নবী-রাসূলগণের ঘটনায় রয়েছে শিক্ষা- ড. মোঃ আবদুল কাদের

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা............

নবী-রাসূলদের কাহিনীর মধ্যে অনেক শিক্ষা বিদ্যমান। তাদের কাহিনীতে ফুটে উঠেছে তাওহীদপন্থীদের অবস্থা তাদের বিরোধীদের অবস্থান। কিভাবে তাদের কাউকে আল্লাহ নাজাত দিয়েছেন, আর অন্যদের কীভাবে ধ্বংস করেছেন। কাহিনীর শিক্ষাগুলো জানার মাধ্যমে যে কোনো লোকের পক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টি শাস্তি কোথায় রয়েছে তা জানা সম্ভব হবে। প্রবন্ধে সেসব শিক্ষা থেকে কিছু কিছু শিক্ষা তুলে ধরা হয়েছে

ভূমিকা

সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি আমাদেরকে সুষ্পষ্ট প্রকাশ্য কিতাব আল-কুরআন উপহার দিয়েছেন, যাতে রয়েছে হিদায়াত উপদেশ গ্রহণের হাজারো উপকরণ। বিশেষ করে কুরআনের সুন্দরতম কাসাস তথা ঘটনাবলী আমাদের উপদেশ নসীহত গ্রহণের আমীয় বাণী। আল-কুরআনে অতীত কালের জাতি সম্প্রদায়সমূহের ঘটনাবলী এবং কাহিনীগুলো বর্ণনা করে তাদের প্রকৃতি, স্বভাব, পরিণতি পরিণামের দিক নির্দেশ করে। অতীত কালের ইতিহাস নির্ভর, বিভিন্ন ঘটনা কিসসা বর্ণনা করা আল-কুরআনের মূল উদ্দেশ্য নয়। তবে অতীত কালের ঐতিহাসিক কাহিনী ঘটনার সঠিক বর্ণনা আল-কুরআনের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। সেই উপমা, উদাহরণ এবং কাহিনী চিত্রায়ণের উদ্দেশ্য হলো দীনি দাওয়াতকে মানুষের নিকট হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরা। আল-কুরআনের প্রধান আলোচ্য বিষয়ের প্রাচীন জাতিসমূহ এবং প্রসিদ্ধ নবী-রাসূলগণের ঘটনাবলীর বিবরণ অন্যতম। সকল কাহিনীর মধ্যে মানব জাতির সর্বস্তরে চিরকাল উপদেশ শিক্ষা গ্রহণের বহুবিধ উপকরণ রয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা মাত্র কয়েকজন নবীর জীবন কাহিনী পর্যালোচনা করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের দিকগুলো চিহ্নিতকরণ এবং বাস্তব জীবনে তা উপলব্ধি করার প্রয়াস পাব

আল-কুরআনে বর্ণিত কাসাস জীবন জগত সম্পর্কে মানব জাতির অতীত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। জীবন জগত সম্পর্কে মানুষ তার নিজের পুর্বধারণা, তার স্বজাতীয় অতীত ঘটনাবলী, কার্যক্রম ফলাফল পর্যালোচনা করেই ভবিষ্যত পরিকল্পনা গ্রহণ করে, সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। মানব জাতির নৈতিক, ব্যক্তিগত, সামাজিক সম্পর্ক হোক, আর রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হোক অতীত ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করেই তাদের সুখ, দুঃখ, ভাল-মন্দের মাপকাঠি নির্ণীত হয় আল-কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ব্যক্তি, সমাজ, জাতি সভ্যতার আলোচনা দ্বারা শিক্ষা প্রদানই আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য

আল-কুরআনে উল্লিখিত সকল কিসসাই ব্যক্তির জীবনে কোনো না কোনো স্তরে উপকার দিচ্ছে এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আছে। নিম্নে আমরা মাত্র কয়েকজন নবীর ঘটনাবলী বর্ণনা করে তাত্থেকে উপদেশ গ্রহণের এবং শিক্ষনীয় বিষয়ের দিক-নিদের্শনা প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা করব

 আদমআলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে শিক্ষা

আল-কুরআনে আদমআলাইহিস সালামের নাম ২৫টি আয়াতে ২৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে।[1] আদমআলাইহিস সালামের প্রসিদ্ধ ঘটনাবলী বর্ণনার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ঘটনা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল থেকে হিদায়াত সৎকর্ম লাভের উপকরণ খুঁজে বের করা এবং জ্ঞান-বৃদ্ধি বিবেক দিয়ে আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদানের শিক্ষা লাভ করা। তাছাড়া আদমআলাইহিস সালামের ঘটনায় অসংখ্য নছীহত এবং মাসআলার সমাবেশ রয়েছে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নছীহতের প্রতি ইঙ্গিত করা হলো

আল্লাহর হিকমতসমূহের রহস্য অসংখ্য এবং অগণিত। কোনো মানুষের পক্ষ (সে আল্লাহর যত সান্নিধ্যপ্রাপ্তই হোক না কেন), সমস্ত রহস্য সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হওয়া সম্ভব নয়। কারণেই আল্লাহর ফিরিশতাগণ চূড়ান্ত পর্যায়ের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আদমকে খলীফা বানানোর হিকমত সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেন নি এবং বিষয়টি পূর্ণ তথ্য সম্মুখে না আসা পর্যন্ত তারা বিস্ময়ে নিমগ্ন ছিলেন
আল্লাহর দয়াদৃষ্টি এবং মনোযোগ যদি কোনো তুচ্ছ পদার্থের প্রতিও হয়ে যায়, তাহলে তা শ্রেষ্ঠ হতে শ্রেষ্ঠতর মর্যাদা এবং মহা সম্মানিত পদে অধিষ্ঠিত হতে পারে এবং মহত্ত্ব বুযুর্গী লাভে ধন্য হতে পারে।[2]
মানুষকে যদিও সকল প্রকারের বুযর্গী দান করা হয়েছে এবং সে সব প্রকারের মর্যাদা বুযর্গী লাভ করেছে, তবুও তার সৃষ্টিগত স্বভাবজাত দুর্বলতা স্বস্থানে পূর্ববৎ বহাল রয়েছে এবং মানব মনুষ্যসূলভ সে সৃষ্টিগত ত্রুটি তবুও বাকী রয়েছে। দুর্বলতা এবং ত্রুটিই সে বস্তু ছিল যা আদমআলাইহিস সালামের উপরও ভুল আনয়ন করেছে, ফলে তিনি ইবলিসের ধোকায় পতিত হয়েছেন।[3]
অপরাধী হয়েও যদি মানুষের অন্তর তাওবা অনুতাপের প্রতি ঝুঁকে পড়ে তবে তার জন্য আল্লাহ পাকের রহমতের দ্বার রুদ্ধ নয়। সে দরবার পর্যন্ত পৌঁছবার পথে নিরাশার অন্ধকার ঘাটিতে পতিত হয় না। অবশ্য খাঁটি তাওবা সত্যিকারের অনুতপ্ত হওয়া অপরিহার্য। আদমআলাইহিস সালামের ভুল-ত্রুটি যেমন এই তাওবা এবং অনুতাপের ফলে ক্ষমা লাভের যোগ্য হয়েছে, তেমনি তার সমুদয় বংশধরের জন্যই ক্ষমা রহমতের জগৎ খুবই প্রশস্ত[4] যেমন, মহান আল্লাহ বলেন,

