ব্যাংকের সুদ কি হালাল - অনুচ্ছেদ ৩১ থেকে ৪০ পর্যন্ত, শাইখ মোস্তাক আহমাদ কারীমী
ব্যাংকের ধ্বংসকারিতা
ব্যাংকের আলোচনা প্রসঙ্গে মওলানা মওদূদী (রঃ) লিখেছেন, ‘‘এভাবে পুঁজিপতিদের সংগঠন কায়েম হওয়ার পর প্রথম যুগের একক ও বিক্ষিপ্ত মহাজনদের তুলনায় বর্তমানের একত্রীভূত ও সংগঠিত পুঁজিপতিদের মর্যাদা, প্রভাব ও অবস্থা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে এবং এর ফলে সারা দেশের ধন-সম্পদ তাদের নিকট কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে।
আজকের দিনে এক একটি ব্যাংকে শত শত কোটি টাকা জমা হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রভাবশালী পুঁজিপতি এগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এ পদ্ধতিতে তারা কেবল নিজের দেশের নয় বরং সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক, তমদ্দুনিক ও রাজনৈতিক জীবনের উপর চরম স্বার্থান্ধতা সহকারে কর্তৃত্ব করতে থাকে।এদের শক্তিমত্তা আন্দাজ করার জন্য কেবল এতটুকুই বলা যথেষ্ট যে, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পূর্বে ভারতের বড় বড় ব্যাংকগুলোর অংশীদারদের সংগৃহীত পুঁজির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৭ কোটি টাকা, কিন্তু আমানতকারীদের গচ্ছিত পুঁজির পরিমাণ ৬১২ কোটি টাকায় পৌঁছে গিয়ে ছিল। এ ব্যাংকগুলোর সমগ্র শাসন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল বড়জোর দেড়-দু’শ পুঁজিপতির হাতে। কিন্তু একমাত্র সূদের লোভে দেশের লাখো লাখো লোক এ বিপুল পরিমাণ অর্থ তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল এবং এ শক্তিশালী অস্ত্র তারা কখন কোথায় কিভাবে ব্যবহার করে, সে ব্যাপারে কারোর কোনো চিন্তাই ছিল না। যে কোন ব্যক্তি অনুমান করতে পারে, যে সব পুঁজিপতির হাতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হয়ে গেছে তারা দেশের শিল্প, ব্যবসায়, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি-সভ্যতার উপর কত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। এ প্রভাব দেশ ও দেশবাশীর স্বার্থে কাজ করছে, না এ সব স্বার্থান্ধ পুঁজিপতিদের নিজেদের স্বার্থোদ্ধারে ব্যয়িত হচ্ছে তাও সহজেই অনুমান করা যায়।
এ পর্যন্ত এমন এক দেশের অবস্থা বর্ণনা করলাম যেখানে পুঁজিপতিদের সংগঠন এখনো সম্পূর্ণ প্রাথমিক পর্যায়ে অবস্থান করছে এবং ব্যাংকগুলোর মোট আমানত সমস্ত জনসংখার মাথাপিছু মাত্র ৭ টাকা করে পড়ে। এখন এই প্রেক্ষিতে অন্যান্য দেশের কথা চিন্তা করুন, যেখানে এ হার মাথাপিছু হাজার দু’হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। চিন্তা করুন সেখানে পুঁজি কেন্দ্রীয়করণের কি অবস্থা। ১৯৩৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেবলমাত্র ব্যবসায়িক ব্যাংকগুলোর আমানতের হার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু ১৩১৭ পাউন্ড, ইংল্যান্ডে ১৬৬৪ পাউন্ড, সুইজারল্যান্ডে ২৭৫ পাউন্ড, জার্মানীতে ২১২ পাউন্ড ও ফ্রান্সে ১৬৫ পাউন্ড ছিল। এ দেশগুলোর অধিবাসীরা এত ব্যাপক হারে ও বিপুল পরিমাণে নিজেদের অতিরিক্ত আয় ও সঞ্চিত পুঁজি তাদের পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছিল। প্রতিটি গৃহ থেকে সংগৃহীত এ বিপুল পরিমাণ অর্থ মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকটি হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। যাদের নিকট এগুলো কেন্দ্রীভূত হচ্ছে তাদেরকে কারোর নিকট জবাবদিহি করতে হয় না, নিজেদের প্রবৃত্তি ছাড়া অন্য কারোর নির্দেশও তারা গ্রহণ করে না এবং নিজেদের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোন দিকে তাদের দৃষ্টিও নেই। তারা কেবলমাত্র সামান্য সূদের আকারে এ বিরাট-বিশাল ধনাগারে ‘ভাড়া’ আদায় করে যাচ্ছে এবং বাস্তবে তারাই এর মালিকে পরিণত হচ্ছে। অতঃপর এ শক্তির জোরে তারা বিভিন্ন দেশের ও জাতির ভাগ্য নিয়ে খেলা করে; তারা ইচ্ছামত যে কোন দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে, তারা ইচ্ছামত দু’ দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধায়, আবার ইচ্ছামত যে কোন সময় সন্ধি স্থাপন করায়। নিজেদের অর্থ-লিপ্সার দৃষ্টিতে যে জিনিসটিকে তারা বাঞ্ছনীয় মনে করে তার প্রচলন বাড়ায় ও বিকাশ সাধন করে, আবার যেটিকে অবাঞ্ছনীয় মনে করে তার বিকাশ লাভের সমস্ত পথই বন্ধ করে দেয়। তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কেবল বাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মচর্চা কেন্দ্র ও রাষ্ট্রীয় পার্লামেন্ট--সর্বত্রই তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। কারণ দেশের ও জাতির সমুদয় অর্থ তাদের ‘পায়ের ভৃত্যে’ পরিণত হয়েছে।
এ মহা বিপর্যয়ের ধ্বংসলীলা দেখে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণই শিউরে উঠেছেন। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চ কলরোল ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে; একটি অতি ক্ষুদ্র দায়িত্বহীন স্বার্থান্ধ শ্রেণীর হাতে ধনের এ বিপুল শক্তি কেন্দ্রীভূত হওয়া সমগ্র সমাজ ও জাতীয় জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো বলা হচ্ছে, সূদের কারবার তো ছিল পুরনো আমলের আড়তদার মহাজনদের অপবিত্র ও হারাম কারবার। আজকের যুগের উন্নত রুচিশীল ও সুসভ্য ব্যাংকারগণ অত্যন্ত পূত-পবিত্র কারবার করছেন। তাদের ব্যবসায়ে অর্থ খাটানো এবং তা থেকে নিজের অংশ নেয়া হারাম হবে কেন? অথচ পুরনো মহাজন ও আজকের এ ব্যাংকারদের মধ্যে যদি সত্যিই কোনো পার্থক্য সূচিত হয়ে থাকে, তাহলে তা কেবল এতটুকু যে, তারা একা একা ডাকাতি করতো আর এরা দলবল জুটিয়ে, ডাকাতদের বড় বড় দল গঠন করে, দলবদ্ধভাবে ডাকাতি করছে। এদের মধ্যে দ্বিতীয় পার্থক্যটি হচ্ছে পুরনো ডাকাতদের প্রত্যেকেই দরজা ও দেওয়াল ভাঙার যন্ত্রপাতি এবং মানুষ মারার অস্ত্রশস্ত্র নিজেরাই আনতো, কিন্তু আজ সমগ্র দেশবাসী নিজেদের নির্বুদ্ধিতা, মূর্খতা ও আইনের শৈথিল্যের কারণে অসংখ্য যন্ত্র ও অস্ত্র তৈরী করে ‘সামান্য ভাড়ায়’ সংঘবদ্ধ ডাকাতদের হাতে তুলে দিচ্ছে। দিনের বেলায় তারা জনগণকে ‘ভাড়া’ আদায় করে আর রাতের আঁধারে এ জনগণের উপর তাদের প্রদত্ত যন্ত্র ও অস্ত্রের সাহায্যে ডাকাতি করে।
