ব্যাংকের সুদ কি হালাল - অনুচ্ছেদ ৪১ থেকে ৫০ পর্যন্ত, শাইখ মোস্তাক আহমাদ কারীমী
৭- ব্যাংকের ইন্টারেষ্ট ও জাহেলিয়াতের সূদ
ব্যাংকের সূদ হালাল করার লক্ষ্যে আরো একটি খোঁড়া যুক্তি এই বলে পেশ করা হয় যে, ব্যাংকের সূদ সেই জাহেলিয়াতের সূদ থেকে ভিন্নতর যাকে আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে হারাম করেছেন এবং সেরূপ সূদখোরের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাকে ভীতিপ্রদর্শন করেছেন।
কারণ, কতিপয় সলফদের উক্তিমতে জাহেলিয়াতের সূদ এরূপ ছিল যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কর্জ দিত। অতঃপর সেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাকে বলত, ‘আমার ঋণ পরিশোধ করে দাও, নচেৎ এর উপর সূদ দাও।’ অবশ্য জাহেলিয়াতের সূদ যে এরূপ ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সে যুগে কেবলমাত্র এই এক রকমই সূদ যে প্রচলিত ছিল না---তাও সত্য।কেননা, বহুসংখ্যক দলীল ও ঘটনা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, ঋণ-চুক্তির প্রারম্ভেই সূদ নেওয়ার শর্ত আরোপ করা হত; যেমন, বাণিজ্যিক কাফেলার লোকেরা এরূপ করত। আল্লামাহ আবু বক্র জাস্সাস (রঃ) তাঁর ‘আহকামুল কুরআন’ নামক তফসীরগ্রন্থে লিখেছেন যে, যে ধরনের সূদ সে যুগের আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং যে ধরনের সূদ ছাড়া তারা অন্য সূদ জান্ত না---তা এই যে, জাহেলিয়াতের লোকেরা একে অন্যের নিকট ঋণ করার সময় আপোসে মূলধন ছাড়া এত টাকা বাড়তি আদায় করতে হবে---এই চুক্তি নিষ্পন্ন করে নিত।
প্রায় অনুরূপ কথাই ইমাম ত্বাবারী এবং আল্লামা রাযীও তাঁদের তফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
পরন্তু তর্কের খাতিরে যদি এ কথাও মেনে নেওয়া যায় যে, জাহেলিয়াতের সূদ যুক্তিতে উপস্থিত সূদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; অর্থাৎ জাহেলিয়াতের সূদ ঋণ পরিশোধের জন্য নির্ধারিত প্রথম মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই শুরু হত, তাহলে দ্বিতীয় প্রকার সূদ অর্থাৎ চুক্তির গোড়াতেই শর্তারোপিত সূদ অধিকতর হারাম হওয়া উচিত। কারণ উপরোক্ত কথাগুলির সারমর্ম এই যে, জাহেলিয়াতের যুগে ঋণ দেওয়ার শুরুতে বিনা সূদে ঋণ দেওয়া হত এবং সূদ নেওয়া ঠিক তখন থেকে শুরু হত, যখন ঋণ পরিশোধ করার নির্ধারিত মেয়াদ পার হয়ে যেত এবং ঋণগ্রহীতা তার ঋণ পরিশোধ করতে পারত না।
যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, শুরুতেই ঋণের উপর আরোপিত শর্ত অনুযায়ী সূদ খাওয়া অধিকরূপে হারাম ও নাজায়েয। আর ব্যাংক এই দ্বিতীয় প্রকার কারবারই করে থাকে। কেননা, ব্যাংকে ঋণগ্রহীতার উপর সূদের হিসাব প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যায়। পরন্তু জাহেলিয়াতের প্রথম প্রকার সূদও ব্যাংকের বর্তমান লেনদেনে পাওয়া যায়। কারণ ঋণ শোধ করার নির্দিষ্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে এবং ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের ঋণ আদায় করতে না পারলে তাকেও বলা হয় যে, ‘হয় তোমার ঋণ পরিশোধ কর, না হয় আরো সূদ আদায় কর।’ এ ছাড়া যদি পরিশোধে একটা মাত্র দিন বিলম্ব হয়ে যায়, তাহলে সেই দিনের সূদও তার উপর জুড়ে দেওয়া হয়। এবং এইভাবে যতদিন বিলম্ব হয়, তত দিনের সূদ তার ঘাড়ে হিসাবমত চাপিয়ে দেওয়া হয়।
৮- জমি ভাড়া দেওয়ার উপর সূদের কিয়াস
একটি যুক্তি এও পেশ করা হয়ে থাকে যে, যে ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখে এবং তার উপর নির্দিষ্ট পরিমাণে সূদ গ্রহণ করে, সে ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির মতই যে তার জমি অপরকে ঠিকা দেয় এবং তার নিকট থেকে চুক্তিমত নির্দিষ্ট পরিমাণে ভাড়া গ্রহণ করে। সে ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি তার জমিতে ফসল হল, কি না হল তার খেয়াল ও পরোয়াই করে না। বরং সে শুধুমাত্র তার জমি চাষ করতে দিয়েই তার ভাড়ার অধিকারী হয়ে যায়।
কিন্তু লক্ষণীয় যে, উক্ত যুক্তিতে বিভ্রান্তিকর হেত্বাভাস ব্যবহার করা হয়েছে। এ কথাটিকে যদি আমরা ফিক্হী ভাষায় বলি, তাহলে বলতে পারি যে, এ যুক্তিতে জমির উপর টাকাকে এবং ভাড়ার উপর সূদকে কিয়াস করা হয়েছে। অথচ এমন কিয়াস মুলেই অচল। কেননা, কিয়াস সহীহ ও শুদ্ধ হওয়ার জন্য (অনুমেয় ও অনুমিত উভয়ের) ইল্লত বা হেতু অভিন্ন হওয়া আবশ্যিক। আর এখানে সেই হেতু অভিন্ন নয়। জমি ঠিকার উপর দেওয়ার ইল্লত (হেতু) হল, জমির সত্ত্ব ব্যবহার করে লাভবান হওয়া যায়। পক্ষান্তরে টাকা যতক্ষণ টাকা থাকে, ততক্ষণ তার সত্ত্ব দ্বারা লাভবান হওয়া সম্ভব নয়। কারণ টাকার সত্ত্ব কারোরই ঈপ্সিত নয়। (ঈপ্সিত হল তার বিনিমেয়।) ইমাম গায্যালী (রঃ) তাই বলেছেন। (ইহ্য়্যাউল উলূম ৪/৮৮) অনুরূপভাবে টাকা পয়সার মান জমি থেকে ভিন্নতর। আর এই ভিন্নতা থাকার কারণেই উক্ত কিয়াস (অনুমিতি) শুদ্ধ নয়।
পক্ষান্তরে জমি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারটা ইজারার পর্যায়ভুক্ত যা যুক্তি ও হিকমতপূর্ণ ইসলামে বৈধ করা হয়েছে। ইজারাতে মূল সত্ত্ব ভাড়া দেওয়া হয় এবং তা ব্যবহার করে উপকৃত হওয়ার দরুন ব্যবহারকারীর নিকট থেকে কিছু ভাড়া নেওয়া হয়। পরন্তু তার মূল সত্ত্ব বিনষ্ট হয়ে যায় না। আর টাকা-পয়সা ঋণ দেওয়ার ব্যাপারটা হল ইহসান ও পরহিতৈষিতার পর্যায়ভুক্ত। আর এই জন্যই এর উপর মজুরী বা ভাড়া নেওয়া অবৈধ।
সুতরাং এর মধ্যে এবং জমি ভাড়া দেওয়ার মধ্যে রয়েছে বড় পার্থক্য। এই পার্থক্যটি একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝুনঃ- মনে করুন, এক ব্যক্তি তার জমি অপর ব্যক্তিকে বার্ষিক ৫০০ টাকা হিসাবে ঠিকায় দিল। উক্ত ৫০০ টাকা হল এ জমির মূল সত্ত্ব দ্বারা উপকৃত হওয়ার ভাড়া। পরন্তু সারা বছর চাষ করার ফলেও জমির সত্ত্ব বিনষ্ট হয় না।
