ: ২৩)।
খ. শারঈ রীতি (السنن الشرعية)
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে নিজ হাতে সৃষ্টি করে সকল সৃষ্টির উপর তাকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন, তাকে বহু সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। মানব জাতি সুনির্দিষ্ট নিয়ম পদ্ধতির মুখাপেক্ষী, ইহকালিন ও পরকালিন কল্যাণ লাভের জন্য সকল অবস্থায় যার উপর তারা পরিচালিত হবে। আর এ নিয়মনীতিই হলো দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সম্মানিত করেছেন, এটাকে তার দ্বীন হিসাবে পছন্দ করেছেন এবং এটা ছাড়া অন্য কিছুকে (অন্য কোন দ্বীনকে) তিনি তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করবেন না। এ দ্বীনকে আঁকড়ে ধরা অথবা এ থেকে বিমুখ হওয়ার মাপকাঠি অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলা মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণ নির্ধারণ করেন এবং এ দ্বীন গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে তাকে স্বাধীনতা দিয়ে থাকেন।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ
دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ
دِينًا) [المائدة: 3]
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে পছন্দ করলাম ’ (সূরা আল-মায়েদা: ৩)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ
فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ) ... [الكهف: 29]
‘আর বল, হক্ব তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যে ইচ্ছা করে, সে ঈমান আনুক এবং যে ইচ্ছা করে, সে কুফরী করুক’ (সূরা আল-কাহফ: ২৯)।
৩। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا
فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ
عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (38) وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا
بِآيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (39)) [البقرة:
38 - 39]
‘আর আমরা বললাম, তোমরা সবাই তা থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন হেদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হেদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না (৩৮) আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে (সূরা আল-বাকবারা: ৩৭-৩৯)।
গ. মানব জাতির প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ (فضل الله على البشرية)
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করে আসমান-যমীনে অবস্থিত সবকিছু তাদের জন্য বশীভূত করে দিয়েছেন এবং তার জন্য নেয়ামতরাজি বরাদ্দ করেছেন। তাদের উপর নাযিল করেছেন কিতাবসমূহ এবং তাদের নিকট প্রেরণ করেছেন নবী-রাসূলগণকে। আর তারা যাতে স্বেচ্ছায় এক আল্লাহর ইবাদত করে ধন্য হতে পারে সেজন্য তাদেরকে জ্ঞান-বুদ্ধির নানা উপকরণ দান করেছেন। যেমন: শ্রবণ শক্তি, দর্শন শক্তি এবং বিবেক-বুদ্ধি।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ
سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ
نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ
بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُنِيرٍ (20)) [لقمان: 20]
‘তোমরা কি দেখ না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে। আর তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামত ব্যাপক করে দিয়েছেন; মানুষের মধ্যে কেউ কেউ জ্ঞান, হেদায়াত ও আলো দানকারী কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক করে (সূরা লুক্বমান: ২০)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ
بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ
وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ (78)) .. [النحل: 78]
‘আর আল্লাহ তোমাদেরকে বের করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভ হতে এমতাবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিসমূহ এবং অন্তরসমূহ। যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর’ (সূরা আন-নাহল: ৭৮)।