﴿قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣﴾ [الزمر: ٥٣]

‘‘হে রাসূল! আপনি লোকদেরকে বলে দিন যে, আল্লাহ বলছেন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের নফসের ব্যাপারে সীমালংঘন করেছ (অর্থাৎ গুণাহের কাজ করে নফসের ওপর যুলুম করেছ) তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিঃসন্দেহে, আল্লাহ যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দিবে, (তোমরা তাওবা অনুতাপের সাথে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা কর), নিঃসন্দেহে তিনি খুবই ক্ষমাশীল এবং দয়ালু।’’ [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩]
আল্লাহর দরবারে অবাধ্যতামূলক আচরণ এবং বিদ্রোহী হওয়া বড় সৎ কর্মগুলোকেও ধ্বংস করে দেয় এবং স্থায়ী অপমান ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়ে ইবলিসের ঘটনাটি বড়ই উপদেশমূলক। আর আল্লাহ তাআলার দরবারে অবাধ্যতা বিদ্রোহ করার ফলে তার পূর্বেকার ইবাদতের কি দুর্দশা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে লক্ষ লক্ষ উপদেশ গ্রহণের উপকরণ বটে।[5] যেমন, আল্লাহর বাণী,

﴿فَٱعۡتَبِرُواْ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَبۡصَٰرِ ٢﴾ [الحشر: ٢] “

অতএব, উপদেশ লাভ কর, হে উপদেশ লাভের চক্ষু বিশিষ্ট লোকেরা।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ]

[1]. সম্পাদনা পরিষদ, সীরাত বিশ্বকোষ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০০ খৃ.), ১ম সংস্করণ, . , পৃ. ৩৩
[2]
আব্দুল ওয়াহাব আল-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া (বৈরুত: দারুল-ফিকর, তা. বি), পৃ.
[3]
আত-তাবারী, কাসাসুল আম্বিয়া (বৈরুত: দার আল-ফিকর, ১৯৮৯), পৃ.
[4]
প্রাগুক্ত
[5]
. সালাহ আল-খলিনী, আল-কাসাস আল কুরআনী, ১ম সংস্কার (দিমাশক: দার আল-কলম, ১৯৯৮ খৃ.) . , পৃ. ১৬

 নূহআলাইহিস সালাম কিনআনের ঘটনা থেকে শিক্ষা

ব্যক্তি পারিবারিক জীবনের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা নূহআলাইহিস সালামের কিসসা স্মরণ করতে পারি যাতে তার ছেলে কিনআনের বে-ঈমানীর কথা উল্লেখ আছে। নবীর ছেলে হয়েও ঈমান না আনার কারণে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পায়নি। নূহআলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর শিক্ষা নিতে পারি

প্রত্যেকটি মানুষকে নিজের কার্যকলাপ আমলের জন্য নিজেই আল্লাহ তাআলার দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং পিতার বুযুর্গী উচ্চ মর্যাদা দ্বারা পুত্রের পাপের প্রতিকার হতে পারে না এবং পুত্রের নেকআমল পারলৌকিক সৌভাগ্য পিতার অবাধ্যচারণের বিনিময় বা বদলাও হতে পারে না। নূহআলাইহিস সালামের নবুওয়াত পয়গম্বরী তাঁর পুত্র কিনআনের কুফুরের শাস্তি ঠেকাতে পারে নি এবং ইবরাহীমআলাইহিস সালামের পয়গম্বরী উচ্চমর্যাদা উচ্চমর্যাদা পিতা আযরের শির্কের জন্য মুক্তির কারণ হতে পারে নি।[1] বিষয়ে আল্লাহর বাণী,

﴿قُلۡ كُلّٞ يَعۡمَلُ عَلَىٰ شَاكِلَتِهِۦ﴾ [الاسراء: ٨٤] ‘

বলুন, প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী কাজ করে থাকে।’’ [সূরা আল ইসরা, আয়াত: ৮৭]

অসৎ সঙ্গ হলো বিষের চেয়েও অধিক মারাত্মক। এর প্রতিফল পরিণতি অপমান, লাঞ্ছনা ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নয়, মানুষের জন্য নেকআমল যেমন জরুরী তদপেক্ষা অধিক জরুরী নেককারদের সংসর্গ। পক্ষান্তরে মন্দকার্য হতে আত্মরক্ষা করা মানুষের জীবনের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য[2] তদপেক্ষা অধিক প্রয়োজনীয় অসৎ সঙ্গ হতে বাঁচিয়ে রাখা। কবি বলেছেন:

‘‘নূহের পুত্র পাপাচারীদের সাথে উঠাবসা করেছে, ফলে সে নবী বংশের মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। (নবীর বংশে জন্মলাভ করা তার কোনই কাজে আসে নি। আসহাবে কাহাফের কুকুর কিছু দিন নেককারদের সংসর্গ লাভ করে মানব (এর ন্যায় মর্যাদাশালী) হয়ে গেছে। নেককারের সংসর্গ তোমাকে নেককার বানিয়ে দেয়। বদকারের সংসর্গ বদকার করে দেয়।’’

আল্লাহ তাআলার ওপর পূর্ণ নির্ভর ভরসা রাখার সাথে বাহ্যিক উপকরণের ব্যবহার তাওয়াক্কুল-এর পরিপন্থী নয়; বরং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের জন্য সঠিক কর্মপন্থা। সে কারণেই তো নূহআলাইহিস সালামের প্লাবন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নৌকার প্রয়োজন হয়েছিল।[3]

আল্লাহ তাআলার পয়গম্বর এবং নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও মানবীয় স্বভাবসূলভ কারণে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালমের পদঙ্খলন বা ত্রুটি-বিচ্যুতি সংঘটিত হতে পারে, কিন্তু তারা সে ত্রুটি বিচ্যুতির ওপর স্থায়ী থাকেন না, বরং আল্লাহ তাআলার তরফ হতে তাদেরকে সতর্ক করে দেওয়া হয় এবং সে ত্রুটি থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়। আদমআলাইহিস সালাম এবং নূহআলাইহিস সালামের ঘটনাগুলো এর সঠিক সাক্ষ্য, এতদ্ভিন্ন তারা গায়েব সম্বন্ধীয় জ্ঞানেরও অধিকারী নন। যেমন, ঘটনায় নূহকে আল্লাহ বলেছেনআমার নিকট এমন বিষয়ের সুপারিশ করো না, যা সম্বন্ধে তুমি অবহিত নও।’’ এতেই পরিষ্কারভাবে উপরোক্ত কথাটি বুঝা যায়।[4]