এহেন ‘ভাড়া’কে হালাল ও পবিত্র গণ্য করার জন্য আমাকে বলা হচ্ছে।’’[1]
[1]
(সূদ ও আধুনিক ব্যাংকিং ৮১ - ৮৩ পৃষ্ঠা)
ব্যাংকের বৈধ কার্যাবলী
ব্যাংক প্রসঙ্গে যে সমালোচনা করা হল তার অর্থ এই নয় যে, ব্যাংকের সারা কাজ-কারবারই ভুল, নাজায়েয ও হারাম এবং এর সহিত কোন প্রকারেরই লেনদেন বৈধ হতে পারে না। কারণ ব্যাংক অনেক এমন কল্যাণকর ও বৈধ কর্মও সম্পাদন করে থাকে, যা বর্তমান যুগের কৃষ্টিময় জীবন এবং লেনদেন ও ব্যবসায় সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রয়োজনের ক্ষেত্রে উপকারী বটে এবং জরুরীও। বস্ত্ততঃ ব্যাংকও আধুনিক সভ্যতার আলোকে গড়ে উঠা বহু জিনিসের মতই এমন এক উপকারী জিনিস যাকে শুধুমাত্র একটি শয়তানী উপাদান (সূদ) এর মিশ্রণ নোংরা করে রেখেছে।
এ ব্যাপারে ব্যাংক যে সকল বৈধ খিদমত আঞ্জাম দেয় তা সংক্ষেপে বর্ণনা করি-
১- এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা স্থানান্তর করা, অনুরূপ এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে টাকা ট্রান্সফার করা। অবশ্য এর বিনিময়ে ব্যাংক সামান্য ফী গ্রহণ করে থাকে। যা ভাড়া বা মজুরীর পর্যায়ভুক্ত, আর তা দেওয়া-নেওয়া নিশ্চয়ই বৈধ।
২- ট্রাভেল চেক (TRAVEL CHEQUE) জারী করাঃ- যে ব্যক্তি এক রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন রাষ্ট্রে সফর বা ভ্রমণ করে তার এ রাষ্ট্রে অর্থের প্রয়োজন অবশ্যই পড়ে। এ ক্ষেত্রে সে ব্যাংকে নগদ টাকা জমা করে ট্রাভেল চেক সংগ্রহ করে; যা সে যে কোন জায়গায় ভাঙ্গিয়ে (যত টাকা জমা দিয়েছিল) তত টাকাই গ্রহণ করতে পারে। আর এ পদ্ধতি নিঃসন্দেহে নিজের সাথে নগদ টাকা নিয়ে বেড়ানোর চাইতে অধিকতর সহজ এবং নিরাপত্তামূলক।
৩- আয়রন-চেষ্ট বা লক ভাড়া দেওয়াঃ- যদি কোন ব্যক্তি (নিরাপদ) আয়রন-চেষ্ট বা লকে টাকা পয়সা অথবা সোনা-দানা রাখতে চায়, তাহলে সে তা ব্যাংক থেকে ভাড়া নিতে পারে।
৪- কোম্পানীর শেয়ার বিক্রয় করাঃ- কোম্পানী চাইলে ব্যাংক কোম্পানীর নিকট মজুরী নিয়ে তার শেয়ার বিক্রয় করে দেয়।
৫- বৈদেশিক লেন-দেন (বা আমদানী ও রফতানী) সংক্রান্ত সুবিধাজনক ও সহজভাবে পারস্পরিক সরবরাহ করাঃ- ব্যাংকের এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেবা। উক্ত বিনিময় সুবিধার মাধ্যমে ব্যাংক বহির্দেশের সাথে (ক্রয়-বিক্রয় বা আমদানী-রপ্তানী ইত্যাদি) আদান-প্রদানকারীদেরকে বহু প্রকার অসুবিধা, হয়রানি ও কষ্ট থেকে অব্যাহতি ও আরাম প্রদান করে। যেমন, ব্যাংক তাদের তরফ থেকে মূল্য আদায় করে, পণ্য-রফতানীর কাগজাদির দায়িত্ব নিজে বহন করে। আর এসব কর্ম ব্যাংক কিঞ্চিৎ মজুরীর বিনিময়ে সম্পাদন করে থাকে। যা দেওয়া নেওয়া বৈধ।
৬- ঋণ আদায় করাঃ- এই ঋণ আদায় করার নিয়ম এই যে, ঋণদাতা লোকেরা ব্যাংকের নিকট তাদের কাগজ-পত্র জমা করে এবং তার উপর স্বাক্ষর করে ব্যাংককে সোপর্দ করে দেয়। যাতে ব্যাংক নিজের মজুরী নিয়ে তাদের ঋণ আদায় করে দেয়। (আল মুআমালাতুল মাসরাফিয়্যাহ ৩৮-৩৯ পৃঃ)
৭- আকলপত্র (LETTERS OF CREDIT) খোলা। বিনা সূদে এল সি খোলার উপর ব্যাংক যে ফী নেয় তা বৈধ।
ব্যাংকের সূদকে হালালকারীদের বিভিন্ন দলীল ও তার জবাব
কতক লোক বড় জোরশোর করে এই আওয়াজ তুলছে যে, সাম্প্রতিক কালে সূদ ব্যাপক বিপত্তির আকার ধারণ করেছে, (যা থেকে বাঁচা কঠিন।) আর এ কথাও বারংবার আওড়ানো হয়ে থাকে যে, সূদ অর্থনীতির বিভিন্ন বুনিয়াদের মধ্যে একটি শক্তিশালী বুনিয়াদরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কেননা সমস্ত রকমের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কোম্পানীই সূদী কারবার করে থাকে; যার প্রতি উম্মাহ ও জাতি একান্ত মুখাপেক্ষী। আর ব্যাংকের সাথে বিভিন্ন কারবার ও লেন-দেন না করা জাতির স্বার্থের প্রতিকূল। কারণ এমন লেনদেন একান্ত জরুরী ও অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়ে পড়েছে। তাই মুসলমান যদি ব্যাংক থেকে দূরে থাকে, তাহলে আর্থিক দিক দিয়ে তারা চরম অবনতির শিকার হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে অন্যান্য জাতি তাদের চাইতে বহু আগে উন্নতির শিখরে অবস্থান করবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার ভিত্তিতে উক্ত ধরনের লোভ ও লোলুপতার শিকার হয়ে অনেকে ব্যাংকের সূদকে জায়েয ও হালাল প্রতিপন্ন করার প্রয়াস করে থাকেন। এ জন্যই তাঁরা ভুল, বিভ্রান্তিকর, অসঙ্গত এবং অযথা দলীল উপস্থাপন তথা ভুয়া যুক্তি ও অযথার্থ কিয়াস পেশ করেন।
আসুন, এখানে আমরা তাঁদের এ দলীলসমূহকে পরখ ও বিবেচনা করে দেখি, যা প্রকৃতপক্ষে (ব্যাংকের সূদ হালালের) দলীলই নয়; বরং তা (দলীল বলে) এক প্রকার ভুল ধারণা ও সন্দেহ। আমরা তাঁদের সন্দিগ্ধ দলীলসমূহ ও ভ্রম ধারণাগুলোকে এক এক করে পেশ করে তার প্রকৃতত্ব, যথার্থতা ও রহস্য উদ্ঘাটন করছি।
১- ব্যবসায় উভয়পক্ষের সম্মতি এবং ব্যাংকের সূদ
আল্লাহ বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا
تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً
عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ﴾
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অন্যের ধন-সম্পত্তি অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না; তবে তোমাদের পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসা করে খেতে পার।[1]
উক্ত আয়াতের ভিত্তিতে ব্যাংকের সূদকে অনেকে হালাল বলে প্রতিপাদিত করতে অপচেষ্টা করেছেন। কারণ ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষের সম্মতি থাকে, তাতে কেউ কাউকে শোষণও করে না এবং কেউ কারো উপায়হীন অবস্থাকে তার লাভের সুবর্ণ সুযোগরূপে ব্যবহারও করে না।