ধরে নেওয়া যাক, বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই ষষ্ঠ মাসে এ জমিটি নদীর ধসে নষ্ট হয়ে গেল। এমতাবস্থায় জমির মালিক ২৫০ টাকা ঠিকাদারকে অবশ্যই ফেরৎ দেবে। কেননা, জমির সেই মূল সত্ত্ব যার দ্বারা ঠিকাদার লাভবান হয়ে আসছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে। অতএব সে ভাড়া কেন আদায় করবে? পক্ষান্তরে ঋণের প্রসঙ্গটা ঠিক এর বিপরীত। ধরে নিন, ঋণের নেওয়া টাকা ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে হারিয়ে গেল অথবা পুড়ে গেল। এমতাবস্থায় ঋণগ্রহীতা ঋণদাতার নিকট থেকে এই দাবী করতে পারে না যে, তোমার টাকা যেহেতু নষ্ট হয়ে গেছে, সেহেতু তুমি আমাকে পুনর্বার ঋণ দাও। বরং এই ক্ষতি ঋণগ্রহীতাকেই বহন করতে হবে।
বুঝা গেল যে, জমি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারের উপর ঋণ দেওয়ার ব্যাপারকে কিয়াস করা এবং এই কিয়াস ও যুক্তি দ্বারা ব্যাংকের সূদকে হালাল করা আদতেই সঠিক নয়।
উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা থেকে আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন যে, ব্যাংকের সূদ হালালকারিগণ বিভিন্ন দুর্বল ও ভিত্তিহীন দলীল প্রয়োগ করে সরলমনা মুসলমাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছেন।
৯- ‘বাইএ সালাম’ এর উপর সূদকে কিয়াস
সূদকে জায়েয করার মানসে একটি যুক্তি এও পেশ করা হয় যে, ঋণ দিয়ে সূদ নেওয়ার কারবারটা ঠিক ‘বাইএ সালাম’ (THE PREPAYMENT) দাদন ব্যবসা বা পূর্বে মূল্য আদায় করে পরে পণ্য নেবার চুক্তি-ব্যবসা) এর মত।
কারণ এ কারবারে উভয় পক্ষের লাভ বর্তমান। আর তা এইভাবে যে, ঋণগ্রহীতা সূদের উপর অর্থ সংগ্রহ করে; যাতে সে নিজের অভাব ও প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। ওদিকে ঋণদাতা নিজের মূলধন অপেক্ষা বেশী টাকা গ্রহণ করে থাকে, আর তা হল সেই বিলম্ব দেওয়ার বিনিময়ে যা সে ঋণগ্রহীতাকে ঋণ-পরিশোধে দিয়ে থাকে। আর এরূপই হয়ে থাকে বাইএ সালামে।
কারণ, বাইএ সালামে তুলনামূলক কম মূল্য অগ্রিম আদায় করা হয়ে থাকে। যাতে পরে সেই আগাম কেনা ফসল দ্বারা অধিক মুনাফা লাভ করা সম্ভব হয়। আর এ ধরনের অগ্রিম চুক্তি ব্যবসাকে ইসলাম বৈধ নিরূপণ করেছে। এই ব্যবসার উপরেই সূদভিত্তিক কারবারকে কিয়াস করে ব্যাংকের সূদকে হালাল বলা হচ্ছে। কারণ উভয় প্রকার কারবারেই এই ধরনের লেনদেন ও অর্থ বিদ্যমান।
উক্ত যুক্তিপেশকারীদের যুক্তির জবাব এই যে, ‘বাইএ সালাম’ ও সূদভিত্তিক ঋণের মাঝে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। বিধায় এককে অপরের উপর কিয়াস (অনুমিতি) করা আদৌ সঠিক নয়। উভয় কারবারের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নিম্নরূপঃ-
ক- ‘সালাম’ (THE PREPAYMENT) দাদন ব্যবসা বা পূর্বে মূল্য আদায় করে পরে পণ্য নেবার চুক্তি ব্যবসা) এক প্রকার ব্যবসা; যাতে মূল্য ও পণ্য উভয় পাওয়া যায়। এতে কেবল টাকা-পয়সারই কারবার হয় না। অর্থাৎ, টাকার পরিবর্তে টাকার বিনিময় হয় না। পক্ষান্তরে সূদভিত্তিক ঋণের (ব্যাংকের) কারবারে নগদ অর্থই সবকিছু। বরং নগদ অর্থই এর আসল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ টাকার পরিবর্তে টাকার বিনিময় হয়; যা হাদীসের ভাষায় ‘রিবাল ফায্ল’।
খ- ‘সালাম’ ব্যবস্যয় ক্রেতা প্রত্যেক বারেই লাভবান হতে পারে না। কেননা, অধিকাংশ দেখা যায় যে, ক্রীতপণ্য নেবার সময় তার মূল্য পড়ে গেছে। আবার কখনো বেড়েও থাকে। সুতরাং ‘সালাম’ ব্যবসায় লাভের গ্যারান্টি থাকে না। তাছাড়া সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে যে সব আপদ-বিপদ ও লাভ-নোকসান সামনে আসে, তাও তাতে বিদ্যমান। কিন্তু সূদভিত্তিক ঋণের ব্যাপারটা ঠিক এর বিপরীত। এতে পূর্ব থেকেই লাভ ও মুনাফার গ্যারান্টি থাকে এবং কোন প্রকারের আপদ-বিপদ অথবা ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে না।
গ- ‘সালাম’ ব্যবসায় বাণিজ্য, কৃষিকার্য, শিল্পকর্ম প্রভৃতি আরো কল্যাণমূলক কর্মে এক ধরনের উৎসাহ, উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা দান করা হয় এবং তা জীবন-তরীকে উন্নয়ন-পথে অগ্রসর করতে ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে প্রগতিশীল করতে বড় সহায়ক। পক্ষান্তরে সূদভিত্তিক ঋণের কারবারে এ কথা পাওয়া যায় না। উল্টা এতে বাজার-মন্দা সৃষ্টি হয়। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য কর্মের উন্নয়ন ব্যাহত হয় এবং এর ফলেই বাণিজ্যিক উদ্যম শীতল হয়ে নিশ্চল অবস্থায় পর্যবসিত হয়। (বিনা পরিশ্রমে টাকা এলে কে যাবে আর পরিশ্রম করতে?)
উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনায় একথাই প্রমাণিত হল যে, উক্ত যুক্তি উপস্থাপিত করেও সূদ হালালকারিগণ সরলমনা মানুষদের চোখে ধুলো দিচ্ছেন এবং তাদেরকে নোংরা, গর্হিত ও অসৎকর্মের দিকে দেদার আহ্বান করে যাচ্ছেন।
১০- কতিপয় হাদীস দ্বারা সূদকে হালাল প্রতিপাদন
ব্যাংকের সূদকে হালাল করার জন্য আরো একটি যুক্তি এই পেশ করা হয়ে থাকে যে, ব্যাংক অপরের পুঁজি দ্বারা তার বিনা অনুমতিতে ব্যবসা করে, আর ব্যবসায় লাভের অর্থ আল্লাহ হালাল করেছেন। এই জন্য ব্যাংক এবং তাতে টাকা জমাকর্তা উভয়ের জন্য উক্ত লভ্যাংশ গ্রহণ করা হালাল, এই যুক্তির দলীলে উরওয়াহ বিন আবিল জা’দ (রাঃ) এবং হাকীম বিন হিযাম (রাঃ) এর বর্ণিত হাদীস পেশ করা হয়। যাতে বলা হয়েছে যে, নবী করীম (সাঃ) উরওয়াহ (রাঃ)কে একটি কুরবানীর পশু বা ছাগল খরীদ করতে একটি দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) প্রদান করলেন। তিনি এ দীনার দ্বারা দুটি ছাগল খরীদ করলেন। অতঃপর একটিকে এক দীনারে বিক্রয় করে সেই দীনার সহ এ ছাগল নবী (সাঃ)কে সমর্পণ করলে তিনি তাঁর ব্যবসায় বর্কতের দুআ দিলেন।[1]