কর্মফল সম্বন্ধীয় আল্লাহ তাআলার কানূন যদিও প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নিজের কাজ করে যাচ্ছে কিন্তু এটি জরুরী নয় যে, প্রত্যেক অপরাধের শাস্তির কিংবা প্রত্যেক নেককাজের বিনিময় দুনিয়াতেই পাওয়া যাবে। কেননা বিশ্বজগৎ কর্মক্ষেত্র। আর কর্মফলের জন্য পরলোককে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তথাপি যুলুম এবং অহংকার দুটি মন্দ কার্যের শাস্তি কোনো না কোনো প্রকারে এখানে দুনিয়াতেও পাওয়া যাবে

ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. বলতেন, যালিম অহংকারী লোকেরা মৃত্যুর পূর্বেই নিজেদের যুলুম অহংকারের শাস্তি কিছু না কিছু প্রাপ্ত হয় এবং অপমান বিফলতার সম্মুখীন হয়। যেমন, আল্লাহর সত্য পয়গম্বরগণকে কষ্ট প্রদানকারী সম্প্রদায়সমূহের এবং ইতিহাসে উল্লিখিত যালিম অহংকারীদের অপদেশমূলক ধ্বংস-লীলার ঘটনাসমূহ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।[5]

[1] ইবন জারীর আল-তাবারী, তারীক আল-উমাম ওয়া আল-মুলুক (বৈরুত: দার আল-কলম, তা.বি) . , পৃ. ৯১; ইবন কাসীর, কাসাসুল আম্বিয়া, ১ম সংস্করণ (বৈরুত: মুআস সাসাতু আল মা আরিফ, ১৯৯৬ খৃ.), পৃ. ৭৯
[2]
ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়া আল-নিহায়া, (মিশর: দার আল ফিকর আল আরাবী, তা. বি), . , পৃ. ৬১
[3]
ইবন কাসীর, আল বিদায় ওয়া আল নিহারা, (মিশর: দার আল ফিকর আল আরাবী, তা. বি), . , পৃ. ১১৫
[4]
আল-ছাআলাবী, কাসাসুল আম্বিয়া (তুরস্ক: ১২২৬ হি.); প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০
[5]
কাজী জয়নুল আবেদীন সাজ্জাদ মিরাঠী, কাসাসুল কুরআন, ১ম সংস্করণ (আসাম: মারকায আল মাআরিফ, ১৯৯৪ খৃ.), পৃ. ২৭

 ইবরাহীম ইসমাঈলেরআলাইহিস সালাম ঘটনা থেকে শিক্ষা

ইবরাহীমআলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে আমরা আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং বিপদে একত্ববাদের প্রতি দৃঢ়তা, ব্যক্তিজীবনে মুশরিক মা-বাবার সাথে আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। যেমন,

মানুষ যখন জ্ঞান বিশ্বাসের আলোকে কোনো আকীদা কায়িম করে নেয় এবং তা তার অন্তরে বসে তার আত্মার সাথে মিশে এবং তার সীনার মধ্যে প্রস্তরাঙ্কনের ন্যায় দৃঢ়ভাবে অঙ্কিত হয়ে যায়, তখন তার চিন্তা কল্পনা, তার ভাবনা বিচার এবং তার ইহাতে ডুবে থাকা এমন স্তরের শক্তিশালী দৃঢ় হয়ে যায় যে, বিশ্বের কোনো আকস্মিক ঘটনা কোনো কঠিন বিপদও তাকে তার স্থান হতে নড়াতে পারে না। সে তার জন্য নিশ্চিন্ত মনে আগুনে লাফিয়ে পড়ে, বিনাদ্বিধায় সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্ভয়ে শুলিকাষ্ঠে চড়ে প্রাণ বিসর্জন দেয়। ইবরাহীমআলাইহিস সালামের দৃঢ় সংকল্প দৃঢ়তার দৃষ্টান্ত তার জন্য একটি জীবন্ত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।[1]

সত্যকে রক্ষা করার জন্য এমন প্রমাণ পেশ করা উচিৎ যা শত্রু এবং মিথ্যা পূজারীর অন্তরের অন্তঃস্থলে পৌঁছে যায় এবং সে মুখে যদিও সত্যকে স্বীকার করে না কিন্তু তার অন্তর সত্যকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়, বরং কোনো কোনো সময় মুখও ইচ্ছার বিরুদ্ধে সত্য ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকতে পারে না।[2] যেমন, কুরআন মাজীদের আয়াতটি[3]

﴿وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ﴾ [النحل: ١٢٥]

বিতর্ক কর উত্তমরূপে’’ [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১২৫] তথ্যেরই ঘোষণা করছে
পয়গাম্বর রাসূলগণের পন্থা হলো, তারা ঝগড়া তর্ক বির্তকের পথে চলে না। তাদের দলীল প্রমাণসমূহের ভিত্তি অনুভবনীয় বস্তু এবং চাক্ষুষ দর্শনের উপর হয়ে থাকে। কিন্তু তা সহজবোধ্য যুক্তির উপর। ইবরাহীমআলাইহিস সালামের কাওমের সাধারণের সাথে মূর্তিপূজা নক্ষত্র পূজা সম্বন্ধীয় বির্তক এবং নমরূদের সাথে বির্তক এর স্পষ্ট উজ্জ্বল প্রমাণ।[4]

কোনো সত্য বিষয়কে প্রমাণ করার জন্য দলীলের মধ্যে বিরোধী পক্ষের বাতিল আকিদাকে কাল্পনিকভাবে মেনে নেওয়া, মিথ্যা বা সে বাতিল আকিদা স্বীকার করা নয়; বরং শত্রু পক্ষকে পরাভূত করার জন্য সাময়িকভাবে বাতিলকে মেনে নেওয়া কিংবা মাআরীয বা পরোক্ষ ইঙ্গিত বলা হয়। পদ্ধতির প্রমাণ আনয়ন বিপক্ষকে নিজের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য করে দেয়। ইবরাহীমআলাইহিস সালাম জনসাধারণের সাথে বিতর্কের মধ্যে প্রমাণের দিকটাই অবলম্বন করেছিলেন যা মূর্তিপুজকদেরকে স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল যে, মূর্তি কোনো অবস্থাতেই শোনেও না জবাবও দিতে পারে না।[5]

যদি কোনো মুসলিমের পিতা-মাতা উভয়ই মুশরিক হয় এবং কোনোক্রমেই শির্ক থেকে বিরত না হয় তবে তাদের মুশরিকী জীবন থেকে অসন্তুস্ট এবং পৃথক থেকেও তাদের সাথে দুনিয়াবী কাজ কারবারে আচরণেও এবং আখিরাতের উপদেশ নসীহতের সম্মান ইজ্জতের সাথে ব্যবহার করা উচিৎ। কঠোর কর্কশ ব্যবহার করা অনুচিত। ইবরাহীমআলাইহিস সালামের ব্যবহার আযরের সাথে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মপদ্ধতি আবূ তালিবের সাথে বিষয়ে অকাট্য সুনিশ্চিত প্রমাণ।[6]