এটা একটি সন্দেহ ও ভ্রম ধারণা মাত্র; যাতে ব্যাংকের সূদ হালালকারীদল জড়িত হয়ে পড়েছেন। নচেৎ প্রত্যেক মানুষই জানে যে, সাধারণ সম্মতি কোনও (হারাম) জিনিসকে হালাল করে দেয় না; বরং সেই সম্মতিই হালাল করতে পারে, যে সম্মতির সাথে ইলাহী নির্দেশ বা শরীয়তের কোনও নির্দেশ তার পরিপন্থী না হয়। যেমন একটি যুবক ও একটি যুবতী যদি যৌনক্রিয়ায় সম্মতি প্রকাশ করে এবং কেউ কাউকে সে কাজে বাধ্য না করে, তাহলে উভয়ের সম্মতির দরুন কি উভয়ের যৌনক্রিয়া (ব্যভিচার) বৈধ হয়ে যাবে? একটি সামান্য জ্ঞানের মানুষও অবশ্যই বলবে যে, উভয়ে রাজি হয়ে গেলেই ব্যভিচার বৈধ ও জায়েয হতে পারে না। অনুরূপভাবে যদি ব্যাংক ও আমানতকারী (টাকা জমাকর্তা) সূদ নেওয়া-দেওয়ার উপর রাজি ও সম্মত হয়ে যায়, তবুও উভয় পক্ষের উক্ত সম্মতিক্রমে সূদ হালাল হতে পারে না; বরং ব্যাংক যদি জমাকর্তাকে সূদ নিতে বাধ্য করে, তাহলেও সূদ হারামই থাকবে; হালাল হয়ে যাবে না। কারণ সম্মতি ও খুশীর সাথে নেওয়া হোক অথবা চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে নেওয়া হোক---উভয় অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলা সূদকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছেন।
[1]
(সূরা নিসা ২৯ আয়াত)
২- ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও ব্যাংকের সূদ
ব্যাংকের সূদকে হালালকারিগণ এই বলেন যে, কুরআন ও হাদীসে যে সূদকে হারাম বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা হল সেই ঋণের উপর সূদ--যা মানুষ তার ব্যক্তিগত অভাব ও প্রয়োজন দূরীকরণের উদ্দেশ্যে (ঋণ) গ্রহণ করে থাকে। অর্থাৎ নিজের প্রয়োজন মিটানো বা ক্ষুন্নিবারণের উদ্দেশ্যে অথবা ছেলে-মেয়ের বিবাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঋণ করে যে সূদ দিতে হয়, সেই সূদই ঋণদাতার পক্ষে হারাম। কারণ এতে গরীব শোষণ হয় এবং অভাবীর অভাবকে অর্থকরী সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আর সূদখোর বলে, ‘যদি তুমি একশ টাকায় মাসে ১০ টাকা হারে সূদ দাও তাহলে আমি ঋণ দেব।’ পরন্তু অভাবী মানুষ বাধ্য হয়েই সেই চুক্তিতেই ঋণ গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়, তার সূদ হারামের আওতাভুক্ত নয়। কারণ এ ক্ষেত্রে অভাবী বা গরীব শোষণ হয় না। বরং উভয় পক্ষই এ ঋণে লাভবান হয়।
ডক্টর নূরুদ্দীন ইত্র লিখেছেন, সাম্প্রতিককালে কোন কোন ব্যক্তি বলে থাকেন যে, কুরআন শুধু মাত্র সেই ঋণভিত্তিক সূদকে হারাম ঘোষণা করেছে যা একজন অভাবী ও উপায়হীন মানুষ ঋণের উপর আদায় করতে বাধ্য হয়। যাকে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীর ঋণভিত্তিক সূদকে হারাম করা হয়নি; যা মুনাফা কামানোর উদ্দেশ্যে গৃহীত ঋণের উপর আদায় করা হয়; যাকে বাণিজ্যিক ঋণ বলে আখ্যায়ন করা হয়। (এবং কুরআন অবতীর্ণকালে এরূপ বাণিজ্যিক সূদ প্রচলিত ছিল না।)
বলা বাহুল্য, এটি (সূদ হারামের) আয়াতের তফসীরে একটি অভিনব রায়। এই রায় পোষণ করে ওঁরা কুরআন মাজীদের স্পষ্ট উক্তিকে অকেজো ও বেকার করে ছেড়েছেন! উপরন্তু ১৪ শতাব্দী ধরে উলামায়ে তফসীর, উলামায়ে ফিক্হ, উলামায়ে লুগাহ (আরবী ভাষাবিদগণ) তথা ইসলামের ঈমামগণ উক্ত আয়াতের যে মমার্থ উপলব্ধি করেছেন, ওঁরা তার বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু আমরা ওঁদেরকে চ্যালেঞ্জ করে দাবী করছি যে, ওঁরা পূর্ব অথবা পরবর্তী উলামাদের কারো একটি উক্তি, নতুবা কমপক্ষে তার কাছাকাছি কোন ইঙ্গিত, অথবা নিম্নমানের কোন আলেমেরই কোন উক্তি তাঁদের এ অভিমতের সমর্থনে পেশ করুন।[1]
হ্যাঁ; চৌদ্দ শত বছর অতিবাহিত হল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন আলেম ফকীহ বা ইমাম এ কথা বলে যান নি (যে, বাণিজ্যি-ভিত্তিক ঋণের সূদ উক্ত হারামের আওতাভুক্ত নয়)। যখন থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করে রাজত্ব শুরু করেছে, তখন থেকে এ কথা বলা শুরু হয়েছে। অথচ এই নতুন অপব্যাখ্যায় কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট উক্তিসমূহকে বিনা দলীলে নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সঠিক ইতিহাস উক্ত অপব্যাখ্যার খন্ডন করে। কারণ জাহেলিয়াতের যুগে যে সূদ প্রচলিত ছিল তা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অভাবপূরণের উদ্দেশ্যে গৃহীত এমন ঋণভিত্তিক সূদ ছিল না; যা সে যুগের লোকেরা নিজেদের পানাহার বা ব্যক্তিগত অভাবপূরণের উদ্দেশ্যে গ্রহণ করত এবং তার উপর সূদ আদায় করত। এ কাজ আরবদের সাধারণ প্রকৃতির পরিপন্থী ছিল। হ্যাঁ, সে যুগে এ ধরনের সূদী ঋণ যদিও প্রচলিত ছিল; তবে তা ছিল বিরল ঘটনা। বস্ত্ততঃ সে যুগে যে সূদ বহুল প্রচলিত ছিল, তা হল সেই বণিক্দের সূদ; যারা কুরআন মাজীদের বিবৃতি অনুযায়ী একবার শীতকালে এবং অন্যবার গ্রীষ্মকালে বাণিজ্যিক কাফেলারূপে বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করত। (সূরা কুরাইশ দ্রষ্টব্য) লোকেরা ধনবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে অংশীদারী বা পার্টনারশিপ হিসাবে এ সকল কাফেলাকে নিজেদের অর্থ ব্যবসায় লাগাতে দিত। অথবা তাদেরকে ঋণ স্বরূপ অর্থ প্রদান করত এবং তার মুনাফা পূর্ব থেকেই নির্ধারিত করে নেওয়া হত; যার অপর নাম ছিল সূদ। এই শ্রেণীর সূদ ছিল নবী করীম (সাঃ)-এর চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব রাযিয়াল্লাহু আন্হুর। যা তিনি বিদায়ী হজ্জের সময় বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন। কোনও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি এ কথা কল্পনাও করতে পারে না যে, আববাস (রাঃ); যিনি জাহেলিয়াত যুগে নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত অর্থ দ্বারা হাজীদেরকে পানি পান করাতেন, তিনি লোভাতুর ইয়াহুদীদের মত ব্যবহার প্রদর্শন করতেন এবং কোন ব্যক্তি তার নিজের ব্যক্তিগত অভাব অনটনের ফলে তাঁর নিকট ঋণ চাইতে এলে তিনি তাকে বলতেন, ‘আমি সূদ ছাড়া তোমাকে ঋণ দিতে পারব না।’