অনুরূপ তিনি হাকীম বিন হিযাম রাঃ কে একটি দীনার দিয়ে একটি কুরবানীর পশু ক্রয় করতে বলেছিলেন। তিনি দীনারটি দিয়ে একটি কুরবানীর পশু ক্রয় করে পুনরায় তা দুই দীনারে বিক্রয় করে দেন। অতঃপর একটি দীনার দ্বারা আবার একটি কুরবানীর পশু ক্রয় করে দীনার সহ পশু নবী (সাঃ)কে প্রদান করেন। তিনি দীনারটিকে সদকাহ করেছিলেন এবং হাকীমের ব্যবসায় বর্কতের দুআ দিয়েছিলেন।[2]
উক্ত হাদীসদ্বয় দ্বারা ব্যাংকের সূদকে এভাবে হালাল করার অপচেষ্টা করা হয়েছে যে, উভয় সাহাবীই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের দেওয়া দীনার দ্বারা তাঁর বিনা অনুমতিতে ব্যবসা করলেন এবং লাভকৃত দীনার সহ ছাগল বা (কুরবানীর পশু) ভেঁড়া নবী (সাঃ)কে সমর্পণ করলেন। অনুরূপ ব্যাংকও জমাকর্তার বিনা অনুমতিতে তার টাকা নিয়ে ব্যবসা করে এবং তার লভ্যাংশ তাকে প্রদান করে।
এই যুক্তির তৃতীয় দলীল গুহাবন্দীদের হাদীস। যাতে বলা হয়েছে যে, তিন ব্যক্তি একটি গিরিগুহায় আশ্রয় নিলে একটি বিরাট পাথর গুহার মুখে পড়ে গেলে তারা সেখানে বন্দী হয়ে পড়ে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ নেক আমলের অসীলা দিয়ে আল্লাহর নিকট দুআ করে; যাতে পাথর সরে গিয়ে তারা সেখান থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে। ওদের মধ্যে একজন তার একটি নেক আমল উল্লেখ করে এভাবে দুআ করতে লাগল, ‘হে আল্লাহ! আমি এক ব্যক্তিকে (সাড়ে সাত কিলো) চালের বিনিময়ে একটি মজুর রেখেছিলাম। মজুরী পেশ করলেও সে তা না নিয়ে আমার নিকটেই ছেড়ে চলে যায়। অতঃপর আমি তার মজুরীর চালকে (ব্যবসায় খাটিয়ে) বাড়াতে লাগলাম। অবশেষে সেই চালের টাকা দিয়েই একপাল গাই এবং একটি রাখাল কিনে নিলাম। কিছু দিন পর সেই মজুর তার মজুরী নিতে আমার নিকট এল। আমি রাখাল সহ সমস্ত গাই তাকে দিয়ে দিলাম--।’[3]
উপর্যুক্ত তিনটি হাদীস থেকে নিম্নলিখিত মাসআলা প্রতিপন্ন করা হয়েছেঃ-
ক- অপরের পুঁজি দ্বারা তার বিনা অনুমতিতে ব্যবসাকারী যে লাভ অর্জন করে, তার সবটাই পুঁজিপতিকে দিতে পারে।
খ- সম্পূর্ণ লাভটাই সে নিজে রেখে নিতে পারে।
গ- এ লাভের কিয়দাংশ পুঁজিপতিকে দিয়ে বাকী অংশ নিজের জন্য রাখতে পারে।
ব্যাংকের কারবার এই তৃতীয় প্রকার মাসআলার পর্যায়ভুক্ত। অতএব ব্যাংকের সূদ সূদ নয়; প্রকৃতপক্ষে তা হল ব্যবসার লভ্যাংশ। আর তা নিঃসন্দেহে হালাল।
কিন্তু পূর্বোল্লেখিত তিনটি হাদীসকে নিয়ে যদি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে বুঝা যাবে যে, এখানে যে কিয়াস করা হয়েছে তা যথার্থ নয়।
নবী (সাঃ) যে উরওয়াহ (রাঃ)কে একটি দীনার দিয়ে ছাগল অথবা কুরবানীর পশু (ভেঁড়া) ক্রয় করতে বলেছিলেন সে ব্যাপারটি প্রতিনিধিত্বের; ‘মুযারাবাহ’ (পুঁজি দিয়ে ব্যবসা করতে দেওয়ার) ব্যাপার নয়। প্রতিনিধি করার অর্থ হল এই যে, ‘তুমি অমুক কাজে আমার স্থলাভিষিক্ত হও। (বা আমার হয়ে তুমি অমুক কাজ করে দাও।)’ আর উকীল বা প্রতিনিধিকে যে কাজে উকালতি বা প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয়, সে কাজে তার নিজস্ব এখতিয়ার চালনোর অনুমতি থাকে। তাছাড়া সাধারণ অনুমতি থাকলে তো কোন সমস্যায় নেই। কিন্তু যদি সাধারণ অনুমতি না হয়, তাহলে সে কাজে উকিলের নিজস্ব এখতিয়ার তার মুয়াক্কিলের অনুমতি সাপেক্ষ থাকে; মুয়াক্কিল রাজি হলে উকিলের এখতিয়ার সঠিক ও জায়েয, নচেৎ জায়েয নয়। উপর্যুক্ত দুটি হাদীসে আল্লাহর রসূল (সাঃ) ছাগল ও কুরবানীর পশু ক্রয় করার জন্য উল্লিখিত দুই সাহাবীকে নিজের প্রতিনিধি বা উকিল বানিয়েছিলেন। এবারে উরওয়াহ বিন আবিল জা’দ বারেকী (রাঃ) এক দীনারে দুটি ছাগল পেয়ে গিয়েছিলেন, আর এ জন্যই তিনি অতিরিক্ত একটি ছাগল এক দীনারে বিক্রয় করে দিয়েছিলেন।
হাকীম বিন হিযাম (রাঃ) কুরবানীর এক মেষ ক্রয় করেছিলেন। অতঃপর তা পছন্দ না হওয়ার কারণে অথবা অন্য কোন কারণে দুই দীনারের বিনিময়ে বিক্রয় করে দিয়েছিলেন। তারপর এক দীনারে একটি মেষ ক্রয় করে বাড়তি দীনারসহ তা নবী (সাঃ) কে সোপর্দ করেছিলেন।
এবারে একটু চিন্তা করে দেখলে বোঝা যাবে যে, উভয় সাহাবী নবী (সাঃ) এর অনুমতি ও সন্তোষ বাইরে কিছুই করেননি। আর এ কথা কল্পনাই বা কি করে করা যেতে পারে যে, সাহাবীদ্বয় নবী (সাঃ) এর অনুমতি ছাড়াই সে কাজে নিজেদের ইচ্ছা প্রয়োগ করেছেন? বলা বাহুল্য, তাঁর অনুমতি ও সন্তোষ শুরুতেও ছিল এবং শেষেও। এ কথার স্পষ্ট দলীল এই যে, তিনি তাঁদের এ কাজ পছন্দ করলেন এবং উভয়ের ক্রয়-বিক্রয়ে বর্কতের দুআও দিলেন।
অতএব উভয় সাহাবী রসূল (সাঃ) এর বিনা অনুমতিতেই উক্ত ক্রয়-বিক্রয় করেছিলেন এ কথা বাস্তব থেকে বহু ক্রোশ দূরে। আর তা যে হাদীসকে সঠিক ও যথার্থভাবে বুঝতে অক্ষমতার পরিণতি---তা বলাই বাহুল্য। পরন্তু এই ভুল বুঝার ভিত্তিতেই সমস্ত হাদীসকে সূদ হালালের দলীলরূপে পেশ করা হয়েছে। অথচ যে ব্যাখ্যা ও বুঝের ভিত্তিতে এমনটি করা হয়েছে, তা কোন হাদীস ব্যাখ্যাতাই করে যাননি।[4]
জনৈক পারসী কবি কি সত্যই না বলেছেন,
খিশ্তে আওয়াল চূঁ নেহদ মে’মার কজ্,
তা সুরাইয়্যা মী রসদ দীওয়ার কজ্।
অর্থাৎ, রাজমিস্ত্রি যখন প্রথম ইটটাই টেরা করে গাঁথে, তখন আকাশ পর্যন্ত দেওয়াল টেরা হয়েই উঠে।
পক্ষান্তরে নিজের পুঁজি দিয়ে অপরকে ব্যবসা করতে দেওয়ার অর্থ হল, ‘তুমি আমার টাকা দ্বারা ব্যবসা কর। ব্যবসার লাভ আমরা উভয়ে ভাগাভাগি করে নেব।’ যেমন প্রতিনিধিত্বে লাভ বা নোকসান ভাগাভাগির কোন প্রশ্নই নেই। তবে হ্যাঁ, প্রতিনিধি তার পারিশ্রমিক নিতে পারে। এখানে প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারকে ‘মুযারাবাহ’ (পুঁজি দিয়ে অপরকে ব্যবসা করতে দেওয়া) এর উপর কিয়াস (অনুমিতি) করা হয়েছে, যা যথার্থ ও সঠিক নয়।
