ব্যাংকের সুদ কি হালাল - অনুচ্ছেদ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, শাইখ মোস্তাক আহমাদ কারীমী
ঋণের সংজ্ঞা
ঋণের নিম্নরূপ সংজ্ঞা করা হয়েছে,
دفع مال لمن ينتفع به ويرد بدله
অর্থাৎ এক ব্যক্তির অপর ব্যক্তিকে কোন মাল (ধার) দেওয়া, যাতে সে (বর্তমানে) নিজের প্রয়োজন মিটাতে পারে এবং পরে সে তার এ (দেনার) পরিবর্ত ফিরিয়ে দেয়।
কর্জ বা ঋণ লেন-দেন করার সময় ঋণের নির্দিষ্ট পরিমাণ, তার গুণ ও বৈশিষ্ট্য (কোয়ানটিটি ও কোয়ালিটি) জেনে রাখা একান্ত জরুরী।
সমাজের মানুষের সুবিধার্থে ইসলামী শরীয়তে কর্জ নেওয়া-দেওয়াকে বৈধ করা হয়েছে। কিন্তু এ ঋণ ব্যবস্থা অর্থ উপার্জনের কোন প্রকার অসীলা বা উপায় বলে বিবেচিত নয় এবং নিজের মাল বৃদ্ধি করার পথসমূহের মধ্যে কোন (বৈধ) পথও নয়। তাই তো ঋণ দেওয়ার পর ঋণগ্রহীতাকে কেবল সেই পরিমাণ মালই পরিশোধ করতে হয় যে পরিমাণ মাল সে ঋণদাতার নিকট থেকে গ্রহণ করেছে। নতুবা তাকে এ নেওয়া মালের অনুরূপ মাল ফেরৎ দিতে হয়। তার চেয়ে অধিক মাল কোনক্রমেই ফেরৎ দিতে হয় না।
কারণ ফিক্হের নীতিগত আইন এই যে,
أي قرض جر منفعا فهو ربا.
অর্থাৎ, যে ঋণ কোন প্রকার মুনাফা আনয়ন করে তা (এ মুনাফা) সুদ বলে গণ্য।
তবে হ্যাঁ, ঋণের উপর এ মুনাফা কেবল তখনই ঋণদাতার জন্য হারাম ও সুদ বলে বিবেচিত হবে, যখন ঋণ দেওয়ার সাথে এ মুনাফা দেওয়ার শর্ত ও চুক্তি আরোপ করা হবে। অথবা এমন দেওয়া-নেওয়া তাদের মাঝে পরিচিত থাকবে।[1]
নচেৎ যদি ঋণের উপর এ মুনাফার শর্ত আরোপ করা না হয় অথবা তাদের মাঝে এরূপ লেনদেন পরিচিত না হয়, তাহলে ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে তার ঋণ পরিশোধের সময় সুন্দর ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়ে নেওয়া বস্ত্ত অপেক্ষা উত্তম বস্ত্ত প্রদান করতে পারে।
আবু রাফে’ (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এক ব্যক্তির নিকট থেকে একটি উটের বাচ্চা ধার নিয়েছিলেন। অতঃপর তাঁর নিকট যখন সদকার উট এল, তখন তিনি এ লোকটির উটের বাচ্চা পরিশোধ করতে আমাকে আদেশ করলেন। আমি বললাম, ‘উটগুলোর মধ্যে সবগুলোই বড় বড় উট, উটের কোন বাচ্চা ওদের মধ্যে নেই।’
তখন নবী করীম (সাঃ) বললেন,
أعطه إياه، فإن خيركم أحسنكم قضاء.
অর্থাৎ, এ বড় উটই দিয়ে দাও। কারণ, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে (ঋণ) পরিশোধের ব্যাপারে উত্তম।’’[2]
কর্জ ও ঋণের উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, ব্যাংক সুদের উপর যে ঋণ দেয় ও নেয় তা অবৈধ। সুতরাং আবশ্যক হল (ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকরণ এবং) ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক লোকেদের সুবিধার্থে বিনা সুদে ঋণ প্রদান। (আল বুনূকুল ইসলামিয়্যাহ বাইনান নাযারিয়্যাতি অত্তাত্ববীক্ব ১১৭পৃঃ)
[1] অর্থাৎ ঋণ নিলে অতিরিক্ত দিতে হয় তা তাদের মাঝে প্রচলিত থাকলে নতুনভাবে শর্ত আরোপ না করলেও সুদ বলে গণ্য। তদনুরূপ ঋণ দেওয়ার পর ঋণগ্রহীতার তরফ থেকে বিভিন্ন হাদিয়া উপঢৌকন,
উপহার ইত্যাদি গ্রহণ করাও সূদের পর্যায়ভুক্ত।
[2] (মুসলিম ৫/৪৫, হাদীস নং ১৬০০,
উক্ত হাদীস ইমাম বুখারী আবু হুরাইরা কর্তৃক বিভিন্নসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করেছেন,
দেখুন, বুখারী ৩য় খন্ড ২৫৩ পৃঃ,
হাদীস নং ২৩০৫, মুসলিম ১৬০১ নং)
সূদ প্রতিহত করার বিভিন্ন পদ্ধতি
ইসলাম যখন কোন বস্ত্তকে হারাম ঘোষণা করে, তখন সেই বস্ত্তর কাছে পৌছে দেয় এমন সকল প্রকার রাস্তা উপায়, উপকরণ, অসীলা ও ছিদ্রপথকেও এক সঙ্গে বন্ধ করে দেয়। বরং যে স্থান হতে সেই বস্ত্তর প্রতি যাওয়ার জন্য উদ্যোগ শুরু হয় সেই স্থানেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেয়। যাতে মানুষ তার নিকটেও পৌঁছতে না পারে।
বলা বাহুল্য, ইসলাম প্রত্যেক সেই জিনিসকে হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে যা মুসলিমকে সূদ পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং যা সূদের অসীলা ও ছিদ্রপথ। আমরা নিম্নে এমন কয়েকটি জিনিস নিয়ে আলোচনা করব যাকে সূদের উপায় ও পথ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ইসলাম নিষিদ্ধ বর্ণনা করেছেঃ-
1.
রিবাল ফায্লঃ
একই শ্রেণীভুক্ত দুটি জিনিসের হাতে-হাতে লেন-দেনের সময় অথবা দুই শ্রেণীভুক্ত দুটি জিনিসের ধারে লেন-দেনের সময় যে অতিরিক্ত ও বাড়তি অংশ নেওয়া-দেওয়া হয় তাকে ‘রিবাল ফায্ল’ বলা হয়।
সেই সকল প্রকার বস্ত্ত রিবাল ফাযলের পর্যায়ভুক্ত হতে পারে, যাতে সেই কারণ পাওয়া যায় যা নবী করীম (সাঃ) কর্তৃক বর্ণিত ছয়টি জিনিসে পাওয়া যায়। আর ছয়টি জিনিস হল, সোনা, চাঁদি, গম, যব, খেজুর এবং লবণ।
আল্লামা ইবনুল কাইয়েম বলেন, ‘ইসলাম সূদের পথ বন্ধ করার জন্যই রিবাল ফায্লকে হারাম চিহ্নিত করেছে। কারণ এতে ঋণ ভিত্তিক সূদ খাওয়ার আশঙ্কা বর্তমান। আর তা এই জন্য যে, যখন কোন ব্যক্তি এক দিরহামকে দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করবে, তখন ধীরে ধীরে নগদ কারবার অতিক্রম করে ধারেও এ রূপ কারবার শুরু করতে প্রয়াস পাবে; যাকে মহাজনী (ঋণী) কারবার বলা হয়। আর উক্ত কারবার সূদখোরীর একান্ত নিকটতম অসীলা। এই জন্যই যুক্তির নিক্তিতে সমীচীন এটাই ছিল যে, সুদের সকল দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ করা হোক এবং এক দিরহামের বিনিময়ে হাতে-হাতে অথবা ধারে উভয় প্রকার বেচা-কেনা নিষিদ্ধ করা হোক। আর এ যুক্তি বিবেকের কষ্টিপাথরেও যথার্থ; যার ফলে ফাসাদ ও বিপত্তির সকল দুয়ার ও ছিদ্রপথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
আর এক দিরহামকে দুই দিরহামের বিনিময়ে বেচা-কেনার প্রয়োজন তখন পড়ে, যখন উভয় দিরহামের মধ্যে গুণ বা বৈশিষ্ট্যগত কোন পার্থক্য বিদ্যমান থাকে; যেমন একটি উৎকৃষ্ট শ্রেণীর এবং অপরটি নিম্নশ্রেণীর অথবা একটি হালকা এবং অপরটি ভারী ইত্যাদি।[1]
উক্ত প্রকার কারবার হারাম করার মানসে উবাদাহ বিন সামেত রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক এক হাদীসে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেন,
الذهب بالذهب والفضة بالفضة والبر بالبر والشعير بالشعير والتمر
بالتمر والملح بالملح مثلا بمثل سواء بسواء يداً بيد، فإذا اختلفت هذه الأصناف
فبيعوا كيف شئتم إذا كان يداً بيد.