যদি এ কথা তর্কছলে মেনেও নেওয়া হয় যে, আল্লাহ এবং তদীয় রসূলের হারামকৃত সূদ কেবলমাত্র ব্যক্তিক অথবা পারিবারিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণভিত্তিক সূদই ছিল; যেমন আধুনিককালের কতক দাবীদারের দাবী, তাহলে সূদদাতাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের অভিশাপ দেওয়ার কারণ কি হতে পারে? আর এ কথা কি কল্পনাও করা যেতে পারে যে, একজন অনাহারক্লিষ্ট উপায়হীন অসহায় মানুষ যখন নিজের তথা নিজের ক্ষুধার্ত সন্তান-সন্ততির অন্নসংস্থানের উদ্দেশ্যে কারো নিকট ঋণ করে এবং সে তার উপর সূদ প্রদান করে, তখন তাকেও আল্লাহর প্রিয়তম নবী (সাঃ) অভিশাপ দেবেন? বরং এ ধরনের উপায়হীন প্রয়োজনে তো আল্লাহ এবং তদীয় রসূল (সাঃ) হারামকৃত মৃত জন্তু, রক্ত এবং শুকরের গোশত খাওয়াকেও বৈধ ঘোষণা করেছেন; আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلا
عَادٍ فَلا إِثْمَ عَلَيْهِ﴾
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি (মৃতজন্তু, শুকরের গোশত ইত্যাদি হারামকৃত বস্ত্ত ভক্ষণ করতে) অনন্যোপায় অথচ অন্যায়কারী কিংবা সীমালংঘনকারী নয়, তার কোন পাপ হবে না।[2]
পক্ষান্তরে এ কথাও প্রকৃত বাস্তব থেকে বহু ক্রোশ দূরে যে, ব্যাংক প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন শিল্প, বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগমূলক কর্মে অর্থ লাগিয়ে তা থেকে মুনাফা অর্জন করে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ব্যাংকসমূহের বাজেট ও কার্য-বিবরণী সংক্রান্ত আলোচনা পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন যে, ব্যাংক মৌলিকভাবে কেবলমাত্র ঋণদানের কাজ করে থাকে। এর মূল কারবার ক্রয়-বিক্রয়, কৃষিকার্য, শিল্পায়ন, ব্রিজ ও অট্টালিকা নির্মাণ প্রভৃতি নয়। একে সংক্ষিপ্ত ভাষায় এও বলতে পারেন যে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আসল কারবার হল, যায়দ, উমার, বকরের নিকট থেকে স্বল্প (প্রায় ৮ শতাংশ) হারে সূদের উপর ঋণ নিয়ে অপরকে অধিক (প্রায় ১৫ শতাংশ) হারে ঋণ প্রদান করা। আর এ দুই হারের মধ্যবর্তী অবশিষ্ট অংশ (প্রায় ৭ শতাংশ) ব্যাংকের মুনাফা। এটাই হল ব্যাংকের আসল কারবার এবং মৌলিক বৃত্তি। এইভাবেই ব্যাংক বড় আকারের চক্রবৃদ্ধিহারে সূদী কারবার করে থাকে, যা জাহেলিয়াত যুগের ছোট ছোট মহাজনরা করত। এ কথাও বলা যায় যে, ব্যাংক হল সূদের এজেন্ট ও দালাল; যে সূদ দেয় এবং নেয়ও।
আর এই ধারণাও নিশ্চিতভাবে সঠিক নয় যে, ব্যাংক কখনোই নোকসান ও ক্ষতির শিকার হয় না; বরং সর্বদাই ব্যাংক লাভ অর্জনই করে থাকে। আমরা সংবাদপত্রে কত দেশের ব্যাংকের ব্যাপারে পড়েছি যে, তা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। সেই আমেরিকা যাকে ব্যাংক ও পুঁজিপতিদের দেশ বলা হয়, শুধুমাত্র সেখানেই ১৯৮৭ সালে ১৪৭টি ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার খবর সংবাদ-পত্রে প্রকাশ হয়। পুনরায় ঠিক তার পরবর্তী ২ বছরেও প্রায় অতগুলো ব্যাংকেরই দেউলিয়া হয়ে পড়ার কথা খবরের কাগজে বের হয়। [3]
পরন্তু যদি আমরা এ কথা মেনে নিই যে, ব্যাংকের কোন প্রকার নোকসান ও ক্ষতিই হয় না---যেমন আমাদের কতিপয় ভাই বলে থাকেন- তাহলে ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রেও কি তাঁরা এ একই কথা বলবেন যে, তাদেরও কোন প্রকার নোকসান হয় না? (সর্বদা লাভই হয়?) সুতরাং যদি ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতাদের নোকসান হয়---যেমন বাস্তব অভিজ্ঞতা তার সাক্ষী---তাহলে তারা একাকী কেন নোকসান বহন করবে এবং ব্যাংক সর্বক্ষেত্রে কেবল লাভ অর্জন করবে? এটা কি ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতা? বিবেক কি এমন একতরফা বিচারকে বৈধ ও সঠিক বলে মেনে নিতে পারে? আমরা যদি কেবল ঋণের বিপত্তির দিকে লক্ষ্য করি তাহলে এ ব্যাপারে বিভিষিকাময় দৃশ্য আমাদের দৃষ্টিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে। যে ঋণ তৃতীয় বিশ্বের কোমর ভেঙ্গে পঙ্গু অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এমন কি কেবল মিসরের মত একটি দেশের ঋণ চার হাজার চার শ’ (৪৪০০০,০০০,০০০) কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে! যার সূদ ১০% হারে ধরা হলে চার শ’ চল্লিশ কোটি ডলার হয়। অথচ কিছু ঋণের সূদ ১০% থেকেও বেশী। যে ঋণ পরিশোধ করতে মিসর অক্ষম।
এই প্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ঋণের ডিউটি আদায়; অর্থাৎ আসল কিস্তী সহ অতিরিক্ত বার্ষিক সূদের টাকা পরিশোধ করা। আর এই ভয়াবহ পরিস্থিতিই বড় বড় শক্তিশালী বহু দেশেরই মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। সুতরাং ভারত-পাকিস্তানের মত উন্নয়নশীল দেশের কি অবস্থা তা অনুমেয়। ঋণের ব্যাপারে একটি আরবী প্রবাদ আছে যে, همّ بالليل ومذلة بالنهار অর্থাৎ, ঋণের কারণে দুশ্চিন্তায় রাত্রের নিদ্রা হারাম হয়ে যায় এবং দিনে অপমান ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হয়।
আর এ হাল তো কেবল ঋণের। এবারে ঋণের সাথে তার সূদ যোগ হলে কত যে নাজেহাল হতে হয়, তা বলাই বাহুল্য। যে সূদ দিনের পর দিন বাড়তেই থাকে এবং কম হওয়ার কোন নামই নেয় না।
সূদে দু’টি মসীবত সমবেত হয়; এক তো ঋণের বোঝা আর দ্বিতীয় হল ঋণদাতার অনুগ্রহ-পদে দলিত হওয়া। আমরা বিশ্বব্যাংক এবং পাশ্চাত্যের ঋণদাতা দেশগুলোর আধিপত্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তি কি লক্ষ্য করছি না যে, কিভাবে তারা আমাদের রুজী-রুটী ও খাদ্যসম্ভারের উপর আধিপত্য জমিয়ে বসে আছে? এবং কিভাবে তারা আমাদের রাজনীতি, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও অর্থনীতির উপর তাদের শাসন-ক্ষমতা অব্যাহত রেখেছে?