ব্যাংক ডিপোজিটারদের পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করে (যদি সঠিক অর্থে ও বাস্তবে সে ব্যবসাই করে। নচেৎ ব্যাংক স্বয়ং নিজে প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসা করে না। বরং সে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি প্রভৃতিকে সুদের উপর ঋণ সরবরাহ করে থাকে), তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। আবার শরীয়ত যে ধরনের মুযারাবাহকে বৈধ নিরূপিত করেছে, তার শর্তাবলী ব্যাংকের কারবারে পাওয়া যায় না।
যেমন; মুযারাবাহ উভয় পক্ষ (টাকার মালিক ও ব্যবসায়ী) প্রত্যেক লাভ-নোকসানে সমানহারে শরীক হয়। কিন্তু ব্যাংকে টাকা জমাকর্তা কেবল লাভেই শরীক হয়, নোকসানে হয় না। যাতে মুযারাবাহর শরয়ীরূপ বাতিলে পরিণত হয় এবং লাভের টাকাও সূদ রূপে পরিগণিত হয়ে যায়।
গুহাবন্দীদের হাদীসটিকে আরো একবার মনোযোগ সহকারে পড়লে বুঝতে পারবেন যে, সে ব্যক্তি মজুরের মজুরীর টাকা নিয়ে এ ব্যবসা করেনি। বরং উক্ত ব্যবসা সে নিজের মালিকানাধীন অর্থের মাধ্যমেই করেছিল। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত মজুরকে তার মজুরী দিয়ে দেওয়া না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত মজুরী মজুরের মালিকানাভুক্ত হয় না। কেননা, ধরে নেওয়া যাক, যদি এ চাল মালিকের নিকট হতে চুরি হয়ে যেত বা পুড়ে যেত অথবা কোন প্রকারে নষ্ট হয়ে যেত, তাহলে নোকসান কার হত? মালিকের না মজুরের? আপনি নিশ্চয়ই বলবেন যে, নোকসান মালিকেরই হত। এবারে কি মালিকের এ কথা বলার অধিকার ছিল যে, তোমার চাল নষ্ট হয়ে গেছে, অতএব তুমি আর মজুরী পেতে পার না? নিশ্চয় এ কথা কোন আদালতই মেনে নেবে না।
সুতরাং যদি তাই হয়, তাহলে এ কথা প্রমাণ হল যে, মালিক যা কিছু বাড়িয়েছিল, তা মজুরের মজুরীর চাল থেকে বাড়ায়নি বরং তা নিজের মাল থেকেই বাড়িয়েছিল।[5]
তবুও এ ব্যক্তি মজুরের জন্য যা কিছুই করেছে, তা নিছকভাবে একমাত্র আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই করেছে। আর এর সাথে যে তার নিজেরও লাভ হবে, ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা পাবে বা ধনবৃদ্ধি হবে এসব উদ্দেশ্য তার মোটেই ছিল না। সুতরাং সে গাইপাল ও রাখাল সেই মজুরকে দিয়ে নিছক অনুগ্রহ ও বদান্যতা প্রকাশ করেছিল। যার ফলেই সে উক্ত কর্মের অসীলা দিয়ে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করলে তিনি তা শ্রবণ করেছিলেন।
এবারে উক্ত হাদীস দ্বারা এই প্রমাণ করা যে, মালিক তার মজুরের মজুরীর চাল নিয়ে তার অনুমতি ছাড়াই ব্যবসা করেছিল---সে কথা নিছক ভুলই নয়; বরং ভিত্তিহীন এবং হাস্যকরও। আর এর চাইতে বেশী হাস্যকর কথা হল এই যে, ইমাম বুখারীর মত দূরদর্শী মুজতাহিদকেও এ ব্যাপারে টেনে আনা হয়েছে; বলা হয়েছে ‘‘ইমাম বোখারী (রঃ) এই তৃতীয় প্রকার ব্যবসার বিষয় এভাবে উল্লেখ করেছেন- باب التجارة في مال غيره بغير إذنه!! কিন্তু আপনি পুরো সহীহুল বুখারী পড়ে দেখুন, উক্তরূপ শব্দে কোন ‘বাব’ই খুঁজে পাবেন না। سبحانك هذا بهتان عظيم (এটা একটি বড় অপবাদ এবং সত্যের অপলাপও।)
ইসলামের মত এমন ন্যায় ও নৈতিকতাপূর্ণ দ্বীন সম্বন্ধে কিভাবে একথা বিশ্বাস করা যায় যে, তাতে এক ব্যক্তির মাল-ধনে তার অনুমতি ছাড়াই অপর ব্যক্তির ঠিক মালিকের ন্যায় ইচ্ছামত এখতিয়ার চালানোর অনুমোদন আছে। এটি ইসলামের একটি এমন সন্দিগ্ধ ও বিকৃত ব্যাখ্যা, যা কোন সঠিক চিন্তাবিদ্ মানুষ সঠিক বলতে পারেন না। নিম্নের হাদীসটিকে ঠান্ডা মাথায় পড়ুনঃ-
আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেন,
لَا يَخْطُبْ أَحَدُكُمْ عَلَى خِطْبَةِ
أَخِيهِ، وَلاَ يَبِعْ عَلَى بَيعِ أَخِيهِ إِلاَّ بِإِذْنِه.
অর্থাৎ, তোমাদের কেউ যেন তার ভায়ের পয়গামের উপর কোন নারীকে পয়গাম না দেয় এবং তার ভায়ের কেনা-বেচার উপর তার বিনা অনুমতিতে কেনা-বেচা না করে।[6]
একটু ভেবে দেখুন, ইসলাম যখন অপরের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর নিজস্ব পয়সা দিয়েও ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করছে, তখন অন্য জনের পয়সা দিয়ে তার অনুমতি ছাড়াই ক্রয় বিক্রয়কে কি করে বৈধ করতে পারে?
পক্ষান্তরে ব্যাংক এবং অনুরূপ কোন সংস্থা নিছক অর্থপূজা, ব্যবসা ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার, সুবিধা ভোগ এবং অর্থ শোষণ করার অভিপ্রায়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্যে এই থাকে যে, সূদের লোভ দেখিয়ে জনগণ ও জাতির ধন-মাল যতবেশী আকারে সম্ভব নিজেদের আয়ত্তে আনা হবে এবং এই পদ্ধতিতে নিতান্ত চাতুর্যের সাথে সমগ্র জাতির উপর স্বীয় ক্ষমতা ও শাসন চালানো হবে। যেখানে ইচ্ছা সেখানে দুর্ভিক্ষ আনা যাবে এবং যেখানে ইচ্ছা সেখানে অনাহার সৃষ্টি করে বিনাশ আনয়ন করা হবে। যেখানে ইচ্ছা সেখানে নিজের পছন্দমত শাসন ও রাজনীতি প্রয়োগ করা যাবে। যখন ইচ্ছা তখন মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করা সম্ভব হবে এবং যখন ইচ্ছা তখন মুদ্রামান বর্ধিত করে মার্কেটে ব্যাপক আকারে মন্দা ছড়ানো যাবে। যাকে ইচ্ছা গদিচ্যুত এবং যাকে ইচ্ছা তাকে গদীনশীন করা সহজ হবে।
প্রিয় পাঠক! এবারে আপনি নিজেই ফায়সালা করতে পারেন যে, (মুখলিস সৎব্যবসায়ীর) নিছক দ্বীনদারী ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ভিত্তিতে করা কারবারের উপর নিছক দুনিয়াদারী ও অর্থপিশাচ-সুলভ কারবারকে কিয়াস করা এবং এর ফলে ব্যাংকের কারবারকে বৈধ করা কতদূর সঠিক ও যথার্থ হতে পারে?
পুনরায় আর একবার আপনি তিনটি হাদীসকেই মন দিয়ে পড়ুন এবং দেখুন, তাতে কোথাও কি এমন কথা আছে যে, ‘ভাইসকল! তোমরা আমাদেরকে তোমাদের পুঁজি সোপর্দ কর, আমরা সে পুঁজির হিফাযতও করব এবং উল্টে তার উপর সূদও আদায় করব?’
আরও খেয়াল করে দেখুন, তাতে কি এ ধরনের কোন শর্ত বা নির্ধারণ আছে যে, ‘যদি তোমাদের টাকা আমাদের নিকট এক বছর থাকে, তাহলে ৮% ইনটারেষ্ট দেব, পাঁচ বছর থাকলে ডবল লাভ দেব আর দশ বছর থাকলে তিন ডবল দেব? অর্থাৎ মেয়াদ যত লমবা হবে তত বেশী হারে আমরা তার লভ্যাংশ (?) আদায় করে যাব?’