অর্থাৎ, ‘‘সোনার বিনিময়ে সোনা, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে উভয় বস্ত্তকে যেমনকার তেমন, সমান সমান এবং হাতে হাতে হতে হবে। অবশ্য যখন উভয় বস্ত্তর শ্রেণী বা জাত বিভিন্ন হবে, তখন তোমরা তা যেভাবে (কমবেশী করে) ইচ্ছা বিক্রয় কর; তবে শর্ত হল, তা যেন হাতে হাতে নগদে হয়।’’ (মুসলিম, মিশকাত ২৮০৮ নং) সুতরাং বুঝা গেল যে, একই শ্রেণীভুক্ত দুটি জিনিসকে একটিকে অপরের বিনিময়ে হাতে হাতে অথবা ধারে কমবেশী করে বেচা-কেনা হারাম। অবশ্য উভয় জিনিসের শ্রেণী ও জাত ভিন্ন ভিন্ন হলে নগদ ক্রয় বিক্রয় বৈধ। নচেৎ ধারে হলে তাও অবৈধ।[2]
২- সুদখোরের নিকট চাকুরী করা অথবা সুদের কোন প্রকার সহায়তা করাঃ-
সুদের দরজা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ইসলাম যে সব উপায় ও পদ্ধতি ব্যবহার করেছে তার মধ্যে এক পদ্ধতি এই যে, সুদকে যেমন হারাম ও অবৈধ ঘোষণা করেছে তেমনি তার সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতাকেও হারাম ও নিষিদ্ধ জারী করেছে। সুতরাং সূদ নেওয়া যেমন হারাম তেমনি দেওয়াও হারাম। (অবশ্য নিরুপায় অবস্থার কথা ভিন্ন।) অনুরূপ প্রত্যেক মুসলমানের জন্য সেই কর্ম করাকেও হারাম বলা হয়েছে যে সব কর্মে বা কর্মক্ষেত্রে সূদী কারবার আছে। অতএব সুদী খাতা-পত্র লেখক, হিসাবরক্ষক, সুদীকারবারের সাক্ষ্যদাতা প্রভৃতিও এ সুদখোরের মত সমান গোনাহরই ভাগী।
এ কথা হাদীস শরীফে স্পষ্টভাবে এইরূপ এসেছেঃ
لَعَنَ رَسُولُ الله ﷺ آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ وَكَاتِبَهُ
وَشَاهِدَيهِ وَقَالَ: هُمْ سَوَاء.
অর্থাৎ, ‘‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) সুদখোর, সূদদাতা, সূদের লেখক এবং তার উভয় সাক্ষীকে অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, ওরা (পাপে) সকলেই সমান।’’[3]
এই অভিশাপ ও পাপে তারাও শামিল হবে, যারা তাদের বিল্ডিং, বাড়ি বা দোকান সুদীকারবারে জড়িত কোন ব্যক্তি, কোম্পানী অথবা সুদী ব্যাংককে ভাড়া দিয়ে থাকে। আর তারাও এর আওতাভুক্ত যারা অনুরূপ সুদী ব্যাংকে নিজেদের টাকা-পয়সা জমা রাখে---যদিও তারা সুদ নেয় না বা খায় না। (নিরুপায় অবস্থায় চোর-ডাকাতের ভয়ে ব্যাংকে টাকা রাখতেই হলে তার নির্দেশ ..... পৃষ্ঠায় দেখুন। )
৩- ঋণ দেওয়ার ফলে কোন প্রকার উপকার গ্রহণ করাঃ- সুদের প্রবেশপথ বন্ধ করার লক্ষ্যে নবী করীম (সাঃ) মুসলমানদের উপর সেই সমস্ত মুনাফা ও উপকার গ্রহণকেও হারাম ঘোষণা করেছেন, যা ঋণ দেওয়ার ফলে ঋণগ্রহীতার নিকট পেশ করা হয়ে থাকে।
যেমন কোন উপহার-উপঢৌকন অথবা বিনা মজুরীতে ঋণদাতার কোন কাজ করে দেওয়া প্রভৃতি (যদিও ঋণগ্রহীতা এ সবের মাধ্যমে উপকারের বিনিময়ে প্রত্যুপকার করতে চায়, তবুও ঋণদাতার জন্য তা গ্রহণ করা বৈধ নয়।) হাদীস শরীফে প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,
إذا أقرض أحدكم قرضاً فأهدى إليه أو حمله على الدابة فلا يركبه ولا
يقبلها إلا أن يكون جرى بينه وبينه قبل ذلك.
অর্থাৎ, ‘‘যখন তোমাদের মধ্যে কেউ (কাউকে) ঋণ দেয়। অতঃপর (ঋণগ্রহীতার তরফ থেকে) তাকে কোন উপঢৌকন দেওয়া হয় অথবা তাকে (ঋণগ্রহীতা নিজের গাড়ি বা) সওয়ারীতে চড়িয়ে কোথাও পৌঁছিয়ে দিতে চায়, তবে সে যেন তার সওয়ারীতে না চড়ে এবং তার উপঢৌকনও গ্রহণ না করে। তবে হ্যাঁ, যদি এরূপ সদ্ব্যবহার (উপঢৌকন আদান-প্রদান ঋণ দেওয়ার) পূর্ব থেকেই জারী থাকে তবে (তার পরে) অনুরূপ কিছু গ্রহণ করায় দোষ নেই।’’[4]
উক্ত হাদীসে নবী করীম (সাঃ) সেই মুনাফা ও উপকার গ্রহণ করতেও নিষেধ করেছেন যা ঋণ দেওয়ার কারণেই ঋণগ্রহীতা ঋণদাতার জন্য নিবেদন করতে চায়।
৪- চাষাবাদ ও ক্রয়-বিক্রয়ের কতক নিষিদ্ধ পদ্ধতিঃ-
সুদের মূলোৎপাটন সাধন এবং তার সকল প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করার মানসে ইসলাম চাষাবাদ ও বেচা-কেনার কিছু পদ্ধতি ও রীতিকেও নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করেছে। যেমন;
ক- মুখাবারাহ ; ভাগচাষীকে জমি ভাগে চাষ করতে দিয়ে ফসলের নির্দিষ্ট অংশ মালিকের জন্য নির্ধারিত করে নেওয়া, জমি বা খেতের বিশেষ বিশেষ গাছ ও তার ফসল অথবা জমির বিশেষ কোন একটা দিক নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়া।[5]
খ- মুযাবানাহঃ- গাছে ধরে থাকা খেজুরকে পাকা খেজুর দ্বারা বিক্রয় করা।
গ- মুহাক্বালাহঃ- খেতে ধরে থাকা কাঁচা শস্যকে পাকা ফসলের বিনিময়ে ক্রয় করা। (অনুরূপ ফল-ফসল পাকার পূর্বে বিক্রয় করাও নিষিদ্ধ।) আল্লামা ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এই শ্রেণী এবং এই ধরণের অন্যান্য শ্রেণীর লেন-দেনকে এই জন্যই হারাম করা হয়েছে; যাতে সূদের কারবার সমূলে বিনাশ হয়ে যায়। কারণ, শুষ্ক হওয়ার পূর্বে বিনিমেয় উভয় ফল বা শস্যের পরিমাণ-সমতা বুঝা যায় না। এই জন্যই ফিক্হবিদগণ বলেছেন,
الجهل بالمماثلة كحقيقة المفاضلة.
অর্থাৎ, ‘‘বিনিমেয় (একই শ্রেণীভুক্ত) দুটি বস্ত্তর পরিমাণ-সমতা অজ্ঞাত হলেই তা প্রকৃত সূদের ন্যায় (কারবার।)[6]
৫- সূদ খাওয়ার জন্য ছল ও বাহানা খোঁজাঃ-
সূদের সকল প্রকার পথ ও দুয়ার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ইসলাম সূদ খাওয়ার জন্য কোন প্রকার ছল, ছুতা বা বাহানা করা অথবা তার জন্য কোন প্রকার ফন্দি ও কৌশল অবলম্বন করাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। শুধু তাই নয়, বরং কোন প্রকারের হারামকে হালাল করতে ছলবাজী করাকেও হারাম করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইয়াহুদীদের উপর গরু-ছাগলের চর্বিকে হারাম করেছিলেন। কিন্তু তারা বৈধ করে খাওয়ার জন্য এক কৌশল অবলম্বন করল; এ সকল চর্বিকে গলিয়ে তা বিক্রি করে তার মূল্য খেতে শুরু করেছিল।
জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন,
قاتل الله اليهود إن الله عز وجل لما حرم عليهم الشحوم جملوه ثم
باعوه فأكلوا ثمنه.