[1]
(আল-মুআমালাতুল মাসরাফিয়্যাহ
৭৩পৃঃ)
[2] (সূরা বাকারাহ ১৭৩ আয়াত)
[3] (ফাওয়াইদুল বুনূক হিয়ার রিবাল হারাম, ডক্টর ইউসূফ কারযাবী ৩৫ পৃঃ)
৩- টাকা জমাকর্তাদের সহিত ব্যাংকের সম্পর্ক
ব্যাংকে যারা টাকা জমা রাখে, সে টাকা তারা ব্যাংকে ঋণস্বরূপ প্রদান করে, নাকি আমানতস্বরূপ গচ্ছিত রাখে তা প্রথমে নির্ধারণ হওয়া উচিত। এবারে আমানতস্বরূপ যে জিনিস রাখা হয়, তা চুরি হয়ে গেলে, পুড়ে গেলে বা কোন প্রকার নষ্ট হয়ে গেলে আমানতদার (যার কাছে আমানত রাখা হয় সে) এ জিনিসের জমানত বা দায়িত্ব নেয় না। তার জন্য সে গচ্ছিত (বিনিমেয়) জিনিস ফিরিয়ে দেওয়াও জরুরী নয়। তবে হ্যাঁ, সে যদি আমানতে খেয়ানত করে (নষ্ট করে) বা রক্ষণা-বেক্ষণে অবহেলা ও ত্রুটি প্রদর্শন করে, তাহলে কিন্তু সে এ জিনিসের যামিন হবে এবং তাকে তার খেসারত আদায় করতে হবে। আর এতে কোন দ্বিমত নেই যে, ব্যাংক জমাকর্তাদের টাকার যামিন থাকে। সুতরাং বুঝা গেল কোন অবস্থাতেই সে টাকা ব্যাংকের নিটক আমানতস্বরূপ নয়। আর যে ব্যক্তি যে জিনিসের যামিন হয়, সে তার লাভনোকসানের অধিকারীও হয়। কেননা নবী করীম (সাঃ) বলেন, الخراج بالضمان অর্থাৎ, যমানত নেওয়ার কারণেই ক্ষতিপুরণ (যামিনদারের দায়িত্ব)।[1]
পক্ষান্তরে যদি ব্যাংকের নিকট অলঙ্কার, সোনারূপা মণিমুক্তা বা জমি ইত্যাদির কাগজ-পত্র (লকে) রাখা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে উক্ত জিনিসগুলো আমানত গণ্য হবে এবং সে গুলোকে ঠিক যেরূপে রাখা হয়েছিল সেরূপেই আমানতকারীকে ফেরৎ দেওয়া ব্যাংকের জন্য জরুরী।
এতদ্ব্যতীত এ কথাও বলা যথার্থ নয় যে, ‘ব্যাংকে টাকা জমাকর্তা যে ব্যাংককে ঋণ দিচ্ছে---সে কথা ঘুণাক্ষরে আদৌ কল্পনা করে না। তাছাড়া ব্যাংক তো কোটি কোটি টাকার মালিক। অতএব তাকে ঋণ দেওয়ার কথা ধারণা বহির্ভূত। (আর ব্যাংক কারো নিকট ঋণ চাইতেও যায় না।)’ এরূপ বলা যথার্থ নয় এই জন্য যে, ঋণ দেওয়া-নেওয়ার শর্তাবলীতে কেবল ধনীরাই গরীবদেরকে ঋণ দেবে---এ কথা নেই। গরীব মানুষও ধনীকে ঋণ দিতে পারে। যেমন মুখাপেক্ষী মানুষ চির অমুখাপেক্ষী প্রতিপালক আল্লাহকে ঋণ দিয়ে থাকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللهَ
قَرْضاً حَسَناً﴾
অর্থাৎ, কে আছে যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে?[2]
এ ছাড়া ঋণ দেওয়া-নেওয়ার শর্তাবলীর পর্যায়ভুক্ত এ কথাও নয় যে, উভয় পক্ষকে ঋণ মনে করে অর্থ দিতে অথবা নিতে হবে। কারণ কখনো কখনো আমানতের মাল ঋণের রূপ পরিগ্রহ করে---যদিও মালের মালিকের ঋণ দেওয়ার নিয়ত থাকে না। যেমন, আমানতদার যখন আমানতের মালে তার নিজস্ব অধিকার প্রয়োগ (তাসার্রুফ) করবে---যেমন ব্যাংক করে থাকে, তখন এ আমানত ঋণরূপে পরিগণিত হয়ে যাবে এবং আমানতদারকে আমানতকারী (জমাকর্তার মালের ক্ষতি হলে) ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। অর্থাৎ আমানতের মাল তার ঘাড়ে ঋণের বোঝাস্বরূপ চেপে যাবে।
এ ক্ষেত্রে এ কথা বিবেচ্য নয় যে, আমানতদার আমানতকারীর অনুমতিক্রমে তার মালে নিজের অধিকার প্রয়োগ করেছে অথবা তার অনুমতি ছাড়াই কোন প্রকার ‘তাসার্রুফ’ করেছে? দৃষ্টান্ত স্বরূপ, যুবাইর (রাঃ) এর লেন-দেন-পদ্ধতি লক্ষণীয়; লোকেরা যখন তাঁর নিকট নিজেদের মাল আমানত রাখতে আসত, তখন তিনি সে মাল আমানত হিসাবে না নিয়ে ঋণ হিসাবে গ্রহণ করতেন। কারণ তিনি এই আশঙ্কা করতেন যে, যদি কোন প্রকারে সে মাল নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আমানতের অবস্থায় আমানতকারীরই নোকসান যাবে। পক্ষান্তরে ঋণ হিসাবে গ্রহণ করলে তাঁকে সে মাল অবশ্যই ফেরৎ দিতে হবে।
তাছাড়া এ কথাও সকলের বিদিত যে, ব্যাংকের সাথে লেনদেনকারীদের যে সম্পর্ক তা হল ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার সম্পর্ক। অর্থাৎ উভয়ের আদানপ্রদান ঋণদাতা ও গ্রহীতার মতই হয়ে থাকে। আর এ কথার সত্যতা ব্যাংকের সেই হিসাব-বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠে যা ব্যাংকের তরফ থেকে তার আমানতকারীদের নামে প্রত্যেক বছর প্রকাশ করা হয়। অথবা ব্যাংক সরকারের নিকট যে বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করে তাতেও এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায়।
[1]
(আবু দাঊদ ৩৫১০নং, নাসাঈ ২/২১৫, ইবনে মাজাহ ২২৪৩নং, হাকেম ২/১৫, আহমদ ৬/৪৯, দারাকুত্বনী
৩১১নং, ইবনে হিববান ১১২৫ নং)
[2] (সূরা বাকারাহ ২৪৫ আয়াত)
৪- ‘মুযারাবাহ’ (THE SPECULATION বা ঝুঁকিবিশিষ্ট অংশীদারী) ও ব্যাংকিং কারবার