উপরন্ত বিলম্ব ও সময়ের বিনিময়ে শর্ত ও নির্ধারণের সাথে মূলধন ছাড়া কিছুও বেশী দেওয়া অথবা নেওয়ার নামই হল সূদ। আপনি পুনরায় আর একবার সূদের সংজ্ঞার্থ এবং জাহেলিয়াত যুগের প্রচলিত সূদকে নিয়ে চিন্তা করে দেখুন। তাতে আপনার নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ব্যাংকের সূদ ও জাহেলিয়াতের সেই সূদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই ; যাকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছেন।
[1] (বুখারী ৩৬৪২ নং, আবু দাঊদ ৩৩৮৪নং)
[2] (আবু দাঊদ ৩৩৮৬নং, তিরমিযী ১২৮০নং, হাদীসটি যয়ীফ, দেখুন মিশকাতের টীকা, হাদীস নং ২৯৩৭নং, যয়ীফ আবু দাঊদ ৭৩৩নং, আউনুল মা’বুদ ৯/২৩৮-২৪৩)
[3] (হাদীসটি প্রসিদ্ধ, দেখুন, বুখারী ২৩৩৩নং)
[4] (দেখুন, ফাতহুল বারী ৪/৪৭৭-৪৭৮, ৫/২১, ৬/৭৩৩-৭৩৪, তুহফাতুল আহওয়াযী ৪/৪৬৯-৪৭২, আউনুল মা’বুদ ৯/২৩৮-২৪৩, সুবুলুস সালাম ৩/৫৫, নাইলুল আওতার ৫/২৭০-২৭১, মিরকাতুল মাফাতীহ ৩/৩৩৪)
[5] (দেখুন, ফাতহুল বারী ৫/২১)
[6] (আবু দাঊদ, ইবনে মাজাহ, মুঅত্তা, মিশকাত ৩১৪৪নং)
সূদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা’
আমার প্রিয় মুসলিম ভাই! ব্যাংকের সূদ হারাম হওয়ার কথা এখান থেকেই শেষ হয়ে যায়নি। বরং মুসলিম বিশব তথা অন্যান্য বিভিন্ন দেশের রাজধানী শহরে এ ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন কনফারেন্স ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সে সব সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয় যে, ব্যাংকের সূদ নিশ্চিতরূপে হারাম; যার হারাম হওয়াতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিং আব্দুল আযীয ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ইসলামী অর্থনীতির প্রথম সম্মেলনে বিশ্বের তিন শতাধিক ফিক্হ ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ অংশ গ্রহণ করেন। এঁদের সকলেই একবাক্যে ব্যাংকের সূদকে হারাম বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং কোন এক জনও সে সূদকে হালাল বলে মতবিরোধ প্রকাশ করেননি। বরং অধিক খুশীর কথা এই ছিল যে, উলামায়ে ইসলামের তুলনায় অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগণই উক্ত সূদকে হারাম করার ব্যাপারে অধিকতর উৎসাহ ও আগ্রহ প্রকাশ করেন।[1]
আমার প্রিয় মুসলিম ভাই! পরিশেষে আমরা আপনার অবগতির জন্য এ কথা জানিয়ে দেওয়া উচিত মনে করি যে, বিভিন্ন ফিক্হী, ইসলামী ও অর্থনৈতিক কনফারেন্স, সংগঠন ও সেমিনারের মাধ্যমে ব্যাংকের সূদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে (গণ্যমান্য) উলামাগণের ইজমা’ (সর্ববাদিসম্মতি) সংঘটিত হয়ে গেছে। সকলের রায় মতে বলা হয়েছে যে, এটা হল সেই সূদ, যার হারাম হওয়াতে কোন প্রকার সন্দেহ ও দ্বিধা অবশিষ্ট নেই। উক্ত ইজমা ১৯৬৫ সাল থেকে নিয়ে আজও পর্যন্ত অব্যাহত আছে। আমাদের জন্য তিনটি বিশ্বসম্মেলনে সংঘটিত ইজমা’ই যথেষ্টঃ-
(১) মুহার্রাম ১৩৮৫ হিঃ মুতাবেক মে ১৯৬৫ খ্রিঃ তে মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত ‘ইসলামিক স্টাডিজ একাডেমীর দ্বিতীয় সম্মেলনে সংঘটিত ইজমা’।
(২) ১২-১৯ রজব ১৪০৬ হিঃ তে মক্কা মুকার্রামায় অবস্থিত মুসলিম ওয়ালর্ড লীগের ইসলামিক ফিক্হ একাডেমীর ইজমা’।
(৩) ১০-১৬ রবীউসসানী ১৪০৬ হিঃ মুতাবেক ২২-২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৫ খ্রিঃ তে অনুষ্ঠিত অরগানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্সের ইসলামিক ফিক্হ একাডেমীর ইজমা’।
যেহেতু উপরোল্লেখিত কনফারেন্সসমূহে প্রায় একই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, সেহেতু আমরা কেবল কায়রোতে অনুষ্ঠিত ইসলামিক স্টাডিজ একাডেমীর দ্বিতীয় কনফারেন্সে গৃহীত সিদ্ধান্তাবলীর খসড়া এখানে নকল করাকে যথেষ্ট মনে করছি। উল্লেখ্য যে, উক্ত কনফারেন্সে ৩৫টি দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মুহর্রাম ১৩৮৫ হিঃ মুতাবেক মে ১৯৬৫ খ্রিঃ তে অনুষ্ঠিত ইসলামিক স্টাডিজ একাডেমীর দ্বিতীয় কনফারেন্সে গৃহীত সিদ্ধান্তাবলীঃ-
১ - যে কোন প্রকারের ঋণের উপর ইনটারেষ্ট নেওয়া হল হারাম সূদ নেওয়ার অন্তর্ভুক্ত। তাতে সে ঋণ ব্যক্তিগত অভাবপূরণের উদ্দেশ্যে নেওয়া হোক অথবা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে নেওয়া হোক; কোন পার্থক্য নেই। কারণ, কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট উক্তিসমূহ উভয় প্রকারেরই ঋণভিত্তিক সূদকে হারাম নিরূপণ করেছে।
২- সূদ চাহে স্বল্প পরিমাণের হোক অথবা অধিক পরিমাণের; সর্বাবস্থায় তা হারাম। আয়াতে উল্লিখিত ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে (দ্বিগুণ-চতুর্গুণ) সূদ ভক্ষণ করো না’ এর সঠিক মর্মার্থ তাই।
৩- ঋণের উপর সূদ গ্রহণ করা হারাম। কোন প্রকারের প্রয়োজন এবং কোন প্রকারেরই অবস্থা ও পরিস্থিতিতে তা জায়েয হতে পারে না। অনুরূপ ঋণের উপর সূদ দেওয়াও হারাম। তবে সূদী ঋণ (বা লোন) গ্রহণের গোনাহ কেবল তখনই ক্ষমার্হ হবে, যখন কেউ সূদ বিনা ঋণ কোথাও না পাবে।
সেক্ষেত্রে কেবল নিরুপায় অবস্থায় বাধ্য হয়েই তা গ্রহণ করলে তা মাফযোগ্য। অবশ্য নিরুপায় অবস্থা নির্ধারণ করাটা প্রত্যেকের দ্বীনদারী অনুভব-সাপেক্ষ।
৪- কারেন্ট একাউন্ট ও এল সি খোলা, চেক ও ড্রাফ্ট ভাঙ্গানো এবং দেশের ভিতরে বিল অফ্ এক্সচেঞ্জ (হুন্ডি)র যে কারবার ব্যাংক বিভিনণ ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীর সাথে করে থাকে---তা জায়েয। পরন্তু এসব সেবার উপর ব্যাংক যে ফী গ্রহণ করে---তা সূদ নয়।
৫- স্থায়ী আমানত (FIXED DEPOSIT) সূদবিশিষ্ট এল সি খোলা এবং সূদ ভিত্তিক ঋণ বা লোন দেওয়া ইত্যাদি কারবার সূদী ও হারাম কারবার।
১৯৬৫ সালের ইসলামিক স্টাডিজ একাডেমীর সদস্যবৃনেদর নামের তালিকা ঃ-
নাম |
সাং |
পেশা |
|
১ |
হাসান মামূন (বড় ইমাম) |
মিসর |
আযহার ইউনিভার্সিটির দ্বীনি শিক্ষক |
২ |
ডক্টর ইব্রাহীম আব্দুল মাজীদ লাববান |
মিসর |
দারুল উলুমের ভূতপূর্ব সভাপতি |
৩ |
ডক্টর ইসহাক মূসা হুসাইনী |
প্যালেষ্টাইন |
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি এবং এ্যারাবিক ইউনিভার্সিটির পি জি বিভাগের প্রফেসর |
৪ |
ডক্টর সুলাইমান হারীন |
মিসর |
অসয়ূত ইউনিভার্সিটির ডিরেক্টর |
৫ |
ডক্টর আব্দুল হালীম মাহমূদ |
মিসর |
অসূলুদ্দীন কলেজের সভাপতি |
৬ |
উস্তায আব্দুল হামীদ হাসান |
মিসর |
দারুল উলূম কলেজের ভূতপূর্ব প্রফেসর। |
৭ |
শায়েখ আব্দুর রহমান হাসান |
মিসর |
আযহার ইউনিভার্সিটির ভূতপূর্ব উপাচার্য |
৮ |
শায়খ আব্দুর রহমান কালহূদ |
লিবিয়া |
ভূতপূর্ব বিচার বিভাগীয় মন্ত্রী |
৯ |
উস্তায আব্দুল্লাহ কানূন |
মরক্কো |
মরক্কো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং তানজার ভূতপূর্ব গভর্নর |
১০ |
ডক্টর উসমান খলীল উসমান |
মিসর |
কায়রোর হুকুক কলেজের আইনবিষয়ক লেকচারার |
১১ |
ডক্টর আলী হুসাইন আব্দুল কাদির |
মিসর |
শরীয়াহ কলেজের সভাপতি |
১২ |
শায়খ আলী খাফীফ |
মিসর |