যদি মুমিনের অন্তর বিশুদ্ধ আকিদার ওপর নিশ্চিন্তে মুখ অন্তরের ঐক্যের সাথে ঈমান রাখে, কিন্তু চাক্ষুষ দর্শন অনুভব করার জন্য কিম্বা যথার্থ বিশ্বাসের স্তর পর্যন্ত লাভ করার উদ্দেশ্যে কোনো ঈমান বা বিশ্বাসের মাসআলায়ও প্রশ্ন এবং অন্বেষণের পথ অবলম্বন করে এবং অন্তরের তৃপ্তি প্রার্থী হয়, তবে অন্বেষণ সন্দেহ এবং কুফুর নয়, বরং প্রকৃত ঈমান। ইবরাহীমআলাইহিস সালামের জবাব

﴿وَلَٰكِن لِّيَطۡمَئِنَّ قَلۡبِيۖ ٢٦٠﴾ [البقرة: ٢٦٠]

বাক্যটি দ্বারা গূঢ়তত্ত্ব পরিস্কার হয়ে যায়

আল্লাহ তাআলা যে সমস্ত মহাপুরুষকে নিজের সত্য প্রচারের জন্য নির্বাচন করে থাকেন তাদের সম্মুখে আল্লাহর মহব্বত এবং সততা ব্যতীত অন্য কোনো বস্তু বাকীই থাকে না। কারণে প্রথম থেকেই তাদের মধ্যে যোগ্যতা প্রদান করা হয় যে, তারা শৈশবকাল হতেই নিজেদের সমসাময়িকদের মধ্যে বিশিষ্ট্য উজ্জ্বলরূপে পরিদৃষ্ট হন এবং আল্লাহর রাস্তায় পরীক্ষাসমূহকে আনন্দের সাথে সহ্য করে ধৈর্য্য সন্তুষ্টির উত্তম আদর্শ পেশ করতে থাকেন। ইসমাঈলআলাইহিস সালামের ঘটনাটি এর প্রমাণের জন্য উপযুক্ত সাক্ষী এবং হাজার হাজার উপদেশমূলক দৃষ্টান্ত।[7]

[1] আল-ছাআলাবী, কাসাসুল আম্বিয়া (তুরস্ক, ১২২৬ হি.) পৃ. ৮৮
[2]
আব্দুল ওয়াহাব আল-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৮
[3]
মাওলানা হিফযুর রহমান, অনু: মাওলানা নূরুর রহমান, কাসাসুল কুরআন, ৫ম সংস্করণ (ঢাকা: ইমদাদিয়া লাইব্রেরি, ২০০১ খৃ.), . , পৃ. ২৭২
[4]
প্রাগুক্ত
[5]
প্রাগুক্ত
[6]
ইবন কাছীর, তারীখ আল-কামিল, ১ম সংস্করণ, (বৈরুত: দার আল কুতুব আল- ইলমিয়্যা, ১৪০৭/১৯৮৭), . . পৃ.৭৪
[7]
আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী, তাফসীর কাবীর (বৈরুত: তা.বি), . ২৬. পৃ. ১৫৩

 ইউসুফআলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে শিক্ষা

ইউসুফআলাইহিস সালামের বিস্ময়কর অভিনব কাহিনীতে ধী-সম্পন্ন লোকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক মাসআলা নিহিত আছে। আসলে কিচ্ছাটি শুধু একটি ঘটনাই নয়, ফযীলত আখলাকের এমন একটি সূবর্ণ কাহিনী যার প্রত্যেকটা দিক নছীহত জ্ঞানের মণি-মুক্তা দ্বারা কানায় কানায় পরিপূর্ণ

ঈমানী শক্তি, আত্মসংযম, সবর, শুকর, পরিত্রতা, দীনদারী, বিশ্বস্ততা, ক্ষমা, দীন প্রচারের অনুপ্রেরণা, আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, আত্মসংশোধন আল্লাহভীতির ন্যায় উচ্চ পর্যায়ের আখলাক এবং মহৎ গুণাবলীর একটি দুর্লভ স্বর্ণ শৃঙ্খল যা কিসসাটির প্রত্যেক পরতে দেখা যায়। তন্মধ্যে নিম্ন হতে নিম্নবর্ণিত কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য

যদি কোনো ব্যক্তির নিজস্ব প্রকৃতি স্বভাব উত্তম হয় এবং তার পরিবেশও পবিত্র-নিস্কলঙ্ক হয়, তবে সে ব্যক্তির জীবন মহৎ চরিত্রাবলীর মধ্যে সুষ্পষ্ট এবং উচ্চস্তরের গুণাবলীর মধ্যে বিশিষ্ট হবে এবং তিনি সর্ব প্রকারের মাহাত্ম্য বুযুর্গীর ধারক বাহক হবেন।[1] ইউসুফআলাইহিস সালামের পবিত্র যিন্দিগী তার অতি উত্তম দৃষ্টান্ত। তিনি ইয়াকূব, ইসহাক এবং ইবরাহীমআলাইহিমুস সালামের মতো অতি উচ্চ মর্যাদাশলি নবী পয়গাম্বরগণের সন্তান ছিলেন, সুতরাং নুবুওয়াত রিসালাতের দোলনায় প্রতিপালিত হন। নবুওয়াত রিসালাতের পরিবারের পরিবেশে শিক্ষা দীক্ষা লাভ করেন। তার নিজস্ব নেক প্রকৃতি এবং স্বভাবগত পবিত্রতা যখন এমন পবিত্র পরিবেশ দেখতে পায় তখন তার সমূদয় প্রশংসনীয় ফযীলত গুণ প্রদীপ্ত হয়ে উঠে! ফলে শৈশব, যৌবন এবং বাধ্যর্ক্যর এমনকি জীবনের সমস্ত কাজ পরহেযগারী, সাধুতা, ধৈর্য্য, দ্বীনদারী এবং আল্লাহর ভালোবাসার এমন উজ্জ্বল বিকাশক্ষেত্র হয়ে গেল যে, মানুষের জ্ঞান এতগুলো পূর্ণ গুণাবলীর সমাবেশযুক্ত একজন মানুষকে দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যায়
যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহর প্রতি ঈমান সঠিক এবং সুদৃঢ় হয় এবং তার ওপর তার বিশ্বাস মজবুত দৃঢ় হয়, তবে পথের সমস্ত জটিলতা মুশকিল তার জন্য সহজ শুধু নয়; বরং সহজতর হয়ে যায়, সত্য দর্শনের পর সমস্ত বিপদ মুসীবত অতি তুচ্ছ হয়ে যায়। ইউসুফআলাইহিস সালামের গোটা জীবনের মধ্যে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে পরিদৃষ্ট হয়।[2]