ব্যাংকের সূদকে হালাল ও জায়েয নিরূপিত করার জন্য একটি বিস্ময়কর তথা অবান্তর কথা এও বলা হয়ে থাকে যে, ব্যাংকের কারবার শরীয়ত-অনুমোদিত মুযারাবাহ[1] (অংশীদারী) ব্যবসায় ও কারবারের মতই! অর্থাৎ ব্যাংক জমাকর্তাদের নিকট থেকে তাদের টাকা ‘মুযারাবাহ’ হিসাবে গ্রহণ করে। যে টাকার মালিক থাকে জমাকর্তা। অতঃপর ব্যাংক সে টাকার মালিক হয়ে অপরকে তা মুযারাবায় লাগানোর জন্য প্রদান করে। আর এ ক্ষেত্রে যাকে টাকা দেওয়া হয়, সে হয় ব্যাংকের মুযারিব (তার টাকায় ব্যবসাকারী)।
কিন্তু বাস্তবে এ ধারণা শরীয়ত অনুমোদিত মুযারাবাহ থেকে সম্পূর্ণম ভিন্ন। কেননা মুযারাবাহতে মুযারিব (ব্যবসাকারী) মালের আমানতদার হয়; দেনাদার (ঋণগ্রহীতা) হয় না। আর মাল তার মালিককে ফেরৎ দেওয়ার যমানত কেবল সেই ক্ষেত্রে আসে যখন মুযারিব (আমানতদার ব্যবসায়ী) সে মালে কোন প্রকার খেয়ানত, রক্ষণা-বেক্ষণে ত্রুটি ও অবহেলা অথবা তাতে কোন অসৎ অভিপ্রায় করে বসে। পক্ষান্তরে যখন মুযারাবাহতে মুযারিবের উপর মালের যমানত নেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয় তখন সে মুযারাবাহ শরীয়তসম্মত অবস্থায় থাকে না।
ব্যাংক যে জমাকর্তাদের জমা রাখা টাকার যমানতদার সে কথায় কারো দ্বিমত নেই। তাহলে ব্যাংক একই সাথে অর্থের আমানতদার এবং যমানতদার উভয়ই হওয়া কি প্রকারে সম্ভব? উপরন্তু শরীয়ত অনুমোদিত মুযারাবাহর এক বিধান এই যে, উভয় পক্ষকে লাভ-নোকসানে সমান হারে শরীক হতে হবে এবং কোন পক্ষ অপর পক্ষের হিসাবে নির্দিষ্ট মুনাফা অথবা নির্দিষ্ট মালের নিশ্চিত অধিকারী হতে পারবে না।
সুতরাং টাকার মালিক অথবা মুযারিব (ব্যবসাকারীর) তরফ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে নিশ্চিত অর্থ যমানত লাভ করা এ প্রকার মুযারাবাহকে বাতিল ও অবৈধ করে ফেলে। আর এ যমানতের শর্তারোপই উক্তপ্রকার কারবারকে হালাল থেকে হারামে পর্যবসিত করে দেয়। কেননা, ইসলামী মুযারাবাহতে এক পক্ষের অর্থ থাকে, আর দ্বিতীয় পক্ষের শ্রম, ব্যয় ও ঝুঁকি নেওয়ার ফলে মাল বৃদ্ধি পায়।
পক্ষান্তরে সূদী (ব্যাংকিং) কারবারে মালের মালিক মুনাফার নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের নিশ্চিত যমানত লাভ করে থাকে; যদিও সে তাতে কোন প্রকার শ্রম ও মেহনত ব্যয় না-ও করে।
রাফে’ বিন খাদীজ (রাঃ) বলেন,
كُنَّا أَكْثَرَ الأنْصَارِ حَقْلا ، فَكُنَّا نُكْرِى الأرْضَ على
أن لنا هذه ولهم هذه، فَرُبَّمَا أَخْرَجَتْ هَذِهِ وَلَمْ تُخْرِجْ هَذِهِ ،
فَنُهِينَا عَنْ ذَلِكَ.
অর্থাৎ, ‘আমরা আনসারগণের মধ্যে সবচেয়ে অধিক খেতের মালিক ছিলাম। (নিজে চাষ করতে না পারলে) আমরা তা ভাগচাষে অপরকে প্রদান করতাম। আর শর্ত এই হত যে, এই খেতের ফসল আমাদের হবে এবং এ খেতের ফসল ভাগীদারদের ভাগে হবে। এতে কখনো এক খেতে ফসল হত এবং অন্যটিতে হত না। এ দেখে নবী (সাঃ) এই ধরনের ভাগচাষ থেকে আমাদেরকে নিষেধ করলেন।’[2]
উপরোক্ত হাদীস থেকে বুঝা গেল যে, জমির মালিক ও ভাগচাষী উভয় পক্ষকেই জমির কোন একটা দিককে নির্দিষ্ট করে নিতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ কখনো কখনো এমনও হয় যে, এ নির্দিষ্টীকৃত দিক বা অংশ আপদমুক্ত থেকে ফসল অধিক প্রদান করে, আবার কখনো আপদগ্রস্ত হয়ে যথেষ্ট অথবা কিছুই প্রদান করে না। যার ফলে উভয় পক্ষের মধ্য হতে কোন এক পক্ষের নিশ্চিত লাভ এবং অপর পক্ষের নিশ্চিত ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। আর এই ধরনের একতরফা লাভ ও ক্ষতি ইসলামের ন্যায়পরায়ণ দৃষ্টিতে পছন্দনীয় নয়। ইসলামের ন্যায়-পরায়ণতা; যা নবী (সাঃ) উক্ত হাদীসে বর্ণনা করেছেন তা হল এই যে, ভাগচাষেও উভয় পক্ষ লাভ-নোকসানে সমানহারে ভাগীদার হবে।
প্রিয় পাঠক! এবারে আপনি ইনসাফের নজরে গভীর চিন্তা করে দেখুন যে, এও কি কোন যুক্তিসম্মত ও বিবেক-গ্রাহ্য কারবার, যাতে উভয় পক্ষের সমান অধিকারের দু’টি মানুষের মধ্যে এক জনের কখনো নোকসান হবে এবং কখনো লাভ, আর অপর জন কেবল লাভে লাভই সঞ্চয় করে যাবে?
এ ধরনের ইনসাফহীন কারবারকে কোন্ শরীয়ত ও কোন্ বিবেক মেনে নিতে পারে? পরন্তু এ কারবারে আশা বর্তমান থাকাও তার বৈধতার কোন প্রকার দলীল হতেই পারে না। কারণ এই শ্রেণীর আশাব্যঞ্জক লাভের সম্ভাবনা তো চাষীর জন্য ‘মুখাবারাহ’র ক্ষেত্রেও থাকে। এই আশায় সে এ ভাগচাষ করেও থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাদীসের স্পষ্ট উক্তি অনুযায়ী মুখাবারাহ অবৈধ।[3]
এর জন্য নবী (সাঃ) এর সতর্কবাণী রয়েছে; তিনি বলেন,
من لم يذر المخابرة فليأذن بحرب من الله ورسوله.