হুকূক কলেজের শরীয়ত বিষয়ক ভূতপূর্ব লেকচারার |
১৩ |
শায়খ আলী আব্দুর রহমান |
সুদান |
ভূতপূর্ব স্বরাষট্র মন্ত্রী |
১৪ |
শায়খ মুহাম্মদ আহমদ আবু যুহরাহ |
মিসর |
হুকূক কলেজের শরীয়ত বিষয়ক ভূতপূর্ব লেকচারার |
১৫ |
শায়খ মুহাম্মদ আহমদ ফারাজ সিনহুরী |
মিসর |
ভূতপূর্ব ওয়াক্ফ মন্ত্রী |
১৬ |
ডক্টর মুহাম্মদ বাহী |
মিসর |
ভূতপূর্ব ওয়াক্ফ মন্ত্রী |
১৭ |
ডক্টর মাহমূদ হিববুল্লাহ |
ইসলামিক স্টাডিজ একাডেমীর সেক্রেটারী জেনেরাল |
|
১৮ |
উস্তাদ মুহাম্মদ খালফুল্লাহ আহমদ |
মিসর |
‘আইন শাম্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য |
১৯ |
মিসর |
||
২০ |
ডক্টর মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আরাবী |
মিসর |
ইন্ষ্টিটিউট অফ ইসলামিক ক্টটাডীর সভাপতি এবং হুকূক কলেজের ভূতপূর্ব লেকচারার |
২১ |
ডক্টর মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ মাযী |
আযহার ইউনিভার্সিটির উপাচায |
|
২২ |
শায়খ মুহাম্মদ আলী সায়েস |
উসূলুদ্দীন কলেজের ভূতপূর্ব উপাচার্য শায়খ মুহাম্মদ ফাযেল বিন আশূর টুনিসিয়া যাইতুনাহ ইউনিভার্সিটির সভাপতি এবং টুনিসিয়ার মুফতী |
|
২৩ |
ডক্টর মুহাম্মদ মাহদী আল্লাম ইউনাইটিড |
মিনিস্ট্রী অফ আরব রিপাবলিক কালচার এ্যান্ড গাইডেন্স-এর (মিসর) টেকনিক্যাল কাউন্সিলার |
|
২৪ |
শায়খ মুহাম্মদ নূরুল হাসান |
আযহার ইউনিভার্সিটির ভূতপূর্ব উপাচার্য |
|
২৫ |
শায়খ নাদীম জিস্র |
লেবানন |
ট্রিপোলী ও উত্তর লেবাননের মুফতী |
২৬ |
উস্তায আফীক কাস্সার |
লেবানন |
হুকূক কলেজের ভূতপূর্ব সভাপতি |
এছাড়া আরো বহুসংখ্যক উলামার নাম সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা সম্ভব হল না।
মিসরের (প্রধান) মূফতী ব্যাংকের সূদ হালাল হওয়ার ব্যাপারে ফতোয়া দিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে আযহার ইউনিভার্সিটির উলামাবৃন্দ মক্কা মুকার্রামায় সমবেত হয়ে একটি জ্ঞানগর্ভ বিবৃতি প্রচার করেন। উক্ত প্রতিবাদে সমর্থক উলামাবৃন্দের ৩৩টি নাম, পেশা ও স্বাক্ষর-সম্বলিত খসড়া মজুদ রয়েছে।
[1] (ফাওয়াএদুল বুনূক হিয়ার রিয়াল হারাম, ডক্টর ইউসুফ কারযাবী)
সূদী ব্যাংকের প্রতিকল্প
পূর্বের পৃষ্ঠাসমূহে ব্যাংকের প্রচলিত নিয়ম-রীতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তার বর্তমান কর্ম- পদ্ধতির ভিত্তিই হল সূদ। এবারে এখানে একটি প্রশ্ন সকলের মনে উঁকি দিতে বাধ্য যে, যদি সূদকে নিশ্চিহ্ন করা হয়, তাহলে ব্যাংকের কার্যাবলী পরিচালনার জন্য বিকল্প পথ কি হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু প্রস্তাব রাখা আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে নাঃ-
১- সূদী ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকল্প কোন ব্যবস্থা খোঁজার অর্থ এই যে, ব্যাংকের যে সমস্ত কার্য বর্তমান বাণিজ্যিক পরিস্থিতিতে জরুরী ও উপকারী তা পরিচালনার জন্য এমন কর্ম-পদ্ধতি অবলম্বন করা হোক, যা শরীয়তের মৌলিক নীতিমালার অনুকূল এবং যাতে শরীয়তের আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন হতে পারে। পক্ষান্তরে যে সব কার্যাবলী শরীয়তের মৌলিক নীতিমালার মাপকাঠিতে জরুরী অথবা উপকারী নয় এবং যে সব কার্যাবলীকে শরীয়তের মৌলিক নীতিমালার ছাঁচে ঢালা সম্ভবপর নয়, তা থেকে দূরে থাকা হোক।
২- যেহেতু সূদের আইনসম্মত বিধিনিষেধের প্রভাব সমগ্র অর্থবন্টন সংক্রান্ত ব্যবস্থার উপরই পড়তে বাধ্য, সেহেতু এ ধরনের আশা করাও ভুল হবে যে, সূদী ব্যবসার শরয়ী প্রতিকল্পকে কার্যকর করা হলে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিবর্গের মুনাফার হার তা-ই থাকবে, যা সূদী ব্যবস্থায় ছিল; বরং বাস্তব তো এই যে, যদি ইসলামী বিধানসমূহকে সঠিক পর্যায়ে কার্যকর করা যায়, তাহলে উক্ত হারে বড় ধরনের এমন মৌলিক পরিবর্তন পরিদৃষ্ট হবে, যা ইসলামী আদর্শ অর্থনীতির জন্য বাঞ্ছিত।
৩- আজকাল ব্যাংক জনসাধারণের যে সকল সেবা করে থাকে, তার মধ্যে একটা দিক খুবই উপকারী; আর তা হল এই যে, ব্যাংক বিভিন্ন সঞ্চয়ীর পৃথক পৃথক বিক্ষিপ্ত সঞ্চিত অর্থকে একত্রে জমা করে বিভিন্ন শিল্পায়ন ও ব্যবসা বাণিজ্যের খাতে ব্যবহার করায় মধ্যস্থতা করে থাকে। এ সমস্ত সঞ্চিত অর্থ যদি প্রত্যেক সঞ্চয়ীর সিন্দুকে পড়ে থাকত, তাহলে তার দ্বারা শিল্প ও ব্যবসার কোন উন্নয়ন প্রকল্পে উপকার লাভ সম্ভব হত না। কিন্তু সেই সঞ্চিত অর্থসমূহকে শিল্প ও বাণিজ্যকর্মে বিনিয়োগ করার যে পথ ও পদ্ধতি প্রচলিত ব্যাংকগুলো অবলম্বন করেছে, তা হল ঋণ দেওয়া-নেওয়ার পদ্ধতি।
তাই এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিপতিদেরকে এই বলে আশ্বাস ও উৎসাহ দান করে থাকে যে, তারা যেন অপরের আর্থিক উপকরণসমূহকে নিজেদের মুনাফা ও স্বার্থে এমনভাবে প্রয়োগ করে, যাতে এ উপকরণসমূহ থেকে সৃষ্ট অর্থের অধিক অংশ তাদের নিজেদের আয়ত্তে থাকে এবং পুঁজির আসল মালিকদের পক্ষে মাথা তুলে দাঁড়াবার যথার্থ সুযোগ লাভ না হয়।
অতএব ইসলামী নির্দেশাবলীর ভিত্তিতে ব্যাংককে এমন একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে; যে বহু সংখ্যক সঞ্চয়ী মানুষদের সঞ্চিত অর্থকে জমা করে প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন কারবারে বিনিয়োগ করবে এবং এ সকল সঞ্চয়ীগণ সরাসরিভাবে এ কারবারের অংশীদার হতে পারবে। তাদের লাভ-নোকসান এ কারবারের লাভ-নোকসানের সঙ্গে জড়িত ও সম্পৃক্ত থাকবে; যে কারবার তাদের সঞ্চিত অর্থ দ্বারা করা হচ্ছে।
৪- বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা কোন জরাজীর্ণ নিয়ম-ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন করে তার পরিবর্তে কোন নতুন নিয়ম-ব্যবস্থা চালু করতে সত্যই বহু সমস্যা ও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তা বলে সেই সমস্যা ও অসুবিধাকে ভিত্তি করে উক্ত নতুন নিয়ম-ব্যবস্থাকে চলার অযোগ্য মনে করা সঠিক নয়।
এমতাবস্থায় আগত সমস্যার বিশেষ সমাধান বের করতে হবে এবং সেই নিয়ম-ব্যবস্থাকেই কার্যকর রাখতে হবে।
ব্যাংকের শরয়ী নিয়ম-পদ্ধতি
ব্যাংকের সম্বন্ধ থাকে দ্বিপাক্ষিক; এক পক্ষের সম্বন্ধ সেই লোকদের সাথে থাকে, যারা নিজেদের টাকা তাতে জমা রাখে। আর দ্বিতীয় পক্ষের সম্বন্ধ সেই লোকেদের সহিত থাকে, যাদের জন্য ব্যাংক পুঁজি সরবরাহ এবং অর্থসংস্থান করে থাকে। এই উভয় প্রকার সম্বন্ধ নিয়ে পৃথক পৃথক আলোচনা করা আবশ্যকঃ
ব্যাংক এবং ডিপোজিটারের সম্বন্ধ
বর্তমান অর্থ-ব্যবস্থায় ব্যাংকে যে অর্থ জমা রাখা হয় তাকে ব্যাংকের পরিভাষায় ‘আমানত’ বলা হয়। কিন্তু ইসলামী ফিকহী দৃষ্টিতে তা হল বাস্তবিক ঋণ। এবারে যদি ব্যাংককে ইসলামী নীতি অনুসারে চালানো যায়, তাহলে আমানতকারীদের সাথে ব্যাংকের সম্পর্ক হবে পার্টনারশিপ অথবা ‘মুযারাবাহ’র। এই নিয়মে জমা রাখা এ অর্থ ঋণ গণ্য হবে না; বরং তার পজিশন এই দাঁড়াবে যে, টাকা জমাকর্তা (আমানতকারী) হবে টাকার মালিক এবং ব্যাংক হবে তার মুযারিব (ব্যবসাকারী)। আর বিনিয়োজিত অর্থ মূলধন হবে; যার উপর ব্যাংক কোন নির্দিষ্ট হারে মুনাফা দিতে বাধ্য থাকবে না। বরং ব্যবসায় যেটুকু পরিমাণেই লাভ অর্জিত হবে, সেইটুকু লাভই পূর্বচুক্তি অনুসারে (যেমন, এক চতুর্থাংশ বা এক তৃতীয়াংশ) হার অনুপাতে উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে।