পরীক্ষা, মুসীবত এবং ধ্বংসের আকৃতিতেই হোক কিম্বা ধন দৌলত এবং রিপুর কামনা বাসনার সুন্দর সুন্দর উপকরণের আকারেই হোক, সর্বাবস্থায় মানুষের উচিৎ আল্লাহ তাআলার দিকে রুজু হওয়া। আল্লাহরই দরবারে কাকুতি মিনতি করা যেন তিনি সত্যের ওপর দৃঢ়পদ রাখেন এবং ধৈর্য্য দান করেন। আযীযে মিসরের বিবি এবং মিসর শহরের সুন্দরী রমণীদের অসৎ প্ররোচন এবং তাদের মনস্কামপূর্ণ না করলে জেলে আবদ্ধ করার ধমক। অতঃপর জেলখানার নানা প্রকার কষ্ট সমস্ত অবস্থায় ইউসুফআলাইহিস সালামের নির্ভর, তার দো এবং কাকুতি-মিনতিসমূহের কেন্দ্রস্থল কেবল আল্লাহরই সাথে সংশ্লিষ্ট দেখা যায়। তাকে আযীযে মিসরের সম্মুখে আবেদন করতেও দেখা যায় না। ফিরআউনের দরবারেও আবদার করতে দেখা যায় না। তিনি সে মিসরের সুন্দরী রমণীদের সঙ্গে মন লাগাচ্ছে না। নিজের পালনকারীর সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গেও না বরং প্রত্যেক ক্ষেত্রে শুধু আল্লাহ তাআলার সাহায্য প্রার্থীই দেখা যায়।[3] যেমন তিনি বলেছেন:

﴿قَالَ رَبِّ ٱلسِّجۡنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدۡعُونَنِيٓ إِلَيۡهِۖ ٣٣﴾ [يوسف: ٣٣]

হে আমার রব, মহিলারা আমাকে যেদিকে আহ্বান করছে তার চেয়ে জেলখানাই আমার নিকট শ্রেয়।” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৩]

﴿مَعَاذَ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ رَبِّيٓ أَحۡسَنَ مَثۡوَايَۖ ٢٣﴾ [يوسف: ٢٣]

আল্লাহর আশ্রয় ভিক্ষা চাইছি। নিঃসন্দেহে তিনি (আযীয মিসর) আমার মুরব্বি আমাকে সম্মান মর্যাদার সহিত রেখেছেন।” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২৩]

যখন আল্লাহ তাআলার মহব্বত এবং ভালোবাসা অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে, তখন মানুষের জীবনের সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য একমাত্র তিনিই হয়ে যান। তার দীনের দাওয়াত, তাবলীগের আকাঙ্ক্ষা সর্বক্ষণ ধমনীসমূহে শিরায় শিরায় ধাবিত হতে থাকে। যেমন, জেলখানায় কঠিন মুসীবতের সময় নিজের সাথীদের সাথে ইউসুফআলাইহিস সালামের সর্বপ্রথম কথা এটিই ছিল। যা আল-কুরআনের

﴿يَٰصَٰحِبَيِ ٱلسِّجۡنِ ءَأَرۡبَابٞ مُّتَفَرِّقُونَ خَيۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَٰحِدُ ٱلۡقَهَّارُ ٣٩﴾ [يوسف: ٣٩]

হে আমার জেলখানার বন্ধুদ্বয়! পৃথক পৃথক বহু দেবতার উপাসনাই কি ভালো? না কি একমাত্র মহা শক্তিশান আল্লাহ তাআলার ইবাদতই উত্তম?” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৯] শীর্ষক বাণীতে উল্লেখ পাওয়া যায়

দীনদারী বিশ্বস্ততা এমন একটি নিআমত যে, একে মানুষের ধর্মীয় পার্থিব সৌভাগ্যের চাবিকাঠি বলা যেতে পারে। আযীযে মিসরের এখানে ইউসুফআলাইহিস সালাম যেরূপে প্রবেশ করেছিলেন, ঘটনাবলীর বিস্তৃত বিবরণে তা জানা গিয়েছে। এটি ইউসুফআলাইহিস সালামের দীনদারী এবং বিশ্বস্ততারই ফল ছিল যে, প্রথম তিনি আযীযে মিসরের দৃষ্টিতে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং প্রিয় হন। তৎপর একেবারে সমগ্র মিসর রাজ্যের মালিকই হয়ে বসেন।[4]

আত্মনির্ভরশীলতা মানুষের উচ্চ শ্রেণির গুণাবলীর অন্তর্গত একটি মহৎ গুণ। আল্লাহ তাআলা যাকে দৌলত দান করে সে ব্যক্তিই দুনিয়ার সর্বপ্রকার মুসীবত দুঃখ কষ্ট অতিক্রম করে দুনিয়া আখিরাতের উন্নতি লাভ করতে পারে

[1] সম্পাদন পরিষদ, সীরাত বিশ্বকোষ, ১ম সংস্করণ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৫ খৃ.), . , পৃ. ১৩০
[2]
প্রাগুক্ত
[3]
মওলানা হিফযুর রহমান, প্রাগুক্ত, . , পৃ. ৩৩৭
[4]
মওলানা আহমদ অন্যান্য, কাসাসুল কুরআন, ১০ম সংস্করণ (মিসর, ১৯৬৯ .) . , পৃ. ৩১২

 মূসাআলাইহিস সালাম হারুনআলাইহিস সালাম এবং তার সঙ্গে তাগুতের ধ্বজাধারী ফিরআউনের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ঘটনা থেকে শিক্ষা

মূসাআলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈল, ফিরআউন এবং ফিরআউনের কাওমের দীর্ঘ ঐতিহাসিক কাহিনী শুধু একটি কাহিনী গল্প নয়, বরং সত্য-মিথ্যার প্রতিযোগিতা, ন্যায়-অন্যায়ের লড়াই স্বাধীনতা দাসত্বের টানা-হেঁচড়া, অক্ষম হীনদের মস্তকোত্তলণ, অত্যাচারী উন্নত মস্তকদের হীনতা বরণ ধ্বংস, সত্যের সফলতা এবং বাতিলের পরাভূত অপদস্থ হওয়া, ধৈর্য পরীক্ষা, শোকর এবং অনুগ্রহের বিকাশ ক্ষেত্র। মোটকথা, অকৃতজ্ঞতা না-শুকরীর নিকৃষ্ট পরিণতির এমন মহৎ ফলশ্রুতিপূর্ণ এবং তথ্যাবলীর এমন সারগত বিষয় নিহিত রয়েছে এবং প্রত্যেক রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিকে তা জ্ঞানের সীমা সুক্ষ্মদৃষ্টি অনুযায়ী চিন্তা গবেষণার দাওয়াত প্রদান করছে। তৎসমূদয় হতে নমুনাস্বরূপ নিম্নের কয়েকটি জ্ঞানগর্ভ বিষয় বিশেষভাবে চিন্তনীয় অনুধাবনীয়

মানুষ যদি কোনো বিপদ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তবে তার অবশ্য কর্তব্য হয় ধৈর্য সন্তুষ্টির সাথে এর মুকাবিলা করা। এরূপ করলে নিঃসন্দেহে সে মহা মঙ্গল লাভ করবে এবং নির্ঘাত সে সফলকাম হবে। মূসাআলাইহিস সালাম ফিরআউনের পূর্ণ ঘটনাটি এর জীবন্ত সাক্ষী।[1]