অর্থাৎ, ‘‘আল্লাহ ইয়াহুদ জাতিকে ধ্বংস করুন। আল্লাহ যখন তাদের উপর চর্বি হারাম করেছিলেন তখন ওরা তা গলিয়ে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করেছিল।’’[7]
আল্লামা ইবনে কুদামাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘দ্বীনের কোন ব্যাপারেই কোন প্রকার ছল-বাহানা বৈধ নয়।’[8]
অতঃপর তিনি বাহানার এই সংজ্ঞা করেন, ‘বাহানা হল, বাহ্যতঃ বৈধ চুক্তি বা লেন-দেন করা অথচ উদ্দেশ্য থাকে এর পশ্চাতে চাতুরী ও প্রতারণার সাথে অবৈধ চুক্তি বা লেনদেন করা, অথবা হারামকে হালাল করা, অথবা ওয়াজেব চ্যুত করা, অথবা কোন হক রদ্ করা।’
[1] (ই’লামুল মুয়াক্কিঈন ২/১৩০, তাহক্বীক আব্দুর রহমান অকীল)
[2] অতএব দৃষ্টান্তস্বরূপ ৫ কেজি বীজ ধানের বিনিময়ে ৭ কেজি সাধারণ ধান, বেশী ওজনের পুরাতন সোনা বা রূপার অলঙ্কারের বিনিময়ে কম ওজনের নতুন অলঙ্কার দেওয়া-নেওয়া এ সূদের পর্যায়ভুক্ত। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে পুরাতন বিক্রয় করে তার দাম হাতে নিয়ে তারপর এ টাকা দিয়ে নতুন অলঙ্কার কেনা জরুরী।
তদনুরূপ ২ কিলো গম দিয়ে ২ অথবা ১ কিলো চাল হাতে হাতে নগদ বেচা-কেনা বৈধ;
ধারে নয়। সুতরাং ভাদ্রমাসে ১ কিলো গম দিয়ে পৌষমাসে ১ বা দেড় কিলো চাল নেওয়া উক্ত সূদ খাওয়ার পর্যায়ভুক্ত।---অনুবাদক
[3] (মুসলিম, মিশকাত ২৮০৭ নং)
[4] (ইবনে মাজাহ,
হাদীস নং ২৪৩২, মিশকাত ২৮৩১ নং)
আলোচ্য হাদীসটি শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ প্রভৃতির নিকট হাসান। কিন্তু আল্লামা আলবানীর নিকট যয়ীফ। অবশ্য ইবনে তাইমিয়্যাহ তাঁর ফতোয়ায় এ হাদীসের সমর্থনে একাধিক আসার
(সাহাবার উক্তি)
পেশ করেছেন। পরিশেষে তিনি বলেছেন,
‘সুতরাং নবী
(সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাবর্গ ঋণদাতাকে ঋণপরিশোধের পূর্বে ঋণগ্রহীতার হাদিয়া বা উপঢৌকন গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এ হাদিয়া পেশ করার মতলব হল ঋণ পরিশোধের মেয়াদ পিছিয়ে দিতে বলা যদিও সে এর শর্ত আরোপ করে না এবং মুখে প্রকাশ করে সে কথা বলে না। সুতরাং এরূপ করা সেই ব্যক্তির অনুরূপ হবে,
যে এক হাজার নিয়ে তার বিনিময়ে নগদ হাদিয়া ও বিলম্বিত এক হাজার ফেরৎ দেয়। আর এমন কাজ অবশ্যই সুদ। পক্ষান্তরে ঋণ পরিশোধের সময়ে নেওয়া অর্থ থেকে উপহার হিসাবে কিছু বেশী দেওয়া এবং পরিশোধের পর ঋণদাতাকে কোন হাদিয়া বা উপঢৌকন দিয়ে
(উপকারের বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা) ঋণগ্রহীতার জন্য বৈধ।
যেহেতু এতে সুদের অর্থ বর্তমান থাকে না।’ আল্লামা আলবানী উক্ত উক্তির টিপ্পনীতে বলেন,
‘অবশ্যই এটা ফকীহর কথা। তবে আলোচ্য ও বিবেচ্য বিষয় হল উক্ত হাদীসের সনদ ও অর্থ।’ (আর তা যয়ীফ। দেখুন,
সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফাহ ৩/৩০৩-৩০৭,
হাদীস নং১১৬২,
যয়ীফ ইবনে মাজাহ ৫২৯নং,
ইরওয়াউল গালীল ১৪০০ নং)
এ মর্মে আবু বুরাইদা বিন আবু মূসা কর্তৃক বর্ণিত তিনি বলেন, আমি
(ইরাক হতে)
মদীনায় এলাম এবং আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাযিয়াল্লাহু আনহুর সহিত সাক্ষাৎ করলাম। অতঃপর (কথা প্রসঙ্গে) তিনি বললেন, ‘তুমি এমন এক দেশে আছ যেখানে সুদ ব্যাপক আকারে প্রচলিত। সুতরাং তুমি কোন ব্যক্তিকে কোন কিছু ঋণ দিয়ে থাকলে সে যদি তোমাকে উপঢৌকনস্বরূপ এক বোঝা গমের কাঁচকি, অথবা এক বোঝা যব অথবা এক বোঝা
(গবাদি পশুর খাদ্য লূস্যার্ন)
পাতা দিতে আসে তাহলে তা গ্রহণ করো না। কারণ তা সূদ!’
(বুখারী ১৮১৪ নং, মিশকাত ২৮৩৩ নং)
ঋণ নেওয়ার পরে ঋণদাতার অনুগ্রহের প্রতিদান প্রকাশার্থে ঋণদাতাকে কোন জিনিস সঠিক দামের চেয়ে কমদামে বিক্রয় করা অথবা ভাড়া দেওয়া এবং ঋণদাতার তা নেওয়া সূদের পর্যায়ভুক্ত।
(ফতোয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৯/৪৪১) -অনুবাদক
[5] এ বিষয়ে বৈধ পথ হল সমস্ত ফসলকে শতকরা হারে ভাগাভাগি করা। যেমন, আধাআধি,
তিন বা চারভাগের ভাগ ইত্যাদি। অনুরূপ নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে জমি ঠিকে বা ভাড়া দেওয়া বৈধ। অনুরূপ গাড়ি বা রিক্সার মালিক ড্রাইভারকে চালাতে দিয়ে দৈনিকহারে নির্দিষ্ট টাকা প্রত্যহ আদায় করা বৈধ নয়। কারণ, এতে উভয় পক্ষেরই ধোঁকার আশংকা থাকে। সুতরাং বৈধ পথ হল,
প্রত্যেক দিনের ভাড়ার নির্দিষ্ট পার্সেন্টটেজ ভাগাভাগি করা। আসল টাকা ড্রাইভার গোপন করলে সে পাপ তার। -অনুবাদক
[6] (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/৫৮১)
[7] (বুখারী, হাদীস নং ২২৩৬,
মুসলিম ১৫৮১নং,
নাসাঈ ৪৬৮৩,
মুসনাদে আহমদ ১/২৫ প্রমুখ)
[8] (মুগনী ৪/৬৩)
সূদ খাওয়ার কতিপয় নয়া পদ্ধতি
সূদ খাওয়ার বহু ধরনেরই বাহানা ও পথ রয়েছে যা গণনা করা সম্ভব নয়। প্রত্যেক যুগেই সূদখোর লোকেরা সুদ খাওয়ার নিত্যনতুন পথ ও পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে এবং তার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর শরীয়তকে ধোঁকা দিতে প্রয়াস পেয়েছে। এই ধরনের কিছু পথ ও পদ্ধতির কথা আমরা এখানে উল্লেখ করছিঃ-
১- বাই-এ ঈনাহঃ-
এই ব্যবসার পদ্ধতি এই যে, এক ব্যক্তি কোন জিনিস নির্দিষ্ট মেয়াদ দিয়ে ধারে বিক্রয় করে, অতঃপর সেই জিনিসকেই নগদে তার থেকে কম দামে ক্রয় করে। (যেমন এক ব্যক্তির অর্থের প্রয়োজন হল। ঋণ কোথাও না পেয়ে এক গাড়ির ডিলারের নিকট গেল। ডিলারের নিকট থেকে ধারে ৫০ হাজার টাকায় একটি গাড়ি কিনল। অতঃপর সেই গাড়িকেই ঐ ডিলারের নিকট নগদ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে বিক্রি করল। যার ফলে ১০ হাজার টাকা ডিলারের পকেটে অনায়াসে এসে গেল।)
সত্যানুসন্ধানী উলামাগণ এই প্রকার ক্রয়-বিক্রয়কে সূদী কারবার বলে আখ্যায়ন করেছেন। উক্ত উলামাবৃন্দের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যাহ ও কুরতুবী প্রমুখ। আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যাহ লিখেছেন, আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হল যে, এক ব্যক্তি নির্দিষ্ট মেয়াদ দিয়ে হারীরাহ (আটা ও দুধ দ্বারা প্রস্ত্তত এক প্রকার খাদ্য) ধারে বিক্রয় করল। অতঃপর সে তা অপেক্ষাকৃত কম দামে খরিদ করে নিল। (এরূপ ক্রয়-বিক্রয় জায়েয কি?) উত্তরে তিনি বললেন, ‘সে তো দিরহামকে দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করেছে, হারীরাহ কেবল উভয়ের মাঝে এসে গেছে।’ (আর বিদিত যে, দিরহামকে দিরহামের বদলে কমবেশী করে ক্রয়-বিক্রয় হারাম বা সূদ।)
অনুরূপ একই বিষয়ে আনাস বিন মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এরূপ করা সেই ক্রয়-বিক্রয়ের পর্যায়ভুক্ত যাকে আল্লাহ ও তাঁর রসূল হারাম ঘোষণা করেছেন। আর এই অভিমতই অধিকাংশ উলামা; ইমাম আবু হানীফা, মালেক, আহমদ (রঃ) প্রমুখগণের।
এদের নিকটেও উক্ত লেন-দেন হারাম ও নাজায়েয।[1]
২- তাওয়ার্রুক ব্যবসাঃ-
১০০ টাকার জিনিসকে ১২০ টাকায় ধারে কিনে তা ব্যবহার করা অথবা তা অল্পদরে অন্যের নিকট বিক্রি করে তার মূল্য ব্যবহার করাকে মাসআলা-এ তাওয়ার্রুক বলা হয়। (যেমন এক ব্যক্তির অর্থের প্রয়োজন হলে ঋণ করার চেষ্টা সত্ত্বেও ঋণ না পেলে সে কোন গাড়ির দোকানে গেল। সেখানে ৫০ হাজার টাকা দামের গাড়ি ৬০ হাজার টাকায় ধারে কিনে তা ৪০ বা ৫০ হাজার টাকায় অন্য ব্যক্তিকে নগদ বিক্রয় করে সে পয়সা কাজে লাগাল।
অথবা গাড়ির প্রয়োজনে এভাবে গাড়ি নিয়ে তা ব্যবহার করল। এমন লেনদেনকে তাওয়ার্রুক বলে।[2]
বহু উলামার নিকট উক্ত প্রকার লেন-দেন সূদের পর্যায়ভুক্ত। উমার বিন আব্দুল আযীয বলেন, ‘তাওয়ার্রুক হল সূদের ভাই।’[3]
৩- দুই ব্যবসায়ীর মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির মধ্যস্থতাঃ-