কারেন্ট একাউন্টের ক্ষেত্রে আজকালের সূদী ব্যাংকগুলোও আমানতকারীকে কোন সূদ আদায় করে না। ইসলামী ব্যাংকেও অনুরূপভাবে এ একাউন্টে রাখা টাকার উপর কোন মুনাফা দেওয়া হবে না। আর আমানতকারীর কারেন্ট একাউন্টে রাখা টাকা ব্যাংকের জন্য বিনা সূদের ঋণ বলে ধরা হবে। তবে অন্যান্য কল্যাণকর আমানত ‘মুযারাবাহ’ অথবা ‘শির্কত’ (পার্টনারশিপ) কারবারে পরিগণিত হবে।
ব্যাংকের পার্টনারশিপ ও মুযারাবাহ কারবারে উপার্জিত মুনাফা ভাগবন্টনের পদ্ধতি এরূপ হবে যে, অংশীদারদিগকে তাদের নিজ নিজ ইচ্ছামত বিশেষ নিয়ম-শৃঙ্খলার ভিত্তিতে ব্যাংকে টাকা রাখার অথবা তা হতে টাকা তোলার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে। কিন্তু যখন শির্কতের একটি নির্ধারিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে, তখন দেখতে হবে যে, সেই সময়ের মধ্যে কত টাকা কত দিন যাবৎ ব্যাংকে ছিল এবং তার প্রত্যেক টাকায় দৈনিকহারে মুনাফার গড় হিসাব কত? অতঃপর যে ব্যক্তির যত টাকা এ নির্ধারিত মেয়াদের যতদিন ব্যাংকে থাকবে, ততদিন হিসাবে সেই ব্যক্তিকে তার লভ্যাংশ প্রদান করা হবে।
অর্থসংস্থানের ইসলামী পদ্ধতি
এবারে ব্যাংকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘ফিন্যানসিং’ বা অর্থসংস্থান করা; অর্থাৎ অপরকে ব্যবসা ইত্যাদির জন্য পুঁজি যোগাড় করে দেওয়ার ইসলামী বিভিন্ন পদ্ধতি প্রসঙ্গে আলোচনায় আসা যাক। শরয়ী দৃষ্টিকোণে এর কতকগুলি পদ্ধতি হতে পারে ঃ-
১- শির্কত ও মুযারাবাহঃ সূদের সঠিক ও বিকল্প ইসলামী ব্যবস্থা হল শির্কত (অংশীদারী হয়ে ব্যবসা) এবং মুযারাবাহ (একজনের পুঁজি ও অপরজনের শ্রম ব্যয়ে ব্যবসা)। এ ধরনের ব্যবসার সুফল সূদী কারবারের তুলনায় বহুগুণে বেশী। আর উক্ত প্রকার ব্যবসায় অংশগ্রহণ করাই হল অর্থসংস্থানের নিতান্ত আদর্শ-ভিত্তিক ন্যায়সংগত ও ইনসাফপূর্ণ পদ্ধতি; যাতে লভ্যাংশ ভাগাভাগির ক্ষেত্রেও বড় সুফল সন্নিবিষ্ট থাকে।
শির্কত ও মুযারাবাহর নিয়ম-ব্যবস্থা জারী হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্ত কারবারে রীতিমত ব্যাংকের কর্তৃত্ব চলবে। অর্থাৎ এক্ষণে তার পজিশন কেবল টাকা জমা রাখা ও তোলার কোন প্রতিষ্ঠানের মতই থাকবে না।
মূলতঃ ইসলামী ফিন্যানসিং পদ্ধতি শির্কত বা মুযারাবাহ হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে মুযারাবাহর রূপ দান করা সম্ভব হয় না। যেমন; কোন এক কৃষককে একটি ট্রাক্টর খরীদ করার জন্য পুঁজির প্রয়োজন হলে তাকে ‘মুযারাবাহ’ রূপে পুঁজি সংস্থান করা সম্ভব নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আরো কয়েকটি ফিন্যানসিং পদ্ধতি নিম্নরূপঃ-
২- ইজারাঃ এটিও একটি শরয়ী ফিন্যানসিং পদ্ধতি; যাকে ইংরাজীতে (LEASING) (লীজ দেওয়া) বলে। এর নিয়ম হল এই যে, কৃষক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নিজে ট্রাক্টর ক্রয় করার পরিবর্তে কোন ব্যাংক অথবা অর্থ প্রতিষ্ঠানকে আবেদন জানাবে, যাতে এ ট্রাক্টর কিনে তাকে ভাড়া দেওয়া হয়।
এ ক্ষেত্রে ট্রাক্টরের মালিক হবে উক্ত ক্রয়কারী ব্যাংক বা অর্থ প্রতিষ্ঠান। আর কৃষক ভাড়াগ্রহণকারী হিসাবে তা গ্রহণ করবে। ভাড়া এমন হারে নির্ধারিত করা হবে, যেন তাতে ট্রাক্টরের দামও অসূল হয়ে যায় এবং ততটা মেয়াদের জন্য উক্ত অংকের অর্থ দ্বারা ব্যাংকের অংশীদারী কারবারে অংশী হলে যে মুনাফা আসত তাও লাভ হয়। যখন নির্দিষ্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে এবং ভাড়া আকারে প্রাপ্ত টাকার মাধ্যমে ট্রাক্টরের মূল্য তথা কিছু লাভও ওসূল হয়ে যাবে, তখন সেই ট্রাক্টরটি এ কৃষকের মালিকানাধীন থেকে যাবে।
৩- বিলম্বিত মুনাফা অর্জনঃ এটি এরূপে হবে যে, যখন কোন ব্যক্তি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আসবে, তখন তাকে কোন্ জিনিস ক্রয় করার জন্য ঋণ নেবে তা প্রশ্ন করা হবে। ব্যাংক তাকে টাকা দেওয়ার পরিবর্তে তার সেই দরকারী জিনিস নিজে ক্রয় করে পুনরায় তাকে লাভ রেখে ধারে বিক্রয় করবে। (সে ব্যক্তি তা সংগ্রহ করে কিস্তিতে টাকা মিটাবে।) লাভের একটি নির্দিষ্ট হার স্থির করে মুনাফালাভ এ জন্যই করা হবে; যাতে নিয়ম-ব্যবস্থায় ভারসাম্য বজায় থাকে এবং সকল শ্রেণীর মানুষের নিকট থেকেই লাভ একই হারে আদায় করা সম্ভব হয়। এই লাভের যে নির্দিষ্ট হার স্থির করা হয় তাকে ইংরাজীতে (MARK UP) (মার্ক আপ) বলা হয়।
এরূপ বিলম্বিত মুনাফা লাভের সাথেও অর্থসংস্থান করা এক প্রকার বৈধ ফিন্যানসিং হতে পারে। তবে এতে শর্ত এই যে, তা যেন সঠিক আকারে জরুরী শর্তাবলী পালনের সাথে ব্যবহার করা হয়। যেহেতু ধারে বিক্রয়ের জন্য দাম বেশী নেওয়া ফকীহগণের নিকট সর্বসম্মতভাবে বৈধ। পরন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলোতেও এই শেষোক্ত পদ্ধতির উপর বড় ব্যাপক আকারে আমল করা হচ্ছে। কিন্তু এটা নেহাতই স্পর্শকাতর পদ্ধতি। কারণ এতে কিঞ্চিৎ পরিমাণের অসাবধানতা একে বৈধ কারবার থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে সূদী কারবারের ভাগাড়ে ফেলে দিতে পারে।
আমার প্রিয় মুসলিম ভাইসকল! সূদী কারবার হল সর্বনাশী ও বিশ্ব বিধ্বংসিতার দুয়ার ও পথ এবং ব্যাংক হল তার আন্তর্জাতিক বাজার। আর এই হল সেই সর্বনাশের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার লক্ষ্যে আমলযোগ্য ইসলামী পদ্ধতি।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا
اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ﴾
অর্থাৎ, ---আল্লাহ তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন তা বিশদভাবে তোমাদের নিকট বিবৃত করেছেন; তবে নিরুপায় অবস্থার কথা স্বতন্ত্র। (সূরা আনআম ১১৯ আয়াত)
যেহেতু আল্লাহ তাআলা তাঁর হারামকৃত জিনিসগুলোকে বিশদ ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন সেহেতু যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা করে সূদ থেকে বাঁচা একজন পাক্কা-সাচ্চা মুসলিমের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। বরং যেখানে সূদের গন্ধ আছে, যে পয়সায় সূদের মিশ্রণ আছে বলে সন্দেহ আছে সেখান ও সে পয়সা হতে দূরে থাকাও তার জন্য জরুরী। কেন না যে ব্যক্তি আল্লাহর (হারাম) সীমারেখার ধারেপাশেই ঘোরাফেরা করে তার জন্য এই আশঙ্কা থাকে যে, কখন যে তার পা পিছল কেটে এ হারাম ও নিষিদ্ধ সীমায় গিয়ে আপতিত হয়ে যাবে, সে তার আদৌ টের পাবে না।
প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আরো একটি ভয় সর্বদা এই রাখা ওয়াজেব যে, যাতে সে নিজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সেই বাণীর মূর্তপ্রতীক না হয়ে যায়, যাতে তিনি বলেছেন,
يَأتِيْ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لاَ
يُبَالِي المَرْءُ فِيهِ بِمَا أَصَابَ مِنَ الْمَالِ أَمِنْ حَلاَلٍ أَمْ مِنْ
حَرَام.