যে ব্যক্তি নিজের সমূদয় কাজ-কর্মে আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা নির্ভর রাখে এবং একমাত্র তাকেই খাঁটি অন্তরের সাথে নিজের পৃষ্ঠপোষক মনে করে, আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তার যাবতীয় বিপদ সহজসাধ্য করে দেন এবং তার সমস্ত বিপদকে মুক্তি সফলভাবে রূপান্তরিত করে দেন। মূসাআলাইহিস সালাম ক্কিবতীকে হত্যা করা, মিসরবাসীরা মূসাআলাইহিস সালামকে হত্যা করার জন্য পরামর্শ করা, অতঃপর শত্রু দলেরই মধ্য থেকে একজন সমব্যথী ব্যক্তি মূসাআলাইহিস সালামকে মিসরবাসীদের ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে অবহিত করা, এরূপে তার মাদায়েন চলে যাওয়া এবং নবুওয়াত লাভ।[2]

যদি আল্লাহর কোনো বান্দা সত্যের সাহাযার্থে জীবন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাআলা বাতিলের পুজারীদেরই মধ্য থেকে তার সাহায্যকারী তৈরি করে দেন। আমাদের সম্মুখে মূসাআলাইহিস সালামের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। যখন ফিরআউন তার সভাসদ তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তখন তাদেরই মধ্য থেকে একজন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি তৈরি হয়ে গেলেন যিনি মূসাআলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে পূর্ণ প্রতিবাদ করলেন। অনুরূপভাবেই ক্কিবতীকে হত্যা করার পর যখন তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল, তখন একজন আল্লাহভক্ত ক্কিবতী মূসাআলাইহিস সালামকে বিষয়ে সংবাদ প্রদান করলেন এবং তাকে মিসর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সৎ পরামর্শ দিলেন, যা ভবিষ্যতে মূসাআলাইহিস সালামের নানাবিধ মহাসাফল্যর কারণ হয়েছিল।[3]

সবরের ফল সর্বদা মিষ্ট হয়ে থাকে, ফল লাভ করতে যতই দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হোক না কেন, তবুও সে ফল মিষ্টই লাগবে। বনী ইসরাঈল কত দীর্ঘকাল পর্যন্ত মিসরে নিঃসহায়তা, দাসত্ব এবং পেরেশান অবস্থায় জীবন কাটিয়েছিল এবং পুরুষ সন্তানদের হত্যা মেয়ে সন্তানদের দাসী হওয়ার অপমান সহ্য করছিল, কিন্তু পরিশেষে এমন সময় এসেই পড়ল, যখন তারা সবরের মিষ্ট ফল লাভ করল এবং ফিরআউনের ধ্বংস নিজেদের সম্মানজনক মুক্তি তাদের সর্বপ্রকার সাফল্যের পথ মুক্ত করে দিল।[4] যেমন, আল্লাহর বাণী:

﴿وَتَمَّتۡ كَلِمَتُ رَبِّكَ ٱلۡحُسۡنَىٰ عَلَىٰ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ بِمَا صَبَرُواْۖ ١٣٧﴾ [الاعراف: ١٣٧]

এবং বনী ইসরাঈলদের ওপর আপনার রবের নেক বাণী পূর্ণ হলোই হলো শুধু জন্য যে, তারা ধৈর্যধারণ করেছে।’’ [সূরা আল রাফ, আয়াত: ১৩৭]

সত্যকে কেউ কবুল করুক বা না করুক, সত্যের প্রতি আহ্বানকারীর কর্তব্য সত্য উপদেশ প্রদানে বিরত না থাকা। যেমন, শনিবারের মর্যাদা নষ্ট করায় তাদেরই মধ্য হতে কতিপয় সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি তাদেরকে বুঝাল। তাদের কতক লোক এও বলেছিল যে এদেরকে বুঝানো নিষ্ফল, কিন্তু সত্যের প্রতি পাকা আহ্বানকারীরা উত্তর করলেন,

﴿مَعۡذِرَةً إِلَىٰ رَبِّكُمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ١٦٤﴾ [الاعراف: ١٦٤]

‘‘কিয়ামতের দিন আমরা আল্লাহ তাআলার সম্মুখে ওযরতো পেশ করতে পারবো যে, আমরা অনবরত সত্যের প্রচার করতে রয়েছি’’, অদৃশ্য জগতে কি নিহিত রয়েছে, তার জ্ঞান তো আমাদের নেই। বিচিত্র কি যে, এরা পরহেযগার হয়ে যাবে [সূরা আল-রাফ, আয়াত: ১৬৪]

[1] আল-কিসাঈ, কাসাসুল আম্বিয়া (লাইডেন, ১৯২২ খৃ.) পৃ. ১৩৮
[2]
মুহাম্মাদ জামীল আহমদ, আম্বিয়া -কুরআন, (লাহোর: শায়খ গোলাম আলী এন্ড সন্স, তা.বি), ., পৃ. ২৭৮
[3]
প্রাগুক্ত
[4]
হিফজুর রহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন (লাহোর: মোস্তাক বুক কর্ণার, তা.বি) . , পৃ. ৩৫৮-৩৬০)

 দাউদআলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে শিক্ষা

দাউদআলাইহিস সালামের পবিত্র জীবনের অবস্থা ঘটনাবলী আমাদের জন্য যে সমস্ত জ্ঞান উপদেশ পেশ করেছে তা যদিও অতিশয় ব্যাপক, তবুও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য এবং মূল্যাবান পরিণাম বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে

আল্লাহ তাআলা যখন কাউকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী করেন এবং তার ব্যক্তিত্বকে বিশেষ মর্যাদায় সম্মানিত করতে ইচ্ছে করেন, যখন তাঁর স্বভাবজাত যোগ্যতাসমূহকে বাল্যকাল থেকেই দীপ্তিমান করে তুলতে থাকেন এবং তার ললাট দীপ্তিমান নক্ষত্রের ন্যায় উজ্জ্বল পরিদৃষ্ট হতে থাকে। যেমন, দাউদআলাইহিস সালামকে যখন পয়গম্বর এবং উচ্চ শ্রেণির রাসূল মনোনীত করা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছিল, তখন জীবনের প্রাথমিক স্তরেই তাগুতের মতো যালিম প্রবল প্রভাবশালী রাজাকে তার হত্যা করিয়ে তার সাহস বীরত্ব এবং তা দৃঢ় সংকল্প দৃঢ়পদতার যোগ্যতাকে এমনভাবে প্রকাশ করে দিলেন যে, সমগ্র বনী ইসরাঈল তাকে নিজেদের প্রিয় নেতা এবং বরেণ্য পথ প্রদর্শকরূপে মান্য করতে লাগল।[1]
অনেক সময় আমরা কোনো একটি বস্তুকে মামুলী এবং সাধারণ মনে করি, কিন্তু অবস্থা ঘটনাবলী পরে প্রকাশ করে যে, এটি অতি মূল্যবান বস্তু। যেমন, দাউদআলাইহিস সালামের শৈশবের অবস্থাবলীর মধ্যে পরবর্তীকালে মুজাহিদসুলভ সত্যের সংরক্ষণ, আল্লাহ তাআলার আহকামকে দৃঢ়রূপে ধারণের সাথে দাওয়াত প্রদান এবং নবুওয়্যাতকালের অবস্থাবালীর মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তাই উপরোক্ত দাবীর জ্বলন্ত প্রমাণ।[2]
সর্বদা খলীফাতুল্লাহ (নবী রাসূল) এবং নাফরমান বে-দীন বাদশাহদের মধ্যে প্রভেদ দৃষ্ট হবে যে, প্রথম দলের মধ্যে সর্বপ্রকার প্রতাপ-প্রতিপত্তি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বিনয় নম্রতা এবং মানবজাতির খিদমত প্রদীপ্ত চিহ্ন দেখা যাবে। আর শেষোক্ত দলের মধ্যে অহংকার, আমিত্ব, যুলুম জবরদস্তীর প্রাবল্য থাকবে। তারা (জনসেবার পরিবর্তে) আল্লাহর সৃষ্ট মানব জাতিকে নিজেদের শান্তি আমোদ-উপভোগের যন্ত্রস্বরূপ মনে করবে