উক্ত ব্যবসা এই রূপ যে, ঋণদাতা ও গ্রহীতা নির্দিষ্ট টাকার কোন সুদী কারবারে চুক্তিবদ্ধ হয়। অতঃপর উভয়ে বাজারে কোন দোকানদারের নিকট এসে চুক্তি পরিমাণ টাকার পণ্য ঋণদাতা খরীদ করে নেয়। অতঃপর সে ঋণগ্রহীতার নিকট উক্ত পণ্য ধারে বিক্রয় করে। পুনরায় ঋণগ্রহীতা এ পণ্য ঘুরে দোকানদারকে কমদরে বিক্রয় করে। এইভাবে দোকানদার এই সূদী কারবারে মধ্যস্থতা করে। টাকা পরিশোধের সময় বেশী পায় ঋণদাতা। মাঝখান থেকে মধ্যস্থতার নামে লাভ হয় দোকানদারেরও। আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেন, ‘এ কারবার সূদী কারবারের পর্যায়ভুক্ত।’[4] শায়খ ইবনে উসাইমীন বলেন, ‘এ কারবার নিঃসন্দেহে হারাম।’[5]
৪- ঋণ পরিশোধ করার নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হলে ঋণকে ব্যবসায় পরিণত করাঃ- তা এই রূপে যে, ঋণ পরিশোধ করার নির্দিষ্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে এবং ঋণ গ্রহীতা তা পরিশোধ না করতে পারলে ঋণদাতা অধিক অর্থ নিয়ে এ ঋণকে অন্য কারবারে পরিবর্তন করে দেয়। এরূপ করা সূদ খাওয়া। যার হারাম হওয়াতে কোন সন্দেহ নেই।[6]
[1] (ফতোয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৬/৪৪৬) ; এ প্রসঙ্গে নবী
(সাঃ) বলেন,
‘‘যখন তোমরা ঈনাহ ব্যবসা করবে এবং গরুর লেজ ধরে কেবল চাষ-বাস নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে আর জিহাদ ত্যাগ করে বসবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর এমন হীনতা চাপিয়ে দেবেন;
যা তোমাদের হূদয় থেকে ততক্ষণ পর্যন্ত দূর করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের দ্বীনের প্রতি প্রত্যাবর্তন করেছ।’’ (মুসনাদে আহমদ ২/২৮,৪২,
৮৪, আবু দাঊদ ৩৪৬২,
বাইহাকী ৫/৩১৬)
[2] (আশ্ শারহুল মুমতে ৮/২৩১)
[3] বর্তমান বিশ্বের সত্যানুসন্ধানী উলামাগণের নিকট তাওয়ার্রুক কিছু শর্তে বৈধ। প্রথমতঃ এ ব্যক্তি ঋণ করার চেষ্টা সত্ত্বেও কোথাও সত্যিই যদি ঋণ না পায়। দ্বিতীয়তঃ সে যদি সত্যসত্যই টাকা বা এ জিনিসের অভাবী হয়। তৃতীয়তঃ যে জিনিস বিক্রয় হচ্ছে তা যেন বিক্রেতার নিকটে থাকা অবস্থায় বিক্রয় হয়। (দেখুন,
আশ্ শারহুল মুমতে, ইবনে উসাইমীন ৮/২৩৩, আল মুদায়ানাহ ৭ পৃঃ, কিতাবুদ্দা’ওয়াহ ইবনে বায ১৮৮ পৃঃ) -অনুবাদক
[4] (ফতোয়া ইবনে তাইমিয়াহ ২৯/৪৪১)
[5] (আল- মুদায়ানাহ ৮পৃঃ)
[6] প্রকাশ যে,
কারো জিনিস বন্ধক রেখে ঋণ দিয়ে এ জিনিস ব্যবহার করা বৈধ নয়। বৈধ নয় জমি বন্ধক নিয়ে ধান খাওয়া। বন্ধক নিয়ে জমির মালিক হওয়া যায়না। তবে তার সম্পূর্ণ ফসল কি করে হালাল হবে?
সুতরাং জমি বন্ধক নিয়ে তার চাষ যদি ঋণদাতাই করে তাহলে জমির মালিকের সাথে একটা ভাগচুক্তি করে করাই হারাম থেকে বাঁচার পথ। অবশ্য গাই বন্ধক নিলে যেহেতু তাকে খাওয়াতে হবে সেহেতু তার দুধপান করা বৈধ। (দ্রষ্টব্য, ফিকহুস সুন্নাহ ৩/১৭১)
সূদের অপকারিতা
প্রিয় পাঠক! এবারে আসুন আমরা সমীক্ষা করে দেখি যে, ইসলাম কেন সূদকে নিষিদ্ধ ও কঠোরভাবে হারাম ঘোষণা করেছে? সূদের মধ্যে কি এমন ক্ষতি, অপকারিতা ও অনিষ্টকারিতা আছে? মানুষের চরিত্রে, সমাজে, রাষ্ট্রে এবং সারা বিশ্বে কি এমন মন্দ প্রভাব ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে সূদে? যার প্রেক্ষিতে না তো সূদ কোন বিবেক ও যুক্তিসম্মত। না তা ন্যায়পরায়ণতার অনুকূল। আর না-ই তা জীবন-জীবিকার কোন অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয় লেন-দেন।
এক্ষণে আমরা এ অভিশপ্ত বস্ত্তর বিভিন্ন দিক থেকে তার অনিষ্টকারিতা ও সর্বনাশিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও সমীক্ষা করব। যাতে কোন জ্ঞান ও বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তির মনে এই নাপাক বস্ত্তর অবৈধতার ব্যাপারে অণু পরিমাণও কোন সন্দেহ ও দ্বিধা অবশিষ্ট না থাকে।
সূদের চরিত্রগত ও নৈতিক ক্ষতি
সচ্চরিত্র ও আত্মা মানবতার মৌলিক উপাদান। আমাদের এই উপাদানে যা ক্ষতিসাধন করে তা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য; চাহে তার অন্যান্য উপকারিতা যতই বর্ণনা করা হোক না কেন। এখন যদি আপনি সূদের মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষা করেন তাহলে বিদিত হবেন যে, অর্থ সঞ্চয় করার আকাঙক্ষা থেকে শুরু করে সূদী কারবারের বিভিন্ন পর্যায় ও অবস্থান্তরে পূর্ণ মানসিক আচরণ স্বার্থপরতা, কৃপণতা, সংকীর্ণমনতা, নির্মমতা এবং অর্থপরায়ণতার মত হীনগুণের কুপ্রভাবের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত থাকে। সূদী কারবারে মানুষ যত অগ্রসর হতে থাকে উক্ত অসৎ গুণাবলী তার মধ্যে ততই প্রতিপালন ও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
পক্ষান্তরে ঠিক এর বিপরীত; সদকাহ এবং যাকাত প্রদানের প্রাথমিক নিয়ত থেকে শুরু করে আমলে পরিণত হওয়া পর্যন্ত অবস্থায় মানুষের মানসিক আচরণ সম্পূর্ণ দানশীলতা, বদান্যতা, ত্যাগ, উৎসর্গ, সহানুভূতি, উদারতা ও উচ্চমন্যতার মত সদ্গুণের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। আবার এই সৎকর্মের উপর আমল করতে থাকলে উক্ত প্রকার সুগুণগুলিও মানুষের মাঝে ক্রমোন্নতি ও বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। এক্ষণে আপনার হৃদয় ও মন কি সাক্ষ্য দেয় না যে, উপরোক্ত উভয়প্রকার চারিত্রিক গুণাগুণ-গুচ্ছের মধ্যে প্রথম গুচ্ছ হল নিকৃষ্ট এবং দ্বিতীয়টি উৎকৃষ্ট ?
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি
যে সমাজের সদস্যরা পরস্পর স্বার্থপরতাপূর্ণ ব্যবহার করে; নিজ নিজ স্বার্থ ও লাভ ছাড়া কেউ কারো কাজে না আসে এবং একজনের অভাব ও অর্থ প্রয়োজন দেখা দিলে অপর জনের মুনাফা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ লাভ হয়, এমন নির্মম সমাজ কোনদিন সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বরং সে সমাজ চিরকালের জন্য বিশৃঙ্খলা ও বৈষম্যের দিকে ঝুঁকে যায়। ঠিক এর বিপরীত যে সমাজের সমাজ-ব্যবস্থা আপোসে সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহারের ভিত্তিতে পরিচালিত, যার সদস্যগণ পরস্পর দানশীলতার সহিত সদ্ব্যবহার করে, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি অপরের অভাব-অনটনের সময় উদারচিত্ত ও মন নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে থাকে সেই সমাজে বৃদ্ধি পায় সম্প্রীতি ও হিতাকাঙক্ষা। আর এমন সমাজে পরস্পর সহযোগিতা এবং পরহিতৈষার ফলে উন্নয়নের গতি প্রথম সমাজের তুলনায় অধিক দ্রুততর হয়।
অনুরূপ এই কথা এক জাতির সহিত অপর জাতির (আন্তর্জাতিক) সম্পর্ক ও সম্বন্ধ রাখার ক্ষেত্রেও বলা যায়; অর্থাৎ এক জাতি যদি অপর জাতির সাথে বদান্যতা ও সহানুভূতিশীল ব্যবহার প্রদর্শন করে এবং তার বিপদ-আপদের সময় উন্মুক্ত হৃদয় নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ায়, তাহলে এ সম্ভবই নয় যে, দ্বিতীয় তরফ হতে এর প্রতিদানে সম্প্রীতি, কৃতজ্ঞতা এবং হিতাকাঙক্ষা ব্যতীত অন্য দুর্ব্যবহার প্রদর্শিত হবে। পক্ষান্তরে এ একই জাতি যদি নিজের প্রতিবেশী আর এক জাতির সাথে স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণমনতা-পূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করে এবং তার বিপদ সমস্যার সময়কে নিজের স্বার্থলাভের সুবর্ণ সুযোগরূপে ব্যবহার করে, তাহলে এ কোন প্রকারেই সম্ভব নয় যে, সেই স্বার্থপর জাতির জন্য এ জাতির হৃদয়ে কোন প্রকার সহানুভূতি, ভালোবাসা এবং পরহিতৈষণা অবশিষ্ট থাকবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা, বৃটেন আমেরিকার নিকট একটা মোটা অঙ্কের অর্থ-ঋণ নেওয়ার চুক্তি করেছিল। আমেরিকা এ যুদ্ধে বৃটেনের মৈত্রীবদ্ধ ছিল; তাই বৃটেন আশা করল যে, আমেরিকা তাদেরকে বিনা সূদে ঋণ প্রদান করবে। কিন্তু আমেরিকা সূদ ছাড়তে রাজী হলো না। ফলে বৃটেন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে সূদ দিতে চুক্তিবদ্ধ হল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ইংরেজ জাতির উপর রেখাপাত করেছিল সে কথা তদানিন্তন অর্থমন্ত্রী ডক্টর ডালটনের কথায় এইরূপ ছিল,