৩। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ
أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ فَمِنْهُمْ
مَنْ هَدَى اللَّهُ وَمِنْهُمْ مَنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلَالَةُ فَسِيرُوا فِي
الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ لْمُكَذِّبِينَ﴾ [النحل: 36]
‘আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং পরিহার কর ত্বাগূতকে। অতঃপর তাদের মধ্য হতে আল্লাহ কাউকে হেদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য হতে কারো উপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং তোমরা যমীনে ভ্রমণ কর, অতঃপর দেখ, অস্বীকারকারীদের পরিণতি কীরূপ হয়েছে’(সূরা আন-নাহল: ৩৬)।
ঘ. সর্বাপেক্ষা বড় নেয়ামত (أعظم النعم)
আল্লাহ তা‘আলা অসংখ্য নেয়ামতের মাধ্যমে তার বান্দাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন। এ নেয়ামত সমূহের মূলতঃ তিনটি ধরণ রয়েছে:
(ক) সৃষ্টি সম্পর্কিত নেয়ামত (খ) সাহায্য সম্পর্কিত নেয়ামত (গ) হেদায়াত সম্পর্কিত নেয়ামত।
আর এসব নেয়ামতের মধ্যে ইসলাম সর্বাপেক্ষা বড়, যা দিয়ে যুগে যুগে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন এবং প্রেরিত রাসূলগণের সর্দার (মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে সকল মানুষের নিকট পাঠিয়ে তিনি নবুঅতের ইতি টেনেছেন।
প্রত্যেক নবী-রাসূলকে আল্লাহ তা‘আলা তিনটি বিষয় বর্ণনার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন:
(১) মানুষের নিকট তাদের প্রতিপালক, সৃষ্টিকর্তা এবং রিযিক্বদাতার পরিচয় দান করা, যাতে তারা তার ইবাদত, সম্মান ও শুকরিয়া আদায় করতে পারে।
(২) মানুষকে তার প্রতিপালকের নিকট পৌঁছার রাস্তা সম্বন্ধে পরিচয় করানো, আর তা হলো দ্বীন ইসলাম।
(৩) মুমিন কাফের আল্লাহর নিকট গমনের পর মানুষের জন্য কী থাকবে, সে সম্বন্ধে তাদেরকে জানানো। আর তা হচ্ছে, মুমিনদের জন্য জান্নাত এবং কাফেরদের জন্য জাহান্নাম।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ
لَا تُحْصُوهَا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌكَفَّارٌ ) ... [إبراهيم: 34]
‘যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে তার সংখ্যা নিরূপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অধিক অত্যাচারী এবং অকৃতজ্ঞ’(সূরা ইবরাহীম:৩৪)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ
اللَّهِ ثُمَّ إِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فَإِلَيْهِ تَجْأَرُونَ ) [النحل: 53]
‘আর তোমাদের নিকট যে সব নেয়ামত আছে, সেসব আল্লাহর পক্ষ হতে। অতঃপর দুঃখ-দুর্দশা যখন তোমাদেরকে স্পর্শ করে, তখন তোমরা শুধু তাঁর নিকটই ফরিয়াদ কর’(সূরা আন-নাহল:৫৩)।
ঙ. দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণতা (كمال دين الإسلام)
ইসলাম এমন একটি দ্বীন, যা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণকে তার সৃষ্টির কাছে প্রেরণ করেছেন। আর মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে আল্লাহ তা‘আলা যে দ্বীনসহ সকল মানুষের কাছে প্রেরণ করেছেন, তা হচ্ছে ইসলাম, যা পরিপূর্ণ, জীবনের সকল দিক ও বিভাগ যার অন্তর্ভুক্ত, যা ব্যাপক, স্থায়ী এবং নির্ভেজাল। এ দ্বীন পূর্ণাঙ্গ, কেননা তা মান-সম্মান ও সৌন্দর্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর এর বিধি-বিধান ন্যায়সঙ্গতও পূর্ণরূপে একত্রিত করা হয়েছে। জীবনের সকল দিক ও বিভাগ দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত, কেননা তা দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষের সৌভাগ্য বয়ে আনে। এ দ্বীন ব্যাপক, কেননা তা সমগ্র জগতর এবং সমস্ত মানুষের জন্য রহমত। তা স্থায়ী, কেননা তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। তা নির্ভেজাল, কেননা আল্লাহ তা‘আলা নিজে তা সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অতএব, এ দ্বীন পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও হ্রাস-বৃদ্ধি হতে নিরাপদ।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ
دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ
دِينًا) ... [المائدة: 3]
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পছন্দ করলাম’ (সূরা আল-মায়েদা:৩)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا
اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا
تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ
تُوعَدُونَ (30) نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي
الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا
تَدَّعُونَ (31) نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ (32)) ... [فصلت: 30 - 32]
নিশ্চয় যারা বলে, ‘আল্লাহই আমাদের রব’ অতঃপর অবিচল থাকে, ফেরেশতামণ্ডলী তাদের কাছে অবতীর্ণ হন এবং বলেন, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার ওয়াদাপ্রাপ্ত তোমরা হয়েছিলে (৩০) আমরা দুনিয়ার জীবনে তোমাদের বন্ধু এবং আখেরাতেও। সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে যা কিছু তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আরও থাকবে যা তোমরা দাবী করবে (৩১) পরম ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে আপ্যায়নস্বরূপ (৩২) (সূরা হা-মীম সাজদা: ৩০-৩২)।
৩। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى
الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو
عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ (164)) ... [آل عمران: 164]
‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ ততেলাওয়াত করেন এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল’ (সূরা আলে ইমরান:১৬৪)।
৪। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا
كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا
يَعْلَمُونَ (28)) ... [سبأ: 28]
‘আর আমি তো কেবল তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী হিসাবে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না’(সূরা সাবা: ২৮)।
৫। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا
رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ (107)) ... [الأنبياء: 107]
‘আর আমি তো কেবল তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবেই প্রেরণ করেছি’(সূরা আল-আম্বিয়া:১০৭)।
৬। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ
وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ (9)) [الحجر: 9].
‘নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী’ (সূরা আল-হিজর:৯)।
চ. দ্বীন ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার কতিপয় দিক (مظاهر الكمال في دين الإسلام)
ইসলাম পরিপূর্ণ দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা), যা জীবনের সার্বিক দিক অন্তর্ভুক্ত করে এবং সব ধরণের প্রয়োজন পূরণ করে:
১। এটা এমন সত্য দ্বীন, যা ইবাদত, একত্ববাদ, সম্মান প্রদর্শন, আনুগত্য করণ, শুকরিয়া জ্ঞাপনসহ মানুষের সকল বিষয়ে তার প্রভূর দিকে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ককে সুবিন্যস্ত করে।
২। এটা এমন দ্বীন যা আল্লাহর প্রতি ঈমান, ভালবাসা, ভরসা, ভয়ভীতি, আশা, সাহায্য কামনা, তার মুখাপেক্ষী হওয়া এবং তার জন্য বিনম্র হওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে অন্তরকে পরিপূর্ণ করে দেয়।
৩। ইসলাম এমন জীবন ব্যবস্থা, যা বিবেকের সামনে আল্লাহকে তার নাম ও গুণাবলিসহ চেনা, মানুষের নিজেকে চেনা, দুনিয়া ও আখেরাত সম্পর্কে জানা, শরী‘আতের নানা বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং তদনুযায়ী আমল করার দরজা উম্মুক্ত করে দেয়।আখেরা
৪। ইসলাম রাসূলগণের সাথে মানুষের সম্পর্ককে সুবিন্যস্ত করে এবং তাদের অনুসরণের জন্য মানুষকে আহবান করে। ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে মানুষের সম্পর্ককেও সুবিন্যস্ত করে। ফলে, ইসলাম রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ভালবাসা, তার আনুগত্য করা, তাকে শ্রদ্ধা করা, তার সুন্নাতের অনুসরণ করা, তিনি যা নিয়ে এসেছেন তার সত্যায়ন করা, তার অনুসরণ করা এবং শরী‘আত তার নির্দেশিত পদ্ধতি ছাড়া ভিন্ন পদ্ধতিতে আল্লাহর ইবাদত না করার প্রতি মানুষকে নির্দেশ দেয়।