অর্থাৎ, ‘‘মানুষের উপর এমন একটি যুগ (অবশ্যই) আসবে, যখন সে এ কথার কোন পরোয়াই করবে না যে, সে যা গ্রহণ (উপার্জন) করছে তা হালালের শ্রেণীভুক্ত অথবা হারামের।’’ (বুখারী ২০৫৯, ২০৮৩নং)
উপরন্তু এ ভয়েও মুসলিমকে কেঁপে ওঠা দরকার যে, যাতে সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের এই বাণীর মূর্তপ্রতীক না হয়ে যায়, যাতে তিনি বলেছেন,
لَيَشْرَبَنَّ نَاسٌ مِنْ أُمَّتِى
الْخَمْرَ يُسَمُّونَهَا بِغَيْرِ اسْمِهَا.
‘‘আমার উম্মতের একদল লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা অবশ্যই পান করবে।’’ (মুসনাদে আহমদ ৫/৩৪৩, সহীহুল জামে ৫৪৫৩নং)
সুতরাং অনুরূপভাবে সেও সূদের মনোলোভা হালালসূচক নাম ‘লভ্যাংশ, বোনাস বা অনুদান’ দিয়ে তা ভক্ষণ করছে না তো? অথচ খোদ ব্যাংকওয়ালারা তার নাম রেখেছে সূদ বা ইনটারেষ্ট। আর যথার্থতা ও প্রকৃষ্টতা প্রমাণের জন্য দুশমনের সাক্ষ্যই অধিক ফলপ্রসূ।
যারা ব্যাংকের সূদকে হালাল বলে ফতোয়া দেন তাঁদেরকে নিজেদের উক্ত ফতোয়া নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা উচিত। নচেৎ এ রকম তো নয় যে, তাঁরা ইসলামের দুশমনদের সহায়তা এবং আল্লাহ তাআলার উপর মিথ্যা রচনা করেছেন? আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿قُلْ أَرَأَيْتُمْ مَا أَنْزَلَ اللهُ لَكُمْ مِنْ رِزْقٍ
فَجَعَلْتُمْ مِنْهُ حَرَاماً وَحَلالاً قُلْ آللهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَى
اللهِ تَفْتَرُونَ﴾
অর্থাৎ, (হে নবী! তুমি) বল, ‘কি রায় তোমাদের, আল্লাহ তোমাদেরকে যে রুজী দান করেছেন তোমরা যে তার কিছুকে অবৈধ ও বৈধ করে নিয়েছ’; বল, ‘আল্লাহ কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন; নাকি তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছ?’ (সূরা ইউনুস ৫৯ আয়াত) তিনি আরো বলেন:
﴿وَلا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ
أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللهِ
الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللهِ الْكَذِبَ لا يُفْلِحُونَ﴾
অর্থাৎ, তোমাদের মুখ থেকে সাধারণতঃ মিথ্যা বের হয়ে আসে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে বলো না যে, ‘এটা হালাল আর এটা হারাম।’ নিশ্চয় যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তারা সফলকাম হবে না। (সূরা নাহ্ল ১১৬ আয়াত)
অথবা তাঁরা এ কথার বাস্তব নমুনা তো নন, যে কথা আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) আব্দুল্লাহ বিন আববাসকে (রাঃ) বলেছিলেন, ‘হে ইবনে আববাস! আর কতদিন যাবৎ লোকদেরকে সূদ খাওয়াতে থাকবেন? শুধু আপনি কি আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সাহচর্য পেয়েছেন, আর আমরা পাইনি? শুধু আপনিই কি রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন, আর আমরা শুনিনি?’ এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন আববাস বললেন, ‘আপনি যা ভাবছেন তা নয়; বরং উসামা বিন যায়েদ আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘‘সূদ তো কেবল ঋণেই পাওয়া যায়।’’ তা শুনে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বললেন,
والله لا آواني وإياك ظل بيت ما دمت على
هذا القول.
অর্থাৎ, আল্লাহর কসম! ততদিন পর্যন্ত কোন গৃহের ছায়া আমাদেরকে আশ্রয় দেবে না, যতদিন পর্যন্ত আপনি উক্ত ফতোয়ার উপর অটল থাকবেন! (অর্থাৎ, ততদিন আমি আপনার সহিত দেখা-সাক্ষাৎ করব না।) (দেখুন, আল মাবসূত্ব, সারখাসী ২/১১১-১১২, মাওয়াক্বিফুশ্ শারীআতি মিনাল মাসারিফিল ইসলামিয়্যাতিল মুআসিরাহ)
আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) এর ফতোয়া ছিল যে, কেবল ঋণের কারবারেই সূদ পাওয়া যায় এবং একই শ্রেণীভুক্ত দুটি জিনিসের কম বেশী করে হাতেহাতে লেন-দেনে সূদ হয় না। যেমন, সোনার পরিবর্তে সোনা বেশী (হাতেহাতে) নেওয়া বৈধ । অথচ তা উবাদা বিন সামেত (রাঃ) এর হাদীসের স্পষ্ট উক্তি অনুসারে হারাম ও সূদ। অবশ্য পরবর্তীকালে আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) এই হাদীস শুনে তাঁর উক্ত ফতোয়া দান করা হতে বিরত হয়েছিলেন। (দেখুন, মুগনী, ইবনে কুদামাহ ৪/৩)
আমার প্রিয় মুমিন ভাই! যদি আমাদের কেউ না জানার কারণে অথবা কোন শয়তানী চক্রান্তে পড়ে অথবা মনের কুপ্রবৃত্তিবশে অথবা কারো ফতোয়ায় ধোঁকা খেয়ে ব্যাংক থেকে সূদ নিয়ে তা ব্যবহার করে ফেলেছে, কিংবা (বিকল্প উপায় থাকা সত্ত্বেও) ব্যাংক থেকে লোন বা ঋণ নিয়ে তাকে সূদ প্রদান করেছে, তাহলে তার অপরিহার্য কর্তব্য হল সত্বর তওবা করা এবং এই সংকল্প করা যে, আমরা আর সূদ নেওয়া ও দেওয়ার মত বড় গোনাহতে নির্বিচল থাকব না। বরং সেই সকল লোকেদের দলভুক্ত হতে যথাসাধ্য প্রয়াস করব, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ
ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا
اللهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ (135) أُولَئِكَ
جَزَاؤُهُمْ مَغْفِرَةٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا
الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِين﴾
অর্থাৎ, (তারা মুত্তাকীন) যারা কখনও কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর যুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনেশুনে তাই (বারবার) করতে থাকে না। তাদেরই জন্য প্রতিদান হল তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত; যার তলদেশে প্রবাহিত আছে বিভিন্ন প্রস্রবণ---সেখানে তারা অনন্তকাল বাস করবে। আর যারা সৎকর্ম করে তাদের জন্যে কতই না চমৎকার প্রতিদান! (সূরা আ-লি ইমরান ১৩৫-১৩৬ আয়াত)
সুতরাং আমরা আল্লাহর নিকট নিজ কৃতপাপের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হব। আল্লাহ অবশ্যই নিতান্ত ক্ষমাশীল, পরম করুণাময় ও দয়াবান। তাঁর নিকট কোন সংকীর্ণতা নেই। তিনি তো আমাদেরকে পাপমুক্ত করতে চান। অতএব যতশীঘ্র সম্ভব তত শীঘ্রই আমাদেরকে গোনাহ থেকে পবিত্র হওয়ার উপায় অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿مَا يُرِيدُ اللهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ وَلَكِنْ
يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾
অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না। বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান ও তোমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর। (সূরা মায়েদাহ ৬ আয়াত) তিনি আরো বলেন,
﴿أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَن
تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ﴾
অর্থাৎ, ঈমানদার ব্যক্তিবর্গের জন্য এখনো কি সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণ ও সত্য অবতীর্ণ হওয়ার ফলে তাদের হৃদয় বিগলিত হয়ে উঠবে?[1]
[1]
(সূরা আল-হাদীদ ১৬ আয়াত)
সূদের ঘূর্ণাবর্ত থেকে বাঁচার উপায়
আমার প্রিয় ভাই! এখন আপনাকে সেই উপায় ও পথের সন্ধান বলে দিই, যা অবলম্বন করলে আপনি সূদের বিপদজনক ঘূর্ণাবর্ত থেকে উদ্ধার পেতে সক্ষম হবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ও আপনাকে সেই তওফীকই দান করুন এবং তাঁর শরীয়ত অনুযায়ী আমল করাকে আমাদের পক্ষে সহজ করে দিন। আমীন।
No comments