‘এই ভারী বোঝা যা বহন করা অবস্থায় আমরা যুদ্ধ থেকে বের হয়ে আসছি এটি আমাদের অসাধারণ ত্যাগ ও কষ্টের বড় চমৎকার প্রতিদান যা আমরা এক যৌথ উদ্দেশ্য সাধনের পথে স্বীকার করে এসেছি।’
এই হল সূদের স্বাভাবিক প্রভাব এবং তার অনিবার্য মানসিক প্রতিক্রিয়া যা সর্বদা পরিস্ফুট হতে থাকবে; তাতে এক জাতি অপর জাতির সাথে এরূপ আচরণ করুক অথবা এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে সেই ব্যবহার প্রদর্শন করুক; সর্বাবস্থায় প্রতিক্রিয়া একই শ্রেণীর।
অর্থনৈতিক ক্ষতি
জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতি সম্পর্কীয় বিভিন্ন দিক দিয়েও সূদের অপকারিতা এত বেশী যে, রাজনীতিবিদ্ এবং অর্থনীতিজ্ঞ বড় বড় পন্ডিতগণ এ কথা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, সারা বিশ্ব আজ যে সকল সংকটের সম্মুখীন তার পশ্চাতে রয়েছে সূদের হাত। তাঁরা এ কথাও বলেছেন যে, বিশ্বের অর্থ-ব্যবস্থা কখনই সফলতা অর্জন করতে পারে না; যদি না সূদী কারবারকে শূন্যের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়; অর্থাৎ সূদকে তার মূল ও বুনিয়াদ থেকে নির্মূল করে উৎখাত না করা পর্যন্ত অর্থনৈতিক সফলতা আদৌ সম্ভব নয়।
এক অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞ সত্যই বলেছেন, সূদ অর্থনৈতিক জীবনের পক্ষে ‘এড্স’ এর মতই; যে তার প্রতিকার-ক্ষমতায় ঘুণ ধরিয়ে দেয় এবং অর্থনৈতিক অবস্থাকে ধ্বংস ও বিনাসের অতল-গর্ভে তলিয়ে দেয়।
বলা বাহুল্য সেই আমেরিকা, যে পুঁজিবাদের সর্বাপেক্ষা বড় পতাকাধারী এবং প্রধান সমর্থক সে বর্তমানে ভীষণভাবে অর্থনৈতিক সংকটের শিকার হয়ে পড়েছে। আমেরিকা সংবাদ-সংস্থা এই খবর প্রকাশ করেছে যে, আমেরিকায় বেকারের সংখ্যা বর্তমানে ১২ মিলিয়ন থেকেও বেশীতে গিয়ে পৌঁছেছে। সন ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ২৫৩০০ থেকেও বেশী কোম্পানী নিজেদের দেউলিয়া হওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। আর জার্মানে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৮২ সনে অর্থনৈতিক বাজার মন্দা তথা মুদ্রাস্ফীতির কারণে নিরিখ বা বাজার দর ১১.৯১৬ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যা ১৯৮১ সনের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশী![1]
জেফরী মার্ক তাঁর ‘আধুনিক পৌত্তলিকতা’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ কথা সংযোজন করা জরুরী মনে করি যে, সেই সকল ঐতিহাসিকগণ যাঁরা সূদী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত অভিনব গণতন্ত্রের স্বার্থে ইতিহাস রচনা করেন তাঁরা এই ঘটনাটিকে মিথ্যা রটনায় পরিণত করেছেন।’
যে মিথ্যা রটনার প্রতি তিনি ইঙ্গিত করেছেন, তা হল (ফরাসী বীর সম্রাট) নেপোলিয়ন বেনোপার্টের পরাজয়। বলা বাহুল্য লেখক যা প্রমাণ করতে চেয়েছেন, তা হল এই যে, নেপোলিয়নকে যে শক্তি পরাজয়ের শিকার করেছিল, তা হল কেবলমাত্র সূদখোরদের আধিপত্য ও ক্ষমতাশীল প্রভাব।[2]
আসুন এবার আমরা সমীক্ষা করে দেখি যে, সূদের অর্থনৈতিক অপকারিতা কি কি?
সাধারণতঃ ঋণ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকেঃ
১- কিছু ঋণ যা, অভাবী লোকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গ্রহণ করে থাকে।
২- কিছু ঋণ, যা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও সওদাগরগণ নিজেদের মুনাফাজনক কাজে খাটাবার জন্য নিয়ে থাকে।
৩- কিছু ঋণ, যা সরকার নিজের দেশবাসীর নিকট থেকে গ্রহণ করে থাকে। যা যুদ্ধের সময় অথবা রেলপথ, বিদ্যুৎ-পরিকল্পনা প্রভৃতি কার্যকর করার নিমিত্তে তা গ্রহণ করা হয় ।
৪- কিছু ঋণ, যা সরকার নিজের প্রয়োজনে কোন অন্য রাষ্ট্রের নিকট থেকে নিয়ে থাকে।
এবার আমরা প্রত্যেক বিষয়ে পৃথক-পৃথক সমীক্ষা করে দেখব যে, সূদ আরোপিত হওয়ার পর কি কি ক্ষতি তাতে নিহিত রয়েছেঃ-
১- অভাবী লোকেদের ঋণঃ
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী যে কারবারের মাধ্যমে সূদ লেন-দেন হয়, তা হল মহাজনী কারবার (LENDING BUISNESS)। এই আপদ কেবল ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি একটি বিশ্বব্যাপী আপদ; যে আপদ থেকে কোন দেশই মুক্ত নয়। এর কারণ এই যে, গরীব এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের নিজ প্রয়োজনে সহজভাবে ঋণ লাভের ব্যবস্থা পৃথিবীর কোন স্থানেই নেই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক দেশেরই মজুর, চাষী, ছোট-খাটো কারবারী, ব্যবসায়ী এবং অল্প বেতনভূক চাকুরীজীবি মানুষেরা বাধ্য হয়েই নিজেদের দুর্দিনের সময় ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু উক্ত মহাজনী কারবারে সূদের হার এত বেশী আকারে প্রচলিত যে, যখনই কোন ব্যক্তি একবার এসে এ সূদী ঋণের জালে ফেঁসে যায়, তখন সে আর নিজেকে সেখান হতে উদ্ধার করতে সক্ষম থাকে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি শেষে এই দাঁড়ায় যে, দাদার গৃহীত ঋণ উত্তরাধিকার-সূত্রে পোতাদের ঘাড়ে চেপে বসে। এই মহাজনী কারবারে ইংল্যান্ডে সরকারীভাবে সূদের বাৎসরিক হার হল শতকরা ৪৮ ভাগ এবং বেসরকারী বাজারে ২৫০ থেকে ৪০০ ভাগ! আমেরিকায় সরকারীভাবে শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ এবং বেসরকারী বাজারে ১০০ থেকে ২৬০ শতাংশ । অনেক সময় এ সূদের হার ৪৮০ শতাংশতেও পৌঁছে থাকে। আর আমাদের নিজের দেশ ভারতবর্ষেই বাৎসরিক ৭৫ শতাংশ হারে সূদ প্রচলিত যা অনেক সময় ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত পেঁŠছে যায় ।
বরং বাৎসরিক ৩০০ থেকে ৩৫০ শতাংশ হারে সূদের দৃষ্টান্তও পাওয়া গেছে ।
প্রত্যেক দেশের গরীব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিরাট সংখ্যক লোক এই মহা আপদজালে মারাত্মকভাবে জড়িত। দিবারাত্রি বিরামহীন পরিশ্রমের পর যে সামান্য বেতন বা মজুরী তারা হাতে পায় তা থেকে সূদ আদায় করার পর তাদের নিকট দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে আহার করার মত পয়সাও অবশিষ্ট থাকে না। এর ফলে উক্ত পরিস্থিতি ঐ শ্রেণীর মানুষদের শুধুমাত্র চরিত্র নষ্ট ক’রে, অপরাধ-প্রবণতার দিকে ঠেলে দিয়ে, তাদের জীবন-যাপনের মান নিম্নমুখী ক’রে এবং তাদের সন্তান-সন্ততির শিক্ষার মান অনুন্নত করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং তার চূড়ান্ত পরিণাম এও যে, দুশ্চিন্তা ও কষ্ট-ক্লেশ দেশের সাধারণ কর্মশীল মানুষদের কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতাকে বহুলাংশে হরাস ক’রে দেয়। পরন্তু যখন তারা নিজেদের মেহনতের ফল অপরকে ভোগ করতে দেখে, তখন তাদের নিজেদের কাজের প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ শেষ হয়ে যায়। সুতরাং এই দিক থেকে সূদী কারবার কেবলমাত্র এক প্রকার যুলুমই নয়; বরং তা সামগ্রিক অর্থ-ব্যবস্থার পক্ষেও ভয়ানক ক্ষতিকর। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে রুজী-রোজগার সম্পর্কিত উৎপাদনের উপর। আর ভাববার কথা এই যে, যদি পৃথিবীর ৫ কোটি মানুষও মহাজনী সূদজালে জড়িয়ে পড়ে এবং তারা গড়ে মাসিক ১০ টাকা হারে সূদ আদায় করতে থাকে, তাহলে তার অর্থ এই দাঁড়াবে যে, প্রতি মাসে ৫০ কোটি টাকার পণ্যদ্রব্য অবিক্রিত অবস্থায় থেকে যাবে। আর এই বিপুল পরিমাণের অর্থ জীবন-জীবিকামূলক উৎপাদনের দিকে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে অতিরিক্ত সূদী ঋণ সৃষ্টির পশ্চাতে মাসের পর মাস ব্যয়িত হবে। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে কেবলমাত্র ভারতবর্ষের মহাজনী ঋণ কমপক্ষে ১০০০ কোটি টাকা অনুমান করা হয়েছিল। (এবারে সারা বিশ্ব জুড়ে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ এবং এ ঋণ বাবদ মহাজনদের ঘরে আসা সূদের পরিমাণ কত তা অনুমেয়।)
1.