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি মুখাবারাহ ত্যাগ করে না, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা শুনে নিক্![4]
উল্লিখিত বর্ণনায় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মুখাবারাহকে সূদের একটি শ্রেণী নিরূপিত করে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। আর যেভাবে সূদখোরের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তদীয় রসূল (সাঃ) যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন ঠিক সেই ভাবেই মুখাবারাহকারীদের বিরুদ্ধেও রয়েছে যুদ্ধের ঘোষণা।
মুখাবারাহ হল এক প্রকার ভাগচাষ। এতে জমির মালিক ভাগচাষীকে এই চুক্তির উপর তার জমি চাষ করতে দেয় যে, চাষী মালিককে এ জমির ফসলের নির্দিষ্ট পরিমাণের ভাগ প্রদান করবে। মনে করুন, আপনার একটি জমি আছে। আপনি সেই জমিটি যায়েদকে এই চুক্তির উপর চাষ করতে সোপর্দ করলেন যে, সে আপনাকে এ জমির ফসলের নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ ভাগস্বরূপ প্রদান করবে। যেমন মনে করুন, প্রত্যেক ফসলের সময় আপনাকে ৫ মন দিতে বাধ্য থাকবে; তাতে সে জমির উৎপন্ন ফসল অধিক হোক অথবা মোটেই না হোক।
অথবা মনে করুন যে, যতটা ফসল পানির নালার ধারে-পাশে উৎপন্ন হবে, তা সে আপনাকে দেবে এবং বাকী সে (চাষী) নেবে। এ ধরনের ভাগচাষকে ‘মুখাবারাহ’ বলা হয়।
এবারে যদি আপনি ব্যাংকের কারবার নিয়ে একটু গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করে দেখেন, তাহলে এ কথা বুঝতে পারবেন যে, তা হুবহু মুখাবারাহ ভাগচাষের মতই কারবার; যা হারাম ও অবৈধ।
[1]
এর ব্যাখ্যা অংশিদারী কারবারে বিভিন্ন প্রকার ভেদ-এর ৫ নং দ্রষ্টব্য।
[2] (বুখারী ২৩২৭নং, মুসলিম ৩৯৩০নং, আবু দাঊদ ৩৩৯২নং, নাসাঈ ৩৯০৮নং, ইবনে মাজাহ ২৪৫৮নং)
[3] (মুসলিম, আবু দাঊদ ৩৪০৭নং)
[4](আবু দাঊদ ৩৪০৬নং, হাকেম ২/২৮৬ আর তিনি বলেন, হাদীসটি মুসলিমের শর্তে সহীহ) আল্লামা আলবানীর নিকট হাদীসটি যয়ীফ। দেখুন, যয়ীফ আবু দাঊদ ৭৩৯নং, সিলসিলাহ যয়ীফাহ ৯৯৩নং, যয়ীফ জামেউস সগীর ৫৮৪১নং) -অনুবাদক।
৫- রিবাল ফায্ল (একই শ্রেণীভুক্ত দুটি জিনিসের হাতে-হাতে বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাড়তি অংশ) ও ব্যাংকের সূদ
ব্যাংকের সূদকে হালাল ও জায়েয করার জন্য একটি যুক্তি এও পেশ করা হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তাআলা যখন সূদকে হারাম করেন, তখন প্রচলিত ছিল সোনা-চাঁদির মুদ্রা। অতএব সেই মুদ্রাতেই সূদ হারাম এবং অধুনা প্রচলিত কাগজের নোটে সূদ হারাম নয়। কেননা সূদ বিষয়ে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা কেবল কয়েকটি নির্দিষ্ট জিনিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর তা হল খেজুর, গম, যব, লবণ, সোনা ও চাঁদি (খাদহীন স্বচ্ছ রৌপ্য)। এগুলোর মধ্যে সোনা ও চাঁদিতে সূদ পাওয়া যায়---আর এর যুক্তিও নিতান্ত স্পষ্ট। কারণ, উভয় বস্ত্তই হল মূল্যবান ও উৎকৃষ্ট পদার্থ। যার নিজস্ব মূল্যমান আছে যদিও বা তা মুদ্রা ও টাকা-পয়সার মত ব্যবহার না করা হয়।
আরো অবাক হওয়ার কথা এই যে, অনেকে বলেছে, এই কাগজের নোটের মূল্যমান তার ক্রয়-ক্ষমতা হরাস পাওয়ার দরুন কমে যায়। আর এ রকম হয় মুদ্রাস্ফীতির সময়। অর্থাৎ টাকার মালিক ব্যাংক থেকে যে সূদ গ্রহণ করে, তা সে এ ঘাটতির বিনিময়ে গ্রহণ করে থাকে যা মুদ্রাস্ফীতির কারণে তার অর্থে আপতিত হয়। বরং কখনো কখনো ব্যাংকের এই সূদ মুদ্রাস্ফীতিজনিত এ ঘাটতি অপেক্ষাও কম পরিমাণের হয়ে থাকে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ব্যাংক ১০% সূদ দেয়, আর মুদ্রাস্ফীতির হার ১৫%। তাহলে এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, বাস্তবপক্ষে ব্যাংকে টাকা জমাকর্তা ৫% ক্ষতি ও নোকসানের শিকার হয়।
তর্কের খাতিরে যদি এ কথা মেনেও নেওয়া হয় যে, কেবলমাত্র সোনা-চাঁদির টাকাতেই যাকাত ফরয এবং সোনা-চাঁদীর মুদ্রাতেই সূদ জারী হয়, তাহলে তার মতলব এই দাঁড়ায় যে, কাগজের নোটে যাকাত নেই; যা ইসলামের তৃতীয় রুক্ন এবং কাগজের নোট বিনিময় করার ক্ষেত্রে সূদ নেওয়া-দেওয়া হালাল; অথচ তা শুধু হারামই নয় বরং সাতটি বিধ্বংসকারী বিষয়াবলীর অন্যতম।[1]
পরন্তু যুক্তিবাদীদের উক্ত যুক্তি মূলেই বাতিল। কেননা, বর্তমানে কাগজের নোটের মাধ্যমেই ক্রয়-বিক্রয় ও পণ্য বিনিময় হয়ে থাকে; বিবাহে মোহর দেওয়া হয়, এবং ভাড়া ও মজুরী আদায় করা হয় (যেমন সে কালে সোনাচাঁদির মুদ্রার মাধ্যমেই অনুরূপ আদান-প্রদান হত)। মোট কথা, এই নোটের উপরেই যাবতীয় শরয়ী প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়। আর এই নোট যার কাছে যত বেশী থাকে, সে তত বড় ধনবান বলে সমাজে পরিচিত।
বাকী থাকল মুদ্রাস্ফীতির কারণে মুদ্রামান তথা ক্রয়-ক্ষমতা হরাস ও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা; যা বাস্তব ও সত্য হলেও এ ক্ষেত্রে হক বলে বাতিল উদ্দেশ্য ও অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৮৮ সনে কুয়েতে অনুষ্ঠিত ইসলামী কন্ফারেন্সের ইসলামী ফিক্হ আলোচনা সভায় উক্ত বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এই আলোচনাচক্রে উলামাগণ দুই দলে বিভক্ত হয়ে যান; এক দলের মতে মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রামান কমে যাওয়া বিবেচ্য বিষয় নয়।
অতএব যদি নোট অবশিষ্ট এবং ক্রয়-বিক্রয় প্রচলিত থাকে, তাহলে সেই নোটই (ঋণে) ফেরৎ যোগ্য। অর্থাৎ যদি ডলার দিয়ে থাকে, তবে ডলারই ফেরৎ পাবে। টাকা নিয়ে থাকলে টাকাই ফেরৎ দিতে হবে; যদিও তার মুল্যমান এক শ’তে এক হাজার কমে যায়। উলামাদের এই দল কাগজের নোটকে প্রত্যেক বিষয়ে সে কালের সোনা-চাঁদির মুদ্রার স্থলাভিষিক্ত ও বিকল্প মনে করেন।
এঁদের দ্বিতীয় দল কাগজের নোটকে মৌলিকভাবে সোনা-চাuঁদর মুদ্রার মান দান করেন। কিন্তু সাধারণভাবে তার স্থলাভিষিক্ত মনে করেন না। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নোটকে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার বিকল্প মনে করেন; কিন্তু সর্বক্ষেত্রে তা মনে করেন না।
পক্ষান্তরে মুদ্রাস্ফীতিজনিত নোটের মূল্যমান কমা-বাড়া বিবেচ্য হলে তা সকল প্রকার লেনদেনেই হওয়া উচিত। সুতরাং আইন এই করে দেওয়া উচিত যে, ঋণগ্রহীতাকে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার অনুপাতে তার ঋণ পরিশোধ করতে হবে; আর সেই হার অনুসারে তার ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না, যে হার পাঁচ বছর পূর্বে ঋণ নেওয়ার সময় ছিল। কিন্তু এসব লেনদেনের ক্ষেত্রে লোকেরা মুদ্রাস্ফীতির কথা ভুলে থাকবে আর শুধুমাত্র ব্যাংকের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে তা স্মরণে ও খেয়ালে রাখবে--এমন কথা কি আশ্চর্যজনক নয়? সুতরাং আরোপিত সূদ অপেক্ষা মুদ্রাস্ফীতির হার বেশী হলে ব্যাংকের নিকটেও এ মুদ্রাস্ফীতিজনিত ঘাটতি পূরণ দাবী করা উচিত। কিন্তু তা কেউ করে কি?
এবারে আপনি ভেবে দেখুন যে, লোকেরা যখন ব্যাংকে টাকা জমা করবে অথবা অন্য কাউকে ঋণ দেবে, তখন মুদ্রাস্ফীতির কথা ও হিসাব মনে মনে রাখবে, অথচ যখন সে নিজে নেবে তখন ঋণগ্রহীতার ব্যাপারে তা ভুলে বসবে এটা কি ভুল ও অসৎ বাহানা নয়; যা সূদকে হালাল করার জন্য অবলম্বন করা হয়েছে?