৫। ইসলাম মুসলিম-কাফের, শাসক-প্রজা, জ্ঞানী-মূর্খ, ধনী-গরীব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-অনাত্মীয় ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষের সাথে সম্পর্ককেও সুশৃঙ্খলিত করে এবং এর উপর অনেক নেকী দান করে।
৬। হালাল উপার্জন, হারাম বর্জন এবং ঠগবাজি ও ধোঁকাবাজি না করার মাধ্যমে ইসলাম মানুষের অর্থনৈতিক লেনদেনকে সুশৃঙ্খলিত করে। ক্রয়-বিক্রয়, উত্তম ও কল্যাণকর কাজে ব্যয়, সর্বদা সত্য অনুসন্ধান এবং মিথ্যা ও সূদ বর্জনের ক্ষেত্রে মহানুভবতার দিকে আহবান জানায়। সাথে সাথে দান-ছাদাকা ও মীরাছ বণ্টনের পদ্ধতি বর্ণনা করে।
৭। সুখ-দুঃখ, স্বচ্ছলতা-অস্বচ্ছলতা, সুস্থতা-অসুস্থতা, সফর-ইক্বামাত, নিরাপত্তা-ভয়ভীতি সর্বাবস্থায় ইসলাম নারী-পুরুষের জীবনকে শৃঙ্খলিত করে। সদাচরণ ও ন্যায়, সুন্দরভাবে সন্তান প্রতিপালন, ফাসাদ থেকে পরিবার রক্ষা এবং স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সদাচার বজায় রাখার মাধ্যমে মানুষের বৈবাহিক জীবনকেও ইসলাম সুশৃঙ্খলিত করে। আর এগুলোর মহা প্রতিদান দেয়।
৮। আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও শত্রুতা পোষণ করার মত সৎ চরিত্রসহ নানা শক্ত সেতুর উপর প্রতিষ্ঠিত সকল সম্পর্ককে ইসলাম সুশৃঙ্খলিত করে। ইসলাম সম্মান-বদান্যতা, ক্ষমা-মার্জনা, সহনশীলতা-লজ্জাশীলতা, সত্যবাদিতা-উদারতা, ন্যায়পরায়ণতা-উত্তম ব্যবহার, দয়া-সহানুভূতি, নরম-কোমল আচরণ ইত্যাদির মত নানা উত্তম চরিত্র ও সুন্দর গুণাবলীর দিকে আহবান করে। আর এগুলোর উত্তম প্রতিদান দেয়।
৯। ইসলাম জীবনধারাকে সুশৃঙ্খলিত করে যাবতীয় কল্যাণের আদেশ এবং যাবতীয় অকল্যাণ, যুলম-অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি থেকে নিষেধের মাধ্যমে। যেমন- আল্লাহর সাথে শিরক, অন্যায়ভাবে হত্যা, ব্যভিচার, মিথ্যা, অহংকার, কপটতা, প্রতারণা, অপকৌশল, ষড়যন্ত্র, হিংসা, শত্রুতা, গীবত, চোগলখোরি, চুরি, ছিনতাই, যাদু, মদপান, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ ইত্যাদি নানা অশ্লীলতা, হারাম কাজ ও কাবীরা গুনাহ, যেগুলি ব্যক্তি ও সমাজকে নষ্ট করে ফেলে। আর এগুলোর এমন সাজা প্রয়োগ করে, যদ্বারা যুলম বিদূরিত হয়।
১০। এসব কিছুর পরে ইসলাম মানুষের পরকালীন জীবনকে সুশৃঙ্খলিত করে এবং ইহকালীন জীবনের উপর পরকালীন জীবনের ভিত্তি রচনা করে। তাই, যে ঈমান আনবে ও সৎ আমল করবে, সে দুনিয়াতে ভাগ্যবান হবে এবং আখেরাতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের উত্তম কাজের প্রতিদান দশ থেকে সাতশতগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন এবং মন্দ বিষয়ের খারাপ প্রতিদান অনুরূপই দান করেন।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ
وَكِتَابٌ مُبِينٌ (15) يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ
السَّلَامِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ
وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (16)) ... [المائدة: 15 - 16]
‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে আলো ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। এর দ্বারা যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, তিনি তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে পরিচালিত করেন (সূরা আল-মায়িদা: ১৫-১৬)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ
يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ
فِيهَاوَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (13) وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ
وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ
(14)) ... [النساء: 13 - 14]
‘আর যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যেগুলির তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর এটা মহা সফলতা। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফলমানী করে এবং তাঁর সীমালঙ্ঘন করে, আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক আযাব’ (সূরা আন-নিসা: ১৩-১৪)।
No comments