আল্লাহ তাআলার বিধান এই যে, যে ব্যক্তি সম্মান উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হওয়ার পর যে পরিমাণ আল্লাহ তাআলার শোকর করে এবং তাঁর দয়া অনুগ্রহ যে পরিমাণ স্বীকার করে, সে পরিমাণই তাকে বেশি পুরষ্কার সম্মান প্রদান করা হয়। দাউদআলাইহিস সালামের পূর্ণ জীবনটি এরই প্রমাণ।[3]

মাযহাব, ধর্ম যদিও আধ্যাত্মিকতার সাথে অধিক সংশ্লিষ্ট, কিন্তু পার্থিব ক্ষমতা (খিলাফত) এর বড় পৃষ্ঠপোষক। অথ্যাৎ ধর্ম ধর্ম সঙ্গত সমাজ দ্বীন এবং পার্থিব অবস্থার সংশোধনের যিম্মাদার। আর পার্থিব ক্ষমতা তথা খিলাফত হলো ধর্মে বর্ণিত ন্যায়নীতির সংরক্ষক। মর্মে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাণী সুপ্রসিদ্ধ ‘‘নিঃসন্দেহে, আল্লাহ তাআলা ক্ষমতার অধিকারী শাসকের দ্বারা অন্যায় দমনের সে কাজ গ্রহণ করে থাকেন, যা কুরআন মাজীদের দ্বারা সম্পন্ন হয় না।[4]

আল্লাহ তাআলা রাজ্য রাজত্ব প্রদানের জন্য কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে যা বর্ণনা করেছেন, তার সারমর্ম এই যে, সর্বপ্রথম মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মিয়ে নেওয়া উচিৎ যে, রাজ্য রাজত্ব প্রদান করা এবং তা কেড়ে নেওয়া একমাত্র আল্লাহরই এখতিয়ারাধীন

[1] মাওলানা হিফজুর রহমান, অনু. মাওলানা নূরুর রহমান, প্রাগুক্ত, . , পৃ. ৩০৫
[2]
প্রাগুক্ত
[3]
প্রাগুক্ত
[4]
প্রাগুক্ত

 আইয়ূবআলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে শিক্ষা

আইয়ূবআলাইহিস সালামের জীবনী তার সম্বন্ধিয় বিভিন্ন ঘটনা থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে যা নিম্নরূপ:

আইয়ূবআলাইহিস সালামের জীবনী উল্লেখযোগ্য শিক্ষণীয় বিষয়, আল্লাহ তাআলার বান্দাগণের মধ্যে আল্লাহ তাআলার সাথে যার যতটুকু সান্নিধ্য আছে তার পরীক্ষাও সে অনুপাতেই হয়ে থাকে। পরীক্ষায় পতিত হয়ে যদি কেউ সবর করে, কোনোরূপ অভিযোগ না করে তবে তার মর্যাদা পূর্বের তুলনায় শতগুণে বেড়ে যায়। একদা সা নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলেন- ‘‘কোনো ধরণের মানুষ কঠিনতর পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে থাকে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নবীগণ সর্বাধিক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এরপর যারা উত্তম। এভাবে পরীক্ষার কঠোরতা ক্রমেই লঘু হতে থাকে। মোটকথা, মানুষ যারা দীনের পরিপক্ক হয় তবে তার পরীক্ষা অপরাপর মানুষের তুলনায় কঠিন হয়। আর যে ব্যক্তি ধর্মের ব্যাপারে দুর্বল তার পরীক্ষাও সে অনুসারেই হয়ে থাক।’’[1]

সুখে-দুঃখে তথা জীবনের সকল অবস্থায় মানুষের জন্য উচিৎ তাদের প্রতিপালকের শোকর আদায় করা, জীবনে সুখ-সম্মৃদ্ধি আসলে আল্লাহ তাআলার রহমত বলে গণ্য করা। আর যদি কোনো প্রতিকুল পরিবেশ বা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তাহলে ধৈর্যধারণ করা। কেননা আল্লাহর প্রতি অভিযোগ নবী-রাসূলগণের শিক্ষা পরিপন্থী
মানুষের জন্য উচিৎ কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া। নিরাশ হওয়া কুফুরী। যেমন, আল্লাহর বাণী:

﴿لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًا﴾ [الزمر: ٥٣]

‘‘আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না, আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দিবেন।’’ [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩]

স্ত্রীর জন্য উচিৎ সর্বদা স্বামীর খিদমতে নিয়োজিত থাকা, সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় স্বামীর পাশে থাকা, নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে হলেও স্বামীর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তার সেবায় নিয়োজিত থাকা। যা আমরা আয়্যুবআলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, যেমন আইয়ূবআলাইহিস সালামের পবিত্রা স্ত্রীরাহমাকরেছিলেন।[2]

[1] ইমাম তিরমিযী, জামেতিরমিযী (দেওবন্দ: কুতুবখানায়ে রশীদিয়া, তা.বি) . , পৃ. ৬৫
[2]
মাওলানা মুহাম্মদ হিফযুর রহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন(করাচী: মীর কুতুবখানা আরামবাগ, তা.বি) . , পৃ. ১৯৩-৯৫

 উযায়েরআলাইহিস সালামের কিসসা থেকে শিক্ষা

উযায়েরআলাইহিস সালামের ঘটনাবলীকে যারা কিসসা কাহিনীর পরিবর্তে ঐতিহাসিক প্রকৃত ঘটনা মনে করেন, তারা নিঃসন্দেহে তা থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ ফায়দা গ্রহণ করতে পারেন এবং তারা নিম্নলিখিত উপদেশগুলোকেও সে প্রসঙ্গীয় উপদেশাবলীর শৃঙ্খলের কথা মনে করবেন