বাণিজ্যিক ঋণ
যে ঋণ ব্যবসা, শিল্পোন্নয়ন এবং অন্যান্য বিভিন্ন কাজ-কারবারে খাটাবার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয় তার উপর সূদ গ্রহণ করাকে বৈধ প্রমাণ করার প্রেক্ষিতে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি পরিদৃষ্ট হয় তা একটু ঠান্ডা মাথায় পড়ুন।
পুঁজিপতিরা অংশীদার হিসাবে নিজেদের পুঁজি কোন ব্যবসায় খাটাবার পরিবর্তে ঋণদাতা হিসাবে ব্যবসায়ীদেরকে এ পুঁজি ঋণ-স্বরূপ প্রদান করে তা থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে নিজেদের সূদ আদায় করে থাকে। জীবিকা- সংক্রান্ত উৎপাদনকে উন্নত করার ব্যাপারে তাদের কোন প্রকারের আগ্রহ ও উদ্যম থাকে না। কারণ তারা তা করুক চাই না করুক সর্বাবস্থায় তাদের মুনাফা তো নির্দিষ্ট আছেই। কারো ব্যবসায় যদি নোকসান হয় তবুও তাদেরকে কোন চিন্তা স্পর্শই করে না। কারণ তাদের জন্য মুনাফা থাকে সুনিশ্চিত। ধরে নিন, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এক ব্যক্তি ২০ বছরের মেয়াদে ৭ শতাংশ হারে একটি মোটা অংকের অর্থ ঋণ নিয়ে কোন একটি বড় ব্যবসা শুরু করল। এখন সে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর নিয়মিতভাবে উক্ত হারে আসল টাকার কিস্তি সহ সূদ আদায় করতে বাধ্য। চুক্তি হয়েছিল ১৯৭০ সালে। কিন্তু ১৯৭৫ সাল পৌঁছতে পৌঁছতে দ্রব্যমূল্য হরাস পেয়ে যদি আগের মূল্যের অর্ধেকে এসে ঠেকে, তাহলে তার অর্থ এই দাঁড়াবে যে, এই ব্যবসায়ী যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তি শুরু হওয়ার সময়কালের তুলনায় বর্তমানে (১৯৭৫ সালে) দ্বিগুণ পণ্য বিক্রয় না করে ততক্ষণ পর্যন্ত সে না তার সূদ আদায় করতে সক্ষম হবে, আর না আসল কিস্তি দিতে পারবে। এর অনিবার্য পরিণতি এই দাঁড়াবে যে, এ চড়ামূল্যের সময়কালে এ ধরনের অধিকাংশ ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবে, নতুবা দেউলিয়ার হাত থেকে রক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক-ব্যবস্থা বিনষ্টকারী অবৈধ কোন কর্ম করে বসবে।
এ ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে আপনি নিঃসন্দেহ ও নিশ্চিত হবেন যে, বিভিন্ন সময়কালে ওঠানামাকারী দ্রব্যমূল্যের মাঝে ঋণদাতা এ পুঁজিপতির সেই সকল মুনাফা যা সর্ব অবস্থা ও সময়ের জন্য এক সমান ও নির্দিষ্ট থাকে, তা অবশ্যই ইনসাফ ও ন্যায়সঙ্গত নয় এবং অর্থনীতির দৃষ্টিকোণেও তা কোনক্রমেই যথার্থ বিবেচিত হবে না।
৩- রাষ্ট্রের বেসরকারী ঋণ
সাধারণতঃ বিভিন্ন দেশের সরকার লাভজনক কাজ-কর্মে লাগানোর উদ্দেশ্যে দীর্ঘ-মেয়াদী ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু কোন সরকারই একটি নির্দিষ্ট হারে সূদের উপর ঋণ নেওয়ার সময় এ কথা জানতে পারে না যে, আগামী ২০/৩০ বছরের ভিতরে দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা এবং বিশেবর আন্তর্জাতিক লেনদেন সম্পর্কিত অবস্থা কোন্ দিকে মোড় নেবে এবং সেই সঙ্গে যে কাজে ব্যয় করার জন্য সে এই সূদী ঋণ নিচ্ছে তাতে মুনাফা অর্জনের পরিমাণ ও অবস্থা কিরূপ থাকবে। অধিকাংশ সময়ে সরকারের অনুমান ভুল প্রমাণিত হতে দেখা যায়। সূদের হার অপেক্ষা বেশী হওয়া তো দূরের কথা সমপরিমাণ মুনাফা লাভও সম্ভবপর হয় না। এবারে পরিস্থিতি এই দাঁড়ায় যে, সরকার তার এ সূদের সাধারণ বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। ট্যাক্সের মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তির পকেট থেকে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ঐ সূদের টাকা অসূল করে নেওয়া হয় এবং বছরের পর বছর লাখো লাখো টাকা জমিয়ে পুঁজিপতিদের নিকট দীর্ঘ সময়কাল যাবৎ পৌঁছানো হয়ে থাকে।
মনে করুন, আজ ৫ কোটি টাকার একটি সেচ-প্রকল্প কার্যকরী করা হল। আর এ কাজে ব্যয়িতব্য পুঁজি বার্ষিক শতকরা ৬ টাকা হারে সংগ্রহ করা হয়েছে। এবারে এই হিসাবে সরকারকে প্রতি বছর ৩০ লাখ টাকা সূদ আদায় করতে হবে। বলা বাহুল্য, সরকার এত বড় অংকের টাকা কোথাও মাঁটি খুড়ে বের করে আনবে না। বরং বোঝাটি সেই চাষীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে যারা ঐ সেচ-প্রকল্পের পানি থেকে লাভবান হবে। প্রত্যেক চাষীর উপর যে সেচকর আরোপ করা হবে, তাতে অবশ্যই ঐ সূদের অংশও থাকবে। আর চাষীরা নিজেরাও ঐ সূদ তাদের পকেট থেকে দেবে না; বরং তার সে অর্থ তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের দাম থেকে বের করে নেবে। এইভাবে উক্ত সূদ পরোক্ষভাবে প্রত্যেক সেই ব্যক্তির নিকট থেকে অসূল করা হবে, যে ঐ চাষীদের উৎপাদিত শস্য ব্যবহার করবে। আর অনুরূপভাবে প্রত্যেক গরীব ও দুঃখী ব্যক্তির রুটি থেকে এক টুকরা অথবা ভাতের বাসন থেকে এক মুঠো ভাত কেড়ে নিয়ে এ পুঁজিপতিদের বিরাট উদরে ঢেলে দেওয়া হবে; যারা বার্ষিক ৩০ লাখ টাকা সুদের ভিত্তিতে উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের নিমিত্তে ঋণ দিয়েছিল। যদি সরকারকে এ ঋণ পরিশোধ করতে ৫০ বছর লেগে যায়, তাহলেও সে গরীবদের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেই ধনীদেরকে পুষ্ট করার এ দায়িত্ব অর্ধ শতাব্দীকাল পর্যন্ত নিয়মিত পালন করে যেতে থাকবে।
এমন কর্মপদ্ধতি সামাজিক অর্থ-ব্যবস্থায় ধনের প্রবাহকে ধনহীনদের নিকট থেকে সরিয়ে ধনবানদের দিকে ফিরিয়ে দেয়। অথচ সামাজিক কল্যাণ ও সফলতার উদ্দেশ্যে উচিত ছিল, ধন-মালের এ প্রবাহ ধনবানদের নিকট থেকে ধনহীনদের দিকে বহমান থাকা। এ অনিষ্টকারিতা কেবলমাত্র সেই সূদেই সীমাবদ্ধ নয় যা সরকার মুনাফাজনক ঋণের উপর আদায় করে থাকে বরং সেই সকল প্রকার সূদী লেনদেনেও তা নিহিত আছে, যা সাধারণতঃ বণিক-সমাজ করে থাকে। বলা বাহুল্য কোন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা কৃষক পুঁজিপতিকে দেয় সূদ নিজের ঘর থেকে আদায় করে না। তারা সকলেই সেই বোঝা নিজেদের পণ্যের দামের উপর চাপিয়ে দেয় এবং এইভাবে সাধারণ মানুষের নিকট থেকে এক পয়সা দু’ পয়সা করে চাঁদা জমা করে লাখপতি পুঁজি-ওয়ালাদের ঝুলিতে ঢেলে দেওয়া হয়! এই উল্ট অর্থ-ব্যবস্থায় দেশের সব চাইতে বড় ধনাঢ্য মহাজনই সর্বাপেক্ষা অধিক ‘সাহায্য লাভের অধিকারী’ হয়। পরন্তু এ সাহায্যদানের দায়িত্ব যাদের উপর সব চাইতে বেশী বর্তায়, তারা হল সেই দরিদ্রশ্রেণীর দেশবাসী, যারা নিজেদের দেহের রক্ত পানি করে যৎসামান্য রোজগার করে আনে। উপরন্তু নিজেদের অভুক্ত সন্তানদের মুখে দু’ মুঠো ডাল-ভাত তুলে দেওয়াও তাদের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত হারাম থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এর পূর্বেই ঐ ডাল-ভাতের একটা অংশ দেশের সব চাইতে বেশী ‘করুণার পাত্র’ কোটিপতিদের জন্য বের করে দেয়।[3]
[1] (আর রিবা,
উমার আশকার ১২৯-১৩০ পৃঃ)
[2] (আর রিবা,
ডক্টর উমর আশকার ১৪২-১৪৩ পৃঃ)
[3] (দেখুন, সূদ ও আধুনিক ব্যাংকিং ৬৮ পৃঃ)
সরকারের বৈদেশিক ঋণ