বস্ত্ততঃ এ সমস্যা হল একটি মৌলিক সমস্যা। আর ব্যাংকের মৌলিক কারবার হল সূদী কারবার। অতএব যে কোন নোট, কারেন্সী, সোনা, চাঁদি অথবা অন্য কোন মালে যে অতিরিক্ত অংশ দেওয়া-নেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়, তা যে কোন অবস্থা ও যে কোন ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে সূদ বলেই গণ্য। এই জন্য এ ধরনের কৌশল বা বাহানার মাধ্যমে সূদ হালাল হতে পারে না; কারণ সত্য ও হক সূর্যবৎ স্পষ্ট।
[1]
(দেখুন, বুখারী ২৭৬৬নং, মুসলিম ৮৯নং)
অর্থ ও মুদ্রার মাঝে পার্থক্য
এখানে অর্থ ও মুদ্রার মাঝে পার্থক্য উল্লেখ করে দেওয়া আশা করি পাঠকের জন্য উপকারী হবে। অর্থ হল সেই জিনিস যার মাধ্যমে বিনিময় কর্ম, পরিমাণ-নির্ধারণ ও আর্থিকতার সংরক্ষণ হয়ে থাকে; কিন্তু একে আইনতঃ বাধ্যতামূলক বিনিময়-মাধ্যমরূপে চুড়ান্ত স্থিরীকৃত করা জরুরী নয়। যেমন চেক, প্রাইজ-বন্ড্ প্রভৃতি দস্তাবেজ ও প্রতিশ্রুতিপত্র দ্বারা লোকেরা পণ্য বিনিময় করে থাকে। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি তার প্রাইজ-বন্ড্ দ্বারা কোন মূল্য আদায় করতে চায় এবং প্রাপক তার প্রাপ্য অধিকার এ বন্ডের মাধ্যমে নিতে রাজী না হয়, তাহলে তাকে তা নেওয়ার জন্য আইনতঃ বাধ্য করা যেতে পারে না।
পক্ষান্তরে কারেন্সী বা মুদ্রা সেই অর্থের নাম, যাকে আইনগতভাবে অন্তর্দেশীয় বিনিময়-মাধ্যমরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন ডলার, টাকা প্রভৃতি কারেন্সীনোট। যদি কেউ টাকার মাধ্যমে কোন কিছুর মূল্য আদায় করে, তবে প্রাপককে তা নিতে আইনতঃ বাধ্য করা যাবে।
৬- চক্রবৃদ্ধিহারে সূদ ও ব্যাংকের সূদ
ব্যাংকের সূদকে বৈধ ও হালাল করার মানসে একটি সন্দিগ্ধ যুক্তি এও পেশ করা হয়ে থাকে যে, যে সূদকে কুরআন হারাম ঘোষণা করেছে তা হল কেবলমাত্র চক্রবৃদ্ধিহারে সূদ। অর্থাৎ অত্যন্ত অধিক পরিমাণের সূদ অথবা ক্রমবর্ধমান সূদের সূদ; যে সূদে সূদখোর অভাবী মানুষের অভাবকে সুযোগরূপে ব্যবহার করে তাকে শোষণ করে ছাড়ে। পক্ষান্তরে স্বল্প পরিমাণের সূদ; যেমন ৮% বা ১০% সূদে শোষণ পাওয়া যায় না। অতএব এমন স্বল্পাকারের সূদ কুরআনে ঘোষিত অবৈধতার পর্যায়ভুক্ত নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা সূরা আলে ইমরানের ১৩০ আয়াতে বলেন,
(﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا
تَأْكُلُوا الرِّبا أَضْعَافاً مُضَاعَفَةً وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ
تُفْلِحُونَ﴾
অর্থাৎ, হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সূদ ভক্ষণ করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর, তবেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে।
যাঁরা আরবী ভাষার বিভিন্ন পরিভাষা ও বাক্ধারা সম্পর্কে অবহিত এবং কুরআন মাজীদের বাগ্বৈশিষ্ট্য ও ভাবধারা সম্বন্ধে অবগত তাঁরা সকলেই জানেন যে, সূদের উক্ত (চক্রবৃদ্ধিহারে) বিশেষণ তার নিকৃষ্টতার যথারীতি প্রচার ও প্রসিদ্ধি তথা বাস্তব প্রেক্ষাপট তুলে ধারণ করার জন্য ব্যবহূত হয়েছে। নচেৎ উক্ত বিশেষণ সূদ হারামের জন্য কোন শর্ত নয়। অর্থাৎ সাধারণ সূদ হারাম হওয়ার ব্যাপারটা উক্ত গুণসাপেক্ষ নয়। কেননা, জাহেলিয়াত যুগের লোকেরা ব্যাপকভাবে ক্রমবর্ধমানহারে দ্বিগুণ-চতুর্গুণ সূদের সূদ নিয়ে যে চরম সীমায় পৌঁছেছিল তাকেই ‘চক্রবৃদ্ধিহার’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর এ ধরনের বাস্তবসূচক বিশেষণ উক্ত অবৈধতায় শর্ত হিসাবে বিবেচ্য নয়। অর্থাৎ তার অর্থ এই নয় যে, সূদ চক্রবৃদ্ধিহারে না হলে তা গ্রহণ করা বৈধ। তাছাড়া ঃ
﴿وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُؤُوسُ
أَمْوَالِكُمْ﴾
অর্থাৎ, যদি তোমরা তওবা কর, তাহলে তোমাদের মূলধন তোমাদের অধিকারভুক্ত।[1]
এই আয়াত হতে স্পষ্টাকারে এ কথাই বুঝা যায় যে, মূলধন ছাড়া অন্য কিছু ঋণদাতাদের অধিকারভুক্ত নয়, সুতরাং তা থেকে এক পয়সাও বেশী নেওয়া হারাম হবে।
এতদ্ব্যতীত কম ও বেশী নির্ধারণ করার কষ্টিপাথর কি? সেটা এমন কোন্ নিক্তি যে ১০%কে কম এবং ১২%কে বেশী বলে নিরূপণ করবে? আমরা যদি কুরআনের আয়াতের স্পষ্ট অর্থ গ্রহণ করি তাহলে দেখা যাবে, চক্রবৃদ্ধিহারে বলতে ৬০০% হচ্ছে। কেননা, উক্ত আয়াতে ‘আযআফ’ শব্দটি বহুবচন। আর বহুবচনের সর্বনিম্ন পরিমাণ হল তিন। এবারে ওকে দ্বিগুণ করলে ৬ হবে। অর্থাৎ ১০০ টাকায় ৬০০ টাকা সূদ হবে। তাহলে কোন জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি কি এ কথা বলতে পারে যে, সূদের এই বিরাট অংক অর্থাৎ ৬০০% হারে সূদ খাওয়াকেই আল্লাহ হারাম করেছেন এবং এর চেয়ে কম অংকের অর্থাৎ ৩০০% অথবা ৪০০% হারে সূদ খাওয়াকে জায়েয করেছেন?!
[1] (সূরা বাক্বারাহ ২৭৯)
ব্যাংকের সুদ কি হালাল - অনুচ্ছেদ ০১ থেকে ১০ পর্যন্ত, শাইখ মুশ্তাক আহমাদ কারীমী
ব্যাংকের সুদ কি হালাল - অনুচ্ছেদ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, শাইখ মোস্তাক আহমাদ কারীমী
ব্যাংকের সুদ কি হালাল - অনুচ্ছেদ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, শাইখ মোস্তাক আহমাদ কারীমী
ব্যাংকের সুদ কি হালাল - অনুচ্ছেদ ২১ থেকে ৩০ পর্যন্ত, শাইখ মোস্তাক আহমাদ কারীমী
ব্যাংকের সুদ কি হালাল - অনুচ্ছেদ ৪১ থেকে ৫০ পর্যন্ত, শাইখ মোস্তাক আহমাদ কারীমী
No comments