মানুষ যতই উন্নতির শিখরে আরোহণ করুক এবং আল্লাহ তাআলার সাথে তার যত অধিক নৈকট্যই লাভ হোক, তবুও সে আল্লাহ তাআলার বান্দাই থেকে যায়। কোনো স্তরেই পৌঁছে সে আল্লাহ কিংবা আল্লাহর পুত্র হতে পারে না। কেননা, আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্ত্বা এক অদ্বিতীয়। তিনি পিতা-পুত্রের সম্পর্ক থেকে পবিত্র এবং বহু উর্ধ্বে। সুতরাং এটি মানুষের মারাত্মক ভ্রান্তি যে, যখন তারা কোনো বুযুর্গ মনোনীত লোক দ্বারা এমন কাজ সংঘটিত হতে দেখে, যা সাধারণত মানব বুদ্ধির নিকট আশ্চর্যবোধক বিষ্ময়কর হয়। তখন সে প্রভাব বা চরম ভক্তির কারণে বলে উঠে, ব্যক্তিত্ব আল্লাহ তাআলার অবতার (অর্থ্যাৎ মানবাকারে আল্লাহ) বা আল্লাহর পুত্র। সে চিন্তা করে না যে, নিঃসন্দেহে সমস্ত ঘটনার সংগঠন আল্লাহ তাআলারই ক্ষমতা দ্বারা মুজিযাস্বরূপ সে ব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে থাকে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সে আল্লাহও নয় এবং আল্লাহর পুত্রও নয়; বরং তার একজন সান্নিধ্যপ্রাপ্ত বান্দা। এর সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার সম্মুখে সেরূপই অক্ষম, যেমন অন্যান্য মাখলূক সৃষ্টি। যেমন, কুরআন মাজীদে স্থানে স্থানে সত্যটিকে স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করে মানুষেকে সে সমস্ত বিভ্রান্তিকর আকিদা থেকে কঠোরভাবে বারণ করা হয়েছে।[1]

আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারাহ এর ঘটনাটিকে ইবরাহীমআলাইহিস সালামের ঘটনাটির সাথে মিলিতভাবে বর্ণনা করেছেন, যাতে উল্লেখ আছে যে, তিনিও একবার আল্লাহ তাআলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আমাকে দেখিয়ে দিন, আপনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করে থাকেন। অতঃপর আল্লাহ তাকে প্রশ্ন করলেন, ইবরাহীম, বিষয়ের প্রতি কি তোমার বিশ্বাস নেই? তখন ইবরাহীমআলাইহিস সালাম আরয করলেন, হে আল্লাহ, বিশ্বাস নিঃসন্দেহেই করি যে, আপনি মৃতকে জীবন দান করে থাকেন, কিন্তু আমার প্রশ্নের আন্তরিক উদ্দেশ্য তৃপ্তি লাভ করা। অতএব, আল্লাহ তাআলা পূর্বোক্ত ঘটনাটিকে ঘটনার সাথে মিলিতরূপে উদ্দেশ্যে বর্ণনা করেছেন, যেন বিষয়টি পরিষ্কার উজ্জ্বল হয়ে যায় যে, আম্বিয়ায়ে কিরামের তরফ থেকে এরূপ প্রশ্ন উদ্দেশ্যে হয় না যে, তারা মৃতকে জীবন দান বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন এবং সেই সন্দেহকে দূর করতে চান; বরং তাদের ব্যাখ্যা প্রার্থনার উদ্দেশ্য শুধু এই হয় যে, বর্তমানে সম্বন্ধে তাদের যে দৃঢ় বিশ্বাসজনিত জ্ঞান রয়েছে তা প্রত্যক্ষ জ্ঞান দিব্য জ্ঞানের স্তরে পৌঁছে যায়। অর্থ্যাৎ তারা বিষয়টির ওপর যেমন দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন, তদ্রুপ তারা কামনা করেন যে, স্বচক্ষেও তা দেখে নেন। কেননা তারা আল্লাহ তাআলার বান্দাদের হিদায়াত সৎপথ প্রদর্শনের জন্য আদিষ্ট হওয়ার কারণে যে সমস্ত দায়িত্ব তাদের ওপর রয়েছে, তার তাবলীগ দাওয়াতের কার্যকে যেন তারা অতি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারেন এবং বিশ্বাসের সর্বোচ্চ স্তর থেকে উপরে এমন কোনো স্তর বাকী না থাকে, যা তাদের হাসিল হয় নি।[2]

ইহলোক কর্মের জগত। এর বিনিময় প্রাপ্তির জন্য অন্য একটি জগত রয়েছে। যাকে পরলোক বলা হয়, কিন্তু আল্লাহ তাআলার নীতি প্রচলিত রয়েছে যে, অত্যাচার অহংকার এমন দুটি কর্ম যালিম অহংকারীকে তিনি ইহলোকে অবশ্যই লাঞ্ছনা অপমানজনক প্রতিফল আস্বাদন করিয়ে থাকেন। বিশেষ করে যখন দুটি কর্ম ব্যক্তিবর্গের পরিবর্তে কাওমসমূহের স্বভাব হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের স্বভাবের অংশরূপে পরিণত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿قُلۡ سِيرُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَٱنظُرُواْ كَيۡفَ كَانَ عَٰقِبَةُ ٱلۡمُجۡرِمِينَ ٦٩﴾ [النمل: ٦٩]

‘‘আপনি তাদেরকে বলে দিন, তোমরা আল্লাহর যমিনে ভ্রমণ কর এবং দেখ, অপরাধী কাওমগুলোর পরিণাম কিরূপ হয়েছিল।’’ [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬৯]

কিন্তু বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কাওমগুলোর সমষ্টিগত জীবনের স্থায়িত্ব ধ্বংস, ব্যক্তিগত জীবন থেকে পৃথক হয়ে থাকে। সুতরাং কর্মফল বিলম্বিত হওয়ার কারণে কখনও কোনো সৎসাহসী এবং দৃঢ়চেতা লোকের পক্ষে ঘাবড়িয়ে যাওয়া কিংবা নিরাশ হয়ে পড়া সমীচীন নয়। কেননা আল্লাহ তাআলার নির্ধারিতকর্মফলের নিয়মস্বীয় নির্দিষ্ট সময় থেকে কখনও ব্যতিক্রম হয় না

[1] মাওলানা হিফযুর রহমান, প্রাগুক্ত, . , পৃ. ১৫৪
[2]
মাওলানা হিফযুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৫

 উপসংহার

আল-কুরআনে বর্ণিত কাসাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ শিরোনামের সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের উপসংহারে আমরা বলতে চাই যে, কুরআনের সত্য বাস্তব কাহিনী হোক প্রতিটি মুসলিমের জীবনের পাথেয়। বিশেষ করে আমাদের শিশু কিশোরদের চরিত্র গঠনে তা হোক নিত্যসঙ্গী। কারণ, আল-কুরআনের সত্য-সঠিক, যৌক্তিক তাত্ত্বিক কাহিনীমালা বরাবরই শ্রোতৃমণ্ডলীকে মৃদু স্পর্শে আকুল করে তোলে

বারবার কাহিনী বর্ণনা করতে এবং শুনতে লোকদের ক্লান্তি আসে না বরং এটি এক জীবন্ত মুজিযা যাতে রয়েছে সম্মোহনী শক্তি। সুতরাং প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য পদ্ধতি শিক্ষা অনুসরণ খুবই সহজ এবং ফলদায়ক, আর অন্য সাধারণের চরিত্র গঠনেও এটি কার্যকর

No comments

Powered by Blogger.