এবারে দেখুন, সরকার দেশের বাইরের বিদেশী মহাজনদের নিকট থেকে যে ঋণ গ্রহণ করে তাতে অর্থনৈতিক কি ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে; এ ধরনের ঋণ সাধারণতঃ ১০/২০ কোটির মাত্রা অতিক্রম করে ১০০ থেকে ১০০০০ কোটির পর্যায়ে পৌঁছে থাকে। এ ধরনের ঋণ সরকার সাধারণতঃ তখন গ্রহণ করে থাকে যখন দেশে কোন অস্বাভাবিক সংকটাবর্ত ও দুরবস্থা আপতিত হয় এবং দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ সে বিপদ থেকে নিস্কৃতি লাভে যথেষ্ট প্রমাণিত হয় না। আবার কখনো এ লোভে পড়েও ঋণ গ্রহণ করে থাকে যে, বড় অংকের পুঁজি নিয়ে উন্নয়নমূলক প্রকল্পসমূহে বিনিয়োগ করলে দেশের উপায়-উপকরণ স্বল্প সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে যাবে। এই শ্রেণীর ঋণে সূদের হার সাধারণতঃ ৬/৭ শতাংশ থেকে ৯/১০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর সূদের উক্ত হার অনুযায়ী কয়েক শত কোটি টাকার বার্ষিক সূদ কয়েক কোটি টাকা হয়। অপর দিকে ঋণদাতা দেশ যমানত স্বরূপ ঋণ গ্রহীতা দেশের কোন একটা শুল্ক; যেমন চিনি লবণ অথবা অন্য কোন খাতের আয়কে বন্ধক রেখে নেয়।
ইতিপূর্বে সূদের যে সমস্ত অনিষ্টকারিতা আমরা আলোচনা করেছি তার সবটাই নিহিত রয়েছে এই ধরনের সূদী ঋণে। উপরন্তু ঋণের এই শ্রেণীতে এ সকল ক্ষতি ছাড়াও আরো এক প্রকার ক্ষতিকর দিক রয়েছে, যা পূর্বালোচিত ক্ষতিসমূহের মধ্যে সব চাইতে বেশী ভয়াবহ। আর তা হল এই যে, এ ধরনের বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে পুরাপুরিভাবে জাতির আর্থিক অবস্থা ধ্বংস এবং অর্থনৈতিক মান সর্বনাশগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর এর নিতান্ত ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। অধিকন্তু এরই মাধ্যমে জাতির মানুষের হৃদয়ে-হৃদয়ে রোপিত হয় শত্রুতা ও বিদ্বেষের বীজ ।
পরিশেষে এরই কারণে বিপদাপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত জাতির তরুণদল বিক্ষুব্ধ ও অতিষ্ঠ হয়ে চরমপন্থী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দর্শন গ্রহণ করতে শুরু করে। অতঃপর এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লব অথবা সর্বনাশী সংগ্রামের মাধ্যমে নিজের জাতির দুর্দশা ও সংকট নিরসনের উপায় অনুসন্ধান করতে আরম্ভ করে দেয়।
নিজের সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে যে জাতিই কোন বড় অংকের অর্থ সূদী ঋণ গ্রহণ করে, তাকে খুব কমভাগই সেই সমস্যা অপসারণে সফলকাম হতে দেখা যায়---যার কারণে সে ঋণ গ্রহণ করে। বিপরীত পক্ষে এই ঋণই সে জাতির সংকট ও সমস্যার বৃদ্ধিতে সহায়কশক্তি হিসাবে কাজ করে। ঋণের কিস্তি ও সূদ আদায় করার জন্য তার নিজের দেশবাসীর উপর খুব বেশী ট্যাক্স ও করভার চাপিয়ে দিতে হয় এবং অনেক দিক থেকেই ব্যয়ের পরিমাণ খুব বেশী হরাস করতে হয়। এর ফলে এক দিকে যেমন জাতির সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে যায় তেমনি অপর দিকে নিজের দেশবাসী জনগণের উপর এত পরিমাণে ভারী বোঝা চাপিয়েও সরকারের পক্ষে ঋণের কিস্তি এবং সূদ নিয়মিতভাবে আদায় করে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অতঃপর ঋণগ্রহীতা দেশের পক্ষ থেকে যখন ঋণ আদায়ে অনবরত শৈথিল্য দেখা দেয়, তখন বৈদেশিক ঋণদাতা দেশ তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ও অপবাদ লাগিয়ে বলতে থাকে, ‘বেঈমান দেশ, আমাদের ঋণের টাকা ফাঁকি দিতে চায়’ ইত্যাদি। তাদের ইশারা মতে তাদের জাতীয় সংবাদপত্র এবং আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলো এই দরিদ্র দেশের বিরুদ্ধে কটূক্তি করতে লাগে।
ঋণগ্রহীতা দেশ এই ফাঁদ থেকে সত্বর বের হতে চেষ্টা করে। এতদুদ্দেশ্যে সে দেশবাসীর উপর করভার আরো বৃদ্ধি করে এবং অধিকতর ব্যয় সঙ্কোচন করে কোন প্রকারে দ্রুত নিস্কৃতি লাভের চেষ্টা করে। শেষে দেশের জনগণ দেশ ও তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।[1]
সূদের এ সকল ধ্বংসকারিতা ও সর্বনাশিতা ছাড়াও কিছু ঋণগ্রহীতা দেশের অবস্থা একবার ঠান্ডা মাথায় পড়ুনঃ-
১৯৮১ সালে ২৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণগ্রস্ত দেশ পোলান্ড ঘোষণা করেছে যে, ঋণদাতাদেরকে পরিশোধ করার মত আড়াই বিলিয়ন ডলার তার নিকট নেই। এ বছরেই আগষ্ট মাসে মেক্সিকো ঘোষণা করেছে যে, সে বৈদেশিক ঋণের সূদ ৮০ বিলিয়ন ডলার আদায় করতে অক্ষম। এরপর ব্রাজিল ঘোষণা করেছে যে, সে তার ৮৭ বিলিয়ন চাইতেও বেশী ডলারের ঋণ আদায় করতে অসমর্থ।
আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (INTERNATIONAL
MONETARY FUND) এ কথা ঘোষণা করেছে যে, ৩২ টি দেশ এমন রয়েছে যে, ১৯৮১ সাল থেকে তারা তাদের ঋণ পরিশোধে অক্ষম।
এবারে কতিপয় দেশের গৃহীত ঋণের সংক্ষিপ্ত হিসাব লক্ষ্য করুনঃ
১৯৮৩ সালের ঋণরাশির আনুমানিক তালিকা (বিলিয়ন ডলারে)
দেশের নাম |
১৯৮২র শেষ পর্যন্ত সর্বমোট ঋণ |
১৯৮৩ পর্যন্ত আদায়কৃত অর্থ |
রপ্তানীর তুলনায় আদায়কৃত অর্থের হার |
ব্রাজিল |
৮৭ |
৩০.৮ |
১১৭% |
মেক্সিকো |
৮০.১ |
৪৩.১ |
১২৬% |
আর্জেন্টিনা |
৩৪.১ |
১৮.৪ |
১৫৩% |
উত্তর কোরিয়া |
৩৬ |
১৫.৭ |
৪৯% |
ভেনিজুয়েলা |
২৮ |
১৯.৯ |
১০০% |
পোল্যান্ড |
২৬ |
৭.৮ |
৯৪% |
রাশিয়া |
২৩ |
১২.২ |
২৫% |
মিসর |
১৯.২ |
৬ |
৪৬% |
যুযোস্লাভিয়া |
১৯ |
৬ |
৪১% |
ফিলিপাইন |
১৬.৬ |
৭ |
৭৯% |
পশ্চিম জার্মানী |
১৪ |
৬.৩ |
৮৩% |
পেরো |
১১.৫ |
৩.৯ |
৭৯% |
রোমানিয়া |
৯.৯ |
৫.৫ |
৬১% |
নাইজেরিয়া |
৯.৩ |
৪.৯ |
২৮% |
হাঙ্গেরী |
৭ |
৩.৫ |
৫৫% |
যাইর |
৫.১ |
১.২ |
৮৩% |
নামিবিয়া |
৪.৫ |
২ |
১৯৫% |
বলিভিয়া |
৩.১ |
১ |
১১৮% |
(দেখুন, আর রিবা, ডক্টর উমার আশকার ১৪৮-১৫২ পৃঃ)
আল্লাহ তাআলা কি সত্যই না বলেছেন,
﴿يَمْحَقُ اللهُ الرِّبا وَيُرْبِي
الصَّدَقَاتِ وَاللهُ لا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ﴾
অর্থাৎ, আল্লাহ সূদকে ধ্বংস করেন এবং সাদকাহকে বৃদ্ধি দান করেন।[2]
তিনি আরো বলেন,
﴿سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي
الْآفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ
أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ﴾
অর্থাৎ, আমি ওদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দিকচক্রবালে প্রদর্শন করব এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও; ফলে ওদের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এ (কুরআন) সত্য।[3]
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,
إن الربا وإن كثر فإن عاقبته تصير إلى قل.
অর্থাৎ, ‘‘সূদ পরিমাণে যতই বেশী হোক না কেন পরিণামে তা কম হতে বাধ্য।’’[4]
প্রিয় পাঠক! সূদের এমন মারাত্মক পরিণতি ও ফলাফল দর্শন করার পরেও কি কোন জ্ঞানসম্পন্ন ও বিবেকবান মানুষ এ কথা মেনে নিতে দ্বিধা করতে পারে যে, সূদ এমন এক ক্ষতিকর নিকৃষ্ট জিনিস, যা চূড়ান্তভাবে হারাম হওয়া অবশ্যই উচিত? সূদের এ অপকারিতা ও ভয়াবহ পরিণাম প্রত্যক্ষ করার পরও কি নবী (সাঃ) এর নিম্নোক্ত বাণী সম্বন্ধে কোন প্রকার সন্দেহ করতে পারে?
الربا سبعون جزءا، أيسرها أن ينكح الرجل أمه.
অর্থাৎ, ‘‘সূদ এমন একটি বড় গোনাহ যে, যদি তাকে সত্তর ভাগে ভাগ করা হয়, তাহলে তার সবচেয়ে হালকা অংশটিও নিজের মায়ের সহিত ব্যভিচার করার সমান গোনাহর শামিল!’’[5]
প্রিয় পাঠক! সূদের উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা পাঠের পর আশা করি আপনার এ অনুমান ও ধারণা হয়েছে যে, সূদ ইসলামের দৃষ্টিতে কত বিরাট অপরাধ ও পাপ এবং সূদের মধ্যে কি কি অনিষ্টকারিতা ও সর্বনাশিতা নিহিত রয়েছে। এবারে পরবর্তী আলোচনায় উক্ত সূদ বর্তমান যুগে কোন্ শ্রেণীর ব্যবসা ও কারবারে পাওয়া যায়, তা আমরা অবগত করাতে চাই। তাই আসুন, প্রথমত আমরা প্রচলিত বিভিন্ন কারবার প্রসঙ্গে পুরাপুরি জ্ঞানলাভ করে নিই। তাহলেই কোন্ ধরনের কারবারে সূদ আছে এবং কোন্ ধরনের কারবারে সূদ নেই তা সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আর একজন তওহীদবাদী এবং পূর্ণ ঈমান ও দ্বীনদার মুসলিমকে কোন্ কোন্ ধরনের কারবার করা এবং কোন্ ধরনের কারবার থেকে দূরে থাকা উচিত---তাও পরিষ্কার হয়ে যাবে।
[1] (সূদ ও আধুনিক ব্যাংকিং দ্রষ্টব্য)
[2] (সূরা বাক্বারাহ ২৭৬ আয়াত)
[3] (সূরা ফুসসিলাত ৫৩ আয়াত)
[4] (মুসনাদে আহমদ ১/৩৯৫,
৪২৪, ইবনে মাজাহ ২২৭৯,
বাইহাকী, মিশকাত ২৮২৭ নং)
[5] (ইবনে মাজাহ,
বাইহাকী, মিশকাত ২৮২৬ নং,
সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব ১৮৫৭)
কারবারে বিভিন্ন প্রকারভেদ (DIFFERENT KINDS OF
BUSINESS)
মালিকানার দিক থেকে কারবার তিন প্রকারেরঃ-
১- ব্যক্তিগত (PRIVATE
PROPRIETORSHIP) কারবার।
২- অংশীদারী (PARTNERSHIP) কারবার।
৩- যৌথ (JOINT STOCK COMPANY) কারবার।
প্রথমোক্ত দুই প্রকারের কারবার ও ব্যবসা মানুষ যখন থেকে কারবার করতে শুরু করেছে, তখন থেকেই প্রচলিত। ইসলামী ফিক্হবিদগণ উভয়ের মৌলিক ও সবিস্তার বিবরণ এবং বিভিন্ন রীতি-নিয়ম (ফিক্হ গ্রন্থে) উল্লেখ করেছেন। এই শ্রেণীর কারবারের বর্তমান পরিস্থিতি অতীতের থেকে মৌলিকভাবে ভিন্নতর নয়। আর এ জন্যই এখানে আমরা তার বিস্তারিত আলোচনার দিকে যাচ্ছি না। সুতরাং এ স্থলে কেবল অংশীদারী কারবারের বিভিন্ন প্রকারভেদ উল্লেখ করব। অবশ্য কোম্পানী বা যৌথ কারবার ব্যবসায়ের এক নতুন শ্রেণী, যার অস্তিত্ব ফিকহ্বিদ্গণের যুগে বর্তমান ছিল না। তাই এই ধরনের কারবারের বিস্তারিত বিবরণ অধিকরূপে দিতে চেষ্টা করব।
অংশীদারী কারবারের বিভিন্ন প্রকার-ভেদ
ইসলামী ফিক্হবিদ্গণ এই কারবারের নিম্নোক্ত প্রকারসমূহ বর্ণনা করেছেনঃ-
১- ‘শারিকাতুল মুফাওয়াযাহ’ (THE PARTNERSHIP OF NEGOTIATION) আপোষচুক্তিমূলক অংশীদারী-
ফকীহবৃন্দের পরিভাষায় শারিকাতুল মুফায়াওযাহ এই যে, দুই (বা ততোধিক ব্যক্তি) কোন কারবার করার উপর এই শর্তের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে যে, উভয়ে এ কারবারে অংশীদার হয়ে নিজ নিজ মাল বা অর্থ বিনিয়োগ করবে। কারবারের ব্যাপারে এক অপরের তরফ থেকে সব রকমের লেনদেনে উভয়েই অনুমতিপ্রাপ্ত থাকবে, উভয়েই লাভের ক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী শরীক হবে এবং নোকসানের ক্ষেত্রে নিজ নিজ মাল বা অর্থের পরিমাণ ও হার অনুপাতে সকলে ভাগী হবে। উল্লেখ্য যে, এর শর্তাবলী বড় সূক্ষম।
২- ‘শারিকাতুল আনান’ (THE EQUAL SHARES IN THE PARTNERSHIP) বা সমঅংশের অংশীদারীঃ-
এই কারবারে দুটি লোক নিজ নিজ মাল বা অর্থ সহ এই শর্তে শরীক হয় যে, উভয়ে এ মালে ব্যবসা করবে এবং নিজ নিজ মালের পরিমাণ ও হার অনুপাতে উভয়েই লাভ ও নোকসানে শরীক হবে।
এই কারবার ও ‘শারিকাতুল মুফাওয়াযাহ’ এর মাঝে পার্থক্য হল এই যে, ‘মুফাওযাহ’তে উভয় অংশীদার সর্বাবস্থায় এক অপরের প্রতিনিধি ও প্রতিভূ হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ‘আনান’ এ উভয়ের মধ্যে কেউই মালের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে নাড়াচাড়া করতে পারে না। অবশ্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সীমিত বিষয়ে নাড়াচাড়া করতে পারে।
৩- শারিকাতুল আ’মাল বা আবদান (THE PARTNERSHIP OF THE BODIES) বা দৈহিক অংশীদারী-
এই কারবারে দুই অথবা ততোধিক কারিগর ব্যক্তি কোন বিশেষ কাজ এক সঙ্গে করতে এই শর্তে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, কাজের মজুরী চুক্তি অনুসারে উভয়ের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা হবে।
এতে এক বা বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন লোক হতে পারে। যেমন ছুতোর ও দর্জির এই কারবারে এক অপরের শরীক হিসাবে একত্রে কাজ করা বৈধ।
৪- ‘শারিকাতুল উজুহ’ (THE PARTNERSHIP OF THE ESTEEM) বা প্রতিপত্তিমূলক অংশীদারী-
এই কারবারে দুই অথবা ততোধিক ব্যক্তি নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ভিত্তিতে ধারে কোন পণ্য ক্রয় করার চুক্তি করে সেই ক্রীত পণ্য নিয়ে সকলে ব্যবসা করে। অতঃপর পণ্যের মালিককে মূল্য পরিশোধ করে যে লাভ অবশিষ্ট থাকে, তা আপোসে ভাগাভাগি করে নেয়। আর নোকসানের ক্ষেত্রেও সকলেই সমান ভাগী থাকে।
৫- ‘শারিকাতুল মুযারাবাহ’ (THE SPECULOTION) বা ঝুঁকিবিশিষ্ট অংশীদারী-
এই কারবারে এক ব্যক্তি নিজের মাল অপর ব্যক্তিকে ব্যবসা করার জন্য প্রদান করে এবং চুক্তি অনুপাতে উভয়েই লাভের ভাগী হয়। কিন্তু নোকসান হলে তা শুধু মাল-ওয়ালাই বহন করে এবং যে ব্যবসা করে, সে নোকসানের ভাগী হয় না। কারণ, তার পরিশ্রম ব্যর্থ হওয়াটাই নোকসানের ভাগী হওয়া।
প্রিয় পাঠক! উপরোল্লেখিত সকল শ্রেণীর ব্যবসা ও কারবারকে শরীয়ত বৈধ চিহ্নিত করেছে এবং এর মধ্যে কোন প্রকার কারবারকেই হারাম ও অবৈধ গণ্য করেনি। পক্ষান্তরে যদি কোন এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ধরনের কোন অংশীদারী কারবার করতে চুক্তিবদ্ধ হয়, তাহলে শরীয়ত তাদেরকে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করে। কারণ উক্ত প্রকার কারবারগুলোর মধ্যে কোন কারবারেই সূদ বা সূদের গন্ধও নেই।
আসুন এবারে আমরা তৃতীয় প্রকার কারবার ‘কোম্পানী’ প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করি।
কোম্পানীর পরিচিতি
কোম্পানীর আভিধানিক অর্থ হল সংঘ। অবশ্য কখনো কখনো ‘সঙ্গী’র অর্থেও ব্যবহার করা হয়। ইউরোপে শিল্পিক বিপলব বিকাশ হওয়ার পরে সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বড় বড় কারখানা প্রতিষ্ঠিত করার নিমিত্তে যখন বিরাট অংকের পুঁজির প্রয়োজন দেখা দিল; পরন্তু ঐ পরিমাণ পুঁজি কোন এক ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তি দ্বারা জমা বা যোগাড় করা সম্ভবপর ছিল না, তখন সাধারণ সকল শ্রেণীর লোকেদের সঞ্চিত অর্থ একত্রীভূত করে যৌথভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে কোম্পানী-ব্যবস্থা চালু হল। এর প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে কয়েক ব্যক্তির একটি দলকে একটিমাত্র আইনসম্মত ব্যক্তির পজিশন দেওয়া হয়। ঐ আইনসম্মত ব্যক্তিকে ‘কর্পোরেশন’ বলা হয়। যার একটি বিভাগ কোম্পানী নামে পরিচিত।
No comments